What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মশা, ভূত ও সুরবালা (ছোটগল্প) (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
325
Messages
5,984
Credits
45,425
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
গল্প (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » মশা, ভূত ও সুরবালা


আমার বাথরুমে একটি লোনলি মশা আছে। বুঝলেন মশাই, এরকম বুদ্ধিমান মশক আমি জীবনে আর দেখিনি। ধূর্ত, ফিজিক্যালি ফিট এবং ক্যারাটে বা কুংফুর ওস্তাদের মতো কূটকৌশলী। গত পনেরো দিনের চেষ্টায় আমি তাকে মারতে পারিনি। অথচ মশা মারায় আমার বেশ হাতযশ আছে।

ওই একটা ব্যাপারে অবশ্য আমি খুবই কাঁচা। কত চড়-চাপড় দিয়েও এ-যাবৎ যে-কয়টি মশা মারতে পেরেছি তা হাতে গোনা যায়। দু-হাতে তালি বাজিয়েই হয়তো মারলুম, মশাটা পড়লও তার মধ্যে, কিন্তু মরল না।

কেন মরল না মশাই? মরার-ই তো কথা।

.

কপাল, আমার হাতের তেলো তো ফাঁপা। ওই ফাঁপার মধ্যে পড়ে দিব্যি গা বাঁচিয়ে উড়ে চলে যায়। তবে আমার গিন্নি এ-ব্যাপারে খুবই নমস্যা মহিলা। মশার একেবারে যম। যেটাকে টার্গেট করবেন সেটারই কপাল পুড়ল।

আপনার স্ত্রীকে আমার নমস্কার জানাবেন। কৃতী মহিলাদের শ্রদ্ধা জানাতে আমি খুবই ভালোবাসি।

তা না-হয় জানালুম। কিন্তু মশাই আপনার বাথরুমে কি ওই একটিই মাত্র মশা?

আর মশা নেই? আজ্ঞে না। আমার সারাবাড়িতে একটিও মশা খুঁজে পাবেন না।

সে কী? এ কি ভূতুড়ে কান্ড নাকি মশাই? যতদূর শুনেছিলাম, আপনি একটা পুরোনো বাড়ি কিনেছেন। পুরোনো বাড়ির আনাচে-কানাচে তো প্রচুর মশা থাকার কথা!

বাড়ি নয় মশাই, বাড়ি নয়। আমি একাবোকো মানুষ, বাড়ি দিয়ে কী করব? একটা পুরোনো বাড়ির তিনতলায় একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। দুখানা শোয়ার ঘর, একখানা বেশ বড়োসড়ো খাওয়া আর বসার জায়গা। আমার তো বেশি জায়গা লাগে না। আসবাবপত্রও যৎসামান্য। বুড়ো বয়েসে কেউ হুড়ো না দেয়, সেইজন্যই কেনা। নইলে সম্পত্তি দিয়ে আমি কী করব বলুন?

আহা, বুড়ো বয়েসের চিন্তা এই কাঁচা বয়েসেই কেন? এখনও তো ওসব ভাববার বয়েস সামনে পড়ে আছে।

একটা আগাম প্ল্যানিং থাকা ভালো, বুঝলেন। ফ্ল্যাটটা কিনতে যে-লোনটা নিতে হয়েছে, সেটা শোধ করতে এখন বেশি গায়ে লাগছে না। কিন্তু বেশি বয়েসে লোন নিলে চাপে পড়ে যেতে হয়।

তা মশার কথাটা কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। তিনতলায় কি মশার উৎপাত কিছু কম?

তা হতে পারে। কিন্তু আমার ফ্ল্যাটে ওই একটিই মশা। তার কোনো সঙ্গী-সাথিও নেই। সারাদিন সে আমার জন্যই অপেক্ষা করে। আমি যেই বাথরুমে ঢুকি অমনি শুরু হয় তার খেল। ওপরে উঠে, নীচুতে নেমে, শূন্যে পাকদন্ডী তৈরি করে কত কায়দায় সে যে আমাকে অ্যাটাক করতে থাকে তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না আপনার। তাকে মারবার সবরকম চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। মশা মারবার ওষুধ স্প্রে করলে নিশ্চয়ই মরবে। তবে তার ধূর্তামি দেখে আমারও জেদ চেপেছে তাকে আমি হাত দিয়েই মারব।

আচ্ছা, আপনার মশাটা কি ব্যাচেলার বলে আপনার মনে হয়?

