What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

ওস্তাদ আমির খাঁ -এক বিস্ময় প্রতিভা। (1 Viewer)

BRICK

Board Senior Member
Elite Leader
Joined
Dec 12, 2019
Threads
355
Messages
10,073
Credits
81,757
T-Shirt
Glasses sunglasses
Calculator
Watermelon
Pistol
Pistol
তাঁর পণ ছিল, শ্রোতার মন ভোলাতে ঠুংরি গাইবেন না। গাননি। শিল্পীর অহঙ্কারে অবিচল থেকেই তিনি সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন।
তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রবাদপ্রতিম সাধক এবং গায়ক উস্তাদ আমির খাঁ (জন্মঃ- ১৫ আগস্ট, ১৯১২ - মৃত্যুঃ- ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪)।

"আমির খাঁ সাহেবের উদ্যোগেই কলাসঙ্গমের অনুষ্ঠান চলছে। ১৯৬৯-৭০ হবে। শেষ দিনে দু'জনের অনুষ্ঠান— খাঁ সাহেব আর বেগম আখতার। অনুষ্ঠান শুরুর আগে গ্রিনরুমে দু'জনেই বসে আছেন। দু'জনেই বলছেন নিজে আগে গাইবেন। আখতারি বলছেন, আপনি উস্তাদ, আপনার পরে গাওয়ার গুস্তাখি আমি কী করে করব? খাঁ সাহেব বলছেন, আরে তাতে কী, লোকে তোমার গান শুনবে বলেই বসে আছে— আমি আগে গেয়ে নিই। এই নিয়ে তুমুল তর্কাতর্কি। শেষ পর্যন্ত জিতলেন বেগম আখতার। বললেন, এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা আপনি, আমি আপনার মেহমান। আমাকে আগে গাইতে দেবেন না? আমির খাঁ পরে গাইতে রাজি হলেন। আখতারি গাইতে বসলেন। তবলায় কেরামতুল্লা খাঁ। সে কী গান! অমন গজল গোটা হিন্দুস্তানে কেউ কখনও গায়নি। আর, ঠুংরিও গাইতেন চমৎকার। তার ওপর বেগমের বিভিন্ন আদাঁয়ে। শ্রোতারা একেবারে মাত হয়ে গিয়েছে। তা, ঘণ্টাদুয়েক গাওয়ার পর বেগম নামলেন। খাঁ সাহেবকে আদাব জানিয়ে একেবারে সামনের সারিতে গিয়ে বসলেন। তানপুরা মিলিয়ে গান ধরলেন খাঁ সাহেব, পুরিয়া। শ্রোতারা সমাহিত ভঙ্গিতে শুনছে, বেগমের গান যে চাঞ্চল্য তৈরি করেছিল, তার লেশমাত্র নেই। সে দিন বুঝেছিলাম, কী দরের শিল্পী তিনি।" লিখেছেন গোবিন্দ বসু। "খাঁ সাহেবকে এমন আসর জমাতে আরও দেখেছি, সেটা ১৯৬৭ বা ৬৮। সে দিনই খাঁ সাহেবের সঙ্গে প্রথম বাজাব। মহাজাতি সদনে সর্বভারতীয় সংগীত সমাজের অনুষ্ঠান। যখন পৌঁছলাম, তখন নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় বাজাচ্ছেন, তবলায় সামতা প্রসাদ। টপ ফর্মের নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়কে যারা শুনেছে, শুধু তারাই জানে যে সে কী বাজনা। আর, সামতা প্রসাদ তখন ভারতের সবচেয়ে গ্ল্যামারাস তবলিয়া। আসর একেবারে আগুন হয়ে আছে। তখনও খাঁ সাহেব আসেননি। আমি শুনছি আর ভাবছি, এর পর খাঁ সাহেব কী ভাবে আসর ধরবেন ? রাত দুটো নাগাদ খাঁ সাহেব মঞ্চে উঠলেন। চোখ বন্ধ করে অভ্যেসমতো ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে ভাটিয়ার ধরলেন। বললে বিশ্বাস হবে না, নিখিলবাবুর ওই আসরের পর যে অমন শান্ত ভঙ্গিতে শুরু করা যায়, সেটাই ভাবতে পারিনি। দেখলাম, কিছু ক্ষণের মধ্যেই খাঁ সাহেবের ম্যাজিকে আটকা পড়ে গিয়েছে আসর। একেবারে সামনের সারিতে বসে মুগ্ধ হয়ে শুনছেন কিশোর কুমার। প্রায় আড়াই ঘণ্টা গাইলেন খাঁ সাহেব। তাঁর অভ্যেস ছিল, মাঝে না থেমেই এক রাগ থেকে অন্য রাগ ধরে নিতেন। ভাটিয়ার থেকে চলে গেলেন আহিরভৈরোঁয়, তা থেকে বৈরাগীতে। একেবারে ভোরের আলো ফুটিয়ে আসর শেষ করলেন আমির খাঁ।'

