What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

মনীষী চরিতঃ আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর (2 Viewers)

arn43

Co-Admin
Staff member
Co-Admin
Joined
Mar 2, 2018
Threads
1,630
Messages
123,480
Credits
300,172
SanDisk Sansa
DVD
Whiskey
SanDisk Sansa
SanDisk Sansa
Computer
মনীষী চরিতঃ আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর

ভূমিকা :
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর (রহঃ) পাকিস্তানের একজন খ্যাতিমান আলেমে দ্বীন ও আহলেহাদীছ আন্দোলনের নির্ভীক মর্দে মুজাহিদ ছিলেন। ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তানে’র সাবেক সেক্রেটারী জেনারেল বিশ্ববরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব একাধারে অনলবর্ষী বাগ্মী, সংগঠক, কলমসৈনিক, শিকড়সন্ধানী গবেষক, ধর্মতাত্ত্বিক ও স্পষ্টবাদী রাজনীতিবিদ ছিলেন। পাকিস্তানে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার-প্রসারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষ করে আহলেহাদীছ যুবকদের মাঝে ইসলামের রূহ সঞ্চারে তাঁর আগ্রহ-আকাঙ্ক্ষা ও প্রচেষ্টা ছিল অতুলনীয়। কাদিয়ানী, শী‘আ, ব্রেলভী, বাহাইয়া, বাবিয়া প্রভৃতি ভ্রান্ত ফিরকার বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষুরধার লেখনী ছিল ‘নীরব টাইমবোমা’ সদৃশ। শাহাদত পিয়াসী আহলেহাদীছ আন্দোলনের এই নওজোয়ান সিপাহসালার ১৯৮৭ সালে লাহোরে এক বিশাল ইসলামী জালসায় বক্তৃতা রত অবস্থায় বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয়ে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেন। পাকিস্তানে আহলেহাদীছ আন্দোলনে গতিসঞ্চারকারী এই মনীষীর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে অত্র প্রবন্ধে আলোকপাত করা হ’ল।-
জন্ম :
১৯৪৫ সালের ৩১ মে বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের অন্তর্গত শিয়ালকোটের আহমদপুরা মহল্লায় এক ধার্মিক ব্যবসায়ী পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড় ছিলেন। তাঁর বাবা হাজী যহূর ইলাহী মুত্তাক্বী-পরহেযগার ও তাহাজ্জুদ গুযার ছিলেন।
(মিয়াঁ মুহাম্মাদ ইউসুফ সাজ্জাদ, ‘ইয়াদূ কীবারাত’, মুমতায ডাইজেস্ট, লাহোর, পাকিস্তান, ইহসান ইলাহী যহীর ও তাঁর শহীদ সাথীবর্গের স্মরণে বিশেষ সংখ্যা-২, অক্টোবর ’৮৭, পৃঃ ১১৬।)
 
