জিম থেকে বেরুবার সময় কাঁকনের পা দুটো হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে আসছিল। এক জোড়া চোখ খুবই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। চমকে উঠল সে। কিন্তু অস্বস্তি এড়াতে পরক্ষনেই চোখ নামিয়ে আবার চলতে শুরু করল। দরজার বাইরে পা দেবার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে আবার তাকাল। ঠিক একইভাবে চোখ দুটো তখনো তাকে দেখছে.....
বাসায় ফিরে কাঁকন বেশ অবাক হলো। জিসান অসময়ে আজ বাড়ীতে। কারণ জানা গেল। কোনো বন্ধুকে সে নৈশভোজে দাওয়াত দিয়েছে। নাম ইশান। বিনা বাক্যব্যয়ে কাঁকন অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দুজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাবুর্চি কাঁকনের নির্দেশনায় থাই,চাইনিজ এবং দেশীয় খাবার মিলিয়ে পনেরো রকমের পদ রান্না করে ফেলল।
রাত নয়টায় সাদা টয়োটা ঢুকল। শাওয়ার শেষ করে লেস লাগানো ম্যাচিং ব্লাউজের সাথে হালকা গোলাপী রঙের একটা সিল্ক শাড়ী পরে হালকা প্রসাধনী মুখে লাগিয়ে মুহূর্তেই চোখ ধাঁধানো রূপের অধিকারিণী হয়ে উঠল কাঁকন । আজকের অতিথি এ বাড়িতে আগে আসেনি। কোনো এক ব্যবসায়িক কাজের সুবাদে অল্পদিনের পরিচয়ে জিসানের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছে নাকি এই লোকটি।
ড্রয়িং রুমটাতে পৌঁছতেই কাঁকনের
হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। জিমে দেখা সেই চোখ দুটো। পরিচয় পর্বে কাঁকন একটি শব্দ ও বলতে পারল না। হতভম্ব হয়ে বসে রইল.......
খাওয়া পর্ব শেষ করে আরো কিছুক্ষণ রইলো অতিথি। যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে দুটো দামী ব্রান্ডের মোবাইল সেট কাঁকন এবং জিসানের হাতে উপহার হিসেবে তুলে দিল সে।
কাঁকনের পুরো ব্যাপারটা গোলমেলে লাগছিল। কোথাও তো কোনো ব্যাপার নিশ্চয় রয়েছে। লোকটির দৃষ্টিতে কি যেন একটা রয়েছে। সারারাত তার ঘুম হলো না। ভোরের দিকে লাল চোখ নিয়ে সে উঠে পড়ল বিছানা থেকে। লোকটির দেয়া উপহারটি হাতে নিল। ভাবতে থাকল,কেন এমন দামী উপহার তাদের জন্য। জিসানকে সে অবশ্য জিজ্ঞেস করেছে ।জিসান বলেছে, ব্যবসায়িক সম্পর্ক খুব ভালো হওয়ায় এমনটি করেছে। উদাসীনতায় মোবাইল সেটটি সে চালু করল। আর সাথে সাথেই একটা এস,এম,এস ঢুকল। চাপ দিয়ে কাঁকন দেখল,একটা মোবাইল নাম্বার দিয়ে, নীচে 'কল মি' কথাটুকু লেখা। কাঁকন তখনই ডায়াল করল।
ফোনের ওপাশে ঘুম জড়ানো গলা,'জানি, আপনার মনে অনেক প্রশ্ন। থাকাটাই স্বাভাবিক। সেই প্রশ্নের উত্তর দিতেই ফোন দিতে বলেছি। ব্যাপারটা খুবই কনফিডেনসিয়াল। তাই আপনি আমাকে আশ্বস্ত করুন যে,এই কথাগুলো শোনার জন্য আপনি একা নিরাপদ দূরত্বে রয়েছেন।'
- জ্বি বলতে পারেন আপনি।
- তিনমাস হলো, আপনার হাজবেন্ডের সাথে আমার পরিচয়। আমরা অল্পদিনেই খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। ভালো মানুষ ভেবেছিলাম তাকে। কিন্তু কিছুদিন আগে সে হঠাৎ আমায় রিকোয়েস্ট করল, আপনার সাথে আমাকে অনৈতিক সম্পর্কে জড়াতে।'
- কেন করতে বলেছে?
