বনওয়ারীর সঙ্গে সে কিন্তু ছলনা করলে। আসল কথা গোপন করলে, বললে—এসেছিলাম কত্তাকে পেনাম করতে। মানত করলাম একটা।
বনওয়ারী বললে—তা কাঁদছিলা কেনে ভাই?
–কাঁদছিলাম মনের বেথায়।
—মনের বেথায়? কেঁদে ফেললে বনওয়ারী। কালোশশীর মনের ব্যথা! সে ব্যথা সঙ্গে সঙ্গে বনওয়ারীর মদ্যসিক্ত নরম মনকে ব্যাকুল করে তুললে।—কি তোমার মনের বেথা ভাই?
—আমার বেথা আমার কাছে ভাই; যাকে বলবার, যার বুঝবার, সেই বুঝবে। বললাম আমার যেন মিত্যু হয়।
কেনে ভাই? এমন মানত কেনে করলে ভাই? কি তোমার বেথা, কি তোমার অভাব আমাকে বলবে না?
—কি হবে বেঁচে? ছেলে নাই, পুলে নাই! সোয়ামি, না, কসাই—
বনওয়ারী তার মাথায় হাত দিয়ে বললে হবে হবে। আমি বলছি, তোমার সন্তান হবে। দেখো তুমি।
হঠাৎ প্রদীপের আলোটা নিবে গেল। চুপড়ির আড়ালের মধ্যে থেকে প্রদীপটার বাইরের বাতাসে নেববার কথা নয়। বাতাস নয়, ফুঁ দিয়ে প্রদীপটা নিবিয়ে দিলে কালেশশী। ব্যাকুলভাবে সে বনওয়ারীর খালি হাতখানি জড়িয়ে ধরলে। কালোশশীর মুখেও মদের বাস উঠছে।
হাঁসুলী বাঁকে বাঁশবনের তলায় পৃথিবীর আদিম কালের অন্ধকার বাসা বেঁধে থাকে। সুযোগ পেলেই দ্রুতগতিতে ধেয়ে ঘনিয়ে আসে সে, অন্ধকার বাঁশবন থেকে বসতির মধ্যে। প্রদীপটা নিবে যেতেই সে অন্ধকার ছুটে এল যেন কোপাইয়ের বুক থেকে হড়পা বানের মত। সেই তমসার মধ্যে মদের নেশায় উত্তেজিত বনওয়ারী এবং কালোশশী বিলুপ্ত হয়ে গেল। এতক্ষণে কালোশশী সব কথা বললে বনওয়ারীকে। বনওয়ার অনেক কাঁদল। তার ব্যথার কথাও সে বললে। তার সন্তান নাই। সে জানে সন্তানহীনতার দুঃখ। এত বড় মাতব্বর সে, দু-দুবিঘে জমি, খানিকটা ঘাসবেড়, এতগুলি গরু, হাল, বলদ, এসব কি হবে? কি দাম এ সবের? কিন্তু আজ আর তার কোনো উপায় নাই। তা ছাড়া আজ এই এমন মুহূর্তে কালোশশীর কাছে সত্য গোপন করবে না; তার স্ত্রীকে সে কখনই কালোশশীর মত ভালবাসে না। কিন্তু কি করবে সে? তাদের মধ্যে সাঙার রেওয়াজ আছে, কিন্তু ওর পক্ষে ঘাড় নাড়লে বনওয়ারী। অন্য কেউ হলে তার পক্ষে সম্ভব ছিল এমন কাজ। সে বনওয়ারী–পাড়ার মাতব্বর।
কালোশশী বললে—আমারই কি আর তাই সাজে ভাই! সেকথা আমি বলি নাই। হঠাৎ কালোশশী চমকে উঠল। বললে—কে যেন গেল! আমি বাড়ি যাই। তুমি যাও, ঠাকুরতলায় পিদিম দিয়ে পাড়ায় যাও।
—দাঁড়াও, পিদিম আবার জ্বেলে আনি।
এইবার কালোশশীই বললে—পিদিম নিয়েছ, ধূপ কই? শুধু পিদিমে সনজে দেওয়া হয় নাকি?
ঠিক কথা। ঠিক বলেছে কালোশশী। কালোশশী যে চন্নপুর ফেরতা মেয়ে, এ কথা কালোশশী ছাড়া আর কে বলতে পারবে?
