What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ঝড় (ছোটগল্প) (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
328
Messages
5,981
Credits
45,360
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
গল্প (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » ঝড়


একটা মেয়ে হাসি-হাসি মুখ করে একটা বিস্কুট খাচ্ছে–এই হল বিজ্ঞাপন। তা বদরী অনেকক্ষণ খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনটা দেখল। খবরের কাগজ তার নয়, পাশে বসা পুলিনবিহারীর। পুলিন খুব খবরের কাগজ পড়ে। কেন পড়ে কে জানে! বদরী বিজ্ঞাপনটা দেখে ভাবল, তাকেও ওই বিস্কুট খেতে বলা হচ্ছে। বিজ্ঞাপন তো তাই বলে।

এই মেয়েটা যখন বিস্কুটটা খাচ্ছে, তখন তোমারও বাপু খাওয়া উচিত। কিন্তু কেন খাবে, বদরী এটাই বুঝতে পারে না। কোলে রাখা গামছাটা তুলে সে কপালের ঘাম মুছল। গরমটাও পড়েছে বাপ। একবারে কাঁঠাল পাকানো গরম। যেমন ভ্যাপসা, তেমনি চনচনে। রোদ্দুরের মুখে আবডাল দেওয়ার মতো ছেঁড়া কাঁথাকানির মতো একটু মেঘও নেই। আকাশ একেবারে নিকোনো উঠোন। মাটিতে কোদাল মারলে এখন ঠন করে শব্দ হয়।

বিস্কুট খাওয়ার বিজ্ঞাপনটা চাপা পড়েছে। পুলিনবিহারী পাতা ওলটাল। এবার একটা টিভির বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। সেখানেও একটা মেয়েছেলে, টিভির ওপর হাতের ভর দিয়ে হেলে দাঁড়ানো, হাসি-হাসি মুখ। মেয়েছেলে ছাড়া দুনিয়ায় যেন কিছু হওয়ার জো নেই! বদরী একটা শ্বাস ফেলল।

পুলিনবিহারীর বয়স তেষট্টি, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, শক্ত গড়ন। গায়ে ঘেমো ময়লা একখানা পলিয়েস্টারের পাঞ্জাবি, আধময়লা ধুতি, চোখে চশমা। মাতব্বর লোক। একটা খবর একটু ঝুঁকেই পড়ছিল। জম্পেশ খবরই হবে। দুনিয়ায় খবরের অভাব কী? খবরের কাগজ হল কুচুটে মেয়েছেলের মতো, যত রাজ্যের গালগল্প ফেঁদে বসে মানুষের কাছে।

ট্রেন চলছে বটে, কিন্তু জানলা দিয়ে তেমন হাওয়া আসছে না। যা আসছে তা যেন কামারশালায় হাপরের ফু। জানলার ধারটা পাওয়া যায়নি। ওদিকে দুটো লোক। বাকি দুজন সে আর পুলিনবিহারী। তিনজনের সিটে চারজন। এটাই নিয়ম। ঠাসন্ত ভিড়। ওপরে পাখা-টাখা ছিল এককালে। কে খুলে নিয়ে গেছে।

বদরী আলালের ঘরের দুলাল নয়। গরমও সয়, শীতও সয়। তবে মাঠে-ঘাটে খোলামেলা থাকার একটা রকম আছে। এই যে খাঁচায় পোরা অবস্থা, এটা তার অভ্যেস নেই।

ট্রেনটা একটা আঘাটায় দাঁড়াল। তা এরকম দাঁড়ায়। পুলিনবিহারীর বাঁ-হাতে ঘড়ি। দেখে নিয়ে বলল, চারটেয় পৌঁছোতে পারলে ফেরার শেষ ট্রেনটা পেয়ে যাব।

ফিরতেই হবে। কচি মেয়েটাকে রেখে এসেছি।

আহা, অত উতলা হলে চলে? জলে তো আর ফেলে আসিসনি। পিসির কাছেই তো আছে। বিলাসী বুক দিয়ে আগলে রাখে।

না ফিরলে চিন্তা করবে। রাতে পিসির কাছে থাকতে চায় না। তার ওপর বিলাসীর যা গন্ধমাদন ঘুম। রাতে ভয় খেয়ে পিসিকে ডাকলেও উঠবে না।

ঘড়িটা আবার দেখে পুলিন বলল, আর চারটে স্টেশন। তারপরই নেমে পড়ব। মেরেকেটে তিন মাইল রাস্তা। মনে হচ্ছে হয়ে যাবে। ফেরার শেষ ট্রেন সাড়ে নটায়।

যারা দাঁড়িয়েছিল তাদের মধ্যে একজন বলল, নটা-কুড়ি, যাবেন কোথা?

