ভ্রমণ কেবলই ঘুরে বেড়ানো আর দৃশ্য উপভোগের নয়; বরং অনেক সময় এর চেয়ে অনেক বেশি উপভোগ্য হয় নানা মানুষের সঙ্গ। দৃশ্য দেখার চেয়েও যা গভীরতর আনন্দের। পথে পথে ঘুরে মানুষ দেখা আর অন্তরঙ্গচারিতা অনুঘটক হয় সমাজবীক্ষণের।
বিস্ময়কর, জাপানে যতই ঘুরছি ততই জ্ঞানসমুদ্রে ভেসে যাচ্ছি। নিজের শখ, চিন্তাধারা অনেক কিছুরই বিনিময় শেষে সে সন্ধ্যায় মিচিকো সাকুরাকে ই–মেইল অ্যাড্রেস এবং ঠিকানা দিয়ে ঢুকে পড়লাম একটি সুপার শপে। টয়োটা, নিশান, হিটাচি, মিতসুবিশি, সনি, সিটিজেন, ক্যাসিও বিশ্বে বিস্তর কদর রয়েছে এসব গাড়ি, ইলেকট্রনিক গ্যাজেটস আর ঘড়ির ব্র্যান্ডের। কিন্তু আমার আগ্রহ জাপানের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পে। এ ছাড়া বউয়েরও আবদার বলে কথা! হোয়াটসঅ্যাপে আগের রাতে বলেছে, যার জন্যই যা কিছু উপহার হিসেবে নিই না কেন, তাতে ওর ওজর-আপত্তি নেই; কিন্তু ওর পুতুল চাই-ই চাই।
থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নানা শ্রেণির পুতুল, ছবি: উইকিপিডিয়া
দেখছিলাম থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নানা শ্রেণির পুতুল। কিছু পুতুল শিশুদের প্রতিনিধিত্ব করছে, কিছু পুতুলে আছে রাজকীয় আদালত, যোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনাদের চরিত্র। কিছু পুতুলে আছে রূপকথার চরিত্র। কিছু পুতুলে দেখলাম জাপানি শহরের দৈনন্দিন জীবনের মানুষও রয়েছেন। ঘুরতে ঘুরতে আমার ভালো লাগল এক লাল টুকটুকে রাজকন্যাকে। যে করেই হোক সেটাকে আমার লাল-সবুজের দেশে উড়িয়ে আনতেই হবে। কর্কশ সেলসম্যান ১৫ পিস একসঙ্গে ছাড়া বিক্রি করতে রাজি নন,আবার দামও বেশ চড়া। পোষাল না।
রাস্তায় রাস্তায় এত্তো এত্তো জাপানি মুখ দেখতে দেখতে ভাবছি, জাপানিদের চেহারার সঙ্গে কোরিয়ান ও চীনাদের পার্থক্যটা আসলে কোথায়? জাপানি মুখ সাধারণত চীনের চেয়ে দীর্ঘতর; বিপরীতে চীনে দেখা যায় গোলাকৃতির মুখ। জাপানের বাসিন্দাদের মুখ আরও প্রসারিত ডিম্বাকৃতির? আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো নাক। চীনাদের মধ্যে এটি প্রায়ই সমতল দেখা যায়। চীনের মানুষের চুল হয় শক্ত ও পুষ্ট। অন্যদিকে জাপানিদের নরম ও রেশম কোমল। আর এই বৈশিষ্ট্যগুলোই জাতিগতভাবে চীন ও কোরিয়ার সঙ্গে জাপানিদের পার্থক্য গড়ে দেয়।
আরও পড়ুন: বুকপকেটে জাপানি সূর্য
রাতে বাসায় ঘুম আসছিল না। রিমোট কন্ট্রোলের বাটন টিপে টিভি চ্যানেলগুলো দেখে নিচ্ছিলাম আগ্রহভরে। কাজলদা জানালেন, জাপানিরা ভীষণ জাতীয়তাবাদী। সেখানে বিবিসি, সিএনএন, আল–জাজিরার দাপট নেই; ওদের সবচেয়ে জনপ্রিয় চ্যানেল এনএইচকে। এমনকি সুনামির সময়ও মানুষ এনএইচকে দেখে; এর কারণ বিশ্বাসযোগ্যতা।
গুণগত মান ও নিজস্বতার দাপটে নিজেদের ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করে না। বিদেশি কোনো কিছু জাপানে বাজারজাত করতে হলে, জাপানিদের পছন্দসহ, অঘোষিত মানদণ্ড রক্ষা করতে হয়! না করতে পারলে, বিনিয়োগের পথেই ব্যবসা মারা যাবে। চাপাবাজি ও হেলাফেলার সুযোগ এখানে নেই। টিভি অনুষ্ঠান তো পরের কথা; ম্যাগডোনাল্ডস, কেএফসি, কোকাকোলার মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোকেও তাদের পণ্য এবং সেবা জাপানিদের মতো করে সাজাতে হয়।
