রোদ খানিকটা তেতে আসায় আমি বাগিচার একটি বেঞ্চে আশ্রয় নিই। পাথরে বাঁধাই করা বেঞ্চ। অর্ধবৃত্তাকার। রোদের দিকে পিঠ রেখে বসি। আমার ছায়া গিয়ে ছুঁয়ে ফেলে মরা গাছের কাণ্ডে জন্ম নেওয়া লালচে ফুলের সজীব পাপড়িকে। আমার উল্টো দিকে এক ভদ্রমহিলা বসে নিবিষ্ট মনে মোবাইলের স্ক্রিনে কিছু একটা দেখছেন। হয়তো বছর পঞ্চাশেক বয়স। কাঁচা-পাকা চুল। বেশভূষা দেখে আন্দাজ করা যায়, ইনি পোড়খাওয়া পথিক।
কৌতূহলী হয়ে ভাবতে থাকি, ইনিও কি আমারই মতো সুযোগ মেলামাত্র ছুটে এসেছেন গ্রিসে? নাকি এখানকারই কেউ? পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করব কি? এদিকে অতিমারি আমার মনোজগতে সৃষ্টি করেছে কিছু অবাঞ্ছনীয় প্রক্ষেপ। দীর্ঘকাল গৃহবন্দী থাকায় আজকাল অপরিচিত মানুষের সঙ্গে যেচে পড়ে কথা বলার ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে কুণ্ঠা, সংকোচ, খানিকটা ভীতি। যদিও এ উর্ণনাভজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে না এলে আরও বেশি করে তলিয়ে যাব আত্মকেন্দ্রিকতার চোরাবালিতে, সেও খুব ভালো করেই বুঝি। নিজেকে তাই যেন কিছুটা ঠেলেই রাজি করালাম ভদ্রমহিলার সঙ্গে টুকটাক আলাপ পর্বে শামিল হতে।
ভদ্রমহিলা জার্মান। গ্রিসে এসেছেন টিকা পাওয়ার পর। স্টুটগার্টের কাছে খুব ছোট্ট একটা শহরে থাকেন। পেশায় ছিলেন স্কুল শিক্ষক। এখন অবসরভোগী। খুব সম্ভবত ব্যক্তিগত জীবনে একা। গ্রিসে এবারই তার প্রথম আগমন নয়। এই নিয়ে ছয়বার। প্রতিবারই নাকি আসেন দীর্ঘ সময়ের জন্য। কয়েক মাস করে থাকেন। এখানে জুটিয়ে ফেলেছেন বেশ কিছু স্থায়ী বন্ধুবান্ধব। এবারে এসেছেন লেফকাডা দ্বীপে। ওটা করফুর আরও দক্ষিণে। সেখান থেকে ফেরিতে করে এসেছেন করফুতে। আগে এই ফেরি প্রতিদিনই পাওয়া যেত। কিন্তু এখন করোনার কারণে যাত্রী কমে আসায় এক দিন পরপর ছাড়ে। আজ আর ফেরি নেই। কাল আছে। সেটি ধরে কালই আবার ফিরে যাচ্ছেন।
শুধু করফু দ্বীপে ঘুরে এথেন্সে ফিরে যাব শুনে তিনি উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, 'বলো কী, ইয়াং ম্যান! এই গ্রিস দেশটার আসল মজাই তো হলো এর দ্বীপগুলোয়। তা সে একটিমাত্র দ্বীপ দেখে তুমি কী বুঝবে? কাল ফেরি ধরে আমার সঙ্গে লেফকাডায় চলো। দাঁড়াও, তোমাকে লেফকাডার কিছু ছবি আর ভিডিও দেখাই।' এই বলে তিনি আমার দিকে কিছুটা সরে আসেন। 'আমরা দুজনেই যেহেতু ভ্যাকসিনেটেড, আশা করি এটা খুলে ফেলাই যায়।' বলে তিনি মুখের মাস্কটি খুলে পাশে রাখেন। তখন দেখতে পাই সে মুখে বহুকাল ধরে খেলে গেছে রৌদ্রছায়া।
