What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Other অবিস্মরণীয় আজম খান (1 Viewer)

dfSr2C6.jpg


আজম খান কেবল একটি নাম বা একজন শিল্পী বা পপসম্রাট নন; বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে, বাংলা গানের সামাজিক–রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আজম খান একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা কোনোভাবেই উপেক্ষিত হতে পারে না। তাঁর প্রয়াণের আজ ১০ বছর।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি মন্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি বাংলা গান নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, বিশ শতকের বাংলা গানের ইতিহাস যাঁরা লিখবেন, তেহাত্তুর–চুয়াত্তর সালের একটা ঘটনার কথা তাঁরা কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারবেন না, বিশেষ করে একজন গায়কের কথা। তাঁর নাম আজম খান। কোনো অসাধারণ গায়ক নন আজম খান। কিন্তু এমন একধরনের গান তিনি সেকালে আমাদের শুনিয়েছিলেন, যে গান এ দেশে এর আগে কেউ শোনেনি।

গানগুলোর কথা, সুর, সঙ্গে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র, পরিবেশনের রীতি—সবই ছিল আলাদা। আমি সেই আলাদা, ব্যতিক্রম, ভিন্নধর্মী আজম খানের কথা স্মরণ করতে চাই। সেদিনের সেই তারুণ্য আজও প্রজন্মের কাছে ইতিহাস হয়ে আছে। বাংলা গান বা সপ্তবর্ণা অনুষ্ঠানের সঙ্গে যখন আমি, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজসহ অনেকে যুক্ত হলাম, তখন বাংলা গানের দৃশ্যপট পাল্টে গেল। দেশের তরুণসমাজকে এই গান মাতিয়ে তুলল।

F99wlnk.jpg


ছবিতে বাম থেকে গানের বন্ধু ফেরদৌস ওয়াহিদ ফকির আলমগীর, পিলু মমতাজ, ফিরোজ সাই এবং আজম খান, ছবি : ফেসবুক থেকে

হাজার হাজার উন্মাতাল তরুণ-তরুণী জড়ো হতে লাগল আমাদের সেই সময়ের কনসার্টে। উন্মাদনা, উদ্দীপনা, আনন্দে চিৎকার আর করতালিতে উন্মুখ করে তুলতে লাগল কনসার্ট অঙ্গন। এই নতুন গানের ঝাঁজ আর উত্তেজনার জ্বলন্ত উন্মাদনা যেন ঝাঁকি দিয়ে জাগিয়ে দেয় আমাদের যুগ যুগান্তর উপেক্ষিত ও অবদমিত তারুণ্যের উদ্যম আকুতিকে। তবে গানের ভুবনের এই বিস্ময়কর জাদুকর আজম খান বরাবরই ছিল সরল–সহজ অতিসাধারণ। জীবনে তাঁর বেশি কিছু চাওয়ার ছিল না, গানই ছিল তাঁর প্রাণ। কোনো অহংকার ছিল না তাঁর। সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। এই সাধারণ জীবনযাপনই তাঁকে অসাধারণ করে তুলেছিল মানুষের কাছে।

ইতিহাসের অনিবার্যতায় একজন আজম খানের জন্ম হয়েছিল। আজম খান ছিলেন এক জীবন্ত ইতিহাস। একদিকে সরল–সহজ সাদাসিধে, অন্যদিকে অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে যে ঘাটতি ছিল, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল সাহসী যোদ্ধা আজম খানের গানের মধ্যে। মানুষের সংকটের মুহূর্তে আজম খান তাঁর গানের মধ্য দিয়ে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কথা বলেছেন। সংগ্রাম আর ভালোবাসার মিশেলে তাঁর নতুন ধরনের পরিবেশনার মাধ্যমে সেদিন জেগে উঠেছিল তরুণেরা।

KgcBCY0.jpg


ফেরদৌস ওয়াহিদ ও ফকির আলমগীরের সঙ্গে আজম খান, ছবি : ফেসবুক থেকে

গান তাঁর কাছে কেবল আনন্দ-বিনোদন নয়, বরং গান ছিল তাঁর কাছে একজন যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধার কাব্যগাথা। সময়ের সাহসী সৈনিক আজম খান সেদিন যুদ্ধের হাতিয়ার স্টেনগান রেখে কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন সমাজ সচেতনতার গান। সব প্রতিকূলতা হটিয়ে তারুণ্যদীপ্ত সুরে তিনি শুরু করলেন গানের নতুন ধারা।
'রেললাইনের ওই বস্তিতে', 'হাইকোর্টের মাজারে', 'এত সুন্দর দুনিয়ায়', 'অভিমানী', 'অনামিকা', 'পাপড়ি', 'আলাল ও দুলাল', 'আসি আসি বলে তুমি আর এলে না', 'আমি যারে চাইরে', 'জ্বালা জ্বালা', 'ও চাঁদ সুন্দর', 'ও রে সালেকা ও রে মালেকা', 'জীবনে কিছু পাব না রে', 'বাধা দিও না'সহ বহু গান আজম খানের কণ্ঠে শুনেছে মানুষ। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ষাটের দশকে, তখন আমরা দুজনই ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য। দুজনই বাম রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলাম।