আসলে মশাদের তো বিয়ে হয় না, অনেক গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারে। সেই অর্থে সব মশাই ব্যাচেলার। যদিও ছেলেপুলে হতে বাধা নেই।

হ্যাঁ, সেটা অবশ্য ঠিক কথা। পশুপাখিরা তো লিভ টুগেদারই করে।

মশা কিন্তু পশুপাখির মধ্যে পড়ে না।

তাহলে?

মশা কীটপতঙ্গের গ্রুপে।

তাই তো! ঠিক কথাই তো! তাহলে মশাটা বেশ প্রবলেম ক্রিয়েট করছে বলুন।

তা বলতে পারেন। তবে আজকাল মাঝে-মধ্যে মনে হচ্ছে মশার সঙ্গে আমার যে-লড়াইটা চলছে সেটা অনেকটা খেলাধুলোর মতোই ব্যাপার। সময়টাও কাটছে ভালোই। আজকাল বাথরুমে মশাটার সঙ্গে ধ্বস্তাধস্তি করতে গিয়ে বেশ অনেকটা সময় কেটে যায়। বাথরুমটা বলতে নেই, বেশ বড়োই। পালিয়ে যাওয়ার অনেক জায়গা।

আহা, শুনেও ভালো লাগে। আমাদের মোটে একখানা, তা সেটাও এমন ছোটো যে মাজা ঘোরানোর জায়গা নেই। বাথরুম জিনিসটা পুরুষদের কাছে, বিশেষ করে চিন্তাশীল পুরুষদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আর্কিমিডিস তো ওই বাথরুমেই কী যেন একটা আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। তা ছাড়া অনেক দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ তাঁরা সব ওই বাথরুমেই চিন্তাটিন্তা করেন বলে শুনেছি। তাই ভাবি, একখানা ভালো বাথরুম থাকলে হয়তো আমার মাথাটাও ভালো খেলত। কিন্তু সে আর হওয়ার জো নেই। পাঁচটা মিনিট বাথরুম বন্ধ থাকলেই বাড়িতে হইচই পড়ে যায়। আপনার বাথরুম ক-টা?

দুটো।

আহা, কান জুড়িয়ে গেল। আপনি একা মানুষ, দু-দুটো বাথরুম। আর আমরা পাঁচজন, বাথরুম মোটে একখানা। বড়ো একটেরে একখানা বাথরুম পেলে আমি তো মশাই গলাও সেধে ফেলতুম। আমার বন্ধু বঙ্কা তো বাথরুমে গলা সেধেই নামকরা গায়ক হয়ে গেল। বাথরুম জিনিসটার গুরুত্ব যে কী সাংঘাতিক তা বলে বোঝানো যায় না।

তা বটে। বাথরুম সম্পর্কে আমিও কিছু ভালো ভালো কথা শুনেছি বটে। ভালো বাথরুম পেলে নাকি সুপ্ত প্রতিভা জেগে ওঠে।

অতি সত্য কথা। ছেলেবেলায় মশাই, আমার অঙ্কে বেশ মাথা ছিল। গানের গলা ছিল। দু-চার লাইন কবিতাও লিখে ফেলতুম। ওই বাথরুমের জন্যই বেগ চেপে চেপে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়ে গেল। আর তাইতেই প্রতিভাটাও গেল ঘোলাটে হয়ে।

খুবই দুঃখের কথা।

তার ওপর আবার মশাহীন বাথরুম! ভাবাই যায় না।

মশাহীন! না মশাহীন হতে যাবে কেন ওই যে বললুম একটা লোনলি মশা আছে।

আহা, মশাদের আর কতদিন আয়ু বলুন। ঠিক জানা নেই বটে, তবে মাসছয়েকের বেশি কী আর হবে? না হয় বছরখানেকই ধরে নিচ্ছি। ততদিনে তার ন্যাচারাল ডেথ হয়ে গেলেই তা আপনি নিষ্কণ্টক।

