What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Review ডুবসাঁতারে মন মজেনি… (1 Viewer)

Nagar Baul

Board Senior Member
Elite Leader
Joined
Mar 2, 2018
Threads
1,152
Messages
13,339
Credits
547,766
Pen edit
Sailboat
Profile Music
xYHKNSd.jpg


ডুব
পরিচালক : মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
অভিনয়ে : ইরফান খান, নুসরাত ইমরোজ তিশা, রোকেয়া প্রাচী, পার্নো মিত্র, অশোক ধানুকা
রেটিং : ২/ ৫

'জীবন মানে যন্ত্রণা, নয় ফুলের বিছানা, সে কথা সহজে কেউ মানতে চায়না'-এখনই সময় চলচ্চিত্রের গান। খুব আফসোস নিয়ে বলতে হচ্ছে, এ গানের কথার মত আজকাল দেশের অনেক নির্মাতা এবং তার ভক্ত-অনুসারীরাই নিজেদের সমালোচনা নিতে পারছেন না।

সদ্য মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র ডুব এর ইংরেজি নাম নো বেড অফ রৌজেস। অর্থাৎ নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও বিশ্বাস করেন জীবন সাজানো ফুলের বাগান নয়। তারপরও এ ছবিটি মুক্তির পর দর্শকরা ছবির সমালোচনায় মুখর হলে তাদের বলা হচ্ছে 'নাবালক'। বলা হচ্ছে ডুব সাধারণের বোঝার ছবি নহে। ইহা বিষাদের কাব্য। ডুব বুঝিতে হইলে বিশেষ শ্রেণীর মস্তিষ্ক থাকা বাঞ্ছণীয়। আমি আমজনতা'র প্রতিনিধিত্বকারী। সাবালক কবে হতে পারবো, ওপরওয়ালা জানেন। আমি শুধু জানি, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে আমার পছন্দের ছবি-মাটির ময়না, মনপুরা, গেরিলা, অজ্ঞাতনামা, আয়নাবাজি ইত্যাদি। এ ছবিগুলো আমাকে একইসাথে বিনোদিত করেছিল। সেই সঙ্গে আলোড়িত করেছিল আমার মনন'কে। এই ছবিগুলো দেখবার সময় আমি আশেপাশের দর্শকদের নাক ডাকার শব্দ শুনিনি। পর্দা নেমে যাবার পর দর্শকদের বলতে শুনিনি ছবির মাথামুন্ডু কিছুই তো বুঝলাম না, এটি নাটক না সিনেমা?

তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, মুক্তির প্রথম দিন ডুব দেখবার পর দর্শকের এরকম অসংখ্য অভিযোগ আমি শুনেছি। ছবিটি দেখে এতটাই হতাশ হয়েছিলাম যে, পরবর্তী তিন দিন এই জনমানবপূর্ণ সমাজে ভাসতে পারিনি। ডুব জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম। প্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ-এর জীবনী নিয়ে গল্প রচনা হয়েছে-ছবি মুক্তির আগে যে মহা প্রচারণার ডামাডোল বাজানো হয়েছিল, সেই ভাবনা আমার মাথা চিবিয়ে খাবার জন্যই হয়তো ডুব ভালো লাগেনি। হয়তো সেরকম ভাবনা মাথায় না এনে স্বাধীনভাবে দেখলে ডুবসাঁতারে মন মজাতে পারতাম-এ ভাবনা থেকে গত সোমবার দ্বিতীয়বারের মত আমি ডুব দর্শনে যাই।

