What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected হাঁসুলী বাঁকের উপকথা -তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়⚛️ (3 Viewers)

বনওয়ারীর সঙ্গে সে কিন্তু ছলনা করলে। আসল কথা গোপন করলে, বললে—এসেছিলাম কত্তাকে পেনাম করতে। মানত করলাম একটা।

বনওয়ারী বললে—তা কাঁদছিলা কেনে ভাই?

–কাঁদছিলাম মনের বেথায়।

—মনের বেথায়? কেঁদে ফেললে বনওয়ারী। কালোশশীর মনের ব্যথা! সে ব্যথা সঙ্গে সঙ্গে বনওয়ারীর মদ্যসিক্ত নরম মনকে ব্যাকুল করে তুললে।—কি তোমার মনের বেথা ভাই?

—আমার বেথা আমার কাছে ভাই; যাকে বলবার, যার বুঝবার, সেই বুঝবে। বললাম আমার যেন মিত্যু হয়।

কেনে ভাই? এমন মানত কেনে করলে ভাই? কি তোমার বেথা, কি তোমার অভাব আমাকে বলবে না?

—কি হবে বেঁচে? ছেলে নাই, পুলে নাই! সোয়ামি, না, কসাই—

বনওয়ারী তার মাথায় হাত দিয়ে বললে হবে হবে। আমি বলছি, তোমার সন্তান হবে। দেখো তুমি।

হঠাৎ প্রদীপের আলোটা নিবে গেল। চুপড়ির আড়ালের মধ্যে থেকে প্রদীপটার বাইরের বাতাসে নেববার কথা নয়। বাতাস নয়, ফুঁ দিয়ে প্রদীপটা নিবিয়ে দিলে কালেশশী। ব্যাকুলভাবে সে বনওয়ারীর খালি হাতখানি জড়িয়ে ধরলে। কালোশশীর মুখেও মদের বাস উঠছে।

হাঁসুলী বাঁকে বাঁশবনের তলায় পৃথিবীর আদিম কালের অন্ধকার বাসা বেঁধে থাকে। সুযোগ পেলেই দ্রুতগতিতে ধেয়ে ঘনিয়ে আসে সে, অন্ধকার বাঁশবন থেকে বসতির মধ্যে। প্রদীপটা নিবে যেতেই সে অন্ধকার ছুটে এল যেন কোপাইয়ের বুক থেকে হড়পা বানের মত। সেই তমসার মধ্যে মদের নেশায় উত্তেজিত বনওয়ারী এবং কালোশশী বিলুপ্ত হয়ে গেল। এতক্ষণে কালোশশী সব কথা বললে বনওয়ারীকে। বনওয়ার অনেক কাঁদল। তার ব্যথার কথাও সে বললে। তার সন্তান নাই। সে জানে সন্তানহীনতার দুঃখ। এত বড় মাতব্বর সে, দু-দুবিঘে জমি, খানিকটা ঘাসবেড়, এতগুলি গরু, হাল, বলদ, এসব কি হবে? কি দাম এ সবের? কিন্তু আজ আর তার কোনো উপায় নাই। তা ছাড়া আজ এই এমন মুহূর্তে কালোশশীর কাছে সত্য গোপন করবে না; তার স্ত্রীকে সে কখনই কালোশশীর মত ভালবাসে না। কিন্তু কি করবে সে? তাদের মধ্যে সাঙার রেওয়াজ আছে, কিন্তু ওর পক্ষে ঘাড় নাড়লে বনওয়ারী। অন্য কেউ হলে তার পক্ষে সম্ভব ছিল এমন কাজ। সে বনওয়ারী–পাড়ার মাতব্বর।

কালোশশী বললে—আমারই কি আর তাই সাজে ভাই! সেকথা আমি বলি নাই। হঠাৎ কালোশশী চমকে উঠল। বললে—কে যেন গেল! আমি বাড়ি যাই। তুমি যাও, ঠাকুরতলায় পিদিম দিয়ে পাড়ায় যাও।

—দাঁড়াও, পিদিম আবার জ্বেলে আনি।

এইবার কালোশশীই বললে—পিদিম নিয়েছ, ধূপ কই? শুধু পিদিমে সনজে দেওয়া হয় নাকি?

ঠিক কথা। ঠিক বলেছে কালোশশী। কালোশশী যে চন্নপুর ফেরতা মেয়ে, এ কথা কালোশশী ছাড়া আর কে বলতে পারবে?

চন্ননপুরে বাবুদের বাড়িতে কালোশশী অনেকদিন ছোটলোক ঝিয়ের কাজ করেছে। বাবুরা বলে-ছোটলোক ঝি। এদের মেয়েরা এঁটোকাটা আঁস্তাকুড় যোয়, বাসন মাজে, ছেলেপিলের ময়লা কাপড় সাফ করে, দুবেলা খেতে পায়, বছরে দুখানা কাপড়ও মেলে, মাইনে চার আনা থেকে এক টাকা পর্যন্ত যার যেমন বাড়ি, যেমন কাজ। কাহারপাড়ার মেয়েরা জাঙলে সদূগোপদের বাড়িতে ভোরবেলায় গিয়ে কাজ করে বাড়ি ফেরে। চন্ননপুর এখান থেকে অনেকটা দূর, সেখানে যাওয়া চলে না এবং সেখানেও অনেক ছোটজাত আছে, তারাই করে সেখানকার কাজ। কেবল কালোশশীই চন্ননপুরে বড়বাবুদের বাড়ি কাজ করেছে বছর দুয়েক। সেবার একটা ডাকাতির মকদ্দমায় পরমের আড়াই বছর জেল হয়েছিল। সেই সময় কালোশশীকে চন্ননপুরে বড়বাবুদের বাড়িতে কাজ ঠিক করে দিয়েছিল বড়বাবুদের হিন্দুস্থানি বরকন্দাজ ভূপসিং মহাশয়। সেইখানেই থাকত তখন কালোশশী। ভূপসিং মহাশয় তখন কালোশশীর মালিক হয়েছিলেন। ব্যাপারটায় নিন্দা অবশ্যই আছে, নিন্দাও হয়েছিল; কিন্তু নিন্দনীয় কর্মমাত্রই অমার্জনীয় অপরাধ। নয় সমাজে। ওদের সমাজে এটা এমন নিন্দনীয় কর্ম নয়, যার মার্জনা নাই। কারণ ভূপসিং মহাশয় জাতিতে উচ্চবৰ্ণ, ছত্রী, গলায় পৈতে আছে, তা ছাড়া তিনি বাবুদের বরন্দাজ। যাক সে কথা। পরম ফিরে এসে কালোশশীকে ঘরে এনেছে। এসব রীতিনীতি কালোশশী সেখানেই শিখে এসেছে।

বনওয়ারী আবার পাড়ায় ফিরে ধূপ প্রদীপ নিয়ে গেল।




প্রদীপটা কয়েক মুহূর্ত জ্বলেই নিবে গেল বাতাসে।

ধূপটা পুড়তে লাগল, কৰ্তাতলার সরীসৃপসঙ্কুল প্রান্তরের মধ্যে বাতাসের সঙ্গে ঘুরতে লাগল। ওদিকে গ্রামের মধ্যে তখন মাতন লেগেছে, ঢোলক বাজছে, গান চলছে সমবেত কণ্ঠে। আঃ, তবু আজ পাগল কাহার নাই! পাগল কাহার বাঁশবাঁদির গায়েনদার, গান বাধে, গান গায়, সে থাকলে আরও জমত। এত বেশ জমেছে। বয়স্কদের মোটা গলার সঙ্গে ছেলেদের মিহি জোরালো মিঠে গলার সুর; শিঙের সঙ্গে সানাইয়ের মত মিহি মোটা সুরের শিল্পময় বুনন বুনছে। মেয়েরাও মদ খেয়েছে। তাদেরও বসেছে স্বতন্ত্র আসর। সে আসরের মূল গায়েন সুচাঁদ; সে আজ খুব খুশি। কত্তার পুজো হয়ে গিয়েছে, পুজোর মত পুজো, বলিদান, ঢাক, মদ-কোনো খুঁত নেই। পাকী আধ সের দুধ ধরে, এমন বাটির তিন বাটি মদ খেয়েছে সে। সুচাঁদ নাচছে। কখনও, গান গাইছে কখনও কখনও বলছে সেকালের রোমাঞ্চকর গল্প। তাদের আমলের মনে মনে রঙ-ধরাধরির কথা, কে ছিল কার ভালবাসার মানুষউচ্চ হাসি হেসে সেইসব কথা বলে যাচ্ছে। কখনও বলছে, নীলকুঠির আমলের সাহেবদের গল্প, কুঠি উঠে গেলে কাহারদের কষ্টের কথা।

–কাহারপাড়ার সে এক মনন্তরা। আমার মা বলত, বাবার মা বলত, সে এক ভেষণ অবস্থা। হাড়ির ললাট-ডোমের দুৰ্গতি। বান এল, সেই বানে কুঠি ভাসল—তা কাহারপাড়া! কাহারপাড়ায় সাগর জল। সে জলের সোরোত কি! ঘর-দুয়োর পড়ে গেল। গরু-বাছুরছাগল মরে ঢোল হয়ে ফুলে বাঁশবনে আটকে থাকল কতক, কতক ভেসে গেল। লোকেরা গাছে উঠে বসে থাকল চি-পুত্তমা-বুন নিয়ে। মায়ের কোল থেকে কচি ছেলে ঘুমের ঘোরে হাত থেকে খসে টুপুল করে পড়ে গেল বানের জলে। আমাদের বনওয়ারীর এক জেঠা ছিল—বাবার বড় ভাই, সে তখন দু বছরের ছেলেসে পড়ে যেয়েছিল। আরও যেন কার কার ছেলে যেয়েছিল পড়ে। গাছের ডালেই তুকুস করে ঘাড় লটকে মরে গেল পেহ্লাদের কত্তাবাবা! ওই হারামজাদা করালীর কত্তাবাবা ছিল তখন মায়ের প্যাটে। ভর্তি-ভর্তি দশ মাস। গাছের ডালেই পেসব হল ছেলে। তাতেই নাম হল—ষষ্ঠীদাস। গাছটি ছিল ষষ্ঠীগাছ। ডাকত নোকে গেছোষষ্ঠী বলে। ওই হারামজাদা করালী এমন ডাকাবুকো কেন? গেছোষষ্ঠীর ঝড় বলে।

তারপর সে হা-হা করে হাসতে লাগল।

বসন বললে—মরণ, এর আবার হাসি কিসের?

পাখী নেশায়-রঙিন চোখ বিস্ফারিত করে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে, বাইরে সে। মজলিসটিকে লক্ষ্য করছে, মনে মনে স্বপ্ন রচনা করছে। ওর কান রয়েছে করালীর বাড়ির আসরের ধ্বনির দিকে। করালীর বাড়িতে করালী আলাদা আসর বসিয়েছে। করালী কাউকে ভয়। করে না, সে কারও কাছে হার মানে না, ঘোষকেই সে আজ প্রণাম করে নাই তো বনওয়ারী: সেই মুণ্ডঘেঁড়া হাঁস তিনটে রান্না হয়েছে। চন্ননপুর থেকে বোতলবন্দি পাকী মদ এসেছে। নসুবালা নাচছে। জমে উঠেছে তাদের আসর। পাখীর মন নাচছে। আষাঢ় মাসে ঘনঘটা করে মেঘ এলে তালচড়ুই যেমন নেচে নেচে ওড়ে, তেমনিভাবে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। তার মনে রঙের সঙ্গে মদের নেশায় উত্তেজনা যোগ দিয়েছে। সে যাবেই করালীর বাড়ি। এদের মজলিসটা ভাঙলে হয়, কি নেশাটা আরও খানিক জমে উঠলে হয়। ওদিকে সেই ডাকাবুকোর অর্থাৎ করালীর মজলিস ভাঙলে হয়! তার সঙ্কল্প আজ দৃঢ়।

সুচাঁদ গাল দেবেদিক। বনওয়ারী শাসিয়েছে—শাসক। সে মানবে না কারও শাসন। সে ছুটে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়বে তার বুকে।

বনওয়ারী আজ পাড়ার মজলিসে বলে দিয়েছে—যদি আপন আপন থাকতে চাও তো সে ভাল কথা; যার যা খুশি কর; কারুর দায় হায় কারুর নাই, কে মরল, কে থাকল দেখাদেখি নাই; বাস্ ভাল কথা; আমি বাঁচি, মাতব্বরি আমি চাই না, করব না। আর তা যদি না হয়, দায়। যদি পুরতে হয় আমাকে, তা হলে আমার কথা মেনে চলতে হবে। ওই করালীর মতন চালচলন-এ চলবে না। কথাটা সে বলবার সময় দু-তিনবার পাখীর দিকে চেয়ে কথা বলেছে। বলুক।
 
নিমতেলে পানু ওই লিকলিকে চেহারা, ধূর্ত চাউনি-ভরা চোখ ওই দুষ্টটাই সর্বাগ্রে সমর্থন করেছে বনওয়ারীকে। যত নষ্টের মূলে হল ওই। করালীর নামে ওই সাতখানা করে লাগিয়েছে। সেদিন চন্ননপুরে সাপটা নিয়ে যাবার সময় কি সব করালী বলেছিল, তা-ই একটাকে সাতখান করে লাগিয়েছে। ওই নষ্টই তুলেছিল পাখীর কথা।

ফুট কেটে বলেছে—বসন আর পাখীকে শুধাও কথা। তারা তোমার কথা মানবে তো? করালীর উঠানে পাখীর যে ফাদ পাতা আছে। হি-হি কুরে সে হেসেছে।

পাখী পাখা ঝাপটে নখ ঠোঁট মেলে আক্রমণ করত পানুকে, কিন্তু তার আগেই বসন্ত তাকে। থামিয়ে দিয়েছে। পাখীর ওই একটা দুর্বলতা। মাকে সে দুঃখ দিতে পারে না। কি করে দেবে? মা তো তার শুধু মা নয় তার পরানের সখী। এমন মা কারও নাই। পাখী অকপটে বলে সকল কথা তার মাকে। বসন কখনও মেয়েকে তিরস্কার করে না। সে তার চুল বেঁধে মুখ মুছিয়ে দেয়। ঠাট্টা করে বলে ভাল হয়েছে কি না করালীকে শুধাস। এই মায়ের অপমান সে করতে পারে, না তাকে দুঃখ দিতে পারে?

