What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

কয়েকটি অপ্রকাশিত চটি গল্প (3 Viewers)

প্রথম ছবিটা এক রমনীর যে নগ্ন হয়ে নিদ্রারত। তারপরের ছবিটা দেখে যথারীতি মনে মনে ইউরেকা বলে চিৎকার করে উঠলাম। ঠিকই ভেবেছিলাম, ছবির ক্রমে একটি রহস্য আছে। দ্বিতীয় ছবিতে এক অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যক্তি বিছানায় শুয়ে, তার শয্যাসঙ্গিনী উলঙ্গ হয়ে মিলনের কামনায় আহুতি দিচ্ছে, কিন্তু এক বলশালী পুরুষ তাদের দিকে ধেয়ে আসছে।




তৃতীয় ছবিটার পর সমস্ত রহস্যটাই সমাধান করে ফেললাম। সেই কামুক রমনী ও বলশালী পুরুষ মিলনরত।



দ্রুত আমার চোখ চতুর্থ ছবিটিতে চলে গেলো। এক দুর্বল রাজাকে চারপাশ থেকে সবাই ঘিরে রেখেছে এবং তার নজর এড়িয়ে অন্য এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর শরীরে স্পর্শ করে চলেছে। ওহ, মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। ঠিক একইরকম ঘটনা কি আমার সাথে কিছুক্ষন আগে গাড়িতে ঘটেছে? রহস্যের পর রহস্য! এই ছবিগুলো কি এভাবে সাজানো শুধুই আমাকে কিছু ম্যাসেজ দেওয়ার জন্য। তার চেয়েও অস্বস্তিকর ব্যাপার হলো এই ঘরের মধ্যে রমা কিকরে অন্য এক পরপুরুষের সাথে থাকবে। আমি তো আমার বউকে চিনি, এমনি শান্তশিষ্ট, কোন অসুবিধে নেই, কিন্তু একবার হিট চড়ে গেলে সোনাগাছির বড়বড় ময়নাকেও হার মানিয়ে দেয়। ওর ভোদার ক্ষেতে প্রায় ১ সপ্তাহ কোন সার পড়েনি। আমি জানি অল্প একটু রোদের তাপেই ও চৌচির হয়ে যাবে।

 
ঘরের মধ্যে আর থাকতে পারছিলাম না। ক্ষনে ক্ষনে রমার উলঙ্গ দেহটা আর তার ওপর দিয়ে বয়ে চলা লতানে সাপের মত চিনুর জিভটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। রুমটা লক করে দিয়ে বাইরে বেরলাম। আমাদের উল্টোদিকেই বিশাল সাইজের একটা হল ঘর। এটাই অন্য কোন পার্টি বুক করেছে। যাইহোক আমি আবার রিসেপশনের দিকে হাঁটা লাগালাম। শালা এই মালটা কি ভূত? সত্যি বাংলোটা এতো রহস্যময় লাগছে যে অন্যকে ভূত ভাবাটা অস্বাভাবিক নয়। এতক্ষন মালটাকে দেখতে পাইনি, এখন দেখছি চেয়ারে বসে শান্তনু কি একটা পড়ে চলেছে। বোধ হয় আমার পায়ের শব্দ পেয়ে গেছিল, প্রায় ভূত দেখার মত বইটা নিমেষে ড্রয়ারের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। আমি ওর টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ‘বৌদিকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।’ মনে মনে বললাম ‘হ্যাঁ, তোরও ঝাঁট জ্বালানোর ইচ্ছে হচ্ছে।’ হলদে দাঁতগুলো বার করে হাসতে হাসতে বলে উঠল ‘বৌদিকে শাড়ি পড়েই বেশী ভালো লাগে।’ আমার শুনতে ভালো লাগছিলনা। আমি কোন উত্তর না দিয়েই নীচে নেমে দাঁড়ালাম। প্রায় ১৫ মিনিট হয়ে গেছে। রমা আর চিনুর কোন পাত্তা নেই।
বেশ কিছুক্ষন পর অনেক দূর থেকে দেখা গেলো চিনু আর রমা আসছে। রমাতো প্রায় হাসতে হাসতে চিনুর গায়ে লুটিয়েই পড়ছিল। আর আমার যে কি অবস্থা হচ্ছে, তা যদি কেউ বোঝে। মনে হচ্ছিল কেউ বুঝি আমার ঝাঁটে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আমার কাছাকাছি এসে রমা আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল ‘ওহ, বিপ্লব তুমি যদি আমায় আগে বলতে! তোমার এই কলিগটি যে কি পরিমান দুষ্টু তা কি তুমি জানো? জানো আমায় কি বলে; বলে কিনা চল বৌদি তোমার সাথে পরকীয়া করি।’
ওর কথা শেষ হতে না হতেই চিনু উত্তর দেয় ‘পরকীয়াতেই তো আসল মজা। কিছুই শেখাতে পড়াতে হয়না। সবই জানা থাকে।’
‘তবে রে দুষ্টু’ বলে রমা প্রায় লাফ দিয়ে ওর কানটা মুলতে যায়।
মনে মনে বলি ‘রমা, ওর চেয়ে অনেক বেশী দুষ্টু তো তোমায় মনে হচ্ছে।’
নিজেকে কিছুটা সেফ ডিস্ট্যান্সে রেখে চিনু বলে ‘দেখো বৌদি, বহু বিবাহিত মেয়ে আমি চড়িয়েছি, তাই জোর দিয়েই বলছি, হ্যান্ডসাম ছেলের প্রতি আকর্ষণ বিবাহিত মেয়েদের কুমারী মেয়ের চাইতে একটু বেশী হয়।’
রমার উত্তরটা যেন তৈরি ছিল ‘তুমি যাদের চড়িয়েছ তারা সব সাদামাটা, আমি হলাম রমা পোদ্দার, আমি আবার যাকে তাকে পাত্তা দিইনা।’
আর এরসাথে সাথেই চিনুর ঝাঁট জ্বালানো উত্তরটা এলো ‘এই তোমার বুড়ো বরের সামনে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ করছি, আজকের ২৪ টা ঘণ্টার মধ্যে যদি তোমায় পটাতে না পারি তবে আমি চিন্ময় নই।’
বানচোদ তোমরা আমার ঝাঁট জ্বালিয়ে যাবে আর আমি কি হরিনাম করব! কিছুটা গলাটা উঁচু করেই বললাম ‘এই চিনু, কি হচ্ছে এসব। বৌদি মায়ের...’ বানচোদটার কি সাহস, আমাকে কথাটা শেষই করতে দিলনা। ‘আচ্ছা আপনিই বলুন বিপ্লবদা। একই পুরুষের সাথে কোন মেয়েরই কি থাকতে ভালো লাগে? যদি বৌদি রনবীর কাপুরের সাথে প্রেম করার সুযোগ পেত? তুমি কি ভাবো বৌদি সুযোগ হাতছাড়া করত?’ আর সত্যি সহ্য হচ্ছিলনা। বাঁ হাতের তর্জনিটা কখন যে চিনুর দিকে চলে গেলো কি জানি। ‘মুখ সামলে কথা বল চিনু!’
এতক্ষন বাদে চিনুকে একটু সিরিয়াস দেখাল। আমার আঙ্গুলটা গায়ের জোরে নীচে নামিয়ে দিয়ে কিছুটা মেজাজ চড়িয়ে ও বলল ‘আঙুল তুলে কথা বলবেন না বিপ্লবদা। আর আপনি কি ভয় পাচ্ছেন নাকি!’
শালা বহু বছর হয়ে গেছে মারপিট করিনি। এরকম একটা শক্তসামর্থ্য জোয়ান মরদের সাথে মারপিট করে পারবো বলেও মনে হয়না। তবে রাগ প্রচণ্ড হচ্ছিল, এবং ভুঁড়িটা প্রচণ্ড জোরে ওঠানামাও করছিল।
‘আমার চ্যালেঞ্জটা তাহলে একসেপ্ট করুন। আমি আর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বৌদিকে পটিয়ে দেখাবো; আর আপনি আমায় বাধাও দেবেন না।’
এতো রাগ হচ্ছিল যে মুখ দিয়ে কথা পর্যন্ত বেরচ্ছিল না। রমাই মাঝে এলো। আমার দিকে একটা মুচকি হেসে বলল ‘ওহ, তুমিও না সত্যি। পটাবে বলেছে, পটিয়ে তো নেয়নি!’
শালা ঝাঁটটা আরও বেশী জ্বলে গেলো। রমার মুখে একটা অদ্ভুতরকমের হাসি। যেন ও চায় ওর জন্য আমরা ল্যাঙোট পড়ে কুস্তি লড়ি। যে জিতবে আজ রাতের জন্য রমা তার। না হয়ত চিনুকে তখন উত্তর দিতে পারিনি কিন্তু মনে মনে শপথ করলাম ‘চিনু, আমিও হাতিবাগানের বিপ্লব পোদ্দার। তুই রমার দুধে হাত দে, পাছায় হাত দে আমি কিছু বলব না। আমি শুধু দেখবো তুই কি করে রমাকে পটাস। শালা, স্পোর্টসম্যান স্পিরিট আমারও রয়েছে।’
আমরা ক্রমশ রুমের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম। মুডটা এমন খিঁচড়ে দিয়েছে যে ওই শান্তনু মালটা কি করছে তারদিকে নজর দিইনি। যতই সামনের দিকে এগোতে লাগলাম একটা ‘হিশহিশ’ করে শব্দ কানে আসতে লাগলো। জানিনা, এই লজটায় ভূত তুত আছে নাকি, তবে সবই রহস্যময়। রমা আর চিনু নিজেদের মধ্যেই মজায় আছে। শাহরুখ এখন বেশী দেখতে ভালো হয়েছে না আগে ছিল সেই নিয়ে গল্পে মত্ত ওরা। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার বলছিল কিছু একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার রয়েছে। আমি চলতে চলতেই পেছন ঘুরে দেখলাম। ওমা, একি শালা বঞ্চিত বানচোদ শান্তনু দেখি দাঁড়িয়ে গিয়ে নিজের বিচিগুলো প্যান্টের ওপর দিয়েই কচলে চলেছে আর ঠোঁট দুটো ফাঁক করে রমার নিটোল পাছার দিকে নিজের জিভটা তাক করেছে। বানচোদ, আমার বউকে দেখে হাত মারছিস? না থাক, ওর আর দোষ কি; চোদন খেয়ে খেয়ে রমা শরীরটা যা বানিয়েছে; ও আমার বউ না হলে আমিও হ্যান্ডেল মারতাম।
আমিই রুমের তালাটা খুলে দিলাম। এতক্ষন যে চিন্তাটা মাথায় আসেনি এখন যেন সেটাই আসতে শুরু করল। শালা, সেই বিকেল থেকে চিনু রমাকে সিডিউস করে চলেছে। রুমের মধ্যে যা নগ্নতা রমাই না আবার গরমকালের কুত্তির মত ল্যাংটো হয়ে যায়। ভেতরে ঢোকার পর তো রমা স্পিকটি নট। বড় বড় চোখ করে রমা শুধু দেওয়ালের ছবিগুলো দেখে চলেছে। আমার তো ভয়ে বুকটা ধুকপুক করছে আর বারবার রমার দিকে তাকাচ্ছি। হ্যাঁ, সত্যি যা ভেবেছি তাই। আমার দুধে আলতা গায়ের রঙের বউটার গালগুলো লজ্জায় একদম লাল হয়ে যাচ্ছে। ওহ, ভাগ্যিস চিনু জানেনা। এইসময় যদি বাইচান্স ও একবার রমার কানের লতিগুলো নিয়ে খেলা করতে করতে রমার ঘাড়ের কাছে হাতটা নিয়ে যায়! রমার বাবারও ক্ষমতা নেই, রমার হিট কমিয়ে দেবে। মনেমনে বিড়বিড় করে চলেছি ‘রমা চোখ নামাও, নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবেনা। চোখটা নামাও।’ আমার মনের কথা ও শুনতে পেলে তো?
‘তোর মাকে চুদি’ ওহ মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়েই যাচ্ছিল; যা কাণ্ড কারখানা ঘটছে। হারামিটা নিজের ডান হাতটা রমার কাঁধের ওপর রাখে, রমার শরীরটা থরথর করে কেঁপে ওঠে। আমি মনেমনে বলি ‘মাদারচোদ, তোর পায়ে পড়ি হাতটা কাঁধেই রাখ কানের দিকে নিয়ে যাবি না।’ মুখটা রমার কানের কাছে নিয়ে গিয়ে চিনু বলে ‘নুড পেন্টিং; এগুলো সত্যিই অসাধারন সৃষ্টি!’ রমা লজ্জায় চোখটা মাটিতে নামিয়ে দেয়। ‘দেখো, দেখো ওই ছবিটা দেখো। ও কি অসাধারন। সত্যি নারী শরীরের চেয়ে সুন্দর বোধ হয় কিছুই নেই!’ চিনুর চোখে চোখ রেখে কথা বলার ক্ষমতা রমা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। মাথাটা নিচু করেই উত্তর দেয়, ‘হুম’। খানকির ছেলের পোঁদে ঝেড়ে এক লাথ মারতে ইচ্ছে হচ্ছিল; শালা করে কি; রমার থুতনিটা আলতো করে ওপরে উঠিয়ে বলে ওঠে ‘আমিও কিন্তু ফটোগ্রাফার।’
‘কিন্তু রমা মডেল নয়।’ গাঁড় মেরেছে, মুখ ফস্কে তো কথাটা বেরিয়েই গেলো। রমা এক ঝলক আমার দিকে তাকিয়ে আবার মাটির দিকে তাকাল। ওহ শালা ন্যাকামো দেখলে গা জ্বলে যায়; এমন একটা কাণ্ড কারখানা যেন কিছুই বোঝেনা, গুদের মধ্যে কক্ষনো বাঁড়া ঢোকায়নি।
‘তাতে কি হয়েছে। রমাকে মডেল আমি বানাবো। ওর মধ্যে একটা কলাবউ লুক রয়েছে।’
রমা লজ্জায় হেসে বলে উঠল ‘আমার বয়েই গেছে মডেল হতে।’
শালা, সিডিউস করছে চিনু আর এই শীতকালে ঘামটা ঝরছে আমার। আর সত্যিই পারা যাচ্ছিলোনা। এই বাংলোটায় আসার পর থেকেই রমা যেন নিজের তন মন সবই চিনুকে দিয়ে দিয়েছে। এদিকে আমি যে প্রদোষ মিত্তিরের মত বেশ কিছু জিনিষ আবিস্কার করেছি তা আর কাউকে বলতে পারছিনা। রুমের মধ্যে ঢোকার পর দেওয়ালে খুব জোর হাতটা লেগে গেছিল। আওয়াজটা অদ্ভুতরকম ফাঁপা। যেন দেওয়াল নয়, কতগুলো পিচবোর্ড খাড়া করে রাখা আছে। এর চেয়েও অদ্ভুত রহস্য রয়েছে বাথরুমটায়। বাথরুমের তিনদিকের দেওয়ালে কাঁচের শেড দেওয়া, পেছনে দেওয়াল আছে না জাস্ট কাঁচ দিয়ে পার্টিশন তাই বুঝলাম না। আর এদিকে ঢ্যামনাটা আমার বউটাকে ক্রমাগত সিডিউস করে চলেছে। যাই হোক, চক্রব্যুহ থেকে রমা নিজেই নিজেকে বার করল।
‘তোমরা একটু এই ঘরটায় বস, আমি ড্রেসটা চেঞ্জ করে আসি।’ কথাটা শুনে চিনু একটু পিছিয়ে এলো। বুঝলাম গাভীটা এখন বিপদমুক্ত। বাল মুক্ত, বুঝতেই পারিনি যে বানচোদটা আরও বড় ফাঁদ পেতে রেখেছে। হঠাৎ চিনু বলে ওঠে ‘আমিও তোমার সাথে যাবো।’ দেখি রমা থমকে দাঁড়িয়েছে। এবার বোঝ বাঁড়া, মেয়েমানুষের স্যান্ডেল তো খাসনি। রমা পেছন ঘুরে অদ্ভুত ও রহস্যময় হাসির সাথে আমার উদ্দেশ্যে বলে ‘তোমায় বলছি। এটা তোমার দায়িত্ব। যেভাবে হোক তোমার এই অসভ্য কলিগটাকে আটকে রাখো এখানে।’ বলে কি মাগীটা। শালা আমায় কুস্তি লড়িয়েই ছাড়বে দেখছি। আর চিনুটাও ঠিক সেরকমই পিট ঢ্যামনা। বলে কি ‘আরে ধুর, বিপ্লবদার মত একটা ভুঁড়িওয়ালা লোক কিনা আমায় আটকে রাখবে?’ এতেই আমার ঝাঁট জ্বালানোর শেষ ছিলনা। রমার উত্তরটা আমারই উদ্দেশ্যে ছিল ‘বিপ্লব তোমায় কিন্তু দেখাতেই হবে যে তুমিও পারো। আমি সিওর ও ঠিক ওই ঘরে উঁকি মারবে।’ মনে মনে বউটাকে দুটো খিস্তি মারলাম আর ভাবলাম ‘কপাল করে তোমায় পেয়েছি রমা!’
রমা ভেতরে ঢুকে গেলো, চিনুও মাঝে দাঁড়িয়ে রইল আর আমি সবার শেষে। যদি চিনু এক পা বাড়ায় শালা একদম কবাডি খেলার ঢঙে ওর পা ধরে টান মারব। কিন্তু মনে প্রবল ভয়, যদি এই খেলায় আমি হেরে যাই তাহলে! মন বলছিল গায়ের জোরে কিছুতেই চিনুর সাথে পেরে উঠব না। হঠাৎ মোবাইলটা তারস্বরে বেজে উঠল। যাক ম্যাচটা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার একটা এক্সকিউস তো পেলাম। আমি একদম জেনটেলম্যানের মত গটগট করে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। আমি জানি চিনুর গাঁড়ে অতো দম নেই যে ও আমার বউকে ল্যাংটো দেখবে।
আরে এতো বিজয়দার ফোন। ফোনটা রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে ভেসে এলো বিজয়দার উদ্বিগ্ন একটা কণ্ঠ; আমিও বুঝলাম যতটা সম্ভব নিরিবিলি জায়গায় আমায় চলে যেতে হবে। হাতে ফোনটা নিয়ে আমিও এক্সিটের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। ‘হ্যাঁ, বিপ্লব বাবু, মন দিয়ে আমার কথা শুনুন। বিশেষ সোর্স থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী আপনাকে ইনফরম করছি। আজই আপনি জুলি ও শানের দেখা পাবেন। তবে ওরা আপনার কাছে ধরা দেবেনা। আপনাকেই ফাঁদ পেতে থাকতে হবে।’ সত্যি বলতে আমি একপ্রকার দ্বিধার মধ্যেই ছিলাম; বিজয়দাকে কি বিশ্বাস করা উচিত নাকি নয়। ‘হ্যাঁ, আপনি বলুন আমায় কি করতে হবে?’ আমার কথা শেষ হতে না হতেই বিজয়দা উত্তর দিলো ‘মোবাইলটা সবসময় হাতের কাছে রাখবেন। যেই মুহূর্তে আমি খবর পাবো আপনাকে একটা ম্যাসেজ করব। আপনি বেরিয়ে পড়বেন।’ আমার তো মটকা গরম হয়ে গেলো। আমিও বলে উঠলাম ‘আরে আমার ওয়াইফ ওখানে থাকবে আর আমি বেরিয়ে যাবো মানে?’ একটু মুচকি হেসে বিজয়দা উত্তর দিলেন ‘আপনি কি পুলিশকে ভেড়া ভাবেন? মধুকর ভিলায় এখনো অবধি আপনি যতজনকে দেখেছেন বা দেখবেন তাদের মধ্যে একজন পুলিশের এজেন্টও আছে। আরে মশাই নয়ত এতো ইনফরমেশন পাচ্ছি কোত্থেকে?’ আমার তো বিচি মাথায় উঠে গেলো। এখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি মোট দুজনকে; চিনু আর শান্তনু। এদের মধ্যে পুলিশের এজেন্ট কে? ‘আপনি তৈরি থাকবেন, যেই মুহূর্তে আমার ম্যাসেজ আপনার ফোনে যাবে বেরিয়ে পড়বেন। আপনার স্ত্রীর কোন ক্ষতি হবেনা।’ আমার কাছে বিজয়দার কথা মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোন পথও ছিলনা।
খেয়ালও করিনি; কখন কথা বলতে বলতে বাগানের মাঝখানটায় এসে গেছি। মাথার ঠিক পেছনেই একটা হ্যালোজেন লাইট। কিন্তু আমার সামনে দুটো ছায়া কেন? আরেকটা ছায়া কার? বিদ্যুতের বেগে পেছন ঘুরলাম। না কেউ তো নেই। আমার হচ্ছেটা কি? কেন এরকম গাটা ছম ছম করছে। হাঁটতে হাঁটতে আবার ভেতরের দিকে চলতে শুরু করলাম। এইদিকে আসার পথে শান্তনুকে দেখেছিলাম চেয়ারে বসে থাকতে। অথচ এখন ও নেই। সত্যিই খুব রহস্যজনক এই শান্তনু। কোথায় থাকে কি করে কিছুই বুঝতে পারিনা। যাই হোক আমি আমার রুমের দিকে চলতে লাগলাম। একটা বাঁক নিয়েই রুমের মুখোমুখি। রুমের সামনে আসতেই আমার মাথা খারাপ হয়ে গেলো। প্রথমত রুমটা যে ভেতর থেকে লক করা তা ভালোই বোঝা যাচ্ছে এবং এর চেয়েও ভয়ঙ্কর যা তা হল, ঠিক দরজার ওপর নিজের মাথাটা রেখে শান্তনু দাঁড়িয়ে আছে। ওকি ভেতরে কি হচ্ছে তা শোনার ও বোঝার চেষ্টা করছে? আমি অনেকটা দূরে ছিলাম, তাই ঠিক করে বুঝতে পারলাম না। গুটি গুটি পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলাম।
শান্তনুর ঠিক ২-৩ হাত পেছনে একটা মোটা থাম আছে। ওখানে অনায়াসে নিজেকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব। বিড়ালের মত করে ধীরে ধীরে থামটার দিকে যেতে শুরু করলাম। বাই চান্স যদি শান্তনু পেছন ঘোরে অবশ্যই আমাকে দেখে ফেলবে। বুকটা ধুকপুক করছিল তাও আমি এগিয়ে চলতে লাগলাম। অবশেষে আমি সফল। নিজের শরীরটা সম্পূর্ণ থামের পেছনে লুকিয়ে শুধু মাত্র চোখদুটো বাইরে বার করলাম। এই মুহূর্তে আমি অনেকটাই শান্তনুর কাছাকাছি। আগে যা বুঝতে পারছিলাম না এখন তাই বুঝতে পারলাম। শান্তনুর প্যান্টের জিপটা খোলা আর তার থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে প্রকাণ্ড এক কালো সাপ। পাশবিক শক্তিতে ও নিজের বাঁড়ার সামনের মাংসপিণ্ড আগুপিছু করে চলেছে। শান্তনুর কার্যকলাপের চেয়েও বেশী আশঙ্কার ছিল ভেতরে কি হচ্ছে তা। একজন মানুষ নিশ্চয়ই একটা মেয়ে মানুষের কণ্ঠ শুনে মুঠ মারতে পারেনা। তাহলে কি, চিনু আমার মাথামোটা বউটাকে? না নিজের মনটাকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এতো সহজে রমা কারুর হাতে নিজেকে সঁপে দিতে পারেনা।
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, শান্তনু নিজের শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া বাঁড়াটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। মালিশ করার ভঙ্গীতে নিজের ধন বাবাজীকে শান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমি বুঝলাম, কিছু একটা হতে চলেছে। প্রায় মিনিট দুয়েক পর মাথাটা দরজাতেই স্পর্শ করা অবস্থায় শান্তনু বেশ জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা মারতে শুরু করে। লক খোলার একটা আওয়াজ হয়। আমিও সজাগ হয়ে যাই। দরজাটা বেশ কিছুটা ফাঁক হয় এবং চিনুর মুখটা বেরিয়ে আসে। সবচেয়ে অদ্ভুত লাগে, শান্তনু নিজের মাথাটা দরজার ওপর থেকে ওঠায় না। প্রায় একই ভঙ্গীতে থেকে বলে ওঠে ‘লন্ড্রি’ সাথে মুখে একটা অদ্ভুত হাসি। চিনুও একইরকম একটা হাসি ফেরত দেয়। এতটুকু বুঝে গেলাম চিনু ও শান্তনু পূর্ব পরিচিত। দরজাটা ছেড়ে দিয়ে চিনু আবার ভেতরে ঢুকে যায়। আলতো করে চাপ দিতে দিতে শান্তনু দরজাটা অনেকটাই খুলে ফেলে। এতে অবশ্য আমারই ভালো হল। বাইরের ঘরটা পুরো ফাঁকা। এতটুকু বুঝলাম রমা ভেতরের ঘরে ছিল। পলকহীন দৃষ্টিতে আমিও ভেতরের দিকে তাকিয়ে থাকি।
ওহ, সাথে চিনু থাকবে জানলে কি এই নাইটিটা রমাকে কখনো কিনতে দিতাম। এটা নাইটি তো নয়, ছোট্ট মেয়েদের টেপ খানিকটা। সাদা ধবধবে একটা নাইটি, কাঁধের ওপর পাতলা সুতোর মত একটা স্ট্র্যাপ যা বগলের কাছে বিশাল একটা ফাঁকা স্থান তৈরি করেছে, বুকটা প্রায় ভি কাট। রমার প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে ওই টেপের মধ্যে থেকে বিশাল মাইদুটো লাফিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে আসছে। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম শান্তনুর চোখদুটো লং জাম্প করা ওই ৩৬ সাইজের দুটো দুধের দিকে। মুখটা অনেকটা হাঁ করে শান্তনু ওইদিকেই তাকিয়ে আছে। রমার চোখও শান্তনুরই দিকে। শান্তনুর এই ইতর দৃষ্টিকে ও প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছে, উপভোগ করছে ও তার সাথে সাথে ওই ৩৬ সাইজের দুধ দুটো আরও বেশী করে লং জাম্প দিয়ে উঠছে। বগল ও গুদ কামানোর অভ্যাস রমার বহুদিনের। টেপটার ফোকর দিয়ে কামানো বগলের ছোট ছোট রোমগুলো যেন শান্তনুকে পাগল করে দিচ্ছে। অবশেষে রমা একদম শান্তনুর সামনে, হাতে সেই কালো সেক্সি ফ্রকটা। শান্তনুর হাতটা আগেই বাড়ানো ছিল, কিছুটা ওপর থেকে রমা শুধু নোংরা কাপড়গুলো ওর হাতের তালুতে রেখে দিলো। জানিনা এটা ইচ্ছাকৃত কিনা, কিন্তু হাত ফস্কে মেয়েদের সবচেয়ে লজ্জার দুই অন্তর্বাস ব্রা ও প্যানটি মাটিতে পড়ল। শান্তনুর দুচোখ একবার নীচে পড়ে থাকা ওই সাদা ব্রা, কালো প্যানটির দিকে ও একবার রমার মুখের দিকে। রমা যেন নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে; ‘এ কি হল; যে খোলসটার মধ্যে আমি আমার নারীত্বকে লুকিয়ে রাখি তাই কিনা এক সাধারন ওয়াচম্যানের চোখে পড়ে গেলো!’ শান্তনু কিছুটা নিচু হয়ে ব্রা ও প্যানটি স্পর্শ করল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সেগুলো না কুড়িয়ে মেঝের ওপরই নিজের নোংরা আঙুলগুলো দিয়ে রগড়াতে রগড়াতে রমার মুখের দিকে তাকাল। রমার মুখে যেন একরাশ ঘেন্না। হঠাতই রমা দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
শান্তনুর কোন হেলদোল নেই। ওইভাবেই মাটিতে ঝুঁকে থাকা অবস্থায় ও ব্রা আর প্যানটিটা চটকাতে থাকে। সাথে নাসারন্ধ্র দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ। যেন কোন কুকুর এক টুকরো মাংস পেয়েছে। বেশ কিছু হলিউড মুভিতে এরকম সেক্স সাইকো আমি দেখেছিলাম, কিন্তু স্বচক্ষে এই প্রথম দেখলাম। কেন জানিনা আমার মন বলছিল, শান্তনু একা নয় আরোও একজন আছে যে ক্রমাগত আমায় ফলো করছে; যার ছায়া আমি কিছুক্ষন আগে দেখেছিলাম। কেন জানিনা মন বলছে এই বাংলোতে ৪ জন নয় ৫ জন আছে এবং সে আমাদের দেখতে পাচ্ছে। আকস্মিক একটা ফিসফিস করা কণ্ঠে আমার রোম খাড়া হয়ে গেলো। ‘এই আমায়ও দে, দে বলছি।’ অদ্ভুত একটা জড়ানো গলা হলেও আমি এই কণ্ঠ এর আগেও শুনেছি কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না কে সে? কোথায় লুকিয়ে রয়েছে। কেন আমি তাকে দেখতে পাচ্ছিনা। অথচ সে সবই দেখতে পাচ্ছে। শান্তনু ততক্ষনে নিজের নোংরা জিভটা বার করে ব্রায়ের কাপগুলোর মধ্যে জিভ ঢুকিয়ে দিয়েছে আর আরেক হাতে প্যানটিটা খুব করে চটকে চলেছে। আবার সেই ধরা মেয়েলি গলায় আওয়াজ ‘এই এদিকেও দে না! দে আমায়ও দে!’ আমি নিজের কান ও চোখকে প্রচণ্ড সজাগ রাখলাম। আমাদের রুমের পাশেই একটা দেওয়াল আলমারি সেটা থেকে ঠক ঠক করে আওয়াজ আসছিল। আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম।
প্রায় শিউরে ওঠার মত অবস্থা। একটা হাত আলমারি থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। অত্যন্ত রোমশ একটা হাত। একটা অতি পরিচিত রিষ্ট ওয়াচ। এই ঘড়িটা আমি কারুর হাতে দেখেছি। কিন্তু কে সে? একি আদৌ মানুষ নাকি? শান্তনুর মুখে কিছুটা বিকৃতি এলো। যেন কুকুরের মুখ থেকে কেউ হাড় কেড়ে নিল। আস্তে আস্তে হাত দুটো আরও শান্তনুর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। কিছুটা হতাশার সুরে শান্তনু নিজের অধিকার সেই রোমশ হাতে তুলে দিলো। আমার মাথায় তখন হাজারো বিক্রিয়া চলছে। কে এ? আর এই দেওয়াল আলমারিতে কিই বা রহস্য লুকিয়ে আছে?
 
