পাক্কা ১ ঘণ্টা কমলাপুর স্টেশনে অপেক্ষা করানোর পর মেজো ভাইয়্যা ফোন দিয়ে বললো,
- অরু,তুই আমার অফিসে চলে আয়। একটা জরুরী মিটিং এ আটকে গেছি রে।
স্টেশন থেকে বের হয়ে খানিকটা সামনে এগিয়ে উবার কল করে নিলাম। ঢাকার সুখ্যাত ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে বনানী পৌঁছালাম দুপুর ১২ টায়। এই গরমে ৭ ঘণ্টা নাইট জার্নি করে আবার এই এক্সট্রা জার্নি টা শরীরে সায় দিচ্ছিলো না। শরীরের সাথে সাথে মেজাজও খানিকটা বিগড়ে আছে তাই।
অফিসের ক্যান্টিনে মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছি আমি আর মেজো ভাইয়্যা। আমাকে সামনে বসিয়ে রেখে সে এখন পর্যন্ত তিনটা ইমার্জেন্সী কল এটেন্ড করেছে। আর আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে বসে তামাশা দেখছি। ২০ মিনিট পর কথা শেষ করে মোবাইল টা টেবিলের উপর রেখে আমার দিকে মনোযোগ দিলো ভাইয়্যা,
- হ্যাঁ তারপর,কি খবর বল। তার আগে বল কি খাবি?
আমি টেবিলের উপর দু'হাত রেখে সোজাসুজি উত্তর দিলাম,
- কিছু না। যে কাজে এসেছি,সেই কাজ টা কখন হচ্ছে?
- এখান থেকে লাঞ্চ করে বের হতে চাচ্ছিলাম।
- তোর লাঞ্চের দরকার হলে তুই করে নে। কিন্তু আমার হাতে সময় কম।
- এতটা জার্নি করে আসলি,কিছু খাবি না?
- এতটা জার্নি করে এসে যখন ১ ঘণ্টা স্টেশনে বসে থাকতে পেরেছি তখন না খেয়ে সারাটাদিনও কাটিয়ে দিতে পারবো। নেহায়েত তোর সিগনেচার টা লাগবে বলে,নয়তো...। যাই হোক আমার তাড়া আছে,প্লিজ তাড়াতাড়ি কর।
গাড়িতে বসে ভাইয়্যা জিজ্ঞেস করলো,
- কোথায় উঠবি কিছু ঠিক করেছিস?
ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে উত্তর দিলাম,
- চিন্তা করিস না,তোর বাড়িতে উঠছি না,এটা নিশ্চিত থাকতে পারিস।
- তুই এভাবে ঠেস দিয়ে কথা বলছিস কেন অরু? যা হয়েছে তাতে আমার কোনো হাত ছিল না। আমি জাস্ট পরিস্থিতির স্বীকার।
এবার আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ভাইয়্যার দিকে তাকালাম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে,
- পরিস্থিতির স্বীকার নাকি বউয়ের স্বীকার?
ভাইয়্যা কোনো প্রতিউত্তর করলো না।
কোনো সিগন্যালে পড়তে হল না বলে ৪৫ মিনিটের মধ্যেই "আপন ঠিকানা" বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছে গেলাম। বাইরে থেকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে এটা একটা বৃদ্ধাশ্রম। দোতলা হাফ বিল্ডিং। পাশেই কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। ভেতরে ঢুকে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। সামনে খোলা মাঠের মত জায়গাটায় রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে। আরেকটু এগিয়ে গেলে চোখে পড়ছে ছোট ছোট খুপরির মত ১৩/১৪ খানা থাকার ঘর। প্রত্যেকটা ঘরে নাকি তিনজন করে থাকে। তার উপর ঘরের সাথে কোনো লাগোয়া বাথরুম নেই। প্রতি দুই ঘরের জন্য একটা বাথরুম বরাদ্দ,মানে দাঁড়াচ্ছে ছয়জন একটা বাথরুম শেয়ার করে। সব মিলিয়ে পুরো পরিবেশ টা বেশ অস্বাস্থ্যকর। টানা তিন টা মাস আমার বাবা কে এই পরিবেশে থাকতে হয়েছে,এটা ভাবতেই আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। যে মানুষ টা সারাজীবন সৌখিন জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন,তাকে কিনা আজ এভাবে দিন পার করতে হচ্ছে!
