ঘনিষ্ঠ মানুষদের সবাই-ই বলেছেন যে,মহম্মদ রফি ছিলেন একজন মহৎ হৃদয়ের মানুষ। একটা tv channel-এ অন্নু কাপুর যা বলেছিলেন সেটাই আপনাকে বলি এবার--- বিদেশী মোটর গাড়ি কেনার পর সেই গাড়ি চালাতে দক্ষ driver রাখার দরকার হয়ে পড়ে,তখন মহঃ রফির দেশী গাড়ির driver-কে ছাড়িয়ে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে,ছাড়িয়ে দিতেও হয়। কিন্তু, সেই দেশী গাড়ির driver-কে ছাড়িয়ে দেওয়ার আগে 'রফি' তাঁর ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেন। উনি সেই driver-কে একটা taxi কিনে দেন,আর নিজে উদ্যোগ নিয়ে taxi-র road-permit বার করে দেন। একটা ঘরোয়া কথা আছে না যে,ঈশ্বর "দিয়ে ধন,দ্যাখে মন।" 'রফি'-র মতো টাকার অধিকারী তৎকালীন বম্বেতে আরো অনেকেরই ছিল,কিন্ত তাদের মধ্যে ক'জনইবা ওনার মতো মনের অধিকারী ছিলেন!
পারিশ্রমিক নিয়ে রফি সাহেব ছিলেন বরাবরই উদাসীন।
১৯৬৮ তে প্রোডিউসার জয় মুখার্জী (কাজলের কাকা) "হামসায়া" নামে একটি ছবি বানিয়েছিলেন। ছবিটি সুপার ফ্লপ করেছিল কিন্তু সে ছবিতে রফির গাওয়া দিল কি আওয়াজ ভি সুন্" গানটি সুপারহিট হয়েছিল। ছবিটি করে জয় মুখার্জী সর্বস্বান্ত হয়েছেন শুনে রফি সাহেব সে ছবির থেকে পাওয়া পারিশ্রমিকটি খামে ভরে জয় মুখার্জীকে ফেরত দিতে গেলেন।
জয় মুখার্জী তো সে টাকা কিছুতেই নেবেন না। স্বল্পভাষী রফি সাহেব নাকি টাকার খামটি জয় মুখার্জী-র জামার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলেছিলেন "কভি দিল কি আওয়াজ ভি সুন্"!
অর্থ লোভ মহম্মদ রফির ছিল না আর এজন্য তাঁকে সঙ্গীত জীবনে অনেক ক্ষতি-ও স্বীকার করতে হয়েছে। সঙ্গীত শিল্পীদের রয়্যালটির দাবিতে যখন সরব হয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর, তখন মহম্মদ রফি প্রকাশ্যে লতা মঙ্গেশকরের বিরোধিতা করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল গানটা গাওয়ার জন্য একবার তো পারিশ্রমিক পেয়েছি, তাহলে সেটার জন্য বার বার অর্থ চাইবো কেন ?
এই বিরোধিতার জন্য লতা মঙ্গেশকর প্রায় তিন বছর রফি সাহেবের সঙ্গে কোনো ডুয়েট গান নি।
কিছুদিন আগে সেই লতা মঙ্গেশকরকেই জিজ্ঞেস করা হয়েছিল উনি আজকাল কাঁর গান শোনেন। লতা মঙ্গেশকর উত্তর দিয়েছিলেন – রফি সাহেবের ভজন !
এই ভজন গাওয়ার সময় যাতে তাঁর সংস্কৃত শব্দ উচ্চারণ নির্ভুল হয় সেজন্য "বৈজু বাওরা" ছবিতে ভজন রেকর্ডিং এর আগে কাশীর এক পন্ডিতের কাছে রীতিমতো সংস্কৃতের পাঠ নিয়েছিলেন রফি সাহেব – এমনই ছিল তার সংগীতের প্রতি আত্মনিবেদন !
সাধে কি খ্যাতির মধ্যগগনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কিশোর কুমারকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তিনি কার গান শোনেন – কিশোর কুমার অকপটে বলেছিলেন মহম্মদ রফির আর সেই একই প্রশ্ন যখন রফি সাহেবকে করা হয়েছিল তিনি বলেছিলেন "মান্না দা'র" !
শুনতে আশ্চর্য লাগলেও রফি সাহেব কিশোর কুমারের জন্যও গান গেয়েছেন - 'রাগিনী' ও 'শারারাত' ছবিতে রফির গাওয়া গানে লিপ দিয়েছিলেন অভিনেতা কিশোর কুমার !