জাপানি শিশুরা ঘুম থেকে উঠেই টিভি দেখতে বসে যায়। বাড়ির কাজ বাকি না থাকলে, শিশুরা সাধারণত সকালে বই নিয়ে বসে না। টিভি দেখে আরাম করে, সকালের নাশতা করেই দলবেঁধে স্কুলে চলে যায়। টিভির শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানগুলো পাঁচ বছরের শিশুদের এত আনন্দের যে অনেক সময় শিশুরা সব ভুলে শুধু টিভি দেখতে চায়। প্রায়ই স্কুলে যেতে গড়িমসি করে, বিলম্ব করে। রাতে ঘুমানোর আগপর্যন্ত শিশু–কিশোররা, বিশেষত রাত আটটা পর্যন্ত বেশ মজা করে টিভি দেখে।
গভীর পর্যবেক্ষণে দেখছি সারা বাড়িবার্তি পুতুল! শান্ত-সৌম্য পরিবেশে মনে হচ্ছিল এগুলোই বেশি মানানসই। কাজলদা বললেন, জাপানের অসংখ্য পুরুষ সিলিকন রোমান্সের দিকে ঝুঁকছে ও এদের সংখ্যাটাও দিন দিন বাড়ছে। প্রতিবছর দেশটিতে প্রায় দুই হাজারের মতো 'সেক্স ডল' বিক্রি হয়। দাম অন্তত ছয় হাজার ডলার। জানালাম, পুতুলপ্রীতিতে বাঙালিরাও পিছিয়ে নেই। অন্যতম ঘরোয়া শিল্পকর্ম। মায়েরা বালিকাদের খেলার জন্য পুতুল বানিয়ে দেন। বাংলাদেশে পুতুল নিয়ে অবসেশন ছোট-বড় কমবেশি সবারই।
ছবি: উইকিপিডিয়া
ইতিহাস বলে পাপেট্রি বা পুতুল নাচের শুরুটা আনুমানিক ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের মাটিতেই। তখনকার দার্শনিক পতঞ্জলির লেখাতে 'পুতুলবাজি' কথাটা পাওয়া গিয়েছিল। মুচকি হাসিতে এতক্ষণ আলোচনা শুনছিলেন এবারে আর তর সইল না; পুতুল আলোচনায় আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন কাজলদার 'জাপানিজ ওয়াইফ' কোমিয়া নাসাকি। তিনি জানালেন, জাপানে একটি গ্রাম আছে যার নাম 'নাগেরো' আস্ত সেই গ্রামটিই এখন পুতুল গ্রাম। গ্রামে যে-ই আসেন, সেই গ্রামের পথে পথে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বয়সী পুতুল দেখে তাজ্জব বনে যান। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে যায় ফসলের মাঠে কোনো ব্যস্ত কৃষকরূপী পুতুলকে। নদীর ধারে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়বে হয়তো ঢিলেঢালা প্যান্ট আর চেক শার্ট গায়ে, মাথায় টুপি পরিহিত একজন পুতুল মাছ ধরায় ব্যস্ত, দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন সত্যিকার এক মানুষ।
পরদিন লাঞ্চ করতে গেলাম সুশির জন্য প্রসিদ্ধ চুও নামক স্থানে। এটা টোকিওতে গিনজা এলাকায় অবস্থিত। সুপ্রসিদ্ধ সেই হোটেলের নাম সুকিয়াবাশি জিরো। এখানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানও সুশির স্বাদ নিয়েছেন। এসেছেন বারাক ওবামাও। প্রথমে সুগন্ধি স্টিকি রাইস বা আঠালো ভাত বয়স্ক সামুদ্রিক মাছের মধ্যে আবদ্ধ করে উমিমি তৈরি করা হয়। একবার শোষণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে সবজি দেওয়া হয় এবং নানা রকম ফলের ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। এটি জাপান ছাড়াও সারা বিশ্ব থেকে জাপানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়।