ভাইয়্যা ম্যানেজারের সাথে কথা বলছেন,আমি গিয়ে তার পাশে বসলাম। ম্যানেজার ভাইয়্যা কে উদ্দেশ্য করে বলছেন,
- মাত্র তিন মাস হল আপনার বাবা কে এখানে দিয়ে গেলেন। এর মধ্যেই নিয়ে যাচ্ছেন! আসলে এখানে যারা আসেন সাধারণত তাদের ফিরে যাওয়ার খুব একটা সম্ভাবনা থাকে না। তাই আর কি একটু অবাক হচ্ছি। নিন,এই যে এখানটায় সিগনেচার করুন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
- আপনাদের পরিবেশ টা এমন কেন? এখানে থাকলে একজন সুস্থ মানুষও তো অসুস্থ হয়ে যাবে।
ম্যানেজার ভদ্রতাসূচক হাসি দিলেন,
- আমাদের এই আশ্রম টা একদম নতুন বলতে পারেন। সেভাবে কিছু গুছিয়ে নেয়া হয়নি এখনো। তাছাড়া আমরা যেমন সেবা দিতে পারছি,তেমনটাই পারিশ্রমিক রাখছি। এতটুকুও বেশি রাখছি না। আর আপনার ভাই তো সব দেখেশুনেই আপনাদের বাবা কে এখানে রেখে গিয়েছিলেন।
ভাইয়্যার দিকে একবার তাকালাম আমি। আমার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে ভাইয়্যা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। কাগজপত্রে সিগনেচারের কাজ শেষ হয়ে গেলে ম্যানেজার একটা অল্প বয়সী ছেলে কে বললেন বাবা কে নিয়ে আসার জন্য। ছেলেটি চলে যেতে নিলে আমি ম্যানেজারের কাছে অনুমতি চাইলাম,
- আমি কি বাবার কাছে যেতে পারি?
- হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আপনি ওর সাথে যান।
১৫ নম্বর রুমটায় ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধে আমার গা গুলোতে শুরু করলো। রুমের মাঝখানে সারিবদ্ধভাবে পাশাপাশি তিনটা সিংগেল বেড পাতানো, বেডের কাছে একটা ছোট টেবিল। বাবা চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে টেবিলের উপর রাখা ভাতের প্লেট টা তে ভাতগুলো নাড়াচাড়া করছেন। প্লেটের দিকে খেয়াল করে দেখলাম,মোটা চালের ভাত আর একটা ডিম ভুনা। দৃশ্য টা দেখে আমার বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠলো। বাবা মোটা চালের ভাত কখনোই খেতে পারতেন না। আর ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, ডিম ভুনা বাবার পছন্দ না।
আমি "বাবা" বলে একবার ডাক দিতেই বাবা মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। আমি বাবা কে নিয়ে যেতে এসেছি শুনে বাবার চোখ দুটো আনন্দে চিকচিক করে উঠলো।
চলে আসার সময় ভাইয়্যা বলেছিলো,আমাদের ড্রপ করে দিয়ে আসবে। কিন্তু আমার কেন জানি ওর গাড়ি তে উঠতে ইচ্ছে করলো না। উবার ডেকে নিলাম।
