হোম অ্যালোন টু তে প্লাজা হোটেলে ছোট্ট কেভিনকে তিনি অভ্যর্থনা ডেস্কের পথ দেখিয়েছিলেন। এর আগে এসেছিলেন প্রো রেসলিং প্রতিষ্ঠান "WWE" তে। তখনও যদি জিজ্ঞেস করা হতো বছর বিশেক পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন সেই মানুষটি, তার পক্ষে বাজি ধরার জন্য কাউকে পাওয়া দুষ্কর হতো। কিন্তু সবকিছুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ব্যবসায়ী থেকে তিনি হয়ে গেলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। বলছিলাম, ট্রাম্প টাওয়ার থেকে হোয়াইট হাউসের রক্ষাকর্তা বনে যাওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা।
শরীরে যার জার্মান রক্ত
অভিবাসীদের নিয়ে বেশ কঠোর ট্রাম্পের পূর্বপুরুষরাও বলতে গেলে অভিবাসীই ছিলেন। ট্রাম্পের পিতামহরা জার্মানি থেকেই এসেছেন মার্কিন ভূখন্ডে। তার পিতামহ ফ্রেডেরিক ট্রাম্পের জার্মানিতে ক্লোনডিক গোল্ড রাশ নামের একটি রেস্তোরাঁ ছিল। সম্ভবত এইজন্যই ট্রাম্পের নিজের চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রেও জার্মান একরোখা আর জেদি ভাব দেখা যায়। ১৮৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন ফ্রেডেরিক ট্রাম্প। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিবারের আসল পদবি ছিল মূলত 'ড্রাম্পফ'। যদিও ১৭শ শতকে কোন এক ভুলে ড্রাম্পফ হয়ে যায় ট্রাম্প। ১৯৮৭ সালে এক বইয়ে অবশ্য ডোনাল্ড ট্রাম্প লিখেছিলেন তারা সুইডিশ বংশোদ্ভূত। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি স্বীকার করেছিলেন যে তার পূর্ব-পুরুষরা আসলে জার্মান বংশোদ্ভূত এবং তারা ১৮৯৯ সালে নিউইয়র্ক শহরে জার্মান-আমেরিকান স্টুবেন প্যারেডে সেনাবাহিনীর গ্র্যান্ড মার্শাল হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৪ জুন, ১৯৪৬ সালে নিউইয়র্কের কুইন্সে জন্মগ্রহণ করেন। ট্রাম্প তার পিতা-মাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে ৪র্থ ছিলেন। তিনি কুইন্স, নিউইয়র্কের জ্যামাইকা এস্টেটে তার ছাত্র জীবন কাটিয়েছিলেন। ট্রাম্প পরিবারের দোতলা বিশিষ্ট মক ট্যুডোর রিভাইভাল আদলে একটি বাড়ি ছিল যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার শৈশবের দিনগুলো পার করেন।
ম্যানহাটনের অভিজাত এলাকায় দাঁড়িয়ে আছে ৬৮তলা ট্রাম্প টাওয়ার; Photo: Mark Reinstein/ Getty Images
ছাত্র জীবন
ডোনাল্ড ট্রাম্প কিন্ডার গার্টেন থেকে সপ্তম গ্রেড পর্যন্ত পরেছেন কিউ-ফরেস্ট স্কুলে। সাধারণ আর দশজন বাচ্চার তুলনায় শৈশবে ট্রাম্প অনেক বেশি উদ্যমী ছিলেন। এমনকি শারিরীক সক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। একারণেই ১৩ বছর বয়সে তার বাবা-মা তাকে নিউইয়র্কের সামরিক একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন। ১৯৬৪ সালে ট্রাম্প ভর্তি হন ফোর্ডহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর দুই বছর পর তিনি পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হন। ১৯৬৮ সালে পেনসেলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ট্রাম্প।
ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প
পেসসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন হোয়ারটন স্কুলে অধ্যয়নের সময় ট্রাম্প তার বাবা ফ্রেড ট্রাম্পের 'এলিজাবেথ ট্রাম্প এন্ড সান' প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। ১৯৬৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি পুরোপুরিভাবে পিতৃ প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন। ১৯৭১ সালে ট্রাম্প এই প্রতিষ্ঠানের সমস্ত ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন এবং সে-বছরই তিনি প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে "দ্য ট্রাম্প অর্গানাইজেশন" রাখেন। প্রেসিডেন্সির বাইরেও ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের রিয়েল স্টেট ব্যবসার সবচেয়ে বড় একটি নাম।
চেয়ারম্যান হবার পরেই তিনি সবার আগে ম্যানহাটানের কাছে তার কোম্পানিকে স্থানান্তরিত করেন। ম্যানহাটনেই আমেরিকার উচ্চবিত্ত সমাজের বড় একটি অংশের বসবাস। এখানে এসেই ধনাঢ্য আর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে ট্রাম্পের সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে। তিনি বুঝতে পারেন, শুধু সম্পর্ক গড়লেই হচ্ছে না, বরং তার সাথে সাথে সুউচ্চ বিল্ডিং প্রকল্পে যোগদান করতে হবে, যা উচ্চ মুনাফা অর্জন এবং জনসাধারণের স্বীকৃতি অর্জনের সুযোগ করে দেবে। তবে এক পর্যায়ে তিনি দেউলিয়া হতে বসেছিলেন। ট্রাম্প টাওয়ার এবং ৩ টি ক্যাসিনো ছাড়া সবই প্রায় হাতছাড়া হয়। তবে সেখান থেকে ফিরেও এসেছিলেন তিনি।
টেলিভিশন উপস্থাপক, প্রযোজক হিসেবেও ট্রাম্প ছিলেন সফল।
মিডিয়া জীবন
ট্রাম্প ২০০৩ সালে এনবিসি টেলিভিশনে রিয়ালিটি শো "অ্যাপ্রেটিস" এর নির্বাহী প্রযোজক এবং উপস্থাপক হিসেবে সবার সামনে আসেন। পরবর্তীতে "দ্য সেলিব্রিটি অ্যাপ্রেটিস" নাম দিয়ে আর একটি তুমুল জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের সহউপস্থাপক হিসেবে কাজ করেন তিনি। এই অনুষ্ঠানে সেলিব্রিটিরা স্থানীয়দের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তাদের দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ জোগাড় করতো। যদিও মিডিয়া জগতে ট্রাম্পের উপস্থিতি আরও আগে থেকেই ছিল। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি মিস ইউনিভার্স, মিস ইউএস সুন্দরী প্রতিযোগিতার স্বত্বাধিকারী ছিলেন। আর ওয়ার্ল্ড রেসলিং ইন্টারটেইনমেন্টে (WWE) এ ট্রাম্পের উপস্থিতি সেই ৮০'র দশক থেকেই। উপস্থাপনা ও প্রযোজনার পাশাপাশি ট্রাম্প মোটে ৮টি চলচ্চিত্রে ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
ট্রাম্প টাওয়ার থেকে হোয়াইট হাউসে
১৯৯৯ সালে রিফর্ম পার্টির হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রথম রাজনৈতিক মঞ্চে আসেন ট্রাম্প। জুলাই ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির মনোনীত প্রার্থী জর্জ ডব্লিউ বুশের বিরুদ্ধে মাঠে নামেন। যদিও পরে তা প্রত্যাহার করেন। তবে সেবার না হলেও সামাজিক সংশ্লিষ্টতা দিন দিন বাড়াতে থাকেন। ১৬জুন, ২০১৫ তারিখে তিনি ম্যানহাটানের ট্রাম্প টাওয়ারে রাষ্ট্রপতির প্রার্থী হওয়ার জন্য তার প্রার্থীতা ঘোষণা করেছিলেন। অবৈধ অভিবাসন, আমেরিকান চাকরির বন্ধন, মার্কিন জাতীয় ঋণ এবং ইসলামী সন্ত্রাসবাদের মতো ঘরোয়া বিষয়গুলিতে মনোযোগ আকর্ষণ করে তিনি খুব দ্রুত সাধারণ মার্কিনী আর বিশ্বের মিডিয়ার সামনাসামনি চলে আসেন। তার স্লোগান ছিল, "মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন"। হাউস স্পিকার পল রায়ান সহ আরো সব বড় রিপাবলিকান নেতারা তার সমর্থক ছিলেন।
