পঞ্চত্রিংশৎ অধ্যায়
সিধু সাইকেল চালাচ্ছে আমি পিছনে বসে।খোকনদা এখন আর মাংসের দোকানে বসে না।কর্মচারী দিয়ে দোকান চালায়।এখন একেবারে বদলে গেছে।সিধু বকে যাচ্ছে আমি কোনো কথা বলছি না।মায়ের সঙ্গে দেখা হলেও এভাবে দেখব ভাবিনি।প্রতিটা দিন যেন এক-একটা বইয়ের পাতা।একটা পৃষ্ঠা পড়ি আর জীবন সম্পর্কে কতকিছু জানতে পারি।বরেনদা একটা কবিতা শুনিয়েছিলেন নদী পাহাড় সাগর সমগ্র প্রকৃতি আমাদের শিক্ষা দেয়।কেউ গ্রহণ করতে পারে কেউ পারে না।খোকনদা মাকে ধরিত্রীর সঙ্গে তুলনা করেছে।সত্যি শেখার শেষ নেই।
সিধুর দোকানের কাছে আসতে আমি নেমে পড়ি।বললাম,এটুকু আমি হেটে চলে যাব।তোকে আর যেতে হবে না।
কাল সকাল নটার মধ্যে চলে যাস।
বাসায় ফিরে আবার রান্না করা তার চেয়ে বরং বাজার থেকে রুটি তরকারি কিনে নিয়ে যাই।গোটা চারেক রুটি আর আলুর দম কিনে বাসায় ফিরে আসলাম।দরজা খুলে ঘরে ঢূকে পোশাক বদলে খাটে শুয়ে পড়লাম।হাসপাতালের দৃশ্যটা ভেসে উঠল।স্বাভাবিকভাবে খেতে পারছে না তাই স্যালাইন দিতে হয়েছে।ভূপেন শেঠের বাড়ী রান্না করতে করতে মা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়।তখন চিৎকার চেচামেচি হতে লোক জড়ো হয়।খোকনদা খবর পেয়ে মাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়।চিকিৎসায় মায়ের জ্ঞান ফিরলেও পুরোপুরি সুস্থ হন নি।
এই বয়সে পরিশ্রমের ধকল নিতে পারেনি।নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল।আমার জন্যই তো মায়ের এত খাটাখাটনী।
সমস্ত রকম শিক্ষার আলাদা মূল্য আছে।পরীক্ষা দিলে আমি হয়তো গ্রাজুয়েট হয়ে যাব।কিন্তু একজন ছুতোর মিস্ত্রী কাঠ খোদাই করে যেমন নক্সা প্রস্তুত করে আমি কি তা পারব? অথচ এদেশে একজন ভাল মাইনের কেরাণি একজন ছুতোর মিস্ত্রীকে নীচু নজরে দেখে।বাইরে কে যেন ডাকছে মনে হল।বেরিয়ে দেখলাম গিরিদি দাঁড়িয়ে আছে।বললাম এসো গিরিদি।
বারান্দায় বসতে বসতে গিরিদি বলল,মনু আমি তোমার রান্না করে দিয়ে যাব?
আমি রুটি কিনে এনেছি।আজ থাক।
হাসপাতালে গেছিলাম তোমারে দেখলাম নাতো?
আমি একটু দেরী করে গেছিলাম।
মনু কোনো দরকার হলি বলবা লজ্জা করবা না।
গিরিদি তুমি কেমন আছো?
কেমনে ভাল থাকি বলো।সারাক্ষন ভগবানরে ডাকতিছি ভগবান তাড়াতাড়ি বৌদিরে বাড়ীতে ফিরোয় এনি দাও।আজ নিয়ে দুইদিন হয়ে গেল এখনো সালান দেচ্ছে।তুমার মামা আসতিছে আমি আসি।কোনো দরকার হলি বলবা।
সুবীরমামা সাইকেল নিয়ে হাজির হল।গিরিদি ঠিক নজর করেছে।মামা বসতে বসতে বলল,ওই মেয়েছেলেটা কি বলছিল?
মায়ের কাছে আসতো।জিজ্ঞেস করল রাতে রান্না করে দিয়ে যাবে কিনা?
খবরদার এদের একদম প্রশ্রয় দিবি না।জল খাওয়া তো।
জল এনে দিতে গেলাসে চুমুক দেবার আগে জিজ্ঞেস করল,কখন এসেছিস?
লালগোলা ধরে সন্ধ্যে নাগাদ।
ঢক ঢক করে জল খেয়ে বলল,হাসপাতালে গেছিলি?
হ্যা এইমাত্র ফিরলাম।
কাতান খোকন কিছু বলছিল?
বলল কাল সকাল নটার মধ্যে হাসপাতালে পৌছাতে এমআরআই করাতে হবে।
মামা ফোলিও ব্যাগ খুলতে খুলতে বলল,এই বয়সে এত ধকল পোষায়।ব্যাগ থেকে একগোছা টাকা বের করে এগিয়ে দিয়ে বলল,দেখতো কত আছে?
