What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected হাঁসুলী বাঁকের উপকথা -তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়⚛️ (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
324
Messages
6,023
Credits
45,388
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
হাঁসুলী বাঁকের উপকথা
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

হাঁসুলী বাঁকের উপকথা – কোপাই নদীর তীরে যেখানে নদীটি হাঁসুলীর মতো বাঁক নিয়েছে সেই বাঁশবাঁদি গ্রামের অন্ত্যজ শ্ৰেণীর মানুষ কাহারদের বিচিত্র জীবনযাত্রার মধ্যে আধুনিক জীবনের আগমন এক বিপ্রতীপ ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে। প্রাচীন কৃষি-ব্যবস্থানির্ভর জীবনে যন্ত্রসভ্যতার আবির্ভাবে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কাহারদের লৌকিক বিশ্বাস, অলৌকিক জগৎ, সংস্কারভাবনা, পূজা-পার্বণ, শিকার-উৎসব, সঙ্গীত বশি এর মধ্যেই যে তাদের সংস্কৃতি তাকে লেখক তন্নিষ্ঠ বাস্তবতায় চিত্রিত করেছেন। তাঁর অনেক লেখার মতো হাঁসুলী বাঁকের মানুষদের কাছ থেকে দেখেছেন। ‘আমার সাহিত্যজীবন’ গ্রন্থে লিখেছেন–‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথার মানুষদের পর্যন্ত আমার এইভাবে জানার সুযোগ হয়েছিল ওই সুচাঁদ এবং আমি বসে গল্প করেছি আর বিড়ি টেনেছি।’ ১৩৫৩-র শারদীয়া আনন্দবাজারে এই উপন্যাসটি বেরিয়েছিল। অবশ্য ওই বছর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দরুন অক্টোবর মাসে পত্রিকা প্রকাশিত হয় নি, হয়েছিল ডিসেম্বর মাসে। ১৩৫৪ সনে বেঙ্গল পাবলিশার্স গ্রন্থাকারে উপন্যাসটি বের করে। এটি উৎসর্গ করা হয়েছিল কবিশেখর কালিদাস রায়কে।
 
হাঁসুলী বাঁকের ঘন জঙ্গলের মধ্যে রাত্রে কেউ শিস দিচ্ছে। দেবতা কি যক্ষ কি রক্ষ বোঝা যাচ্ছে না। সকলে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে কাহারেরা।

কোপাই নদীর প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় যে বিখ্যাত বাঁকটার নাম হাঁসুলী বাঁক—অর্থাৎ যে বাঁকটায় অত্যন্ত অল্প-পরিসরের মধ্যে নদী মোড় ফিরেছে, সেখানে নদীর চেহারা হয়েছে ঠিক হাঁসুলী গয়নার মত। বর্ষাকালে সবুজ মাটিকে বেড় দিয়ে পাহাড়িয়া কোপাইয়ের গিরিমাটিগোলা জলভরা নদীর বাঁকটিকে দেখে মনে হয়, শ্যামলা মেয়ের গলায় সোনার হাঁসুলী; কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে জল যখন পরিষ্কার সাদা হয়ে আসে—তখন মনে হয় রূপোর হাঁসুলী। এই জন্যে বাঁকটার নাম হাঁসুলী বাঁক। নদীর বেড়ের মধ্যে হাঁসুলী বাঁকে ঘন বাঁশবনে ঘেরা মোটমাট আড়াই শো বিঘা জমি নিয়ে মৌজাবাঁশবাঁদি, লাট্‌ জাঙলের অন্তর্গত। বাঁশবাঁদির উত্তরেই সামান্য খানিকটা ধানচাষের মাঠ পার হয়ে জাঙল গ্রাম। বাঁশবাঁদি ছোট গ্রাম; দুটি পুকুরের চারি পাড়ে ঘর-তিরিশেক কাহারদের বসতি। জাঙল গ্রামে ভদ্রলোকের সমাজ–কুমার-সদ্‌গোপ, চাষী-সদ্‌গোপ এবং গন্ধবণিকের বাস, এ ছাড়া নাপিতকুলও আছে এক ঘর, এবং তন্তুবায় দু ঘর। জাঙলের সীমানা বড়; হাঁসিল জমিই প্রায় তিন হাজার বিঘা, পতিতও অনেক–নীলকুঠির সাহেবদের সায়েবডাঙার পতিতই প্রায় তিন শো বিঘা ৷


সম্প্রতি জাঙল গ্রামের সদ্‌জাতির ভদ্রলোক বাবু মহাশয়েরা বেশ থানিকটা ভয়ার্ত হয়ে উঠেছেন। অল্প আড়াই শো বিঘা সীমানার বাঁশবাঁদি গ্রামের অর্থাৎ হাঁসুলী বাঁকের কাহারেরা বলছে— বাবু মশায়ের ‘তরাস’ পেয়েছেন। অর্থাৎ ত্ৰাস। পাবারই কথা। রাত্রে কেউ যেন শিস দিচ্ছে। দিনকয়েক শিস উঠেছিল জাঙল এবং বাঁশবাঁদির ঠিক মাঝখানে ওই হাঁসুলী বাঁকের পশ্চিম দিকের প্রথম বাঁকিতে—বেলগাছ এবং স্যাওড়া ঝোপে ভর্তি, জনসাধারণের কাছে মহাআশঙ্কার স্থান ব্রহ্মদৈত্যতলা থেকে। তারপর কয়েকদিন উঠেছে জাঙলের পূর্ব গায়ে কোপাইয়ের তীরের কুলকাটার জঙ্গল থেকে। তারপর কয়েকদিন শিস উঠেছিল আরও খানিকট। দূরে—ওই হাঁসুলী বাঁকের দিকে স’রে। এখন শিস উঠছে বাঁশবাদির বাশবনের মধ্যে কোনখান থেকে।


বাবুরা অনেক তদন্ত করেছেন। রাত্রে বন্দুকের আওয়াজ করেছেন, দু-একদিন লাঠিসোঁটা বন্দুক নিয়ে গ্রাম থেকে বেরিয়ে এসে হৈ-চৈ করেছেন, খুব জোরালো হাতখানেক লম্বা টর্চের আলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চারিদিক দেখেছেন, তবু কিছুরই সন্ধান হয় নাই। কিন্তু শিস সেই সমানেই বেজে চলেছে। ক্রোশখানেক দূরে থানা। সেখানেও খবর দেওয়া হয়েছে; ছোট দারোগাবাবুও এসেছিলেন দিন তিনেক রাত্রে, কিন্তু তিনিও কোন হদিস পান নাই। তবে নদীর ধারে ধারে শব্দটা ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা ঠিক। এইটাই তিনি সমস্ত শুনে ঠাওর ক’রে গিয়েছেন।


দারোগাবাবু পূর্ববঙ্গের লোক-তিনি বলে গিয়েছেন, নদীর ভিতর কোন একটা কিছু হচ্ছে। ‘নদীর ধারে বাস, ভাবনা বারো মাস।‘ ভাবেন, খানিকট ভাবেন। সন্ধান মিললে পর খবর দিবেন।


‘নদীর ধারে বাস, ভাবনা বার মাস’–কথাটা অবশ্য ডাকপুরুষের বচন–পুরুষানুক্রমে চলেও আসছে দেশে। সে কথা কখনও মিথ্যা নয়, কিন্তু দেশভেদে বচনেরও ভেদ হয়, তাই ওকথাটা হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবাদির জাঙল গ্রামে ঠিক খাটে না। বাংলাদেশের এই অঞ্চলটাতেই খাটে না। সে হল বাংলাদেশের অন্য অঞ্চল। জাঙল গ্রামের ঘোষ-বাড়ির এক ছেলে ব্যবসা করে। কলকাতায়। কয়লা বেচা-কেনা করে, আর করে পাটের কারবার। বাংলাদেশের সে অঞ্চল। ঘোষবাবু ঘুরে এসেছে। সে বলে-সে দেশই হল নদীর দেশ। জলে আর মাটিতে মাখামাখি। বারটি মাস ভরা নদী বইছে; জোয়ার আসছে, জল উছলে উঠে নদীর কিনারা ছাপিয়ে সবুজ মাঠের মধ্যে ছলছলিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে; জোয়ারের পর আসছে ভাটার পালা, তখন মাঠের জল আবার গিয়ে নামছে নদীতে; নদীর ভরা কিনারা খালি হয়ে কুল জাগছে। কিন্তু তাও কিনারা থেকে বড়জোর দু-আড়াই হাত; তার বেশি নামে না। সে নদীও কি এমন-তেমন, আর একটিদুটি? সে যেন গঙ্গা-যমুনার ধারা, অইথই করছে, থমথম করছে; এপার থেকে ওপর পারাপার করতে এ দেশের মানুষের বুক কেঁপে ওঠে। আর সে ধারা কি একটি? কোথা দিয়ে কোন ধারা এসে মিশল, কোন ধারা কোথায় পৃথক হয়ে বেরিয়ে গেল—তার হিসাব নাই। সে যেন জলের ধারার সাতনরী হার,-হাঁসুলী নয়। নদীর বাঁকেরই কি সেখানে অন্ত আছে? ‘আঠার বঁকি’, ‘তিরিশ বঁকি’র বাঁকে বাঁকে নদীর চেহারা সেখানে বিচিত্র। দুধারে সুপারি। আর নারিকেল গাছঃ-সারি নয়—বাগিচা নয়-সে যেন অরণ্য। সঙ্গে আরও যে কত গাছ, কত লতা, কত ফুল, তা যে দেখে নাই সে কল্পনা করতে পারবে না। সে দেখে আশ মেটে না। ওই সব নারিকেল-সুপারির ঘন বনের মধ্য দিয়ে বড় নদী থেকে চলে গিয়েছে সরু সরু খাল, খালের পর খাল। সেই খালে চলেছে ছোট ছোট নৌকা। নারিকেল-সুপারির ছায়ার তলায় টিন আর বাঁশের পাশ দিয়ে তৈরি ঘরের ছোট ছোট গ্রাম লুকিয়ে আছে। সরু খালগুলি কোনো গাঁয়ের পাশ দিয়ে, কোনো গ্রামের মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে–গ্ৰাম থেকে গ্রামান্তরে। ও-দেশের ছোট নৌকোগুলি এ-দেশের গরুর গাড়ির মত। নৌকাতেই ফসল উঠছে ক্ষেত থেকে খামারে, খামার থেকে চলেছে হাটে-বাজারে, গঞ্জে-বন্দরে। ওই নৌকোতেই চলেছে। এ গায়ের মানুষ ও—গাঁয়ের কুটুমবাড়ি, বহুড়ি যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি, মেয়ে আসছে বাপের বাড়ি; মেলা-খেলায়। চলেছে ইয়ারবন্ধুর দল। চাষী চলেছে মাঠে-তাও চলেছে নৌকোতেই, কাস্তে নিয়ে লাঙল নিয়ে একাই চলে নৌকো বেয়ে। শরতের আকাশের ছায়াপথের মত আদি-অন্তহীন নদী, সেই নদীতে কলার মোচার মত ছোট্ট নৌকের মাথায় বসে-বাঁ হাতে ও বাঁ বগলে হাল ধরে, ডান হাতে আর ডান পায়ে বৈঠা চালিয়ে চলেছে। ঘোষের ছেলে শতমুখে সে দেশের কথা বলে ফুরিয়ে উঠতে পারে না। এ নদীর ধারে বাসা-ভাবনার কথাই বটে। ভাবনার কথা বলতে গিয়ে ঘোষের ছেলের চোখে ভয় ফুটে ওঠে-সময়ে সময়ে শরীরে কাঁটা দেয়। ওই নদীর সাতনরী হার আরও নিচে গিয়ে এক হয়ে মিশেছে। তখন আর নদীর এপার ওপার নাই। মা-লক্ষ্মীর গলার সোনার সাতনরী হয়ে উঠেছে যেন মনসার গলার অজগরের বেড়; নদী সেখানে অজগরের মতই ফুসছে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে ফুলে ফুলে উঠছে, যেন হাজার ফণা তুলে দুলছে। এরই মধ্যে কখনও ওঠে আকাশে টুকরো খানেক কালো মেঘ-দেখতে দেখতে বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে যায় তার উপর, যেন কেউ আগুনে-গড়া হাতের আঙুলের ঘা মেরে বাজিয়ে দেয় ওই কালো মেঘের ‘বিষমঢাকি’র বাজনা। যে বাজায় তার মাথায় জটার দোলায় আকাশ-পাতাল দুলতে থাকে। অজগর তখন তার বিরাট অঙ্গ আছড়ে আছড়ে হাজার ফণায় ছোবল মেরে নাচে-কুঁসিয়ে ফুঁসিয়ে মাতনে মাতে। নদীর জলে তুফান জাগে। সে তুফানে বাড়ি ঘর গ্রাম-গোলা-গঞ্জ বন্দর-মানুষ গরু কীটপতঙ্গ সব ধুয়ে মুছে নিয়ে যায়। আবার তুফান নাই, ঝড় নাই, বাইরে দেখতে-শুনতে সব শান্ত স্থির, কোথাও কিছু নাই।–হঠাৎ নদীর ধারের গ্রামের আধখানা কঁপতে লাগল, টলতে লাগল-দেখতে দেখতে কান্ত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল অজগরের মত নদীর অথৈ গর্ভে। মানুষকে সেখানে বার মাস এক চোখ রাখতে হয় আকাশের কোলে-কালো মেঘের টুকরোর সন্ধানে আর এক চোখ রাখতে হয় সবুজ ঘাসে-ফসলে-ঢাকা চন্দনের মত মাটির বুকের উপর-ফাটলের দাগের খোজে-ভাবনা সেখানে বার মাসই বটে।


ছোট দারোগা সেই দেশের মানুষ, তাই ও-কথা বলছেন। কিন্তু হাঁসুলী বাঁকের দেশ আলাদা। হাঁসুলী বাঁকের দেশ কড়াধাতের মাটির দেশ। এ দেশের নদীর চেয়ে মাটির সঙ্গেই মানুষের লড়াই বেশি। খরা অর্থাৎ প্রখর গ্ৰীষ্ম উঠলে নদী শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যায়, ধু-ধু করে বালি–এক পাশে মাত্র একহাঁটু গভীর জল কোনোমতে বয়ে যায়-মা—মরা ছোট মেয়ের মত শুকনো মুখে দুৰ্বল শরীরে, কোনোমতে আস্তে আস্তে ধীরে ধীরে। মাটি তখন হয়ে ওঠে। পাষাণ, ঘাস যায় শুকিয়ে, গরম হয়ে ওঠে আগুনে-পোড়া লোহার মত; কোদাল কি টামনায় কাটে না, কোপ দিলে কোদালা-টোমনারই ধার বেঁকে যায়; গাইতির মত যে যন্ত্র সে দিয়ে কোপ দিলে তবে খানিকটা কাটে, কিন্তু প্রতি কোপে আগুনের ফুলকি ছিটকে পড়ে। খাল বিল পুকুর দিঘি চৌচির হয়ে ফেটে যায়। তখন নদীই রাখে মানুষকে বাঁচিয়ে; জল দেয় ওই নদী। নদীর ভাবনা এখানে বার মাসের নয়।
 