১৭ জন রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁদের প্রচারনা স্থগিত করার পর ট্রাম্প তাঁর প্রার্থিতা ঘোষণা করেন। ট্রাম্প এক নির্বাচনেই বড় সব রেকর্ড ভেঙে দেন। তিনি ২৮ বছরে রিপাবলিকান দলের সর্ববৃহৎ ইলেকটোরাল কলেজ জয় লাভ করেন। তিনি সারা দেশে ২,৬০০ এর বেশি কাউন্টিতে জয়লাভ করেন, যা ১৯৮৪ সালে প্রেসিডেন্ট রিগানের পর সবচেয়ে বেশি। এছাড়া তিনি জনপ্রিয়তার ভোটে ৬২ মিলিয়নের বেশি ভোট পান। আমেরিকা প্রতিষ্ঠার পর রিপাবলিকানদের মধ্যে যা ছিল সর্বোচ্চ। তিনি ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট পান, ১৯৮৮ সালে জর্জ এইচ ডাবলিউ বুশ সিনিয়ারের পর যা সবচেয়ে বেশি ছিল। দেশ পুনর্গঠন এবং স্থিতাবস্থা ভেঙ্গে ফেলা সংক্রান্ত তার বার্তা বেশ বড় প্রভাব রেখেছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি ৮ নভেম্বর, ২০১৬ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হন এবং গণতান্ত্রিক প্রতিপক্ষ হিলারি ক্লিনটন বিরুদ্ধে বিস্ময়কর বিজয় লাভ করেন।
বিখ্যাত রেসলার স্টিভ অস্টিনের সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্প
এখানে বলা দরকার ডোনাল্ড ট্রাম্প সেইসব জায়গায় নির্বাচনী প্রচারনা চালিয়েছেন, যেগুলোয় রিপাবলিকানদের জয়লাভ কঠিন বলে ধারণা করা হত। ফ্লিন্ট, মিশিগান, ক্লিভল্যান্ডের স্বল্প-আয়ের অধিবাসীদের চার্টার স্কুল এলাকা এবং ফ্লোরিডার হিস্পানি চার্চ এসবের মতো জায়গায় ডেমোক্র্যাটদের ধরাশায়ী করেন তিনি। আধুনিক বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে সমৃদ্ধি আনার ব্যাপারে তাঁর লক্ষ্যের কারণে লাখ লাখ নতুন রিপাবলিকান সমর্থক তৈরি করেন ট্রাম্প। এর ফলে রিপাবলিকান সমর্থন বলয়ে প্রবেশ করা নতুন নতুন এলাকায় ভালো ব্যবধানে জিতেছেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবন
ট্রাম্প ২০০৫ সালের জানুয়ারীতে মেলানিয়া কানাসকে বিয়ে করেন। এটি ছিল তার ৩য় বিয়ে। এই ঘরে ট্রাম্পের রয়েছে ব্যারন উইলিয়াম ট্রাম্প নামের এক পুত্র সন্তান। তার আগের দুই সম্পর্ক বিবাহ বিচ্ছেদ দিয়ে শেষ হয়। ১৯৯২ সালের মার্চে ১৫ বছরের দাম্পত্য শেষে প্রথম স্ত্রী ইভানা জেলনিকোভার সাথে সম্পর্কের ইতি টানেন। প্রথম স্ত্রীর ঘরে ডোনাল্ড জুনিয়র, ইভাঙ্কা, এরিক নামের তিন সন্তান রয়েছে। ১৯৯৩ সালে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন মার্লা ম্যাপলসকে। যার বিচ্ছেদ হয় ১৯৯৯ সালের জুন মাসে। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে জন্ম নেয়া ট্রাম্পের কন্যা সন্তানের নাম টিফানি। তবে এসবের বাইরেও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বেশ বড় কিছু যৌন হয়রানির অভিযোগ ছিল।