মোবাইলের স্ক্রিনটি ফেটে গেছে। ওয়ালেটের মতো দেখতে একটি কভারে সেটি বন্দী। কভারটির ভাঁজে বেশ কয়েকটি ক্রেডিট কার্ড। খরায় ফেটে চৌচির ভূমির মতোই দেখতে সেই স্ক্রিনে স্ক্রল করার নমুনা দেখে বুঝি, কম করে হলেও কয়েক হাজার ছবি তুলেছেন। এখন এসব ছবি যদি বসে বসে দেখতে হয়, তবে তো বিপদ।
দুরে প্রমোদতরী
আমাকে সে বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দেয় একটা ফোন কল। হঠাৎই বেজে ওঠায় তিনি সেটা কানে লাগান। আমি শুরুতে ভাবি হয়তো জার্মানি থেকে পরিচিত কেউ। কিন্তু খানিক পরে কথোপকথন শুনে বুঝি, তিনি কথা বলছেন স্থানীয় কারও সঙ্গে। বোঝা যাচ্ছে, এই অপর পক্ষের অপেক্ষাতেই তিনি এতক্ষণ এই বেঞ্চে বসে ছিলেন।
'যিনি ফোন করেছিলেন, তিনি আমার এক গ্রিক বান্ধবীর বান্ধবী। এখানকার বাস-ট্রামের দুরবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছ। সে জন্যই একে অনুরোধ করেছিলাম আমাকে এসে নিয়ে যাওয়ার জন্য।' ফোনটি রেখে ব্যাগ গুছাতে গুছাতে তিনি বলেন।
হঠাৎ একটা কথা খেলে যায় মনে। ভদ্রমহিলাকে যিনি নিতে এসেছেন, তাকে বলেকয়ে আমিও কি একটা রাইড ম্যানেজ করে ফেলতে পারি না? গররাজি হলে সে ভিন্ন কথা, একটু চেষ্টা করে দেখতেইবা ক্ষতি কী? জার্মান ভদ্রমহিলাকে সে অভিপ্রায় জানালে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেন, 'বলে দেখো। ইনফ্যাক্ট, আমার সঙ্গেও ওর আজই প্রথম দেখা হবে। কাজেই আমি আগ বাড়িয়ে তোমাকে কোনো কমিট করতে পারছি না।'
প্রাসাদের ব্যালকনি থেকে দুরে সাগর ও লোকালয়
প্রাসাদের বাইরে সড়কের ধারে গাড়ির দরজা খুলে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি এই জার্মান মহিলারই সমবয়সী হবেন। তবে তাঁর মতো দীর্ঘাঙ্গী নন। মাঝারি উচ্চতা। খানিকটা পৃথুলা। নাকের ওপর আটকে থাকা সানগ্লাসের ওপর কপালের কাছটায় জমেছে অল্প কিছু স্বেদবিন্দু। পরনে ঢিলেঢালা হাফস্লিভ সাদা ফতুয়া। তাঁকে আমার আরজি জানালে কিছুটা যেন লজ্জিত হন। পুরোপুরি নিরাশ না করে অপরাধীর মতো মুখ করে বলেন, 'বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না। আমার বাড়িতে ছয়টি বিড়াল, তিনটি পোষা কুকুর। আমি যেখানে যাই, প্রায়ই এই ছানাপোনাদের নিয়ে যাই। পেছনের সিট তাই পুরোটাই এদের লোমে বোঝাই। গতকাল গাড়িটাকে সাফসুতরো করার জায়গায় নেওয়ার কথা ছিল। সে আর হয়ে ওঠেনি। তাই বলছিলাম...মানে এমন জায়গায় বসতে যদি আপনার আপত্তি না থাকে…।'
