‘থামুন! এই এখানেই মৃত ব্যক্তিদের সাম্রাজ্য।’ প্রবেশপথে এভাবেই সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে। মাটির অনেক গভীরে, অর্থাৎ ২০ মিটার, মানে ৬৬ ফুট নিচে এক বিশাল সমাধিক্ষেত্র। হিমশীতল নিস্তব্ধতায় আর আলো-আঁধারিতে গা শিউরে ওঠা একেবারে ভুতুড়ে এক পাতালপুরী।
‘থামুন! এখানেই মৃত ব্যক্তিদের সাম্রাজ্য’—পাতালে সমাধিভূমিতে প্রবেশের প্রধান ফটক, ছবি: উইকিমিডিয়া
অথচ এই নীরব, নিথর বিশাল কবরখানার ওপরেই রয়েছে হাজারো মানুষের কোলাহল, নানা চাহিদায় জীবন-জীবিকার টানে দিগ্বিদিক ছুটে চলা নানা বর্ণ, জাত আর ধর্মের ব্যস্ত মানুষ। আলোকোজ্জ্বল ঝকঝকে বিপণিকেন্দ্রগুলোয় উপচে পড়া ভিড়। জনাকীর্ণ রাজপথে বাস, ট্রাম, ট্রেন, গাড়ির সারি। জীবন-সংসারে মান-অভিমান, প্রেম-ভালোবাসা আর সেই সঙ্গে দুঃখ-সুখের পিঠে ভর করা উচ্ছল–উজ্জ্বল এক প্রাণবন্ত জগৎ—পারফিউমের রোমান্টিক শহর প্যারিসে।
ফরাসিরা খানিকটা ছোট করে বলে ‘পারি’। আবার কেউ কেউ খানিকটা আবেগতাড়িত হয়ে এই জনপদকে পৃথিবীর ‘নাভি’ বলেও আখ্যা দিয়ে থাকে। কী নেই এই বিশাল নগরীতে? সব আছে। আছে হাজার বছরের জমজমাট ঐতিহ্য, ঘটনাবহুল ইতিহাস, বাহারি ফ্যাশনের চোখঝলসানো জৌলুশ, শিল্প-সাহিত্যের অতিরিক্ত চাকচিক্য, নান্দনিকতা। তারপরও মায়াবী এই শহরে রাত নামে। ৬৬ ফুট মাটির গভীর থেকে উঠে আসে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের ফিসফিস শব্দমালা। অতিমারি আর শীতের প্যারিসের আকাশ বিদীর্ণ করে সে শব্দ। শুনতে পাই, প্রিয় পারিতে গেলেই শুনতে পাই ভবিষ্যতের মৃত ব্যক্তিদের পূর্বপুরুষেরা কথা বলছে মাটির ৬৬ ফুট নিচ থেকে!
ক্যাটাকম্বস বা পাতালসমাধি প্রবেশের আগে দর্শনার্থীদের সারি, ছবি: উইকিমিডিয়া
আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ফ্রান্সের প্রথম রাজা প্রথম ক্লোভিস প্যারিসে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। সেই থেকে আজও এই নগরী ফ্রান্সের রাজধানী, অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। আজও এই মোনালিসার নগরী প্যারিস তার সব রহস্য উন্মোচন করেনি। এই নগরীর মাটির নিচে আছে আরেক জগৎ, অনেক সুড়ঙ্গপথ। এর দৈর্ঘ্য হবে সব মিলিয়ে এক হাজার কিলোমিটারেরও বেশি।
মাটির অনেক নিচে যেন এক সুবিশাল পাতালপুরী। নানা স্থাপনা, বিস্তীর্ণ গ্যালারি। পাতালে এমন অলিগলির শহর, নগর আরেকটি আছে বলে মনে হয় না। কত কাহিনি আছে এই মাটির নিচের অন্ধকার জগৎ নিয়ে। ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজারেবল’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র জঁ ভালজঁ সবার চোখকে ফাঁকি দিতে সেসব অন্ধকার সুড়ঙ্গপথকেই বেছে নিয়েছিল। সে কাহিনি অনেকেরই জানা। নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও অন্ধকার জগতের কিছু কিছু মানুষ এই পাতাল নগরীতেই বিচরণ করতে স্বচ্ছন্দবোধ করে।
সমাধিতে স্তূপাকারে সাজানো মানুষের দেহবিশেষ, ছবি: প্যারিস মিউজিয়াম
অনেকেই এই নগরীর ওপর দিয়ে হেঁটে, গাড়িতে চড়ে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করেছেন। তখন কি একবার ভেবে দেখেছেন যে আপনার পায়ের নিচেই আছে আরেক জগৎ, আরেক সুবিস্তীর্ণ পাতাল–শহর।
সবচেয়ে বড় চমক হচ্ছে এই নগরীর মাটির ৬৬ ফুট নিচে বিশাল এক সমাধিক্ষেত্র, লাখ লাখ কঙ্কালের এক নিস্তব্ধ নগরী। এখানে ৩০০ কিলোমিটারজুড়ে স্তূপাকারে জড়ো করা হয়েছে ৬০ লাখ মানবকঙ্কাল, ৬০ লাখ মানবসন্তানের মাথার খুলি, হাড়গোড় সব, যা কিনা এই নগরীর অধিবাসী জীবিত মানুষের চেয়েও তিন গুণ বেশি—ওজন করলে হবে এক লাখ টনেরও বেশি!