আমি অরুনিমা। একটা সরকারি ব্যাংকে জব করছি। শুরুতে আমার পোস্টিং ছিল চিটাগাং এ। তখন আমার তিনভাই তাদের বউ বাচ্চা নিয়ে আমাদের সাথেই থাকতো। দু'বছর আগে একটা এক্সিডেন্টে আমার মা মারা যান। তারপর থেকে শুরু হয় যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবার গঠন। আমরা যে ফ্ল্যাটে থাকতাম সেটা তিন ভাই মিলে বিক্রি করে দিয়ে টাকা টা তিনজন মিলে ভাগ করে নেয়। শুনেছিলাম,সেই টাকা থেকে কিছু অংশ আমার জন্যও তুলে রাখা হয়েছে। অথচ ফ্ল্যাট টা বাবা কিনেছিলেন মায়ের নামে। ছোট ভাইয়্যা তার বউ নিয়ে মালয়েশিয়া স্যাটেল হয়ে যায়। আর মেজো ভাইয়্যা,বড় ভাইয়্যাও আলাদা সংসার শুরু করে। বিপত্তি দেখা দেয় বাবা কে নিয়ে। বাবা কার কাছে থাকবেন,এ নিয়ে টানা দু'সপ্তাহ আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হয়-বাবা ছয় মাস মেজো ভাইয়্যার কাছে থাকবেন আর বাকি ছয়মাস বড় ভাইয়্যার কাছে। বলে রাখা ভালো,আমার দুই ভাই ই একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তে ভালো স্যালারির জব করছে। তো সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাবা মেজো ভাইয়্যার সংসারে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু দু'মাস যেতে না যেতেই বাবা কে নিয়ে মেজো ভাইয়্যার সংসারে অশান্তি শুরু হয়ে গেল। বাবার বিরুদ্ধে মেজো ভাবীর অভিযোগের শেষ নেই। বাবা নাকি বাথরুম ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারেন না। রাতে বাবার কাশির শব্দে মেজো ভাবীর ঘুমের সমস্যা হয়। এমন আরো অনেক অযৌক্তিক অভিযোগ উঠে আসে বাবার নামে। মেজো ভাবীর কাছে এসব শুনে বড় ভাবীও বাবা কে নিতে অসম্মতি জানালেন। নিত্যনতুন অশান্তি সইতে না পেরে মেজো ভাইয়্যা আবারো বড় ভাইয়্যার সাথে আলোচনায় বসলো। আমার দুই ভাই তাদের বউদের খুশি করতে নিরুপায় হয়ে বাবা কে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার সিদ্ধান্ত নিলো। যদিও এই সিদ্ধান্তের পেছনে আমার দুই ভাবীর যথেষ্ট কেরামতি ছিল। কিন্তু তাতে কি! একটা শান্তিচুক্তি তো হল! চিটাগাং এ বসে বসে সব খবরই আমি পাচ্ছিলাম। তাই এই খবর টা পেয়ে আর চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না। দ্রুত ঢাকা ট্রান্সফারের জন্য এপ্লিকেশন জমা দিলাম। ঢাকা আসার একমাস আগে আমার ভার্সিটির ক্লোজ ফ্রেন্ড নাবিলার সাথে যোগাযোগ করে সব কিছু বলার পর বললাম,আমার জন্য একটা বাসা ভাড়া নিয়ে রাখতে আর যদি সম্ভব হয় আমি অফিসে চলে যাওয়ার পর বাবা কে দেখাশুনা করার জন্য ১ টা আয়া ম্যানেজ করে দিতে। আমার কথা অনুযায়ী নাবিলা দুই রুমের একটা বাসা ভাড়া নিয়ে রাখলো শ্যামলী তে। ফার্ণিচারের জন্য কিছু টাকাও পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এখন আমি বাবা কে নিয়ে শ্যামলী তে আমাদের বাপ-বেটির নতুন বাসায় যাচ্ছি।
বাসার ভেতরে ঢুকে আমি রীতিমত অবাক হয়ে গেলাম। কি সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো গুছানো সবকিছু। বিস্ময় চোখে নাবিলার দিকে তাকাতেই নাবিলা মুচকি হাসলো,
- সারপ্রাইজ। বাসা পছন্দ হয়েছে?
