What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected সকল কাঁটা ধণ্য করে (হুমায়ুন আহমেদ) (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
328
Messages
5,981
Credits
45,360
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
অন্য রকম উৎসব




ছোটবেলায় আমি একবার মেহমানী উৎসবে গিয়েছিলাম।

আজকালকার পাঠক-পাঠিকারা মেহমানী শব্দটার সঙ্গে পরিচিত কি না জানি না, কাজেই একটু ব্যাখ্যা করে নেই। আগেকার আমলে বিত্তবান লোকদের একটা প্রবণতা ছিল তাদের বিত্তের বিষয় অন্যদের জানানো। মেহমানী উৎসবের শুরুটা বোধহয় সেই বিত্ত প্রদর্শনীতে। এই উৎসবে কোন একটা উপলক্ষ ধরে তিন গ্রাম, পাঁচ গ্রাম কিংবা সাত গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করা হত। সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার।

শৈশবের স্মৃতি থেকে বলি, আমার নানার বাড়ির কাছেই চন্দ্রপুর গ্রাম। সেই গ্রামের বিত্তবান একজন মানুষ তার বাবার মৃত্যুদিনে মেহমানী দেবেন। তিন গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করা হয়েছে। দশটি গরু উৎসব উপলক্ষে প্রাণ দিয়েছে, আরো পাঁচটি অপেক্ষা করছে। প্রয়োজনে এদেরও প্রাণ দিতে হবে।

খাবার আয়েজন খোলা মাঠে। অগুণতি মানুষ। সমুদ্র গর্জনের মত শব্দ উঠছে। স্রোতের মত মানুষ আসছে–খাচ্ছে–চলে যাচ্ছে। রান্নার বিরাম নেই, খাওয়ারও বিরাম নেই। আমার বিশেষ কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে–খোলা মাঠে আটদশটা নৌকা সারি বেঁধে রাখা। নৌকাভর্তি ডাল। ডালের পাত্র হিসেবেও যে নৌকার একটা ব্যবহার আছে, আমার জানা ছিল না।

আমাদের খেতে বসতে বসতে রাত বারোটার মত বেজে গেল। মানুষের তুলনায় আলো কম। চাঁদের আলোয় মাটিতে সানকি নিয়ে মিছিলের একজন হয়ে বসেছি। সানকি উচু করে একজন ভাত দিয়ে গেল। সেই ভাতের উপর একজন এসে ঢেলে দিল এক গাদা গোশত। মুখে দিয়েছি কি দেইনি এর মধ্যে ডাল চলে এল। যিনি মেহমানী দিচ্ছেন (সম্পর্কে তিনি আমার মার আপন খালু) তিনি এক পর্যায়ে হাত জোড় করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং বললেন, তার দাওয়াত রক্ষা করার জন্যে তিনি যে কী পরিমাণ আনন্দিত সেটিও অনেক অলংকার দেয়া ভাষায় জানানো হল এবং তিনি বারবার বলতে লাগলেন, তিনি অতি অভাজন। নাদান। অতি নগণ্য। বলতে বলতে তার চোখে পানি এসে গেল। তিনি কাঁধে ফেলে রাখা চাদরে চোখ মুছতে লাগলেন।

যাঁরা মেহমানী দেন তাঁদের এই সব বলতে হয়। এটাই নিয়ম। তিনি নিয়ম রক্ষা করছেন। আবেগে অশ্রুবর্ষণও নিয়ম রক্ষারই অংশ।

শৈশবের মেহমানীর স্মৃতি আমার মধ্যে বেশ ভালভাবেই ছিল। আমার মেয়েদের কাছে আমি এই গল্প বেশ কবার করেছি। এর প্রতিবারই বলেছে, বাবার কী যে আজগুবি সব গল্প–নৌকাভর্তি ডাল! নৌকার বৈঠা ডাল নাড়ার চামচ।

আমি সুযোগ খুঁজছিলাম আমার মেয়েদের এই দৃশ্য দেখানো যায় কিনা। কোনই সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। মেহমানী দেয়ার রীতি হয়ত দেশ থেকে উঠে গেছে। এই অবস্থায় আমি নিজেই একটা মেহমানী দেব বলে ঠিক করলাম। মাকে বললাম–আমি আমার বাচ্চাদের গ্রামের মেহমানী দেখাতে চাই। আমি আমার গ্রামের সব মানুষকে একবেলা খাওয়াব। এরা সবাই একবেলা খাবে, এবং সারারাত জেগে গান শুনবে। আপনি ব্যবস্থা করুন। মা ব্যবস্থা করলেন। সেই মচ্ছব দেখার জন্যে আমি ঢাকা থেকে বন্ধুবান্ধবের পঞ্চাশজনের এক দল নিয়ে রওনা হলাম।