নদীর ভাবনা এখানে চার মাসের। আষাঢ় থেকে আশ্বিন। আষাঢ় থেকেই মা-মরা ছোট মেয়ের বয়স বেড়ে ওঠে। যৌবনে ভরে যায়। তার শরীর। তারপর হঠাৎ একদিন সে হয়ে ওঠে ডাকিনী। কাহারদের এক-একটা ঝিউড়ী মেয়ে হঠাৎ যেমন এক-একদিন বাপ-মা-ভাইভাজের সঙ্গে ঝগড়া করে, পাড়া-পড়শীকে শাপ-শাপান্ত করে, বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে গায়ের পথে, চুল পড়ে এলিয়ে, গায়ের কাপড় যায় খসে, চোখে ছোটে আগুন, যে ফিরিয়ে আনতে যায় তাকে ছুঁড়ে মারে ইট পাটকেল পাথর, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলে কুলে কালি ছিটিয়ে দিয়ে, তেমনিভাবেই সেদিন ওই ভরা নদী অকস্মাৎ ওঠে ভেসে। তখন একেবারে সাক্ষাৎ ডাকিনী! ক্ষমা নাই—ঘেন্না নাই, দিগম্বরীর মত হাঁক ছেড়ে, ডাক পেড়ে, শতমুখে কলকল খলখল শব্দ তুলে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটে। গ্রাম বসতি মাঠ শ্মশান ভাগাড়, লোকের ঘরের লক্ষ্মীর আসন থেকে আঁস্তাকুড়—যা সামনে পড়ে মাড়িয়ে তছনছ করে দিয়ে চলে যায়। সেও এক দিন দুদিন। বড়জোর কালে-কম্মিনে চার-পাঁচ দিন পরেই আবার সংবিৎ ফেরে। কাহারদের মেয়েও যেমন রাগ পড়লে এসে চুপ করে গায়ের ধারে বসে থাকে, তারপর এক পা, দুপা করে এসে বাড়ির কানাচে শুয়ে গুনগুন করে কাঁদে কি গান করে, ঠিক ধরা যায় নাতেমনই ভাবে কোপাইও দুদিন বড়জোর চার দিন পরে আপনি কিনারায় নেমে আসে, কিনারা জাগিয়ে খানিকটা নিচে নেমে কুলকুল শব্দ করে বয়ে যায়। চার মাসের মধ্যে এমনটা হয় পাঁচ বার কি সাত বার, তার বেশি নয়। তার মধ্যে হয়ত এক বার, কি দু তিন বৎসরে এক বার ক্ষ্যাপামি করে বেশি। কোপাই নদী ঠিক যেন কাহার-কন্যে।


তবে কন্যার পাপে কুল নষ্ট। কোপাইয়ের বন্যায়। ঘরঢ়োর না ভাঙলেও ভুগতে হয় বৈকি। জল সরে গেলে ভিজে মাটি থেকে ভাপ উঠতে আরম্ভ করে-মাছিতে মশাতে ভরে যায় দেশ। মানুষ চলে, মানুষের মাথার উপর ঝাকবন্দি মশা সঙ্গে চলে ভনভন শব্দ তুলে, মানুষের শরীর শিউরে ওঠে, তাদের কামড়ে অঙ্গ দাগড়া দাগড়া হয়ে ফুলে ওঠে। গরুর গায়ে মাছি বসে থাকে চাপবন্দি হয়ে, লেজের ঝাপটানিতে তাড়িয়ে কুলিয়ে উঠতে না পেরে তারা অনবরত শিঙ নাড়ে, কখনও কখনও চার পা তুলে লাফাতে থাকে। তাকে সাহায্য করে চাষী, তালপাতা চিরে বঁটার মত করে বেঁধে তাই দিয়ে আছড়ে মাছি মারে, তাড়িয়ে দেয়। এর কিছুদিন পরেই আরম্ভ হয় ‘মালোয়ারী’র জ্বর।

আরও আছে-কোপাইয়ের বন্যার দুর্ভোগ। সাঁওতাল পরগনার পাহাড়িয়া নদী কোপাইয়ে ওই দু-তিন বৎসর অন্তর যে আকস্মিক বন্যা আসে যাকে বলে ‘হাড়পা বান’, সেই বন্যার স্রোতে পড়ে কৃচিৎ কখনও একটা-দুটো ‘গুলবাঘা’ ভেসে এসে হাঁসুলী বাঁকের এই খাপছাড়া বাঁকে, বাঁশবাদি গায়ের নদীকূলের বাঁশবনের বেড়ার মধ্যে আটকে যায়। কখনও মরা, কখনও জ্যান্ত। জ্যান্ত থাকলে বাঘা এই বাঁশবনেই বাসা বাঁধে। আর আসে ভালুক; দুটো-একটা প্রতি বৎসরেই আসে ও-বেটারা। কিন্তু আশ্চৰ্য, ও-বেটারা মরে কখনও আটকে থাকে না বাঁশবনে। জ্যান্ত বাঘ কদাচিৎ আসে, মরাও ঠিক তাই। গোটা এক পুরুষে দুটো এসেছে-একটা মরা, একটা জ্যান্ত। মরাটাকে টেনে বের করে জেলার সায়েবকে সেটার চামড়া দেখিয়ে জাঙলের ঘোষেরা বন্দুক নিয়েছে। জ্যান্তটাকে কাহাররাই মেরেছিল, সেটা দেখিয়ে বন্দুক নিয়েছে গন্ধবণিকেরা। ভালুক এলে কাহারেরাই মারে, প্রতিবার বন্যার পর বাঁশবন খুঁজে-পেতে দেখতে পেলে লাঠিসোটা খোঁচা বল্লম তীরন্ধনুক নিয়ে তাড়া করে মেরে হইহই করে নৃত্য করে; নিজেদের বীৰ্যে মোহিত হয়ে প্রচুর মদ্যপান করে। আর এখানেই আছে বুনো শুয়োর, কাহারদের লাঠিসোটা খোঁচা বল্লম সত্ত্বেও এখানে বুনো শুয়োরের একটা দস্তুরমত আডা-আড়ত গড়ে উঠেছে। অবশ্য বাঁশবাদির বাঁশবেড়ের জঙ্গলে নয়, এখান থেকে খানিকটা দূরে সাহেবডাঙায়। কাহারদের দৌরাত্ম্যে ওরা বাঁশবাদির এলাকায় বাসা বেঁধে রক্ষা পায় না। ওদের বড় আড্ডা হল প’ড়ো নীলকুঠির কুঠিবাড়ির জঙ্গলে। রাত্রে শূকরের দল ঘোঁতঘোঁত শব্দ করে নদীর ধারে ছুটে বেড়ায়, দীতে মাটি খুঁড়ে কন্দ তুলে খায়। কখনও কখনও দুটো—একটা ছটকে এসে গায়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে। অকস্মাৎ কেউ কেউ সামনে পড়ে জখম হয়। তখন কাহারেরা ওদের বিপক্ষে অস্ত্র ধারণ করে। অস্ত্র নয়, ফাঁদ। বুনো শুয়োর মারবার আশ্চর্য কৌশল ওদের। হাতখানেক লম্বা বাখ্যারির ফালির মাঝখানে আধ হাত লম্বা শক্ত সরু দড়ি বেঁধে প্ৰান্তভাগে বাধে ধারালো বড়শি। বড়শিতে টোপের মত গেথে দেয় কলা এবং পচুই মদের ম্যাত। এমনই আট-দশটা ছড়িয়ে রেখে দেয় পথে প্রান্তরে। মদের ম্যাতার গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে শুয়োর ব্যাটারা মাটি শূকে শূকে এসেই পরমানন্দে গাপ করে মুখে পুরে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে বড়শি গেথে যায় জিভে অথবা চোয়ালের মধ্যে। তখন পায়ের খুর দিয়ে টেনে বড়শি ছাড়াতে চেষ্টা করে-তাতে ফল হয় বিপরীত, চেরা খুরের মধ্যে বঁড়শির দড়ি ঢুকে গিয়ে শেষে আটকায় এসে বাখ্যারির ফালিতে। একদিকে বড়শি আটকায় জিভে, অন্যদিকে দড়ি পরানো খুর আটকায় বাখ্যারিতে, বেটা শুয়োর নিতান্তই শুয়োরের মত ঠ্যাঙ তুলে তিন পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সকালে কাহারেরা আসে। লগুড় হাতে, এসেই দমাদম ঠেঙিয়ে মেরে টেনে নিয়ে গিয়ে ভোজনযজ্ঞে লাগিয়ে দেয়।


আর আসে মধ্যে মধ্যে কুমির। প্রায়ই সব মেছো কুমির। কুমির এসে জাঙলের বাবুভাইদের মোছ-ভরা পুকুরে নামে। সে আর উঠতে চায় না। বাবুরা বন্দুক নিয়ে দুমদাম গুলি ছেড়ে, কুমির ভুস করে ডোবে আবার এক কোণে নাকটি জাগিয়ে ওঠে। কাহারেরা পাড়ের উপর বসে খুঁকো টানে আর আমোদ দেখে; তবে হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবাদির ঘাটের পাশে যে দহটা আছে, সেখানে আসে সর্বনেশে মানুষ—গরু-খেকো বড় কুমির—এখানকার লোকে বলে, ‘ঘড়িয়াল’। তখন কাহারেরা চুপ করে বসে থাকে না। তারা বের হয় দল বেঁধে; সর্বাঙ্গে হলুদ মাখে, সঙ্গে নেয় কোদাল কুড়ুল লাঠি সড়কি, বড় বড় বাঁশের ডগায় বাধা শক্ত কাছির ফাঁস। নদীর ধারে ধারে খুঁজতে থাকে কুমিরের আস্তানা। পাড়ের ধারে গর্তের মধ্যে শয়তানের আস্তানার সন্ধান পেলে মহা উৎসাহে তারা গর্তের মুখ বন্ধ করে উপর থেকে খুঁড়তে থাকে সেই গর্ত। তারপর গর্তের নালার মধ্যে অবরুদ্ধ শয়তানকে তারা হত্যা করে। কখনও সুকৌশলে ফ্যাস পরিয়ে বেঁধে টেনে এনে নিষ্ঠুরভাবে দু-তিন দিন ধরে ঠেঙিয়ে মারে। গর্তে কুমির না পেলে গোয়ালপাড়ার গোয়ালাদের মহিষের পাল এনে সেগুলোকে নামিয়ে দেয় দহে। মহিষে জল তোলপাড় করে তুলে ঘড়িয়ালকে বের করে। তারপর কুন্তীরবন্ধের পালা। সে প্রায় এক দক্ষযজ্ঞ। কুন্তীর বেটাকে দক্ষের সঙ্গে তুলনা করা কখনই চলে না, কিন্তু কাহারদের মাতন—সে শিবঠাকুরের অনুচরদের নৃত্য ছাড়া আর কিছু বলা চলে না।

মোটকথা, এ দেশে-হাঁসুলীর বাঁকে নদীর ভাবনা খুব বেশি নয়; যেটুকু আছে, তার একটুমাত্র ‘মালোয়ারী’র পালাটা ছাড়া সকল ভাবনার ভার একা বাঁশবাদির কাহারদের উপর। কিন্তু এবারের এই শিস দেওয়ার ব্যাপারে তারাও হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। প্রথম প্রথম তাদের ধারণা হয়েছিল ব্যাপারটা চোর ডাকাতের নয়, ব্যাপারটা বৃন্দাবনী ধরনের কিছু। তারা ক্ষেপেও উঠেছিল। কারণ এই অঞ্চলের বৃন্দাবনী ব্যাপারের নায়িকারা একশো জনের মধ্যে নিরেনধ্বই জনই হয় তাদের ঘরের মেয়ে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের এ ধারণা পাল্টে গিয়েছে। এখন তাদের ধারণা ব্ৰহ্মদৈত্যতলার ‘কর্তা’ কোনো কারণে এবার বিশেষ রুষ্ট হয়েছেন। হয়ত—বা তিনিই ওই বেলবন ও শেওড়া জঙ্গল থেকে বিদায় নিয়ে নদীর ধারে ধীরে চলে যাচ্ছেন–শিস দিয়ে সেই কথা জানিয়ে দিয়ে চলেছেন হাঁসুলী বাঁকের অধিবাসীদের। এ নিয়ে তাদের জল্পনা-কল্পনা চলছিল। ঘরে ঘরে কুলঙ্গিতে সিঁদুর মাখিয়ে পয়সাও তুলেছে তারা, এবং এ বিষয়ে জাঙলের ভদ্রলোক মহাশয়দের উদাসীনতা দেখে তারা অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়েছে। বেচারি কাহারদের আর সাধ্য কি? জ্ঞানই-বা কতটুকু? তবু একদিন সন্ধ্যায় ওরাই বসালে মজলিস। কিন্তু কাহারদের আবার দুটি পাড়া, বেহারাপাড়া আর আটপৌরে পাড়া। বেহারা পাড়ার মাতব্বর বনওয়ারী আটপৌরেদের সম্পর্কে ঘাড় নেড়ে হতাশা প্ৰকাশ করে বললে-বছরে একবার পুজো, তাই ভাল করে দেয় না। তা ‘লতুন’ পুজো দেবে!

নিমতেলে পানূর ভাল নাম প্ৰাণকৃষ্ণ। পাড়ায় দুজন প্ৰাণকৃষ্ণ থাকায় এ প্রাণকৃষ্ণের বাড়ির উঠানের নিমগাছটির অস্তিত্ব তার নামের আগে জুড়ে দিয়ে নিন্মতেলে পানু বলে ডাকা হয়। সে বললে-জান মুরুবি, কথাটা আমি বাপু ভয়ে বলি নাই এতদিন। তা কথা যখন উঠল, বুয়েছ। কিনা, আর কি বলে যেয়ে-কাণ্ড যখন খারাপ হতেই চলেছে, তখন আর চেপে থাকাটা ভাল লয়। কি বলা?

গোটা মজলিসটির লোকের চোখ তার উপর গিয়ে পড়ল। বনওয়ারী বসে বসেই ঘেঁষড়ে খানিকটা এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলে—কি হয়েছেন বল দিকিনি?

মুখ খুলেছিল পানু, কিন্তু তার আগেই একটা সুচালো বাঁশির শব্দ বেজে উঠল। সেই শিসের শব্দ! শব্দটা আসছে-বাঁশবাদি গায়ের দক্ষিণের বাঁশবন থেকে। সকলে চকিত হয়ে কান খাড়া করে চুপ করে রইল। বনওয়ারী বসে ছিল উত্তর মুখ করে, বা হাতে ছিল ইকো—সে ডান হাতটা কাঁধের উপর তুলে, পিছনে তর্জনীটা হেলিয়ে ইঙ্গিতে দক্ষিণ দিকটা দেখিয়ে দিলে সকলকে। পিছনে দক্ষিণ দিকে বাঁশবেড়ের মধ্যে শিস বাজছে।

আবার বেজে উঠল শিস! ওই!
 