রফি সাহেব নিজেই বলে গেছেন কিশোর কুমারের গাওয়া তাঁর সবচেয়ে প্রিয় গান হলো "মিস্টার ফানটুশ" ছবি থেকে "দুখী মন মেরে, সুন্ মেরে কেহনা"। এ গান কিশোর ছাড়া আর কেউ গাইতে পারতো না বলেই তাঁর ধারণা।
৬০ এর দশকের শেষে আরাধনা ছবি দিয়ে কিশোর কুমারের ধূমকেতুর মতো আগমনে এবং সচিন কর্তার পৃষ্ঠপোষকতায় রফির দেড় দশকের সাম্রাজ্য যখন প্রায় যায় যায় – খবরের কাগজওয়ালাও যখন প্রায় রফির সংগীতজীবনের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছেন সেই সময় রাহুল দেব বর্মন একটি এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন।
সবার মতো রাহুলদেব বর্মনেরও প্রশ্ন ছিল কে বেশি ভালো – রফি না কিশোর ?
"প্যার কা মৌসম" ছবিতে তিনি "তুম বিন জাউ কাহাঁ" গানটি রেখেছিলেন রফি এবং কিশোরের গলায় আলাদা আলাদা সিচুয়েশনে। রাহুলদেবের মতো কিশোর ভক্ত-ও দেখে অবাক হয়েছিলেন যে রফির গাওয়া ভার্সনটিই সেসময় বেশি পপুলার হয়েছিল !
কাগজওয়ালা যাই বলুক রফি-কিশোরের সম্পর্ক কিন্তু বরাবরই ভালোবাসা-শ্রদ্ধারই থেকে গেছে কেননা রফি সাহেব মানুষটিই এমন খাঁটি আর সদা হাস্যমুখের যে তাঁর প্রতি বিরূপ ভাব পোষণ করা কার্যত অসম্ভব ।
HMV একবার রফি সাহেবের দুঃখের গানগুলির একটি সংকলন বের করবে বলে তাঁর একটি দুঃখ দুঃখ মুখের ছবি চায় – অনেক আর্কাইভ, খবরের কাগজওয়ালাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সেরকম কোনো ছবি পাওয়া যায়নি – নিরুপায় হয়েই রফি সাহেবের হাস্যমুখের একটি ছবি দিয়েই তাঁরা রেকর্ডটি বের করেন এবং সেটিও সুপারহিট হয়েছিল। এই ঘটনায় সবচেয়ে মজা পেয়েছিলেন রফি সাহেব স্বয়ং !
৩১ সে জুলাই ১৯৮০, রমজানে রোজা রেখেছেন রফি সাহেব। সকালবেলা শরীরটা বেশ খারাপ, কিন্তু তার মধ্যেই তিনি দূর্গা পুজোর রেকর্ডের জন্য অভ্যাস করছেন একটি বাংলা গান – শ্যামা সঙ্গীত। হঠাৎ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। হাসপাতালে পৌঁছনোর কিছুক্ষনের মধ্যেই খবর এলো চির নিদ্রায় চলে গেছেন বলিউডের তানসেন – রোজা রাখা এই সাচ্চা মুসলমান মানুষটি যখন শ্যামা সঙ্গীত গাইতে গাইতে মহাসিন্ধুর ওপারে চলে গেলেন, বাইরে তখন নেমেছে প্রবল শ্রাবনের ধারা।
.
এরকম আকাশ ভাঙা বৃষ্টি অনেকদিন দেখেনি বোম্বে কিন্তু সেই দুর্যোগের মধ্যেই বেরিয়েছিল স্মরণকালের সচেয়ে বড় মিছিল আর সে রেকর্ড আজও ভাঙেনি। অন্তত ২০ হাজার রফি ভক্ত এক আকাশ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন রফি সাহেব কে শেষ বিদায় জানাতে। কোনো সঙ্গীতশিল্পী মারা যাবার পর সেটাই আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মিছিল কেননা এই মানুষটি যে ছিলেন অজাতশত্রু ।
কে ছিলেন না সেই মিছিলে ?