সুকিয়াবাশি জিরোয় বারাম ওবামা, Pete Souza
এ ছাড়া জাপানে থাকাকালীন কিছু জনপ্রিয় খাবার আমি চেটেপুটে খেয়েছি—এর মধ্যে শুকিয়াকি, সাবু সাবু, গরুর মাংসের ওয়াগিউ বেশ সুস্বাদু। আমার মনে হয়েছে যে কারও ভালো লাগতে পারে।
আমার এক সপ্তাহের ভ্রমণের মধ্যেই চলে আসে পবিত্র ঈদুল আজহা। প্রবাসীদের অনেকেই দেখলাম কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়েছেন। কিনশিখোর স্থানীয় মসজিদে ঈদের নামাজ আদায়ের পর, আমি তাই টোকিও স্কাই ট্রি দেখার জন্য উন্মুখ হই। আমাকে সঙ্গ দেন কাজলদা এবং তাঁর বন্ধু হক রোকন।
টোকিও স্কাই ট্রি, ছবি: উইকিপিডিয়া
স্কাই ট্রি অভ্যর্থনায় লিফলেট পড়ে জানলাম, এটি একই সঙ্গে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভবনও। অনেকে এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন হিসেবেও অভিহিত করে থাকে। কিন্তু না, এটি শুধু সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার। সবচেয়ে উঁচু ভবন হলো দুবাইয়ে অবস্থিত 'বুর্জ খলিফা' ভবনটি। সবচেয়ে উঁচু টাওয়ারের ওপরে যখন উঠলাম; মনে হলো ঝকঝকে নভোযান চড়ে দক্ষিণ আকাশের মাথা ক্রস করে যেন উত্তর আকাশ বরাবর নেমে এলাম। নানা দেশের মানুষের ভিড়, জটলা, গোপন শূন্যতাকে উড়িয়ে দিচ্ছে বহুকণ্ঠ কোরাসের যৌথ সুর।
এই টাওয়ারে হয়তো জীবনে দ্বিতীয়বার আসা হবে না, লিফটে প্রতিটি ফ্লোর একবার করে ঢুঁ মেরে, ছবি তুলছি আর দেখছি কৌতূহলী চোখ। ওদের কত প্রশ্ন, কত বার্তা! মনে হলো, অনুভূতিকে আসলে কখনো বেঁধে রাখতে নেই। যখন নিচে অবতরণ করলাম, দেখলাম স্কাই ট্রি একসময় দিগন্ত পেরিয়ে অনেক দূর দেশে হারিয়ে গেল। অবশ্য উল্লসিত অনুভূতিতে এর আগেই ক্যামেরাবন্দী হয়েছিলাম।
সুকিয়াকি, ছবি: উইকিপিডিয়া
তখনো বেলা মাত্র তিনটা। সূর্যালোক অ্যাপার্টমেন্টের কাচ ছাদ ভেদ করে ঠিকরে ধুয়ে দিচ্ছিল পরিচর্যিত বাগানগুলো। কাজলদা বললেন, এবার বাসায় গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম তারপর তোমার জন্য শপিং করতে বেরোব। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে কাজলদা সিঁড়ি ভেঙেই রোজ রোজ অ্যাপার্টমেন্টের চারতলায় ওঠেন।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটা উপকারী ভেবে দুজনেই একসঙ্গে সিঁড়ি ভাঙছিলাম। এমন সময় ডাউন-স্টেয়ার্সে দেখা হলো ধূসর রঙের ওভারকোট পরা কোমিয়া নাসাকির সঙ্গে। তিনি কাজলদাকে মুচকি হেসে জাপানি ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, মিচিকো সাকুরাটা কে? কাজলদা ত্বরিত উত্তর দিলেন, কেন, কী হয়েছে? কোমিয়া নাসাকি বললেন, এক ব্যাগভর্তি পুতুল পাঠিয়েছে সঙ্গে একটি চিরকুট! কাজলদা আমার দিকে চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললেন—সারপ্রাইজ!