- কারণ আপনাকে ডিভোর্স দিতে আপনার বিরুদ্ধে স্ট্রং এভিডেন্স প্রয়োজন।
- ডিভোর্স দিতে চায় কেন?
- কারণ তার অন্য নারীর প্রতি আসক্তি রয়েছে।
- তাহলে বিয়ে কেন করেছে আমায়?
- এটা আমি জানি না।
- আপনি জিসানের বন্ধু। আমায় কেন সাহায্য করছেন?
- আপনার সাথে যা ঘটছে তা কাম্য নয়।
- আপনার সাথে মিট করতে চাই।ও এক্সাক্টলি কি কি বলেছে আপনাকে সেটা শোনার জন্য।
- ওকে, আজ বিকেলে
আসুন 'ফ্রেন্ডস কফি হাউস' এ। বলব সব।
.....জিসান কিছুদিন হলো আরো রাত করে বাসায় ফিরছে। তাকে ব্যাপারটি বলার উপযুক্ত সময় আসেনি। আর তাছাড়া,এখনই বিষয়টি জিসানকে না জানানোর জন্য খুব জোর অনুরোধ করেছে ইশান। তবে বলতে না পারার কষ্ট যেন মৃত্যু ছুঁই ছুঁই । এদিকে জিসানের বাবা এসেছেন ওদের সাথে কয়েকদিন থাকবেন বলে। এই মানুষটিকে দেখলে কাঁকনের প্রথম থেকেই মনে হয়, শশুর শব্দটি উনার সাথে ঠিক যায় না। উনার স্বভাবের সাথে শুধুমাত্র বাবা শব্দটিই মানায়। মাস কয়েক আগে একদিন ঝড় জলের রাতে এসে হাজির।উদ্দেশ্য,কাঁকনের পছন্দের চিংড়ি মাছের মালাইকারী আর কই পাতুড়ি তাকে বৃষ্টির রাতে খাওয়ানো।
তো এই মানুষটি আসায় কাঁকনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা ভাবটা নিয়ন্ত্রনে আছে বোধহয়। গত রাতে তিনি হঠাৎ কাঁকনের রুমে এসেছিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,শোন মা,কান্না চাপিয়ে রাখলে কষ্টের ওজনটা বাড়ে। মাঝে মধ্যে মন খুলে কাঁদবি।
কাঁকন বিস্মিত হলো। কিছুই বলতে পারল না। শুধু উনি রুম ছাড়ার আগে বলতে পারল,'বাবা,আপনি আর একটু ক্ষণ আমার পাশে বসবেন?'
- হুম,আমি আছি। তোকে একটা কথা বলি,কোনো কারণেই নিজের সমস্যা চেপে রাখা বোকামি। যেকোনো সমস্যা ডিসক্লোজ করে তার সমাধানের চেষ্টা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ এই জগতে ভালো থাকাটা সব মানুষের অধিকার।
কাঁকনের চোখের জল তখন যেন তার কান দুটোতেও একটা আবরন তৈরি করল। বাবা এরপর কি বলল,সে আর কিছুই শুনতে পারল না.....
.....মেয়েটির নাম সুসান। ক্রিশ্চিয়ান। কালো রঙের কোনো মেয়ে যে এতটা সুন্দরী হতে পারে ,তা কাঁকনের জানা ছিল না। চোখ দুটোতে কি ভীষণ মায়া! মেয়েটির বাবা প্যারালাইজড। মা ও অসুস্থ।শয্যাশায়ী। কাঁকন দীর্ঘসময় এদের শয্যার পাশে বসে রইলো।ছোট একটা ভাই স্কুল থেকে বাড়ীতে ফিরে কি এক অজানা কারণে মনমরা হয়ে বারান্দার এক কোনে বসে রয়েছে।কাঁকন তার হাতে চকলেটের একটি বাক্স তুলে দিল। চোখ দুটোতে তখন তার খুশির ঝিলিক। সুসান অবাক চোখে কাঁকনের কর্মকান্ড দেখছিল। কাঁকন তার হাতটি ধরে যাবার বেলায় বলে গেলো,'আগামীকাল আমি আবার আসব। আমি তোমার জন্য কিছু উপহার নিয়ে আসব। না করতে পারবে না।
- জ্বি। না করব না।
- আর একটা কথা। তুমি আমার পরিচয় জানতে চাইছো না কেন?
