What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected হাঁসুলী বাঁকের উপকথা -তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়⚛️ (2 Viewers)

নাঃ-কাহারদের ভাগ্য ভাল। কোধের মধ্যেও কত্তা কিঞ্চিৎ দয়া করেছেন।

গ্রামে আগুন নয়। আগুন লেগেছে বাঁশবেড়ের বাঁশবনের তলায়। মাঘে পাতা ঝরেছে। বাঁশের। নিবিড় বাঁশবনের অজস্র পাতা স্থূপীকৃত হয়ে জমে আছে তলায়। সেই ঝরা শুকনো পাতায় আগুন লেগেছে। কি করে লাগল কে জানে? বেলা প্রখর হয়ে উঠেছে, পাতাগুলির উপরে রাত্রের শিশির শুকিয়ে গিয়েছে; আগুন খোরাক পেয়েছে ভাল। সবুজ দেওয়ালের মত যে বাঁশবন, সে বাঁশবন ধোঁয়ায় প্রায় ঢেকে গিয়েছে।

বাঁশবাদির ধারে লোকজন স্তম্ভিত বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢুকতে কারও সাহস নাই। নিমতেলে পানু, প্রহ্লাদ জাঙল থেকে বনওয়ারীর আগেই ফিরে এসেছে। তারা ঢুকেছিল, কিন্তু পালিয়ে এসেছে ভয়ে এবং যন্ত্রণায়। ভয়—সেই শিস উঠছে। যন্ত্রণা-ধোঁয়ার।

কর্তার রোষ শেষে আগুন হয়ে জ্বলে উঠেছে গায়ের ধারে, সাবধান করে দিচ্ছেন। বনওয়ারী থমকে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে পাতে বললেকত্তার কোপ! কত্তার কোধ।

প্রহ্লাদ বলে–না, করালী আগুন লাগিয়েছে, বাঁশের পাতায় কেরাচিনি ত্যাল ঢেলে আগুন। লাগিয়েছে। সে রয়েছে ওই ধোঁয়ার মধ্যে।

মুহূর্তে ক্ষেপে গেল বনওয়ারী, নেমে গেল ধোঁয়ায় ভরা বাঁশবনের মধ্যে।

হ্যাঁ, শিসও উঠছে। কৰ্তাও ক্ষেপেছেন। এগিয়ে গেল বনওয়ারী শব্দ লক্ষ্য করে।

যেখানে শব্দটি উঠছে, তারই সামনে দাঁড়িয়ে আছে করালী। বুক চিতিয়ে নিৰ্ভয়ে একদৃষ্টে উপরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে জল পড়ছে। মুছছে আর উপরের দিকে চেয়ে দেখছে। নিচে আগুন নাচছে শুকনো পাতার স্থূপে। উত্তাপে বাঁশবেড় যেন অগ্নিগড় হয়ে উঠেছে, আঁচ লাগছে গায়ে, করালীর সেও গ্রাহ্য নাই।

বনওয়ারী এগিয়ে গেল ভয়ঙ্কর মূর্তিতে।–হে কত্তা, মাপ কর তুমি। আমি হতভাগাকে ফেলে দিচ্ছি ওই আগুনে। তুমি নিজের মহিমায় আগুন নিবিয়ে দাও। বাঁচাও তুমি বাঁশবাঁদিকে, বাঁচাও হাঁসুলীর বাককে বচাও। সে সেই ভয়ঙ্কর কণ্ঠে ডাকলে—করালী!

করালী তার দিকে চকিতের মত চেয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে বনওয়ারীকেই ইশারা করে ডাকলে—এস, এস। এতটুকু নড়ল না সে। বনওয়ারীর ক্রোধ আরও বেড়ে গেল। সে অগ্রসর হল, মনে মনে বলল—যাই যাই, দাঁড়া।

দূরে পিছন থেকে ভেসে আসছে আর একটা আওয়াজমামা! মামা! মামা! পাখীর গলা। আর্ত-উৎকণ্ঠা যেন ফেটে পড়ছে কণ্ঠস্বরে। কিন্তু বনওয়ারী আজ নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। কাহারপাড়ার বিচারকর্তা সে। ব্রহ্মার পুত্র দক্ষের মত সর্বময় কর্তা–দণ্ডদাতা।

বনওয়ারী দুর্দান্ত ক্ৰোধে করালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কোশকেঁধের বাড়ির ছেলে, বিধাতার মোটা হাতে পাথর কেটে গড়া বনওয়ারী।

করালী কিন্তু নড়ল না, এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, বনওয়ারীর হাত থেকেও মোচড় দিয়ে ছাড়িয়ে নিলে একটা হাত। সেই হাতে সে দুর্দান্ত বিক্ৰমে আক্রমণ করলে বনওয়ারীকে। আশ্চর্য, বনওয়ারী অনুভব করছে—করালীর শক্তি যেন তার চেয়ে বেশি। না, বনওয়ারীর পায়ের তলায় বাঁশের পাতাগুলি পিছলে সরে যাচ্ছে। সেই অসুবিধার জন্যই করালী তাকে বাগে পেয়েছে। হঠাৎ করালী চিৎকার করে উঠল—ছাড়–ছাড়পড়ছে। ছাড়।

উৎসাহের প্রাবল্যে তার শক্তি যেন শতগুণ বেড়ে গেল। সে অনায়াসে বনওয়ারীকে নিচে ফেলে দিয়ে তাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নাচতে লাগল সে। ওই ওই ওই শালা পড়ছে। বনওয়ারী উঠে বসল। সঙ্গে সঙ্গে করালী এসে তার হাত ধরে টেনে আঁকি দিয়ে বলল—ওই ওই দেখ, তোমার কর্তা পড়ছে বশের ডগা থেকে। হুই-হুইয়ো!



বঁশের ঝাড়ের মাথা থেকে আগুনের উত্তাপে ধোঁয়ায় ক্লিষ্ট অবসন্ন হয়ে এলিয়ে নিচে পড়ছে। একটা প্রচণ্ড সাপ। পাহাড়ে চিতির মত মোটা, তেমনই বিচিত্র তার বর্ণ, কিন্তু লম্বা খুব বেশি নয়। পাহাড়ে চিতির সঙ্গে ওইখানেই সেটার পার্থক্য।

বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সেই দিকে চেয়ে বনওয়ারী বললে—পে-কা-ণ্ড চন্দ্রবোড়া! হ্যাঁ, ওদের গৰ্জন খুব বটে।

—এটা কত বড় দেখছ না? তাতেই শিসের শব্দ হয়। শালা!

আগুনের মধ্যে পড়ে সাপটা ছটফট করছে। মরছে। করালী তারই উপর দমাদম ঢেলা ছুঁড়ে মারছে। অব্যর্থ তার লক্ষ্য।

মামা! মামা! এদিক থেকে পাখী ডাকছে। ধোঁয়ার মধ্যে বুঝতে পারছে না সে, এরা কোন দিকে রয়েছে। উৎকণ্ঠিত আগ্রহে সে ডাকছে। ডাকটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাখী ওদের খুঁজে ফিরছে।

চিৎকার করে সাড়া দিলে করালী—এই দিকে এই দিকে। আয়। আয়। ডাক্‌ সব পাড়ার নোককে! দেখে যা তাদের কত্তা পুড়ছে। দেখে যা। ডাক্‌ সব লোককে। ডাক্—ডাক্।

ওদিকে সাপটার পেটটার একটা মোটা অংশ ফেটে গেল আগুনের আঁচে। বেরিয়ে পড়ল একটা কি। এগিয়ে গেল করালী, বনওয়ারীও গেল। অঁকে দেখতে লাগল, ওটা কি? ওঃ, একটা বুনো শুয়োরের বাচ্চা। ওটাই কাল রাত্রে সেই তীক্ষ্ণ চিৎকার করেছিল।

পাখী ছুটে এসে করালীর হাত ধরলে। সে হাঁপাচ্ছে।

করালী বললেওই দেখৃ। সাপটা দেখে পাখী অবাক হয়ে গেল। দেখতে দেখতে ভেঙে এল গোটা কাহারপাড়ার লোক। বিস্ময়ে কৌতূহলে অবাক হয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর কলকল করে বাঁশবাঁদি মুখরিত করে তুললে।

করালী হাসতে হাসতে বলে উঠল–মুরুবি, কত্তার পুজোটা সব আমাকে দিয়ো গো। সে হা-হা করে হাসতে লাগল।

পাখী ধমক দিয়ে বললে—চুপ কর।

করালী তবুও হাসতে লাগল। সে যেন এক অপার কৌতুক।

পাখী করালীর পিঠে একটা কিল মেরে বললে—ডাকাবুকো, ডারপাড়, লঘুগুরু জ্ঞান নাই তোমার?
 
গোটা কাহারপাড়ার আবালবৃদ্ধবনিতা স্তম্ভিত এবং স্তব্ধ হয়ে গেল করালীর কথা শুনে আর সকৌতুক উচ্চহাসি দেখে। করালী বলে কি? কত্তার পুজোটা আমাকে দিয়ো গো! এত বড় স্পৰ্ধা তার! হে ভগবান, হে বাবা কালারুদ্র, হে বাবাঠাকুর।

বনওয়ারী স্থির দৃষ্টিতে দেখছিল করালীকে। আজই যেন সে করালীকে নতুন করে দেখলে। নোড়ার কাজের জন্যে কুড়িয়ে আনা নুড়িটাকে আলোর ছটায় জ্বলতে দেখে মানুষ যেমনভাবে সবিস্ময়ে সাগ্রহে সসম্ভ্ৰমে তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, তেমনই ভাবে দেখলে তাকে বনওয়ারী। ছোঁড়ার চেহারাটা ছেলেবেলা থেকেই মিষ্টি চেহারা আজও তাকে দেখে সেই মিষ্টি চেহারার আস্বাদই মনে জাগে, আজ বনওয়ারী তাকে দেখে নতুন আস্বাদ পাচ্ছে। গোটা কাহারপাড়াই পাচ্ছে যেন।


লম্বা দীঘল চেহারা, সাধারণ হাতের চার হাত খাড়াই তাতে কোনো সন্দেহ নাই, সরু কোমর, চওড়া বুক, গোলালো পেশিবহুল হাত, সোজা পা দুখানি, লম্বা আমের মত মুখ, বড় বড় চোখ, নাকটি খাদা; কিন্তু তাতেই চেহারাখানিকে করেছে সবচেয়ে মিষ্টি, তারও চেয়ে মিষ্টি তার ঠোঁট আর পাঁত। হাসলে বড় সুন্দর দেখায় করালীকে।

তরুণের দলের অবশ্য এ চেহারা চোখে ঠেকেছে। পাড়ার ছোকরারা মনে মনে অধিকাংশই করালীর অনুগত। কিন্তু এ চেহারা সকলের চেয়ে ভাল করে দেখেছে পাখী। করালীর দেহের রূপ। বীর্য সে দেখে মুখস্থ করে ফেলেছে। তার কাছে জীবনে সব এক দিক আর করালী এক দিক।


বনওয়ারীও দেখছিল করালীর দেহের শক্তির শোভা। হ্যাঁ, ছোকরা জোয়ান হয়েছে বটে। করালী যখন ঘরে কুকুরটার জন্যে সমাধি খুঁড়ছিল, তখন চকিতের মত যেন চোখে পড়েছিল এ চেহারা। কিন্তু বনওয়ারী তখন দেখেও দেখে নাই। আজ এই মুহূর্তে তাকে না দেখে বনওয়ারীর উপায় নাই। মনে পড়ছে বনওয়ারীর বাঁশবনে সে ঝাপিয়ে পড়ল করালীর উপর, নিষ্ঠুর ক্রোধে কাঁপিয়ে পড়ল, ইচ্ছে ছিল—বুকে চেপে বসে গলাটা টিপে ধরবে, মরে যদি যায় দেবে ফেলে ওই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে। কিন্তু বনওয়ারীর ভাল মনে পড়ছে না, কি করে হয়েছিল। বাঁশপাতায় পা পিছলে গিয়েছিল?


