What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Self-Made একুশ বছর 🔆🔅🔆🔅🔆 (1 Viewer)

Fahima

Senior Member
Joined
Apr 8, 2019
Threads
137
Messages
539
Credits
32,076
ফয়সাল। হ্যাঁ, ফয়সালইতো। প্রায় একুশ বছর পর মানুষটাকে আমি দেখলাম। এত অল্প দেখেই আমি চিনতে পারলাম। এখনও সেই মোটা ফ্রেমের চশমা পড়েন। মাথার চুল বেশখানি পেকে গেছে। চেহারাও কেমনজানি রোগা রোগা। তবে মুখে আগের সেই হাসিটা ঠিকই আছে। এত বছর পর ঠিক এই হাসিটা দেখলেই বুঝা যাবে উনিই ফয়সাল। এক সময়ের আমাদের ফয়সাল ভাই। প্রিয় ফয়সাল ভাই।



আমি তখন সবে মেট্রিক দিয়েছি। আমাদের পাড়ার সবচেয়ে ভালো ছাত্র ফয়সাল ভাই স্টার মার্কস পেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলো। সবাই বলাবলি করে এই ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবেই পাবে। লাইন ধরে গার্লস স্কুলে যাওয়া মেয়েগুলো ফয়সাল ভাইকে দেখলে খুব সমীহ করতো। সালাম দিত। আমাদের মেয়েদের মধ্যে অনেকে ফয়সাল ভাই বলতেই অজ্ঞান। রাত দিন শুধু ফয়সাল ভাই আর ফয়সাল ভাই।



আমাদের পাড়ার উত্তর গলি পেরিয়ে একটু আগালে বড় মোড়টাতে ফয়সাল ভাইয়ের আব্বার মুদি দোকান। জননী স্টোর। দোকান থেকে একটু দুরেই আমাদের গার্লস স্কুল। শুধুমাত্র দুপুর হলেই ফয়সাল ভাই দোকানে বসতো। এই সময়টায় ফয়সাল ভাইয়ের আব্বা দুপুরের খাবার খেতে বাসায় যেতেন। সেই সময় টিফিন পিরিয়ডে আমরা কয়েক বান্ধবী মিলে কিছু একটা কিনতে এই দোকানে যেতাম। ভীষণ ভয়ে ভয়ে যেতাম। রোকসানাতো ভীষণ ভীতু। ফয়সাল ভাইয়ের দোকানে যাচ্ছি শুনলে আমাদের আশে পাশে আর থাকত না। রোকসানা বলতো, কি রাগী মানুষ রে বাবা। দেখবি একদিন আব্বার কাছে ঠিকই বিচার দিবে আমরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করি।



আসলেই ফয়সাল ভাই খুব রাশভারি মানুষ। যখন দোকানে যাই, দেখি গম্ভীর হয়ে কি সব বই পড়েন। আমরা গেলে তেমন ভালো করে তাকাতোই না। আমার খুব রাগ হতো। শুধু মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতো, পরীক্ষার জন্য ঠিকমত প্রস্তুতি কেমন নিচ্ছি। তারপর আর একটি কথাও মুখ দিয়ে বেরুতো না।



ফয়সাল ভাইকে নিয়ে আমার আর শায়লার মধ্যে বেশ বিরোধ। এই মেয়েটা কেন যে ফয়সাল ভাইয়ের পিছু নিল। ক্লাসের অনেকে জানে বিষয়টা। আমি সামনা সামনি কিছু বলিনা। শায়লাও না। তবে দুজনের মধ্যে কথাবার্তা হয় না। একই ক্লাসে পড়লেও আমরা কেউ কারো সাথে কথা বলি না। কারণ শুধু ঐ ফয়সাল ভাই।