- আমি জানি আপনি কে। আর না জানলে ও জানতে চাইতাম না। কারণ, আপনার আচরনে মনুষ্যত্বের পরিচয় রয়েছে। তাই আর কোনো পরিচয় জানার প্রয়োজন হয়না....
....বিকেলটায় ইশানের সাথে দেখা করল কাঁকন। তাকে নিজের পরিকল্পনা সব জানালো। এ কাজে ইশানের সহযোগিতা দরকার। সব শুনে ইশান হতভম্ব। সে কাঁকনকে বিভিন্নভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। কাঁকন যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই ইশান বলল,'আরেকটু বসুন প্লিজ। আমার কিছু বলার ছিল আপনাকে।'
কাঁকন নির্লিপ্ত গলায় 'বলুন' বলে বসে পড়ল।
- উইল ইউ প্লিজ ম্যারি মি?
- আই ওয়াজ প্রিপেয়ারড ফর দিজ কোয়েশ্চেন।
- হাউ কুড ইউ নো দ্যাট?
- আপনার চোখ দেখে বুঝেছি। আর জিসান যে আমার বিরুদ্ধে কোনো স্ট্রং এভিডেন্স চায়নি বা আপনাকে আমার সাথে প্রেম করতে বলেনি সেটা ও আমি প্রথমদিন থেকেই জানি। কারণ জিসান ফেরেশতা টাইপ মানুষ। এমন কাজ সে করবে না।তবে বাকীটুকু সত্যি। সুসান নামের মেয়েটির বাড়ীতে সে রেগুলার যায়।
- জানতে চাইবেন না কেন মিথ্যে বলেছিলাম?
- আমি জানি। আমার প্রতি কোনোভাবে আপনার অপরিসীম ভালো লাগা তৈরি হয়েছে। আর পাশাপাশি জিসানের ব্যাপারটাও জানতেন। এসব থেকেই আমাকে ভালোবাসতে চাওয়া,পেতে চাওয়া।
- আমাকে ঘৃণা করছেন?
- না। জিসানের বিষয়টা আমার জানা দরকার ছিল। আর তা আপনার কারণে জানতে পেরেছি।
তবে আপনাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। জিসানের প্রতি আমার ভালোবাসা এতটুকুও কমেনি। বরং ভালোবাসা আরো বেড়েছে.....
...... কাঁকন আজ জিসানের পছন্দের নীল শাড়ীটা আর হাত ভর্তি নীল রেশমী চুড়ি পরেছে। সে যখন চোখে গভীর করে কাঁজল আঁকে জিসান ভালো লাগার আতিশয্যে কেমন যেন ছটফট করতে থাকে। তাই আজ মনের মত করে চোখ সাজাতে ইচ্ছে হলো। এরপর তার হঠাৎ মনে হলো , আজ জিসানের থেকে সে দূরে চলে যাবে, তাহলে কেন চাইছে জিসান তাকে দেখে মুগ্ধ হোক। ব্যাপারটা পরস্পরবিরোধী।তখন সব সাজগোজ সে ধুয়ে নিল। নীল শাড়ীটা ছেড়ে হালকা রঙের একটা থ্রীপিস পরল। এরপর জিসানের ঘুম ভাঙালো। চায়ের কাপটা জিসানের হাতে দেয়ার সময় বলল,'আচ্ছা, নখ কাটার কাজটা এবার নিজে অভ্যাস করো না বাবা। বনমানুষ হয়ে ঘুরছ। আমি তো সবসময় না ও থাকতে পারি।'
জিসান আলতো করে কাঁকনের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো,'পাগল তুমি! তোমার হারিয়ে যাওয়ায় আমার অস্তিত্ব কোথায়?'
চোখের জল সংযত করার আপ্রাণ চেষ্টা কাঁকনের,'ওসব ছাড়ো। এবার চটপট উঠে পড়ো। আমি একটু বের হচ্ছি.....
