What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected সংলাপ (ছোটগল্প) (1 Viewer)

Welcome! You have been invited by বান্টি দাস to join our community. Please click here to register.

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
328
Messages
5,981
Credits
45,360
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
গল্প (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » সংলাপ


পেটে গ্যাস হয়, বুঝলেন! খুব গ্যাস হয়।

সেটা খুব টের পাচ্ছি। গত পঁয়তাল্লিশ মিনিটে শ দেড়েক ঢেকুর তুললেন।

দেড়শো! না মশাই, দুশোর বেশি। কী থেকে যে গ্যাস শালা জন্মায় সেটাই ধরতে পারছি না। সেই দুপুরে পাবদা মাছের ঝোল দিয়ে চাট্টি ভাত খেয়েছি সেটাও গিয়ে পেটের মধ্যে গ্যাস সিলিণ্ডার হয়ে গেড়ে বসে আছে।

আজ পাবদা কিনেছিলেন বুঝি? ভালো পাবদার কাছে কিছু লাগে না।

যা বলেছেন। আমাদের বাজারে সুকুমার বলে যে মাছওয়ালাটি আছে সে-ই একটু ভালো জিনিস রাখে। আর সবাই তো কাটা পোনা চিতিয়ে বসে আছে। নয়তো আড়-বোয়াল-তেলাপিয়া।

কত করে নিল?

সেটা আর জিজ্ঞেস করবেন না। দামের কথা মুখে আনাই পাপ। অবিশ্বাস্য মশাই, অবিশ্বাস্য। তবে বাবার বয়স হয়েছে। ক-দিন ধরেই জিজ্ঞেস করছিলেন, হ্যাঁ রে, বাজারে পাবদা ওঠে না? তাই আনা।

আপনার বাবা তো পুলিশে ছিলেন, তাই না?

হ্যাঁ, অ্যাডিশনাল ডি এস পি।

বড়ো পোস্ট।

হ্যাঁ, তা বড়োই।

বাড়িটা তো আপনার বাবারই করা, তাই না? দিব্যি বাড়ি।

হ্যাঁ, তা মন্দ নয়।

এ বাজারে কলকাতায় ওবাড়ি হেসেখেলে বিশ-পঁচিশ লাখ দাঁড়াবে।

হ্যাঁ, পঁচিশ লাখ অফার পেয়েছি।

অফার মানে? বাড়িটা বেচবেন নাকি? আরে না মশাই, বাড়ি বেচে যাব কোথায়? তবে অনেকে আছে-না, ভালো বাড়ি দেখলেই একটা দর হেঁকে বসে, সেরকম-ই ব্যাপার।

তবু ভালো। আমি ভাবলাম বেচার তোড়জোড় চলছে বুঝি। আজকাল প্রোমোটারের যা দৌরাত্ম্য!

সে তো বটেই। তবে ভাবছি বাবা যতদিন বেঁচে আছেন, ততদিন তো আর বাড়ি প্রোমোটারকে দেওয়ার প্রশ্ন উঠছে না। কিন্তু বাবা মারা গেলেই সেই সাবেক সমস্যা। তিন ভাইয়ে ভাগাভাগি। আর বাড়িটাও এমন প্ল্যানে তৈরি যে, ভাগজোখ হয় না। তখন প্রোমোটারকে না দিয়ে বোধ হয় উপায় থাকবে না।

সে তখন ভাববেন। আপনার এক ভাই পলিটিক্স করত-না?

আমার বড়দা। ইলেকশনেও দাঁড়িয়েছিল।

আর মেজো-জন?

ছোড়দা তো? তিনি ইনকাম ট্যাক্সের উকিল।

মেলা পয়সা, না?

দেদার পয়সা। সব মাড়োয়ারি ক্লায়েন্ট।

সব একসঙ্গেই আছেন তো?

পাগল নাকি? বড়দা গড়িয়ায় বাড়ি হাঁকিয়েছে সেই কবে। মেজদা ফ্ল্যাট কিনেছে ভবানীপুরে। আমিই পৈতৃক বাড়িতে পড়ে আছি।

আপনি তো ব্যাচেলার, আলাদা বাড়িতে থাকার দরকারটাই বা কী?