শিক্ষাজীবন :
প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের জন্য তাঁকে প্রথমত দাহারওয়াল গ্রামের এম.বি প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করা হয়। প্রাইমারী স্কুলের পাঠ শেষে উঁচী মসজিদ বাজার পানসারিয়াতে কুরআন মাজীদ হিফয করার জন্য ভর্তি করা হয়। যহীর প্রচন্ড মেধাবী হওয়ায় মাত্র দেড় বছরে কুরআন মাজীদ মুখস্থ করেন। (মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৬। ) মাহবূব জাবেদকে দেয়া জীবনের সর্বশেষ সাক্ষাৎকারে নিজের বাল্যজীবন সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি শিয়ালকোটের এক ব্যবসায়ী খান্দানে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার বাবা যহূর ইলাহী ছালাত-ছিয়ামে অভ্যস্ত এবং ইসলামের প্রতি প্রচন্ড অনুরক্ত ছিলেন। উনি মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম শিয়ালকোটীর অত্যন্ত আস্থাভাজন ও ভক্ত ছিলেন। এজন্য তিনি বাল্যকালেই আমাকে কুরআনের হাফেয বানানো এবং ইসলামের খিদমত করার জন্য উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমি যখন প্রাইমারী স্কুলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই তখন আমার বাবা আমাকে কোন (মাধ্যমিক) স্কুলে ভর্তি করার পরিবর্তে কুরআন মাজীদ হিফয করার জন্য নিয়োজিত করেন। ঐ সময় আমার বয়স ছিল সাড়ে সাত বছর। আল-হামদুল্লিাহ, আমি নয় বছর বয়সে কুরআন মাজীদ মুখস্থ করি এবং হিফয সমাপনান্তেই রামাযান মাসে তারাবীহর ছালাত পড়াতে শুরু করে দেই’। (আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর সে আখেরী ইন্টারভিউ, সাক্ষাৎকার গ্রহণে : মাহবূব জাবেদ, মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, সেপ্টেম্বর ’৮৭, পৃঃ ৪২।) হিফয সম্পন্ন করার পর তাঁকে ‘দারুল উলূম শিহাবিয়াহ’ মাদরাসায় ভর্তি করা হয়। এরপর গুজরানওয়ালার বিখ্যাত মাদরাসা ‘জামে‘আ ইসলামিয়া’য় ভর্তি হন। এখানে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের খ্যাতিমান মুহাদ্দিছ, পঞ্চাশের অধিকবার বুখারীর দরস প্রদানকারী, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ (পশ্চিম) পাকিস্তানে’র সাবেক আমীর আল্লামা হাফেয মুহাম্মাদ গোন্দলবীর (১৮৯৭-১৯৮৫) কাছে হাদীছের দরস গ্রহণ করেন। (মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৬; w... wikipedia.org। ) আল্লামা যহীর বলেন, ‘এরপর আমার বাবা দ্বীনী জ্ঞান অর্জনের জন্য আমাকে বিভিন্ন মাদরাসায় ভর্তি করান। আমি গুজরানওয়ালার বিখ্যাত মাদরাসা জামে‘আ ইসলামিয়াতে দ্বীনী জ্ঞান অর্জনের নবযাত্রা আরম্ভ করি। প্রাথমিক বিষয়ে জ্ঞান লাভের পর ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী জ্ঞানের খ্যাতিমান শিক্ষক মাওলানা হাফেয মুহাম্মাদ গোন্দলবীর কাছে হাদীছের গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করি। মাওলানা হাফেয মুহাম্মাদ গোন্দলবী শুধু জমঈয়তে আহলেহাদীছের আমীরই ছিলেন না; বরং তিনি এ সম্মানও অর্জন করেছিলেন যে, পাক-ভারতের অধিকাংশ আহলেহাদীছ আলেম সরাসরি বা কোন না কোন মাধ্যমে তাঁর কাছ থেকে হাদীছের পাঠ গ্রহণ করেছেন। মাওলানা গোন্দলবীর কাছে হাদীছের গ্রন্থাবলী অধ্যয়নের পর ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের মানসে কিছুদিন (জামে‘আ সালাফিয়া) ফয়ছালাবাদেও ছিলাম। বিশেষ করে আমি ওখানে মাওলানা মুহাম্মাদ শরীফুল্লাহর কাছে মা‘কূলাতের গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করি। মাওলানা মুহাম্মাদ শরীফুল্লাহ ফতেহপুর সিক্রি থেকে হিজরত করে ফয়ছালাবাদে এসেছিলেন এবং মা‘কূলাতের বিষয়াবলী পড়ানোতে তাঁর পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি তাঁর কাছে দর্শন ও মানতিক (যুক্তিবিদ্যা) পড়েছি এবং এই দুই বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছি। ১৯৬০ সালে আমি শুধু ফারেগ হয়েছিলাম তাই নয়; বরং পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে আরবী সাহিত্যে বি.এ (অনার্স) ডিগ্রিও অর্জন করেছিলাম’। (মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪২-৪৩। )
 
