এখনও সমান কর্মক্ষম জিরো ওনো, ছবি: উইকিপিডিয়া
স্বপ্ন নাকি সাদাকালো হয়। কিন্তু জিরো ওনোর স্বপ্নের ভেতর আসত রঙিন সব সুশি। সুশিরা তাঁকে ঘুমাতে দিত না। স্বপ্নের সেই সুশিদের থাকত অনেক হাত-পা। তারা ভেসে বেড়াত আর কথা বলত জিরোর সঙ্গে। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে বসে থাকতেন জিরো। সুশিকেন্দ্রিক নানান আইডিয়া ঘুরপাক খেত। ৯৫ বছর বয়সী এই জিরোই সুশিশিল্পের সত্যিকারের হিরো।
জিরো ওনো, ছবি: ইনস্টাগ্রাম
১৯২৫ সালের ২৭ অক্টোবর জাপানের শিজুওকা প্রদেশের টেনরি শহরে জন্ম নেন জিরো। এই টেনরি নাম বদলে এখন হয়েছে হামামাৎসু। জিরোর মা–বাবা তাঁর লেখাপড়া নিয়ে মোটেই চিন্তিত ছিলেন না। ‘করলে করল, না করলে নাই’ এ রকম একটা ভাব। যেহেতু সুযোগ ছিল, তাই ‘নিজ দায়িত্বে’ লেখাপড়াকে টা টা দিয়ে বিদায় করেছেন জীবন থেকে। পড়াশোনা না, খেলাধুলা না, বয়সের তুলনায় গম্ভীর জিরো ভালোবাসতেন রান্না।
সাত বছর বয়স থেকে জিরো একটা রেস্টুরেন্টে বয়ের কাজ শুরু করলেন। সেখানেই চটপট শিখে ফেললেন টুকিটাকি রান্না। তারপর টোকিওতে এসে রাঁধুনির চাকরি নিলেন। ১৯৫১ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি বনে যান ‘কোয়ালিফায়েড সুশি শেফ’। এরপর থেকেই জিরোর মাথায় আসত সুশিরা। নানা আকৃতির, পদের, বর্ণের সুশিরা ঘুরে বেড়াত জিরোর কল্পনাজুড়ে। স্বপ্নে পেতেন সুশির রেসিপি। মাথার কাছেই থাকত কাগজ–কলম। ঘুম ভেঙে উঠে লিখে ফেলতেন। তারপর সেই মধ্যরাতে ঢুকতেন হেঁশেলে। বানিয়ে ফেলতেন স্বপ্নে দেখা সুশি। চেখে খেতেন। তারপর প্রসন্নচিত্তে ঘুমিয়ে পড়তেন।
৯৫তম জন্মদিনে বড় ছেলের সঙ্গে জিরো, ছবি: ইনস্টাগ্রাম
১৯৬৫ সালে জিরো নিজেই একটি রেস্টুরেন্ট দেন। নাম দেন ‘সুকিয়াবাশি জিরো’। এটিই বিশ্বের প্রথম সুশি রেস্টুরেন্ট। এখানে সুশি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। জিরোর শূন্য থেকে বানানো এ রেস্টুরেন্ট কখনোই অনেক বড় বা ফুড চেইন করার চেষ্টা করেননি। ব্যবসা বড় করার চেয়ে জিরো চেয়েছেন ঐতিহ্য ধরে রেখে সবচেয়ে ভালো সুশিটি গ্রাহকের সামনে দিতে। এখনো, এই ৯৫ বছর বয়সে এসেও জিরোর সব মনোযোগ সেদিকেই, কীভাবে আরও ভালো সুশি বানানো যায়।
জিরো যেভাবে রেস্টুরেন্টটি বানিয়েছিলেন, ৫৬ বছর পরও রেস্টুরেন্টটি আকৃতিগতভাবে সে রকমই আছে। তখনো মাত্র ১০ জন বসে খেতে পারত, এখনো তাই। সবাই ফাঁকা ফাঁকা করে বসে, আরাম করে চেখে দেখে বিশ্বসেরা এসব সুশি। তবে এখানে আগে থেকেই বুকিং দিয়ে যেতে হয়। আগে থেকে মানে অন্তত মাসখানেক আগে। মাঝেমধ্যে ছয় মাস পর্যন্ত ‘বুকড’ থাকে এই রেস্টুরেন্ট। ছয় মাসের পরে গিয়ে পাওয়া যায় সুশি খাওয়ার সিরিয়াল।
৫৬ বছর পরও অবিকল আছে রেস্টুরেন্টটি, ছবি: উইকিপিডিয়া
সুশির এই সামাল দেওয়া যায় না, এমন চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে দিব্যি হাজার কোটি টাকার ব্যবসা ফাঁদতে পারতেন জিরো। কিন্তু সেখানে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না। সব আগ্রহ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে গ্রাহকদের পেট পুরে খাওয়ানো। আর সুশি মুখে পোরার পর তাঁদের মুখভঙ্গি দেখা। এটিই নাকি তাঁকে এত বছর পর্যন্ত দিব্যি সুস্থ আর কর্মক্ষম রেখেছে। জিরোর রেস্তোরাঁয় প্রতি প্লেট সুশির দাম ৩০ হাজার ইয়েন। বাংলাদেশি টাকায় তা এ মুহূর্তে ২৩ হাজার টাকার সমান! এক প্লেটে থাকে ২০টি সুশি।