দরকার নেই ঠিকই। কিন্তু দায়দায়িত্ব ঘাড়ে এসে পড়ে কিনা। এই ধরুন, দাদারা সটকে পড়ল, কেউ বাপ মায়ের দায়িত্ব নিল না। কিন্তু আমি ব্যাচেলার বলেই সটকাতে পারলুম না।

বয়েস কত হল?

প্রায় চল্লিশ।

এমন কিছু বয়স নয় কিন্তু।

বলেন কী? আমার তো সবসময়ে মনে হয় বুড়ো হয়ে গেছি।

বিয়েটা হল না কেন?

কপালে নেই বলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে আমিই অগামার্কা, ছাত্র ভালো ছিলুম না। চাকরিও ভালো জোটেনি।

একটা সিন্ধি কোম্পানিতে আছেন-না আপনি?

আছি বটে, তবে না থাকার মতোই। অপমানজনক বেতন, হাড়ভাঙা খাটনি। কোনোরকমে গ্রাসাচ্ছাদন চলে যায় আর কী!

তাহলে সংসারটা কি বাবার টাকায় চলে?

চললে তো হতই। কিন্তু ওটা আমিই চালিয়ে নিচ্ছি। বেতনের টাকা সবটাই খরচ হয়ে যায়। তা যাক। আমার আছেই বা কে, খাবেই বা কে?

দাদারা কিছু দেয় না?

নাঃ। আমিও চাই না, তারাও দেয় না।

আপনি তো তাহলে স্কেপগোট, বলির পাঁঠা।

তা বলতে পারেন। তবে অত হিসেব-টিসেব করে কীই বা হবে? চলে তো যাচ্ছে। অসুখ-বিসুখ বা মোটা খরচের পাল্লায় পড়লে অবশ্য বিপদ ঘটবে।

বাবা কিছু দিতে পারেন তো! আফটার অল পুলিশের চাকরি করেছেন, হাতে ভালোই থাকার কথা।

আছেও। কিন্তু দেন না। তাঁর সাফ কথা, এতদিন তোমাদের প্রতিপালন করেছি, এখন তোমাদের কর্তব্য মা বাবার প্রতিপালন করা। এই নিয়েই দাদাদের সঙ্গে খিটিমিটি।

তারা পালিয়ে বাঁচলেন তো!

পালানোর-ই কথা। আজকাল তো পালানোই রেওয়াজ।

আপনিই পারলেন না তাহলে?

পালানোর কী আছে? ওরা বউ-বাচ্চার ভবিষ্যৎ ভেবে পালিয়েছে, আমার তো সে-বালাই নেই।

বিয়েটা করলেন না কেন মশাই? লাভ অ্যাফেয়ার-ট্যাফেয়ার ছিল নাকি?

সত্যি কথা শুনতে চান?

আপনার যদি আপত্তি না থাকে।

লাভ অ্যাফেয়ার বললে বাড়াবাড়ি হবে। একটা মেয়ের প্রতি একটু সফটনেস ছিল। কিন্তু কথাটা তাকে মুখ ফুটে জানাতে পারিনি।

ও, তাহলে আর লাভ অ্যাফেয়ার কী হল?

দুঃখের কথা হল, পরে আমার এক খুড়তুতো বোনের কাছে জানতে পারি যে, সেই মেয়েটারও নাকি আমার প্রতি সফটনেস ছিল। সেও কখনো বলতে পারেনি।

এঃ হেঃ, এ যে, খুব-ই দুঃখের ব্যাপার। মেয়েটার কি বিয়ে হয়ে গেছে?

তা হবে-না? সে এখন ছেলেপুলের মা, ঘোর সংসারী।

তার তো হিল্লে হয়ে গেল, আপনার তো হল না।

হিল্লে আর কী? জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া তো? সে কেটে যাবে।

মা বিয়ে দিতে চান না?