কাহার-বাড়ির মেয়েরা সব উদ্বিগ্ন মুখে উঠানে নেমে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে। কারও হাতে রান্নার হাত; কেউ ছেলে ঘুম পাড়াচ্ছিল, তার কোলে ছেলে; কেউ কঁকুই দিয়ে নিজের চুল আঁচড়াচ্ছিল, তার বা হাতে ধরা রইল চুলের গোছা, ডান হাতে কাঁকুই; কেউ কেরোসিনের ডিবে জ্বেলে ঘরের পিছনে দেওয়াল থেকে ঘুটে ছাড়িয়ে আনতে গিয়েছিল, সে কেরোসিনের ডিবে আর খানচারেক ঘুটে হাতেই ছুটে এসে দাঁড়াল দশজনের মধ্যে। কেবল বদ্ধকালা বুড়ি সুচাঁদ কাহারনী সকলের মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল; সে উপরের অঙ্গের কাপড়ের আঁচলটা নিঃসঙ্কোচে খুলে কঁথা-সেলাই-করা সুচে পুরনো কাপড়ের পাড়ের কস্তা পরিয়ে একটা লম্বা ছেড়া জুড়ছিল, ভুরু কুঁচকে নীরব প্রশ্ন তুলে সকলের দিকে চেয়ে সে শুধু বসে রইল। কিছু বুঝতে না পেরে অবশেষে সে তার স্বাভাবিক মোটা গলায় অভ্যাসমত চিৎকার করে প্রশ্ন করলে–কি?

সুচাঁদের মেয়ে বসন-অৰ্থাৎ বসন্ত, মায়ের বিধিরত্বের জন্য লজ্জা পেয়ে পিছন দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললে—মর তুমি।

সুচাঁদ আবার প্রশ্ন করলে—এবং আরও বেশি একটু চিৎকার করেই বললে-বলি, হল কি? উঠে দাঁড়ালি যে সবাই?

এবার নাতনী পাখী–অর্থাৎ বসন্তর মেয়ে পাখী এসে তার মুখের কাছে চেঁচিয়ে বললে—শি—স।

—শিস? তা ওই জাঙলের ছোড়ারা কেউ দিচ্ছে।

–না-না। হাত নেড়ে বুঝিয়ে বললে—সেই শি-স!

এই মুহূর্তটিতেই আবার শিস বেজে উঠল।

পাখী দিদিমাকে ঠ্যালা দিয়ে বললে-ওই শোন। কিন্তু সুচাঁদ চকিত হয়ে পাখীর মুখে হাত চাপা দিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে বসল। শুনতে পেয়েছে সে। এবং সে উঠে দাঁড়াল; প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় পা দিয়ে অবধি সে গায়ে-ঘরে বুকে কাপড় নামমাত্রই দিয়ে থাকে, তাও দেয় মেয়ে বসন্তের অনুরোধে। এবং সেই উদ্দেশ্যেই আজ এই মুহূর্তে ছেড়া আঁচলটা সে সেলাই করছিলকিন্তু ছেড়া আঁচলটা টেনে গীয়ে তুলতে সে ভুলেই গেল। আঁচলটা টানতে টানতে এসে বনওয়ারীর মুখের কাছে মুখ নিয়ে খুব চিৎকার করে বললে-দেবতার পুজো-আচ্চা করাবি, না গাড়োপাড়ে যাবি?

বনওয়ারীও খুব চিৎকার করে বেশ ভঙ্গি করে হাত-পা নেড়ে বললে—দেবতার পুজো কি আমা-তোমাদের থেকে হয় পিসি? বাবুরা কিছু না করলে আমরা কি করব?

–তবে মরবি? মরতে যে তোদের মরণই হয় আগে?

-–তা কি করবি বল? ভগবানের বিধেন যা তাই তো হবেন। গাঁয়ের দক্ষিণ দিক আগুলে যখন আছি, আর আমরাই যখন কি বলে-ছিষ্টির ওঁচা, তখন আগেই আমাদিগে মরতে হবেন বৈকি।

নিমাতেলে পানু বলে উঠল-না মুরুব্বি। এবার খ্যানত হলে আগে তোমার ওই চৌধুরী—বাড়িতেই হবেন। তা আমি জানি।

বনওয়ারী ভুরুতে এবং দৃষ্টিতে সুগভীর বিস্ময় ও প্রশ্ন জাগিয়ে তুলে বললে-ব্যাপারটা কি বল দি-নি?

সুচাঁদ বললে–কি? কি বললি?

–কিছু লয় গো। তোমাকে বলি নাই। বাস দিকি তুমি।

পাখী এসে সুচাদকে হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিয়ে বললে—বস এইখানে।

পানু বললে—ইবারে যে পুজোটি গেল মুরুবি, তার পাঠাটি খুঁতো ছিলেন।

সবিস্ময়ে সকলে বলে উঠল-থুতো ছিল? মেয়েরা শিউরে উঠল–হেই মা গো!

পানু বৃত্তান্তটি প্রকাশ করলে। পানুর ছাগলের একটি বাচ্চাকে খুব ছোটতে কুকুরে কামড়েছিল।–হেই এতটুন বাচ্চা তখন তোমার, তখন এক শালার কুকুর খপ করে ধরেছিল। পেছাকার পায়ে। সঙ্গে সঙ্গে দেখেছিল লটবরের মা, ঝাটা হাতে ছিল—কুকুরটাকে এক বঁটা মেরে ছাড়িয়ে দিয়েছিল; কিন্তুক দুটি দাঁত বসে গিয়েছিল। হলুদ—মলুদ লাগিয়ে সেরে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম-ওটাকে খাসি করে দেব। তা তোমার এখন-তখন করে হয় নাই, বড় হয়ে গেল। তখন ভেবেছিলাম, কেটে-মেটে একদিন পাড়ায় ভাগ দিয়ে খেয়ে লোব। ই বছর বুঝলে কিনা, একদিন শালার পাঁঠা করেছে কি-চলে গিয়ে ঢুকেছে চৌধুরী-বাড়ি; আর খাবি তো খাবাবুদের শখ করে লাগানো-কি বলে বাপু, সেই ফুলের গাছ। এখন ধরে বেঁধে রেখেছিল। খোজে খোজে আমি গেলাম। গেলাম তো চৌধুরীদের গোমস্ত মারলে আমাকে তিন থাপ্নড়। তারপর সেই গাছ দেখিয়ে’ বললে-কলকাতা থেকে পাঁচ টাকা দিয়ে কলম এনেছিলাম। তোর দাম দেওয়া লাগবে কলমের। আমি কি বলব? দেখলাম-বেটা পাঁঠা গাছটার পাতা—ডাল খেয়েই ক্ষ্যান্ত হয়ে নাই।–টেনে-উপড়ে একেবারে গাছের নেতার মেরে দিয়েছে। আমি তো পায়ে–হাতে ধরলাম। শেষমেশ পাঠাটাকে দিয়ে খালাস। আমি বললাম-কিন্তু দেখেন মশায়, খুঁতো পাঁঠা, কেটে ফিষ্টি-মিষ্টি করে খাবেন, কিন্তুক দেবতা-টেবতার থানে যেন পুজো-টুজো দেবেন। না মশায়। তোমার গায়ে হাত দিয়ে বলছি, নিজের বেটা ওই লটবরের মাথায় হাত দিয়ে কিরে করে বলতে পারি মুরুবি, আমি দুবার বলেছিলাম-খুঁতো পাঁঠা, খুঁতো পাঁঠা, হেই মশায়, যেন দেবতা-থানে দেবেন না। তা এবার বেহ্মদত্যিতলায় কত্তার পুজোতে দেখি–পেরথম চোটেই চৌধুরীবাবুদের সেই পাঁঠা পড়ে গেল। ’এশ্বর’ জানেন-আমার দোষ নাই।


সুচাঁদ খুব বেশি সরে যায় নাই। কাছেই বসে একদৃষ্টি পানুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কথাগুলি শুনছিল; তারই হাতের ডিবেটার আলো পরিপূর্ণভাবে পড়েছিল পানুর মুখের উপর। সে এবার প্রায় কথাগুলিই বুঝতে পেরেছে। সে একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ঘাড় নেড়ে নেড়ে বললে-ভাল লয়, ভাল লয়, এ কখনও ভাল লয়।

সমস্ত মজলিসটা থমথম করে উঠল। মনে হল, সুৰ্চাদের মুখ দিয়ে যেন দেবতাই ওই কথাগুলি বললেন-ভাল লয়, ভাল লয়, এ কখনও ভাল লয়।

সকলে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল।

সেই থমথমে মজলিসে সুচাঁদ আবার আরম্ভ করলে—এই বাবার দয়াতেই হাঁসুলী বাঁকের যা কিছু। ওই চৌধুরীরা তিন পুরুষ আগে তখন গেরুস্ত, সাহেবদের নীলকুঠির গোমস্তা। কুঠিরও তখনও ভাঙা-ভাঙটা অবস্থা। সেবার এল কোপাইয়ের ‘পেলয়’ বান। সে অনেক দিন আগে, তখন আমরা হই নাই; বাবার কাছে গল্প শুনেছি। দুপুরবেলা থেকে ভাসতে লাগল কোপাই। রাত এক পহর হতে তু-ফা-ন! ‘হদের পুকুরের শাহী পাড় পর্যন্ত ড়ুবে গেল। নীলকুঠির সাহেব মোম গাছে চড়ল। তারপর সমস্ত রাত হাড়-হড়-হড়-হড়ী বান চললই-বান চললই। চারদিক আঁধার ঘুরাঘুট্টি। আর ঝম-ঝম জল। সে রাত যেন আজ পার হয়ে কাল হবে না। এমন সময়, রাত তখন তিন পহর চলছে,-হাঁসুলী বাঁকের অনেক দূরে নদীর বুকে যেন আলো আর বাজনা আসছে বলে মনে হল। দেখতে দেখতে পঞ্চশব্দের বান্দ্যি বাজিয়ে নদীর বুক আলোয় ‘আলোকীন্নি’ করে এক বিয়েশাদির নৌকের মত নৌকো এসে লাগল হাঁসুলী বাঁকের দহের মাথায়। সায়েব দেখেছিল-সে ঝাঁপিয়ে নামল জলে। মোম বারণ করলে। সায়েব শুনলে না। তখন মেম আর কি করে। মেমও নামল। সায়েব এক কোমর জল ভেঙে চলল নৌকো ধরতে। হঠাৎ ওই বাবার থান থেকে বেরিয়ে এলেন কত্তা। বলতে কাঁটা দিয়ে উঠছে পায়ে।–সত্যিই শিউরে উঠল সুচাঁদ।-এই ন্যাড়ামাথা, ধবধব করছে রঙ, গলায় রুদ্দাক্ষি, এই পৈতে, পরনে লাল কাপড়, পায়ে খড়ম-কত্তা জলের ওপর দিয়ে খড়ম পায়ে এগিয়ে এসে বললেন—কোথা যাবে সায়েব? নৌকে ধরতে? যেয়ো না, ও নৌকা তোমার লয়। সায়েব মানলে না সে কথা। বললে-পথ ছাড়, নইলে গুলি করেঙ্গা। কত্তা হাসলেন,–বেশ, ধরাঙ্গা। তবে নৌকে। বাস্, যেমনি বলা আমনি সায়েব-মোমের এক কোমর জল হয়ে গেল অথৈ সঁতার। সঙ্গে সঙ্গে, এক ঘুরনচাকিতে পাক দিয়ে ড়ুবিয়ে কো—থা—য় টেনে নিয়ে গেল-শো করে। চৌধুরী ছিল সায়েবের কাছেই আর একটা গাছের ডালে বসে। কত্তা এসে তাকে ডাকলেন-নেমে আয়। চৌধুরী তখন ভয়ে কাঁপছে। কত্তা হেসে বললেন-ওরে বেটা, ভয় নাই, নাম্। তুই ড়ুববি না। বললে না। পেত্যয় যাবে বাবা-চৌধুরী নামল, তো এক হাঁটুর বেশি জল হল না। কত্তা হাসলেন, তা’পরে আঙুল দেখিয়ে বললেন-নৌকো লেগেছে দেখেছিস? ও নৌকো তোর! আমার পুজো করিস, দেবতার কাছে মাথা নোয়াস, অতিথকে জল দিস, ভিখিরিকে ভিখ দিস, গরিবকে দয়া করিস, মানুষের শুকনো মুখ দেখলে মিষ্টি কথা বলিস। যখের কাছে ছিলেন লক্ষ্মী, তোকে দিলাম। যতদিন আমার কথা মেনে চলবি-উনি অচলা হয়ে থাকবেন। অমান্যি করলে ছেড়ে যাবেন, আর নিজেই ফলভোগ করবি। তাকেই–সেই কত্তাকেই-এত হতচ্ছেদা! মা-লক্ষ্মী তো গিয়েছেন। অধর্মের তো বাকি নাই। শেষমেশ সেই কত্তার থানেই খুঁতে, কুকুরে ধরা, এঁটো পাঠার পুজো! এতে কি আর দেবতা থাকেন! দেবতাই বটেন-দেবতাই শিস দিচ্ছেন। চলে যাবেন, তাই জানিয়ে দিচ্ছেন।
 
নদীর সঙ্গে সমান্তরালভাবে বেঁকে চলে গিয়েছে গ্রামের বাঁশের বেড়। হাঁসুলীর মত গোল নদীর বেড়, তাই তার সঙ্গে সমান্তরালভাবে যে বাঁশবেড় বা বাঁশের বাঁধ সেও গোলাকার। বাঁশৰ্বাদিকে ঘিরে রেখেছে সবুজ কস্তার ড়ুরি মালার মত। সেই বাঁশবন থেকে অন্ধকার গোল হয়ে এগিয়ে আসছে কাহারপাড়ার বসতিকে কেন্দ্র করে। উঠানের মজলিসের আলোটার মাথার উপরে এসে আলোর বাধা পেয়ে যেন থমথম করছে। প্যাঁচগুলো কৰ্কশ চেরা গলায় চিৎকার করে উড়ে যাচ্ছে। বাদুড় উড়ছে-পাখসাটের শব্দে মাথার উপরের বাতাস চমকে চমকে উঠছে। মধ্যে মধ্যে দুটোতে ঝগড়া করে পাখসাট মেরে চিলের মত চিৎকার করছে। এরই মধ্যে সুচাঁদের এই গল্পে সেই বেলবন ও শেওড়াবনের কর্তার মাহাত্ম্য, তার সেই গেরুয়াপরা ন্যাড়ামাথা, রুদ্ৰাক্ষ ও ধবধবে পৈতাধারী চেহারার বর্ণনা শুনে এবং সেই কর্তার কাছে কুকুরে-ধরা পাঁঠা দেওয়ার অপরাধের কথা মিলিয়ে সকলে একেবারে নিদারুণ ভয়ে আড়ষ্ট পঙ্গু হয়ে গেল। কার একজনের কোলের ছেলেটা কেঁদে উঠল। মজলিসসুদ্ধ লোক বিরক্তিভরে বলে উঠল-আঃ!