মনের জানালা খুলে, চোখের দরজা অর্থাৎ পলক না ফেলে অতি মনোযোগের সাথে অবলোকন করি নির্মাতা ফারুকীর ৬ষ্ঠ চলচ্চিত্র। তবে ছবি শেষ হবার পর কষ্ট হয়; আমার বুঝি আর কখনো সাবালক হওয়া হবে না! সর্বভুক আমার এই চলচ্চিত্র মন'কে প্রশ্ন করি, শেক্সপীয়রের ম্যকবেথ, ওথেলো, হ্যমলেট নিয়ে নির্মিত বিশাল ভরদ্বাজের হিন্দি ছবি মকবুল, ওমকারা, হায়দার-ও তো আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সে ছবিগুলোর গতিও মন্থর ছিলনা। সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত থেকে তাইওয়ানের পরিচালক হাউ সিয়াও সিয়েন-সবার ছবিই তো কম বেশি দেখেছি। তাদের ছবি দেখে কখনো নিজেকে নির্বোধ মনে হয়নি। তবে শামুকের চেয়েও ধীর গতির বিষাদের কাব্য ডুব কেন আমার মন ছুঁয়ে যেতে পারলো না? কেন ছবির গল্প, চরিত্র, নির্মাণ-সবকিছু ঝাপসা হয়ে আমার কাছে ধরা দিল? অনেকেই বলছেন, ডুব ছবির মাধ্যমে দেশীয় চলচ্চিত্রে নতুন এক ভাষার আমদানী করলেন পরিচালক। এ ভাষা বুঝতে হলে অনেক পড়াশোনা করতে হবে। অন্য ধরনের চোখ থাকতে হবে। বিশ্ব চলচ্চিত্রের অনেক নামকড়া পরিচালকদের ছবি দেখতে হবে। যারা এ ধরনের কথা বলছেন তাদের কাছে প্রশ্ন, সাধারণ আমজনতাকে কি একটু মাফ করে দেয়া যায় না? কষ্টার্জিত টাকা খরচ করে ট্রাফিক জ্যম ঠেলে মূল্যবান ১ ঘন্টা ৪৩ মিনিট প্রেক্ষাগৃহে খরচ করাটাও কি যথেষ্ট নয়? পড়াশোনা করে, বুদ্ধিজীবী হয়ে নিজের ভাষায় নিজের দেশের একটি চলচ্চিত্র দেখতে হবে? যে চলচ্চিত্র মুষ্টিমেয় দর্শকের মনকে স্পর্শ করে বেশিরভাগ দর্শককে নিথর করে রাখে, সে চলচ্চিত্রকে কি কোনো দিক দিয়ে সফল বলা যায়? বাংলা ভাষায় বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হলে সার্বজনীন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে, যা অতীতে করে গেছেন জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, আলমগীর কবির, মাসেহ উদ্দিন শাকের, শেখ নিয়ামত আলী, মোরশেদুল ইসলাম থেকে তারেক মাসুদ, এমনকি সাম্প্রতিককালে অমিতাভ রেজা, তৌকীর আহমেদ সহ আরো অনেকে।

U8CyOrV.jpg


মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নিঃসন্দেহে একজন মেধাবী নির্মাণশিল্পী। তাকে এবং তার সৃষ্টি ডুব চলচ্চিত্রকে একটি ব্যাপারে কুর্নিশ করতেই হয়। যেখানে ঢাকাই চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক দর্শকই উন্নাসিক থাকেন, সেখানে এই একটি চলচ্চিত্র মুক্তির আগে এবং পরে দর্শকদের ভাবিয়েছে। আমি দেখেছি এই একটি চলচ্চিত্র অতি ভালো এবং অতি খারাপ লাগার কারণে অনেকের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কেরও পতন হয়েছে। দীর্ঘদিনের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার সম্পর্ক মুহূর্তেই সামাজিক মাধ্যমে ব্লক হবার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে শুধুমাত্র এই একটি চলচ্চিত্রের কারণে। পরিস্থিতি অনেকটা সুকুমার রায়ের ছড়ার মতন, 'আমরা সবাই লক্ষ্মী ভীষণ, তোমরা সবাই হিংসুটে'। কেন আমরা ধরেই নেবো, আমি যা করি যা বলি তার সঙ্গে সবাই একমত হবে? ভালো রিভিউ পড়ে ছবি দেখতে যাওয়া যদি ঠিক হয়, তাহলে খারাপ রিভিউ পড়ে কেউ ছবি দেখতে না গেলে আমরা কি তাকে দোষ দিতে পারি? অবশ্যই ডুব আমরা সবাই দেখবো। তবে যারা দেখবেন না কিংবা ছবির ভালোটা না বলে খারাপটা বলবেন, তাদেরকে অশ্রদ্ধার চোখে দেখা/ ব্লক করা কি ছেলেমানুষী নয়? এটা কেন আমরা ভাবছিনা, দুলাভাই জিন্দাবাদ ছবিতে কি করে গরুকে দিয়ে সংলাপ বলিয়ে অভিনয় করানো হয়েছে কিংবা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ছবিতে অনন্ত জলিল কি করে নিজের হার্ট বের করেছে কিংবা সাফটা চুক্তির আওতায় কেন মাস্তানী'র মত অখাদ্য ছবি ভারতে পাঠানো হচ্ছে-এসব নিয়েও কেউ মাথা ঘামায়না, অথচ ডুব কেন আমাদের প্রিয় চলচ্চিত্র হতে পারলোনা-এটি নিয়ে অনেকে সোচ্চার; কারণ মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং তার শিল্পী-কলাকুশলীদের কাছ থেকে এখনো আমরা প্রত্যাশা করি। ভালোবাসুন অথবা ঘৃণা করুন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে গণনায় ধরতেই হবে।

