ইমাম বুখারী (রহঃ) ও তাঁর ছহীহ বুখারী সম্পর্কিত অত্যন্ত চমৎকার একটি কাজের আলোচনা করা এখানে যরূরী। যেটি করেছেন লাহোরের গাযালাহ হামিদ বাট নাম্নী এক মহিলা। এ সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে সামান্য ভূমিকা।
লাহোরের এক খ্যাতিমান আলেম ছিলেন প্রফেসর আব্দুল কাইয়ূম। যিনি ১৯০৯ সালের ১৫ই জানুয়ারী (১৩২৬ হিজরীর ২৩শে যিলহজ্জ) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবারে ইলম ও আমলের অনন্য সম্মিলন পাওয়া যেত। তিনি আরবীতে এম.এ করেন এবং পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিছুকাল পর তিনি প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ১৯৪৭-১৯৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি লাহোর সরকারী কলেজে আরবী সাহিত্য পড়াতে থাকেন। চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণের পর পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির উর্দূ ইসলামী বিশ্বকোষ প্রকল্পের সিনিয়র সম্পাদক হিসাবে যোগদান করেন।
১৯৪৮ সালের ২৪শে জুলাই ‘মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ’ নামে পাকিস্তানে আহলেহাদীছ জামা‘আতের সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করলে প্রফেসর আব্দুল কাইয়ূমকে এর সেক্রেটারী জেনারেল করা হয়। আর মাওলানা সাইয়িদ মুহাম্মাদ দাঊদ গযনভীকে সভাপতি নির্বাচন করা হয়। প্রফেসর ছাহেব ১৯৮৯ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
প্রফেসর আব্দুল কাইয়ূমের পুত্র মেজর যুবায়ের কাইয়ূম মৃত্যুর দ্বিতীয় দিন সমবেদনা জানানোর জন্য আমাকে তাঁর বোন গাযালাহ হামিদ বাটের বাড়িতে নিয়ে যান। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে মুহতারামা গাযালাহ বলেন, তিনি ১৯৬৬ সালে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে আরবীতে এম.এ করেছিলেন এবং ‘শুরূহে ছহীহ বুখারী’ (شروح صحيح بخارى) শিরোনামে এম.এ থিসিস করেছিলেন। আমি একথা শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম। আমি সেই সময় ‘ইদারায়ে ছাকাফাতে ইসলামিয়াহ’-এর সাথে জড়িত ছিলাম। ইদারার পক্ষ থেকে আমি ঐ থিসিসটি গ্রন্থাকারে ছাপিয়ে দিয়েছিলাম। বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে এই গ্রন্থটি অত্যন্ত গুরুত্বের দাবীদার। ছহীহ বুখারীর ভাষ্যগ্রন্থসমূহ লেখার সূচনা কবে হয়েছিল এবং কোন কোন আলেম এই বরকতপূর্ণ খিদমত আঞ্জাম দিয়েছিলেন, সম্মানিতা লেখিকা বিস্তারিতভাবে তা আলোচনা করেছেন। উপমহাদেশে এটি ব্যতিক্রমধর্মী কাজ, যেটি লাহোরের প্রাচীন আহলেহাদীছ পরিবারের যোগ্য মহিলা অত্যন্ত গবেষণা করে লিখেছেন। এতে ছহীহ বুখারীর দু’শর অধিক ব্যাখ্যাগ্রন্থের পরিচিতি সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে। আমি এ গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছি।
মাওলানা মুহাম্মাদ আতাউল্লাহ হানীফ ভূজিয়ানী (আতাউল্লাহ হানীফ ভূজিয়ানী সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : অনুবাদক প্রণীত মনীষী চরিত, মাসিক আত-তাহরীক, মে ২০০৫। ) প্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন। যিনি অবস্থার চাহিদা অনুপাতে শিক্ষকতা ও বক্তৃতা প্রদানের সাথে সাথে গ্রন্থ রচনার সিলসিলাও অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি ১৯০৯ সালের আগে-পরে ভূজিয়ান (যেলা অমৃতসর, পূর্ব পাঞ্জাব) নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যেসকল শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেন তাঁদের মধ্যে মাওলানা আব্দুর রহমান ভূজিয়ানী, মাওলানা আব্দুল জাববার খান্ডিলবী, মাওলানা আবু সাঈদ শারফুদ্দীন দেহলভী, উসতাযে পাঞ্জাব মাওলানা আতাউল্লাহ লাক্ষাবী ও হাফেয মুহাম্মাদ গোন্দলবীর নাম উল্লেখযোগ্য। মাওলানা আতাউল্লাহ হানীফ ভূজিয়ানীর কাছ থেকে অনেক আলেম ও ছাত্র জ্ঞানার্জন করেন। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে সুনানে নাসাঈর হাশিয়া বা পাদটীকা ‘আত-তা‘লীকাতুস সালাফিয়্যাহ’ (التعليقات السلفية) অত্যন্ত গুরুত্ব লাভ করেছে। আল্লাহ এই