১২

দেওয়াল আলমারিটা আবার নিজের থেকেই বন্ধ হয়ে গেলো। আমার সামনে এই মুহূর্তে বেশ কয়েকটা রহস্য। ওই আলমারির মধ্যে কি রয়েছে? কেন শান্তনু দরজায় কান লাগিয়ে হস্তমৈথুন করছিল? রমা কি নিজেকে ওই সমর্থ যুবকের কাছে সঁপে দিয়েছে? সবার আগে আমায় নিজের রুমে একবার প্রবেশ করতে হবে। দরজায় গিয়ে ঠক ঠক করে একটা আওয়াজ করলাম। ভেতর থেকে কোন শব্দ নেই। আবার একবার শব্দ করতেই রমা এসে দরজাটা খুলে দিলো। আমায় দেখে কিছুটা নাক কুঁচকে রমা বলে উঠল ‘একি, এতক্ষন কোথায় ছিলে?’ আমার মুখে কোন উত্তর নেই! চোখদুটো শুধুই রমার পরনের পাতলা টেপটাকে দেখে যাচ্ছে। আমার চোখের চাহুনি রমা চেনে। তাই ওই বলে উঠল ‘কি গো কেমন লাগছে আমায়?’ কোন উত্তর দেওয়ার মত অবস্থায় আমি ছিলাম না। ভেতরের রুমটা থেকে চিনুর গলা ভেসে এলো; ‘কি গো বৌদি কোথায় গেলে? আসো এখানে।’ এতক্ষনে রমার মুখের সেই দুষ্টু মিষ্টি হাসিটা মিলিয়ে গেছে। তার বদলে নেমে এসেছে একরাশ দুশ্চিন্তা। দেখি মৃদুমন্দ গতিতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে চিনু। পরনে একটা শুধুই পায়জামা, ঊর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ অনাবৃত। দুই হাতের বাই শেপসগুলো এটাই প্রমান করছে যে নিয়মিত জিমে যাওয়ার অভ্যাস ওর রয়েছে। দুই বুকের মাঝে ও পেটের অনুভুমিক খাঁজগুলো দেখে যে কেউ বলে দেবে যে চিনু জিমের ব্যাপারে ঠিক কতটা সচেতন। তাহলে কি এতক্ষন? মস্তিস্কে রক্তক্ষরনের সাথে সাথে আমার নিম্নাঙ্গেও কম্পন শুরু হলো। আমি তো কয়েকটা দিন আগেই এরকম একটা চটি পড়েছি। স্বামী স্ত্রী ও পেয়িং গেস্ট। যেন সেই গল্পটাই আমার জীবনে বাস্তবের রূপ নিচ্ছে। চিনু কি আমার পিঠমোড়া করে খাটের পাশে ফেলে রেখে রমাকে চুদবে নাকি আমার চোখের আড়ালে? এইসব ভাবতে ভাবতেই দেখি চিনুর দুই ঠোঁট ফাঁক হয়ে দুপাশের গজ দাঁতগুলো বাইরে বেরিয়ে এলো। মনে মনে বললাম ‘হ্যাঁ, তুই প্রথম রাউন্ডে জিতে গেছিস।’ ওমা, একি; বানচোদটা রমার খোলা নগ্ন কাঁধের ওপর নিজের দুহাত রেখে ভালো করে মালিশ করতে লাগলো। রমার দুচোখ বারবার আমায় নীরিক্ষন করছে; যেন বুঝে নিতে চায় আমি কিছু বুঝতে পারছি কিনা। ধীরে ধীরে রমার দুচোখ আবার আগের মত ঘোলাটে হয়ে যায়। ও যেন নিজের সাথেই লড়াই করছে আর দাঁত চিপে নিজেকে বোঝাচ্ছে না কিছুতেই আমি বিপ্লবকে বুঝতে দেবনা যে আমার প্রচণ্ড হিট চড়ে গেছে।
একজন সাধারন বুদ্ধির নারীর যা করা উচিত; রমা ঠিক তাই করল। ওখানে ওভাবে দুই পুরুষের মাঝে আবদ্ধ না থেকে গুটিগুটি পায়ে ভেতরের দিকে চলতে শুরু করল। ছোটবেলায় বন্ধুর কাঁধে হাত দিয়ে যেভাবে আমরা রাস্তায় হাঁটতাম ঠিক সেইভাবেই চিনুও রমার কাঁধের ওপর নিজের হাতটা চাপিয়ে ভেতরে যেতে শুরু করল। আমি একটা বোকা ভেড়ার মত ওখানে দাঁড়িয়েই সব দেখতে লাগলাম। মনে মনে নিজেকে বোঝালাম ‘না, চিনু শুধুই সিডিউস করার চেষ্টা করবে; কিন্তু আমার বউ কখনো সেই আগুনে ঝাঁপ দেবেনা।’ বাইরের খাটটায় বসে আমি কান পেতে ভেতরের কথাবার্তা শুনতে থাকলাম। ‘ঋত্বিকের মত হ্যান্ডসাম বলিউডে আর অন্য কেউ নয়।’ কথা প্রসঙ্গে এই লাইনটা আমার প্রচণ্ড কানে লাগলো। তাহলে কি রমার একটু লম্বা চওড়া পেশীবহুল পুরুষ বেশী পছন্দ। ‘তোমার জন আব্রাহামকে কেমন লাগে?’ চিনুর প্রশ্নটা অতটা ঝাঁট জ্বালানো ছিলনা; যতটা ছিল রমার উত্তর। ‘শুধু জন কেন যেকোনো হিরো যার শরীরে মাসল রয়েছে তাকেই আমার ভালো লাগে।’ গাঁড় মেরেছে। শালা চিনু শার্ট খুলে কি তাই রমাকে মাসল দেখিয়ে যাচ্ছে। না আর সহ্য করা যায়না। ছোটবেলায় বাবা একটি কবিতার লাইন বারবার বলতেন ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদিনী।’ আমি তো চিনুকে এমনিতেই ওয়াক ওভার দিয়ে দিচ্ছি। এবার কিছু একটা ব্যাবস্থা আমাকেই করতে হবে।
হনহন করে ভেতরে ঢুকে রমাকে বললাম, ‘রমা যাও ফ্রেস হয়ে নাও। আজ অনেক ধকল গেছে।’ শালা মোক্ষম চাল চেলেছি। আমার কথা শুনে রমাও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। ‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। আমারও গাটা ম্যাজম্যাজ করছিল। যাই দু এক মগ জল ঢেলে আসি।’ কথাটা শেষ করেই রমা ব্যাগ থেকে তোয়ালেটা বার করে নিল। আমার তো দিল গার্ডেন গার্ডেন হয়ে গেলো চিনুর মুখের অবস্থা দেখে। চিনু কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনেমনে বললাম এটা তো প্রথম চাল, এবার দ্বিতীয় চালটাও দেখ। রমা বাথরুমের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকতে যাবে এমন সময় আমি দ্বিতীয় চালটা দিলাম। চিনুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম ‘আরে চিনু, যাও ওদেরকে খাবারের অর্ডারটা দিয়ে আসো। এখন না বললে তো প্রবলেম হয়ে যাবে।’ চিনুর কান লাল হয়ে গেলো। যেন বোঝাতে চাইল আজ ও এক মুহূর্তের জন্যও রমাকে হাতছাড়া করবেনা। রমা প্রায় বাথরুমের ভেতরেই ঢুকে গেছিল। হঠাৎ দরজাটা অনেকটা ফাঁক করে রমা বেরিয়ে আসে। ‘একি, তুমি কেমন গো? তোমার তো নিজেরই যাওয়া উচিত?’ ব্যাস সমস্ত ছন্দেরই তাল কেটে গেলো। চিনুর মুখে আবার পুরনো হাসিটা ফেরত চলে এলো। আর কিছুই করার নেই, স্নানরত স্ত্রী ও ক্ষুধার্ত চিনুকে রেখে আমায়ই বেরোতে হলো। দরজাটা যে এভাবে মুখের ওপর চিনু লক করে দেবে তা সত্যিই বুঝতে পারিনি। যাইহোক আমিও রিসেপশনের দিকে চলতে শুরু করলাম।
দু তিন পা যাওয়ার পরই একটা খসখস করে শব্দ। গা টা কেমন ছমছম করে উঠল। তখন হ্যালোজেন লাইটটায় দুখানা ছায়া দেখতে পাওয়া, দেওয়াল আলমারিটার ভেতর দিয়ে একটা হাত বাইরে আসা এবং রমার ব্রা ও প্যানটিগুলো ভেতরে ঢুকিয়ে নেওয়া; সব মিলিয়ে সত্যিই একটা গা ছমছমে ভাব। এর সাথে যুক্ত হয়েছে, বিজয়দার রহস্য। কেউ একজন রয়েছে যে পুলিশের ইনফরমার, অথচ আমাদেরই মধ্যে রয়েছে। কে সে? কানটা খাড়া করে রাখলাম। হ্যাঁ, আমি একদম ঠিকই শুনেছি। একটা খস খস করে শব্দ হচ্ছে এবং তার তীব্রতা বেড়েই চলেছে। আওয়াজটা ওই আলমারির ভেতর থেকেই আসছিল। বুকটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠল। এইখানে আসার পর থেকেই সবকিছু কেমন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলাম। কানটা রাখলাম ঠিক ওপরটায়। একটা ফিসফিস করে কোন শব্দ আসছে। ঠিক বোধগম্য হচ্ছিলনা। আরও সজাগ হয়ে শুনতে শুরু করলাম। এবার শুনতে পেলাম। ‘উফফফফ, কি মাইরে। উম্ম কামড়ে দিতে ইচ্ছে করছে!’ গলাটা এতো চেনা চেনা লাগছে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিনা কার গলা। আসলে ফিসফিস করে বললে চেনা লোকের গলাও চেনা দায় হয়ে যায়। কি করব আলমারির দরজাটা খুলবো? যদি ধরা পড়ে যাই তাহলে? আরও সজাগ হয়ে শুনতে শুরু করলাম ‘দাদা, জুলি কই?’
‘চুপ কর; এইতো জুলি। এই তো আমার জুলি।’
এবার কিছুটা বুঝলাম, প্রথম কণ্ঠটা শান্তনুর কিন্তু দ্বিতীয়টা কার? এতো চেনা চেনা কেন লাগছে?
‘লিপস্টিকটা নিয়ে আয়।’
‘আমার হাতেই আছে, এই নিন।’ ওদের মৃদু গলার স্বর আমার মস্তিস্কে রহস্যের জালটা ক্রমশ ঘন করে তুলল। যা কিছু রয়েছে তা এই আলমারিরই মধ্যে।
অত্যন্ত সন্তর্পণে আমি দাঁতে দাঁত চিপে আলমারির ডালা দুটোকে ফাঁক করলাম। উঁকি মারার মত একটু ফাঁক হতেই আমার বিচি পুরো আউট। শালা, সুনীল গাঙ্গুলির একটা গল্পে, সম্ভবত ‘কলকাতার জঙ্গলে’, ঠিক এরকমই আন্ডার গ্রাউন্ড একটা ঘরের বর্ণনা ছিল। যদিও এটা আন্ডার গ্রাউন্ড ঘর নয় লোকচক্ষুর আড়ালে লুকোনো একটা ঘর, জানি এর মধ্যে হাজারো রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। দরজাটা ভালো করে ফাঁক করে ভেতরে উঁকি মারলাম। টিমটিম করে আলো জ্বলছে। দুটো খাট পাশাপাশি লাগানো আর তার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র নোংরা জামাকাপড়। আমি পা টিপে ভেতরে প্রবেশ করলাম। দুজন মানুষের ফিসফিসানির শব্দ এলেও সামনে কোথাও তাদের দেখা যাচ্ছেনা। একইরকম ভাবে আলমারিসদৃশ দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। তখনও একইরকমভাবে ভেসে আসছে যৌন শীৎকার। ‘ওহ নীল প্যানটিটা কখন খুলবে রে, উফ আর পারছিনা আমি!’ গলাটা এতো চেনা লাগছে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিনা। আমি ধীরে ধীরে খাটের কাছে এগিয়ে গেলাম। ঢাঁই করে রাখা নোংরা কাপড়ের ঢিবি। এই শীৎকারগুলো না থাকলে অবশ্যই এটাকে একটা স্টোর রুম ভেবে চলে যেতাম। কিন্তু লোক দুটো কোথায়? হঠাৎ আমার চোখ গেলো হলুদ একটা শাড়ির দিকে। এই শাড়িটা কি আমি কখনো ভুলতে পারি? ঠিক ৪ বছর আগে পুজায় আমি রমাকে কিনে দিয়েছিলাম। শেষ কয়েকমাস রঙ উঠে যাওয়ায় ঘরে পড়া শাড়ি হিসেবেই ও ব্যাবহার করত। ব্যালকনিতে শুকাতে দিয়েছিল হাওয়ায় নাকি উড়ে গেছিল আর খুঁজে পায়নি। সবকিছু কেমন রহস্যময় লাগছিল। তাহলে কি এই যে নোংরা ব্রা, প্যানটি এগুলো সব পড়ে রয়েছে এগুলো কি রমার? আর হলেও বা এখানে কি করে এলো? সবার আগে আমায় খুঁজে বার করতে হবে ওই লোকগুলোকে। ওরা কোথায়? পুরো ঘরে তো আর একটাও কোন দরজা বা জানলা দেখতে পাচ্ছিনা।
সন্তর্পণে দেওয়ালগুলোতে হাতড়াতে শুরু করলাম। খাটটা ঠিক পেরিয়ে গিয়ে দেওয়ালে পেরেক পুঁতে একটা কাপড় ঝোলানো। কাপড়টার ওপর হাত রাখতেই বুঝলাম এটা একটা দরজা অর্থাৎ এটা দিয়েই পাশের ঘরে যাওয়ার ব্যাবস্থা। বানচোদগুলো বাংলোর আড়ালে যে কি চক্র চালায় তার হদিশ না পেলে আমার খাবার হজম হবেনা। খুব সন্তর্পণে পর্দাটা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। গা ছমছম করতে শুরু করল। পা টিপে টিপে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম। মাঝে মধ্যেই দুএকটা টেবিল চেয়ার আমার পায়ে লাগছে কিন্তু অত্যন্ত ধীরে ধীরে এগোনোয় সেরকম কোন শব্দ হলনা। এতটুকু বুঝতে পারছি যে এটা বিশাল বড় একটা হল ঘর এবং লোকগুলো অন্য কোনোদিকে রয়েছে কারন ওদের ফিসফিসানিগুলো কিছুতেই আর আমার কানে আসছেনা। অথচ ঢোকার মুখে যথেষ্টই আসছিল। আর সামনে এগোতে ভয় করছিল। চুপ করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চারপাশটা একবার দেখলাম। দূরে কোন এক ফুটো দিয়ে হাল্কা নাইট বাল্বের আলো আসছে। নিশ্চয়ই ওইদিকেই কোন দরজা বা জানলা থাকবে। আমি ধীরে ধীরে সেদিকেই এগোতে শুরু করলাম। দেওয়ালটা হাতড়াতে হাতড়াতে বুঝলাম এটা একটা দরজা ও তার ফাঁক দিয়েই আলোটা আসছে। আমি কি দরজাটা খুলবো? এই প্রশ্নটাই বারবার করে মনের মধ্যে উঁকি দিতে থাকলো। কিন্তু এই রহস্য উদ্ঘাটন করা ছাড়া আমার কাছে অন্য কোন উপায় নেই।
দরজাটা সামান্য ফাঁক করে ভেতরের দিকে উঁকি মারলাম। ভেতরের দৃশ্য দেখে তো আমার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। অন্তত হাজার খানেক পেটি সার দিয়ে রাখা আছে। মাটিতে একটা বিছানা পাতা আর তাতে দুজন ষণ্ডামার্কা লোক ভোঁস ভোঁস করে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। টেবিলটার ওপর একটা রাইফেল ও একটা নাইন এম এম পিস্তল। ভয়ে তো আমার পা কাঁপতে শুরু করে দিলো। আদৌ কি আমার ভেতরে ঢোকা উচিত? আমি কানটাকে অত্যন্ত সজাগ রাখলাম। অপেক্ষাকৃত দুর্বলভাবে হলেও দুই ব্যক্তির সেই কামাতুর গোঙানিটা আবার আমার কানে আসতে শুরু করল। না, এই রহস্যগুলো যেভাবে হোক আমায় উদ্ঘাটন করতে হবে। ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম। আমার থেকে মাত্র ৩-৪ হাত দুরেই ওই দুই ব্যক্তি শুয়ে আছে। সামান্য কোন আওয়াজ হলেই ওদের ঘুম ভাঙবে এবং আমার পগারপার ঘটবে। সবার আগে যে রহস্যটার সমাধান করতে হবে তা হল ওই পেটিগুলোতে কি রয়েছে। আমার দুচোখ ওই দুই ব্যক্তির দিকে এবং হাতটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে শুরু করল পেটিগুলোর দিকে। কপাল ভালো ছিল হাতের সামনের পেটিটাই সিল করা ছিলনা। হাতটা ভেতরে ঢুকতেই আমার নাগালের মধ্যে একটা পলিথিনের সিল করা প্যাকেট এলো। ধীরে ধীরে সেটাকে আমি বাইরে বার করে আনলাম। হাতে নিয়ে ভালো করে দেখতে তো আমি অবাক। খানিকটা ব্যাঙের ছাতার মত দেখতে একটা ছত্রাক। কিছুই মাথায় ঢুকল না। আরেকটা অদ্ভুত জিনিষ, এই ঘরটার মধ্যে ঢুকতেই আগের সেই কামাতুর গোঙানিটা আবার স্পষ্টভাবে আমার কানে আসতে শুরু করল। ভালো করে পুরো ঘরটা লক্ষ্য করতে লাগলাম। ঠিক উল্টো দিকের দেওয়ালে একটা জানালা আর তার ফাঁক দিয়ে বাইরেটা কিছুটা দেখা যাচ্ছে। রমাকে খুঁজতে যখন বাইরে বেরিয়েছিলাম এরকমই একটা সুপুরি গাছ বাগানে দেখেছিলাম। ভালো করে দিকগুলো ভাবার পর বুঝতে পারলাম এটা আমাদের উল্টো দিকের যে রুমটা আছে তারই পেছনে। অর্থাৎ আমাদের রুম ও উল্টো দিকের রুমটার কানেকশন হচ্ছে এই লুকোনো ঘরগুলো। কিন্তু আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে?
ডান দিকে তাকালাম আবার এক জায়গায় ওই একইভাবে একটা কাপড় টাঙ্গানো। নিশ্চয়ই এর ভেতরেই রয়েছে আরও একটা রুম। ভয় লাগছিল, পা দুটো এক জায়গাতেই আটকে রয়েছিল। বাই চান্স যদি ধরা পড়ে যাই তাহলে সত্যি প্রান হাতে এখান থেকে বেরনো সম্ভব হবেনা। তবুও, হাত দুটো মাথার ওপর করে একবার প্রদোষ মিত্তিরকে স্মরন করে গুটিগুটি পায়ে পৌঁছে গেলাম ওই পর্দা লাগানো দরজার কাছে। আস্তে করে পর্দাটা একবার সরিয়ে ভেতরে উঁকি মারতেই মাথা খারাপ হয়ে গেলো।
না আমি কোন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার নই; কোন আর্কিটেক্টও নই। কিন্তু সম্পূর্ণ বাংলোর ডিজাইনটা কোন আর্কিটেক্ট বা ইঞ্জিনিয়ার নয় যেকোনো সাধারন মানুষকেই মুগ্ধ করবে। বাংলোর বাইরে থেকে এমনকি ভেতর থেকেও এটা বোঝা প্রায় অসম্ভব যে বাংলোর দুটো রুমের মধ্যে সংযোগ রয়েছে, যদিও দুটো রুম পরস্পরের বিপরীতে। সংযোগ শুধুমাত্র একটা জায়গায় তা হল বাথরুমের দেওয়ালে। দুটো রুমেরই বাথরুমের একটা কমন দেওয়াল রয়েছে। না, দেওয়াল বললে ভুল হবে রয়েছে একটা কাঁচের পার্টিশন। আর বাকি দুটো কাঁচের পার্টিশন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লম্বা একটা দেওয়াল তৈরি করেছে। এই মুহূর্তে আমি যেন কোন ব্লু ফিল্মের স্টুডিওতে। এই রুমটার একটা দেওয়াল অর্থাৎ ঠিক আমার সোজাসুজি দেওয়ালটি অন্য কিছুই নয় পরপর দুটি রুমের বাথরুমের ওয়াল। বাথরুমে ঢোকার পর একবারও মনে হয়নি যে কাঁচটা সি থ্রু। অর্থাৎ বাথরুম থেকে পেছনের রুমটা দেখা অসম্ভব, কিন্তু পেছনের রুমটা থেকে দুটো বাথরুমই সম্পূর্ণ দেখা সম্ভব। ভয়ে আমার দুটো পা থর থর করে কাঁপছে। আমার ঠিক পেছনেই দুটো ষণ্ডমার্কা লোক ঘুমাচ্ছে, তাদের হাতের একটু পাশেই রয়েছে একটা রাইফেল ও পিস্তল এবং আমার ঠিক সামনে দুটো লোক। তাদের মধ্যে একজন অবশ্যই শান্তনু, অপরজন কে? এই ৪ জনের মধ্যে যদি একজন এই মুহূর্তে আমায় দেখে ফেলে আমার মৃত্যু নিশ্চিত। স্বয়ং ভগবানেরও ক্ষমতা নেই আমাকে বাঁচানোর।
সামনের দৃশ্য ছিল ভয়াবহ। দুজন উলঙ্গ পুরুষ, তাদের মুখে পেছন বাঁধা এক মুখোশ। এখানে ঢুকেই আমি শান্তনুকে খুব ভালো করে লক্ষ্য করেছিলাম, তাই আমি নিশ্চিত মাঝারি হাইটের কমবয়সী ওই ছেলেটি শান্তনু। কিন্তু তার পাশের ওই মাঝবয়সী ভারিক্কি চেহারার ওই মানুষটি কে? আমি কি ওকে চিনি? হাতে সেই পরিচিত রিষ্ট ওয়াচ, কার হাতে দেখেছি কিছুতেই মনে করতে পারছিনা। ঠিক শিরদাঁড়া বরাবর একটা কালো লম্বা দাগ। না এরকম কোন দাগের কথা আমি জানিওনা এবং রমার ডায়েরিতেও পড়িনি। কে ও? ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার বলছে এই মানুষটি আমার অতি পরিচিত। বিজয়দা বলেছিলেন মধুকর ভিলায় আমি আমার অতি পরিচিত একজনকে খুঁজে পাবো। তাহলে কি এই সেই ব্যক্তি নাকি অন্য কেউ। আবার একবার পেছন ঘুরে দেখলাম; না লোকদুটো এখনো আগের মতই একইভাবে ঘুমিয়ে আছে। আরেকটা রহস্য আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই দুটো লোক মুখোশ কেন পরে আছে? ওরা কি জানে যে আমি ওদের ফলো করে এখানে আসবো? নাকি এর পেছনেও রয়েছে অন্য কোন রহস্য। তবে এতো রহস্য ভীতি সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে ওদের মাদকীয় যৌন আচরন। ভারতের মত রক্ষনশীল দেশেও কি এইসব হয়?
বহুবার আমার সামনেই বহু মানুষ রমার শরীরে নিজের চোখ সেঁকে নিয়েছে। কখনো ঝুঁকে পড়ার ফলে বেরিয়ে আসা দুধের অংশ কখনো সুদৃশ্য ক্লিভেজ আবার কখনো শাড়ির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা কারুকার্য করা নাভী অন্যকে স্বর্গসুখ দিয়েছে। আমারই সামনে রঞ্জন রমাকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় দেখেছে। অস্বীকার করবো না প্রতিটা ক্ষেত্রেই নিজের সজ্ঞানে অথবা অজান্তে আমিও চরম উত্তেজিত হয়ে পড়েছি, অন্যের চোখ দিয়ে নিজের স্ত্রীর শরীরসুধা পান করতে চেয়েছি। কিন্তু এই মুহূর্তের দৃশ্য সমস্ত ইরটিসিসমকে হার মানিয়েছে। আমার বারবার করে মনে হচ্ছে ওদেরই পাশে দাঁড়িয়ে রমার সৌন্দর্যকে ওদের মত করে উপভোগ করতে। আমার গবেট বউটা বাথরুমের মধ্যে সম্পূর্ণ উলঙ্গ, ও জানেও না সামনের দেওয়ালটা দেওয়াল নয় একটা সিনেমার পর্দা, যেখানে ওর শরীরের প্রতিটা গোপন অংশের কারুকার্য সুনিপুনভাবে ফুটে উঠছে।

আর আমার সামনে এরা কারা? কোনমতেই এদের মানুষ বলা চলেনা। মানুষের যৌন আসক্তি কখনোই এতটা হিংস্র নয়। রমার মুখে একটা মিষ্টি হাসি লেগেই আছে। আর এই হাসিটাই হয়ত ওদের ভেতরের পাশবিক যৌনতাকে আরও বেশী উদ্দীপিত করে তুলছে। ওরা যেন একটা গোলাপের সমস্ত পাপড়িকে ছিঁড়ে পা দিয়ে পিষে দিতে চায়। একটু বয়স্ক লোকটির দু হাতে দুটো লিপস্টিক। সেটা দিয়ে কাঁচের ওপর রমার অবস্থান অনুযায়ী চিহ্ন এঁকে চলেছে। ওপরের দিকে তাকাতেই বুঝলাম রমার ঠোঁট বরাবর কাঁচের ওপর বার তিনেক লিপস্টিক ওদের লাগানো হয়ে গেছে। সেই লিপস্টিক জিভ আর ঠোঁটের অত্যাচারে প্রায় ফ্যাকাসে। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি খুব সুন্দর ভাবে যোনী আঁকা, তার চারপাশে আবার খয়েরি লিপস্টিক দিয়ে ছোট ছোট রোমেরও চিহ্ন করা আছে। দুজনেই নিজের বাঁড়াটা একদম মাটির সাথে লম্ব করে কাঁচের দেওয়ালে ঘষে চলেছে।

অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা রমা এসব কিছুই বুঝতে পারছে না। আমারও শরীরে শিহরন শুরু হয়েছে আর তার সাথে অদ্ভুত এক ভয়, আদৌ কি এখান থেকে বেঁচে বেরোতে পারবো। হঠাৎ দেখি রমা পেছন ফিরে নিজের কাঁধে শাওয়ারের জলটা লাগাতে শুরু করলো। সেই মাঝ বয়সী মানুষটিও হাঁটু গেড়ে বসে নিজের মুখটা ঠিক রমার পায়ুছিদ্র বরাবর রেখে জিভ দিয়ে কাঁচের ওপরই লেহন করতে শুরু করল। দেখে মনে হচ্ছে, এই কাঁচটা না থাকলে ও বুঝি এক্ষুনি নিজের লম্বা জিভটা রমার পায়ুছিদ্রতে লাগিয়ে লম্বা টান দিয়ে যোনিদ্বার অবধি চালিয়ে দিত। আর রমাও স্টেশনের পাগলীর মত উম্মম্মম্মম উম্মম্মম্মম্মম করে লাফ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠত।

রমার শরীরটা যতই কাঁচের দেওয়ালের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে দুটো জানোয়ারই লাফ দিয়ে চিৎকার করে কাঁচের দেওয়ালে ধাক্কা মারছে। যেন ওরা চায়, এক্ষুনি কাঁচের দেওয়ালটা ভেঙে ফেলতে।
আচ্ছা সত্যিই যদি এই কাঁচের দেওয়ালটা ভেঙে যায় তাহলে? আমি কি পারবো এই দুই মানসিক উন্মাদের থেকে আমার রমাকে রক্ষা করতে? আচ্ছা, এরকম পৈশাচিক যৌনতা কি রমা একটিবারের জন্য হলেও উপভোগ করবে না? যতই হোক রমা তো নারী ওরও গুদে কুট কুট করে, পুরুষ মানুষকে দিয়ে চোদাতে মন যায়। হয়ত প্রথমে একটু প্রতিবাদ করবে, কিন্তু তারপর যদি দেখে ওর এই শরীরটা একবার ছোঁয়ার জন্য দুটো মানুষ আস্তাকুঁড়ের কুকুরের মত কামড়া কামড়ি করছে তাহলে কি ও নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করবেনা! আমি একবার ওই কুকুরদুটোর দিকে তাকাচ্ছি আর একবার বাইরের ঘরের ওই দুই গুণ্ডার দিকে তাকাচ্ছি। রমার স্নান হয়ে যায়, ও তোয়ালেটা নিতে প্রায় কাঁচের দেওয়ালের গায়ে নিজেকে সাঁটিয়ে দেয়। জানোয়ার দুটোর সমস্ত বোধ বুদ্ধি হারিয়ে যায়। পাগলের মত দেওয়ালের ওপর আঁচড়াতে, ঘুসি মারতে শুরু করে। এতো জোরে আওয়াজ হচ্ছিল যে পেছনের দুটো লোকের জেগে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। আমি তাই বাধ্য হয়ে ঘরটার ভেতরই ঢুকে দাঁড়াই। আমার গেসটা ঠিক ছিল, ভেতরের ঘর থেকে আওয়াজ আসে ‘আরে ও ব্যাহেনচোদো, শালে প্যায়সা লিয়া হু তো কুছ ভি কারোগে। আওয়াজ নাহি হোনা চাহিয়ে।’ বুঝলাম এরা ফ্রিতে নয়, টাকা দিয়েই শো দেখছে। এবার যদি এই দুটো জানোয়ার বাই চান্স পেছন ঘুরে দেখে আমি ফেঁসে যাবো। যাই হোক ভাগ্য আমার সাথেই ছিল। ওরা শুধু ‘হুউউউ’ বলে বিরক্তি প্রকাশ করল। রমার গা মোছা হয়ে গেলে ওপর থেকে নাইটি আর প্যানটিটা পেড়ে নেয়। আমিও বুঝলাম এটাই সুবর্ণ সুযোগ। ধীরে ধীরে রুমের বাইরে বেরলাম। না লোক দুটো আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। যে পথে এসেছিলাম সেই পথেই আবার চলতে শুরু করলাম। এখন আর আগের মত মনে ভয় নেই কারন পুরো পথটাই আমার জানা।
বিজয়দা এই কেসের দায়িত্ব নেওয়ার পর ওনার মুখ থেকে শুনেছিলাম মনিদা ও রবির খুনে মোট ৩ টে জিনিষের গভীর যোগ রয়েছে; ব্যাঙ্ক, ফেসবুক ও সেক্স র‍্যাকেট। ব্যাঙ্কের যোগ এই অর্থেই ভাবতাম যে খুন হওয়া ২ জনই ব্যাংকার, এছাড়া আমার এনজিওতে ১০ লাখ টাকার ড্রাফট করা। ফেসবুকের যোগ সেই অর্থে মাত্র একটাই জায়গায় তমাল সেন, অবশ্যই এটা কোন ছদ্মনাম যে আমাকে আর রমাকে দেখতে পায় ও খুব ভালো করে চেনে। কিন্তু বিজয়দার হাজারো যুক্তি তত্বের পরও আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না সেক্স র‍্যাকেট কিভাবে এই খুনগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে। আজ কিছুটা হলেও ব্যাপারটা আমার কাছে পরিস্কার হলো। প্রাপ্তবয়স্ক সাইটগুলোতে চোখ বোলালেই বোঝা যাবে; এই সমাজের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে হাজারো যৌন বিকৃতি। কেউ ইন্সেসট, কেউ বা কাকোল্ড, কেউ আবার বিডিএসএম এর প্রতি আসক্ত। এই আসক্তি কোন কল গার্ল বা নিজ স্ত্রীর পক্ষে মেটানো সম্ভব নয়। এর জন্য চলছে এক অত্যাধুনিক চক্র; হয়ত এই মধুকর ভিলা তার অন্যতম। যেভাবে কাঁচের ঘরের মধ্যে ওই দুটি মানুষ দাপাদাপি করল তার থেকে এটাই স্পষ্ট যে ওদের একটা ট্রেলার দেখানো হয়েছে; ওদের নিজের নিজের ফ্যান্টাসিগুলো কি ওরা এই বিবাহিত নারীর মধ্যে দেখতে চায়? সমস্ত রহস্যগুলো একটা সুতোর মধ্যে খুব সুন্দরভাবে বেঁধে যাচ্ছিল, কিন্তু তাল কাটল একটাই জায়গায়। আমি বা আমার পরিবার কেন এর মধ্যে ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছি? জুলি কে? কেই বা শান? রমার ব্যাবহার হঠাৎ এতো রহস্যময় কেন?
নিরাপদেই আমি দেওয়াল আলমারির ডালা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আর তার সাথে সাথে আমার মোবাইল ফোনটাও বেজে উঠল। সত্যিই কপাল সুপ্রসন্ন তাই প্রানে বাঁচলাম। আর কয়েকটা মিনিট আগে এটা বাজলে আমি জ্যান্ত থাকতাম না। এখন একটাই কাজ দ্রুত রমাকে এখান থেকে বার করে পালিয়ে যাওয়া। দেখি বিজয়দার ফোন। রিসিভ করলাম। ‘বিপ্লব বাবু যত দ্রুত সম্ভব আপনি বাংলো থেকে কিছুটা দূরে কোন ফাঁকা স্থানে লুকিয়ে থাকুন। একটা কালো মারুতিতে শান আসছে, জুলির কোন খবর নেই। তবে এই বাংলোতে প্রবেশ করলে শান কিছুতেই আপনাকে দেখা দেবেনা। তাই আমি চাই যেভাবে হোক আপনি শান কে, সেই রহস্য উদঘাটন করুন।’ আমার মুখ দিয়ে প্রথম যে উত্তরটা এলো তা হলো ‘কিন্তু রমা?’ সঙ্গে সঙ্গে বিজয়দা আমায় আশ্বস্ত করলেন, ‘এই বাংলোতেই পুলিশের ইনফরমার লুকিয়ে আছে। আপনার মিসেসের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগবে না। আমি প্রমিস করছি।’ আমি কি করব তাই ভাবতে থাকলাম। জীবনে হতাশা দুঃখের শেষ নেই, এর পর যদি সত্যিই রমার কোন ক্ষতি হয়ে যায় তাহলে সত্যিই নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবো না। কিন্তু এই রহস্যটার সাথে যে জড়িয়ে আছে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্বল স্থানটা। কত বার যে মাঝ রাতে আমার ঘুম ভেঙেছে তা কেউ জানেনা। আজ বহু বছর ধরে আমারও মনে একটাই প্রশ্ন জুলি কে? আজ কি আমি সেই প্রশ্নের উত্তরের সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দেবো। বিজয়দাকে বিশ্বাস করেই দেখিনা। আমি প্রানপনে বাইরের দিকে ছুটতে থাকলাম।
ছুটতে ছুটতে কখন যে বাংলোটা পেরিয়ে অনেকটা দূরে চলে এসেছি নিজেরও খেয়াল নেই। বহুদুরে টিমটিম করে একটা চায়ের দোকানে লাইট জ্বলছে। আর ঠিক তার আগেই বড় রাস্তা। এই বাংলোতে আসলে এই রাস্তা দিয়েই আসতে হবে। আমার পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় ওই চা দোকান। ওইদিকেই এগিয়ে গেলাম। চারপাশ নিস্তব্ধ, শীতকালের রাত তো জনশূন্য হওয়ারই কথা। মাঝে মধ্যে প্রবল বেগে কতগুলো লরি ছুটে চলেছে। দোকানটাও শুনশান। দোকানদার হয়ত বেশ কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে পড়েছে। হুক করা লাইট তো তাই সারা রাত জ্বললেও কিছু যায় আসেনা। আমি ওখানে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আর তার সাথে দূর থেকে কিছু কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ এছাড়া আমার আর কোন সঙ্গী সাথী ছিলনা। আমার চোখ বড় রাস্তার দিকে, কখন কোন কালো রঙের গাড়ী এইদিকে আসবে ও আমি গাড়ির ভেতর উঁকি মেরে দেখবো কে সে? শান আসলে কে? খেয়াল করিনি এতক্ষন আমার ঘাড়ের ওপর একটা উষ্ণ নিঃশ্বাস বয়ে চলেছে।
আমি নিশ্চিত আমার পেছনে কেউ একজন রয়েছে। কিন্তু কে? সেকি কোন মানুষ নাকি...? ঘাড়টা ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোর মত সাহস আমার বুকে ছিলনা। সামনের দিকে তাকালাম, ছায়াটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এটাও বোঝা যাচ্ছে সারা গায়ে চাদর মুড়ি দেওয়া। বাল্বের আলোটা আমার গায়ে সেইরকম সরাসরি পড়ছিল না তাই পেছন ঘুরলে যে মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাবো তা বলা যায়না। পেছন ঘোরার ক্ষমতা আমার মধ্যে ছিলনা। একটা হাত আমার কাঁধের ওপর এসে স্পর্শ করল। এতো শীতল তো কোন মানুষের হাত হয়না? কে ও?
 