ছয় বিষয়ে এম.এ ডিগ্রি অর্জন :
আল্লামা যহীর তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী ছিলেন। মাদরাসায় শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি তিনি ১৯৬০ সালে ফার্সী, ১৯৬১ সালে উর্দূ এবং ১৯৬২ সালে আরবী সাহিত্যে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি দর্শন, ইসলামিক স্টাডিজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। তাছাড়া করাচী ইউনিভার্সিটি থেকে এল.এল.বি ডিগ্রিও অর্জন করেন। এভাবে একজন মাদরাসা পড়ুয়া হয়েও ছয়টি বিষয়েএম.এ ডিগ্রি লাভের অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী হন। (মুহাম্মাদ আসলাম তাহের মুহাম্মাদী, ‘আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর শহীদ : এক হামাপা শাখছিয়াত’, মাসিক শাহাদত (উর্দূ), ইসলামাবাদ, পাকিস্তান, বর্ষ ১৫, সংখ্যা ৩, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৬, ১১৮, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৩; w... wikipedia.org. ) আল্লামা যহীর বলেন, ‘আমি এই মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছি যে, অল্প সময়ের ব্যবধানে এখন আমার নিকট ৬টি বিষয়ে এম.এ ডিগ্রি আছে এবং আমি এল.এল.বিও করে রেখেছি। দ্বীনী জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি আমি মসজিদ ও মাদরাসায় চাটাইয়ে বসে এসব ডিগ্রি অর্জন করেছি’। (মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৩। )
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি : জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন
আল্লামা যহীর ১৯৬০ সালে জামে‘আ সালাফিয়া (লায়েলপুর, ফয়ছালাবাদ, পাকিস্তান) থেকে ফারেগ হওয়ার পর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উদগ্র বাসনায় বাবা-মা ও শিক্ষকদের উৎসাহে ১৯৬৪ সালে দ্বিতীয় পাকিস্তানী ছাত্র হিসাবে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রথম পাকিস্তানী ছাত্র ছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ শরীফ আশরাফ, যিনি পরবর্তীতে ওখানকার প্রফেসর হিসাবে কর্মরত ছিলেন। এখানে ভর্তি হওয়ার পর ছয় মাসের মধ্যে যহীর আরবীতে কথা বলা, বক্তব্য দেয়া ও লেখার দক্ষতা অর্জন করেন। (মুহাম্মাদ খালেদ সাইফ, ‘মাতায়ে দ্বীন ও দানেশ জোলুট গায়ী’, মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১২৭; শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২। ) আল্লামা যহীর বলেন, ‘মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকালে আমি আরবী বলার দক্ষতা অর্জন করি। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমিই একমাত্র অনারব ছাত্র ছিলাম যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরব ছাত্রদের সাথে কোন প্রকার ইতস্ততঃ ছাড়াই আরবী বলত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন আরব ছাত্র একথা বলতে পারত না যে, সে আমার চেয়ে ভাল আরবী বুঝতে বা বলতে পারে। আমার প্রচুর আরবী কবিতা মুখস্থ ছিল এবং আমি কুরআন মাজীদের হাফেযও ছিলাম। এজন্য আরবী ভাষায় খুব সুন্দরভাবে কথা বলতে পারতাম’। (মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৩। ) মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যেসব শিক্ষকের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন- বিশ্ববরেণ্য মুহাদ্দিছ, মুহাক্কিক্ব শায়খ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (১৯১৪-১৯৯৯), সঊদী আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী, বিশ্ববিখ্যাত সালাফী বিদ্বান শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (১৩৩০-১৪২০ হিঃ/১৯৯৯), ‘আযওয়াউল বায়ান’ শীর্ষক তাফসীর গ্রন্থের রচয়িতা শায়খ মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানকীতী (১৩২০-১৩৯৩ হিঃ), শায়খ আব্দুল কাদের শায়বাতুল হামদ মিসরী, শায়খ আতিয়্যা মুহাম্মাদ সালিম, শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ প্রমুখ। (মুহাম্মাদ বাইয়ূমী, আল-ইমাম আল-আলবানী (কায়রো :দারুল গাদ আল-জাদীদ, ১ম প্রকাশ, ১৪২৭ হিঃ/২০০৬), পৃঃ ১৪৩; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষসংখ্যা-২, পৃঃ ১১৭। )১৯৬৭ সালে তিনি মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শরী‘আহ অনুষদ থেকে গ্রাজুয়েশন সমাপ্ত করেন। ফাইনাল পরীক্ষায় ৯৩ দশমিক ৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে ৯২টি দেশের ছাত্রদের মাঝে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। (শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৮, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৫, ১২৭।)
 