ছেলেটার মা স্তন মুখে দিয়ে ছেলেটাকে নিয়ে সেখান থেকে পালাতে চেষ্টা করলে, কিন্তু সাহস হল না এক ঘরের ভিতরে যেতে।

সুচাদ হঠাৎ আবার বললে-পানী, অপরাধ কিন্তু তোমারও বটে বাবার থানে।

পানু এমন অভিযোগের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তা ছাড়া ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, কেন কে জানে ভয় তারই হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সূৰ্চাদের কথা শুনে সে উত্তর দিতে চেষ্টা করলে, কিন্তু পারলে না!

তারপর বনওয়ারী সুচাদকে সায় দিয়ে বললে—তা ঠিক বলেছ পিসি। পাঠটি তো পানুর ঘরের।

সুচাঁদ এতক্ষণ ধরে নিজে একই কথা বলে আসছিল—কানে না শোনার সমস্যা ছিল না। বনওয়ারী কথা বলতেই সমস্যাটা নতুন করে জাগল। এমন গুরুতর তত্ত্বে রায় দেবার অধিকার কাহারপাড়ায় প্রাচীন বয়সের দাবিতে সুঁচাদ তার নিজস্ব বলে মনে করে। তাতে কেউ বাদ-প্রতিবাদ করলে সে ‘রূরপমান সুচাঁদের সহ্য হয় না। এদিক দিয়ে তার অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি। বনওয়ারীর কথা কানে শুনতে না পেয়ে সে ধারণা করলে-বনওয়ারী তার কথার প্রতিবাদ। করছে, তার কথাতে সে মৃদুস্বরে কথা বলে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। স্থির দৃষ্টিতে সে বনওয়ারীর দিকে একটু ঝুঁকে হাত নেড়ে বললে–তোর মত বনওয়ারী, আমি ঢের দেখেছি।-বুঝলি! তুই, তো সেদিনের ছেলে রে ; মা মরে যেয়েছিল, ‘মাওড়া’ ছেলে-অ্যাই ডিগডিগে ‘প্যাট’। আমার দুধ খেয়ে তোর হাড়-পাজরা ঢাকল। আমার গতির তখন ভাগলপুরের গাইয়ের মতন, বুকের দুধও তেমনি অ্যাই মোষের গাইয়ের মতন। তু আজ আমার ওপর কথা কইতে আসিস? এই আমি বলে রাখলাম, তু দেখিস-গায়ের নোকেও দেখবে-বছর পার হবে না, পানুর ‘খ্যানত’ হবে।

পানু শিউরে উঠল। পানুর বউ দাঁড়িয়ে ছিল একটু দূরে-মেয়েদের মধ্যে;-মৃদু অথচ করুণ সুর তুলে সে কেঁদে উঠল।

বনওয়ারী এবার চিৎকার করে বললে—তাই তো আমিও বলছি গো! তুমি যা বলছি, আমিও তাই বলছি।

–তাই বলছিস?

—হ্যাঁ। বলছি, পাঁঠাটি যখন পানুর ঘরের, তখন পানুর অপরাধ খণ্ডায় কিসে? সুচাঁদের ঘোলাটে চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল-বুদ্ধিমত্তার তৃপ্তির একটা হাসিও ফুটে উঠল। মুখে, সে বলল-অ্যা-অ্যাই! খণ্ডায় কিসে?

পানু কাতর হয়ে প্রশ্ন করলে—তাই তো বলছি গো, খণ্ডায় কিসে তাই বল? শুনছ?—বলি ‘পিতিবিধেন’ কি বল? তার স্বরে চিৎকার করে বললে শেষ কথা কটি।

–পিতিবিধেন?

–হ্যাঁ।

একটু ভাবলে সুচাঁদ। বনওয়ারী প্রমুখ অন্য সকলে আলোচনা আরম্ভ করলো।–তা কাল একবার চল সবাই চৌধুরী-বাড়ি। বলা যাক সকল কথা খুলে।

সুচাঁদ বললে—আর একটি পাঠা তু দে পানু। আর পাড়া-ঘরে চাঁদা তুলে বাবার থানে পুজো হোক একদিন। জাঙলের নোকে যদি ‘রবহেলা’ করে–আমার আপনাদের কত্তব্য করি। না, কি বলিস বনওয়ারী? আর পিতিবিধেন কি আছে বল? কত্তা তো দেবতা-তিনি তো বুঝবেন আমাদের কথা।

বনওয়ারী বারবার ঘাড় নাড়লেন। হ্যাঁ তা বটে, ঠিক কথা। কি বল হে সব? সকলেই ঘাড় নাড়লে। প্ৰহাদ, গোপীচাঁদ, পাগল, দু নম্বর পানু, অমণ, সকলেই সন্মত হল,-হোক, পুজো হোক।

ঠিক এই মুহূর্তে হঠাৎ রাক্রির অন্ধকারটা একটা নিষ্ঠুর চিৎকারে যেন ফালি ফালি হয়ে গেল। কোনো জানোয়ারের চিৎকার। সে চিৎকার তীব্রতায় যত যন্ত্রণাকর তীক্ষ্ণতায় সে তত অসহনীয়। বুনো শুয়োরের বাচ্চার চিৎকার। সম্ভবত দল থেকে ছিটকে পড়েছিল কোনো রকমে, সুযোগ বুঝে শেয়ালে ধরেছে। শুয়োরের বাচ্চার মত এমন তীরের মত চিৎকার কেউ করতে পারে না। আর পারে খরগোশে-বুনো মেটে খরগোশ। এ চিৎকার খরগোশেরও হতে পারে।




ঠিক এই সময়ে ঘেউ ঘেউ করে শব্দ করে ছুটে এল একটা কুকুর। কালো রঙের প্রকাণ্ড বড় একটা কুকুর দৃপ্ত ভঙ্গিতে, সতেজ চিৎকারে পাড়া মজলিস চকিত করে মজলিসের মাঝখান দিয়ে লোকজন না মেনেই লাফ দিয়ে বেরিয়ে গেল ওই চিৎকার লক্ষ্য করে। কুকুরটার গায়ের ধাক্কা লাগল সুচাঁদের গায়ে। ধাক্কা খেয়ে এবং ঠিক কনের কাছে ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনে সুচাঁদ চমকে উঠল। পরমুহূর্তে সে চিৎকার করে বলে উঠল—এই দেখ বনওয়ারী, এই আর এক পাপ। ওই যে হারামজাদা বজাত-ওই ওর পাপের পৌরাশ্চিতি করতে হবে সবাইকে, ওই হারামজাদার জরিমানা করু। তোরা। শাসন করু। শাসন কর। শাসন করু।

বনওয়ারী কিছু উত্তর দেবার আগেই মেয়েদের মধ্য থেকে ফোঁস করে উঠল সুৰ্চাদের নাতনী-বসন্তের মেয়ে পাখী। সে বলে উঠল—ক্যানে, সে হারামজাদা আবার করলে কি তোমার? ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো। যত রাগ সেই হারামজাদার ওপর।

মেয়েরা এবার মুখ টিপে হাসতে লাগল। আশ্চর্য নাকি মানুষের জীবনে রঙের ছোঁয়াচের খেলা। এ দেশের এরা, মানে হাঁসুলী বাঁকের মানুষেরা, নরনারীর ভালবাসাকে বলে ‘রঙ’। রঙ নয়-বলে ‘অঙ’। ওরা রামকে বলে ‘আম’, রজনীকে বলে ‘আজুনী’, রীতকরণকে বলে ‘ইতকরণ’, রাতবিরেতকে বলে ‘আতবিরেত’। অর্থাৎ শব্দের প্রথমে র থাকলে সেখানে ওরা র-কে আ করে দেয়। নইলে যে বেরোয় না জিভে, তা নয়। শব্দের মধ্যস্থলের র দিব্যি উচ্চারণ করে। মেয়ে—পুরুষের ভালবাসা হলে ওরা বলে–অঙ লাগায়েছে দুজনাতে। রঙ-ই বটে। গাঢ় লাল রঙ। এক ফোঁটার ছোঁয়াচে মনভরা অন্য রঙের চেহারা পাল্টে দেয়। যে মেয়েরা এতক্ষণ আশঙ্কায় কাজকর্ম ছেড়ে নির্বাক হয়ে মাটির পুতুলের মত দাঁড়িয়ে সুঁচাদের রোমাঞ্চকর কাহিনী শুনছিল এবং আশঙ্কাজনক ভবিষ্যতের কথা ভেবে কুল-কিনারা পাচ্ছিল না, তারাই পাখীর কথার মধ্যে সেই রঙের ছোঁয়াচ পেয়ে মুহূর্তে চঞ্চল হয়ে উঠল, মুখে হাসি দেখা দিল। ব্যাপারটার মধ্যে ‘রঙ’ ছিল।

সুচাঁদের ওই ‘হারামজাদা’টির নাম করালী। করালী এই পাড়ারই ছেলে। চন্দনপুরে রেলের কারখানায় কাজ করে করালী। কথায় বার্তায় চালে চলনে কাহারপাড়ার সকলের থেকে স্বতন্ত্র। কাউকেই সে মানতে চায় না, কিছুকেই, সে গ্রাহ্য করে না। যেমন রোজগোরে, তেমনই খরচে। সকালে যায় চন্দনপুর, বাড়ি ফেরে সন্ধ্যায়। আজ বাড়ি ফিরে শিস শুনেই সে কুকুর আর টর্চ নিয়ে বেরিয়েছে। এই করালীর সঙ্গে পাখীর মনে মনে রঙ ধরেছে। তাই পাখী দিদিমার কথায় প্ৰতিবাদ করে উঠল। ওদের এতে লজ্জা নাই। ভালবাসলে, সে ভালবাসা লজ্জা বল, ভয় বল, পাড়াপাড়শীর ঘৃণা, বল, কোনো কিছুর জন্যই ঢাকতে জানে না কাহারেরা। সে অভ্যাস ওদের নাই, সে ওরা পারে না। সেই কারণেই মধ্যে মধ্যে কাহারদের তরুণী মেয়ে বানভাসা কোপাইয়ের মত ক্ষেপে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে পথে দাঁড়ায়। তার উপর পাখী বসন্তের মেয়ে, বসন্তের ভালবাসার ইতিহাস এ অঞ্চলে বিখ্যাত। তাকে নিয়ে সে এক পালাগান হয়ে গিয়েছে একসময়। গান বেঁধেছিল লোকে, ‘ও–বসন্তের অঙের কথা শোন!’



সে অনেক কথা। তবে বসন্তের মেয়ে পাখীর কথা এদিক দিয়ে আরও একটু স্বতন্ত্র। এই গীয়েই তার বিয়ে হয়েছে। কাহারপাড়ার পূর্বকালের মাতব্বর-বাড়ির ছেলের সঙ্গে। কিন্তু ভাগ্য মন্দ-সে। রুগৃণ, হাঁপানি ধরেছে এই বয়সে। এদিকে পাখী ভালবেসেছে করালীকে। কারালীকে সমাজের মজলিসে এইভাবে অভিযুক্ত করায় সে মজলিসের মধ্যেই দিদিমার কথার প্রতিবাদ করে উঠল।

দিদিমাও পাখীকে খাতির করবার লোক নয়; সেও সুচাঁদ। সুচাদও পাখীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠল-ওঃ, আঙ যে দেখি মাখামাখি। বলি ওলো ও হারামজাদী! আমি যে নিজের চোখে ছোড়াকে ওই কত্তার থানে ওই কেলে কুকুরটাকে সাথে নিয়ে বাঁটুল ছুঁড়ে ঘুঘু মারতে দেখেছি।

ঠিক সেই সময় মজলিসের পিছন থেকে কেউ, অর্থাৎ করালীই বলে উঠল-কত্তা আমাকে। বলেছে, তু যখন আমার এখানে বঁটুল ছুড়ছিস, তখন আমি একদিন ওই বুড়ি সুচাঁদের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বা দড়াম করে। তু সাবধান হোস বুড়ি, বিপদ তোরই। সে হা—হা করে হেসে উঠল। তার হাসির দমকায় মেয়েদের হাসিতে আরও একটু জোরালো ঢেউয়ের দোলা লাগল।

বনওয়ারী হঠাৎ একটা প্ৰচণ্ড ধমক দিয়ে উঠল–অ্যাই করালী!

করালী হেসে উঠে বললে-ওরে ‘বানাস’ রে! ধমক মারে যে?

—বস বস হারামজাদা, তু বস।

–দাঁড়াও, আসছি আমি।

–কোথা যাবি?

—যাব।–হেসে বললে—দেখে আসি কাণ্ডটা কি? তাতেই তো কুকরটাকে ছেড়ে দিলাম।

–না। কাণ্ড কি সে তোমার দেখবার পেয়োজন নাই। সে আমরা জানি। তোমাদের পাপেই সব হচ্ছে।

হা-হা করে হেসে উঠল করালী।-কি? ওই বেহ্মদত্যি ঠাকুর? উঁহুঁ।

–খবরদার করালী! মুখ খসে যাবে।

-–এই দেখ! আমার মুখ খসে যাবে তো তোমাদের খবরদারি কেন?

ওদিকে বাঁশবনের মধ্যে কোথাও কুকুরটার চিৎকারের ভিতর হঠাৎ যেন একটা সতর্ক ক্রুদ্ধ আক্রমণোদ্যোগের সুর গর্জে উঠল। এই মুহূর্তে সে নিশ্চয় কিছু দেখেছে, ছুটে কামড়াতে যাচ্ছে। করালী একটা অতি অল্প-জোর টর্চের আলো জ্বেলে প্রায় ছুটেই পুকুরের পাড় থেকে নেমে বাঁশবাদির বাঁশবেড়ের গভীর অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। গোটা মজলিসটা স্তব্ধ হয়ে গেল। করালীর কি অসীম স্পর্ধা, কি দুৰ্দান্ত দুঃসাহসী! শুধু পাখীই খানিকটা এগিয়ে গেল। অন্ধকারের মধ্যে, ডাকলে—যাস না। এই, যাস না বলছি। ওরে ও ডাকাবুকো! এই দেখ। ওরে ও গোয়ার-গোবিন্দ। যাস না! যাস না!

তার কণ্ঠস্বর ঢেকে গেল কুকুরটার একটা মৰ্মান্তিক আৰ্তনাদে।

বনওয়ারী বললে-হারামজাদা মরবে, এ তোমাকে আমি বলে দেলাম সুচাঁদপিসি।



কুকুরটা আর্তনাদ করতে করতে ছুটে ফিরে এল। সে এক মর্মান্তিক আৰ্তনাদ।

পিছন পিছন ফিরে এল করালী। কালুয়া, কালুয়া!

কালুয়া মনিবের মুখের দিকে চেয়ে স্থির হবার চেষ্টা করলে, কিন্তু স্থির হতে পারলে নে সে। কোন ভীষণতম যন্ত্রণায় তাকে যেন ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। পাক দিয়ে ফিরতে লাগল কালুয়া। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পড়ে গেল মাটিতে, মুখ ঘষতে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে গোঙাতে লাগল।

করালী তার পাশে বসে গায়ে হাত বুলাতে লাগল, কিন্তু কুকুরটা যেন পাগল হয়ে গিয়েছে, মনিব কেরালীকেও কামড়াতে এল। ছটফট করতে লাগল, মাটি কামড়াতে আরম্ভ করলে, কখনও মুখ তুলে চোঁচালে-অসহ্য যন্ত্রণা অভিব্যক্তি করলে, তারপরই মাটিতে মুখ ঘষতে লাগল।

করালী স্থির হয়ে বসে দেখছিল। তার টর্চটার দীপ্তি ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। হঠাৎ সে মৃদুস্বরে ও বিস্ময়ে আতঙ্কের সঙ্গে বললে—রক্ত!

