What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected আমি সুমন (ছোট গল্প) (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
328
Messages
5,981
Credits
45,360
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
গল্প (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » আমি সুমন


আমি জানি ভিনি আমাকে ভালোবাসে। ভালোবাসে বলেই তিনি বারবার আমার কাছে ধরা পড়ে যায়; নাকি ইচ্ছে করেই ধরা দেয় কে জানে। তার সঙ্গে প্রথম দ্যাখা সেই শিশুবয়সে। তখন ও ফ্রক পরে, লালচে আভার এক ঢল চুল আর ঠোঁটের ওপরে বাঁ-ধারে একটা আঁচিল, খুব ফরসারং

–ব্যস, আর কিছু মনে নেই।

প্রথম দিন, পনেরো–ষোলো বছর পর প্রথম দিন ভিনি আমার দিকে তাকালই না। কিংবা তাকিয়ে এক পলকেই সব দেখে এবং জেনে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ভালোমানুষ সেজে গেল নিজের মার সামনে, কে জানে। বসল খাটের ওপর জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে।

সুমন, এই হচ্ছে ভিনি। ওর মা বললেন, তাঁর চোখেমুখে অহঙ্কার ঝলমল করছিল, আরও অনেক নিঃশব্দ কথা ছিল তাঁর মুখে যা তিনি বললেন না, আমি বুঝে নিলুম–দ্যাখো তো আমার ভিনি কী সুন্দর হয়েছে। দ্যাখো ওর আঙুল, ওর চুল, ওর মুখের ছাঁদ, কথা বলে দ্যাখো কী সুন্দর মিষ্টি ওর গলার স্বর, রাজপুত্রের যুগ্যি আমার ভিনি।

এইসব কথা ভিনির মায়ের মুখে লেখা ছিল কিংবা বলা ছিল। আমি বুঝে নিলুম। সঙ্গে-সঙ্গে মনে-মনে নিজের জন্য লজ্জা হচ্ছিল আমার। আমি তেমন কিছু হলুম না কেন। ভিনির বয়স হয়েছে বিয়ের, তবু কোনওদিন ওর অভিভাবকেরা আমার কথা ভাববে না-আমি বুঝে গেলুম প্রথমদিনের প্রথম কয়েক মিনিটেই। মনে-মনে বললুম–পালা সুমন, মনে-মনে যোগী ঋষি হয়ে যা। ছেলেবেলায় তুই যে সুন্দর ছিলি একথা অনেকেই ভুলে গেছে। এখন কাঠুরের মতো চেহারা তোর, গুন্ডাদের মতো ছোট করে ছাঁটা চুল, মুখের ভাব চোর-চোর, কাঠ হয়ে বসে আছিস।

কতদিন দেখা নেই! ভিনির মা বলে কী করে আমাদের ঠিকানা পেলে?

সেটা আমার গুপ্ত কথা। তাই বললুম না, হেসে এড়িয়ে গেলুম। বুঝলুম ভিনি যে আমাকে তিনটে চিঠি লিখেছিল পরপর তার কথা ওর বাড়ির কেউ জানে না। তার প্রতিটিতেই লেখা ছিল –একবার আসবেন। আপনাকে বড় দরকার আমার। আমারও প্রশ্ন–আমার ঠিকানা ভিনি পেল কোথায়!

দরকারটা আমি বুঝতে পারছিলুম না, কেন না তিনি জানালার বাইরে মুখ ঘুরিয়ে ছিল। অথচ পনেরো–ষোলো বছর পর দেখা, তারও আগে দরকারের চিঠি দেওয়া!

চা খেয়ে আমি উঠে পড়লুম–চলি।

আবার আসবে ত? ভিনির মা বলল –আমরা আর তিন-চার মাস কলকাতায় আছি। উনি রিটায়ার করলেন, হেতমপুরে ওঁদের দেশেই আমাদের বাড়ি তৈরি হচ্ছে, দু-তিনটে ঘরের ছাদ বাকি, ছাদ হলেই আমরা চলে যাব। এর মধ্যেই এসো আবার। মা-বাবা কেমন? বলে হাসলেন–কতদিন ওঁদের দেখি না।

হ্যাঁ আসব বলেই বেরিয়ে আসছিলুম, মনে-মনে তাগাদা দিচ্ছিলুম নিজেকে–পালা সুমন, ভিতুর ডিম, আর আসিস না কখনও।

সিঁড়িতে পা যখন দিয়েছি তখনই গলার স্বর শুনলুম–আমি অহঙ্কারী নই।

একঝলক ফিরে দেখলুম–পিছনে সেই লালচে চুলের ঢল আধো আলোতেও ঝলমল করছে মুখ। পাশে ওর মা দাঁড়িয়ে। তবু সঙ্কোচ নেই, কেবল ওর মায়ের মুখে একটু শুকনো ভাব আর জোর করা হাসি।

পালালুম।

২.