.....চিঠিটা পাওয়া গেলো রাত বারোটায়। বালিশের নীচ থেকে।দুপুরে হন্তদন্ত হয়ে বাসায় এসেছিল জিসান। কাঁকন ফেরেনি বাসায়। ফোন চেষ্টা করা হচ্ছে। বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আত্নীয়, বন্ধু বান্ধব কোনোটাই খোঁজ নিতে বাকী রইলো না।
জিসানের বুক কাঁপছিল চিঠিটা পড়তে গিয়ে,' আমি জানি এতক্ষণে তুমি পাগলের মত হয়ে গেছো। একটু শান্ত হয়ে আমার চিঠিটা পড়ো। সুসান নাম মেয়েটির। তুমি তাকে প্রচন্ড ভালোবাসো। চমকে উঠছ জানি। স্বাভাবিক। আমি জানি এই মেয়েটিই তোমার ফ্যাক্টরির ফায়ার এক্সিডেন্টে নিজের জীবন বিপন্ন করে তোমাকে বাঁচিয়েছিল। এরপর থেকে তুমি ওর পরিবারের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে অনেকবার ওর বাড়ীতে গেছো। না,এটা অপরাধ নয় বরং মানবিকতার এক চরম দৃষ্টান্ত। তুমি এতটাই নিষ্পাপ যে একটি দিন ও অপ্রাসঙ্গিক কথা মেয়েটির সাথে বলোনি। শুধু একটা দিন মেয়েটি অসুস্থ হয়ে যখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিল,তখন তার পাশে বসে নীরবে কেঁদেছো। আমি জানি তুমি আমাকে ও অনেক ভালোবাসো। কিন্তু এই মেয়ের প্রতি তোমার ভালোবাসা তার চেয়ে ও অধিক। না, তুমি আমাকে বিন্দুমাত্রও ঠকাওনি।। কারণ, তোমার সাবকনসাচ মাইন্ড তোমার মধ্যে ধীরে ধীরে মেয়েটির জন্য ভালোবাসা তৈরি করেছে, যা তুমি সেভাবে টের পাওনি কখনো। জান,আমি জানি চিঠিটা পড়তে গিয়ে ভীষণ রেগে যাচ্ছ আমার উপর। কারণ, আমার প্রস্থান মেনে নেয়া ও খুব বেশি কঠিন তোমার জন্য। জীবনে কখনো কখনো এমন সময় আসে। মন কোনোটাই ছাড়তে রাজী হয় না। ভাবছ, অর্থহীন সন্দেহের ভিত্তিতে পাগলামি করে ফেললাম। এটা যে আমার অমূলক সিদ্ধান্ত ছিল না,তা তুমি বুঝবে একসময়। আমি আর কিছু বলতে পারছি না। কাজকর্ম দেবীর মত হলে ও আমি আসলে পুরোমাত্রায় মানুষ। তাই খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। জানি তোমার চোখের জল ও এখন টপ টপ করে পড়ছে আমার লেখাগুলোর উপরে। ঝাপসা চোখে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছ না। আমাকে ক্ষমা করো জান.........
জিসান টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো। এত রাতে বের হওয়ার কোনো মানে হয় না।
তবুও তাকে যেন বের হতেই হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার মেয়েটিকে সে পেয়েও ধরে রাখতে পারবে না? হঠাৎ বাইরে সোরগোল শোনা গেলো। জিসান বেরিয়ে এলো আর তখন তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দৃশ্যটি দেখল। অনেকগুলো রাস্তার ছেলেমেয়েকে চেয়ার সাজিয়ে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের সবাইকে খাবারের প্যাকেট দেয়া হচ্ছে আর সে কাজটি খুব আনন্দের সাথে করছে কাঁকন।জিসান দূরে দাঁড়িয়ে ভাবছিল,এই জীবনে সে আর কিছু চাইবে না কখনো,সব পেয়ে গেছে সে। কাঁকন এর মধ্যে জিসানকে দেখেছে আর দূর থেকে মুচকি হাসছে। জিসান ধীরে ধীরে কাছে এলো। কাঁকন তার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,'তোমাকে ছেড়ে আমি এক মুহূর্তও বাঁচতে পারব না। আমাকে রাখবে তোমার সাথে?'
