এর কয়েকদিন পরেই হাঁসুলী বাঁকে কাহারপাড়া বাঁশবাঁদিতে আবার একবার বাদ্যি বেজে উঠল। এবার বাজল ঢোল কাঁসি সানাই –কুরুতাক-কুরুতাক-কুরুম-কুরুম। বায়েন এসেছিল একদল, ঢোল কাঁসি সানাই। মেয়েরা এবার দিচ্ছে উলু-উলু-উলু-লু-লু-লু। তারই সঙ্গে ঢুলী বাজাচ্ছে—কুরুর—কুরুর–কুরুর—তাক—তাক–তাক। কাসিতে বাজল কাঁই—কাঁই-কাঁই। সানায়ে সুর উঠল—আহা মরি মরি মরি রে মরি, শ্যামের পাশে রাইকিশোরী। বাঁশবাঁদির বাঁশবনে-বনে চঞ্চল হয়ে উঠল পাখির কঁক; তলায় আদ্যিকালের পচা এবং শুকনো। পাতার মধ্যে থেকে দু-চারটা খরগোশ বার হয়ে ছুটে পালাল নদীর ধারের জঙ্গলের দিকে। শিয়ালগুলি এত ভীরু নয়, তারা প্রথমটা একবার চঞ্চল হয়েই স্থির হল। সাহেবডাঙার দিকে বুনো শুয়োরগুলো নিজেদের আড্ডায় বার কয়েক গো-গোঁ করে উঠল। শীতকালের আমেজ এখনও আছে, সাপেরা এখনও মাটির তলায় না-খেয়ে ‘ছ-মেসে দম নিয়ে অসাড় হয়ে ঘুমুচ্ছে—তারা মাথা তুলতে চেষ্টা করলে; কিন্তু পারলে না। পাখী ও করালীর বিয়ে।
কাহারপাড়ায় মাত লাগল। তেল হলুদ রঙ নিয়ে মাতামাতি। করালীর সঙ্গে পাখীর সাঙা, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিবাহ। নসুরাম–করালীর নসুদিদি–গাছকোমর বেঁধে তেল-হলুদ মেখে, কাপড়ে রঙ নিয়ে হা-হা করে আসছে আর গাইছে— ‘আমার বিয়ে যেমন তেমন—দাদার বিয়ের আয়বেঁশে-আয় ঢকাঢক্ মদ খেসে।”
প্রচুর মদ, বড় বড় হাঁড়ি থেকে বাটি ভরে তুলে ঢেলে দিচ্ছে একজন, সকলে আকণ্ঠ পান। করছে। করালী দরাজ হাতে খরচ করছে। তার সঙ্গে কাহারপাড়ার কার সঙ্গ? সে হ্যাট হ্যাট করে তাড়িয়ে লাঙ্গল চষে না, হিম্-প্লো হাঁক হেঁকে পালকি বয়ে খায় না, সে ‘অ্যাল’ কোম্পানিতে চাকরি করে, নগদ ‘ওজকার’। সে সেটা দেখিয়ে দিতে চায়, বুঝিয়ে দিতে চায় এই সুযোগে। সে দেড় কুড়ি টাকা নগদ খরচ করেছে। খাসি কিনেছে, ছোলার ডাল কিনেছে— জ্ঞাতিভোজনে সে চুনোপ্টির অম্বল আর কাচা কলাইয়ের ডাল দিয়ে ভাত দেবে না। পাখীকে শাখা-শাড়ি-সিঁদুর-নোয়া ছাড়াও দেবে অনেক জিনিস, অনেক গয়না; রুপদস্তার