আগে চাইতেন। তবে দুই বউমার কাছ থেকে যা ব্যবহার পেয়েছেন তাতে বোধ হয় আগ্রহ কমে গেছে। আর আমারও তো বয়স হল।

বয়সের চেয়েও বড়োকথা হল, আপনি বুড়িয়ে যাচ্ছেন। এটা ভালো কথা নয়। ঠিক কত বয়স হল বলুন

আটত্রিশ পূর্ণ হয়ে উনচল্লিশ চলছে।

সাহেবরা তো এই বয়সেই বিয়ে করে। চল্লিশে তাদের জীবন শুরু।

সাহেবরা সব ব্যাপারেই আমাদের চেয়ে এগিয়ে, তাদের সঙ্গে কি আমাদের তুলনা হয়?

আহা, তারাও তো রক্তমাংসের মানুষ। তাদেরও জরা-ব্যাধি আছে।

তা আছে। তবু তুলনা হয় না। জীবনকে ওরা ভোগ করতে জানে। আর আমরা জীবনটা কাটিয়ে দিই মাত্র।

বেড়াতে-টেড়াতে যান-না?

না, বেড়ানোর যা-খরচ। শখ-আহ্লাদ বলতে কিছুই নেই। আগে ময়দানে ফুটবল খেলা দেখতে যেতুম। এখন আর ইচ্ছে হয় না। সময় পেলে একটু-আধটু টি.ভি. দেখি। ব্যস। পাড়ার একটা ক্লাবে একটু যাতায়াত আছে। সামান্য সোশ্যাল ওয়ার্ক করি।

সোশ্যাল ওয়ার্ক করা তো খুব ভালো।

মন দিয়ে করলে তো ভালোই। আমি করি সময় কাটানোর জন্য।

কীরকম সোশ্যাল ওয়ার্ক? বন্যাত্ৰাণ, খরাত্ৰাণ ওসব নাকি?

সেসবও আছে। তা ছাড়া সাক্ষরতা অভিযান, রক্তদান, অ্যান্টিসোশ্যালদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা –এইরকম আর কী।

ভালো ভালো। তবে অ্যান্টিসোশ্যালদের সঙ্গে লাগাটা আবার বিপজ্জনক। এটা তো ওদেরই যুগ কিনা। পুলিশ, প্রশাসন সবই ওদের হাতে।

যা বলেছেন। ভালো করে না বুঝেসুঝে আমিও বড় বিপদে পড়ে গেছি।

তাই নাকি? কী ব্যাপার?

টাপু বলে একটা ছেলে আছে আমাদের পাড়ায়। ভালো ছেলে। সে একজন অ্যান্টিসোশ্যালের পাল্লায় পড়ে বখে যাচ্ছিল। তার বাবা এসে ক্লাবে কেঁদে পড়ে। আমরাও ভালো করে না ভেবেচিন্তে অ্যাকশনে নেমে পড়ি। কিন্তু তার ফল দাঁড়ায় মারাত্মক। সেই অ্যান্টিসোশ্যালটা–তার নাম টিপু–দলবল নিয়ে এসে ক্লাবে বোমাবাজি করে গেল এই তো, মাত্র দিন পনেরো আগে এক সন্ধেবেলা।

সর্বনাশ! কেউ মার্ডার হয়নি তো?

না। তবে দুজনের সপ্লিন্টার ইনজুরি হয়েছে।

বেঁচে গেছেন তাহলে।

মশাই, বাঁচা অত সোজা নয়। শাসিয়ে গেছে সবাইকে দেখে নেবে।

ও বাবা, তাহলে তো আপনি বিপদের মধ্যেই আছেন।

তা আছি।

পুলিশ অ্যাকশন নেয়নি?

রুটিন মাফিক নিয়েছে। ওদের কেউ ভয় পায় না আজকাল।

সেই টাপু ছেলেটার কী অবস্থা?

পালিয়েছে।

তাকে ফেরাতে পারবেন মনে হয়?

বলতে পারি না। সবাইকে তো ফেরানো যায় না। সৎপথে থাকার আকর্ষণ আজকাল কমে যাচ্ছে। ইয়াং জেনারেশন আজকাল একটু গা গরম করতে চায় বোধহয়।

এ-ব্যাপারে আপনাদের নেক্সট লাইন অফ অ্যাকশন কী?

সবাই ভয় পেয়ে গেছে। অ্যাকশনে কেউ যেতে চাইছে না।

তাহলে আপনারা রণে ভঙ্গ দিলেন বলুন?