ফয়সাল ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছেন। আমাদের পাড়ার কোন ছেলে এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। এই নিয়ে পুরো এলাকায় কেমন একটা খুশির আমেজ। সবার মুখে মুখে শুধু ফয়সাল ভাইয়ের কথা। আমার শুনতে বেশ লাগে। আব্বা অফিস থেকে ফিরে সেদিন ফয়সাল ভাইকে নিয়ে খুব প্রশংসা করল। আব্বা একটার পর একটা ভালো কথা বলছেন আর আমার গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। খুশিতে গায়ের লোম দাঁড়ায় তা আমি প্রথম দেখলাম। খুশিতে আমার কান্নাও আসছে। আমি লুকিয়ে চোখের ভেতর জমে উঠা পানি মুছে ফেলি। কিশোরী বয়সে এমন অনুভূতি দেখে আমার নিজেরও ভীষণ লজ্জা লজ্জা লাগে।



ঠিক চার মাস তিন দিন পর। হ্যাঁ, আমি ফয়সাল ভাই সংক্রান্ত সব দিন তারিখ মুখস্থ রাখি। ঠিক চার মাস তিনদিন পর আব্বার অনুরোধে ফয়সাল ভাই আমাকে ম্যাথ পড়াতে আসলেন। তখন সবে আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি। ফয়সাল ভাই আমাকে পড়াবে শুনে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। উনি আসার আগেরদিন রাতে আমি একটুও ঘুমাতে পারিনি। সারারাত শুধু কেঁদেছি। আমি কেন কাঁদছি আমি নিজেও জানিনা। তারপরও কাঁদতে আমার বেশ ভালো লাগছে।



মোটামুটি ভালো ছাত্রী হিসেবে আমারও টুকটাক নাম ধাম আছে পাড়ায়। ফয়সাল ভাই বেশ ভালো পড়ান। আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করি প্রায় তিন মাস পর। বিষয়টা নিশ্চিত হতে আমার বেশ সময় লেগেছে। এই ফয়সাল ভাইও বোধহয় আমাকে একটু আধটু পছন্দ করেন। মেয়েদের বোঝার ক্ষমতা প্রবল। সেই ক্ষমতা আমাকে এটা নিশ্চিত করেছে ফয়সাল ভাই আমাকে পছন্দ করেন। যদিও এখনও আমি কিংবা ফয়সাল ভাই এই নিয়ে কেউ কাউকে কিছুই বুঝতে দিইনি।



এভাবেই যাচ্ছে দিন। তবে আমরা দুজন আস্তে আস্তে ঠিকই বুঝতে পারি একজন আরেকজনের প্রতি ভালোবাসা বা দুর্বলতার বিষয়গুলো। দিন, মাস পেরুই কিন্তু কেউ সাহস করে এই বিষয়ের দিকে এগুতে পারি না।



ঠিক পাঁচ মাস সতের দিন পর। পাঁচ মাস সতের দিন পর হঠাৎ করে ফয়সাল ভাইয়ের আব্বা মারা গেলেন। স্ট্রোক করেছিলেন। সবকিছু কেমন যেন উলট পালট হয়ে গেল। ফয়সাল ভাই আমাকে পড়াতে আসা বন্ধ করে দিলেন। দুই বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ফয়সাল ভাই। পরিবারের আয়ের উৎস ফয়সাল ভাইয়ের আব্বার সেই জননী স্টোর মুদি দোকানই । পুরো পরিবারের চাপটা এখন তার কাঁধেই। ফয়সাল ভাই নিয়ম করে এখন এই দোকানেই বসেন। আব্বা সেদিন খুব আফসোস করে বললেন, ফয়সাল ছেলেটার লেখাপড়া বোধহয় আর করা হলো না। এত ভালো ছাত্র। পরিবারের জন্য সব বিসর্জন দিতে হচ্ছে। এটাই হয়তো নিয়তি।



আব্বার কথা শুনে সেদিন অনেক অনেক কেঁদেছিলাম। এত কান্না আমি আর কখনও কাঁদিনি। নিজের ভেতর কেমন একটা অসহায়ত্ব দানা বেঁধেছিল। আমি পাগলের মত ফয়সাল ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ফয়সাল ভাই এখন নিয়ম করে দোকানে বসেন। সকাল থেকে রাত অবধি। শুনেছি ইউনির্ভাসিটি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এই কথাটি শোনার পর আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। একদিন সকাল সকাল সোজা গিয়ে দাঁড়ালাম ফয়সাল ভাইয়ের দোকানের সামনে। আমাকে দেখে তিনি একটুও চমকায়নি। মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো, কি শিমু তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে?