মুশকিল কী জানেন? কয়েকদিন আগে অবধি মশাটাকে আমি শত্রু বলে ভাবতাম বটে, কিন্তু হঠাৎ দিনকয়েক হল আমার মনে হচ্ছে, বজ্জাত হোক যাই হোক, মশাটা তো আমাকে সঙ্গও দিচ্ছে। এই যে আমি বাথরুমে গেলেই সে তার খেল শুরু করে, এতে আমার একাকিত্ব ভাবটা কেটেও তো যায় এবং বেশ একটা ফুর্তির ভাব আসে।

কথাটা কিন্তু মন্দ বলেননি। কুকুর, বেড়াল, পাখি পুষলেও কিন্তু ওরকমধারা হয়। মশা অবশ্য পোষ মানার পাত্র নয়।

পোষ মানলে মজাটাও থাকবে না।

আপনি বেশ বিজ্ঞ মানুষ। হবে-না? যার দু-দুটো বাথরুম তার বিজ্ঞ না হয়ে উপায় নেই কিনা। আচ্ছা মশাই, আপনার দ্বিতীয় বাথরুমটার কথা তো কিছুই বললেন না!

ওঃ! ওটা সম্পর্কে যত কম বলা যায়, ততই ভালো।

কেন মশাই, কেন? সেটা কি ব্যবহারযোগ্য নয়?

না, এমনিতে সেটা খুবই ভালো বাথরুম। বিশাল বড়ো। সেটাতে আবার শ্বেতপাথরের একটা পেল্লায় বাথটাব। আছে, বিরাট আয়না, রাজকীয় কমোড এবং বেশ দামি দামি সব ফিটিংস।

তা হলে সেটা ব্যবহার করেন না কেন?

একটু অসুবিধে আছে।

কী অসুবিধে মশাই?

আজ্ঞে, বললে হয়তো আপনি বিশ্বাস করবেন না।

কেন মশাই, বিশ্বাস করব না কেন?

ওই বাথরুমটা আর একজন ব্যবহার করেন।

ও, তা বিশ্বাস না করার কী আছেন বলুন? আর একজন তো ব্যবহার করতেই পারে।

তা, তো বটেই! কিন্তু আমার ফ্ল্যাটে আমি ছাড়া দৃশ্যত আর কেউ থাকে না।

অ্যাঁ। তা হলে এই আর একজনটা এল কোত্থেকে?

সেটাই তো আমারও প্রশ্ন। ফ্ল্যাটে আর কেউ থাকে না, অথচ ওই বাথরুমটা আর কেউ ব্যবহার করছে এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

বাইরে থেকে কেউ আসে না তো?

আজ্ঞে না।

তবে কি ভূতটুত কিছু?

আমি ভূতে বিশ্বাস করতাম না, এখনও করতে চাইছি না, তবে ব্যাপারটা ওরকমই।

একটু খুলে বলুন-না মশাই, শুনে শরীর রোমাঞ্চিত হচ্ছে যে!

বলার তেমন কিছু নেই। আমি ওই বাথরুমে গেলেই বাথরুমটা যেন খুশি হয় না।

আহা, বাথরুমের আবার খুশি-অখুশি কী?

আছে মশাই, আছে। বাথরুমটা আমাকে তার যোগ্য ব্যবহারকারী বলে মনেই করে না। প্রথম দিন গিয়ে কমোডে বসতে না বসতেহ, ফ্লাশটা আপনা থেকেই অন হয়ে হুড়মুড় করে জল নেমে এল সিস্টার্ন থেকে। শাওয়ার থেকে জল পড়তে লাগল অকারণে। বাথটাবের কলটা কে খুলে দিল। দরজাটা দুম করে খুলে গেল। আমি তো পালিয়ে বাঁচি না।

এ তো পরিষ্কার ভূতুড়ে কান্ড মশাই।

তা বলতে পারেন। অন্যের কাছে ব্যাপারটা ভূতুড়ে বলেই মনে হবে হয়তো। আমার ব্যাখ্যাটা অন্যরকম।

কীরকম মশাই?

কোনো নাক-উঁচু লোক ওটা ব্যবহার করত। খুব শৌখিন লোক। আর বাথরুমটাও সেইজন্য একটু উন্নাসিক। এলেবেলে লোক তাকে ব্যবহার করুক এটা সে চায় না। তাই আমি ঢুকলেই বাথরুমটা নানা কায়দায় তার প্রতিবাদ জানায়।

কিন্তু আপনি যে বললেন, ওটা আর কেউ ব্যবহার করে।

হ্যাঁ, তাও করে। নিশুত রাতে বাথরুম থেকে খুব সুরেলা শিস শুনতে পাই, কখনো গুনগুন করে গান। দামি ওডিকোলোনের গন্ধ আসে, শাওয়ার খুলে কেউ স্নান করে টের পাই।

আপনার ভয় করে না?