চন্ননপুরে বাবুদের বাড়িতে কালোশশী অনেকদিন ছোটলোক ঝিয়ের কাজ করেছে। বাবুরা বলে-ছোটলোক ঝি। এদের মেয়েরা এঁটোকাটা আঁস্তাকুড় যোয়, বাসন মাজে, ছেলেপিলের ময়লা কাপড় সাফ করে, দুবেলা খেতে পায়, বছরে দুখানা কাপড়ও মেলে, মাইনে চার আনা থেকে এক টাকা পর্যন্ত যার যেমন বাড়ি, যেমন কাজ। কাহারপাড়ার মেয়েরা জাঙলে সদূগোপদের বাড়িতে ভোরবেলায় গিয়ে কাজ করে বাড়ি ফেরে। চন্ননপুর এখান থেকে অনেকটা দূর, সেখানে যাওয়া চলে না এবং সেখানেও অনেক ছোটজাত আছে, তারাই করে সেখানকার কাজ। কেবল কালোশশীই চন্ননপুরে বড়বাবুদের বাড়ি কাজ করেছে বছর দুয়েক। সেবার একটা ডাকাতির মকদ্দমায় পরমের আড়াই বছর জেল হয়েছিল। সেই সময় কালোশশীকে চন্ননপুরে বড়বাবুদের বাড়িতে কাজ ঠিক করে দিয়েছিল বড়বাবুদের হিন্দুস্থানি বরকন্দাজ ভূপসিং মহাশয়। সেইখানেই থাকত তখন কালোশশী। ভূপসিং মহাশয় তখন কালোশশীর মালিক হয়েছিলেন। ব্যাপারটায় নিন্দা অবশ্যই আছে, নিন্দাও হয়েছিল; কিন্তু নিন্দনীয় কর্মমাত্রই অমার্জনীয় অপরাধ। নয় সমাজে। ওদের সমাজে এটা এমন নিন্দনীয় কর্ম নয়, যার মার্জনা নাই। কারণ ভূপসিং মহাশয় জাতিতে উচ্চবৰ্ণ, ছত্রী, গলায় পৈতে আছে, তা ছাড়া তিনি বাবুদের বরন্দাজ। যাক সে কথা। পরম ফিরে এসে কালোশশীকে ঘরে এনেছে। এসব রীতিনীতি কালোশশী সেখানেই শিখে এসেছে।
বনওয়ারী আবার পাড়ায় ফিরে ধূপ প্রদীপ নিয়ে গেল।
প্রদীপটা কয়েক মুহূর্ত জ্বলেই নিবে গেল বাতাসে।
ধূপটা পুড়তে লাগল, কৰ্তাতলার সরীসৃপসঙ্কুল প্রান্তরের মধ্যে বাতাসের সঙ্গে ঘুরতে লাগল। ওদিকে গ্রামের মধ্যে তখন মাতন লেগেছে, ঢোলক বাজছে, গান চলছে সমবেত কণ্ঠে। আঃ, তবু আজ পাগল কাহার নাই! পাগল কাহার বাঁশবাঁদির গায়েনদার, গান বাধে, গান গায়, সে থাকলে আরও জমত। এত বেশ জমেছে। বয়স্কদের মোটা গলার সঙ্গে ছেলেদের মিহি জোরালো মিঠে গলার সুর; শিঙের সঙ্গে সানাইয়ের মত মিহি মোটা সুরের শিল্পময় বুনন বুনছে। মেয়েরাও মদ খেয়েছে। তাদেরও বসেছে স্বতন্ত্র আসর। সে আসরের মূল গায়েন সুচাঁদ; সে আজ খুব খুশি। কত্তার পুজো হয়ে গিয়েছে, পুজোর মত পুজো, বলিদান, ঢাক, মদ-কোনো খুঁত নেই। পাকী আধ সের দুধ ধরে, এমন বাটির তিন বাটি মদ খেয়েছে সে। সুচাঁদ নাচছে। কখনও, গান গাইছে কখনও কখনও বলছে সেকালের রোমাঞ্চকর গল্প। তাদের আমলের মনে মনে রঙ-ধরাধরির কথা, কে ছিল কার ভালবাসার মানুষউচ্চ হাসি হেসে সেইসব কথা বলে যাচ্ছে। কখনও বলছে, নীলকুঠির আমলের সাহেবদের গল্প, কুঠি উঠে গেলে কাহারদের কষ্টের কথা।
