What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

করফু দ্বীপের কল্লোল ২ (1 Viewer)

Bergamo

Forum God
Elite Leader
Joined
Mar 2, 2018
Threads
9,649
Messages
117,051
Credits
1,241,096
Glasses sunglasses
Berry Tart
Statue Of Liberty
Profile Music
Sandwich
SVH4bTa.jpg


সত্যি বলতে কি, আমি কিছুই ভাবিনি। ভাবার মতো অবকাশও খুব একটা ছিল না। কারণ, আর অন্যবারের মতো তো এবারের ভ্রমণ নয়। এবার শঙ্কা ছিল, যদি যাওয়ার আগে করোনার টেস্টে পজিটিভ রিপোর্ট আসে? যদি কোনো কারণে ডাচ বিমানসংস্থা করোনা-সংক্রান্ত নতুন কোনো নিয়মের ছুতা দেখিয়ে বোর্ডিং কার্ড দিতে অস্বীকৃতি জানায়? সে কারণেই খুব একটা পূর্বপরিকল্পনা করে এবারের যাত্রায় আসা হয়নি।
'ঠিক জানি না। তোমার কোনো সাজেশন আছে?' অরেঞ্জ জুসের গ্লাসটা হাতে নেওয়ার সময়ে বলি।

'উমম, আজ তো রোববার। রোববারে এক ক্যাঁচাল।' এটুকু বলে সে থামে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সোমবার নানা জাদুঘর, দর্শনীয় স্থান বন্ধ থাকে বলে শুনেছি। তবে কি এখানে রোববার সেসব বন্ধ? সে কারণেই অ্যালেক্স ক্যাঁচালের কথা বলছে?
'আমাদের এটা দ্বীপ। মানুষজন কম। এথেন্সের মতো এখানে মিনিটে মিনিটে বাস পাবে না। হয়তো ঘণ্টায় একটা। তা–ও আবার রোববারের দিন সেটা হয়ে যায় কয়েক ঘণ্টায় একটা।'

আমি প্রমাদ গুনি। এ দ্বীপে যে বাস-ট্রামের অবস্থা সুবিধার নয়, সেটা গতকাল এয়ারপোর্টে নেমেই বুঝেছি। চারদিকে সুনসান। কেবল দু–চারটি লজ-ভিলা। লোকেরা তাদের গাড়িতে বোর্ডারদের তুলে নিতে এসেছে। উপায়ান্তর না দেখে আমাকেও অ্যালেক্সকে ফোন করে সাহায্য চাইতে হয়েছিল।

এয়ারপোর্টের প্রসঙ্গ আসায় তা নিয়ে দুটি কথা বলি। বিমানের টিকেট কাটার সময়ে আমি করফু এয়ারপোর্ট নামে সার্চ করি। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও এই নামে কোনো এয়ারপোর্ট নেই। তবে কি এ দ্বীপে বিমানপোতে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থাই নেই? কিন্তু সেটিও তো হওয়ার কথা নয়। গ্রিসের প্রখ্যাত দ্বীপ হিসেবে যাদের কথা উঠে আসে, সেই সান্তরিনি, ক্রিট, মাইকনাস, রোডসের সাথেই একই কাতারে আসে করফুর নাম। এ দ্বীপে বিমানবন্দর থাকবে না, সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। পরে আরও খানিকটা খোঁজ করে বুঝলাম, এখানকার এয়ারপোর্টের নাম কেরকিরাস এয়ারপোর্ট। কেরকিরাস করফু দ্বীপেরই আরেকটি নাম। স্থানীয় নাম।

এয়ারপোর্টটি বেশ চমৎকার। একদিকে আগ্নেয় শিলায় ঢাকা পাহাড়, অন্যদিকে সাগর। রানওয়ের কোণে কয়েকটি সিঙ্গেল ইঞ্জিনের শৌখিন বিমান পার্ক করে রাখা। আমি নিশ্চিত, এগুলো হয়তো ধনী পর্যটকদের লনিয়ান সাগরে উড়িয়ে নিয়ে নীল জল দর্শনের বন্দোবস্ত করে দেয়। তবে করোনাকালীন এই মন্দার সময়ে প্লেনগুলো অলস হয়ে কিছুদিনের জন্যে ঝিমিয়ে নিচ্ছে হয়তো।