গ্রন্থের দারুণ সুখ্যাতি দান করেছেন এবং অসংখ্য আলেম এই গ্রন্থ থেকে উপকৃত হয়েছেন। আমার যতদূর মনে পড়ছে মাওলানা আতাউল্লাহ পাঞ্জাবের প্রথম আলেম, যিনি আরবী ভাষায় কুতুবে সিত্তাহর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ সুনানে নাসাঈর আরবীতে টীকা লিখেছেন।
মাওলানা আতাউল্লাহ হানীফ ভূজিয়ানী ১৯৮৭ সালের ৩রা অক্টোবর (১৪০৮ হিজরীর ৯ই ছফর) মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সারা জীবন সাদাসিধে ও ইলমের খিদমতে অতিবাহিত করেন।
মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জানবাযের পাঠদান ও গ্রন্থ রচনাগত খিদমতের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। তিনি ১৯৩৪ সালে ফিরোযপুর যেলার (পূর্ব পাঞ্জাব, ভারত) ‘চক বধুকে’ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার সহ ঐ এলাকার সকল মানুষ লাক্ষাবী আলেমদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং দ্বীনী মাসায়েল বুঝার জন্য তাঁদের নিকটেই প্রত্যাবর্তন করতেন। মুহাম্মাদ আলী জানবায ‘দারুল হাদীছ রহমানিয়া’ ফারেগ মাওলানা মুহাম্মাদ রহমানীর নিকট নিজ পিতৃপুরুষের গ্রামে (চক বধুকে) জ্ঞানার্জন শুরু করেন। ভারত ভাগের সময় এরা নিজ জন্মস্থান ত্যাগ করে পাকিস্তানে চলে আসেন এবং লায়েলপুর যেলার (বর্তমানে ফায়ছালাবাদ) এক গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। ঐ সময় মুহাম্মাদ আলী জানবাযের বয়স ছিল ১৩ বছর। পাকিস্তানে তিনি বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষকদের নিকট থেকে জ্ঞানার্জন করেন। যাঁদের মধ্যে হাফেয মুহাম্মাদ গোন্দলবীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৮ সালে তিনি জামে‘আ সালাফিয়া (ফায়ছালাবাদ) থেকে ফারেগ হন এবং এখানেই ছাত্রদেরকে পড়াতে শুরু করেন। এরপরে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয় যে, তিনি শিয়ালকোটে চলে যান এবং সেখানে পৃথকভাবে বসবাস করতে থাকেন। ওখানে ‘জামে‘আ রহমানিয়া’ নামে মাদরাসাও চালু করেন।
মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জানবায দরস-তাদরীসের পাশাপাশি লেখালেখিও করেন এবং বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করে নিজেই প্রকাশ করেন। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা হল সুনানে ইবনু মাজাহর শরাহ বা ব্যাখ্যা ‘ইনজাযুল হাজাহ’ (انجاز الحاجة)। আরবী ভাষায় রচিত এই শরাহটি ১২ খন্ডে ও ৭৩৯১ পৃষ্ঠায় বিন্যস্ত। নিঃসন্দেহে এটি এ বিষয়ে এক অতুলনীয় শরাহ। আরো কতিপয় আলেম সুনানে ইবনু মাজাহর শরাহ লিখেছেন, কিন্তু কলেবর ও বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে এই শরাহটি সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যেটি উপমহাদেশের পাঞ্জাব প্রদেশের এই আলেম লিখেছেন।
মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জানবায ১৪২৯ হিজরীর ১৫ই যিলহজ্জ (২০০৮ সালের ১৩ই ডিসেম্বর) শিয়ালকোটে মৃত্যুবরণ করেন। আমি তাঁর জানাযায় শরীক ছিলাম। আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীরের ছোট ভাই প্রফেসর ড. ফযলে ইলাহী তাঁর জানাযার ছালাত পড়ান।
মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জানবাযের পূর্বে আরবী ভাষায় ‘মিফতাহুল হাজাহ’ (مفةاح الحاجة) নামে ইবনু মাজাহর হাশিয়া বা পাদটীকা লিখেছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আলাবী পাঞ্জাবী। তিনি ১৩১২ হিজরীর ১০ই জুমাদাল উলা (১৮৯৪ সালের ১০ই নভেম্বর) এ গ্রন্থের পান্ডুলিপি সমাপ্ত করেন। তিনি অত্যন্ত নেক্কার ও গভীর জ্ঞানের অধিকারী আলেম ছিলেন। মূলতঃ তিনি হাযারা এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। হায়দারাবাদে (দাক্ষিণাত্য) চলে গিয়েছিলেন এবং জীবনের বৃহদাংশ সেখানেই অতিবাহিত করেন। প্রায় ৮০ বছর আয়ু পেয়ে ১৩৬৬ হিজরীর (১৯৪৭ খ্রিঃ) দিকে মৃত্যুবরণ করেন। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিছ শায়খ হুসাইন বিন মুহসিন আনছারী ইয়ামানীর নিকট ইলমে হাদীছ অধ্যয়ন করেন। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে মুসনাদে আহমাদের উর্দূ অনুবাদ এবং অন্যান্য গবেষণামূলক কর্মকান্ড শামিল রয়েছে।
মাওলানা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আলাবী পাঞ্জাবী লিখিত এই হাশিয়া সম্মানিত টীকাকারের জীবদ্দশায় প্রথমবার ১৩১৫ হিজরীতে (১৮৯৭ খ্রিঃ) লক্ষ্ণৌতে সুনানে ইবনে মাজাহর সাথে মুদ্রিত হয়। দ্বিতীয়বার ১৩৯৪ হিজরীর জুমাদাল উলাতে (জুন ১৯৭৪ খ্রিঃ) ‘ইদারাহ ইহইয়াউস সুন্নাহ আন-নাবাবিয়্যাহ’, ডি ব্লক, সারগোধা, পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হয়। তৃতীয়বারও এই প্রতিষ্ঠানই ১৩৯৮ হিজরীর মুহাররম মাসে (জানুয়ারী ১৯৭৮ খ্রিঃ) প্রকাশ করে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় মুদ্রণের তত্ত্বাবধান করেন ‘ইদারাহ ইহইয়াউস সুন্নাহ আন-নাবাবিয়্যাহ’ (সারগোধা)-এর পরিচালক মাওলানা আবুস সালাম মুহাম্মাদ ছিদ্দীক।
শায়খুল হাদীছ মুফতী হাফেয ছানাউল্লাহ মাদানী পাকিস্তানের তাদরীসী ও তাছনীফী (পাঠদান ও গ্রন্থ রচনা) পরিমন্ডলে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য এক নাম। প্রথমতঃ তিনি হাফেয আব্দুল্লাহ রোপড়ীর কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেন। অতঃপর মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখানকার উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষকদের নিকট থেকে জ্ঞানার্জন করেন। ফারেগ হওয়ার পর হাফেয আব্দুর রহমান মাদানীর ‘জামে‘আ রহমানিয়া’-তে (লাহোর) শায়খুল হাদীছ হিসাবে খিদমত আঞ্জাম দিতে শুরু করেন।
তিনি নিজেও ‘মারকাযু আনছারিস সুন্নাহ’ নামে একটি প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে ফারেগ হওয়া পরিশ্রমী ছাত্রদেরকে পাঠদান, লেখনী ও বক্তৃতার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যদিও সেখানে অল্পসংখ্যক ছাত্রকে ভর্তি করা হয়, কিন্তু এটি একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত উন্নত প্রতিষ্ঠান এবং লাহোরে এ বিষয়ে এটিই প্রথম প্রচেষ্টা। এর কার্যক্রম দেখে অনুমিত হয় যে, ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠানটি উন্নতি করবে এবং এর অনেক সুফল দৃশ্যমান হবে। ইলমের সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা হাফেয ছানাউল্লাহ মাদানীকে আমলের গুণেও গুণান্বিত করেছেন।
সাপ্তাহিক ‘আল-ই‘তিছাম’ ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় তাঁর ফৎওয়াসমূহ প্রকাশের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। ‘ফাতাওয়া মাদানিয়াহ ছানাইয়াহ’ নামে তাঁর ফৎওয়া সমষ্টির এক খন্ড আমাদের প্রিয় বন্ধু মাওলানা কারী আব্দুশ শুকূর মাদানী নিজ প্রকাশনা সংস্থা ‘দারুল ইরশাদ’, ২১৪ বি, সাবযাহ যার স্কীম, লাহোর থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশের জন্য প্রস্ত্তত করছেন। মূলতঃ এখানে এটা উল্লেখ করা উদ্দেশ্য যে, মুফতী হাফেয ছানাউল্লাহ মাদানী ‘জায়েযাতুল আহওয়াযী’ (جائزة الأحوذى) নামে ৪ খন্ডে জামে তিরমিযীর শরাহ লিখেছেন। হাফেয ছাহেব পাঞ্জাব প্রদেশের প্রথম আলেম, যিনি আরবী ভাষায় এই বিশাল বড় খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন।