ফারেগ হওয়ার পূর্বেই মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট লাভ : একটি বিস্ময়কর ঘটনা
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আল্লামা যহীর ‘আল-কাদিয়ানিয়্যাহ : দিরাসাতুন ওয়াতাহলীল’ (القاديانيةدراساتوتحليل) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। মূলত এগুলো ছিল তাঁর ঐসব লেকচারের সমাহার, যেগুলো তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের প্রদান করতেন। কারণ তখন কাদিয়ানীদের ব্যাপারে আরব শিক্ষকদের জ্ঞান ছিল একেবারেই সীমিত। সেজন্য তিনি ধর্মতত্ত্ব ক্লাসে ছাত্রদেরকে এবিষয়ে লেকচার প্রদান করতেন এবং এগুলো সমৃদ্ধাকারে আরবী পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধাকারে প্রকাশ করতেন।
উক্ত গ্রন্থটি প্রকাশের সময় প্রকাশক যহীরকে বললেন, যদি লেখকের পরিচয়ে ‘মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র’র (طالبالجامعةالإسلاميةبالمدينةالمنورة)পরিবর্তে ‘মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় ফারেগ’ (خريجالجامعةالإسلاميةبالمدينةالمنورة) লেখা হয়, তাহ’লে এ বইয়ের গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাবে। আল্লামা যহীর বলেন, ‘আমি প্রকাশকের এই আগ্রহের কথা মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন) ভাইস চ্যান্সেলর আল্লামা আব্দুল আযীয বিন বায-এর কাছে ব্যক্ত করলাম। উনি বিষয়টি ইউনিভার্সিটির গভর্নিং বডির কাছে উপস্থাপন করলে আমার বইয়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে গভর্নিং বডি এই সিদ্ধান্ত নেন যে, আমার বইয়ে আমার নামের সাথে ‘মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় ফারেগ’ লেখার অনুমতি দেয়া যায় এবং আমাকে এই অনুমতি প্রদানও করা হ’ল। আমার প্রথম গৌরব এটা ছিল যে, আমি আমার ক্লাসে শিক্ষকদের পরিবর্তে ছাত্রদেরকে কাদিয়ানী মতবাদের উপর লেকচার প্রদান করেছি এবং আমার এই লেকচারসমগ্র বই আকারে আমার ছাত্র জীবনেই প্রকাশিত হয়েছে। আর আমার দ্বিতীয় গৌরব এটা ছিল যে, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উঁচু মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বেই আমাকে ‘ফারেগ’ সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়েছিল। আমার স্মরণ আছে, যখন আমাকে এই সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়েছিল তখন আমি ভাইসচ্যান্সেলর মহোদয়কে একদিন রসিকতা করে বলেছিলাম, ‘মাননীয় শায়খ! যদি আমি ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করি তাহলে এই সার্টিফিকেটের কী হবে’? ভাইস চ্যান্সেলর মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘যদি ইহসান ইলাহী যহীর ফেল করে তাহ’লে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ই বন্ধ করে দিব’। মূলত এটা আমার যোগ্যতা সম্পর্কে তাঁর আস্থার বহিঃপ্রকাশ ছিল এবং নিজেকে আমি এই আস্থার যোগ্য প্রমাণ করতে কখনো কার্পণ্য করিনি’। (মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৪-৪৫।)
 
কুয়েতের এক পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখন : সাহিত্য পুরস্কার লাভ
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি আরবী পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। এমনকি এ সময় তিনি একটি আরবী পত্রিকাও বের করেন। তিনি কুয়েতের একটি বহুল প্রচারিত আরবী পত্রিকায় ১৯৬৫ সালে ধর্মতত্ত্বের ওপর একটি প্রবন্ধ লিখে সাহিত্যাঙ্গনে হৈচৈ ফেলে দেন। পরবর্তীতে একই প্রবন্ধ অন্যান্য পত্রিকাও লুফে নেয়। ঐ প্রবন্ধের জন্য তিনি বিশেষ সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। (শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৭। )
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার প্রস্তাব :
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তাঁর প্রতিভার দ্যুতি ওখানকার আলেমগণ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। সেজন্য পাঠ চুকানো মাত্র ঐবিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার জন্য তাঁর নিকট প্রস্তাব পেশ করা হয়। কিন্তু তিনি সবিনয়ে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। এই সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ না করার কারণ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সম্ভবত আমার এই প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল যে, আমি দ্বীনের যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছি এবং যা কিছু আমার কাছে আছে তা দিয়ে আমার দেশের সেবা করব। স্বদেশবাসীর কাছে আমার জ্ঞান পৌঁছাব। এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ এবং অপরিসীম দেশপ্রেমের কারণেই আমি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যাওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ না করে পাকিস্তানে চলে এসেছি। কুরআন মাজীদের হুকুমও এই যে, একদল লোক এমন থাকা চাই যারা জ্ঞান অর্জন করে নিজের জাতির লোকদের কাছে ফিরে এসে নিজের অর্জিত জ্ঞান তাদের মাঝে বিতরণ করবে’। অন্য আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানে আমার ফিরে আসার একটা উদ্দেশ্য তো এটাও ছিল যে, আমি জমঈয়তে আহলে হাদীছকে সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করব। পাকিস্তানে আমার ফিরে আসার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানে ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠা। কারণ পাকিস্তান ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল’। (মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৬। )
 
