নাঃ-কাহারদের ভাগ্য ভাল। কোধের মধ্যেও কত্তা কিঞ্চিৎ দয়া করেছেন।
গ্রামে আগুন নয়। আগুন লেগেছে বাঁশবেড়ের বাঁশবনের তলায়। মাঘে পাতা ঝরেছে। বাঁশের। নিবিড় বাঁশবনের অজস্র পাতা স্থূপীকৃত হয়ে জমে আছে তলায়। সেই ঝরা শুকনো পাতায় আগুন লেগেছে। কি করে লাগল কে জানে? বেলা প্রখর হয়ে উঠেছে, পাতাগুলির উপরে রাত্রের শিশির শুকিয়ে গিয়েছে; আগুন খোরাক পেয়েছে ভাল। সবুজ দেওয়ালের মত যে বাঁশবন, সে বাঁশবন ধোঁয়ায় প্রায় ঢেকে গিয়েছে।
বাঁশবাদির ধারে লোকজন স্তম্ভিত বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢুকতে কারও সাহস নাই। নিমতেলে পানু, প্রহ্লাদ জাঙল থেকে বনওয়ারীর আগেই ফিরে এসেছে। তারা ঢুকেছিল, কিন্তু পালিয়ে এসেছে ভয়ে এবং যন্ত্রণায়। ভয়—সেই শিস উঠছে। যন্ত্রণা-ধোঁয়ার।
কর্তার রোষ শেষে আগুন হয়ে জ্বলে উঠেছে গায়ের ধারে, সাবধান করে দিচ্ছেন। বনওয়ারী থমকে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে পাতে বললেকত্তার কোপ! কত্তার কোধ।
প্রহ্লাদ বলে–না, করালী আগুন লাগিয়েছে, বাঁশের পাতায় কেরাচিনি ত্যাল ঢেলে আগুন। লাগিয়েছে। সে রয়েছে ওই ধোঁয়ার মধ্যে।
মুহূর্তে ক্ষেপে গেল বনওয়ারী, নেমে গেল ধোঁয়ায় ভরা বাঁশবনের মধ্যে।
হ্যাঁ, শিসও উঠছে। কৰ্তাও ক্ষেপেছেন। এগিয়ে গেল বনওয়ারী শব্দ লক্ষ্য করে।
যেখানে শব্দটি উঠছে, তারই সামনে দাঁড়িয়ে আছে করালী। বুক চিতিয়ে নিৰ্ভয়ে একদৃষ্টে উপরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে জল পড়ছে। মুছছে আর উপরের দিকে চেয়ে দেখছে। নিচে আগুন নাচছে শুকনো পাতার স্থূপে। উত্তাপে বাঁশবেড় যেন অগ্নিগড় হয়ে উঠেছে, আঁচ লাগছে গায়ে, করালীর সেও গ্রাহ্য নাই।
বনওয়ারী এগিয়ে গেল ভয়ঙ্কর মূর্তিতে।–হে কত্তা, মাপ কর তুমি। আমি হতভাগাকে ফেলে দিচ্ছি ওই আগুনে। তুমি নিজের মহিমায় আগুন নিবিয়ে দাও। বাঁচাও তুমি বাঁশবাঁদিকে, বাঁচাও হাঁসুলীর বাককে বচাও। সে সেই ভয়ঙ্কর কণ্ঠে ডাকলে—করালী!