হাফেয ছাহেব এখন আরবী ভাষায় ছহীহ বুখারীর ব্যাখ্যা লিখছেন। অদ্যাবধি অনেক আলেম ছহীহ বুখারীর উর্দূ অনুবাদ করেছেন এবং খুব সুন্দরভাবে করেছেন। হৃদয়ের গভীর থেকে ঐ সকল আলেমের শুকরিয়া আদায় করছি যে, তাঁরা এদিকে মনোনিবেশ করেছেন এবং হাদীছের এই মর্যাদাপূর্ণ বিশাল গ্রন্থের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করে উর্দূভাষীদেরকে নবী (ছাঃ)-এর হাযার হাযার হাদীছ ও অগণিত নির্দেশনার সাথে পরিচিত করানোর বরকতপূর্ণ চেষ্টা করেছেন এবং করছেন। আল্লাহই তাদেরকে এই কল্যাণকর কাজের প্রতিদান দানকারী এবং ইনশাআল্লাহ অবশ্যই তিনি তা দিবেন। কিন্তু আরবী ভাষায় এর বিস্তারিত ব্যাখ্যার ব্যাপারে উপমহাদেশের হাফেয ছানাউল্লাহ মাদানী গুরুত্ব প্রদান করেছেন। যিনি পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোর মহানগরীর বাসিন্দা। দো‘আ রইল আল্লাহ যেন তাঁকে এই বিশাল বড় কাজ সমাপ্ত করার তৌফিক দান করেন।
এখন সিন্ধু প্রদেশের দিকে আসুন! শায়খ আবুল হাসান সিন্ধী- যাকে শায়খ আবুল হাসান সিন্ধী কাবীর বলা হয়- যিনি কুরআন, হাদীছ ও ফিকহে গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। এই মৌলিক জ্ঞান সমূহের অসংখ্য প্রাচীন গ্রন্থের তিনি হাশিয়া বা পাদটীকা লিপিবদ্ধ করেছেন, যেগুলো দ্বারা শিক্ষক-ছাত্র উপকৃত হচ্ছেন এবং বিদ্বানমহলে যেগুলো অত্যন্ত গুরুত্ব লাভ করেছে। এই হাশিয়াগুলো থেকে তাঁর সূক্ষ্মদৃষ্টি, কুরআন-হাদীছে দখল এবং ফিকহে গভীর পান্ডিত্য অনুমান করা যায়।
কুরআন মাজীদ সম্পর্কে তাঁর গ্রহণযোগ্য খিদমত হল তিনি দু'টি প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে বায়যাভী ও তাফসীরে জালালাইনের হাশিয়া বা পাদটীকা লিখেছেন। কুরআন মাজীদের একটি স্বতন্ত্র তাফসীরও লিখেছেন। ইলমে হাদীছের সকল দিক ও বিভাগে তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল। তিনি এই শাস্ত্রের অপরিসীম খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। পাঠদান এবং গ্রন্থ রচনা উভয় দিক থেকে তিনি এই খিদমত করেছেন। এটা তাঁর অনেক বড় ইলমী অবদান যে, তিনি আরবীতে কুতুবে সিত্তাহর হাশিয়া লিখেছেন। ছহীহ বুখারী ও ইবনু মাজাহর হাশিয়া মিসরে এবং নাসাঈর হাশিয়া ভারতে মুদ্রিত হয়েছে। পাকিস্তানের একজন খ্যাতিমান আহলেহাদীছ আলেম মাওলানা আব্দুত তাওয়াব মুলতানী (রহঃ) ছহীহ মুসলিমের হাশিয়া পৃথকভাবে প্রকাশ করেছেন। আবুদাঊদের অপ্রকাশিত হাশিয়া সাইয়িদ ইহসানুল্লাহ শাহ (ঝান্ডার পীর)-এর গ্রন্থাগারে মওজুদ রয়েছে। সম্ভবত তিরমিযীর হাশিয়া সমাপ্ত হয়নি। তিনি মুসনাদে ইমাম আহমাদেরও হাশিয়া লিখেছেন। তিনি মুসনাদে ইমাম আবু হানীফা, হেদায়া ও হেদায়াহ-এর শরাহ ফাতহুল কাদীর-এর হাশিয়া লেখার মর্যাদাও লাভ করেছেন।
তাঁর বিচিত্র ইলমী অবদান থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, তিনি একই সাথে অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন। মুফাসসিরে কুরআন, হাদীছের ব্যাখ্যাকার, খ্যাতিমান ফকীহ, শিক্ষক, মুবাল্লিগ, টীকাকার, গ্রন্থকার সবকিছুই ছিলেন তিনি। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে অপরিসীম যোগ্যতা দান করেছিলেন। শায়খ আবুল হাসান সিন্ধী সম্পর্কে তাঁর ছাত্র মুহাম্মাদ হায়াত সিন্ধী লিখছেন ,
كان زاهدا متورعا كثير الاتباع لكتاب الله وسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم.