- অনেক। তাছাড়া এই অল্প কিছু ফার্ণিচার দিয়েও যে এত সুন্দর করে বাসা সাজানো যায়,তা আজ জানলাম। তোর আজকে অফিস ছিল না?
- ছিল কিন্তু ছুটি নিয়েছি। এত দূর থেকে আসছিস,তাও আবার আংকেল কে সাথে নিয়ে। তাই ছুটি না নিয়ে পারলাম না।
নাবিলা কে জড়িয়ে ধরে আমি কৃতজ্ঞতা জানালাম। নাবিলা আমার পিঠ চাপড়ে বললো,
- হয়েছে হয়েছে। যা,শাওয়ার নিয়ে আয়। আমি খাবার গরম করছি।
- খাবার গরম করছিস মানে? খাবার কিনে আনতে হবে না?
- খাবার যদি কিনেই আনতে হবে,তাহলে আমি সারাদিন থেকে করলাম টা কি?
- তুই না,পারিসও বাবা!
খাওয়াদাওয়া শেষ করে বাবা নিজের রুমে বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন। তারপর আমি আর নাবিলা মিলে আড্ডা দিতে বসে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ নানা বিষয় নিয়ে আড্ডা দেয়ার পর নাবিলা জিজ্ঞেস করলো,
- বাসাটা অনেক ছোট হয়ে গেল না অরু? আংকেল থাকতে পারবেন তো?
- বাবার জন্য একটু ছোট হয়ে গেছে ঠিকই। কিন্তু কি করবো বল,বেশিদিন তো হয় নি চাকরী তে জয়েন করেছি,তেমনভাবে কিছু জমাতেও পারি নি। আর হাতে যা ছিল সেসব তো ফার্ণিচারে লেগে গেল। তবে কয়েকমাসের মধ্যে একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলার চিন্তাভাবনা করছি।
- হুম। কিন্তু তুই কি সারাজীবন এভাবেই থাকবি নাকি? বিয়েশাদী করবি না?
- ধুর,সেই বয়স কি আর আছে নাকি!
নাবিলা এবার সোজা হয়ে বসলো,
- আলবত আছে। তোকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তুই 25+ দিনে দিনে যা সুন্দরী হচ্ছিস! আর তোর বডি ফিটনেসও তো মাশাল্লাহ্।
- অনেক হয়েছে। আর বাতাস দিতে হবে না।
- বাতাস না রে,সত্যি বলছি। ভার্সিটি তে কত ছেলে তোর দিওয়ানা ছিল তা কি ভুলে গেছিস? তোর জন্য আমাদের কেউ পাত্তাই দিতো না। কিন্তু হাতের কাছে এত ভাল ভাল ছেলে পেয়েও,পড়াশোনার জন্য বিয়ে করলি না। হ্যাঁ এটা ঠিক,তুই স্টুডেন্ট হিসেবে যথেষ্ট ভাল ছিলি, একটা ব্রাইট ফিউচার ছিল তোর। তাই বলে ক্যারিয়ারের জন্য সবকিছু বিসর্জন দিয়ে দিলি!
- সবকিছু কই বিসর্জন দিলাম। শুধু তো বিয়ে...
- ওই একই কথা। শোন এখনো সময় আছে,একটা ভাল ছেলে দেখে স্যাটেল হয়ে নে।
- হুম দেখি।
- ইশ্,অনেকটা দেরী হয়ে গেছে রে। আমি আজ উঠি।
- থেকে যা না আজকে।
- না রে। ঝুমু টা আমাকে ছাড়া ঘুমোতে চায় না।
আমি দুষ্ট ইশারা করে জিজ্ঞেস করলাম,
- ঝুমু টা নাকি ঝুমুর বাবা টা,হুম?