না। ভূতে বিশ্বাস করি না বলেই ভয়ও পাই না।

কিন্তু অকাট্য প্রমাণ পেয়েও ভূতে বিশ্বাস করেন না কেন?

বিশ্বাস জিনিসটাই যে ওরকম। বিরুদ্ধ প্রমাণ পেলেও বিশ্বাস শেকড় গেড়ে বসে থাকে, টলতে চায় না।

আশ্চর্য। ভূত সামনে এসে যদি দাঁড়ায় তখনও বিশ্বাস করবেন না?

আজ্ঞে না। পরিষ্কার বলে দেব, ফোটো হে বাপু, তোমাকে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

মশাই, এটা কিন্তু আপনার অন্যায়। ভূতকে পাত্তা না দেওয়াটা ঠিক নয়।

পাত্তা না দিলেও, ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগে না। শিসটা বেশ সুরেলা। গানের গলাও খারাপ নয়। আর সুগন্ধিগুলো খুবই চমৎকার।

আপনি বেশ সাহসী লোক।

না মশাই, আমার ধারণা ঠিক উলটো। বরং আমি বেশ ভীতু লোক। ও-বাড়িতে আর যারা আছে তারাও বলে, আমি নাকি খুব সাহসী লোক। কিন্তু আমি তো আমার মধ্যে সাহসের ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাই না।

ভূতুড়ে ফ্ল্যাটে থাকা কি সাহসের কাজ নয়?

আজ্ঞে, ভূতুড়ে ফ্ল্যাট বলছেন কেন? আপনাদের কথামতো যদি ভূত থেকেই থাকে, সে তো ফ্ল্যাটের আর কোথাও কোনো উৎপাত করে না। তার একমাত্র লক্ষ্য হল ফ্ল্যাটের ভালো বাথরুমটা। আমার কী মনে হয় জানেন?

কী মশাই?

মনে হয়, ভূত-টুত নয়, বাথরুমটাই একটু অ্যানিমেটেড হয়ে গেছে। বাথরুমটা উন্নাসিক হওয়াতেই এসব হচ্ছে। আমাকে পছন্দ করছে না। তাই আমি ওই বাথরুমটাকে অ্যাভয়েড করে চলি। ফলে কোনো ঝামেলা হয় না।

তা হলে আপনার একটা বাথরুমে একটা লোনলি মশা এবং অন্যটায় একটা শৌখিন ভূত। বেশ আছেন মশাই।

হ্যাঁ। আছি বেশ ভালোই। দিব্যি খোলামেলা ফ্ল্যাট, আলো-হাওয়া আছে।

তা কত বড়ো হবে ফ্ল্যাটখানা?

মন্দ নয়। ফ্ল্যাটের মালিক তো বিক্রির সময় বলেছিল ষোলোশো বর্গফুট। দলিলেও তাই লেখা আছে।

ষোলোশো? ও বাবা, সে তো পেল্লায় ব্যাপার! আমার কপালটা দেখুন, ধারেকর্জে তল হয়ে, গিন্নির তাড়নায় অতিকষ্টে মাত্র পাঁচশো পঁয়ত্রিশ বর্গফুটের একখানা ফ্ল্যাট কিনতে পেরেছি। তাইতেই গাদাগাদি করে থাকা। বেশি ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকার ড্ৰব্যাকটা কী জানেন? পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হয়ে যায়। প্রাইভেসি বলে বস্তুটাই থাকে না কিনা। এ-ঘর, ও-ঘর করতে গিয়ে গায়ে গা ঠেকে যায়। গুতোগুতি করে থাকা আর কী। আর সেইজন্যই তো যতক্ষণ পারি বাড়ির বাইরে কাটিয়ে যাই। আর আপনি রাজা-বাদশার মতো থাকেন। শুনতেও কত ভালো লাগে। কিন্তু একা মানুষ, অতবড়ো ফ্ল্যাটটা কেনার দরকারটা কী ছিল?