টোকিওর একটি পার্কে লেখক
চিরকুট পড়ে তিন জোড়া চোখের পাতা থেকে ছড়িয়ে পরে যে মুগ্ধতা, তাতে যেন পাখির ডানা ঝাপটানোর আনন্দ...আবার এ যেন সঠিক শব্দটা খুঁজে না পেয়ে কৃতজ্ঞতায় চোখের পাপড়ির নত হওয়ারও ইঙ্গিত!
একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস বিদায়ের মুহূর্তকে আলিঙ্গন করলে, ভাবি টোকিওর লালসূর্যটা কি হ্নদয় থেকে ডুব দিল? না! কোমিয়া নাসাকির থমথমে মুখখানা দেখে আমার চোখও ছলছল করে উঠল। মনেও কি ধড়ফড়? প্রতিটি বিদায় মুহূর্ত বুঝিবা এ রকম সঘন! কেমন এক ইন্দ্রজাল যেন ঘোরের মধ্যে থাকা একটি সপ্তাহ অল্পতেই ফুরিয়ে গিয়েও ফুরোল না! স্বর ভেঙে গেলে মুখ থেকে শব্দও বেরোয় না। ধীর পায়ে ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে ভিকট্রি চিহ্ন দেখালাম।
গেটের বাইরে এক মধ্যবয়স্ক নারী, সাদা ধবধবে কুকুরটাকে গলায় চেইন বেঁধে কোথাও নিয়ে যাচ্ছেন, তিনিও আমার চোখে চোখ রেখে কী যেন বোঝাতে চাইলেন। গোলাপি গালের অনিন্দ্যকান্ত কিশোরটি দুরন্ত গতির বাইসাইকেল থেকে নেমে বিদায়ী সম্ভাষণ জানাল।
বিমানবন্দরের ডিপারচার লাউঞ্জ, ছবি: উইকিপিডিয়া
একটা প্রবল দুলুনিতে বুঝলাম প্লেন উঠে গেছে ভূমি থেকে অনেক অনেক ওপরে। দেখছি, নিচে সারাটা জাপানের সবুজ জমিন মানচিত্রের মতো বিছিয়ে আছে। মাঝখানে ঐশ্বর্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফুজি পাহাড়ে। একসময় ঘুম পেয়ে গেল। কল্পনার তুলিতে এঁকে চলেছি নানা ছবি। সেসব ছবিতে যেন আমার আবারও জাপানে ফেরার গল্প। আমি আবারও আসব শিশিরের পালক ছুঁয়ে, চকচকে পালিশ করা জাপানি কালো বুটে হলুদ পাতা মাড়িয়ে, মিচিকো সাকুরাকে সঙ্গী করে প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে জাপান সাগরের গভীরতা পরখ করে, অসংখ্য ভক্তিপূর্ণ বৌদ্ধদের মোমের আলোয় শেষবারের মতো নিজের প্রার্থনাটুকু সেরে নিতে!