আজম খানের জন্ম আজিমপুরে ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আর আমার ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের ভাঙ্গার কালামৃধা গ্রামে। আজম খান আজিমপুরে জন্মগ্রহণ করলেও বেড়ে ওঠেন কমলাপুর আর আমি খিলগাঁওয়ে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, নিজামুল হক, মনিরুল আলম মনু ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা ষাটের দশকে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীতে যোগ দিই। মহান গণ–অভ্যুত্থানের পল্টন থেকে লালদিঘি ময়দান তথা গোটা বাংলাদেশে গণসংগীত পরিবেশন করেছি। দুই বন্ধু কৃষক সমিতির লাল টুপি মাথায় দিয়ে টঙ্গী সন্তোষ সাহাপুর মাওলানা ভাসানীর কৃষক সম্মেলনে অংশ নিয়েছি।

RZpz9fG.jpg


মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিকালে পরিবেশন করেছি অনেক গণসংগীত, যেমন 'বাংলার কমরেড বন্ধু', 'বিপ্লবের রক্তে রাঙা', 'জনতার সংগ্রাম চলবেই', 'হিমালয় থেকে সুন্দরবন', 'জয় বাংলা বাংলার জয়', 'সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা', 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো', 'ওরা আমার মুখের কথা', 'রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করলিরে বাঙালি', 'বিচারপতি তোমার বিচার', 'মানববন্ধনে', 'পথে এবার নামো সাথি', 'ওরা নাকি আমাদের', 'ঘুমের দেশে ঘুম ভাঙাতে', 'দাও দাও দুনিয়ার যত গরিব', 'রিকশাওয়ালা বলে কারে ঘৃণা করো'সহ অনেক গণসংগীত। শাহীন সামাদ, জাহিদুর রহিম বাবু ভাই, মাহমুদুর বেনু, ইকবাল আহমেদ, শিমূল ইউসুফসহ অনেকে গণসংগীতে কণ্ঠ মিলিয়েছেন। আবদুল লতিফ, আলতাফ মাহমুদ, শেখ রহমান, সুকান্ত চক্রবর্তী, খোকা দা, অজিত রায়, আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, মমিনুল হক, মনিরুল আলম, সাধন ঘোষ, সাধন সরকার প্রমুখ শিল্পী এবং সুরকার, গীতিকার আমাদের সহযোগিতা করেছেন। পপ সংগীতের অবিস্মরণীয় উত্থানের আগে আমি ও আজম খান গণসংগীতের শিল্পী ছিলাম, সংগঠক ছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দুই বন্ধু মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। আজম খান চলে যান আগরতলা মেলাঘর আর আমি চলে যাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। দুজনই ফিরে এসে পাশ্চাত্যের সঙ্গে দেশীয় সুরের মেলবন্ধনে সৃষ্টি করি আধুনিক এক ধারা। যার সঙ্গে যুক্ত হন ফেরদৌস, ফিরোজ, হাবলু, লাকী আখান্দ্‌, হ্যাপী আখান্দ্‌, পিলু মমতাজ, নিলু মুসা, ইশতিয়াক নয়ন, রকেট বাবু, সাইদুল দস্তগীর প্রমুখ।

oVQnDYa.png


আজম খান ও তাঁর দুই বন্ধু ফেরদৌস ওয়াহিদ এবং ফকির আলমগীর

আজম খান আমাদের মধ্যে নেই। নেই সংগীতের সাথিদের অনেকেই। বন্ধু হারানোর বেদনায় আকাশটা আজ কেবল মেঘাচ্ছন্ন। ২০১০ সালে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবে আজম খানের ৬০তম জন্মবার্ষিকী পালন করার স্মৃতিটা রয়ে গেছে। এর পরের বছর ২০১১ সালের ৫ জুন তিনি দেশবাসীকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে যান। এর আগে মরণব্যাধি ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে তিনি মৃত্যুর কাছে হার মানেন। কিংবদন্তিতুল্য এই পপসম্রাটের মৃত্যুতে সেদিন কেঁদেছিল বাংলার আকাশ–বাতাস। আজ মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই আর কামনা করি, বন্ধু আমার, তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো, শান্তিতে থেকো।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top