একরকম তাই। বোমা-পিস্তলের সঙ্গে লড়াই করব কী করে?

তাই তো বলছিলুম মশাই, অ্যান্টিসোশ্যালদের সঙ্গে লাগা বিপজ্জনক।

খুবই বিপজ্জনক। সেই ঘটনার পরে থেকে টেনশনে আমার গ্যাস আর অম্বল বেড়ে গেছে।

শুনেছি টেনশনে গ্যাস-অম্বল বাড়ে।

আমারও বেড়েছে। রাতে শুয়ে দুশো-আড়াইশো ঢেকুর ওঠে।

আর ওসবের মধ্যে যাবেন না।

ইচ্ছে করে কি যাই? একটা ঘটনা থেকে নানা ঘটনার ফ্যাঁকড়া বেরোয় যে!

কীরকম?

টাপুর মা এসে আমাকে ধরে পড়েছিল সেদিন। বলল, দেখ বাবা, ওই টিপু আর ওর দলবল আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলবে। তুই একটা কিছু কর। মহিলাকে কিছুতেই বোঝাতে পারি না যে, আমার মতো ভীতুকে দিয়ে কিছু হওয়ার নয়। অগত্যা বললাম, আচ্ছা চেষ্টা করব।

চেষ্টা করেননি তো!

ঠিক চেষ্টা করেছি বলা যায় না। তবে টিপুর হদিশ করতে শুরু করি।

ও বাবা! আপনি তো সাংঘাতিক লোক!

কী করব বলুন? ভদ্রমহিলা এমন কান্নাকাটি করলেন যে, কিছু না করেও থাকা যায় না।

হদিশ পেলেন নাকি?

পেলুম। পাশেই পালপাড়ার একটা ছেলে খবর দিল, ওদের বাড়ির কাছে একটা রং ঝালাইয়ের দোকানের পেছনে থাকে। হাইড আউট।

মশাই, শুনে যে আমারই বুক ধড়ফড় করছে।

আমারও করছিল।

যাননি তো?

যাওয়ারই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ঘাড়ে ভূত চাপলে যা হয়।

গেলেন?

একটু রাতের দিকে গেলুম।

বলেন কী?

সেই তো বলছি। গ্রহের ফের। তবে কপাল ভালো যে, টিপুকে বেশি খুঁজতে হয়নি। রাত এগারোটা হবে তখন, টিপু মাল খেয়ে ফেরার পথে পান-সিগারেটের দোকানে সিগারেট ধরাচ্ছিল।

কী করলেন?

গিয়ে বললুম, কাজটা ঠিক করছ না হে টিপু। এসব করা ভালো নয়।

এভাবে বললে কি কাজ হয়?

হল না তো! টিপু একটা খিস্তি করে কোমর থেকে একটা ছোরা বের করল। দোধার ছোরা। প্রকান্ড ফলাটা একেবারে ঝকঝক করছিল।

সর্বনাশ! পালালেন তো?

না। পালিয়ে যাব কোথায়? যাওয়ার কি জায়গা আছে?

তাহলে কী করলেন?

সে আর বলবেন না। আপনি কি দৈব মানেন?

খুব মানি মশাই, খুব মানি। এই যুগে বেঁচে থাকার-ই যা সমস্যা, দৈব না মেনে উপায় আছে?

ঠিক তাই, দৈব ছাড়া আর কী বলি বলুন? নিতান্তই টাপুর মায়ের চোখের জল সইতে না পেরে আহাম্মকের মতো টিপুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সৎপথে ফেরাতে গিয়েছিলুম। কাজটা যে কতবড়ো ভুল হয়েছিল, তা আগে বুঝতে পারিনি।

অতি খাঁটি কথা মশাই। কাজটা করা আপনার মোটেই ঠিক হয়নি। তারপর হলটা কী সেইটে বলুন।

আজ্ঞে কী যে হল তা কি আমি জানি। ছোরা দেখে আর টিপুর রক্ত-জলকরা চাউনিতে আমার তখন শরীরে স্তম্ভন। এত ভয় খেয়ে গেছি যে, হাত-পা যেন কাঠ। ভগবানকে জীবনে ডাকিনি কখনো। আসলে ডাকার কথা মনেই থাকে না। সেই অবস্থাতেও মনে পড়ল না। টিপু ব্যাধের মতোই এগিয়ে এল। কিন্তু তারপর কী যে হয়ে গেল, কিছু মাথায় ঢুকল না।

কী হল?