এতকাল আমি শান্তিতে ছিলুম। ছোট্ট একটা ঘর আমার। ছায়াময়, একটু গলির ভিতরের নির্জনে। সারাদিন প্রায়ই কথা না বলে কাটানো যেত। লোকে আমার নাম জানে না, খুব কম লোকেই আমাকে চেনে। আমি নিজের কাছেই নিজের সুমন। ভালোবাসার, আদরের সুমন।

বাড়িওলার বউ বলল –আপনার কাছে একজন এসেছিল।

–কে? অন্যমনস্ক আমি সিঁড়ি ভাঙতে–ভাঙতে ঘাড় না ফিরিয়ে জিগ্যেস করলুম।

–সুন্দরমতো একজন।

চমকে মুখ ঘুরিয়ে দেখি বাড়িওলার বউয়ের মুখে একটু সবজান্তা হাসি। ওঁর অনেক বয়স তবু হাসিটা সুন্দর দেখাল–মায়ের মতো হাসি।

দুটো সিঁড়িতে দু-পা রেখে দাঁড়িয়ে রইলুম।

–খুব সুন্দর। বাড়িওলার বউ বলল –কে?

বুঝতে পারছিলুম। তবু জিজ্ঞাসা করতে ভয় করছিল–ছেলে না মেয়ে।

–ভাবসাব দেখে মনে হল আবার আসবে। বাড়িওলার বউ বলল –আমাদের ঘরে বসিয়ে রেখেছিলুম অনেকক্ষণ। চা করে খাইয়ে দিয়েছি। কথাবার্তা বেশি হয়নি, ভয় নেই।

ঘরে ঢুকে আলো জ্বাললুম। অন্ধকারকে ডেকে বললুম,–ধরা পড়ে গেছ।

রাতে শুতে গিয়ে কষ্টটা টের পেলুম। বুকে পেটে কিংবা কোথায় যে একটা বিশ্রী ব্যথা ছোট্ট একটা মাছের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘুম আসছিল না। কেবল ভয় আর ভয়। কিছু একটা ঘটবে। আমি টের পাচ্ছিলুম।

আমি এইরকম।

.

খুব বড় একটা বাড়িতে অনেক অপোগণ্ড ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমার ছেলেবেলা কেটেছিল। তারা সব আমার জ্যেঠতুতো খুড়তুতো পিসতুতো ভাইবোন–অনাদরে রুক্ষ চেহারা তাদের, ঝাকড়–মাকড় চুল, গায়ে তেলচিট ময়লা, ঝগড়াটে, হিংসুটে। প্রকাণ্ড ঘরের মেঝেয় ঢালাও এজমালি বিছানায় শুতে যাওয়ার সময় তাদের জায়গা নিয়ে ঝগড়া হত। বাড়িটাকে বড় বললুম। কিন্তু হিসেবে ধরলে বাড়িটার এলাকাই ছিল বড়, বড় উঠোন ভিতরে, বাইরে বড় কচ্ছপের পিঠের মতো ঢালু একটা মাঠ। ভিতর বাড়িতে বড় উঠোন ঘিরে কয়েকখানা ঘর–যাদের নাম ছিল পুব পশ্চিম উত্তর বা দক্ষিণের ঘর। এক উত্তরের ঘর ছাড়া আর কোনও ঘরেরই পাকা ভিত ছিল না। আমাদের বাড়িটা যে লক্ষ্মীছাড়া ছিল, কিংবা আমাদের যে খুব অভাব ছিল তা নয়। বরং উলটোটাই আমাদের অনেক ছিল। শুধু আশ্রিত আত্মীয়স্বজন আর যৌথ থাকার চেষ্টায় যে ভিড় বেড়েছিল তাইতেই বাড়িটার মধ্যে সব সময়ে ছিল একটা দিশেহারা ভাব। অনেক ছেলেমেয়ে ছিলুম আমরা, যাদের কেউ-কেউ পরে অনেক বড় কিছু হয়েছে। কিন্তু অতগুলোর মধ্যে কখন কোনটার হাত-পা কাটল, কোনটা পড়ে মরল, কোনটা পুকুরে ডুবল এই চিন্তায় একটা 'গেল গেল' ভাব সবসময়ে আমাদের বাড়িটায় টের পাওয়া যেত। আমার দাদুর কোনও ঢিলেমি ছিল না। –তিনি সবসময়ে কৌটোর মুখ ভালো করে আটকাতেন, দরজার হুড়কো দিতেন ঠিকমতো, আর সন্ধেবেলা আমাদের গুনে–গুনে ঘরে তুলতেন। –বাবার কাছে শোওয়ার নিয়ম ছিল না, আমরা উত্তরের ঘরের মেঝেয় শুতুম একসঙ্গে, দাদু থাকতেন চৌকিতে, বিড়বিড় করে বীজমন্ত্র বলতেন দাদু-ঠাকুমার সঙ্গে, ছোটখাটো বচসা হত, আর ঘুম ভেঙে রাতে মাঝে-মাঝে শুনতুম দাদুর গুড়ুক–গুড়ুক তামাক খাওয়ার শব্দ।