ধোঁয়ায় মাথা ঘুরে গিয়েছিল? হয়েছিল একটা কিছু। করালীই চেপে বসেছিল তার উপর? সে ভাবছিল, করালী হয়ত উচ্চহাসি হেসে এই সমবেত কাহারদের কাছে বলবে, বাবাঠাকুরের চেলা বনওয়ারী মুরুব্বিকেও দেখে নিয়েছি

পাখী এগিয়ে এল বনওয়ারীর কাছে। ডাকল-মামা!

বনওয়ারী তার মুখের দিকে তাকাল। তারপর হঠাৎ হেসে বললে—করালীর বুদ্ধি আছে। ও ঠিক ধরেছে।

করালী উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠল—রেললাইনের আটাশ মাইলে ঠিক এমনি হয়েছিল। বুঝেছ—আটাশ মাইলে—খুব জঙ্গল, সেখানে গেলবারে ঠিক এমনি শিস উঠত। সন্ধ্যাবেলা টলি ঠেলে আসছি, টলিতে আছে সায়েব। হাতে বন্দুক। বুঝেছ, শিস শুনেই বললে—রোখো টলি। তাপরেতে টর্চ মারতে লাগল, মারতে মারতে এক জায়গায় টর্চ পড়তেই দেখতে পেল সাপ। বাস্, বন্দুক তুলে গুড়ুম।

প্ৰহ্লাদ বললে, লে এখন সাপটাকে ভাল করে পুড়িয়ে দে। খরিস গোখরা লয়, চিতি বটে–তা বড় চিতি। বেরান না হোক, বদ্যি কায়স্থ-টায়স্থ তো বটেই। সৎকার করতে হবে তো!



নিমতেলে পানু বয়সে করালীদের বয়সী হলেও জ্ঞানবৃদ্ধ প্রহ্লাদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করে। সে সর্বাগ্রে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল—একশো বার। শুধু কি সজাত পেহ্লাদদাদা? পবীন, পবীন সাপ। তা বয়স তোমার অনেক হবেন গো।


করালী বললে না। ও আমি নিয়ে যাব। দেখুক, পাঁচজনায় দেখুক। সন্জে হতেই সব কিসের ভয়ে জুজুমানা হয়ে ঘরে খিল দিত। দেখুক।-বলে আবার সে হেসে উঠল।

নিমতেলে পানু বনওয়ারীর দিকে চেয়ে বললে—মুরুব্বি!

বনওয়ারী বললে—তা। সে বুঝতে পারলে না, কি বলা উচিত।

—কি? বল? তা বলে যে থেমে গেলা! পানু বিরক্তিভরেই বললে, শাস্ত যা বটে, তা করতে হবে? না–কি?

—তা করবে। মড়া মলে সঙ্গে সঙ্গেই তো পোড়ায় না। পাঁচজনা আসে, দেখে। বাসমড়া না হলে হল। তা এখন নিয়ে যেয়ে রাখুকতাপরে আত্তি কালে নদীর ধারে দেবে পুড়িয়ে।

খুব খুশি হয়ে উঠল করালী। বললে—এই না হলে মুরুব্বি বলবে কেনে?

বনওয়ারী বললে—তু তো মানিস না রে মুরুব্বি বলে।

করালী এবার লজ্জিত হল। সুন্দর হাসি হেসে সে বললে মানি গো খুব মানি, মনে মনে মানি। বুঝলে?

নিমতেলে পানু বললে তা আবার মানিস না। কাহারপাড়ার পিতিপুরুষের রোপদেশে নাতি মেরে মুরুরি মুখের ওপর বুড়ো আঙুল লেড়ে দিয়ে চন্দনপুরে মেলেচ্ছো কারখানায় কাজ করছিস। মেলা রোজগার করছিস

করালী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল মুহূর্তে। সে চিৎকার করে উঠল-হারামজাদা!

বনওয়ারী দুই হাত বাড়িয়ে আগলে বললে–না।

করালী থমকে দাঁড়াল। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি বনওয়ারীর মুখের উপর রেখে চেয়ে রইল।

বনওয়ারী বললে, মারামারি করতে নাই। পেনোর অন্যায় বটে। ওকে আমি শাসন করে দোব।


করালী তার অনুগতদের বললে—একটা বাঁশ আন। চাপিয়ে তুলে নিয়ে যাব।


প্ৰহ্লাদ বললে—বেশ পেশস্ত জায়গায় আখ। অ্যানেক লোক দেখতে আসবে।

এ সম্বন্ধে তাদের অভিজ্ঞতা আছে। দাতাল শুয়োর মারা এখানে তো সাধারণ ব্যাপার; এ বিষয়ে শিক্ষাও তাদের পুরুষানুক্রমিক; কখনও কখনও দু-এক জন জখমও হয় দাতালের দাতে। বছরে দু-তিনটে দাতালে মারেই, আর এখানকার লোকের স্বভাব হল—খবর পেলেই ছুটে দেখতে আসবে। দাতালটাকেও দেখে, আবার জখম মানুষটাকেও দেখে। বাঘ কি কুমির হলে তো কথাই নাই। প্ৰায় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগে একটা চিতা এসেছিল, ওই কোপাইয়ের বানে ভেসে এসে বাঁশবেড়েয় আটকে যায়। সেটা ছিল জ্যান্ত। সে বলতে গেলে বনওয়ারীর বাপের আমল। কৰ্তা ছিল তারাই। বনওয়ারী প্রহ্লাদ এদের তখন করালীর বয়স, এরা ছিল কর্মী। কর্তাদের পরামর্শে বাঘটাকে তারাই বাঁশের খাঁচা তৈরি করে ধরেছিল। শক্ত পাকা বাঁশ আধখানা করে চিরে শিকের মত গেঁথে খাঁচা তৈরি করেছিল তারা; লোহার শিক দিয়ে তৈরি খাঁচার চেয়ে সে বেশি শক্ত। সেই আঁচার মধ্যে পাঠার বাচ্চা বেঁধে বাঁশবাঁদির বনে খচা পাতা হল। এক দিন, দু দিন, তিন দিনের দিনই বাঘা বন্দি হল। তখন খুঁচিয়ে মারার ব্যবস্থা। মারার পর ভেঙে এল চাকলার লোক। ঘোষকৰ্তা আগেই এসে মরা বাঘের উপর মারলে এক গুলি। রগে নল রেখে গুলি। তারপর লোকের ভিড় দেখে জাঙল থেকে আনালেন একটা উঁচু তক্তপোশ, সেইটার উপরে রেখে দিলেন। সে কি ভিড়! কেউ বাঘটাকে ঢেলা মারলে, কেউ লাঠি দিয়ে খোঁচালে, কেউ লেজ ধরে টানলে, দু-চার জন ছোকরা তো বাই ঠুকে লাফিয়ে উপরে পড়ে মারলে দমাদম ঘুষি। কেউ-বা সেটাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েই পড়ল মনের আনন্দে। সেইসব ভেবেই চিরদিনের চলতি প্রথা অনুযায়ী কথাটা বললে প্ৰহাদ-রতনের দল। জায়গার জন্য ভাবনারও কোনো প্রয়োজন নাই। চিরকাল যেখানে নামানো হয়, সেই বনওয়ারীর খামার পড়ে রয়েছে—মস্ত ফাকা জায়গা।


কিন্তু করালীর মতিগতিই ভিন্ন। হাত ছয়েক লম্বা একটা বশের উপর সেটাকে ঝুলিয়ে আর। একজনের সাহায্যে কাঁধে তুলে বয়ে বনওয়ারীর খামার পার হয়ে চলতে শুরু করলে নিজের বাড়ির দিকে। প্রহ্লাদ রতন পানু বললে–নামা এইখানে।

করালী বললেউই। আমার বাড়িতে নিয়ে যাব আমি।

প্ৰহ্লাদ রতন পানু স্তম্ভিত হয়ে গেল করালীর স্পৰ্ধা দেখে। তারা বনওয়ারীর মুখের দিকে চাইল।

বনওয়ারী এতক্ষণে হাসলে। তাচ্ছিল্যভরেই বললে—যাক, যাক, ছেলেমানুষ। তা ছাড়া কাণ্ডটি তো ওরই বটে বাবু। তারপর করালীর পিঠে কয়েকটা আদরের চাপড় মেরে বললে–হা। বীর বেটাছেলে বটিস তুই।

করালী হাসলে। স্মিতমুখে আনন্দের হাসি হাসলে। সঙ্গে সঙ্গে একটু যেন লজ্জিত হল। মনে হল, বনওয়ারী খুড়োকে খানিকটা সম্মান দেখানোর প্রয়োজন আছে। সে বললে—তুমিও এসো কিন্তুক।

আচ্ছা। যাব, চল্‌।
 
বাড়ির উঠানে ফেলে করালী বীরদৰ্পে সকলের দিকে চাইল। মাতব্বর-মুরব্বিরা কেউ আসে নাই। অপমান বোধ না করলেও তারা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। করালী এই সুযোগে কৌতুক করে অকস্মাৎ ভান করে চমকে উঠে বলে উঠল—ওরে বাবা, লড়ছে যে!

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের দল আতঙ্কে চিৎকার করে ঠেলাঠেলি করে পিছু হঠতে লাগল। পুরুষেরা ঠেলাঠেলি লাগিয়ে দিলে। করালী অট্টহাসি হেসে উঠল। বললে—যত সব ভয়তরাসের দলভয়েই মরবে, ভয়েই মরবে।

তারপর বললে-পালাও সব, পালাও বলছি। নইলে ভাল হবে না। পালাও। পাখী, বার কর।

অর্থাৎ মদের বোতল। বিজয়ী বীর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মদ্যপান করবে। কাহারপাড়ায় তরুণদের নিয়ে তার একটি দল আছে, যে দল বাইরে বনওয়ারীর মাতব্বরি মেনে চললেও অন্তরে অন্তরে করালীই তাদের দলপতি। এদের মধ্যে রতনের ছেলে নটবরই প্রধান।

নটবর একবার বীরদৰ্পে সাপটার চারদিক ঘুরে বললে—কই, একটি করে পয়সা আন দেখি নি।–বাবা, তার বেলাতে লবডঙ্কা!

একটি মেয়ে বললে—মরণ! সাপ মেরে গিদেরে যেন কি করছে! অর্থাৎ অহঙ্কারে।

করালী বললে—ধর্‌ ওকে নটবরে, আমরা গান করব, ওকে লাচতে হবে। ধর্‌।

মেয়ের দল এইবার পালাল। চ্যাঙড়ার দলকে বিশ্বাস নাই, তার উপর মদের বোতল বেরিয়েছে। কয়েক ঢোক পেটে পড়লে হয়!

নটবর বললে—আঃ, নদিদি নাই রে আজ!

করালী ইতোমধ্যে খানিকটা খেয়েছে। সে বললেওঃ, সে থাকলে মাতন লাগিয়ে দিত। হারামজাদীর কুটুম্বিতে লেগেই আছে।

নসুবালা করালীর পিসতুতো ভাই। আসল নাম সুরাম। অদ্ভুত চরিত্র নসুরামের। ভাবে ভঙ্গিতে কথায় বার্তায় একেবারে মেয়েদের মত। মাথায় মেয়েদের মত চুল, তাতে সে খোপা বঁধে, নাকে নাকছবি পরে, কানে মাকড়ি পরে, হাতে পরে কাচের চুড়ি লাল রুলি, মেয়েদের মত শাড়ি পরে। মেয়েদের সঙ্গে গোবর কুড়ায়, কাঠ ভাঙে, ঘর নিকায়, চন্ননপুরে দুধের যোগান দিতে যায়, মজুরনী খাটতে যায়। কণ্ঠস্বরটি অতি মিষ্ট গান গায়, নাচে। গান আর নাচ এই তার সবচেয়ে বড় নেশা। ঘেঁটুর দলে নাচে, ভাঁজোর নাচনে সে-ই মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা নাচিয়ে। মেয়েদের সঙ্গেই সে ব্ৰতপার্বণ করে। করালীর ঘরে সে-ই গৃহিণী। করালী বিয়ে করে বউ তাড়িয়ে দিয়েছে, বউ তার পছন্দ হয় নি, আবার বিয়ে করবে। নসুরও বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, নসুও বউ তাড়িয়ে দিয়েছে, সে আর বিয়ে করবে না। করালীর ঘরে বোন হয়ে, করালীর বউয়ের ননদ হয়ে থাকবে—এই তার বাসনা। পাড়ার বিয়েতে নসুবালাই বাসরে নাচে, গান গায়। শুধু পাড়ায় নয়, গ্রামে গ্রামান্তরে যে কোনো ঘরে ধুমধামের বিয়ে হলেই নসুকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খবর দেয়। নসু খোপা বেঁধে, আলতা পরে, রঙিন শাড়ি পরে, কপালে সিঁদুর ঠেকিয়ে অর্থাৎ টিপ পরে রওনা হয়, আবার উৎসব মিটলে ফেরে। করালীর জন্য কিছু-না-কিছু নিয়ে আসে।

এই নসুবালার অভাবই করালী সবচেয়ে বেশি অনুভব করলে আজ।

—নসুদিদি নাই তো পাখী নাচুক কেনে? কথাটা বললে করালীর অপর অনুগত শিষ্য মাথলা। মাথলার আসল নাম রাখাল বা আখাল, কিন্তু দেহের অনুপাতে মাথাটা মোটা বলে কাহারেরা তাদের নিজস্ব ব্যাকরণ অনুযায়ী সম্ভবত ওয়ালা প্রত্যয় করে করেছে মাথলা।


কথাটা মন্দ বলে নাই মাথলা। কিন্তু তবু ভ্ৰ কুঁচকে উঠল করালীর। পাখী তাকে ভালবাসে, একদিন হয়ত তাকেই সে সাঙা করবে। সে নাচবে এই এদের সামনে?