করালী তার দিকে চকিতের মত চেয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে বনওয়ারীকেই ইশারা করে ডাকলে—এস, এস। এতটুকু নড়ল না সে। বনওয়ারীর ক্রোধ আরও বেড়ে গেল। সে অগ্রসর হল, মনে মনে বলল—যাই যাই, দাঁড়া।
দূরে পিছন থেকে ভেসে আসছে আর একটা আওয়াজমামা! মামা! মামা! পাখীর গলা। আর্ত-উৎকণ্ঠা যেন ফেটে পড়ছে কণ্ঠস্বরে। কিন্তু বনওয়ারী আজ নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। কাহারপাড়ার বিচারকর্তা সে। ব্রহ্মার পুত্র দক্ষের মত সর্বময় কর্তা–দণ্ডদাতা।
বনওয়ারী দুর্দান্ত ক্ৰোধে করালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কোশকেঁধের বাড়ির ছেলে, বিধাতার মোটা হাতে পাথর কেটে গড়া বনওয়ারী।
করালী কিন্তু নড়ল না, এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, বনওয়ারীর হাত থেকেও মোচড় দিয়ে ছাড়িয়ে নিলে একটা হাত। সেই হাতে সে দুর্দান্ত বিক্ৰমে আক্রমণ করলে বনওয়ারীকে। আশ্চর্য, বনওয়ারী অনুভব করছে—করালীর শক্তি যেন তার চেয়ে বেশি। না, বনওয়ারীর পায়ের তলায় বাঁশের পাতাগুলি পিছলে সরে যাচ্ছে। সেই অসুবিধার জন্যই করালী তাকে বাগে পেয়েছে। হঠাৎ করালী চিৎকার করে উঠল—ছাড়–ছাড়পড়ছে। ছাড়।
উৎসাহের প্রাবল্যে তার শক্তি যেন শতগুণ বেড়ে গেল। সে অনায়াসে বনওয়ারীকে নিচে ফেলে দিয়ে তাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নাচতে লাগল সে। ওই ওই ওই শালা পড়ছে। বনওয়ারী উঠে বসল। সঙ্গে সঙ্গে করালী এসে তার হাত ধরে টেনে আঁকি দিয়ে বলল—ওই ওই দেখ, তোমার কর্তা পড়ছে বশের ডগা থেকে। হুই-হুইয়ো!
বঁশের ঝাড়ের মাথা থেকে আগুনের উত্তাপে ধোঁয়ায় ক্লিষ্ট অবসন্ন হয়ে এলিয়ে নিচে পড়ছে। একটা প্রচণ্ড সাপ। পাহাড়ে চিতির মত মোটা, তেমনই বিচিত্র তার বর্ণ, কিন্তু লম্বা খুব বেশি নয়। পাহাড়ে চিতির সঙ্গে ওইখানেই সেটার পার্থক্য।
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সেই দিকে চেয়ে বনওয়ারী বললে—পে-কা-ণ্ড চন্দ্রবোড়া! হ্যাঁ, ওদের গৰ্জন খুব বটে।
—এটা কত বড় দেখছ না? তাতেই শিসের শব্দ হয়। শালা!
আগুনের মধ্যে পড়ে সাপটা ছটফট করছে। মরছে। করালী তারই উপর দমাদম ঢেলা ছুঁড়ে মারছে। অব্যর্থ তার লক্ষ্য।
মামা! মামা! এদিক থেকে পাখী ডাকছে। ধোঁয়ার মধ্যে বুঝতে পারছে না সে, এরা কোন দিকে রয়েছে। উৎকণ্ঠিত আগ্রহে সে ডাকছে। ডাকটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাখী ওদের খুঁজে ফিরছে।
চিৎকার করে সাড়া দিলে করালী—এই দিকে এই দিকে। আয়। আয়। ডাক্ সব পাড়ার নোককে! দেখে যা তাদের কত্তা পুড়ছে। দেখে যা। ডাক্ সব লোককে। ডাক্—ডাক্।
ওদিকে সাপটার পেটটার একটা মোটা অংশ ফেটে গেল আগুনের আঁচে। বেরিয়ে পড়ল একটা কি। এগিয়ে গেল করালী, বনওয়ারীও গেল। অঁকে দেখতে লাগল, ওটা কি? ওঃ, একটা বুনো শুয়োরের বাচ্চা। ওটাই কাল রাত্রে সেই তীক্ষ্ণ চিৎকার করেছিল।
পাখী ছুটে এসে করালীর হাত ধরলে। সে হাঁপাচ্ছে।
করালী বললেওই দেখৃ। সাপটা দেখে পাখী অবাক হয়ে গেল। দেখতে দেখতে ভেঙে এল গোটা কাহারপাড়ার লোক। বিস্ময়ে কৌতূহলে অবাক হয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর কলকল করে বাঁশবাঁদি মুখরিত করে তুললে।
করালী হাসতে হাসতে বলে উঠল–মুরুবি, কত্তার পুজোটা সব আমাকে দিয়ো গো। সে হা-হা করে হাসতে লাগল।
পাখী ধমক দিয়ে বললে—চুপ কর।
করালী তবুও হাসতে লাগল। সে যেন এক অপার কৌতুক।
পাখী করালীর পিঠে একটা কিল মেরে বললে—ডাকাবুকো, ডারপাড়, লঘুগুরু জ্ঞান নাই তোমার?