আজ্ঞে না, আপনাকে তো বলেইছি, অত জায়গা আমার লাগে না। তবে লোকটা ভারি সস্তায় দিল বলে নেওয়া। ফ্ল্যাটটায় বেশ হাত-পা খেলিয়ে থাকা যায় বটে।

তা কত পড়ল?

লাখ বিশেকের মধ্যেই হয়ে গেল।

বিশ লাখ। তা টাকাটা লোন করলেন বুঝি?

না, লোন নিতে হয়নি। কুড়িয়ে বাড়িয়ে হয়ে গেল।

তাহলে তো আপনি শাঁসালো লোক মশাই। গত দু-মাস ধরে আলাপ, কিন্তু আপনি যে, একজন পয়সাওয়ালা লোক তা টেরটিও পেতে দেননি তো।

টাকার কীই বা মূল্য আছে বলুন!

তা অবিশ্যি ঠিক। টাকা এখন পয়সার স্তরে নেমে গেছে। দশ পয়সা বিশ পয়সার কয়েনগুলো পর্যন্ত আজকাল কেউ নিতে চায় না। আমার কাছে গাদাগুচ্ছের পড়ে আছে। শুনছি এক টাকা দু-টাকার নোটও আর ছাপা হচ্ছে না। শুধু কয়েনগুলো চলছে। না মশাই, টাকার আর ইজ্জত রইল না। আচ্ছা মশাই, তাহলে এই উঠতি বয়সে সংসারী হচ্ছেন না কেন বলুন তো? একটা বিয়ে করে ফেলুন। মশা আর ভূত নিয়ে তো জীবন কাটানো যাবে না।

নিজের বিয়ের চেয়ে আমি পরের বিয়ে দিতেই বেশি ভালোবাসি।

সেটা কীরকম ব্যাপার মশাই?

খুব সোজা, বাংলার ঘরে ঘরে তো বিবাহযোগ্যা অরক্ষণীয়ার অভাব নেই। টাকা-পয়সার অভাবে সেইসব মেয়ের বাপ বিয়ে দিতেও পারছেন না। আমি সাধ্যমতো দু-চারটে বিয়েতে কিছু সাহায্য করতে পেরেছি। সেটাতেই আমার বেশি আনন্দ।

বাঃ মশাই, শুনে বড় খুশি হলাম। আপনার চরিত্রের এই মহৎ দিকটার কথা আমার জানা ছিল না। উঃ, কতদিন কোনো মহৎ মানুষের দেখা পাইনি। মানুষ যে এই কলিযুগেও মহৎ হতে পারে–এই ধারণাটাই করা কঠিন হয়ে পড়ছিল ক্রমশ। না মশাই, আজ আপনি আমার চোখ খুলে দিলেন।

আহা, অতটা বাড়িয়ে বলার কিছু নেই। আসলে যখনই কোনো মেয়ে বা মেয়ের বাপ আমাকে এসে বিয়ে করার জন্য ধরে তখনই আমি টাকা-পয়সা দিয়ে বিয়ের বন্দোবস্ত করে নিজের গর্দান বাঁচাই। মহত্ত্ব নয়, ওটা আমার আত্মরক্ষার কৌশল বলতে পারেন।

ও-কথায় ভুলছি না মশাই, আপনি নিজের মহত্ত্বকে আড়াল করতে চাইছেন। মহৎ লোকের লক্ষণই তো তাই। নিজের মহত্ত্ব স্বীকার করলে, আর তার মূল্য কী থাকে বলুন? আপনার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। বয়সে ছোটো না-হলে আমি আপনার পায়ের ধুলো নিতুম।

ছিঃ ছিঃ, কী যে বলেন! শুনলেও পাপ হয়।

না, মশাই, না, গুণীর গুণ-এর মর্যাদা দেওয়া তো বাঙালির ধাতে নেই। কিন্তু আমি সেরকম লোক নই। গুণী মানুষ দেখলে মাথা নোয়াতে জানি।

আপনি অতি উদারহৃদয় মানুষ।

না মশাই না। উদার আর হতে পারলাম কই? মাসকাবারে হাতে মোটে দশটি হাজার টাকা পাই। তাই দিয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হয়। ধারকর্জও হয়ে যায়। পাঁচটি হুমদো হুমদো প্রাণী, এসোজন, বোসোজন, অভদ্রতা, ভদ্রতা, ব্যাঙ্কের লোন শোধ দেওয়া, এল আই সি-র প্রিমিয়াম, ঠিকে ঝি-র মাইনে সব মিটিয়ে উদার হওয়ার সুযোগ কোথায় বলুন? নইলে আমারও কি ইচ্ছে করে না অরক্ষণীয়াদের বিয়ে দিই, বন্যাত্রাণে সাহায্য

করি, গরিবের চিকিৎসার খরচ জোগাই? করে, খুবই ইচ্ছে করে, কিন্তু উপায় কী বলুন!