আমাদের পরিবারে নাম রাখার একটা রীতি ছিল। আমার আগের ভাইদের নাম রাখা হয়েছিল অনিমেষ, হৃষীকেশ, পরমেশ, অজিতেশ, সমরেশ ইত্যাদি। সব মিলিয়ে প্রায় উনিশজনের ওরকম নাম রাখা হয়েছিল। আমার বেলায় আর নাম পাওয়া যাচ্ছিল না। শোনা যায়। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর আমার বড়দা রায় দিয়েছিলেন মাত্র দুটি নাম বাকি আছে আর। সুটকেস আর সন্দেশ। কোনটা পছন্দ বেছে নাও। আমার ধর্মবিশ্বাসী মেজোকাকা আমার নাম দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ধর্মেশ। সেটা বাতিল করে দাদু আমার নাম রাখলেন সুমনেশ। ভালো মনের অধিকারী। কেউ মুখে কিছু বলেনি কিন্তু অনেকেরই পছন্দ ছিল না নামটা, আমার মায়েরও না। তাই কালক্রমে আমি শুধু সুমন হয়ে উঠেছিলাম।

আমি সুমন। ভালো মনের অধিকারী।

ওই বাড়িতে খুব বেশি বড় হয়ে উঠবার আগেই আমরা বাড়ি ছেড়েছিলুম। আমার বাবা চাকরি নিয়ে চলে গেলেন বিহারে। প্রকাণ্ড বাগানঘেরা বাংলোবাড়িতে এসে আমার সেই পাঁচ সাত বছর বয়সে প্রথম হঠাৎ মনে হয়েছিল আমার জীবন খুব একার হবে, না হঠাৎ নয়। সেই বাড়িতে প্রথম সকালবেলায় আমি বাড়িটা ঘুরে ফিরে দেখতে ছুটে বেরিয়েছিলুম। একা। সামনে পপি ফুলের বাগান, তারপর ছোট মসৃণ লন, তারপর আগাছা আর রাঙচিতার বেড়া। আমি দৌড়োতে গিয়ে থমকে গেলুম–যত যাই ততই একা। কেবল একা। শিমুলগাছ থেকে হঠাৎ হুহু। করে কেঁদে উঠল একটা কোকিল। ওরকম ডাক আমি আর কোনওদিন শুনলুম না। হাজার বছরে কোকিল বোধহয় ওরকম একবার ডাকে। আমি কি অনেক কোকিলের ডাক শুনিনি। তবু আমাদের দেশের এজমালি বাড়িতে অনেক অপোগণ্ড ছেলেমেয়ের ভিড়ে কখনও আমি কোকিলের ডাক শুনেছিলুম বলে মনে পড়ে না। একা ভোরের ভেজা বাগানে দাঁড়িয়ে আমি প্রথম একটি কোকিলকে ডাকতে এবং কাঁদতে শুনলুম। সেই মুহূর্তেই একা একটি কোকিল আর তার ডাকের সঙ্গে আমার মিলমিশ হয়ে গেল। মনে হল আমার জীবন খুব একার হবে। সেই ভোরবেলাটির কথা আজও আমার খুব মনে পড়ে। ওইরকম একটি কোকিলের ডাক কিংবা আরও তুচ্ছ একটি দুটি ঘটনা থেকে আমরা আবার নতুন করে আমাদের যাত্রা শুরু করি। করি না! আমার এতদিনের বিশ্বাস ছিল–আমার জীবন খুব একার হবে।