সেইটেই তো বলবার চেষ্টা করছি। কিন্তু বর্ণনা দেওয়ার ভাষাটাও খুঁজে পাওয়া কঠিন। টিপু এগিয়ে এসে ছোরা বাগিয়ে ধরে পেটে বা বুকে ঢুকিয়ে দেয় আর কী! ওদের তো মায়া-দয়া নেই। কিন্তু কী যে হল, হঠাৎ টিপু যেন পায়ে পা জড়িয়ে, যেন নিজেকেই নিজে ল্যাং মেরে একটা পুঁটুলির মতো দলা পাকিয়ে পড়ে গেল মাটিতে। একেবারে আমার পায়ের গোড়ায়।

বলেন কী?

দৈব ছাড়া আর কী বলি বলুন। অবিশ্বাসেরও কিছু নেই। নিজের চোখে দেখা।

তারপর?

পড়ে গিয়ে টিপু কেমন যেন ছটফট করতে লাগল, গলায় গোঙানির আওয়াজ। মরতে মরতে বেঁচে গিয়ে আমি যেন কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলুম। নড়তেও পারছি না। পানের দোকানিটা নেমে এসে টিপুর মুখে-চোখে জলের ঝাঁপটা দিতে দিতে বলছিল, এর শরীরে কি কিছু আছে? দিনরাত চুন্নু টানছে, পাতা খাচ্ছে। শালা এবার মরবে।

জোর বেঁচে গেছেন তাহলে! দৈব ছাড়া এ আর কিছু নয়।

ঠিকই বলেছেন। তবে কিনা ব্যাপারটা চাউর হল অন্যরকম।

সেটা আবার কী?

আর বলবেন না মশাই। লোকের মুখে মুখে রটে গেল আমিই নাকি টিপুকে মেরে পাট করে দিয়েছি। বুঝুন কান্ড। আমার গায়ে না আছে জোর, না আছে মনে সেই সাহস। কিন্তু লোকে তা বুঝলে তো! সে এমন কান্ড যে, টিপুর দলের একটা ছেলেও সাহস করে আমার কাছে এগিয়ে এল না। আমিও আর দাঁড়াইনি। তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। কিন্তু পরদিন সকাল থেকেই আমাকে নিয়ে পাড়ায় হইচই। এমনকী থানার দারোগা পর্যন্ত এসে আমাকে হিরো বানিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন। বললেন, আপনার জন্যই টিপুকে ধরা গেল।

তারপর কী হল মশাই?

টাপু বাড়ি ফিরে গেল। আমার পা জড়িয়ে ধরে বলল, আপনার জন্যই টিপুর খপ্পর থেকে ছাড়া পেয়েছি, নইলে ওরা আমাকে শেষ করে দিত।

তাহলে আপনি এখন হিরো?

কাকতালীয় ঘটনা আর কাকে বলে! যেভাবে আমাকে হিরো বানানো শুরু হয়েছিল তাতে আমার ভয় হল, এবার টিপুর দলের ছেলেরা না আমার ওপর চড়াও হয়। মানুষের প্রাণের স্থায়িত্ব কী বলুন? একটা গুলি বা ছুরি-ছোরা, নিদেন একখানা আধলা ইটেও কাজ হয়ে যায়।

তা তো ঠিকই। তা সেরকম কিছু হয়েছিল নাকি?

না মশাই। বরং টিপুর এক শাগরেদ এসে দেখা করে মাপটাপ চেয়ে গেল। বলল, টিপুটা ইদানীং বড়ো বাড়াবাড়ি করছিল। আমরা তো তাকত দেখাতে লাইনে নামিনি দাদা, এসেছি রুজি-রোজগার করতে। আর টিপু হতে চায় রবিনহুড।

বাঃ, তাহলে তো আপনার আর কোনো সমস্যাই রইল না।

সমস্যা! সমস্যার কী শেষ আছে? একটা যায় তো আর একটা আসে।

সেটা আবার কীরকম?