'তুমি বরং এক কাজ কর। আগে ভ্লাসারনা মঠটা দেখে এসো। এই এখানেই ওটা। হাঁটাপথ। হোটেল থেকে বেরিয়ে ডানে যাবে। একটু হাঁটলেই দেখবে নিসোস নামের এক রেস্তোরাঁ। ওর পাশ দিয়ে ঢালু পথ। ও পথে গেলেই পেয়ে যাবে মঠটা।' আমাকে খানিকক্ষণ ভাবতে দেখে অ্যালেক্স বলে।
'সে না হয় গেলাম। তারপর? পুরো দিনই কি এভাবে ফ্যা ফ্যা করে আশপাশে হেঁটে বেড়াব?'

gFDqcdP.jpg


ভ্লাসারনা মঠ

অ্যালেক্সের একটা স্বভাব হলো দাঁড়িয়ে কথা বলার সময়ে অনবরত এক হাতের মুষ্টি দিয়ে আরেক হাতের মুষ্টিতে ঘুষি মারে। আমার এই প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ার সময়ে ব্যাপারটা খেয়াল করি।

'ওখান থেকে ফিরে এসে চাইলে আমার ভাড়ার গাড়িটা নিয়ে আখিলিয়ন প্যালেসে যেতে পার। যাওয়া আর আসা মিলিয়ে তোমাকে ২০ ইউরো চার্জ করব।'
'দেখা যাক, আগে এই কাছের মঠ থেকে ঘুরে আসি।' ২০ ইউরো একটু বেশিই মনে হচ্ছে। তাই পরিস্থিতি দেখে পরে সিদ্ধান্ত নেব বলে ঠিক করি।

হোটেলের ঠিক উল্টো দিকেই কিন্তু একটি বাসস্ট্যান্ডের ছাউনি। লোহার একটি বেঞ্চ। পেছনের দিকে অনেকগুলো কচি বাঁশের ঝাড়। ভ্রম হয়, যেন ইক্ষুদণ্ড। হাওয়ায় ক্রমাগত দুলছে। নবীন সবুজ পাতাগুলো আদর বুলিয়ে দিচ্ছে বেঞ্চের হাতলে। ছাউনিতে কেউ নেই। নেই বাসের সময়সূচি লেখা কোনো নোটিশ। তাই পরের বাসটি কি দুই মিনিট পর এসে দাঁড়াবে, নাকি দুই ঘণ্টা পর, সেটি বোঝারও কোনো উপায় নেই।

5xOELf9.jpg


বিত্তবানদের বালাখানা

আমি সে চেষ্টায় প্রাণপাত না করে নিসোস রেস্তোরাঁর দিকে হাঁটতে থাকি। রাস্তাটি ক্রমশ একটি পাহাড়ের দিকে ধেয়ে যায়। অনতিদূরে তীক্ষ্ণ বাঁক। বাঁকের কোণেই রেস্তোরাঁটি। পথের পাশে বিশাল নোটিশ বোর্ড। সেখানে খাবারের ছবি আর পদের মূল্য। দামের ওপর নজর বুলিয়েই বলে দেওয়া যায়, এটি মালদার আদমিদের জায়গা। সেটি হওয়ার অবশ্য কারণও আছে। এর তেতলার ছাদ, যেখানে বসবার ব্যবস্থা, সেখান থেকে বেশ একটা জম্পেশ ভিউ পাওয়া যায়। সেদিকে তাকিয়ে দেখি, ছাদে পেতে রাখা সব কটি চেয়ার খালি। হাওয়ায় দুলছে টেবিলে পেতে রাখা সফেদ কাপড়। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রেলিঙের ধারে দৌড়ে আসে ম্যানেজার। 'প্লিজ, আসুন না আমাদের রেস্তোরাঁয়। ভালো অক্টোপাস আছে। ভেজে খাওয়াব।' আমি 'সকালের নাশতা মাত্র খেলাম, দুপুরে লাঞ্চের সময়ে আপনার এখানকার কথা ভেবে দেখব' বলে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়ি।

মঠাভিমুখী ঢালু পথটির দুধারে অল্প কয়েকটি বাড়ি। সামনে প্রশস্ত বাগান। সেখানে নানা জাতের ফলদ উদ্ভিদ। বাগান থেকে ভেতর বাড়ি অবধি চলে গেছে বাঁধানো বাগানপথ। এই বাড়িগুলোর সীমানাপ্রাচীর টপকে উঁকি মারছে জেসমিন ফুলের ঝাঁক। সবুজ পাতা উপচে সাদা ফুল মৌতাত ছড়াচ্ছে। ফুলের এই উন্মাতাল ঘ্রাণ ডেকে এনেছে রাজ্যের মৌমাছিকে। তাদের দু–চারটে দলছুট হয়ে এসে আমার মাথার চারদিকে ভনভন করে ঘোরে। দুই পাশের এই বাড়িগুলো বেশ সুনসান। তেমন একটি বাড়ির বারান্দায় এক বুড়ি বসে আছেন।