–কাহারপাড়ার সে এক মনন্তরা। আমার মা বলত, বাবার মা বলত, সে এক ভেষণ অবস্থা। হাড়ির ললাট-ডোমের দুৰ্গতি। বান এল, সেই বানে কুঠি ভাসল—তা কাহারপাড়া! কাহারপাড়ায় সাগর জল। সে জলের সোরোত কি! ঘর-দুয়োর পড়ে গেল। গরু-বাছুরছাগল মরে ঢোল হয়ে ফুলে বাঁশবনে আটকে থাকল কতক, কতক ভেসে গেল। লোকেরা গাছে উঠে বসে থাকল চি-পুত্তমা-বুন নিয়ে। মায়ের কোল থেকে কচি ছেলে ঘুমের ঘোরে হাত থেকে খসে টুপুল করে পড়ে গেল বানের জলে। আমাদের বনওয়ারীর এক জেঠা ছিল—বাবার বড় ভাই, সে তখন দু বছরের ছেলেসে পড়ে যেয়েছিল। আরও যেন কার কার ছেলে যেয়েছিল পড়ে। গাছের ডালেই তুকুস করে ঘাড় লটকে মরে গেল পেহ্লাদের কত্তাবাবা! ওই হারামজাদা করালীর কত্তাবাবা ছিল তখন মায়ের প্যাটে। ভর্তি-ভর্তি দশ মাস। গাছের ডালেই পেসব হল ছেলে। তাতেই নাম হল—ষষ্ঠীদাস। গাছটি ছিল ষষ্ঠীগাছ। ডাকত নোকে গেছোষষ্ঠী বলে। ওই হারামজাদা করালী এমন ডাকাবুকো কেন? গেছোষষ্ঠীর ঝড় বলে।
তারপর সে হা-হা করে হাসতে লাগল।
বসন বললে—মরণ, এর আবার হাসি কিসের?
পাখী নেশায়-রঙিন চোখ বিস্ফারিত করে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে, বাইরে সে। মজলিসটিকে লক্ষ্য করছে, মনে মনে স্বপ্ন রচনা করছে। ওর কান রয়েছে করালীর বাড়ির আসরের ধ্বনির দিকে। করালীর বাড়িতে করালী আলাদা আসর বসিয়েছে। করালী কাউকে ভয়। করে না, সে কারও কাছে হার মানে না, ঘোষকেই সে আজ প্রণাম করে নাই তো বনওয়ারী: সেই মুণ্ডঘেঁড়া হাঁস তিনটে রান্না হয়েছে। চন্ননপুর থেকে বোতলবন্দি পাকী মদ এসেছে। নসুবালা নাচছে। জমে উঠেছে তাদের আসর। পাখীর মন নাচছে। আষাঢ় মাসে ঘনঘটা করে মেঘ এলে তালচড়ুই যেমন নেচে নেচে ওড়ে, তেমনিভাবে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। তার মনে রঙের সঙ্গে মদের নেশায় উত্তেজনা যোগ দিয়েছে। সে যাবেই করালীর বাড়ি। এদের মজলিসটা ভাঙলে হয়, কি নেশাটা আরও খানিক জমে উঠলে হয়। ওদিকে সেই ডাকাবুকোর অর্থাৎ করালীর মজলিস ভাঙলে হয়! তার সঙ্কল্প আজ দৃঢ়।
সুচাঁদ গাল দেবেদিক। বনওয়ারী শাসিয়েছে—শাসক। সে মানবে না কারও শাসন। সে ছুটে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়বে তার বুকে।
বনওয়ারী আজ পাড়ার মজলিসে বলে দিয়েছে—যদি আপন আপন থাকতে চাও তো সে ভাল কথা; যার যা খুশি কর; কারুর দায় হায় কারুর নাই, কে মরল, কে থাকল দেখাদেখি নাই; বাস্ ভাল কথা; আমি বাঁচি, মাতব্বরি আমি চাই না, করব না। আর তা যদি না হয়, দায়। যদি পুরতে হয় আমাকে, তা হলে আমার কথা মেনে চলতে হবে। ওই করালীর মতন চালচলন-এ চলবে না। কথাটা সে বলবার সময় দু-তিনবার পাখীর দিকে চেয়ে কথা বলেছে। বলুক।
বনওয়ারী বললে—তা কাঁদছিলা কেনে ভাই?