নয়, রুপোর গয়না। হাতে চারগাছা করে আটগাছা চুড়ি, গলায় দড়ি-হার, কোমরে এ ছাড়া একপ্রস্থ গিলটির গয়না—সুতহার, পার্শী মাকড়ি, হাতে বাজু অনন্ত বালা। পাড়ার ঝিউড়ী-বউড়ীরা ধন্য ধন্য করেছে করালীকে। ছেলে-ছোকরারাও বাহবা দিচ্ছে। মনে মনে ঠিক করছে, রেল কোম্পানির ওই আজব কারখানায় চাকরির চেষ্টা ওরাও অতঃপর করবে। পরক্ষণেই দমে যাচ্ছে। যে মাতব্বর। আছে, সে কি ও-মুখে কাউকে হাঁটতে দেবে? করালীর মত বুকের পাটা তাদের নয়, তারা বনওয়ারী মাতব্বরকে অমান্য করে রেল কোম্পানিতে খাটতে যেতে পারবে না। সঙ্গে সঙ্গে মনের সামনে ভেসে ওঠে বনওয়ারীর মূর্তি। চোখ বড় করে হাত তুলে বলছে, পিতি নুরুষের বারণ। সাবোধান।
কিন্তু বনওয়ারী মাতব্বর হয়ত করালীকেও এবার কায়দা করলে। তাকে বার বার প্রতিজ্ঞা। করিয়ে নিয়েছে, পঞ্চায়েতের হুকুম অমান্য করা চলবে না। দেবতা-গোঁসাইকে মানতে হবে, অনাচার অধৰ্ম করবে না। পাকাচুলের কথা না-শোন না-ই শুনবে, কিন্তু প্ৰবীণ মুরুরি ‘রপমান’ কখনও করবে না; করালী সে প্রতিজ্ঞা করেছে।
এই বিয়ের খরচ নিয়েও বনওয়ারী তাকে বলেছিল—এত ভাল লয় করালী। যা রয় সয় তা করতে হয়। এত খরচ করতে তু পাবি কোথা?
করালী অন্য সময় হলে বলত—আজারা মানিক কোথা পায়? নিশ্চয় বলত এ কথা এবং মুখ টিপে হেসে ঠোট বেঁকিয়ে বলত কথাটা। কিন্তু এবার সে হাত জোড় করে বনওয়ারীকে বললে— হেই কাকা, তোমাকে জোড় হাত করে এবার বোলছি, এবার কিছু বোলো না। বিয়ে আমার পাখীর সঙ্গে।
বনওয়ারী পরিতুষ্ট হয়ে হেসে বললে—আচ্ছা আচ্ছা। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে করালীকে একটু আড়ালে ডেকে প্রশ্ন করলে, কিন্তুক বাবা, একটি কথা বল দেখি নি, এত টাকা তু পেলি কোথা? কোম্পানির কিছু চুরিচামারি করিস নাই তো? দেখ? ফেসাদ হবে না তো ইয়ের পরে?
করালী তার গায়ে হাত দিয়ে বললে—এই তোমার গায়ে হাত দিয়ে বলছি। সেসব ভেবো না তুমি। মাইরি বলছি।
বনওয়ারী চলে গেল বসনের বাড়ির দিকে। করালীর কাকা, পাখীর মামা সে, পাড়ার মাতব্বর, তার দায়িত্ব কত!