* লেখক: মোস্তফা মহসীন
বিস্ময়কর, জাপানে যতই ঘুরছি ততই জ্ঞানসমুদ্রে ভেসে যাচ্ছি। নিজের শখ, চিন্তাধারা অনেক কিছুরই বিনিময় শেষে সে সন্ধ্যায় মিচিকো সাকুরাকে ই–মেইল অ্যাড্রেস এবং ঠিকানা দিয়ে ঢুকে পড়লাম একটি সুপার শপে। টয়োটা, নিশান, হিটাচি, মিতসুবিশি, সনি, সিটিজেন, ক্যাসিও বিশ্বে বিস্তর কদর রয়েছে এসব গাড়ি, ইলেকট্রনিক গ্যাজেটস আর ঘড়ির ব্র্যান্ডের। কিন্তু আমার আগ্রহ জাপানের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পে। এ ছাড়া বউয়েরও আবদার বলে কথা! হোয়াটসঅ্যাপে আগের রাতে বলেছে, যার জন্যই যা কিছু উপহার হিসেবে নিই না কেন, তাতে ওর ওজর-আপত্তি নেই; কিন্তু ওর পুতুল চাই-ই চাই।
থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নানা শ্রেণির পুতুল, ছবি: উইকিপিডিয়া
দেখছিলাম থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নানা শ্রেণির পুতুল। কিছু পুতুল শিশুদের প্রতিনিধিত্ব করছে, কিছু পুতুলে আছে রাজকীয় আদালত, যোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনাদের চরিত্র। কিছু পুতুলে আছে রূপকথার চরিত্র। কিছু পুতুলে দেখলাম জাপানি শহরের দৈনন্দিন জীবনের মানুষও রয়েছেন। ঘুরতে ঘুরতে আমার ভালো লাগল এক লাল টুকটুকে রাজকন্যাকে। যে করেই হোক সেটাকে আমার লাল-সবুজের দেশে উড়িয়ে আনতেই হবে। কর্কশ সেলসম্যান ১৫ পিস একসঙ্গে ছাড়া বিক্রি করতে রাজি নন,আবার দামও বেশ চড়া। পোষাল না।
রাস্তায় রাস্তায় এত্তো এত্তো জাপানি মুখ দেখতে দেখতে ভাবছি, জাপানিদের চেহারার সঙ্গে কোরিয়ান ও চীনাদের পার্থক্যটা আসলে কোথায়? জাপানি মুখ সাধারণত চীনের চেয়ে দীর্ঘতর; বিপরীতে চীনে দেখা যায় গোলাকৃতির মুখ। জাপানের বাসিন্দাদের মুখ আরও প্রসারিত ডিম্বাকৃতির? আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো নাক। চীনাদের মধ্যে এটি প্রায়ই সমতল দেখা যায়। চীনের মানুষের চুল হয় শক্ত ও পুষ্ট। অন্যদিকে জাপানিদের নরম ও রেশম কোমল। আর এই বৈশিষ্ট্যগুলোই জাতিগতভাবে চীন ও কোরিয়ার সঙ্গে জাপানিদের পার্থক্য গড়ে দেয়।
আরও পড়ুন: বুকপকেটে জাপানি সূর্য
রাতে বাসায় ঘুম আসছিল না। রিমোট কন্ট্রোলের বাটন টিপে টিভি চ্যানেলগুলো দেখে নিচ্ছিলাম আগ্রহভরে। কাজলদা জানালেন, জাপানিরা ভীষণ জাতীয়তাবাদী। সেখানে বিবিসি, সিএনএন, আল–জাজিরার দাপট নেই; ওদের সবচেয়ে জনপ্রিয় চ্যানেল এনএইচকে। এমনকি সুনামির সময়ও মানুষ এনএইচকে দেখে; এর কারণ বিশ্বাসযোগ্যতা।
গুণগত মান ও নিজস্বতার দাপটে নিজেদের ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করে না। বিদেশি কোনো কিছু জাপানে বাজারজাত করতে হলে, জাপানিদের পছন্দসহ, অঘোষিত মানদণ্ড রক্ষা করতে হয়! না করতে পারলে, বিনিয়োগের পথেই ব্যবসা মারা যাবে। চাপাবাজি ও হেলাফেলার সুযোগ এখানে নেই। টিভি অনুষ্ঠান তো পরের কথা; ম্যাগডোনাল্ডস, কেএফসি, কোকাকোলার মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোকেও তাদের পণ্য এবং সেবা জাপানিদের মতো করে সাজাতে হয়।