কুরুশ দিয়ে সোয়েটার বুনছেন। এই ঘোর গ্রীষ্মে তিনি হয়তো শীতের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। আমাকে দেখে খানিকটা মুখ তুলে চেয়ে আবারও উল বোনায় মন দেন। এর দুটি বাড়ির পরের বাড়িটি বেশ অদ্ভুত। হলদে বিবর্ণ বাড়িটিতে খড়খড়ি দেওয়া জানালা। দোতলার ঝুলবারান্দাটি এখনো অটুট। নিচতলার মূল দরজাটি হাট করে খোলা। কিন্তু তাই বলে ভেতরে ঢুকে যাওয়ার জো নেই। সাদা অপরাজিতার গাছ বিপুল পত্রালিসহ সে পথ আগলে আছেত, যেন প্রহরী। ওদিকে পুরো বাড়িকেই যেন গিলে খাচ্ছে পেঁচিয়ে আসা লতাগুল্ম। জানালার ফাঁকা স্থান দিয়ে ঢুকে পড়েছে অন্দরমহলে। সাগরের এত কাছে এমন এক মোক্ষম স্থানে এই পোড়ো বাড়ি দেখে মনে খেয়াল জাগে, এটিকে বেশ কম দামে কিনে নিয়ে সংস্কার করে কিছুদিন কাটিয়ে গেলে কেমন হয়?

পায়ে চলা পথটির একেবারে শেষ প্রান্তে উঁচু ঘাসের অরণ্যে প্লাবিত নিচু ভূমি। মাঝের একটি ডুমুরগাছের কাণ্ডে নোটিশ আঁটা—'এই জমি বিক্রয় হইবে।' ঘেমে নেওয়া ওঠা এক কৃষক জমির ঘাস কাটার জোগাড়যন্ত্র করছেন। তার যন্ত্রটিতে বুঝি তেল ফুরিয়েছে। জ্যারিকেন থেকে তেল ঢেলে নিয়ে তিনি ঘাস কাটার যন্ত্রটি বিকট শব্দে চালু করেন। এমন শান্ত–স্নিগ্ধ একটা পরিবেশ সেই শব্দে যেন কাচের আয়নার মতো ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে।

g5ccvKC.jpg


খাঁড়ির পাশে সারিবাঁধা নৌকায় বিক্রি হচ্ছে মাছ

এখান থেকেই সমুদ্র শুরু। আসলে এটি মূল সমুদ্র নয়। বরং সমুদ্র থেকে ছিটকে আসা খাঁড়ি। তাই এখানে উন্মাতাল ঢেউ নেই। ঝিমিয়ে থাকা মন্থর হ্রদের মতোই এখানকার জল আক্রোশবিহীন। খুব মৃদু শব্দে একেকটি ঢেউ তীরের নুড়িগুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছে কেবল। সেখানে দাঁড়িয়েই আমি মঠটিকে দেখতে পাই। তবে সেটি কিন্তু এপারে নয়, ওপারে।

এপার থেকে ওপারের মধ্যে কংক্রিটের ব্যারাজ। একটু দূরে জলের মধ্যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো জেগে আছে কংক্রিটের আরেকটি পাটাতন। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, যেন একটি সেতু নির্মাণ করতে গিয়েও কোনো কারণে কাজ শেষ করা হয়নি। শ্রমিকেরা সব কাজ ফেলে পালিয়েছেন। কেবল রয়ে গেছে নির্মাণ পর্বের প্রাথমিক সাক্ষী। কিন্তু তা–ই যদি হবে, তাহলে এর গায়ে সারি সারি বাতি কেন? আর সেই বাতিগুলো সূর্যমুখী ফুলের মতো কেনই–বা আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে? রাতের আকাশ অভিমুখে খামোখা আলোকসম্পাত করেই–বা কী লাভ?