মৌলবির বাজার।

অ। দূর আছে।

পুলিন পাঞ্জাবিটা তুলে ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে পেট চুলকোল। চশমাটা ঘামে পিছলে নাকের ডগায় নেমে এসেছে। সামনের দুটো দাঁত নেই। বলল, আর দেরি না করলেই হল।

এদিককার ট্রেন এরকমই চলে। দাঁড়ায়, জিরোয়, ঘুমিয়েও পড়ে। ট্রেন নড়ছে না।

বদরীর একটা আঁকুপাঁকু লাগে। গরম, ঘাম, ভিড় সব সহ্য হয়, কিন্তু দেরিটা ভোগাবে। তেমনি দেরি হলে–বদরী ঠিক করেই রেখেছে–দাঁইহাট স্টেশন থেকেই ফিরতি ট্রেন ধরবে। বিলাসী শ্বশুরবাড়ি থেকে মোটে আসতে চায় না। সেখানে বিরাট সংসার। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আনিয়েছে। কাল-ই তার রওনা হওয়ার কথা। তার মেয়ে নন্দরানির বয়স মোটে তিন। বিলাসীর তিনটে মেয়ে একটা ছেলে। দিনের বেলাটা নদু ওদের সঙ্গে বেশ থাকবে। তবে রাত হলে তার বাপকে চাই। মা-মরা মেয়ে, বাপের বড্ড নেই-আঁকড়া। বাপের দিক থেকে একটা একরকমের ভাবনা থাকে। আবার মেয়ের দিক থেকেও আর একরকমের ভাবনা আছে। এমন হতে পারে, মেয়ে বাপের কথা তেমন ভাবছে না। যেমনটা মেয়ে ভাবছে বলে মনে করছে, তেমনটা নয়।

পুলিনদা, কী হবে?

পুলিন একটা ময়লা রুমালে নাক মুছল। চশমাটা ফের নাকে বসিয়ে বলল, অত ভাবছিস কেন? খবরের কাগজটা ভাঁজ করে একটু হাওয়া খাওয়ার চেষ্টা করল পুলিন। পুলিনবিহারীর পিছুটান তেমন নেই। গাঁয়ের মাতব্বর হলে কী হয়, বাড়িতে বিরাট সংসারে তেমন পোঁছে না কেউ। ছেলেরা লায়েক হয়েছে, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে, পুলিনবিহারীও নানা কাজে বারমুখো। যেখানে সেখানে দেহখানা রাখলেই হয়। দু-চার দিন তার খোঁজও হবে না।

পুলিন বলল, কাজটা আসল, না ফেরাটা আসল?

ভারি তো কাজ! বলে বদরী মুখ ফিরিয়ে নিল।

কে একজন বিড়ি ধরিয়েছে, তার ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে এদিকে। এই দমবন্ধ অবস্থায় বিড়ির গন্ধ যেন, আরও গরম করে দিল কামরাখানা। চারদিকে অনড় ভিড়। তবে গোলমালটা কম। গরমে হাঁফিয়ে গিয়ে লোকের আর কথা বলার মতো দম নেই। শুধু শালা, সুমুন্ধির পুত, রেল কোম্পানির ইয়ে করেছে, গোছের কয়েকটা কথা কানে এল।

গাড়ি একটা স্তিমিত ভোঁ দিয়ে অবশেষে ছাড়ল। পুলিন ঘড়ি দেখে বলল, হয়ে যাবে।

কী হয়ে যাবে?

সময় থাকবে হাতে। ভাবিসনি।

আরও চারটে স্টেশন, তার মধ্যে কত কী হয়ে যেতে পারে!

পুলিন মুখটা কুঁচকে বাইরের দিকে চেয়ে রইল। আজ রোদটাও উঠেছে।

চারদিকটা যেন স্টিলের বাসনের দোকান হয়ে আছে।

পরের স্টেশনটা কাছেই ছিল। থামতেই কিছু লোক নামায় কামরাটা কিছু হালকা হল। জানলার দিকের দুটো লোক উঠল বটে, কিন্তু বদরী ওদিকে এগোল না। তেরছা হয়ে রোদ পড়ছে জানলা দিয়ে।

ঝালমুড়ি, শসা আর দাঁতের মাজনে ফিরিওয়ালারা হেদিয়ে পড়ে নেমে গেছে। একটা বাচ্চা চা-ওয়ালা উঠে হাঁক মারছিল।

পুলিন বলল, চা খাবি?

ও বাবা, এ গরমে চা!

বিষে বিষক্ষয়।

আমার দরকার নেই। তুমি খাও।

পুলিন চা নিল। চুমুক মেরে বলল, আগে অটোরিকশা সব যেত। রাস্তাটা দু-বছর আগে এমন ভাঙল যে, আর কিছুই যায় না।

দেশের অবস্থা যে ক্ৰমে খারাপ হচ্ছে এটা জানে বদরী। তবে তাতে তার বিশেষ আসেও না, যায়ও না। সে উদয়াস্ত খেতে পড়ে থাকে। শরীরখানা পাত করে, তবে অন্ন জোটে বরাবর। এ ব্যবস্থার ভালোও নেই, মন্দও নেই। চলে যায়। খরা, বন্যা হলেই যা বিপদ।

পরের স্টেশনে দুড়দাড় লোক নামতে লাগল দেখে, বদরী একটু অবাক হল। পুলিন বলল, আজ হরিপুরের হাট। চৈত্র-সংক্রান্তির মেলাও বসেছে ক-দিন হল। হরিপুরের জন্যই ভিড়, নইলে এ ট্রেন ফাঁকা যায়।

বড্ডই ফাঁকা হয়ে গেল। গরমটাও যেন খানিক উড়ে গেল খোলা বাতাসে। পুলিন চায়ের ভাঁড়টা এতক্ষণ ফেলেনি, হাতে ধরেছিল। এবার সেটা জানলার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, তোর কপালটা ভালো, বুঝলি! বিয়েটা যদি লেগে যায়, দেখবি কপাল খুলে যাবে।