জাপানি শিশুরা ঘুম থেকে উঠেই টিভি দেখতে বসে যায়। বাড়ির কাজ বাকি না থাকলে, শিশুরা সাধারণত সকালে বই নিয়ে বসে না। টিভি দেখে আরাম করে, সকালের নাশতা করেই দলবেঁধে স্কুলে চলে যায়। টিভির শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানগুলো পাঁচ বছরের শিশুদের এত আনন্দের যে অনেক সময় শিশুরা সব ভুলে শুধু টিভি দেখতে চায়। প্রায়ই স্কুলে যেতে গড়িমসি করে, বিলম্ব করে। রাতে ঘুমানোর আগপর্যন্ত শিশু–কিশোররা, বিশেষত রাত আটটা পর্যন্ত বেশ মজা করে টিভি দেখে।
গভীর পর্যবেক্ষণে দেখছি সারা বাড়িবার্তি পুতুল! শান্ত-সৌম্য পরিবেশে মনে হচ্ছিল এগুলোই বেশি মানানসই। কাজলদা বললেন, জাপানের অসংখ্য পুরুষ সিলিকন রোমান্সের দিকে ঝুঁকছে ও এদের সংখ্যাটাও দিন দিন বাড়ছে। প্রতিবছর দেশটিতে প্রায় দুই হাজারের মতো 'সেক্স ডল' বিক্রি হয়। দাম অন্তত ছয় হাজার ডলার। জানালাম, পুতুলপ্রীতিতে বাঙালিরাও পিছিয়ে নেই। অন্যতম ঘরোয়া শিল্পকর্ম। মায়েরা বালিকাদের খেলার জন্য পুতুল বানিয়ে দেন। বাংলাদেশে পুতুল নিয়ে অবসেশন ছোট-বড় কমবেশি সবারই।
ছবি: উইকিপিডিয়া
ইতিহাস বলে পাপেট্রি বা পুতুল নাচের শুরুটা আনুমানিক ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের মাটিতেই। তখনকার দার্শনিক পতঞ্জলির লেখাতে 'পুতুলবাজি' কথাটা পাওয়া গিয়েছিল। মুচকি হাসিতে এতক্ষণ আলোচনা শুনছিলেন এবারে আর তর সইল না; পুতুল আলোচনায় আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন কাজলদার 'জাপানিজ ওয়াইফ' কোমিয়া নাসাকি। তিনি জানালেন, জাপানে একটি গ্রাম আছে যার নাম 'নাগেরো' আস্ত সেই গ্রামটিই এখন পুতুল গ্রাম। গ্রামে যে-ই আসেন, সেই গ্রামের পথে পথে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বয়সী পুতুল দেখে তাজ্জব বনে যান। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে যায় ফসলের মাঠে কোনো ব্যস্ত কৃষকরূপী পুতুলকে। নদীর ধারে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়বে হয়তো ঢিলেঢালা প্যান্ট আর চেক শার্ট গায়ে, মাথায় টুপি পরিহিত একজন পুতুল মাছ ধরায় ব্যস্ত, দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন সত্যিকার এক মানুষ।
পরদিন লাঞ্চ করতে গেলাম সুশির জন্য প্রসিদ্ধ চুও নামক স্থানে। এটা টোকিওতে গিনজা এলাকায় অবস্থিত। সুপ্রসিদ্ধ সেই হোটেলের নাম সুকিয়াবাশি জিরো। এখানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানও সুশির স্বাদ নিয়েছেন। এসেছেন বারাক ওবামাও। প্রথমে সুগন্ধি স্টিকি রাইস বা আঠালো ভাত বয়স্ক সামুদ্রিক মাছের মধ্যে আবদ্ধ করে উমিমি তৈরি করা হয়। একবার শোষণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে সবজি দেওয়া হয় এবং নানা রকম ফলের ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। এটি জাপান ছাড়াও সারা বিশ্ব থেকে জাপানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়।