১৩

কম বয়সে অনেক মারপিট করেছি, কিন্তু সেসবই মানুষের সাথে। আমার গুরুমস্তিষ্ক বারবার বলছে আমার পেছনে কোন মানুষ নয় এক অশরীরী দাঁড়িয়ে আছে এবং তার বরফ শীতল হাতটা ক্রমশ আমার কাঁধ থেকে কানের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। পেছন দিকে তাকানোর ক্ষমতা আমার মধ্যে নেই। ওই বেঞ্চের ওপরই চুপটি করে বসে দাঁতে দাঁত চিপে আমি ঠক ঠক করে কেঁপে চলেছি। হঠাৎ হাতের কোমল আঙুলগুলো কেমন যেন লোহার মত শক্ত অনুভুত হলো। বেশ কিছুক্ষন চুপ করে অনুভব করার পর বুঝলাম এটা আঙুল নয় রিভালবারের নল। এবং এর সাথে সাথে বুক থেকে একরাশ ভয় নেমে গেলো। হ্যাঁ, পেছনের সেই ছায়াটি ভূত নয় মানুষ। আমি শুধুই অপেক্ষায় তার মুখ থেকে সামান্য কোন শব্দ শুনতে পাওয়ার; কারন পেছন ঘুরে আমি তার মুখ দেখে চিনে ফেলব সেই সুযোগ হয়ত সে আমায় দেবেনা। ‘মাথাটা বেঞ্চের ওপর ঠেকিয়ে উবুড় হয়ে বস। একটু নড়চড় করলেই মাথা ফুঁড়ে গুলি এদিক ওদিক করে দেবো।’ গলাটা অস্বাভাবিক রকম; কিছুটা প্রচণ্ড কফ জমে গেলে মানুষের গলা যেমন হয় তেমন অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের গলাটা অন্যের কাছে অপরিচিত করতে চাইলে যেমন হয় তেমন। আমি কানটা খাড়া রাখলাম, জানি পেছনের সেই ব্যক্তি আমার অতি পরিচিত। কিছুতেই নিজের পরিচয় আমার কাছে দিতে চায়না। আমি যেভাবে বসে ছিলাম সেভাবেই বসে থাকলাম; লক্ষ্য একটাই আরও একবার ওর গলাটা শুনে চিনে নেওয়া।
মানুষই ভুল করে। হ্যাঁ, ঠিক যা চাইছিলাম তাই হলো। ‘কি হলো; শুনতে পাচ্ছনা। মাথাটা নিচু কর, নয়ত এক্ষুনি গুলি চালিয়ে দেবো।’ এবারে গলার স্বরটা আর আগের মত বিকৃত করতে পারলো না, আর সেই কারনেই হয়ত রিভালবারের বাঁটটা দিয়ে সজোরে আমার মাথায় আঘাতটা নেমে এলো। আমার মাথায় বীভৎস যন্ত্রণা হচ্ছিল, কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও মনের মধ্যে একটা আনন্দ ছিল। মাথাটা বেঞ্চের ওপর রাখতে রাখতে আমি নিজের মনেই হেসে উঠলাম; ও মনে মনে বলে উঠলাম ‘আমি তোমায় চিনে ফেলেছি।’ স্কুলে পড়াকালীন বহুবার পাড়ায় নাটক, যাত্রাপালা করেছি। একবার সিতার পার্টও করেছিলাম। তাই জানি অভিনয় করা ও গলাকে পরিবর্তন করা এই দুই একসাথে করা ঠিক কি পরিমান কষ্টসাধ্য কাজ। শান যে আমার এতো পরিচিত ও কাছের লোক তা আগে জানা ছিলনা। কষ্ট হচ্ছিল, কাছের মানুষের এতো বড় বেইমানী দেখে কিন্তু আনন্দও হচ্ছিল যেহেতু সম্পূর্ণ রহস্যের অন্তত ৭৫ ভাগ আমি সল্ভ করে ফেলেছি।
বিজয়দাকে আমি নিজের দাদা মনে করি। অনেকবারই ওনার ওপর সন্দেহ হয়েছে কিন্তু কখনোই সেভাবে ওনাকে অবিশ্বাস করিনি। মাদারচোদের দুনিয়ায় সত্যিই কেউ কারুর হয়না। আর ভাবতে পারলাম না কিছু কারন আবার প্রচণ্ড জোরে রিভলবারের বাঁটটা দিয়ে মাথায় সজোরে একটা আঘাত। মনে হলো এবার বুঝি সত্যিই মাথাটা ফেটে গেলো। আবার বিকৃত করা গলায় একটা আওয়াজ ‘এই গাড়িটা এবার এখানে নিয়ে আয়। আর লুকিয়ে থাকার দরকার নেই।’ তাহলে এতক্ষন সেই সাদা গাড়িটা এখানে অপেক্ষা করছিল। গাড়ির স্টার্ট নেওয়ার আওয়াজ শুনে একটু অনুধাবন করার চেষ্টা করলাম। রাস্তাটার ঠিক উল্টোদিকে কিছু ঝাউ আর ইউক্যালিপটাস গাছের জঙ্গল রয়েছে। নিশ্চয়ই গাড়িটা ওখানেই কোথাও লুকানো ছিল। গাড়িটা যে ধীরে ধীরে এদিকেই এগিয়ে আসছে তা আমি বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছি। ‘যে কথাটা বলার জন্য এতকিছু; রমার কিচ্ছু হবেনা। এই বড় রাস্তায় কলকাতাগামী অনেক বাস পেয়ে যাবে। তার মধ্যে কোন একটায় উঠে কেটে পড়ো দেখি। রমাকে ৩-৪ দিন বাদে সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত পাঠিয়ে দেবো। যদি নিজের ও রমার ভালো চাও তো এক্ষুনি এখান থেকে কেটে পড়ো।’ আমার মুখ দিয়ে একটাও শব্দ বেরোল না, আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আমার কি করা উচিত। রিভালবারের বাঁটটা ক্রমশ আমার মাথা থেকে ধীরে ধীরে সরে গেলো। আমি কি মাথাটা ওপরে ওঠাবো। ধীরে ধীরে মাথাটা ওপরের দিকে তুলতে লাগলাম। ‘খবরদার, তোমায় প্রানে মারলাম না কারন একদিন তোমার থেকে সাহায্য পেয়েছিলাম, যেমন আছো ওইভাবেই বেঞ্চে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকো। গাড়িটা বেরিয়ে যাওয়ার পর মাথা তুলবে।’ এবারে আওয়াজটা বেশ কিছুটা পেছন থেকে আসলো। বুঝলাম যে ও গাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে। না মাথা ওঠানোর কোন প্রশ্ন নেই, ওটা মুর্খামি হবে। কিন্তু শান যেটা লক্ষ্য করল না তা হলো আমার মুখের একটা সন্তোষের হাসি। ‘তোমায় প্রানে মারলাম না কারন একদিন তোমার থেকে সাহায্য পেয়েছিলাম।’ এবং সেই পরিচিত গলাটা আমায় শানের পরিচয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত করে তুলল।
প্রচণ্ড বেগে গাড়িটা কাঁচা রাস্তা বরাবর আমাদের বাংলোর দিকে চলতে শুরু করল। গাড়িতে কে কে ছিল, শুধুই কি শান ও তার ড্রাইভার? নাকি আরও অনেকজন? নাকি বিশেষ একজন? এইসব কিছুই আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হলো না। শুধু একটাই কথা বুঝলাম তা হলো ...ই হলো শান। এই মুহূর্তে আমার একটাই কর্তব্য রমাকে রক্ষা করা। কিন্তু কি করে? ওদের কাছে অস্ত্র আছে। যা কিছু করেছি তা শুধুই বিজয়দাকে ভরসা করে। উনি বলেছিলেন বাংলোতে কোন একজন রয়েছে যে পুলিশের চর এবং শুধু সেকথা বিশ্বাস করেই আমার এতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া। তাহলে কি সত্যিই কোন পুলিশের চর বাংলোতে নেই! বিজয়দার ওপর অবিশ্বাস হওয়াটা এই মুহূর্তে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। মাথার পেছনে হাত দিয়ে দেখলাম, মাথাটা ফাটেনি, শুধুই ফুলে গেছে। শান কি ইচ্ছে করেই আমায় বেশী আঘাত করতে চায়নি? কাঁচা রাস্তা বরাবর আমি দৌড়াতে শুরু করলাম। মাথায় শুধুই নতুন কিছু সমীকরন; বিজয়দার আমাদের বাড়িতে আসা - এটা শুধু আমিই জানি অন্য কেউ নয়, সেদিন বিজয়দা কার সাথে কথা বলছিলেন; রঞ্জনের সাথে? এটাও পরিস্কার নয়, যদি বিজয়দা জানতেন এখানে শান ও জুলি আসবেই তাহলে আমাকে ও রমাকে কেন গিনিপিগ বানিয়ে পাঠালেন; উনি তো নিজেই আসতে পারতেন এবং সর্বোপরি আমার এনজিওতে এতো টাকা দান করার ইচ্ছা প্রকাশ এবং তা ঘুষের টাকা বলে স্বীকার করে নেওয়া। সমস্ত ষড়যন্ত্রের কারিগর তাহলে বিজয়দাই!
আর ভাবতে ভালো লাগছিল না। এই মুহূর্তে একটাই কাজ রমাকে উদ্ধার করা। আমি কাঁচা রাস্তাটা বরাবর দৌড়ে চলছিলাম। রাস্তাটা বেশ অন্ধকার, তাই আমি যে দৌড়াচ্ছি এটাও যেমন অন্যের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় তেমনই সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে কিনা তা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আরও কিছুটা দূরে যাওয়ার পর হঠাৎ একটা অত্যন্ত উজ্জ্বল ও চকচকে বস্তু আমার চোখে পড়ল। মন বলছে সামনের মোড়টায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। দ্রুত নিজেকে পাশের একটা গাছের পেছনে লুকিয়ে নিলাম। এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। হ্যাঁ, যা ভেবেছি তাই। এইসময় ওর মোবাইলটা বেজে না উঠলে হয়ত বুঝতেই পারতাম না। মোবাইলের আলোতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে; হাতে একটা একে ৪৭ রাইফেল; ওই গোপন ঘরটায় যে দুজন গুণ্ডাকে দেখেছিলাম তাদেরই একজন। বুঝলাম এর কাজ, বাংলোর মধ্যে কে ঢুকছে আর কে বেরোচ্ছে সেদিকে নজর রাখা। রমাকে বাঁচাবো কি করে? ২-৩ দিন ধরে কি এই জানোয়ারগুলো রমার শরীরটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে? আর তারপর ছিবড়ে করে নষ্ট মেয়েমানুষটাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে? না, এটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। বেঁচে থাকতে আমি যেভাবে হোক রমাকে এখান থেকে উদ্ধার করব। আমার বাঁ দিকে কয়েকটা ঝাউ গাছের পাতলা জঙ্গল। আমাদের বাংলোর উল্টোদিকেও ঠিক একইরকম দেখতে কয়েকটা গাছের জঙ্গল ছিল। নিশ্চয়ই এই জঙ্গলটার ভেতর দিয়ে গেলে বাংলোর উল্টো দিকে উঠবো। যা ভাবা তাই কাজ।
আমি ধীরে ধীরে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলাম। প্রথমে বুঝতে পারিনি, এখন পারছি, জঙ্গলটা বাইরে থেকে দেখে যতটা পাতলা লাগে ও ছোট লাগে বাস্তবে তা নয়। এক পা এক পা করে যত ভেতরের দিকে এগোচ্ছি জঙ্গলটা ততই ঘন হয়ে যাচ্ছে। পাতায় খসখস করে শব্দ হচ্ছে, সেটা আমার পায়ের শব্দ নাকি অন্য কিছু তা সত্যিই আমার বোধগম্য হচ্ছেনা। এই জঙ্গলে যে বেশকিছু বিষধর সাপ থাকবে তা একটা বাচ্চা ছেলেও বলে দিতে পারে। না প্রানের ভয় আমার নেই, ভয় একটাই তা হলো রমা। যেভাবে হোক, রমাকে ওদের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে। যত এগোচ্ছি ততই খসখস করে শব্দটা বাড়ছে। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ বুঝি আমার পিছু নিচ্ছে আবার মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছে এটা বুঝি আমার মনের ভুল। বেশকিছুটা দূরে সামান্য একটা আলোর দিশা দেখা যাচ্ছে। হলফ করে বলতে পারি ওটাই আমাদের বাংলোর উল্টো দিকটা। আমি প্রানপনে দৌড় লাগালাম। আমাকে যেভাবে হোক বাংলোতে প্রবেশ করতে হবে। যত দৌড়াচ্ছি গাছগুলোর মধ্যে পারস্পরিক দূরত্বও ক্রমশ কমে যেতে শুরু করছে। আমিও নিশ্চিত হচ্ছি যে আমি সঠিক দিশাতেই রয়েছি। বেশ কিছুদুর যাওয়ার পর গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে বাংলোর প্রাচীরটা দৃশ্যমান হলো। আমিও কিছুটা হাঁপাতে হাঁপাতে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
যখন স্পষ্টভাবে বাংলোটা দৃশ্যমান হলো, তখন এক মুহূর্তের জন্যও আমার মনে আনন্দের সঞ্চার ঘটেছিল, কিন্তু পরক্ষনেই সেই আনন্দ কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। বাংলোর সামনে অপর গুন্ডাটি পাহারায় রয়েছে, এবং এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে কিছুতেই আমি নিজেকে লুকিয়ে বাংলোর মধ্যে ঢোকাতে পারবোনা। হঠাৎ দেখি সেই ষণ্ডমার্কা লোকটি আমারই দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু ওর পক্ষে তো বোঝা সম্ভব নয় যে আমি এখানে রয়েছি, জঙ্গলের ভেতরটা অন্ধকার আর বাংলোর দিকে আলো। দৌড়ে যে পেছনে চলে যাবো তারও উপায় নেই। পাতায় যা খসখস করে শব্দ হয়, তাতে ওরা নিশ্চিত হয়ে যাবে যে আমি এখানে লুকিয়ে আছি। ক্রমশ একপা একপা করে আমি বাঁদিকে কোনাকুনি ভাবে সরে যেতে শুরু করলাম। একদম জঙ্গলের কাছাকাছি লোকটা আসার অনেক আগেই আমি অন্তত ১০ মিটার পেছনে চলে গেছি। নিজেকে একটা গাছের পেছনে সম্পূর্ণ লুকিয়ে রেখে সামনের দিকে তাকালাম। লোকটা জঙ্গলের সামান্য ভেতরে প্রবেশ করে কি একটা খুঁজে চলেছে। ওরা কি জেনে গেছে আমিই জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছি? প্রায় মৃত মানুষের মত নিঃশ্বাস বন্ধ করে চুপটি করে একটা গাছের পেছনে লুকিয়ে থাকলাম। হঠাৎ দেখি লোকটা জঙ্গল থেকে বাইরে বেরিয়ে পকেটের মোবাইলটা বার করল। কাকে ফোন করছে ও? চোখ ও কান এই দুই ইন্দ্রিয়কেই সজাগ রেখে আমি সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ‘কাঁহা হো? বাহার আও?’ লোকটার কথাটা শুনে আমারও গাটা ছমছম করতে শুরু করল। তাহলে কি জঙ্গলের মধ্যেও পাহারার ব্যাবস্থা ছিল, কেউ কি আমার উপস্থিতি জঙ্গলের মধ্যে থেকেই জানান দিয়েছে? হঠাৎ দেখি পেছন থেকে একটা খসখস শব্দ ভেসে আসছে। গাছের গুঁড়িটার সাথে নিজেকে একদম সেঁটে রেখে আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। আওয়াজটা আরও বাড়তে লাগলো, আমিও অপেক্ষায় থাকলাম কে আসছে তা দেখার জন্য।
পেছন থেকে হলেও চিন্ময়কে চিনতে আমার কোন অসুবিধা হলনা। ওই লোকটার দিকে তাকিয়ে চিন্ময় বলে উঠল ‘তাহলে আমি এখন কি করব?’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর ‘শান সাব আগেয়া হ্যায়। সুরঙ্গ কি মুখ ঢাককে ওয়াপাশ আ যাও।’ গায়ের রোমগুলো খাড়া হয়ে যাচ্ছিল। এই মধুকর ভিলায় যে এতো রহস্য একসাথে লুকিয়ে আছে তা সত্যিই আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা। অর্থাৎ এই মধুকর ভিলায় প্রবেশ করার জন্য একটা সুরঙ্গও রয়েছে। লোকটা আবার নিজের অবস্থানে চলে গেলো এবার চিন্ময়ের পালা। চিন্ময় ধীরে ধীরে আবার জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করতে শুরু করল। একমাত্র চিন্ময়ই পারে আমায় এই বাংলোতে ঢোকাতে। এই মুহূর্তে আমার একটাই কাজ চিন্ময়কে ফলো করে যাওয়া। কিন্তু ভয় একটাই, সারা জঙ্গল জুড়ে শুকনো পাতা ছড়িয়ে আছে, এক পা হাঁটলেই খসখস করে শব্দ হবে। যদি চিন্ময় বুঝে যায়; আমি তো মরবই সাথে রমাও। তবুও অত্যন্ত সন্তর্পণে আমি চিন্ময়কে ফলো করতে শুরু করলাম। ঠিক যা ভাবলাম তাই। সবে দুখান গাছ পার করেছি; চিন্ময় হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। যেন ও বুঝতে পেরেছে কেউ ওকে ফলো করছে। একটা গাছের আড়ালে নিজেকে সম্পূর্ণ লুকিয়ে ফেললাম। আবার একটা খসখস করে শব্দ। অর্থাৎ চিন্ময় আবার সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমিও সামনের গাছটার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু এবার ঘটল সেই বিপত্তি। চিন্ময় পায়ের শব্দ শুনে দ্রুত পেছন ঘুরে দেখল। তখনও আমি নিজেকে সম্পূর্ণ গাছের পেছনে লুকাতে পারিনি। যতটা দ্রুত সম্ভব সম্পূর্ণ শরীরটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে ফেললাম। চিন্ময়ের পায়ের কোন শব্দ নেই। ওকি বুঝে গেছে, আমি ওকে ফলো করছি। আমার বুকটা এতো জোরে ধুকপুক করছিল যে বারবার মনে হচ্ছিল যে এই বুঝি ধরা পড়ব। তবুও সামনের দিকে একবার তাকাতেই হত। খুব সন্তর্পণে আমি ডান চোখটা বাইরে বার করে সামনের দিকে তাকালাম। দেখি চিন্ময় ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে এবং মাথাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখছে। তারচেয়েও রহস্যময় চিন্ময়ের মুখের অদ্ভুত সেই হাসিটা। ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলার সময় ঠিক এরকমই মজা আমি পেতাম। ভয় লাগছে; চিন্ময়ের কাছে নিশ্চয়ই কোন অস্ত্র আছে। আমি কি আদৌ প্রানে বাঁচব? হঠাৎ চোখটা গেলো চিন্ময়ের পায়ের কাছে। একটা কফিনের মত দেখতে বাক্স, কফিনের চেয়ে আকারে হয়ত একটু বেশীই বড় হবে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম চিন্ময়ের দিকে।
চিন্ময় নিচু হয়ে মাটিতে বসে পড়ল। হ্যাঁ, যা বুঝেছিলাম ঠিক তাই ওটাই সুরঙ্গের মুখ। এক টানে কফিনের ডালাটা টান মেরে খুলে ফেলতেই ভেতর থেকে টিমটিম করা বাল্বের আলো ভেসে আসলো। আমিও সিওর হয়ে গেলাম যে ওটাই সেই সুরঙ্গ। ধীরে ধীরে সুরঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করে চিনু ডালাটা আবার লাগিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে আমিও ওই সুরঙ্গের কাছে এগিয়ে গেলাম ও একটা গাছের আড়ালে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার অন্তত ৫ টা মিনিট অপেক্ষা করা উচিত। কারন চিনু সবে সুরঙ্গে প্রবেশ করেছে। অপেক্ষার চেয়ে কঠিন কাজ বোধ হয় পৃথিবীতে দ্বিতীয় কিছু নেই। যত সময় যাচ্ছে মনের মধ্যে হাজারো জল্পনা উঁকি দিচ্ছে। চিনু কি সত্যিই আমায় দেখতে পেয়েছে? ওকি আমাকে মেরে ফেলার জন্য ফাঁদ পাতলো? কেন পেছনে কেউ আছে এটা বুঝতে পেরেও ও সুরঙ্গের মুখটা খুলে দিলো? হাজারো আশঙ্কা ও ভয় আমার মনে উঁকি দিতে শুরু করল। কিন্তু এইসব ভয়কে কাটিয়েই আমায় সামনে এগিয়ে যেতে হবে কারন আমার স্ত্রী আমার ভালোবাসা রমা এই মুহূর্তে কতগুলো জানোয়ারের কবলে পড়েছে। আমি আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। কফিনের ডালাটা তুলে ভেতরের দিকে উঁকি মারলাম। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নীচে নেমে যাচ্ছে। আর অপেক্ষা না করে আমিও সিঁড়ির মধ্যে নেমে পড়লাম। যা হবার তা হবে। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নীচে নেমে যাচ্ছে। আর ১০ হাত ছাড়া ছাড়া মাথার ওপর একটা ১০০ ওয়াটের বাল্ব। অন্তত ৫০ টা সিঁড়ি বেয়ে আমি একদম নীচে একটা সমতলে নামলাম। এটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো নয়, মাটিটা স্যাঁতস্যাঁতে, জায়গায় জায়গায় জল জমে আছে। বুঝতে পারলাম, ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেকটাই নীচে হওয়ায় মাঝে মধ্যেই চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল ওপরে ওঠে। সামনের দিকে সন্তর্পণে এগিয়ে চললাম। সুরঙ্গ যখন একটা রয়েছে বাংলোর ভেতরে প্রবেশ পথও রয়েছে। কিন্তু সেটা কোথায়? এমন কোন জায়গায় নয়তো যাতে আমি সকলের চোখে পড়ে যাই। ভয়কে দূর করে আমি এগিয়ে চললাম। প্রায় ১০০ মিটার হাঁটার পর ওপরের দিকে ওঠার একইরকম একটা সিঁড়ি।
আমার মনটা আনন্দে ভরে গেলো, অবশেষে আমি তাহলে বাংলোর ভেতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হলাম। খুব স্পীডে আমি সিঁড়িগুলোকে অতিক্রম করে ওপরের দিকে উঠতে লাগলাম। বেশ কিছুটা ওঠার পরই ওপর থেকে একটা টিমটিম করে আলোর দিশা ভেসে আসলো। আমি বুঝলাম আমি বাংলোর ভেতরে প্রবেশ করছি। আরও কিছুটা অতিক্রম করার পর বুঝলাম, সুরঙ্গের মুখটা খুবই ক্যাসুয়ালি একটা চটের বস্তা দিয়ে ঢাকা দেওয়া আছে। কিন্তু হঠাৎ করে বস্তাটা সরিয়ে ভেতরে উঁকি মারা আমার পক্ষে অনুচিত। আমি সন্তর্পণে বস্তার একদিকটা কিছুটা সরিয়ে ভেতরে উঁকি মারলাম। কোন একটা খাটের নীচে সুরঙ্গের মুখটা রয়েছে। কিন্তু কোন ঘর এটা তা সহজে বুঝতে পারলাম না। আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ বস্তাটাই সরিয়ে ভালো করে চারপাশটা তাকালাম। হ্যাঁ, এতক্ষনে আমার বোধগম্য হলো। এটা হলো সেই আলমারির ডালার ভেতরের গোপন ঘরটা। আলমারি খোলার পরই লম্বালম্বি ভাবে লাগানো দুটো খাট দেখতে পেয়েছিলাম, এটা তারই একটা। এতো আনন্দ চাকরি পাওয়ার পরও পাইনি। অর্থাৎ আর মাত্র দুটো স্টেপ; খাটের নীচে থেকে বেরিয়ে আলমারির দরজা খোলা ও রমাকে ডেকে এই পথেই আবার ফিরে যাওয়া। দ্রুত আমি উবু হয়ে খাটের নীচে বসলাম। চারপাশটা একবার ভালো করে দেখে নিলাম। না আশেপাশে কেউ নেই। পা টিপে টিপে খাটের নীচ থেকে বেরলাম।
আলমারির ডালাটা বা দরজাটা দুহাত দিয়ে ধরে টানতেই আমি আসল রহস্যটা বুঝতে পারলাম। আলমারিটা বাইরে থেকে লক করা। ইচ্ছে করলেই আমি ধাক্কা মেরে ওটা ভেঙে ফেলতে পারি, কিন্তু তাহলে তো প্রত্যেকেই বুঝে যাবে যে আমি এখানে উপস্থিত। আমি কি ফেঁসে গেলাম? চিন্ময় কি আমায় ফাঁদে ফেলে দিলো। এই গুপ্ত ঘরটা আমি ভালো করেই দেখেছি, এখান থেকে বেরোনোর অন্য কোন উপায় নেই। আমার কাছে এখন একটাই পথ, বাথরুমদুটোর সংযোগস্থলের ওই কাঁচের দেওয়ালটার কাছে যাওয়া। ওখান থেকে আমাদের রুমটা ও পাশের রুমটার বাথরুম ভালো করে লক্ষ্য করা যাবে। পা টিপে টিপে আমি ভেতরের দিকে যেতে থাকলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই আমি সেই কাঁচে ঘেরা ঘরটার কাছে গিয়ে পৌছালাম। দুটো রুমেরই বাথরুম বন্ধ এবং অন্ধকার। কিন্তু দরজার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে; অর্থাৎ দুটো রুমেই ভেতরের ঘরে আলো জ্বলছে। যদি রমা বাথরুমে এসেও যায় ওকে তো কিছু বলা বা নিজেকে দেখানো প্রায় অসম্ভব। আমার হাতপা বাঁধা, কিছুই করার নেই। জীবনে এই অবস্থায় এর আগে কখনো পড়িনি, সব দেখতে পাচ্ছি, বুঝতে পারছি অথচ কিছুই করার নেই। কাঁচের দেওয়ালে দুহাত ঠেকিয়ে অবোধের মত দাঁড়িয়ে আছি। ঈশ্বরকে ডাকি না সে প্রায় কলেজ লাইফ থেকেই। আজ প্রায় ২০ বছর পর আরও একবার ঈশ্বরকে স্মরন করলাম। ‘ভগবান তুমি যদি সত্যিই থাকো রমাকে বাথরুমে নিয়ে আসো আর ওকে যেভাবে হোক বোঝাও আমি ওই কাঁচের দেওয়ালের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি।’ কিন্তু ঈশ্বর কি আমার কথা শুনবে? ঈশ্বর তো উচ্চবিত্তের পার্সোনাল প্রপার্টি, নিম্ন ও মধ্যবিত্তের কথা শোনার সময় ঈশ্বরের নেই। কি করব কিছুই মাথায় ঢুকছে না। হঠাৎ দেখি পাশের রুমটার বাথরুমের আলো জ্বলে উঠল। ভয়ে অন্য কোথাও লুকাতে যাচ্ছি এমন সময় মনে পড়ল, ‘ধুস, আমায় তো আর কেউ দেখতে পাচ্ছেনা।’ খট করে একটা শব্দ হলো, বুঝলাম কেউ বাথরুমের দরজাটা খুলে দিলো। প্রখর দৃষ্টিতে আমি তাকিয়ে থাকলাম ভেতরের দিকে।
দরজাটা ক্রমশ ফাঁক হয়ে যেতে থাকলো। আমারও চোখের সামনে ভেতরের ঘরের কিছুটা দৃশ্য ভেসে এলো। বেশ কিছু লোক হাতে মদের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমনি আমার কপাল, প্রত্যেকেই আমার দিকে পেছন ঘুরে আছে। ঠিক কতজন লোক আছে তা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিলনা। তবে আমার নজরে শুধুই ৩ জন পড়ল। পেছন থেকে তাদের চিনতে পারা প্রায় অসম্ভব। আরও একটা অদ্ভুত জিনিষ হলো, ঘরের আলোটা অত্যন্ত লো পাওয়ারের একটা নাইট বাল্বের মত। এই জিনিষটাও যথেষ্ট রহস্যময়! এটা কি শুধুই একটা উগ্র বন্য যৌনতা সৃষ্টির জন্য? নাকি এর পেছনেও রয়েছে কোন রহস্য। হঠাৎ দেখি বাথরুমের ভেতরে এগিয়ে আসছে আমার অতি পরিচত এক ব্যক্তি। সে আর কেউ নয়, চিন্ময়। চিন্ময়ের হাতে একটা সাদা শাড়ি, এই শাড়িটা ও কি করবে? আমি এক দৃষ্টিতে ভেতরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। চিন্ময়ের মুখে একটা মিষ্টি হাসি। আমার তো সারা গা জ্বলে যাচ্ছিল। কিছুটা অদ্ভুতভাবেই চিন্ময় ঠিক আমার উল্টোদিকে এসে দাঁড়াল। মুখের হাসিটাও ক্রমশ চওড়া হতে শুরু করল। নিজের দুটো হাত ক্রমশ সোজা করে দেওয়ালের ওপর রাখল। যেন কোন সেন্সরে পাম প্রিন্ট দিচ্ছে। ওকি আমায় কোন সঙ্কেত দিতে চায়। ভালো করে লক্ষ্য করতে লাগলাম ওর হাতের দিকে। দুই হাতের আঙুল দিয়ে কি ও আমায় ১০ এই সংখ্যাটা বোঝাতে চায়। ১০ এর মানে কি? কি বলতে চায় ও। রমার ডায়েরীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ লাইন আমার স্মরনে এলো। ‘শানের ডান হাতে একটা পোড়া দাগ আছে।’ ভালো করে আমি চিন্ময়ের দুই হাত লক্ষ্য করলাম। না চিন্ময়ের দুই হাতেই কোন পোড়া কালো দাগ নেই, অর্থাৎ চিন্ময় শান নয়। চিন্ময় কাঁচের দেওয়ালের ওপর থেকে নিজের দুহাত তুলে একইরকম ভাবে আমায় ১০ এই চিহ্নটা দেখিয়ে চলেছে। ওপাশের কোন শব্দই এপাশে আসা সম্ভব নয়। লক্ষ্য করলাম চিন্ময় পেছন ঘুরে কাউকে একটা কিছু উত্তর দিলো। ওর ঠোঁটের দিকে লক্ষ্য করে বুঝলাম ‘আসছি’। এরপরে ও যেটা বোঝানোর চেষ্টা করল সেটা আরও অদ্ভুত।
দুপা জড় করে কিছুটা ১০০ মিটার রেসে ভাগার মত করে দাঁড়াল। তারপর দু তিন পা দৌড়ে দেখাল। ওকি আমায় পালিয়ে যেতে বলছে। সেটা তো আমার পক্ষে অসম্ভব। দেখলাম চিনুর মুখে কিছুটা হতাশার সুর। আর আমার দিকে না তাকিয়ে ও শাড়িটা দুহাতে ধরল। ওকি চায়? ভেতরে কি হচ্ছে তা আমি কিছুই দেখতে না পাই। হ্যাঁ, ঠিক তাই, বাথরুমের ছাদে দুখানা পেরেক গাঁথা ছিল। সেই বরাবর ও শাড়িটা ঝুলিয়ে দিলো। এর চেয়ে বেশী হতাশার আর কিছুই নেই। এতক্ষন ভেতরে কি হচ্ছে তার মাত্র ৩০% দেখতে পাচ্ছিলাম আর এখন তাই ১০% হয়ে গেলো। শাড়ির ভারের জন্যই হয়ত, দুপাশে কিছুটা ফাঁক থেকেই গেলো। আমি একদিকের ফাঁকের মধ্যে চোখ লাগিয়ে রাখলাম। বাথরুমের কিছুটা অংশ ও দরজার কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। দেখলাম পুরুষ মানুষের পা বাথরুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ চিনু বেরিয়ে গেলো। আমি আরও একবার আমার নিজের রুমের বাথরুমটার দিকে খেয়াল করলাম। না এখনো ওটা বন্ধ হয়ে রয়েছে। আরও অদ্ভুতভাবে একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম, ভেতরের ঘরের লাইটটাও অফ হয়ে গেছে। নিজেকেই দোষ দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কখন অফ হয়েছে; কেন খেয়াল করিনি। রমা আবার আমাকে বা চিনুকে খুঁজতে বাইরে বেরয়নি তো? ওর পক্ষে তো সত্যিই জানা সম্ভব নয় আমি কোথায়।
আমার বুকে কাঁপন ধরিয়ে বাথরুমের দরজার সামনে ভেসে এলো এক নারীর পা। ডান পায়ের ওপরের কালো দড়িটায় চোখ পড়তে হৃদয়টা খান খান হয়ে গেলো। রমাকে আমি ভালবেসেছিলাম, রমার জন্য পাগল হয়ে নিজের ক্যারিয়ার বরবাদ করেছিলাম। রমার জন্য জীবনে শ্বশুরবাড়িতে জামাই আদর পাইনি। নিজের মনের সাথেই যুদ্ধ করে চলেছি। না, রমা জুলি নয়, কোনমতেই রমা জুলি নয়। সেই দুটো পা ক্রমশ আমার সামনে এগিয়ে আসতে লাগলো। কিন্তু হাতের কিছুটা আর পায়ের কিছুটা অংশ ছাড়া আর কিছুই আমার চোখে পড়ল না। একটিবারের জন্য আমি এই নারীর মুখ দেখতে চাই। আমি নিজেকেই বুঝিয়ে চললাম ‘আমি ঠিকই এর মুখ দেখতে পাবো, এবং এ রমা নয়।’ হয়ত মানুষের মন সবচেয়ে দুর্বল স্থান হয়। সত্য কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়না। সত্যকে বিশ্বাস করানোর জন্য দরকার হয় একটা আঘাত। সেই আঘাতটাই হয়ত রমা আমায় দিলো। বাথরুমের মধ্যে একটা দড়ি রয়েছে। সেই দড়ির ওপর হঠাৎই একটা লাল বেনারসী শাড়ি ঝুলে গেলো। মনে পড়ে গেলো এই শাড়িটা নিয়ে আমাদের দুজনের এক টুকরো স্মৃতি। এবারের পুজায় এই শাড়িটা আমি ওর জন্য কিনছিলাম। দোকানের মধ্যেই আমাদের মধ্যে এক প্রস্থ ঝগড়া। ‘বিপ্লব, তুমি কি মনে কর আমার বয়সটা দিনকে দিন কমেই চলেছে। এই বুড়ো বয়সে আমি এই শাড়িটা পরব?’ আমারও উত্তরটা ঠিক সেরকমই ছিল ‘না রমা, আমি কিছু জানিনা, আমার এটা পছন্দ হয়েছে তোমায় এটা নিতেই হবে।’ অবশেষে রমা রাজী হয় ও শাড়িটা নেয়। আজ সেই শাড়িটাই আমাকে এক মরীচিকার মধ্যে থেকে এক টানে বার করে বাস্তবের কঠোর রুক্ষ মরুভূমিতে নামিয়ে দিলো। নিজের অজান্তেই চেঁচিয়ে উঠলাম ‘ভালোবাসার কি কোন দাম নেই? গরীব মধ্যবিত্তকে কি ভালবাসতে নেই?’ কে যেন, হয়ত আমার বিবেক, উত্তর দিলো ‘না, ভালোবাসা শুধুই টাকার।’ আমার চোখ দুটো নোনতা জলে ঝাপসা হয়ে এসেছে। বাথরুমের দরজায় দুখানা জানোয়ার দাঁড়িয়ে। পরনে লাল হাফ কাট জাঙ্গিয়া, হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকছে, এই নগ্ন শরীরটা একবার ছুঁয়ে দেখার জন্য।
রমার ডায়েরীর প্রতিটা পাতায় একটা লাইন থাকবেই থাকবে। আসলে জুলি....(ডট ডট), আসলে জুলি আমার অর্ধাঙ্গ। প্রায় শখানেকবার এই লাইনটা আমি পড়েছি। কিন্তু একবারের জন্যও মনে হয়নি রমাই আসলে জুলি। সমাজের মাকে চুদি, বড়লোকের মাকে চুদি, যাকেই পছন্দ হতোনা মুখ দিয়ে প্রথমে তার নাম ও তারপর তার মাকে চুদি। কিন্তু ভালোবাসার মাকে চুদি, নাহ এই কথাটা মুখ দিয়ে কখনো বেরয়নি। আজ যখন কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তখনও নয়। কিকরে বেরোবে? বঞ্চিত বানচোদদের জীবনে তো এক টুকরো ভালোবাসা এক টুকরো হীরের চেয়েও দামী।
 