আমি আমার বাবাকে সাদা জিনের প্যান্ট পরে ক্রিকেট টেনিস খেলতে দেখেছি। তবু বাবার ছিল সাধু–সন্ন্যাসী–জ্যোতিষ আর তুকতাকের বাতিক। খুব লম্বা সুন্দর সাদা চেহারার এক ভ ভদ্রলোক, যার পরনে গেরুয়া আলখাল্লা আর চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা, আমাকে দেখে বলেছিলেন–এ-ছেলের স্বাভাবিক ছবি আঁকার হাত আছে। এর মন একটু দার্শনিক। বলে তিনি চুপ থেকেছিলেন।

বাবা প্রশ্ন করলেন–আর?

উনি হেসে বললেন–একটু দেখে রাখবেন এ-ঘর ছেড়ে পালাতে পারে। সন্ন্যাসের দিকে খুব টান।

–আর? বাবার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। দরজার আড়ালে মা ছিল। হঠাৎ তার হাতের চুড়ির ঝনাৎ শব্দ হয়েছিল। আমি বুঝেছিলুম, আমি সেই বয়সেই বুঝেছিলুম, লোকটা ভুল কথা বলছে না।

উনি একটু ভেবে বললেন, ওকে খুব সবুজের মধ্যে রাখবেন। ওর পোশাক যেন হয় সবুজ, ওর খাবারের মধ্যে বেশিরভাগ যেন হয় সবুজ রঙের, ওর চিন্তায় সবুজের প্রভাব যেন বেশি থাকে দেখবেন।

তার পরদিনই রং সাবান কিনে এনে মা আমার সমস্ত পোশাক সবুজ করে তুলেছিল। রাশি রাশি শাকপাতা অনিচ্ছায় খেতে হত আমাকে। লুডো খেলতে বসেছি, মা ছুটে এসে বলত–সুমন–বাবা, তুই সবুজ ঘর নে। বাড়িতে পোষা বুলবুলি ছিল, তার পাশে এল একটা টিয়াপাখি। জন্মদিনে এক বাক্স জলরং কিনে দিয়ে মা বলল –কেবল গাছপালার ছবি আঁকবি।

তবু আমার জানা ছিল যে, আমার জীবন খুব একার হবে। সবুজ রঙের ভিতরেও একটি উদাসীন মমতা আছে। আমার মা কিংবা বাবা তা ধরতে পারেনি।

৩.

আমার চোখে চোখ রেখে শান্ত একটু হেসে তিনি বলল –তারপর?

কী?

–তোমার চোখ দেখলেই মনে হয় কোথাও একটু বিপদের আভাস দেখলে তুমি হরিণের মতো ছুটে পালাবে। সুমন লক্ষ্মীসোনা, আমাকে ভয় পেও না। তোমার জন্য আমি অনেক কষ্ট করেছি।

আমি হাসলুম। কী জানি! আমি সুমন। ভালো মনের অধিকারী। তবু আমি জানি ভিনির জন্য আমাকে কেউ ভাববেই। ছেলেবেলা থেকেই তিনি এরকম কথা শুনেছে তার মা কিংবা আত্মীয়দের কাছে সুন্দর ভিনি, তোমার জন্য এনে দেব সোনার রাজপুত্তুর।

কিন্তু আমি কেবল সুমন। কেবলমাত্র সুমন। নিজের কাছে আমি নিজে বড় প্রিয়। আমি বরং পালিয়ে যাব, লুকিয়ে থাকব, পা টিপে হাঁটব, লোকালয়ে যাব না, তবু কেউ যেন কোনও কিছুর জন্য আমার অনাদর না করে, অপমান যেন না করে আমায়। বরং বলি–তোমাদের সুন্দর ভিনিকে নিয়ে যাও! আমি কিছুই চাই না। আমি আমার বড় আদরের সুমন, বড় ভালোবাসার। আমার সামনে আমার সুমনকে অনাদর করো না, বাতিল করে ফেলে দিও না। বরং নিয়ে যাও তোমাদের সুন্দর ভিনিকে।

ভিনি আমার খুব কাছে এসে বলল –সুমন মনে নেই তোমার বাবার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে তোমাদের বাড়িতে একদিন আর এক রাত ছিলুম আমি। সন্ধেবেলা মায়ের কথা মনে পড়তে আমি খুব কেঁদেছিলুম। তুমি খেলার মাঠ থেকে ফিরে এসে আমার কান্না দেখে খুব খেপিয়েছিলে। মনে নেই? তখন তোমার দু'হাত তুলে নাচ, নকল কান্না আর মুখের কাছে মুখ এনে চোখ বড় করে তাকানো দেখে কান্না ভুলে আমি খুব হেসেছিলুম?