'তিনি দুনিয়াত্যাগী, আল্লাহভীরু এবং কুরআন ও সুন্নাহর যথার্থ অনুসারী ছিলেন'। মাওলানা মুহাম্মাদ আবেদ সিন্ধী লিখেছেন, كان الشيخ عاملا بالحديث لايعدل عنه إلى مذهب. 'তিনি হাদীছের প্রতি আমলকারী ছিলেন। হাদীছ ছাড়া কোন মাযহাবের দিকে তিনি মনোনিবেশ করতেন না'।
যে সময় শায়খ আবুল হাসান সিন্ধী মদীনা মুনাউওয়ারায় অবস্থান করছিলেন, সেই সময় তাঁর এক স্বদেশী শায়খ আবুত তাইয়িব সিন্ধীও সেখানে অবস্থানরত ছিলেন। তিনিও অত্যধিক অধ্যয়নকারী খ্যাতিমান আলেম ছিলেন। জামে' তিরমিযীর ভাষ্যকার এবং দুর্রে মুখতারের টীকাকার ছিলেন। মদীনা মুনাউওয়ারায় তাঁর দরসের খ্যাতি ছিল। সমকালীন শাসকগোষ্ঠী এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের দরবারে তাঁর প্রবেশাধিকার ছিল। হানাফী মাযহাবের এবং নকশবন্দী তরীকার অনুসারী ছিলেন। নিজ মাযহাবে অত্যন্ত কট্টর ছিলেন। মাসলাকের ভিন্নতার কারণে শায়খ আবুল হাসান সিন্ধী কাবীরের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তাঁর কারণে শায়খ আবুল হাসান সিন্ধীকে বারবার কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। শায়খ মুহাম্মাদ আবেদ সিন্ধী ঐ সময়ের কিছু ঘটনা বর্ণনা করেছেন। যার আলোকে তাদের দু'জনের দ্বন্দ্বের মূল কারণ প্রতিভাত হয় এবং স্বদেশী ও সমকালীন প্রতিদ্বন্দ্বীর কারণে শায়খ আবুল হাসানকে যে কষ্ট স্বীকার করতে হয়, তা সুস্পষ্ট হয়ে যায়।
শায়খ মুহাম্মাদ আবেদ সিন্ধী বর্ণনা করেন, শায়খ আবুল হাসান সিন্ধী হাদীছের প্রতি আমলকারী ছিলেন। হাদীছ ব্যতীত কোন মাযহাবের দিকে তিনি মনোনিবেশ করতেন না। রুকূর পূর্বে, রুকূ থেকে মাথা উত্তোলনের সময় এবং দ্বিতীয় রাক'আত থেকে উঠার সময় রাফ'উল ইয়াদায়েন করতেন এবং বুকের উপর হাত বাঁধতেন। তাঁর সময়ে হানাফী মাযহাবের অনুসারী শায়খ আবুত তাইয়িব সিন্ধী স্বীয় ফিকহী মাসলাক থেকে কখনো সামান্যতম দূরে সরতেন না। এ ধরনের মাসআলা-মাসায়েলে শায়খ আবুল হাসান ও শায়খ আবুত তাইয়িব সিন্ধীর মাঝে মুনাযারা অব্যাহত থাকত। শায়খ আবুল হাসান মতবিরোধপূর্ণ মাসআলাগুলোতে নিজের মতের অনুকূলে দলীল বর্ণনা করলে শায়খ আবুত তাইয়িব তার প্রত্যুত্তর প্রদানে অপারগ হয়ে যেতেন। সেই দিনগুলোতে এই ঝগড়া সর্বদা চলত।
একদা এক তুর্কী হানাফী বিচারক হিসাবে মদীনা মুনাউওয়ারায় আসলে শায়খ আবুত তাইয়িব তাঁর নিকট যান এবং অভিযোগ করেন যে, শায়খ আবুল হাসান তাঁর ফিকহী মাযহাবের সাথে কোন সম্পর্ক রাখেন না। তিনি কতিপয় মাসআলা উল্লেখ করে বলেন, তিনি এই মাসআলাগুলোতে হানাফী ইমামদের বিরোধী। বিচারক নিজ পদ্ধতি অনুযায়ী শায়খ আবুল হাসানের অবস্থা ও