জিসান মুখে কিছুই বলতে পারল না। শুধু শক্ত করে বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে চাইলো এই কাঙখিত মুখটিকে,যেন আর কখনো হারিয়ে না যায়......
(সমাপ্ত)
বাসায় ফিরে কাঁকন বেশ অবাক হলো। জিসান অসময়ে আজ বাড়ীতে। কারণ জানা গেল। কোনো বন্ধুকে সে নৈশভোজে দাওয়াত দিয়েছে। নাম ইশান। বিনা বাক্যব্যয়ে কাঁকন অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দুজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাবুর্চি কাঁকনের নির্দেশনায় থাই,চাইনিজ এবং দেশীয় খাবার মিলিয়ে পনেরো রকমের পদ রান্না করে ফেলল।
রাত নয়টায় সাদা টয়োটা ঢুকল। শাওয়ার শেষ করে লেস লাগানো ম্যাচিং ব্লাউজের সাথে হালকা গোলাপী রঙের একটা সিল্ক শাড়ী পরে হালকা প্রসাধনী মুখে লাগিয়ে মুহূর্তেই চোখ ধাঁধানো রূপের অধিকারিণী হয়ে উঠল কাঁকন । আজকের অতিথি এ বাড়িতে আগে আসেনি। কোনো এক ব্যবসায়িক কাজের সুবাদে অল্পদিনের পরিচয়ে জিসানের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছে নাকি এই লোকটি।
ড্রয়িং রুমটাতে পৌঁছতেই কাঁকনের
হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। জিমে দেখা সেই চোখ দুটো। পরিচয় পর্বে কাঁকন একটি শব্দ ও বলতে পারল না। হতভম্ব হয়ে বসে রইল.......
খাওয়া পর্ব শেষ করে আরো কিছুক্ষণ রইলো অতিথি। যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে দুটো দামী ব্রান্ডের মোবাইল সেট কাঁকন এবং জিসানের হাতে উপহার হিসেবে তুলে দিল সে।
কাঁকনের পুরো ব্যাপারটা গোলমেলে লাগছিল। কোথাও তো কোনো ব্যাপার নিশ্চয় রয়েছে। লোকটির দৃষ্টিতে কি যেন একটা রয়েছে। সারারাত তার ঘুম হলো না। ভোরের দিকে লাল চোখ নিয়ে সে উঠে পড়ল বিছানা থেকে। লোকটির দেয়া উপহারটি হাতে নিল। ভাবতে থাকল,কেন এমন দামী উপহার তাদের জন্য। জিসানকে সে অবশ্য জিজ্ঞেস করেছে ।জিসান বলেছে, ব্যবসায়িক সম্পর্ক খুব ভালো হওয়ায় এমনটি করেছে। উদাসীনতায় মোবাইল সেটটি সে চালু করল। আর সাথে সাথেই একটা এস,এম,এস ঢুকল। চাপ দিয়ে কাঁকন দেখল,একটা মোবাইল নাম্বার দিয়ে, নীচে 'কল মি' কথাটুকু লেখা। কাঁকন তখনই ডায়াল করল।
ফোনের ওপাশে ঘুম জড়ানো গলা,'জানি, আপনার মনে অনেক প্রশ্ন। থাকাটাই স্বাভাবিক। সেই প্রশ্নের উত্তর দিতেই ফোন দিতে বলেছি। ব্যাপারটা খুবই কনফিডেনসিয়াল। তাই আপনি আমাকে আশ্বস্ত করুন যে,এই কথাগুলো শোনার জন্য আপনি একা নিরাপদ দূরত্বে রয়েছেন।'
- জ্বি বলতে পারেন আপনি।
- তিনমাস হলো, আপনার হাজবেন্ডের সাথে আমার পরিচয়। আমরা অল্পদিনেই খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। ভালো মানুষ ভেবেছিলাম তাকে। কিন্তু কিছুদিন আগে সে হঠাৎ আমায় রিকোয়েস্ট করল, আপনার সাথে আমাকে অনৈতিক সম্পর্কে জড়াতে।'
- কেন করতে বলেছে?
- কারণ আপনাকে ডিভোর্স দিতে আপনার বিরুদ্ধে স্ট্রং এভিডেন্স প্রয়োজন।
- ডিভোর্স দিতে চায় কেন?