- যাহ,তোর মুখে না কিচ্ছু আটকায় না।
নাবিলা কে বিদায় দিয়ে আমি বাবার কাছে গেলাম। বাবা বই পড়তে পড়তে চেয়ারে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছেন। সাবধানী ভঙ্গী তে চোখ থেকে চশমা টা খুলে নিলাম। তখন আমার নজরে পড়লো,বাবার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। এই ক'মাসে অনেকখানি বুড়িয়ে গেছেন।
আমার বাবা-মা দুজনই ব্যাংকে জব করতেন। তাই আল্লাহ্র রহমতে আমাদের সংসারে ভাল সচ্ছলতা ছিল। সবাই বলে,মেয়েরা নাকি মায়ের চেয়ে বাবাদের টান বেশি টানে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ঘটেছে পুরো উল্টো ঘটনা। আমি মা'র সাথে ফ্রি ছিলাম বেশি। বাবাকে ছোটবেলা থেকে খুব একটা কাছে পাই নি বাবার ব্যস্ততার কারণে। তাছাড়া বাবার গম্ভীরতার জন্য বেশ ভয় পেতাম তাঁকে। বাবা বাসায় ফেরার আগেই ঘুমিয়ে পড়তাম যেন বাবার মুখোমুখি হতে না হয়। তবে আমার মত আমার অন্য তিন ভাই আবার বাবাকে এতটা ভয় পেতো না। তাদের সব আবদার বাবা অবলীলায় পূরণ করতেন। আর আমি তো ভয়ের ছোটে বাবার কাছে কোনো আবদার ই করতে পারতাম না। তাই ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে আমার একটা অদৃশ্য দূরত্ব থেকে গেছে,যা এখনো ঘুচে নি। অথচ আদরের বেলায় বাবা আমাকে অন্য তিন ভাইদের তুলনায় যে বেশি আদর করতেন,এটা আমি বেশ বুঝতে পারতাম। বাবার সাথে খেতে বসলে মাছের মাথা টা সবসময় আমার প্লেটে তুলে দিতেন বাবা। ঈদের সময় বড় একটা বাজেট বরাদ্দ থাকতো আমার জন্যে। আমার মধ্যেও বাবার প্রতি এক ধরনের আলাদা টান কাজ করতো সবসময়। বাবা অফিসিয়াল কাজে কখনো ঢাকার বাইরে গেলে আমার খুব মন খারাপ হত,কিন্তু কাউকে বুঝতে দিতাম না। বড় ভাইয়্যা রেজাল্ট খুব একটা ভাল করতো না বলে বাবা খুব কষ্ট পেতেন,এ কষ্টটাও যেন আমার কলিজায় গিয়ে বিঁধতো তখন। মোট কথা আমার আর বাবার ভালোবাসা টা সবসময় ই লুকোচুরি স্বভাবের ছিল।
পরদিন বিকেলবেলা নাবিলা কল করে বললো,
- অরু,তুই আয়ার কথা বলেছিলি না?পেয়েছি একজন কে। আংকেলের দেখাশুনার জন্য একদম পারফেক্ট।
- ঠিক আছে। তুই তাহলে উনাকে কাল আমার কাছে পাঠিয়ে দিস। কথা বলে সব ঠিকঠাক করে ফেলবো। ভালোই হল,এর মধ্যে ম্যানেজ হয়ে গেছে। খুব টেনশনে ছিলাম জানিস,কাল ই তো আমার ছুটি শেষ হয়ে যাবে।
- হুম আচ্ছা। কিন্তু একটা কথা আছে অরু।
- কি,বল?
- বলছি যে, মেয়েটা এডুকেটেড,ভদ্র ফ্যামিলির। ঠেকায় পড়ে এই কাজ টা করতে রাজি হয়েছে। ওকে দিয়ে অন্য কোনো কাজ করানো টা ঠিক হবে না।
- তুই চিন্তা করিস না। আমি এমনিতেও ওকে দিয়ে অন্য কোনো কাজ করাতাম না। আমি যতক্ষণ অফিসে থাকবো,ততক্ষণ ও শুধু বাবার খেয়াল রাখবে। যাই হোক,ওর নাম টা কি?