বোধ হয় ১৯৯৩ সাল। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ক্যাসেটটা সবে বেরিয়েছে। 'রঙের আভাস হবে কি তেমন, আমির খানের ললিতে যেমন -' তাকে নিয়ে গান লিখেছেন সুমন? পরের বছরই আবার ফিরে আসেন তিনি— 'ইমনে তোমায় মানায় না, বাহারেও নয় তোমার গান। ললিত তোমাকে চেনায় না, বুঝতেন এটা আমির খান'। এক দিন হঠাৎই এইচ এম ভি-র ক্যাসেটে শুনে ফেলি তাঁর সেই ললিত। তার পর কোমল রেখাব আশাবরী, হংসধ্বনি। সে গানের মর্ম তখনও বুঝিনি, এখনও বুঝি না। শুধু টের পাই, এত দিন যা শুনেছি, সব কিছুর থেকে আলাদা এই এক জনের গান। এ গান মন্দিরে বসে শোনার, এ গানের ভিতর ধ্যান ঢুকে পড়েছে। আমির খাঁর হাত ধরে গান শোনা চলতে থাকে। এই এক জনের কাছে আমায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য কবীর সুমনের ঋণ কখনও ভোলার নয়। আরও কয়েক বছর পেরিয়ে কবীর সুমন যখন লিখলেন, 'আমির খানের বোনা মেঘে, কাটিয়েছি কত রাত জেগে'— - তখন সেই আমির খাঁকে আমি চিনি। তাঁর বুনে দেওয়া মেঘে কী করে রাত কেটে যেতে পারে, তত দিনে সেটুকু বোঝার মতো বড় হয়ে গিয়েছিলাম।

"'কোন বছর, এখন আর বলতে পারব না"', স্মৃতি হাতড়ান সেতারিয়া মণিলাল নাগ, ' "তবে এক বর্ষায় কলকাতার পাঁচটা আসরে খাঁ সাহেব মেঘ গেয়েছিলেন। তাঁর কল্পনাশক্তি কোন পর্যায়ের ছিল, বুঝে দেখো— পাঁচটা আসরে একই রাগ নিয়ে তিনি পাঁচটা আলাদা রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। অমন রাগবিস্তারের শক্তি, ওই প্রকার দখল কখনও দেখিনি"।'

ভাগ্যসন্ধানে ইন্দৌর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন আমির খাঁ। সম্ভবত ১৯৪৬ সাল। আমির খাঁর বয়েস তখন বত্রিশ। গানের দুনিয়ায় তখনও নিতান্ত অজ্ঞাতকুলশীল তিনি। বাবা শাহমির খাঁ সারেঙ্গি বাজাতেন। এক বার আবদুল বহিদ খাঁ কিশোর আমিরকে ডেকে বলেছিলেন, তু তো তেরে বাপসে বহুত আগে নিকল গয়া হ্যায় বেটা, তেরে বাপ তো সারেঙ্গিকি গ্যায়ারা তার মিলা নেহি পাতে! শহমির খাঁ ইন্দৌর দরবারের চৌধুরী ছিলেন, ফলে গানের দুনিয়ায় কিঞ্চিৎ আনাগোনা ছিল। কিন্তু সেই পরিচয়ের এমন জোর ছিল না যে আমির খাঁকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আরও মুশকিল, কোনও প্রতিষ্ঠিত ঘরানায় টানা তালিমও মেলেনি তাঁর, ফলে মাথার ওপর কোনও উস্তাদের আশীর্বাদের হাত ছিল না।