সাংবাদিকতা ও প্রবন্ধ লিখন :
দেশে থাকা অবস্থাতেই তিনি বিভিন্ন উর্দূ পত্র-পত্রিকায় কাদিয়ানীদের সম্পর্কে অনেক প্রবন্ধ লিখেন। (ইহসান ইলাহী যহীর, আল-কাদিয়া নিয়্যাহ দিরাসাতুন ওয়া তাহলীল (রিয়াদ : কেন্দ্রীয় দারুল ইফতা, ১৪০৪ হিঃ/১৯৮৪ খৃঃ), পৃঃ ৯। ) দেশে ফিরে এসে তিনি ‘চাটান’, ‘লায়ল ওয়া নাহার’, ‘আক্বদাম’, ‘কোহেস্তান’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয়ে উর্দূতে প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। তিনি ‘মারকাযী জমঈয়তে আহলে হাদীছ পাকিস্তান’-এর মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘আল-ই‘তিছাম’, সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’ ও ‘আল-ইসলাম’-এর সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া ‘জমঈয়তে আহলে হাদীছ পাকিস্তানে’র মুখপত্র রূপে ‘তরজুমানুল হাদীছ’ নামে একটি মাসিক উর্দূ পত্রিকাও বের করেন। এ পত্রিকার তিনি প্রধান সম্পাদক রূপে দায়িত্ব পালন করেন। (আহমাদ শাকির, ‘আল-ই‘তিছাম কী চালীসবেঁ জিলদ কা আগায মাযী আওর হাল কী মুখতাছার সারগুযাশত’ (সম্পাদকীয়), সাপ্তাহিক ‘আল-ই‘তিছাম’, বর্ষ ৪০, সংখ্যা ১-২, ১-৮ জানুয়ারী ১৯৮৮, লাহোর, পাকিস্তান, পৃঃ ৪; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৮-১৯; বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৫, ১১৮; শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২। )
বাগ্মী হিসাবে আল্লামা যহীর :
বাল্যকাল থেকেই ইহসান ইলাহী যহীরের বক্তৃতার প্রতি ঝোঁক ছিল। অনলবর্ষী বাগ্মী হওয়ার স্বপ্নের জাল তিনি আশৈশব বুনতেন। এক সাক্ষাৎকারে এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বাল্যকাল থেকেই বক্তৃতার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। আমার ফুফা স্বাধীনচেতা এবং মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারী (রহঃ)-এর আস্থাভাজন ও ভক্ত ছিলেন। মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারীর বক্তৃতার কথা আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আলোচিত হ’ত এবং বাল্যকাল থেকেই আমার মনে এই আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছিল যে, আমিও বড় হয়ে বক্তা হব। এ দৃষ্টিকোণ থেকে মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারীর ব্যক্তিত্ব আমার জন্য অনুপ্রেরণা ছিল। আমি কুরআন মাজীদ মুখস্থ করে তারাবীহর ছালাত পড়াতে লাগি। এভাবে কুরআন মাজীদ তেলাওয়াতের মাধ্যমে আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে এবং বয়সও জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে আমার বক্তৃতা শিল্পও সুদৃঢ় হ’তে থাকে’। (মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৩। )
 