গ্রামে আগুন নয়। আগুন লেগেছে বাঁশবেড়ের বাঁশবনের তলায়। মাঘে পাতা ঝরেছে। বাঁশের। নিবিড় বাঁশবনের অজস্র পাতা স্থূপীকৃত হয়ে জমে আছে তলায়। সেই ঝরা শুকনো পাতায় আগুন লেগেছে। কি করে লাগল কে জানে? বেলা প্রখর হয়ে উঠেছে, পাতাগুলির উপরে রাত্রের শিশির শুকিয়ে গিয়েছে; আগুন খোরাক পেয়েছে ভাল। সবুজ দেওয়ালের মত যে বাঁশবন, সে বাঁশবন ধোঁয়ায় প্রায় ঢেকে গিয়েছে।
বাঁশবাদির ধারে লোকজন স্তম্ভিত বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢুকতে কারও সাহস নাই। নিমতেলে পানু, প্রহ্লাদ জাঙল থেকে বনওয়ারীর আগেই ফিরে এসেছে। তারা ঢুকেছিল, কিন্তু পালিয়ে এসেছে ভয়ে এবং যন্ত্রণায়। ভয়—সেই শিস উঠছে। যন্ত্রণা-ধোঁয়ার।
কর্তার রোষ শেষে আগুন হয়ে জ্বলে উঠেছে গায়ের ধারে, সাবধান করে দিচ্ছেন। বনওয়ারী থমকে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে পাতে বললেকত্তার কোপ! কত্তার কোধ।
প্রহ্লাদ বলে–না, করালী আগুন লাগিয়েছে, বাঁশের পাতায় কেরাচিনি ত্যাল ঢেলে আগুন। লাগিয়েছে। সে রয়েছে ওই ধোঁয়ার মধ্যে।
মুহূর্তে ক্ষেপে গেল বনওয়ারী, নেমে গেল ধোঁয়ায় ভরা বাঁশবনের মধ্যে।
হ্যাঁ, শিসও উঠছে। কৰ্তাও ক্ষেপেছেন। এগিয়ে গেল বনওয়ারী শব্দ লক্ষ্য করে।
যেখানে শব্দটি উঠছে, তারই সামনে দাঁড়িয়ে আছে করালী। বুক চিতিয়ে নিৰ্ভয়ে একদৃষ্টে উপরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে জল পড়ছে। মুছছে আর উপরের দিকে চেয়ে দেখছে। নিচে আগুন নাচছে শুকনো পাতার স্থূপে। উত্তাপে বাঁশবেড় যেন অগ্নিগড় হয়ে উঠেছে, আঁচ লাগছে গায়ে, করালীর সেও গ্রাহ্য নাই।
বনওয়ারী এগিয়ে গেল ভয়ঙ্কর মূর্তিতে।–হে কত্তা, মাপ কর তুমি। আমি হতভাগাকে ফেলে দিচ্ছি ওই আগুনে। তুমি নিজের মহিমায় আগুন নিবিয়ে দাও। বাঁচাও তুমি বাঁশবাঁদিকে, বাঁচাও হাঁসুলীর বাককে বচাও। সে সেই ভয়ঙ্কর কণ্ঠে ডাকলে—করালী!