ভালোর তো লক্ষণ দেখছি না। যাত্রাটাই খারাপ হল। ট্রেন যা লেট মারছে স্টেশন থেকেই না ফিরতে হয়। কথাটা গ্রাহ্য করল না পুলিন। বলল, স্বয়ং কাত্যায়নীর সংসার, বুঝলি তো? এক ছটাক বাড়িয়ে বলা নয়। এ-তল্লাটের সবাই জানে। অজাপুর থেকে বউ এল, তেরো বছর সবে বয়স। একেবারে লক্ষ্মীপ্রতিমা। গাঁয়ে ঢুকতেই দু-বছরের খরা কেটে বৃষ্টি নামল। গাছে গাছে ফলন। বউ যেখান দিয়ে যায় যেন লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ পড়ে। ভাসুরকে ভাত দিতে গিয়ে বিপত্তি, ঘোমটা পড়ে গেল। দু-হাত জোড়া। কী করে? সবাই দেখতে পেল, বউ আর এক জোড়া হাত বের করে ঘোমটাটা তুলে দিল মাথায়।

ও গপ্পো আগে শুনেছি।

বলেছি নাকি তোকে?

তুমি বলোনি। অন্য এক বউ সম্পর্কে এরকম আর একজন কেউ বলেছিল।

ও যে এই বউয়ের-ই গল্প। পাঁচমুখে ছড়িয়েছে। এ তল্লাটে সবাই জানে।

তা নয় হল, কিন্তু সে তো পুরোনো কাসুন্দি। তোমার খুড়োর মেয়ে তো আর সে নয়।

ওরে ওনারা যে-পরিবারে আসেন, সেই পরিবারটাই জাতে উঠে যায় কিনা। ওর একটা ধারা থাকে।

কতকাল আগেকার কথা সব। ওর ধারা আর নেই গো পুলিনদা।

তা এক-দেড়শো বছর হবে। এমন কিছু বেশিদিনের কথা নয়। ধরো আমার বাবার বয়েস।

ধরলাম। কিন্তু তাতেও সুবিধে হচ্ছে না। যদি সেই ধারাই হবে, তাহলে আমাকে পাত্তর ঠাওরাচ্ছ কেন?

পুলিন গোঁফের ফাঁকে একটু হাসল, কেন তুই কি খারাপ পাত্তর? পনেরো বিঘে জমি, দু-বিঘে মাছের পুকুর, বাড়িতে অতগুলো ফলন্ত গাছের বাগান।

পাত্তরের আর কিছু লাগে-না বুঝি?

আর কী লাগে?

কেন, চরিত্তির, পেটে বিদ্যে, বংশগৌরব।

তোর কী চরিত্তির খারাপ? বিদ্যেও ধরা, বাংলাটা জানিস, ইংরিজিতে নাম-সই কম নাকি? হারাধন বিশ্বাসের নাতি–বংশই কি ফেলনা?

স্টেশনগুলো পটাপট পেরিয়ে এল তারা।

পুলিন একটু হুটোপাটা করে উঠল, ওরে নাম নাম। সামনের স্টেশনটাই। গাড়ি বিইয়ে এল।

নেমে পড়ল তারা। পুলিন ঘড়ি দেখে একগাল হেসে বলল, দেরি করেনি রে। চারটে বেজে পাঁচ মিনিট। হেসেখেলে সাড়ে-নটার গাড়ি পাব।

তোমার তিন মাইল যদি চার বা পাঁচে দাঁড়ায় তাহলে অন্য কথা।

ওরে না না। অত নয়।

উদোম মাঠের ভেতর দিয়ে পথ। পাকা না হলেও রাস্তাটা পাথরকুচির ছিল বটে। তবে বহুকাল সারানো হয়নি। ভেঙে-টেঙে একশা।

পুলিন বলল, এইবার রাস্তাটা স্যাংশন হয়েছে। সারানো হবে। সামনের বছর যখন জামাইষষ্ঠীতে আসবি, তখন পাকা রাস্তা দিয়ে অটোয় চেপে হাসতে হাসতে গোঁফে তা দিতে দিতে আসবি। বুঝলি?

গাছে এখন কাঁঠালের ফুলটিও আসেনি গো, গোঁফে তা দিয়ে হবে কী? দ্বিতীয়বার ছাদনাতলায় বসার ইচ্ছে নেই গো মোটে। তুমি ধরে নিয়ে এলে বলে আসা। নদুকে আমি সৎমায়ের হাতে দেব ভেবেছ নাকি?