টাকা গুনতে গুনতে কাকুর কথা মনে পড়ল।মামা সম্পর্কে কাকুর ধারণা ঠিক নয়।গুনে বললাম, সাড়ে-চার হাজার।
তোর কাছে রেখে দে কাল লাগবে।
খোকনদা বলছিল চার হাজারের কথা।
ওকী ডাক্তার নাকি?কিযে লেখাপড়া করিস।রেখে দে কোথায় কি লাগে।কাল নটার মধ্যে চলে যাবি আমার একটু দেরী হবে।
মামা চা খাবে?
চা করেছিস?
খেলে করতাম।
দরকার নেই।তোর পরীক্ষা তো এসে গেল।
পরীক্ষা এসে গেলেও কিছু করার নেই। মামা চলে গেল।রাত হয়েছে সকাল সকাল খেয়ে শুয়ে পড়া যাক।কাল সকালে অনেক কাজ।কলকাতায় এখন যাওয়ার প্রশ্নই নেই।মাকে ভালোয় ভালোয় সুস্থ করে বাড়ীতে এনে ওসব ভাবা যাবে। রুটিগুলো চামড়ার মত শক্ত হয়ে গেছে।ঝোলে ভিজিয়ে নরম করে চিবোতে থাকে।এম আর আই কথাটা শুনেছে কিন্তু সেটা কি ঠিক জানা নেই।এই পরীক্ষা করে কি জন্য তাও জানে না।এক্স-রে যেমন বাইরে থেকে ভিতরে ছবি তুলে ভেতরের অবস্থা বোঝে ওই রকম এম আর আই করে সেরকম কিছু জানা যায় হয়তো।
রাতে শুয়ে সকালের অপেক্ষায়,ঘুম আসে না চোখে।হাসপাতাল হতে সুস্থ হয়ে ফিরলে বিশ্রাম দরকার।লোকের বাড়ী কাজ করতে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।পড়াশোনা নিয়ে ভাবছে না।কত মানুষ কত রকম স্বপ্ন দেখে সব স্বপ্ন কি বাস্তবায়িত হয়?মামাকে বলে কোনো একটা কাজ জুটিয়ে নেবে।শুভ নন্দিতারা ভাববে কলেজে আসছে না গেল কোথায়?একদিন ওরা বুঝতে পারবে সুখদারঞ্জন আর ক্লাসে আসবে না। সিদ্ধেশ্বর পাস করে দোকানে বসে আর পড়ল না।তারও আর পড়া হল না।বছর দুয়েকের মত কলেজে ক্লাস করলেও দুজনেই উচ্চ মাধ্যমিক পাস। এই রকম ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে এক সময়।
ভালভাবে আলো ফোটার আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেল।তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নিল।কত দেরী হবে কে জানে।স্নান করে তৈরী হয়ে হাসপাতলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।অফিসে গিয়ে দেখা করে নিজের পরিচয় দিতে ওরা কাগজ পত্র দিয়ে Diagnostic Centre-এ যেতে বলল।কাছেই সেণ্টার।গিয়ে কাগজ দেখাতে চার হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দিল।টাকা জমা দিয়ে অপেক্ষা করছি একটু পরেই স্ট্রেচারে করে মাকে নিয়ে ভিতরে চলে গেল।
বাইরে একটা বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছি।মাকে কোথায় নিয়ে গেল।অস্থির অস্থির লাগছে।মিনিট পনেরো হয়ে গেল।এয়াপ্রোন পরা একজনকে দেখে উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করে জানা গেল।এম আর আই করার আগে একটা ওষুধ খাওয়ানো হয় তাতে ভিতরটা রঙীন হয়।মা ওষুধ খেতে পারছে না।সেজন্য ডাক্তারকে খবর দেওয়া হয়েছে।একটা ফিয়াট গাড়ী এসে দাড়াতে একজন মহিলা নামলেন।জানা গেল উনি ডাক্তার।কিছুক্ষন পর ক্যাশ কাউণ্টার হতে আমাকে ডেকে জানালো,ওষুধ ছাড়াই করা হচ্ছে।আমাকে এক হাজার টাকা ফেরত দেওয়া হল।
কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।দরজা দিয়ে সুবিমামাকে ঢুকতে দেখে এগিয়ে গেলাম।
হয়ে গেছে?
না এখন হবে।মামাকে ব্যাপারটা বললাম।
তোকে অত ভাবতে হবে না।ডাক্তারবাবুরা যা করছে জেনে বুঝেই করছে।ওই তো দিদি।
দেখলাম স্ট্রেচারে শুইয়ে মাকে গাড়ীতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেল।নিঃসাড়ে শুয়ে আছে নড়াচড়া করছে না।কলকাতা থেকে এসে অবধি মার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি।
মামা এসে বলল,তুই খেয়েছিস?
না গিয়ে খাবো।
এম আর আই হয়ে গেছে।বেডে দিয়েছে একবার গিয়ে দেখে যা বাড়ী যা।
আমি একটু ইতস্তত করি।মামা বলল,তুই থেকে কি করবি যা করার ডাক্তারবাবুরা করছে।
মাকে ছাড়বে কবে?
আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলবো তুই বাড়ী গিয়ে খাওয়া দাওয়া কর।কটা বাজে দেখেছিস?