পাখির চোখেও রঙ ধরেছে, সেও খানিকটা পাকী মদ খেয়েছে, করালীর গৌরবে তারও নাচতে মন যাচ্ছে; তবু সে করালীর মুখের দিকে চাইলে। চেয়েই সে বুঝতে পারলে করালীর মন, সে তৎক্ষণাৎ বললে–না। তোর বউকে ডাক্ কেনে?

ঠিক এই সময়েই কাছাকাছি কোথাও সুচাঁদের কর্কশ কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়ে উঠল, মুহূর্তে সমস্ত পাড়াটা চকিত হয়ে উঠল।

—ওরে বাবা রে! ওরে মা রে! আমি কোথায় যাব রে!

করালী হা-হা করে হেসে উঠল, বললে—বিত্যেব দেখ বুড়ির! অর্থাৎ ভয়ে চেঁচানি দেখ বুড়ির। তারপর সকৌতুকে বলে উঠল—নিয়ে আয়, নিয়ে আয়, ও-ই বুড়িকে নিয়ে আয়ওই নাচবে। তুর্কি নাচন নাচাব বুড়িকে। ব্যাঙ দেখে নাচে, সাপ দেখে নাচবে না? ডাকতে হল না, এক-গা কাদা মেখে খাটো-কাপড়-পরা সুচাঁদ এসে দাঁড়াল করালীর উঠানে। তার পিছনে আরও কয়েকজন প্রৌঢ়া মেয়ে। স্থির দৃষ্টিতে সে মরা সাপটাকে কিছুক্ষণ দেখে হঠাৎ বুক চাপড়ে কেঁদে উঠল। শঙ্কাতুর অমঙ্গল ঘোষণার সুর ধ্বনিত হয়ে উঠল তার কণ্ঠস্বরে।

—ওগো বাবাঠাকুর গো! ওরে, আমার বাবার বাহন রে! ওরে, কি হবে রে! হায় মা রে! বলতে বলতে সে থরথর করে কেঁপে মাটির উপরে বসে পড়ল।

সমস্ত কাহারপাড়ার আকাশে একটা আশঙ্কার আর্তবাণী হায় হায় করে ছড়িয়ে পড়ল। করালী পাখী নটবর মাথলা সকলেই বেরিয়ে এল—কি হল?

হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবনে-ঘেরা আলো-আঁধারির মধ্যে গ্রামখানি। সে গ্রামের উপকথায় এ দেশের কতকাল আগের ব্রত-কথায় আছে, গায়ে ছিল এক নিঃসন্তান বুড়ি, ব্রত করত, ধর্মকর্ম করত, গাঁয়ের দুঃখে দুঃখ করেই তার ছিল সুখ। কারও দুঃখে কাঁদতে না পেলে বুড়ি পশু-পক্ষীর দুঃখ খুঁজে বেড়াত। এমন দিনের সকালে বসে ভাবতে ভাবতে আপন মনেই বলত—কাদি কাঁদি মন করছে, কেঁদে না আত্মি মিটছে, মহাবনে হাতি মেরেছে, যাই; তার গলা ধরে কেঁদে আসি।

হাঁসুলী বাঁকে সুচাঁদ বুড়ি বোধহয় সেকালের সেই বুড়ি। সাপটা যখন মরে তখন বুড়ি বাড়ি ছিল না। থাকলে যে কি করত, সে কথা বলা যায় না। সে গিয়েছিল ঘাস কাটতে। বাঁশবাঁদির কাহার-বুড়িরা, প্ৰবীণরা, যারা মজুরনী খাটতে পারে না, তারাও বসে খায় না—পিতিপুরুষের নিয়ম এই, যেমন গতর তেমনই খাটতে হবে। তারা দুপুরবেলা গরু-বাছুর-ছাগলের জন্য ঘাস। কাটতে যায়। কাখে ঝুড়ি নিয়ে, কাস্তে নিয়ে চলে যায় হাঁসুলীর বাঁকের ওপারে—কোপাইয়ের অপর পারে গোপের পাড়ায় মোষদহরীর বিলে ঘাস কাটতে। মস্ত বিলটার চারিপাশে প্রচুর ঘাস জন্মায়। তার সঙ্গে পানিফল তুলে আনে, কলমি শুনি শাক সংগ্রহ করে, আর দু-চারটে পাকাল মাছ—তাও ধরে আনে। তাই বুড়ি গিয়েছিল ওই মিেষদহরীর বিলে। ফিরে এসে সমস্ত কথা শুনে ছুটে এসেছে সাপটাকে দেখতে। দেখে চিৎকার করে পাড়াটাকে শঙ্কায় সচকিত করে দিলে।
 
সাপটার সামনে বুড়ি চোখ বিস্ফারিত করে স্তব্ধ হয়ে বসল। কিছুক্ষণ পর কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বাবাঠাকুরের থানের দিকে প্রসারিত করে। দিয়ে বললে—হে বাবা, হে বাবা, হে বাবা!

–অ্যাই বুড়ি। চিৎকার করে প্রতিবাদ করে উঠল করালী।

পাখী বললে—মরণ! ঢঙ দেখ! দোপরবেলায় কাদৃতে বসল দেখ! সাপ আবার বাবা হয়!

–হয় লো, হয়। বুড়ি কেঁদে উঠল। সুর করে কেঁদে কেঁদে বুড়ি বলে গেলও যে আমার বাবাঠাকুরের বাহন রে! ওর মাথায় চড়ে বাবাঠাকুর যে ভোমন করেন। আমি যে নিজের চোখে দেখেছি রে! দহের মাথায় বাবাঠাকুরের শিমুলগাছের কোটরে সুখে নিদ্যে যাচ্ছিলেন রে, আমি যে পরশু দেখেছি রে!

এরপর আর অবিশ্বাসের কিছু থাকে না। বাবাঠাকুরের শিমুলগাছ, দহের মাথায় প্রাচীনতম বনস্পতি, তারই কোটরে এই আশ্চর্যজনক শিস দেওয়া বিচিত্ৰবৰ্ণ বিষধর যখন থাকত, তখন বাবাঠাকুরের আশ্রিত, তার বাহন—এতে আর সন্দেহ কোথায়! সমবেত কাহারপাড়ার নরনারী শিউরে উঠল, মেয়েরা সমস্বরে বলে উঠল—হেই মা রে!

করালী শঙ্কিত হয়ে উঠল, আবার ক্রুদ্ধও হয়ে উঠল। সে অনুমান করতে পারছে, এরপর কি হবে। পাড়া জুড়ে হায় হায় রব উঠবে। তার সকল বীরত্ব ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। কিন্তু সে ভেবে পেল না, কি করবে! তার সঙ্গীদের মুখ শুকিয়ে গেছে। তারাও যেন ভয় পেয়েছে। তার ইচ্ছে হল, সে ছুটে চলে যায় চন্ননপুরে। সেখান থেকে ডেকে নিয়ে আসে তাদের ছোট সাহেবকে, যে সেদিন এমনই একটা সাপ মেরেছে রেললাইনের ধারে, যে সাহেব নিজে হাতে কোপ মেরেছে নদীর ঘাটে পেত্নীর আশ্রয়স্থল পুরনো শেওড়াগাছটায়; সে এসে মরা সাপটাকে লাঠি দিয়ে খোঁচা মারুক, গোটা কাহারপাড়াকে সায়েস্তা করে দিক।

হঠাৎ পাখী চিৎকার করে উঠল। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে সে মাতামহীর সামনে এসে বললে—এই দেখ বুড়ি, এই ভর তিন পর বেলাতে তু কাদতে লাগিস না বললাম।

কালা সুচাঁদ শুনতে পেলে না কথা। সে আপন মনেই আক্ষেপ করে চলল—সব্বনাশ হবে। রে, সৰ্ব্বনাশ হবে। ই গায়ের পিতুল নাই। আঃ আঃ হায় হায় রে!

পাখী এবার আর বৃথা চিৎকার করলে না। এসে বুড়ির হাত ধরে টেনে তাদের ঘরের সীমানা থেকে বার করে এনে চিৎকার করে বললে—এইখানে বসে কা।

হাত ধরে টানাতেও বুড়ি প্রথমটা বুঝতে পারে নাই পাখীর মনের ভাব। এবার কিন্তু বুঝতে বাকি রইল না। সে মুহূর্তে ভয়ঙ্করী হয়ে উঠল, এবং এক মুহূর্তে সে অলৌকিক লোক থেকে নেমে এল লৌকিক বাঁশবাঁদির ইতিহাসে। তা নইলে যেন পাখীকে ধরা যায় না, পাখী এবং করালীকে দেবতার ভয় দেখিয়ে মানানো যায় না। তাই সে আরম্ভ করলে পাখীর জন্মকাণ্ডের কাহিনী, তা নইলে ওর চরিত্র এমন হবে কেন?

চিৎকার করে পাখীর জীবনের জন্মকাণ্ড হতে এ পর্যন্ত যত অনাচারের কথা আছে তাকে সাতকাও করে আকাশ-লোককে পর্যন্ত শুনিয়ে দিলে। অবশেষে শাসন করে বললে হারামজাদী বেজাত—বদজাত—বদজম্মিত, এত বড় বড় তোমার? আমার বাড়ি থেকে আমাকে বার করে দাও তুমি?