আমি কোন উত্তর দেইনি। কোন উত্তর দিতে আমার ইচ্ছে করেনি। উল্টো আমি সব ভয়, লজ্জা ভুলে গিয়ে তাকে বললাম, আপনার সাথে আমার কথা আছে?



উনি আবার একটা হাসি দিয়ে বললো, বলো তোমার কি কথা?



আমি বললাম, এখানে বলব না। আপনি আমাকে ঘন্টাখানেক সময় দিবেন। আমি অন্য কোথাও গিয়ে বলব।



এবারও তিনি একটা হাসি দিলেন। হাসি দিয়ে বললেন, এই দোকান ছেড়ে আমার এখন কোথাও যাওয়ার মত সময় নেই। সকাল থেকে রাত অবধি এই দোকানই এখন আমার সবকিছু।



ফয়সাল ভাইকে আমার বেশ অপরিচিত লাগছে। এমন কড়া কড়া আর ভাবলেশহীন কথাবার্তা শুনে আমার খুব কান্না পাচ্ছে। আমার কেনজানি খুব চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে। আমার দুচোখ পানিতে টলমল করছে। এই চোখ ফয়সাল ভাই দেখেছে। দেখেছে বলেই হয়তো আমার দিকে না তাকিয়ে কথা বলছে। আমার গলা আস্তে আস্তে ভারি হয়ে আসছে। ভীষণ ভারি। আমি এই ভারি গলায় আরও একবার মিনতি করে বললাম, প্লিজ আমার জন্য শুধু একঘন্টা সময় আপনার কাছে চাই। আমি কখনও আর আপনার কাছে আসব না।



আমার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফয়সাল ভাই বলল, তুমি কাল ভোরে গালর্স স্কুলের সামনে এসো।



ফয়সাল ভাইয়ের এই একটা কথা শুনে আমি আর এক সেকেন্ডও তার দোকানের সামনে দাঁড়ালাম না। বাসায় ফিরে আসলাম। সেদিন বাসায় ফিরে আমার একটুও কান্না পায়নি। আমি শুধু প্রতিটি সেকেন্ড গুনছি কখন ভোর হবে। কখন ভোর হবে।



সকাল সকাল আমি গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি স্কুলের সামনে। তখন সূর্যের আলো মাত্র ফুঁটছে। ফয়সাল ভাই আসার পর আমরা হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দাঁড়ালাম আমাদের এলাকা থেকে প্রায় মাইল খানেক দুরে রেল লাইনের পাশ ঘেষা বিশাল এক দিঘির ঘাটে। এই দিঘি অনেক বড় দিঘি। নানা জায়গা থেকে প্রচুর লোকজন দেখতে আসে। আমরা মাঝে মাঝে স্কুল পালিয়ে এই দিঘির ঘাটে এসে বসে থাকতাম। তবে বয়েজ স্কুলের ছেলেরা বেশি আসতো। শুনেছি আমাদের উপরের ক্লাসের মিতু আপা জাহিদ ভাইয়ের সাথে রোজ রোজ এখানে এসে দেখা করত। একদিন নাকি ধরাও পড়েছিলেন। তারপর থেকে ভয়ে আমরা এই দিঘির ঘাটে আসা বন্ধ করে দিয়েছি। আজ আমার একটুও ভয় করছে না। ভীষণ ভালো লাগছে। দিঘির ঘাটে কেউ নেই। সকাল সকাল বলে আশে পাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আমি আর ফয়সাল ভাই বসে আছি দিঘির ঘাটে বাধানো বেঞ্চে। ফয়সাল ভাই বসেছে আমার কাছ থেকে বেশ দুরে। তিনি খুব স্বাভাবিক। দিঘির জলের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা মাছরাঙা খুটির উপর বসে আছে। তিনি বেশ কিছুক্ষণ সেই মাছ রাঙার দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা দুজন চুপচাপ বসে আছি বেশ খানিকক্ষণ। কেউ কথা বলছি না। আমার মনে হচ্ছে আমাদের মধ্যে টুকটাক কথা হচ্ছে। নিজেদের ভেতর একটা যোগাযোগ হচ্ছে। প্রিয় মানুষগুলো পাশে বসে থাকলে সব সময় কথা বলতে হয় না। কথা না বলেও মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করা যায়। এই যোগাযোগটা শব্দহীন। আমার মনে হচ্ছে আমার আর ফয়সাল ভাইয়ের মধ্যে তেমন একটা যোগাযোগ হচ্ছে।