আচ্ছা আচ্ছা, আগে দেখ তো। কাকা বলে ভাবিসনি যে বুড়ো। বাবার পিসির ছেলে। বয়েস আমার চেয়েও পাঁচ বছর কম। তারই দ্বিতীয়পক্ষের কনিষ্ঠা। পনেরো-ষোলোর বেশি হবে না।

সবই জানে বদরী। পুলিন একবার নয়, বহুবার বলেছে। বলে বলে কান ঝালাপালা করে দিয়েছে। তাই বাঁচার জন্য আসা। একবার দেখে নাকচ করে দিলেই হবে। বিয়ে করতে বড়ো বয়েই গেছে বদরীর। মেয়েটার জন্য গাঁয়ের শোভাখুড়ির সঙ্গে বন্দোবস্ত হয়ে আছে। বদরী যখন মাঠে যায়, খুড়ি এসে দেখে। বছর পাঁচেক বয়স হলে তখন আর খবরদারির তেমন দরকারও হবে না। পাঁচটা গাঁয়ের মেয়ের সঙ্গে খেলবে-ধুলবে, বড়ো হয়ে যাবে। বদরীর তখন ঝাড়া হাত-পা। বিয়ে আর নয়। ত্রিশ-বত্রিশ বয়স হল তার। আর দরকার কী বিয়ের?

পুলিনবিহারী আগডুম বাগড়ম, বলতে বলতে পথ হাঁটছে আগে আগে। পেছনে বদরী।

ঘরটাও পাওয়া গেছে পালটি। একেবারে যেন তোর জন্য পাঠিয়েছেন ভগবান।

বদরী জবাব দিচ্ছে না। হাঁ করলেই গলা বুক শুকিয়ে যাচ্ছে, এমন গরম।

প্রথম গাঁ গোবিন্দপুর, দ্বিতীয় সোনাডাঙা, তিন নম্বর মৌলবির বাজার। আন্দাজ আছে বদরীর। তিন মাইলই হবে।

মৌলবির বাজার যেন মরুভূমির মধ্যে একখানা দ্বীপ বড় গাছপালা চারদিকে। ধূলিধূসর ভাবটা নেই।

কেন জানিস তো? সাতাশখানা পুকুর আছে, একখানা দিঘি। তার ওপর ইরিগেশনের খাল। এ-গাঁ একেবারে লক্ষ্মীমন্ত। হবে-না? স্বয়ং কাত্যায়নী লীলা করে গেছেন।

বদরীর একটু ভয় ভয় করছে। কেন কে জানে!

ঘাবড়াচ্ছিস নাকি?

না, ঘাবড়াব কেন?

মৌলবির বাজার যে লক্ষ্মীমন্ত গাঁ এটা মনে মনে স্বীকার করতে হল বদরীনাথকে। গাছপালা আছে। পাড়ায় পাড়ায় পুকুর। গাঁও বিশাল। মেলা লোকের বাস। রোজ বাজার বসে। হপ্তায় দু-দিন হাট।

পুলিনবিহারী দূর থেকে দেখাল, ওই যে শিবমন্দির দেখছিস, ওর পিছনেই বাড়ি।

বাড়িখানা পুরোনো হলেও ভালোই। পাকা দেয়াল, মেঝে, ওপরে টিনের চাল। মস্ত উঠোন, তিনটে ধানের গোলা, সবজি বাগান, নারকেল আর সুপুরির গাছ আছে।

পুলিনবিহারী হাঁক মারল, কই রে, কোথায় গেলি সব?

হাঁক-ডাকের দরকার ছিল না। দাওয়াতেই একধারে দুজন লোক বসে গ্যাঁজালি করছিল। রোগা কালোপানা একজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ও বাবা, ভাইপো যে!

এই কাকা, বুঝলি? এর-ই মেয়ে।

কাকার কপালে রসকলি, গলায় কন্ঠি, গায়ে গেঞ্জি, পরনে ধুতি। মুখখানায় ধূর্তামি আছে। বদরী ভালো করে দেখে নিল।

পুলিন বারান্দায় উঠে বলল, হাতে মোটেই সময় নেই। রাত সাড়ে নটায় ফিরতি ট্রেন। বুঝেছ তো?

সম্পর্কে খুড়ো হলেও বয়েসে কম। ফলে সম্পর্কটা ঘোরালো। খুড়ো কদম দাস বলল, আজই ফেরত যাবে কেন? চোত সংক্রান্তিতে মেলা বসিয়েছি এবার, দুটো দিন থেকে যাও।

ঘন ঘন মাথা নেড়ে পুলিনবিহারী বলল, না না, এই বদরীর জন্যই আসা। তা তার থাকার উপায় নেই কিনা।

বলেই গা থেকে জামা খুলে ফেলল পুলিনবিহারী। তার সারাগায়ে দগদগ করছে ঘামাচি। বলল, হাতপাখা দাও তো একটা। আর ডাব।

কদম দাস তাড়াতাড়ি ভেতর বাগে গেল। যে-লোকটা বসে এতক্ষণ কদমের সঙ্গে কথা বলছিল, সে এবার উঠে কাছে এসে বলল, এদিকটায় রোদ। ওদিকটায় ছায়া আছে।

বদরী এ-লোকটাকেও ভালো করে দেখল। বয়েস অল্পই। ছোঁকরা গোছের। ভারি বিনয়ী, নরমসরম ভাব।

পুলিন বলে উঠল, এক্রাম নাকি রে?

আজ্ঞে।

তোর মোকদ্দমার কী হল?