তারপর সে বললে—তাই বা কেন? এত বড় স্পৰ্ধা এই পাখী ছাড়া আর কার হতে পারে? বসন্তের এই কন্যাটি ছাড়া আর কার হতে পারে? সুষ্ঠাদের নিজের কন্যা হলে কি হয়? সুচাঁদ সত্য ছাড়া মিথ্যা বলবে না। নিজের কন্যা বলে সে তার খাতির করে না। বসন্তের যে মতিগতি মন্দ; যখন ওই জাঙলে চৌধুরীবাবুর মাতাল ছেলের সঙ্গে মনে রঙ লাগায়, তখন সে জানে এর দুর্ভোগ তাকেই ভুগতে হবে। আজও পর্যন্ত বসন্ত সেই রঙের নেশায় বিনা পয়সায় বারটি মাস চৌধুরী-বাড়িতে দুধ যোগায়। তাও কিছু বলে না সে। এই হারামজাদী পাখী যখন বসন্তের পেটে এল, তখন খুঁজে খুঁজে সুচাঁদ নিয়ে এসেছিল এক জরাজীর্ণ খোড়া কাহারের ছেলেকে; এনে অনেক ঘুষ দিয়ে পাখীর পিতৃত্বের দায়িত্ব তার উপর চাপিয়ে বসন্ত এবং পাখীকে রক্ষা করেছিল। অন্যায় হয়েছিল—তার অন্যায় হয়েছিল। বসন্তকেই পথে বার করে দেওয়া উচিত ছিল। অথবা এ পাপকে ভ্রুণ অবস্থায় বিনষ্ট করতে বসন্তকে বাধ্য করা উচিত ছিল তার। এ পাপ যে এমন হবে, সে তো জানা কথা। ওই চৌধুরীদের এবং বসন্তের রক্ত তার দেহে, তার রঙের নেশা এমনই হবে যে! করালীর নেশায় পাগল হয়েছে পাপ পাখী। সেই নেশায় অন্যায়কে ন্যায়, ন্যায়কে অন্যায় দেখছে বজ্জাত বেজাত।


পাখী হঠাৎ ফোঁস করে উঠল-হারামজাদী, আমার শরীলে লয় চৌধুরীদের অক্ত আছে, তাতেই না হয় আমার নেশা বেশি। কিন্তু তোর প্যাটের মেয়ের নেশা কেনে আজও ছাড়ল না শুনি? বলি, তোর বসন্তের শরীরে কার অক্ত আছে তা বল? শুনি।

পাখীর চিৎকারে ঠিক মাথার উপরে আকাশে উড়ন্ত চিলটাও বোধ করি চমকে উঠল, অন্তত তাই মনে হল। ঠিক মাথার উপরে যে চিলটা স্থির পাখা মেলে ভেসে চলেছিল বলে মনে হচ্ছিল, সেটা এই মুহূর্তেই সজোরে পাখা আন্দোলিত করে দ্রুততর বেগে অতিক্রম করে গেল স্থানটা। সুচাঁদের কানেও একটি কথা অস্পষ্ট রইল না। সুচাঁদ স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর এদিক-ওদিক চেয়ে কিছু যেন খুঁজতে লাগল।

পাখী বললে—আমি জানি না তোমার বেবরণ, লয়? তুমি নিজে মুখে আমাকে বল নাই তোমার অঙের কথা?

সুচাঁদ ছুটে গিয়ে নিতেলে পানুর নিমতলা থেকে একগাছা বঁটা হাতে নিয়ে ছুটে এল।–তোর বিষ ঝেড়ে দোব আমি আজ।

পাখী ছুটে গিয়ে নিয়ে এল মস্ত লম্বা একখানা বাঁশের লাঠি। আয়, তু আয়। দেখি আমি তোকে।

হঠাৎ এই সময় এসে পড়ল বনওয়ারী। চিৎকার বেড়ে গেল সুচাঁদের। পাখী চিৎকার বন্ধ করে লাঠিখানা নিয়ে ঘরে ঢুকল। ব্যাপারটা হাঁসুলীর বাঁকে বাঁশবাঁদির কাহারপাড়ার অতি সাধারণ ব্যাপার। এমনিই এখানকার ধারা—এমনিভাবেই কলহ বাধে, এমনিভাবেই মেটে। দপ করে আগুনের মত যেমন জ্বলে উঠেছিল, তেমনই খপ করে নিবে গেল। বনওয়ারী এলে এমনিভাবেই ঝগড়া থামে।

বনওয়ারীর মুখ গম্ভীর। তার ভাবে ভঙ্গিতে একটি সম্পূর্ণ ব্যস্ততা, সে বললে—চুপ, সব চুপ।

সুচাঁদ চিৎকার করে উঠল আবারওরে বাবা রে—

বনওয়ারী ঝুঁকে কানের কাছে চিৎকার করে বললে—শুনব ইয়ের পরে।

–ইয়ের পরে?

–হ্যাঁ। মাইতো ঘোষ আসছেন সাপ দেখতে।

—কে আসছে?

জাঙলের মাইতো ঘোষ। আমার মনিব।

বুড়িও সন্ত্রস্ত হল। সকলে উদ্‌গ্রীব হয়ে জাঙলের পথের দিকে চেয়ে রইল। পানু পিছন থেকে হাঁকলে–সর, সর, সরে যাও। পথ দাও।

দু ফাঁক হয়ে গেল জনতা। জাঙলের ঘোষ এসে দাঁড়ালেন।
 
করালীর চোখ জ্বলে উঠল।

জাঙলের মাইতো ঘোষকে দেখলে যত তার ভয় লাগে, মনে মনে তত তার ক্ষোভ জেগে ওঠে। চন্ননপুরের কারখানায় কাজ করার জন্য তার মনে যত অহঙ্কার, তার অজ্ঞাত কোন গোপন মনে তার চেয়েও বেশি বেদনাও জমে আছে। ওই চন্ননপুরের কারখানায় তাড়িয়ে নিয়ে গেছেন এই মাইতো ঘোষ। ওই সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার মায়ের ইতিহাস। লজ্জা এই হাঁসুলী বাঁকের আলো-আঁধারিতে কম। কিন্তু তবুও মায়ের লজ্জাই সবচেয়ে বড় লজ্জা। তার সঙ্গে আরও আছে মা হারানোর বেদনা। আর আছে এই বাঁশবাঁদি ছেড়ে যাওয়ার প্রথম দিনের বেদনার স্মৃতি।

সেসব অনেক পুরনো কথা। হাঁসুলী বাঁকের উপকথার একটা টুকরো গল্প, গোটা পাঁচালির মধ্যের কয়েকটা ছড়া। সে ছড়া বলতে বনওয়ারীর মত মাতব্বরেরা লজ্জা পায়। ছোঁড়ারা আনাচে-কানাচে বলে। মেয়েরা বলে নিজেদের মধ্যে, রঙের কথা উঠলে ফিসফাস করে। কেবল চিৎকার করে বলে সুচাঁদ। সে বলে—আঃ, তার আবার লাজ কিসের? বলে যে সেই বেগুনে কেনে খাড়া? না বংশাবলীর ধারা। এই তো কাহারদের পুরুষে পুরুষে চলে আসছে। তারা অকপটে বলেও আসছে এই কাহিনী। করালী তখন ছেলেমানুষ, বাপ মারা গিয়েছিল তিন বছর বয়সে। পাঁচ বছর বয়স যখন তার, তখন তাকে ফেলে তার মা পালিয়ে যায় ওই চন্ননপুরে ইস্টিশানের একজন লোকের সঙ্গে। তখন ওই রেললাইন তৈরি হচ্ছে, দেশ-দেশান্তর থেকে লোক এসে লাইন বসাচ্ছে, কোপাইয়ের উপরে পুল তৈরি হচ্ছে, সে যেন এক মস্ত ব্যাপার করে। তুলেছে। হাঁসুলী বাঁকের মেয়েরা খাটতে যেত চন্ননপুরের বাড়িঘর তৈরির কাজে। রেললাইনের ওই মস্ত ব্যাপারে যাওয়া ছিল তাদের বারণ। বনওয়ারীই তখন মাতব্বর, বারণ ছিল তারই। ওখানে গেলে জাত যায়—ধৰ্ম থাকে না। চাষ করে খায় যারা, তারা ওই কারখানার বাতাস গায়ে লাগালে তাদের মঙ্গল হয় না। ওই বাতাস, ওই ঘরাণ অর্থাৎ ঘ্রাণ সহ্য করতে পারেন না চাষীর লক্ষ্মী। যাক সে কথা। করালীর মা বিধবা হয়ে চন্ননপুরে বাবুদের বাড়ি মজুরনী খাটতে গিয়ে পয়সার লোভে ইস্টিশানে কারখানার লোকদের সঙ্গে গোপ্ত যোগাযোগ পায়। তারপর সে একদিন সন্তানের মায়া পর্যন্ত পরিত্যাগ করে চলে গেল কোথায়। কেইবা খোঁজ করবে? আর খোঁজ করেই-বা কি হবে? করালী কাঁদতে লাগল। তবে হাঁসুলী বাঁকে এটা কোনো নূতন ব্যাপার নয়। এমন অনেক ঘটে, অনেক ছেলে কাদে; আত্মীয়স্বজনে টেনে নেয় কাছে। আত্মীয়স্বজন না। থাকলে মাতব্বর নেয় টেনে। অনাদরের মধ্যেই কোনো রকমে বড় হয়। দশ-বার বছর বয়স হলেই আর ভাবনা থাকে না; সে তখন সক্ষম হয়ে ওঠে, নিজের অন্নবস্ত্ৰ নিজেই রোজগার করতে। পারে। জাঙলে সদ্‌গোপের বাড়িতে ভাত কাপড় আর মাসিক চার আনা মাইনে বাঁধা। গরুর রাখালি কর্মে ঢুকে পড়ে।


করালীর তিনকুলে থাকার মধ্যে ছিল এক পিসি-ওই নসুর মা, সে-ই করালীকে টেনে। নিলে। লোকে করালীকে বলত–ভুতুড়ে ছেলে। করালী খুঁজে বেড়াত তার মাকে। খুঁজতে যেত মহিষডহরির বিলে, খুঁজত কোপাইয়ের তীরের বনে বনে, দুয়ের ধারে, শিমুলগাছের তলায়, ওই। বাবাঠাকুরতলায়; কোনো কোনোদিন চলে যেত চন্ননপুরের আলপথ ধরে মাঝপথ পর্যন্ত। কাদত মা মা বলে। তারপর কোনো খেলা আবিষ্কার করে তাই নিয়ে মত্ত হয়ে পড়ত, অথবা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। বাবাঠাকুরতলায় বসে বসে সে দেখত বেলগাছে পিঁপড়ের সারি, গোড়ায় উইয়ের ঢিপি। বেলগাছ ঢাকা অপরাজিতার লতা থেকে পাড়ত ফুল। কাহারেরা যেদিন বাবা ঠাকুরের থানে পুজো দিত, সেদিন পুজোর পরে সে সেখানে যেত গিয়ে ভোগ-দেওয়া বাতাসা পাটালি কুড়িয়ে খেত, পিঁপড়েদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হত। ঊড়ে দুধ রেখে আসত কাহাররা, সে সেটুকু খেত। ওই দহের শিমুলগাছতলায় বসে সে দেখত ঝাকবন্দি টিয়াপাখির খেলা—লেজ নাচিয়ে তারা উড়ত, রাঙা ঠোঁটে বয়ে আনত ধানের শিষ, কত দিন লড়াই করত তারা ছানাআক্রমণকারী সাপের সঙ্গে। করালী সাহায্য করত টিয়াপাখিদের, সে ঢিল ছুঁড়ে মারত, সাপটাকে বিব্রত করত। দু-একটা সাপকে ঢেলা মেরে নিচে ফেলে দিয়েছে। হঠাৎ এক সময় খেলার নেশা ছুটত, তখন সে আবার মাকে খুঁজত। ক্রমে বয়স বাড়ল, মায়ের ইতিহাসের লজ্জা তাকে স্পর্শ করল, তখন মাকে খোঁজা ছাড়লে সে। তখন একদিন-বার বছর বয়স হতেই বনওয়ারী তাকে রাখালি কর্মে ঢুকিয়ে দিলে ঘোষ মহাশয়দের বাড়ি। গরু চরাত, গোবর কুড়াত, ফাইফরমাশ খাটত। মধ্যে মধ্যে মেজ ঘোষকে ইস্টিশানে গাড়িতে চড়িয়ে দিলে প্রতিবারেই মেজ ঘোষ তাকে একটি করে আনি দিত।
 
করালীর ভারি ভাল লাগত মাইতো অর্থাৎ মেজ ঘোষকে, ভয়ও লগত তেমনই। এমন যার বাক্স বিছানা, এন যার সাজপোশাক, যে লোক এমন করে অবহেলায় ফেলে দিতে পারে একটা আনি, যে তোক রেলগাড়িতে চড়ে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায়, তাকে কাহারদের যত ভাল লাগে, তত ভয় লাগে। হঠাৎ একদিন এই ভাল লাগাটা বিষ হয়ে উঠল।