১৪

হামাগুড়ি দিয়ে ততক্ষণে ভেতরে চলে এসেছে সেই দুই জানোয়ার। ওদের শরীরের একাংশ ও জুলিরুপী রমার শরীরের একাংশ আমি দেখতে পাচ্ছি। দুজনে লম্বা একটা জিভ বার করে রমার পায়ের পাতা থেকে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। যৌন আচরন কিছুটা শান্তনু ও সেই লোকটি (যার রিষ্ট ওয়াচ আমার খুব চেনা) তাদেরই মতন, হয়ত তারাই। রমা কিছুটা অবজ্ঞার সুরে নিজের পাটা পেছনদিকে টেনে নেয়। এটাও বেশ ভালোই বুঝতে পারছিলাম রমা হয় নগ্ন নয় স্বল্পবসনা। অন্য এক পুরুষের এক জোড়া হাত আমি দেখতে পেলাম। সজোরে দুজনকেই টেনে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার ডান হাতের ঠিক কনুইটার নীচে লক্ষ্য করলাম কালো পোড়া একটা দাগ। এই শান, এর গলা কিছুক্ষন আগে আমি শুনেছি। মনে মনে কল্পনাও করেছি তাকে। সে আমার অতি পরিচিত, কিন্তু কোন প্রমান নেই যে তিনিই আসলে শান। যথাসাধ্য চেষ্টা চালালাম তাঁর মুখটা একবার দেখতে। কিন্তু কিছুতেই পারলাম না। চিনু পর্দাটা এমনভাবে টাঙিয়েছে যে কারুরই মুখ সম্পূর্ণভাবে আমি এখনো দেখতে পাইনি। একটা প্রশ্ন বারবার মনের মধ্যে আসতে লাগলো। চিনু কেন পর্দাটা টাঙাল? এর চেয়েও অদ্ভুত চিনুর ব্যাবহার। মোট দুখানা সম্ভাবনা রয়েছে এই মুহূর্তে আমার মস্তিস্কে।
১)চিন্ময়ই হলো পুলিশের সেই এজেন্ট। ও চাইছে আমার হেল্প করতে। সুড়ঙ্গের মুখ দেখানো থেকে কিছু সঙ্কেত দেওয়া প্রতিটা ক্ষেত্রেই এটা স্পষ্ট যে চিনু আমার সাহায্য করছে।
২)চিন্ময় পুলিশ নয়, বিজয়দার লোক। বিজয়দাই এই ষড়যন্ত্রের আসল মাথা। এবং রীতিমত প্ল্যান করে চিন্ময় আমায় আরও বড় বিপদের মুখে ফেলে দিতে চাইছে।
দুটো সম্ভাবনা সম্পূর্ণ বিপরীত। তাই গুরুমস্তিস্ক সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়ে যাচ্ছে। এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন; কাঁচের ওপর পর্দা কেন টাঙ্গানো হলো? ওই দুটো জানোয়ার তো রমার শরীরটা এর আগেও কাঁচের ওপাশ থেকে দেখে বিকৃত যৌন আচরন করেছে। ওরা সবাই কি জানে আমি এইপারে আছি? নাকি জুলি ও শানের মুখটা শুধুই অল্প কয়েকজনের জানা; হয়ত ওই ষণ্ডামার্কা লোকদুটো জুলি বা শানকে স্বচক্ষে দেখেনি। তাই হয়ত এই ব্যাবস্থা।
হাজারো প্রশ্ন ও রহস্যের পারমুটেশন মাথার মধ্যে কিলবিল করতে শুরু করে দিলো। দেখলাম স্নানের জন্য রমা বাথরুমে আসেনি। বরাবরের অভ্যেস ওর শরীরকে পুরুষ মানুষের হাতে সঁপে দেওয়ার আগে একটাবার গায়ে জল দেওয়া। রমার ওই স্মৃতিবিভ্রাট থেকে নিষ্পাপ ব্যাবহার; সবই আসলে ছলনা। রমা শুধুই যৌন বিকৃতির প্রতীক। তোয়ালে দিয়ে শরীরটা মুছে নেওয়ার পরই দড়ি থেকে লাল বেনারসি শাড়িটা পাড়লো রমা। তখনই বুঝলাম; এতক্ষন ও তাহলে সত্যিই নগ্ন ছিল। আরও অদ্ভুত লাগলো; সামান্য কোন অন্তর্বাস দেখতে না পাওয়ায়। নগ্ন শরীরে লাল বেনারসী শাড়ি, এও বোধ হয় বিকৃত যৌন লালসার অংশ। গায়ে শাড়িটা জড়ানোর সাথে সাথেই ভেতরের ঘরের সাদা টিউবটার বদলে নীল নাইট ল্যাম্পটা জ্বলে উঠল। এবার শুরু হবে আমার বিয়ে করা বউকে নিয়ে সমাজের কিছু অসুস্থ কৃমির যৌন অজাচার। প্রথম যখন চাকরিটা জোগাড় হয়েছিল মাইনে ছিল ৮০০০। অফিসে ঢোকার আগে একটা বিড়ি আর বেরোনোর পর একটা বিড়ি; ব্যাস এই ছিল আমার হাত খরচা। টাকা বাঁচানোর জন্য ফেরার সময় অফিস থেকে বাড়ি অবধি ১০ কিলোমিটার রাস্তাটা পায়ে হেঁটেই পার করে দিতাম। একফোঁটা কষ্ট হতোনা, বাড়ি গিয়ে যখন দেখতাম রমা না খেয়ে আমার জন্য হাসিমুখে অপেক্ষা করছে, মনে হত আমিই বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
হৃদয় যখন ভাঙে, তখন মানুষ জানোয়ার হয়ে ওঠে। যদি কাঁচের দেওয়ালটা ভাঙতে পারতাম! হয়ত রমাকে পিটিয়েই মেরে ফেলতাম! আজ এই মুহূর্ত থেকে রমা আর আমার কেউ নয়। ভ্রান্ত পৃথিবীতে আমি আমার বস্তাপচা আইডিওলজি নিয়েই বেঁচে থাকবো। রমা নিজেকে নষ্ট করে অন্তত আমার জীবনটা ফিরিয়ে দিলো। আজ প্রায় ১০ টা বছর প্রতিটা মুহূর্তে বাবাইয়ের মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করেছি। আফসোস করেছি, নিজের ইগো নিয়ে না থেকে যদি সত্যিই বসের পোঁদটা চাটতে পারতাম! যদি আর একটু বেশীই প্রমোশন পেতাম! হয়ত ছেলেটাকে ঠিকই বাঁচিয়ে ফেলতে পারতাম। কেন সেই কলেজ লাইফের বস্তাপচা তত্বটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি! কি পেলাম, এই থিওরি চুদিয়ে? শুধুই উপহাস। না উপহাসও হয়ত অনেক সুখের। আমি তো নিজেরই বিবেকের কাছে নীচ হয়ে গেছি, পরের উপহাসের চেয়েও দামী। একবার নিজের মনেই হেসে উঠলাম। শালা, আমিই ঠিক। রমা কোনদিনই মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি। নয়ত বারবার বাবাইয়ের মৃত্যুর জন্য আমায় দায়ী করে? চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছিল, রমা তোমার হাতে মাস গেলে যে ৯৩০০ টাকাটা তুলে দিতাম তার মুল্য তুমি বুঝলেনা। অতিরিক্ত ১৩০০ টাকাটা রোজগার করতে আমার ফেটে যেত রমা। অফিস থেকে ছাড়া পেতাম সন্ধ্যে ৮ টায়। তারপর হেদুয়ায় গিয়ে টিউশন করে আবার কসবায় ফিরে যাওয়া। রমা তোমার মৃত্যু কামনা করি আমি। রমা, তুমি একটা মানুষকে ১৫ বছর ধরে প্রতিদিন খুন করে গেছো। তার শরীরে প্রতিদিন বিষ ঢুকিয়েছ। রমা আজ থেকে আমার কেউ নয়।
চোখটা ঝাপসা হয়ে এসেছে। সামনের দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করছিলনা। ভেতরের টিমটিমে আলোর মধ্যে থেকে ভেসে আসছে কয়েকটা জানোয়ারের উন্মত্ততা। আমি কি করব? কি নিয়ে বাঁচব? কিভাবে বাঁচব? রমাকে কি করে ভুলবো? দেওয়ালে মাথাটা ঠুকেই চলেছি, জানি কেউ দেখতেও পাচ্ছেনা বুঝতেও পারছেনা। হৃদয়ের মধ্যে কোন এক কোনে কেউ একজন লুকিয়ে বলেই চলেছে ‘বিপ্লব, মানুষ যা দেখে তা সবসময় সত্য হয়না। হয়ত একটা কিছু মিরাকেল ঘটবে।’ শালা গরীব, মধ্যবিত্তের জীবনে মিরাকেল! এর চেয়ে বড় উপহাস আর কিছুই হয়না। জীবনের প্রতিটা সমস্যার বিশ্লেষণেই চলে আসে গরীব, মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত। কেন আমি এখনো সেই বস্তাপচা তত্বটাকে আঁকড়ে ধরে আছি, গোটা পৃথিবী ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। আমি কি এই সমাজ, জীবন, সভ্যতা এদের থেকে অনেক অনেক পিছনে। কিছুই জানিনা, বারবার মন চাইছে দ্রুত এখান থেকে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু কে যেন আমার পা টা আঁকড়ে ধরে কেঁদে চলেছে আর কাতর স্বরে অনুরোধ করে চলেছে ‘বিপ্লব, তোর জীবনে ভুলের ইয়ত্তা নেই। এখান থেকে এক পা বাইরে বেরোনোর অর্থ তোর জীবন থেকে রমা শব্দের মুছে যাওয়া।’ নিজের সাথেই লড়ে চলেছি, আপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছি, কিন্তু পারছিনা। ‘বিপ্লব তোর এই শ্রেনীদ্বন্দের তত্ব দিয়ে জীবন বোঝা যায়না। বিপ্লব একটা মিরাকেল ঘটবেই।’ কে বলছে কথাগুলো, একি আমার বিবেক! নিজের মনটা শক্ত করে দিয়ে যতটুকু ফাঁক দিয়ে ভেতরের দিকে চোখ রাখা যায় রাখলাম। শুধুই দুজন লাল জাঙিয়া পরা জানোয়ার মেঝেতে হামাগুড়ি দিচ্ছে, মুখের অভিব্যক্তি পশুসুলভ। মানুষের হৃদয় বীভৎসরকম দুর্বল। আমি জানি পায়ের ওই কালো দড়ি, লাল কাপড় সবকিছুই এটাই প্রমান করে রমাই জুলি; কিন্তু এটাও তো সত্য যে আমি জুলির মুখটা এখনো দেখিনি। না, একবারের জন্য হলেও আমি ওর মুখটা দেখতে চাই; জানি মিরাকেল কিছু ঘটবে না; কিন্তু আমিও চাইনা আবেগের কোন পিছুটান থেকে যাক। আমার অনেক কাজ; শ্রেনীবিভক্ত সমাজের লড়াই, আমার এনজিও, আমার অনেক কাজ।
আলমারির দরজাটা খট করে খোলার একটা শব্দ হলো। এবার আমি কি করব? কোথায় লুকাব? আমি মারা গেলে আমার এনজিওর কি হবে? যে মানুষগুলোকে এতো স্বপ্ন দেখিয়ে ফেলেছি তাদের কি হবে? অথচ লুকিয়ে যাওয়ার সুযোগটুকুও নেই। কাঁচের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে জড় বস্তুর মত নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। জুতোর খটখট শব্দ হচ্ছে, এবং সেই শব্দ ক্রমশ এদিকেই এগিয়ে আসছে। হাতের কাছে কিছুই নেই। লড়াই করতে গেলে একটা অস্ত্র তো দরকার। জুতোর আওয়াজটা অনেকটাই ফিকে হয়ে গেলো এবং তার জায়গায় ভেসে আসতে লাগলো একটা গোঙানির আওয়াজ। এই গোঙানি কোন নারীর। ওরা আমাকে ফাঁদে ফেলার জন্যই কি এরকম করছে? আমি একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এবার সেই গোঙানির সাথে ভেসে আসলো ‘বিপ্লব’ ‘বিপ্লব’ বলে জড়ানো একটা শব্দ। কে কাঁদছে? রমা? নামটা মুখে নিতেও লজ্জা করছে। ও তো রমা নয় ও জুলি। একইভাবে আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। ‘বিপ্লব আমার খুব ভয় লাগছে।’ বুকটা একটু হলেও কেঁপে উঠল; একেই তো একদিন ভালোবেসে ক্যারিয়ারের গাঁড়টা মেরেছিলাম। ‘বিপ্লব আমায় বাঁচাও!’ না আর নিজেকে সংবরন করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলনা। মরলে মরব তবুও যাকে ভালবেসেছি তারই হাতে মরব! আমি ভেতরের ঘরটার দিকে দৌড়াতে শুরু করলাম। সেই পুরনো সালোয়ারটা পরে রমা এক কোনে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। হাতে দুটো ভারী ব্যাগ। আমি কি আর রমাকে ভালবাসিনা? কেন বারবার মনে হচ্ছে সবই রমার ছলনা! কেন আমি দৌড়ে যাচ্ছিনা ওর কাছে, কেন ওকে বলছিনা ‘রমা, একদম টেনশন করবে না! দেখো ডাক্তার তোমায় টেনশন করতে বারন করেছে না?’ কেন ওর মাথায় হাতটা রেখে ওর মাথাটা নিজের বুকে লুকিয়ে নিচ্ছিনা। আমি কি নিজের ভালবাসাকেই হারিয়ে ফেললাম।
আমি রমার কাছে যাইনি। রমাই আমায় দেখতে পেয়ে ভারী ব্যাগদুটো নিয়ে এঁকে বেঁকে এসে আমায় জড়িয়ে ধরল। ‘বিপ্লব, পালিয়ে চল। এখানে ডাকাত এসেছে। বিপ্লব পালিয়ে চল, এখানে ডাকাত।' আমি ওর দুই চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। সত্যিই কি রমা নিষ্পাপ? নাকি রমা হলো সেই জুলি যে প্রতি মুহূর্তে এই সমাজটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে। নিমোনিয়া রুগির মত রমা কেঁপেই চলেছে। আমার কিছুই ভালো লাগছিল না। কিন্তু রমাই হোক আর জুলিই হোক সে তো মানুষ আগে। এক মানুষ আমার কাছে প্রান ভিক্ষা চাইছে। আমরা দুজনেই ধীরে ধীরে সুড়ঙ্গটার দিকে এগিয়ে চললাম। শক্ত করে রমা আমার কাঁধটা জড়িয়ে আছে, কিন্তু আমি ওকে স্পর্শ করিনি। একই কথা বারবার করে রমা বলে চলেছে ‘পালিয়ে চল, ডাকাত।’ হ্যাঁ, অতিরিক্ত মানসিক প্রেসারে এটাই ওর স্বাভাবিক লক্ষন। অন্যদিন হলে হয়ত ওকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য আমি ক্লাউন সাজতেও পিছপা হতাম না। কিন্তু আজ কিছুই ভালো লাগছেনা। এমনকি ওই কাঁচের দেওয়ালের বাইরে থেকে জুলি কে, এই রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টাও আমি করিনি। অবশেষে আমরা আবার জঙ্গলের মধ্যে এসে উঠলাম।
রমা তখনও শক্ত করে আমার কাঁধটা চেপে আছে, প্রচণ্ড জোরে কাঁপতে কাঁপতে বিড়বিড় করে চলেছে ‘পালিয়ে চল ডাকাত।’ আমি জড় বস্তুর মত স্ট্যাচু হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। কৌতূহল ওর প্রতি নয়, নিজের প্রতি বেশী হচ্ছে। আমি কি আর সত্যিই রমাকে ভালবাসতে পারবো না। আজ থেকে কি প্রতি মুহূর্তে আমার মনে একটা সন্দেহের বীজ ঢুকে যাবে ‘রমাই কি জুলি?’ রাগ হচ্ছিল; রমার ওপর, নিজেরও ওপর। আমার সামনে দাঁড়িয়ে রমা, দুহাতে আমার জামার কলারটা চেপে ধরে কেঁপে কেঁপে বলেই চলেছে ‘পালিয়ে চল, ডাকাত।’ আমার আর সহ্য হচ্ছিল না। দুহাত দিয়ে প্রচণ্ড জোরে ওর গালদুটো চেপে ধরলাম। ওর মনে ভয়টা আরও বেড়ে গেলো। কাঁপতে কাঁপতে আবার বলে উঠল ‘পালিয়ে চল, ডাকাত।’ আর পারলাম না নিজেকে সংবরন করতে। জীবনে কখনো রমার গায়ে হাত দিইনি। এতো জোরে যে আমি রমাকে কখনো চড় মারতে পারবো স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। রমা ছিটকে গিয়ে ঝোপের মধ্যে পড়ল। চিৎকার করে উঠলাম আমি ‘রমা, তুমি তো আমাকেই বিষটা আগে খাওয়াতে পারতে! রমা তুমিই জুলি, আমি জানি তুমিই জুলি। তোমাদের এই নোংরা চক্রটার ব্যাপারে যারাই জেনেছে, তুমি তাদেরকেই সরিয়ে দিয়েছ। আমায় কেন মারলে না, রমা?’ রমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ নেই, শুধু ওর শরীরটা থরথর করে কেঁপে চলেছে। মাটির ওপর উবু হয়ে বসে আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। রমার ঠোঁটটা কেটে টিপ টিপ করে রক্ত ঝরছে। আমি কি জানোয়ার হয়ে গেছি? আমার কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কিছুতেই হাতটা রমার দিকে যাচ্ছেনা।
আবার রমাকে প্রশ্ন করলাম ‘রমা, তুমি কে? কেন তুমি কখনো রঞ্জন, কখনো বা চিন্ময়ের গায়ে ঢলে পড়ো? রমা তুমি কে? কেন তুমি পরপুরুষের সামনে বেশ্যার মত নিজের শরীরকে এক্সপোজ কর, কি মজা পাও তুমি? ভালো লাগে নিজের স্বামীকে চাপরাশি পরিচয় দিতে?’ জানি আমার গলার যা তীব্রতা তাতে এতক্ষনে জঙ্গলের বাইরে পাহারায় থাকা দুই গুণ্ডার কাছে খবর চলে গেছে। আমাদের বেঁচে থাকার কোন উপায় আর নেই। শুধু মরবার আগে একবার জানতে চাই, রমা কি সত্যিই জুলি? রমার ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠল, ভালো করে কান পাতলাম। ‘ডাকাত’ এই একটাই শব্দ ওর মুখ দিয়ে বেরোল। আর সত্যিই পারলাম না, এতটা অভিনয় রমা করতে পারেনা। আমার নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে। দুহাত দিয়ে রমাকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিলাম। আমার হাতের সেই ছোঁয়ায় স্নেহের উষ্ণতা পেতেই রমা ডুকরে উঠল। ক্রমশ রমার পিঠে হাত বুলিয়ে গেলাম। নিজের অজান্তেই প্রশ্ন করে ফেললাম ‘রমা, তোমায় কে বলেছে, ডাকাতের কথা?’ আবার রমা ডুকরে উঠল ‘আমার কিচ্ছু মনে নেই। আমায় আর মেরো না বিপ্লব। আমার সত্যিই কিচ্ছু মনে নেই।’ শালা ছেলেটা মরবার সময়ও নিজেকে দাগী ক্রিমিনাল মনে হচ্ছিল, ব্যাঙ্কে যখন কোন গরীব মানুষ বিপদে পড়ে লোণ চাইতে আসে ও আমি না বলি তখনও মনে হয় আর আজকে নিজেকে সত্যিই একটা রেপিস্ট মনে হচ্ছে। আমি কি জানোয়ার? কি করছি আমি? আমি রমাকে অবিশ্বাস করছি!
নাহ, রমাকে যেভাবে হোক বাঁচিয়ে এখান থেকে বার করতে হবে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রমার হাতটা ধরে হাঁটতে থাকলাম। রমা জুলি হোক বা না হোক ও আমার। ও যদি সত্যিই জুলি হয় তাহলে ওরই হাতে বিষ খেয়ে আমি মরতে চাই। জীবনটা যাকে একদিন সঁপে দিয়েছি, ফেরত চাওয়ার কোন অর্থ নেই। ফোনটা ভাইব্রেট মোডে ছিল, প্রায় ৫ মিনিট ধরে ফোনটা কেঁপে চলেছে, বার করার ইচ্ছে করেনি। এবার বার করলাম; দেখি বিজয়দার ফোন। ওকে তো বিশ্বাস করতেই হবে কারন ওর কথা মত আমাদের সত্যিই কোন ক্ষতি হয়নি।
‘কোথায় আছেন এখন?’
‘আমরা জঙ্গলের মধ্যে’
‘ওকে, বড় রাস্তার মোড়ে একটা গাড়ি পাবেন, সেটায় উঠে যাবেন। গাড়িতে উঠুন, আবার ফোন করছি’।
২০-৪০ সেকেন্ডের কথোপকথন অথচ নতুন করে জীবনটা আবার ফেরত দিয়ে দিলো। জঙ্গল অতিক্রম করে যখন বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালাম, দেখি সত্যিই একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে গাড়ির দরজাটা খুলে দিলো সে। গাড়িতে দুজনেই চেপে বসলাম, মুহূর্তের মধ্যে গাড়িটা ওখান থেকে বেরিয়ে গেলো। আবার বিজয়দার ফোন।
‘গাড়িতে চেপেছেন তো?’ আমি ক্যাজুয়ালি ‘হুম’ বলে একটা উত্তর দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা উদ্বেগের সাথে ওনার কতগুলো প্রশ্ন ভেসে এলো। ‘আপনি জুলিকে দেখেছেন? শানকে দেখেছেন? কোন এভিডেন্স মানে এই ফটো বা ভিডিও টাইপের কিছু তুলতে পেরেছেন?’ আমার আর এইসব সত্যিই ভালো লাগছিলনা। কে জুলি? কে শান? কে খুন করছে? কেন করছে? এইসব আমার মাথায় আর নেই। আমার দু চোখ রমার দিকে। ঠোঁটটা বেশ ফুলে উঠেছে। উদাস মনে রমা জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে। একটাই কথা নিজের মনে ভেবে চলেছি ‘কি করে আমি রমাকে এরকমভাবে মারলাম? আমি কি জানোয়ার?’ বিবেকের দংশন যে কি তা এর আগে বহুবার আমি বুঝেছি; আবার একবার বুঝলাম। বিজয়দার ওই একই প্রশ্নগুলো ভেসে এলো। এবার সত্যিই উত্তর দিতে হত। কিছুটা অবজ্ঞার সুরে আমি বলে উঠলাম ‘আমি জুলি, শান কাউকে দেখতে পাইনি। শুধু প্রান বাঁচিয়ে ফিরে আসছি।’ বিজয়দা যে কোনোদিন আমার সাথে এভাবে ব্যাবহার করবে তা আমি জীবনেও ভাবতে পারিনি। তারস্বরে চিৎকার করে বলে উঠলেন ‘দেখতে পাননি মানে? বললেই হলো। এতো কষ্ট করে একটা মাস্টারপ্ল্যান বানালাম আর আপনি সমস্ত কিছুতেই জল ঢেলে দিলেন। আমি চার্জশিট কি করে বানাবো? আমি আপনাকে কেন পাঠালাম? আপনাকে কেউ সন্দেহ করবেনা, ওরাও অতিরিক্ত সতর্ক হবেনা, ও আপনি কিছু এভিডেন্স নিয়ে আসবেন।’ ওনাকে মাঝপথেই থামিয়ে আমি বলে উঠলাম ‘বিজয়দা, আমার মানসিক অবস্থাটা যদি আপনি বুঝতে পারতেন? কোনরকমে রমাকে বাঁচিয়ে ফিরছি।’ আবার প্রচণ্ড জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন বিজয়দা ‘রমাকে আপনি বাঁচিয়েছেন? আপনার ক্ষমতা আছে, ওদের হাত থেকে রমাকে বাঁচানোর? আপনি বেঁচেছেন শুধু আমার জন্য। আমার ইনফরমারই আপনাকে বাঁচিয়েছে।’ মনেমনে বললাম ‘আপনার ইনফরমার মানে ওই চিনু তাইতো?’ আবার বিজয়দা চেঁচিয়ে উঠলেন ‘কেন নিজে যাইনি জানেন? ওদের গ্রেফতার করতে কয়েক মিনিট লাগবে। কিন্তু ওই চার্জশিট। চার্জশিট প্রপার না হলে কিছুতেই সমাজের এতো ওপরের তলার লোককে গ্রেফতার করা যায়না। আপনি কোন কর্মের নয়; আপনি একটি অকর্মার ঢেঁকী।’
একেই মেজাজ বিগড়ে আছে, তারপর বিজয়দার এই ব্যাবহার। আমিও আর নিজেকে সংবরন করতে পারলাম না। চেঁচিয়ে বলে উঠলাম ‘আপনি এতো বড় বড় কথা বলছেন, অথচ সত্যি এটা যে আপনি আমায় আর রমাকে নিজের প্রমোশনের জন্যে ইউস করলেন। আপনি কি ভেবেছিলেন আমরা গিনিপিগ? যদি আমাদের কিছু হয়ে যেত? আসলে পুলিশও একধরনের গুন্ডা, খালি রাষ্ট্র তাদের গুণ্ডামি করার পারমিশন দেয়। আর চার্জসিট! এটা একটা কমেডি সিনেমা ছাড়া কিছুই নয়। আমি অন্তত ১০ টা নামকরা কেসের নাম আপনাকে বলতে পারি; যেখানে সাক্ষীদের হয় কিনে নেওয়া হয়েছে নয় খুন করা হয়েছে। আদালত কিসসু করতে পারেনি।’
প্রায় একই ভঙ্গীতে বিজয়দাও উত্তর দিলেন ‘হ্যাঁ, আমি আপনার সাহায্য হয়ত নিয়েছি, কিন্তু আপনি নিজেও জানেন এই কেসের ভিকটিমও কিন্তু আপনি। যা করেছি তা আপনাকে বাঁচাতে। এই সিস্টেমের মধ্যে থেকেও অনেক কিছু করা যায়। সিস্টেমটা শুধুই কিছু সমাজবিরোধী নয় আপনাদের মত তাত্বিক সিস্টেমবিরোধীদের জন্যও পচন ধরছে।’ বিজয়দার শেষ লাইনটা শুনে খটকা লাগলো আমার মনে। চুপ করে গেলাম। আবার বিজয়দা বললেন ‘আমি আপনাকে আগেই বলেছি, নিজেকে শারলক হোমস ভাবা বন্ধ করুন। মনে রাখবেন গোয়েন্দাগিরিটা আমার পেশা।’ শুধু যে বিজয়দাই আমায় কথা শুনিয়ে যাবে আর আমি শুনে যাবো তা হয়না। ‘বিজয়দা, আপনিও কিন্তু ঘুষ নেন। স্বীকারও করেছেন আমার কাছে। তাহলে?’ কিছুটা অবজ্ঞার হাসি হেসে বিজয়দা উত্তর দিলেন ‘তাহলে আপনার সন্দেহের তালিকায় আমিও প্রবেশ করেছি মিস্টার শারলক হোমস, তাইতো?’ বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকলাম। আজকে সত্যি বহুবার আমি নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রন হারিয়েছি। আমার জীবনে যে আনসল্ভড রহস্যগুলো রয়েছে তা সল্ভ করতে বিজয়দার সাহায্য প্রতি মুহূর্তেই আমার দরকার। জানি আমি ভুল করছি। নিজেকে সংশোধন করলাম। গলাটা অনেক নামিয়ে বললাম ‘বিজয়দা, আমি সত্যিই আপনাকে নিজের দাদার চোখে দেখি। কিন্তু দাদা, একটা সত্যি কথা বলুন। আপনি কার দিকে?’ একটা মুচকি হেসে বিজয়দা উত্তর দিলেন ‘আমি আমার প্রফেশনের দিকে। আমার কাছে আদর্শ, আঁতলামি, ক্ষোভ, বিক্ষোভ এগুলোর চেয়ে বাস্তব অনেক অনেক বেশী দামী। তাই আমি শুধুই চার্জশিটে বিশ্বাস করি। একটা পাওয়ারফুল চার্জশিটই সবকিছু।’ আমার কাছে উত্তর দেওয়ার মত কিছুই ছিলনা। চুপ করে বসে থাকলাম। নীরবতাটা বিজয়দাই ভঙ্গ করলেন। ‘দাদা যখন ভাবেন তখন একটা কথা মনে রাখবেন, দাদা-ভাইয়ে লড়াই হয় ঝগড়াও হয়।’ ওফ সত্যি এই কথাটাই দরকার ছিল। মনটা একদম হাল্কা হয়ে গেলো। আমি প্রায় হেসেই দিলাম। বিজয়দাও হেসে উঠলেন।
‘শুনুন বিপ্লববাবু, পুলিশ হিসেবে নয় দাদা হিসেবে দুটো কথা আপনাকে জানাই। যে জঙ্গলের মধ্যে আপনি রমাকে চড়টা মারলেন, সেখানেই আমার ৩ জন অফিসার লুকিয়ে আছে। রমা জুলি নয়। আমি এক মহিলাকে সন্দেহ করি। তিনিই জুলি। আজই হয়ত জুলি কে এই রহস্যটা সমাধান হয়ে যেত, যদি সত্যিই আপনি আমায় দাদা বলে ভেবে থাকতেন। আপনি আমায় বিশ্বাস করতে পারেননি এটাই আমার কষ্ট অন্য কিছু নয়। আর দ্বিতীয় কথাটা হলো, আপনি শারলক হোমস নন আপনার চেয়ে পুলিশ অনেক বেশী ইনটেলিজেন্ট, নিজেকে শারলক হোমস ভাবা বন্ধ করুন।’ আমি আবার হেসে উঠলাম, এই হাসির মধ্যে যে কি তৃপ্তি রয়েছে তা বিজয়দাও বোঝেন। মুখ দিয়ে একটাই কথা বেরোল ‘অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা’। একটু হেসে বিজয়দা উত্তর দিলেন ‘আমি শুধুই চার্জশিটে বিশ্বাস করি’। বিজয়দা ফোনটা রেখে দিলেন।
একরাশ কালো মেঘ কোথায় যেন উড়ে গেলো। সবার আগে রমার মুখের দিকে তাকালাম। জানি আমি যে ওকে চড় মেরেছি সেটাও হয়ত ওর আর মনে নেই। নিজেকে বিশাল বড় একটা জানোয়ার মনে হচ্ছিল। রমার কপালের ওপর একটা চুলের গোছা এসে পড়েছিল। হাত দিয়ে সরাতেই রমা আমার দিকে তাকাল। ওর মুখে জোর করে বসিয়ে দেওয়া একটা হাসি। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরলনা শুধুই মনেমনে বিড়বিড় করলাম ‘আমায় ক্ষমা করে দিও রমা, আমি সত্যিই জানোয়ার নই।’ মাত্র দুখানা প্রশ্ন, যদি এর জবাবটা পেতাম, সমস্ত কিছুই আমার কাছে পরিস্কার হয়ে যেত। একবার চেষ্টা করেই দেখিনা। রমার দিকে তাকিয়ে হাসিহাসি মুখ করে বললাম ‘রমা, সোনা আমার। প্লিস একটু ভাববার চেষ্টা কর। তোমায় আমি এবার পুজায় একটা লাল বেনারসি শাড়ি দিয়েছিলাম। ওটা কোথায়? তুমি কি কাউকে দিয়েছ?’ রমা জানলার দিকে তাকাল আর কিছুক্ষন পর আমায় বলল ‘ঠিক মনে পড়ছে না, তবে মনে হয় আলমারিতেই আছে।’ না এরও উত্তর পেলাম না। আলমারিতে তো রমার সব কাপড়ই থাকে। আলাদা করে এই কাপড়টার কথা ওর মনে নেই। দ্বিতীয় প্রশ্নটা ছিল, ‘মধুকর ভিলায় যে ডাকাত রয়েছে, এই কথাটা রমাকে কে বলেছে?’ না ওকে আর ওটা জিজ্ঞেস করলাম না। জানি ও উত্তর দিতে পারবেনা। নিজের হাতটা রমার কাঁধের ওপর দিয়ে জড়িয়ে দিলাম, রমাও নিজের মাথাটা আমার বুকে গুঁজে দিলো।
দুজনেই চোখ বুজে দিয়েছিলাম। হুঁশ ফিরল ড্রাইভারের একটা প্রশ্নে। ‘কেমন আছেন দাদা? এতো রাতে বেরলেন? সকালেও তো ফিরতে পারতেন?’ গাড়ির সামনের কাঁচটায় দেখলাম। আরে এতো মনিরুল। আহা, বেচারা বেকার ছেলের ক্যান্সার হয়েছে। কদিন বাঁচবে ঠিক নেই। ওকে এনজিও থেকে অনেকবার সাহায্য করেছি। হাসিহাসি মুখ করে উত্তর দিলাম ‘আরে তুমি। হ্যাঁ, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? শরীর কেমন আছে? আর এই শরীরে এখনো ট্যাক্সি চালাচ্ছ?’ একটু হেসে উত্তর দিল ‘কি করব দাদা। যতদিন আছি সংসারটা টেনে যাই। তারপর কি হবে কেউ জানেনা!’ আমারও মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। সত্যি মানুষের কপালে যে কি রয়েছে তা মানুষ সত্যিই জানেনা।
প্রচণ্ড বেগে গাড়িটা ছুটে চলেছে দ্বিতীয় হুগলী সেতুর দিকে। আমরা প্রত্যেকেই নীরব, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত।
 