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে হজ্জের সময় ভারতীয় ও পাকিস্তানী হাজীদেরকে হজ্জের মাসআলা-মাসায়েল বর্ণনা করার জন্য মসজিদে নববীতে যহীরের জন্য ‘বাবুস সঊদ’ (সঊদ দরজা) নির্দিষ্ট ছিল। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে উর্দূতে বক্তৃতা দিতেন। একদিন মসজিদে নববীতে প্রচুর লোক সমাগম হয়। তিনি তাঁর নির্দিষ্ট স্থানে বক্তৃতা দেয়া শুরু করার পর লক্ষ্য করেন যে, তাঁর চতুর্স্পার্শ্বে ভারতীয় ও পাকিস্তানী হাজীরা ছাড়াও বহু সংখ্যক আরব হাজী অবস্থান করছেন। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে আরবীতে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। প্রথমে সামান্য বাধো বাধো ভাব হ’লেও দ্রুত তা দূর হয়ে যায় এবং অনুভব করেন যে, তিনি আরবী ভাষায় বক্তব্য দিতে সক্ষম। এরপর থেকে প্রত্যেক বছর হজ্জের মওসুমে আরবীতে বক্তৃতা দিতেন। (মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৩-৪৪।) ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের সময় মসজিদে নববীতে আক্রমণের আশংকা দেখা দিলে আল্লামা যহীরের তেজোদীপ্ত ঈমান তাঁর বাগ্মী সত্তাকে জাগিয়ে তুলে। ফলে তিনি সেখানে উপস্থিত লোকদেরকে উদ্দেশ্য করে অগ্নিঝরা বক্তৃতায় বলেন, ‘পৃথিবী সবসময় মদীনায় আগন্তুক কাফেলা গুলোর পদভারে মুখরিত হওয়ার খবর শুনত। আর আজ আমরা মদীনার রাস্তাঘাটে ইহুদীদের আক্রমণের খবর শুনছি’। একথা বলার সাথে সাথে উপস্থিত যুবক ও বৃদ্ধদের ‘আল-জিহাদ’ ‘আল-জিহাদ’ শ্লোগানে মসজিদে নববী প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। গোটা মদীনায় যেন প্রতিশোধের বহ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয়। (শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২-২৩।) মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তাঁর বিদ্যাবত্তা ও বক্তৃতার খ্যাতি দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে আসার পর তিনি ১৯৬৮ সালে লাহোরের ‘প্রাচীন ও প্রথম আহলে হাদীছ জামে মসজিদ’ বলে কথিত (মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলে হাদীছ আন্দোলন (পিএইচ.ডি থিসিস), পৃঃ ৩৮২। ) চীনাওয়ালী মসজিদের খতীব নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর আগুনঝরা জুম‘আর খুৎবা শোনার জন্য লাহোরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ মসজিদে লোকজনের ঢল নামত। (মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৮; শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২৩। ) ছাত্রজীবন থেকেই আল্লামা যহীর বক্তব্য দেয়া শুরু করলেও চীনাওয়ালী মসজিদের খতীব নিযুক্ত হওয়ার পর থেকেই মূলত তাঁর নিয়মতান্ত্রিক বক্তৃতার নবযাত্রা শুরু হয়। মাতৃভাষা পাঞ্জাবী হ’লেও তিনি সবসময় উর্দূতে বক্তৃতা দিতেন। দেশের যে প্রান্তেই বক্তৃতা দিতে যেতেন সেখানেই প্রচুর লোক সমাগম হ’ত। শ্রোতা সংখ্যা লাখ পর্যন্ত ঠেকত। মুক্বাল্লিদরাও তাঁর বক্তব্য শুনতে যেত। যেকোন বিষয়েই বক্তব্য দিয়ে বাজিমাত করতেন। অধিকাংশ মানুষ তাঁকে ‘সুরেশে ছানী’ (দ্বিতীয় সুরেশ) বলত। বক্তব্যের হক তিনি যথাযথ আদায় করতেন। কুরআন, হাদীছ থেকে দলীল এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর উদাহরণ পেশ করতেন। (প্রফেসর মুহাম্মাদ ইয়ামীন মুহাম্মাদী, ‘ইসলাম কা বেবাক সিপাহী, বেমেছাল মুছান্নিফ ইহসান ইলাহী’ মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১১৭।)
 
১৯৬৮ সালে আইয়ূব খানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও কেউ টুঁ শব্দটি করার দুঃসাহস রাখত না। করলেই জেলে পুরে নাস্তানুবাদ করা হ’ত। এমনইএক দুঃসন্ধিক্ষণে আল্লামা যহীর লাহোরে ঈদের মাঠে এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। এ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘১৯৬৮ সালের ঘটনা। আমি মূলত চীনাওয়ালী মসজিদের খতীবের পদে আসীন ছিলাম। সেই সময় ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল। ইকবাল পার্কে- যাকে মিন্টু পার্কও বলা হয়, চীনাওয়ালী মসজিদের খতীব হিসাবে ঈদের জামা‘আতে ইমামতি করার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। মাওলানা দাঊদ গযনবীর সময় থেকেই ইকবাল পার্কের ঈদের জামা‘আতকে লাহোরে ‘ঈদে আযাদগাঁ’ রূপে আখ্যা দেয়া হ’ত এবং এখানকার জামা‘আত লাহোরের কয়েকটি বড় ঈদের জামা‘আতের মধ্যে গণ্য হ’ত। ১৯৬৮ সালে যখন এই দেশের জনগণ ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ ছিল এবং তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল, তখন ঈদের কয়েকদিন পূর্বে মাওলানা ওবায়দুল্লাহ আনওয়ার (রহঃ)-এর বিরুদ্ধে পুলিশের উদ্ধত আচরণের কারণে লাহোর শহরে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও উত্তেজনা দানা বেঁধে উঠেছিল। লোকদের প্রত্যাশা ছিল, ঈদে আযাদগাঁর খুৎবায় আইয়ূব খানের সরকারকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্ত্ততে পরিণত করা হবে। এজন্য ঈদের পূর্বেই আমার কাছে প্রতিনিধি দল আসা শুরু হয়ে যায়। কিছু লোকের ধারণা ছিল, আমি রাজনীতিবিদ নই। সুতরাং আমি অনুমতি দিলে তারা ওখানকার খুৎবার জন্য এমন ব্যক্তিকে নিয়ে আসবেন যিনি ঐ ঈদের জামা‘আতের ইমামের মর্যাদা, ভাবমূর্তি ও সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখবেন। এ প্রেক্ষিতে আমি ঐ বন্ধুদের নিশ্চিন্ত থাকতে বলি। ঈদের খুৎবায় আমি যে বক্তব্য দিয়েছিলাম তাকে আমার প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্যও বলা যেতে পারে। আমার ঐ বক্তব্যের প্রভাব এতই গভীর ছিল যে, (বক্তব্যের পর) অনেক মানুষ আবেগের আতিশয্যে নিজেদের জামা ছিঁড়ে ফেলেছিল। আমার স্মরণ আছে, আগা সুরেশ কাশ্মীরীও ঈদের খুৎবার শ্রোতা ছিলেন। ঈদের ছালাতের পর আমাকে উনি মিয়াঁ আব্দুল আযীয বার এট ল-এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করেন, ‘আমি নিজেই বক্তৃতা শিল্পে অনেক দক্ষতা রাখি। কিন্তু আমি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলতে পারি, ইহসান ইলাহী! যদি তুমি ভবিষ্যতে বক্তৃতা দেয়া ছেড়েও দাও তাহ’লে তোমার এই এক বক্তৃতার দ্বারাই তোমাকে পাক-ভারতের কতিপয় বড় বক্তাদের মাঝে গণ্য করা যেতে পারে’। (মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫২।)
 