করালী তার দিকে চকিতের মত চেয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে বনওয়ারীকেই ইশারা করে ডাকলে—এস, এস। এতটুকু নড়ল না সে। বনওয়ারীর ক্রোধ আরও বেড়ে গেল। সে অগ্রসর হল, মনে মনে বলল—যাই যাই, দাঁড়া।
দূরে পিছন থেকে ভেসে আসছে আর একটা আওয়াজমামা! মামা! মামা! পাখীর গলা। আর্ত-উৎকণ্ঠা যেন ফেটে পড়ছে কণ্ঠস্বরে। কিন্তু বনওয়ারী আজ নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। কাহারপাড়ার বিচারকর্তা সে। ব্রহ্মার পুত্র দক্ষের মত সর্বময় কর্তা–দণ্ডদাতা।
বনওয়ারী দুর্দান্ত ক্ৰোধে করালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কোশকেঁধের বাড়ির ছেলে, বিধাতার মোটা হাতে পাথর কেটে গড়া বনওয়ারী।
করালী কিন্তু নড়ল না, এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, বনওয়ারীর হাত থেকেও মোচড় দিয়ে ছাড়িয়ে নিলে একটা হাত। সেই হাতে সে দুর্দান্ত বিক্ৰমে আক্রমণ করলে বনওয়ারীকে। আশ্চর্য, বনওয়ারী অনুভব করছে—করালীর শক্তি যেন তার চেয়ে বেশি। না, বনওয়ারীর পায়ের তলায় বাঁশের পাতাগুলি পিছলে সরে যাচ্ছে। সেই অসুবিধার জন্যই করালী তাকে বাগে পেয়েছে। হঠাৎ করালী চিৎকার করে উঠল—ছাড়–ছাড়পড়ছে। ছাড়।
উৎসাহের প্রাবল্যে তার শক্তি যেন শতগুণ বেড়ে গেল। সে অনায়াসে বনওয়ারীকে নিচে ফেলে দিয়ে তাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নাচতে লাগল সে। ওই ওই ওই শালা পড়ছে। বনওয়ারী উঠে বসল। সঙ্গে সঙ্গে করালী এসে তার হাত ধরে টেনে আঁকি দিয়ে বলল—ওই ওই দেখ, তোমার কর্তা পড়ছে বশের ডগা থেকে। হুই-হুইয়ো!
বঁশের ঝাড়ের মাথা থেকে আগুনের উত্তাপে ধোঁয়ায় ক্লিষ্ট অবসন্ন হয়ে এলিয়ে নিচে পড়ছে। একটা প্রচণ্ড সাপ। পাহাড়ে চিতির মত মোটা, তেমনই বিচিত্র তার বর্ণ, কিন্তু লম্বা খুব বেশি নয়। পাহাড়ে চিতির সঙ্গে ওইখানেই সেটার পার্থক্য।
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সেই দিকে চেয়ে বনওয়ারী বললে—পে-কা-ণ্ড চন্দ্রবোড়া! হ্যাঁ, ওদের গৰ্জন খুব বটে।
—এটা কত বড় দেখছ না? তাতেই শিসের শব্দ হয়। শালা!
আগুনের মধ্যে পড়ে সাপটা ছটফট করছে। মরছে। করালী তারই উপর দমাদম ঢেলা ছুঁড়ে মারছে। অব্যর্থ তার লক্ষ্য।
মামা! মামা! এদিক থেকে পাখী ডাকছে। ধোঁয়ার মধ্যে বুঝতে পারছে না সে, এরা কোন দিকে রয়েছে। উৎকণ্ঠিত আগ্রহে সে ডাকছে। ডাকটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাখী ওদের খুঁজে ফিরছে।
চিৎকার করে সাড়া দিলে করালী—এই দিকে এই দিকে। আয়। আয়। ডাক্ সব পাড়ার নোককে! দেখে যা তাদের কত্তা পুড়ছে। দেখে যা। ডাক্ সব লোককে। ডাক্—ডাক্।
ওদিকে সাপটার পেটটার একটা মোটা অংশ ফেটে গেল আগুনের আঁচে। বেরিয়ে পড়ল একটা কি। এগিয়ে গেল করালী, বনওয়ারীও গেল। অঁকে দেখতে লাগল, ওটা কি? ওঃ, একটা বুনো শুয়োরের বাচ্চা। ওটাই কাল রাত্রে সেই তীক্ষ্ণ চিৎকার করেছিল।
পাখী ছুটে এসে করালীর হাত ধরলে। সে হাঁপাচ্ছে।
করালী বললেওই দেখৃ। সাপটা দেখে পাখী অবাক হয়ে গেল। দেখতে দেখতে ভেঙে এল গোটা কাহারপাড়ার লোক। বিস্ময়ে কৌতূহলে অবাক হয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর কলকল করে বাঁশবাঁদি মুখরিত করে তুললে।
করালী হাসতে হাসতে বলে উঠল–মুরুবি, কত্তার পুজোটা সব আমাকে দিয়ো গো। সে হা-হা করে হাসতে লাগল।
পাখী ধমক দিয়ে বললে—চুপ কর।
করালী তবুও হাসতে লাগল। সে যেন এক অপার কৌতুক।
পাখী করালীর পিঠে একটা কিল মেরে বললে—ডাকাবুকো, ডারপাড়, লঘুগুরু জ্ঞান নাই তোমার?