১৫

‘মনিরুল তোমার নাম্বারটা হারিয়ে গেছে। নাম্বারটা দেবে প্লিস?’ আমার প্রশ্নে মনিরুল উদাস হয়ে একবার পেছন ঘুরে দেখল। তারপর কিছুটা হতাশার সাথে উত্তর দিলো ‘দাদা, নাম্বার কেন দেবনা। তবে অনেক হেল্প পেয়েছি আপনার থেকে বিজয়দার থেকে। আর উপকার নিতে পারবো না দাদা, আল্লা আমায় তাহলে মাফ করবে না।’ খুব খারাপ লাগলো ছেলেটার কথা শুনে। একটু সামনের দিকে এগিয়ে ওর কাঁধে একটা হাত দিয়ে বললাম ‘মনিরুল, মানুষই তো মানুষের পাশে থাকে। আর তুমিই বা ভাবছ কেন আমি তোমার উপকার করার জন্য ফোন নাম্বারটা নিচ্ছি। হয়ত তুমিই আমার কোন উপকারে লেগে যাবে।’ বেশ কিছুক্ষন নীরব থাকার পর মনিরুল বলে উঠল ‘ইমানে লাগে দাদা। আর কত অন্যের দয়া নেবো। আল্লা মেহেরবান হোক। একটিবার আপনাদের মত মানুষের জন্য কিছু করার সুযোগ দিক।’ রমা চুপ করে আমাদের কথা শুনে যাচ্ছিল। আজ বহুবছর ও নিজেকে স্বাভাবিক পৃথিবী থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। মনিরুলের বাড়িতে ২ অবিবাহিত দিদি ও এক বিধবা মা। ওর ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে দিদিরা লোকের বাড়ি কাজ ধরেছে, মা সেলাই টেলাই করেও কিছু রোজগার করার চেষ্টা করে। মনিরুলের সহ্য হয়না এটা। বাড়ির একমাত্র রোজগেরে মনিরুল। তাই এই শরীরেও মাঝে মাঝে মনিরুল ভাড়ার ট্যাক্সিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মনিরুলের কথাগুলো শুনে আমিও কেমন একটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। গাড়িটা কখন যে দ্বিতীয় হুগলী সেতু পেরিয়ে এক্সাইড মোড়ে ঢুকে গেছে খেয়াল করিনি। হলুদ নিয়নের বাতিতে রাতের মহানগরী হয়ত অনেকেরই চোখে তিলোত্তমা হয়ে ওঠে কিন্তু আমার কাছে শুধুই এক বেশ্যা মাগী। এই মহানগরী কত মানুষকে দুবেলা খাবার দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে নিজের বুকে টেনে আনে, কাজ ফুরিয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলেও দেয়। আদ্যোপান্ত স্বার্থপর খামখেয়ালি বড়লোকের মেয়ের মত এই মহানগরীকে আমি ঘেন্না করি।
‘দাদা, কোনোদিন কোন প্রয়োজন হলে একটা খবর দেবেন। আজ বিজয় বাবুর ফোন এসেছিল। বলল আপনি বিশাল বিপদে রয়েছেন, গাড়িটা নিয়ে যেতে হবে। এক ডাকে চলে এলাম। দাদা, কোন প্রয়োজন হলে খবর দেবেন।’ মনিরুলের কথায় আমার হুঁশ ফেরে। একটু মুচকি হেসে আমি মনিরুলকে উত্তর দিলাম ‘মনিরুল, প্রয়োজন আছে। তাইতো ফোন নাম্বারটা নিলাম।’ আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। রাস্তার দুধারে সার দিয়ে কিছু ফুটপাথবাসী শুয়ে আছে। কিছুটা দূরে কতগুলো নোংরা ছেলে একটা চিকচিকির মধ্যে মুখ ডুবিয়ে পড়ে রয়েছে। বঞ্চিত বানচোদগুলো ৫ টাকার ডেনড্রাইটের প্যাকেট থেকেই জীবনের সব সুখ উশুল করে নিচ্ছে। প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করতে ইচ্ছে হলো ‘ওরে বানচোদরা ডেনড্রাইট ফেলে হাতে আধলা ইঁট ওঠা। যত বড়বড় দোকান দেখছিস, তাদের কাঁচের দরজায় ছুঁড়ে মার। আর চিৎকার করে বল আমরাও পড়াশুনা শিখতে চাই, মানুষ হতে চাই।’ চিৎকার করলেও কি! বানচোদগুলো কিছু বুঝতে তো পারতো না। মহানগরীর বুক চিরে গাড়িটা সামনে এগিয়ে চলেছে, আশেপাশে শুধুই সর্বহারা। শালা, সব গনতন্ত্রের দোকানের কাঁচামাল এগুলো। যতদিন এরা আছে, গণতন্ত্রও আছে।
কখন যে বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছি বুঝতেও পারিনি। মনিরুল আমার বাড়িটা আগে থেকেই চিনত। মনিরুল চলে গেলো আমরাও অন্ধকার কুয়োর মত ফ্ল্যাটের ভেতরে প্রবেশ করে গেলাম। দরজাটা বন্ধ করছি দেখি রমা পেছনে, একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আজ আমারও ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। এই অসুস্থ মেয়েটার আমি গায়ে হাত তুলেছি, ওকে সন্দেহ করেছি ওর ভালোবাসা আর আত্মত্যাগকে অপমান করেছি। নিজেকে কখনোই নায়ক আমি মনে করিনা, আমিও তো এই পচে যাওয়া গলে যাওয়া সিস্টেমটারই অঙ্গ। আমার পেশা অন্যকে লোণ দেওয়া; অথচ জীবনে কোনোদিন কোন বিপদে পড়া মানুষকে লোণ আমি পাইয়ে দিইনি। আমার ক্লায়েন্টরা প্রত্যেকেই সমাজের অনেক ওপরতলার মানুষ, আমি তাদের পোঁদ চেটে লোণ নিতে অনুরোধ করি, নিজে কমিশন খাই আর তারপর প্যাঁচ কষে তাদের থেকেই কড়া সুদ আদায় করে আমার ব্যাঙ্কটাকে বাঁচিয়ে রাখি। হ্যাঁ, আমার ব্যাঙ্কটা আমারই মত কিছু দালালের জন্য এখনো লেম্যান ব্রাদার্স হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তাতে কি; মুনাফাটা তো ৫-৬ জন ম্যানেজমেন্টের লোকই খাচ্ছে, সমাজের দেশের মানুষের তো কোন মুনাফাই নেই। অতএব আমিও একটা অসুস্থ কৃমি তা সে যত খ্যাতনামা ব্যাংকারই হইনা কেন।
রমা ধীরে ধীরে আমার শরীরের একদম কাছে এগিয়ে এলো। ট্যাক্সিতে ওকে বারবার লক্ষ্য করছিলাম, বুকের মধ্যে থেকে একটা সাদা কাগজ বার করে ৫ মিনিট ছাড়াই চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। ওকি আমায় কিছু বলতে চায়? এখনো তো পুরো রহস্যটা আমি বুঝতে পারিনি। শান কে? উত্তর আমার জানা। জুলি কে? বিজয়দা এর উত্তর জানেন তাই আমিও একদিন জেনে যাবো। কিন্তু কিছু প্রশ্ন বাতের ব্যাথার মত আমাকে বহুদিন ধরে কষ্ট দিয়ে চলেছে। কেন রমা, রঞ্জনের সামনে বা চিন্ময়ের মত একটা কমবয়সী ছেলের সামনে এরকম অদ্ভুত ব্যাবহার করে। ওকি শরীরের দিক থেকে সন্তুষ্ট নয়। আগে তো আমরা নিজেদের দাম্পত্য জীবন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতাম, কিন্তু কেন রমা এতো রক্ষনশীল হয়ে গেলো। আজ বারবার রমাকে সব কিছু খুলে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু তার আগেই রমা বলে উঠল ‘বিপ্লব আমি তোমায় কিছু কথা বলতে চাই।’ আমিও তো এটাই চাইছিলাম আজ ও মন খুলে সবকথা বলুক। তা সে যতই অপ্রিয় হোক, আমি শুনতে চাই। রমার দু কাঁধ আমি স্পর্শ করলাম। ওকে সময় দিলাম। রমা মাটির দিকে মুখ করে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রমার চোখের ভাষা আমি পড়তে জানি। আমি জানি এই মুহূর্তে ওর মনের মধ্যে একটা টাইফুন বয়ে চলেছে। কিন্তু কেন? কি এমন কথা যা ও আমার থেকে লুকিয়ে রেখেছিল আজ আবেগপ্রবণ হয়ে বলে ফেলতে চায়। আমি ওকে সময় দিতে চাইলাম। একদৃষ্টিতে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। রমার দুই চোখে ধীরে ধীরে জল জমছে, মেঘ থেকে বৃষ্টি হওয়ার মত টিপ টিপ করে সেই জল মেঝেতে পড়ছে। আহ, আবার, আরও একবার বউটার চোখে জল দেখতে হলো। আমি ওকে টেনে নিজের বুকে লুকিয়ে নিলাম। আমারই বুকে ডুকরে উঠল রমা। ওর পিঠে সান্তনার পরশ দিয়ে চলেছিলাম কিন্তু আমার মনে একটা দ্বিধা থেকেই গেলো। বারবার প্রার্থনা করতে লাগলাম ‘আর কোন অপ্রিয় সত্য আমি জানতে চাইনা।’ রমা শান্ত হলে আমি আবার প্রশ্ন করলাম ‘রমা, কোন চিন্তা করোনা। যা বলতে চাও বল।’ অনেকক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে রমা বলে উঠল ‘বিপ্লব অনেকদিন তুমি আমায় ভালোবাসোনি, আজ একটু ভালবাসবে?’ আমার মনটা আরও বিষণ্ণ হয়ে গেলো। কি এমন কথা যা রমা কিছুতেই আমায় বলতে চাইছেনা। রমার ঠোঁটদুটো ক্রমশ আমার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল।
ভালোবাসা ছাড়া যৌনতা অর্থহীন। কি রয়েছে এই দুই ঠোঁটে জানিনা। আমার ঠোঁট রমার দুই ঠোঁট স্পর্শ করলে আজও জীবনের প্রথম দিনের কথা মনে পড়ে যায়। শরীরের মধ্যে আগুনটা খুব অল্প সময়েই জ্বলে গেলো। রমাকে পেছন দিকে ঠেলতে ঠেলতে একদম সোফার ওপর নিয়ে গিয়ে ফেললাম। রমা তো নিজেকে আগেই আত্মসমর্পণ করে দিয়েছে। এই রমাকে আমি চাইনা। আমি চাই আমার রমাকে; যার শরীরে একটাবার স্পর্শ করতে হলে আমায় হাজারো সুনাম গান গাইতে হয়। ‘রমা, তোমার মত সুন্দরী আমি জীবনে কখনো দেখিনি। রমা, উফ তোমার এই দুটো ঠোঁট একবার স্পর্শ করতে আমি পাগল হয়ে যাই। জানো রমা তুমি আগের চেয়ে অনেক বেশী সেক্সি হয়ে গেছো। রমা, প্লিস আজ না বলবেনা, আমি আজ তোমার সোনায় মুখ দেবো। না প্লিস, আরে সবই তো তোমায় সুখ দেওয়ার জন্য, এতে ঘেন্নার কি আছে!’ না এই কথাগুলো কিছুতেই আমার মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে না, কারন রমার মধ্যে সেই প্রতিরোধটাই নেই। রমা মুখুজ্জে, যাকে ছুঁতে গেলে আমার কালঘাম ছুটে যেত, সেই রমাই আজ কত পালটে গেছে। আমার দুই হাত শুধুই ওর নাভিটা স্পর্শ করেছে, আর এরই মধ্যে নিজের দু পা ফাঁক করে আমায় ইঙ্গিত করছে ‘বিপ্লব যত দ্রুত সম্ভব আমার কামিজের ফাঁসটা খুলে ফেলো।’ বারবার রমার দিকে তাকাচ্ছি আর মনে মনে বলছি ‘প্লিস, রমা আমি তোমার শরীরটা ভোগ করতে চাইনা। আমি তোমায় একটু একটু করে ভালোবেসে তোমার মধ্যে প্রবেশ করতে চাই। রমা তুমি ফিরে আসো, আজ এতো বছর ধরে শুধু চেষ্টা করে যাচ্ছি আমার পুরানো রমাকে একবার ফিরিয়ে আনতে। ফিরে আসো রমা।’ আমি জানি আমার সেই পুরনো রমাকে আমি আর কোনোদিন ফেরত পাবনা। কামীজের ফাঁসে হাত দিয়ে একটা টান মারতেই কামিজটা গড়িয়ে নীচে পড়ে গেলো। ‘উম্ম’ করে একটা শব্দ বেরোল রমার মুখ দিয়ে। শরীরটা কিছুটা বাঁকিয়ে ওপরের দিকে তুলে রমা আমার মাথাটা ওর প্যানটির দিকে নিয়ে যেতে শুরু করল। এই রমাকে আমি চাইনা। এখানে শরীর আছে, উত্তেজনা আছে, ভোগ আছে কিন্তু ভালোবাসা নেই। জিভটা প্যানটির ওপর থেকেই উঁচু হয়ে থাকা যোনির দুই ঠোঁটের ওপর রাখলাম। রমার শরীরটা ভীষণ জোর দুলে উঠল।
মানুষ তো আমিও, হয়ত মন চাইছিল না কিন্তু শরীর? তাকে তো আর আটকে রাখা যায়না। আমি ঝাঁপ দিলাম অতল সমুদ্রে। এক টানে ওর প্যানটিটা আর তার সাথে নিজের প্যান্টটাও খুলে ফেলে দিলাম। রমার একটা পা ভাঁজ করে আমার কাঁধের ওপর রাখলাম। দুদিকে ছোট ছোট রোম গজানো চেরা গুদটার দিকে তাকিয়ে দেখি, ওর মধ্যে ইতিমধ্যে বিন্দু বিন্দু রস জমতে শুরু করেছে। আমারও আর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রন ছিলনা। দাঁড়িয়ে থাকা বাঁড়াটা ওর ওই নরম তুলতুলে জায়গাটায় রেখে অল্প একটু চাপ দিতেই পচাক করে আওয়াজ হলো ও প্রায় অর্ধেকটা ভেতরে ঢুকে গেলো। রমার মুখ দিয়ে একটা উম্ম উম্ম করে শব্দ আসছিল। শরীরটা শরীরের কাজ করে চলেছে কিন্তু আমার মন ও দুচোখ তখনও রমাকে দেখে চলেছে। ‘কি গোপন করছে ও আমার থেকে?’ রমার সালোয়ারটা ওপর দিকে তুলতে তুলতে একদম গলার কাছে নিয়ে চলে গেলাম। ভেতরের ৩৬ সাইজের ব্রা আর তার ভেতরের বীভৎসরকম সুন্দর দুটো দুধ দেখা যাচ্ছে। আমার হাতদুটো নিজেরই অজান্তে ব্রায়ের ভেতরে চলে গেলো। রমার মুখ দিয়ে আহহ উম্ম উম্ম করে শীৎকারটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে আর আমার ক্রমাগত থাপের ফলে মাঝে মধ্যেই আহহ অহহ করে চিৎকার ভেসে আসছে। যতই নিজেকে লুকিয়ে রাখুক, রমা আছে রমাই। নিজের শীৎকারগুলো গায়ের সেই উগ্র গন্ধটা তো আর ও বদলাতে পারবেনা। ব্রায়ের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে প্রথমে কিছুক্ষন নিপিলগুলো নিয়ে খেলা করলাম তারপর আঙুলগুলো ক্রমশ ক্লিভেজের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করলাম।
আমার আঙুলগুলো কোন এক শক্ত জিনিষে আটকে গেলো। ভালো করে অনুভব করে বুঝলাম এক টুকরো কাগজ ভাঁজ করে রাখা আছে। রমা যেন বুঝতে না পারে তাই খুব সন্তর্পণে কাগজটা ওর বুক থেকে বার করে আমার প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দিলাম। আমার মন জুড়ে এখন শুধুই প্রসন্নতা। এতদিন যে রমা আমার থেকে কিছু গোপন করেছে তা আমি খুব ভালো করেই জানি। অবশেষে আমি সেই কথাগুলো জানতে পারবো যা রমা ডায়েরিতে লেখেনা। আনন্দে নিজের শরীরটা রমার ওপর ছুঁড়ে দিলাম। পাগলের মত ধনটা ওপর নীচ করতে লাগলাম। রমাও আনন্দে চিৎকারে গোটা ঘর মাতিয়ে দিলো। ঝড় যখন থামল তখন রমা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। দুহাতে রমার শরীরটা উঠিয়ে ভেতরের ঘরে নিয়ে গিয়ে ওকে খাটের ওপর শুইয়ে দিলাম। পেছন ফিরে চলে আসছি এমনসময় রমা আমার হাতটা জড়িয়ে ধরল। আমি ঘুরে দেখি রমা উদাস হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ‘বিপ্লব জীবনে কোনোদিন যাই হয়ে যাক রমাকে ভুল বুঝবেনা। রমার জীবনে বিপ্লব ছাড়া আর কেউ নেই।’ আমি শুধুই তাকিয়ে থাকলাম। কিছুক্ষন রমাও আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো আর তারপর ক্লান্তিতে চোখদুটো ক্রমশ বুজে এলো। আমি ঘরের লাইটটা অফ করে বাইরের ঘরে চলে এলাম।
এটা ঠিক কাগজ নয় ৩ পাতার একটা চিঠি। বারবার মনটা খচখচ করছিল। কে যেন বলছিল ‘না, আজ থাক। আজ এমনিতেই হাজারো ঝড় বয়ে গেছে।’ তবুও নিজেকে সংবরন করতে পারলাম না। চিঠিটা শুরু খানিকটা এরকম।
‘প্রিয় বিপ্লব, আজও তোমায় ততটাই ভালোবাসি যতটা হাতিবাগানের রমা মুখুজ্জে বিপ্লব পোদ্দারকে ভালোবাসতো...’ এরপর ৩ পাতার একটা দীর্ঘ করুন ইতিহাস। চিঠি শেষ হয় প্রায় অনুরুপ একটা লাইন দিয়ে। ‘বিপ্লব, আমি নিজেকে চিনি। আমি কোনোদিন এই চিঠিটা তোমায় দিতে পারবোনা। কোনোদিন এটা বিশ্বাস করতে পারবোনা যে বিপ্লব রমাকে ঘেন্না করে। যদি কোনোদিন চিঠিটা সাহস করে তোমায় দিয়েও দি, আমায় বিষ খাইয়ে মেরে ফেলো। এই সত্যিটা জানার পর আমি তোমার সামনে কিছুতেই বেঁচে থাকতে পারবো না। বিপ্লব তোমাকে আজও অতটাই ভালোবাসি যতটা তোমায় সেদিন ভালবাসতাম।’ সোফায় বসেছিলাম আমি। পাশের টেবিলটা ক্রমাগত নড়ছিল, মোজাইক করা মেঝেটা ক্রমশ সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ওলট পালট হয়ে যাচ্ছিল। না ওরা তো জড় বস্তু, জীবন্ত একা আমি। তাও আজ যেন ওদেরই মত মৃত। মাথাটা ক্রমাগত ঘুরিয়ে যাচ্ছিল, কিছুতেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। কোনরকমে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। রমাকে একবার জিজ্ঞেস করব। একটাবার রমাকে জিজ্ঞেস করব ‘রমা, চিঠিতে যা লেখা আছে সব মিথ্যে না? শুধুই আমায় ভয় দেখাতে এই চিঠিটা তুমি লিখেছ তাইতো?’ ধীরে ধীরে দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম। বিছানার ওপর রমার নগ্ন শরীরটা পড়ে রয়েছে। ওর সেই সেক্সি কোমর, ৩৬ সাইজের লোভনীয় স্তন আমারই বীর্য মখামাখি করে থাকা ওর লাল টুকটুকে চেরা গুদ। হঠাৎ করে কেমন গাটা গুলিয়ে উঠল। একটা বীভৎস রকম মৃতদেহ দেখলে যেমন মনে হয় ঠিক তেমন। বাথরুমে ঢোকার সাথে সাথে সারা শরীরটা দুলিয়ে বেরিয়ে এলো একরাশ বমি। আমি যে আমার ভালোবাসার রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে ফেলেছি। চোখে মুখে ভালো করে জল দিয়ে বাইরে এলাম। এই ছাদটার তলায় আমি যদি আর এক মুহূর্ত থাকি দমবন্ধ হয়ে মরে যাবো।
আমার স্কুটারটা প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলেছে। গন্তব্য নিমতলা মহাশ্মশান। এখানেই আমি আমার ছেলেটার মৃতদেহে আগুন দিয়েছিলাম। কলকাতা শহরে এমন অনেক জায়গা আছে যা নাকি মনখারাপের রাতে বহু মানুষের গন্তব্যস্থল। কিন্তু আমার গন্তব্যটা একটু আলাদা। নিমতলার ঘাটে বসে আমি দেখি কত মানুষ তাদের প্রিয়জনের শবদেহ নিয়ে আসছে। আর তারপর গঙ্গায় ডুব দিয়ে নতুন জীবনের অঙ্গীকার, বেঁচে থাকার প্রতিজ্ঞা। ঠিক এরকমই একটা অঙ্গীকার আমিও করেছিলাম। দিনটা ছিল ২৫ শে মাঘ। রমা তখন ভাড়া বাড়িটাতেই, অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ছেলের মুখে যখন আগুনটা লাগাচ্ছিলাম ছেলের চেয়েও রমার কথাই বেশী মনে পড়ছিল। সমস্ত কাজ সেরে যখন গঙ্গায় ডুব দিলাম একটাই শপথ করেছিলাম ‘রমাকে আমি ঠিক সুস্থ করে তুলবো।’ সেদিন বিশ্বাস করিনি, অনেক পরে বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম রমা সত্যিই কোনোদিন আর সুস্থ হবেনা।
সেই গঙ্গার পাড়েই গিয়ে বসলাম। তখনও ভেতরে ধিকধিক করে একটা চিতা জ্বলে চলেছে। কয়েকটা মানুষ শ্রান্ত শরীরে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত মনে মনে বলছে যে গেছে সে গেছে কিন্তু যে আছে সে অনেক দামী। আমিও ঠিক এই কথাটাই বলেছিলাম। আজও আমাকে একটা অঙ্গীকার করতে হবে। আমি যে সমস্ত সত্যিটা জেনে গেলাম তা যেন রমা কোনোদিন না জানে। রমা অসুস্থ, মানসিক চাপ ওকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে। এভাবে কতক্ষন যে বসে আছি খেয়াল নেই। চিতার মধ্যে থেকে ফটাস ফটাস করে শব্দগুলো ভেসে আসছে। আর হয়ত একটা ঘণ্টা তারপরই এই শরীরটা এক মুঠো ধুলোয় পরিনত হবে ঠিক যেমনটা আমার ছেলে হয়েছিল। মাথার ওপর সূর্যটা ক্রমশ মাথা তুলে উঠছিল। হ্যাঁ, ভোর হয়ে আসছে। রাতের অন্ধকারের বিভীষিকা ঠেলে সূর্যদেব বেরিয়ে আসছে। আমাকেও ঠিক একিভাবে নিজের মন শান্ত করতে হবে। কিছুটা দূরে একটা চা দোকান। এক কাপ চা খেয়ে গঙ্গায় একটা ডুব দিয়ে আবার ফিরে যাবো। রমা নিশ্চয়ই এখনো ঘুমাচ্ছে। সবে চা টা বসিয়েছে। এফএমে সবে চ্যানেলগুলো চালু হয়েছে। একসময় প্রচুর এফএম শুনতাম। ঠিক ভোরের দিকের গানগুলো দুর্ধর্ষ লাগে। প্রথমে একটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ আর তারপর ভেসে এলো ভুপেন হাজারিকার সেই বিখ্যাত গানটা ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য...’ মন ভালো করে দেওয়া নতুন করে বাঁচতে শেখানোর একটা গান। সত্যিই মানুষ মানুষের জন্য। আমিও বাঁচব শুধুই রমার জন্য।
চায়ের পয়সা দিয়ে সোজা হাঁটা লাগালাম ঘাটের দিকে। প্যান্টটা খুলে শুধু জাঙ্গিয়াটা পরে জলে নামলাম। হাতদুটো জড় করে একটা প্রতিজ্ঞা ‘ঈশ্বর আমায় শক্তি দাও, ওই অসুস্থ মেয়েটার জন্য আমায় সুস্থ রাখো। যেন জীবনে কোনোদিন রমাকে কষ্ট না দি।’ ডুব দিয়ে পাড়ে উঠবো ঠিক এমন সময় অন্য আরেকজন, হয়ত এই মৃতব্যাক্তিরই কোন আত্মীয় স্নান করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, হাতে একটা রিষ্ট ওয়াচ। রিষ্ট ওয়াচের কথাটা মনে পড়তেই আমার মনে হলো কেসটা অনেকটাই সল্ভ হয়ে যাবে যদি আমি সেই চেনা রিষ্ট ওয়াচ ও সেটা কার হাতে দেখেছিলাম তা মনে করতে পারি। সেই রিষ্ট ওয়াচ, পিঠে একটা কালো দাগ এগুলো থেকে আমায় খুঁজে বার করতে হবে সেই লোকগুলোকে। জামা প্যান্ট পরছিলাম। দুজন বুড়ো মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিল। ওদেরই খোশ গল্প কানে আসতে লাগলো। ‘এই যে দুতলা বাড়ি, এতদিন ধরে মানুষ করার কষ্ট সব তো এই শর্মাই করেছে। আর আজ বুড়ো হয়ে যেতেই আমি নন্দ ঘোষ। শালা, ছেলেপুলেকে এতো কষ্ট করে মানুষ করাই উচিত হয়নি।’ আমার কানে যেন একটা চকলেট ব্যোম ফাটল। ‘শর্মা’ এই শব্দটা শুনে যেন কতদিনের পুরনো একটা রহস্য আমি সমাধান করে ফেললাম। মনে পড়ে গেলো সেদিনের কথা। শর্মাজীর গাড়ি আমাকে ওভারটেক করে দাঁড়াল। নেমে এসে নিজের পা থেকে চপ্পলটা খুলে আমার দিকে এগিয়ে দিলো এবং মুখে সেই অদ্ভুত ন্যাকামো ‘লিন দাদা, লিন। এই লিন আমার চপ্পলটা লিয়ে আমারই গালে ঠাস ঠাস করে মারুন।’ সেদিনই প্রথম ওই সোনার ঘড়িটা আমি ওর হাতে দেখেছিলাম। হয়ত তার কিছুদিন আগেই ও কিনেছিল।
শর্মার সাথে আমার প্রথম পরিচয় আমারই কেবিনে। মাস তিনেক আগে। ‘দাদা, একটা নতুন বিজনেস স্টার্ট করছি। আমাকে একটা লোণ পাইয়ে দেন, হামি আপনারটা দেখবো আপনি হামারটা দেখবেন। হি হি হি (সেই বিচ্ছিরি হাসিটা)’ সেটা প্রথম পরিচয় হলেও সাক্ষাত হয়েছিল তারও মাস দুয়েক আগে। যদিও আমি সেটাকে নেহাতই কাকতালীয় একটা ব্যাপার ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলাম।
সেটা ছিল মহাঅষ্টমীর রাত। আমি আর রমা সুরুচি সংঘের প্যান্ডেল দেখতে গিয়েছিলাম। ছেলেদের একটা আলাদা লাইন ও মেয়েদের একটা আলাদা লাইন ছিল। যথারীতি দুজনে আলাদা হয়ে পড়ি। প্যান্ডেলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আর কিছুতেই রমাকে খুঁজে পাইনি। পাগলের মত এদিক ওদিক খুঁজে অবশেষে বহুদুরে একটা দোকানের মধ্যে রমাকে দেখতে পাই। রমা দাঁড়িয়ে আছে, আর একটা লোক রমাকে কিসব বলে যাচ্ছে। আমি সামনে যেতেই সেই লোকটা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়। রমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘রমা লোকটা কি বলছিল?’ রমার উত্তর ছিল ‘আমাকে নাকি কোথায় দেখেছে, বারবার করে জিজ্ঞেস করছিল।’ সেদিন ভেবেছিলাম পাতি মাগিবাজ মাল বোধ হয়। পরে সেই শর্মাজীই আমার কেবিনে আসে। প্রথমে ভেবেছিলাম মালটাকে ভাগিয়ে দেবো। কিন্তু সব তো আর আমার হাতে নেই। অবশেষে লোণের কেসটা আমায় নিতেই হলো। ঠিক এই কারনেই আমি শর্মাজীকে কখনো বাড়িতে নিয়ে আসিনি। আমার ভিজিটিং কার্ডটাতে ল্যান্ড ফোন ও মোবাইল দুটো নাম্বারই দেওয়া থাকে। কিন্তু কেন জানিনা ও অধিকাংশ সময়ই ল্যান্ড নাম্বারটায় ফোন করত।
মনে পড়ে গেলো আরও একটা ঘটনা। সেদিন অফিস থেকে বেরচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ শর্মাজীর সাথে দেখা। কথা প্রসঙ্গে ওর ছেলের কথা উঠল। অদ্ভুত একটা কথা বলেছিল। ‘আরে দাদা, পড়াশুনা শিখলে কি হয়! আমি তো এইট ফেল আছি। আপনি জানেন হামার প্রথম বিজনেস কি ছিল; রেলের লুহা চুরি। একবার পুলিশ তাড়া করল, একদম ব্রিজের ওপর থেকে ঝাঁপ মারলাম। পিঠে এমন লেগেছিল যে এখনো দাগ রয়েছে। কিন্তু সেই শর্মা আজ কত তারক্কি করেছে লাইফে দেখে লিন।’ অঙ্কের প্রতিটা হিসেব অদ্ভুতরকম ভাবেই মিলে যেতে শুরু করল। জানি এবার সম্পূর্ণ কেসটাই আমি বুঝে ফেলেছি। মনে পড়ে গেলো বিজয়দার কথা। ‘যেকোনো কেসে পুলিশ হোক বা ডিটেকটিভ, প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত, শক্তিশালী একটা চার্জশিট। যাতে কিছুতেই আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে অপরাধীরা পালাতে না পারে।’ শুধু সন্দেহ আর কিছু সামান্য তথ্যপ্রমান দিয়ে কখনোই শর্মার মত পয়সাওয়ালাদের জেলে পোরা যায়না। আমার সবকিছু বিজয়দাকে জানানো উচিত। মোবাইলটা বার করে দেখলাম ভোর ৫ টা। নাহ, এতো ভোরে আর ওকে ফোন করতে মন গেলনা।
স্কুটারটা চালিয়ে আবার ফ্ল্যাটের দিকে যেতে শুরু করলাম। রমা যদি ঘুম থেকে না ওঠে এর মধ্যে তাহলে দরজাটা খোলাই থেকে যাবে। সত্যি খুব খারাপ লাগছিল, যতই হোক রমা সুস্থ নয়। মিনিট পাঁচেক গাড়ি চালিয়েছি হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। এতো সকালে কে ফোন করবে? ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি, বিজয়দার ফোন। রিসিভ করার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটা উদ্বিগ্ন গলা।
‘দেখুন বিপ্লব বাবু কাল যদি আপনি ওরকম ভয় না পেয়ে সঠিক তথ্য প্রমান জোগাড় করে আনতেন, আজ হয়ত এতো প্রবলেমের মধ্যে পড়তে হতনা।’ সত্যি বিজয়দাকে অবিশ্বাস করে বিশাল একটা ভুল কাজ করেছিলাম। আমি চাইলেই ওখান থেকে অনেক কিছু তথ্য জোগাড় করে আনতে পারতাম। কিছুটা সহানুভুতির সুরেই বললাম ‘কেন কি হয়েছে বিজয়দা?’ সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এলো বিজয়দার উত্তর। ‘কাল এই রাত ২ টো নাগাদ আবার একটা খুন হয়েছে। মৃতদেহ আবার দ্বিতীয় হুগলী সেতুর পাশেই পাওয়া গেছে। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো এবার খুনের স্টাইলটা একদম আলাদা। বিষ প্রয়োগ হয়নি, যদিও এখনো ময়নাতদন্ত হয়নি তবে আমি চেক করে দেখেছি, আগের মৃতদেহগুলোর মত নয়। কেসটা আরও জটিল হয়ে গেলো বিপ্লব বাবু কারন খুন হয়েছে...’ দেখলাম বিজয়দা কিছুটা থমকে গেলেন। আমি আর ধৈর্য রাখতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলাম ‘কে খুন হয়েছে বিজয়দা?’
 