লাভ–লোকসানের হিসাবটি বুঝি যখন আমার বাঁ পাশ থেকে চারদিকের পাহাড়গুলোকে প্রকম্পিত করে এক দানবীয় আওয়াজ ভেসে আসে, সেদিকে চেয়ে আমি একেবারে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাই।

টুই এয়ারলাইন্সের বিশাল নীল এয়ারবাসটি আমার ঠিক বাঁ দিকের রানওয়েতে দাঁড়িয়ে। পাগলা ষাঁড় যেমন দৌড়ানোর আগে তপ্ত নিশ্বাস ফেলে মাটিতে পা দাপায়, ঠিক তেমনি এই বিমানও ফাইনাল রান শুরু করার আগে দুই পাশের দুই ইঞ্জিন কাজে লাগিয়ে পেছনে ধুলার ঝড় তুলেছে। ইঞ্জিনের হাওয়ার দমকে সাগরের জলেও তৈরি হয় ক্ষণিকের মাতম। তারপর হুট করেই যেন বিমানটি ছুট লাগায় সম্মুখস্থিত পাহাড়ের পানে। দেখে মনে হয়, পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়বে এর নাক। কিন্তু না, সেই দুর্ঘটনা ঘটার আগেই কৌশলী পাইলট হয়তো থ্রাসট বাড়িয়ে বিমানটিকে আরও ঊর্ধ্বমুখী করে পাহাড়ের শীর্ষদেশ প্রায় ছুঁয়ে পালিয়ে যান। তিন দিকে ঘিরে থাকা শৈলশ্রেণি সেই পলায়নদৃশ্যকে দ্রুত আড়াল করে ফেলে।

এবার আমি বুঝি, ডান ধারে জেগে থাকা সেই একফালি কংক্রিটের স্থাপনার রহস্য। ওগুলো আসলে সার্চলাইট। রাতের বিমানগুলোকে রানওয়ের নিশানা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। এ ছাড়া উপায়ও নেই। কারণ, এই রানওয়ে যেন গড়া হয়েছে সাগরের মাঝ থেকে একখণ্ড ভূমিকে জাগিয়ে তুলে। তিন ধারেই জল। একটু বেশি বা কম দৌড়ালেই বিমানকে সে জলে আছড়ে পড়তে হবে। আর সে কারণেই ইউরোপের ১০টি ব্যতিক্রমী বিমানবন্দরের এটি একটি।

এবার সেই সরু ব্যারাজটির ওপর হাঁটতে থাকি। ওপার থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে একজন এগিয়ে এলে আমাকে কিছুটা সাইড দিতে হয়। ওটি চলে যাওয়ার পর দেখি, দুই বন্ধু মনোযোগ দিয়ে ছিপ ফেলে বসে আছেন। মাথায় হ্যাট, মুখে চুরুট। ষাটের তাদের আশেপাশে বয়স। খুব সম্ভবত শখের মৎস্যশিকারি। তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে খানিকটা গলা বাড়িয়ে ঝুঁকে দেখি, তাদের একজনের ছিপে টোপ হিসেবে আটকে থাকা চিংড়িখানি ডুবে আছে ব্যারাজের দেয়াল ঘেঁষে পড়ে থাকা ডুবো পাথরের ভাঁজে। আর তাকে গিলে খেতে খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সবুজাভ খোলের বিশাল এক কাঁকড়া। যে–ই না কাঁকড়াটি সামনের দুটি হাতকে সাঁড়াশির মতো বাগিয়ে এগিয়ে আসে, ওমনি মৎস্যশিকারি ফিশিং নেটটি জলে ডুবিয়ে ওটিকে ধরাশায়ী করে ফেলেন। স্বচ্ছ জল হওয়ায় এর নিচের পুরো দৃশ্যই আমি অ্যাকুয়ারিয়ামের কাচের বাইরে থেকে দেখার মতো করে দেখতে পারছি।

Bph2BmS.jpg


ব্যারাজের অপর প্রান্তেই সেই মঠ

ব্যারাজের অপর প্রান্তেই সেই মঠ। একটু ডানে। অনেকটা যেন জলের মধ্যে ভেসে আছে। তীর থেকে সেখানে যেতে হলে একটি সাঁকো পেরোতে হয়। সাঁকোর একধারে খুঁটি ধরে লটকে আছে কয়েকটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা। মাঝিরা চেয়ার পেতে গল্পগুজব করছে। দু–একজন টেবিল পেতে সদ্য ধরে আনা মাছ সাজিয়ে রাখছেন বিক্রির জন্য। তাদের পাশ কাটিয়ে খানিকটা এগিয়ে দেখি, সাঁকো আগলে থাকা লোহার দরজাখানি শেকলবদ্ধ। আমাকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাঝিদের আড্ডা থেকে ঢ্যাঙ্গামতো একজন এগিয়ে এসে বলেন, 'এত সক্কাল-সক্কাল মঠের দরজা খুলি না। তবে আপনি এসেছেন যখন, খুলে দিচ্ছি। একটু অপেক্ষা করুন। আমি ভেতরটা আগে একটু ঝাড়পোঁছ করে নিই।'
বুঝলাম, ইনি আসলে মাঝি নন, বরং মঠের তত্ত্বাবধায়ক।