বেশ খানিক পরে আমি কিছু একটা বলতে যাবো অমনি ফয়সাল ভাই বললো, আমার মনে হয় তোমার পড়ালেখায় মন দেয়া উচিত। আমাকে নিয়ে আর ভাবার দরকার নেই। যদিও ভেবে কোন লাভও হবে না। আমার আর পড়ালেখা হচ্ছে না। এই বিষয়টা আমার মাথা থেকে বাদ দিয়েছি। সম্ভবও না। পুরো পরিবার আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের সম্ভল বলতে ঐ দোকানটা। এখন এটা নিয়ে এগুতে হবে। ভাই বোনগুলো মানুষ করা ছাড়া আমার কোন কাজ সামনে নেই।



এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে ফয়সাল ভাই একটু থামলেন। এই কথাগুলো বলতেই কেমনজানি হাঁপিয়ে উঠলেন তিনি। খুব বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। আমি জানি কথাগুলো অল্প হলেও বলতে তার খুব কষ্ট হয়েছে। আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি তার দিকে। আমি বললাম, সবকিছু কি এভাবে শেষ করা যায়?



ফয়সাল ভাই হাসলেন। কেমন যেন করুণ হাসি। হাসতে হাসতে বললো, সৃষ্টিকর্তা নিজে যেখানে এমন করে চেয়েছেন সেখানে আমি আর কি করতে পারি?



আমার খুব রাগ হলো। ভীষণ রাগ। আমি কাঁদছি আর চিৎকার করে বলছি, অবশ্যই সৃষ্টিকর্তা চায়নি। আপনি নিজে নিজেকে শেষ করছেন।



-কেউ নিজেকে শেষ করতে পারে না। সময় এবং পরিস্থিতিতে মানুষ হারিয়ে যায়। আমার এখন হারিয়ে যাবার সময় হয়েছে। আমি চাইলেও এর বেশি এগুতে পারব না।



-ভুল এটা ভীষণ ভুল। আপনি সাহস নিতে ভয় পাচ্ছেন। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার সাহস নিতে আপনার ভয় হচ্ছে।



আমার কথা শুনে ফয়সাল ভাই হাসছেন। হাসতে হাসতে বলছেন, তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ।



আমার বুকের ভেতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমি কাঁদছি পাগলের মত করে। যে মানুষটাকে আমি একটি বারের জন্য কোনদিন বলিনি আমি তাকে ভালোবাসি। অথচ আমি আজ তার সামনে বসে পাগলের মত করে কাঁদছি। আমি ভীষণ অসহায় আর আর্জি নিয়ে বলছি, প্লিজ ফয়সাল ভাই, প্লিজ। আপনি একটিবার চেষ্টা করুন। আপনি যতদিন বলবেন আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো। প্লিজ।



ফয়সাল ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কি এক মায়া আর ভালোবাসা নিয়ে তাকানো। তার চোখ দুটি ছল ছল করছে। এখন মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি আমি ফয়সাল ভাইকে হারাতে যাচ্ছি। আমার কান্নার বেগ বাড়ছে। হারানোর ভয়, শংকা আর অসহায়ত্বে আমার বুকের ভেতরে সবকিছু ওলট পালট হতে শুরু করেছে।



হুট করে ফয়সাল ভাই আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, দেখো তুমি অনেক সুখী হবে। আমাকে নিয়ে শুধু শুধু সময় নষ্ট করোনা।