মনে মনে ভাবলাম, প্যান্টে যদি কিছু লোম লেগেও যায়, ক্ষতি কী? সে তো হোটেলে গিয়ে ধুয়ে নিলেই হবে। বরং এ লগ্নে এমন একখানা রাইড মুফতে মেলাটাই ভাগ্যের ব্যাপার। গ্রিক ভদ্রমহিলা অবশ্য তখনো খানিকটা ইতস্তত করছেন। ট্রাংক খুলে একটা পুরোনো তোয়ালে জোগাড় করে সেটা বিছিয়ে দিলেন সিটের ওপর। 'নিন, এটার ওপর বসুন। আমি খুব দুঃখিত, এমন একটা বাজেভাবে আপনাকে বসতে হচ্ছে।' ভদ্রমহিলাকে আমি এ নিয়ে আর বিব্রত না হতে বলি।
ইনিও সেই জার্মান মহিলার মতোই অবসরভোগী। আগে সরকারি চাকরি করতেন। একটিমাত্র ছেলে। সে এথেন্সে থাকে। করোনার প্রকোপের কারণে শেষবার মাকে দেখতে এসেছে বছর খানেক আগে। আর তার বর্তমান ছেলেবন্ধু থাকে করফুর উল্টো দিকের নগর ইগোমেনিৎসায়। সেখানেই তার চাকরি। নিবাস। শুক্রবার এ দ্বীপে আসে বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে। রোববার বিকেলে চলে যায়। একটি-দুটি বছর নয়, ১২ বছর ধরে তাদের সম্পর্ক এভাবেই চলছে। ভালোই নাকি চলছে। কারও দিক থেকেই তেমন কোনো তাড়া নেই, উচ্চ প্রত্যাশা নেই, জোর নেই। দুজনেই আর্থিকভাবে কারও ওপর নির্ভরশীল নয়। অনেকটা যেন প্রিয় বন্ধুর মতো করেই কাটিয়ে দিচ্ছে প্রবহমান সময়।
'আপনাকে তো নামিয়ে দেব বলে গাড়িতে তুললাম, কিন্তু কোথায় নামিয়ে দেব, সেটাই তো জানা হলো না।' সমুদ্রের ধারে এসে সড়কটা যেখানে দুভাগ হয়ে গেছে, সেখানে পৌঁছে গ্রিক ভদ্রমহিলা পেছনে খানিকটা মুখ ফিরিয়ে প্রশ্ন করেন।
এখান থেকে বাঁ দিক ধরলে আমার হোটেল পেরিয়ে পুরোনো শহর। জার্মান ভদ্রমহিলা এসে উঠেছেন ওদিকটাতেই। আর ডান দিকে গেলে কয়েক মাইল পর বেনিৎসেস। জেলেদের একটা গ্রাম। অ্যালেক্স বলছিল, তাজা মাছভাজা খাবার জন্য সেখানে বেশ কিছু ভালো রেস্তোরাঁ আছে। এই ভরদুপুরে সেখানে কোনো রেস্তোরাঁর শামিয়ানার নিচে বসে ভাজা আনচোভি মাছ খেলে হয়তো মন্দ হয় না। তবে সেদিকে যেতে বললে ভদ্রমহিলার কাছে খানিকটা বাড়তি আবদার করতে হয়। সেটা খুব শোভন হবে কি?
ডান আর বাঁয়ের দোলাচলে আমি যখন এভাবে পেন্ডুলামের মতো দুলছি, পেছন থেকে গাড়ির ভেঁপু ভেসে আসে। আমিও তাই চটজলদি সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে পেছনের সিটে হেলান দিয়ে বসি। জানালা দিয়ে দেখি দুপুরের সোনালি রোদে সাগরের ঢেউ ঝলকে উঠে যেন ছুঁয়ে ফেলতে চায় আমাদের গাড়িটিকে। সামনে সিটে ওরা দুজন নিজেদের মধ্যে আলাপে মত্ত হন, কিন্তু আমার আর ততক্ষণে ওদিকে মন নেই।
মন তখন ব্যস্ত ভিন্নতর কিছুর পশ্চাদ্ধাবনে। (শেষ)
লেখক: সঞ্জয় দে