- রজনী।
এর কিছুদিন পর একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে আমার কাছে। আমি তখন অফিসে ছিলাম। কল রিসিভ করলাম আমি,
- হ্যালো, কে বলছেন?
- বলছি কেউ একজন। কেমন আছেন আপনি?
কণ্ঠ টা বেশ চেনা চেনা লাগলেও ঠিক ধরতে পারছিলাম না। তাই আবারো জিজ্ঞেস করলাম,
- কে বলছেন প্লিজ?
ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসলো,
- তোর ভয়েস টা এখনো সেই আগের মতোই সেক্সি আছে রে অরু।
আমি যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য হার্টবিট মিস করলাম,
- আদিল? এতদিন পর? আমার নাম্বার পেলি কোথায়?
- তাও ভালো যে চিনতে পেরেছিস। নাবিলার কাছে শুনলাম তোর ঢাকায় ট্রান্সফার হয়েছে,তাই আর এই সুযোগ টা মিস করলাম না।
- ও,তাহলে কথা চালাচালির কাজ টা নাবিলাই করছে।
- উঁহু, না। চালাচালি এখনো হয় নি। আপাতত শুধু সেল নাম্বার টা নিতে পেরেছি।
সেদিন আদিলের সাথে প্রায় ২৫ মিনিটের মত কথা হল আমার। কথা আরো চলতো যদি না আমি অফিসে থাকতাম। আদিল আমার ক্লাসমেট। একসময় ওর আর আমার এক গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ভার্সিটির সব ছেলেরা যেখানে আমার সাথে প্রেম করতে চাইতো,সেখানে একমাত্র আদিল ই ছিল যে কিনা প্রেম ভালবাসা বাদ দিয়ে আমার সাথে শুধু বন্ধুত্ব করতে এসেছিলো। প্রথমে ভেবেছিলাম এটা প্রি-প্রপোজের একটা স্টেপ মাত্র। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। আদিল কখনোই আমার সাথে কোনো চান্স নেয়ার চেষ্টা করে নি। ওর সাথে নির্দ্বিধায় আমি মনের সব কথা শেয়ার করতে পারতাম। খুব ভালো বন্ধু ছিলাম আমরা। ভার্সিটি তে ও ই ছিল আমার একমাত্র ছেলেফ্রেন্ড। আদিল দেখতে আহামরি কিছু ছিল না কিন্তু ওর খুব সুন্দর একটা মন ছিল। তাছাড়া ওর পারসোনালিটি বরাবরই আমাকে মুগ্ধ করতো। এভাবে চলতে চলতে এক সময় আমিই ওর প্রেমে পড়ে গেলাম,কিন্তু প্রকাশ করলাম না। আর আদিলও বুঝতে পারলো না। ভেবেছিলাম,গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে গেলে ওকে আমি আমার মনের কথা জানাবো। ও নিশ্চয়ই আমাকে ফিরিয়ে দিবে না। কিন্তু বিধি বাম। হঠাৎ করে আদিল আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তারপর একদিন শুনি ও আমেরিকা চলে গেছে। ওখানে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করবে। বড্ড অভিমান হয়েছিল আমার। সেই অভিমান পুষে রেখে ওর সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করি নি।
দু'দিন পর আদিল আমাকে ওর সাথে দেখা করতে বলে। আমিও পুরনো সবকিছু ভুলে রাজি হয়ে যাই। অফিস টাইমের পর আমরা একটা কফিশপে বসলাম। মুখোমুখি বসে আছি আমি আর আদিল,
- আচ্ছা অরু,তোর বয়স কি বাড়ছে নাকি কমছে রে?
ভ্রু কুঁচকে ফেললাম আমি,
- কেন?
- তুই আগের থেকেও বেশি সুন্দরী হয়ে গেছিস।
- সে তো তুইও আগের থেকে অনেক হ্যান্ডসাম হয়ে গেছিস,কই তার বেলায় কি আমি কিছু বলেছি?