অতি ঠিক কথা। মানুষের মধ্যে মহত্ত্ব আছেই, তবে সেটা

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটা ফোড়ার মতো টনটন করে, বদ্ধজীবের মতো ডানা ঝাঁপটায়, পাথরচাপা ঘাসের মতো। চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে থাকে। তাই-না?

আপনার উপমা-জ্ঞান অতি চমৎকার। হ্যাঁ, ওরকমই হয় বটে। তবে টাকা থাকলেই যে সবাই দানধ্যান করে তা কিন্তু নয়। এই আমার কথাই ধরুন। ভাবি বটে, অনেক টাকা থাকলে মেলা দানধ্যান করতুম, কিন্তু যদি কোনোদিন সত্যিই ছপ্পড় ফুড়ে টাকা আসে, তখন হয়তো মানসিক পরিবর্তন হয়ে যাবে। টাকা হলে নাকি টাকার নেশা বাড়ে। আরও টাকা, আরও টাকা করে মানুষ হেদিয়ে মরে।

আপনি বিজ্ঞ মানুষ। ঠিকই ধরেছেন। দানধ্যান করার জন্য টাকা ছারখারের চেয়েও মানসিকতার প্রয়োজন বেশি। তবে দানধ্যান বা লোকের সেবা সাহায্য করে বেড়ানোর নেশার বাড়াবাড়িও ভালো নয়। ওর মধ্যে আবার অহং প্রবল হয়ে দাঁড়ায়। দানধ্যানের অহংকার অর্জিত পুণ্যের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে। কখনো-কখনো সাধ্যমতো লোককে একটু আধটু সাহায্য করলেও হয়। টাকাপয়সার চেয়ে সহানুভূতি, সাহচর্য, পাশে দাঁড়ানো এসবেরও মূল্য আছে।

আপনার কাছে বসলেই কতকিছু শেখা যায়। আচ্ছা, আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, আপনি একটু অস্বস্তি এবং উদবেগের মধ্যে আছেন। কেমন যেন একটু আনমনাও। তাই না? ঠিক যেন প্রফুল্ল দেখছি-না আপনাকে?

ঠিকই ধরেছেন। সম্প্রতি আমি একটু অশান্তিতে আছি।

সে কী কথা! আপনার মতো মহৎ মানুষ যদি অশান্তিতে থাকেন তাহলে তো আমাদের-ই উদবেগের কথা। কী হয়েছে বলুন তো?

ঠিক বলবার মতো নয়।

খুব প্রাইভেট প্রবলেম কি?

হ্যাঁ, তাও বলতে পারেন। তবে আপনি সহানুভূতিশীল মানুষ। আপনাকে বলাই যায়। বিশেষ করে আমার যখন পরামর্শ দেওয়ার মতো বিচক্ষণ মানুষ কেউ তেমন নেই।

আহা, শুনে বড়ো প্রীত হলুম। আমার বউ তো আমাকে দিনরাত বোকা, হাঁদা, ভ্যাবাগঙ্গারাম, আহাম্মক বলে গঞ্জনা দেয়। শুনতে শুনতে আমিও কেন যে ক্যাবলা হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু একসময়ে আমারও কিছু বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল মশাই।

আছে। এখনও আছে। নিজেকে বোকা ভাবতে নেই। আমি তো আপনার কথাবার্তায় বিচক্ষণতার লক্ষণই দেখতে পাই।

ধন্যবাদ মশাই, অজস্র ধন্যবাদ। আপনি আমার হারানো আত্মবিশ্বাসটা ফিরিয়ে দিলেন। তা ব্যাপারটা কী?