ডুব দেখে নিজেকে সমালোচকের আসনে বসিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব হয়েছেন। অবশ্য এটিকেও নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছেন অনেকে। দর্শকরা সরলভাবে তাদের ভালো লাগা-খারাপ লাগার কথা জানাতেই পারেন। এই অংশগ্রহণকে সাধুবাদ জানানো উচিত। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। যেমন ছবির অন্যতম প্রধান অভিনেত্রী তিশাকে আমি জানিয়েছিলাম, 'তিশা, ডুব আমার ভালো লাগেনি। তোমাকে আরো ভালো ছবিতে দেখতে চাই।' প্রত্যুত্তরে তিশা জানিয়েছিলেন, 'পৃথিবীর কোনো শিল্পকর্মই সবার মন যোগাতে পারেনি। হয়তো পরবর্তী কাজটি ভালো লাগবে। এটাই জীবন। আহারে জীবন'। তিশা বুঝলেও আজকাল সমালোচনা লিখে আমি অনেকেরই শত্রু তালিকায় স্থান পাচ্ছি। একটি শিল্পকর্ম নিয়ে নানা মুনির নানা মত হতেই পারে। তবে সমালোচকের ওপর ব্যক্তিগত আক্রোশ জন্ম নেয়া সাবালকের কাজ নয়।

ডুব-এর চিত্রনাট্য মোটামুটি এই ছকে আঁকা: প্রথম জীবন। একটি পরিবার। পরকীয়া। অতঃপর স্ত্রী ও সন্তানদের ডিভোর্স (সাবেরীর সংলাপ: বাবা তো আমাদের সবাইকে ডিভোর্স দিয়েছে)। দ্বিতীয় জীবন। মৃত্যু। আত্মোপলব্ধি। প্রথমবার ডুব দেখবার সময় প্রতিটি চরিত্রের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। এসব চরিত্রের প্রকাশ পাই, কিন্তু তার বিকাশ হয়না। মায়ার সঙ্গে জাভেদ হাসানের কোন জায়গায় মিলছে না, স্পষ্ট নয়। নীতু কেন জাভেদ হাসানের ওপর অনুরক্ত, স্পষ্ট নয়। জাভেদ কেন ঘর ছাড়লেন, কেন বিয়ে করলেন, কেন মারা গেলেন-কিছুই স্পষ্ট নয়। বারবারই মনে হয়েছে, বাস্তব জীবনের খন্ড খন্ড চিত্র জোড়া লাগিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের চেষ্টা করা হয়েছে। নির্মাতা হয়তো নিশ্চিত ছিলেন, দর্শক তো জানেই সব। অহেতুক এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কি দরকার? আর এ কারণেই আমরা দর্শকরা এ ছবিতে নতুন কিছু পাইনি। নতুন কোনো গল্প পাইনি। নির্মাতা বা চিত্রনাট্যকারের প্রধান কাজ তার সৃষ্ট চরিত্র বিশ্বাসযোগ্যভাবে দর্শকের সামনে তুলে ধরা। অথচ এ ছবিতে জাভেদ-মায়া কিংবা জাভেদ-নীতু কারো সম্পর্কই পরিষ্কার নয়। এ কারণেই হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুর পর নাওয়া খাওয়া ভুলে গেলেও জাভেদ হাসানের চলে যাওয়া এতটুকু চোখ ভেজাতে পারেনি আমাকে। সাবেরী কিংবা মায়া'র আবেগ ছুঁতে পারেনি আমার মন।