সে জানে, করালীর ঘরে সে গেলে কেউ তাদের কিছু করতে পারবে না। কিন্তু তার মা বসনকে সবাই বিধে মারবে। সেই ভয়েই এতদিন সে কিছু করে নাই। তবে আজ আর নয়। আজই সে যাবে, আজ যেন মন বলছে, যেতেই হবে।

ওঃ! কি আষাঢ়ে এক গল্প ফেঁদেছে দিদি-বুড়ি ওর্থাৎ সুচাঁদ, তার আর শেষ নাই। টুকরো টুকরো করে এই গল্প—এই আঠার বছর বয়সের গোটা জীবনটাই শুনে আসছে পাখী। অরুচি ধরেছে তার ওই গল্পে, বিশেষ করে আজ এই মুহূর্তে।

হা-হা করে হাসছে সুচাঁদসে হাসি আজ রাত্রে আর থামবেই না বোধহয়। করালীর বাবার বাবা বন্যার সময় গাছের উপর জন্মেছিল, সেই নিয়ে বুড়ি হাসছে। তা নিয়ে এত হাসি কিসের? বুড়ি ডাইনি ডাকিনী, করালীকে দুচক্ষে দেখতে পারে না।

সেজন্য কিন্তু হাসে নাই সুচাঁদ। বন্যার দুর্যোগে গাছের ডালে জীবন বাঁচাতে মানুষ যখন বিব্রত, তখনও কিনা কাহার-কাহারনীর মন মাতানো রঙের খেলা! সেই কথা বলতে গিয়ে সুচাঁদ না হেসে পারে! হায় হায় রে! কাহার-কুলের মনে রঙের খলার বিরাম নাই। কি মনই তাদের দিয়েছিল বাবাঠাকুর! বলতে বলতে হাত জোড় করে প্রণাম করে সুচাঁদ। গাছের ডালে বসে মানুষ অনাহারে রয়েছে, শীতে কাঁপছে, হু-হু করে বাদলের বাতাস বইছে, নিচে পাথার বান, কোপাইয়ের বুকে গো-গোঁ করে ডাক উঠেছে, সেই সময়ে কিনা ওই নিমতেলে পানুর ঠাকুরদাদার বাবার তৃতীয় পক্ষের পরিবার রঙ লাগালে আটপৌরেদের পরমের কত্তাবাবার সঙ্গে? ওরা ছিল এক গাছে, এরা ছিল এক গাছে। চোখে চোখে কি খেল হল, কখন হল দুজনার, কে জানে! সেই দুর্যোগে—কেইবা উদিকে মন দেয়। পরমের কত্তাবাবার তখন ছোকরা বয়েস; তার উপর কুটির সাহেবদের আটপৌরে; খাতির যত, হাঁকডাক তত। আর ছুঁড়ীরও তখন অল্প বয়েস, বুড়ো স্বামী ইংলি-বিংলি সতীনপোর কঁক, সে থাকবে কেনে তার ঘরে? এমনিতেই থাকত না। আশ্চর্যের কথা মা, তা দুদিন তর সইল না, ওই গাছের উপর বসেই চোখে চোখে অঙ খেললে! ভোরবেলা সবাই ঢুলছে; শব্দ উঠল—ঝপ। বাস্। কেবল বনওয়ারীর কত্তামাছেলের শোগে ঘুমোয় নাই, সে চেঁচিয়ে উঠল। সবাই জাগল। দেখু দেখৃ কে পড়ল। নিমতেলে বুড়ো কেঁদে উঠলও মাতব্বর, আমার বউ পড়েছে। পড়েছে তো পড়েছে, যে গেল সে যাক। কি করবি বল? আর করবেই বা কি? বুড়ো কাদতে লাগল। ওমা! সকাল হলে লোকে দেখলে, আটপৌরেদের গাছে পরমের কত্তাবাবার ডালে বসে আছে সে মেয়ে।

আবার হাসতে লাগল সুচাঁদ।

রতনের স্ত্রী বললে—তা হলে মজার মনন্তরা বল?


সুচাঁদ এক মুহূর্তে হাসি থামিয়ে মদের নেশায় লাল চোখ বিস্ফারিত করে মুখ তুলে চাইলে, মাঝ উঠানে জ্বলছিল যে কাঠের পাতার ধুনিটা তার ছটা পড়ল মুখে; হাঁড়ির মত বুড়ির মুখখানা কেমন হয়ে উঠেছে যেন। সে বললে—মজা! হা, সে মজা যেন আর কখনও না হয়। মজা হল তাপরেতে। বান নেমে গেল। ভিজে দেয়াল ও আর বাতাস পেয়ে দুড়দাড় করে ধসতে লাগল। গায়ের মাটি ভিজে সপসপ করছে, চার আঙ্গুল করে পলি পড়েছে, দড়াবার থান নাই। গরু মরেছে, বাছুর মরেছে, ছাগল মরেছে, শুয়োর মরেছে, মানুষ মরেছে; চারিদিকে পচা দুগগন্ধ; ধান চাল ভেসে গিয়েছে, কথা-কানি ভিজে ডবডব করছে। কুঠির সায়েবের চাকর বেয়ারারা ছিল, সাহেব মেম মরেছে, কুঠি ভেসে গিয়েছে। কে গুরু, কে গোঁসাই তার ঠিকানা নাই। মুনিব নাই। মুনিব নাই, অক্ষে করবে কে? আগের কালে বান আসত, কাহারপাড়া ড়ুবত, সায়েবরা ছিল—তারা বড় বড় তক্তা বেঁধে ভেলা করে কাহারদের নিয়ে যেত কুঠিবাড়িতে। চাল দিত, ডাল দিত, হুকুম দিত—খিচুড়ি রাধ, খাও। ঘর ভাঙলে ঘরের খরচ দিত, খোরাক দিত। কাহারেরা ছিল পাহাড়ের আড়ালে। ঝড় আসুক, ঝাপটা আসুক, বান। আসুক, কাহারদের ভাবনা ছিল না। আর এবার কাহারদের পিথিমী অন্ধকার হয়ে গেল। সাহেব মল, মেম মল, কুঠি বিকিয়ে গেল। তার ওপর সেবার সে কি ওগ! সে এক মহামারণ। জ্বরজ্বালা, প্যাটের ব্যানো; কে কার মুখে জল দেয়—এমনি হাল। দু-তিন ঘর নিবনেদ হয়ে গেল। তখন সব যে যার পরান নিয়ে পালাতে আরম্ভ করলে। কেউ গেল কুটুমবাড়ি, কেউ গেল ভিখ করতে হেথা-হোথা। বিদেশ-বির্ভুয়ে কতজনা যে মল তার ঠিকানা নাই। তাপর দেশঘাট শুকুল, মা দশভুজার পুজোর সময় যারা বেঁচে ছিল একে একে ফিরল গায়ে। ফিরল যদি তো সে আর এক বেপদ। সে বেপদের কাছে বানের বেপদ কোথা লাগে! সায়েবদের কুঠি উঠে যেয়েছে, বেবাক জমিদারি হকহুকুক কিনেছে চৌধুরী। সেই যে যখের ধন দিয়েছিলেন কত্তা, সেই টাকায় সায়েবদের সবকিছু কিনেছে তখন চৌধুরী। ঘর নাই, দুয়োর নাই, আশ্চয় নাই, চাকরি নাই, কাহারেরা এসে অতান্তরে পড়ল, চোখে পিথিমী অন্ধকার হয়ে গেল। কি হবে? কোথা যাবে? কে চাকরি দেবে?

সায়েবদের আমলে দুখানা পালকি, কুঠিতে চব্বিশ ঘণ্টা হাজির থাকতে হত, ষোলজন বেহারা মোতায়েন থাকত। সায়েবরা ফি বেহারাকে জমি দিয়েছিল দশ বিঘে করে আর বাস্তুভিটে। জমি চাষ কর, খাও দাও, আর সায়েব-মেমকে নিয়ে সাওয়ারী কাঁধে বেড়াও। তার ওপর বশকিশ ছিল, হেথা-হোথা বিয়েশাদির বায়না ছিল। আরও ছিল তোমার নীলের চাষ। তাও সবাই খানিক আধেক দু বিঘে পাঁচ বিঘে করত। তাপরে তোমার সায়েবদের যখন দাঙ্গা হত—এই ধর কোনো ভদ্দশুদুদের জমির ধান ভেঙ্গে নীল বুনতে হত, কি পাকা ধান কেটে নিতে হত তখন কাহারেরা ছিল সায়েব মোয়দের ডান হাত। সায়েবদের লেঠেল যেত। ওই আটপৌরেরাও লেঠেলদের সঙ্গে লাঠি নিয়ে যেত। তারা পাহারা দিত, আর বেহারা-কাহারেরা হাল গরু নিয়ে দিত পোতা জমি ভেঙে, চযেমষে তছনছ করে নীল বুনে দিত, পাকা ধান হলে কেটে-মেটে ছিঁড়ে-খুঁড়ে তুলে নিয়ে চলে আসত বাড়ি। ধান যে যা আনত সে তো পেতই, তার ওপর ছিল লগদ গদ বশকিশ। সে ছিল কাহারদের সোনার আমল। সায়েবরা গেল, কাহারদের কপাল ভাঙল। চোখে অন্ধকার দেখবে না কাহারেরা? আমলই পালটিয়ে গেল। চৌধুরী বেবাক চাকরান জমি খাস করে নিয়েছে এখন। বললে—আমার তো পালকি বইতে হবে না বার মাস, বেহারাদের চব্বিশ ঘণ্টা হাজির থাকতেও হবে না-চাকরান জমি আমি দোব কেনে? কেড়ে নিলে মা জমি। জমি বাড়ি ঘর সব গেল। অন্ধকার, তিভুবন অন্ধকার মা। বুক চাপড়িয়ে কেঁদেছিল কাহারেরা। আমার মা বলত, তখন আমার মা ভরাভরতি সোমত্ত মেয়ে; তার এক বছর পরে আমি প্যাটে হই। মা বলত-কাহারেরা বুক চাপড়িয়ে কেঁদেছিল, সে কান্নায় পুজো-বাড়ির ঢাকের বাদ্যি ঢাকা পড়ে যেয়েছিল। যে প্যাটের জ্বালায় গা ছেড়ে দিয়ে ভিখ মাগতে গিয়েছিল কাহাররা, কুটুমবাড়িতে নেনো হয়েছিল এতদিন মা, সেই প্যাটের জ্বালা পারণ হয়ে গেল। হাঁড়ি চড়ালে না; আন্নাবান্না দূরে থাক, পুজো-বাড়ির পেসাদ–সেও কেউ মাগতে গেল না। তাপরে হল কি মা, শেষকালে নউমী পুজোর দিনে সে এক অবাক কাণ্ড! হঠাৎ চৌধুরী বললে—যা ভিটেগুলো তাদের ছেড়ে দিলাম, ভিটে থেকে তাদের বাস তুলে দোব না, সে বজায় রাখলাম। ওই চাকরানটুকু রইল, কালেকস্মিনে পালকির দরকার হলে বইতে হবে। তবে জমি পাবি না। হ্যাঁ, কৃষাণি মান্দেরী করথা। কাহাররা তবে হপ ছেড়ে বাঁচল। পিতিপুরুষদের ভিটে থাকল মনন্তরায়, এই ভাগ্যি। চৌধুরীকে দু হাত তুলে আশীর্বাদ করে বিজয়া দশমী থেকে ঘর তুলতে লাগল সব পড়ো ভিটেয়। সেও তোমার ওই কত্তামশায়ের দয়া। চৌধুরীকে তিনি স্বপন দিয়ে দিয়েছিলেন অষ্টমীর আতে মানুষকে ভিটেছাড়া করতে নাই। কাহারদিগে তুলে দিলে আমার ওষ হবে তোর ওপর। তাতেই নউমীর দিন সকালে উঠে চৌধুরী ভিটে ছেড়ে দিলে।


থামল সুচাঁদ। সমস্ত মজলিসটা হাঁসুলী বাঁকের উপকথা শুনে অবাক বিস্ময়ে স্তম্ভিতের মত বসে আছে, মদের নেশায় আবেগপ্রবণ মস্তিষ্কে সেকাল ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাথার মধ্যে নেশার স্রোত ছুটছে কোপাইয়ের হরপা বানের মত। সেই বানের উপর কল্পনায় সেকালের নৌকো। ভেসে বেড়াচ্ছে! ভেসে বেড়াচ্ছে চৌধুরী-বাড়িতে ভেসে আসা সেই যক্ষের নৌকোর মত। পঞ্চ-শব্দের বাজনা বাজিয়ে আলো ঝলমল হয়ে যেন ঢেউয়ে ঢেউয়ে নড়ছে। সব ভাম হয়ে বসে আছে। কেউ কেউ ঢুলছে, কার যেন নাক ডাকছে। শব্দ উঠেছে নানা রকমের, হাসি আসে। শুনে।

বসন বড় ঠাণ্ডা প্রকৃতির মেয়ে, সে মদও কম খেয়েছে—মৃদু হেসে রতনের স্ত্রী কুসুমকে বললে—মরণ, নাক ডাকছে কার লো?

কুসুমও চারিদিকে চেয়ে প্রশ্ন করলে—কে লো, কার নাকে শুয়োর ঢুকল বটে? ঘোৰ্ঘোত করছে কে লো?

সুচাঁদ ওদের মুখ নড়া দেখতে পেয়ে মুখটা এগিয়ে এনে প্রশ্ন করলে—অ্যাঁ?

পাখী এবারে উঠে পড়ল বিরক্ত হয়ে। নাঃ, এরা আর ঘুমোবে না। ওদিকে করালীর ঘরেও মজলিসে তেহাই পড়বে না! সে উঠে মাকে বললে আমি শুতে চললাম মা।

–খেয়ে শুবি। আর খানিক বস।

–না।

কুসুম চিমটি কাটলে বসনের পায়ে। কুসুম বসন্তের সখী, সে সবই জানে ভিতরের কথা। বসন্ত একটু হেসে বললে—যা তাই। ঘুমোস না যেন।

সুচাঁদ একটু বিরক্ত হয়ে বললে—কি বলছিস লো? আঁ?

চিৎকার করে বসন্ত বললে—পাখী শুতে চলল। তাই বলি ঘুমোস না যেন।

সুচাঁদ সর্বাঙ্গ দুলিয়ে দু হাত নেড়ে একটা ছড়া কেটে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তেই একটা জোর হক জেগে উঠল কোথা থেকে। হাঁসুলী বাঁকের অন্ধকার চমকে উঠে সতর্ক হল; ওঃ, চৌকিদার হাক দিচ্ছে। সুচাঁদও চমকে উঠেছিল—পাখীকে কথাটা তার বলা হল না, তার বদলে বিস্মিত হয়ে বললেও মা গো! থানাদার হাক দিচ্ছে? ইয়ের মধ্যে? বলি হা বসন, ট্যান পল পেরিয়ে গেল কখন? কই বাদ্যির মত শব্দ তো ওঠে নাই?

সত্যই ট্রেন যাওয়ার শব্দ এখনও ওঠে নাই।

পাখী যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে বলে গেল মদ খেয়ে মেতে আনন্দের আর সীমে নাই। আজ অবিবার মনে আছে? আজ সেই ভোরবেলাতে গাড়ি।

তাই বটে, সে কথা কারও খেয়াল নাই। রবিবার সন্ধ্যায় ট্রেন যায় না, যায় ভোররাত্রে।

–কি?

–আজ অবিবার।

হ্যাঁ, মনে পড়ল সুচাঁদের। পরক্ষণেই ভুরু কুঁচকে বললে—তা শ্যাল ডেকেছে পহরের? শুনেছিল?

–কই, না। যে গল্প তুমি বলছিলে!

ঠিক এই সময়েই খানিকটা দূরে শোনা গেল কার খুব গম্ভীর গলার আওয়াজ-পরম! পরম! পরম আটপৌরে! সঙ্গে সঙ্গে একটা জোরালো টর্চের আলো লম্বা ফালিতে আটপৌরে-পাড়ার অন্ধকার চিরে ফেললে। সকলে আশ্বস্ত হল। না, রাত্রি বেশি হয় নাই। থানার বাবুরা কেউ এসেছে। দাগ দেখতে। মধ্যে মধ্যে সপ্তাহে এক দিন করে আসে থানার বাবুরা। এরা ওই সকালে সকালেই আসে। পরম আটপৌরে দাগী। এই জাঙলে সদৃপোপ-বাড়িতে ডাকাতি হয়েছিল কয়েক বছর আগে। পরম ডাকাতির দলে অবশ্য ছিল না, কিন্তু শুলুক-সন্ধান সে-ই দিয়েছিল। মালও বেরিয়েছিল তার ঘরে। জেল হয়েছিল পরমের। পরম দাগী আসামি।

সকলেই ভাল হয়ে বসল। পুরুষদের মজলিসে গান বাজনা গোলমাল সংযত হল। করালীর বাড়ির মজলিসের বাজনা একেবারে থেমে গেল। থানার বাবু, এ পাড়া পানেও আসবে একবার। আটপৌরে-পাড়ায় এলে এ পাড়াও ঘুরে যায়। এ পাড়ায় দাগী এখন কেউ নাই, কিন্তু এককালে ছিল। এককালে কাহারপাড়ার সকলেই দাগী ছিল বললেই সত্য কথা বলা হবে। সে কারণেও বটে, তা ছাড়া—অজ্ঞান জাত, কার কখন মতিভ্ৰম হয় কে বলতে পারে? তাই বোধহয় বাবুরা দেখে যান। বনওয়ারী বলে—এঁরা যে আসেন, তাতে আমি খুশি। নিজের চোখে দেখে যান। আমাদের রীতকরণ, আর আমাদের মধ্যে যারা মনে মনেও চুলবুল করে তারাও জ্ঞান পাক, সতর হোক, মনকে সামাল দিক।
 
এই যে করালীর মত বেহেট-বেতরিবৎ ছোকরা, এদের শাসন কি শুধু মাতব্বর থেকে হয়? বনওয়ারী ঠিক করে রেখেছে আজ বলবে—দারোগা হোক, ছোট দারোগা হোক, যে আসবে তাকেই বলবে করালীর কথা। রতনকে সে বললে—তোর সেই বড় কুকুড়েটা ঠ্যাঙে বেঁধে নিয়ে আয় দি-নি।

বাবুরা যেদিন আসেন, সেইদিন কুকুড়ে অর্থাৎ মুরগি আর হসকিছু না হলে কয়েকটা ডিম কাহারেরা ভেট দিয়ে থাকে। আজ বড় মুরগি একটা দিতে হবে ঠিক করলে বনওয়ারী। রতন একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠে গেল। উপায় নাই, মাতব্বরের কথা, তা ছাড়া তার ছেলে লটা লচ্ছার করালীর দলে জুটেছে। লটা শাসনের বাইরে; বাপের সঙ্গে ভিন্নই হয়েছে তো শাসন! কিন্তু তবু তো তার বাপের পরান? কি জানি, কখন কুদৃষ্টিতে পড়বে বাবুদের! আগে থেকে একটু বলে রাখা ভাল।

বনওয়ারী হাঁকলে—শিগগির কর। বাবু আসছে।

নীলের বাঁধের উত্তর-পশ্চিম কোণ বরাবর আলোর ছটা উঠে হেঁড়ে তালগাছটার মাথায় গিয়ে পড়েছে। দুটো পাঁচা ছটা পেয়ে কাঁচ কাঁচ শব্দ করে উড়ে গেল। বাবু মাঠ থেকে পাড়ের উপর উঠছেন। জুতোর শব্দ বাজছে পাষাণের মত কঠিন মাটিতে। এইবার সামনাসামনি আসছে টর্চের আলো। বাবু এসে পড়েছেন।

বাবু এসে দাঁড়ালেন। প্রণাম করলে সব। নিমতেলে পানু ছুটে গিয়ে একটা মোড়া নিয়ে এল। বাবু বসেন না ওটাতে, পা দিয়ে দাঁড়ান। বাবু হেসে বললেন—কি রে, আজ যে খুব ধুম দেখি!