–রক্ত!

–হ্যাঁ।

সে আঙুল দেখালে-কালুয়ার নাকের ছিদ্রের দিকে। মুখ দিয়ে, নাক দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে আসছে। শেষে ঘটল একটা বীভৎস কাণ্ড! হঠাৎ চোখ দুটো ফুলে উঠে ফেটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রক্তের ধারা পড়ল কালো রোমের উপর দিয়ে। সমস্ত কাহারপাড়া দৃশ্য দেখে শিউরে উঠল।

বনওয়ারী ভয়ার্ত বিজ্ঞস্বরে বললে–কর্তা!

কর্তা বোধহয় খড়মসুদ্ধ বাঁ পা-টা কুকুরটার গলায় চাপিয়ে চেপে দিলেন।
 
সেই দিনই, শেষরাত্রে, তখন ভোরবেলা।

ঘুমের ঘোরের মধ্যে আর্তনাদ করে উঠল বনওয়ারী। তার স্ত্রী গোপালীবালা চমকে জেগে উঠে তাকে ঠেলা দিয়ে ডাকলে–ওগো, বলি–ওগো! ওগো!

ফাল্গুন মাসের শেষ, বিশ তারিখ পার হয়ে গিয়েছে। কঠিন মাটির দেশ। এরই মধ্যে এখানে বেশ গরম পড়েছে, সন্ধ্যাবেলা বেশ গরম ওঠে; কিন্তু শেষরাত্রে শীত শীত। বনওয়ারী বলে গাশিরশির করে। সমস্ত রাত্রি বনওয়ারীর ভাল ঘুম হয় নাই। শেষত্রে গায়ে কথাটা টেনে নিয়ে আরামে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ বু-বু করে চিৎকার করে উঠল। গোপালীবালা তাকে ঠেলে তুলে দিলে–ওগো! ওগো!


বনওয়ারী ঘুম ভেঙে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। তারপর উঠে বসল।


গোপালীবালা জিজ্ঞাসা করলে—কি হয়েছিল? স্বপন দেখছিলা নাকি গো? এমন করে চাঁচালা কেনে গো!

সেও কাঁপছিল ভয়ে।

–হুঁ। একবার তামুক সাজ দেখি।

—কি স্বপন দেখলা বল দি-নি? এমন করে তরাসে বুবিয়ে উঠলে কেনে গো?

-কত্তা আইছিলেন। হাত দুটো জোড় করে কপালে ঠেকালে বনওয়ারী।

–কত্তা! শিউরে উঠল গোপালী।

–হুঁ কত্তা। পিসির কথাই ঠিক গোপালী। একটু চুপ করে থেকে আবার বললে—লে, শিগগির তামুক সাজু। খেয়ে আটপৌরে-পাড়া হয়ে তবে যাব নদীর ধারে। লইলে হয়ত ওদের কারোর দেখা পাব না।-বাবার পুজো দিতে হবে। আটপৌরে-পাড়ার চাঁদা চাই।

পরম কাহার আটপৌরে-কাহারপাড়ার মাতব্বর। তার কাছে যাবে বনওয়ারী।


বাঁশবাঁদি পুরোপুরি কাহারদের গ্রাম গ্রাম ঠিক নয়, ওই জাঙল গ্রামেরই একটা পাড়া। তবে জমিদারি সেরেস্তায় মৌজা হিসেবে ভিন্ন বলে—ভিন্ন গ্রাম বলেই ধরা হয়। দুটি পুকুরের পাড়ে দুটি কাহারপাড়া। বেহারাকাহার এবং আটপৌরে-কাহার। বেহারাকাহারপাড়াতেই চিরকাল লোকজন বেশি, প্রায় পঁচিশ ঘর বসতি; পুব দিকে নীলের মাঠের বড় সেচের পুকুর, নীলের বাঁধের চার পাড় ঘিরে বেহারাদের বসবাস। কোশকেঁধে-বাড়ির বনওয়ারী বেহারাপাড়ার মুরব্বি। বেহারা-কাহারেরা পালকি বয়। বনওয়ারীর পূর্বপুরুষ এক কাঁধে পালকি নিয়ে এক ক্ৰোশ পথ চলে যেত, কাঁধ পর্যন্ত বদল করত না—তাই ওদের বাড়ির নামই কোশ-কেঁধেদের বাড়ি। ওদের বংশটাই খুব বলশালীর বংশ। লম্বা চওড়া দশাসই চেহারা, কিন্তু গড়ন-পিটনটা কেমন যেন মোটা হাতের; অথবা গড়নের সময় ওরা যেন অনবরত নড়েছে, পালিশ তো নাই-ই।

বেহারাপাড়া থেকে রশিখানেক পশ্চিমে আটপৌরে-কাহারদের বসতি। গোরার বাঁধ বলে মাঝারি একটা পুকুরের পাড়ের উপর ঘর কয়েক আটপৌরে-কাহার বাস করে। আটপৌরেরা পালকি কাঁধে করে না, ওরা বেহারাদের চেয়ে নিজেদের বড় বলে জাহির করে। খুব ভাল কথা ব্যবহার করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করে। বলে-আটপৌরে হল অট্টপহরী।

অর্থাৎ অষ্টপ্রহরী।



আসল অর্থ পাওয়া যায় চৌধুরীদের বাড়ির পুরনো কাগজে। সেসব কাগজ এখন প্রায় উইয়ে খেয়ে শেষ করে এনেছে। উইয়ে-খাওয়া কাগজের স্তুপের মধ্যে কিছু কিছু এখনও পুরো আছে। তার মধ্যে ১২২৫-২৬ সালের থোকা জমাওয়াসিল বাকি থেকে পাওয়া যায়—গোটা বাঁশবাঁদি মৌজাটাই ছিল পতিত ভূমি। ওখানে কোনো পুকুরও ছিল না, বসতিও না। জাঙল গ্রামে মোটমাট দশ ঘর বাস্তুর উল্লেখ পাওয়া যায়, সবাই তারা ছিল চাষী সদ্‌গোপ। ১২৫০ সালের কাগজে দেখা যায়—এক নতুন জমাপত্তন-নীলকর শ্রীযুক্ত মেস্তর জেনকিন্‌স সাহেবের নামে। সেই জমার মধ্যে সেই জাঙলের যাবতীয় পতিত ভূমি, তার সঙ্গে গোটা বাঁশবাঁদি মৌজাটাই প্রায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে। জাঙলের পশ্চিম দিকে উঁচু ডাঙার উপর এখনও কুঠিবাড়ির ধ্বংসাবশেষ এবং হ্রদের পুকুর বলে একটা পুকুর দেখা যায়। ওই হ্রদের পুকুরের জল পাকা নালা বেয়ে এসে নীল। পচানোর পাকা চৌবাচ্চাগুলি ভর্তি করে দিত। সেখানটা এখন জঙ্গলে ভরে গিয়েছে এবং ওইখানেই বুনো শুয়োরের একটা উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। বাঁশবাঁদি মৌজা বন্দোবস্ত নিয়ে সায়েবরাই ওখানে পুকুর কাটায় এবং বাঁশবাঁদির সমস্ত পতিতকে নীলচাষের জন্য হাসিল করে তোলে। সেই হাসিল করবার জন্যই এই কাহারপাড়ার লোকেরা বাঁশবাঁদিতে আসে। এসেছিল। অনেক লোক। তার মধ্যে এই কাহার কয়েক ঘরই এখানে বসবাস করে। কয়েকজন পেয়েছিল। কুঠিবাড়িতে চাকরি, লাঠি নিয়ে ঘুরত ফিরত, আবার দরকারমত সাহেব মহাশয়দের ঘরদোরে। কাজ করত; এজন্য তাদের জমি দেওয়া হয়েছিল, এবং এখানকার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী চব্বিশ ঘণ্টার কাজের জন্য চাকরানভোগী হিসেবে খেতাব পেয়েছিল—অষ্টপ্রহরী বা আটপৌরে। বেহারা-কাহারেরা নীলের জমি চাষ করত এবং প্রয়োজনমত সাহেব-মেমদের পালকি বইত। নীলের জমি সেচ করবার জন্য পুকুরটা কাটানো হয়েছিল বলে ওটার নাম নীলের বাঁধ, আর গোরার বাঁধ নামটা হয়েছে গোরা অর্থাৎ সাহেবদের বাঁধ বলে। পুকুরটার জল ভাল—ওই পুকুরে সেকালে কারও নামবার হুকুম ছিল না, ওখান থেকেই যেত সাহেবের ব্যবহারের জল, মধ্যে মধ্যে কুঠিয়াল সাহেবের কাছে সমাগত বন্ধুবান্ধব গোরা সাহেবেরা এসে স্নান করতে নামত। স্নান করত নাকি উলঙ্গ হয়ে। সেই আমল থেকে কাহারদের কয়েকটা ঘরে রূপ এসে বাসা বেঁধেছে। পরম কাহারদের গুষ্টিটার রঙই সেই আমল থেকে ধবধবে ফরসা। সুচাঁদপিসির কর্তাবাবা অর্থাৎ বাবার বাবার রঙ একেবারে সাহেবের মত ছিল। সুচাঁদপিসির রঙও ফরসা। মেয়ে বসন্ত খুব ফরসা নয়। কিন্তু ওর মেয়ে পাখী তো একেবারে হলুদমণি পাখি; চৌধুরী বাড়ির কর্তার ছেলে অকালে মরে গেল মদ খেয়ে, নইলে যুবতী পাখীর এখনকার মুখের সঙ্গে তার মুখের আশ্চর্য মিল দেখা যেত। তেমনিই বড় বড় চোখ, তেমনিই সুডৌল নাক, চুলের সামনেটা পর্যন্ত তেমনিই ঢেউখেলানো। চৌধুরীকর্তা আজ নিঃস্বও বটে, তার উপর হাড়কৃপণও বটে, তবু তিনি বসন্তের মেয়ে পাখীকে মায়ামমতা করেন। বসন্তের ও-বাড়ির সঙ্গে সম্বন্ধ। আজও ঘোচে নাই, সে আজও ও-বাড়ি যায়, যোজখবর করে, দুধের রোজ দেয়, কিন্তু টাকার তাগাদা করে না।

এই চৌধুরীকর্তার বাবার বাবা ছিলেন সাহেবদের নায়েব। তিনি নাকি ছিলেন লক্ষ্মীমন্ত পুরুষ, আর তেমনিই নাকি ছিলেন জবরদস্ত জাহাবাজ বেটাছেলে; তার দাপে নাকি বাঘে-বলদে এক ঘাটে জল খেত। তাঁকেই দয়া করেছিলেন এই বেলবনের মহারাজ যিনি নাকি এখানে কর্তা বলে পরিচিত—গেরুয়া কাপড় পরে, খড়ম পায়ে, দণ্ড হাতে, গলায় রুদ্ৰাক্ষ আর ধবধবে পৈতের শোভায় বুক ঝলমলিয়ে, ন্যাড়া মাথায় যিনি রাত্রে চারদিকে ঘুরে বেড়ান। চন্দনপুরের ভদ্রলোকেরা বলেও কথাটা নেহাতই কাহারদের রচনা করা উপকথা। আসল কথা নীলকুঠি সব জায়গায় যেমনভাবে উঠেছে এখানেও তেমনভাবেই উঠেছে, তবে কোপাইয়ের বান আর। কুঠি-ওঠা ঘটেছে একসঙ্গে। সে সময় কুঠিয়াল সাহেবদের খারাপ সময় চলছিল, কারবার। উঠিয়ে দেবার কথা হচ্ছিল, সেই সময় হঠাৎ একদিন রাত্রে কোপাই ভাসল। তেমন ভাসা কোপাই নাকি কখনও ভাসে নাই। সে বান কুঠিবাড়ি পর্যন্ত ড়ুবিয়ে দিয়েছিল। লোকে বলে, সাহেব-মেম সেই বানে ভেসে গিয়েছিল। কিন্তু সুচাঁদপিসি যে-কথা বললে, সেইটাই হল আসল কথা। সেই কথাটাই বিশ্বাস করে বনওয়ারী। ওই কর্তার কথা অমান্য করতে গিয়েই সাহেব মহাশয় মেমকে নিয়ে তলিয়ে গেল ঘুরনচাকির মধ্যে পড়ে। নইলে সাহেব-মেম—যারা সাত সমুদ্দর পার হয়ে ভাসতে ভাসতে আসে, তারা কোপাইয়ের বানে মরে যাবে? কর্তার লীলা, কর্তার ছলনা সব। চৌধুরীকর্তা দেবতার দয়ায় শুধু যথের ধনই পেলেন না, সাহেব কোম্পানির তামাম সম্পত্তিও পেয়ে গেলেন জলের দামে। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম।


চৌধুরীকর্তাদের আমলেও কাহাররা বেহারার কাজ করেছে। চৌধুরীদের পালকি ছিল দুখানা। ড়ুলি ছিল খানচারেক। আটপৌরেরা তাদের বাড়িতেও আটপৌরের কাজ করেছে।

* * * *

পুরনো কথা যাক; আজকের কথাই বলি। বনওয়ারী পরমের বাড়ি এসে দেখলে, এই ভোরবেলায় পরম বেরিয়ে গেছে। পরমের বউ কালোশশী এই গায়েরই দৌহিত্রী। আটপৌরেদের গোরাচাঁদের বেটীর বেটী। এই গায়েই মানুষ হয়েছে কালোশশী। গোরাচাঁদের ছেলে ছিল না–বড় মেয়ের মেয়েকে নিয়ে মানুষ করেছিল। সুতরাং কালোশশীর সঙ্গে কথা বলতে বউমানুষের সঙ্গে কথা বলার সঙ্কোচ ছিল না। তার উপর এককালে বনওয়ারীর সঙ্গে তার নাকি মনে মনে রঙ চুঁই যুঁই এমন অবস্থা হয়েছিল। সে অনেক কথা। কাহার-কন্যে কালোশশীর জন্যে সেকালে বোধহয় দেবতারাও পাগল হয়েছিল। কিন্তু তার মন কেউ পায় নাই। পেয়েছিল। বনওয়ারী। কিন্তু হায় রে নেকন! আটপৌরে-কাহার-কন্যে বেহারা-কাহারের ঘরে আসে কি করে? হায় রে নেকন!