নির্মাতা এবং তার ভক্ত-অনুসারীরা দাবী করেছেন, ছবিটি প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক নয়। আমিও বলবো, অবশ্যই ডুব হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক নয়। জাভেদ হাসান (ইরফান খান) হুমায়ূন আহমেদের মত হাঁটেন না। কথা বলেন না। এ ছবির মায়া গুলতেকিন খান নন, সাবেরী শিলা আহমেদ নন, নীতু মেহের আফরোজ শাওন নন, আহীর নুহাশ নন, নয়নতারা নুহাশ পল্লী নয়। তবে বুকে হাত দিয়ে কি কেউ বলতে পারবেন, ডুব হুমায়ূন আহমেদ-এর ব্যক্তিজীবনের বহুল চর্চিত ঘটনাগুচ্ছের অনুপ্রেরণায় নির্মিত নয়? যদি তাই হয় এ ছবির শুরুতে কেন প্রবোধ দেয়া হলো, ছবির প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক, জীবিত বা মৃত কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই? সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত-এমনটিও তো বলা যেত।

ujBCj9Q.jpg


বারবার একটি কথাই জানতে ইচ্ছে করেছে, এই সুন্দর পৃথিবীতে এত গল্প থাকতে হুমায়ূন আহমেদ-এর দ্বিতীয় বিয়ে, দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বব্যাপী দর্শকদের পরিচিত করার ব্যাপারে নির্মাতার এত আগ্রহ কেন? তাছাড়া দ্বিতীয় প্রেম, দ্বিতীয় স্ত্রী কিংবা ততোধিক সংসার কি হুমায়ূন আহমেদ একাই করেছিলেন? পৃথিবীর আর কোনো কিংবদন্তীর চরিত্রে কোনো দাগ নেই? অন্য কোনো ভুল নেই? তারা সবাই কি নিষ্কলঙ্ক ছিলেন? আমরা সবাই যেহেতু রক্তে মাংসে গড়া মানুষ, আমাদের সবারই ভুল হবে। কিন্তু তাই বলে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের সুপরিচিত এবং বিতর্কিত গল্পকে পণ্য করে একপেশেভাবে আমি চলচ্চিত্রের জন্য গল্প বুনবো? নিজের ব্যক্তিগত রায় একপেশেভাবে বিশ্বব্যাপী দর্শকদের জানাবো? কিংবদন্তী অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি প্রসঙ্গে কোনো প্রশ্ন করা হলে অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা সবসময়ই বলেন, 'ব্যক্তি কিংবা স্বামী ফরীদিকে নিয়ে আমার কিছুই এখন আর বলার নেই। হুমায়ূন ফরীদির স্বপক্ষে অবস্থান নেবার মত যেহেতু পরিস্থিতি নেই, চলুন আমরা ব্যক্তি নয়, অভিনেতা ফরীদিকে নিয়েই কথা বলি।' সুবর্ণা মুস্তাফার মত করে যদি মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও ভাবতেন, তাহলে মৃত্যুর পাঁচ বছর পরও হুমায়ূন আহমেদের জীবনের অনুপ্রেরণা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেন না।