রাজ্ কাপুর, দিলীপ কুমার থেকে অমিতাভ বচ্চন। লতা মঙ্গেশকর থেকে কিশোর কুমার। সে মিছিলে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যান রফি সাহেবের সেক্রেটারি জাহির। রফি সাহেব সারা জীবন যত দান-ধ্যান করেছেন তা সবই জাহিরের নামে।
নিজের নাম কখনো প্রকাশ করেননি। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিয়েছেন "দেনেওয়ালা ম্যায় কৌন হুঁ ? সব উপরওয়ালা"।
সে বৃষ্টিস্নাত বিষন্ন বিকেলে বান্দ্রার মসজিদে তখন তিল ধরণের জায়গা নেই। পুলিশ গেট বন্ধ করে দিয়েছে। কুছ পরোয়া নেহি – ১০ ফুট উঁচু পাঁচিল বেয়ে কাতারে কাতারে মানুষ তখনও চেষ্টা করে যাচ্ছেন মসজিদে ঢোকার। তাদের জামা প্যান্ট ছিঁড়েছে, জুতো-চটি খুলে পড়ছে, হাত পা কেটে রক্তে পাঁচিল লাল হয়ে গেছে কিন্তু তাদের সামলানো যাচ্ছে না। পুলিশ দুবার লাঠি চার্জ করে হাল ছেড়ে দিয়েছে।
সেখানেই সেই বিখ্যাত ছবিটি তোলেন স্টেটসম্যান পত্রিকার এক চিত্র সাংবাদিক যা পরদিন কাগজের প্রথম পাতায় বেরিয়েছিল। ফুলে ফুলে ঢাকা মহম্মদ রফির দেহ মসজিদে শোয়ানো আর তাঁর পা ধরে অঝোরে কেঁদে চলেছেন তাঁর সংগীতজীবনের সব চেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী – কিশোর কুমার আর কী আশ্চর্য ! সে ছবিতে দেখা যাচ্ছে মৃত্যুর পরেও রফি সাহেবের মুখে তাঁর সেই চিরন্তন হাসিটিই লেগে রয়েছে।
রফি সাহেবের মৃত্যুর পরদিন ভারতে দেড় লক্ষ আর পাকিস্তানে ৫ লক্ষ মানুষ অরন্ধন দিবস পালন করেন।
লাহোর রেডিও স্টেশন সব অনুষ্ঠান বাতিল করে সারা রাত শুধু রফি সাহেবের গান বাজিয়েছিল। শ্রোতাদের অনুরোধে সে অনুষ্ঠানটি আরো ১২ ঘন্টা বাড়াতে হয়েছিল।
১৯৮০ তে রফি সাহেবের পুজো-র গানের রেকর্ড বের হয়নি কিন্তু কিশোর কুমারের বেরিয়েছিল। সেখানে গীতিকার মুকুল দত্তকে বিশেষ অনুরোধ করে একটি গান লিখিয়ে সেটি গেয়েছিলেন কিশোর কুমার।
গানটির সুর দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সেটাই ছিল রফি সাহেবের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ও তাঁর সবচেয়ে বড় ভক্তের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আজও পুরোনো না হওয়া সুপার ডুপার হিট সেই গানটি ছিল :
"সে যেন আমার পাশে আজও বসে আছে
চলে গেছে দিন তবু, আলো রয়ে গেছে।"
সংগৃহীত।
পারিশ্রমিক নিয়ে রফি সাহেব ছিলেন বরাবরই উদাসীন।
১৯৬৮ তে প্রোডিউসার জয় মুখার্জী (কাজলের কাকা) "হামসায়া" নামে একটি ছবি বানিয়েছিলেন। ছবিটি সুপার ফ্লপ করেছিল কিন্তু সে ছবিতে রফির গাওয়া দিল কি আওয়াজ ভি সুন্" গানটি সুপারহিট হয়েছিল। ছবিটি করে জয় মুখার্জী সর্বস্বান্ত হয়েছেন শুনে রফি সাহেব সে ছবির থেকে পাওয়া পারিশ্রমিকটি খামে ভরে জয় মুখার্জীকে ফেরত দিতে গেলেন।
জয় মুখার্জী তো সে টাকা কিছুতেই নেবেন না। স্বল্পভাষী রফি সাহেব নাকি টাকার খামটি জয় মুখার্জী-র জামার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলেছিলেন "কভি দিল কি আওয়াজ ভি সুন্"!
অর্থ লোভ মহম্মদ রফির ছিল না আর এজন্য তাঁকে সঙ্গীত জীবনে অনেক ক্ষতি-ও স্বীকার করতে হয়েছে। সঙ্গীত শিল্পীদের রয়্যালটির দাবিতে যখন সরব হয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর, তখন মহম্মদ রফি প্রকাশ্যে লতা মঙ্গেশকরের বিরোধিতা করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল গানটা গাওয়ার জন্য একবার তো পারিশ্রমিক পেয়েছি, তাহলে সেটার জন্য বার বার অর্থ চাইবো কেন ?