তখনও কলকাতা নামের শহরটা বেঁচে ছিল। পাঁচ জনে বলল, কলকাতায় যাও। সেখানে নাম কামাতে পারলে তবেই ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীতের দুনিয়ায় পা ফেলতে পারবে। যুবক আমির খাঁ কলকাতায় পৌঁছলেন। সেই কলকাতা, যে শহর এক দিন তাঁকে মাথায় করে রাখবে।

কিন্তু, ১৯৪৬-এর কলকাতায় মাথা গোঁজার জায়গা ছিল না আমির খাঁ-র। হোটেলে থাকার মতো টাকা ছিল না সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত এক পূর্বপরিচিত আশ্রয় দিলেন। বৌবাজার-সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ক্রসিংয়ের কোনও একটি বাড়িতে দারোয়ানের কাজ করতেন তিনি। স্থির হল, সারা দিন নিজের ধান্দায় শহরে ঘুরবেন খাঁ সাহেব। রাতে, সেই দারোয়ানের খাটিয়ায় শোবেন, ফুটপাথের ওপর, খোলা আকাশের নীচে।— বহু দিন পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে এই গল্পটা বলেছিলেন আমির খাঁ। সুনীল জানতে চেয়েছিলেন, '"ও ভাবে থাকতে আপনার অসুবিধা হত না খাঁ সাহেব?"' আমির খাঁ বলেছিলেন, '"একটা অসুবিধা হত। তোমাদের কলকাতার খাটিয়াগুলো খুব ছোট, বুঝলে। ওগুলোয় শুলে আমার পা বেরিয়ে থাকত।'"

তখন গোটা দেশে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের একচ্ছত্র সম্রাট ছিলেন উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ। তাঁর গান ছিল ঈশ্বরপ্রদত্ত। স্বয়ং আমির খাঁ বলতেন, আমাদের বহু কষ্ট করে আসর জমাতে হয় আর বড়ে গোলাম আলি আসরে বসে সুর লাগালে আসর এমনিই জমে যায়, তাঁর গলার এমনই তাসীর, এমনই প্রভাবগুণ। বড়ে গোলাম নিজে ছিলেন শ্রোতা-অন্ত-প্রাণ। শ্রোতারা তাঁর কাছে পঞ্জাবি হরকৎ প্রত্যাশা করে, দুর্দান্ত তান আশা করে— কখনও নিরাশ করেননি বড়ে গুলাম। বলতেন, 'এরা পয়সা খরচ করে আমার গান শুনতে আসে। আমি এদের হতাশ করতে পারি না।' শ্রোতার মনোরঞ্জনে আর এক অমোঘ অস্ত্র ছিল তাঁর তূণে— ঠুংরি। খাঁ সাহেব 'আয়ে না বালম', বা 'ইয়াদ পিয়া কি আয়ে' ধরলে আসর পাগল হয়ে যেত। আমির খাঁ যখন পায়ের নীচে জমি খুঁজতে কলকাতায় এলেন, তখন তাঁকে লড়তে হয়েছিল এই বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের সঙ্গে।