নতির স্বীকৃতি জানিয়ে বনওয়ারী একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে মুখের সামনে বা হাতের আড়াল দিয়ে জবাব দিলে—পাছে মুখের আব অথবা গন্ধ গিয়ে লাগে তাই সতর্কতা; বললে–আজ্ঞেন হুজুর, আজ কত্তার থানে পুজো দিলাম কিনা।

বাবু বললেন-আচ্ছা ভাল।

রতন বড় মুরগিটা এনে নামিয়ে দিলে সামনে। টর্চের আলোটা সেটার উপর ফেলে বাবু খুশি হয়ে বললেন—বেশ বড় জাতের যে রে, আঁ?

–আজ্ঞেন হা। আজ কত্তার পুজো দিলাম; আপনাকে কি আর যা-তা দব্য দিতে পারি?

—বেশ, বেশ। তা তোদের মধ্যে করালী কার নাম?

মনে মনে বিস্মিত হল সকলে। বনওয়ারী চকিতে অনুভব করলে বাবাঠাকুরের অদ্ভুত মাহাত্ম্য। ওঃ! এরই মধ্যে করালীর বীতি-চরিত্রের কথা দারোগাকে তিনি জানিয়েছেন। মনে মনে বাবাকে প্রণাম করে বনওয়ারী বললে আজ্ঞে হা, ছেড়াটা বড়ই আজ্ঞেনবেজায় আজ্ঞেন—

করালীকে অভিযুক্ত করার মত বিশেষণ খুঁজে পেলে না বনওয়ারী।

কিন্তু দারোগা বললেন উল্টো কথা—হা, বাহাদুর ছোকরা। ছোকরাকে পাঠিয়ে দিবি থানায়। বকশিশ পাবে কিছু। গোটা পাঁচেক টাকা পাবে।

–বকশিশ পাবে?

–হ্যাঁ। আমরা শিসের কথা ডায়েরি করেছিলাম, ওপরেও গিয়েছিল খবর। এখন যখন। সাপটাই শিস দিচ্ছিল, আর সেই সাপ ওই ছোকরা মেরেছে—সে খবরও পাঠিয়েছি। পাঁচ টাকা। বকশিশ ও পাবে।

বাবু চলে গেলেন। মুরগিটা নিয়ে গেল চৌকিদার।

কাহারপাড়াটা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। তাদের বিস্মিত মনের দৃষ্টির সামনে করালী যেন নতুন মূর্তিতে দাঁড়িয়ে আসছে। গোলালো বুক ফুলে উঠেছে, গালে টোল খেয়েছে, সুন্দর মিষ্টি হাসিতে সুন্দর সাদা দাঁতগুলি ঝিকমিক করছে।

মেয়েদের মজলিসে হঠাৎ গোল উঠল।

করালীর বকশিশের ব্যাপার নিয়ে কথা হচ্ছিল, হঠাৎ তাদের সুমুখ দিয়ে কে ছুটে পালিয়ে গেল।

হাতের চুড়ি বিনরিন শব্দে বেজে উঠল।

—কে? কে?

–পাখী! পাখী! একজন জবাব দিলে—পাখী ছুটে চলে গেল।

–পাখী! পাখী! ও পাখী!—বসন্ত ডাকলে তারস্বরে।

পাখী শুতে যাবার জন্য উঠছিল, এই সময়েই এলেন ছোট দারোগা। সে দরজার মুখে ঢুকছিল, ছোট দারোগা করালীর নাম করতেই থমকে দাঁড়াল। ব্যাপারটা শুনে সেও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ দাওয়া থেকে লাফিয়ে নেমে মজলিসকে পাশ কাটিয়ে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সাদা কাপড়ের দোলায় বাতাসে খানিকটা ঝলক তুলে ছুটে বেরিয়ে গেল।

বসন্ত ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে এল-পাখী শোন! পাখী!

দূর অন্ধকারের ভিতর থেকে জবাব এল-না। আমি চললাম।

পাখী বললে—যার ওপর আমার মন পড়েছে, আমি তারই ঘরে চললাম।

হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় তুফান বানে ঝাপ খেয়ে যুবতী বউ পালায় যার উপরে মন পড়ে তার কাছে, তার গাছের উপরে তার পাতা সংসারেই গিয়ে উঠে বসে। পাখীর মা বসন্ত যৌবনে নিত্য রাত্রে বেশভূষা করে একাই চলে যেত চৌধুরীবাবুদের গায়ের ধারের বাগানে, কোনোদিন ফিরত গভীর রাত্রে, কোনোদিন ভোরবেলা। পাখীও আজ চলে গেল ছুটে করালীর বাড়ি।

এরপর আসছে একটা কুৎসিত ঝগড়ার পালা। তারপর হয়ত লাঠি-মারপিট মাথা ফাটাফাটি! করালী তো হটবার পাত্র নয়!



ঝগড়ার পালাটা জমিয়ে তুললে সুচাঁদ। কর্কশ কণ্ঠে উচ্চকণ্ঠে সে গালিগালাজ আরম্ভ করলে। করালীর নিজের মা বোন কি কোনো স্ত্রীলোক আত্মীয়া নাই। কিন্তু নদিদি আছে। নসুদিদি এতক্ষণ নাচছিল, পায়ে নূপুর বেঁধেই সে বেরিয়ে এল ঝগড়া করতে। মেয়েদের মত কোমরে কাপড় জড়িয়ে দুই হাতের বুড়ো আঙুল নেড়ে অঙ্গ দুলিয়ে সুচাঁদের সঙ্গে সমান। জোরালো ভাষায় ঝগড়া জুড়ে দিলে।

সকলেই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে নিমতেলে পানু। হঠাৎ সকলে চমকে উঠল। একটা কঙ্কালসার মানুষ টলতে টলতে এসে দাঁড়িয়েছে মজলিসের সামনে। এখনও টলছে। কে? কে?—ও, নয়ান এসেছে। হেঁপো রোগী নয়ান। ওই নয়ানের সঙ্গেই ছেলেবেলায় পাখীর বিয়ে হয়েছিল। তখন অবশ্য নয়ান হাঁপানির রোগী ছিল না, এবং নয়ান তখন ছিল পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে ভাল পাত্ৰ। নয়ানের ঠাকুরদাদা ছিল সে আমলে কাহারপাড়ার মাতব্বর। সেই আমল থেকেই চৌধুরী-বাড়ির ভাগজোতদার নয়ানেরা। দু বিঘা নিজের জমিও আছে নয়ানের। সেইসব দেখেই বিয়ে দিয়েছিল সুচাঁদ। হঠাৎ নিউমোনিয়া হয়ে নয়ান ঘায়েল হয়ে গেল প্রথম যৌবনেই। সারল, কিন্তু পানি ধরে গেল। পাখী বলে—যে গন্ধ ওর নিশেষে আর যে বুকের ডাক! সে সহ্য করতে পারে না, তার ভয় লাগে। সে কিছুতেই যাবে না ওর বাড়ি। আজ দু বৎসর ধরেই এই বিরহের পালা চলছে, কিন্তু আজও পর্যন্ত পূর্ণ বিচ্ছেদ হয় নাই। আজ হয়ে গেল। মৃতপ্রায় নয়ান এমন ক্ষেত্রে না বেরিয়ে পারলে না। টলতে টলতে এসে বসে পড়ল, তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে চাপড় মেরে বনওয়ারীকে বললে—তুমি এর বিচার কর। বিচার কর তুমি।

কিন্তু বনওয়ারী বসে রইল মাটির পুতুলের মত। সে যেন কেমন হয়ে গিয়েছে। করালী এবং পাখীর ঘটনায় তার বার বার মনে পড়ছে সন্ধ্যার কথা; মনে পড়ছে কালোশশীকে। সে উৎসাহ পাচ্ছে না। সে যেন মাথা তুলতে পারছে না।

নয়ান কান্নায় চিৎকার করে উঠল—মাতব্বর।

বনওয়ারী হতভষের মত বললে—কি বলব?

রতন বললে–না না। এ ভারি অল্যায়। তুমি চুপ করে থাকলে হবে না বনওয়ারী। গাঁ-সুদ্ধ ছেলে মাটি হল ওই হারামজাদার সঙ্গে জুটে।

বনওয়ারী তবু স্তব্ধ।

ওদিকে হঠাৎ মেয়েদের ঝগড়ার আসরের সুর পালটে গেল। অকস্মাৎ সুচাঁদ আৰ্তনাদ করে উঠল—মর্মান্তিক আর্তনাদ। কি হল? নসু মারলে নাকি ধরে? প্রহ্লাদ, রতন, নিমতেলে পানু ছুটে গেল। কি হল?

সুচাঁদ আৰ্তনাদ করে লাফাচ্ছে। মুখে একটা ভয়ার্ত শব্দ শুধু। চোখের দৃষ্টিতে বিভীষিকার ছায়া। সে যেন মৃত্যুকে দেখছে চোখের সম্মুখে।

বুঝতে বাকি রইল না কারও কিছু।

ব্যাঙ দেখেছে সুচাঁদ। ব্যাঙকে সুচাঁদ মৃত্যুদূতের মত ভয় করে। ব্যাপারটা ঘটেছে এই–

সুচাঁদ প্রচণ্ড চিৎকারে গালিগালাজ করছিল। করালী হঠাৎ এসে শাসিয়ে তাকে বলে—চুপ কর, নইলে দেব ছেড়ে।

অর্থাৎ ব্যাঙ ছেড়ে দেবে।

সুচাঁদ মানে নাই সে কথা। ব্যাঙ যে কেউ তার গায়ে ছেড়ে দিতে পারে—এ তার ধারণার অতীত ছিল। চন্ননপুরে বাবুদের ছেলেরা কখনও কখনও এমন ঠাট্টা করে। কিন্তু এ গায়ে এমন সাহসই বা কার, এমন হৃদয়হীনই বা কে? কেরালীর যে সেই সাহস সেই হৃদয়হীনতা আছে, তা সে জানত না। কিন্তু করালী সত্যিই একটা ব্যাঙ ধরে এনেছিল। সুচাঁদ ক্ষান্ত হল না দেখে, সেটাকে সে তার উপর ছুঁড়ে দিয়ে নসকে টেনে নিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছে।

পাখী খিলখিল করে হাসছে করালীর বাড়িতে।

এদিকে বসন্ত দুই হাতে জাপটে ধরেছে মাকে। সুচাঁদ তবু লাফাচ্ছে। মেয়েরা সব মুখে কাপড় দিয়ে হাসছে। প্রহ্লাদ ব্যাঙটা ফেলে দিয়ে এক বাটি মদ এনে সুচাঁদের মুখের কাছে ধরলেখাও পিসি। চোখ বন্ধ করে তৃষ্ণার্তের মত পান করে নিলে সুচাঁদ, তারপর বুকে হাত দিয়ে প্রহ্লাদের কোলের মধ্যেই নিজেকে এলিয়ে দিল।—আঃ আঃ! তারপর হাউহাউ করে কেঁদে উঠল।

প্ৰহ্লাদ বললে—ভয় নাই, ফেলে দিয়েছি, ফেলে দিয়েছি ব্যাঙ।

ওদিকে করালী পাখীকে নিয়ে তখন বেরিয়ে পড়েছে বাঁশবাঁদি থেকে। এই রাত্রির অন্ধকারেই তারা যাবে চন্ননপুরে। নদিদিও চলল। বনওয়ারীর সঙ্গে বিবাদ করে কাহারপাড়ার সকলকে বিরোধী করে থাকতে তার সাহস হল না।

দূরে রেললাইনের উপর সিগ্নালের লাল আলো জ্বলছে। ওই চন্ননপুর। করালীর দুর্গ ওইখানে। ওখানে যেতে কাহারদের সাহস নাই। নসুবালা হঠাৎ গান ধরলে। করালী ধমক দিয়ে বললে—চুপ কর। সে ভাবতে ভাবতে চলছে, কেমন করে এর শোধ তুলবে সে। শোধ তাকে তুলতেই হবে।

ওদিকে বনওয়ারী ভয়ঙ্কর মূর্তিতে করালীর বাড়িতে এসে দেখলে, করালী নেই—বাড়ি খাঁ খাঁ করছে।
 
কয়েক দিন পর।

হাঁসুলী বাঁকে পৃথিবীর সঙ্গেই যথানিয়মে রাত্রি প্রভাত হয়। সেখানে ব্যতিক্রম নেই। গাছে গাছে পাখি ডাকে, ঘাসের মাথায় রাত্রের শিশিরবিন্দু ছোট ছোট মুক্তার দানার মত টলমল করে। বাঁশবনের মাথা থেকে, বনশিরীষ নিম আম জাম কঁঠাল শিরীষ বট পাকুড়ের মাথা থেকে টুপটাপ করে শিশিরবিন্দু ঝরে পড়ে মাটির বুকে। যে ঋতুতে যে ফুল ফোটার কথা সেই ফুলই ফোটে। পূর্ব দিকে নদীর ধার পর্যন্ত অবারিত মাঠের ওপারে—কোপাইয়ের ওপারের গ্রামে গোপগ্রামের চারিপাশে গাছপালার মাথায় সূর্য ওঠে। কিন্তু কাহারেরা জাগে সূর্য ওঠার অনেক আগে। পূর্বের আকাশে তখন শুধু আলোর আমেজ লাগে মাত্র, পূর্ব-দক্ষিণ কোণে শুকতারা জ্বলজ্বল করে। কাহাররা ওঠে সেই সকালে। আপন আপন প্রাতঃকৃত্য সমাধা করে মেয়েরা ঘরে-দোরে জল দেয়, মাজুলি দেয়, সামান্য যে বাসন কয়েকখানি রাত্রে উচ্ছিষ্ট হয়ে থাকে সেগুলি মাজে। গরু ছাগল বার করে তাদের জায়গায় বাধে। হাঁসগুলিকে ছেড়ে দেয়, কলরব করে তারা ছুটে গিয়ে নামে নীলের বাঁধের জলে, নেমেই ছুটে আসে ঘাটে, এঁটো বাসনের খাদ্যকণাগুলো মুখ ড়ুবিয়ে খুঁজে খুঁজে খায়। মুরগিগুলোকে ছেড়ে দেয়, তারা ছুটে যায় আঁস্তাকুড়ে, সারের গাদায়। পুরুষেরা প্রাতঃকৃত্য সেরে এই সকালেই ঘরে দোরে যে মাটির কাজগুলি থাকে, কোদাল নিয়ে সেই কাজগুলি সেরে ফেলে। পাষাণের মত মাটি-মেয়ে-পুরুষে আগের দিন সন্ধ্যায় কলসিতে ভরে জল তুলে ভিজিয়ে রাখে, সকালে কাহার মুনিষ তার উপর কোদাল চালায়। মাটির কাজ কিছু-না-কিছু থাকেই। পুরনো দেওয়াল মেরামত চলতে থাকে ধীরে সুস্থে। নূতন ঘর যদি কেউ করে, তার কাজ চলে দীর্ঘদিন ধরে। কিছু না থাকলে বাড়ির ধারে শাক-পাতার ছোট ছোট ক্ষেত কোপায় তারা। বাড়ির গাছা পেটের বাছার মতই গেরস্থের সহায়। গোটা শীতকালে এই ধারা।