মনে নেই। হেসে বললুম খেপিয়েছিলুম বলে আজও আমার ওপর রাগ পুষে রাখোনি তো ভিনি?

ও চোখ বুজে সোজা হয়ে বসে রইল, তারপর বলল –আমার গা দ্যাখো।

দেখলুম গায়ে কাঁটা দিয়েছে।

ও চোখ বুজেই সামান্য হাসল, বলল –সেদিনের কথা মনে হলে আমার সমস্ত শরীর দিয়ে শিহরণ বয়ে যায়। ওরকম সুখ আমি আর কখনও পেলুম না।

শুনে একটু লজ্জা পেলুম। কখনও মানে ভিনি আজকের কথাও বলছে কি? কে জানে মনে সন্দেহ এল, আমাকে কিশোর বয়সে যতটা ভালো লেগেছিল ভিনির ততটা আজও লাগে কি না। কিংবা হয়তো আজও ভিনি সেই কৈশোরের ভালোবাসাই বহন করে চলেছে। কি জানি।

ভিনির দুই চোখ নিঃশব্দে কথা বলছিল–আমি তোমাকে ভালোবাসি সুমন। আমি তোমাকে ভালোবাসি।

ভিনি খুব সুন্দর। বড় ভালোবাসে। আমার বুকের ভিতর লাফিয়ে উঠল একটি বল। চোখে অকারণ জল আসছিল। মনে-মনে বললুম–ভিনি সত্যি? তিন সত্যি? দিব্যি? আমার গা ছুঁয়ে বলো। দ্যাখো ভিনি আমি কিছুই না। আমি কেবলমাত্র সুমন। তাও এ নাম জানে মাত্র কয়েকজন লোক। তুমি এই নাম বুকে করে রেখেছিলে এতকাল? কেন গো? তিনটি চিঠি দিয়ে তুমি ডেকেছিলে আমায় কি সত্যি? সত্যি বটে তোমার খেলামাটির রান্নাঘরে মাঝে-মাঝে আমার নিমন্ত্রণ ছিল, পাথরকুচি পাতার লুচি আর কাদামাটির তরকারি আমি জিভ আর ঠোঁটের কৌশলে চকচক শব্দ করে নকল খাওয়া খেয়েছি, সত্য বটে, তোমাকে আমি দেখিয়েছিলুম দু-হাত তুলে বাঁদরনাচ কিংবা চোখের পাতা উলটে ভয় দেখানোর খেলা। কিন্তু তারপর ক্রমে আমি তোমাকে ভুলেও গিয়েছিলুম। পনেরো–ষোলো বছর পরের এই তোমাকে আমি চিনিই না। ভিনি, মা–কালীর দিব্যি, সত্যি বলো। তিন সত্যি? আমার পা ছুঁয়ে বলো!

.

ভিনি চলে গেলে রাতে আমার ঘুম এল না। আমার শরীরের ভিতরে একটিমাত্র যন্ত্রণার মাছ একা খেলা করে ফিরছে। কখনও পেটে, কখনও বুকে, কখনও মাথায়। ঠিক কোথায় যে তা বুঝতে পারি না। ওই মাছ আমার সমস্ত শরীরে এবং চেতনায় একটিমাত্র কথাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে–সুমন, তোমার জীবন বড় একার হবে।

আমি জানি। আমি তা জানি। অন্ধকারে আমি আপনমনে মাথা নাড়লুম। তারপর চুপিচুপি আমার বালিশের কাছে বলে রাখলুম একটি নাম। ভিনি। ভিনি। ভিনি।