ঘোষ তাকে জুতোর বাড়ি মারলেন। ঘাড়ে ধরে তার মাথাটা নুইয়ে ধরলে বনওয়ারী, আর মেজ ঘোষ মারলেন পিঠে চটাচট চটিজুতোর পাটি। ব্যাপারটা ঘটেছিল এই। মেজ ঘোষের এক। খদ্দের পাঠিয়েছিল এক ঝুড়ি খাস আম। সেই আমের ঝুড়ি করালী আনতে গিয়েছিল চন্ননপুর ইস্টিশান থেকে। মাস্টার মশায়ের মত এমন ভাল লোক আর হয় না। এত জিনিস আসে ইস্টিশানে, রাজ্যের সামগ্রী; সব মাস্টারই তার থেকে কিছু কিছু নিয়ে থাকে। কিন্তু সে মাস্টার কখনও কারুর জিনিসে হাত দিতেন না। শুধু মালের রসিদপিছু তার যে পার্বণীটি পাওনা সেইটেই নিতেন। ঘোষের আমের ঝুড়ি বেশ করে চট দিয়ে মুড়ে সেলাই করাই ছিল। কিন্তু উৎকৃষ্ট জাতের ল্যাংড়া আমের সুগন্ধে মালের ঘরখানা একেবারে মউ মউ করছিল। ঢুকলেই সে গন্ধে মানুষের নাক থেকে বুক পর্যন্ত ভরে উঠেছিল, জিভের তলা থেকে জল বেরিয়ে মুখটাকে সপপে সরস করে তুলছিল। মাস্টারের একটি ছোট মেয়ে সেই গন্ধে লুব্ধ হয়ে আম খাওয়ার জন্য বায়না ধরে শেষ পর্যন্ত কান্না জুড়ে দিয়েছিল। মাস্টার তবু একটি আমও বার করে নেন নি। কিন্তু করালী থাকতে পারে নি। সে নিজে দুটি আম বার করে মেয়েটির হাতে দিয়েছিল। বলেছিল—আমার মুনিব তেমন লয়, মাস্টার মশায়। তারপর ইস্টিশান থেকে বেরিয়ে আসতেই জমাদার ধরেছিল করালীকে। সে দুটো আম না নিয়ে ছাড়লে না। শুধু ছাড়লে না নয়, পকেট থেকে ছুরি বার করে একটা আম কেটে খেয়ে আমের প্রশংসায় শতমুখ হয়ে এক চাকা আম করালীকে আস্বাদন করিয়ে তবে ছাড়লে। তাই তার অপরাধ। চারটে আম কম-বেশিতে ঘোষ। করালীকে ধরতে পারত না, ধরলে করালীর হাতের ও মুখের গন্ধ থেকে। আমের ঝুড়িটা মেজ ঘোষই ধরে তার মাথা থেকে নামাচ্ছিল। নামিয়েই সে করালীর ডান হাতখানা খপ করে ধরে নাকের কাছে টেনে নিয়ে কলে, তারপর বনওয়ারীকে ডেকে বললে মুখটা শোক তো বনওয়ারী। হারামজাদা ঝুড়ি থেকে আম বের করে খেয়েছে পথে। বনওয়ারী লজ্জায় মাথা হেঁট করে রইল প্রথমটা। এ লজ্জা সে রাখবে কোথায়? করালী তার জাত-জ্ঞাতের ছেলে, সেই তাকে এনে এ বাড়িতে চাকরি করে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, যে পাড়ার সে মাতব্বর, সে-ই পাড়ার ছেলে করালী। প্রজার পাপ জমিদার-রাজাকে অর্সায়, সেই জন্যই তো জমিদার-রাজার প্রজাকে শাসনের অধিকার। সমাজের পাপ মণ্ডলকে মাতব্বরকে অসায়, সেই জন্যই মণ্ডল মাতব্বরের কাজ হল—অধর্মের পথে পুরুষ-মেয়েকে যেতে নেবারণ করা। ছিছিছি। দেবতা আছেন, ব্রাহ্মণ আছেন, বাড়ির মালিক আছেন—তারা তোর মনিব, তারা খেয়ে তবে না তোকে প্রসাদ দেবেন। বনওয়ারীর ইচ্ছা হয়েছিল, একটা লোহার শিক আগুনে পুড়িয়ে তার। জিভে হেঁকা দেয়। কিন্তু মেজ ঘোষ নিজেই তাকে সাজা দিলেন। তাকে বললেন—ধ, বেটার ঘাড় ধরে মাটিতে মাথাটা নুইয়ে ধর। তাই ধরলে বনওয়ারী। মেজ ঘোষ নিজেই পায়ের চটি খুলে পেচণ্ড পেহার দিলেন। এবং কালীকে তাড়িয়ে দিলেন মেজবাবু। মাইনে কিছু পাওনা। ছিল, সেও দিলেন না। কথাটা কানে গিয়েছিল স্টেশন মাস্টারের। তিনি লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে গেলেন, এবং তিনিই করালীকে ডেকে দিলেন ইস্টিশানের গুদামে কুলির কাজ। কিন্তু ছোট স্টেশনে এ কাজে উপাৰ্জন নাই। কায়ক্লেশে একটা লোকের পেট চলে। তাই লাইন-ইন্সপেক্টরকে বলে শেষে ঢুকিয়ে দিলেন কুলি-গ্যাঙের মধ্যে। সেই জন্যই-না করালী আজ এই করালী, এবং এই সবের জন্যই সে অন্য দশজনের মত বনওয়ারীকে খাতির করতে চায় না এবং ঘোষ বাড়ির ছায়াও মাড়াতে চায় না। হোক না কেন এসব অনেক দিনের কথা, এবং দশে বিচার করে বলুক-না কেন অন্যায় তারই, তবু করালী সে কথা ভুলতেও পারে না, এবং অন্যায় তার বলে মানতেও পারে না।


মেজ ঘোষকে দেখে করালীর চোখ দুটো জ্বলে উঠল প্রথমে; কিন্তু পরক্ষণেই মনটা নেচে উঠল। বনওয়ারী তার ঘাড় ধরেছিল, মেজ ঘোষ তাকে মেরেছিল। আজ বনওয়ারী তাকে তারিফ করছে, মেজবাবু এসেছে তার মারা সাপটা দেখতে। মেজ ঘোষ কি বলে, কি রকম ভাবে তার দিকে চেয়ে থাকে প্ৰশংসা-ভরা দৃষ্টিতে, সে আজ তা একবার দেখবে।
 
উঠানে নেমে সে সত্যই বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল। ঘোষ দাঁড়িয়ে ছিলেন সাপটার কাছেই। বনওয়ারী সামনের ভিড় সরিয়ে এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করলে। করালী কিন্তু এগিয়েও এল না, প্ৰণামও করলে না। সে লটবরের সঙ্গে কি একটা কথা নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিলে। বনওয়ারী বারকয়েক চোখের ইশারায় তাকে এগিয়ে এসে ঘোষ মহাশয়ের চরণে দণ্ডবৎ করতে ইঙ্গিত করলে। করালী দেখলে, কিন্তু দেখেও যেন দেখতে পেলে না, এই ভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। কান কিন্তু তার খুব সজাগ ছিল, কে কি বলছে, তার প্রতিটি কথা সে শুনছিল। অধীরভাবে প্রতীক্ষা করছিল মেজ ঘোষের মুখে কি কথা বার হয়—সেইটুকু শুনবার জন্য। সকলেই খুব বিস্ময় প্রকাশ করলে, করালীর বীরত্বের তারিফ করলে। কিন্তু কিছুক্ষণ দেখেশুনে একটু হেসে মেজ ঘোষ বললেন, নাঃ, খুব বড় না। এর চেয়ে অনেক বড় পাহাড়ে চিতি চিড়িয়াখানাতেই আছে। আসামের জঙ্গলে তো কথাই নাই। সেখানে এত বড় সাপ আছে যে, বাঘের সঙ্গে লড়াই হলে বাঘ মেরে ফেলে। রেললাইনের উপর যদি কোনো ট্রেন যাবার সময় পড়ে তো ট্রেন আটকে যায়।


বনওয়ারী সায় দিলে কথাটায়, বললে—আজ্ঞে হ্যাঁ। মাঝারি সাপ।


করালী এবার উদ্ধতভাবেই এগিয়ে এল। সাপটাকে এখনই এখান থেকে তুলে নিয়ে যাবে সে। নিয়ে যাবে চন্ননপুর স্টেশনে, সেখানে বাবুদের দেখাবে, সায়েবকে দেখাবে। তাদের কাছে ঘোষের দাম কানাকড়ি। জাঙলের একজন ভদ্রলোকের ছেলে বললে—কিন্তু এ তো পাহাড়ের চিতি নয়-এ হল চন্দ্রবোড়া। চন্দ্রবোড়া এত বড় কিন্তু কেউ কখনও দেখে নি। আর সাপও ভীষণ সাপ।

ঘোষ একটু হেসে বললেন–জাত ওই একই হে, চিতির জাত। তারপর করালীর দিকে চেয়ে দেখে বললেন, জোয়ান তো হয়েছিস বেশ। বুদ্ধিরও একটু ধার আছে মনে হচ্ছে। কি করিস এখন?

করালী বেশ মাথা উঁচু করে গম্ভীরভাবেই জবাব দিতে চেষ্টা করলে, অ্যাললাইনে কুলিগ্যাঙে কাজ করি। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, গম্ভীর আওয়াজ তার গলা দিয়ে একেবারেই বার হল না। উত্তর দিতে গিয়ে বার দুই ঢোক গিলে সে চুপ করে রইল। বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগল। উত্তর দিলে বনওয়ারী, বললে—এ এখন অ্যাললাইনের কুলি খাটে।

—ও, আচ্ছা! তা হলে তো অনেক দূর এগিয়েছিস রে! আর কি করছিস? রাত্রে চুরি? যে রকম শরীরটা বেঁধেছে আর বুদ্ধিতে যেমন বড়শির বাঁকা ধার, তাতে তো ও-বিদ্যেটায় পণ্ডিত হতে পারবি।

করালীর শরীরটা ঝিমঝিম করতে লাগল। মাথা হেঁট করে রইল সে। কথা বলার ভঙ্গিই এমন মেজ ঘোষের যে, সকলেই মুখ টিপে হাসতে লাগল। বনওয়ারী হেসে বললে—আজ্ঞে না, চুরি-চুরি করে না। সেসব আমার আমলে হবার যো নাই কাহারপাড়ায়। সে যিনি করবেন, তাকে গা থেকে উঠে যেতে হবে। তবে করালী বজ্জাত খুব। যত বজ্জাত, তত ফিচলেমি বুদ্ধি।

মেজ ঘোষ হাসতে হাসতে বললেন—তা হলে চোর হওয়া ওর অনিবার্য। যদি চোর না হয় তবে পয়লা নম্বরের লোচ্চা হবে—এ আমি বলে দিলাম বনওয়ারী। তারপর পকেট থেকে চামড়ার বাহারে মনিব্যাগ বার করে একটা সিকি ছুঁড়ে দিয়ে বললেননে।

সঙ্গে সঙ্গে মেজ ঘোষ সমস্ত লোকের কাছে আশ্চর্য রকমের সম্ভ্রান্ত হয়ে উঠলেন। তারপর বললেন—উঠিয়ে নিয়ে যা ওটা। গন্ধ উঠেছে এর মধ্যে। সকলেই জোরে জোরে নিশ্বাস টানতে লাগল কথাটা শুনে। গন্ধ উঠছে নাকি? গন্ধ? বনওয়ারীও নিশ্বাস টানলে জোরে জোরে। করালী একটা রুদ্ধ অথবা ক্ষুব্ধ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেও সিকিটাকে উপেক্ষা করলে না, সিকিটা নিয়ে কোঁচড়ে গুঁজে সঙ্গীদের বললে—লে, তো। নিয়ে যাব চন্ননপুর ইস্টিশান। তোল্‌।

আজ এই মুহূর্তটিতে আবার করালীর আক্ষেপ হল নসুদিদি নাই, সে থাকলে জবাব দিতে পারত ঘোষকে। সে থাকলে কোমরে কাপড় বেঁধে মেজ ঘোষকে দেখে মাথায় একটু ঘোমটা দিয়েও ঘোষের কথার উত্তর না দিয়ে ছাড় না।

ঘোষ বললে–না, খুব বড় না।

নসু সঙ্গে সঙ্গে গালে হাত দিয়ে জবাব দিত—হেই মাগো! বড় তবে আর কাকে বলে। মাশায়?

