What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected আমার যে সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো, স্বাধীন হওয়ার পর সেই দেশে আমার আশ্রয় হলো না (1 Viewer)

ZnFmQdH.jpg


১৯৭১ সালে তিনি সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এদেশে তাঁর ঠাঁই মেলেনি। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে আজ শোনা যাক ভাগ্যবিড়ম্বিত এমন এক বীর মাতার কথা।

মুক্তিযুদ্ধ আমি দেখিনি। তবুও সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে যুদ্ধের স্মৃতি ভেসে থাকে। মনের ভেতরে শুধু নড়াচড়া করতে থাকে ১৯৭১ সালের সেই মা-বোনদের ভয়াবহ করুণ ঘটনার কথা, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা দুই থেকে তিন লাখ মা-বোনের ছবি, যাঁরা বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় বিরাট একটা অংশজুড়ে রয়েছেন। যদিও তখন নির্দিষ্ট করে গণনা করা সম্ভব হয়নি যে কতজন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। একটু অনুমানের ওপর হিসাব করে ধারণা করা যায়, দুই থেকে তিন লাখ হবে। তাঁদের থেকে ১০ হাজারের কম মা-বোন এখন বাংলাদেশে আছেন।

যাঁরা দেশে আছেন, তাঁদের সম্পর্কে আমরা কমবেশি মোটামুটি কিছু জানি। কিন্তু যাঁরা দেশের বাইরে আছেন, তাঁরা কোথায়, কী অবস্থায় আছেন, তা তো দূরের কথা, তাঁদের সন্ধানই আমরা জানি না। আবার এ–ও আমাদের হয়তো জানা নেই বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ছাড়া অন্যান্য দেশেও আছেন সেই বীর মাতারা। এমনই একজন বীর মাতা আফরোজা বেগমের কথা আজ তুলে ধরছি। এখানে তাঁর আসল নাম নয়, ছদ্মনাম ব্যবহৃত হলো।

১৯৭১ সালে আফরোজা ছিলেন স্বপ্না রানী। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৮-১৯ বছর। বাড়ি বগুড়া। যুদ্ধের সময় তিনি জুন মাসে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েন। তখন তাঁর বিয়ের বয়স হয়েছে পাঁচ কি ছয় মাস। পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ার পর যুদ্ধের বাকি সময় পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে ক্যাম্পে রেখে দিনরাত ধর্ষণ করত। দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করেন। শ্বশুর ও বাবার বাড়ি—কোথাও তাঁর কোনো আশ্রয় মেলেনি। তখন তিনি ঢাকায় আশ্রয়কেন্দ্রে এসে আশ্রয় নেন। তাঁর কোলজুড়ে ফুটফুটে একটি ছেলে আসে। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা–যাওয়া করতেন এক মুক্তিযোদ্ধা, তাঁর নাম তারেক। আফরোজার অসহায় অবস্থা দেখে তারেক তাঁকে বিয়ে করেন। কিন্তু তারেক আফরোজাকে আর ঘরে তুলতে পারেননি।

তারেকের আগের বউ ছিল এবং ছেলে-মেয়েও ছিল বড় বড়। একসময় আফরোজা বাচ্চা নিয়ে অসহায়ের মতন রাস্তায় রাস্তায় দিশেহারা হয়ে ঘুরতে থাকেন।

একসময় আলমগীর নামের একজনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। আলমগীর তাঁকে বাড়ির কাজ করার জন্য প্রস্তাব দেন। আফরোজা রাজি হয়। ঠাঁই মেলে আলমগীরের বাড়িতে।

কয়েক মাস যেতে না যেতেই আবার রাস্তায় নেমে যেতে হয়। ঘুরতে ঘুরতে আবার দেখা মেলে তাঁর প্রথম স্বামীর এক আত্মীয়ের সঙ্গে। তিনি তখন তাঁকে ভারতে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন। আফরোজা চলে যান ভারতে। সেখানে তিন-চার বছর বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন। তারপরও বেশি একটা সুবিধা করতে পারেননি। অবশেষে তাঁর আশ্রয় হয় পতিতালয়ে। এখানেই শেষ নয়। পতিতালয়ে তাঁর কাছে এক ব্যবসায়ী নিয়মিত আসতেন। তিনি একসময় আফরোজাকে প্রস্তাব দেন, তাঁর সঙ্গে বিদেশে যেতে, আবার তাঁর সঙ্গেই ফিরে আসবেন। অনেক চিন্তাভাবনা করে, ছেলের দিকে তাকিয়ে তিনি রাজি হন। প্রথম প্রথম সেই ভদ্রলোক একাধিকবার তাঁর সঙ্গ পেতে চাইতেন। কিন্তু আস্তে আস্তে আফরোজার বয়স বাড়তে থাকে। শরীর আগের মতন ধকল আর সহ্য করতে পারে না। এদিকে তাঁর ছেলেও বড় হয়ে উঠছে।

'এখন শুধু আমার একটাই চাওয়া, মরার আগে যদি আমার সন্তান একবার এসে মা বলে ডাকত। এটাই শুধু চাওয়া। জানি, এটাও হয়তোবা কোনো দিন কোনো অবস্থায় সম্ভব নয়। আমার মতন তারও তো কোনো পরিচয়-ঠিকানা নেই। কেমন করে তাকে আমি পাব।'