এই ভ্লাসারনা মঠের উঠানটি পাকা করা। চারধারে সীমানাপ্রাচীর নেই। সে জন্য আনমনে হাঁটলে সোজা সাগরের জলে গিয়ে ভাসতে হবে। প্রাচীরের আগল না থাকায় কয়েকটি কৃষ্ণকায় সারস সহজেই জল থেকে উঠে এসে উঠানে জিরিয়ে নিচ্ছে। তাদের চক্ষু মুদিত। আচরণে আলসে ভাব প্রকট। ওদিকে মঠের মূল প্রবেশদ্বারের মাথায় শ্বেতপাথরের ফলকে মঠের প্রতিষ্ঠাকাল উল্লেখ করে লেখা—১৬৮৫। এই প্রবেশদ্বারের পাশের দেয়ালে শুয়েবসে জিরিয়ে নিচ্ছে এক বেড়াল দম্পতি। অসংখ্য ছানাপোনাসমেত। পেছনের সাইপ্রাসগাছ থেকে মাঝেমধ্যে তাদের মাথায় টুপ করে ঝরে পড়ছে গোলাকার ফল।

9KTTLyJ.jpg


মঠের ঘন্টাতোরণ

ঘণ্টাতোরণটির দিকে তাকাই, যেন একটি একহারা দেয়ালের কোটরে লুকিয়ে আছে তিনটি মাঝারি আকারের ধাতব ঘণ্টা। নিচের সারিতে দুটি। ওপরে একটি। খুব সম্ভবত ব্রোঞ্জনির্মিত। পৃথিবীর নানা দেশে খ্রিষ্টধর্মের নানা মতের মঠ-গির্জায় ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ঘণ্টা দেখা যায়। তাদের কোনোটি স্থান পায় গির্জায় চূড়ায়, আবার কোনোটি রক্ষিত থাকে গির্জার প্রাঙ্গণে নির্মিত মিনার আকৃতির কাঠামোতে। গ্রিক মঠগুলো কিন্তু তেমন নয়। এখানে ঘণ্টাগুলো ঝুলানো থাকে একটি দেয়ালে। সেই দেয়াল হতে পারে সীমানাদেয়াল, হতে পারে প্রবেশদ্বারের তোরণ। ক্যালিফোর্নিয়ায় যে স্প্যানিশ মঠগুলো দেখা যায়, তাদের সঙ্গে এই গ্রিক মঠের এদিক থেকে কিছুটা মিল আছে। অবশ্য স্পেন আর গ্রিস তো ভৌগোলিকভাবে খুব দূরে নয়। কাজেই হতে পারে সেই একই স্থাপত্যরীতি ভূমধ্যসাগরের জল পাড়ি দিয়ে মেক্সিকো হয়ে গিয়ে পৌঁছেছে ক্যালিফোর্নিয়ার ধূসর প্রান্তরে।

'এবার ভেতরে আসতে পারেন।'
উঠানের পাশে সাগরের জলকে থামিয়ে দেওয়া বিশাল কয়েকটি পাথরের বোল্ডারের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। এ সময়ে সেই ঢ্যাঙ্গামতো লোকটি এসে ডাকেন। আমাকে মূল প্রার্থনাঘরের দরজা চিনিয়ে দিয়ে তিনি পাশের স্যুভেনিরের দোকানের ঝাঁপি খোলেন। তাকে ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়ে না। তবে কি মঠটি যাজকবিহীন নিঃসঙ্গ এক উপাসনালয়?

