আগ্রার তাজ হোটেলের কনভেনশন সেন্টারে যখন এই ৪৫ বছরের ভদ্রমহিলা বক্তৃতা দিতে উঠলেন, উপস্থিত জনতা উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানালেন। অনুষ্ঠানের আয়োজকরা মজা করে অ্যামাজন প্রাইমের ভীষণ জনপ্রিয় "পঞ্চায়েত" ওয়েব সিরিজের থিম সংটি বাজালেন যা শুনে হেসে ফেললেন ছবি রাজাওয়াত ! ভারতে সবচেয়ে কম বয়েসে পঞ্চায়েত প্রধান হয়েছিলেন তিনি এবং তিনিই এখনো পর্যন্ত ভারতের একমাত্র পঞ্চায়েত প্রধান যার একটি MBA ডিগ্রী আছে।
পড়াশুনোয় দুর্দান্ত, দিল্লি শ্রীরাম কলেজের এই ঝকঝকে মেয়েটি MBA করে কর্পোরেট জগতে তরতর করে উন্নতি করছিলেন। মাত্র ৩০ বছর বয়েসে রাজস্থানে নিজের গ্রাম থেকে একটি ফোন পেয়ে সেই বিশাল অর্থের চাকরি ছেড়ে দেন ছবি রাজাওয়াত ! ব্যাগ গুছিয়ে রাতারাতি রওনা দেন রাজস্থানের সোডা গ্রামের উদ্দেশে ! কি ছিল সেই ফোন কলে ? ছিল নিজের মাতৃভূমিকে বাঁচানোর কাতর আর্তি। ছিল শহর ছেড়ে "স্বদেশে" ফেরার অনুরোধ। নিজের গ্রামের দরিদ্র অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর আর্জি।
২০০৭-২০০৮ সালের ভয়াবহ খরায় রাজস্থানের সোডা গ্রাম তখন সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখোমুখি। গ্রামে পান করার যোগ্য এক ফোঁটা জল নেই, ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই শুকিয়ে গেছে। মারা গেছে হাজার হাজার গবাদি পশু। জলের অভাবে গ্রামের মানুষ দলে দলে গ্রাম ছাড়ছেন। সরকারি সাহায্য আসেনি, নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা নির্লিপ্ত, উদাসীন। গ্রামবাসীর শেষ ভরসা - গ্রামের মেয়ে, এই মাটিরই কন্যা ৩০ বছরের ছবি রাজাওয়াত যার দাদু অনেক কাল আগে এই গ্রামেরই পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন। গ্রামের এক বয়স্ক ব্যক্তি ছবিকে ফোন করে কাতর অনুরোধ করেন "বেটি, বাঁচালো হামে" ! হ্যাঁ, সেদিন এই বেটি-ই রাজস্থানের অখ্যাত সোডা গ্রামকে বাঁচিয়েছিলেন।
কর্পোরেটের চাকরি ছেড়ে, নিজের সঞ্চিত অর্থ আর সামান্য কিছু বেসরকারি সাহায্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ছবি। তিল-তিল করে মরণাপন্ন একটি গ্রামকে আবার নতুন জীবন দিয়েছিলেন। ২০১০-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে রেকর্ড ভোট পেয়ে সোডা গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান নির্বাচিত হন ছবি রাজাওয়াত অথচ তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি-ই নন ! পরের ১৩ বছরে তার জনসমর্থন এবং জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি বরং বেড়েছে !
তার উদ্যোগে সোডা গ্রাম আজ শস্য-শ্যামল। নিজে হাতে বানিয়েছেন বাচ্চাদের স্কুল, মেয়েদের জন্য হাই স্কুল, ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার, আর্ট এন্ড ক্র্যাফট সেন্টার, কমিউনিটি সেন্টার, সবজি মান্ডি, এমনকী একটি আইটি হাব। সোলার পাওয়ার ব্যবহার করে গ্রামের বিদ্যুৎ সমস্যা মিটিয়েছেন। গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িতে বানিয়েছেন শৌচালয়। একসময়ে দিল্লির রাস্তায় দামি গাড়ি চালানো ছবি রাজাওয়াত এখন ঘোড়ার পিঠে চড়ে গ্রাম পরিদর্শনে যান !