আছে মশাই, আছে। হিরো হওয়ার হ্যাপাও বড়ো কম নয়। মিনি মাগনা হিরো বনে গেছি বটে, কিন্তু ফ্যাঁকড়াও আছে।

ঝেড়ে কাশুন-না মশাই।

এই ধরুন, আগে কেউ পাড়ায় আমার দিকে ফিরেও চাইত না, আজকাল সবাই তাকায়, পথে বেরোলে জানলায়, বারান্দায় উঁকিঝুঁকি শুরু হয়, নাগরিক কমিটি থেকে আমাকে চেয়ারম্যান করার কথা উঠেছে। এইসব নানা উদ্ভট কান্ড। তারপরও গোদের ওপর বিষফোঁড়া আছে।

সেটা কী?

টাপুর মা এসে আমার মাকে ধরেছে, টাপুর দিদি–এই ধরুন বাইশ-তেইশ বছর বয়েস হবে–তাকে ছোটোবউমা করে নিতে। বর্ণ-গোত্র সব নাকি ঠিকঠাক আছে।

বলেন কী মশাই? একথা আগে বলতে হয়। এ তো দারুণ খবর!

না মশাই, না। মোটেই ভালো খবর নয়। বয়সের তফাতটা লক্ষ করেছেন? তার ওপর আমি তো একরকম বুড়োই। একা-বোকা, থেকে-থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন কি আর ঝুটঝামেলা ভালো লাগে?

রিফিউজ করলেন নাকি?

হ্যাঁ, খুব কঠোরভাবেই রিফিউজ করলাম। টাপুর মাকে বললাম, আপনারা মোহের বশে এ-প্রস্তাব করেছেন। ভালো করে ভেবে দেখবেন কাজটা ঠিক হবে না।

আপনার চরিত্রটি বেশ দৃঢ়।

না মশাই, একেবারেই না। বরং আমি অতিশয় দুর্বলচিত্ত। ভেবে দেখলাম দুর্বলচিত্ত লোকদের দাম্পত্যজীবনে না যাওয়াই ভালো। তা ছাড়া, ওরা আমড়াকে আম ভেবে বসে আছে কিনা। আমি তো আসলে হিরো নই, জিরো।

তাহলে ব্যাপারটা ওখানেই মিটে গেল নাকি?

মিটলে তো ল্যাঠা চুকেই যেত।

মেটেনি তাহলে? না, বললাম না, সব ঘটনা থেকেই ফ্যাঁকড়া বেরোয়।

তা এখানে আবার ফ্যাঁকড়া কী বেরোল?

টাপুর দিদি নন্দনাই হল ফ্যাঁকড়া। একদিন সে সোজা আমার ঘরে এসে হাজির। দুই চোখ জলে ভরা, ঠোঁট কাঁপছে।

বাস রে, এ যে, উত্তম-সুচিত্রা।

বাইরে থেকে এরকম মনে হয়। আমার যে, তখন কী অবস্থা তা বোঝাতে পারব না।

মেয়েটা দেখতে কেমন মশাই?

ভালোই। রং তেমন ফর্সা নয় কিন্তু মুখে-চোখে শ্ৰী আছে। পাড়ায় ভালো মেয়ে বলে নামও আছে।

তাহলে পিছোচ্ছেন কেন?

ওই যে বললাম, বুড়ো হয়ে গেছি। এখন কি কেঁচেগন্ডূষ করা যায়?

তা মেয়েটা বলল কী?

তেমন যে কিছু বলল, তা নয়। গলা কাঁপছিল। শুধু বলল, আমি কি খারাপ? তবে কেন আপনি–ব্যস ওই পর্যন্তই। বাক্যটা শেষ অবধি করতে পারেনি।

তা আপনি কী করলেন?

মেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তা তো বিশেষ বলিনি কখনো। ঘাবড়ে গিয়েছিলুম।

কিছুই বললেন না?