এই বিরোধিতার জন্য লতা মঙ্গেশকর প্রায় তিন বছর রফি সাহেবের সঙ্গে কোনো ডুয়েট গান নি।
কিছুদিন আগে সেই লতা মঙ্গেশকরকেই জিজ্ঞেস করা হয়েছিল উনি আজকাল কাঁর গান শোনেন। লতা মঙ্গেশকর উত্তর দিয়েছিলেন – রফি সাহেবের ভজন !
এই ভজন গাওয়ার সময় যাতে তাঁর সংস্কৃত শব্দ উচ্চারণ নির্ভুল হয় সেজন্য "বৈজু বাওরা" ছবিতে ভজন রেকর্ডিং এর আগে কাশীর এক পন্ডিতের কাছে রীতিমতো সংস্কৃতের পাঠ নিয়েছিলেন রফি সাহেব – এমনই ছিল তার সংগীতের প্রতি আত্মনিবেদন !
সাধে কি খ্যাতির মধ্যগগনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কিশোর কুমারকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তিনি কার গান শোনেন – কিশোর কুমার অকপটে বলেছিলেন মহম্মদ রফির আর সেই একই প্রশ্ন যখন রফি সাহেবকে করা হয়েছিল তিনি বলেছিলেন "মান্না দা'র" !
শুনতে আশ্চর্য লাগলেও রফি সাহেব কিশোর কুমারের জন্যও গান গেয়েছেন - 'রাগিনী' ও 'শারারাত' ছবিতে রফির গাওয়া গানে লিপ দিয়েছিলেন অভিনেতা কিশোর কুমার !
রফি সাহেব নিজেই বলে গেছেন কিশোর কুমারের গাওয়া তাঁর সবচেয়ে প্রিয় গান হলো "মিস্টার ফানটুশ" ছবি থেকে "দুখী মন মেরে, সুন্ মেরে কেহনা"। এ গান কিশোর ছাড়া আর কেউ গাইতে পারতো না বলেই তাঁর ধারণা।
৬০ এর দশকের শেষে আরাধনা ছবি দিয়ে কিশোর কুমারের ধূমকেতুর মতো আগমনে এবং সচিন কর্তার পৃষ্ঠপোষকতায় রফির দেড় দশকের সাম্রাজ্য যখন প্রায় যায় যায় – খবরের কাগজওয়ালাও যখন প্রায় রফির সংগীতজীবনের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছেন সেই সময় রাহুল দেব বর্মন একটি এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন।
সবার মতো রাহুলদেব বর্মনেরও প্রশ্ন ছিল কে বেশি ভালো – রফি না কিশোর ?
"প্যার কা মৌসম" ছবিতে তিনি "তুম বিন জাউ কাহাঁ" গানটি রেখেছিলেন রফি এবং কিশোরের গলায় আলাদা আলাদা সিচুয়েশনে। রাহুলদেবের মতো কিশোর ভক্ত-ও দেখে অবাক হয়েছিলেন যে রফির গাওয়া ভার্সনটিই সেসময় বেশি পপুলার হয়েছিল !
কাগজওয়ালা যাই বলুক রফি-কিশোরের সম্পর্ক কিন্তু বরাবরই ভালোবাসা-শ্রদ্ধারই থেকে গেছে কেননা রফি সাহেব মানুষটিই এমন খাঁটি আর সদা হাস্যমুখের যে তাঁর প্রতি বিরূপ ভাব পোষণ করা কার্যত অসম্ভব ।
HMV একবার রফি সাহেবের দুঃখের গানগুলির একটি সংকলন বের করবে বলে তাঁর একটি দুঃখ দুঃখ মুখের ছবি চায় – অনেক আর্কাইভ, খবরের কাগজওয়ালাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সেরকম কোনো ছবি পাওয়া যায়নি – নিরুপায় হয়েই রফি সাহেবের হাস্যমুখের একটি ছবি দিয়েই তাঁরা রেকর্ডটি বের করেন এবং সেটিও সুপারহিট হয়েছিল। এই ঘটনায় সবচেয়ে মজা পেয়েছিলেন রফি সাহেব স্বয়ং !