ঘোষ বললে আসাম না কোথাকার জঙ্গলে পাহাড়ে চিতির কথা।

নসু হাত নেড়ে বলে উঠত-গোখুরা কোথা পাব বাবা? আমাদের এই হেলেই গোখুরা। আসাম না বেলাত কোথাকার কথা বলছেন, সেথাকার রজগর সেথাকেই থাকুক। আমাদের এই রজগর, ওই আমাদের খুব বড়; লঙ্কায় বলে সোনা সস্তা, সেখানকার নোকের সব্বঅঙ্গে সোনা, আমাদের দ্যাশে কাচের চুড়ি, রুপদস্তার চুড়িই সোনার চুড়ি।

আরও কত ছড়াকাটত। করালীর বারবার মনে হল নসুবালার কথা। আর আজ নসুদিদি। থাকলে বড় ভাল হত! এতবড় একটা কীৰ্তির গৌরব-উৎসাহ স্নান করে দিল মেজ ঘোষ। ঘোষ চোখের অন্তরাল হতে তবে তার সাহস খানিকটা ফিরে এল। সে মাথলাকে ধমক দিয়ে বললে–কি রে, কানে কথা যায় না, লয়? লে, তেল। সাপটাকে বয়ে নিয়ে যাবার বাঁশের একদিকে কাঁধ দিয়েছিল মাথলা, অন্যদিকে লটা অর্থাৎ নটা, মানে নটবর।




ঘোষ বাড়ি থেকে চলে গেলে কেঁচড় থেকে সিকিটা বার করে করালী বললে—দেখ দিনি রেসিকিটা আবার চলবে তো? মেকি-ফেকি লয় তো? মাথলা এবং নটবর সাপটাকে বশে ঝুলিয়ে বয়ে নিয়ে যাবে, তাদেরই বললে সে। তারা কেউ বলবার আগেই এগিয়ে এল নিমতেলে। পানু। বললে—কই, দে দেখি!

দেখে বললে–না, চলবে। ভালই বটে। তা ছাড়া মাইতো ঘোষ মশায়ের বেগের সিকি। নতুন চকচকে ছাড়া রাখেই না তিনি টাকা-পয়সা।

করালী বললে—হুঁ।

পানু বললে—আমাকে সেবার পয়সা দেবার তরে বেগটা ঢাললে তক্তপোশের ওপর। একেবারে সোনার পয়সার মত চকচকে লালবন্ন পয়সা—সে এই এত।

পানুও তাদের সঙ্গ নিলে বেহায়ার মত, সেও যাবে চন্ননপুর ওদের সঙ্গে। চন্ননপুরে যে অনেক পয়সা মিলবে তাতে সন্দেহ নাই। করালী তাতে আপত্তি করে নাই। আসুক বেটা ছুঁচো। পানুই দিলে একটা কাঁধ। অজগর চললেন চন্ননপুর।

কয়েক মুহূর্ত পরেই হঠাৎ করালী দূরে দাঁড়িয়ে পানুর গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলে আচমকা—শালা, কানার মত চলছ যে বড়? কানার মত চলছে যে? পায়ে পায়ে টক্কর দিলি যে বড়? আমাদের আর চোখে দেখতে পাও না, লয়? শালো! সোনার পয়সার মত চকচকে। লালবন্ন। শালে, যাও না কেনে, সেইখানে যাও না। আমার সাথে কি বটে তোমার?

মাথলা বললে—ঠিক বলেছে করালী। আজ আমাদের সাথে কি বটে হে তোমারঃ মুরুদ্ধির কাছে তো সাতখান করে লাগাও তুমি। আজ কি বটে আমাদের সাথে?

নটবর তাকে সাবধান করে দিলে—আই, চুপ কর। মুরুদ্ধি আসছে কি না দেখ্‌ আবার।

ওদের দুজনের ঘাড় ফেরাবার উপায় ছিল না, একে আলপথ, তার উপর কাধে সাপ ঝুলানো বাঁশ।

মাথলা তবু ঘাড় ফিরিয়ে দেখে বললে–না। কই? আসে নাই সে।

করালী বললে তার বিদ্যাসম্মত হিন্দিতে সে আসেঙ্গা সে আসেঙ্গা, হাম কেয়ার করতা নেহি হ্যায়। হুঁ। তারপর হঠাৎ বললে—কাহারদের ছেলে পালকি বওয়ার হক ধ না কেনে শালোরা। হাক ধৰ্ব কেনে। কথাটা ভারি মনে লাগল মাথলাদের। মরা সাপটাকে পালকির আরোহী ধরে নিয়ে তারা হাত দুলিয়ে হাঁক ধরলে—প্লো হিঁ–প্লো হিঁ। হঠাৎ পিছন থেকে বনওয়ারীর মোটা গলার হক তারা শুনতে পেলে, দাঁড়া—দাঁড়া। এই! দাঁড়া। থেমে গেল সকলে। থেমে যেতে হল। পা আর উঠল না। শুধু করালী উঠল অধীর হয়ে। এ কি কাণ্ড! এ কি জুলুম!

বনওয়ারীর মুখটা হয়ে উঠেছে হাঁড়ির মত। সে এসে দাঁড়াল। বললে—ফিরে আয়।

—ফিরব? কেনে?

–দাহ করতে হবে।

—সে তো আত্তে করব বলেছি।

–না। এখুনি হবে দাহ। গোটা কাহারপাড়াকে চান করতে হবে। তারপর হঠাৎ আক্ষেপভরা আক্রোশভরা কণ্ঠে সে বলে উঠল, তুই গাঁয়ের সর্বনাশ করবি রে—তুই সব অনত্থের মূল।

করালী স্তম্ভিত হয়ে গেল।

বনওয়ারী একটা দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেললে। বললে—ফিরে আয়। যা করেছি, তার পিতিবিধেন করতে হবে।

করালী বললে–না। ওঠা রে সব, ওঠা।

কিন্তু কেউ ওঠাতে সাহস করে না। দাঁড়িয়ে রইল মাটির পুতুলের মত।

করালী আবার বললে—শুনছিস? ওঠা!

কেউ যেন শুনতেই পাচ্ছে না। বনওয়ারী বললে—মুখ দিয়ে অক্ত উঠে যদি মরতে না চাস তবে ফেরা।

এবার সাপ উঠল। চলল সকলে সাপ কাঁধে করে বাঁশবাঁদিতে ফিরে। ফিরল না শুধু করালী। সে হনহন করে চলতে শুরু করলে চন্ননপুরের দিকে।

বনওয়ারী ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ফিরল।

কাহারপাড়ার আদ্যিকালের যত বিধান সুচাঁদের কাছে। সেই বিধানই চিরদিন বলবতী হয়েছে এখানে, আজও হল।
 
মেজ ঘোষকে বিদায় করে বনওয়ারী বাড়ি ফিরে দেখলে, সুচাঁদ বসে আছে। সুচাঁদ পাখীর সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছে। পাখীকে বলে এসেছে—এ বাড়িতে যদি আর ফিরি, তোর মায়ের গতরের ওজগারের রন যদি খাই, তবে আমার জাত নাই, আমি বেজাত। আমি বনওয়ারীর বাড়িতে থাকব।

বনওয়ারী সম্মান করতে জানে। সে বললে—বেশ তো পিসি। ছেলেকালে অ্যানেক দোগ্ধ তুমি দিয়েছ আমাকে। তুমি থাকবে সে তো ভাগ্যি আমার গো। কি, হল কি?

সুচাঁদ সবিস্তারে সমস্ত বর্ণনা করে বললে বনওয়ারী, উনি যদি কত্তার বাহন না হন, কিমা-মনসার বেটী না হন, তো আমি কি বলেছি।

বনওয়ারীর-কাহারপাড়ার মাতব্বরের দৃষ্টি যেন এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল, এবার জেগে উঠল। খুশিও হল সে। অত্যন্ত খুশি হল। মনের মধ্যে সাপ মারার সেই স্মৃতির বেদনা যেন ঘন হয়ে। উঠছে। সে পিসির পায়ের ধুলে নিলে।

পিসি আশীৰ্বাদ করলে—ছেরায়ু হ বাবা। আমার মাথার চুলের মতন তোর পেরমাই হোক। তারপর কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে বললে—আহা, আগুনে দগুধে গিয়েছেন মা আমার, তবু কি বনের বাহার, কি গড়ন! আঃ! সর্বনাশ করে দিলে বাবা!

বনওয়ারীর মন সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবিধানের জন্যই বেশি আগ্ৰহান্বিত হয়ে উঠেছে। প্রতিবিধান-বাবাঠাকুরের পূজা। মদে-মাংসে ঢাকে-ঢোলে আতপে-চিনিতে বস্ত্ৰে-সিঁদুরে পূজা। সকল কর্মের উপর হল তার মাতব্বরির দায়িত্ব, গ্রমের ভাল আগে দেখতে হবে তাকে। হে বাবা কর্তা! গ্রামের মঙ্গল কর তুমি। সাজা দিতে হয়, যে দোষ করেছে তাকে দাও। করালীকে কিন্তু শাসন করা দরকার হয়েছে। বড়ই বৃদ্ধি হয়েছে। জোয়ান বয়সের রক্তের তেজ। হঠাৎ ক্রোধে ফুলে উঠল বনওয়ারী। আজও ওই ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন বাঁশবনের মধ্যে। আফসোসের সঙ্গে মনে করতে চেষ্টা করলে বনওয়ারী, বাঁশপাতার উপর অসাবধানে কেমন করে তার পা পিছলে গিয়েছিল। কিন্তু তবুও সে তার অপমান। সে তার পরম লজ্জার কথা।

বনওয়ারী মাতব্বর কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করলে বাবাঠাকুরকে। উপরের দিকে চাইলে একবার। তারপর মনে মনে মানত করলে ঠাকুরকে—হে ঠাকুর, পুজো দেবার কথা তো হয়েই আছে। আবারও মানত করছি—এর জন্যে একটি নতুন পাঁঠা দেব আমি। তুমি কাহারদের রক্ষা কর।

সুচাঁদ প্রশ্ন করলে—কি করছিস তা বল্‌?

বনওয়ারী বললে—এর তরে আমি পুজো দেব পিসি, আলাদা পাঁঠা মানত করছি।

—কি করছিস? আরও একটা পাঠা? স্থির দৃষ্টিতে বনওয়ারীর মুখের দিকে চেয়ে সুচাঁদ প্রশ্নচ্ছলে কথাটার পুনরুক্তি করলে।

বনওয়ারী আবার বুঝিয়ে বললো, হ্যাঁ, মানত করছি—মানত।

মানত?

–হ্যাঁ। দুটো পাঁঠা দিয়ে কত্তার পুজো দোব।

আঙুল দেখিয়ে সুচাঁদ বললে—দুটো পাঁঠা দিবি?

–হ্যাঁ।

–বেশ বেশ। কিন্তুক, অ্যানেক কল্যেণ করতেন উনি বাবা-ওই উনি। আঃ, কি শিস! বনওয়ারী বললে—দাহ হবে বাবার বাহনের। কাহারপাড়ার সবাইকে চান করতে হবে। বলে দাও সব। আমি চললাম ডাকতে। সে ছুটল।

কোপাইয়ের তীরে চিতা সাজিয়ে দাহ হল বাবার বাহনের। গোটা কাহারপাড়া চান করে ফিরল। বনওয়ারী প্রণাম করে এল বাবার থানে।–হে বাবা! রক্ষা কর বাবা। পাষণ্ডকে দলন কর বাবা। কাহারদের মালিক, কাহারদের রক্ষা কর।
 
ড্যাং-ডাং-ডাং-ড্যাডাং-ড্যাডাং-এর্‌-র্‌-র্‌-র্‌-র্‌-র্‌-র্‌–ড্যাং-ডাং-ড্যাডং-ডাং-

বাবাঠাকুরতলায় ভোরবেলায় ঝুঁজকি থাকতে অর্থাৎ অন্ধকার থাকতেই ঢাকী ভোরের বাজনা ধুমুল বাজাতে শুরু করলে। রবিবার অমাবস্যা ক্ষণ মিলেছে ভাল, বাবাঠাকুরের পুজো হবে। ফুলে বেলপাতায়, তেলে সিঁদুরে, ধূপে প্রদীপে, আতপে চিনিতে, দুধে রম্ভায়, মদে মাংসে, কাপড়ে দক্ষিণায়সমারোহ করে পুজো।

ঢাক বাজবার আগেই ওঠে কাহারপাড়া—মেয়ে পুরুষে। ঘুমিয়ে থাকে শুধু ছেলেরা। তারাও আজ উঠে পড়ল। কলরব করে তারা যেতে চায় বাবাঠাকুরের থানে। সুচাঁদ চোখ বড়। বড় করে বললে—খবরদার, এ তো বছরশালি পুজো নয়,-আমোদ নেই এতে। অপরাধের। পুজো, একেই বাবা মুখ ভার করে আছেন, তারপর ছেলেরা যাবে, চেঁচামেচি করবে, ল্যাই কলহ। করবে, ধুলো ছিটোবে, অবলার জাত—নোংরা ময়লা করবে অপরাধের ওপর অপ্রাধ হবে। খবরদার! আগে পাঁঠা দুটি নিব্বঘ্নে কাটা হোক, বাবাঠাকুর পুজো লেন হাসিমুখে; তারপর নাচন-কোদন, গান-বাজনা, মাল-মাতালি—সব হবে।


বনওয়ারী পাড়ায় পাড়ায় বলে এলসবোধান, সব সাবোধান! করালীর অপরাধের সাজা গোটা পাড়াকে ভুগতে হচ্ছে বাবা সকল; আর অপরাধ বাড়িয়ো না। অনেক মাসুল লাগল। আর না।

প্ৰহ্লাদ বললে—সোজা খরচ!