করালী হলুদ তেল মেখে স্নান করে টেরি কাটতে বসল। নতুন আয়না চিরুনি কিনেছে। গোলাপী রঙের বুকে-ফুল-কাটা গেঞ্জি গায়ে দেবে। নতুন একখানা মিহি ধুতি হলুদ রঙে রাঙিয়েছে; সেগুলো নসুদিদি সামনে রাখলে পাট করে। আর রাখলে একখানা বাহারের ‘থইলো অর্থাৎ তোয়ালে; করালী বলে—তইলা, নসু বলে থইলা। কাহারপাড়ার উপকথায় বরের সাজসজ্জায়—করালী কলিযুগ এনেছে, কলিযুগের ছেলেছোকরা ঝিউড়ী-বউড়ীরা এ সব দেখে মোহিত হলেও প্রবীণেরা এটা বরদাশত করতে পারছে না। তারা সবাই একটু ভুরু কুঁচকে। এড়িয়ে চলছে। আপনাদের মধ্যে বলছে, এতটা ভাল নয়। মদের গন্ধেও তাদের মন খুব সরস হয়ে উঠছে না। অবশ্য দু-এক পাত্র করে সবাই খেয়েছে; কিন্তু ছোকরা এবং মেয়েদের মত মাতনে মন মেতে উঠতে চাচ্ছে না তাদের। তবে বড় সুন্দর দেখাচ্ছে করালীকে। যেমন জোয়ান, তেমনই সুন্দর, তেমনই পোশাক। কাহারপাড়ায় ও যেন মোহন সাজে এক নতুন নটবর এসেছে।
প্ৰহ্লাদ হল বনওয়ারীর পরের মান্যের লোক। সে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত। সে বললেই মুখ খুলে কাজটা ভাল করলে না বনওয়ারী ভাই। মাতব্বরের মতন কাজ হল না। করালীকে শাসন না। করে তার দণ্ড না করে এই ‘পেকার’ ‘আসকারা’ দিলে, এর ফল ভাল হবে না। তাও একজনার ঘর ভেঙে
গুপী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে—ভাই রে, ওই নয়ানের বাপের ‘পেতাপ’ কত ভেবে দেখ। ‘মানুষের দশ দশা, কখনও হাতি কখনও মশা’। মাতব্বরের এ বিচার ভাল হল না।
রতন–লটবরের বাপ; অবাধ্য ছেলে লটবর, করালীর অনুরক্ত ভক্ত। অবাধ্য ছেলের দায়ে। রতনকে করালীর অর্থাৎ লটবরের দলের টান টানতে হয়, সে বললে—তা ছোকরা বাহাদুর বটে। করলে খুব।
নিমতেলে পানু অল্পবয়সী হলেও প্রবীণদের দলেই চলে ফেরে, সে ফুট কাটতে অদ্বিতীয়, সে বললে লুট লুটলুটের পয়সা বুঝলে? আমাদের মত চাষে খেটে মাথার ঘাম পায়ে ফেলায়ে এই ধুম করতে পারত, তবে বুঝতাম। বুল্লে কিনা, অ্যালের পুরানো ‘সিপাট’ কাঠ। চুরি করে চন্ননপুরে কতজনাকে বিক্রি করেছে—সে আমি জানি।
বনওয়ারী চুপ করে ভাবছে। মনে পড়েছে আগুনের আঁচে-ভরা বাঁশতলা, মনে পড়েছে। বটতলায় কালোবউয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা।
করালী এসে দাঁড়াল তাদের সামনে। তার বগলে দুটো পাকী মদের বোতল। নামিয়ে দিলে প্ৰহ্লাদ-রতনের সামনে।—নাও কাকা, আরম্ভ কর, আরও আছে।
ওদিকে গাল দিচ্ছে নয়ানের মা।
নয়ান চুপ করে বসে আছে নিজের দাওয়ায়। বুকটা ‘দুঁপছে’, পাজরাগুলো উঠছে, নামছে, কালো কঙ্কালসার বেড়ানো মুখের মধ্যে সাদা চোখ দুটো হাঁসুলী বাঁকের মাথায় কত্তাবাবার থানের দিকে চেয়ে রয়েছে—স্থির নিম্পলক হয়ে। সে মনে মনে বাবাকে ডাকছে। আর কল্পনা করছে ভীষণ কল্পনা।