চলছে।

মোকদ্দমার কথায় পুলিনের আলাদা উৎসাহ আছে। মামলা-মোকদ্দমার ব্যাপারটা সে খুব পছন্দ করে। পাঞ্জাবিটা কাঁধে ফেলে বলল, ফাঁকে চল তো, শুনি ভালো করে।

বদরী দেখল, কথা কইতে কইতে তারা ফটক অবধি গিয়ে দাঁড়াল। কথা আর শেষ হয় না। মামলা মোকদ্দমার কথা শেষ হওয়ারও নয়।

কদম দাস সঙ্গে একটা রাখাল গোছের ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে এল। রাখাল ছেলের দু-হাতে কাটা ডাব।

জলটুকু খেয়ে নাও ভাই। তারপর অন্য ব্যবস্থা হচ্ছে।

ডাবটা হাতে নিয়ে বদরী বলল, এক ঘটি জলও দেবেন। বড্ড তেষ্টা।

হ্যাঁ হ্যাঁ। ওরে পুটু, শিগগির গিয়ে কুয়ো থেকে জল তুলে নিয়ে আয়।

রাখাল ছেলেটা দৌড়োল।

ও ভাইপো, ডাব খাবে না?

পুলিনবিহারী হাতটা তুলে বরাভয় দেখাল। কথা থামল না।

ডাবটা শেষ করে বদরী ঢকঢক করে ঘটির জলটাও মেরে দিল। ভেতরটা একবারে ঝামা হয়েছিল এতক্ষণ।

রাখাল ছেলেটা দুটো লোহার চেয়ার এনে বারান্দায় পেতে দিয়ে বলল, উঠে বসুন। দাওয়ার দড়িতে একটা মোটা চাদর ঝুলিয়ে ছায়ার ব্যবস্থাও হল। হাতপাখা চলে এল।

কিন্তু মুশকিল হল, পুলিনবিহারীকে নিয়ে। তার কথা আর শেষ হচ্ছে না। এক্রামকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আরও তফাত হল। তারপর চোখের আড়াল।

কদম দাস বোধহয় ভেতর-বাড়িতে খবর করতে গিয়েছিল। হঠাৎ বদরী দেখতে পেল, ঘরের দরজায় কিছু মেয়েমানুষের ভিড় আর ঠেলাঠেলি। দু-চারটে কচিকাঁচাও আছে। বদরী আজ দাড়ি কামিয়ে গোঁফ হেঁটে এসেছে। গায়ে একখানা সবুজ পাঞ্জাবি, পরনে তাঁতের ধুতি। ঘামে একটু দুমড়ে দুমড়ে গেলেও, পোশাক খারাপ নয়। বদরী পেছনদিকে আর তাকাল না। হাতপাখায় বাতাস খেতে খেতে বে-আক্কেলে পুলিনবিহারীর চোদ্দো পুরুষ উদ্ধার করছিল মনে মনে। বিপদের মুখে ফেলে কোথায় যে। হাওয়া দিল। কান্ডজ্ঞান বলে যদি কিছু থাকে। বদরীকে একটা লজ্জার অবস্থায় ফেলে এরকম চলে যাওয়াটা কী ভালো হল?

রাখাল ছেলেটা একখানা আগাম টুল মুখোমুখি পেতে দিয়ে চলে গেল। তাতে এসে বসলেন একজন রোগামতো বুড়োমানুষ। তার সাদা গোঁফ, গায়ে গেঞ্জি। গায়ের রং তামাটে। গলায় একটু চাপা কফের শব্দ হচ্ছে। মুখে একটু আপ্যায়নের হাসি।

বাবাজীবনের কথা খুব শুনেছি বিপিনের কাছে।

এসব কথার জবাবে কী বলতে হয়, তা বদরী জানে না। তার একবারই বিয়ে হয়েছিল। তাতে মেয়ে দেখার ঝামেলা ছিল না। মেয়ে দেখে রেখেছিল জেঠিমা। দিন ঠিক হলে সেইদিন খেত থেকে একটু সকাল সকাল ফিরে বরযাত্রীদের সঙ্গে রওনা হয়ে পড়েছিল। পাশের গাঁয়ের মেয়ে। ট্যাং ট্যাং বাজনা বাজিয়ে বিয়ে হয়ে। গিয়েছিল। ঝুটঝামেলা ছিল না। টানা পাঁচ বছর সংসার। এই বছর দেড়েক আগে বাসন্তীর কী যে রোগ হল ধরাই গেল না। পেটে ব্যথা বলে যখন তখন অজ্ঞান হয়ে যেত। ডাক্তার দেখে ওষুধও দিত। তারপর বাড়াবাড়ি হওয়ায় শহরের হাসপাতালে নিয়ে গেল। তখন শেষ অবস্থা। ডাক্তার বলল, দেরি করে ফেলেছেন। অ্যাপেণ্ডিক্স বাস্ট করে গেছে। নইলে আজ এই ঘেমো দুপুরে এই রোদ ঠেঙিয়ে আসতে হত না।

বুড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এ-বংশের মেয়ে যে-সংসারে যায় সে-সংসারে সুখ একেবারে খুলে পড়ে, বুঝলে? স্বয়ং কাত্যায়নী এ-সংসারে এসেছিলেন তো। আমার প্রপিতামহের আমলে। বুঝলে? খুব রোখাচোখা পুরুষ ছিলেন, আবার দেবদ্বিজে ভক্তি ছিল খুব। তা আমার প্রপিতামহী এলেন, নামেও কাত্যায়নী, কাজেও কাত্যায়নী…

আজ্ঞে, সে-গল্প শুনেছি।

সবাই জানে কিনা। এ-বংশের খুব নাম। তা তোমার ক-টি ছেলেপুলে?