"সেই লড়াই নিজের জন্য আরও কঠিন করে দিয়েছিলেন স্বয়ং আমির খাঁ-ই", বললেন গোবিন্দ বসু। খাঁ সাহেবের জীবনের শেষ কয়েকটা বছর কলকাতার প্রায় সব আসরে যিনি তবলায় সঙ্গত করেছিলেন তাঁকে। বড়ে গোলামের সঙ্গে লড়াইয়ে নামার আগে আমির খাঁ প্রতিজ্ঞা করলেন, যে ঠুংরি গেয়ে বড়ে গোলাম শ্রোতাদের পাগল করে দেন, সেই ঠুংরি তিনি গাইবেনই না কোনও আসরে। শুধু পাক্কা, রীত কা গানা গেয়েই যদি শ্রোতাদের মন জেতা যায়, একমাত্র সেই জয়েই তাঁর আগ্রহ। প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন তিনি। কখনও কোনও আসরে ঠুংরি, দাদরা গাননি।
মণিলাল নাগ স্মৃতির গভীরে ডুব দিলেন। বললেন, '"আমির খাঁর পাণ্ডিত্যের কোনও তুলনা হয় না। কী ভাবে একটা রাগে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে হয়, কত ভাবে যে তার বিস্তার সম্ভব, তা আমির খাঁর গান শুনে শেখার মতো।'"
মণিলালের কথার সুর ধরে নিলেন গোবিন্দ বসু। বললেন, '"খাঁ সাহেব গাইতেন বিলম্বিত ঝুমরায়। চোদ্দ মাত্রার তাল। এমনিতেই তার শমে ভেড়ানো মুশকিল। আর খাঁ সাহেব শমে পড়তেন সরাসরি, তান রোল করাতে করাতে, কোনও আলাদা ফ্রেজ, টুকরা জুড়ে নয়। কী প্রকার ম্যাথমেটিকাল মাথা থাকলে এই কাজটা করা সম্ভব, ভাবো এক বার!' নিজের সীমাবদ্ধতাকে কী ভাবে অতিক্রম করে যেতে হয়, তার মোক্ষম উদাহরণ ছিলেন আমির খাঁ। ফ্যারিঞ্জাইটিসের জন্য গলার রেঞ্জ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তারসপ্তকের রেখাবের ওপর গলা উঠত না, ফলে গোলা আওয়াজে চড়ায় উঠতে পারতেন না, আওয়াজ চাপতে হত। কিন্তু সেই লিমিটেড রেঞ্জেই রাগে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতেন তিনি।"

তাঁর অসম্ভব ভক্ত ছিলেন সেতারিয়া নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এক বার বলেছিলেন, "'আভোগী রাগটাকে আমি দু'চক্ষে দেখতে পারতাম না। যত দিন না আমির খাঁর গলায় আভোগী শুনেছিলাম, তত দিন।'"

পারিবারিক জীবনে শান্তি ছিল না তাঁর। প্রথম স্ত্রী ছিলেন ওস্তাদ এনায়েত খাঁর কন্যা, সেতারিয়া বিলায়েত খাঁ-র বোন। সেই স্ত্রীর সঙ্গে কিছু দিনের মধ্যেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল তাঁর— কারণ, উস্তাদের রোজগার তখন সামান্যই। অবশ্য, তার আগে থেকেই মন দেওয়ানেওয়া চলছিল আর এক জনের সঙ্গে। মুন্নিবাই। কিরানা ঘরানার কিংবদন্তি শিল্পী উস্তাদ আবদুল বহিদ খাঁ-র রক্ষিতা ছিলেন জগমগি নামের এক তবায়ফ, তাঁরই কন্যা এই মুন্নিবাই। এঁরই দৌলতে লুকিয়েচুরিয়ে বহু দিন ধরে আবদুল বহিদের রিয়াজ শোনেন আমির খাঁ, এবং তাঁর গায়কীতে এই শিল্পীর পাকা ছাপ পড়ে যায়। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর এই মুন্নিবাইকে নিকাহ করেন তিনি। সেই বিয়েও সুখের হয়নি, অশান্তি লেগেই থাকত।
গোবিন্দ বসু তেমনই এক অশান্তির সাক্ষী। '"খাঁ সাহেব তখন কলকাতায় এসেছেন, ল্যান্সডাউনে অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে উঠেছেন। এক সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান আছে, বিকেল নাগাদ গিয়েছি— খাঁ সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে বেরোব। গিয়ে দেখি, খাঁ সাহেব পাঞ্জাবি পরে তৈরি। বেরোতে যাব, এমন সময় কোত্থেকে তাঁর স্ত্রী হাজির হলেন। প্রচণ্ড চিৎকার করতে করতে খাঁ সাহেবের বুকের কাছটায় পাঞ্জাবি খিমচে ধরে দিলেন এক টান ফড়ফড় করে পাঞ্জাবি ছিঁড়ে গেল। আমি তো বেজায় অপ্রস্তুত। খাঁ সাহেব বললেন, থোড়া ঠেহর যাও গোবিন্দ, ম্যায় আভভি আয়া। খানিক বাদে পাঞ্জাবি পাল্টে ফিরে এসে বললেন, চলো। রওনা হলাম। আমি খালি ভাবছি, এমন মানসিক অবস্থায় গাইবেন কী করে খাঁ সাহেব? পথে তেমন কথা হল না। আসরে বসলাম। খাঁ সাহেব যখন গান ধরলেন, কী আশ্চর্য, সেই শান্ত, সমাহিত ভঙ্গি— মানসিক অশান্তির তিলমাত্র নেই তাতে।'"