এইসব সেরে তারপর কাহারেরা কাজে বার হয়।

সুচাঁদ ভোরে ওঠে। বঁটা দিয়ে উঠোন পরিষ্কার করতে করতে তারস্বরে গাল দিচ্ছে। আজ আর তার ভাষা অশ্লীল নয়—মর্মান্তিক অভিশাপ-তীক্ষ্ণ, এবং সে অভিশাপের মধ্যে দুঃখ লাঞ্ছনা, নিয়তির নিপুণ বিধানের মত স্তরে স্তরে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে সাজানো।

—যে ‘অক্তের’ ‘ত্যাজে’ এমন বড় হয়েছে, সে অক্ত জল হয়ে যাবেন তোমার। ‘গিহিনী ‘ওগ’ হবে, ‘ছেরউগী’ হয়ে পড়ে থাকবে, ওই পাথরের মত ছাতি ধসে যাবে, হাড় পাজর ঝুরঝুর করবে। যে গলার ত্যাজে হাঁকিয়ে পেঁচিয়ে ফিরছ, সেই গলা তোমার নাকী হয়ে পাখির গলার মত চি-চি করবে। যে হাতে তুমি আমাকে ব্যাঙ দিয়েছ, যে হাতে তুমি বাঁশবনে আগুন লাগিয়ে মা-মনসার বিটীকে পুড়িয়ে মেরেছ, সেই হাতদুটি তোমার পড়ে যাবে, কাঠের মত শুকিয়ে যাবে। দ্যাবতাকে যদি আমি পুজো করে থাকি, অতিথকে যদি আমি সেবা করে থাকি, তবে আমার কথা ফলবে—ফলবে ফলবে। হে বাবা কত্তা, হে মা-মনসা, হে বাবা জাঙলের ‘কলারুদ্দু’, হে মা চন্ননপুরের চণ্ডী, হে মা বাকুলের বুড়িকালী, হে বাবা বেলের ধম্মরাজ, তোমরা এর বিচার কোরো–বিচার কোরো।


বোধ করি হঠাৎ সুচাঁদের মনে পড়ে গেল চোখের কথা—চোখ নিয়ে তো কোনো অভিশাপ দেওয়া হয় নাই! সঙ্গে সঙ্গে চোখ নিয়ে অভিশাপ দিতে আরম্ভ করলে। ওই যে তোমার ড্যাবা চোখ, ওই চোখ তুমি হারিও। দিন ‘আত’ জল ঝরে ঝরে ছানি পড়ুক। কানা হয়ো তুমি—কানা হয়ো তুমি—কানা হয়। ওই ড্যাবা চোখ তোমার ‘আঙা’ ‘অক্তের’ ডেলার মতন কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে এসে ‘বিভীকার হয়ে যায় যেন।

এটি একটি বিশেষত্ব হাঁসুলী বাঁকের কাহারপাড়ার। ঝগড়া হলে সে ঝগড়া এক দিনে মেটে না। দিনের পর দিন তার জের চলতে থাকে এবং প্রাতঃকালে উঠেই এই গালিগালাজের জেরটি টেনে তারা শুরু করে রাখে। কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে থামে। আবার জিরিয়ে নিয়ে অবসর সময়ে নিজের ঘরের সীমানায় দাঁড়িয়ে বিপক্ষ পক্ষের বাড়ির দিকে মুখ করে এক-এক দফা গালিগালাজ করে। এবং কাহারদের ঝগড়ায় এই গালিগালাজের এই বাধুনিটি পুরুষানুক্ৰমে চলে আসছে, একে কলহ-সংস্কৃতি বলা চলে। তবে সাধকভেদে মন্ত্রের সিদ্ধি—এই সত্য অনুযায়ী সুচাঁদ এই বৃদ্ধ বয়সেও সর্বশ্রেষ্ঠা। ওদিকে আরও একজন গাল দিচ্ছে করালীকে—সে হল নয়ানের মা। সে গাল দিচ্ছে করালীকে একা নয়, পাখীকেও শাপ-শাপান্ত করছে।


হাঁপানির রোগী নয়ন উঠে বসে কাশছে আর হাঁপাচ্ছে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বুকের উপর ধর্মরাজের এক মোটা মাদুলি হাঁপানির আক্ষেপে চামড়া-ঢাকা পাজরার সঙ্গে সঙ্গে উঠছে আর নামছে। তার বাড়ির সামনেই একই উঠানের ওদিকে রতনের বাড়ি। রতন কোদাল চালানো শেষ করে বসে হুঁকো টানছিল আর গালাগালি শুনছিল।

হাঁপানিটা একটু থামতেই নয়ান দাওয়ার বাঁশের খুঁটিটা ধরে দাঁড়াল। চোখের দৃষ্টিতে তার অমানুষিক প্রখরতা ফুটে বেরুচ্ছে। এইসব দীর্ঘদিনের রোগীর চোখের রঙ বোধহয় একটু বেশি সাদা হয়। নয়ত জীর্ণ দেহ এবং কালো রঙের জন্যই নয়ানের চোখ দুটো বেশি সাদা দেখাচ্ছে।

রতন বললে—উঠলি যে?

–হুঁ।

—কোথায় যাবি?

—যাব একবার মুরব্বির কাছে।

—যেতে হবে না। বস।

না। এর একটা হেস্তনেস্ত–

—মুরুব্বি বেরিয়ে যেয়েছে।

–বেরিয়ে যেয়েছে! তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে রতনের দিকে, যেন অপরাধটা রতনের। নয়ান আবার প্রশ্ন করলে—এই ‘সমকালে গেল কোন ভাগাড়ে? কেউ তো এখনও যায় নাই?

রতন বললে–মাইটে ঘোষ এই সকালের ‘ট্যানেই’ কোথায় যাবে; ঘোষেদের চাকর এয়েছিল, ভারী মোট আছে—নিয়ে যেতে হবে চন্ননপুরের ইস্টিশান।

—তা হলে? হতাশ হয়ে পড়ল এবার নয়ান।

—তা হলে আর কি করব? বাড়িতে বসে আগে জল গরম করে আরসোলা সিজিয়ে খা। হাঁপটা নরম পড়ক। হাজার হলেও রতনের বয়স হয়েছে, মাতব্বরের বয়সী, বন্ধুলোক; খোদ মাতব্বর না হলেও প্রবীণ। স্নেহবশেই সে উপদেশ দিলে। নয়ানের মা বাসন মাজতে মাজতে গাল পাড়ছিল, সে হঠাৎ ছাইমাখা হাতে এগিয়ে এসে হাত দুটো রতনের মুখের কাছে নেড়ে বললে—তুমি তো মাতব্বরের ডান হাত। সলা-শুলুক-গুজগুজ তো খুব! বলি, মাতব্বরের এ কোন দিশী বিচার, এ কোন ঢঙের মাতব্বরি, শুনি! এ অন্যায়ে একটি কথাও বললে না তোমার মাতব্বর? বিচার করবার ভয়ে সকালে উঠে পালাল?

রতন বললে–তা আমি কি বলব? তোমরাই তাকে বোলো।

—বলব বৈকি, একশোবার বলব। ছাড়ব আমি? জমিদারের কাছে যাব, থানা পুলিশ করব।

—তা যা খুশি তুমি করতে পার। তবে সকালে উঠে বিচারের লেগে মাতব্বর বসে থাকবে—এ তোমাদের ভাল ‘নেকরা’ বটে।


নয়ানের মা বললমাতব্বর তোমার খুব ‘আঁতের’ নোক-তুমি বল কেনে, শুনি।


বিরক্ত হয়ে রতন হুঁকাটি রেখে গামছাখানা টেনে গায়ে চাদরের মত ফেলে বেরিয়ে পড়ল। সূর্য উঠে পড়ছে গোপগ্রামের গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে। রোদ এসে বাঁশবাঁদির ঘরগুলির চালের উপর পড়েছে; বনওয়ারীর সদ্য-ছাওয়া চালের নতুন খড়ের উপর যেন সোনা ঢেলে দিয়েছে।

একা রতন নয়, গ্রামের পুরুষেরা সকলেই বেরিয়েছে নীলের বধের উত্তর পাড় থেকে সরু আঁকাবাকা পথ বেয়ে নামছে জাঙলে যাবার মাঠে পথে।

মেয়েরাও সব এরপর বার হবে। সাতটার ট্রেন তাদের নিশানা।

হাঁসুলী বাঁকের এই জীবনই স্বাভাবিক জীবন। মন্থর গতিতে, পায়ে হাঁটা আলপথে। পদাতিকের জীবন তাদের। কথাটার মধ্যে একবিন্দু অতিরঞ্জন নাই। হাঁসুলী বাঁকে গরুর গাড়ির পথ পর্যন্ত নাই। জাঙল গ্রাম পর্যন্ত গরুর গাড়ির পথ এসে শেষ হয়েছে। বহু আগে এগুলি ছিল চারণভূমিতে গরু নিয়ে আসবার পথ। ‘নিয়ে আসবার বলছি এই জন্য যে, বহু প্রাচীন ভদ্র মহাশয়দের গ্রামওই চন্দনপুর থেকে সেকালে গরু চরতে আসত এই হাঁসুলী বাঁকের চরে। জাঙল পর্যন্ত ছিল রাস্তা গো-পথ, তারপরই ছিল হাঁসুলীর ঘেরের মধ্যে গোল তক্তির মত চারণভূমি। তারপর নীলকুঠির সাহেবেরা এসে ডাঙায় কুঠি কাঁদলে, গোচরভূমি ভেঙে জমি করে সেচের পুকুর কাটিয়ে বাঁশবাঁদির মাঠে নীল চাষ ও ধান চাষের পত্তন করলে, এই পুকুরপাড়ে কাহারবসতি বসালে। যে পথে চন্দনপুরের গরুর পাল আসত, সে পথে গরু আসা বন্ধ হল। ওই পথকে মেরামত করে তার উপর চলতে লাগল নীল কুঠির মালের গাড়ি এবং সাহেবদের। পালকি ও ঘোড়া। চন্দনপুরের ভদ্র মহাশয়দের জাঙলের মাঠে জমিজেরাত আছে চিরকাল, তাদের গরুর পালের সঙ্গে গাড়ি যাতায়াত করত এই পথে মাঠের ধান ঘরে নিয়ে যেত, সেই গরুর গাড়ির যাতায়াত বজায় রইল শুধু। আজও সে পথে তাদের ধান-কলাই-গুড় বোঝাই গাড়ি চলে। বাঁশবাঁদির কাহারদের পায়ে-চলা-পথের চেয়ে ভাল পথের দরকারও ছিল না। কোনো কালেই। তারা পায়ে হেঁটেই চলে, সে হিসাবে পদাতিক, কিন্তু সেকালে তারা পদাতিক ছাড়া আরও কিছু ছিল; পেশা হিসাবে ছিল বাহক, কাধে পালকি নিয়ে সাহেব-মেমদের বইত, বর-কনে বইত। কখনও কখনও জ্ঞানগঙ্গা নিয়ে যাবার জন্য বায়না আসত। সকলের আগে যে। বেহারা থাকত, সে সুর করে বলত সওয়ারীর ছড়া, অন্য সকলে সমস্বরে হাঁকত–প্লো-হিঁ প্লে-হি–প্লো-হিঁ। চারিদিক সরগরম করে তারা চলত দ্রুতবেগে। আজকাল তাদের এ পেশাটা গৌণ হয়েছে। বিয়ে ছাড়া ওদের আর ডাক পড়ে না এই কর্মের জন্য। তবে বহনের কাজটা বজায় আছে, পালকি-বহা কাধে ভার বয়। সে দেড় মন বোঝা নিয়ে যায় দশ ক্রোশ পর্যন্ত। বিশ ক্রোশও যায়, তবে পথে এক রাত্রি বিশ্রাম করতে হয়। মাথায় বোঝা বইতে হয় আজকাল বেশি। বাহকত্ব ছাড়া চালকত্ব গৌরবও আছে; হালের বলদ চালায়, গরুর গাড়িও চালায়। সুতরাং সে গতি আরও মন্থর, তাই পায়ে-চলাপথ ছাড়া অন্য পথের অভাব তারা অনুভব করে না।
 
পথ চলতে চলতে হুঁকো টানে, মধ্যে মধ্যে হাত বদল করে গল্প হয়। এই মন্থর জীবনের গতানুগতিক কথাই হয় পরস্পরের মধ্যে। রোমন্থন বলা যায়। আজ কিন্তু সকলেই একটু উত্তেজিত। আজ কথা চলছে গত কয়েক দিনের ঘটনার আলোচনা। তার মধ্যে বনওয়ারীর ব্যবহারের সমালোচনাই বেশি। বনওয়ারীর অন্যায় হয়েছে—এ কথা সকলেই একবাক্যে বলছে। নিমতেলে পানু বেশ গুছিয়ে এবং চিবিয়ে কথা বলতে পারে। সে-ই বলছিল মাতব্বর যদি শাসন করতে ‘তরাস’ করে, তবে দুষ্ট নোকে ‘অল্যায়’ করলে তার শাসন হবে কি করে? ‘আজা’ হীনবল হলে ‘আজ্য’ লষ্ট। এতবড় ‘অল্যায়ে’ মুরুদ্ধি বাক্যিটি বার ক বলে না মুখ থেকে।

—‘নিচ্চয়’। তবে চলুক এই করণ কাণ্ড; তোমার পরিজনকে’ আমি টেনে নিয়ে যাই। আমার পরিজন গিয়ে উঠুক ‘অতনার’ ঘরে।—কথাটা বললে প্ৰহাদ।

রতন পিছন থেকে প্রতিবাদ করে উঠল—আমার নাম মাইদি কোরো না বলছি। আমি কাল। ‘সব্বাগ্যে’ মাতব্বরকে বলেছিলাম, এ ‘অল্যায়’ হচ্ছে মাতব্বর। তবে নিজের নিজের বউ বিটী নিজে নিজে না সামলালে মাতব্বরই বা করবে কি? মাতব্বর পাহারা দিয়ে বসে থাকবে?

প্রহ্লাদ চিৎকার করে উঠল—বলি হা শাপলা, মাতব্বর করালীকে শাসন করতে পারত।

সকলের পিছনে নীলের বাঁধের ঘাটের উপর থেকে চিৎকার করে কেউ বললে—কার দশ হাত ল্যাজ গজালছে রে শুনি, করালীকে শাসন করবে, তার নাম কি?