একটিই মেয়ে, তিন বছর বয়স।

ভালো হাতে পড়বে। সম্মা বলে ভাবতেও পারবে না কখনো।

খুব ঘামছে বদরী। আরও জনাকয় এসে আশপাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে একজন বেশ জাঁদরেল চেহারার মহিলা। লজ্জায় সংকোচে তাকাতে পারছিল না বদরী। এদিকে ভিড় হওয়াতে বাইরের হাওয়া আসতে পারছে না। গরম হচ্ছে।

জাঁদরেল মহিলাই হঠাৎ বললেন, ওরে খুবলো, বাতাস কর-না। কত দূর থেকে এসেছে। গরম হচ্ছে।

খুবলো একটা বছর পনেরো-ষোলোর ছেলে। পাখাটা নিয়ে টেনে বাতাস করতে লাগল। উৎসাহের চোটে দু-একবার ফটাস ফটাস করে পাখার চাঁটিও লাগিয়ে ফেলল মাথায়। মাথাটা একটু নামিয়ে নিল বদরী। এরা যে কার কে হয়, তা বুঝতে পারছে না সে। বোঝার অবশ্য বিশেষ দরকারও নেই। তার এখন লক্ষ্য হল রাত ন-টা কুড়ির শেষ ট্রেনটা ধরা। মেয়েটা বাপ ছাড়া থাকতে পারবে কি?

জরদগব অবস্থা। মেয়ে দেখতে এসেছে সে, উলটে তাকেই হাঁ করে দেখছে সবাই। মাথাই তুলতে পারছে না বদরীনাথ।

জাঁদরেল মহিলার হাতখানা দেখতে পাচ্ছিল বদরী। হাতে শাঁখা আছে, নোয়া আছে। সধবা। কার বউ কে জানে?

কদম দাস ব্যস্ত পায়ে এসে জাঁদরেল মহিলাকে বলল, তোমাদের হল? এরা সব রাতের ট্রেনে ফিরবে যে!

জাঁদরেল বলল, আহা, ফিরবে তো কী? দেরি আছে।

ছ-টা বেজে গেছে কিন্তু।

বদরীর হাতে ঘড়ি নেই। ছ-টা শুনে তার একটু চিন্তা হল। তিন মাইল রাস্তা অন্ধকারে হাঁটতে হবে। গাড়িটা পেলে হয়। পুলিনবিহারীর ভাবগতিক ভালো ঠেকছে না তার। পুলিনের ফেরার ঠেকা নেই, তার আছে।

ভিড়ের ভেতর থেকে আর একটা শাঁখা-পরা কালো আর রোগা হাত এগিয়ে এল। হাতে একখানা কাঁসার রেকাব। তাতে মিষ্টি। সঙ্গে এক গ্লাস জল।

খাও বাবা।

খিদে আছে। রেকাবটা হাত বাড়িয়ে নিলও বদরী। কিন্তু এত জনার চোখের সামনে খায়-ই বা কী করে? এ তো বড়ো অসুবিধের মধ্যেই পড়া গেল।

সে বলল, পুলিনদা আসুক।

কদম ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে, তাই তো! ভাইপোকে তো দেখছি না। গেল কোথা? ওরে ও পুটু, একটু রাস্তায় গিয়ে দেখ তো বাবা। বড়ো বে-আক্কেলে লোক। ডেকে আন।

ছোঁড়াটা দৌড়ে গেল।

বদরী বসে রইল চুপ করে। হাতপাখা চলছে, তবু ঘামছে। গামছাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু এদের সামনে সেটা বের করা যাচ্ছে না। লজ্জা হচ্ছে।

পুলিন বেশিদূর যায়নি। এসে গেল। আগর ঠেলে ঢুকতে ঢুকতেই বলল, ওরে বাবা, উকিলের ওপর ছেড়ে দিলে, কী আর মামলা জেতা যায়? তদবির হল আসল কথা। উকিলের কী? দক্ষিণাটি নিয়ে কথা কয়ে ছেড়ে দেবে। পয়েন্ট দিতে হবে না?

ভিড় ঠেলে গন্ধমাদনের মতো বারান্দায় উঠে পুলিন বলল, এ, এ যে বাঁদর নাচের ভিড় লাগিয়েছিস তোরা। সর-সর, বাতাস আসতে দে।

তাকেও একটা রেকাব ধরানো হল। পুলিন খেতে খেতে বলল, এক্রামকে জোরালো কয়েকটা পয়েন্ট ধরিয়ে দিয়েছি। খুব খুশি।

খাওয়া-দাওয়া মিটতেই কদম বলল, এবার যে একটু ঘুরে আসতে হচ্ছে। একটু গরম হবে ঘরে। কিন্তু বারান্দায় তো আর পাত্রী দেখানো যায় না।

পুলিন বলল, আহা, বাইরেই কী গরম কম নাকি? আয় রে বদরী। অত ভাবিস না, সাড়ে নটার ট্রেন ধরতে পারবি।

ঘরখানা একটু ঝুঝকো আঁধার। জানলা-দরজা বিশেষ বড়ো নয়। তা ছাড়া জানলার বাইরেই বড়ো বড়ো গাছ। একধারে বড়োচৌকি বেডকভার দিয়ে ঢাকা। চৌকির পায়ের ধারে বেঞ্চিতে মেলা ট্রাঙ্ক বাক্স থাক দিয়ে সাজানো।