নয়ানের মা তারস্বরে গালাগাল দিচ্ছে, অভিসম্পাত দিচ্ছে করালীকে এবং পাখীকে। কত্তাবাবাকে, কালরুদ্রকে ডাকছে বিচার করবার জন্য। সমস্ত সমাজের প্রবীণদের উদ্দেশে বনওয়ারীর আচরণের প্রতিবাদ করবার জন্য বলছে—মঈল নাই, মঙ্গল নাই, এমন মাতব্বর যেখানে। মধ্যে মধ্যে তাদের অর্থাৎ ঘরভাঙাদের পূর্বগৌরব স্মরণ করে বিলাপ করছে। বনওয়ারী মাতব্বর। মাতব্বরের এই কি বিচার? এমন মাতব্বর যেখানে, সেখানের মঙ্গল নাই। একজনের ঘর ভেঙে দিয়ে আর একজনের ঘর গড়ার নাম মাতব্বরি? শত্ৰুর, চিরকালের শত্রুর ওই কোশকেঁধেরা এই ঘরভাঙাদের বাড়ির। এই বাড়ি ছিল একদিন মাতব্বরের বাড়ি, এই বাড়ির উঠানে উবু হয়ে বসে লোকের বাপ-ঠাকুরের হাঁটুতে পাছায় কড়া পড়েছে। তারপর অনাথা ছেলের কালে উড়ে এসে জুড়ে বসল। হালে উঠতি ঘোষবাবুদের দেমাকে বড়কে বড় মানলে না, ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল’ হয়ে পড়ল। বিধেতা এর বিচার করবেন।
নয়ন বসে বসে ওই ন্যাড়ামাথা, গলায় রুদ্রাক্ষ, ধবধবে পৈতে, পরনে গেরুয়া, পায়ে খড়ম-কত্তাঠাকুরকে যেন মনশ্চক্ষে দেখছে। বেলগাছতলায় দাঁড়িয়ে আছেন—একটি কুটিল চোখের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে। চেয়ে আছেন তিনি করালীর ঘরের দিকে। পায়ের তলায় পড়ে আছে সেই বিরাট চন্দ্রবোড়া–করালী যাকে মেরে বাহাদুরি নিয়েছে। সে কি মরে? বাবার সাপ সে! কত্তার বাহন। সে বেঁচে উঠেছে। কলক করে জিব নাড়ছে। বাসরঘরে ওই সাপ ঢুকবে।
বসনের বাড়িতেও অনেক মদ, অনেক নেশা, অনেক নাচ, অনেক গান। সুচাঁদ বলে—সিঁদুরের মত ‘অঙ’ লাগবে চোখে, তবে তো বিয়ের মাতন। চারিদিকে ‘আতদিন’ অক্তসন্ধে নেগে থাকবে।
সুচাঁদের সে রঙ চোখে লেগেছে।
প্রথমটায় সে কিছুটা মদ্যপান করে বসে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছে; তারপর একটা বাটিতে মদ আর আঁচলে মুড়ি লঙ্কা নিয়ে বাঁশবনের ধারে বসে কেঁদেছে। কেঁদেছে তার মরা বাপের জন্য, মরা জামাই অর্থাৎ পাখীর বাপের জন্য আঃ, এমন দিনে তারা বেঁচে নাই। মধ্যে মধ্যে চোখ মুছে কান্না বন্ধ করে মুখে মুড়ি চিবিয়ে লঙ্কার ঝাল জিবে ঠেকিয়ে মদ খেয়ে নিচ্ছিল।
কাহারপাড়ায় মাত লাগল। তেল হলুদ রঙ নিয়ে মাতামাতি। করালীর সঙ্গে পাখীর সাঙা, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিবাহ। নসুরাম–করালীর নসুদিদি–গাছকোমর বেঁধে তেল-হলুদ মেখে, কাপড়ে রঙ নিয়ে হা-হা করে আসছে আর গাইছে— ‘আমার বিয়ে যেমন তেমন—দাদার বিয়ের আয়বেঁশে-আয় ঢকাঢক্ মদ খেসে।”