- কারণ তার অন্য নারীর প্রতি আসক্তি রয়েছে।
- তাহলে বিয়ে কেন করেছে আমায়?
- এটা আমি জানি না।
- আপনি জিসানের বন্ধু। আমায় কেন সাহায্য করছেন?
- আপনার সাথে যা ঘটছে তা কাম্য নয়।
- আপনার সাথে মিট করতে চাই।ও এক্সাক্টলি কি কি বলেছে আপনাকে সেটা শোনার জন্য।
- ওকে, আজ বিকেলে
আসুন 'ফ্রেন্ডস কফি হাউস' এ। বলব সব।
.....জিসান কিছুদিন হলো আরো রাত করে বাসায় ফিরছে। তাকে ব্যাপারটি বলার উপযুক্ত সময় আসেনি। আর তাছাড়া,এখনই বিষয়টি জিসানকে না জানানোর জন্য খুব জোর অনুরোধ করেছে ইশান। তবে বলতে না পারার কষ্ট যেন মৃত্যু ছুঁই ছুঁই । এদিকে জিসানের বাবা এসেছেন ওদের সাথে কয়েকদিন থাকবেন বলে। এই মানুষটিকে দেখলে কাঁকনের প্রথম থেকেই মনে হয়, শশুর শব্দটি উনার সাথে ঠিক যায় না। উনার স্বভাবের সাথে শুধুমাত্র বাবা শব্দটিই মানায়। মাস কয়েক আগে একদিন ঝড় জলের রাতে এসে হাজির।উদ্দেশ্য,কাঁকনের পছন্দের চিংড়ি মাছের মালাইকারী আর কই পাতুড়ি তাকে বৃষ্টির রাতে খাওয়ানো।
তো এই মানুষটি আসায় কাঁকনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা ভাবটা নিয়ন্ত্রনে আছে বোধহয়। গত রাতে তিনি হঠাৎ কাঁকনের রুমে এসেছিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,শোন মা,কান্না চাপিয়ে রাখলে কষ্টের ওজনটা বাড়ে। মাঝে মধ্যে মন খুলে কাঁদবি।
কাঁকন বিস্মিত হলো। কিছুই বলতে পারল না। শুধু উনি রুম ছাড়ার আগে বলতে পারল,'বাবা,আপনি আর একটু ক্ষণ আমার পাশে বসবেন?'
- হুম,আমি আছি। তোকে একটা কথা বলি,কোনো কারণেই নিজের সমস্যা চেপে রাখা বোকামি। যেকোনো সমস্যা ডিসক্লোজ করে তার সমাধানের চেষ্টা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ এই জগতে ভালো থাকাটা সব মানুষের অধিকার।
কাঁকনের চোখের জল তখন যেন তার কান দুটোতেও একটা আবরন তৈরি করল। বাবা এরপর কি বলল,সে আর কিছুই শুনতে পারল না.....
.....মেয়েটির নাম সুসান। ক্রিশ্চিয়ান। কালো রঙের কোনো মেয়ে যে এতটা সুন্দরী হতে পারে ,তা কাঁকনের জানা ছিল না। চোখ দুটোতে কি ভীষণ মায়া! মেয়েটির বাবা প্যারালাইজড। মা ও অসুস্থ।শয্যাশায়ী। কাঁকন দীর্ঘসময় এদের শয্যার পাশে বসে রইলো।ছোট একটা ভাই স্কুল থেকে বাড়ীতে ফিরে কি এক অজানা কারণে মনমরা হয়ে বারান্দার এক কোনে বসে রয়েছে।কাঁকন তার হাতে চকলেটের একটি বাক্স তুলে দিল। চোখ দুটোতে তখন তার খুশির ঝিলিক। সুসান অবাক চোখে কাঁকনের কর্মকান্ড দেখছিল। কাঁকন তার হাতটি ধরে যাবার বেলায় বলে গেলো,'আগামীকাল আমি আবার আসব। আমি তোমার জন্য কিছু উপহার নিয়ে আসব। না করতে পারবে না।
- জ্বি। না করব না।
- আর একটা কথা। তুমি আমার পরিচয় জানতে চাইছো না কেন?