আমি ব্যাচেলর বলে এবং রোজগারপাতি ভালো করি বলে, আমার কাছে কিছু মানুষ সাহায্যের আশায়। আসে।

তা তো বটেই, পাকা কাঁঠাল ভাঙলে মাছি তো আসবেই। তা রোজগারপাতি আপনার কেমন হয়?

ভালোই, আমি ইঞ্জিনিয়ার, এম বি এ। কনসালটেন্সি আছে। ফলে বুঝতেই পারছেন।

খুব পারছি, খুব পারছি, তারপর বলুন।

এই সম্প্রতি আমার গ্রাম-সম্পর্কে এক খুড়োমশাই এসে হাজির হয়েছেন।

গ্রামটা কোথায়?

নৈহাটির কাছে, গ্রাম নামেই। আসলে এখন পুরোদস্তুর শহর হয়ে গেছে। তা এই খুড়োমশাই এসে অবধি আমি কিছু অশান্তিতে আছি।

খুব টেঁটিয়া লোক নাকি?

না, না। অতি সজ্জন মানুষ, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, জীবনে একটাও মিথ্যে কথা বলেছেন কি না সন্দেহ। ত্রিসন্ধ্যা। আহ্নিক, জপতপ করেন। তা ছাড়া ভারি অমায়িক ব্যবহার।

বলেন কী? এমন মানুষকে নিয়ে তাহলে আপনার অশান্তি হচ্ছে কেন?

মানুষটা এরকম বলেই অশান্তি। তিনি কলকাতায় এসে আমার বাড়িতেই উঠেছেন। তারপরই আমার আচরণ দেখে অন্নজল ত্যাগ করার উপক্রম।

বলেন কী? কী করেছেন আপনি?

বামুন হয়েও পইতে রাখি না, আহ্নিক করি না, বাসি কাপড়ে চা খাই, সদাচারের অভাব। তিনি তেজস্বী মানুষ। এসব অনাচার দেখে ভারি রেগে গিয়ে চলেই যাচ্ছিলেন। আমি ক্ষমাটমা চাওয়ায় তিনি আমাকে গোবর জলটল দিয়ে শুদ্ধ করে গঙ্গাস্নান করিয়ে একদিন হবিষ্যি ভক্ষণ করিয়ে গলায় পইতে ঝুলিয়ে দিয়েছেন, নিয়মিত আহ্নিক করাচ্ছেন, বাসি কাপড় না ছেড়ে কোথাও কাজ করার উপায় নেই।

আহা, এসব করা তো ভালোই। প্রাচীনকাল থেকে ওসব চলে আসছে, ওর মধ্যে ভালো ব্যাপারও থাকতে পারে তো!

কিন্তু এসব করতে গিয়ে আমার মানসিক শান্তি খুবই বিঘ্নিত। ওঁর ব্রাহ্মণী অবশ্য রান্নাবান্না খুবই ভালো করেন। এতদিন আমিই যা হোক কিছু রান্না করে খাচ্ছিলাম। ওঁরা আসার পর আমার হেঁসেলে ঢোকা বারণ। আরও আশ্চর্যের কথা, খুড়ো আসার পর বাথরুমের বেয়াদবিও বন্ধ হয়েছে।

ওই দেখুন, ওকেই বলে ব্রহ্মতেজ। ভূতপ্রেত পালানোর পথ পায় না। বাঃ, এ তো বেশ ভালোই হয়েছে মশাই। পুজো-আচ্চা চালিয়ে যান, ভূত আর কাছে ঘেঁষবে না।

আহা, ভূতপ্রেত যাই হোক, ব্যাপারটা তো আমি উপভোগই করতাম। কিন্তু আরও একটা মুশকিল হয়েছে।

কী বলুন তো?

খুড়োর সঙ্গে খুড়িমা যেমন এসেছেন তেমনি তাঁদের একমাত্র মেয়ে সুরবালাও এসেছে কিনা।

বাঃ, বেশ নামটি তো। সুরবালা, এ-ধরনের পুরোনো নাম তো আজকাল রাখাই হয় না। তা তাতে মুশকিলটা কীসের?

সুরবালাই মূর্তিমতী মুশকিল।

কেন মশাই, কেন?

সুরবালার বয়স সতেরো-আঠেরো। খুবই চালাক, চতুর, একটু ফাজিল, আর….আর…..