৩১ সে জুলাই ১৯৮০, রমজানে রোজা রেখেছেন রফি সাহেব। সকালবেলা শরীরটা বেশ খারাপ, কিন্তু তার মধ্যেই তিনি দূর্গা পুজোর রেকর্ডের জন্য অভ্যাস করছেন একটি বাংলা গান – শ্যামা সঙ্গীত। হঠাৎ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। হাসপাতালে পৌঁছনোর কিছুক্ষনের মধ্যেই খবর এলো চির নিদ্রায় চলে গেছেন বলিউডের তানসেন – রোজা রাখা এই সাচ্চা মুসলমান মানুষটি যখন শ্যামা সঙ্গীত গাইতে গাইতে মহাসিন্ধুর ওপারে চলে গেলেন, বাইরে তখন নেমেছে প্রবল শ্রাবনের ধারা।
.
এরকম আকাশ ভাঙা বৃষ্টি অনেকদিন দেখেনি বোম্বে কিন্তু সেই দুর্যোগের মধ্যেই বেরিয়েছিল স্মরণকালের সচেয়ে বড় মিছিল আর সে রেকর্ড আজও ভাঙেনি। অন্তত ২০ হাজার রফি ভক্ত এক আকাশ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন রফি সাহেব কে শেষ বিদায় জানাতে। কোনো সঙ্গীতশিল্পী মারা যাবার পর সেটাই আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মিছিল কেননা এই মানুষটি যে ছিলেন অজাতশত্রু ।
কে ছিলেন না সেই মিছিলে ?
রাজ্ কাপুর, দিলীপ কুমার থেকে অমিতাভ বচ্চন। লতা মঙ্গেশকর থেকে কিশোর কুমার। সে মিছিলে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যান রফি সাহেবের সেক্রেটারি জাহির। রফি সাহেব সারা জীবন যত দান-ধ্যান করেছেন তা সবই জাহিরের নামে।
নিজের নাম কখনো প্রকাশ করেননি। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিয়েছেন "দেনেওয়ালা ম্যায় কৌন হুঁ ? সব উপরওয়ালা"।
সে বৃষ্টিস্নাত বিষন্ন বিকেলে বান্দ্রার মসজিদে তখন তিল ধরণের জায়গা নেই। পুলিশ গেট বন্ধ করে দিয়েছে। কুছ পরোয়া নেহি – ১০ ফুট উঁচু পাঁচিল বেয়ে কাতারে কাতারে মানুষ তখনও চেষ্টা করে যাচ্ছেন মসজিদে ঢোকার। তাদের জামা প্যান্ট ছিঁড়েছে, জুতো-চটি খুলে পড়ছে, হাত পা কেটে রক্তে পাঁচিল লাল হয়ে গেছে কিন্তু তাদের সামলানো যাচ্ছে না। পুলিশ দুবার লাঠি চার্জ করে হাল ছেড়ে দিয়েছে।
সেখানেই সেই বিখ্যাত ছবিটি তোলেন স্টেটসম্যান পত্রিকার এক চিত্র সাংবাদিক যা পরদিন কাগজের প্রথম পাতায় বেরিয়েছিল। ফুলে ফুলে ঢাকা মহম্মদ রফির দেহ মসজিদে শোয়ানো আর তাঁর পা ধরে অঝোরে কেঁদে চলেছেন তাঁর সংগীতজীবনের সব চেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী – কিশোর কুমার আর কী আশ্চর্য ! সে ছবিতে দেখা যাচ্ছে মৃত্যুর পরেও রফি সাহেবের মুখে তাঁর সেই চিরন্তন হাসিটিই লেগে রয়েছে।
রফি সাহেবের মৃত্যুর পরদিন ভারতে দেড় লক্ষ আর পাকিস্তানে ৫ লক্ষ মানুষ অরন্ধন দিবস পালন করেন।
লাহোর রেডিও স্টেশন সব অনুষ্ঠান বাতিল করে সারা রাত শুধু রফি সাহেবের গান বাজিয়েছিল। শ্রোতাদের অনুরোধে সে অনুষ্ঠানটি আরো ১২ ঘন্টা বাড়াতে হয়েছিল।
১৯৮০ তে রফি সাহেবের পুজো-র গানের রেকর্ড বের হয়নি কিন্তু কিশোর কুমারের বেরিয়েছিল। সেখানে গীতিকার মুকুল দত্তকে বিশেষ অনুরোধ করে একটি গান লিখিয়ে সেটি গেয়েছিলেন কিশোর কুমার।
গানটির সুর দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সেটাই ছিল রফি সাহেবের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ও তাঁর সবচেয়ে বড় ভক্তের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আজও পুরোনো না হওয়া সুপার ডুপার হিট সেই গানটি ছিল :
"সে যেন আমার পাশে আজও বসে আছে
চলে গেছে দিন তবু, আলো রয়ে গেছে।"
সংগৃহীত।