১৬

বিজয়দার কথা শুনে আমার হৃদস্পন্দন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেলো। এটা কি করে হয়! আমি তো ওর গলা শুনে চিনে ফেলেছিলাম যে ওই শান। এমনকি মেকআপ লোশন দিয়ে প্রলেপ লাগানোর পরও আমি ওর হাতের কালো দাগটা চিনতে পেরেছিলাম। এটা কি করে হয়। আমাকে নির্বাক থাকতে দেখে বিজয়দাই বললেন ‘নিজেকে শান্ত করুন, বিপ্লববাবু, সত্যিই রঞ্জন খুন হয়েছে। আপনার মত আমারও সন্দেহের তালিকায় এক নম্বরে ওই ছিল। ওই যে শান তার বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রমান আমার হাতে ছিল, কিন্তু তা ওকে গ্রেফতার করার জন্য যথেষ্ট ছিলনা।’ নিজেকে কোনরকমে শান্ত করলাম। এতদিন ধরে ধীরে ধীরে আমি রহস্যের জালটা গুটিয়ে এনেছিলাম রঞ্জন তথা শানের মৃত্যুতে রহস্যের জালটা আরও জটিল হয়ে গেলো। কিছুটা আক্ষেপের স্বরেই বললাম ‘বিজয়দা, সব আমার দোষ। আমার সেদিন ওরকম আবেগপ্রবণ হয়ে ওখান থেকে চলে আসা উচিত হয়নি। আমি ওখানে থাকলে আরও কিছু তথ্য জোগাড় করতে পারতাম!’ বিজয়দা কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললেন ‘কি বলেছিলাম বিপ্লব বাবু, নিজেকে শারলক হোমস ভাববেন না। আপনার থেকে ওদের মস্তিষ্ক অনেক বেশী উর্বর। আপনাকে এই রহস্যটা আবার প্রথম থেকে ভাবতে হবে।’ বিজয়দা ফোনটা কেটে দিলো।
একটা অদ্ভুত জিনিষ আমি লক্ষ্য করলাম। রঞ্জনই যে শান এবং আমি তাকে চিনতে পেরেছি এই কথা আমি বিজয়দাকে একবারের জন্যও বলিনি। বিজয়দা বারবার দাবী করে এসেছেন যে উনি জুলি কে চিনতে পেরেছেন। কিন্তু একবারও দাবী করেন নি যে উনি শানকেও চিনতে পেরেছেন। বরঞ্চ শানকে চিনতে পারার জন্যই আমাকে আর রমাকে মধুকর ভিলায় পাঠানো। আরও একটা অদ্ভুত জিনিষ, বিজয়দার কাছ থেকে ‘নিজেকে শারলক হোমস ভাববেন না, পুলিশ আপনার চেয়ে বেশী বুদ্ধিমান।’ এই কথাটা আমি অন্তত ১০০ বার শুনেছি। কিন্তু আজ কথাটা একটু হলেও পরিবর্তিত। ‘কি বলেছিলাম বিপ্লব বাবু, নিজেকে শারলক হোমস ভাববেন না। আপনার থেকে ওদের মস্তিষ্ক অনেক বেশী উর্বর। আপনাকে এই রহস্যটা আবার প্রথম থেকে ভাবতে হবে।’- এর সাথে সাথে ফোনটা কাটার আগে এক অদ্ভুত সন্তোষজনক হাসি। কিসের সন্তোষ? আমার মত পুলিশেরও তো সমস্ত ভাবনা চিন্তায় জল মিশে গেছে। তাহলে কেন হতাশার স্থলে এই সন্তোষ। আমি যে রঞ্জনকে চিনতে পেরেছি তা কোনমতেই বিজয়দার জানা সম্ভব নয় যদি না রঞ্জন নিজে বিজয়দাকে...
আবার কেমন সমীকরনগুলো মিলে যেতে শুরু করল। এই চক্রটাকে আজ ১০ বছর ধরে আমি খুঁজে চলেছি। কখনো ব্যাঙ্কের নেটওয়ার্কে, কখনো ফেসবুকে অথবা কখনো ব্যাক্তিগতভাবে। প্রতিটা ক্ষেত্রেই বুঝেছি, মুখ্য অপারেটর শান। কিন্তু এই প্রমান আমি কখনো পাইনি যে শানই এই চক্রটার মাথায় রয়েছে। আজকে অন্তত আমি নিশ্চিত যে শান এর মাথায় নয়, এর মাথায় অন্য কেউ। যে শানকে সরিয়ে দিয়ে বিশাল একটা মিসিং লিঙ্ক তৈরি করে দিলো। সন্দেহের তালিকায় মোট দুজন। কিন্তু নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা সম্ভব নয়। স্কুটারটা নিয়ে যে কতক্ষন দাঁড়িয়ে রয়েছি সেদিকে কোন খেয়াল নেই। হঠাৎ হুঁশ ফিরল, বাড়িতে রমা একা রয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব আমায় ওখানে পৌঁছে যেতে হবে।
প্রচণ্ড বেগে স্কুটারটা চালিয়ে চলেছি আর মাথার মধ্যে দুটো নাম বারবার করে কিলবিল করে উঠছে। বিজয় সামন্ত ওরফে বিজয়দা এবং শর্মাজী। বিজয়দা সবচেয়ে বেশী রহস্যময়। আমার বাড়িতে এলেন, কিন্তু কখন এলেন তা আমি ছাড়া কেউ জানেনা। মদ্যপান করলেন, প্রচণ্ড মাতলামি করলেন। এই রহস্যটা নিয়ে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ঠিক কি ভাবছে তা আমার সামনে গড়গড় করে সব বলে দিলেন। এতদিনের অভিজ্ঞ একজন পুলিশ অফিসার কি এতটাও ভুল করতে পারেন! যতই হোক পুলিশের সন্দেহে প্রত্যেকেই থাকে। আর শর্মাজী, সেই দুর্গা পুজার দিন থেকে আজ অবধি লোকটা সত্যিই প্রচণ্ড রহস্যময়। রঞ্জনের ক্ষতি করার জন্য আমাকে একটা প্রপোসাল দেওয়া। ও কেন রঞ্জনের ক্ষতি করতে চায় তা আমি কখনো ভাবিওনি আর জিজ্ঞেসও করিনি। তাহলে কি রঞ্জনকে সরিয়ে দেওয়াটা অনেকদিন আগে থেকেই প্ল্যান করা ছিল। সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যেতে শুরু করল। এইসব ভাবতে ভাবতেই আমি ফ্ল্যাটের সামনে এসে পৌঁছালাম।
ভেতরে ঢুকে আগে টেবিলের কাছে খেয়াল করলাম। না, শান্তনু আসেনি। ওকে যদি পুলিশ জেরা করত তাহলেও অনেক তথ্য বাইরে আসত। কিন্তু ওকি আদৌ আর এই ফ্ল্যাটে ফিরবে! আমার তো মনে হয় শুধু আমার আর রমার ওপর নজরদারির জন্যই ওকে এখানে আনা হয়েছিল। লিফট দিয়ে ওপরে উঠে গেলাম। না, রমা সত্যিই ঘুম থেকে ওঠেনি। দরজাটাও তাই খোলাই ছিল। ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে আবার ফোন। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি বিজয়দা করেছে। রিসিভ করলাম।
‘বিপ্লব বাবু, মৃতদেহ সনাক্ত করতে হবে। আর মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি আপনার বাড়িতে আসছি। আপনি আর মিসেস পোদ্দার আমার সাথে যাবেন।’ আমি আর কি উত্তর দিতাম। ‘হুম’ বলে একটা শব্দ করলাম। বিজয়দাও ফোনটা কেটে দিলেন। রমাকে যত দ্রুত সম্ভব উঠিয়ে দিতে হবে। ভেতরের ঘরে গিয়ে ৩-৪ বার রমা রমা বলে ডাকতেই ওর ঘুম ভেঙে গেলো। রমার ঘুম বরাবরই খুব পাতলা। আমি ওর পাশে বসে পিঠে কিছুটা সহানুভুতির ছোঁয়া দিয়ে বললাম ‘রমা, খুব খারাপ একটা খবর আছে।’ রাতে ভালো ঘুম হয়নি, তার ওপর ওর কাঁচা ঘুমটা আমি ভাঙিয়ে দিলাম, তাই ওর চোখদুটো টকটকে লাল হয়ে রয়েছে। বেশ কিছুটা চমকে গিয়ে আমার দুহাত ধরে রমা বলল ‘কি হয়েছে বিপ্লব?’ কিছুটা নম্রভাবে বললাম ‘রমা, রঞ্জনদা খুন হয়েছে।’ রমা ডুকরে উঠল। ওকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে ক্রমাগত সান্তনা দিয়ে চললাম। রমার মুখ দিয়ে খালি একটাই অস্পষ্ট কথা বাইরে বেরচ্ছিল ‘আমার দিদিটার কি হবে?’ এই এতো বছর ধরে দিদি বোনের মধ্যে কি যে সম্পর্ক রয়েছে আমার জানা নেই। মিতা শেষ আমাদের বাড়িতে এসেছিল প্রায় ৩ বছর আগে। আমাকে বিয়ে করা থেকে শুরু করে প্রতিটা ক্ষেত্রেই মিতা নিজের বোনকে খালি খোঁটাই দিয়েছে। অথচ রঞ্জন মারা যাওয়ার পর রমার রঞ্জনের চেয়ে নিজের দিদির ভবিষ্যৎ নিয়েই বেশী দুশ্চিন্তা। ভাবলেও কেমন অবাক লাগে।
রমার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে আমি বললাম ‘রমা, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। বিজয়দা আসবেন। ওনার সাথে আমাদের যেতে হবে। ডেড বডি সনাক্ত করতে হবে।’ আমার কথা শুনে রমা কিছুটা হলেও নিজেকে শান্ত করে বাথরুমের দিকে যেতে উদ্যত হয়। আমি বিছানায় বসেই ভাবতে শুরু করি। যেদিন প্রথমবার শর্মাজী আমার কাছে এসেছিলেন আমি খুব একটা বিস্মিত হইনি। ব্যক্তিগত জীবনে উনি ভালো না মন্দ তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যাথাই ছিলনা। আমার কাছে লোণের জন্য এইধরনের ধড়িবাজ মানুষই আসেন সাধারনত আর তাদেরকেই টুপি পরানো এবং লোণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া, এই হল আমার ছোট্টখাট্টো প্রফেশন। বিশাল অঙ্কের একটা লোণ পাইয়ে দেওয়ার দাবী জানান শর্মাজী। এতে কোন অবাক হওয়ার মত ব্যাপার ছিলনা। অবাক করার ব্যাপারটা হয়েছিল তার প্রায় ১ মাস পর। একদিন শর্মাজীর ফোন আসে আমার কাছে। আমার তো তখন মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়, কারন বহু চেষ্টা করেও আমি কিছুতেই শর্মাজীর লোণটা জোগাড় করতে পারিনি।
কিছুটা ভয়েই আমি ফোনটা রিসিভ করলাম ও ওপাশ থেকে কোন কথা ভেসে আসার আগেই উত্তর দিলাম ‘শর্মাজী, সত্যি বলতে আমি এখনো লোণের টাকাটা জোগাড় করতে পারিনি। আমার কিছুদিন সময় লাগবে।’ একটা বিকট অট্টহাস্য ও ওপাশ থেকে ভেসে এলো রহস্যময় এক প্রস্তাব। ‘আরে ধুর বোকা, কে আপনাকে লোণের জন্য তাগাদা করছে। আপনার ওপর আমার ফুল বিসবাস আছে। হামি ফোন করেছি দুসরা একটা প্ল্যান লিয়ে। এতো মুনাফা দেবো যে আপনি জিন্দেগী ভর হামায় ইয়াদ রাখবেন।’ আমি তো প্রায় থ হয়ে গেছিলাম। কি এমন প্রস্তাব! শর্মাজীর পরের প্রস্তাবটা সত্যিই আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলনা। ‘রঞ্জন, আপনার সম্বন্ধী আছে?’ ওর মুখে রঞ্জনের নাম শুনে আমি সত্যিই কিছুটা চমকে উঠেছিলাম। ‘ওই শালা হারামজাদাটা আমার এক নাম্বারের কম্পিটিটর আছে। ও শালা আমার চেয়েও বড় জালী।’ রঞ্জনের ওপর রাগ তো আমার বরাবরই ছিল। রঞ্জনের দুনাম্বারি ব্যাবসাটা ঠিক কিসের ওপর তা সত্যিই আমি জানতাম না। শর্মাজীই ছিল একমাত্র উৎস যার থেকে আমি সব জানতে পারি। আমিও শর্মাকে টোপটা দিলাম। কিছুটা শর্মার সাথে গলা মিলিয়ে বললাম ‘আরে বলবেন না, এক নাম্বারের নচ্ছার লোক। আমাকে তো মানুষ বলেই মনে করেনা। ওর কোন সর্বনাশ করতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।’ সঙ্গে সঙ্গে শর্মার উৎফুল্ল হয়ে ওঠা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ‘আরে হারামিটা বেনামে ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট খুলেছে। ওর বেশির ভাগ ক্যাশ ওই এ্যাকাউন্টেই থাকে। একসাথে গরমেনট, পুলিশ সবাইকে চুনা লাগাচ্ছে। ওর কাছে কোটি কোটি টাকার ব্ল্যাক মানি রয়েছে।’ আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। আমাদের ব্যাঙ্কে যে কিছু ফেক এ্যাকাউন্ট আছে তা আমার জানা। কিন্তু সেগুলো সবই ভিভিআইপিদের। রঞ্জনও যে ফেক এ্যাকাউন্টে টাকা রাখে তা সত্যিই আমার জানা ছিলনা। আসলে এইসব ফেক এ্যাকাউন্টের ব্যাপারে সামান্য কিছু তথ্য আমার কাছে থাকলেও সেভাবে আমি বিশদে জানতাম না। কারন এগুলো সবই অফিসিয়াল লেভেলের ব্যাপার স্যাপার। আমি তো সামান্য লোণ সেক্সানের কর্মচারী।
শর্মাজীর পরের কথাটায় আমার বিচি মাথায় উঠে গেছিল। ‘কি করতে হবে তা বাদ মে বলছি। লেকিন আগে কমিশনটা জেনে লিন। পুরা ৫০ লাখের কমিশন।’ শালা বাপের জন্মে কখনো ৫০ লাখ কামাতে পারবো বলে ভাবিনি। কিন্তু এটাও জানতাম যে কাজটার মধ্যেও ৫০ লাখের রিস্ক আছে। সেই কারনে নিজেকে সংবরন করে উত্তর দিয়েছিলাম ‘টাকাটা বড় কথা নয় শর্মাজী। আগে কাজটা শুনি। আর এটা বোঝেন তো যে রঞ্জন আমার রিলেটিভ।’ একটা অট্টহাস্য আর তার সাথে সাথেই শর্মাজীর গলাটা ভেসে আসে। ‘আরে, দাদা, রিস্ক হি লিলেন না তো লাইফে কি লিবেন! শোনেন আপনাকে হামি চোরি ভি করতে বলছিনা আর ডাকা ভি ডালতে বলছিনা। আপনার কাজটা খুব সিম্পিল আছে। আপনি খোঁজ লিন, কোন নামে রঞ্জনের ফেক এ্যাকাউন্ট আছে। আর সেটা গরমেনটকে ফাঁস করে দিন। ব্যাস, কাম খতম।’ শর্মাজীর কাছে ব্যাপারটা ঠিক যত সরল ছিল আমার কাছে ততটাই কঠিন। কারন ফাঁস করতে আমার কয়েকটা মাস সময় লাগবে। কিন্তু এতে আমার ব্যাঙ্কিং ক্যারিয়ার একদম শেষ হবে। যে কাজটা এতদিন ধরে দুবেলা ভাত জুগিয়ে গেছে তার সাথে বেইমানি করার কথা ভাবতেও পারিনি। প্রথম শোনার পর থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কখনোই শর্মাজীর দ্বিতীয় প্রপোসালটা একসেপ্ট করবোনা। তা রঞ্জনের ওপর আমার যতই রাগ থাকুক না কেন। ‘দাদা, একটু শুধু মেহনত করতে হবে। কারন ওর ফেক এ্যাকাউন্টটা কলকাতা নয়, মুম্বাইয়ের ব্রাঞ্চে রয়েছে। এবার আপনার দায়িত্ব এটা যে আপনি কি করে মুম্বাইয়ের ব্রাঞ্চ থেকে ওর এ্যাকাউন্টটার হদিশ জানবেন।’ সেদিন আমি শুধু একটাই কথা বলেছিলাম ‘ভেবে দেখছি।’ মন থেকে কোনোদিনই এই কাজটা গ্রহন করতে পারিনি তাই একসেপ্টও করিনি। আমি বেচু হই আর চাপরাশি কখনো নিজের প্রফেশনের সাথে বেইমানি করতে পারবোনা।
রমা এখনো বাথরুমে। আমি শুধু ভেবে চলেছিলাম; শর্মাজীর এই দ্বিতীয় প্রপোসালটার সাথে রঞ্জনের খুন হওয়ার বেশ ভালোই যোগ রয়েছে। এমনসময় হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠল। জানি বিজয়দাই এসেছে। দরজা খুলতে যাচ্ছি এমনসময় হঠাৎই মনে পড়ল যে রমা বাড়িতে থাকা অবস্থায় এর আগে কখনোই বিজয়দা আসেনি। বিজয়দা রমাকে মাত্র একবারই দেখেছে; রমাকে দ্বিতীয় হুগলী সেতুর থেকে উদ্ধার করার সময়। যেকোনো মানুষ সে যত চালাকই হোক না কেন, শরীরের ভাষায় অনেক কিছু প্রকাশ পায়। না কথাটা আমার নয় আমার গুরু প্রদোষ মিত্তিরের। অর্থাৎ এই মুহূর্তে আমার একটাই লক্ষ্য, বিজয়দাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা ও ওনার সাথে কিছুই না বোঝার অভিনয় করে যাওয়া।
আমি দরজাটা খুলে দিলাম। হ্যাঁ, বাইরে বিজয়দাই কিছুটা গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে আসতে বলব তার আগেই উনি নিজের থেকে ভেতরে প্রবেশ করে গেলেন। দরজাটা লক করব এমন সময়েই উনি বলে উঠলেন ‘বিপ্লব বাবু সমস্ত রহস্যটা আরও জটিল হয়ে গেলো।’ আমি দরজাটা বন্ধ করতে করতে উত্তর দিলাম ‘হুম, ঠিকই বলেছেন। সেদিন যদি আমি এতটা ভুল না করতাম!’ সঙ্গে সঙ্গে বিজয়দা উত্তর দিলেন ‘ছাড়ুন ওই কথা যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। কিন্তু একটা সামান্য ক্লু আমি পেয়েছি। এবং তা আপনাকে না জানিয়ে সত্যিই পারলাম না।’ আমিও কিছুটা উদ্বেগের ভান করে বললাম ‘কি ক্লু বিজয়দা?’
‘বিপ্লব বাবু, এতদিন ধরে আমরা ভাবছিলাম রবির খুনটা একটু তাড়াহুড়ো করে হয়ে গেছিল। কিন্তু মনীন্দ্র বাবুর খুনটা ছিল একদম প্রিপ্ল্যানড। ওই সিরিয়াল কিলিংয়ে ঠিক যেরকম হয়, সেরকম।’ বিজয়দার কথা শুনে আমিও মাথা নাড়লাম কারন সত্যিই আমারও মত তাই। মনীন্দ্র বাবুকে প্রথমে স্লো পয়সন ও তারপর ছাদ থেকে ফেলে খুন করা হয়েছিল। খুনের পদ্ধতি যথেষ্ট পরিকল্পনামাফিক। এইসব ভাবতে ভাবতেই বিজয়দা বলে উঠলেন ‘আজকের খুনের পর নতুন একটা লিঙ্ক মাথায় এসেছে। তা হল দ্বিতীয় হুগলী সেতু।’ আমি প্রায় চমকে গিয়ে বললাম ‘কি, খুনের সাথে দ্বিতীয় হুগলী সেতুর সম্পর্ক?’ মনে মনে ভাবলাম ‘লোকটা কি সত্যিই ভাট বকছে নাকি সত্যিই কোন সম্পর্ক আছে?’ আমার কথা শেষ হতে না হতেই বিজয়দা বললেন ‘রবির মৃতদেহ পাওয়া গেছিল দ্বিতীয় হুগলী সেতুর ঠিক নীচে। আর রঞ্জনের মৃতদেহও পাওয়া গেলো দ্বিতীয় হুগলী সেতুতে। আরেকটা অদ্ভুত জিনিষ জানেন; মনীন্দ্র বাবুর ময়না তদন্তের রিপোর্টে জানা গেছে যে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার আগে ওনার সাথে খুনির যথেষ্ট ধ্বস্তাধস্তি হয়েছে।’ আমিই ওনাকে চুপ করিয়ে বললাম ‘না, বিজয়দা, আপনার এই যুক্তিটা আমি কিছুতেই মানতে পারছিনা। দ্বিতীয় হুগলী সেতুর ব্যাপারটা নেহাতই কাকতালীয়। কারন, আমি গতরাতে সত্যিই শানের দেখা পেয়েছিলাম। ওর মুখ দেখতে পাইনি কিন্তু কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলাম। চেষ্টা করেছিল গলাটা বিকৃত করে আমার সাথে কথা বলতে। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে রঞ্জনই আসলে শান। এবার দেখুন, কোলাঘাট থেকে কলকাতা আসতে গেলে দ্বিতীয় হুগলী সেতু হয়েই আসতে হবে। দ্বিতীয় কোন রাস্তা নেই।’ আমাকে মাঝপথেই থামিয়ে প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উনি বলে উঠলেন ‘কিন্তু দ্বিতীয় হুগলী সেতুই কেন? অন্য কোন জায়গা কেন নয়?’ সত্যিই আমার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর ছিলনা।
নিজেকে কিছুটা সংযত করে বিজয়দা বললেন ‘ভালো করে বুঝুন। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট, খুনের স্টাইল এসব থেকে একদম পরিস্কার যে মনীন্দ্র বাবুকে খুন করেছিলেন মোট দুজন আলাদা আলাদা সময়। প্রথম খুনী একজন নারী, যিনি মদের গ্লাসে বিষ মিশিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় খুনি একজন পুরুষ যিনি মনীন্দ্র বাবুকে ওপর থেকে নীচে ফেলে দিয়েছিলেন।’ শুধুই চুপ করে শুনে যাওয়া ছাড়া আমার কাছে দ্বিতীয় কোন উপায় ছিলনা। ‘শুধু তাই নয়, সেই নারী ও পুরুষ দুজনেই জানতেন না যে তারা প্রত্যেকেই খুনের মোটিভ নিয়ে এসেছেন। পরে উভয়েই জানতে পারেন। এবং তার পর থেকেই খুনের স্টাইলটা চেঞ্জ হয়ে যায়।’ হুম, সত্যিই বিজয়দার লজিকে দম আছে। এই ব্যাপারটা আমার মাথায় আগে আসেনি। কিন্তু সবার আগে আমায় যা বুঝতে হবে তা হল রঞ্জন ঠিক কিভাবে খুন হয়েছে? আমি বিজয়দাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘আচ্ছা, বিজয়দা, রঞ্জনের খুনটা ঠিক কিভাবে হয়েছে?’ সঙ্গে সঙ্গে বিজয়দার উত্তর ‘আরে মশাই এটাই তো সবচেয়ে জটিল ব্যাপার। এবারের খুনের সাথে আগের খুনগুলোর কোন মিল নেই। এর আগের প্রতিটা মৃতদেহে একটা কমন ব্যাপার ছিল। মৃত্যুর আগে মুখ দিয়ে গ্যাঁজা উঠেছে। অর্থাৎ বিষ প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। অর্থাৎ বিষ প্রয়োগ হয়নি।’ আমি আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করেই বসলাম ‘তাহলে খুনটা কিভাবে হয়েছে?’
‘অন্তত ৪ বার শরীরের বিভিন্ন স্থানের ওপর দিয়ে গাড়িটা চলে গেছে। মাথাটা প্রায় থেঁতলে গেছে। বিকৃত একটা শরীর। আশেপাশে কোন পার্সোনাল কারও লক্ষ্য করিনি। অতএব কেউ একজন রঞ্জনকে গাড়ি চাপিয়ে দ্বিতীয় হুগলী সেতুতে নিয়ে এসেছে এবং ওখানেই গাড়ি থেকে নামিয়ে খুন করেছে।’ বিজয়দার মুখ থেকে এই কথাটা শুনে আমার মাথাটা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে শুরু করল। ‘বিপ্লব বাবু আমি নিশ্চিত যে এই খুনের পেছনে কাজ করছে এক চরম প্রতিশোধের স্পৃহা। এই দ্বিতীয় হুগলী সেতুর ওপরই কোন না কোন ঘটনা ঘটেছিল। আর সেই কারনেই তার পাণ্ডাদেরকে এক এক করে এখানে এনে মেরে ফেলা হচ্ছে। খুনটা যেই করুক তাকে আমি ঠিক ধরবই। কারন আইনের চোখকে কেউ...’ বিজয়দা কথাটা শেষ করলেন না, কথাটা বলার সময় ওনার চোখে এক চরম আত্মবিশ্বাস লক্ষ্য করেছিলাম অথচ সেই আত্মবিশ্বাসই হঠাৎ এক চরম যৌন লালসার আগুনে পরিনত হল। আমি একদৃষ্টিতে বিজয়দার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি, কোন এক দুর্মূল্য বস্তুর লোভে ওনার চোখদুটো চকচক করে চলেছে। শ্বাস প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন সবই কেমন অস্বাভাবিকরকম হয়ে গেছে। আমি পেছন ঘুরে দেখি তো আমারও বিচি টোটালি আউট।
বাথরুমের দরজার কাছে শুধু একটা সাদা তোয়ালে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে রমা। যেন সম্মানটুকু ঢেকে দিতেই কোনোমতে দুহাত দিয়ে তোয়ালের মুখটা বুকের কাছে ধরে থাকা। রমার দুচোখ পাগলের মত বিজয়দাকে দেখে যাচ্ছে। যেন কিছু একটা মনে করতে চেষ্টা করছে ও। আমিও মাথাটা ঘুরিয়ে একবার বিজয়দার দিকে তাকালাম। বিজয়দার শরীরী ভাষা এখন আর শুধুই নিষিদ্ধ যৌনাচারকে প্রকাশ করছেনা তার সাথে কিছু একটা ভয়ও রয়েছে। বিজয়দাকে এর আগে আমি কখনো নার্ভাস হতে দেখিনি। আজ কেন জানিনা ওনার চোখে মুখে বিশাল একটা চিন্তার ছাপ, যেন উনি বুঝি ধরা পড়ে গেছেন কারুর হাতে। আমার আর এই দৃশ্য সহ্য হচ্ছিলনা। আমি পেছন ঘুরে রমার দিকে তাকিয়ে বললাম ‘রমা যাও তৈরি হয়ে নাও। আমাদের এক্ষুনি বেরোতে হবে।’ রমা কিছুটা ঘাবড়ে গেলো, আর সাথে সাথে বেডরুমের মধ্যে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। রমা ভেতরে প্রবেশ করার পর কিছুটা অন্যমনস্ক হয়েই বিজয়দা বললেন ‘শি ইস বিউটিফুল!’ বিজয়দার ওপর সন্দেহ আমার ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
মুখ দিয়ে বেফাঁস কথা বেরিয়ে গেছে এটা বিজয়দা বেশ ভালোই বুঝতে পারলেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংবরন করে উনি বললেন ‘এখন বাজে সাড়ে ৬ টা। রঞ্জন বাবুর মিসেস আর ১ ঘণ্টার মধ্যেই কলকাতা পৌঁছে যাবেন।’ ওনার কথা শুনে আমার হুঁশ ফিরল। হ্যাঁ, সত্যিই তো আমিও তো মিতাকে জানাইনি। অথচ মিতাকে আমারই জানানো উচিত ছিল। এর চেয়েও অদ্ভুত যা হল, সব জেনেও মিতা কেন আমাদের কিছু জানালো না। যতই নাক উঁচু হোক ও, এই মুহূর্তে ওর পাশে দাঁড়ানোর মত তো শুধুই আমি আর রমা। ‘আচ্ছা বিপ্লব বাবু, মিতা দেবীর সম্বন্ধে আপনার কি মত?’ প্রশ্নটা শুনে আমি কি বলব তাই বুঝতে পারলাম না। ‘না, মানে আমি বলছি, মিতা দেবী কি কোনভাবে এইসবের সঙ্গে যুক্ত?’ সত্যি বলতে মিতার ব্যাপারে আমিও কখনো ভেবে দেখিনি। এতটুকুই জানি, মিতা প্রচণ্ড অহংকারী। হয়ত নিজের স্বামী ও আপনজনের চেয়েও টাকাকেই ও বেশী ভালোবাসে। আর এর চেয়েও অদ্ভুত হল আমার বিয়ের পর থেকে মিতা আমাদের বাড়িতে মাত্র ৫ বার এসেছে। তার মধ্যে ২-৩ বার বাবাই প্রচণ্ড অসুস্থ এই খবর শুনে। ‘এই ব্যাপারে আমি সেরকম কিছুই জানিনা আর ভাবিওনি।’ এই বলেই আমি ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু গুরু মস্তিস্কে ভর হওয়া প্রদোষ মিত্তিরকে কি করে আটকে রাখি। এই মুহূর্তে সন্দেহের তালিকায় মোট ৩ জন চলে এলো বিজয়দা, শর্মাজী ও নবতম সংযোজন মিতা, রমার দিদি।
রমা রেডি হয়ে আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে দেখা মাত্রই বিজয়দা টপিকটা সম্পূর্ণ চেঞ্জ করে দিলেন। যেন উনি চাননা রমা কিছুতেই এই ব্যাপারে কিছু জানুক। ‘চলুন, আমাদের এবার বেরনো উচিত। আর হ্যাঁ, মিসেস পোদ্দার, আপনি কিন্তু নিজেকে একটু সংবরন করবেন। কারন মৃতদেহের অবস্থা শোচনীয়।’ হ্যাঁ, এই কথাটা বিজয়দা সত্যিই বলেছেন। রমার শরীরের যা অবস্থা তাতে সত্যিই ওকে এরকম বীভৎস একটা মৃতদেহ দেখতে না দেওয়াই উচিত। আমি তাই বিজয়দাকে বললাম ‘আচ্ছা, বিজয়দা, মিতা তো আসছেই, আমিও আছি তাহলে কি রমাকে আর নিয়ে যাওয়ার কোন দরকার আছে?’ আমার কথা শুনে বিজয়দা একবার রমার মুখের দিকে তাকালেন এবং সেই অবস্থাতেই বললেন ‘ওকে, মিসেস পোদ্দারকে যেতে হবেনা। কিন্তু আমি ওনার সাথে পার্সোনালি কয়েকটা কথা বলতে চাই। আপনি যদি একটু নীচে গিয়ে দাঁড়ান খুব ভালো হয়।’ আমার চরম আপত্তি ছিল, কিন্তু একজন পুলিশ অফিসার একজন সাধারন নাগরিককে জেরা করতে চান, সত্যিই এতে আমার বাধা দেওয়ার কিছুই নেই। আমি মুখটা বিজয়দার কানের কাছে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম ‘বিজয়দা, দেখবেন, ওর কিন্তু মানসিক অবস্থা ভালো নয়।’
আমায় প্রায় অবাক করেই বিজয়দা কিছুটা জোরে হেসে উঠে বললেন ‘আরে ধুস, আপনি মিসেস পোদ্দারকে যতটা অসুস্থ মনে করেন উনি ততটাও নন। আপনি নীচে যান আমি আসছি।’ প্রায় পিলে চমকে গিয়ে আমি রমার দিকে তাকালাম। রমার দুই চোখ যেন বারবার করে আমায় বলছে ‘বিপ্লব, এই লোকটার কাছে আমাকে একা ছেড়ে কোথাও যেওনা প্লিস!’ আমি বিজয়দার চোখটার দিকেও তাকালাম। যেন এক আদিম হিংস্র পশু ওনার দুই চোখ ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসছে। আমার আর কিছুই করার ছিলনা। আমি ধীরে ধীরে রুমের বাইরে বেরিয়ে গেলাম।
 
১৭

ল্যাদ খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি ফ্ল্যাটের বাইরে, কখন বিজয়দা রমাকে জিজ্ঞাসাবাদ সম্পূর্ণ করে আসবেন তার অপেক্ষায়। ‘বিজয়দা’ এই চরিত্রটি বড় বড় উপন্যাসের জটিল চরিত্রকে হার মানায়। কখনো মানুষটিকে চরম আদর্শবান ও সিস্টেমের প্রতি নিবেদিতপ্রান মনে হয় কখনো আবার সেই লোকটিই চরম রহস্যময়। আমি আর রমা যে হিন্দি সিনেমার আদব কায়দায় মধুকর ভিলা থেকে বেরইনি তা আমি খুব ভালো করেই জানি। এর পেছনে যে বিজয়দার অদৃশ্য হাত ও সহযোগিতা রয়েছে তা আমি ভালোই বুঝি। কিন্তু কেন? কেন এই লোকটি আমায় প্রতি মুহূর্তে এই রহস্যের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে দিচ্ছে। কখনো কখনো বিজয়দাকে প্রচণ্ড সন্দেহ হয়। আসলে মানুষের চরিত্র একটা সাদা কালো নেগেটিভ ফিল্ম। এর সাদা স্পটগুলো সেই মানুষকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে আর নেগেটিভ স্পটগুলো সেই মানুষকেই চরম অবিশ্বাস করতে বাধ্য করে। আমি রয়েছি গোলকধাঁধায়, বিজয়দার অদ্ভুত ও অত্যন্ত আকর্ষক এই চরিত্র বিশ্লেষণে আমি সত্যিই অপারগ। তবে, এটা প্রচণ্ড সত্য যে এই মুহূর্তে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনায় আমার মনে কালো স্পটগুলোই ভেসে উঠছে। সত্যিই কি বিজয়দা এই খুনের সাথে জড়িয়ে? বিজয়দা যে ঘুষের টাকার কথা বলেছিলেন, অথবা হথাত করে বিজয়দা ও রঞ্জনকে একসাথে বিজি দেখতে পাওয়া, অথবা আমার বাড়িতে কিছুক্ষন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তো আমাকে বারবার বিজয়দাকে সন্দেহ করতে বাধ্য করছে। এইসবই ভাবছি এমন সময় দেখি বেশ হাসিহাসি মুখে বিজয়দা আমার দিকে আসছেন।
‘চলুন যাওয়া যাক’। বিজয়দার কথাটা শুনে তো মনে হচ্ছিল যে আমরা বোধ হয় ম্যাটিনি শো দেখতে যাচ্ছি। যাই হোক আমি গাড়িতে চেপে বসলাম। আমার ফ্ল্যাট থেকে হসপিটাল এমন কিছু দূর নয়। এই মিনিট দশেকের রাস্তা। বিজয়দার চোখে মুখে একটা প্রশস্তির ছাপ। যেন কোন এক অজানা ভয়কে উনি সবে মাত্র জয় করেছেন। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা হাসপাতালে পৌছালাম। একটা ভুঁড়িওয়ালা হাবিলদার এগিয়ে এসে বিজয়দাকে বলল ‘স্যার, ময়নাতদন্ত হয়ে গেছে’ কিছুটা সিরিয়াস হয়ে বিজয়দা ওকে বললেন ‘ডাক্তারের সাথে মৌখিক কিছু পরামর্শ করতে বলেছিলাম তোমায়?’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো ‘হ্যাঁ, স্যার, সবই জিজ্ঞেস করেছি। না, এবার সত্যিই আর সেই আফ্রিকান বিষ প্রয়োগ করা হয়নি। খুন হয়েছে এই রাত দুটো নাগাদ। শরীরের ওপর দিয়ে মোট ৫ বার ও মাথার ওপর দিয়ে মোট ২ বার গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে’ দুটো হাত দিয়ে প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ করে বিজয়দা আমার দিকে তাকালেন। আমি কিছুটা হতবাক হয়েই তাকিয়ে থাকলাম। ‘ব্যাস, আর কি পুরো কেসটাই তো হাতের মুঠোয় চলে এলো। এবার একটাই কাজ পড়ে রয়েছে। কি?’ আমারই মুখ দিয়ে নিজের অজান্তে একটা শব্দ বেরিয়ে এলো ‘চার্জসিট’। প্রচণ্ড জোরে অট্টহাস্য করে উঠলেন বিজয়দা। আবার মুখটা কিছুটা গম্ভীর করে আমার উদ্দেশ্যে বললেন ‘বউয়ের জন্য কিছু রাখা আছে তো? মানে এই ইনসিওরেন্স বা নগদ টাকা ইত্যাদি?’ কথাটা শুনে ওখানে দাঁড়িয়েই আমার পা থরথর করে কাঁপতে শুরু করে দিলো। তবে কি বিজয়দা...?
আমি বিজয়দার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। বিজয়দার দুটো অনুসন্ধিৎসু চোখ যেন আমার শরীরটা গিলে খেয়ে নেবে। আমার মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা অবধি বারবার করে লক্ষ্য করতে শুরু করলেন। যেন আমার শরীরটা নয় শরীরের মধ্যে থাকা মনটাকে উনি রিড করতে চাইছেন। কিছুটা অধৈর্য হয়েই আমি বলে উঠলাম ‘কি বলতে চাইছেন আপনি?’ আবার একটা অট্টহাস্য। আমার কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন ‘একটু সাইডে আসুন’ ওনার কথা শুনে সেই হাবিলদারটিই হেঁটে কিছুটা দূরে সরে গেলো। আমার সাড়া শরীরে এক অদ্ভুত শিহরন শুরু হয়েছে। তাহলে কি সত্যি বিজয়দাই...। ওনার ঠোঁটদুটো ধীরে ধীরে আমার কানের কাছে এসে গেলো। আমিও শুনতে চাই, উনি আমায় ঠিক কি বলতে চান। ‘আপনার কিছু হয়ে গেলে রমার কি হবে?’ সাথে অত্যন্ত নোংরা একটা হাঁসি। হাঁসিটার ইঙ্গিত হয়ত আমার নয় রমার দিকে। নিজেকে আর সংবরন করতে পারলাম না, কিছুটা চিৎকার বলেই বলে ফেললাম ‘বিজয়দা আপনি?’ সঙ্গে সঙ্গে বিজয়দার মুখের হাঁসিটা কর্পূরের মত উড়ে গিয়ে তার জায়গায় ভেসে এলো এক পর্বত কঠিন কঠোর মানসিকতার মানুষ। কিছুটা গলাটা গম্ভীর করে উনিও বলে উঠলেন ‘আমি কি?’ জানি বিজয়দার মত একজন পুলিশ অফিসারের সাথে লড়ার ক্ষমতা আমার নেই। তাই নিজেকে কিছুটা সংবরন করে নিয়ে কিছুটা কাতরভাবেই বললাম ‘আপনি কি চান বিজয়দা?’ এতো জটিল একটা প্রশ্নের উত্তরে শুধুই একটা অমলীন হাঁসি। এমন এক হাঁসি যার মধ্যে হাজারো রহস্য ও তার সমাধান লুকিয়ে রয়েছে। ‘চার্জশিট’ আবার ওই শব্দটাই উচ্চারন করলেন বিজয়দা। এই মানুষটা কে? এই পৃথিবীতে কি এনার আগমন শুধুই আমাকে মানব জনমের জটিলতা ও বাস্তবের কঠোরতা বোঝানোর জন্য? ‘চলুন মর্গের দিকে যাওয়া যাক’। আর কথা না বাড়িয়ে আমিও চলতে লাগলাম।
চারপাশে ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। কোনটা সেলাই করা। কোনটার বা চোখগুলো বেরিয়ে আছে। কি বীভৎস, জানি রমা আসেনি ভালো হয়েছে। রমা সহ্য করতে পারতো না। কিন্তু আমি পারবো, বাবাইএর মৃত্যুকে আমি নিজের চোখে দেখেছি। দেখেছি কিভাবে একটা মানবদেহ থেকে ধীরে ধীরে প্রাণবায়ুটা বেরিয়ে যায়। শেষ ২ মিনিট বাবাই যখন ক্রমাগত হেঁচকি তুলে যাচ্ছিল আমার গলা দিয়ে কিছুতেই আওয়াজ বেরচ্ছিল না। চোখের সামনে যমরাজকে দেখেছিলাম। ‘সরি, নিজেকে নিয়ন্ত্রন করুন, স্ত্রীর পাশে থাকুন, আমরা আপনার ছেলেটাকে নিয়ে যাচ্ছি’ যেন যমরাজ এই কথাটাই আমার মুখের ওপর বলেছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম বাবাইকে আমি বাঁচাতে পারবো না। ডাক্তার মৃতদেহর মুখের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে নিল। কি বীভৎস! হাবিলদারটা ওয়াক করে একটা আওয়াজ করে দরজার দিকে দৌড়ে গেলো। বিজয়দাও দেখলাম মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আমি তাকিয়ে আছি। একটা মৃতদেহ; আমারই আত্মীয় রঞ্জনের। আমি ওই চেপ্টে যাওয়া নৃশংস মুখটার দিকে তাকিয়ে আছি। কে যেন হয়ত আমার বিবেক আমাকে প্রশ্ন করে চলেছে, ‘কি বিপ্লব, এই মৃতদেহটা কার? উচ্চবিত্তের? মধ্যবিত্তের? নিম্নবিত্তের? শোষকের? শোষিতর? জবাব দাও বিপ্লব। ব্যাখ্যা কর তোমার ওই বস্তাপচা তত্ব দিয়ে’। নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠলাম ‘এই মৃতদেহ একটা জানোয়ারের! টাকা নামক যন্ত্র দিয়ে যে গোটা পৃথিবীকে কুক্ষিগত করতে চেয়েছিল’ বীভৎস ওই নারকীয় পরিবেশে আর কেউ থাকতে পারছিলনা, আমি ছাড়া। খেয়ালই করিনি পেছন ঘুরে বিজয়দা আমার হাতটা ধরে টেনে টেনে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা কেউ আমার মুখের হাঁসিটা দেখেনি। আমি হাসছিলাম, আমি বিদ্রুপ করছিলাম, একটা জানোয়ার মরেছে, একটা বিপ্লব হয়েছে, সমাজ পাল্টাচ্ছে।
বিজয়দা টানতে টানতে আমায় বাইরে নিয়ে গেলেন, প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে বলে উঠলেন ‘আপনি কি মানুষ! কিভাবে? কিকরে আপনি পারলেন! এইরকম বীভৎস একটা মৃতদেহের দিকে আপনি কি করে তাকিয়ে রয়েছেন?’ আমার হুঁশ ফিরল। হাবিলদারটা একটা জলের বোতল নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো। ভালো করে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে শান্ত করলাম নিজেকে। মনে পড়ল, মিতার কথা। সত্যি এই মুহূর্তে মিতার পাশে দাঁড়ানো ও ওকে স্বান্তনা দেওয়াই আমার প্রধান কর্তব্য। বিজয়দাকে প্রশ্ন করলাম ‘বিজয়দা, মিতা মানে রঞ্জনের স্ত্রী কি এসে গেছে?’ বিজয়দা একবার ওই হাবিলদারের দিকে তাকালেন। সেই আমাকে জবাব দিলো ‘হ্যাঁ, উনি এসে গেছেন। ওনাকে বাইরের ঘরটায় বসিয়ে এসেছি’ আমরা প্রত্যেকেই মিতার সাথে দেখা করতে চললাম। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর দেখলাম মিতা সিঁড়ির ওপর বসে। মাথায় দুহাত দিয়ে রয়েছে, দেখেই মনে হচ্ছে, মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। আমিই সবার আগে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখেই মিতা উঠে দাঁড়াল। আমি কিছু বোঝানোর আগেই বা স্বান্তনা দেওয়ার আগেই মিতা বলে উঠল ‘বিপ্লব আমার কি হবে! আমি তো দেউলিয়া হয়ে গেলাম!’ হাতটা মিতার মাথার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলাম ওকে স্বান্তনা দিতে, লঘুমস্তিস্কের কোন এক জটিল প্রক্রিয়ায় হাতটা ওখানেই দাঁড়িয়ে গেলো। বলে কি মেয়েটা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সকলের সামনেই ও বলল ‘বিপ্লব, রঞ্জনের সমস্ত টাকা কোন এক ফেক আকাউন্তে রয়েছে। আমার হাতে ৩-৪ লাখ টাকা ছাড়া কিছু নেই। আমি তো দেউলিয়া হয়ে গেলাম’ শালা হাসবো না কাঁদবো তাই বুঝলাম না। সত্যিই কি তাহলে উচ্চবিত্তের আবেগও আমাদের থেকে আলাদা হয়। একটা মানুষ যে মিতার স্বামী ছিল সে মারা গেছে। আর আজ তার মৃত্যুর যন্ত্রণাকে হার মানিয়ে ওপরে উঠে আসছে একটা যন্ত্র যার নাম টাকা। টাকা দিয়ে এরা ভালোবাসা কেনে, শরীর কেনে, এগুলো আমি আগেই জানতাম এখন দেখছি টাকা দিয়ে এরা মানুষের আবেগও কিনে নেয়।
‘তুমি কোন চিন্তা করোনা। কোন না কোন একটা ব্যাবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে’ এই কথাটা বলা ছাড়া আমার কাছে আর কোন উপায় ছিলনা। ‘মিতাদেবী আপনি এখন তাহলে বিপ্লববাবুর বাড়িতে উঠুন। যেকোনো সময় আপনাকে জেরা করার জন্য ডাকা হতে পারে’ হাতের রুমালটা দিয়ে চোখের জলটা একবার মুছে মিতা শুধু মাথাটা নাড়াল। ‘চলুন আপনাদের ছেড়ে দিয়ে আসি’ হাবিলাদারের কথায় আমার একটু স্বস্তি ফিরল। আমরা দুজনেই গাড়ির পেছনে বসে আছি। সামনে সেই হাবিলদার ও একজন ড্রাইভার। বিজয়দা ডাক্তারের সাথে কথা বলার জন্য ওখানেই থেকে গেলেন। হথাত দেখি আমার হাতের ওপর মিতার হাতটা এসে স্পর্শ করল। কিছুটা চমকে গিয়েই ওর দিকে তাকালাম। ‘বিপ্লব, আমাকে তুমিই বাঁচাতে পারবে। রঞ্জন আমায় কোনোদিন জানায়নি কোন নামে ওর আকাউন্ত আছে। শুধু এটাই জানি তোমাদের ব্যাঙ্কেই ওর আকাউন্ত আছে। তুমি যেভাবে হোক আমায় বাঁচাও। নয়ত আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো’ আমি কোন জবাব দিলাম না। শুধুই সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ‘কি অদ্ভুত এই পৃথিবী, একদিন এই মেয়েটিই চাইত যেন কোনমতেই আমার আর রমার বিয়ে না হয়। আমার সাথে রমার বিয়ে হওয়ার পর শুধুই গঞ্জনা আর হেয় হওয়া, তাও আজ সেই মানুষটিই আমার দুহাত ধরে অনুরোধ করে চলেছে। শুধু মিতাকে নিজের পাওনা গণ্ডা ফিরিয়ে দিতে নয়, রঞ্জনের আসল আকাউন্তটির ব্যাপারে আমারও জানা অত্যন্ত জরুরি। আজ আমায় যেভাবে হোক অফিসে যেতে হবে। আজ প্রায় ৩ দিন হয়ে গেলো আমি অফিস যাইনি।
লিফটে করে আমি ও মিতা দুজনেই ওপরে উঠছি। আমি ভেবে চলেছি কি করে লাখ লাখ আকাউন্তের মধ্যে থেকে একটা বেনামী আকাউন্ত আমি খুঁজে বার করব। বিজয়দার থেকেই জেনেছিলাম যে রঞ্জনের ফেক আকাউন্তটি মুম্বাইতে আছে। পরপর কতগুলো ঘটনা আমার মাথায় সেজেগুজে বসে গেলো। মনীন্দ্রদার খুন হওয়া, শর্মাজীর দ্বিতীয় প্রপসাল এবং তারপর রঞ্জনের খুন হওয়া। ‘স্পেশাল আকাউন্ত’ হ্যাঁ, সবার আগে এই টার্মটাই আমার মাথায় এসেছিল। আমাদের ব্যাঙ্কে কিছু স্পেশাল আকাউন্ত আছে। ব্যাঙ্কের অফিসিয়ালদের পার্সোনাল রেকমেনডেশনে কিছু আকাউন্ত খোলা হয়। এর জন্য ডকুমেন্ট ও যৎসামান্যই লাগে। এই পাসপোর্ট জাতীয় কিছু হলেই যথেষ্ট। মনিদা কেন খুন হলেন? এর পেছনে কোন সুনির্দিষ্ট কারন রয়েছে। মিতার দিকে তাকিয়ে বললাম ‘মিতা তুমি বাড়িতে ঢোক, রমা আছে। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি’। মিতা কিছু বলল না, আমিও ঝড়ের বেগে ফ্ল্যাট থেকে বেরোতে শুরু করলাম। আমাদের অফিস অনেক সকালেই খুলে যায় কিন্তু স্টাফরা সবাই ১১ টা নাগাদ আসে। এটাই পারফেক্ট সময়। দ্রুত স্কুটারটা স্টার্ট দিয়ে অফিসের দিকে যেতে শুরু করলাম।
অফিসে যখন পৌছাই তখন প্রায় ৯ টা। সিকিউরিটি গার্ডটা আমাকে দেখে কিছুটা ভুরু কুঁচকে উঠে দাঁড়াল। আমিও হাত পা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলাম ‘হেব্বি চাপ, বাপু। কাজ করতে হবে নয়ত স্যাক হয়ে যাবো’। দ্রুত অফিসে ঢুকে পড়লাম, হ্যাঁ সত্যিই আমি ছাড়া অন্য কোন স্টাফ এই মুহূর্তে নেই। কিন্তু আমার সিস্টেম থেকে তো আকাউন্ত সেকশন অ্যাকসেস করা যায়না। অতএব অন্য কারুর সিস্টেমে হাত মারতে হবে। সবচেয়ে বেস্ট চিনুর সিস্টেম। ওর আলাদা কেবিন রয়েছে, মেন এন্ট্রান্স থেকে চট করে কারুর নজরও পড়বে না। সঙ্গে সঙ্গে ওর সিস্টেমটা খুলে ফেললাম। আকাউন্ত সেক্সানে ক্লিক করতেই দেখি অলরেডি লগ ইন করা রয়েছে। মাথা থেকে একটা বিশাল চাপ নেমে গেলো। বিশাল লম্বা একটা লিস্ট। কারসারটা ধরে একদম নীচের দিকে নামতে শুরু করলাম। একদম তলার দিকে স্পেশাল আকাউন্ত এর একটা কলাম। কিন্তু এখানেও লিস্টটা বেশ বড়সড়। খুঁজে বার করা যথেষ্ট চাপের। কলামের একদম শেষ রো টার নাম ‘রেকমেনডেড বাই’। যদি আমার অনুমান সঠিক হয়ে যায় তাহলে আমি ৫ মিনিটের মধ্যেই রঞ্জনের ফেক আকাউন্তটি খুঁজে বার করে দেবো। ওই রো বরাবর মনিদার নাম খুঁজতে শুরু করলাম। কারসার ক্রমশ নীচের দিকে নামছে কিন্তু মনিদার নাম নেই। আমারও হতাশা বেড়েই চলেছে।
কারসারটা একদম শেষে এসে থেমে গেলো। সবার শেষে পেলাম একটি আকাউন্ত, নাম সুধীররঞ্জন গুপ্তা, রেকমেনডেড বাই মনীন্দ্র বসু। আমার আর বুঝতে কোন অসুবিধেই রইলনা এটাই রঞ্জনের ফেক আকাউন্ত। ঘড়ির দিকে তাকালাম ৯ টা ১০। অর্থাৎ হাতে এখনো বেশ কিছুটা সময় রয়েছে আমার। ক্লিক করলাম, আকাউন্তটির ওপর। সাথে সাথে সম্পূর্ণ আকাউন্ত ডিটেলস আমার হাতে চলে এলো। নিউ জেনারেটেড পেজটায় আমার চোখ পড়তেই হার্ট ফেল হওয়ার উপক্রম হোল। ‘নেট ব্যালেন্স ৮০ লাখ’। আকাউন্ত ডিটেলসটা একবার মিলিয়ে দেখার জন্য ক্লিক করলাম। হ্যাঁ, যা ভেবেছি ঠিক তাই। জালী পাসপোর্ট দিয়ে ফেক আকাউন্ত। এটা রঞ্জনের ই ফেক আকাউন্ত। শালা, মানুষ দুবেলা খাবার পেতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে আর এরা খোলাম কুচির মত কালোটাকা নিয়ে ফুর্তি করছে। হথাত মোবাইলটা বেজে উঠল। সবার আগে সিস্টেমটা বন্ধ করলাম। কারন এটাকে খুলে রাখা উচিত নয়। ফোনটা রিসিভ করতে যাবো দেখি তার আগেই ফোনটা কেটে গেলো। এইসময় কে ফোন করল? কল লিস্ট হাতড়ে বুঝলাম চিন্ময় ফোন করেছে। চিন্ময়? কিন্তু কেন? সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা লাগিয়ে দিলাম। রিং হয়েই গেলো কিন্তু চিনু ফোনটা রিসিভ করলনা। আমার উদ্বেগ হুহু করে বাড়তে শুরু করল। চিনু আমায় কি জানাতে চায়। মধুকর ভিলায় যে আসলে চিনুই আমাদের দুজনকে বার করেছে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমি আবার কল করতে যাচ্ছি এমন সময় দেখি চিনুর ই ফোন চলে এলো।
‘বিপ্লবদা আপনি কোথায়? আমি আপনাকে এক্ষুনি একটা ম্যাসেজ করেছি চেক করুন। ওই ম্যাসেজটার মধ্যে অনেককিছু রয়েছে। বিপ্লবদা আমি কিছুক্ষন পরে ফোন করছি। আমি বিশাল বিপদে’ আমি কিছু বলার আগেই চিনু ফোনটা কেটে দিলো। নতুন এক রহস্য। ফোনটা ভালো করে চেক করলাম, না কোন ম্যাসেজ আসেনি। আসলে অফিসের মধ্যে নেটওয়ার্কের এতো প্রবলেম যে ম্যাসেজ খুব কষ্টে ইনবক্সে ঢোকে। কিন্তু এটা বেশ ভালো মতই বুঝতে পারছিলাম যে এই ম্যাসেজটা অত্যন্ত জরুরি। যদি এক্ষুনি পাঠিয়ে থাকে, অফিসের বাইরে গেলে ম্যাসেজটা রিসিভ করার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। আমি প্রায় রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে অফিসের বাইরে চলে গেলাম। হাতে মোবাইলটা নিয়ে অপেক্ষা করছি, এমনসময় ম্যাসেজ রিং টোন টা বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ইনবক্স ওপেন করলাম।