শব্দ লক্ষ্য করে সকলে চকিত হয়ে তাকিয়ে দেখলে, বক্তা করালী নিজে।

নীলের বাঁধের উত্তর-পূর্ব কোণের পথটা বেয়ে ঘাটে করালী উঠছে। চন্দনপুর থেকে আসছে নিশ্চয়। সেই সেদিন রাত্রে পালিয়েছে পাখীকে নিয়ে, ফিরছে আজ সকালে। সম্ভবত কোনো জিনিসপত্র নিতে এসেছে। দাঁড়িয়ে আসছে। সঙ্গে তার পাখী ও নসুদিদি।

রতন প্রহ্লাদ পানু এবং অন্য সকলেই করালীর কথায় ফিরে দাঁড়াল।

তবু তাচ্ছিল্যভরে হাসছে করালী। পানু অন্য সকলকে বললে—দেখ সব, একবার ভাল করে দেখ। পিতিকার করতে না পার, তোমরা গলায় দড়ি দাও গা।

চিৎকার করে উঠল প্ৰহ্লাদ-কিলিয়ে তোমার দাঁত ভেঙে দেব গা।

করালী হা-হা করে হেসে বললে—এস কেনে একা একা, কেমন মরদ দেখি!

পাড়ের উপর থেকে পাণুদের দলের অনুসরণ করে নেমে এল মাথলা এবং নটবর। ওদেরও গন্তব্যস্থল জাঙল, ওরাও সেখানে কৃষাণি করে।

রতন বললে–চল চল। এখন আর পথের মাঝে দাঁড়িয়ে গায়ের ‘খিটকাল’ করতে হবে না।

সে ব্যাপারটাকে চাপা দিতে চায়। করালীর দলে রতনের ছেলেও রয়েছে যে।

করালী কিন্তু অকুতোভয়, কারও ভয়ে সে চাপা দিয়ে রাখতে চায় না। সে চেঁচিয়েই বলে দিল—তোমাদের মাতব্বরকে দেখেছি সেদিন। তোমরাও দেখতে চাও তো এস।

ঘাড় নেড়ে ভুরু নাচিয়ে সে বললে—সেদিন একহাত মুরুক্মির সঙ্গে হয়ে যেয়েছে।

সকলের কাছে এ উক্তিটা একটা অসম্ভব সংবাদের মত। বনওয়ারী কোশকেঁধেদের বংশের ছেলে, পাকা বাঁশের মত শক্ত মোটা হাড়ের কাঠামো তার। কাহারপাড়ায় কেন, কাহারপাড়া, আটপৌরেপাড়া, জাঙল তিন জায়গায় তার মত জোরালো মুনিষ নাই; বনওয়ারী শক্ত মুঠোয় লাঙল কষে টিপে ধরলে টানতে মাঝারি বলদের পিঠ ধনুকের মত বেঁকে যায়, ঘাড় লম্বা হয়ে যায়। তার সঙ্গে একহাত হয়ে গিয়েছে কালীর? বলে কি শয়তান ডাকাত? শুধু তাই নয়, শয়তানের কথার ভঙ্গির তাচ্ছিল্যের মধ্যে যে ফলাফলের ইঙ্গিত রয়েছে, সে কি কখনও হতে পারে—না হয়। কিন্তু সকলের মধ্যে মুখের সামনে জোরগলায় যে একটা স্পষ্ট সত্যের ঘোষণা রয়েছে তাও তো মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে না। সকলে অবাক হয়ে এ ওর মুখের দিকে চাইলে।

করালীকিঙ্কর এতেও ক্ষান্ত হল না; সে আরও একদফা হেসে নিয়ে বললে—তোদের মাতব্বর তো মাতব্বর, তাদের কত্তার বাহনকেই দেখেলিলাম

সঙ্গে সঙ্গে তার পিঠে একটা ধাক্কা দিয়ে শাসন করে পাখী বললে—আবার! আবার! আবার!

হি-হি করে হাসতে লাগল করালী। নদিদি তো হেসে উল্টে পড়ল। পাখীকে সে বললে— দে বুন, দে, আরও ঘা কতক দে। আমি লারলাম ওকে বাগ মানাতে—আমি লারলাম। তু দেখ। বুন এইবার। গদাগ কিল মারবি, আমি বলে দিলাম।

করালীর এই চরম স্পধিত উক্তিটি প্রত্যক্ষ সত্য। কত্তার বাহন অর্থাৎ ওই চন্দ্রবোড়া। সাপটাকে মারার কথা তো সকলে চোখে দেখেছে। কিন্তু সে কথাটাকে এমন স্পৰ্ধায় শাণিত করে বলায় সকলে আশ্চর্য রকম সঙ্কুচিত হয়ে গেল।


করালী পাখী নস্যু কিন্তু উল্লাস করতে করতেই চলে গেল। কোনো কথা না বলে মাথলা। নটবরও মাঠে নেমে পাশ কাটিয়ে তাদের অতিক্রম করে চলে গেল। ওরা নীরবেই গেল—নটবর হুঁকোটা টানছিল, বাপকে দেখে একটু খাতিরই দেখালে, কাছ বরাবর এসে নামালে হুঁকোটা একবার। ওরা চলে যেতেই রতনের দলের চমক ভাঙল। সে-ই ছিল সর্বাগ্রেসে চলতে আরম্ভ। করলে সকলেরই পা চলল সঙ্গে সঙ্গে। চলল কিন্তু নীরবে। খবরটা শুনে যেন সকলের কথা শেষ। হয়ে গিয়েছে।

হঠাৎ একটা ডাক এল সামনে থেকে। জাঙলের আমবাগান পড়ে সর্বাগ্রে। ওই বাগানের মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ। পথের উপর দাঁড়িয়ে হেদো মোড়ল তার খুব মোটা গলায় ডাকছে— অ্যাই! অ্যাই বেটা রতনা! হারামজাদা! ওরে গুখোর বেটা!

রতন জোরে হাঁটতে শুরু করল। প্রহ্লাদ বললে ওরে বাবা রে, মোড়ল ‘এগে’ যেয়েছে। লাগছে!

রতন বললে—সঁচিল দেবার ‘জাওন’ খারাপ হয়ে যেছে, কাল দিন যেয়েছে পাচিল দেবার।

পানু বলে উঠল—আমার মুনিব মশায় আবার কি করলে কে জানে? আলু তুলতে হবে; পরশুই লাগবার কথা। কত্তার পুজোর ‘পাট’ পড়ে গেল। বললাম তো বলে দিয়েছে-উ সব আমি জানি না। আলু খারাপ হলে আমি নগদা মুনিষ লাগাব। তোমার ভাগ থেকে কাটব।

প্ৰহ্লাদ পানুকে বললেহা রে পানা, তোর মুনিবের পাল-বাছুরটার ক দাঁত হল রে?

—দু দাত।

এবারে জোয়াল গতাবে?

–তা খানিক-আধেক করে না গতিয়ে রাখলে, চার দত হলে তখন কি আর উ জোয়াল লেবে ঘাড়ে?

—ত্যাজ কেমন হবে বুঝছি?

—ওঃ, বেপৰ্য্যয় ত্যাজ! ‘লেঙুড়ে হাত দেয় কার সাধ্যি। পাচন পিঠে ঠেকলে চার পায়ে লাফিয়ে ঝাপিয়ে ঘুরবে। ওকে বেচে মুনিব পিটবে একহাত।

প্ৰহ্লাদ বললে—আমার মুনিবকে আমি বলছিলাম বাছুরটার কথা।

—লতুন গরু কিনবে নাকি তার মুনিব?

–হ্যাঁ। এবারে কিনবে। তিন বছর বলে বলে এ বছর ‘আজি’ করালছি।

–অ্যানেক টাকা লেবে আমার মুনিব। মাটি থেকে তুলতে হবে টাকা তোর মুনিবকে।

–ওরে না। আমার মুনিব মাটিতে পুঁতলে আর তোলে না, আধ ‘বাখার’ ধান ছেড়ে দেবে। ধানও ছাড়তে হবে না, আলুর টাকাতেই হয়ে যাবে, লাগবে না। তিন বিঘে আলু রে! সোজা কথা! কাঠা-ভূঁই দু পসুরি খোল দিয়েছে, ‘সালপেট আলুমিনি’ দিয়েছে। কাঠাতে ফলন দু মন, তা হেসে খেলে—হ্যাঁ, তা খুব।

ওরা অ্যামোনিয়াকে বলে ‘আলুমিনি’, অ্যালুমিনিয়মকে বলে—‘এনামিলি’।

—অতনকাকার মুনিবের আলু কেমন গো? গাছ তো হলছিল বাহারের!

রতনের উত্তর দেবার অবসর নাই। খুব দ্রুতপদেই সে হেঁটে চলেছে। ইচ্ছে হচ্ছে এক লাফ দিয়ে মনিবের সামনে হাজির হয়। সত্যিই তার মনিবের ক্ষতি হয়েছে। মাটির ‘ক’ ভারি হিসাবের জিনিস। তা ছাড়া পরিশ্রমই কি কম? গোটা একদিন মাটি কেটে, তাতে জল দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া হয়েছে, পরের দিন ফের দুপুর কি তিন প্রহরের সময় আবার একদফা জল ঢালা হয়েছে, পরের দিন ফের কাটা, জল দেওয়া এবং খুব করে ছাঁটা হয়েছে তার উপর আবার জল ঢেলে দেওয়া হয়েছে। সেই জল শুষে সেই জলে ভিজে মাটি তৈরি হয়। বেশি নরম থাকলে চলে না, বেশি শুকিয়ে গেলে তো ‘কাজ খারাবি’ই হয়ে গেল। সেই আবার নতুন করে পাট করতে হবে। নিজের হয় তো সে কথা আলাদা, এ হল মনিবের কাজ। খারাপ হলে মানবে কেন মনিব? তার উপর তার মনিব যে লোক! একবারে মোষের ‘কোধ’। রাগ হলে আর নিজেকে সামলাতে পারে না। প্রকাণ্ড পাথুরে গড়নের ভারী চেহারা, মোটা গলা, থ্যাবড়া নাক, কোঁকড়া চুল, আমড়ার আঁটির মত চোখতাও আবার ‘লালব’, মোটা বেঁটে আঙুল, বাঘের মত থাবা, বুনো দাঁতাল শুয়োরের মত গোঁ। রাগ হলেই গাঁ-গাঁ শব্দে চিৎকার করে দমাদম কিল মারতে আরম্ভ করবে। ঠিক যেন মা-দুর্গার অসুর।

রতনও বেশ মজবুত মুনিষ। লম্বা চেহারা লম্বা ঢঙের ইস্পাতে গড়া মানুষ। বয়স কম হয় নাই, দু কুড়ি পার হয়ে গিয়েছে—আড়াই কুড়ি হবে কি হয়ে গিয়েছে। তবু এখনও পর্যন্ত গায়ের চামড়া কেউ চিমটি কেটেও ধরতে পারে না। সকাল থেকে হালের মুঠো ধরে, দুপুরবেলা হাল ছেড়ে কোদাল ধরে—সাড়ে তিনটের ট্রেন কোপাইয়ের পুলে উঠলে তবে কাজ ছাড়ে। ধান রোয়ার সময় হলে কোদাল ছেড়ে তখন নামে বীজের জমিতে। সন্ধে পর্যন্ত বীজ মেরে তবে ওঠে। দেড় মন বোঝা ভার চাপিয়ে বেশ সোজা হয়েই কাঁধ দুলিয়ে দোলনের তালে তালে একটানা চলে যায় ক্রোশখানেক রাস্তা। এই রতনও মনিবের কিলকে ভয় করে। মনিব রাগে। চিৎকার করে আর কিল মারে। চিৎকার করে যতক্ষণ কাশি না পায়, গলা না ভাঙে, সে ততক্ষণ এই কিল চালায়। সে কিল আস্বাদন করা আছে রতনের, একটি কিলেই পিঠখানি বেঁকে যায়, দম আটকে যায়। এর ওষুধও কিন্তু ওই দম বন্ধ করে থাকা আর চুপ করে থাকা। কিল খাবার আগে থেকেই দমটি বন্ধ করে রাখতে হয়। তাহলে আর কিল খেলে দম আটকায় না এবং লাগেও কম। ঘোষ মহাশয়ের ছেলেদের একটা ‘বল’ আছে, পিতলের পিচকারি দিয়ে বাতাস ভরে দেয়, ইটের মত শক্ত হয়ে ওঠে বলটা, তাতে কিল মারলে যেমন বলটার কিছু হয় না, লাফিয়ে ওঠে—তেমনি হয় আর কি! আর কিল খেয়ে যত চুপ করে থাকবে, মনিব তত চিৎকার করবে রাগে। তাতে সহজেই গলা ভাঙে, কাশি পায় মনিবের। কাশি পেলেই মনিব ছেড়ে দিয়ে নিজের গলায় হাত দিয়ে কাশতে শুরু করবে।
 
রতন কাছে আসতেই মনিব হেদো মণ্ডল মহাশয় বললেনওরে বেটা গুয়োটা কাহার, বেলা কত হয়েছে রে বেটা? কত্তার পুজো দিয়ে মদ মেরে তুই হারামজাদারা ‘কেডামাতন করবি-—আর আমার ‘জাওন’ শুকিয়ে কাঠ হবে নাকি?

রতন ঘাড় হেঁট করে কান টানতে লাগল। এটা কাহারদের সবিনয় অপরাধ স্বীকারের ভঙ্গি। এর সঙ্গে, মুখে একটু হাসিও থাকা চাই—নিঃশব্দ দন্তবিকাশ। তা অবশ্যই ছিল রতনের মুখে। ওই হাসিটুকুর অর্থ হল এই যে, মনিবের তিরস্কারের অন্তর্নিহিত সদুপদেশ এবং স্নেহ সে অনুভব করতে পারছে।

তা মনিব মহাশয়েরা ‘স্ন্যাহ’ করেন বৈকি। তা করেন। বিপদে আপদে মনিবেরা অনেক করেন। কাহারেরা স্বীকার করে মুক্তকণ্ঠে-অ্যানেক, অ্যানেক করেন। অসুখবিসুখে খোজ করেন, কিছু হলে দেখতে পর্যন্ত আসেন, পয়সা-কড়ি ধার দেন, পথ্যের জন্য পুরনো মিহি চাল, আমসত্ত্ব, আমচুর এমনিই দেন; বিঘটন কিছু ঘটলেও তত্ত্বতল্লাশ করতে আসেন। রতনদের দুঃখে নিজেও হেদো মণ্ডল মহাশয়েরা কাদেন, আপ্তবাক্য বলেন, মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দেন, তাতে সত্যই অন্তর জুড়িয়ে যায় রতনদের। আবার অন্য কোনো ভদ্র মহাশয় যদি কোনো কারণে অকারণে রতনদের উপর জুলুমবাজি করতে উদ্যত হন, তাতেও মনিব মহাশয়েরা আপন আপন। কৃষাণদের পক্ষ নিয়ে তাদের রক্ষা করেন, প্রতিপক্ষের সঙ্গে দরকার হলে ঝগড়াও করেন, প্রতিপক্ষ তেমন বড় কঠিন লোক হলে অর্থাৎ চন্দনপুরের বাবুরা হলে তখন মনিবেরা রতনদের পিছনে নিয়ে বাবুদের কাছে গিয়ে মিটিয়ে দেন হাঙ্গামাটা। ভদ্র মহাশয়দের বলেন, আপনার মত লোকের ওই ঘাসের উপর রাগ করা সাজে? ঘাসও যা, ও-বেটাও তাই।

কখনও বলেন–পিঁপড়ে। ও তো মরেই আছে। মড়ার ওপর খাড়ার ঘা কি আপনার সাজে?

তারপর রতনদের ধমক দিয়ে বলেন—নে বেটা উল্লুক কাহার কঁহাকা, নে ধ, পায়ে ধ। বেটা বোকা বদমাশ হারামজাদা!

পায়ে ধরিয়ে বলেন—নে, কান মল, নাকে খত দে।

তাতেও যদি না মানেন-বড় কঠিন লোক বাবু মহাশয়, তবে মনিব নিজেই হাত জোড় করে বলেন-আমি জোড়হাত করছি আপনার কাছে। আমার খাতিরে ওকে ক্ষমা ঘেন্না করতেই হবে এবার। ‘না’ বললে শুনব না। মোটকথা, যেমন করে তোক রক্ষা করেন রতনদের।

সেই মনিব মহাশয় ‘আগ করেছেন। আজ রাগ খুব বেশি। হবারই কথা। দুদিন কামাই, তার উপর মাটি খারাপ হয়ে গিয়েছে; আজও দেরি হয়েছে খানিকটা। রতন খুব দ্রুতপদেই চলল। মাঠ পার হয়েই কুঠির সাহেবদের আমবাগান—সেই পুরনো কালের আমবাগানের মধ্য দিয়ে জাঙলে ঢুকতে হয়। বাগানের ভিতরে ঢুকতেই মাথার উপরে আমগাছের পাতার মধ্য থেকে অজস্ৰ পোকা উড়ে মাথায় মুখে লাগল। এবার আমগাছের মুকুলও বেশি। মধুর গন্ধে চারিদিক ভুরভুর করছে, পোকাও হয়েছে অসম্ভব রকমের বেশি।

হেদো মোড়ল চিৎকার করতে করতেই চলল-হারামজাদা, নেমকহারাম ছোটলোক জাতেরই দোষ—তোর আর দোষ কি?