সেদিনের কথা মনে পড়লে বনওয়ারীর এই বয়সেও বুকের ভিতর তোলপাড় করে ওঠে। রাত্রে উঠে দুজনে গিয়ে মিলত কোপাইয়ের কূলে। গান গাইত কালোশশী। আকাশে উঠত চন্দ্ৰশশী।
 
আটপৌরে-পাড়ার ঘোড়ারা পাহারা দিত; বনওয়ারীকে পাকড়াও করবার জন্যে তাদের সে। কি চেষ্টা! কিন্তু লবডঙ্কা! একদিনও ধরতে পারে নি তারা। বনওয়ারী হাসত আর গান করত সুরু করে চলে যাব গিরগিটির মতন, চোখে চোখে রাখবি কতক্ষণ। ওরা আক্ৰোশে জ্বলত। ওদের সর্দার পরম পথে-ঘাটে ছুতোনাতা করে ঝগড়াও করত। কতবার যে দু-চারটে করে কিল চড় আদান-প্রদান হয়েছে পরমের সঙ্গে তার ঠিক নাই। শেষে পরমের হাতে পড়ল কালোশশী। কপাল কালোশশীর। পরমের হাতে পড়ে ওর আর দুর্গতির শেষ নাই। কালোবউকে বিয়ে করে পরম ভালবাসলে এক ভিনজাতের কন্যাকে; তার উপর মন্দ-সঙ্গে মিশে ধরলে ডাকাতি। কালো-বউ মনের আক্ৰোশে চন্দনপুরে রেজা খাটতে গিয়ে নিজেকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে লাগল। পরমের দ্বীপান্তরের সময় চন্দনপুরে বাবুদের বাড়ির ঝি-বৃত্তি করলে, আর বাবুদের চাপরাসী সিংজীর অনুগৃহীত হয়ে রইল।

পরম দ্বীপান্তর থেকে ফেরার পর কালোশশী গাঁয়ে এসেছে। কালোশশীর অনেক দুর্নাম, অনেক কলঙ্ক,মানুষটা যত বড়, তার চেয়েও বড় তার কলঙ্ক।

আজ কালো-বউ একগাল হেসে সাদরে অভ্যর্থনা করে বললে—কি ভাগ্যি, সকালেই তোমার মুখ দেখলাম! বস।

পরমদাদা গেল কমনে, তাই কওঁ।

—দাদার তরেই আইছিলা তা হলে? হাসলে কালোশশী।

–সে তো তোমার এই খানিক আগে বেরিয়ে গেল। ওই হুঁকোর মাথায় কল্কিতে আগুনও নেবে নাই এখনও। খাও কেনে তামুক।

—কি বেপদ দেখ দি-নি!

—কেন? বেপদটা কি হল? বস, আমার সাথে খানিক গল্প কর নিশ্চিন্দি। মুখে কাপড় দিয়ে হাসতে লাগল কালোবউ।

—বলি, হাসি তোমার আসছে?

—কেনে? তোমাকে দেখে হাসি আসবে না কেনে?

—বলি কাল আতে সনজেকালে শিস শোন নাই?

কালোবউ এবার শঙ্কিত হয়ে উঠল। হা, তা শুনেছি ভাই।

—তবে?

তবের ব্যাপারটা হলরাত্রির অন্ধকার কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভাবনাটা কালো-বউ ভুলে গিয়েছে।

বনওয়ারী এবার বসল। কোটা নিয়ে টানতে টানতে সবিস্তারে কালোশশীকে বললে করালীর কুকুরটার রোমাঞ্চকর ভয়ঙ্কর মৃত্যুর কথা। বললে—তোমাকে বলব কি ভাই, একেবারে মুখে অ তুলে মাথা কাছড়ে মরে গেল। শেষকালে হল কি–

মুখের কাছ থেকে হুঁকোটা সরিয়ে ধরলে বনওয়ারী—তার চোখে-মুখে ফুটে উঠল অপরিসীম আতঙ্ক, গায়ের রোমগুলি কাটার মত খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল।

কালোশশী মুখ হ করে শুনছিল। হাতে আঁটা নিয়ে সে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বনওয়ারী বললে কুকুরটার চোখ ফেটে যাওয়ার কথা। বললে—ফোসকার মত ফুলে উঠে ফ-টা-স করে ফেটে গেল। আর গলগল করে অক্ত।

শিউরে উঠল কালোশশী—ওঃ, মাগো!

বনওয়ারী বললে—তাই এয়েছিলাম পরমদাদার কাছে; পিতিবিধেন তো করতে হবে।

–তা হবে বৈকি! কত্তার আশ্চয়ে বাস করে কত্তার কোপে পড়ে বাঁচব কি করে?

—সেই তো। তা তোমরা করছ কি?

—আমরা? হঠাৎ কালোশশী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল তার স্বামীর উপর।–আমার কপালে ঝাঁটা আর তার কপালে ছাই–বুঝলা দেওর, তার কপালে ছাই। এ পাড়ার অদেষ্টই মন্দ। বুঝলা না? মাতব্বর যদি মাতব্বরের মত হয় তো দশের জন্য ভাবে। সে কি আর তুমি ভাই! সে হল–ফরম আটপৌরে। আতদিন নিজের ভাবনা, জমি-পয়সা আর ওই পয়সা-জমি। কাল আতে সবাই শুনেছে শিস। ভয়ও সবাই পেয়েছে। কিন্তু কি হবে? মাতব্বর গেল চন্ননপুরে, বড়বাবুদের কাছারিতে। তামাম সাহেবডাঙ্গা কিনেছে বাবুরা, শুনেছ তো?

চমকে উঠল বনওয়ারী। কথাটি তার কাছে একটা মূল্যবান কথা। সে প্রশ্ন করলে—সকলে উঠে সেখানেই গিয়েছে বুঝি?

—আবার কোথাও বলব কি দেওর, আতে স্বপন দেখে কথা কয়—বিড়বিড় করে ওই কথা। নয়ানজুলি, ছেচের জল, দে কেটে দে, কোদালে করে মাথা কুপিয়ে দোব-এই কথা।



বনওয়ারী অত্যন্ত অন্যমনস্ক হয়ে গেল। চন্ননপুরের বড়বাবুরা রাজাতুল্য লোক, মস্ত কয়লার ব্যবসা। তারা হঠাৎ জমির উপর নজর দিয়েছেন। পতিত জমি যেখানে যা আছে কিনে চলেছেন। জমি কাটাবেন। কতক নিজেরা কাটিয়ে চাষ করবেন, কতক প্রজাবিলি করবেন। পরমদাদা ভারি। বুদ্ধিমান লোক। খাজখবর অনেক রাখে। সে ঠিক গিয়ে হাজির হয়েছে বাবুদের দরবারে। আর সে কি করছে? নাঃ, ছি ছি ছি!

বনওয়ারীর সমস্ত বৈষয়িক কাজগুলি মনে পড়ে গেল। জাঙলে মনিব-বাড়ি যেতে হবে। ধান পিটানো শেষ হয়ে গিয়েছে—এখনও বছরের দেনা-পাওনার হিসাব হয় নাই। সেখানে একবার যাওয়া উচিত। তারপর একবার চন্ননপুর যেতেই হবে। কালো-বউয়ের কথাগুলি বনওয়ারীর কানে আর যাচ্ছেই না প্রায়!

কালোশশী বলেই চলেছিল-পাশে আমি যে একটা মানুষ শুয়ে থাকি, তা অসুখবিসুখ কি দেহ খারাপ হলে যদি কাতরে কাতরে মরেও যাই, তবু তার ঘুম ভাঙে না। বললে বলে কি জান? বলেনাক ডাকে, তাতেই শুনতে পাই না। সে নাক ডাকা যদি শোন।

কালোশশী মুখে কাপড় দিয়ে হাসতে লাগল।

বনওয়ারী হঠাৎ উঠে পড়ল। হুঁকোটা ঠেসিয়ে রেখে দিয়ে বললে—আমি ভাই তা হলে ওঠলাম।

—বস বস। আর একবার না হয় তামুক সেজে দি।

আমারও তো কাজকৰ্ম্ম আছে ভাই। মুনিব-বাড়ি যেতে হবে। তা, পরে থেমে গেল বনওয়ারী। চন্ননপুর যাওয়ার অভিপ্ৰায়ের কথাটা আর বললে না সে। হাজার হলেও কালোশশী পর।

কালোশশী তার মুখের দিকে চেয়ে হেসে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে আক্ষেপের একটা শব্দ করে বললে–হা-রে, হা-রে! সব পুরুষই এক! ওই কাজ কাজ আর কাজ! মুখে তার এক বিচিত্র অভিব্যক্তি ফুটে উঠল।

বনওয়ারী একটু অপ্রস্তুত হল। সে হাসতে চেষ্টা করে বললে—তা ভাই, কাজ করলেও সে তো সবই তোমাদের জন্যেই। ওজগার করে সমপ্পন তো তোমাদের হাতেই।

বলতে বলতে সে বেরিয়ে এল পরমের বাড়ি থেকে। নইলে এ কথাতেও কালোশশীর কথায় ছেদ পড়বে না।

কাজ অনেক। বনওয়ারীর একদণ্ড বসে থাকলে চলে? ভাই কালোশশী, তোমাকে ভাল তো বারি, কিন্তু উপায় কি? রঙের ছাপ একবার মনে লাগলে কি আর ওঠে? হোক না দেখা এক যুগ পরে, দেখা হলেই দুজনের ঠোঁটেই হাসি ফোটে। ওই রঙটার রকমই হল পাকা। একবার লে, ঘষে ঘষে হিয়ে ক্ষয়ে ফেললেও ওঠে না। কিন্তু যার উপায় নাই, তার জন্যে কেঁদেকেটে মন খারাপ করেই বা লাভ কি? তোমার মায়ের বাপ যে তখন বেহারা-কাহার বলে তোমাকে দিলে না বনওয়ারীর হাতে! আর পরমের সঙ্গে যখন তোমার বিয়ে হয়ে গেল, তখন বনওয়ারী আর হেসে দুটো কথা কয়ে করবে কি? আর তেমন জাতের মানুষ নয় বনওয়ারী। কৰ্তব্যধর্ম বলে একটা কথা আছে। একটা পাড়ার মাতব্বর সে। হরিবোল! হরিবোল! পভু, তুমিই বনওয়ারীকে বাঁচিও। বাঘ-শুয়োর-সাপ-ঝড়-বান—এসব থেকে বাঁচাতে বলে না বনওয়ারী, বনওয়ারীকে তুমি এইসব অন্যায় কারণ থেকে বাঁচিও।

কাজ অনেক। পাড়ায় ফিরে সুচাঁদপিসিকে বলতে হবে—যেন প্রতি বাড়ি ঘুরে পুজোর চাঁদা আর চাল তুলে রাখে। যে মেয়েগুলান ঘুটে মাথায় করে দুধ নিয়ে চন্ননপুরে যাবে, দুধ ও ঘুটে বেচে তারপর সারাদিনটা সেখানে বাবুদের ইমারতে মজুরনী খাটবে, তাদেরই বলে দিতে হবে অবসর করে কেউ যেন কাছারিতে পরমের সঙ্গে দেখা করে সকাল সকাল তাকে বাড়ি ফিরতে বলে। যদি তার চন্ননপুরে যাওয়া আজ না-ই হয়, মুনিব-বাড়িতে যদি আটক পড়েই যায় কোনো রকমে, সেই জন্যই এই ব্যবস্থা ঠাওরালে সে। মুনিব-বাড়িতে তো রকমের অভাব নাই। খামারটা সাফ কর, নয়ত কাঠের গুঁড়িটা থেকে কতকগুলো কাঠ ছাড়িয়ে দিয়ে যা; নয়ত গরুর জাব-খাওয়া ডাবরগুলোর গায়ে মাটি লেপন দে; নিদেন কলার ঝাড়ের মধ্যে পুরনো এটে পচেছে, খুঁড়ে তুলে ফেল। আর হিসেবে? হিসেবে বসলেই তো এক বেলা।
 
আটপৌরে-পাড়া থেকে নিজেদের পাড়ায় ফিরে প্রথমেই তাকে দাঁড়াতে হত, করালীর বাড়ির উঠানে। করালী উঠানেই একটা গর্ত খুঁড়ছে, আর পাখী করালীকে তিরস্কার করছে।

—পচে গন্ধ উঠবে যে!

করালী মাটি কুপিয়েই চলেছে। ছোঁড়াটার দেহখানা শক্ত বটে। আচ্ছা জোয়ান হয়ে উঠেছে! এরই মধ্যে শরীরের বিশেষ করে বুকের পিঠের হাতের পায়ের পেশিগুলো ফুলে উঠেছে, তার উপর ঘেমেছে–চকচক করছে সর্বাঙ্গ। আজ রবিবার-ছোঁড়ার ছুটি, তাই চন্ননপুর না গিয়ে কালুয়া কুকুরটার জন্যে সমাধি খুঁড়তে আরম্ভ করেছে।

পাখী চেঁচিয়েই চলেছে—কথা শুনছিস? না কানে যেছে না?

চেঁচাস না মেলা বকবক করে। করালী মাটি কোপাতে কোপাতেই সংক্ষিপ্ত উত্তর দিবে। কালুয়া কুকুরটাকে সে এইখানেই সমাধি দেবে। কালুয়ার হাড়মাস যে চিল শকুন শেয়ালে ছিঁড়ে খাবে, সে করালীর সহ্য হবে না।

–বাড়িতে টেকা দায় হবে। ভাতের গরাস মুখে তুললে বমি আসবে বদ ঘেরানে।

–তা তোর কি? আমার বাড়ি আসিস না তুই!

–ওরে মুখপোড়া, ওরে নেমকহারাম! তোর মতন নেমকহারাম বজ্জাত কেউ আছে নাকি? বলে যে সেই—যার লেগে মরি, তার ঘা সইতে নারি, তাই তোর বিত্তান্ত। তা আমার ঘেরান। না লাগুক, আমি তোর বাড়িতে না আসি, নসুদিদিও তো মানুষ। সে থাকতে পারবে কেনে?

বনওয়ারী করালীর বাড়ি না ঢুকে পারলে না। বনওয়ারীকে দেখেই পাখী বলে উঠল–এই দেখ মামা; কি করছে দেখ! বাড়িতে কুকুর পুঁতবে সামাজ দেবে। বারণ কর তুমি। নদিদি নাই, উ যা-খুশি তাই করছে।

বনওয়ারী বলে—এই, বলি হচ্ছে কি? বাড়ির উঠোনে ভাগাড় করে কে? তুই কি ক্ষ্যাপা না পাগল?

করালীর টামনার কোপে মাটিতে একটা ফাট দেখা দিয়েছিল ফাটলে টামনার চাড় দিয়ে সেই মাটির একটা চাপ ছাড়াবার চেষ্টা করছিল পাঁতে দাঁত টিপে, প্রাণপণ শক্তি প্রয়োগ করে! সে কোনো উত্তর দিলে না। পাখী বললে আবার বলছে কুকুর পুঁতে যাবে বাঁশবেড় খুঁজতে।

–বাঁশবেড় খুঁজতে। বিস্ময়ের সীমা রইল না বনওয়ারীর।

–হ্যাঁ। কিসে শিস দেয়, কিসে মেরেছে ওর কালুয়াকে, তাই খুঁজে দেখবে।

সর্বনাশ! হে ভগবান! হে বাবা কত্তাঠাকুর—তোমার লীলাখেলার নিরাকরণ করতে চায় ছোঁড়া! একের পাপে দশ নষ্ট হবে! মুহূর্তে সে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল।

—করালী!