জাপানের ৭৩ বছর বয়সী মাসুহিরো ইয়ামামোটো সেখানকার খাবাররসিকদের কাছে অতি পরিচিত নাম। যেকোনো খাবার নিয়ে ইয়ামামোটোর একটা রিভিউ তাঁদের কাছে খুবই গুরুত্ব রাখে। তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘোরেন। সেখানকার খাবার চেখে দেখেন। আর খাবার নিয়ে ব্লগ, বই লেখেন। জিরোর সুশি খেয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বুঝি না এত সিম্পল দেখতে একটা খাবারে কীভাবে এত ফ্লেভার থাকে! জিরোর সুশির সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো দেখলে মনে হয়, এখানে কিচ্ছু দেওয়া নেই। কিন্তু মুখে পুরলেই, উমমম...। এত স্বাদ কোত্থেকে যে এল! এটা কীভাবে সম্ভব হয়, কে জানে।’
২০১১ সালে মার্কিন নির্মাতা ডেভিড গেলব তাঁর প্রথম প্রামাণ্যচিত্রটি বানান জিরো আর তাঁর রেস্টুরেন্টকে নিয়ে। নাম: জিরো ড্রিমস অব সুশি। সেখানে জিরো বলেন, ‘আমি যেন বুঝতে পারি, সবচেয়ে কম মসলা ব্যবহার করে আমি কীভাবে সবচেয়ে উপযোগী স্বাদটি পাব। স্বাদকে বর্ণনা করা কঠিন। আমি যেন বুঝতে পারি, কীভাবে কী করলে সেরাটা পাওয়া যাবে। আমি রান্নায় বিশ্বাসী নই। বরং খাবারের ‘র’ স্বাদে বিশ্বাসী। আমি সেটিকেই বের করে আনতে চাই। পরিচয় করিয়ে দিতে চাই খাদ্যরসিকদের সঙ্গে। হ্যাঁ, আমার সুশির দাম বেশি। তবে এক প্লেট সুশি খেয়ে কখনোই কারও মনে হয়নি যে টাকাটা জলে গেল বা বাজে খরচ হলো।’
এখনো প্রতিদিন নিয়ম করে বাড়ি থেকে ট্রেনে চাপেন জিরো। নিজের রেস্টুরেন্টে আসেন। কাজ করেন। রাতে ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরে যান। প্রতিদিন একই জায়গা থেকে ট্রেনে ওঠেন, নামেন। প্রতিদিন একই কাজ করেন। এর ভেতর থেকেই বের করেন আনেন ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ। কিন্তু কিছুতেই ‘বোর’ হন না। ৯৫ বছরের জীবনে জিরো ছুটি কাটিয়েছেন, এমনটা মনেই পড়ে না। ছুটি কাটাতে নাকি ভালো লাগে না তাঁর। বললেন, ‘ছুটি একদিন নিয়েছিলাম। কিন্তু কাটাতে গিয়ে দেখি দিনটা বড্ড বেশি লম্বা। শেষ হবার নাম নেই। তাই আবার রেস্টুরেন্টে ফিরে গিয়ে একটা চমৎকার সুশি বানালাম।’
জিরোর সঙ্গে কথা বলছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ছবি: উইকিপিডিয়া
২০১৪ সালে জাপান সফরে যান তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তখন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে তাঁকে নৈশভোজ করান সুকিয়াবাশি জিরোতে। সেখানে সুশি খেয়ে ওবামা বলেছিলেন, ‘আমি হাওয়াই রাজ্যে জন্মেছি। জীবনে অনেক সুশি খেয়েছি। তবে আজ যা খেলাম, এটাই সবার সেরা।’
জিরোর দুই পুত্র। ইয়োশিকাজু ওনো ও তাকাশি ওনো। দুজনেই বাবার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সুশির এ রেস্টুরেন্টে। ৬২ বছর বয়সী ইয়োশিকাজুর মতে, বাবার সন্তান হিসেবে তাঁর ‘টেস্ট বাড’ বেশ। তিনি খাবার চেখে বলে দিতে পারেন, কোনটায় কী মেশালে, কমালে–বাড়ালে আরও ভালো হবে। আর এ কারণেই তিনি বাবার রেস্তোরাঁয় যোগ দিয়েছেন। বললেন, ‘এই গুণ তো আর সবার থাকে না। সম্ভবত বাবার সন্তান হিসেবে আমার আছে। তাই সেটা বাবার রেস্তোরাঁয় কাজে লাগাচ্ছি।’
শূন্য থেকে গড়া জিরোর এ রেস্তোরাঁর দাম এখন ৯০ লাখ মার্কিন ডলার বা ৭৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা। যদিও রেস্তোরাঁয় কেবল সুশির মেনু আর মান ছাড়া আর কিছুই বাড়েনি।
* জিনাত শারমিন