কথাগুলো বলে ফয়সাল ভাই আমার দিকে আর ফিরে না তাকিয়ে হাঁটা শুরু করলো। দিঘির ঘাটে বসে আমি কাঁদছি। একদৃষ্টে ফয়সাল ভাইয়ের চলে যাওয়া দেখে আমি কাঁদছি। হ্যাঁ ফয়সাল ভাই একটিবারও আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখেনি। আমি শুধু তার হেঁটে যাওয়া দেখেছি। এমন করে ফয়সাল ভাই কখনো হাঁটে না। তিনি পরাজিত মানুষের মত করে হাঁটছেন। তার হেঁটে যাওয়ার প্রতিটা পা ফেলা আমি দেখছি আর উপলব্ধি করেছি।



একুশ বছর। এই একুশ বছর আমি আর এই ফয়সাল ভাইয়ের মুখ দেখিনি। আমার ফাষ্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার পর পর সাজিদের সাথে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর পরই আমি সাজিদের সাথে কানাডায় চলে আসি। সাজিদের পরিবার আগে থেকেই এখানে সেটেল্ড। একুশ বছর পেরিয়ে গেল। মাঝে মাঝে বছর তিন চারেক পর পর দেশে গেলেও ঐ এলাকায় যাওয়া আর হয়ে উঠেনি। আব্বা ঐ এলাকা ছেড়ে বাড়ি করেছেন পাশের একটা এলাকায়। দেশে গেলে নতুন বাড়িতেই যাওয়া হয়। বলতে গেলে ঐ এলাকার কথা প্রায় ভুলে গিয়েছি।



আমার বড় ফুপু থাকেন ঐ এলাকায়। এবার দেশে এসে জানতে পারলাম ফুপু বেশ অসুস্থ। ভাবলাম গিয়ে দেখে আসি। সাথে আমার দুই মেয়েও আছে। গাড়িতে বসে আছি। গাড়ি সেই জননী স্টোর দোকানের কাছে আসতেই বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো। ষ্পষ্ট আমার সবকিছু মনে পড়তে শুরু করলো। কি কারণে যেন গাড়িটা সেই দোকানের সামনে গিয়ে আটকে আছে। আমি অধীর হয়ে তাকিয়ে আছি দোকানের দিকে। হ্যাঁ, হ্যাঁ এই মাত্র একটি বার আমি তার মুখ দেখেই চিনেছি। আমি কল্পনাও করিনি এই মানুষটাকে এত বছর পর এই দোকানে ঠিক দেখব। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো ফয়সাল ভাইয়ের এই দোকানটাই এখন যে মানুষটা আছে তাকে দেখার। আমি নিশ্চিত ছিলাম তিনি হয়তো এখন অন্যকিছু করেন। হয়তো আবার পড়ালেখা করে অনেক পাল্টে গিয়েছে। নানা কিছু ভাবতে ভাবতে নিজের অতীত পাগলামি নিয়ে যখন মনে মনে হাসছিলাম ঠিক তখন এই মানুষটার মুখটা দেখে আমার সবকিছ উলট পালট হয়ে গেল। আমি জানিনা আমার কি হয়েছে। আমার বেশ অস্থির লাগছে। কেন জানিনা।



আমার আর ফয়সাল ভাইয়ের বিষয়ে এলাকার কেউ কিছু জানতো না। জানার কথাও না। বিষয়টাতো প্রকাশ হওয়ার আগেই শেষ হয়েছে। ফুপুর বাসায় এসে নানা কথায় জানতে পারলাম ফয়সাল এই দোকান করেই বোন দুইটার বিয়ে দিয়েছেন। ভাইটাকে পড়ালেখা করিয়েছেন। তবে নিজে এখনো বিয়ে শাদী করেননি। কেন করেননি কেউ জানেনা। সবার এক কথা, ছেলেটা পরিবারের জন্য নিজের পুরোটা জীবন দিয়ে দিল। সবাই কত জোরাজুরি করলো বিয়ে শাদী করতে। তিনি কিছুতেই রাজি হন না।