প্রচুর মদ, বড় বড় হাঁড়ি থেকে বাটি ভরে তুলে ঢেলে দিচ্ছে একজন, সকলে আকণ্ঠ পান। করছে। করালী দরাজ হাতে খরচ করছে। তার সঙ্গে কাহারপাড়ার কার সঙ্গ? সে হ্যাট হ্যাট করে তাড়িয়ে লাঙ্গল চষে না, হিম্-প্লো হাঁক হেঁকে পালকি বয়ে খায় না, সে ‘অ্যাল’ কোম্পানিতে চাকরি করে, নগদ ‘ওজকার’। সে সেটা দেখিয়ে দিতে চায়, বুঝিয়ে দিতে চায় এই সুযোগে। সে দেড় কুড়ি টাকা নগদ খরচ করেছে। খাসি কিনেছে, ছোলার ডাল কিনেছে— জ্ঞাতিভোজনে সে চুনোপ্টির অম্বল আর কাচা কলাইয়ের ডাল দিয়ে ভাত দেবে না। পাখীকে শাখা-শাড়ি-সিঁদুর-নোয়া ছাড়াও দেবে অনেক জিনিস, অনেক গয়না; রুপদস্তার নয়, রুপোর গয়না। হাতে চারগাছা করে আটগাছা চুড়ি, গলায় দড়ি-হার, কোমরে এ ছাড়া একপ্রস্থ গিলটির গয়না—সুতহার, পার্শী মাকড়ি, হাতে বাজু অনন্ত বালা। পাড়ার ঝিউড়ী-বউড়ীরা ধন্য ধন্য করেছে করালীকে। ছেলে-ছোকরারাও বাহবা দিচ্ছে। মনে মনে ঠিক করছে, রেল কোম্পানির ওই আজব কারখানায় চাকরির চেষ্টা ওরাও অতঃপর করবে। পরক্ষণেই দমে যাচ্ছে। যে মাতব্বর। আছে, সে কি ও-মুখে কাউকে হাঁটতে দেবে? করালীর মত বুকের পাটা তাদের নয়, তারা বনওয়ারী মাতব্বরকে অমান্য করে রেল কোম্পানিতে খাটতে যেতে পারবে না। সঙ্গে সঙ্গে মনের সামনে ভেসে ওঠে বনওয়ারীর মূর্তি। চোখ বড় করে হাত তুলে বলছে, পিতি নুরুষের বারণ। সাবোধান।
কিন্তু বনওয়ারী মাতব্বর হয়ত করালীকেও এবার কায়দা করলে। তাকে বার বার প্রতিজ্ঞা। করিয়ে নিয়েছে, পঞ্চায়েতের হুকুম অমান্য করা চলবে না। দেবতা-গোঁসাইকে মানতে হবে, অনাচার অধৰ্ম করবে না। পাকাচুলের কথা না-শোন না-ই শুনবে, কিন্তু প্ৰবীণ মুরুরি ‘রপমান’ কখনও করবে না; করালী সে প্রতিজ্ঞা করেছে।
এই বিয়ের খরচ নিয়েও বনওয়ারী তাকে বলেছিল—এত ভাল লয় করালী। যা রয় সয় তা করতে হয়। এত খরচ করতে তু পাবি কোথা?
করালী অন্য সময় হলে বলত—আজারা মানিক কোথা পায়? নিশ্চয় বলত এ কথা এবং মুখ টিপে হেসে ঠোট বেঁকিয়ে বলত কথাটা। কিন্তু এবার সে হাত জোড় করে বনওয়ারীকে বললে— হেই কাকা, তোমাকে জোড় হাত করে এবার বোলছি, এবার কিছু বোলো না। বিয়ে আমার পাখীর সঙ্গে।
বনওয়ারী পরিতুষ্ট হয়ে হেসে বললে—আচ্ছা আচ্ছা। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে করালীকে একটু আড়ালে ডেকে প্রশ্ন করলে, কিন্তুক বাবা, একটি কথা বল দেখি নি, এত টাকা তু পেলি কোথা? কোম্পানির কিছু চুরিচামারি করিস নাই তো? দেখ? ফেসাদ হবে না তো ইয়ের পরে?
করালী তার গায়ে হাত দিয়ে বললে—এই তোমার গায়ে হাত দিয়ে বলছি। সেসব ভেবো না তুমি। মাইরি বলছি।
বনওয়ারী চলে গেল বসনের বাড়ির দিকে। করালীর কাকা, পাখীর মামা সে, পাড়ার মাতব্বর, তার দায়িত্ব কত!