একমাত্র গানই যে তাঁকে সব ভুলিয়ে রাখতে পারত, তার এক আশ্চর্য প্রমাণ পেয়েছিলেন মণিলাল নাগও - "'এক বার বম্বে থেকে ফিরছি। স্টেশনে খাঁ সাহেবের সঙ্গে দেখা। তিনি আমায় দেখেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নিজেই একে-তাকে ধরে আমার জায়গা বদলে নিজের পাশে নিয়ে এলেন। ট্রেন ছাড়তেই টিফিন ক্যারিয়ার খুলে একের পর এক খাবার বের করছেন আর আমায় খাওয়াচ্ছেন। এ ভাবেই চলছে। নাগপুরের আগে বডনেরা বলে একটা স্টেশন আছে। সেখানে পৌঁছে ট্রেনের ইঞ্জিন বিগড়াল। খানিক ক্ষণ কামরায় বসে থেকে খাঁ সাহেব প্ল্যাটফর্মে নামলেন, পিছন পিছন আমিও। খাঁ সাহেবের পরনে লুঙ্গি, গলায় মাফলার। চাওয়ালাকে ডেকে দু'কাপ চা নিলেন। আমরা প্ল্যাটফর্মে বসে। হঠাৎ শুনি, খাঁ সাহেব গুনগুন করে গাইছেন। ভাল করে শুনলাম, নটভৈরব। স্টেশনে তখন বিস্তর ক্যালরব্যালর চলছে, কুলিরা ধাক্কাধাক্কি করেছে, ফেরিয়াওলারা চেঁচাচ্ছে, গণ্ডায় গণ্ডায় লোক বিড়ি ফুঁকছে আর আড্ডা মারছে— তার মধ্যে ভারতের সেরা খেয়ালিয়া, আমির খাঁ সাহেব আপন মনে নটভৈরবের আলাপ গেয়ে চলেছেন। মনে হচ্ছিল, আশেপাশের পৃথিবী থেকে তিনি বোধ হয় অন্য কোথাও চলে গিয়েছেন, যেখানে আছেন তিনি, আর আছে তাঁর সুর।'"

তবে, সর্বত্রই যে গাইতেন, তা নয়। তিনি নিজেই নিয়ম বেঁধে নিয়েছিলেন, মদ্যপান করার পর কখনও গাইতেন না। যে দিন তাঁর আসর থাকত, সকাল থেকে খালি পেটে থাকতেন। বলতেন, পেট খালি থাকলে গলা চনচনে থাকে। রাতে আসর শেষ হলে খাওয়াদাওয়া, মদ্যপান। তখন আর গান নয়।

