What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কাঠ পেন্সিল (হুমায়ুন আহমেদ) (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
328
Messages
5,981
Credits
45,360
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
অসুখ


ছোটখাটো অসুখ আমার কখনো হয় না। সর্দিকাশি-জ্বর কখনো না। পচা, বাসি খাবার খেয়েও আমার পেট নামে না। ব্যাকপেইনে কাতর হয়ে বিছানায় পড়ে থাকি না। আধকপালি, সম্পূর্ণ কপালি কোনো কপালি মাথাব্যথা নেই। মুড়িমুড়কির মতো প্যারাসিটামল আমাকে খেতে হয় না।

এক বিকেলে দুটা Ace নামের প্যারাসিটামল খেয়ে ফেললাম। শাওন বিস্মিত হয়ে বলল, মাথাব্যথা?

আমি বললাম, না। এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে যাব। সেখানে মাথা ধরতে পারে ভেবেই অ্যাডভান্স ওষুধ খাওয়া।

ছোট রোগ-ব্যাধি যাদের হয় না, তাদের জন্যে অপেক্ষা করে বড় অসুখ। একদিন কথা নেই বার্তা নেই গলা দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। এক চামচ দুচামচ না, কাপভর্তি রক্ত। আমি হতভম্ব। কিছুক্ষণের মধ্যে নাক দিয়ে রক্তপাত শুরু হলো। আমার শরীরে এত রক্ত আছে ভেবে কিছুটা আহ্লাদও হলো।

তখন আমি চিটাগাং-এর এক হোটেলে। শিশুপুত্র নিষাদকে নিয়ে শাওন আছে আমার সঙ্গে। নিষাদ অবাক হয়ে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, মা। এত রক্ত দিয়ে আমরা কী করব?

আমি তার কথায় হো হো করে হাসছি। শাওন বলল, এই অবস্থায় তোমার হাসি আসছে?

আমি সঙ্গে সঙ্গে হাসি বন্ধ করলাম। আসলেই তো এই অবস্থায় হাসা ঠিক না। আমার উচিত কাগজ-কলম নিয়ে এপিটাফ লিখে ফেলা। কল্পনায় দেখছি নুহাশপল্লীর সবুজের মধ্যে ধবধবে শ্বেতপাথরের কবর। তার গায়ে লেখা

চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে
নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে।

.

এখন বলি হার্ট অ্যাটাকের গল্প। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আমার চিকিৎসা চলছে। প্রথম ধাক্কা সামলে ফেলেছি। আজরাইল খাটের নিচেই ছিল। ডাক্তারদের প্রাণপণ চেষ্টায় বেচারাকে মন খারাপ করে চলে যেতে হয়েছে। আমাকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কেবিনে। কতদিন থাকতে হবে ডাক্তাররা পরিষ্কার করে বলছেন না।

এক সকালবেলায় হাসপাতালের লোকজনের মধ্যে অতিরিক্ত ব্যস্ততা দেখা গেল। আমার বিছানার চাদর বদলে দেওয়া হলো। জানালায় পর্দা লাগানো হলো। ঝাড়ুদার এসে বিপুল উৎসাহে ফিনাইল দিয়ে মেঝে ঘষতে লাগল। তারপর দেখি তিনজন অস্ত্রধারী পুলিশ। একজন ঢুকে গেল বাথরুমে, দুজন চলে গেল বারান্দায়। আমি ডিউটি ডাক্তারকে বললাম, ভাই আমাকে কি অ্যারেস্ট করা হয়েছে? অপরাধ কী করেছি তাও তো জানি না।

ডিউটি ডাক্তার বললেন, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দিন সাহেব আপনাকে দেখতে আসছেন।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন?

সেটা তো আমরা জানি না। প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব খবর দিয়েছেন তিনি আপনাকে দেখতে আসবেন।

আমি মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলাম এই দফায় আমি মারা যাচ্ছি। শুধুমাত্র মৃত্যুপথযাত্রী কবি-সাহিত্যিকদেরকেই দেশের প্রধানরা দেখতে আসেন।

প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দীন আমার প্রিয় মানুষদের একজন। তাঁর সততা, দেশের প্রতি ভালোবাসা তুলনাহীন। তিনি আমাকে দেখতে আসছেন জেনে নিজেকে খানিকটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে।

ছোটখাটো মানুষটা দুপুরের দিকে এলেন। বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসলেন। যে কথাটা বললেন তাতে সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে পানি এসে গেল। তিনি ময়মনসিংহের ভাষায় বললেন, এখন মারা গেলে চলবে? আপনার নোবেল পুরস্কার আনতে হবে না!