ছেলেবেলায় চেনা কিশোরীদের মুখগুলি আর মনে পড়ে না। কত নাম ভুলে গেছি। তবু মিতু নামে একটি মেয়ের সঙ্গে যে একটি-দুটি দুপুর আমি কাটিয়েছিলুম আমার কৈশোরে, তা মৃত্যু পর্যন্ত মনে থাকবে। আধো-অন্ধকার ছাদের সিঁড়িতে আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম এক দুপুরে। ছাদের ওপর ঝড়ের মতো হাওয়ায় মড়মড় করে নুয়ে পড়ছে এরিয়ালের বাঁশ, কলতলায় এঁটো বাসনের ওপর কাকদের হুড়োহুড়ি, নীচের ঘরে শীতলপাটিতে শুয়ে ভাতঘুমে মা, আর তখন আমার বুক কেঁপে উঠছিল, আমরা কথা বলছিলুম না, মিতু খুব আস্তে-আস্তে আমার আরও কাছ ঘেঁষে আসছিল। অনেক কাছে চলে এল মিতু, তার মুখ আমার মুখকে ছোঁয়–ছোঁয়। আমি সরে সরে গিয়ে রেলিঙের সঙ্গে সেঁটে গেছি, আমার বুক কাঁপছে বুকের ভিতরে আমার সেই গলার স্বর –পালা সুমন, রেলিং টপকে দেওয়াল ডিঙিয়ে পালিয়ে যা, অনেক দূরে চলে যা। আমি টের পেয়েছিলুম তখন দেওয়াল কেঁপে উঠেছিল, কথা বলে উঠেছিল সিঁড়ি, মারমার শব্দে ছুটে আসছিল ছাদের বাতাস। মিতু টেরও পায়নি। মিতু বলেছিল–তোর মুখে কেমন ভাত খাওয়ার গন্ধ! রোজ খাওয়ার পর লুকিয়ে পান খাবি, কিংবা মৌরি, তারপর ফিক করে হেসে সে বলল –আমার মুখে একটা লবঙ্গ আছে, খাবি? দাঁত টিপে সে লবঙ্গর একটি কণা আমাকে দেখাল, বলল –নে, তোর দাঁত দিয়ে কেটে নে। নে না! বলে সে আমাকে টেনে নিল। সেই সময়ে, সেই নিতান্ত কৈশোরেও আমার মনে হয়েছিল আমি এক চারা গাছ, মিতু শিকড়সুদ্ধ আমাকে উপড়ে ফেলল।

আমাদের একটা ছোট্ট পুরোনো জিনিসপত্র রাখার জন্য ঘর ছিল। সেই ঘরে ছিল সবুজ রঙের একটা তোরঙ্গ। আমি আর মিতু সেই তোরঙ্গ এক দুপুরে খুলেছিলুম। তাতে ছিল বান্ডিল–বান্ডিল পুরোনো চিঠি–সেগুলো সবই আমার বাবার লেখা মাকে, কিংবা মার লেখা বাবাকে। আমি আর মিতু হেসেছিলুম। সবজান্তা হাসি। কিন্তু মা-বাবার ওপর অকারণে আমার বড় রাগ হয়েছিল। ইচ্ছে হয়েছিল আমি ওদের আর ভালোবাসব না। মিতু বলল ,–তুই আমাকে চিঠি লিখবি? লেখ না। বানান ভুল করিস না, আর চিঠির ওপর ঠাকুর–দেবতার নাম লিখিস না। লিখবি তো? আমি বিকেলে এসে নিয়ে যাব। তারপর তোকেও দেব চিঠি।

সেই ঘটনার পর থেকে অনেক দিন আমি আমার বাবা–মার ওপর খুশি ছিলুম না। আমি বাগানে ঘুরে গাছেদের জিগ্যেস করতুম, আমি ঘরের দেওয়ালকে জিগ্যেস করতুম, রাতে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে বুকজোড়া অন্ধকারকে জিগ্যেস করতুম, কেন আমি তাদের আর ভালোবাসব মনে-মনে আমি নিজেকে ডেকে বলেছিলুম–সুমন তুই কখনও বিয়ে করিস না।

আমাদের বাড়িতে প্রায়ই জ্যোতিষেরা আসত। তাদের মধ্যে একজন একবার বাবাকে বলেছিলসুমনের বউ যেন খুব সুন্দর হয়। কখনও কুচ্ছিত কিংবা চলনসই মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দেবেন না। সইতে পারবে না।

সেই জ্যোতিষ কী বলতে চেয়েছিল তা বুঝতে পেরে আমার সমস্ত শরীর শিউরে উঠেছিল। বুঝতে পেরেছিলুম আমার ভিতরে অন্যকে ভালোবাসার ক্ষমতা কত কম! শিশুর মতো রঙিন খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে না রাখলে আমি সহজেই সব কিছুকে অবহেলা করব।

৪.