বনওয়ারী খরচ করছে, পানু মনে করে হিসেব রাখছে। এসবে নিমতেলে ছোকরা খুব লায়েক। দেহখানিওরা বলে, সরিঙ্গী অর্থাৎ কাঠির মত; কিন্তু মাথা নাকি খুব। মনে রাখতে পারে খুব। পানু মুখে মুখে হিসেব দিলে—খরচ তোমার অনেক। লগদ তিন টাকা বার আনার ওপর দু পয়সা।

এর উপরে আরও খরচ আছে, ঘর থেকে দ্রব্যসামগ্রী দেওয়া হয়েছে, তার দামই বেশি। দুটো পঁঠা, একটা ভেড়া, বারটা হাঁস, দশবার সের চালও দিতে হয়েছে—বায়েন কর্মপ্রকার পুরোহিত মহাশয়দের সিধার জন্য। এ সবের দাম অনেক। সকালবেলা থেকে তিন প্রহর বেলা পর্যন্ত মজুরি খেটে যারা পাঁচ আনা রোজ পায় অর্থাৎ মাসিক ন টাকা ছ আনা মাত্র যাদের আয়, তাদের কাছে অনেক বৈকি! সুতরাং কাহারদের জীবনে এ একটা সমারোহ এবং রোমাঞ্চকরও বটে।


রোমাঞ্চটা আরও প্রবল হয়ে উঠল বাবাঠাকুরের থান পরিষ্কারের সময়। সেয়াকুলের ঝোপ কাটবার সময়, ওই ঝোপগুলির ভিতরের উইঢিপি থেকে বেরিয়ে পড়ল তিন-তিনটে আলকেউটে। কেউটেকে ওরা খুব ভয় করে না। কোপাইয়ের তীরে, জাঙলের মাঠে আল-কেউটের বাস চিরকাল। ওদের সঙ্গেই একরকম বাসই করে কাহারেরা। কেউটেরাও ওদের মধ্যে মধ্যে তাড়া করে, ওরাও কেউটেদের তাড়া করে পাঁচন-লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে। তবে জাতসাপ নাকি ব্রাহ্মণ, ওদের মেরে তাই সম্মান করে আগুনে ডাহ অর্থাৎ দাহ করে। বাবাঠাকুরের থানে কেউটের কিন্তু অন্য অর্থ হল। বিশেষ করে এই অজগরতুল্য চন্দ্রবোড়াটিকে বাবার বিচিত্রবর্ণ বাহন বলে জানার পর, এই কেউটেগুলিকে তার সঙ্গী-সাথী না ভেবে পারলে না বনওয়ারী। সে বললে-খবরদার! হাত দিয়ো না গায়ে।-বলে নিজেই সে হাত জোড় করে। প্ৰণাম করলে। সাপ তখন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ফোঁসাচ্ছে। মধ্যে মধ্যে মাটিতে ছোবল মারছে। কিন্তু এগিয়ে আসতে তাদেরও সাহস নাই। বেদে জাতের গায়ের গন্ধে সাপ তাদের বেদে বলে। জানতে পারে, ভয় পেয়ে ছুটে পালায়; কাহারদের গায়ের গন্ধে ওরা তেমনিই বোধহয় ভয় পায়, এগিয়ে আসতে চায় না সহজে।


বনওয়ারী সাপদের বললে—যা যা, যা বাবারা, চলে যা। খানিকটা সরে যা। লরে-লাগে অর্থাৎ নরে-নাগে বাস করতে নাই, এখন তোরা সরে যা। তোমাদের প্রভু, আমাদের বাবাঠাকুর, তার পুজোটি সেরে লি, তাপরেতে তোমরা আবার স্বস্থানে পরমেশ্বরী হয়ো না কেনে!


সাপগুলো সরেই গেছে। কাহারেরাও সাবধান হয়ে রইল। কি জানি, হোক না কেন বাবাঠাকুরের বাহনের সঙ্গী-সাথী, তবু ও জাতকে বিশ্বাস নাই।

তবে ওই যে ঢাকের শব্দড্যাডাং-ড্যাডাং, ওতেই ওরা সরে যাবে অনেক দূর। তার উপর ধূপ-ধুনো, অনেক মানুষের আনাগোনা।


নগদ খরচের মধ্যে পুরুত মহাশয় নিলেন আট আনা; কাপড় একখানা সাত হাত-দাম পাঁচ। সিকে জোড়া হিসেবে দশ আনা; পাকী কারণ সওয়া পাঁচ আনা; বাতাসা কদমা মণ্ডা ও অন্যান্য জিনিস,বনওয়ারীরা এক্ষেত্রে জিনিসকে বলে দব্যতার দাম সওয়া পাঁচ আনা; বলিদানের ছেত্তাদার ছ আনা; দেড় গোলা মদ আঠার আনা, এবং ঢাকী নিয়েছে চার আনা, বাকি চার আনায় তেল সিঁদুর ধূপ ধুনো ধুনুচি প্রদীপ ইত্যাদি। ছাগলের দুটো মুড়ির একটা নিয়েছে পুরুত, একটা ছেত্তাদার, ঢাকী নিয়েছে ভেড়ার মাথাটা। কাপড়খানা পুরুত নিয়েছে। সকলেই খুশি হয়ে গিয়েছে, বলে গিয়েছে পুজো নিখুঁত হল মুরুদ্ধি। শুধু একদিন দেরি হয়ে গেল এই যা! শনিবারটা পাওয়া গেল না। তা হোক। পুরুত বললেন—রবিবার অমাবস্যে—খুব ভাল। অমাবস্যে রবিবার, মৎস্য খাবে তিনবার। কত্তা খুশি হয়ে মদ-মাংস খাবেন।


তা বাবাঠাকুর খুশি হয়ে পেসন্ন মনে দু হাত ভরে মদ-মাংসের পুজো নিলেন। বলিদানে একটু খুঁত হল না। তিন প্রহরের সময় বলিদানের ঢাক বাজল–ড্যাং-ডাং-ডাং-ডেনাক–ড্যাডাং-লাগ-ডাং-ড্যাং-ড্যানা–


কাহারদের মাতব্বরেরা তখন বাবার পেসাদী কারণের প্রসাদ নিয়ে ছ—উপোসকরা পেটে অল্প কারণেই বেশ জমিয়ে তুলেছে; মাথা ঝিমঝিম করছে। তারা সব জোড়হাত করে দাঁড়াল। সুচাঁদ রাঙা আঁটির মত চোখ বিস্ফারিত করে চেয়ে চেঁচাতে লাগল,—হে মাহে মা হে মা!

ছেলেরা মুখে বাজনার বোল বলতে লাগল-খা-জিংজিং জিনাক জিজিং লাগ জিং জিং জিনা

বলির সঙ্গেই পূজা শেষ। দেখতে দেখতে বলি হয়ে গেল নিখুঁত বলি। হাঁসগুলোকে কেটে উড়িয়ে দিলে। হাঁসগুলোকে কেটে ধড়টাকে ছুঁড়ে দিলে। তারা খানিকটা উড়ে গিয়ে পড়ল।

পানুর পাঁঠা তো ছিলই, বনওয়ারী নিজে একটা পাঁঠা দিয়েছে। রতন দিয়েছে ভেড়াটা। বনওয়ারী দিলে ওই সাপটিকে মারার অপরাধের জরিমানা করালী করলে পাপ, সে করলে প্ৰায়শ্চিত্ত। না করলে কে করবে? করালীর যা হবে হোক, কিন্তু পাড়ার মঙ্গল, গায়ের মঙ্গল তাকেই দেখতে হবে যে। সমস্ত পাড়ার লোক বনওয়ারীকে এর জন্য প্রাণ খুলে ধন্যবাদ দিয়েছে। রতন ভেড়াটি দিয়েছে নিজের অবাধ্য সন্তানের জন্য লটা করালীর সঙ্গী, সেই হতভাগাই বাশে ঝুলিয়ে ওই অলৌকিক সাপটিকে বয়ে নিয়ে গিয়েছে। সুচাঁদ দিয়েছে একটি হাঁস। নিছক ভক্তির বশবর্তী হয়েই সে দিয়েছে। বসন্তও দুটি হাঁস দিয়েছে, ডাইনে বায়ে বলি দেবার মত দু পাশে দুটো হাড়কাঠ ছিল না—তবু ওই মানসেই সে দুটি হস দিয়েছে। পাখী করালীকে সমর্থন করে। বসন্তের গোপন মানত ছিল একটি হাঁস পাখীর জন্য, অন্যটি করালীর জন্য। একটি পাঠিয়েছে কালোশশী—গোপনে পাঠিয়েছে। এ পুজোয় আটপৌরে-পাড়ার সকলে যোগ দিলেও পরম মাতে নাই এতে। বনওয়ারীর সঙ্গে তার সৌহার্দ্য নাই। বনওয়ারী মাতব্বর হয়ে যা করে, তাতে পরম যোগ দিতে দেয় না আটপৌরেদের। এক্ষেত্রে আটপৌরেরা পরমের কথা মানে নাই। কিন্তু পরম যোগ দেয় নাই। তবে নিজের পাড়ার লোকেরা যখন তার কথা না শুনেও যোগ দিলে, তখন নেহাত পাড়ার মাতব্বরি করতে উপস্থিত হয়েছিল মাত্র। বাকি আটটা হাঁস আর আট ঘর থেকে এসেছে। যার হাঁস ছিল, সে না-দেওয়া হয় নাই। যার নাই, সে কি করবে? কত্তাকে পুজো দিতে সাধ কার না হয়, প্রসাদ পাওয়ার ভাগ্য কে চায় না? সকল বাড়ি থেকেই মণ্ডা বাতাসা পাঁচ পয়সা হিসেবে দিয়েছে। এ ছাড়া মদ। ঘোষ মহাশয় তিন গোলার দাম দিয়েছিলেন, কিন্তু বনওয়ারী দেড় গোলার বেশি কেনে নাই। দেড় গোলা কিনে তারই আবরণে ভেণ্ডরকে ফাঁকি দিয়ে গ্রামেই তারা আরও তিন গোলা মদ নিজেরাই করে নিয়েছে। পুজো হয়ে গেল। এইবার নিশ্চিন্ত। চল সব, চল, বাবাঠাকুরের বাতাসা পেসাদ লাও, জল খাও, রান্নাবান্না কর। জয় বাবাঠাকুর! হে ভগবান, মঙ্গল কর তুমি।


হঠাৎ ভিড় ঠেলে এসে দাঁড়ালে করালী। তার হাতে তিনটে হাঁস। পিছনে নসুবালা আর পাখী।

–মাতব্বর, আমি তিনটে হাঁস বলিদান দোব।
 
বনওয়ারী দুঃসহ ক্রোধে স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল। এ কি উৎপাত—এ কি বিঘ্ন রাগে তার মুখে কথা ফুটল না, গোটা কাহারপাড়াই স্তব্ধ হয়ে রইল। এগিয়ে এল পানু। সে তার শীর্ণ লম্বা হাতখানা লম্বা করে বাড়িয়ে রাস্তা দেখিয়ে বললে—ভাগো।

—ভাগো?—করালী প্রশ্ন করলে।

–হ্যাঁ। লিয়ে যাও তোমার হাস। তোমার বলি লেয়া হবে না।

–লেয়া হবে না?