পানু বললে প্ৰদকে খুব বেঁচে গেলছে অতনকাকা, আমি বলি-লাগালে বুঝি ‘আষিঢ়ে কিল গদাম করে!

প্ৰহ্লাদ বললে—কিল খেয়ে অতনার অভ্যেস হয়ে যেয়েছে। মারলেও কিছু হত না।

আমবাগান পার হয়ে অপর প্রান্তে জাঙলের বসতি আরম্ভ হয়েছে। বালিপ্ৰধান একটা পথ। বর্ষায় হুড়হুড় করে জল যায় রাস্তাটা বেয়ে, তখন এটা নালা। জল চলে যায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যে, তখন এটা পথ। পথটা এসেছে উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের কুঠিডাঙা থেকে। থমকে দাঁড়াল প্রহ্লাদ। পানু বললে দাঁড়ালে যে গো!

প্ৰহ্লাদ বললে—উটো কে রে? পরমের পারা লাগছে না?

দূরে সায়েবডাঙার উপরে দুটি লোক ঘুরছে প্রহ্লাদ দেখালে।

—তেমুনি তো লাগছে।

–সাথে কে বল দি-নি?

–বড়বাবুদের সেই মোচাল চাষবাবু লয়? সেই যে গো, চুল কোঁকড়া-মিচ্ছি মাশায়। প্ৰহ্লাদ বললে—পরমা আমাদের তত্ত্বে তর্কেই আছে। কোথা জমি, কোথা পয়সা–

—জমি?

—সেদিন মাতব্বরের কাছে শুনিস নাই। চন্ননপুরের বড়বাবুরা কুঠিডাঙা কিনেছে, জমি করবে। বন্দোবস্ত করবে খানিক। পরম সেই তত্ত্বে ঘুরছে।

পানু হেসে বেশ বসিয়ে বললে—ঘুরুক শাললা তর্কে তক্কে পরের দুয়ারে, উদিকে শালোর ঘরে কুত্তা ঢুকে

হাসতে লাগল পান, যে হাসির অনেক অর্থ এবং সে অর্থ কাহারেরা ‘বেদের সাপের হাঁচি চেনা’র মতই চেনে।

–কে? বাবুদের চাপরাসী মাশায় এসেছিল? তা, ও তো জানা কথা।

পানু ঘাড় নেড়ে বললে—সিংয়ের কথা বলছি না। সে পুরনো কথা। সে আর কে না জানে? ভূপ সিং মাশায় ছত্তিরি বেরান, সে কি আর কুত্তা হয়? সে হল বাঘা। বাঘে ধান খেলে তাড়ায় কে? হুঁ-হুঁ, অন্য লোক। কাল সনজেবেলাতে–। সে এক মজার কথা।

সে হাসতে লাগল।

ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন করলে প্রহ্লাদকে? কে? কে রে?

খুব হাসতে লাগল পানু।

—কে রে?

–সে বলব মাইরিউ বেলাতে। অ্যানেক সময় নাগবে। গতকাল সন্ধ্যায় আটপৌরেপাড়ার বটগাছের তলায় সেই অন্ধকারের মধ্যেও পানু আবিষ্কার করেছে মাতব্বর এবং কালোবউকে একসঙ্গে। সেও ঠিক সেই সময় ওইদিকে গিয়েছিল আটপৌরে-পাড়ায় তার এক ভালবাসার লোকের সন্ধানে।



বাঁশবাঁদির বাঁশবনে আজও জমে আছে আদিম কালের অন্ধকার। সে অন্ধকার রাত্রে এগিয়ে এসে বাঁশবাঁদির কাহারপাড়াকে আচ্ছন্ন করে। সেই অন্ধকারের মধ্যেও কাহারদের দৃষ্টি কিন্তু ঠিক চলে, ওদের চোখেও তখন জেগে ওঠে সেই আদিম যুগের অর্থাৎ অগ্নি-আবিষ্কারের পূর্বযুগের। মানুষের চোখের অন্ধকারভেদী আরণ্যজন্তুর দৃষ্টি!

মাতব্বরের রঙের খেলা দেখে পানু অত্যন্ত কৌতুক অনুভব করেছে। কৌতুকেরও বেশি একটু কিছু আছে। অন্য লোক হলে ওই কৌতুকের বেশি কিছু হত না। কিন্তু বনওয়ারী মাতব্বর, তা ছাড়া মানুষটাও যেন একটু অন্য ধরনের। কৌতুকের সঙ্গে জেগেছিল বিস্ময়। তাই সে কথাটা গোপন করে রেখেছিল। প্রকাশ করতে সাহস পায় নাই। এবং গতকাল হঠাৎ পাখী ও কালীর কাণ্ডটা ঘটায় এ কাণ্ডটার কথাটা মনেই ছিল না বলতে গেলে। হঠাৎ পরমকে দেখে মনে পড়ে গেল তার আজ। আজও তার বলতে গিয়েও বলতে সাহস হল না। তা ছাড়া কথাটা বলবে কি না তাও পানু ভাবছে মাঝে মাঝে। ওটাকে নিজস্ব করে রাখলে ভাঙিয়ে কিছু কিছু আদায় করতে পারবে মাতব্বরের কাছে।

পানু দল ছেড়ে গলিপথে ঢুকল। গলির ও মাথায় তার মুনিববাড়ি।

প্ৰহ্লাদ প্রমুখ কজন কিন্তু মনে মনে উদগ্রীব হয়ে রইল।

কি মজার কথা! কি মজার কথা! পরমের ঘরে কে ছিল?

কথাটার কল্পনাতে সারাটা দিনের কাজ হালকা হয়ে গেল কাহারদের।

প্ৰহ্লাদ, ভূততা প্রভৃতি এরা কজন গম ঝাড়াই করলে, শিষ পিটিয়ে ক্রুপ করে তুললে। জলখাবার নিয়ে আসবে মেয়েরা, কুলো দিয়ে পাছড়ে খোসা ঝেড়ে গম বার করবে।

জলখাবার-অন্তত দু সের মুড়ি, খানিকটা গুড়, পেঁয়াজ, লঙ্কা আর এক ঘটি জল।

পানা তুললে আলু। খুব মোটা আলু হয়েছে পানার মনিবের। পানার স্ত্রী জলখাবার নিয়ে। আসবে, সেও আলু তুলবে। চারটে মোটা আলু পানী খোড়া মাটি চাপা দিয়ে একটা চিহ্ন দিয়ে। রেখে দিলে। পরিবারকে বলবে, পেঁট-আঁচলে পুরে নিয়ে যাবে। মোটা আলু বেছে মনিবই নিয়ে থাকে। মোটা আলুও খাওয়া হবে ভাত দিয়ে, নিজের ভাগে বেশি কিছু পাওয়া হবে। এই বেশি পাওয়ার আনন্দটাই এক্ষেত্রে বেশি। আর প্রহ্লাদকে দেখাতে হবে। প্রহ্লাদ বলে, বিঘে ভূঁই দুপসুরি খোল, আর ‘আলুমিনি সার দিয়েছে ওর মনিব, আলু ইয়া মোটা হয়েছে। গল্প করা প্রহ্লাদের স্বভাব। পানুর মনিবের বাছুরটা কিনবে নাকি প্রহাদের মনিব। আলুর টাকা থেকেই নাকি তার টাকা হয়ে যাবে। তাই দেখাবে ওকে ওর কৃষাণির জমির আলু-মনিবের সম্পদ।

নিজের মনিবকে বললে পানু—মুনিব মাশায়, পল্লাদে আজ আমাদের পাল বাছুরটার কথা শুধাচ্ছিল। বলে—কত দাম? ওর মুনিব এবার গরু কিনবে।

পানুর মনিব লগ অর্থাৎ নগেন্দ্ৰ মণ্ডল মহাশয় বিচক্ষণ হিসাবি লোক, নাক মুখ চোখ বেশ পাতলা পাতলা চোখা গড়নের, মানুষটিও পাতলা ছিপছিপে; বেশ বাবু-মহাশয়ী ছাপ আছে। মনিব। মহাশয় কিন্তু পানার কথার জবাব না দিয়ে উঠে এলেন জমিতে। যেখানটায় পানা আলুগুলি মাটি চাপা দিয়েছিল, সেখানকার মাটি খুঁড়ে আলু চারটে তুলে গামছায় বেঁধে বললেন—ভাল করে দেখে খোড় রে বেটা, দেখে খোড়, বাদ দিয়ে চললি যে, তাতে তোরই লোকসান। আমার আলু তো আমার জমিতেই থাকবে, সে তো আমি মাটি সরালেই পাব। হ্যাঁ, এ আলু কটির ভাগ তুই পাবি না বুঝলি? তোর নজরের দোষের জরিমানাবলে জমি থেকে উঠে আলের ওপর বসে আবার হুঁকো টানতে লাগলেন নিশ্চিন্ত হয়ে। ভাবটা যেন কিছুই হয় নাই। পানার বুকটা গুরগুর করে উঠল। তেষ্টা পেয়ে গেল।

ওই জলখাবার আসছে। কোপাইয়ের পুলের ওপর দশটার ট্রেন শব্দ করে পার হয়ে গেল। বেশ শব্দ। ঝমর-ঝম, ঝম্‌-ঝম্‌!

ইচ্ছে ছিল জলখাবার নিয়ে গাঁয়ের বাইরে আমবাগানে সকলে বসে জমিয়ে গল্প করবে। বনওয়ারী-কালোশশীর কথাটা সকলে শোনবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছে। তারও ইচ্ছে খুব। কিন্তু মনিবের কাছে ধরা পড়ে পানুর সব উৎসাহ নিবে গেল। মাঠে বসেই জল খেতে লাগল সে। হঠাৎ বউটার উপর পড়ল তার রাগ। পানুর সন্দেহ হয়, বউটা করালীর দিকে তাকিয়ে থাকে ঘোমটার মধ্যে দিয়ে। সে তাকে রূঢ় ভাষায় গাল দিতে লাগল।
 
বনওয়ারী গিয়েছিল চন্দনপুর ইস্টিশানে মনিবের সঙ্গে।

মাইতো ঘোষ ট্রেনে চাপলেন। বনওয়ারীকে চার আনা বকশিশ করে বললেন—খুব ট্রেন ধরিয়েছিস। ও, বুড়ো বয়সে এখনও খুব জোর তোর! প্রশংসা করলেন তিনি।

বনওয়ারী হেঁট হয়ে প্রণাম করে হাসতে লাগল। বললে তা আজ্ঞেন, আরও কোশখানেক এই গমনে যেতে পারি আজ্ঞেন।

ঘোষ বললেন–বাপ রে বাপ, ছুটতে হয়েছে আমাকে!

—কি করব আজ্ঞেন! চা খেতে দেরি করে ফেললেন আপুনি। সতর গমনে না এলে এনারে ধরতে লারতেন। উনি তো দাঁড়ান না। টায়েন হলেই ছেড়ে দ্যান।

হাসতে লাগলেন ঘোষ। বনওয়ারী গামছা দিয়ে কপালের শরীরের ঘাম মুছলে। স্থূল। গড়নের পাথরের মূর্তির মত শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছে। কানের পাশ দিয়ে জুলফি বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে সদ্য-স্নান-করানো কষ্টিপাথরের মূর্তির মত।