নিয়মের ব্যতিক্রমও কি হত না? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাক্ষী। কলকাতায় যাঁরা আমির খাঁর সঙ্গ করেছেন ঘনিষ্ঠ ভাবে, সুনীল তাঁদের অন্যতম। হাসতে হাসতে বললেন, '"আয়ান রশিদ খান নামের এক পাগল ছিল আমাদের বন্ধু। পুলিশের বড়কর্তা, এ দিকে কবি, আমাদের মতোই মদ খেতে ভালবাসত। আর ভালবাসত গান। আমির খাঁর অতি ঘনিষ্ঠ ছিল আয়ান রশিদ। সে আমাদের সঙ্গে খাঁ সাহেবের পরিচয় করিয়ে দিল। আমরাও তখন সবাই খানিক হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিকাল শিখেছি। কোনটা ভৈরবী আর কোনটা পূরবী, শুনলে বুঝতে পারতাম। খাঁ সাহেবের সঙ্গে আড্ডা তাই বেসুরো হত না। দিব্যি জমে গেল। রাতের দিকে প্রায়ই তাঁর আড্ডায় হাজির হই। পকেটে করে রামের বোতল নিয়ে যেতাম। খাঁ সাহেবও বোতল বের করতেন। কিন্তু, একটা গোলমাল ছিল। সেই আড্ডা চলাকালীন যাঁরাই খাঁ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, খাঁ সাহেব প্রত্যেককে বলতেন, থোড়া পিয়েঙ্গে? কেউই দেখি না বলে না! ফলে, মুহূর্তে মদ ফুরিয়ে যেত। তখন খাঁ সাহেব বলতেন, চলো একটু ঘুরে আসি। আয়ান রশিদের গাড়িতে চেপে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, গড়ের মাঠ, গঙ্গার ধারে ঘুরতে যেতাম আমরা।

বাইরের লোকের কাছে তিনি ছিলেন গম্ভীর, মিতবাক্। কিন্তু, যাঁদের কাছে তিনি নিজের মনের দরজা খুলে দিতেন, তাঁরা দেখতে পেতেন খাঁ সাহেবের অন্য দিকগুলো। যেমন কলকাতা রেডিয়োর অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর প্রদ্যুম্ন মুখোপাধ্যায় দেখেছিলেন। খাঁ সাহেবের অতি প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি এবং তাঁর স্ত্রী পূরবী। এক বার বম্বেতে খাঁ সাহেব প্রদ্যুম্ন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছেন। খেয়াল হল, সামনেই এক বাড়িতে বড়ে গোলাম আলি খাঁ উঠেছেন। খাঁ সাহেব দেখা করতে ঢুকলেন। বড়ে গোলাম আলি নিজের অভ্যাস মতো স্বরমণ্ডল হাতে রিয়াজ করছিলেন। আমির খাঁ ঢুকতেই তিনি গান বন্ধ করলেন। আমির খাঁ বললেন, "থামলেন কেন গোলাম আলি ভাই, দিব্য তো হচ্ছিল।" গোলাম আলিও হেসে ফের গান আরম্ভ করলেন। রকম-বেরকমের তান। হঠাৎ মন্দ্রসপ্তকের ষড়জ থেকে অতি তারার সা অবধি উঠে গড়গড় করে ফিরে এলেন খরজের সা-তে। এক বার নয়, তিন বার। প্রদ্যুম্নবাবুর ভাষায়, "কোনও মানুষের গলা থেকে অমন সাচ্চা সুর বেরোতে পারে, না শুনলে বিশ্বাস হয় না।"

আমির খাঁ-র মুখ কিন্তু গম্ভীর। বললেন, "খাঁ সাহেব, আর এক বার নিন তো, ওপরের সা-র টিপটা ঠিক সাচ্চা হল না"।
গোলাম আলি স্তম্ভিত— "ক্যা কহে রহে হ্যাঁয় আপ, টিপ সাচ্চা নেহি হুয়া? লিজিয়ে, ফির সুনিয়ে।"
এ বার সত্যিই সুর লাগল না। আবারও তান নিলেন গোলাম আলি। এ বার আরও কম লাগল সুর। আড্ডা আর তেমন জমল না।

বাইরে বেরিয়ে প্রদ্যুম্নবাবু আমির খাঁ-কে জিজ্ঞেস করলেন, '"আচ্ছা, প্রথম বার তান শুনে আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি যে কারও গলা থেকে অমন সুর বেরোতে পারে। আপনি কেন বললেন যে সুর লাগেনি?"' আমির খাঁ গম্ভীর ভাবেই উত্তর দিলেন, '"সত্যিই ওই সুর আর কারও গলা থেকে বেরোবে না।'" বলে মুচকি হাসলেন," 'মগর হমে উসে তোড়না থা। তভি থোড়াসা টেনশন পয়দা কর দিয়া। ঔর গুস্সা যৈসে আ গয়া, ও বাত দুবারা নহি বনা!'"