ফুপুর বাসায় এসে এসব শুনে আমি কেমন হয়ে গেলাম বুঝতে পারলাম না। আমার আর কিছুই ভালো লাগছে না। আমিতো বিষয়টা ভুলেই গিয়েছি। ঠিক একুশ বছর পর এসে আমার মনে হচ্ছে আমি ঠিক একুশ বছর আগের মানুষটা হয়ে গিয়েছি। আমার বুকের ভেতর যে শূণ্যতা, যে অস্থিরতা হচ্ছে তাতে আমার মনে হচ্ছে আমি ঠিক আগের মত এই ফয়সাল ভাইকে ভালোবাসি। আমার সন্তান, সংসার সবকিছু কেমনজানি অচেনা মনে হচ্ছে। প্রচন্ড তৃষ্ণা পেলে মানুষ যেমন অস্থির হয়ে উঠে, আমার ঠিক তেমনটা লাগছে।



পরদিন খুব ভোরে আমি ফয়সাল ভাইয়ের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এখনও দোকান খোলেনি। না খোলারই কথা। এত সকাল সকাল কেউ দোকান খুলে বলে মনে হয়না। তারপরও আমি গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। খানিক বাদে ফয়সাল ভাই আসলেন। দোকানের সামনে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেথেই কেমন স্তব্ধ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু একটা বলতে চা্ইছেন কিন্তু পারছেন না। আমিই বললাম, আমাকে চিনতে পেরেছেন?



ফয়সাল ভাই চুপ করে আছেন। আমি আবারও বললাম, চিনতে পেরেছেন আমাকে?



ফয়সাল ভাই শুধু মাথা নাড়লো। মাথা নেড়ে বললো, তুমি শিমু। কথাটা বলেই কি মনে করে উনি আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দোকান খুলতে ব্যস্ত হলেন।



আমি বললাম, দোকান একটু পর খোলেন। আপনার সাথে আমার কথা আছে।



ফয়সাল ভাই কোন উত্তর দিলেন না। দোকান না খুলে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাকানোর মায়াটা তার এখনো ঠিক আগের মতই আছে। আমার মনে হচ্ছে এমন মায়া করে অনেকদিন কেউ আমার দিকে তাকায়নি।



ঠিক এই ভোরেই আমি আর ফয়সাল ভাই একুশ বছর আগে আসা সেই দিঘির ঘাটে বসে আছি। দিঘিটা আগের মতই আছে। এখন বরং দেখতে বেশ সুন্দর হয়েছে। চারিদিকে প্রচুর গাছপালা। আমি আর ফয়সাল ভাই চুপচাপ বসে আছি অনেকক্ষণ। বেশ খানিক বাদে আমাকে অবাক করে দিয়ে ফয়সাল ভাই বললো, ঋতু আর ইতু কেমন আছে?



-আপনি আমার মেয়েদের কথা জানেন?



-জানি।



-আর কি কি জানেন?



এবার ফয়সাল ভাই একটা মুচকি হাসি দিলেন। তার হাসি দেখে আমি একটু কঠিন করেই বললাম, কেন জীবনটা এভাবে পার করে দিলেন?



এবারও তিনি হাসলেন। এই হাসি দেখে আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগলো। ভীষণ অসহায়। আমার গলাটা ভারি হয়ে আসছে। এই ভারি গলা দিয়েই আমি বললাম, একটুও হেয়ালী করবেন না।