তেমন কিছু বলতে পেরেছি বলে মনে হয় না। একটু আমতা আমতা করে বললুম, তুমি তো ভালো মেয়ে। তবে কেন আমাকে–ব্যস, বাক্যটা আমিও শেষ করতে পারিনি।

ওঃ, আপনার পেটে পেটে এত? এরকম মাখোমাখো ব্যাপারখানা এতক্ষণ চেপে রেখেছিলেন? আপনি তো খুনি লোক মশাই।

কী যে বলেন। মাখোমাখো ব্যাপারটা মোটেই নয়। নন্দনা এসে ও-কথা বলে যাওয়ার পর থেকে আমার ঘুম গেছে, খাওয়া গেছে, দুশ্চিন্তায় আধমরা অবস্থা। আর পেটে ফাঁপা ভাব। কী-যে অসোয়াস্তি।

গ্যাসের মেলা ওষুধ আছে মশাই। ওর জন্য চিন্তা নেই। আগে বলুন, সিদ্ধান্তটা কী নিলেন?

ওই যে বললুম, গ্যাসে এমন কাহিল হয়ে পড়েছি যে, আর ওসব নিয়ে এগোতে ভরসা হচ্ছে না। তবে মা ইদানীং দেখছি আদাজল খেয়ে লেগেছে। বড় বিপদ যাচ্ছে মশাই।

কীসের বিপদ?

একটা মিথ্যে জিনিসকে সবাই মিলে সত্যি করে তুলছে, এটা ভালো হচ্ছে না।

মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে কেন?

মিথ্যে নয়? গুণ্ডাটা নিজেই কেতরে পড়ল আর হিরো বনলাম আমি!

আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে, ঘটনাটা তত মিথ্যে নয়। আপনি চেপে যাচ্ছেন।

বলেন কী? আমার কি গুণ্ডার সঙ্গে লড়ার ক্ষমতা আছে?

কিছু বলা যায় না। কখনো-কখনো কাপুরুষও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। আর আপনি সত্যিকারের কাপুরুষ হলে, মাঝরাত্তিরে গিয়ে টিপুর ডেরায় হানা দিতেন না।

ওই যে বললুম, কাজটা আহাম্মকি হয়েছিল।

আপনাকে তত আহাম্মক বলে মনে হচ্ছে না। ঘটনাটা বলেই ফেলুন-না। আমি তো আর পুলিশের লোক নই।

কী যে বলেন।

বলুন-না মশাই, লজ্জা পাচ্ছেন কেন? আসলে কী জানেন, ঘটনার সময়ে আমি এমন বিভ্রান্ত অবস্থায় ছিলাম যে, সত্যিকারের কী ঘটেছিল তা আমি নিজেও জানি না।

এই তো এবার মাল বেরোচ্ছে। টিপুর মতো গুণ্ডা আপনাকে ছোরা মারতে এসে হঠাৎ কনভালশন হয়ে ঢলে পড়বে এমন ঘটনা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়।

ওইটেই মুশকিল। আমার যেটুকু মনে পড়ছে তাই বলেছি। বাকিটা আমার স্মৃতিতে নেই।

তাহলে মশাই, বলতেই হবে, আপনি টিপুর চেয়েও অনেক বেশি ডেনজারাস লোক।

ছিঃ ছিঃ, কী যে বলেন। জীবনে আমি মারপিট করিনি।

প্রয়োজন পড়েনি বলে করেননি। কিন্তু এলিমেন্টটা আপনার ভেতরে ছিলই।

আপনি কী বলতে চান, আমার ভেতরে একজন অচেনা আমি আছে?

সকলের ভেতরেই থাকে।

কী জানি মশাই। লোকে বলছেও বটে যে, আমার বিবরণ বিশ্বাসযোগ্য নয়। অনেকেই নাকি দেখেছে, আমি টিপুকে পেটাচ্ছি। আর হাসপাতালের ডাক্তাররাও টিপুর ইনজুরির রিপোর্ট দিয়েছে। কিন্তু আমি ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি যা বলছেন, তা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে তো চিন্তার কথা।

কীসের চিন্তা?

এই যে আমার ভেতরে একজন হিংস্র, নিষ্ঠুর, অ্যাগ্রেসিভ লোক লুকিয়ে রয়েছে এ কি চিন্তার কথা নয়? বেশ ভয়েরই ব্যাপার।

তা ভয় পেলে একজন পাহারাদার বসালেই তো হয়।

পাহারাদার? সে আবার কী?