একধারে একখানা কাঠের চেয়ার। অন্য ধারে কিছু ছিল না। রাখালছেলে পুটু বারান্দার চেয়ার দুটো তুলে এনে পাতল। ঘরে বেশ ভিড় জমে গেছে চারধারে। বসতেই খুবলো ফের পাখা চালাতে লাগল পেছন থেকে। পুলিন বলল, জোরে চালা বাবা। ঘেমে নেয়ে যাচ্ছি। কই গো, আনো মেয়েকে। ওরে বাবা, গেরস্ত ঘরেই তো যাবে। বেশি সাজানো-গোছানোর দরকার নেই।

অন্দরমহলের দরজায় একটু ঠেলাঠেলি পড়ে গেল। মেয়ে আসছে। একটু কেমন ভয় ভয় করছিল বদরীর। মেয়ের চারখানা হাত বেরোবে না তো!

ভিড় ঠেলে যাকে আনা হচ্ছিল, তার দিকে বদরী চাইতেই পারল না। দেয়ালে একখানা পাখির বাঁধানো ছবি দেখছিল। হলুদ রঙের পাখি। কী পাখি কে জানে বাবা! সুতোর কাজ।

ওরে দেখ, দেখ। দেখে নে। অন্যদিকে চেয়ে আছিস যে?

বদরী মাথাটা প্রথমে নুইয়ে তারপর তুলল। সব মুখই কালো লেপাপোঁছা দেখাচ্ছিল। বাইরে এতক্ষণ বসেছিল বলে, চোখটাও ধাঁধানো। ঘরটাও অন্ধকার।

তবু তারমধ্যেই একজোড়া চোখে তার চোখ আটকাল। একজোড়া? নাকি তিনটে? মেয়ের কি তিনটে চোখ? যা-সব গল্প শুনেছে পুলিনের কাছে, হওয়া বিচিত্র কী?

তবে না। কপালে একটা লম্বাটে বড়োটিপ পরেছে বলে ওইরকম। মুখচোখের তেমন হদিশ পেল না। পেয়ে। হবেটাই বা কী? ফেরার পথে পুলিনকে শুধু একটা কথাই বলতে হবে, পছন্দ হয়নি।

হঠাৎ ঝাঁ করে, এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া কোথা থেকে যে এল কে বলবে? বদরীর মনটাই আজ নানা আলৌকিকের বাসা হয়ে আছে। সে একটু চমকে উঠল। এ কী রে বাবা, ঠাণ্ডা হাওয়া মারে কেন?

কে একজন হেঁড়ে গলায় বলে উঠল, ঝড় আসছে।

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই একটা সিংহগর্জনের মতো মেঘ ডেকে উঠল। সেরেছে। এতক্ষণ লক্ষ করেনি বদরী। লক্ষ করবেই বা কীভাবে। যা ঘিরে ছিল সবাই মিলে।

পুলিনবিহারী পান চিবুচ্ছে। কোত্থেকে পেল কে জানে? তার খুড়োর বাড়ি পেতেই পারে। বলল, আসুক বাবা, আসতে দে। ঘামাচিগুলো মরে তাহলে।

দু-চারজন ছিটকে বেরিয়ে গেল। ঝড় এলে গেরস্তবাড়িতে কিছু সারা-তাড়া থাকে।

জাঁদরেল মহিলা বলল, ও কাতু, অমন মাথা নুইয়ে আছিস যে? মুখটা তোল। ভালো করে দেখুক। নইলে পছন্দ হবে কী করে?

নাঃ, মিঠে হাওয়াটা বন্ধ হল না। বরং বাড়ল। চোতের কালবোশেখি কত তাড়াতাড়ি আসে, তা বদরী আর পাঁচজন চাষির মতোই জানে। দম ফেলার সময়টুকু দেয় না। কড়াৎ কড়াৎ করে দুটো বাজ পড়ল, আর মুঠো মুঠো ধুলো উড়ে এল বাতাসে। ঝপঝপ জানলা-দরজা বন্ধ করছিল সবাই। একটা হুড়োহুড়ি।

পুলিন বলল, ওরে আসতে দে, আসতে দে। এ যে, সূচিভেদ্য করে ফেললি বাপ!

বাস্তবিকই, দরজা-জানলা বন্ধ হওয়ার পর, ঘরখানা জম্পেশ অন্ধকার হয়ে গেল হঠাৎ। বাইরে তুমুল গর্জন করে একটা বড়ো হাওয়ার ঝটকা, টিনের চালে মটমট শব্দ করে গেল। দু-নম্বর ঝটকায় দরজাটা উঠল মড়মড় করে। তারপর একেবারে হুহুংকারে কেঁপে উঠল চারদিক। বাইরে চেঁচামেচি, দৌড়োদৌড়ি, ঠাস ঠাস কপাট-জানলার শব্দ।

ঝড়ের গর্জনে ঘরের ভেতরকার কথাবার্তাও চাপা পড়ে গেল। কানে তালা ধরিয়ে বাজ পড়ল কোথাও। খুব কাছেই।