ফয়সাল ভাই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলা শুরু করলো, তোমার বিয়ের পর আমি একটুও কষ্ট পায়নি। বরং খুশি হয়েছি। আমার টানাপোড়নের মাঝ থেকে তোমাকে সরিয়ে দেবার কাজটা সত্যি আমাকে ভীষণ খুশি করেছিলো। কারণ আমি তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছি। ভাইবোনদের মানুষ করতে করতে সময় অনেক পেরিয়েছে। অনেককিছু পরিবর্তন হলেও এই দোকান, এই এলাকা ছেড়ে চলে যাবার সাহস আমার কখনো হয়নি। তোমার ফুপুর বাড়ির লোকজনের কাছে কথার চলে মাঝে মাঝে তোমার খোঁজ পাই। তোমার বাচ্চা হওয়া থেকে শুরু করে নানা খবর আমার কাছে সব সময় ছিলো আনন্দের। বছর তিন চারেক পর পর তুমি দেশে আসতে। আমি প্রতিবারই অধীর হয়ে প্রহর গুনতাম তুমি একদিন আমার দোকানে এসে একটিবারের জন্য হলেও আমার সামনে দাঁড়াবে। প্রতিবারই তুমি দেশে আসো আর ফিরে যাও। তোমার সাথে আমার দেখা আর হয়ে উঠে না। তুমি যখন দেশে থাকো তখন রোজদিনই আমি ভোরে দোকান খুলি। কেন জানিনা। আমার প্রতিদিনই মনে হয় তুমি বুঝি সকাল সকাল আমার দোকানে এসে অপেক্ষা করছো। ঐ সময়টায় আমি ভীষণ অস্তির হয়ে সকাল সকাল দোকানে আসি। ছোট ভাইটা খুব বারণ করে দোকান করতে। ছেড়ে দিতে বলে রোজ রোজ। কিন্তু আমি বলে দিয়েছি এই দোকান ছাড়া যাবে না। তুমি যখন দেশ থেকে ফিরে যাও তখন খুব হতাশ হয়ে পড়ি। তারপরও আবার ভাবি নিশ্চয় পরেরবার দেশে আসলে দেখা হবে। আমি জানি এটা ভীষণ পাগলামি। এমন পাগলামি ঠিক না। তারপরও এই পাগলামি আমি করি। এটা ভাবতে, করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমারতো আর কিছু করার নেই। বিশ্বাস করো, যখনই তোমার কোন ভালো সংবাদ শুনি কি যে ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে। এভাবে ভেবে ভেবে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে।



শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে ফয়সাল ভাইয়ের গলাটা ভারি হয়ে এলো। আমি তাকিয়ে আছি অন্য দিকে। আমি বুঝতে পারছি ফয়সাল ভাই কাঁদছে। আমি ইচ্ছে করে তার দিকে তাকাচ্ছি না। ফয়সাল ভাইয়ের দিকে তাকানোর সাহস আমার নেই।



আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছি। বাচ্চাদের মত করে। এত বছর পর সংসার, স্বামী, সন্তান সবার থেকে আলাদা হয়ে একুশ বছর আগের একটা মানুষের জন্য কাঁদছি। আমার বুকের ভেতরটা ফেটে যেতে চাইছে। আমি দিঘির জলের দিকে তাকিয়ে কাঁদছি। একুশ বছর ধরে লালন করা একটা মানুষের ভালোবাসার ভার আমি সত্যিই নিতে পারছি না। এত বিশাল ভালোবাসা গ্রহণের যোগ্যতা বা ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেননি। আমি ফয়সাল ভাইকে রেখে হাঁটা শুরু করলাম। ঠিক একুশ বছর আগে এই ফয়সাল ভাই আমাকে ঠিক এই জায়গায় রেখে চলে গিয়েছিলেন। আমার সেদিন মনে হয়েছিল ফয়সাল ভাই হয়তো আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসেননি। ঠিক একুশ বছর পর আমি ঠিকই বুঝলাম আসলে ঐদিন আমাকে রেখে গিয়ে আমার সবটুকু ভালোবাসা তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন। আজ ঠিক একই জায়গায় এসে আমাকে আমার ভালোবাসা দ্বিগুন করে ফিরিয়ে দিয়েছেন।



আমি কাঁদছি আর হাঁটছি। পেছনে তাকাতে আমার একটুও ইচ্ছে করছে না। পেছনে তাকাতে আমার খুব ভয় হচ্ছে। সত্যিকারের ভালোবাসা পুষে রাখা মানুষের দিকে তাকানোর সাহস আমার নেই।


(সমাপ্ত)
 

Users who are viewing this thread

Back
Top