মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর মতে, আকাঙ্খা নতুন কাজের ক্ষুধা তৈরি করে, যে ক্ষুধা মানুষকে নিয়ে যায় তার লক্ষ্যে। তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন, সঙ্গে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রও।
বাংলাদেশের সিনেমা জগতের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নাম - মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ফারুকী যখন নাটক বানাতে এলেন তিনি জানতেন স্রোত কোনদিকে। তিনি মিডিয়ার এই কঠিন সমুদ্রে প্রথমেই নেমে গেলেন স্রোত যেদিকে যাচ্ছে তার উল্টো দিকে। তিনি হয়তো জানতেন না কতদূর যেতে পারবেন, তিনি তার লক্ষ্যতে স্থির ছিলেন। তার পূর্বসূরিরা যে পথে হেঁটেছে তিনি হাটলেন না সে পথে।
নব্বই এর পরবর্তী সময়ে যারা ছোটপর্দাকে সমৃদ্ধ করেছেন, তিনি তাদের সবার উপরে থাকবেন। নাট্যজগতে আলাদা একটা ধরন সৃষ্টি করেছিলেন। তার পূর্বসূরিদের পথ থেকে সরে গিয়ে পুরো ব্যাকরণ ভেঙে বানালেন প্রথম নাটক নির্মাণ করেন ১৯৯৯ সালে, নাটকের নাম 'ওয়েটিং রুম'। এরপর একে একে প্রত্যাবর্তন, আয়নামহল এর মতো বেশ কয়েকটি দর্শকনন্দিত নাটক নির্মান করেন।
ঢাকার নাখাল পাড়ায় বেড়ে ওঠা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী শুধু নাটক নিয়ে পড়ে থাকেন নি। ২০০৪ সালে 'ব্যাচেলর' সিনেমার নির্মাণ করে সারাদেশে নিজের নামকে পরিচিত করে দেন।
নাটক-সিনেমা নির্মাণের পাশাপাশি মোস্তাফা সরোয়ার ফারুকী তার নিজস্ব ঢঙে নাটক, চলচ্চিত্র নির্মাণের তাগিদে তৈরি করেন 'ছবিয়াল'নামে একটি সংগঠন। তিনিই এই সংগঠনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। হয়ে উঠেন 'বস'! বাংলাদেশের বর্তমান বেশিরভাগ ফিল্মমেকার থেকে শুরু করে নাটক/বিজ্ঞাপন, অভিনয় শিল্পী এরা 'বস' ফারকীর অনুরাগী এবং উনার হাত ধরেই এই জগতের এসেছেন। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে বাংলাদেশের সব পরিচালকের 'পরিচালক' ও বলা চলে।
২০১২সালে দেশে কাঁপানো 'টেলিভিশন' নাটকের মাধ্যমে ফারুকী কাজের ধরণ আগের সব কিছুকে ছাড়িয়ে চলে যায়। 'টেলিভিশন' নাটকে তার এই নিজস্ব ভাষা প্রয়োগ, নাটকে আমাদের ঘরে ব্যবহৃত ভাষা, নাটক না, মনে হইতাছে যা দেখাচ্ছে তা আমার চোখের সামনেই ঘটছে যা দর্শকদের কাছে খুব প্রিয় হয়ে উঠে।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর বেশ কয়েকটি অসাধারণ সিরিয়াল/নাটক নির্মাণ করেছেন, যা বাংলাদেশের নাটকের ফ্লেভার পরিবর্তন করে দেয়। ৫১ বর্তী, ৬৯, ৪২০, ক্যারাম, ঊনমানুষ, তাল পাতার সিপাহী, উপসংহার, বালকবালিকা মতো অসাধারণ কাজ করেন নাখালপাড়ার ডিরেক্টর।
ফারুকীর নাটক মানে বিশেষ পত্রিকার বিশেষ প্রচারণা, আলাদা আর্টিকেল, আলাদা স্টোরি, খ্যাতিমান সঙ্গী বর্তমান সাহিত্যিক আনিসুল হকের সাথে তার জুটিতে দর্শকরা পায় অসাধারণ সব কাজ। আনিসুল হকের রচনা, মোস্তাফা সরোয়ার ফারুকীর পরিচালনায় 'স্পার্টাকাস৭১', 'চড়ুইভাতি', 'কানামাছি' ও 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি'র মতো নন্দিত টেলিফিল্মের পাশাপাশি। বেশ কিছুদিন টেলিভিশনের পর্দায় না থাকলেও সর্বশেষ আনিসুল হকের 'আয়েশামঙ্গল' অবলম্বনে 'আয়েশা' নাটকটির মাধ্যমে পুনরায় টেলিভিশন পর্দায় ফিরেছেন তিনি। বরাবরের মতো এটিও পেয়েছে দর্শকপ্রিয়তা।