সবচেয়ে ভালো পাহারাদার তো নন্দনাই হতে পারে।

যাঃ, কী যে বলেন। আপনি কি মনে করেন বিয়ে মানুষের কোনো উপকার করে? আমার তো ও-কথা ভাবলে পেটে গ্যাস বেড়ে যায়। দেখলেন-না কতগুলো ঢেকুর তুললাম! আজকাল বড্ড বেড়ে গেছে।

আচ্ছা, টিপুর অবস্থা এখন কীরকম?

যতদূর জানি, পুলিশ-পাহারায় হাসপাতালে রাখা হয়েছে তাকে। খুব সিরিয়াস কিছু নয়।

আচ্ছা মশাই, টিপুর কি নন্দনার ওপরেও একটা নজর ছিল?

কী করে বুঝলেন মশাই, জানি না। কিন্তু কথাটা মিথ্যে নয়। ছিল।

বুঝতে বেশি মাথা ঘামাতে হয়নি। টাপুকে হাত করার পেছনে হয়তো ওটাই ছিল আসল উদ্দেশ্য।

তাই হবে। নন্দনার মাও ঠারেঠোরে কথাটা আমাকে জানিয়েছেন। নন্দনা নাকি টিপুর ভয়ে কিছুদিন মামার বাড়িতে গিয়ে পালিয়ে ছিল।

তাহলে আপনার কি এখন উচিত নয়, নন্দনাকে এই ভয়ের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া?

আমার কী গরজ?

গরজ আছে বই কি। অসহায় অবলা নারীকে রক্ষা করাই তো পুরুষের ধর্ম, টিপু সেরে উঠলে যে নন্দনার আবার বিপদ!

তা নন্দনা আর কাউকে বিয়ে করলেই তো পারে।

সেটা দ্বিচারণা হবে না? তার যে আপনাকে পছন্দ।

দূর আমি বুড়ো গ্যাসের রুগি, কম বেতনের অপদার্থ লোক। আমার মধ্যে কী দেখল বলুন তো?

সেটা নন্দনাকে জিজ্ঞেস করছেন না কেন?

করে কী লাভ? যা বলবে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। প্রেম তো একটা ইমোশনাল অ্যাকসেস। ওর কোনো জোরালো ভিত নেই।

আপনার কপালে কী আছে জানেন?

কী?

বয়েস হলে বিড়বিড় করে কথা কওয়া, উদ্ভট উদ্ভট সব কান্ড করা, বাতিক আর বায়ুগ্রস্ত হয়ে পড়া–যা ব্যাচেলারদের হয় আর কি। তা ছাড়া দাদারা ভুজুং-ভাজুং দিয়ে বাড়ি দখল করবে, হাতের-পাতের যা-কিছু হাতিয়ে নেবে। আরও বুড়ো হলে আপনাকে গিয়ে উঠতে হবে বৃদ্ধাশ্রমে। বউ যেমনই হোক, ঝগড়াঝাঁটি করুক, মুখনাড়া দিক, কিন্তু তবু সে পুরুষকে ঠিক সামলে রাখে।

হুম।

কথাটা ঠিক বলেছি?

খুব বেঠিকও বলেননি। ব্যাচেলারদের ওরকম-ই হয়ে থাকে।

তাহলে?

একটু ভাবি।

ভাবুন কিন্তু বেশি নয়। ভাবতে সময় নিলে হাউসফুল হয়ে যাবে। নন্দনাই কি পড়ে থাকবে ভেবেছেন? আগেরটির বেলায় যা হয়েছিল, এর বেলায়ও তাই হবে।

আপনি বড্ড ভয় দেখান তো!

ভয় দেখাচ্ছি না, সৎ পরামর্শ দিচ্ছি। আজকের দিনটা ভাবুন। ভেবে কাল সকালেই নন্দনাকে জানিয়ে দিন যে, আপনি তাকেই বিয়ে করবেন।

কাল সকালেই?

কাল সকালেই। কিংবা আজ রাতেই। কিংবা এক্ষুনি গিয়ে চোখ বুজে বলে ফেলুন গে। যান।

আচ্ছা, তাহলে চলি মশাই।

হ্যাঁ হ্যাঁ, একটু পা চালিয়েই যান।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top