মাঘ মাসের এক গোধূলি লগ্নে ভিনির সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেল।

সমারোহ কিছুই হল না। খুব আলো জ্বলল না, বাজনা বাজল না। প্রায় স্তব্ধতার ভিতরে আমি মন্ত্রোচ্চারণ করলুম।

বাসরঘরেও আমরা ছিলুম একা। ভিনি চুপিচুপি আমাকে বলল –বাব্বাঃ, বাঁচা গেল।

কেন? আমি জিগ্যেস করলুম। ভিনি পরম নিশ্চিন্তে চোখ বুজে বলল –কী জানি ভয় হচ্ছিল শুভদৃষ্টির সময়ে হয়তো দেখব অন্য লোক। তাহলে আমি ঠিক অজ্ঞান হয়ে পিঁড়ি থেকে পড়ে যেতুম।

হাসলুম–এত ভয়।

চোখ বুজে ভিনি একটা হাত বাড়িয়ে আমার বুকে রাখল, বলল –মন, তোমার বুকের ভিতরে পালিয়ে যাওয়ার দুরদুর শব্দ। বলেই হাসল ভিনি, তেমনি চোখ বুজে থেকে বলল –সেই কবে থেকে তোমাকে ভালোবেসে আসছি মন, ভয় ছিল যদি পালিয়ে যাও! জানোনা তো তোমার জন্য মা-বাবার সঙ্গে কত ঝগড়া করলুম আমি।

আমার মাথার ভিতরে গুনগুন করে ঘুরে বেড়াতে লাগল ভিনির ওই কথাটুকু-কী জানি, ভয় হচ্ছিল শুভদৃষ্টির সময়ে হয়তো দেখব অন্য লোক।

আমি আস্তে-আস্তেভিনিকে বললুম–ভিনি একটা কথা বলি?

–হুঁ।

–ছেলেবেলায় আমার মাকে কখন ভালো লাগল জানো? যখন রান্নাবান্না আর কাজ করতে-করতে মার চুল এলোমেলো হয়ে যেত, মুখে জ্যাবজ্যাব করত ঘাম, সিঁদুর গলে নেমে আসত নাকের ওপর, যখন মার আটপৌরে শাড়িতে হলুদের দাগ, তখন মাকে আমি সবচেয়ে ভালোবাসতুম। আর মা যখন সাজগোজ করত, গায়ে পরত ফরসা জামাকাপড়, তখন মাকে বড় গম্ভীর আর রাগী দেখাত যেন ছুঁতে গেলেই বকে দেবে। কিংবা মা যখন দুঃখ পেত, চুপ করে বসে থাকত, অথবা হয়তো কোনও কারণে কাঁদত তখনই মা আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল, আমি কেবল মার আশেপাশে ঘুরঘুর করতুম। কেন বলো তো?

–কেন।

–আসলে একটু কষ্ট, একটু দুঃখের মধ্যেই মানুষকে দেখতে বোধহয় আমার ভালো লাগে।

–পাগল। বলে তিনি হাসল।

আমি একটু চুপ করে থেকে বললুম–আমার বাবাকে আমি সবচেয়ে বেশি কবে ভালোবেসেছিলুম জানো?

–কবে?

–মফসসলে রেল কলোনির এক ক্রিকেট–ম্যাচে একটি লোক ছাব্বিশ রান করে আউট হয়ে গেল। বুড়ো স্কোরারের পাশে মাঠের ঘাসে বসে আমি দেখলুম সাদা পোশাক করা লম্বা চেহারার যুবকটি ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আসছে, মাথা অল্প নোয়ানো, হাতের ব্যাটটা শূন্যে একবার আধপাক ঘুরে গেল হতাশায়, মাথার টুপিটা খুলে নিয়ে ম্লান হাসি মুখে বাবা প্রকাণ্ড মাঠটা আস্তে আস্তে পার হয়ে প্যাভিলিয়নের তাঁবুর দিকে চলে যাচ্ছিল। সে জানত না যে সেই সময়ে মাঠের দর্শকদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি দুঃখ পাচ্ছিল তার জন্য, সে আমি। বাবা আউট হয়ে গেল বলে না, আসলে বাবার ওই হেঁটে ফিরে আসা, আধপাক ঘুরে যাওয়া ব্যাটটার হতাশা আর মুখের হাসিটুকুর জন্য আমি কেঁদেছিলুম। তারপর থেকে বাবাকে যে আমি কি ভীষণ, ভীষণ ভালোবাসি ভিনি। এখনও যে বাবাকে ভালোবাসি তার কারণ বোধহয় ওই মুহূর্তটি, বাবার আউট হয়ে ফিরে আসার ওই মুহূর্তটি। বাবা বলে ভাবতেই ওই দৃশ্য আজও আমার চোখের সামনে স্পষ্ট ফুটে ওঠে। কেন বলো তো?