দামি গাড়ি থেকে স্বেচ্ছায় নেমে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হবার পথটি কি রকম ছিল ? সেকথা শুনতে শুনতে "শের-দিল" সিনেমার পঞ্চায়েত প্রধান "গঙ্গারামজী"-কে মনে পড়লো যিনি দরিদ্র, অসহায় গ্রামবাসীর জন্য সরকারি সাহায্য জোগাড় করতে না পেরে ঠিক করেন তিনি জঙ্গলে গিয়ে স্বেচ্ছায় বাঘের মুখোমুখি হবেন। বাঘ তাকে মেরে ফেললে সরকার ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছু টাকা দেবে। সেই টাকা দিয়ে গ্রামবাসীর দুঃখ দুর্দশা কিছুটা কমবে !
নিজের মাতৃভূমিকে বাঁচাতে, সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছবি রাজাওয়াতও ভারতের শ্বাপদসংকুল রাজনৈতিক জঙ্গলে হিংস্র, নির্মম রাজনৈতিক বাঘ-ভাল্লুকদের মুখোমুখি হয়েছেন। পঞ্চায়েতের ক্ষমতা হারিয়ে যারা ছবিকে ক্রমাগত আক্রমণ করে গেছেন। তাদের হুমকি, হামলা ক্রমাগত ছবিকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। তার প্রজেক্টের অফিস ভেঙে দেয়া হয়েছে, সহকর্মীদের মার-ধোর করা হয়েছেন কিন্তু বন্দুক-পিস্তল দেখিয়ে বা প্রাণনাশের হুমকি দিয়েও এই "শেরনী"-কে ভয় পাওয়ানো যায়নি যার শপথ বাক্য - করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে !
ওম্যান এমপাওয়ারমেন্ট সম্পর্কে বলতে গিয়ে অবিবাহিত ছবি রাজাওয়াত মজা করে বললেন যে চরম বিপদেও তার কখনো হাসব্যান্ড, বয়ফ্রেন্ড, বডিগার্ড বা বাউন্সারের কথা মনে পড়েনি। উপরে ভগবান আর মাটিতে সাধারণ মানুষ - এনারই সবসময় তার পাশে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।
বিয়ে বা সংসার করেননি বলে তার কোনো খেদ নেই। ঈশ্বরের ইচ্ছায় তার সংসারে আজ হাজার হাজার মানুষ। তার ঘর ভারতের ধুলো-বালি-মাটিতে। তাই মহিলা হিসেবে তার দাবি অর্ধেক নয় - পুরো আকাশটাই ! শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিলো কিছু মানুষকে কিছুতেই "দশ ফুট বাই দশ ফুটের" ঘর-সংসারে, স্বামী-পুত্র-কন্যার মায়াডোরে বেঁধে রাখা যায় না। তাদের মুক্তির আকাশ তারা ঠিক খুঁজে নেন। তাইতো রবি ঠাকুর লিখেছেন :
"আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,
দুঃখবিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে
আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে ...."
---- আশাভরী সেন
সংগৃহীত..........
পড়াশুনোয় দুর্দান্ত, দিল্লি শ্রীরাম কলেজের এই ঝকঝকে মেয়েটি MBA করে কর্পোরেট জগতে তরতর করে উন্নতি করছিলেন। মাত্র ৩০ বছর বয়েসে রাজস্থানে নিজের গ্রাম থেকে একটি ফোন পেয়ে সেই বিশাল অর্থের চাকরি ছেড়ে দেন ছবি রাজাওয়াত ! ব্যাগ গুছিয়ে রাতারাতি রওনা দেন রাজস্থানের সোডা গ্রামের উদ্দেশে ! কি ছিল সেই ফোন কলে ? ছিল নিজের মাতৃভূমিকে বাঁচানোর কাতর আর্তি। ছিল শহর ছেড়ে "স্বদেশে" ফেরার অনুরোধ। নিজের গ্রামের দরিদ্র অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর আর্জি।
২০০৭-২০০৮ সালের ভয়াবহ খরায় রাজস্থানের সোডা গ্রাম তখন সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখোমুখি। গ্রামে পান করার যোগ্য এক ফোঁটা জল নেই, ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই শুকিয়ে গেছে। মারা গেছে হাজার হাজার গবাদি পশু। জলের অভাবে গ্রামের মানুষ দলে দলে গ্রাম ছাড়ছেন। সরকারি সাহায্য আসেনি, নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা নির্লিপ্ত, উদাসীন। গ্রামবাসীর শেষ ভরসা - গ্রামের মেয়ে, এই মাটিরই কন্যা ৩০ বছরের ছবি রাজাওয়াত যার দাদু অনেক কাল আগে এই গ্রামেরই পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন। গ্রামের এক বয়স্ক ব্যক্তি ছবিকে ফোন করে কাতর অনুরোধ করেন "বেটি, বাঁচালো হামে" ! হ্যাঁ, সেদিন এই বেটি-ই রাজস্থানের অখ্যাত সোডা গ্রামকে বাঁচিয়েছিলেন।
কর্পোরেটের চাকরি ছেড়ে, নিজের সঞ্চিত অর্থ আর সামান্য কিছু বেসরকারি সাহায্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ছবি। তিল-তিল করে মরণাপন্ন একটি গ্রামকে আবার নতুন জীবন দিয়েছিলেন। ২০১০-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে রেকর্ড ভোট পেয়ে সোডা গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান নির্বাচিত হন ছবি রাজাওয়াত অথচ তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি-ই নন ! পরের ১৩ বছরে তার জনসমর্থন এবং জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি বরং বেড়েছে !