ট্রেন ছেড়ে দিলে; বনওয়ারী আবার প্রণাম করে বললে—আমার নেবেদনটা’ তা হলে—

–হবে। দাদাকে বলে দিয়েছি। আমগাছ কটা আর বাঁশঝাড় পঁচটা লিখে দিস।

—তা দিতে হবে বৈকি আজ্ঞেন।

–বেশ।


গাড়ি চলে গেল। বনওয়ারী ইস্টিশানের নিমগাছতলাটায় ছড়ানো ইটগুলোর মধ্যে দুখানা টেনে উপরে উপরে রেখে একটু উঁচু করে নিয়ে বসল। আর তাড়া নাই। জিরিয়ে নিয়ে একটি কাজ আছে, সেই কাজটি সেরে তবে ফিরবে। বেশ ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে; হাওয়ার সঙ্গে রয়েছে মিঠে গন্ধ-বন-আউচ ফুলের সুবাস। এখানকার মাঠের আলের উপর, রাস্তার ধারে অনেক বন-আউচের গাছ। ইস্টিশানের দক্ষিণ দিকটা একেবারে জাঙল-বাঁশবাঁদি পর্যন্ত খোলা। চন্দনপুরের মাঠ একেবারে খালি—কাটা ধানের গোড়া ছাড়া আর কিছু নাই। খাখা করছে। বাবুলোকের গ্রাম। এ গ্রামের মাঠে অন্য ফসল হয় না এখন। হয়, তবু বাবু মহাশয়দের ওদিকে খেয়াল নাই। ধান ছাড়া আর সবই তারা খরিদ করে খান। মেলা পয়সা, বিস্তর টাকা-কেনইবা এইসব চাষের হাঙ্গামা তারা করবেন! এই যে চন্দনপুরের বড়বাবুরা জাঙলের কুঠিডাঙাটা কিনলেন, ওখানে কি ওঁরা এইসব চাষ করবেন বলে কিনলেন? চৌধুরীদের অবস্থা খারাপ হয়েছে-“মা-লক্ষ্মী ছেড়েছেন, ওরা সবই বিক্রি করছে, পতিত ডাঙাটাও বিক্রি করলে। মাইতো ঘোষ নিজে বলে গেলেন—ঘঘাষেরা কিনতে চেয়েছিলেন ওটা। কিন্তু ঘোষেদের কাছে বিক্রি করতে চাইলে না চৌধুরীরা। হাজার হলেও জাতজ্ঞাত তো। শেষে সেধে দিয়ে এল চন্দনপুরের বাবুদের; এখন বাবুরা যে অংশটার মাটি ভাল, অল্পস্বল্প ডোবে, মানে পলি পড়ে অথচ ফসল নষ্ট হয় না, সেই অংশটা কাটিয়ে জমি করবেন, বাকিটা বিলি করবেন; কতক কতক প্রজাবিলি করবেন, সেলামী নেবেন, খাজনা নেবেন। সেসব নেবেন জাঙলের মোড়ল মহাশয়েরা। বাকি যা থাকবে তাই পাবে পরম, বনওয়ারী, জাঙলের হাড়িরা, চন্দনপুরের শেখেরা। তাদের বন্দোবস্তের শর্ত আলাদা; শর্ত হল—কড়ারী খাজনার শর্ত। সেলামী নেবেন না। তবে তারা পতিত ভেঙে যে জমি করবে দশ বছর পরে সে জমিদারের হবে। খাজনার শর্ত হল প্রথম দু বছর বা তিন বছর খাজনা নেবেন না, তারপর এক বছর সিকি খাজনা, তার পরের বছর আধা খাজনা নেবেন, তারপর চলবে পুরো খাজনা। এগার বছরের বছর জমি হবে জমিদারের। কারণ, বার বছর হলেই নাকি তার স্বত্ব হয়। এগার বছরের পরে আর একটা বন্দোবস্ত হবে আর দশ বছরের জন্য। বিক্রি করতে পাবে না, করলেও তা আইনে টিকবে না, জমিদার কেড়ে নেবেন। তবে বিক্রি না করে চাষ করে যাও; খাজনা দাও, জমিদার মহাশয়ের সঙ্গে নিয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা করে চল, কেউ কিছু বলবে না যতদিন খুশি ভোগ করে যাও। বাস্। সেইজন্যই তো ‘পিতিপুরুষে’ বলে গিয়েছেন—“আশ্চয়’ করবি লক্ষ্মীমন্তকে, মা-লক্ষ্মী মনিবের ঘরে ঢুকবেন, মনিবের উঠানে মায়ের পায়ের ধুলো অবশ্যই পড়বে, তাই কুড়িয়ে মাথায় করে আনবি, তাতেই তোর ‘সেগুষ্ঠি’র ‘প্যাট’ ভরবে। এতটুকু মিথ্যে নয় পিতিপুরুষের কথা। এই বনওয়ারীদের কথাই ধর না! ঘোষ মহাশয়ের ঘরে লক্ষ্মী এলেন। বনওয়ারীদের বাপ তাকে আশ্চয় করলে— সেই কল্যাণেই বনওয়ারীর বাবা হল কাহারপাড়ার মাতব্বর। ঘোষ-বাড়ির লক্ষ্মীর পায়ের ধুলোয় বনওয়ারীর বাপের অবস্থা সচ্ছল হল। নইলে তখন তো মাতব্বর ছিল ওই হেঁপো রোগী নয়ানের বাবা। নয়ানের কর্তাবাপের নিজের দু বিঘে জমি, চৌধুরী বাড়ি আশ্চয়ে’ বাস, তাদের সোনা-ফলানো জমি ওরা ভাগে করত। নয়ানের ঠাকুরদা মরদও ছিল জব্বর, হাঁকডাকও খুব। ‘ঘরভাঙারাই’ তখন মাতব্বর। নয়ানদের বংশটার নাম সেকালে ছিল ‘ঘরভাঙাদের গুষ্টি। আগের আমলে ওদের ঘর ছিল নীলের বাঁধের দক্ষিণ পাড়ে সব থেকে নিচু জায়গায়; আশ্চর্যের কথা, গোটা ঘরে বাস করা ওদের কখনও ঘটত না, প্রতি বছরই বর্ষার সময় ভাঙত। কোনোবার পুরো ঘরটাই ভাঙত, কোনোবার একটা দেওয়াল, কোনোবার-বা আধখানা দেওয়াল; এ ভাঙতেই হত। সেই অবধি ওদের বাড়ির নাম ঘরভাঙাদের বাড়ি। তারপর যখন নয়ানের কত্তাবাবা জাঙলের চৌধুরী মহাশয়দের ‘আশ্চয়ে এল—চৌধুরী-বাড়ির মা-লক্ষ্মীর পায়ের ধুলো কুড়িয়ে এনে নতুন ঘর করলে তখন আর মায়ের কৃপায় সে ঘর ভাঙল না। তবে নয়ানের ঠাকুরদাদা পিতিপুরুষের কথা মেনেছিল, ঘরখানা গোটা করেও দেওয়ালের মাথায় হাতচারেক লম্বা হাতখানেক চওড়া জায়গা দেওয়াল সম্পূৰ্ণ না করে মজবুত বাখারির বেড়া দিয়ে রেখেছিল। ভাগ্যমন্তের ‘আশ্চয়’চৌধুরী-বাড়ির মা-লক্ষ্মীর পায়ের ধুলোর কৃপা ছাড়া সেটা আর কি? চৌধুরী-বাড়ির পতন হল, সঙ্গে সঙ্গে ঘরভাঙা কাহার-বাড়ির মাতব্বরি গেল। মাতব্বর হল। বনওয়ারীর বাপ। বাপের পর বনওয়ারী মাতব্বর হয়েছে। ঘোষেদের আশ্চয়ে রয়েছে, ঘোষেদেরও চলছে বাড়বাড়ন্ত, বনওয়ারীরও যে বাড়বাড়ন্ত চলবে তাতে বনওয়ারীর সন্দেহ নাই। এখন সেদিন ওই কালোবউয়ের কাছে সায়েবডাঙা বন্দোবস্তির কথা শুনে ওই জমি খানিকটা নেবার মতলব হয়েছে, সেই কথা ভাবতে ভাবতে আর একটা কথা তার মনে হয়েছে। চন্ননপুরের বড়বাবুদের এখন এ চাকলার মধ্যে বাড়বাড়ন্ত, বাবুদের ‘আশ্চয়’ যদি একটু পায়, যদি এঁদের মা-লক্ষ্মীর পায়ের ধুলো আঙুলের ডগায়ও একটু তুলে আনতে পারে, তবে তো তার ঘরেও মা-লক্ষ্মী উথলে উঠবেন।
 
বনওয়ারীর মনে এটি অতি গোপন কথা। এ কথা কাউকে বলতে পারে না। ঘোষ মহাশয়রা জানতে পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তবে ভাগ্যটা ভালই মনে হচ্ছে। মাইতো ঘোষ সাধারণত ইস্টিশানে যেতে তাকে ডাকেন না। মাল তো তার বেশি থাকে না। কি বলে, ‘বেগ’ না ‘সুটক্যাস’ আর তেরপলের মত মোটা কাপড়ের খোলে বাধা ‘বেনা’। এবার মাল নিয়েছেন বেশি। তাই ডাক পড়েছে ‘কোশকেঁধে বাড়ির বনওয়ারীর। ভালই হয়েছে, চন্ননপুরে যেকালে এসেছে, সেকালে বড়বাবুদের কাছারি হয়েই যাবে। বনওয়ারী উঠল। মাইতো ঘোষ যে সিগারেটটি দিয়েছিলেন, কানে যেটি গোঁজা ছিল, সেটি হাতে নিয়ে ইস্টিশানের বাইরে পান। বিড়ি-চায়ের দোকানের দড়ির আগুনে ধরিয়ে নিয়ে চন্ননপুর গ্রামের পথ ধরলে। প্রথমেই ইস্টিশান এলাকা। পথে পা বাড়িয়েও সে থমকে দাঁড়াল। মনে পড়ে গেল তার খুড়তুতো বোন সিধুকে। ঘুরল সে।

ইস্টিশানের এলাকাটি বেশ বড়।

ছোট ‘নাইন’ হলে কি হয়, চন্ননপুরের ইস্টিশানের সীমানা-সহর মস্ত। লাইন তো তৈরি হয়েছে সেদিন-বনওয়ারীর চোখের সামনে হল এসব। এই লাইনে খাটতে এসে কজন মেয়ে ঘর ছেড়েছে-পাচী খুকী বেলে চিত্ত নিম্মলা। খুকী আর বেলে গিয়েছে দেশ ছেড়ে-দুজন মুসলমান রাজমিস্ত্রির সঙ্গে। আর চিত্ত পাচী গিয়েছে একজন হিন্দুস্থানি লাইন-মিস্ত্রির সঙ্গে। নিৰ্ম্মলাও গিয়েছে আর একজন মিস্ত্রির সঙ্গে। ওই নিম্মলারই ছেলে করালী। পাঁচ বছরের ছোট করালীকে পর্যন্ত ফেলে হারামজাদী চলে গিয়েছে। ওঃ, রঙের নেশার কি ঘোর, সন্তান পর্যন্ত ভুলে যায়! সিধু আর ‘জগধাত্তি’ এরাও দুজনে ঘর ছেড়ে গিয়েছিল, কিন্তু তাদের ভালবাসার লোক তাদের সঙ্গে নিয়ে যায় নাই। তারা এখনও রয়েছে চন্ননপুরে, এই ইস্টিশান এলাকাতেই থাকে। মাস্টারদের বাড়িতে ঝিয়ের ‘পাটকাম’ করে, ইস্টিশানে পোড়া কয়লা কুড়োয়, কয়লা-চুনের ডিপোতে কামিনের কাজ করে। আবার রাত্রিকালে অন্য রূপ ধরে। বনওয়ারীই আর তাদের গায়ে ঢুকতে দেয় নাই। সিধু তার নিজের খুড়োর কন্যে; সিধুকে সে ভালবাসত। এই সিধুর জন্য আজও তার মন ‘বেথা পায়। আপন খুড়োর মেয়ে, কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে। হঠাৎ এসে আজ তার ইচ্ছে হল একবার সিধুকে দেখে যাবে। সিধুর ওখানে করালী-পাখীর খবরও পাবে।

ঘুরল বনওয়ারী। ইস্টিশানের এলাকার মধ্যে ঢুকল। লম্বা-এই এখান থেকে সেখান পর্যন্ত চলে গিয়েছে সারি সারি ঘর। পাকা ঘর, পাকা মেঝে, সামনে খানিকটা উঠান, এক এক ঘরে এক এক সংসার বেশ আছে। থাকবে না কেনে? সায়েবসুবোর কারখানা, তাদের ‘আশ্চয়ে আছে; কিন্তু বড় ঘুপচি। পাকা ছাদ, পাকা দেওয়াল, পাকা মেঝে হলেও এর মধ্যে থাকতে হলে বনওয়ারীর হাঁপ ধরে যেত। তাদের ঘর এর চেয়ে অনে; খারাপ, কিন্তু উঠানটি খোলা। তা ছাড়া এদের সংসারের ঘরদোরের গন্ধ যেন কেমন কেমন। এলেই নাকে লাগে। তাদের ঘরে গন্ধটির মধ্যে গোবর-মাটির গন্ধ, গরুর গায়ের গন্ধ, ধানের গন্ধ, কাঠ-ঘুটে পোড়ার গন্ধ, সারগাদার গন্ধ, পচাই মদের গন্ধ, বাড়ির আশপাশের বাবুরি তুলসীগাছের গন্ধ মিশে এক ভারি মিষ্টি প্ৰাণ-জুড়ানো গন্ধ। আর এখানকার গন্ধ আলাদা, ভারি কটু গন্ধ, ইঞ্জিনের ঝাড়া কয়লা আর জলে মিশে একটি ভাপানী তেজীয়ান গন্ধ এসে নাকে ঢোকে। ডাক্তারখানার তেজী ওষুধের গন্ধ ছাড়া আর কোথাকারও গন্ধ এমন তেজী নয়।

সিধু এই সকালবেলাতেই চুল আঁচড়াচ্ছে। যে অন্ন গেঁজে পচে যায়, সে অন্নের গন্ধ সকাল-বিকেল সব সময়ে এক। বনওয়ারী মনে মনে দুঃখের হাসি হাসলে। সকালবেলাতেই ‘ক্যাশ’ করতে বসেছে! বনওয়ারীকে দেখে সিধু ব্যস্ত হয়ে চুল আঁচড়ানো বন্ধ করে হেসে বললে—এস, দাদা এস, কি ভাগ্যি আমার!

—এলাম একবার। মাইতো ঘোষের মোটঘাট নিয়ে এসেছিলাম। তা বলি, একবার সিধুকে দেখে যাই।

সিধু উঠে তাড়াতাড়ি একখানা বস্তা পেতে দিলে—বস।


চন্দনপুরে থেকে সিধু তরিবৎ শিখেছে। আসন পেতে দিতে হয় সভ্যতার এ রীতি জেনেছে। তাদের পাড়ায় আগন্তুকেরা নিজেরাই ফু দিয়ে অথবা গামছা দিয়ে ধুলো-কুটো ঝেড়ে নিয়ে মাটিতেই বসে। গণ্যমান্য কেউ এলে বনওয়ারীর ঘরে দুটো মোড়া আছে, তাই এনে পেতে দেয়—যেমন দারোগাবাবু কি জাঙলের মনিব মহাশয়েরা কেউ। বনওয়ারী বসল বস্তাখানার উপর। বললে তারপরে, ভাল আছিল?

ভাল আর মন্দ! হেসে উঠল সিধু।–যেদিন খাটি সেদিন খাই, যেদিন খাটতে নারি সেদিন পেটে আঁচল বেঁধে পড়ে থাকি। জগধাত্তি কি কেউ যদি এক মুঠো দেয় তো খাই। আপনজন কে আছে যে তার উপর দাবি করব, বল?

বনওয়ারী চুপ করে রইল। সিধুর কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন অভিযোগ রয়েছে, তার সমস্তটাই এসে পড়ছে বনওয়ারীর উপর।

সিধু আবার বললে—তবু তোমার করালী ছোঁড়া লাইনে কাজ করা অবধি খোঁজখবর করে। পিসি বলে এসে বসে। তোমাদের খবর তার কাছেই পাই।

এতক্ষণে বনওয়ারী বললে—তা তুও তো মধ্যে-মাঝে যেতে পারিস উদিক পানে।

সিধু বললে—কে জানে বাপু, ভয় তো কাউকে নয়, ভয় তোমাকেই।

বনওয়ারী দুঃখের হাসি হেসে মাথা নামিয়ে রইল। সিধু হেসে বললে—তোমাকে বাপু বড় ভয় লাগে।

বনওয়ারী বললে—ছোটকালে বড় মারতাম ততাকে, লয়?

সিধু হেসে বললে—বাবা রে! তারপর গম্ভীর হয়ে বললে—তার লেগে লয়, তুমি বাপু ভারি কড়া নোক। কি বলে দেবে কে জানে? হয়ত বলবেসিধুকে কেউ বাড়িতে ঢুকতে দিয়ো না।

বনওয়ারীর চোখে হঠাৎ জল এসে গেল। মাথা হেঁট করে মাটির দিকে চেয়ে কোনোরকমে। আত্মসংবরণ করে সে উঠে পড়ল। ঘোষ যে চার আনা পয়সা তাকে দিয়েছিলেন, তারই একটি দুয়ানি সিধুকে দিয়ে সে বললে রাখ, মিষ্টি কিনে খাস।

সিধু বললে—সঁাড়াও। বলে ঘরে ঢুকে একটি পাকী মদের বোতল এনে বললে খানিক আছে, খাও।

বনওয়ারী একবার ভাবলে, তারপর বোতলটি নিয়ে গলায় ঢেলে দিলে।

সিধু বললে—সেদিন করালী সাপ মেরেছিল, মেরে এখানে অনেক খরচ করেছিল। দু বোতল এনে সবাই মিলে খেলাম। ওইটুকুন ছিল। তারপর হঠাৎ তার একটা সরস কথা মনে। পড়ে গেল, সে বেশ কৌতুক-পুলকিত স্বরে বলে উঠল—ওই দেখ, আসল কথাই শুধধতে ভুলে গিয়েছি—করালী-পাখীর রঙের কথা!

–হ্যাঁ, সে এক কাণ্ড হয়ে যেয়েছে। ছেড়াকে শায়েস্তা না করলে হবে না।

সিধু বললে—তারা এখানে পালিয়ে এসে দিব্যি রয়েছে। করালী তো লাইনে কাজ করে, একখানা ঘর পেয়েছে, সেইখানে রয়েছে। কি আর শায়েস্তা করবা তুমি? সে বলছিল—যাবেই। না আর তোমার এলাকাতে।

চমকে উঠল বনওয়ারী।
 
সিধু বললেওই সবশেষের ঘরখানায় রয়েছে তারা। এর পরে মুখে কাপড় দিয়ে হাসি ঢেকে বললে, ওদের রঙ দেখলাম খুব জমজমাট। করালী বলে–গায়েই যাব না, লাইনে খাটব, এইখানেই থাকব, কারুকে গেরাহ্যি করি না আমি। নতুন নোয়া এনে পরিয়ে দিয়েছে পাখীকে। ঘর পেতেছে, ধুম এখন চলছেইচলছেই।

চন্দনপুরে এসে সিধুর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রঙকে সে অঙ বলে না, নতুনকে নতুন বলে না। ঢলকো করে চুল বাধে।

বিড়ি লাও একটা, বিড়ি। সিধু বললে।

থাক্‌। বনওয়ারী হঠাৎ উঠে পড়ল।

বেরিয়ে এসে সে থমকে দাঁড়াল। হঠাৎ পাখী এবং করালীর ব্যাপারটা নিয়ে সে খুব চিন্তিত হয়ে উঠেছে। ভাল কথা নয়, গ্রামেই যাবে না এ মতলব ভাল নয়। বদমাশ হোক, দুষ্ট হোক, পাপী হোকছোঁড়া এখনও এমন অন্যায় কিছু করে নাই, যাতে তাকে গা থেকে দূর করে দিতে হবে। পাখীর সঙ্গে ব্যাপারটার মত ব্যাপার তো চিরকালই ঘটে আসছে। তা রঙ যখন পাকা, তখন নয়ানের সঙ্গে পাখীর ছাড়পত্র হয়ে যাক, সাঙা হোক করালীর সঙ্গে। গায়ে-ঘরেই থাকুক। এখানে সর্বনাশ হবে। পাখী-করালী জানে না, বুঝতে পারছে না, কিন্তু চোখ তো আছে—চেয়ে দেখুক ওই সিধুর দিকে, জগদ্ধাত্রীর দিকে।



খুব জমিয়ে বসেছিল ওরা। পাখী করালী নসুদিদি জগদ্ধাত্রী আর করালীর লাইনগ্যাঙ্গের দুজন সঙ্গী। মধ্যে একরাশ তেল-মাখানো মুড়ি-লঙ্কা-পেঁয়াজ, কতকগুলো বেগুনি ফুলুরি আর মদের বোতল। খুব গরম গরম কথা চলছে। পাখী কলরব করছে বেশি। দরজার মুখ থেকে তারই কথা শুনতে পেলে বনওয়ারী। পাখী বলছিল জগকে‘যার সঙ্গে মেলে মন, সেই আমার আপন জন’—ইয়ের আবার শাসনই বা কি মাতব্বরিই বা কিওই হেঁপে উগীর ঘরে আমি থাকব না, পালিয়ে এসেছি আজ ছ মাস। এখন একজনার সাথে আমার মনে অঙ ধরল, আমি তার ঘরে এলাম। এ কি লতুন নাকি কাহারদের ঘরে? না কি বল জগমাসি?