করালী এ আওয়াজ শুনে চমকে উঠল, টামনাটা ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে খানিকটা সরে দাঁড়াল। ঘুরে তাকালে সে বনওয়ারীর দিকে।

বনওয়ারীর এই কণ্ঠস্বরকে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। বনওয়ারী সহজে অত্যন্ত ভালমানুষ লোক, পাড়ার মাতব্বর হলেও মাতব্বরির কোনো কঁজ নাই, কোনো অহংকার নাই। হাসি-খুশি নাচ-গান মিষ্টি কথা নিয়েই আছে। কারও সঙ্গে কারও ঝগড়া-বিবাদ হলে দুজনকেই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে গায়ে-পিঠে হাত বুলিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে দেয়; দেখে মনে হয় গরজ যেন বনওয়ারীরই। কিন্তু আর এক বনওয়ারী আছে; কালেকস্মিনে সে দেখা দেয়। সে দেখা দেবার আগে প্রথমেই এই আওয়াজ তুলে সে সাড়া দেয়, সেই বনওয়ারী জাগছে।

সে বনওয়ারী জাগলে বিদ্রোহীকে তৎক্ষণাৎ অসুরের মত শক্তিতে আক্রমণ করে মাটিতে ফেলে, বুকে চেপে বসে, বাঁ হাতে গলা টিপে ধরে, ডান হাতে টেনে ধরতে চেষ্টা করে জিভ। তখন পাঁচ-সাত জন জোয়ান ভিন্ন সে বনওয়ারীকে টেনে সরানো যায় না।

বনওয়ারীর চোখ লাল হয়ে উঠেছে। সে এগিয়ে আসতে আরম্ভ করলে করালীর দিকে। পাখী এবার সামনে এসে ভয়ার্ত স্বরে বললে–না, মামা, না। ও আর সেসব করবে না।

করালী কিন্তু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, স্থিরদৃষ্টিতে বনওয়ারীকে দেখছে।

মুহূর্তে চোখে ফুটছে শঙ্কা, আবার পরমুহূর্তে জ্বলে উঠছে বিদ্ৰোহ।

বনওয়ারী পাখীকে ঠেলে সরিয়ে দিলে। পাখী পিছন থেকে তার হাত ধরতে চেষ্টা করলে–মামা! মামা! তবু বনওয়ারী নীরবে এগুচ্ছে।

শেষে নিরুপায় হয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল পাখী—ও দিদি, দিদি গো! ও দিদি! দিদি অর্থাৎ সুচাঁদ। এ সময়ে এক সুদ পারে বনওয়ারীর সামনে দাঁড়াতে।

বনওয়ারী উত্তরোত্তর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে, এমনভাবে আজও কেউ তাকে অপমান করে নাই। সে এগিয়ে চলল। তবু করালী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে।

করালী কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, হঠাৎ যেন সাহস তার ভেঙে পড়ল, মুহূর্তে সে লাফ দিয়ে উঠানের বেড়াটা ডিঙিয়ে ওপাশে পড়ে ছুটে পালাল মাঠে। বনওয়ারী খানিকটা ছুটল, কিন্তু বয়স হয়েছে বনওয়ারীর, ছুটলে হাফ ধরে। এমনি পালকি কাঁধে সওয়ারী বহনের অভ্যস্ত চালে কাঁধ বদল করে মধ্যে মধ্যে বিশ্রাম নিয়ে দশ ক্ৰোশ হাঁটতে পারে, কিন্তু এমনভাবে ছুটতে আর পারে না। থামতে হল বনওয়ারীকে। ওদিকে গায়ের ধারে দাঁড়িয়ে সুচাঁদপিসি হাঁকছে। মেয়ে ছেলে সব জমে গিয়েছে। প্রহ্লাদ রতন এগিয়ে আসছে। বনওয়ারী অগত্যা ফিরল। যাক হারামজাদার বাচ্চা এখন যাক; কিন্তু যাবে কোথা? ফিরতে হবে, না ফিরতে হবে না? কার এলাকায় ফিরবে?

* * * *
 
ফাল্গুন মাসের সকালবেলা, তাই কাহারেরা বাড়িতে ছিল। কাহারপাড়ায় কাজকর্মের চাপ এখন কম; মাঠে ক্ষেতে চাষ-কর্ম এখন বন্ধ, খামারে ধান মাড়াইও শেষ হয়ে গিয়েছে; রবি ফসলের পালাও প্রায় শেষ; গম কারও পেকেছে, কারও পাকতে শুরু করেছে, ছোলা-মসুরসরষে এ সবেরও ওই অবস্থা। আলুর জমির কাজও আর নাই। কেবল তুলতে বাকি। চৈত্রের প্রথম থেকে একদফা ভিড় লাগবে আবার। কারও কারও আখ আছে নাবি চাষের আখ, সেও মাড়াই হবে চৈত্র মাসে। এখন একমাত্র কাজ মুনিব-বাড়ির দেনা পাওনার হিসেব—সে হিসেব মুনিবদের হাতে। কাজেই পুরুষেরাও সকলে বাড়িতেই ছিল। তাই রক্ষা হল।

প্ৰহ্লাদ রতন বনওয়ারীর সমবয়সী। ওরা এগিয়ে এসে বনওয়ারীর হাত ধরে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। প্রহ্লাদ বললে—করালীর বিহিত যদি না হয় অতন, তাহলে তো কাণ্ড খারাপ। কেউ আর কাউকে মানবে না।

রতন বললে—তা হলে গেরামের পিতুল নাই—এ একেবারে ধ্রোব কথা।

বনওয়ারী কোনো কথা বললে না।

যে দিক দিয়ে ওরা পাড়ায় ঢুকল, সে দিক দিয়ে নিমতেলে পানুর ঘর সামনেই পড়ল। পান্ত নিমতলার পশ্চিম দিকে ছায়াটি যেখানে পড়ে, সকালবেলা সেইখানটিতে তালপাতার চাটাই বিছিয়ে তামাক সেজে মাতব্বরদের অভ্যর্থনা করলে।—বস বনওয়ারীদাদা, অতনদাদা, পেল্লাদখুড়ড়া,বস, তামুক খাও।

একে একে জুটল সকলেই। সুচাঁদও এসে দাঁড়াল। বললে—বেশি আগ করি না বাবা বনওয়ারী, ঘোড়াকে এনে তোর পায়ে ফেলে দিছি আমি।

বনওয়ারী এতেও কোনো কথা বললে না।

সুচাঁদ বললে—আমার হয়েছে এক মরণ, বুঝলি বাবা—এই বুড়ো বয়সে হারামজাদী বেটীর বেটী নিয়ে এ এক বেপদ। গলায় কাটা বিধেছে, সে কাটা ওঠেও না, নামেও না, তাই। সর্বনাশীর করালী ছাড়া সারা তিভুবন খাঁখাঁ-খা করছে। বুড়ির সে হাতনাড়া দেখে এবার সবাই হেসে উঠল। শুধু হাত নাড়াই নয়, খানিকটা নেচে দিলে বুড়ি। সে দেখে বনওয়ারীর মুখেও এবার অল্প একটু হাসি দেখা গেল। পানু ঘরের ভিতর থেকে একটা পাঠার কান ধরে টেনে এনে বললে—এই দেখ বনওয়ারীদাদা, এইটি। কাল আতে এসেই আমরা স্তি-পুরুষে এইটিকে কত্তার পুজোয় দোব ঠিক করেছি। এইটিই তোমার সবচেয়ে বড়, আর গায়েও বেশ আছে। বেশ তেজালো পাঠা।

বনওয়ারী পিঠার গায়ে হাত বুলিয়ে মেরুদণ্ডটা টিপে দেখে বললে, বেশ সাবধানে যতন করে আখিস বাপু দুটো দিন। পুজো পরশু দোবই। শনিবার আছে; বারও পাব।

রতন বললে—আটপৌরেপাড়ায় বলবে না?

বনওয়ারী ঘাড় নেড়ে হতাশা প্রকাশ করে বললে—তবে আর মেজাপ খারাপ হল কেনে! সকালে, সেই ধর পেথম-কাক কোকিল ডাকতে ঘুম ভেঙেছে। সমস্ত আত ভাবনায় ঘুম হয় নাই। ভোর আতে চোখ লেগেছিল খানিকতা তোমার, সঙ্গে সঙ্গে স্বপন হয়ে গেল। দেখলাম যেন, ঠিক কত্তা এসে দাঁড়িয়েছেন মাথার ছিয়রে। বু-বু করে ঘুম ভেঙে গেল। উঠলাম। উঠেই গেলাম পরমের বাড়ি। তা পরম সেই ভোরেই বেরিয়েছে। তা বলে এলাম কালো-বউকে–বলি বোলো পরম এলে।

রতন প্রহ্লাদ দুজনেই একটু হাসলে বনওয়ারীর মুখের দিকে চেয়ে। মজলিসের সকলে–স্ত্রী-পুরুষ সকলে হাসলে। তারা অবশ্য গোপন করে হাসলে।

বনওয়ারী অনুভব করতে পারলে গুপ্ত হাসির ধারার সরস স্পর্শটুকু। সে কথাটাকে ঘুরিয়ে দেবার জন্যই বললে—সে গিয়েছে তোমার চন্ননপুরে বাবুদের বাড়ি। বাবুরা নাকি গোটা সায়েবডাঙা কিনেছে। ডাঙা ভেঙে জমি করবে। খানিক আধেক জমি বিলিও করবে শুনলাম। সঙ্গে সঙ্গে সবার মন ঘুরে গেল; বনওয়ারীও কালো-বউয়ের কথা থেকে লুব্ধ হয়ে ছুটল জমির দিকে।

এটা একটা খবর বটে। নীলকুঠির সাহেবদের সেই ডাঙাটা, যেখানে বন্যা থেকে বাঁচবার জন্য তারা ঘর-দোর করেছিল, কুঠি করেছিল, সেই ডাঙাটা ভেঙে জমি হবে? বিলিও করবে কিছু জমি? এবং তাদেরই একজন সে জমি বিলি নেবার জন্য ভোরবেলায় গিয়ে ধরনা দিয়ে বসে আছে? মুহূর্তে সকলেই চঞ্চল হয়ে উঠল। জমি! জমি!

বনওয়ারী বললে, আমি একটা কথা ভাবছিলাম। শুনছ অতন-ভাই, পেল্লাদ-খুড়ো!




রতন প্রহ্লাদ উৎসুক হয়ে বনওয়ারীর মুখের দিকে চেয়ে বসে বসেই খানিকটা কাছে এগিয়ে এল। কি বল দি-নি? কথা কিন্তু সকলেই বুঝতে পেরেছে। এক চাপ ছোলা-কলাই যখন ভিজে ফুলে ওঠে, তখন যেমন সবগুলি ছোলা থেকেই অঙ্কুর বার হয়ে মাটি ফাটিয়ে উপরের দিকে একসঙ্গে ওঠে, তেমনিভাবে এই খবরের অন্তর্নিহিত আশার সরসতায় সকল কাহারের অন্তর থেকে একই আকাঙ্ক্ষার অঙ্কুর একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কাছাকাছি বসে পরস্পরের মনের খবর পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে পরস্পরকে ছুঁয়ে বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারছে। কিন্তু তবু কথাটা বনওয়ারীর কাছ থেকে আসাই ভাল। বনওয়ারীরও কথাটা বলাই ভাল। কথাটা একদিন প্রকাশ পাবেই, এবং নিজে জমি নিয়ে সে যদি কথাটা কাহারদের কাছে গোপন করে। রাখে, তবে সেটা তার অধর্ম হবে এবং মাতব্বরেরও যোগ্য হবে না। সে বললে, আমাদেরও সব চল কেনে চন্ননপুর। জাঙলের সায়েবডাঙার জমি তো তোমার ধরগা চেয়ে কম লয়; সেরেস্তায় তিন শো বিঘের ডাক। আমরা সবাই মিলে দু বিঘে এক বিঘে করে। বনওয়ারী সকলের মুখের দিকেই তাকালে।

সবাই উদগ্রীব হয়ে উঠেছে, চোখগুলি জ্বলজ্বল করছে—কয়লার মধ্যে পড়া আগুনের ফিনকির মত।

—কি বল?

সুচাঁদ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে নাই। সে দূরে দাঁড়িয়ে সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলে, করালীর আচরণের সকল বিরক্তি এবং রাগ মুছে গিয়ে সকলের মুখে হঠাৎ যেন একটি প্রসন্ন দীপ্তি ফুটে উঠল। কোন সে বিস্ময়কর সংবাদ, যার মধ্যে সর্বজনীন প্রসন্নতার কারণ লুকানো আছে? তার উপর বনওয়ারীর কথা বলবার ভাবের মধ্যে বেশ একটি সলাপরামর্শ করার ভঙ্গিও সে দেখতে পেলে।

এগিয়ে এসে সে বললে—কি? কি রে বনওয়ারী? কি বলছিস তোরা?

প্ৰহ্লাদ হেসে বললে, লাও ঠ্যালা! এখন ঢাকঢোল বাজিয়ে পাড়া গোল করে বল।

সুচাঁদ তার মুখের দিকে চেয়ে বললে—মশকরা করছিস আমার সঙ্গে পেল্লেদে, মুখপোড়া

ছুঁচো?

শুনতে না পেলেও বক্তার মুখের দিকে তাকিয়ে মুখড়া এবং মুখভঙ্গি দেখে সুচাঁদ নির্ভুল ধরতে পারে যে তাকেই তারা ঠাট্টা করছে। এবার নিশ্চয় চিৎকার করে কেলেঙ্কারি করবে বুড়ি। একমাত্র উপায় ব্যাপারটা বলা। বললে বুড়ি মশকরার জ্বালাটা ভুলতে পারে। সুতরাং কথাটা তাকে বলতে হয়, তাই বললে বনওয়ারী। কাছে বসিয়ে চিৎকার করে হাত নেড়ে বুঝিয়ে বললে সব। সুচাঁদ বললো, তা ভাল যুক্তি বটেন। ওই নদীর উ পারে বুঝলি কিনা—

বনওয়ারী উঠে পড়ল। সুচাঁদপিসির বুঝলি কিনা বুঝতে গেলে এ বেলা কাবার হয়ে যাবে। এমনিতেই করালী-শয়তানের পাল্লায় পড়ে দেরি হয়ে গিয়েছে। ভেবেচিন্তে হঠাৎ সে উঠে পড়ল। তারপর চিৎকার করে সুচাঁদকে বললে—তুমি তা হলে পুজোর পয়সা চাল আদায় কোরো পিসি, বুঝলে?

পুজোর? কত্তার পুজোর? হ্যাঁ গো। না হলে কল্যেণ নেই।

অ্যাঁ—আই! না হলে কল্যেণ নাই। সে কথা বুঝবে কে? তা শোন, আর একটি কথা বলি।

কি?

—জমি যদি লিবি, তবে পুজোতে আর একটি পাঁঠা জুড়ে দে। কত্তার আজ্ঞে নিয়ে করবি; আখোড়া পিথিবীর অঙ্গে চোটাবি–কত কি না-জানা না-চেনা না-শোনা রোপোদ্দরব আছে বুঝলি কিনা—না কি বলিস।

কথাটা মনে নিলে সকলের। সকলে বনওয়ারীর দিকে চাইলে। সুচাঁদও চেয়ে রয়েছে তার মুখের দিকে। বনওয়ারীও ঘাড় নেড়ে বললেহা হা, এই একটা কথার মত কথা। হ্যাঁ। ভাল বলেছ পিসি।

—কি বলছিস?