–কাঁদছিলাম মনের বেথায়।
—মনের বেথায়? কেঁদে ফেললে বনওয়ারী। কালোশশীর মনের ব্যথা! সে ব্যথা সঙ্গে সঙ্গে বনওয়ারীর মদ্যসিক্ত নরম মনকে ব্যাকুল করে তুললে।—কি তোমার মনের বেথা ভাই?
—আমার বেথা আমার কাছে ভাই; যাকে বলবার, যার বুঝবার, সেই বুঝবে। বললাম আমার যেন মিত্যু হয়।
কেনে ভাই? এমন মানত কেনে করলে ভাই? কি তোমার বেথা, কি তোমার অভাব আমাকে বলবে না?
—কি হবে বেঁচে? ছেলে নাই, পুলে নাই! সোয়ামি, না, কসাই—
বনওয়ারী তার মাথায় হাত দিয়ে বললে হবে হবে। আমি বলছি, তোমার সন্তান হবে। দেখো তুমি।
হঠাৎ প্রদীপের আলোটা নিবে গেল। চুপড়ির আড়ালের মধ্যে থেকে প্রদীপটার বাইরের বাতাসে নেববার কথা নয়। বাতাস নয়, ফুঁ দিয়ে প্রদীপটা নিবিয়ে দিলে কালেশশী। ব্যাকুলভাবে সে বনওয়ারীর খালি হাতখানি জড়িয়ে ধরলে। কালোশশীর মুখেও মদের বাস উঠছে।
হাঁসুলী বাঁকে বাঁশবনের তলায় পৃথিবীর আদিম কালের অন্ধকার বাসা বেঁধে থাকে। সুযোগ পেলেই দ্রুতগতিতে ধেয়ে ঘনিয়ে আসে সে, অন্ধকার বাঁশবন থেকে বসতির মধ্যে। প্রদীপটা নিবে যেতেই সে অন্ধকার ছুটে এল যেন কোপাইয়ের বুক থেকে হড়পা বানের মত। সেই তমসার মধ্যে মদের নেশায় উত্তেজিত বনওয়ারী এবং কালোশশী বিলুপ্ত হয়ে গেল। এতক্ষণে কালোশশী সব কথা বললে বনওয়ারীকে। বনওয়ার অনেক কাঁদল। তার ব্যথার কথাও সে বললে। তার সন্তান নাই। সে জানে সন্তানহীনতার দুঃখ। এত বড় মাতব্বর সে, দু-দুবিঘে জমি, খানিকটা ঘাসবেড়, এতগুলি গরু, হাল, বলদ, এসব কি হবে? কি দাম এ সবের? কিন্তু আজ আর তার কোনো উপায় নাই। তা ছাড়া আজ এই এমন মুহূর্তে কালোশশীর কাছে সত্য গোপন করবে না; তার স্ত্রীকে সে কখনই কালোশশীর মত ভালবাসে না। কিন্তু কি করবে সে? তাদের মধ্যে সাঙার রেওয়াজ আছে, কিন্তু ওর পক্ষে ঘাড় নাড়লে বনওয়ারী। অন্য কেউ হলে তার পক্ষে সম্ভব ছিল এমন কাজ। সে বনওয়ারী–পাড়ার মাতব্বর।
কালোশশী বললে—আমারই কি আর তাই সাজে ভাই! সেকথা আমি বলি নাই। হঠাৎ কালোশশী চমকে উঠল। বললে—কে যেন গেল! আমি বাড়ি যাই। তুমি যাও, ঠাকুরতলায় পিদিম দিয়ে পাড়ায় যাও।
—দাঁড়াও, পিদিম আবার জ্বেলে আনি।
এইবার কালোশশীই বললে—পিদিম নিয়েছ, ধূপ কই? শুধু পিদিমে সনজে দেওয়া হয় নাকি?
ঠিক কথা। ঠিক বলেছে কালোশশী। কালোশশী যে চন্নপুর ফেরতা মেয়ে, এ কথা কালোশশী ছাড়া আর কে বলতে পারবে?