প্রার্থনাঘরটি বেশ নিরাভরণ। এক চিলতে। বসার মতো কিছু নেই। ভক্তকে তার শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করতে হবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই। মূল বেদির পাশে কাঠের ফ্রেমে এককালে হয়তো কিছু ফ্রেস্কো আঁকা ছিল, কালের আবর্তনে আজ সেগুলো ধূসর, যেন আবছা জলছাপ।

খানিকটা গুমোট সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমি এবার সাঁকোতে বেঁধে রাখা নৌকোগুলোর কাছে আসি।

'যাবেন নাকি ওদিকটার দ্বীপে? যাওয়া-আসা মাত্র আড়াই ইউরো। আর একজন যাত্রী পেলেই নৌকা ছেড়ে দেব।' এতক্ষণ যে মাঝিরা গুলতানি মারছিল, তাদের মধ্য থেকে বৃদ্ধ একজনের প্রশ্ন। রোদের তাপ খানিকটা বাড়ায় উনি শার্টের ওপরের বোতামগুলো খুলে ফেলেছেন। তামাটে খুলিতে আটকে থাকা একগুচ্ছ চুল হাওয়ায় উড়ছে। এদিকে আমি খানিকটা ইতস্তত করছি। এখান থেকে কিছুটা দূরে সাগরের মধ্যে ছোট্ট একটি দ্বীপ দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু সেখানে কেনই–বা যাব?
'অ্যানাদার বিউটিফুল মনাস্টারি।'

যেন মনের কথা আঁচ করতে পেরেই বুড়োর উত্তর। আমার তো আর কোনো তাড়া নেই। কাজেই বুড়োর নৌকায় চেপে দ্বীপে একটু পা ফেলে এলে তেমন কোনো ক্ষতি বোধ হয় নেই। নীল জলকন্যার ছবি আঁকা ইঞ্জিনের পাশে আমি বেশ আয়েশ করে বসি।

নীল জলের ঢেউকে সন্তর্পণে সরিয়ে নৌকাটি দুলে দুলে চলে দ্বীপের দিকে।
'এখানেই নামুন, আমি আধা ঘণ্টাখানেক বাদে এসে আবার নিয়ে যাব।' এই বলে মাঝি দ্বীপের এককোণে নামান। সেখানে পাথরে বাঁধাই করা একচিলতে জমি। নৌকা ভেড়ানোর ঘাট। দ্বীপটিকে চারদিক থেকে ঢেকে রেখেছে সাইপ্রাসগাছের উঁচু শিখর। তাই একরত্তি দ্বীপের সবেধন নীলমণি পাহাড়ের মাথায় থাকা মঠটিকে এখান থেকে দেখার কোনো উপায় নেই। ওটির দর্শন পেতে হলে পাহাড় বাইতে হবে। আমি পাহাড় বাই।

মঠের আঙিনায় পৌঁছানোমাত্র একটা আদুরে কুকুর পায়ের কাছে এসে কুঁইকুঁই করে। গলায় বাঁধা বেল্টটি দেখে অনুমান করা যায়, এটি পোষা কুকুর। কিন্তু এমন নির্জন–নিরালা দ্বীপে কুকুর এল কী করে? পরক্ষণে দেখি শিস শোনামাত্র কুকুরটি লেজ নাড়িয়ে মনিবের পানে ছুট লাগায়। যিনি মনিব, তিনি হয়তো এ দ্বীপের একমাত্র স্থায়ী নিবাসী। মঠের পাশে ছোট্ট দোকান খুলে বসে আছেন। বিক্রি করছেন কোমলপানীয়, জল আর মঠের ভেতরে পুণ্যার্থীদের জ্বালানোর জন্য মোম। তবে এখানে তো আর তেমন একটা খদ্দের নেই। তাই দোকানটিকে হাট করে খোলা রেখেই তিনি পাহাড়ের প্রান্তের পাঁচিলে বসে কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করায় মন দেন।

lrvRVv4.jpg


মঠ পাহায় থাকা কুকুরছানা

এই মঠের ঘণ্টাদেয়ালে কিন্তু তিনটি ঘণ্টা নেই। ওপরের সারির ঘণ্টাটি উধাও। কেবল নিচের দুটি আছে। তবে এর ভেতরটা বেশ আলোকিত। সিলিংয়ের দিকে থাকা ছোট্ট জানালাগুলো দিয়ে গলগল করে রোদ এসে ভাসিয়ে দিয়েছে ভেতরটা। আর সেই আলোতে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে যিশুর ছবিতে থাকা সোনালি পটভূমি।

নিঃসঙ্গ যিশুকে পাইন আর সাইপ্রাসগাছের অবগুণ্ঠনে বন্দী সেই দ্বীপে ফেলে এসে আমি আবারও এসে পৌঁছাই পূর্বের তটে। আর সেখানেই পাহাড়ের গায়ে লেপটে থাকা কয়েক শ বছরের পুরোনো সিঁড়িটি আবিষ্কার করে এসে পৌঁছাই এই ক্যাফেতে। (চলবে)

লেখক: সঞ্জয় দে
 

Users who are viewing this thread

Back
Top