জগ বললেইয়ের আর বলব কি লো?

করালী বললে—মামলা যদি থাকে তো আমার সাথে ওই নয়না শলোর। তা আসুক নয়না, তার সাথেই বোঝাপড়া হোক। ঠেঙা আনুক, লাঠি আনুক, নিয়ে যাক পাখীকে কেড়ে।

পাখী ঝঙ্কার দিয়ে উঠল—ম মুখপোড়া, তোকে লাঠিসোটা মেরে আমাকে লিয়ে যেতে চাইলেই আমি যাব নাকি?

নসুদিদি বলে উঠল—তা বোলো না হে, তা বোলো না, সেই ‘কিল ধমধম পড়ে সই— কিল ধমধম পড়ে গো’, লাঠিসোটা মেরে নিয়ে যেতে ক্ষ্যামতা থাকলে চুলের মুঠোতে ধরে নিয়ে যাবে। তুমি হাত-পা ছুঁড়ে বড়জোর চেঁচিয়ে ‘রবশ্যাষে’ গলা ধরিয়ে কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছে ভাত রাধতে বসবা, ‘হেনসেলে’ যাবা। মরদের কিলে বাবা ভুলে যায়, তা অঙের নোক!

পাখী বললে–না হে, না। অঙ যার পাকা হয়, অঙের নোকই পিথিবীর মধ্যে ‘ছেষ্ট’।

হি-হি করে হেসে উঠল নসুদি।

এই কি পাকা অঙ লাগল মনে মনে–ও সজনি!

এ সময়ে ঘরে ঢুকল বনওয়ারী। এক মুহূর্তে আসরটা স্তব্ধ হয়ে গেল। করালীর মুখ পর্যন্ত শুকিয়ে গেল। শুধু পাখী বার বার ঘাড় নেড়ে বলে উঠল–আমি যাব না, আমি যাব না। সঙ্গে সঙ্গে উঠে ছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দিলে।

বনওয়ারী ডাকলে করালীকে শোন।

করালী এতক্ষণে একটা দীর্ঘনিশ্বাস টেনে বুকটা ফুলিয়ে নিয়ে উঠে এসে উদ্ধতভাবেই বললে—কি?

বনওয়ারী বললে—চুটি হলে বাড়ি যাস পাখীকে নিয়ে। এখানে থাকবার মতলব ভাল নয়। উ-সব ছাড়। বাড়ি যাস; সাঙার ব্যবস্থা করে দেব। বুঝলি?

করালী শান্ত ছেলেটির মতই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালে।

বাড়ির বাইরে এসে আবার করালীকে ডাকলে বনওয়ারী, আর একটা কথা মনে পড়েছে থানায় গিয়েছিলি? বশকিশটা এনেছিস?

—না। —আয় আমার সাথে। দারোগাবাবুর কাছে তাকে শনাক্ত দিয়ে যাব।

শনাক্ত?

—হ্যাঁ রে। তুই যে করালী, দারোগা তা জানবে কি করে? সেই শনাক্ত দিয়ে যাব। তা’পরে আপনার বশকিশ তুই লিস যবে দেবে। আয়।
 
দারোগার কাছে করালীকে শনাক্ত করে দিয়ে সে বড়বাবুদের কাছারি হয়ে বাড়ি ফিরল। বেলা তখন দুপুর গড়িয়েছে। ঘোষের বাকি দু আনা পয়সায়—ছ পয়সার মুড়ি, দু পয়সার পাটালি কিনে গামছায় বেঁধে বাবুদের কেষ্ট দিঘির জলে ভিজিয়ে আমগাছের ছায়ায় বসে খেয়ে নিয়েছে, আঁজলা ভরে জল খেয়েছে। সিধুর পকী মদের বোতলটিতে নেহাত কম ‘দব্য ছিল না, জিনিসটাও ছিল। খ্ৰীটি এখনও পর্যন্ত অল্প-অল্প নেশায় বেশ ফুর্তি রয়েছে বনওয়ারীর। তার উপর মনটাও খুব খুশি রয়েছে। দিনমানটা আজ ভালই বলতে হবে। সেদিন পুজোটি কর্তা প্রসন্ন হয়েই নিয়েছেন মনে হচ্ছে তার। করালীর ব্যাপারটা মিটে গিয়েছে, ভালই হয়েছে। তার মনের মধ্যে ভারি একটা অশান্তি ছিল। ‘কোধ’ অবশ্য খুবই হয়েছিল তার। গুরুবলে খুব সামলে গিয়েছে। নইলে হয়ত কাণ্ডটা একটা বেপৰ্য্যয় ঘটিয়ে ফেলত। ছোঁড়াটার গায়ে ক্ষমতা হয়েছে, হা, তা হয়েছে, মানতেই হবে বনওয়ারীকে। বাঁশবনে সে তার নিচে পড়েছিল—এজন্য বলছে না, ওটা বেকায়দায় পড়ে হয়ে গেল, ঝরা বাঁশপাতার গাদায় পাতা সরে গিয়ে পিছলে পড়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু বনওয়ারীর বুকে যখন উঠে বসেছিল করালী, তখন তার ক্ষমতার আঁচটা পেয়েছে সে। ‘সঁটো মরদ হবে ঘোড়া। তবে মদেবদখেয়ালীতে না মাটি হয়ে যায়। সেই জন্যই তো বনওয়ারী তাকে নষ্ট হতে দেবে না। এ কদিন কয়েকবারই তার মনে হয়েছে, ছোঁড়াকে ফেলে বুকে চেপে বসে। বসলে হয়ত মেরে ফেলত তাকে। তা, তা থেকে রক্ষে করেছেন গুরু আর কর্তা। আজ ওই সিধুকে দেখে পাখীর জন্য তার মন কদল করালী আর পাখীকে ফিরিয়ে আনাই ‘কৰ্ত্তব্য মনে হল। তার মত লোকের কি ওই ছেলেমেয়ের উপর রাগ করা ভাল দেখায়? রাম, রাম, লোকের কাছে সে মুখ দেখাত কি করে? যাক, ঘোড়াটাও শেষটা বুঝতে পেরেছে, পাখীকে নিয়ে ফিরে যাবে বলেছে। থানায় ছোঁড়া পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে। হতভাগা, বদমাশ কোথাকার! হতভাগা যে শেষে বুঝেছে, এতেই বনওয়ারী খুব খুশি। নিমতেলে পানু প্ৰহ্লাদ নয়ান এরা খানিকটা মাথা নাড়বে, তা নাড়ানাড়ি করুক। বুঝিয়ে দিতে হবে। বড় ঝঞাটের কাজ এই মাতব্বরের কাজ। দশজনের মাথার উপর বসার ভারি আরাম—এই ভাবে সবাই। ওরে বাবা, এ দশের মাথায় বসা নয়—এ হল লোহার গজাল-বসানো গাজনের পাটায় গজালগুলোর সুচালো মাথায় বসে থাকা। হে ভগবান! মতি ঠিক রেখে বাবা, মতিভ্ৰম হলেই ওই গজালে চেপে বিধে মারবে দশে। বুকের ভিতর রাগ অশান্তি হলেই বুঝতে হবে-গজাল বিধছে। করালীর ব্যাপারটা নিয়ে মনে যখন অশান্তি ছিল, তখন ওই গজালই বিধছিল। মিটে গেল—যাক। ভারি আনন্দ।

চন্দনপুরের বাবুদের ওখানেও সে সুফল পেয়েছে। জয় বাবাঠাকুর! বারু শুনছেন তার কথা-বাবুর সেরেস্তার কর্মচারী—কোপাইয়ের অপর পারের গোপের পাড়ার দাসজী মহাশয়ের ছেলে-বনওয়ারীর খুব সুখ্যাতি করলে বাবুর কাছে। পরমের নিন্দেই করলে। বললেওই তো আসল মাতব্বর কাহারপাড়ায়। পরম তো আটপৌরে-পাড়ার। আটপৌরেরা মোটে ছ-সাত ঘর। তাও সকলে পরমকে মানে না। তা ছাড়া পরম লোকও ভাল নয়। ডাকাতিতে জেল খেটেছে। এবং যত কুঁড়ে তত মাতাল। বনওয়ারীর স্বভাব-চরিত্র খুব ভাল।

বাবু মন দিয়ে শুনলেন সব। বললেন–আচ্ছা, দেব তোমাকে জমি।


চন্দনপুরের বড়বাবুর চার মহলা বাড়ি, গাড়ি ঘোড়া লোকলস্কর, যাকে বলে—‘চার চৌকস’ কপাল। ওঁর বাড়ির মা-লক্ষ্মী—সাক্ষাৎ ‘আজলক্ষ্মী’। ওই মায়ের পায়ের পাজের ধুলো যদি বনওয়ারী পায়, তবে কি আর দেখতে আছে! আর ওই রকম মনিৰ নইলে কি মনিব! ওই মনিবের চাকর হলে এক হাত ছাতি দশ হাত হয়ে ওঠে। লোকের কাছে বলে সুখ কত? তা ছাড়া কত দুর্লভ জিনিস তার আশেপাশে? মেলাখেলায় ঝকমকে আলোর তলায় সারারাত বসে নয়ন ভরে দেখে যে সুখ, ওই রাজবাড়িতে চাকর হয়ে ঠিক সেই সুখ। বনওয়ারীর মন কল্পনায় পুলকিত হয়ে উঠল।

হঠাৎ দাঁড়াল বনওয়ারী। ডাইনে জাঙল—সামনে বাঁশবাদি। বয়ে পুবে মা-কোপাইয়ের ‘পলেনের’ অর্থাৎ পলি-পড়া মাঠে রাখাল ছোঁড়ারা গরু ছাগল ভেড়া ছেড়েছে। সকলে দিব্যি। নিশ্চিন্ত হয়ে গাছতলায় কড়ি খেলছে। এদিকে ওই একটা আলোর পাশে একটা শেয়াল মুখ বাড়িয়েছে দেখা যাচ্ছে; ছাগলগুলো চিৎকার করে ছুটছে, দেখেছে তারা; কিন্তু ভেড়াগুলো এক জায়গায় জমাট হয়ে গায়ে গায়ে বেঁধে দাঁড়িয়েছে। আচ্ছা জাত! চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়েছে। নিলে বোধহয় একটা। বনওয়ারী হাঁকলে—লিলে রেলিলে রে! এই ছোঁড়ারা!

রাখালেরা চকিত হয়ে খেলা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই শেয়ালটাকে দেখতে পেলে, সঙ্গে সঙ্গে তারা হইহই করে ছুটল।—লে—লে—লে—লে। বনওয়ারী ভারি বিরক্ত হল। বেকুবের দল! সব একদিকে ছুটল। কাহারের ছেলে হয়ে ধুত্ত্ব শেয়ালের ফন্দি জানে না হতভাগারা! হায় হায় হায়! কালীর আড্ডায় দিনরাত গিয়ে গিয়ে ওদের এই দশা, সেখানে দিনরাত দ্যাশ-বিদেশের আজা-উজিরের গল্প। এসব কুলকর্মের কথা তো হয় না, শিখবে কি করে? ওই একটা শেয়াল ছুটে পালাচ্ছে। তা হলে আসল শিকারি পিছন দিকে কোথাও আছে নিশ্চয়। এই ফাঁকে সে এসে একটা ভেড়ার বাচ্চা নিয়ে পালাবে। আচ্ছা ধূর্তের জাত! রাখাল থাকলে ধূর্তেরা এইভাবে একটা এক দিকে দেখা দেবেউলটো দিকে লুকিয়ে থাকবে আর একটা কি দুটো। রাখালেরা যেমনই ছুটবে দেখা-দেওয়া ধূৰ্তটার দিকে, অমনিই পিছন দিক থেকে সেটা বার হয়ে ঝপ করে ভেড়া ছাগল যা সামনে পাবে মেরে টেনে নিয়ে পালাবে। সাধে “পণ্ডিত মহাশয়’ বলে শেয়ালকে! কিন্তু এদিকের ধূর্ত পণ্ডিতটি কই? কোথায়? যেখানেই থাক, বনওয়ারী ভেড়ার পালের দিকে ছুটতে লাগল।

সামনে একটা নালা। প্রচণ্ড এক লাফ দিয়ে সশব্দে পার হল বনওয়ারী। সঙ্গে সঙ্গে একটা ‘খ্যা’ করে শব্দ হল, তারপরই নালার কুল-ঝোপ থেকে সড়াৎ করে বেরিয়ে পালাল একটা শেয়াল। ছুট ছুট-উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে শেয়ালটা। হরি হরি, পণ্ডিত মহাশয় এইখানেই নালাকে পেছনে রেখে কুলবনের ঝোপে ঝোপে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ভেড়াগুলোর দিকে! বনওয়ারী ঠিক হাত পাঁচেক দূরে লা। ফয়ে পড়েছে। ঘাড়ে পড়লে ঠিক হত। ওঃ-ওঃ—এখন ছুটছে পণ্ডিত! ধর্— ধরধর, ধূৰ্তকে ধ! পণ্ডিতকে ধর!

খুব একচোট হেসে ঘোড়াগুলোকে পণ্ডিতদের ধূর্ত বুদ্ধির কৌশল বুঝিয়ে দিয়ে বললে— খবরদার, সবাই মিলে কখনও ছুটে যাবি না, একজনা থাকবি ছাগলভেড়ার কাছে—বড় দেখে একজনা থাকবি। তা লইলে পণ্ডিত দাঁত মেলে খ্যাখ্যা করে তেড়ে এসে ছেলেমানুষকে ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করে পালাবে। তারপর বললে—ককেটায় আগুন আছে? ট্যাক থেকে বিড়ি বার করলে সে। ধরিয়ে নিলে।

ওই কত্তার ‘থান’ দেখা যাচ্ছে। প্রণাম করলে বনওয়ারী। বাড়ি ফিরতে গিয়ে গায়ের ধারে এসে মনে পড়ল-বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। বউ বলেছিল—“চার পয়সার পোস্তদানা আনতে। ভুলে গিয়েছে। জাঙলে পানার মনিবের দোকান থেকে নিয়ে গেলে হত। কিন্তু না, থাক্। ধার সে নেবে। না। চার আনা পয়সার দু আনা নিজে খেয়েছে, দু আনা দিয়েছে সিধুকে। এতে তার মন খুশি হয়েছে—সিধুকে পয়সা দিয়েছে, এতে তার মন ভারি খুশি। আহা, ‘দুভাগ’ মেয়ে! সিধু এখন আঁস্তাকুড়ের অন্নের সমান। আঁস্তাকুড়ে যে অন্ন পড়ে, সে অন্ন আর তুলে নেবার উপায় নাই। কিন্তু সে অন্নও তো লক্ষ্মী! তার জন্য মন না কেঁদে তো পারে না।

***
 

Users who are viewing this thread

Back
Top