সুকিয়াবাশি জিরোয় বারাম ওবামা, Pete Souza
এ ছাড়া জাপানে থাকাকালীন কিছু জনপ্রিয় খাবার আমি চেটেপুটে খেয়েছি—এর মধ্যে শুকিয়াকি, সাবু সাবু, গরুর মাংসের ওয়াগিউ বেশ সুস্বাদু। আমার মনে হয়েছে যে কারও ভালো লাগতে পারে।
আমার এক সপ্তাহের ভ্রমণের মধ্যেই চলে আসে পবিত্র ঈদুল আজহা। প্রবাসীদের অনেকেই দেখলাম কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়েছেন। কিনশিখোর স্থানীয় মসজিদে ঈদের নামাজ আদায়ের পর, আমি তাই টোকিও স্কাই ট্রি দেখার জন্য উন্মুখ হই। আমাকে সঙ্গ দেন কাজলদা এবং তাঁর বন্ধু হক রোকন।
টোকিও স্কাই ট্রি, ছবি: উইকিপিডিয়া
স্কাই ট্রি অভ্যর্থনায় লিফলেট পড়ে জানলাম, এটি একই সঙ্গে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভবনও। অনেকে এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন হিসেবেও অভিহিত করে থাকে। কিন্তু না, এটি শুধু সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার। সবচেয়ে উঁচু ভবন হলো দুবাইয়ে অবস্থিত 'বুর্জ খলিফা' ভবনটি। সবচেয়ে উঁচু টাওয়ারের ওপরে যখন উঠলাম; মনে হলো ঝকঝকে নভোযান চড়ে দক্ষিণ আকাশের মাথা ক্রস করে যেন উত্তর আকাশ বরাবর নেমে এলাম। নানা দেশের মানুষের ভিড়, জটলা, গোপন শূন্যতাকে উড়িয়ে দিচ্ছে বহুকণ্ঠ কোরাসের যৌথ সুর।
এই টাওয়ারে হয়তো জীবনে দ্বিতীয়বার আসা হবে না, লিফটে প্রতিটি ফ্লোর একবার করে ঢুঁ মেরে, ছবি তুলছি আর দেখছি কৌতূহলী চোখ। ওদের কত প্রশ্ন, কত বার্তা! মনে হলো, অনুভূতিকে আসলে কখনো বেঁধে রাখতে নেই। যখন নিচে অবতরণ করলাম, দেখলাম স্কাই ট্রি একসময় দিগন্ত পেরিয়ে অনেক দূর দেশে হারিয়ে গেল। অবশ্য উল্লসিত অনুভূতিতে এর আগেই ক্যামেরাবন্দী হয়েছিলাম।
সুকিয়াকি, ছবি: উইকিপিডিয়া
তখনো বেলা মাত্র তিনটা। সূর্যালোক অ্যাপার্টমেন্টের কাচ ছাদ ভেদ করে ঠিকরে ধুয়ে দিচ্ছিল পরিচর্যিত বাগানগুলো। কাজলদা বললেন, এবার বাসায় গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম তারপর তোমার জন্য শপিং করতে বেরোব। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে কাজলদা সিঁড়ি ভেঙেই রোজ রোজ অ্যাপার্টমেন্টের চারতলায় ওঠেন।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটা উপকারী ভেবে দুজনেই একসঙ্গে সিঁড়ি ভাঙছিলাম। এমন সময় ডাউন-স্টেয়ার্সে দেখা হলো ধূসর রঙের ওভারকোট পরা কোমিয়া নাসাকির সঙ্গে। তিনি কাজলদাকে মুচকি হেসে জাপানি ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, মিচিকো সাকুরাটা কে? কাজলদা ত্বরিত উত্তর দিলেন, কেন, কী হয়েছে? কোমিয়া নাসাকি বললেন, এক ব্যাগভর্তি পুতুল পাঠিয়েছে সঙ্গে একটি চিরকুট! কাজলদা আমার দিকে চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললেন—সারপ্রাইজ!