করালী হলুদ তেল মেখে স্নান করে টেরি কাটতে বসল। নতুন আয়না চিরুনি কিনেছে। গোলাপী রঙের বুকে-ফুল-কাটা গেঞ্জি গায়ে দেবে। নতুন একখানা মিহি ধুতি হলুদ রঙে রাঙিয়েছে; সেগুলো নসুদিদি সামনে রাখলে পাট করে। আর রাখলে একখানা বাহারের ‘থইলো অর্থাৎ তোয়ালে; করালী বলে—তইলা, নসু বলে থইলা। কাহারপাড়ার উপকথায় বরের সাজসজ্জায়—করালী কলিযুগ এনেছে, কলিযুগের ছেলেছোকরা ঝিউড়ী-বউড়ীরা এ সব দেখে মোহিত হলেও প্রবীণেরা এটা বরদাশত করতে পারছে না। তারা সবাই একটু ভুরু কুঁচকে। এড়িয়ে চলছে। আপনাদের মধ্যে বলছে, এতটা ভাল নয়। মদের গন্ধেও তাদের মন খুব সরস হয়ে উঠছে না। অবশ্য দু-এক পাত্র করে সবাই খেয়েছে; কিন্তু ছোকরা এবং মেয়েদের মত মাতনে মন মেতে উঠতে চাচ্ছে না তাদের। তবে বড় সুন্দর দেখাচ্ছে করালীকে। যেমন জোয়ান, তেমনই সুন্দর, তেমনই পোশাক। কাহারপাড়ায় ও যেন মোহন সাজে এক নতুন নটবর এসেছে।
প্ৰহ্লাদ হল বনওয়ারীর পরের মান্যের লোক। সে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত। সে বললেই মুখ খুলে কাজটা ভাল করলে না বনওয়ারী ভাই। মাতব্বরের মতন কাজ হল না। করালীকে শাসন না। করে তার দণ্ড না করে এই ‘পেকার’ ‘আসকারা’ দিলে, এর ফল ভাল হবে না। তাও একজনার ঘর ভেঙে
গুপী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে—ভাই রে, ওই নয়ানের বাপের ‘পেতাপ’ কত ভেবে দেখ। ‘মানুষের দশ দশা, কখনও হাতি কখনও মশা’। মাতব্বরের এ বিচার ভাল হল না।
রতন–লটবরের বাপ; অবাধ্য ছেলে লটবর, করালীর অনুরক্ত ভক্ত। অবাধ্য ছেলের দায়ে। রতনকে করালীর অর্থাৎ লটবরের দলের টান টানতে হয়, সে বললে—তা ছোকরা বাহাদুর বটে। করলে খুব।
নিমতেলে পানু অল্পবয়সী হলেও প্রবীণদের দলেই চলে ফেরে, সে ফুট কাটতে অদ্বিতীয়, সে বললে লুট লুটলুটের পয়সা বুঝলে? আমাদের মত চাষে খেটে মাথার ঘাম পায়ে ফেলায়ে এই ধুম করতে পারত, তবে বুঝতাম। বুল্লে কিনা, অ্যালের পুরানো ‘সিপাট’ কাঠ। চুরি করে চন্ননপুরে কতজনাকে বিক্রি করেছে—সে আমি জানি।
বনওয়ারী চুপ করে ভাবছে। মনে পড়েছে আগুনের আঁচে-ভরা বাঁশতলা, মনে পড়েছে। বটতলায় কালোবউয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা।
করালী এসে দাঁড়াল তাদের সামনে। তার বগলে দুটো পাকী মদের বোতল। নামিয়ে দিলে প্ৰহ্লাদ-রতনের সামনে।—নাও কাকা, আরম্ভ কর, আরও আছে।
ওদিকে গাল দিচ্ছে নয়ানের মা।