–কেন? আমি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললুম–আসলে দু-একটিই ভালোবাসার মুহূর্ত থাকে আমাদের। না? বলেই হাসলুম–ছেলেবেলার তুমি মাত্র একবারই ভালোবেসেছিল আমায়।

শুনে ভিনি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল –আমি জানি তুমি আমাকে তেমন ভালোবাসো না মন। তেমন মুহূর্ত তোমার কখনও আসেনি।

শুনে বড় চমকে উঠলুম। হেসে বললুম–পাগলি।

ও চুপ করে আমার চোখের দিকে চেয়ে বলল –তাকে কিছু আসে যায় না। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি।

আমি হেসে গলা নামিয়ে বললুম–ভিনি তোমার গায়ে জন্মদাগটা কোথায়?

অবাক হয়ে ভিনি বলল –কেন?

বললুম–তোমার গায়ের ভোলা দাগটা খুঁজে পাইনি।

একটু চুপ করে থেকে ভিনি হঠাৎ লাল হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল–এঃ মাগো, বিচ্ছু কোথাকার…তোমার…তোমারটা কোথায়?

তারপর অনেক রাতে ভিনি আমাকে তার জন্মদাগ দেখতে দিয়েছিল।

তিন বছরে আমাদের দুটি ছেলেমেয়ে হল। আর আমরা অল্প একটু বুড়ো হয়ে গেলুম।

মাঝে-মাঝে আমি ভিনিকে বলি–ভিনি, আমার মন ভালো নেই।

–কেন?

–কি জানি।

–শরীর খারাপ নয়তো? বলতে-বলতে সে এসে আমার কপালে তার গাল ছোঁয়ায়, বুকে হাত দিয়ে দেখে গা গরম কি না।

–না, শরীর খারাপ নয়। আমি বলি।

–রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছিলে?

–না।

–তবে কী?

–কি জানি! আমি বলি–মন ভালো নেই।

ভিনি হাসে-পাগল কোথাকার।

–আমার বড় একা লাগছে ভিনি।

ভিনি চমকে উঠে–কেন আমরা তো আছি।

আমি শূন্য চোখে চেয়ে থাকি। কথার অর্থ বুঝবার চেষ্টা করি। পকেট হাতড়ে খুঁজি সিগারেট আর দেশলাই।

.

গত আশ্বিনে আমি আমার চৌত্রিশের জন্মদিন পার হয়ে এলুম। আমি জানি আমি খুব দীর্ঘজীবী হব–আমার কুষ্ঠিতে সেই কথা লেখা আছে। ত্রিশের ঘরে বসে আমি তাই সামনের দীর্ঘ জীবনের দিকে চেয়ে অলস ও ধীরস্থির হয়ে আছি। বিছানায় শুয়ে হাত বাড়ালেই যেমন টেবিলের ওপর সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাই, জলের গ্লাস কিংবা ঘড়ি ছোঁয়া যায়, মৃত্যু আমার কাছে ততটা সহজে ছোঁয়ার নয়। মাঝে-মাঝে জ্যোৎস্না রাতে আমার জানালা খুলে চুপ করে বসে থাকি। হালকা বিশুদ্ধ চাঁদের আলো আমার কোলে পড়ে থাকে। ক্রমে–ক্রমে আমার রক্তের মধ্যে ডানা নেড়ে জেগে ওঠে একটি মাছ ছোট্ট আঙুলের মতো একটি মাছ–শরীর ও চেতনা জুড়ে তার অবিরল খেলা শুরু হয়। আমার চেতনার মধ্যে জেগে ওঠে একটি বোধ, আমারই ভিতর থেকে কে যেন বড় মৃদু এবং মায়ার স্বরে ডেকে দেয়, 'সুমন, আমার সুমন।' অকারণে চোখের জল ভেসে যায়। আস্তে-আস্তে জানলার চৌকাঠের ওপর মাথা নামিয়ে রাখি। মায়ের হাতের মতো মৃদু বাতাস আমার মাথা থেকে পিঠ পর্যন্ত স্পর্শ করে যায়। তখন মনে পড়ে–সুমন, তোমার জীবন খুব একার হবে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top