ফিকহী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তথ্য যোগাড় করে অবগত হন যে, শায়খ আবুল হাসান প্রচলিত সকল জ্ঞানে ইমামের মর্যাদায় অভিষিক্ত এবং বিভিন্ন বিষয়ে পূর্ণ পান্ডিত্যের অধিকারী। তাঁর নিকট এই সত্যও প্রকাশিত হয় যে, মদীনাবাসীদের মধ্যে অসংখ্য মানুষ শায়খ আবুল হাসানের ভক্ত এবং তারা তাঁকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখে। এরপরে উল্লিখিত বিচারক শায়খ আবুল হাসানের সাথে সম্মানজনক আচরণ করেন, নিজের জন্য দো'আ চান এবং সম্মানের সাথে তাঁর সাথে কথাবার্তা বলেন।
শায়খ আবুত তাইয়িব সিন্ধীর এই অভ্যাস ছিল যে, যে বিচারকই মদীনা মুনাউওয়ারায় আসতেন তিনি তার নিকট যেতেন এবং শায়খ আবুল হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেন। কিন্তু কোন বিচারকই তাকে কিছু বলতেন না। প্রত্যেক বিচারক তাঁকে নিজের নিকট ডাকতেন এবং তাঁর সাথে কথা বলে তাঁর জ্ঞান ও পরহেযগারিতায় এতটাই প্রভাবিত হতেন যে, সম্মানের সাথে বিদায় জানাতেন। একদা এক গোঁড়া কাযী মদীনায় আসেন। অভ্যাস অনুযায়ী শায়খ আবুত তাইয়িব তাঁর নিকট শায়খ আবুল হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তিনি তাঁকে দরবারে তলব করেন এবং অত্যন্ত কঠোর ভাষায় নাভির নীচে হাত বাঁধতে এবং তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত রাফ'উল ইয়াদায়েন না করতে নির্দেশ দেন। শায়খ উত্তর দেন, আমি আপনার এ কথা মানব না। যেটা হাদীছে উল্লেখ আছে আমি সেটাই করব এবং সেভাবেই ছালাত আদায় করব যেভাবে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত আদায় করেছেন বা আদায় করার হুকুম দিয়েছেন।
বিচারক অত্যন্ত কঠোর স্বভাবের ও গোঁড়া ছিলেন। তিনি শায়খ আবুল হাসানের নিকট থেকে এই চাঁছাছোলা জবাব শুনতে প্রস্ত্তত ছিলেন না। অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি তাঁকে জেলে প্রেরণ করেন এবং এমন সংকীর্ণ কক্ষে বন্দী রাখার নির্দেশ দেন যেটা সর্বদা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। প্রাকৃতিক প্রয়োজনেও তাঁকে বাইরে বের করা হত না। ৬ দিন তিনি সেই অন্ধকার কক্ষে বন্দী থাকেন। অতঃপর মদীনাবাসীরা শায়খের নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে বিচারকের কথা মেনে নিয়ে জেল থেকে মুক্ত হওয়ার কথা বলেন। শায়খ তাদেরকে উত্তর দেন, যে কথা ছহীহ হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত নয় এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণিত নয়, আমি তা কখনো মানব না। আর যে আমল রাসূল (ছাঃ) থেকে প্রমাণিত সেটা আমি কোন অবস্থাতেই ছাড়ব না। তিনি কসম খেয়ে এই কথা বলেছিলেন।