চন্ননপুরে বাবুদের বাড়িতে কালোশশী অনেকদিন ছোটলোক ঝিয়ের কাজ করেছে। বাবুরা বলে-ছোটলোক ঝি। এদের মেয়েরা এঁটোকাটা আঁস্তাকুড় যোয়, বাসন মাজে, ছেলেপিলের ময়লা কাপড় সাফ করে, দুবেলা খেতে পায়, বছরে দুখানা কাপড়ও মেলে, মাইনে চার আনা থেকে এক টাকা পর্যন্ত যার যেমন বাড়ি, যেমন কাজ। কাহারপাড়ার মেয়েরা জাঙলে সদূগোপদের বাড়িতে ভোরবেলায় গিয়ে কাজ করে বাড়ি ফেরে। চন্ননপুর এখান থেকে অনেকটা দূর, সেখানে যাওয়া চলে না এবং সেখানেও অনেক ছোটজাত আছে, তারাই করে সেখানকার কাজ। কেবল কালোশশীই চন্ননপুরে বড়বাবুদের বাড়ি কাজ করেছে বছর দুয়েক। সেবার একটা ডাকাতির মকদ্দমায় পরমের আড়াই বছর জেল হয়েছিল। সেই সময় কালোশশীকে চন্ননপুরে বড়বাবুদের বাড়িতে কাজ ঠিক করে দিয়েছিল বড়বাবুদের হিন্দুস্থানি বরকন্দাজ ভূপসিং মহাশয়। সেইখানেই থাকত তখন কালোশশী। ভূপসিং মহাশয় তখন কালোশশীর মালিক হয়েছিলেন। ব্যাপারটায় নিন্দা অবশ্যই আছে, নিন্দাও হয়েছিল; কিন্তু নিন্দনীয় কর্মমাত্রই অমার্জনীয় অপরাধ। নয় সমাজে। ওদের সমাজে এটা এমন নিন্দনীয় কর্ম নয়, যার মার্জনা নাই। কারণ ভূপসিং মহাশয় জাতিতে উচ্চবৰ্ণ, ছত্রী, গলায় পৈতে আছে, তা ছাড়া তিনি বাবুদের বরন্দাজ। যাক সে কথা। পরম ফিরে এসে কালোশশীকে ঘরে এনেছে। এসব রীতিনীতি কালোশশী সেখানেই শিখে এসেছে।
বনওয়ারী আবার পাড়ায় ফিরে ধূপ প্রদীপ নিয়ে গেল।
প্রদীপটা কয়েক মুহূর্ত জ্বলেই নিবে গেল বাতাসে।
ধূপটা পুড়তে লাগল, কৰ্তাতলার সরীসৃপসঙ্কুল প্রান্তরের মধ্যে বাতাসের সঙ্গে ঘুরতে লাগল। ওদিকে গ্রামের মধ্যে তখন মাতন লেগেছে, ঢোলক বাজছে, গান চলছে সমবেত কণ্ঠে। আঃ, তবু আজ পাগল কাহার নাই! পাগল কাহার বাঁশবাঁদির গায়েনদার, গান বাধে, গান গায়, সে থাকলে আরও জমত। এত বেশ জমেছে। বয়স্কদের মোটা গলার সঙ্গে ছেলেদের মিহি জোরালো মিঠে গলার সুর; শিঙের সঙ্গে সানাইয়ের মত মিহি মোটা সুরের শিল্পময় বুনন বুনছে। মেয়েরাও মদ খেয়েছে। তাদেরও বসেছে স্বতন্ত্র আসর। সে আসরের মূল গায়েন সুচাঁদ; সে আজ খুব খুশি। কত্তার পুজো হয়ে গিয়েছে, পুজোর মত পুজো, বলিদান, ঢাক, মদ-কোনো খুঁত নেই। পাকী আধ সের দুধ ধরে, এমন বাটির তিন বাটি মদ খেয়েছে সে। সুচাঁদ নাচছে। কখনও, গান গাইছে কখনও কখনও বলছে সেকালের রোমাঞ্চকর গল্প। তাদের আমলের মনে মনে রঙ-ধরাধরির কথা, কে ছিল কার ভালবাসার মানুষউচ্চ হাসি হেসে সেইসব কথা বলে যাচ্ছে। কখনও বলছে, নীলকুঠির আমলের সাহেবদের গল্প, কুঠি উঠে গেলে কাহারদের কষ্টের কথা।