আমি বললাম, আপনি কি জানেন এই মুহূর্তে আপনি আমাকে যে পুরস্কার দিয়েছেন তা নোবেল পুরস্কারের চেয়েও বড়?

থাকুক এসব কথা, বাইপাস অপারেশনের গল্পে চলে যাই। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথের ডাক্তার আমার বাইপাস করবেন। অপারেশন হবে ভোরবেলায়। সন্ধ্যাবেলায় ডাক্তার আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। মূল কারণ আমাকে সাহস দেওয়া।

আমি বললাম, ঠিক করে বলুন তো ডাক্তার অপারেশনে আমার মৃত্যুর আশঙ্কা আছে না? আপনি কি ১০০ ভাগ গ্যারান্টি দিতে পারবেন যে বেঁচে থাকব?

না।

মৃত্যুর আশঙ্কা কত ভাগ?

ফাইভ পার্সেন্ট।

তাহলে আজ রাত বারোটা পর্যন্ত আমাকে ছুটি দিন। রাত বারোটা পর্যন্ত আমি আনন্দ করব। এক গ্লাস ওয়াইন খাব। সিগারেট খাব। মনের আনন্দ নিয়ে সিঙ্গাপুরের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখব। রাত বারোটা বাজার আগেই ফিরে আসব।

ডাক্তার বললেন, কাল ভোরবেলায় আপনার অপারেশন। মেডিকেশন শুরু হয়ে গেছে। এখন এসব কী বলছেন?

আমি বললাম, অপারেশনের পর আমি তো মারাও যেতে পারি।

আপনি কী করেন জানতে পারি?

আমি একজন লেখক। গল্প বানাই।

একজন লেখকের পক্ষেই এমন উদ্ভট প্রস্তাব দেওয়া সম্ভব। আচ্ছা দেখি আমি কিছু করতে পারি কি না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে রাজি করানো কঠিন হবে।

আশ্চর্যের ব্যাপার, বিশেষ ব্যবস্থায় আমাকে রাত বারোটা পর্যন্ত ছুটি দেওয়া হলো। মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের আমিই না-কি প্রথম বাইপাস পেশেন্ট—যাকে এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

.

অপারেশন টেবিলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দুজন নার্স চাকা লাগানো বিছানা ঠেলতে ঠেলতে নিচ্ছে। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। একজন হাস্যমুখি আবার হি হি করে কিছুক্ষণ পরপর হাসছে। তার গা থেকে বোটকা গন্ধ আসছে। চায়নিজ মেয়েদেল গা থেকে গা গুলালো গন্ধ আসে। চায়নিজ ছেলেরা হয়তো এই গন্ধের জন্যেই পাগল।

আমি চোখ বন্ধ করলাম। কোনো সুন্দর দৃশ্যের কল্পনা করা যায় কি না তার চেষ্টা। জোছনাস্নাত অপূর্ব কোনো রজনীর স্মৃতি। কিংবা শ্রাবণের ক্লান্তিবিহীন বৃষ্টির দিনের স্মৃতি। কিছুই মাথায় আসছে না। চোখ মেললাম এনেসথেসিস্টের কথায়। এনেসথেসিস্ট বললেন (তিনি একজন মহিলা), তুমি ভয় পাচ্ছি?

আমি বললাম, না।

আশ্চর্যের কথা, আসলেই ভয় পাচ্ছিলাম না। কেন ভয় পাচ্ছি না তাও বুঝাতে পারছি না। পরে শুনেছি ভয় কমানোর একটা ইনজেকশন না-কি তারা দেয়।

অজ্ঞান করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শরীর হালকা হতে শুরু করেছে। অস্পষ্টভাবে কোনো একটা বাদ্যযন্ত্রের বাজনা কানে আসছে। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজাবে না। তাহলে কে বাজাচ্ছে?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top