ছবিতে তিশার সাবেরী চরিত্রের মত করেই বলি, হুমায়ূন আহমেদের জীবন তো ৫০-এর পর শুরু হয়নি। তার আগের জৌলুস, কিংবদন্তী হয়ে ওঠার অনেক গল্পই চলচ্চিত্রের উপাদান হতে পারতো। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া লেখকের সাংসারিক জটিলতার গল্প নিয়ে আপনি আগ্রহী হতে পারেন, কিন্তু বিশ্বাস করুন, অধিকাংশ দর্শক বিরক্তই হয়েছে। ধরে নিলাম, গল্প লিখবার সময় নির্মাতার মস্তিষ্কে কোনো অবস্থাতেই হুমায়ূন আহমেদের নামটি মাথায় আসেনি। কিন্তু প্রিয় নির্মাতা, আপনি কি নিশ্চিত আপনার অজ্ঞাতে এই একটি চলচ্চিত্র গুলকেতিন খান, নোভা-শিলা-বিপাশা, মেহের আফরোজ শাওনকে নতুন করে বিব্রত করেনি? আপনি কি নিশ্চিত নিষাদ-নিনিথ বড় হয়ে এই একটি চলচ্চিত্র দেখে বিব্রত হবে না? নিজের মা'কে পর্দায় এতটা নোংরাভাবে উপস্থাপিত হতে দেখে কষ্ট পাবে না? এতটা অনধিকার চর্চা করা কতটা সমীচীন হয়েছে, এখন না হোক, ক'বছর পর ভেবে দেখবেন। তাছাড়া ছবিতে যে নীতুকে আমরা 'খল' চরিত্রে দেখেছি, তা দেখে মনে হয়েছে মেহের আফরোজ শাওনও বুঝি এরকম-ই ছিলেন। কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত, শাওন একাই হুমায়ূন আহমেদের প্রেমে পড়েছিলেন? ব্যক্তি জীবনে হুমায়ূন আহমেদ এভাবেই 'গো গো' বলে তাড়িয়ে দিতেন? গুলকেতিনের সংসার ভাঙার জন্য এক 'শাওন'ই কি শুধু দায়ী ছিলেন? হুমায়ূন আহমেদের কোনো দায় ছিলনা? শাওনের সঙ্গে লেখকের প্রেম, বিয়ে, সংসার, সন্তান কিংবা আনন্দদিনের কোনো গল্পই রাখেননি নির্মাতা। শেষ সময়ে লেখকের পাশে সেবাযত্নে ব্যস্ত থাকা শাওনকে দেখাননি তিনি। এ ছবিতে তাকে দেখানো হয়েছে 'অ্যটেনশন সিকার' এবং চোর হিসেবে। মেয়েকে তার বাবা কিছু উপহার দিক, নীতু (শাওন) সেটা পছন্দ করেন না। মানুষের সঙ্গে ব্যবহার জানেন না। সাবেরীর (শিলা) সঙ্গে সারাজীবন প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে সাবেরীর (শিলা) বাবাকে বিয়ে করেন (এই গল্পেরও কোনো ব্যকগ্রাউন্ড নেই ছবিতে)। কাজের লোকদের তাচ্ছিল্য করেন। মায়ার (গুলতেকিন) পছন্দ করা পর্দা সরিয়ে ফেলেন। সত্যিই কি তাই? দৃষ্টিকটু লেগেছে 'পরনারী'র চরিত্র পর্দায় তুলে ধরতে গিয়ে সেকেলে সিগারেট এবং স্লিভলেস ব্লাউজের আশ্রয় নিয়েছেন নির্মাতা। খল চরিত্র মানেই কি এসব বেশ ধারণ করতে হবে? আরো দৃষ্টিকটু লেগেছে এক ভক্তের ফেসবুক প্রোফাইল পিকচারে স্ত্রী নীতুর ছবি বাদ দিয়ে ভক্তের নিজের সঙ্গে জাভেদ হাসানের ছবি দেয়ার বিষয়টি নিয়ে যখন জাভেদ হাসান মহাক্ষিপ্ত হন। কোনো শিল্পী কিংবা তারকাকে শ্রদ্ধা করতে গেলে যে তার ভালোবাসার মানুষটিকেও শ্রদ্ধা করতে হবে-এমন কোনো নিয়ম এর আগে শুনিনি। তাছাড়া ৩/৪ বয়সের ব্যবধানেও জাভেদ হাসান পুত্র আহীর একই রকম থাকে। বিষয়টি কারো চোখ এড়ায়নি।