আর? থাকগে সেসব কথা, আসল ব্যাপারটা হল, খুড়োমশাই এবং তাঁর পরিবার পেঁয়াজ-রসুন, বলির পাঁঠা ছাড়া অন্য মাংস, ডিম ইত্যাদি খান না। আমাকেও সেইসব নিয়ম মেনে চলতে হচ্ছে। আর একটু-আধটু যে

অনিয়ম করব তারও উপায় নেই। সুরবালা আমার ওপর রীতিমতো গোয়েন্দাগিরি করে যাচ্ছে। সেদিন ভাত খাওয়ার সময় বাঁ-হাতে জল খেয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে নালিশ। বাইরে থেকে হয়তো ওমলেট খেয়ে এসেছি। ঘরে ঢুকতেই সুরবালা ঘোষণা করল, উনি পেঁয়াজ খেয়ে এসেছেন। বুঝুন কান্ড।

হ্যাঁ, তা বটে, একটু-আধটু অসুবিধে তো হতেই পারে। পুরোনো অভ্যেস তো। তা ওঁরা থাকবেন ক-দিন?

আসলে ওঁরা এসেছেন সুরবালার জন্য একটি সচ্চরিত্র পাত্রের খোঁজ পেয়ে। পাত্রটি নাকি সংস্কৃতে এম এ, কোন কলেজের অধ্যাপক, ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, ত্রিসন্ধ্যা আহ্নিক করে, শাস্ত্রজ্ঞ এবং সদবংশজাত। বিয়ে প্রায় ঠিক হয়ে গেছে। দু-পক্ষের কথাবার্তাও মোটামুটি পাকা।

বাঃ, তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই যাচ্ছে।

না, যাচ্ছে না।

কেন মশাই? সুরবালার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলেই তো ওঁরা ফিরে যাবেন?

হ্যাঁ।

তাহলে?

সুরবালাকে আপনি দেখেননি।

তা তো বটেই।

দেখলেই বুঝতেন সমস্যাটা কোথায়?

দেখতে কদাকার নাকি?

না, বরং উলটো, সুরবালা ভীষণ সুন্দরী, আর…

আর?

তাকে দেখলেই আমার বুকটা ধক করে ওঠে।

এ তো ভালো লক্ষণ নয় মশাই!

না। আর বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সুরবালার দুটো চোখ সবসময়ে লাল আর ভেজা ভেজা। সেদিন আড়াল থেকে শুনলাম, খুড়িমা ওকে বকছেন, কাঁদছিস কেন মুখপুড়ি? এত ভালো পাত্র আর জুটবে? জবাবে সুরবালা বলছিল, তোমরা কী বুঝবে কেন কাঁদছি? ও বিয়ে ভেঙে দাও। মায়ে-মেয়েতে বেশ লেগে গেল।

তারপর?

ওইখানেই ঝুলে আছে। শুধু গতকাল যখন অফিসে বেরোচ্ছি, তখন সুরবালা দরজা দিতে এসে চাপা গলায় বলল, অনেক পাষাণ দেখেছি, আপনার মতো দেখিনি।

বলেন কী মশাই? এ তো সাংঘাতিক কথা!

হ্যাঁ। সেই থেকে বড়ো উচাটন হয়ে আছি। মনে শান্তি নেই।

আহা, এতে উচাটন হওয়ার কী আছে? আরে আপনি ভূতকে ভয় পান না, দানশীল লোক, মহৎ প্রাণ, আপনার ভয়টা কীসের?

ভয়ের ব্যাপার তো নয়। এ হল ব্যাখ্যার অতীত একটা সিচুয়েশন। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ব্যাপারটা।

কেন, আমি তো বেশ বুঝতে পারছি।

পারছেন?

বিলক্ষণ।

কী বুঝলেন?

সেটা হাঁটতে হাঁটতেই বলবখন। এখন উঠুন তো, উঠে পড়ন। খুড়োমশাই বাড়িতে আছেন তো?

আছেন, কিন্তু…

আর কিন্তু নয়, দেরি করলে কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে যাবে। খুড়োমশাইয়ের সঙ্গে আমার এক্ষুনি কথা বলা দরকার।

ইয়ে, তা নয় যাচ্ছি। কিন্তু….
 

Users who are viewing this thread

Back
Top