নয়ান চুপ করে বসে আছে নিজের দাওয়ায়। বুকটা ‘দুঁপছে’, পাজরাগুলো উঠছে, নামছে, কালো কঙ্কালসার বেড়ানো মুখের মধ্যে সাদা চোখ দুটো হাঁসুলী বাঁকের মাথায় কত্তাবাবার থানের দিকে চেয়ে রয়েছে—স্থির নিম্পলক হয়ে। সে মনে মনে বাবাকে ডাকছে। আর কল্পনা করছে ভীষণ কল্পনা।
নয়ানের মা তারস্বরে গালাগাল দিচ্ছে, অভিসম্পাত দিচ্ছে করালীকে এবং পাখীকে। কত্তাবাবাকে, কালরুদ্রকে ডাকছে বিচার করবার জন্য। সমস্ত সমাজের প্রবীণদের উদ্দেশে বনওয়ারীর আচরণের প্রতিবাদ করবার জন্য বলছে—মঈল নাই, মঙ্গল নাই, এমন মাতব্বর যেখানে। মধ্যে মধ্যে তাদের অর্থাৎ ঘরভাঙাদের পূর্বগৌরব স্মরণ করে বিলাপ করছে। বনওয়ারী মাতব্বর। মাতব্বরের এই কি বিচার? এমন মাতব্বর যেখানে, সেখানের মঙ্গল নাই। একজনের ঘর ভেঙে দিয়ে আর একজনের ঘর গড়ার নাম মাতব্বরি? শত্ৰুর, চিরকালের শত্রুর ওই কোশকেঁধেরা এই ঘরভাঙাদের বাড়ির। এই বাড়ি ছিল একদিন মাতব্বরের বাড়ি, এই বাড়ির উঠানে উবু হয়ে বসে লোকের বাপ-ঠাকুরের হাঁটুতে পাছায় কড়া পড়েছে। তারপর অনাথা ছেলের কালে উড়ে এসে জুড়ে বসল। হালে উঠতি ঘোষবাবুদের দেমাকে বড়কে বড় মানলে না, ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল’ হয়ে পড়ল। বিধেতা এর বিচার করবেন।
নয়ন বসে বসে ওই ন্যাড়ামাথা, গলায় রুদ্রাক্ষ, ধবধবে পৈতে, পরনে গেরুয়া, পায়ে খড়ম-কত্তাঠাকুরকে যেন মনশ্চক্ষে দেখছে। বেলগাছতলায় দাঁড়িয়ে আছেন—একটি কুটিল চোখের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে। চেয়ে আছেন তিনি করালীর ঘরের দিকে। পায়ের তলায় পড়ে আছে সেই বিরাট চন্দ্রবোড়া–করালী যাকে মেরে বাহাদুরি নিয়েছে। সে কি মরে? বাবার সাপ সে! কত্তার বাহন। সে বেঁচে উঠেছে। কলক করে জিব নাড়ছে। বাসরঘরে ওই সাপ ঢুকবে।
বসনের বাড়িতেও অনেক মদ, অনেক নেশা, অনেক নাচ, অনেক গান। সুচাঁদ বলে—সিঁদুরের মত ‘অঙ’ লাগবে চোখে, তবে তো বিয়ের মাতন। চারিদিকে ‘আতদিন’ অক্তসন্ধে নেগে থাকবে।
সুচাঁদের সে রঙ চোখে লেগেছে।
প্রথমটায় সে কিছুটা মদ্যপান করে বসে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছে; তারপর একটা বাটিতে মদ আর আঁচলে মুড়ি লঙ্কা নিয়ে বাঁশবনের ধারে বসে কেঁদেছে। কেঁদেছে তার মরা বাপের জন্য, মরা জামাই অর্থাৎ পাখীর বাপের জন্য আঃ, এমন দিনে তারা বেঁচে নাই। মধ্যে মধ্যে চোখ মুছে কান্না বন্ধ করে মুখে মুড়ি চিবিয়ে লঙ্কার ঝাল জিবে ঠেকিয়ে মদ খেয়ে নিচ্ছিল।