মিয়াঁ আব্দুল আযীয ঐ সময় বলেছিলেন, ‘যদি পাক-ভারতের বাগ্মীদের উল্লেখযোগ্য বক্তব্য গুলোকে একত্রিত করা হয় তাহ’লে এই বক্তব্যই শীর্ষস্থানে থাকবে’। (শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২৩।) ১৯৮৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার এশার ছালাতের পর ইকবাল রোর্ড শিয়ালকোটে অবস্থিত আহলে হাদীছ জামে মসজিদে ষষ্ঠ কুরআন ও হাদীছ মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে আল্লামা যহীর তাওহীদের উপর এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। মাসূনন খুৎবা ও আঊযুবিল্লাহ-বিসমিল্লাহ পাঠের পর কুরআন মাজীদের সূরা আ‘রাফের ১৫৮ নং আয়াত তেলাওয়াতের মাধ্যমে তিনি বক্তব্য শুরু করেন। এ বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমাদের নিকট জীবিত ব্যক্তিদেরকে ভয় করাও শিরক এবং মৃত ব্যক্তিদেরকে ভয় করাও শিরক। আমরা তাওহীদের তত্ত্বাবধায়ক আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেই ভয় করি না। আর যে ব্যক্তি নিজের মনের মধ্যে চিরস্থায়ী চিরঞ্জীবের ভয় স্থান দেয়, তিনি তাকে সৃষ্টিজগতের ভয় থেকে মুক্ত-স্বাধীন করে দেন। এই শিক্ষাই আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) দিয়েছেন’। তিনি আরো বলেন, ‘শুনুন! তাওহীদের সবচেয়ে বড় উপকারিতা এই যে, তাওহীদী আক্বীদা পোষণের পর মানুষ গায়রুল্লাহর ভয় থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে যায়। এরপর আর কাউকে ভয় করে না। কারণ তাওহীদপন্থীর এ দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হয় যে, لاَإِلَهَإِلاَّهُوَيُحْيِىْوَيُمِيْتُ ‘তিনি (আল্লাহ) ব্যতীত অন্য কোন (হক্ব) ইলাহ নেই। তিনিই জীবিত করেন এবং তিনিই মৃত্যু দান করেন’ (আ‘রাফ ১৫৮) মৃত্যুও তাঁর আয়ত্বাধীন এবং জীবনও তাঁর আয়ত্বাধীন। তিনি ব্যতীত কেউ মারতে পারেন না, কেউ জীবিত করতেও পারে না। যার বিশ্বাস এরূপ হবে সমগ্র সৃষ্টিজগত তার কিছুই করতে পারবে না’। এরপর আহলে হাদীছদেরকে সম্বোধন করে তিনি দরদমাখা কণ্ঠে বলেন,اهلحديثو! اللهكاتمپرانعامﮨﮯكهتمتوحيدوالوںكےگهرميںپيداﮨوئـےﮨو. تمهيںنهيںمعلومتوحيدكىقدركياﮨﮯ؟توحيدكىقدركسىسےپوچهنىﮨﮯتواسسےپوچهوجسكواللهنےبعدميںهدايتدىﮨﮯ.
‘আহলে হাদীছগণ! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ হ’ল তোমরা তাওহীদ পন্থীদের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছ। তাওহীদের মূল্য কি- তা তোমাদের জানা নেই? তাওহীদের মূল জানতে চাইলে ঐ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস কর যাকে আল্লাহ পরে হেদায়াত দান করেছেন’।اولوگو ! توحيدكىقدرپوچهنىﮨﮯتوانسےپوچهو،جوشرككىپستيوںسےنكلكرتوحيدكىبلنديوں پهآئے. اهلحديثو! كعبهكےربكىقسم،تمزندگىكىآخرىلمحاتتكاگرخداكاشكراداكرتےرﮨو،تواسكےكئےهوئےانعامكاشكرادانهيںكرسكتےكهاللهنےتمهيںاپنىتوحيدكاعلمبرداربناياهے.
‘ওহে লোক সকল! তাওহীদের মূল্য জানতে চাইলে ঐ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস কর যে শিরকের নীচুতা থেকে বের হয়ে তাওহীদের উচ্চতায় পৌঁছেছে। আহলে হাদীছগণ! কা‘বার প্রতিপালকের কসম! তোমরা যদি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে থাক তাহ’লেও তাঁর কৃত (এই) অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় করতে পারবে না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে স্বীয় তাওহীদের ধারক-বাহক বানিয়েছেন’। তিনি আরো বলেন, ‘আজ আমাদের দেশ, জাতি ও জনগণের যত অসুখ আছে সেগুলোর মূল হ’ল শিরক’।
(হাফেয হাফীযুল্লাহ, ‘শিয়ালকোট মেঁ শহীদে মিল্লাত হযরত আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীরকা আখেরী ইয়াদগার খেতাব’, মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ৩৮-৫২। )
 