- আমি জানি আপনি কে। আর না জানলে ও জানতে চাইতাম না। কারণ, আপনার আচরনে মনুষ্যত্বের পরিচয় রয়েছে। তাই আর কোনো পরিচয় জানার প্রয়োজন হয়না....
....বিকেলটায় ইশানের সাথে দেখা করল কাঁকন। তাকে নিজের পরিকল্পনা সব জানালো। এ কাজে ইশানের সহযোগিতা দরকার। সব শুনে ইশান হতভম্ব। সে কাঁকনকে বিভিন্নভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। কাঁকন যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই ইশান বলল,'আরেকটু বসুন প্লিজ। আমার কিছু বলার ছিল আপনাকে।'
কাঁকন নির্লিপ্ত গলায় 'বলুন' বলে বসে পড়ল।
- উইল ইউ প্লিজ ম্যারি মি?
- আই ওয়াজ প্রিপেয়ারড ফর দিজ কোয়েশ্চেন।
- হাউ কুড ইউ নো দ্যাট?
- আপনার চোখ দেখে বুঝেছি। আর জিসান যে আমার বিরুদ্ধে কোনো স্ট্রং এভিডেন্স চায়নি বা আপনাকে আমার সাথে প্রেম করতে বলেনি সেটা ও আমি প্রথমদিন থেকেই জানি। কারণ জিসান ফেরেশতা টাইপ মানুষ। এমন কাজ সে করবে না।তবে বাকীটুকু সত্যি। সুসান নামের মেয়েটির বাড়ীতে সে রেগুলার যায়।
- জানতে চাইবেন না কেন মিথ্যে বলেছিলাম?
- আমি জানি। আমার প্রতি কোনোভাবে আপনার অপরিসীম ভালো লাগা তৈরি হয়েছে। আর পাশাপাশি জিসানের ব্যাপারটাও জানতেন। এসব থেকেই আমাকে ভালোবাসতে চাওয়া,পেতে চাওয়া।
- আমাকে ঘৃণা করছেন?
- না। জিসানের বিষয়টা আমার জানা দরকার ছিল। আর তা আপনার কারণে জানতে পেরেছি।
তবে আপনাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। জিসানের প্রতি আমার ভালোবাসা এতটুকুও কমেনি। বরং ভালোবাসা আরো বেড়েছে.....
...... কাঁকন আজ জিসানের পছন্দের নীল শাড়ীটা আর হাত ভর্তি নীল রেশমী চুড়ি পরেছে। সে যখন চোখে গভীর করে কাঁজল আঁকে জিসান ভালো লাগার আতিশয্যে কেমন যেন ছটফট করতে থাকে। তাই আজ মনের মত করে চোখ সাজাতে ইচ্ছে হলো। এরপর তার হঠাৎ মনে হলো , আজ জিসানের থেকে সে দূরে চলে যাবে, তাহলে কেন চাইছে জিসান তাকে দেখে মুগ্ধ হোক। ব্যাপারটা পরস্পরবিরোধী।তখন সব সাজগোজ সে ধুয়ে নিল। নীল শাড়ীটা ছেড়ে হালকা রঙের একটা থ্রীপিস পরল। এরপর জিসানের ঘুম ভাঙালো। চায়ের কাপটা জিসানের হাতে দেয়ার সময় বলল,'আচ্ছা, নখ কাটার কাজটা এবার নিজে অভ্যাস করো না বাবা। বনমানুষ হয়ে ঘুরছ। আমি তো সবসময় না ও থাকতে পারি।'
জিসান আলতো করে কাঁকনের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো,'পাগল তুমি! তোমার হারিয়ে যাওয়ায় আমার অস্তিত্ব কোথায়?'
চোখের জল সংযত করার আপ্রাণ চেষ্টা কাঁকনের,'ওসব ছাড়ো। এবার চটপট উঠে পড়ো। আমি একটু বের হচ্ছি.....