‘Ranjan100isshan’ ‘25thmagh’

এ এক অদ্ভুত ম্যাসেজ। এতটুকু বুঝলাম যে বলতে চাইছে রঞ্জন ই হোল শান। সেটা আমি গতরাতে মধুকর ভিলাতেই জেনে গেছিলাম। আর ২৫ শে মাঘ আমার ছেলের মৃত্যুদিন। এই দুটোর মধ্যে কি সম্পর্ক? একমাত্র চিনুই আমায় ভালো করে বুঝিয়ে সব বলতে পারে। সুতরাং আবার চিনুকেই ফোন লাগালাম। ওপাশ থেকে ‘হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো বিপ্লবদা শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো হ্যালো’ এই কথাটাই ভেসে আসছে। আমি যত বলছি ‘হ্যাঁ চিনু আমি সব শুনতে পাচ্ছি’ ততই একি কথা ওপাশ থেকে ভেসে আসছে। বেশ কিছুক্ষন এরকম চলার পর চিনু বলে উঠল ‘বিপ্লবদা, আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছিনা। আমি এই মুহূর্তে গাড়িতে। আপনি কোনা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এগিয়ে আসতে শুরু করুন। আমার পেছনে লোক লেগেছে। মনে হয় বাঁচব না। আর হ্যাঁ, বিজয়দাকে...’ হথাত লাইনটা কেটে গেলো। শালা কোনা এক্সপ্রেসওয়ে কি পাড়ার গলি, যে চিনুকে তুড়ি মেরে খুঁজে বার করব। তবুও আমায় যেতেই হত। স্কুটারটায় স্টার্ট মারলাম।
যতটা স্পীডে এই স্কুটারটা চালানো যায় ঠিক ততটাই স্পীডে চালাচ্ছিলাম। একটু সকাল সকাল হওয়ায় সেভাবে ট্রাফিকের প্রবলেম ও হয়নি। বাধ সাধল রবীন্দ্র সদনের কাছে এসে। বিশাল একটা জ্যাম। কিছুই করার নেই, স্টার্টটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। হথাত ই চোখে পড়ল বেশ কিছুটা দূরে একটা পুলিশের জিপ। কলকাতার রাস্তায় পুলিশের জিপ থাকাটা অস্বাভিক কিছু নয়। কিন্তু আমার মনে কিছু জটিল সমীকরন কিলবিল করে চলেছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম ওইদিকে। হথাত ই জটিল বহুঘাত সমীকরনের সমাধান হয়ে গেলো। গাড়ির ভেতর থেকে নেমে এলো বিজয়দা। হেঁটে কিছুটা গিয়ে ট্রাফিক পুলিশকে কিছুটা ধমকের স্বরে কিছু বললেন। আমি চুপ করে তকিয়ে আছি ওই দিকেই। ধাতানি খেয়ে ট্রাফিক পুলিশটাও কিছুটা তাড়াহুড়ো করে গাড়িগুলোকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিলো। তাহলে কি বিজয়দাই?
অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্রাফিক ক্লিয়ার হয়ে গেলো। আমিও প্রচণ্ড বেগে স্কুটারটা ছোটাতে শুরু করলাম। কিন্তু পুলিশের জিপের সাথে কি আমার মধ্যবিত্ত স্কুটার পারে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বিজয়দার জীপটা আমার নজরের বাইরে চলে গেলো। মনে মনে সঙ্কল্প করলাম যেভাবে হোক আমি চিনুকে বাঁচাবো। ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। আবার একটা জ্যাম। আশেপাশে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। না পুলিশের জীপটা আর দেখা যাচ্ছেনা। হতাশা ক্রমশ আমাকে গ্রাস করে চলেছে। তাহলে কি আমি সত্যিই চিনুকে বাঁচাতে পারবো না। কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্রাফিক ক্লিয়ার হয়ে গেলো ও আমি সোজা চলতে লাগলাম। এরপর রাস্তাটা সোজা হাইওয়েতে উঠেছে, আর সেরকম জ্যামে পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কখন যে দ্বিতীয় হুগলী সেতু পেরিয়ে গেছি খেয়াল করিনি।
কিছুটা দূরে একটা লাল গাড়ি দাঁড়িয়ে। চিনুর গাড়িটা আমি চিনি, এটা চিনুরই গাড়ি। আরও কিছুটা আগে যেতে বুঝলাম তার ঠিক পেছনে পুলিশের জিপও দাঁড়িয়ে। আমি একদম গাড়িটার পাশে এসে দাঁড়ালাম। ভেতরে দুটো মৃতদেহ। একটা চিনুর একটা চিনুর ড্রাইভারের। পেছনে জিপের ওপর হেলান দিয়ে বিজয়দা কাউকে ফোন করছেন, সম্ভবত থানা থেকে লোক পাঠানোর জন্য। আমাকে দেখে ফোনটা একটু কান থেকে নামিয়ে বলে উঠলেন ‘একি বিপ্লব বাবু আপনি এখানে?’ এর উত্তর দেওয়ার কোন ইচ্ছে আমার ছিলনা। শুধু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হোল ‘আপনি এখানে কি করে?’ কিন্তু পারলাম না। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বিজয়দা আবার ফোনে কথা বলতে শুরু করলেন। ‘হ্যাঁ, একটা এ্যাম্বুলেন্স আর ৪ জন পাঠাও’ ফোনটা রেখে আমায় বললেন ‘প্রচুর চেষ্টা করলাম কিন্তু বেচারাকে বাঁচাতে পারলাম না’। আমার মুখ দিয়ে একটাও শব্দ বেরোল না। মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাহলে কি বিজয়দাই?
 
১৮

চিনুর মৃত্যুর সাথে সাথে রহস্য সমাধানের একটা মুখ বন্ধ হয়ে গেলো। আমি একদৃষ্টিতে চিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার আর রমার শপিং মলে যাওয়া, একটা ছিঁচকে চোরের রমার ভ্যানিটি ব্যাগ চুরি করা, আমার পেছন থেকে চিনুর দৌড়, বেশ কিছুক্ষন পর ডান হাতে ক্ষত নিয়ে চিনুর ফিরে আসা, গায়ে একটা উগ্র সেন্ট, চিনুর রমাকে সিডিউস করা, আবার আমাকে কিছু অঙ্গভঙ্গি করে ওখান থেকে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত করা, অবশেষে আমায় ফোন ও একটা অদ্ভুত ম্যাসেজ পাঠানো; সবকিছুকেই একটা সরলরেখায় নিয়ে চলে এসেছিলাম। কিন্তু চিনুর মৃত্যুতে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। রমার চিঠিটা থেকে বুঝেছি শানের সহযোগী মোট ৫ জন। প্রত্যেকেই পুরুষ। অবিলম্বে খুন হয়ে যাওয়া প্রত্যেকে শানের সহযোগী হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। সেইরকম ভাবেই ভেবে নিয়েছিলাম। মনিদা, রবি, ও রঞ্জন ওরফে শান অবিলম্বে খুন হয়ে গেছে। শানের আরও দুজন সঙ্গী রয়েছে। এই দুজন কারা? এই মুহূর্তে সন্দেহের তালিকায় বেশ কয়েকজন। তারমধ্যে একজন নিশ্চিত, কারন মধুকর ভিলায় আমি তার উপস্থিতি লক্ষ্য করেছি, সে হোল শর্মাজী। কিন্তু অপর জন কে? চিন্ময়? ফ্ল্যাটের সেই সিকিউরিটি গার্ড, শান্তনু? নাকি অন্য কেউ। মানুষের সবচেয়ে উত্তেজনা প্রবন ইন্দ্রিয় হলো সন্দেহ। সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ই বারবার করে আমায় জানান দিচ্ছে, শানের দ্বিতীয় সহযোগী আর কেউ নয় বিজয়দা। এইসবই ভাবছিলাম, হথাত বিজয়দাই অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে উঠলেন
‘আচ্ছা, বিপ্লব বাবু, একটা অদ্ভুত জিনিষ খেয়াল করেছেন; শেষ দুখানা খুনে আর সেই আফ্রিকান বিষটি ব্যাবহার করা হচ্ছেনা।’ আমি অন্যমনস্ক ছিলাম। বিজয়দার আকস্মিক এই প্রশ্নে আমি কিছুটা চমকে গিয়েই ওনার দিকে তাকালাম। বিজয়দার মুখে অদ্ভুত এক সন্তোষজনক হাসি। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই উত্তর দিলাম ‘আসলে মনে হয় ওরা পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য...’ আমাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বিজয়দা প্রচণ্ড জোরে অট্টহাস্য করে উঠলেন। প্রায় মিনিট দুয়েক পরে ওনার হাসি থামল। হাসতে হাসতেই কিছুটা অবজ্ঞার ছলে আমায় বললেন ‘বিপ্লববাবু, ভাবছি পুলিশের চাকরিটা এবার ছেড়ে দেবো। যা টাকা জমিয়েছি তা দিয়ে শ্যামবাজারে একটা পান দোকান খুলে বসে যাবো।’ আবার সেই বিচ্ছিরি একটা হাসি। ‘কেন জানেন? শালা, পুলিশের কোন সম্মান নেই। দিনরাত পলিটিসিয়ানের পোঁদে পোঁদে ঘোরা, মাঝেমাঝে পাবলিকের ক্যালানি তবুও নিজেদের একটা বেশ হিরো হিরো লাগত। কিন্তু আজকাল তো দেখছি ব্যাংকাররাও শারলক হোমস হয়ে যাচ্ছে।’ বিজয়দার এই বিদ্রুপ আমার আর সহ্য হচ্ছিলনা। কিছুটা মেজাজ হারিয়েই বলে ফেললাম ‘আপনি কি বলতে চান বলুন তো? আমাকে এইসব বলবেন না। আমায় চিন্ময় কিছুক্ষন আগে ফোন করেছিল। ও বলল ও বিপদে পড়েছে, কোনা এক্সপ্রেসওয়ে বরাবর আসতে। আমাদের ওখানেই দেখা হয়ে যাবে। আর আপনাকে...’
‘আমায় কি? আমায় না জানাতে বলেছিল তাই তো?’ বিজয়দার শেষ কথাটার কোন উত্তর আমার কাছে ছিলনা। কারন সত্যিই চিনুর শেষ বাক্যটা আমি পরিস্কারভাবে শুনতে পাইনি। ‘আর হ্যাঁ, বিজয়দাকে...’ এটা শোনার পরই লাইনটা কেটে গেছিল। এই বাক্যটা তো মোট দুভাবে সম্পূর্ণ করা যায়। ‘আর হ্যাঁ বিজয়দাকেও খবরটা দিয়ে দিন অথবা আর হ্যাঁ বিজয়দাকে খবরটা দেবেন না কারন উনি ওদেরই লোক।’ এর মধ্যে কোনটা সত্যি আর কোনটা ভ্রম? এর উত্তর আমার কাছে নেই। আমি বিজয়দার মুখের দিকে তাকালাম। ওনাকে যথেষ্ট গম্ভীর লাগছে। আমি কিছু বলার আগেই বিজয়দা বলে উঠলেন ‘বিপ্লব বাবু এবার আপনি যান। আপনার অফিস আছে। পুলিশকে পুলিশের কাজটা করতে দিন।’
আমিও একটু অসম্মানিত বোধ করলাম। আর কথা না বাড়িয়ে স্কুটারটা স্টার্ট দিয়ে পেছন দিকে চলতে শুরু করলাম। একটার পর একটা বাস, ফুটব্রিজ পেরিয়ে চলেছি কিন্তু মস্তিস্কে রয়েছে এই কাহিনীর সবচেয়ে রহস্যজনক চরিত্র, বিজয়দা। বিজয়দা যে খুব একটা সহজ সরল মানুষ নন তা আমি প্রথম দিনই বুঝে গেছিলাম। যেদিন থানায় আমাদের সকলকে ডেকে পাঠালেন, আমাকে দেখার পর জিজ্ঞেস করলেন ‘আপনার নাম?’ আমি প্রায় পিলে চমকে গেছিলাম। বিজয়দার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ আজ থেকে প্রায় ৩ বছর আগে। তারপর আর ওনার সাথে আমার কোন সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু সেই প্রথম সাক্ষাৎটি এতটাই ঘটনাবহুল ছিল যে যেকোনো সাধারন মানুষই আমৃত্যু তা মনে রাখবেন আর বিজয়দা তো পুলিশ অফিসার। পুলিশের স্মৃতিশক্তি সাধারন মানুষের থেকে একটু বেশীই উর্বর হয়। বিজয়দা আসলে কি সত্যিই খলনায়ক? কেন আমার মন বারবার ওনাকে সন্দেহ করছে। অথচ থানায় ওনার সাথে দেখা করার সময় বা ওনার বেমালুম আমার কথা ভুলে যাওয়া এগুলোর পরেও আমি ওনাকে সন্দেহ করিনি। যেকোনো উপায়ে আমায় এই সন্দেহের বেড়াজাল থেকে বাইরে আসতে হবে। কিন্তু উপায় কি? সিগন্যালে গাড়িটা দাঁড় করাতে হলো। হথাত মাথায় এলো, বিজয়দা, রমার সাথে একান্তে কিছু কথা বলেছেন। রমার কাছে এই কথাগুলো অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে ও রমা নিজের ডায়েরিতে তা লিখে রাখবে। সুতরাং বিজয়দার চরিত্র বিশ্লেষণ একমাত্র রমার ডায়েরী থেকেই সম্ভব। কিন্তু পরপর ৩ দিন অফিস কামাই করেছি আর আজ যেহেতু একবার অফিসে চলে গেছি তাই কামাই করা সম্ভব নয়। সুতরাং বাড়ি ফিরেই ওই ডায়েরী থেকে বিজয়দার রহস্যটা উদ্ঘাটন করতে হবে।
সোজা অফিসের দিকে চলতে শুরু করলাম। আরও একটা রহস্য রয়ে গেছে। চিনুর ম্যাসেজ। ও আমায় কি বোঝাতে চাইল ওটা বলে। ‘Ranjan100isshan’ ‘25thmagh’ রঞ্জনই যে শান তা আমি জানি, কিন্তু আমার ছেলের মৃত্যুবার্ষিকী কেন উল্লেখ করল ও। আর রঞ্জনের নামের পাশের ওই ১০০ কথাটারও বা মানে কি? হয়ত এর উত্তর আমি পেয়ে যেতাম যদি চিনু জীবিত থাকতো। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ব্যাঙ্কের সামনে চলে এসেছি খেয়াল নেই। লিফট দিয়ে ওপরে উঠে ভেতরে উঁকি মারতেই দেখি ম্যানেজার বাবু অলরেডি চলে এসেছেন। পরপর ৩ দিন কামাই করেছি আজ আবার সকাল সকাল এসে বেরিয়ে গেছি; জানি কপালে প্রচুর দুঃখ রয়েছে। গুটি গুটি পায়ে নিজের টেবিলটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এমনসময় হঠাত ম্যানেজার স্যারের ডাক। ‘বিপ্লব বাবু, একটু আমার কেবিনে এসে দেখা করে যাবেন।’ হ্যাঁ, আজ আমার গাঁড় ফাটাবে মালটা। আবার স্যাক করে দেওয়ার হুমকি, ইংরিজিতে অখাদ্য কিছু গালাগাল ইত্যাদি। টেবিলে গিয়ে সিস্টেমটা অন করেই ম্যানেজারের কেবিনের দিকে যেতে শুরু করলাম। ‘মে আই কাম ইন স্যার?’ ভেতর থেকে খ্যারখ্যারে গলায় আওয়াজ এলো ‘হ্যাঁ, আসুন’। ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে রইলাম। কখন শুরু হবে টাইফুন তার অপেক্ষায়।
‘হ্যাঁ, বিপ্লব বাবু যার জন্য ডাকা। আজ অফিসে স্টাফ প্রচুর কম। আপনাকে ২-৩ টে সেকশন সামলাতে হবে একসাথে। কিছুক্ষন পরেই এক ভদ্রলোক আসবেন, নেট ব্যাঙ্কিং সংক্রান্ত কিছু বিষয় নিয়ে...’ আমি ওনাকে মাঝ পথেই থামিয়ে বলে উঠলাম ‘স্যার, আমি তো এই কাজগুলো খুব একটা জানিনা।’ ম্যানেজার বাবু প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন ‘জানিনা মানে। ১০ বছরের ওপর ব্যাঙ্কে চাকরি করছেন আর বলছেন জানিনা?’ আমি চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওনার বুঝি একটু মায়াই হল আমার প্রতি। ‘ওকে, আমি কিছু পেপার পাঠাচ্ছি, ওগুলো পড়ে নিন, সব বুঝে যাবেন।’ আমি চুপচাপ নিজের টেবিলে গিয়ে বসে গেলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই নেট ব্যাঙ্কিং সংক্রান্ত কাগজপত্র চলে এলো। আমিও কাগজগুলো খুলে ভালো করে চোখ বোলাতে শুরু করলাম। ‘একটা ইউসার নেম ও একটা পাসওয়ার্ড। ইউসারনেম ও পাসওয়ার্ডে লেটারের পাশাপাশি অঙ্কও থাকা বাধ্যতামুলক। যেমন prokashroy এটা সঠিক ইউসারনেম নয় কারন এরমধ্যে শুধুই লেটার রয়েছে কোন ডিজিট বা অঙ্ক নেই, কিন্তু prokashroy345 একটি সঠিক ইউসার নেম। একইভাবে password112 একটি সঠিক পাসওয়ার্ড হলেও password সঠিক পাসওয়ার্ড নয় কারন এরমধ্যে কোন অঙ্ক নেই। হাতদুটো একবার মাথার ওপর তুলে মনে মনে বিড়বিড় করে উঠলাম ‘প্রদোষ মিত্তিরের জয় হোক’। দু একজন স্টাফ আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। আমি সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংবরন করে নিলাম। ওরা তো আর জানেনা আমার মাথায় মাঝে মধ্যেই প্রদোষ মিত্তির ভর করে। মনে হয় আমি যা ভাবছি তা সঠিক। কিন্তু যা ভাবছি তা অত্যন্ত সন্তর্পণে করতে হবে। এর জন্য দরকার এর পরের স্টেপগুলো ভালো করে বোঝা।
‘আপনাকে এমন অনেক কাস্টমারকে হ্যান্ডেল করতে হতে পারে, যিনি টেকনিক্যাল ব্যাপারে একেবারে অজ্ঞ। মানে ধরুন ইন্টারনেট ব্যাবহার করতে জানেন না, ফোনের সিম যে নেট ব্যাঙ্কিংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাও বোঝেন না। এইরকম মানুষজন মাঝেমধ্যেই বিভিন্নরকম অসুবিধের সম্মুখীন হন। হয় তারা ইউসার নেম নয় পাসওয়ার্ড ভুলে যান। প্রতিটি ইউসারের এ্যাকাউন্টকে অ্যাকসেস করার জন্য ব্যাঙ্কেরও একটি প্রসেস আছে। খালি ব্যাঙ্কারকে সেই কাস্টমারের ইউসারনেম ও পাসওয়ার্ড জানতে হবে।’ চোখদুটো চকচক করছিল আমার। আজ একটা অপারেশনে নামবো। হঠাত দেখি এক ভদ্রলোক আমার সামনে এসে দাড়িয়েছেন। ‘আপনিই কি বিপ্লববাবু, আমাকে ম্যানেজারবাবু পাঠিয়েছেন।’ বুঝলাম ইনিই সেই যার দয়ায় কিছুটা ভাগ্যের জোরে আজ আমি ব্যাংকার অফ দা ইয়ার হতে চলেছি। জীবনে কখনো কোন কাস্টমারের সাথে এতো ভালো ব্যাবহার করিনি। দাঁতগুলো বাইরে বার করে হেসে ওনাকে বসতে বললাম।
‘আরে আর বলবেন না। আমি লোহার বিজনেস করি। আমরা কি আর এইসব নেট ফেট বুঝি। ছেলের জন্যই সব করতে হচ্ছে।’
কিছুটা অনুসন্ধিৎসু হয়েই ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘আপনার ছেলে কি করে? কোথায় থাকে?’
‘আরে আর কি বলব ছেলের তো বিশাল ব্যাপার! কিছুতেই ১১-১২ এ সাইন্স পাচ্ছিল না, লাইন করে স্কুলে সাইন্স পাইয়ে দিলাম। আজকাল তো আবার ইঞ্জিনিয়ার না হলে পাড়ায় মুখ দেখানো যায়না। বললাম, ব্যাটা ভালো করে পড়। ওই যে কিসব জয়েন্ট ফয়েন্ট হয়না, বললাম সেগুলো দে। শালা তাতেও ডাহা ফেল। ৩-৪ টে লিস্ট বার করল গরমেনট, ওর শালা নাম নেই। তারপর এক বন্ধু বলল প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে নাকি ম্যানেজমেন্ট কোটা থাকে। এই দশ বিশ লাখ ডোনেশন দিতে হয়।’ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ‘সেরকমই একটা কলেজে গেছিলাম বলে নেট ব্যাঙ্কিংয়ে টাকা দিতে হবে তাই একটা বানাতে এলাম।’ আমার মনের কথাতো আর ওনার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, উনি এটাও বুঝলেন না আমি কেন এতো হাসিখুশি রয়েছি। আনন্দে ওনার দুহাত জড়িয়ে ধরলাম। ‘আপনার ছেলে তো দাদা আর ৩-৪ বছরেই ভিআইপি হয়ে যাচ্ছে। আমার একটা ছোট্ট রিকোয়েস্ট আছে। আমি একটা গরীব ছেলেদের জন্য এনজিও চালাই। বলবেন চাকরি পাওয়ার পর যেন কিছু দান করে।’
সেই ভদ্রলোকের হাসি তো বাধ মানেনা। সত্যিই পয়সায় বেচে যাওয়া শিক্ষাব্যাবস্থার মেধা ওনার ছেলে, এরাই তো দেশের ভবিষ্যৎ।
সেই ভদ্রলোককে নেট ব্যাঙ্কিংয়ের এ্যাকাউন্ট ক্রিয়েট করে দিয়ে আমিও চললাম নিজের অপারেশনে। অপারেশন কমপ্লিট করতে প্রায় ঘণ্টা তিনেক লেগে গেলো। মনে মনে একবার বিড়বিড় করে উঠলাম ‘বিপ্লব পোদ্দার ব্যাংকার অফ দ্যা ইয়ার।’ শালা এতদিন পরে নিজেকে সত্যি হিরো হিরো লাগছিল। প্রায় ঘণ্টা ৬-৭ একটা সিগারেট ধরাইনি। তাই আমি অফিসের বাইরে চলতে শুরু করলাম। অফিস থেকে বেরিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে সুখটান দিয়ে চলেছি আর মনে পড়ে যাচ্ছে একেকটা ঘটনা। তখন সবেসবে চাকরি পেয়েছি, এক ব্যাক্তি এসে প্রায় পায়ে পড়ে গেলো। ‘দাদা, ছেলেটা জয়েন্টে দারুন র‍্যাঙ্ক করেছে। গরমেনট কলেজে চান্স পেয়েছে। মাত্র ৫০ হাজার টাকা লোণ চাই। আমি রিক্সা চালাই দাদা। আপনাদের হাতে তো এতো টাকা, দাদা আমায় এইকটা টাকা যেভাবে হোক দিয়ে দিন। ছেলেটাকে কলেজে ভর্তি করতে না পারলে কাউকে মুখ দেখাতে পারবো না দাদা’।
মুখের ওপর বলেছিলাম ‘না দাদা, এখানে আপনাদের মত নিম্নবিত্তকে লোণ দেওয়ার কোন স্কিম নেই।’ তার ঠিক ২ বছর পর আমার ছেলেটা মারা গেছিল। শালা এ্যাম্বুলেন্সে যখন ছেলেটা হেঁচকি তুলছিল, বিচি শুকিয়ে গেছিল একদম। মনে হচ্ছিল সেই রিক্সাওয়ালাটা পাশে বসে বলে চলেছিল ‘দেখ রে মাদারচোদ, ছেলের কষ্ট কেমন লাগে?’ শালা ছেলের মৃত্যুর চেয়েও বোধ হয় বেশী কষ্ট ছেলের ক্যারিয়ার নিজের চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যেতে দেখা। দৌড় দৌড় শুধু ইঁদুর দৌড়। এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে গেলে অন্য কেউ পাছায় লাথি মেরে বেরিয়ে যাবে। শুধু দৌড়াতে হবে। কি পেলাম এই দৌড়ে, ছেলেটাকেই তো বাঁচাতে পারলাম না। বউটা শালা দুরারোগ্য রোগের রুগী হয়ে গেলো। যদি আমার বাপের একটা দু নাম্বারি বিজনেস থাকতো? যদি আমি মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্মাতাম? তাহলে কি আমায় সত্যিই এই দিন দেখতে হত? শালা উচ্চবিত্তের ছেলে মেধাবী না হয়েও ম্যানেজমেন্ট কোটায় ইঞ্জিনিয়ার আর নিম্নবিত্তের ছেলে মেধাবী হয়েও রিক্সা চালায়। ১০ শতাংশ মানুষ, রোজ বাকি ৯০ শতাংশের পোঁদ মেরে চলেছে, আর আমরাও ভাগ্য, ঈশ্বর ইত্যাদি অজুহাত দেখিয়ে রোজ ওই ১০ শতাংশের দিকে পোঁদটা সুন্দরভাবে এগিয়ে দিচ্ছি। না, আমি নগন্য। আমি শুধুই থিওরি চোদাতে পারি।
এইসব আঁতলামি করতে করতেই মগজটা হঠাত অন্য অভিমুখে ঘুরে গেলো। অফিসের সামনে বিশাল ট্র্যাফিক জ্যাম হয়েছে। সার দিয়ে একের পর এক গাড়ি দাঁড়িয়ে। তারই মধ্যে একটা সাদা রঙের এ্যাম্বাসাডার গাড়ি। এই গাড়িটা আমি প্রচণ্ড ভালো করে চিনি। এটা শর্মাজীর। কাঁচটা সামান্যই নীচের দিকে নামানো। তাও বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে গাড়ির মধ্যে সাজুগুজু করা কোন এক সুন্দরী রমনী রয়েছে। কে সে? এইকি জুলি? একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম ওইদিকে। গাড়ির কাঁচটা ধীরে ধীরে নীচে নামছে। আমিও জানি আজ এই মুহূর্তেই হয়ত আমি এতো বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকা রহস্যের পর্দা ফাঁস করতে পারবো। গাড়ির কাঁচটা একটু একটু করে নীচে নামছে আর আমারও মনের সেই ইচ্ছেটা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। জুলি কে? হঠাত গাড়িটা বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলো। আমি কিছু বোঝার আগেই সিগন্যালটা গ্রিন হয়ে গেলো ও গাড়িটা অনেক আগে এগিয়ে গেলো। জানি এই সুযোগ হয়ত আর জীবনে দ্বিতীয়বার পাবনা। রাস্তা বরাবর দৌড়াতে শুরু করলাম, সামনেই একটা নো রিফিউসাল ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। অন্য কেউ চেপে বসার আগেই আমায় ওটায় চেপে বসতে হবে।
ভাগ্য আমারই পক্ষে ছিল। খুব সহজেই ট্যাক্সিটা পেয়ে গেলাম। ‘দাদা, ওই সামনের গাড়িটাকে ফলো করুন। টাকা নিয়ে ভাববেন না।’ শালা টাকার লোভ কেই বা ছাড়তে পারে। আমার ট্যাক্সিটাও প্রচণ্ড বেগে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল। শত চেষ্টা করেও আমি গাড়ির ভেতরে যে মহিলা আছে তার মুখটা দেখতে পাচ্ছিনা। আমাদের গাড়িটা প্রচণ্ড স্পীডে শর্মাজীর গাড়িটাকে ফলো করতে শুরু করল। প্রায় আধ ঘণ্টা আমরা পিছু নিয়ে চলেছি। আবার বাধ সাধল সেই ট্রাফিক সিগন্যাল। শালা, এইবার ভাগ্য বিশাল জোরে একটা লাথি মারল। ওদের গাড়িটা সিগন্যাল রেড হওয়ার বেশ কিছু আগেই পার হয়ে গেছিল। মনে হয়না ৫ মিনিটের আগে আমরা এখান থেকে বেরোতে পারবো। সুতরাং জুলি কে সেই রহস্য আমার পক্ষে আর সমাধান করা সম্ভব নয়। রমা কি জুলি? না রমা জুলি নয়? রমার ডায়েরী বা রমার চিঠি এই দুটো থেকেই আমি বুঝেছি, রমা জুলি নয়, কিন্তু জুলি রমার পরিচিত কেউ। কিন্তু কে সে? এরকম নয়ত রমা ছলনা করছে। রমা আমায় ঠকাচ্ছে! নিজেরই মনে একবার বলে উঠলাম ‘না, রমা আমার সাথে এরকম করতে পারেনা।’ জানি ওদের আর ধরতে পারবো না, কিন্তু রমাই কি জুলি? এই রহস্যটা সমাধান এখনো সম্ভব। যদি শর্মাজীর গাড়িতে রমা থেকে থাকে তাহলে ল্যান্ড লাইনে ফোন করলে ও কিছুতেই রিসিভ করতে পারবেনা।
যা ভাবা তাই কাজ, সঙ্গে সঙ্গে আমার ল্যান্ড লাইন নাম্বারটায় ফোন লাগিয়ে দিলাম। মনে সন্দেহ রয়েছে, দ্বিধা দ্বন্দ্ব রয়েছে কিন্তু হৃদয় বারবার করে বলে চলেছে ‘না রমা, বাড়িতেই আছে।’ ক্রিং ক্রিং করে রিং হয়ে চলেছে। প্রতিটা রিংয়ের প্রতিধ্বনি আমার বুকের মধ্যে হচ্ছে। আমার হৃদয় বারবার করে বলে চলেছে ‘রমা তুমি ঘরের যে প্রান্তেই থাকো আগে ফোনটা রিসিভ কর।’ অন্তত ২০ বার ক্রিং ক্রিং করে শব্দ হল, কিন্তু কেউ ফোনটা রিসিভ করলনা। রমার দিদি মিতা কোথায়? ওরা দুই বোন মিলে আবার কোথাও বেরয়নি তো? এই শোকের পরিবেশে বাইরে ঘুরতে যাওয়াটা সত্যিই অস্বাভাবিক। আমি আবার একবার কল করলাম। কিন্তু বারবার রিং হওয়ার পরও কেউ ফোনটা রিসিভ করলনা। নিজেরই অজান্তে চেঁচিয়ে উঠলাম ‘রমা তুমি কোথায়?’ এদিকে সিগন্যালটা আবার গ্রীন হয়ে গেছে। ড্রাইভার গাড়িটা একটু বাঁদিক করে পার্ক করে আমায় জিজ্ঞেস করল ‘স্যার, এবার কোথায় যাবো?’ হতাশায়, ভয়ে আমার দুই চোখ জলে ভরে উঠেছে। ‘ঈশ্বর যেন আমার সন্দেহ সত্যি না হয়। যেন রমা বাড়িতেই থাকে।’ মনে মনে বলে উঠলাম। দেখি ড্রাইভারটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ‘কিছু প্রবলেম হয়েছে স্যার?’ ওর কথায় আমার হুঁশ ফিরল। কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলাম ‘ভাই, আমি স্যার নই। তোমারই মত খেটে খাওয়া এক মানুষ। কলকাতার এই রাস্তাগুলো তুমি আমার চেয়ে অনেক ভালো বোঝ। ওই গাড়িটার মধ্যে আমার জীবন রয়েছে। ওই গাড়িটা খুঁজে না পেলে আমি বাঁচব না।’ দেখলাম ড্রাইভারটা বেশ কিছুক্ষন আবেগপ্রবণ হয়ে রইল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল ‘চিন্তা করবেন না দাদা, এই রাস্তাটা সোজা বাইপাসের দিকে গেছে। আমি ওইদিকেই যাচ্ছি।’ গাড়িটা আবার চলতে শুরু করল। শ্রান্ত শরীরে আমিও হেলান দিয়ে পড়ে থাকলাম।
সত্যিই কি রমার ওই চিঠি বা রমার ডায়েরী এসব শুধুই আমার চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য! বারবার করে নিজের মনে প্রশ্ন করতে লাগলাম। আমার হৃদয়ে রমার অংশই সর্বাধিক। ‘না রমা জুলি নয়’ এই কথাটাই তাই বারবার করে ভেসে আসতে লাগলো। আমার তো আর কলার আইডি নেই, তাই ল্যান্ড ফোনে কে ফোন করেছে তা ওর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। শেষ উপায় রমার মোবাইলে ফোন করা। যদি সত্যিই ও শর্মাজীর সাথে থেকে থাকে তাহলে আশেপাশের ট্রাফিকের আওয়াজেই আমি তা বুঝে যাবো। কল লাগালাম রমার মোবাইলে। সুইচড অফ। চোখদুটো হতাশায় বন্ধ করে নিলাম। মনিদা খুন হয়েছিল শুক্রবার। শুক্রবার অফিসে চরম ব্যস্ততা ছিল। ফিরতে একটু দেরী হবে এটা বলার জন্য ওকে ফোন করেছিলাম। একদম একই অবস্থা ছিল। ল্যান্ড ফোনে কেউ ফোন রিসিভ করেনি। রমার মোবাইলটা সুইচ অফ বলছিল। বাড়ি ফিরে দেখলাম বিছানার ওপর রমার ঘামে ভেজা প্যানটিটা পড়ে রয়েছে। সাধারনত সালোয়ার পরে বাইরে না বেরলে রমা প্যানটি ইউস করেনা। সঙ্গে সঙ্গে রমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘রমা, তুমি কি কোথাও গিয়েছিলে?’ কিছুটা চমকে উঠেছিল রমা। ও তারপর উত্তর দেয় ‘কই না তো’। আরও অনেক অনেক ঘটনা রয়েছে এবং তার সাথে যোগ হয়েছে রমার এই ফোন না ধরা। রমা কি সত্যিই আমায় ছলনা করে চলেছে। নিজের মনকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। আবার ল্যান্ড ফোনে একবার ফোন করলাম। সেই একই ক্রিং ক্রিং করে শব্দ হল আর তারপর ফোনটা কেটে গেলো। হতাশা শুধুই হতাশা। চোখদুটো বন্ধ করে পড়ে রইলাম।
এইভাবে কতক্ষন গাড়িটা চলেছে খেয়াল নেই। বাইপাশের ঠাণ্ডা হাওয়া আর সারাদিনের ধকল; সব মিলিয়ে এতো ক্লান্তি এসেছিল কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। ড্রাইভারের প্রচণ্ড জোরে একটা চিৎকারে ঘুমটা ভাঙল। ‘স্যার, ওই যে গাড়িটা।’। চোখ খুলে দেখি, বাইপাশের একধারে গাড়িটা পার্ক করা আছে। আমাদের গাড়িটা ঠিক ওর পেছনে পার্ক করা হল। আমরা দুজনেই দৌড়ে গাড়িটার কাছে গেলাম। আবার দুটো মৃতদেহ, শর্মাজী আর শর্মাজীর ড্রাইভার। আশপাশটা সম্পূর্ণ জনহীন। একজনকেও দেখা যাচ্ছেনা। খালি কয়েকটা গাড়ি প্রচণ্ড স্পীডে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে।
 