তার উদ্যোগে সোডা গ্রাম আজ শস্য-শ্যামল। নিজে হাতে বানিয়েছেন বাচ্চাদের স্কুল, মেয়েদের জন্য হাই স্কুল, ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার, আর্ট এন্ড ক্র্যাফট সেন্টার, কমিউনিটি সেন্টার, সবজি মান্ডি, এমনকী একটি আইটি হাব। সোলার পাওয়ার ব্যবহার করে গ্রামের বিদ্যুৎ সমস্যা মিটিয়েছেন। গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িতে বানিয়েছেন শৌচালয়। একসময়ে দিল্লির রাস্তায় দামি গাড়ি চালানো ছবি রাজাওয়াত এখন ঘোড়ার পিঠে চড়ে গ্রাম পরিদর্শনে যান !
দামি গাড়ি থেকে স্বেচ্ছায় নেমে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হবার পথটি কি রকম ছিল ? সেকথা শুনতে শুনতে "শের-দিল" সিনেমার পঞ্চায়েত প্রধান "গঙ্গারামজী"-কে মনে পড়লো যিনি দরিদ্র, অসহায় গ্রামবাসীর জন্য সরকারি সাহায্য জোগাড় করতে না পেরে ঠিক করেন তিনি জঙ্গলে গিয়ে স্বেচ্ছায় বাঘের মুখোমুখি হবেন। বাঘ তাকে মেরে ফেললে সরকার ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছু টাকা দেবে। সেই টাকা দিয়ে গ্রামবাসীর দুঃখ দুর্দশা কিছুটা কমবে !
নিজের মাতৃভূমিকে বাঁচাতে, সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছবি রাজাওয়াতও ভারতের শ্বাপদসংকুল রাজনৈতিক জঙ্গলে হিংস্র, নির্মম রাজনৈতিক বাঘ-ভাল্লুকদের মুখোমুখি হয়েছেন। পঞ্চায়েতের ক্ষমতা হারিয়ে যারা ছবিকে ক্রমাগত আক্রমণ করে গেছেন। তাদের হুমকি, হামলা ক্রমাগত ছবিকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। তার প্রজেক্টের অফিস ভেঙে দেয়া হয়েছে, সহকর্মীদের মার-ধোর করা হয়েছেন কিন্তু বন্দুক-পিস্তল দেখিয়ে বা প্রাণনাশের হুমকি দিয়েও এই "শেরনী"-কে ভয় পাওয়ানো যায়নি যার শপথ বাক্য - করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে !
ওম্যান এমপাওয়ারমেন্ট সম্পর্কে বলতে গিয়ে অবিবাহিত ছবি রাজাওয়াত মজা করে বললেন যে চরম বিপদেও তার কখনো হাসব্যান্ড, বয়ফ্রেন্ড, বডিগার্ড বা বাউন্সারের কথা মনে পড়েনি। উপরে ভগবান আর মাটিতে সাধারণ মানুষ - এনারই সবসময় তার পাশে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।
বিয়ে বা সংসার করেননি বলে তার কোনো খেদ নেই। ঈশ্বরের ইচ্ছায় তার সংসারে আজ হাজার হাজার মানুষ। তার ঘর ভারতের ধুলো-বালি-মাটিতে। তাই মহিলা হিসেবে তার দাবি অর্ধেক নয় - পুরো আকাশটাই ! শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিলো কিছু মানুষকে কিছুতেই "দশ ফুট বাই দশ ফুটের" ঘর-সংসারে, স্বামী-পুত্র-কন্যার মায়াডোরে বেঁধে রাখা যায় না। তাদের মুক্তির আকাশ তারা ঠিক খুঁজে নেন। তাইতো রবি ঠাকুর লিখেছেন :
"আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,
দুঃখবিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে
আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে ...."
---- আশাভরী সেন
সংগৃহীত..........