টোকিওর একটি পার্কে লেখক
চিরকুট পড়ে তিন জোড়া চোখের পাতা থেকে ছড়িয়ে পরে যে মুগ্ধতা, তাতে যেন পাখির ডানা ঝাপটানোর আনন্দ...আবার এ যেন সঠিক শব্দটা খুঁজে না পেয়ে কৃতজ্ঞতায় চোখের পাপড়ির নত হওয়ারও ইঙ্গিত!
একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস বিদায়ের মুহূর্তকে আলিঙ্গন করলে, ভাবি টোকিওর লালসূর্যটা কি হ্নদয় থেকে ডুব দিল? না! কোমিয়া নাসাকির থমথমে মুখখানা দেখে আমার চোখও ছলছল করে উঠল। মনেও কি ধড়ফড়? প্রতিটি বিদায় মুহূর্ত বুঝিবা এ রকম সঘন! কেমন এক ইন্দ্রজাল যেন ঘোরের মধ্যে থাকা একটি সপ্তাহ অল্পতেই ফুরিয়ে গিয়েও ফুরোল না! স্বর ভেঙে গেলে মুখ থেকে শব্দও বেরোয় না। ধীর পায়ে ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে ভিকট্রি চিহ্ন দেখালাম।
গেটের বাইরে এক মধ্যবয়স্ক নারী, সাদা ধবধবে কুকুরটাকে গলায় চেইন বেঁধে কোথাও নিয়ে যাচ্ছেন, তিনিও আমার চোখে চোখ রেখে কী যেন বোঝাতে চাইলেন। গোলাপি গালের অনিন্দ্যকান্ত কিশোরটি দুরন্ত গতির বাইসাইকেল থেকে নেমে বিদায়ী সম্ভাষণ জানাল।
বিমানবন্দরের ডিপারচার লাউঞ্জ, ছবি: উইকিপিডিয়া
একটা প্রবল দুলুনিতে বুঝলাম প্লেন উঠে গেছে ভূমি থেকে অনেক অনেক ওপরে। দেখছি, নিচে সারাটা জাপানের সবুজ জমিন মানচিত্রের মতো বিছিয়ে আছে। মাঝখানে ঐশ্বর্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফুজি পাহাড়ে। একসময় ঘুম পেয়ে গেল। কল্পনার তুলিতে এঁকে চলেছি নানা ছবি। সেসব ছবিতে যেন আমার আবারও জাপানে ফেরার গল্প। আমি আবারও আসব শিশিরের পালক ছুঁয়ে, চকচকে পালিশ করা জাপানি কালো বুটে হলুদ পাতা মাড়িয়ে, মিচিকো সাকুরাকে সঙ্গী করে প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে জাপান সাগরের গভীরতা পরখ করে, অসংখ্য ভক্তিপূর্ণ বৌদ্ধদের মোমের আলোয় শেষবারের মতো নিজের প্রার্থনাটুকু সেরে নিতে!
* লেখক: মোস্তফা মহসীন