–কাহারপাড়ার সে এক মনন্তরা। আমার মা বলত, বাবার মা বলত, সে এক ভেষণ অবস্থা। হাড়ির ললাট-ডোমের দুৰ্গতি। বান এল, সেই বানে কুঠি ভাসল—তা কাহারপাড়া! কাহারপাড়ায় সাগর জল। সে জলের সোরোত কি! ঘর-দুয়োর পড়ে গেল। গরু-বাছুরছাগল মরে ঢোল হয়ে ফুলে বাঁশবনে আটকে থাকল কতক, কতক ভেসে গেল। লোকেরা গাছে উঠে বসে থাকল চি-পুত্তমা-বুন নিয়ে। মায়ের কোল থেকে কচি ছেলে ঘুমের ঘোরে হাত থেকে খসে টুপুল করে পড়ে গেল বানের জলে। আমাদের বনওয়ারীর এক জেঠা ছিল—বাবার বড় ভাই, সে তখন দু বছরের ছেলেসে পড়ে যেয়েছিল। আরও যেন কার কার ছেলে যেয়েছিল পড়ে। গাছের ডালেই তুকুস করে ঘাড় লটকে মরে গেল পেহ্লাদের কত্তাবাবা! ওই হারামজাদা করালীর কত্তাবাবা ছিল তখন মায়ের প্যাটে। ভর্তি-ভর্তি দশ মাস। গাছের ডালেই পেসব হল ছেলে। তাতেই নাম হল—ষষ্ঠীদাস। গাছটি ছিল ষষ্ঠীগাছ। ডাকত নোকে গেছোষষ্ঠী বলে। ওই হারামজাদা করালী এমন ডাকাবুকো কেন? গেছোষষ্ঠীর ঝড় বলে।
তারপর সে হা-হা করে হাসতে লাগল।
বসন বললে—মরণ, এর আবার হাসি কিসের?
পাখী নেশায়-রঙিন চোখ বিস্ফারিত করে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে, বাইরে সে। মজলিসটিকে লক্ষ্য করছে, মনে মনে স্বপ্ন রচনা করছে। ওর কান রয়েছে করালীর বাড়ির আসরের ধ্বনির দিকে। করালীর বাড়িতে করালী আলাদা আসর বসিয়েছে। করালী কাউকে ভয়। করে না, সে কারও কাছে হার মানে না, ঘোষকেই সে আজ প্রণাম করে নাই তো বনওয়ারী: সেই মুণ্ডঘেঁড়া হাঁস তিনটে রান্না হয়েছে। চন্ননপুর থেকে বোতলবন্দি পাকী মদ এসেছে। নসুবালা নাচছে। জমে উঠেছে তাদের আসর। পাখীর মন নাচছে। আষাঢ় মাসে ঘনঘটা করে মেঘ এলে তালচড়ুই যেমন নেচে নেচে ওড়ে, তেমনিভাবে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। তার মনে রঙের সঙ্গে মদের নেশায় উত্তেজনা যোগ দিয়েছে। সে যাবেই করালীর বাড়ি। এদের মজলিসটা ভাঙলে হয়, কি নেশাটা আরও খানিক জমে উঠলে হয়। ওদিকে সেই ডাকাবুকোর অর্থাৎ করালীর মজলিস ভাঙলে হয়! তার সঙ্কল্প আজ দৃঢ়।
সুচাঁদ গাল দেবেদিক। বনওয়ারী শাসিয়েছে—শাসক। সে মানবে না কারও শাসন। সে ছুটে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়বে তার বুকে।
বনওয়ারী আজ পাড়ার মজলিসে বলে দিয়েছে—যদি আপন আপন থাকতে চাও তো সে ভাল কথা; যার যা খুশি কর; কারুর দায় হায় কারুর নাই, কে মরল, কে থাকল দেখাদেখি নাই; বাস্ ভাল কথা; আমি বাঁচি, মাতব্বরি আমি চাই না, করব না। আর তা যদি না হয়, দায়। যদি পুরতে হয় আমাকে, তা হলে আমার কথা মেনে চলতে হবে। ওই করালীর মতন চালচলন-এ চলবে না। কথাটা সে বলবার সময় দু-তিনবার পাখীর দিকে চেয়ে কথা বলেছে। বলুক।