চিৎকার করে বনওয়ারী বললে—তাই হবেন গো।

সুচাঁদ খুশি হয়ে বললে—আ-চ্ছা। এই দে, সে তো বাপের আমলের কথা—

বনওয়ারী চিৎকার করে বাধা দিয়ে বললে—সাতটার টেন পুল পেরিয়ে গেল। উ বেলায় শুনব।

রেলের লাইনটা চলে গিয়েছে গায়ের পুবদিক দিয়ে। চন্ননপুর স্টেশন ছাড়িয়ে লাইনটা কোপাই নদীর উপর ব্রিজ বেঁধে পার হয়ে চলে গিয়েছে। সুলীর বাঁকে বাঁশবাঁদির নীলের-বধ পুকুরের পাড় থেকে বেশ দেখা যায় ব্রিজটা। ওই ব্রিজে যে গাড়িগুলো পার হয়, তাই ধরে চলে কাহারপাড়ার জীবনের ঘড়ি। সকালে ছয়টায় একটা গাড়ি। তারপর সাতটায় গাড়ির সিগনাল পড়লেই পুরুষেরা কাজে বের হয়। আজ তাদের দেরি হয়ে গিয়েছে। তারপর যেই ওই সিগনাল দেখে সাতটার গাড়ি আসে অমনি মেয়েরা বের হয়, খাটতে যায়, ঘুটে বেচতে যায়, দুধ বেচতে যায়।


সুচাঁদ ট্রেনের দিকে চেয়ে রইল। পুলে গাড়ি চাপলে যে শব্দ ওঠে, সে শব্দও তাকে কান পেতে মনোযোগসহকারে শুনতে হয়। গুরুগম্ভীর ঝুমঝম শব্দের যে ক্ষীণ ধ্বনি তার কানে প্রতিধ্বনি তোলে, সেটুকু ভারি মিষ্টি বলে মনে হয় সুচাঁদের। সুচাঁদ বলে—আতে যখন গাড়ি পুল পেরোয়, ঘরে চোখ বুজে শুয়ে আমার মনে হয় কেত্তনের দলের খোল বাজছে।

পুরুষেরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল।

বনওয়ারী বলে দিল সকলকে পরশু আসতে পারব না, আগাম আজ থেকে বলে এখো যেন, হ্যাঁ। নইলে আবার মনিবেরা বলবে—আগে বলিস নাই কেনে, আমার কাজ চলবে কি করে?

***
 
জাঙলের ঘোষ-বাড়ির ভাগজোতদার বনওয়ারী। বনওয়ারীর বাপের আমল থেকে দু পুরুষ ধরে সম্বন্ধ। জাঙলের ঘোষ-বাড়ির যখন নিতান্তই সাধারণ গৃহস্থের অবস্থা, তখন থেকে বনওয়ারীদের সঙ্গে তাদের সম্বন্ধ। বুড়ো ঘোষকৰ্তা যিনি এই সেদিন মারা গিয়েছেন, তখন তার অল্প বয়স ছোকরা মানুষ, তখন তিনি সদ্য পিতৃহীন হয়ে বাউণ্ডুলের মত ঘুরে বেড়াতেন আর ওই চন্ননপুরে বড়বাবুদের নতুন শখের থিয়েটারে মেয়ে সেজে বক্তৃতা করতেন। বাড়িতে ছিল বিধবা মা আর অল্পবয়সী স্ত্রী ও বিধবা বোন। কিন্তু দিন গুজরানের কোনো উপায় ছিল না। জমি না, জেরাত না, কোনো চাকরি না। ছেলে ভাবে না, ভাববার সময় নাই; তাই দিন চালানোর জন্য অনেক ভেবে বিধবা মা বনওয়ারীর বাপের কাছে একটি টেকি পাতবার কাঠ চেয়ে নেয়। এই হল সম্বন্ধের সূত্র। বনওয়ারীর বাপ সেবার কোপাইয়ের বানে একটা বেশ বড় কাঠ ধরেছিল, তারই একটা অংশ সে নিয়েছিল। বউয়ের কানের মাকড়ি বিক্রি করে ছুতোর ডেকে সেই কাঠে ভেঁকি পেতে ধানোনার কাজ নিয়েছিল ঘোষ-গিনি। এ কাজেও তাকে মধ্যে মধ্যে সাহায্য করত বনওয়ারীর মা। এই অবস্থায় ছেলেকে বারবার রোজগারে মন দেওয়ার জন্য অনেক মিনতি করে হতাশ হয়ে অবশেষে সে পাগলের মত এক কাণ্ড করে বসল। একদিন অনেক রাত্রে। থিয়েটারের আডড়া থেকে ছেলে গান গাইতে গাইতে ফিরে এসে যখন ভাত চাইলে, তখন মা একখানা ভাঙা থালায় এক মুঠো সত্যি সত্যি ছাই এনে নামিয়ে দিয়ে বলেছিল-খাও! ছেলে মায়ের মুখের দিকে সবিস্ময়ে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ, তারপর উঠে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

গেল তো গেল পাঁচ বছরের মত। সেই অবস্থায় বনওয়ারীর বাপ-মা ঘোষ-সংসারের দুঃখের সঙ্গে আরও জড়িয়ে পড়ল। আগে বনওয়ারীর মা, তারপর স্ত্রীর টানে বনওয়ারীর বাপ। বনওয়ারীর বাপ চন্ননপুরের বাবুদের বাড়ি থেকে চাল করে দেবার জন্য ধান আনত এবং ঘোষেরা চাল তৈরি করলে চন্ননপুরে চাল পৌঁছে দিয়ে আসত। নিতান্তই একতরফা ব্যাপার। কারণ ধান থেকে চাল করার মজুরি চাল ঘোষেরাই পেত। এ ছাড়াও যে কোনো দরকারে ঘোষ মা, ঘোষ-দিদি নিজেরাই যেত বনওয়ারীর বাবার কাছে। কাঠ তালপাতা মাঠের মাছ ঝুড়িভর্তি গোবর ঘোষ-বাড়িতে দিয়ে আসত আর কি দিতে পারে বনওয়ারীর মত লোকেরা? তাই দিত তারা এবং তাই ছিল ঘোষেদের সংসারের পক্ষে প্রচুর সাহায্য। ঘোষ-মা দিত বন্নন। মায়ের হাতের রান্না অম্রেতো। তারপর ঘোষ একদিন ফিরল রোজগার করে। সেই ঘোষেদের ঘরে লক্ষ্মী এলেন। ঘোষ একটি জোত কিনলেন-জাঙলের ওই চৌধুরীদের কাছে। নদীর ধারের জমি, গোপথের ধার; বান এলে তো ড়ুবে যায়ই, তার উপর গোপথের গরুর পাল নিত্য মুখ দেয়। ফসলে। দশ বিঘে জমি, তার দু বিঘে জমির ধান গরুর পেটেই যেত চিরকাল। তবে রক্ষা এইটুকু যে, খাজনাটা ঠাণ্ডা—দশ বিঘে জমির বছরসাল খাজনা সাড়ে বার টাকা, বিঘাপিছু পাঁচ সিকি নিরিখ। ঘোষের মা বললেন—তারিণী আমার বড় ছেলে। ওই করবে জমি। ওকেই ভাগে জমি দাও।

বনওয়ারীর বাপের নাম ছিল তারিণী।

সংসারে লক্ষ্মী হলেই নাকি সব হয়, শ্রীভ্রষ্ট কুৎসিত মানুষও শ্ৰীমন্ত হয়—একটা রূপ দেখা দেয় তার চেহারায়, কুমতি ঘুচে সুমতি হয়, বিষমাখা জিভের বিষ ঘুচে মধুর মত অমৃত উথলে ওঠে। মায়ের কথায় ঘোষ তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললে—তোমার কথার কি না হতে পারে। তারিণী আমার দাদা। তারিণীদাদাই আমার জমি করবে, বুঝেছ, তারিণী?

তারিণী হেসে বলেছিল—এই দেখেন না, আমাকে কি ফ্যারে ফেলেছেন দেখেন। আমার হাল-বলদ কোথা গো? আপনারা বরং হাল-বলদ করেন, আমি কৃষাণ থাকব।

-হাল-বলদ কর। আমি টাকা দিচ্ছি তোমাকে। ভয় কি, ক্ৰমে শোধ দেবে—ঘোষ বলেছিলেন।


অবাক হয়ে গিয়েছিল তারিণী; সৰ্জাতিকে সেবা করে অমন পুরস্কার পেয়ে সে ধন্য হয়ে গিয়েছিল, বাড়িতে এসে কেঁদেছিল সেদিন। সেই অবধি বনওয়ারীদের ঘরে হাল-বলদ। সেই অবধি বনওয়ারীরা ঘোষেদের জমি চাষ করছে। বাপ তারিণী মারা গিয়েছে, ঘোষকৰ্তাও নাই, ঘোষকৰ্তার ছেলেদের এখন জমজমাট সংসার। মেজ ছেলে ব্যবসা করে দেশ-দেশান্তরে ছুটে বেড়ায়, দু হাতে টাকা রোজগার করে বেঙ্কে জমিয়ে রাখে। ঘোষেদের বাড়িতে বনওয়ারী যে বনওয়ারী তারও এখন কেমন ভয়-ভয় করে। এখন আগের মত সরাসরি বাড়ির ভিতর গিয়ে ঢুকতে পারে না, বড় ঘোষকে এখন আর তেমন উপদেশ দিতে পারে না। সারের টাকার জন্য সেভাবে জোর করে দশটা কথা বলতে পারে না। হিসেবের জন্য তাড়া, তাইবা কেমন করে দেয়? বনওয়ারী সেখানে গিয়ে দেখলে, বড় আর মেজ দুজনে চা খাচ্ছে আর খুব মন দিয়ে সলাপরামর্শ করছে। সে প্রণাম করে বসল উবু হয়ে দাওয়ার উপর। কিছুক্ষণ পর একটা থামে ঠেস দিয়ে ভাল করে বসল। তারপর ঢুলতে লাগল। সারারাত্রি ভাল ঘুম হয় নাই—সকালের মিঠে ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘুম আসছিল। দক্ষিণ দিক থেকে ভারি আমেজী হাওয়া দিচ্ছে। সকালে সূর্য উঠে এরই মধ্যে ভোরের শীতশীত ভাবটা কেটে গিয়েছে। পাতলা ঘুমের মধ্যেই নানা এলোমেলো স্বপ্ন দেখছে সে। কালোশশী, করালী, পরম আরও কত লোক সায়েবডাঙায় জমেছে সব। সায়েবডাঙার কুঠিবাড়ির জঙ্গল থেকে বেরিয়েছে এক মহিষের বাচ্চার মত বড় এবং কালো বুনো পাঁতাল শুয়োর, ঘোৰ্ঘোত করে তীরের মত ছুটে আসছে। দিলে ফেঁড়ে করালীকে। পরম পালাচ্ছে। বনওয়ারীকে জড়িয়ে ধরেছে কালোশশী। বনওয়ারী কি কালোশশীকে ঝাপটা দিয়ে ফেলে পালাতে পারে! খটখট শব্দ করে পিছনে কে এল? বনওয়ারী বুঝতে পারলে, তিনি কে। কর্তা আসছেন। আর ভয় নাই। ভয়ের মধ্যে আশ্বাস পেয়ে বুনো শুয়োরটাকে ধমক দিয়ে সে বিক্রমভরে হাঁক মেরে উঠল, আ—প্‌।

সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের আমেজ ছুটে গেল। সে প্রথমটা ফ্যালফ্যাল করে চারিদিকে দেখে তাল সামলে নিয়ে বসল। ঘোষ-ভাইয়েরা হাসছেন।

—কি রে বনওয়ারী, চেঁচিয়ে উঠলি কেন?

অপ্রস্তুত হয়ে হেসে বনওয়ারী বললে—আজ্ঞে, উ একটো হয়ে গেল আর কি!

একটো হয়ে গেল আর কি! কি হয়ে গেল?

চুপ করে রইল বনওয়ারী। লজ্জা লাগে বৈকি স্বপ্ন দেখে অমনি চিৎকার করেছি এ কথা বলতে।

—কি রে? স্বপ্ন দেখেছিলি বুঝি?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

হা-হা করে হেসে উঠলেন মেজ জনা। প্রশ্ন করলেন—কি স্বপ্ন রে?

আজ্ঞে, স্বপ্ন দেখেছিলাম, দাতাল শুয়োরে তাড়া করেছে। আবার দুজনে হো-হো করে হেসে উঠলেন। বনওয়ারীও হাসতে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে মাথা চুলকাতে লাগল। বললেদাতাল বেটারা ভারি পাজি গো! আপনারা জানেন না। তারপর তাদের হাসি থামলে সুযোগ পেয়ে বললে—আমার হিসেবটা আজ্ঞে, একবার দেখে মিটিয়ে দ্যান। আবার নতুন চাষকৰ্ম এসে গেল।

–হিসেব! তা হবে। কাল আসিস। না হয় পরশু।

—কাল পরশু আসতে পারব আজ্ঞে।

—কেন? কাল পরশু কি করব?

–আজ্ঞে, পাড়াতে চাঁদা তুলে কত্তার পুজো দোব।

—কর্তার পুজো! অসময়ে? কি ব্যাপার?

বনওয়ারী সবিস্তারে বলতে চেষ্টা করে ব্যাপারটা। ইচ্ছে—কিছু চাদাও আদায় করবে মেজ ঘোষের কাছ থেকে। কিন্তু মেজ ঘোষই খানিকটা শুনেই বললেন—তোদের সেই—অন্ধ। জাগো! না, কিবা রাত্ৰি কিবা দিন! সেই এক কালই চলেছে রে তোদের। হুঁ, কর্তাবাবা শিস দিচ্ছে! যত সব-হুঁ!


দমে গেল বনওয়ারী। কিন্তু সামলে নিয়ে সে আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বলা হল না, দুই কানের পাশে হাত দিয়ে উৎকণ্ঠ হয়ে উঠে বসল। হঠাৎ দূরে একটা কোলাহল উঠছে। বলে মনে হল।—আগুন! আগুন!

আগুন! ছুটে বেরিয়ে এল বনওয়ারী। কোথায় আগুন? কোলাহলের দিক লক্ষ্য করে সে ছুটে এল গ্রামের বাইরে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাঁশবাঁদির ওই দক্ষিণ মাথা থেকেই তো প্রচুর ধোঁয়া উঠছে। আকাশে। বাঁশবেড়ের বাঁশের মাথাগুলি ঢেকে গিয়েছে কুণ্ডলী পাকানো রাশি রাশি ধোঁয়ার মেঘে। আষাঢ়ের মেঘের মত জমাট ধোঁয়ার মেঘ।

বনওয়ারীর বুকটা তোলপাড় করে উঠল—কত্তার কোধ!

****
 

Users who are viewing this thread

Back
Top