১৯

ড্রাইভারের মুখের দিকে একবার তাকালাম। ভয়ঙ্কর রকম ভয় পেয়ে গেছে। আমাকে ফিসফিস করে বলতে শুরু করল ‘স্যার, চলুন এখান থেকে পালিয়ে যাই, নয়ত পুলিশ কেসে ফেঁসে যাবো।’ সত্যি ও ঠিকই বলছে, এই অবস্থায় যদি আমাদের কেউ দেখে ফেলে তাহলে স্বয়ং ভগবানও আমাদের বাঁচাতে পারবেনা। দ্রুত গাড়িটা স্টার্ট করে আবার অফিসের দিকে যেতে শুরু করলাম। কাল রাতে রঞ্জন খুন আর আজ সকালে চিন্ময় খুন আর এখন শর্মাজী খুন। কোন উর্বর মস্তিস্কের সিরিয়াল কিলারও এতো দ্রুত খুন করার চেষ্টা করেনা কারন এতে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। তাহলে কেন? কেউ কি পথের কাঁটাগুলোকে সরিয়ে দিয়ে নিজেকে সেফ স্থানে রাখতে চাইছে। কিন্তু কে? রঞ্জন, চিন্ময়, শর্মাজী মৃত। তাহলে কে? সন্দেহ করার মত একজনই বাকি রয়েছে তিনি বিজয়দা। মধুকর ভিলা থেকে প্রায় ফিল্মি আদবকায়দায় পালিয়ে আসার সময় থেকেই বিজয়দার ওপর আমার প্রবল সন্দেহ। কিন্তু, সত্যি বলতে বিজয়দা ঠিক কিভাবে এই ঘটনার সাথে জড়িত তা এখনো আমার কাছে পরিস্কার নয়।
ভাবলাম আরোও একবার রমাকে ফোন করি। বাড়ির ল্যান্ড ফোনে ফোন করে লাভ নেই কারন আমি সিওর যে বাড়িতে নেই। রমার মোবাইলে আবার একবার ফোনটা লাগালাম। অদ্ভুতভাবে এবার রিং হল অথচ কিছুক্ষন আগেও সুইচ অফ ছিল। বার ৬-৭ রিং হওয়ার পরই রমা রিসিভ করল। আমার মাথা থেকে যেন একরাশ কালো মেঘ নেমে গেলো।
‘হ্যালো, রমা তুমি কোথায়? তুমি জানো তোমায় কতবার ফোন করেছি আমি। তোমার মোবাইল সুইচ অফ...’ আমার কথাটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই রমা বেশ কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল ‘বিপ্লব, তুমি কোথায়? আমায় এক্ষুনি তোমার সাথে দেখা করতে হবে।’ ওর কথাটা মোটামুটি বুঝতে পারলেও ভয়েসটা ক্লিয়ার আসছিলনা। আশপাশ থেকে বেশ কিছু বাস ট্রামের শব্দে বিশাল একটা নয়েস তৈরি হচ্ছিল। এতোটুকু বুঝলাম যে রমা খুব ভয়ের মধ্যে রয়েছে। আমি বললাম ‘রমা তুমি কোথায় আছো বল আমি এক্ষুনি আসছি।’ মনে হয় রমা আমার কথাটা শুনতে পেলো না। ‘হ্যালো, হ্যালো’ বলতে বলতে লাইনটা কেটে গেলো। এ এক ভয়ঙ্কর বিপদ। রমা কোথায় আছে তা না জানলে ওকে কোনমতেই উদ্ধার করা সম্ভব নয়। আমি আবার একবার ওকে ফোন করতে যাচ্ছি দেখি আমার মোবাইলেই ফোন চলে এলো। কার ফোন না দেখে সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে নিলাম।
‘হ্যালো রমা তুমি কোথায়? প্লিস বল তুমি কোথায়? আমি সত্যিই খুব চিন্তায় আছি।’ আমাকে সম্পূর্ণ স্তম্ভিত করে দিয়ে ওপাশ থেকে এক পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো। ‘আরে বিপ্লব বাবু আপনি কোথায় বলুন তো? কতবার বলেছি যে নিজেকে শারলক হোমস ভাববেন না। যা কিছু হবে পুলিশকে জানাবেন। আবার আপনি একা একা...’ আমার আর সহ্য হচ্ছিল না। প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে বললাম ‘বিজয়দা, আমার স্ত্রী ছাড়া এই পৃথিবীতে সত্যিই আমার কেউ নেই। ওর কোন ক্ষতি যেন না হয়।’ বিজয়দার উত্তরটা ছিল ভয়ঙ্কর রহস্যময়। ‘নিজেকে একটু বেশীই স্মার্ট ভেবে ফেলেছেন আপনি। রমাদেবী কি করে বিপদ কাটিয়ে উঠবেন তা আমি জানিনা। কিন্তু আপনি ভাবুন আপনি নিজের বিপদটা কিকরে কাটাবেন?’ যেন মাথার ওপর বাজ পড়ল। বিজয়দা কি আমায় হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম ‘আপনি কি বলতে চান?’ সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে ঠাণ্ডা গলায় যা ভেসে এলো তা আমার হৃদয়ে কম্পন ধরাতে বাধ্য। ‘যেদিন মনীন্দ্র বাবু খুন হয়েছিলেন হোটেলের ঠিক বাইরে আপনার স্কুটার পার্ক করা ছিল। হোটেলের পারকিং লিস্টে আপনার স্কুটারের নাম্বার পাওয়া গেছে। পার্ক করেছিলেন ঠিক ৯-১০ টার মধ্যে। মনিবাবুকে ওপর থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হয় ঠিক সাড়ে ৯ টার সময়...’ আর সত্যিই নিজেকে সংবরন করা সম্ভব ছিলনা। প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে বলে উঠলাম ‘বিজয়দা আপনি কি মনে করেন খুনগুলো আমি করছি। আর আপনি বোধ হয় এটা ভুলে গেছেন যে হোটেলে মনিবাবু উঠেছিলেন তার ঠিক উল্টো দিকেই আমার অফিস। অফিস যাওয়ার পথে হোটেলটা বাঁ দিকে পড়ে তাই মাঝে মধ্যে ওখানে আমি গাড়িটা পার্ক করে দি। সেদিন অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর আমি ফেরত আসি। শর্মাজীর লোণের কাগজ অফিসেই ফেলে এসেছিলাম। ওটাই আনতে যাই। সাক্ষী হিসেবে আমি...’ আর বলতে পারলাম না, কিকরে বলি সাক্ষী হিসেবে আমি শর্মাজীর নাম বলতে পারি, ও তো মৃত। ফোনে হলেও বিজয়দার অট্টহাস্য চিনতে আমার খুব একটা অসুবিধে হলনা।
‘সাক্ষী হিসেবে কার নাম আপনি পেশ করবেন বিপ্লব বাবু? শর্মাজী? শর্মা তো মরে ভূত হয়ে গেছে!’ আমার মাথাটা বনবন করে ঘুরতে শুরু করে দিলো। শর্মাজী যে মারা গেছে তা বিজয়দা কিকরে জানলেন? আমার কোন জবাব দেওয়ার আগেই বিজয়দা বলে উঠলেন ‘চিন্ময়ের খুন হওয়ার সময়ও ঘটনাস্থলে আপনি ছিলেন।’ এবার আর আমার পক্ষে নিজেকে সংবরন করা সম্ভব ছিলনা। চেঁচিয়ে বলে উঠলাম ‘রাষ্ট্র ব্যাবস্থা আপনাদের অস্ত্র দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে তার মানে তো এটা নয় যা ইচ্ছে তাই বলবেন। চিন্ময়ের খুন হওয়ার সময় তো আগে ঘটনাস্থলে আপনি পৌঁছেছিলেন?’ আমার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই বেশ জোরে একটা অট্টহাস্যের সাথে বিজয়দা বলে উঠলেন ‘কই না তো আমি তো ঘটনাস্থলে খুন হওয়ার অনেক পরে গেছিলাম। এক সোর্সের দেওয়া ইনফরমেশন পেয়ে গেলাম আর দেখি আপনি দাঁড়িয়ে আছেন, আপনার হাতে রক্তের দাগ। কি বিপ্লব বাবু, চার্জশিটটা কেমন হবে বলুন তো? ওহ মিডিয়া থেকে পলিটিসিয়ান প্রত্যেকেই একদম চেটে পুটে খাবে।’ নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিলনা। কিছুটা হতাশার সুরে আমি বললাম ‘বিজয়দা, কোন প্রমান ছাড়া আপনি কিছুতেই আমায় গ্রেফতার করতে পারবেন না।’ আবার একটা অট্টহাস্য। ‘আপনার বাবা কি এমএলএ না আপনার মেসোমশাই মন্ত্রী? কে বলল পুলিশ কোন প্রমান ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনা? শুধু একটা শক্তিশালী চার্জশিট বানাতে হয়।’ আর সত্যি ধৈর্য রাখা সম্ভব ছিলনা। ‘আপনার যা করার করে নিন, পারলে ফাঁসি কাঠে চড়িয়ে দিন। এখনো দেশে গনতন্ত্র বলে...’ আমায় আবার থামিয়ে দিয়ে বিজয়দা কিছুটা উপহাস করেই বলে উঠলেন ‘একি ভুতের মুখে রামনাম শুনছি তো। বিপ্লব আর গনতন্ত্র। ওরে বাবা, বিপদে পড়লে যেমন মানুষ মন্দিরে যায় বিপ্লবও তাহলে গনতন্ত্রের কথা বলে!’ সত্যিই আমার উত্তর দেওয়ার কিছুই ছিলনা। নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বললাম ‘আপনি কি চান বিজয়দা? আপনি কার পক্ষে, সত্যের না মিথ্যার?’ প্রায় এক মিনিট নীরবতা। ‘আমি আপনাকে একটা শিক্ষা দিতে চাই, এমন শিক্ষা যা আপনি সারাজীবন মনে রাখবেন। কাল সকাল ৬ টায় আমি আপনাকে গ্রেফতার করব। ওপরমহল থেকে এই কেসটার চার্জশিট বানিয়ে ফেলার জন্য প্রচুর চাপ দিচ্ছে। আমার কাছে যা মেসিনারি আছে তাতে অনায়াসেই আপনাকে গ্রেফতার করা যায়।’ আমার মুখ দিয়ে একটাও কথা বেরোল না। জানি বাঘের মুখে পড়ে গেছি, তবুও ঠাণ্ডা মাথার মানুষকে ছুঁতে বাঘও দুতিন বার ভাবে। তাই নিজেকে একটু সংবরন করে বললাম ‘বিজয়দা, যদি আমি পালিয়ে যাই তাহলে?’
আবার একটা অট্টহাস্য। ‘আপনি তো ড্রাইভারের পাশে বসে আছেন, তাই তো। একবার আড় চোখে ওর প্যান্টের পকেটের দিকে তাকান।’ কিছুটা বিস্মিত হয়েই আমি তাকালাম। প্যান্টের পকেটটা উঁচু হয়ে রয়েছে। ‘কি দেখলেন আর কি বুঝলেন?’ আমি ভেবেচিন্তে কিছু জবাব দেওয়ার আগেই বিজয়দা বললেন ‘ও পুলিশের ইনফরমার। ৭ বছর জেল খেটে এখন জামিনে মুক্ত। আমার এক বাক্যে ও আপনার মাথায় টুক করে একটা গুলি মেরে লাশটা বাইপাশে ফেলে চলে আসবে।’ ভয়ে আমার হাত পা থরথর করে কাঁপতে শুরু করে দিলো। চুপ করে বসে থাকলাম। ‘পালাবার কোন চেষ্টা করবেন না। আপনাকে প্রতি মুহূর্তে কেউ না কেউ নজর রাখছে।’ আমি জানি আমি চক্রব্যূহের মধ্যে পড়ে গেছি। এখান থেকে পালানো প্রায় অসম্ভব। মোবাইলটা কানে দিয়ে চুপ করে বসে থাকলাম। আবার একবার আড় চোখে ড্রাইভারের দিকে তাকালাম। ‘বিজয়দাকে আমার প্রনাম জানাবেন।’ ড্রাইভারের কথায় আমার বুকের ধুকপুকানিটা ১০০ গুণ বেড়ে গেলো। ‘বিপ্লব বাবু, শারলক হোমস হওয়ার জন্য আমাদেরকে ২ বছরের ট্রেনিং দেওয়া হয়। আপনাদের মত সাধারন লোক যদি শারলক হোমস হয়ে যায় আমরা খাবো কি!’ আমার কাছে কোন দ্বিতীয় রাস্তা ছিলনা, শুধুমাত্র বিজয়দার কথা শুনে যাওয়া ছাড়া। এই পুলিশের চাকরিটা করার জন্য আমি ২ খানা এসি ঘরের চাকরি ছেড়েছি বিপ্লব বাবু। আপনি তো এখনো জুলিকেই খুঁজে বার করতে পারলেন না। ওহ সরি, সত্যি বলতে চিনতে চাইলেন না। ভালোবাসা, বুঝলেন বিপ্লব বাবু ভালোবাসা; এটা মানুষকে অন্ধই বানিয়ে এনেছে চিরকাল।’ ফোনটা কেটে দিলেন বিজয়দা। ওনার শেষ কয়েকটা কথা হয়ত আমার কাছে অমৃতবানীর সমান। সত্যি ভালোবাসা, এই শব্দটার জন্য আমি কেরানী হয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিলাম।
চোখ দুটো বুজে ভেবে চলেছি, দেখি আবার ফোন। জানি রমাই ফোনটা করেছে। কিছুতেই মন চাইছিলনা ফোনটা রিসিভ করতে। বারবার মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল, ‘বিপ্লব বাবা, সোনা আমার, আমাদের কথাও একটু ভাব। তুই একটা নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে। এভাবে একটা মেয়ের জন্য পাগল হয়ে যাস না বাবা। কত সরকারী চাকরির পরীক্ষা বেরোয়, ওগুলোর জন্য পড়, তুই একটা সরকারী চাকরি পেলে আমাদের অবস্থা ফিরে যাবে, কত কষ্ট করে তোকে আমরা পড়িয়েছি বল তো?’ সেদিন নিজেকে সামলাতে পারিনি কেঁদে মায়ের কোলে মাথা গুঁজে দিয়েছিলাম। ‘মা, আমি রমাকে ছাড়া বাঁচব না মা। ওর বাড়িতে আমাদের বিয়েটা কিছুতেই মেনে নেবেনা। আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করতেই হবে মা। নয়ত আমি রমাকে হারিয়ে ফেলব।’ মায়ের চোখেও জল ছিল, ‘দেখ যা ভালো বুঝিস, তবে তোর বাবাও মানবে না। তোর জন্য আমরা সবই ছেড়েছি। তোর বাবা, কখনো মানবে না।’ না, আমার বিয়েটা আমার বাবা মেনে নেয়নি কখনো। প্রথমে এই ব্যাঙ্কের চাকরিটা জোগাড় করা তারপর রমাকে বিয়ে করে একটা ভাড়া বাড়িতে উঠলাম। শ্রেনী বৈষম্যই এই সমাজের সবচেয়ে বড় রোগ। অনেক পরে বুঝেছি, একটা বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করেই জীবনটা নষ্ট করেছি। মায়ের কথা, বাবার কথা, পুরনো বন্ধুদের কথা এগুলো যত মনে পড়ছিল, বুকের মধ্যে একরাশ ঘৃণা জমা হচ্ছিল। ফোনটা বাধ্য হয়েই রিসিভ করলাম।
‘বিপ্লব, আমার কথাটা মন দিয়ে শোন...’ ভালো লাগছিলনা আর রমার ওই ন্যাকা ন্যাকা মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলো শুনতে। ওকে মাঝপথেই থামিয়ে দিলাম। ‘রমা, তুমি কি সত্যিই আমায় ভালোবাসো? পারবে আমি যদি তোমায় এক্ষুনি হাওড়া ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিতে বলি, ঝাঁপ দিতে। রমা তোমাকে না পেলে সত্যিই আমি আত্মহত্যা করতাম। রমা তুমি আমায় ঠকিয়েছ। রমা আমার ওই বস্তাপচা আইডিওলজিই ঠিক। শ্রেনী চরিত্রই শেষ কথা। আমার উচিত হয়নি তোমার মত একটা বড়লোকের আদুরে মেয়েকে ভালোবাসা। তোমার জন্য আমি আমার বাবা মার কাছে ছোট হয়ে গেছি।’ আমি নিজেও বুঝতে পারিনি যে আমার কণ্ঠস্বর ক্রমশ এতো তীব্রতর হয়ে যাবে। ট্যাক্সিচালক কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েই গাড়িটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করায়। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে তখন রমার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠার শব্দ ভেসে আসছে। ‘বিশ্বাস কর বিপ্লব, আমি তোমায় ঠকাই নি। আমি তোমায় আজও ভালোবাসি, আগের চেয়ে অনেক বেশী ভালোবাসি। আমি প্রতি মুহূর্তে তোমার খেয়াল রাখার চেষ্টা করি।’ মাথাটা বনবন করে ঘুরছিল ‘খেয়াল রাখার চেষ্টা কর! এতবড় মিথ্যে কথাটা তুমি বলতে পারলে! কোনোদিন ভেবেছ ওই পুরনো বাড়িটায় আমার বাবা মা একা একা কি করে থাকে? তুমি জানো শেষ দশ বছরে প্রতিদিন আমার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। একবারও বুঝতে পেরেছ, আমি কষ্ট পাই বলে। তোমার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আমি কি করিনি রমা! ক্লাউন সেজেছি ব্যাঙ্কে কেরানীর চাকরি করেছি, নিজের আইডিওলজি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি, তুমি কি করেছ রমা?’
রমার বুজে আসা গলাটা থেকে একটাই শব্দ বেরোল ‘আমি জানি বিপ্লব তুমি আমায় বিশাল ভুল বুঝেছ। কিন্তু আমি তোমায় সত্যি প্রচুর ভালোবাসি বিপ্লব।’ আর শালা শুনতে ভালো লাগছিলনা। ‘ভালোবাসা’ এর মানে কি তাই শালা বুঝলাম না। নিশ্চয়ই ভালোবাসা মানে এই নয় একটা বড়লোকের মেয়ের আজীবন চাকরে পরিনত হয়ে যাওয়া। রমার ওপর আমার দুঃখটা শুধু একটাই জায়গায়। আমি ফোনটা কেটে দিলাম। জানি রমাও প্রচণ্ড অভিমানী ঘুরে ফোনটা আর ও করবেনা। নাহ, এরকম মাগীর মত ফিচফিচ করলে হবেনা। চোখদুটো ভালো করে মুছে ডান দিকে তাকালাম। দেখি ড্রাইভারটি অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
‘ভাই তুমি তো দাগী আসামী। হাড়কাটা গলি বা সোনাগাছিতে যাতায়াত আছে নিশ্চয়ই?’ আমার এই আকস্মিক কথাটা শুনে ড্রাইভার ভাইয়ের তো পুরো পিলে চমকে গেলো। আমি আবার বললাম ‘সেরকম কিছু করেছ কি?’ এবার একটু আমতা আমতা করে ওর জবাব এলো ‘সেরকম মানে? কি বলছেন?’ একটু মুচকি হেসে উত্তর দিলাম ‘এই বিডিএসএম মানে দড়ি দিয়ে হাত পা বেঁধে রেন্ডি চোদা বা ওইধরনের কিছু?’ ‘আরে দাদা, কি যে বলেন। আমরা কি আর হাইফাই মাগী চুদি? আমরা তো পেটো বেশ্যাতেই খুশি থাকি।’ বুঝলাম মালটার ওইদিকে একটু আধটু যাতায়াত রয়েছে। টোপটা দিয়েই দিলাম। ‘আপার ক্লাস কল গার্লকে চুদবে? একদম ফুল বিডিএসএম। টাকা নিয়ে ভাববে না।’ বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর উত্তর এলো ‘হ্যাঁ, দাদা, আপনি যদি পাইয়ে দেন, কেন হাতছাড়া করব?’ আমিও জিজ্ঞেস করলাম ‘একটা ফাঁকা ঘর জোগাড় করতে পারবে। আমার আবার একটা শখ রয়েছে। যতই হাইক্লাস মাগী চুদি না কেন ওই হাড়কাটা গলি বা সোনাগাছির ভেতরেই চুদব। ওখানে মজাই আলাদা।’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো ‘আরে দাদা, কোন চিন্তা করবেন না। হাড়কাটা গলিতে আমার খাতা চলে।' প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উঠলাম ‘দেখি তোমার ফোনটা? একটা মাগী আছে নাম জুলি। প্রথমে রং নাম্বার বলবে। তারপর নিজেই অন্য একটা নাম্বার থেকে কল করবে। যে রেটই বলুক না কেন হ্যাঁ বলে দেবে। আর একটা কথা একটু আপার ক্লাসদের মত কথা বল। নাও ডায়াল করে দিয়েছি কথা বলে নাও। আর হ্যাঁ, একটু খেয়াল কোরো তো গলাটা কি একটু ধরা ধরা লাগছে? নাও কথা বল।’
কানটা খাড়া করে পেতে রাখলাম। অনেকক্ষণ রিং হল কিন্তু কেউ রিসিভ করল না। ‘দাদা, ফোন তো রিসিভই করলনা?’ ড্রাইভারের দিকে একটু মুচকি হেসে বললাম ‘কয়েক মিনিটের মধ্যে একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসবে। রিসিভ করবে।’ কথাটা শেষ হতে না হতেই অন্য একটা নাম্বার থেকে ফোন এসে গেলো। আমিও সজাগ হয়ে থাকলাম। ‘হ্যালো জুলি?’ ‘একদম কাজের কথায় চলে আসছি। তোমার নাম্বার ইন্টারনেটের একটা সাইট থেকে পেয়েছি। বহুদিনের শখ তোমায়। কি? আরে কথাটা তো বলতে দাও।’ আমি কানটা খাড়া করে পেতে রেখেছিলাম। দু'খানা আবেগ; আনন্দ ও দুঃখ। আনন্দে বুকটা উথাল পাতাল হয়ে যাচ্ছে এই ভেবে যে আন্দাজে আমার মারা ঢিলটা একদম ঠিক জায়গায় লেগেছে। আর যন্ত্রণা; থাক সে আর কাকে বোঝাবো! হৃদয় ভাঙ্গার যন্ত্রণা তো নিম্ন ও মধ্যবিত্তের রোজকার সম্বল। ড্রাইভার আমার দিকে তাকিয়ে বলল ‘কি নাম্বার দিয়েছেন দাদা, বলল তোমার নাম্বার পুলিশকে দিচ্ছি কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশই তোমায় ফোন করবে।’ আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। প্রচণ্ড জোরে অট্টহাস্য করে উঠলাম। মনে মনে বিড়বিড় করলাম ‘হ্যাঁ, পুলিশ, পুলিশই ফোন করবে।’ মুহূর্তের মধ্যে অন্য একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এলো। ড্রাইভার ফোনটা রিসিভ করল। এই কণ্ঠস্বরটি চিনতে পারা আমার পক্ষে অত্যন্ত দরকার। কানটা একদম সজাগ করে রইলাম। হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। এই রাশভারী কণ্ঠস্বরটা কি আমি কোনোদিন ভুলতে পারি। ‘ওকে। হ্যাঁ, আমার গাড়ির নাম্বার এক্সক্সক্স। আর আধ ঘণ্টার মধ্যে কলেজ স্ট্রিটে ঢুকে যাচ্ছি। কলেজ স্কয়ারের সামনে অপেক্ষা করব। ওকে নো প্রবলেম।’ ফোনটা কেটে ড্রাইভার ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল ‘দাদা, ২ লাখ বলছে!’ আমি শুধুই মুচকি হাসলাম। আরও একটা প্রশ্ন রয়ে গেছে। তাই করেই ফেললাম ‘আচ্ছা, ভাই, জুলির গলাটা কি একটু ধরা ধরা লাগছিল?’ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ও উত্তর দিলো ‘হ্যাঁ, একটু ভারী ভারী লাগছিল।’
আমাদের গাড়িটা ক্রমশ কলেজ স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে চলেছে। বুকের মধ্যে একরাশ যন্ত্রণা যেমন রয়েছে এই ১০ বছর ধরে চেপে থাকা সমস্ত যন্ত্রণার একটা প্রতিশোধ নেওয়ার আনন্দও রয়েছে। ‘ভাই, আমার কিন্তু কয়েকটা শর্ত আছে। প্রথমত তুমি আরও ২-৩ জনকে জোগাড় কর। আর এ্যান্যাল সেক্স ছাড়া অন্য কোনকিছু হবেনা। উফ জাস্ট ভাবতে পারছিনা। আপার ক্লাস কল গার্লকে আমরা সবাই মিলে পোঁদ মারব। ওর হাত পা দড়ি দিয়ে জানলার গরাদের সাথে বেঁধে রাখবো। সারা ঘর জুড়ে পানের পিকের দাগ। উফ জাস্ট ভাবতে পারছিনা!’ ড্রাইভারটা কিছুটা নার্ভাস হয়েই উত্তর দিলো ‘দাদা, কোন প্রবলেম হবেনা তো? যদি...’ হয়ত ও ভাবতে পারেনি আমি এভাবে চেঁচিয়ে উঠব। ‘মাদারচোদ ওই রেন্ডিটার জন্য আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। ও মরে গেলেও আমার কোন কষ্ট নেই।’ ও আর বেশী কথা বাড়াল না। আমাদের গাড়িটা মহানগরের বুক চিরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল। চোখ দুটো বুজে নিলাম। এই কলকাতাতেই আমি জন্মেছি, জীবনে প্রথম প্রেমে পড়েছি। কত হেঁটেছি এই রাস্তায়। দুচোখ মেলে দেখতে থাকলাম আমার স্বপ্ন সুন্দরীকে আর ভেসে এলো এক নিম্নবিত্তের চোখে দেখা কলকাতা শহর।
‘রমা, আর দুটো মাস সময় দিতে পারবে! তুমি তো জানোই আমার অঙ্কটা প্রচণ্ড স্ট্রং। খালি ইংলিশ আর জিকেটা একটু ঘষে মেজে নিতে হবে।’ ‘না, বিপ্লব তুমি সত্যি আমায় ভালোবাসো না। আমায় ভালবাসলে এভাবে শুধু নিজের কথাটাই ভাবতে পারতে না। তুমি জানো, আজ এক ডাক্তারের সম্বন্ধ এসেছিল। তুমি কি বোঝ কত কষ্টে আমি ওই সম্বন্ধটা আটকে দিয়েছি। আমার বাবা মা দাদারাও তো চায় যে আমি তাড়াতাড়ি সেটেল হয়ে যাই।’ ‘রমা, আমার বাবা আমায় প্রচুর কষ্ট করে পড়িয়েছে। তুমি তো জানো আমাদের ওই পানের দোকানটায় সেরকম কোন আয় নেই। আমি যদি একটা গরমেনট জব পেয়ে যাই, তাহলে পুরো সংসারটাই দাঁড়িয়ে যাবে।’ ‘তুমি কি করে এই কথাগুলো বলছ বিপ্লব? একবারও বুঝতে পারছ না আমার ওপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আর আমি তো তোমায় সারাজীবন প্রাইভেটে জব করে যেতে বলছি না। আগে আমাদের বিয়েটা হয়ে যাক তারপর তুমি চেষ্টা করতে থাকো।’
‘তুমি কি বিপ্লব, এখন আমরা সংসারী। তুমি জানো, একটা ছেলের বিয়ের পর কত দায় দায়িত্ব হয়। তুমি বলছ সরকারী চাকরির চেষ্টা করবে। একবারও তোমার হুঁশ আছে বিপ্লব, ৮০০০ টাকায় সংসারটা কিকরে চলবে?’ ‘দেখো রমা, আজকাল তো মেয়েরাও চাকরি করে। তুমিও যদি প্রাইভেটে একটা চাকরি করতে তাহলে আমিও পড়াশুনা করে একটা গরমেনট জবের জন্য চেষ্টা করতে পারি।’ ‘তুমি কি বলছ বিপ্লব! জানো যদি বাবা সত্যি জানতে পারে টাকা রোজগারের জন্য আমি ওই প্রাইভেটের নোংরা পরিবেশে গেছি, তাহলে সত্যিই হয়ত তোমাকে কখনো জামাই বলে মেনে নেবেনা।’ ‘রমা কেন প্রতিটা কথায় তুমি তোমার বাবা, তোমার বাড়ি এগুলো টেনে নিয়ে আসো? তোমার বাবা মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্মেছে, আমি নই। জীবনে অনেক কষ্ট করেছি রমা। টিউশন করে কলেজের খরচা তুলেছি। তোমার দাদা তো আমার সাথে পড়ত! ও জীবনে করেছেটা কি? বড়লোকের জানোয়ার ছেলে একটা। খালি ডাইলগবাজী আর দেখনদারী।’ ‘বাহ বাহ চমৎকার। এই তো কলেজে শিখেছ। তোমাদের গোটা পৃথিবী সেই ৯০ এর দশকেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কেউ তোমাদের আর ধর্তব্যের মধ্যেই রাখেনা। সেই গরীব, বড়লোক বিত্তের কচকচানি। তোমরা কবে বুঝবে বিপ্লব, যুগটা পাল্টাচ্ছে। এখন আর ওই থিওরি মানুষ খাচ্ছেনা। তোমার ক্যারিয়ার তোমার ওই বস্তাপচা তত্বই নষ্ট করেছে, আমি নই।’
‘বিপ্লব, তুমি কি মানুষ না পশু! কি হবে রঞ্জনদার কথাটা মেনে নিলে। ও তো বলেছে যে ওই কাজটায় ওর প্রায় ১৫ লাখের প্রফিট তার থেকে ১০ লাখ আমাদের ধার হিসেবে দিয়ে দেবে। কে আগে? আমাদের ছেলে না তোমার ওই বস্তাপচা আইডিওলজি?’ ‘রমা, বাবাইকে আমিও ভালোবাসি, নিজের প্রানের চেয়ে বেশী ভালোবাসি। কিন্তু ওকে বাঁচাতে অন্যকে আমি পথে বসাতে পারবো না। কোনমতেই পারবো না। আদর্শ বলে একটা জিনিষ আজও আমার মধ্যে রয়েছে, সে যতই আমি বড়লোকের মেয়ের চাকর হয়ে যাই না কেন!’ ‘চাকর! বাহ ভালো বলেছ তুমি। এই তোমার ভালোবাসা। বিপ্লব তুমি ভালোবাসার মধ্যেও রাজনীতির রং খুঁজে বেড়াও। নিজের ছেলেকে বাঁচানোর চেয়ে একটা গরীব মানুষকে বাঁচানো তোমার কাছে বেশী দামী হয়ে গেলো। কি পাবে, একটু নাম, লোকের প্রশংসা। আমি কিচ্ছু চাইনা আমি শুধু বাবাইকে দেখতে চাই।’ ‘দেখো রমা, আমি তো বাবাইয়ের বদলে অন্যের ভালো করছিনা, আমি শুধু বাবাইয়ের ভালোর জন্য অন্যের ক্ষতি করতে চাইনা।’ ‘তুমি মানুষ নয়, তুমি জানোয়ার। কেন আমায় ভালোবাসার স্বপ্ন দেখিয়েছিলে? বাবা, ঠিকই বলত ছেঁড়া কাঁথার ভালোবাসা জানলা দিয়ে পালিয়ে যায়। তুমি আমায় ভালোবাসো না বিপ্লব। তুমি বাবাইকেও ভালোবাসো না। তুমি শুধু নিজেকে ভালোবাসো। তুমি শুধু অন্যের মুখ থেকে নিজের ব্যাপারে ভালো ভালো কথা শুনতে চাও।’ ‘আর এভাবে একটা মানুষকে শেষ করে দিওনা রমা। আমি জীবনে চুরিও করিনি, ডাকাতিও করিনি। তোমায় ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তোমরা বড়লোক, তোমাদের বাড়িতে মানবে না এটা জেনেই তো আমরা ভালবেসেছিলাম। রমা, তোমায় বলিনি এতদিন। আমি কিডনি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আজকের মধ্যেই জানতে পেরে যাবো কবে যেতে হবে।’ ‘বাহ, চমৎকার। আবার সেই চে গুয়েভারা হওয়ার ইচ্ছে। তোমাদের চে কবেই মরে ভূত হয়ে গেছে। তুমি কিডনিটা বিক্রি করলে আমাদের হবে কি! একবারও ভেবেছ বিপ্লব। বিপ্লব বেরিয়ে আসো তোমার ওই বস্তাপচা তত্ব থেকে। এটা বিপননের দুনিয়া। তোমরা পিছিয়ে পড়েছ বিপ্লব!’
‘রমা একটাবার মুখ ফুটে কথা বল। রমা রোজ অফিস থেকে এসে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি। রোজ ভাবি আজ তুমি ঠিক কথা বলবে। রমা কেন তুমি কথা বলনা। ডাক্তার আমাকে প্রচুর বকে, বারবার করে বলে একবারের জন্যও আমি চেষ্টা করছিনা। রমা বোঝ এইভাবে তুমি একটা মারাত্মক ব্যাধির দিকে চলে যাচ্ছ। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে রমা? আমি কি করে বাঁচব? তুমি ছাড়া তো আমার আর কিছুই নেই, কেউ নেই। সবাই দূরে সরিয়ে দিয়েছে। রমা, একটু জিভটা নাড়াও, চেষ্টা কর তুমি ঠিক পারবে।’ ‘বিপ্লব তুমি খুনি। তুমি বাবাইকে মেরে ফেলেছ। তোমায় কক্ষনো ক্ষমা করব না বিপ্লব। তুমি সারা জীবন একটা বস্তাপচা তত্ব আঁকড়ে পড়ে থাকলে। একবারও আমাদের কথা ভাবলে না। আমায় একটু বিষ দাও বিপ্লব।’ ‘আমায় তুমি এভাবেই শেষ করে দাও রমা, এভাবেই প্রতি মুহূর্তে নিজের চোখে ছোট ছোট হতে হতে আমি মরতে চাই। আমি আমার বাবা, মাকে দেখিনি। তোমার চোখেও কখনো নায়ক হয়ে উঠতে পারিনি। আমি তোমার থেকে এগুলোই শুনতে চাই রমা। কিন্তু রমা, তুমি বল, যা তোমার মনে আসে তাই বল। আজ ৬ মাস পর তুমি কিছু বললে। রমা আর তুমি নীরব হবেনা কোনোদিন। প্রতি মুহূর্তে আমায় দায়ী করে যাও...’
‘দাদা, কলেজ স্ট্রীট এসে গেছে।’ শুনে যেন মনে হল এক পৃথিবী থেকে অন্য এক পৃথিবীতে এসে নামলাম। গলা দিয়ে কোন কথা বেরোচ্ছে না, ড্রাইভারটা ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নোনতা বিস্বাদ জলে আমার পুরো মুখ ভিজে যাচ্ছে। শুধু বাঁ হাতটা উঁচু করে অঙ্গভঙ্গি করে বোঝালাম ‘একটু জল, আমি একটু স্বাভাবিক হতে চাই।’ ও নীচে নেমে দোকান থেকে একটু জল জোগাড় করতে গেলো। আমার শরীর আর পারছেনা। কোনরকমে মাথাটা সামনের ডেকটার ওপর রেখে দিলাম। চোখদুটো বন্ধ করে পড়ে থাকলাম। ‘একটা মানুষ জীবন্ত জ্বলে যাচ্ছে। দাউদাউ করে জ্বলছে। আমি জানলার রেলিং ধরে দেখছি। ভয়ঙ্কর একটা আর্তনাদ। ‘বিপ্লব তোমার ছেলে বাঁচবে না, বিপ্লব আমার অভিশাপ রইল তোমার ছেলে কষ্ট পেতে পেতে মরবে। এই টাকাটা আমার ৩ মেয়ের বিয়ের জন্য রেখেছিলাম। ওদের বিয়ে ভেঙে গেছে। বিপ্লব, তুমিও সেই নেতাদেরই মত যারা প্রতিদিন আদর্শকে ধর্ষণ করে চলেছে। বিপ্লব তুমি যদি সাচ্চা হতে এতো কষ্টেও তুমি নিজেকে বিক্রি করতে না। বিপ্লব তোমার ছেলে মরবে এর চেয়েও বেশী কষ্ট পেয়ে মরবে। তুমি বাবাইকে বাঁচাতে পারবে না বিপ্লব। মিলিয়ে নিয়ো আমার কথাটা।’
‘মেসোমশাই আমার কথাটা শুনুন?’ প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উঠলাম আমি। দেখি ড্রাইভার ভাই হন্তদন্ত করে হাতে একটা জলের মগ নিয়ে আমার দিকে ছুটে আসছে। ‘কি হয়েছে দাদা? শরীর খারাপ লাগছে? নিন চোখে মুখে একটু জল দিন।’
ওর দিকে একবার তাকালাম। না ওকে আমি বোঝাতে পারলাম না কেন প্রতি রাতে হঠাত আমার ঘুম ভেঙে যায়। কেন আজ ১০ বছর ধরে স্বাভাবিক একফোঁটা ঘুম আমার জীবন থেকে চলে গেছে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top