চোখ এড়ায়নি এ ছবির বেশ কিছু ভালো দিকও। প্রথমেই আমাদের দেশের প্রযোজক জাজ মাল্টিমিডিয়াকে ধন্যবাদ অন্য ধরনের একটি ছবির পেছনে অর্থ লগ্নী করার জন্য। ছবি যার কাছে যেমনই লাগুক, প্রযোজকের ব্যলেন্স শীটে শেষ পর্যন্ত যত অঙ্কই জমা পড়ুক, জাজ মাল্টিমিডিয়ার কাছে সবসময়ই ব্যতিক্রম একটি প্রযোজনা হয়ে থাকবে ডুব। আশা করছি ভিন্ন ধারার ছবির প্রতি আগ্রহ জাজ মাল্টিমিডিয়া জিইয়ে রাখেবে।মাঝে মাঝে দূরে যেতে হয় কাছে আসার জন্য কিংবা মানুষ মারা যায় তখনই যখন পৃথিবীর কাছে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় কিংবা যখন শুনেছি মারা গিয়েছো, খুশি হয়েছি কারণ তুমি এখন কারো অধিকারে নেই-এ ছবি থেকে বেশ কিছু সংলাপ বাড়িতে নিয়ে গিয়েছি। সাবেরীর পিছু পিছু বিড়ালের ছুটে আসা এবং পা জড়িয়ে ধরার দৃশ্যটি নান্দনিক এবং মজার।

শেখ রাজিবুল ইসলামের শৈল্পিক চিত্রগ্রহণ-ছবির সম্পদ। '৯০এর ঢাকা কিংবা বান্দরবানের পাহাড়, ঝর্ণা, সবুজের সমারোহ, আঁকাবাকা রাস্তা, গাড়ির ছাদে ঝুম বৃষ্টি মুগ্ধ চোখে দেখেছি। এরিয়েল শট বা লং শটে প্রকৃতির দৃশ্য বিশ্ববাসীর কাছে অপরূপা বাংলাদেশকেই তুলে ধরেছে। অবশ্য পাতার মাঝ দিয়ে বা কৃষ্ণচূড়ার ওপর দিয়ে তোলা দৃশ্যের বারংবার ব্যবহার বাহুল্য মনে হয়েছে। শট ট্রানজিশনে হিচকক টেকনিক এবং মন্থরগতির প্রতিটি প্যানিং সব দর্শক হয়তো বোঝেনি, তবে যারা বুঝেছে মুগ্ধ হয়েছে। নৈঃশব্দও এ ছবির একটি চরিত্র। নৈঃশব্দের ভেতর দিয়ে ঘাস, পথ, বৃষ্টি, কাশবনের চরিত্র অবলোকন করার চেষ্টা করেছি। ছবিতে নৈঃশব্দও প্রায়ই চিৎকার করে উঠেছে। চিরকুটের গান 'আহারে জীবন' মন ছুঁয়ে গেছে। আবহ সংগীত এবং শব্দগ্রহণের দিক দিয়েও ডুব 'এ ক্লাস'। পাভেল আরীনের সংগীতে মন হারিয়েছি। তবে এই মনই বারবার অশান্ত হয়েছে ছন্নছাড়া গল্পের চিত্রায়ণ দেখে। গল্প বলায় নতুন ভাষা তৈরির দিকে ডুব না দিয়ে যদি সুন্দর কিছু মুহূর্ত তৈরি করে সুন্দর একটি মালা গেঁথে দর্শকদের উপহার দিতেন, তাহলে নির্মাতা আমাদের সবার কাছ থেকেই ধন্যবাদ পেতেন। দুই ভাগ হতেন না।

ytPAgCY.jpg


ডুব ছবির গল্প আবর্তিত হয়েছে ইরফান খানকে নিয়ে। এ ছবির পোস্টারেও এককভাবে প্রাধান্য পেয়েছেন তিনি। ইরফান খান গুণী অভিনেতা, সন্দেহ নেই। তবে জাভেদ হাসান চরিত্রের জন্য ইরফান খানের মাঝে কি পেয়েছিলেন নির্মাতা কিংবা চিত্রনাট্যে এমন কি দেখেছিলেন ইরফান খান, জানতে ইচ্ছে হয়। যতদূর জানি, নির্মাতা 'গিমিক'-এ বিশ্বাসী নন। যদি তাই সত্যি হয়, জাভেদ হাসান চরিত্রে তো আমাদের দেশের অনেক গুণী অভিনেতাই ছিলেন। ইরফান খান তার মেধার স্পর্শে এ চরিত্রটিতে 'বিশেষ' কি সৃষ্টি করতে পারলেন? ইরফান খানের বাংলা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আমার নিজেরও বেশ কানে লেগেছে। তবে একজন অবাঙালির কাছ থেকে এর চেয়ে কত ভালো বাংলা আমরা আশা করতে পারি? এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে, পিঁপড়াবিদ্যা'র জন্য যদি শিনা চৌহানের অন্তরালে অপি করিম থাকতে পারেন, এ ছবিতে ইরফান খানের অন্তরালেও একজন শুদ্ধ বাংলা বলা ডাবিংশিল্পী থাকতে পারতেন।