মাটির নিচে এমন সমাধিক্ষেত্রটির পত্তন হয় আঠারো শতকের দিকে। বিশেষ করে মহামারির কারণে তখন প্যারিসে মৃত ব্যক্তিদের সৎকারের স্থান এবং স্বাস্থ্য সংকট দেখা দেয়। ফলে পৌর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় শহরের বেশ কিছু সমাধিভূমি থেকে মানুষের দেহাবশেষ সরিয়ে নিয়ে শহর থেকে দূরে মাটির নিচে বিশাল এক প্রশস্ত স্থানে জমা করার। প্রথমবার ১৭৮৫ থেকে ১৭৮৭ এই সময়ে সে কাজই করা হয়। প্যারিসের ১৪টি উপশহরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবকঙ্কালের সমাবেশ ঘটে আর নামকরণ করা হয় ‘ক্যাটাকম্বস’ বা পাতালসমাধি।
সমাধিতে স্তূপাকারে সাজানো মানুষের দেহাবশেষ, ছবি: প্যারিস মিউজিয়াম
১৮০৯ থেকে মৃত নগরীটির দ্বার সর্বসাধারণের আংশিক উন্মুক্ত করা হয়। ৩০০ কিলোমিটারজুড়ে রাশি রাশি কঙ্কালের মধ্য দিয়ে সরু রাস্তায় পর্যটকেরা শুধু দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত পরিদর্শন করতে পারেন, এর বেশি নয়। এই পথটুকুতে উঁচু-নিচু মিলিয়ে ২৪৩ ধাপ সিঁড়ি আছে। গড় তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গরমেও সঙ্গে একটি গরম কাপড় রাখা ভালো। পর্যটকেরা যেটুকু পরিদর্শন করার সুযোগ পাচ্ছেন, সেটুকু হচ্ছে মাত্র ১ শতাংশের অর্ধেক। অন্যভাবে বলা যায় যে ৯৯ শতাংশের বেশি থেকে যাচ্ছে তাদের অদেখা।
এখানে অত্যন্ত দক্ষতায়, যত্নে এক বিশেষ কায়দায় এই বিপুল পরিমাণ কঙ্কাল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মৃত মানুষের কঙ্কালও যে এমন সজ্জার উপাদান, উপকরণ হতে পারে তা চিন্তাচেতনাকে আচ্ছন্ন করে। অনেকটাই কল্পনাকে ছাড়িয়ে যায়। এদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা নাম ছিল, ছিল পরিচয়। এখন সবাই কঙ্কাল। এখানে ধনী-দরিদ্র এককাতারে পাশাপাশি। জীবনের দীর্ঘ যাত্রার শেষে এখানে এসে জড়তে পরিণত হয়েছে। বর্ণ–ধর্মের রেষারেষি নেই, কাউকে টপকে যাওয়ার নেই প্রাণপাত, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, নেই কুটিল স্বার্থদ্বন্দ্বের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এখানে সবাই সমান, সব চাওয়া–পাওয়ার ঊর্ধ্বে তারা সবাই এখন অনন্তকালের অতল গহ্বরের বাসিন্দা।
দর্শকদের জন্য মাত্র দেড় কিলোমিটার উন্মুক্ত। এই পথটুকুতে উঁচু-নিচু মিলিয়ে ২৪৩ ধাপ সিঁড়ি আছে, ছবি: প্যারিস মিউজিয়াম
বর্তমানে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এ সমাধিভূমি আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। তা না হলে প্রতিবছর পৃথিবীর সব দেশ থেকে পাতালপুরীর এই মৃত মানুষের নগরী দেখতে আসে প্রায় পাঁচ লাখ পর্যটক। এখানে প্রবেশমূল্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ২৯ ইউরো। আর চার থেকে সতেরো বয়সের যারা, তাদের জন্য ৫ ইউরো। আরও কিছু বেশি দিলে মিলবে একটি যান্ত্রিক অডিও গাইড। তবে এ প্রবেশমূল্য অবস্থাভেদে হ্রাস করার ব্যবস্থা আছে। আগে থেকে অনলাইনে টিকিট নিয়ে রাখলে ভিড় এড়াতে সুবিধা হয়। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই পাতালপুরী। সোমবার এবং কিছু কিছু ছুটির দিন বন্ধ। প্যারিসের যেকোনো স্থান থেকে পাতালরেল মেট্রো করে ডেলফোর্ট স্টেশনে যেতে হবে। এখানেই আছে মৃত ব্যক্তিদের সাম্রাজ্যে প্রবেশের পথ।
হাজার হাজার বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে আজও উজ্জ্বল প্যারিস, ফরাসিদের প্রিয় পারি। এই নগরীর ওপরে আছে ২০ লাখ ভবিষ্যতের মৃত ব্যক্তির আবাস আর এর মাটির নিচে আশ্রয় নিয়েছে প্রাচীন জীবিত মানুষের ৬০ লাখ, মতভেদে ৭০ লাখ কঙ্কাল।