পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির উপকথায় অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে ইউনিকর্ন! আমরা যাকে চিনি ময়ূরপঙ্খী ঘোড়া হিসেবে। প্রাচীন গ্রীস থেকে ভারত, মেসোপটেমিয়া থেকে চীন- সব যায়গায় কল্পকাহিনীতে ইউনিকর্ন এর অস্তিত্ব আছে। এমনকি বিখ্যাত পন্ডিতেরাও ইউনিকর্নের অস্তিত্তে বিশ্বাস করতো।
ইউনিকর্ন আসলে কি?
ইউনিকর্ন হচ্ছে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন পৌরাণিক প্রাণী। এদের গতির সাথে আলোর গতির সাথে তুলনা করা যায়! এরা সাধারণ সময়ে শান্ত ও পবিত্র থাকে। তবে প্রয়োজনের সময় প্রচণ্ড বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। শক্তি দিয়ে কখনও ইউনিকর্নকে আটক করা যায় না, এদের বশ করতে হয় বুদ্ধি দিয়ে!
ইউনিকর্ন দেখতে কেমন?
সাধারণ বর্ণনা মতে, ইউনিকর্ন সাদা বড় ঘোড়ার মতো দেখতে এরা। ঠিক কপালের মাঝখানটাতে আছে একটা লম্বা শিং। গ্রীক চিকিৎসক ও ঐতিহাসিক টিসিয়াস বলেছেন- এই প্রাণী বুনো গাধার মতো দেখতে। আলোর গতির মতো দ্রুত চলে। শিংগুলো সাদা, লাল কিংবা কালো হতে পারে। প্রায় কাছাকাছি বর্ণনা দেন এরিস্টটল। বিখ্যাত পরিব্রাজক মার্কো পলো বলেছেন ইউনিকর্ন আকারে হাতির মতো। মাথার মধ্যখানে কালো শিং আছে। প্রাণীটা বেশিরভাগ সময় কাদাতে থাকতে পছন্দ করে। অনেকেই মনে করেন মার্কো পোলো আসলে গন্ডার দেখে ইউনিকর্ন ভেবেছিল!
ইসলাম ধর্মে বর্ণীত – বোরাক ঘোড়া
ইসলাম ধর্মে বেহেশতি জীব হিসেবে অলৌকিক বোরাক ঘোড়ার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যে ঘোড়া এতো দ্রুত পদক্ষেপ ফেলতো যা কোনো প্রাণীর চোখে দেখা সম্ভব ছিল না। আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) সেই ঘোড়ায় চড়েছিলেন যা মিরাজের কাহিনীতে বর্ণনা করা আছে। হাদিসে বলা হয়েছে-
" তখন খচ্চর অপেক্ষা ছোট কিন্তু গাধা অপেক্ষা বড় একটি সাদা প্রাণী আমার কাছে আনলো।" প্রাণীটি এতো দ্রুত পদক্ষেপ ফেললো যা কোনো প্রাণীর চোখে দেখা সম্ভব না। " – মোহাম্মদ আল-বুখারী, সহী আল-বুখারী
বিভিন্ন হাদিসে বর্ণনা অনুযায়ী বোরাক ঘোড়ার বৈশিষ্ট্য অনেকটা ইউনিকর্নের সাথে মিলে যায়।
বিভিন্ন দেশের প্রচলিত উপকথায় ইউনিকর্ন
চীনা উপকথায় ইউনিকর্নকে বলা হয়েছে কি-লিন। কি-লিনের শরীর দেখতে হরিণের মতো কিন্তু মাথাটা সিংহের। জাপানি উপকথায় ইউনিকর্নকে বলা হয়েছে কিরিন। আর গ্রিকরা বলতো কাইমেরা। এই তিন অঞ্চলের ইনিউকর্নের বর্ননায় অনেক মিল রয়েছে। এদের শান্তিপ্রিয় এবং অলৌকিক হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। চলাচল করে মেঘ কিংবা পানির উপর দিয়ে। প্রচলিত উপকথায় ইউনিকর্নের মত প্রচলিত রয়েছে মৎস্যকন্যার কথা। প্রাচীন গ্রীস থেকে ভারত, মেসোপটেমিয়া থেকে চীন, এমনকি বাংলাদেশের লোককথায় মৎস্যকন্যা নিয়ে রয়েছে অসংখ্য কল্প কাহিনী।
আফ্রিকান সংস্কৃতির কঙ্গো উপকথায় আবাদা নামে ইউনিকর্নের মতো এক প্রাণীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এরা আকারে গাধার মতো এবং লেজ শূকরের লেজের মতো। দক্ষিণ আমেরিকার চিলির উপকথায় ক্যামাহুয়েতো (kamahuyeto) নামে এক প্রাণীর কথা বলা হয় যা অনেকটা ইউনিকর্নের মতো দেখতে। এছাড়া ইরানের প্রাচীন নগরী পার্সিপোলিসে ইউনিকর্নের ভাস্কর্য পাওয়া গেছে, যা থেকে বোঝা যায় আরবেও ইউনিকর্ন নিয়ে বিশ্বাস ছিলো।
ইউরোপিয়ানরা মনে করতো ইউনিকর্নরা কুমারি মেয়েদের ভালোবাসে। নির্জনে কোন সুন্দরী কুমারি মেয়ে একা বসে থাকলে ইউনিকর্নরা তাদের কাছে আসে। মেয়েদের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়। এই সময় তাদের ধরা সম্ভব হয়। এই নিয়ে মধ্যযুগের ইউরোপিয়ান সাহিত্যে অনেক কাহিনী ও উপাখ্যান লেখা হয়েছে।
ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত রূপকথায় ইউনিকর্নের অস্তিত্ব আছে। এই অঞ্চলে ইউনিকর্নকে বলা হয় ময়ূরপঙ্খী ঘোড়া। এই ধরণের ঘোড়ার দুটি পাখা যা দিয়ে এরা দ্রুত গতিতে উড়ে আসতে পারে। প্রাচীন আমলের রাজপুত্রদের ঘোড়ায় চড়ে রাজকন্যাকে বিয়ে করতে আসতো। তারপর সেই ঘোড়ায় করে নিয়ে যেত নিজের রাজ্যে।
সত্যিই কি পৃথিবীতে ইউনিকর্নের অস্তিত্ব ছিল?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- সত্যিই কি পৃথিবীতে ইউনিকর্নের অস্তিত্ব ছিল? যদি নাই থাকবে, তাহলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের উপকথাতে কীভাবে এই প্রাণীর অস্তিত্বের কথা বলা হলো? বিজ্ঞানীদের ধারণা যে সম্ভবত ইউনিকর্নের মতো দেখতে এক ধরনের প্রাণী পৃথিবীতে আসলেই ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে এরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে এদের নাম!