এই আমির খাঁ-ই আবার সম্পূর্ণ মাটির মানুষও। মণিলাল নাগের বাবা, বিষ্ণুপুর ঘরানার পণ্ডিত গোকুল নাগের সম্বর্ধনা হবে। আমির খাঁকে গাইতে অনুরোধ করলেন মণিলাল। খাঁ সাহেব এক কথায় রাজি। টাকাপয়সার কথা তুললেনই না। অনুষ্ঠান হল। তবলায় কেরামতুল্লা খাঁ। ফেরার পথে রাস্তায় গাড়ি খারাপ। তখন বেশ রাত, পথে তেমন লোকজন নেই। খাঁ সাহেব নিজেই নেমে পড়লেন। কেরামতুল্লা খাঁ-ও নামলেন। দু'জনে গাড়ি ঠেলতে আরম্ভ করলেন। গল্পটা বলে মণিলাল নাগ হাসলেন। বললেন, "ভুলবেন না, যে সময়ের গল্প, তখন আমির খাঁ ভারতের সর্বজনমান্য খেয়ালিয়া"।

এক আশ্চর্য গল্প বললেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়— 'এক রাতে খাঁ সাহেব বললেন, "চলো গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি।" তিনি রাতের কলকাতা দেখতে অসম্ভব ভালবাসতেন। আয়ান রশিদের গাড়িতে ঠেসাঠেসি করে যত জন পারি উঠে পড়লাম। তখন গঙ্গার ধারে ফুচকাওয়ালাদের কাছে গেলাস পাওয়া যেত। গোটাকয়েক গেলাস জোগাড় করা হল। পকেটে রামের বোতল ছিল। আড্ডা আরম্ভ হল।

'আমাদের দলে এক অদ্ভুত চরিত্র ছিল। তার নাম বসন্ত গোবিন্দ পোৎদার। যখন কলকাতায় এল, তখন এক বর্ণ বাংলা জানে না। আমাদের আড্ডায় ভিড়ে গেল, এবং এক বছরের মধ্যে এমন বাংলা শিখল যে সাগরময় ঘোষ ওকে দিয়ে দেশ পত্রিকায় গোটা পাঁচেক লেখা লিখিয়ে ফেললেন। এই বসন্ত ছিল ছ'ফুট চার ইঞ্চি লম্বা, তেমন চেহারা। ওর ছোটবেলা কেটেছিল ইন্দৌরে, খাঁ সাহেবকে তখন থেকে চিনত। খাঁ সাহেব ওকে ডাকতেন 'বাচ্চা'। পূর্ব পরিচয়ের দরুণও বটে, আর বসন্তের স্বভাবের জন্যও বটে, খাঁ সাহেবের ওপর ওর একটু আলাদা দাবি ছিল।

'সে রাতে গঙ্গার পাড়ে বসে বসন্ত খাঁ সাহেবকে বলল, "কোয়ি গানা সুনাইয়ে খাঁ সাব"। কিন্তু তখন মদ্যপান চলছে, ফলে খাঁ সাহেব গাইবেন না। বসন্তও নাছোড়বান্দা। বললে, "আচ্ছা থোড়া ছেড়ছাড় তো কিজিয়ে"। বিস্তর আবেদন-নিবেদনের পর খাঁ সাহেবের মন গলল। একটু চুপ করে থেকে তিনি একটা রাগ ধরে নিলেন। আমরা প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছি। বুঝতে পারছি, খাঁ সাহেব সম্ভবত একটু অন্যমনস্ক হয়ে গাইছেন, আমাদের নড়াচড়ায় তাঁর ঘোর কেটে গেলেই গান থামিয়ে দেবেন। খাঁ সাহেব আপন মনে গেয়ে চলেছেন। রাতের গঙ্গা, জলের শব্দের সঙ্গে খাঁ সাহেবের গান, সব মিলিয়ে সে এক অপার্থিব অনুভূতি।