এসব বিষয় নিয়ে সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে মাঝেমধ্যে তাঁর কথা-কাটাকাটি হতো। একবার তাঁদের মধ্যে বড় ধরনের কথা-কাটাকাটি হওয়ায় আফরোজাকে তিনি বিদেশে রেখেই চলে আসেন। শুধু রেখে আসেন, তা–ই নয়, আফরোজার পাসপোর্টটিও সেই তিনি নিয়ে আসেন। তাঁর ঠাঁই হয় জেলখানায়।

বেশ কয়েক বছর জেলখানায় থাকার পর আফরোজা ছাড়া পান। কিন্তু তত দিনে তিনি সব হারিয়ে ফেলেন। তাঁর ছেলের আর কোনো সন্ধান তিনি পাননি। আর তখন ভারতে যে আসবেন, সে পথও তো তাঁর ছিল না। আসলে তাঁর ছেলের তো কোনো ঠিকানা ছিল না, ছিল না কোনো পরিচয়, এখানে–সেখানে থাকত। তাই আফরোজার ছেলেও জানত না যে তাঁর মা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কোন দেশে গিয়েছেন, কবে ফিরবেন।

তা ছাড়া তাঁর পাসপোর্ট না থাকায় তিনি আর বাংলাদেশ কিংবা ভারত—কোথাও আসতে পারেননি। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁর ছেলের সন্ধান করতে পারেননি।

বয়সের ভারে এখন আফরোজা বড় বেশি ক্লান্ত। নিজে কোনো কাজকর্ম করতে পারেন না। বলা যায়, না খেয়ে বা আধপেট খেয়ে কোনোরকমে দিন কাটছে। মানুষের কাছে হাত পেতে যা পান, তা–ই খান।

আফরোজা অনেক কিছু ভুলে গেছেন। তাঁর দাবি, জেলখানায় তাঁকে অনেক অত্যাচার করা হয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'আমি তাদের ভাষা বুঝতাম না। আর তারাও আমার ভাষা বুঝত না। যারা আমাকে নির্যাতন করত, তারা ভাবত, আমি সব বুঝি, কিন্তু তাদের কথার উত্তর দিচ্ছি না।' এই ভুল–বোঝাবুঝির জন্য বেশি অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। তিনি হিন্দি ও ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলেন, বাংলাটা কমই বলেন। প্রথমে আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। কারণ, তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে বেশ অসুস্থ। আফরোজা বর্তমানে থাকেন আফ্রিকান শেতাঙ্গ এক পরিবারের সঙ্গে।

শেতাঙ্গ পরিবারটি তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে থাকার জন্য, তাদের বাড়ির ভাঙা–পরিত্যক্ত একটি ঘরে—এতটুকুই। তাঁর নিজের খাবার, কাপড়, চিকিৎসা—এসব তাঁকেই ব্যবস্থা করতে হয়। তিনি যেখানে থাকেন, সেখান থেকে কিছু দূরে একটা শপিং মল আছে। সেই মলের ভেতরে একটা খাবার দোকান আছে, যখন ভালো লাগে, তখন ঘণ্টা হিসেবে সেই দোকানে আফরোজা কাজ করেন। কাজ করতে না পারলে খাবার জোটে না। যখন বেশি অসুস্থ থাকেন, তখন কাজ করতে পারেন না। বেশি দিন অসুস্থ থাকলে, কাজ করতে না পারলে ভিক্ষা করেন। এভাবেই কাটছে তাঁর গত ৮-৯ বছর। এখন তিনি অচল। হাঁটা, চলাফেরা করতে পারেন না। যে বাড়িতে তিনি আশ্রিত, সেই বাড়ির ড্রাইভার তাঁকে সকালে একটা জায়গায় রেখে আসেন, আবার সময়–সুযোগমতো বাড়িতেও নিয়ে আসেন। এভাবেই চলছে তাঁর দিন।

আফরোজার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি বাংলাদেশে আসতে চান কি না। তিনি জানিয়েছেন, 'আমার যে সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো, স্বাধীন হওয়ার পর সেই দেশে আমার আর আশ্রয় হলো না, সেই দেশে আর কেন ফিরে যাব? একটা সময় সেই দেশে আমার মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, আপনজন—সবই ছিল, এখন আর কেউ হয়তো বেঁচে নেই, কার কাছে যাব? একসময় আমার ঠিকানা ছিল, ঘরবাড়ি, ভিটা ছিল। যে ভিটায় আমার জন্ম হলো, সে ভিটায়ও আমার জায়গা হলো না। কিছু আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল, ভালোবাসা ছিল। আজ তো এসব কিছুই নেই। এখন আমি মৃত্যুর প্রহর গুনছি।

'এখন শুধু আমার একটাই চাওয়া, মরার আগে যদি আমার সন্তান একবার এসে মা বলে ডাকত। এটাই শুধু চাওয়া। জানি, এটাও হয়তোবা কোনো দিন কোনো অবস্থায় সম্ভব নয়। আমার মতন তারও তো কোনো পরিচয়-ঠিকানা নেই। কেমন করে তাকে আমি পাব।'

লেখক: সুরমা জাহিদ
 

Users who are viewing this thread

Back
Top