.....চিঠিটা পাওয়া গেলো রাত বারোটায়। বালিশের নীচ থেকে।দুপুরে হন্তদন্ত হয়ে বাসায় এসেছিল জিসান। কাঁকন ফেরেনি বাসায়। ফোন চেষ্টা করা হচ্ছে। বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আত্নীয়, বন্ধু বান্ধব কোনোটাই খোঁজ নিতে বাকী রইলো না।
জিসানের বুক কাঁপছিল চিঠিটা পড়তে গিয়ে,' আমি জানি এতক্ষণে তুমি পাগলের মত হয়ে গেছো। একটু শান্ত হয়ে আমার চিঠিটা পড়ো। সুসান নাম মেয়েটির। তুমি তাকে প্রচন্ড ভালোবাসো। চমকে উঠছ জানি। স্বাভাবিক। আমি জানি এই মেয়েটিই তোমার ফ্যাক্টরির ফায়ার এক্সিডেন্টে নিজের জীবন বিপন্ন করে তোমাকে বাঁচিয়েছিল। এরপর থেকে তুমি ওর পরিবারের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে অনেকবার ওর বাড়ীতে গেছো। না,এটা অপরাধ নয় বরং মানবিকতার এক চরম দৃষ্টান্ত। তুমি এতটাই নিষ্পাপ যে একটি দিন ও অপ্রাসঙ্গিক কথা মেয়েটির সাথে বলোনি। শুধু একটা দিন মেয়েটি অসুস্থ হয়ে যখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিল,তখন তার পাশে বসে নীরবে কেঁদেছো। আমি জানি তুমি আমাকে ও অনেক ভালোবাসো। কিন্তু এই মেয়ের প্রতি তোমার ভালোবাসা তার চেয়ে ও অধিক। না, তুমি আমাকে বিন্দুমাত্রও ঠকাওনি।। কারণ, তোমার সাবকনসাচ মাইন্ড তোমার মধ্যে ধীরে ধীরে মেয়েটির জন্য ভালোবাসা তৈরি করেছে, যা তুমি সেভাবে টের পাওনি কখনো। জান,আমি জানি চিঠিটা পড়তে গিয়ে ভীষণ রেগে যাচ্ছ আমার উপর। কারণ, আমার প্রস্থান মেনে নেয়া ও খুব বেশি কঠিন তোমার জন্য। জীবনে কখনো কখনো এমন সময় আসে। মন কোনোটাই ছাড়তে রাজী হয় না। ভাবছ, অর্থহীন সন্দেহের ভিত্তিতে পাগলামি করে ফেললাম। এটা যে আমার অমূলক সিদ্ধান্ত ছিল না,তা তুমি বুঝবে একসময়। আমি আর কিছু বলতে পারছি না। কাজকর্ম দেবীর মত হলে ও আমি আসলে পুরোমাত্রায় মানুষ। তাই খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। জানি তোমার চোখের জল ও এখন টপ টপ করে পড়ছে আমার লেখাগুলোর উপরে। ঝাপসা চোখে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছ না। আমাকে ক্ষমা করো জান.........
জিসান টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো। এত রাতে বের হওয়ার কোনো মানে হয় না।
তবুও তাকে যেন বের হতেই হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার মেয়েটিকে সে পেয়েও ধরে রাখতে পারবে না? হঠাৎ বাইরে সোরগোল শোনা গেলো। জিসান বেরিয়ে এলো আর তখন তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দৃশ্যটি দেখল। অনেকগুলো রাস্তার ছেলেমেয়েকে চেয়ার সাজিয়ে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের সবাইকে খাবারের প্যাকেট দেয়া হচ্ছে আর সে কাজটি খুব আনন্দের সাথে করছে কাঁকন।জিসান দূরে দাঁড়িয়ে ভাবছিল,এই জীবনে সে আর কিছু চাইবে না কখনো,সব পেয়ে গেছে সে। কাঁকন এর মধ্যে জিসানকে দেখেছে আর দূর থেকে মুচকি হাসছে। জিসান ধীরে ধীরে কাছে এলো। কাঁকন তার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,'তোমাকে ছেড়ে আমি এক মুহূর্তও বাঁচতে পারব না। আমাকে রাখবে তোমার সাথে?'
জিসান মুখে কিছুই বলতে পারল না। শুধু শক্ত করে বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে চাইলো এই কাঙখিত মুখটিকে,যেন আর কখনো হারিয়ে না যায়......
(সমাপ্ত)