'আমাদের থেকে একটু দূরে আর একটা দল বসে ছিল। একটু পরেই সেখান থেকে এক জন খাঁ সাহেবকে ভেঙাতে আরম্ভ করল। বেশ জোর গলায়। খাঁ সাহেব গান থামিয়ে দিলেন। আমরা অপ্রস্তুত, এমন সময় বসন্ত তড়াৎ করে লাফিয়ে উঠল, আর একটা অসম্ভব হিংস্র গলায় চিৎকার করে উঠল, "ম্যায় তুঝে মার ডালুঙ্গা।" সেই দলের লোকরাও উঠে দাঁড়িয়েছে। দেখি, জনা আটেক পঞ্জাবি ট্যাক্সিচালকের একটা দল। খাঁ সাহেব বসন্তের হাত চেপে ধরলেন। বললেন, "ছাড়ো। এই রকম কিছু বেসুরো আছে বলেই দুনিয়ায় আসল সংগীত এখনও বেঁচে আছে।'"

মৃত্যুর দিনকয়েক আগে এক সকালে তিনি রিয়াজ করছেন, গোবিন্দ বসু উপস্থিত। এক গান্ধারে অকল্পনীয় সুর লাগল তাঁর। খাঁ সাহেব গাওয়া থামিয়ে দিলেন। তার পর আস্তে আস্তে বললেন, "'ঔর জাদা দিন নহি, গোবিন্দ। ইয়ে গান্ধার জিসে লগ যাতা হ্যায়, ও ইনসান জাদা দিন রহেতা নহি।'"

এই কলকাতা শহরের মাটিতেই শেষ শয্যায় শায়িত উস্তাদ আমির খাঁ। রাতের সাদার্ন অ্যাভিনিউ জানে, কী ভাবে ঘাতক লরির ধাক্কায় দুমড়ে গিয়েছিল সেই গাড়িটা, যে গাড়িতে তাঁর কলকাতার ঠিকানায় ফিরছিলেন আমির খাঁ, ১৯৭৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি।
- আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে

জাগে জাগে রাত
ইচ্ছে হল (১৯৯৩)
জাগে জাগে রাত ভোর হবে বলে
ভোর দেবে রঙ মাটির আদলে।
মাটিতে লুটিয়ে পড়বে আকাশ
সবুজে মেশাবে নীলের আভাস।
রঙের আভাস হবে কি তেমন
আমির খানের ললিতে যেমন।
....
তোমার কথার রং
===========

তোমার কথার রঙ কি লাল
হলুদ সবুজ হালকা নীল
বুঝি বা শুভ্র শরত্কাল
তোমার কথার শংখ চিল

তোমার কথার ছন্দ কি
পয়ার ত্রিপদী ঝাঁপ তালে
চলেছ একলা নর্তকী
বেতাল বেসুর দিন কালে

ফায়ব্রাফোন কি ধ্বনি তোমার
স্পন্দন মাখা তোমার সুর
সিন্থেসাইজার এই আমার
কেঁপে ওঠে তুমি-ময় ঘুঙ্গুর

ইমন এ তোমায় মানায় না
বাহারেও নয় তোমার গান
ললিত তোমাকে চেনায় না
বুঝতেন এটা আমীর খান

বব ডিলান কি তোমায় খুব
দূর থেকে ভালোবেসেছিলেন
তোমারি জন্যে অনুষ্টুপ
ছন্দে ব্যালট বেঁধেছিলেন

লেনিন সেবার শীতকাল এ
ভালোবেসে ফুল জীবন্ত
আনলেন মরা দিনকালে
তোমারি জন্যে বসন্ত

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সেই
মুক্ত হাওয়ার বসন্তে
ধরতে তোমার কথার খেই
গেলেন গানের অনন্তে

তোমার ভাষা কি পাখির চোখ
উদগ্রীব আকাশের খোঁজে
আমার আকাশ তোমার হোক
পাখিদের ভাষা সেই বোঝে
 

Users who are viewing this thread

Back
Top