–না।

করালী চিৎকার করে উঠল—মাতব্বর!

বনওয়ারী এগিয়ে এল এবার। বললে—চিকার কিসের? চিচ্‌কার কিসের?

—পানার মুখ ভেঙে দেব আমি। কি বলছে শুনছ?

–কি বলছে?

—আমার হাঁস লেবে না। বলি দিতে দেবে না।

–হ্যাঁ, লেবে না—আমার হুকুম।

—কেনে? লেবে না কেনে?

—না, না। লেবে না। তোমাকে নাকে খত দিতে হবে—

বাধা দিয়ে বলল করালী—নাকে খত দিতে হবে?

–হ্যাঁ। জরিমানা দিতে হবে। সকলের ছামুনে–

—থাক্, থাক্। এই করলে তবে লেবে আমার হাঁস?

–হ্যাঁ।

—নইলে লেবে না?

—না।

করালী আর কোনো কথা না বলে পট-পট করে হাঁস তিনটের মুণ্ড দু হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বললে-কত্তা, খাবে তো খাও, না খাবে তো খেয়ো না, যা মন তাই কর। আমাদের হাঁস খাওয়া নিয়ে কথা, আমাদের বলিদান হয়ে গেল।-বলে মুখে বলিদানের বাজনার বোল। আওড়াতে আওড়াতে চলে গেল—খা—জিং জিং-জেনাক পুজো

মুণ্ডগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাঁসগুলোকে নিয়ে সে চলে গেল। গোটা পাড়াটা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

শুধু বনওয়ারী হেঁকে উঠল—যাক, যেতে দাও ওকে। চল সব, বাড়ি চল, জল খাও। একবার বাবাকে ডাক। বলেই সে ডেকে উঠল, বলো, শি-বো–ধর্ম রঞ্জো।

সবাই সমবেত কণ্ঠে হেঁকে উঠল।

ঢাক বাজতে লাগল পুজো শেষের–ড্যাং-ডাং-ডাং-ডাং-ডাং-ডাং-ডাং-ড্যাং ড্যাং—লম্বা করে বাজনা। শেষ হল। পুজো শেষ।

অশুভক্ষুণে করালী, অশুভক্ষণে ওর জন্ম; এমন পুজোটিতে কেমন অস্বস্তি এনে দিলে। দিক। সে ভাববার অবকাশ নাই বনওয়ারীর। পুজো শেষ হলেই কাজ শেষ হল না। অনেক কাজ। মাতব্বরি সহজ নয়। অনেক বিবেচনা করতে হয়। অনেক ভাবতে হয়। প্রসাদ বিলি করতে হবে। মিষ্টির প্রসাদ, বলিদানের প্রসাদ, কারণের প্রসাদ। যেসব লোকের বাড়ি থেকে। হাঁস অথবা অন্য বলি যায় না, তাদের বাড়িতে দেবার জন্য প্রত্যেক বলি থেকে দুটি করে পা। কেটে নিয়ে একত্র করে কুটে তাই ভাগ করে পাঠিয়ে দাও তাদের বাড়ি বাড়ি। নিজের বলিটির আর দুটি পা ছাড়িয়ে ঘোষ মহাশয়ের বাড়ি পাঠাতে হবে। নিজেই সে চলল সে-দুটি নিয়ে। তার আগে নিজের পোশাক-পরিচ্ছদটি সে ভাল করে দেখে নিলে। বাঃ, বেশ হয়েছে। ঠিক আছে। পরনে আজ তার পরিষ্কার একখানি হাঁটু-বহরের কাপড়, তার কেঁচাটি উল্টে নিয়ে কোমরে খুঁজেছে, কাঁধে পরিষ্কার করা গামছাখানি পাট করে ঝুলিয়েছে, কপালে পরেছে সিঁদুরের। ফোঁটা। মাংস পেয়ে ঘোষ খুশি হলেন খুব, একটা সিগারেট দিলেন বনওয়ারীকে। বললেন হ্যাঁ, আজ একটা মণ্ডল মাতব্বর বলে মানাচ্ছে বটে। তা এর সঙ্গে একটা সিগারেট না হলে চলবে কেন?

বনওয়ারী সেটিকে কানে খুঁজে ভক্তিসহকারে প্রণাম করে বাড়ি ফিরল। দু বাটি মদ সে এর আগেই খেয়েছিল। একটু বেশ নির্ভয়-নির্ভয় ঠেকছিল দিন-দুনিয়া; সে বললে—আশীব্বাদ সব আপনকারদের আশীৰ্ব্বাদ। ঘোষ-বাড়ির নক্ষ্মীর এঁটোকাটায় বনওয়ারীর পিতিপুরুষের জেবন। আবেগে কেঁদে ফেললে বনওয়ারী।

সান্ত্বনা দিতে গেলে ফ্যাসাদ বাড়বে—ও অভিজ্ঞতা মেজ ঘোষের স্বােপার্জিত; ধমক দিলেও ওদের মনে বড়ই লাগে তাও অজানা নয়। সুতরাং তিনি সংক্ষেপে বললেন—সে হবে বনওয়ারী, কাল হবে সেসব কথা। ওদিকে তোমার পাড়ায় আজ অনেক কাজ। দেখো, যেন কোনো অঙ্গহীন না হয়।



বনওয়ারীকে এখন বিয়ে করতে পারলেই বাচেন ঘোষ। একে কাহার, তাতে মাতাল হয়েছে, গায়ে দুৰ্গন্ধ উঠছে। কিন্তু মাতাল বনওয়ারীর কথা সহজে শেষ হবে কেন, সে বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ। একশো বার। জ্ঞানবানের কথা। তবে বনওয়ারীর জেবন থাকতে সেটি হবেন না। খুন-খারাপি হয়ে যাবে। ওই করালীওই যে হারামজাদা বদমাশ-অক্তের ত্যাজে মেরে ফেলালে দেবতুল্য সপ্যটিকে, ওর আমি কি করি দেখেন। তাড়াবওকে আমি এখান থেকে তাড়াব।

বড় ঘোষ-বউ বললেন—বেশ বেশ, এখন বাড়ি যাও। সন্ধে হয়ে গেল, আজ পুজো দিয়েছ, কত্তার ওখানে আজ একটা পিদিম দিয়ে, ঢাকীটাকে একবার ধুমুল দিতে বোলো যেন। যাও। এখন ব্যবস্থা কর গিয়ে।

বনওয়ারী এবার তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। একটি ব্যবস্থা তার ভুল হয়ে গিয়েছে। ঠিক কথা, ওরা জ্ঞানবান লোক, অনেক বিদ্যা ওঁদের ওদরের মধ্যে আছে, এমন প্রয়োজনীয় কথা। ঠিক ওঁদের মনে পড়বেই তো! সে হাত জোড় করে বললে—আজ্ঞে আমি আজ যাই।

–হ্যাঁ, এসো—এমন ক্ষেত্রে গম্ভীর ভাব রক্ষা করতে মেজ ঘোষ অদ্বিতীয়। অন্য সকলেই অল্প অল্প হাসছিল, কিন্তু ঘোষ একেবারে গম্ভীর, যেন কোনো সম্পত্তি নিলামে ওঠার সম্পর্কে চিন্তান্বিত মুখে আলোচনা করছেন তার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীর সঙ্গে।

বনওয়ারী চলে গেল, খুব দ্রুতপদে হনহন করে চলল। প্রদীপ দিতে হবে, ঢাকীকে বলতে হবে বাবার স্থানে ধুমুল দেওয়ার জন্যে। তার হয়েছে এক মরণ। এই যে মাতব্বরি, এর চেয়ে ঝকমারির কাজ আজ আর কিছু নাই। রাজার দোষে রাজ্য নাশ, মণ্ডলের দোষে গ্রাম নাশ; প্রজার পাপে রাজ্য নষ্ট, গ্রামের পাপে মণ্ডলের মাথায় বজ্ৰপাত। হে ভগবান!

পাড়ায় এসেই হাঁকডাক শুরু করে দিলে, পিদিম—পিদিম চাই একটা। কাঁচা কাপড়ের সলতে দে। ভঁড় ঘেঁকে ত্যাল দে, অনুশালের ত্যাল দিস না যেন।

পানুকে সে পাঠালে বায়েনপাড়া। ধুমুল দিতে হবে।

প্রদীপটি নিয়ে সে দু পা এগিয়ে থমকে দাঁড়াল। বাতাস দিচ্ছে। তার স্ত্রী গোপালীবালা এগিয়ে এসে একটি টোকা অর্থাৎ চুপড়ি হাতে দিলে।

বনওয়ারী বললে—বাঃ! হ্যাঁ, এসব কাজে মেয়েদের বুদ্ধিই খেলে ভাল। ঠিক হয়েছে। প্রদীপটিকে টোকার আড়াল দিয়ে সে চলল। কত্তার থানে যেতে হলে পথে আটপৌরে-পাড়ার উত্তর প্রান্তের কঁকড়া বটগাছতলাটা পার হতে হয়। বড়ই অন্ধকার স্থান। টোকার আড়ালে প্রদীপের আলো ঢেকে গেছে। গাছতলাটা থমথম করছে। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে বনওয়ারী থমকে দাঁড়াল। কে ফেসফেঁস করে কাঁদছে যেন?—কে?—কে গা?

গাছতলায় একটা সাদা মূর্তি বসে রয়েছে। এগিয়ে গেল বনওয়ারী।

–কে? প্রদীপটার উপর থেকে টোকাটা সরিয়ে নিয়েই সে চমকে উঠল।কালোবউ? কালোশশী? এ কি? এ কি? হা, সে কালোশশীই বটে! বুকের ভিতর যেন ঢাক বেজে উঠল। অন্ধকারে এই গাছতলায় একা কালোশশী!

মনের দুঃখে ঘর ছেড়ে এসে কালোশশী কাঁদছিল। পরম তাকে বেশ ঘা কতক দিয়েছে। গোপনে সে যে হাঁসবলি পাঠিয়েছিল বনওয়ারীর কাছে, সে কথাটা পরমের কাছে গোপন থাকে নাই। কেউ বলে দেয় নাই, কিন্তু পরম নিজেই ধরে ফেলেছে। কত্তার ওখানে পরম একবার গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, পুজো না দিলেও প্রণাম জানাবার জন্য গিয়েছিল; সেই সময় বলি দেবার জন্য যখন হাঁসটার মাথায় সিঁদুর দিচ্ছিল পুরুত, তখনই তার সন্দেহ হয় হসটা তার বাড়ির হাঁস বলে। কিন্তু সেখানে কোনো গোল করে নাই। বাড়ি এসে হাঁসের হিসেব করে দেখেছে একটি হাঁস কম। অমনি বাক্যব্যয় না করে কালোশশীকে ঘরে পুরে নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করেছে এবং এই গোপনে পুজো দেওয়া যে কালোশশীর কর্তার প্রতি ভক্তির জন্য নয়, পুজোর উদ্যোক্তা বনওয়ারীর প্রতি প্রীতির আতিশয্যের নিদর্শন, সেই কথাটা অত্যন্ত কুৎসিত ভঙ্গি করে পরম তাকে বারবার করে বলেছে—আমি কবে মরব তাই জানি না, লইলে সব জানি, সব বুঝি, বুয়েছিস? পরিশেষে কয়েকটা কুৎসিত অশ্লীল সম্বোধনে সম্বোধিতও করেছিল কালোশশীকে। প্রহারের বেদনার জন্যই সে রাগ করেছে, এবং সেই ক্ষোভের মধ্যেই সুযোগ পেয়ে তার অভিমান জেগে। উঠেছে তার অদৃষ্ট এবং বিধাতার উপর। তাই ঘর ছেড়ে গ্রামের বাইরে গাছতলায় বসে সে কাঁদতে এসেছে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top