ঢাকার বন্ধুরা কাণ্ডকারখানা দেখে চমৎকৃত হলেন। কিন্তু আমি যা চেয়েছিলাম, তা কিন্তু হল না। আমার শৈশবস্মৃতির সঙ্গে মিলাতে পারলাম না। নৌকাভর্তি ডাল নেই। ভাতের পাহাড় নেই। মাটির সানকি নেই। অবশ্যি আমাদের আয়েজনও অল্প। আমাদের গ্রাম ছোট। মাত্র সাতশ লোকের বাস। তবে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে চার হাজার মানুষের–হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার না। এলোমেলো ভাবও নেই। তবুও হাজার হাজার মানুষ খাচ্ছে। দেখার মতই উৎসব। কিন্তু এই উৎসব আমার তিন কন্যাকে স্পর্শ করল না। বড় মেয়ে বলল, লোকজন এসে খেয়ে যাচ্ছে–এতে দেখার কি আছে বাবা? মানুষের খাওয়া দেখতে আমার ভাল লাগে না। ছোট মেয়ে বলল, তুমি বলেছিলে নৌকাভর্তি ডাল থাকবে। নৌকা কোথায়?

আমার তিন কন্যা গাছে উঠে বসে রইল। ওদের নাকি গাছে বসে থাকতেই বেশি ভাল লাগছে।

খাওয়া চলল সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যাবেলায় খেতে বসল আশেপাশের গ্রামের ফকিরমিসকিনরা। শহরের ফকির এবং গ্রামের ফকিরদের ভেতর একটা প্রভেদ লক্ষ্য করলাম। শহরের ফকিররা তাদের দৈন্যদশী প্রদর্শনে অসম্ভব আগ্রহী। গ্রামের এরা এই ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতে চায়। আজ তারা সবাই তাদের সবচেয়ে ভাল পোশাকটা পরে এসেছে। ভদ্র, বিনয়ী আমন্ত্রিত অতিথির মত আসন গ্রহণ করছে।

এদের খেতে দেয়া হল। আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হল যাতে আমি মেহমানীর বক্তৃতাটা দেই। আমি যথারীতি উপস্থিত হলাম এবং বললাম,

আমি নিতান্তই অভাজন। আমার নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্যে আপনারা যে কষ্ট করে এসেছেন এতে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।

খাওয়া শুরু হল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। কি আগ্রহ নিয়েই না এরা খাচ্ছে! প্লেট ভর্তি করে মাংস দিয়ে গেল। এরা মুগ্ধ চোখে মাংসের স্তুপের দিকে তাকাচ্ছে। এক মহিলা আনন্দিত গলায় বললেন, আফনেরা কি খাওয়াইতে খাওয়াইতে আমরারে মাইরা ফেলাইবেন? (আপনারা কি খাওয়াতে খাওয়াতে আমাদের মেরে ফেলার মতলব করেছেন?)

এই মহিলার আনন্দিত গলা শুনে হঠাৎ আমার চোখে পানি এসে পড়ল। হঠাৎ মনে হল, আমি আমার শৈশবের স্মৃতি নতুন করে তৈরি করতে পারিনি। না পারলেও আমার শ্রম, আমার অর্থব্যয় সার্থক হয়েছে। অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও এইসব হতভাগ্যদের আনন্দিত চোখ আমি দেখলাম। এ আমার পরম সৌভাগ্য।

চল্লিশ বছর আগে আমার মার খালু এমনই এক মেহমানী উৎসবে হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছিলেন। অতিথিদের খেতে বলার পর তিনি হঠাৎ কঁদতে শুরু করেছিলেন। সেদিন মনে হয়েছিল, তিনি মেকি কান্না কাঁদছেন। চল্লিশ বছর পর চোখের জল ফেলতে ফেলতে বুঝলাম, তার সেদিনের কান্না মেকি ছিল না। আমি তাঁর আত্মার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম।

আমার মনে হল–যদি আমার ক্ষমতা থাকতো, আমি অবশ্যই এদেশের প্রতিটি নিরন্ন মানুষকে খাওয়াতাম। আমি জানি, আমার এই আবেগ সাময়িক–আমি শহরে ফিরে যাব, আমার আর কিছুই মনে থাকবে না। তবুও ক্ষণিকের জন্যে হলেও এক মহান বোধ আমার ভেতর সৃষ্টি হয়েছিল–তার মূল্যই বা কম কি? যে মঙ্গলময় আমার ভেতর এই বোধ তৈরি করেছিলেন–তিনি সেই বোধ সবার ভেতর ছড়িয়ে দিবেন–এই আমার প্রার্থনা।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top