আরবী ভাষাতেও আল্লামা যহীর চমৎকার বক্তৃতা দিতেন। যখন তিনি এ ভাষাতে বক্তব্য দিতেন তখন মনে হ’ত এটা তাঁর মাতৃভাষা। বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রে তিনি আরবীতে বক্তৃতা দিয়েছেন। আরবী ভাষার বড় বড় পন্ডিত তাঁর আরবী বক্তৃতা শুনে প্রভাবিত হয়েছে। একজন অনারবের মুখ থেকে বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় বক্তৃতা শুনে তারা বিস্ময়াভিভূত হয়ে যেত। মোদ্দাকথা, তিনি আরবী ও উর্দূ উভয় ভাষায় প্রথম সারির বক্তা ছিলেন। (মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১২২, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১১৭-১৮।) ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধলে তিনি মসজিদে নববীতে জিহাদের উপর এক জ্বালাময়ী বক্তব্য প্রদান করেন। তাঁর বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে ওখানে উপস্থিত আরব বিশ্বের খ্যাতিমান বাগমী, অশীতিপর আলেম, ‘আস-সুন্নাহ ওয়া মাকানাতুহা’ গ্রন্থের লেখক ড. মোস্তফা আস-সিবাঈ বক্তব্য শেষে তাঁর কপালে স্নেহ চুম্বন দিয়ে বলেছিলেন, أناخطيبالعربوأنتأخطبمنى. ‘আমি আরব বিশ্বের বড় বাগ্মী আর তুমি আমার চেয়েও বড় বাগ্মী’। (শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১২৮।)
মুবাল্লিগ হিসাবে যহীর :
আল্লামা যহীর একজন বড় মাপের মুবাল্লিগ ছিলেন। দ্বীনের তাবলীগের জন্য তিনি পাকিস্তানের শহর-নগর, গ্রাম-গঞ্জ সর্বত্র বক্তব্য দিয়েছেন। হাযার হাযার লোক তাঁর বক্তব্য শুনে প্রভাবিত হয়ে ইসলামের নিকটবর্তী হয়েছে। যারা বংশগতভাবে মুসলমান ছিল তারা আমলী মুসলমানে পরিণত হয়েছে। বহু লোক তাঁর বক্তব্য শুনে শিরক-বিদ‘আত ছেড়ে তাওহীদের আলোকোজ্জ্বল পথে ফিরে এসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন কনফারেন্সে তিনি পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। সঊদী আরব ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্র ছাড়াও তিনি বেলজিয়াম, হল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, স্পেন, ইতালী, ফ্রান্স, জার্মানী, ইংল্যান্ড, যুগোশ্লাভিয়া, ভিয়েনা, ঘানা, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ফিলিপাইন, হংকং, থাইল্যান্ড, আমেরিকা, চীন, ইরান, আফগানিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশে বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও কনফারেন্সে অংশগ্রহণের জন্য তাবলীগী সফর করেছেন। (মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১২০, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১১৮।)
 

Users who are viewing this thread

Back
Top