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর চলচ্চিত্র যাত্রা : নাটক দিয়ে দর্শকের প্রিয় হলেও ফারুকী নিজেকে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে ভাবতেই ভালোবাসেন। ফারুকীর আছে নিজস্ব গল্প বলার ভঙ্গিমা। যে গুণটা তাকে আজকের উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। এখন পর্যন্ত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন সাতটি। তিনি ২০০৪ সালে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন 'ব্যাচেলর', এটাতে যেমন সম্পর্কের কথা বলেছেন, তারপরের ছবি 'মেড ইন বাংলাদেশে' দেখিয়েছেন পলিটিক্যাল স্যাটায়ারের দুর্দান্ত চিত্র। ২০০৮ সালে 'ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে' সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কারটি যায় এই ছবির ঝুলিতে।
'থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার' ২০০৯ সালে মুক্তি পায়। এই ছবি 'পুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব', 'রোটেরডেম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব', 'ফ্রাইবুর্গ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব', 'আবুধাবি চলচ্চিত্র উৎসবে' অফিসিয়াল সিলেকশনে ছিল। এছাড়াও ২০১০ সালে 'টিবুরন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব', 'জোগজা- নেপটেক এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভাল'– গোল্ডেন হ্যানোমেন অ্যাওয়ার্ডের জন্য নির্বাচিত হয় এটি। ২০১৪ সালে 'কেস উইক চলচ্চিত্র উৎসবে' প্রদর্শনীর পাশাপাশি ৮৩ তম অস্কারে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে এই ছবি। এরপর ২০১২ সালে 'টেলিভিশন', ২০১৩ তে 'পিঁপড়াবিদ্যা', ২০১৭ তে 'ডুব' প্রতিটি চলচ্চিত্রেই নতুন কিছু তুলে ধরেন তিনি। ২০১৪ সালে 'বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে' সমাপনী ছবি হিসেবে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয় 'টেলিভিশনে'র। সেবারই বুসানে 'এশিয়ান সিনেমা ফান্ড ফর স্ক্রিপ্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পোস্ট- প্রোডাকশন' এর পুরস্কার জিতে নেয় এটি।
সামনে নাখালপাড়া বস ফিল্মমেকার ফারুকীর পরিচালিত 'নো ম্যানস ল্যান্ড' আসবে। এই ছবিতে অভিনেতা হিসেবে থাকবেন বলিউডের অন্যতম জনপ্রিয় মুখ নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকী। পাশাপাশি তাহসান খান, নুসরাত ইমরোজ তিশা সহ ইন্টারন্যাশনাল আরও কয়েকজন তারকা।
'নো ম্যানস ল্যান্ড', ২০১৪ সালে– এশিয়ান স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডসে' এমপিএ ফিল্ম ফান্ড এবং গোয়াতে অনুষ্ঠিত 'ফিল্ম বাজার ইন্ডিয়া'য় 'মোস্ট প্রমিসিং প্রজেক্ট' হিসেবে জয় করে নিয়েছে তহবিল। একই সালে 'বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে' এটি ছিল এশিয়ান প্রজেক্ট মার্কেটের অফিসিয়াল প্রজেক্ট।
বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি যোগ করেছেন নতুন ধারা।মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর মতে, আকাঙ্ক্ষা নতুন কাজের ক্ষুধা তৈরি করে, যে ক্ষুধা মানুষকে নিয়ে যায় তার লক্ষ্যে। তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন, সঙ্গে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রও। দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তার পদচারণা আস্তে আস্তে দৈর্ঘ্য হচ্ছে।