তুলনায় এ ছবিতে সুঅভিনয়ের সুযোগ বেশি পেয়েছেন তিশা। তিশা ছোট পর্দায় বিগত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের সবচাইতে জনপ্রিয় অভিনেত্রীর আসন দখল করে বসে আছেন। তার মেধা নিয়ে কেউই প্রশ্ন তুলবেন না, ছোট পর্দায় বহুমুখী চরিত্রে অভিনয় করতে দেখেছি আমরা তাকে। ব্যক্তিগতভাবে তিশা আমারও অন্যতম প্রিয়। তবে চলচ্চিত্রে এবারও তিশাকে তিশার মতই লেগেছে। শিল্পীর কাজ তার ব্যক্তিত্বের অনুবাদ। তবে তিশাকে অন্য নির্মাতাদের নাটক কিংবা চলচ্চিত্রে যেভাবে প্রমিত বাংলায় কথা বলতে দেখে শ্রদ্ধা জাগে, নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর কাজে এবারও সেটি হয়নি। শিলা আহমেদও তো ব্যক্তি জীবনে 'করছি খাইছি' ভাষায় কথা বলেন না। তিশার অভিনয় নিয়ে বলবার কিছু না থাকলেও তার ভাষা কানে লেগেছে।

যেমনটি কানে লেগেছে শিক্ষক চরিত্রে রোকেয়া প্রাচীর 'করছি খাইছি'। এমনকি পার্নো মিত্রও এ ছবিতে বলেন, আজকে মুড়িঘন্ট রান্না করছি। বুঝলাম নির্মাতা তার কাজের মাধ্যমে বাস্তবিক চিত্র ফুটিয়ে তুলবার চেষ্টা করেন। কিন্তু সমাজের সব শ্রেণীর মানুষই কি সারাক্ষণ, সর্বাবস্থায় 'করছি-খাইছি' বলেন? ইরফান খানকেও আমরা এই বাংলা শেখালাম? দেশের বাইরের মানুষদের কাছে এই বাংলা তুলে ধরলাম? কি ক্ষতি হতো, চরিত্রগুলো (অন্তত ২/১টি চরিত্র) শুদ্ধ উচ্চারণে প্রমিত বাংলায় কথা বললে? বাস্তবতা উড়ে যেত? হুমায়ূন আহমেদ এবং তার পরিবার কি এ ভাষাতেই কথা বলতেন? অভিনয়ের ক্ষেত্রে রোকেয়া প্রাচীর মত মেধাবী অভিনেত্রী সুযোগ পেয়েছেন কম। তবে যতটা পেয়েছেন, কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছেন। যদিও নীরব-সর্বংসহা মায়ের চরিত্রে মায়াকে আরেকটু মায়াবী দেখানো যেত। তাকে নিয়ে চিত্রনাট্যে আরেকটু খেলা যেত। একই কথা প্রযোজ্য পার্নো মিত্রের ক্ষেত্রেও। ঈর্ষাপরায়ণ, মন্দ নারীর চরিত্রে তিনি সাবলীল ছিলেন। তবে চিত্রনাট্যের দুর্বল গাঁথুনীর কারণে এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি জাভেদ নিতুকে ভালোবাসেন বা তার মাঝে আশ্রয় খুঁজছেন। নীতু চরিত্রটির ভালো-মন্দ দুই রূপ দেখানো হলে পার্নো মিত্রের অভিনয় আরো বিশ্বাসযোগ্য হতো।