বদরীর অবশ্য ভয় নেই। প্রতিবারই খোলা মাঠে এই ঝড়ের সঙ্গে তার দু-চারবার দেখা হয়। ঘরে বসে সে শুধু শব্দটা শুনে তান্ডবটা কীরকম তা আন্দাজ করছিল। বেশি বাড়াবাড়ি হলে ট্রেনটা পিছলে যাবে।

আচমকাই ফের মনের ভুল? নাকি চোখের বিভ্রম! পরিষ্কার দেখল সে, একটা নয়, দুটো নয়, তিন তিনটে চোখ অন্ধকারে তিনটে পিদিমের শিখার মতো জ্বলছে। স্থির।

নাঃ, আজ তার মাথাটাই গেছে। কোথায় কী? ঘর যেমন কে তেমন অন্ধকার। তার মধ্যেই পুলিন টর্চ জ্বালাল। পাত্রীর চেয়ার ফাঁকা। উঠে গেছে কোন ফাঁকে। ঘরের ভিড়ও পাতলা হয়ে গেছে। সেই বুড়ো, জাঁদরেল মহিলা আর কদম দাস দাঁড়িয়ে।

পুলিন বলল, এ তো মুশকিল হল রে! যাবি কী করে?

পাঁচ-দশ মিনিটের বেশি তো আয়ু নয়। থেমে যাবে। বদরী বলল।

সে যাবে। কিন্তু রাস্তাটার কী অবস্থা হবে জানিস?

একটু হাসল বদরী। সে হেলে চাষা, জলকাদা ভেঙে চাষ। এসব বাবু-ঘেঁষা কথা শুনলে মায়া হয়।

ঝড়ের তাড়স বাড়ল। বৃষ্টিটা এখনও শুরু হয়নি।

কদম দাস বলল, আমের বউলগুলো সব গেল।

পুলিন বলল, যায় যাক, তবু ঠাণ্ডা হোক। চাষবাস লাটে উঠতে বসেছিল।

তা বটে।

চালের টিন ধরে টানাটানি করছে ঝড় বাবাজীবন। ওপড়ায় আর কি!

কদম দাস উধ্বমুখে চেয়েছিল। চালের নীচে কাঠের পাটাতন। পাটাতনে রাজ্যের জিনিস।

এ-ঘরের না হলেও অন্য কোনো ঘরের টিন মড়াৎ করে উলটে গেল বটে। বিকট শব্দে সেটা আছড়ে পড়ল কোথাও। দুটো গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ হল পর পর।

সুপুরি আর জামগাছটা গেল। কদম দাস মুখ শুকনো করে বলল।

পুলিন টর্চটা নিবিয়ে বলল, অ বদরী।

বদরী বলল, ঘড়িটা দ্যাখো পুলিনদা।

ছ-টা বত্রিশ। টাইম দেখে হবেটা কী? ঝড় না থামলে তো নড়ার উপায় নেই।

এরপর খানিকক্ষণ কথাবার্তা বন্ধ। তারপর-ই বৃষ্টিটা এল। প্রথম চড়বড়ে কয়েকটা ফোঁটা। তারপর তুমুল। তারপর মুষলধারে।

বদরী চুপ করে বসে রইল। বাইরের ঝড়বৃষ্টি বা মেয়ের চিন্তা, শেষ ট্রেন কোনোটার কথাই ভাবছে না সে। ভাবছে, ভুল দেখল। কী দেখল সে? কাত্যায়নীর গপ্পো তো গপ্পোই। ওর কম অনেক রটনা হয়। তাহলে এরকমধারা হচ্ছে কেন?

বুড়ো মানুষটি হঠাৎ বলল, সুলক্ষণ।

পুলিন বলে, কীসের সুলক্ষণ?

এই কালবোশেখির কথাই বলছি।

অ।

কদম একটা শ্বাস ফেলে বলল, যাক, ফাঁড়াটা কেটেছে। গোয়ালঘরের একটা টিন গেছে। তা যাক।

বদরী বসে আছে চুপচাপ। তার যেন আর তাড়া নেই। গেলেও হয়, না গেলেও হয়।

তাড়াটা এল পুলিনের দিক থেকেই, ওরে ওঠ, সাতটা বাজে যে।

ঝড় থেমেছে। বৃষ্টিটাও ধরে এল। টিনের চালে এখন শুধু মিঠে রিমঝিম। বদরী উঠল।

কদম দরজাটা খুলে দিয়ে বলল, চললেন তাহলে। কষ্ট পেয়ে গেলেন একটু। যেতেও কষ্ট আছে। জলকাদা। বদরী বলল, ও কিছু নয়।

দাওয়ায় পা দিয়েই বুঝল, সামনের অন্ধকারে মেলা লন্ডভন্ড কান্ড হয়ে আছে। গাছ পড়েছে, ডাল ভেঙেছে, মেলা চাল উড়ে গেছে। লোকজনের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে খুব। আতঙ্কের গলা। টর্চ জ্বেলে হাঁটতে হাঁটতে মাঠ পেরোচ্ছে দুজন। চারদিকে বিশাল অন্ধকার মাঠ। ভেজা বাতাস বইছে। জলে-কাদায় পিছল পথ।

ও বদরী, কিছু বল।

কী বলব?

পছন্দ হল?

বদরী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, পছন্দ না হয়ে উপায় আছে!
 

Users who are viewing this thread

Back
Top