আমি মহা জ্ঞানী নই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র উৎসব ঘুরে আসিনি। আমার সব মন্তব্যও হয়তো সঠিক নয়। তবে আমি আমজনতা। দেশের চলচ্চিত্রকে ভালোবাসি। খাঁচা, ডুব থেকে দুলাভাই জিন্দাবাদ, ঢাকা অ্যাটাক, মনপুরা, মোল্লাবাড়ির বউ থেকে সোনাবন্ধু-সব রুচির ছবি মুক্তির প্রথম দিন প্রেক্ষাগৃহে দেখতে ভালোবাসি। কারো প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ রাখিনা। যদি রাখতাম, ডুব দেখবার সময় বিরক্ত হয়ে একজন জনপ্রিয় চলচ্চিত্র তারকা যখন চিৎকার করে সিনেমা হলে দাঁড়িয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছিলেন, আমি তাকে থামিয়ে দিতাম না। ফেসবুকে তার আপত্তিকর স্ট্যাটাস মুছে ফেলবার অনুরোধ করতাম না। তারপরও আমার এ লেখা পড়ে নির্মাতা এবং তার অনুসারীরা আমাকে তুলোধুনো করলেও খারাপ লাগবে না। কারণ আমি জানি তার পরের ছবি শনিবার বিকাল ভালো লাগলে সবার আগে আমিই লিখবো।

ডুব আমাদের অনেকের ভালো না লাগলেও দেশের বাইরে ভ্যারাইটি, হলিউড রিপোর্টার, স্ক্রিন ডেইলি কিংবা আরো অনেক আন্তর্জাতিক সমালোচকরা প্রশংসা করেছে-এই অর্জনকেও খাটো করে দেখবার সুযোগ নেই। তবে এ ক্ষেত্রে সবার কাছেই ছোট্ট একটা অনুরোধ: কাজের মাঝে কিংবা চলনে বলনে এসব অর্জনকেও বড় করে দেখার কিছু নেই। এরকম অর্জন প্রিয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেতেরও আছে। ফ্রান্স, স্পেন, জার্মান, ইটালী সহ আন্তর্জাতিক অনেক জার্নালে তাকে নিয়ে কিংবা 'ইত্যাদি' অনুষ্ঠানকে নিয়ে লেখা প্রকাশ হতে আমি দেখেছি। অথচ দেশের পত্রিকায় ফলাও করে কখনো প্রকাশ হতে দেখিনি। প্রয়াত তারেক মাসুদ-এর কথা তো সবাই জানেন। তৌকীর আহমেদ, অমিতাভ রেজা থেকে কামার আহমেদ সায়মন- অনেকের ছবির প্রশংসা বিদেশের পত্রিকায় পড়েছি। তাছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের খবর আসা মানেই আমি শ্রেষ্ঠ, আমি নির্ভুল, দেশের অনেক দর্শক নির্বোধ, দেশের অনেক সাংবাদিক নির্বিকার, দেশের পুরস্কারের জুরিবোর্ড নিরক্ষর-এই ভাবনায় যারা বসবাস করে তাদের বাংলাদেশের জন্য ছবি নির্মাণ করার প্রয়োজন নেই। ডুব কারো ভালো লাগবে, কারো ভালো লাগবে না। তবে ভুল চোখে পড়লে সেটি নির্মাতাকে না ধরিয়ে সর্বাবস্থায় তার প্রশংসা বন্দনায় ব্যস্ত হলে, তিনি সত্যি সত্যিই একদিন ডুবে যাবেন। আমরা কি তা চাই? অবশ্যই না। নির্মাতার কাছে বিশেষ অনুরোধ, এমন কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ করুন যা দেখে আনন্দে আপনার মত আমরাও রাতের ঘুম হারাম করতে পারি। পায়ের তালু গরম করতে পারি। আপনার আবেগ যেন আমরা সবাই মিলে ধারণ করতে পারি। আপনার ছবি আসবে আর জাতি দুই ভাগ হবেনা-এটি কোনো কৃতিত্বের কথা নয়। মনপুরা কিংবা আয়নাবাজি নির্মাণ করতে বলছি না, অন্তত একবার পুরো বাংলাদেশকে সহজ-সরল একটি গল্প শোনান। যে গল্প দেখে সবাই আমরা হাসবো, একসঙ্গে কাঁদবো, একসঙ্গে ভাসবো এই আনন্দলোকে। ডুবে যাবো না। আমি বিশ্বাস করি আপনার পক্ষে সম্ভব। কারণ আপনার সে মেধা, ক্ষমতা, সাহস-সবই আছে। আপনি তা কি বিশ্বাস করেন?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top