তারপর দুজনই হেসে উঠলাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আদিল আমতা আমতা করতে করতে বললো,
- অরু,তোকে এখনো আমার স্যরি বলা হয় নি। আসলে তখন আমাকে হুট করে এ সিদ্ধান্ত টা নিতে হয়েছিল যে তোকে জানানোর মত সময় পাই নি। আমি সত্যি....
- আদিল প্লিজ। পুরনো কথা তুলতে ইচ্ছে করছে না। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন আর এসব বলে কি হবে! সময় টা তো ফিরে আসবে না। বাদ দে। আমার এখন উঠতে হবে।
- কফি টা শেষ করে নে।
- না রে। এমনিতেই লেট হয়ে গেছে। বেশি দেরী হয়ে গেলে বাবা টেনশন করবেন। আমাকে আবার নীলক্ষেত যেতে হবে। বাবার জন্য কিছু বই কিনবো।
- ও। তাহলে আমি তোর সাথে নীলক্ষেত পর্যন্ত যাই? অনেকদিন টিএসসির মাল্টা চা খাওয়া হয় না।
আমি মুচকি হেসে সম্মতি জানালাম।
বাসায় এসে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রাতের রান্না টা করতে যাব এমন সময় রজনী এসে বললো,
- ম্যাডাম,আপনাকে এখন রান্নাঘরে যেতে হবে না। আপনার দেরী হচ্ছে দেখে আমি রান্না করে রেখেছি।
- তুমি রান্না করতে গেলে কেন? আর তোমাকে না বলেছি আমাকে ম্যাডাম না ডাকতে।
রজনী লজ্জা পেয়ে উত্তর দিলো,
- এখন অভ্যাস হয়ে গেছে ম্যাডাম। রান্না করতে আমার কোনো কষ্ট হয় নি। সবকিছু তো রেডি ই ছিল। তাছাড়া আংকেল তো টাইমলি খাওয়াদাওয়া করতে পছন্দ করেন।
রজনীর কাছে এগিয়ে গিয়ে আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম,
- তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ থাকলো না। তুমি যেভাবে বাবার যত্ন নাও,খেয়াল রাখো! এভাবে ক'জন তার দায়িত্ব টা পালন করে বলো! তুমি কিন্তু রাতে খেয়ে যাবে।
- না ম্যাডাম। তা সম্ভব হবে না। আমাকে ছাড়া আমার ছোট ভাই টা খেতে চায় না।
- ওহ্,তাহলে আর কি।
রাতে খাওয়ার সময় বাবা বললেন,
- তোমাকে আজ খুব রিফ্রেশ লাগছে।
আমি হাসিমুখে উত্তর দিলাম,
- আসলে আজ আমার এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে। অনেকদিন পর ওর সাথে আড্ডা হল তো তাই।
- হুম। মাঝে মাঝে এভাবে বন্ধুদের সাথে সময় কাটালেও তো পারো। তোমাদের বয়সে থাকতে আমরা কতকিছু করেছি জানো....
এভাবে গল্প করতে করতে বাবার খাওয়া শেষ হল ঠিকই কিন্তু গল্প শেষ হল না। সেদিন বাবা আর বই পড়লেন না। আমার সাথে গল্প করে করে সময় কাটিয়ে দিলেন। এমনিতে বাবা খুব কম কথার মানুষ। তাই হঠাৎ বাবাকে এত কথা বলতে দেখে আমার নিজেরও খুব ভাল লাগছিলো। তাছাড়া বাবা যে এত সুন্দর করে গুছিয়ে গল্প জমাতে পারেন,তা আগে জানা ছিল না। গল্প করতে করতেই বাবাকে ঔষুধ খাওয়ালাম,ব্রাশ করালাম। তারপর ঘাড়ে পিঠে গলায় ঘামাচির পাউডার দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতেই বাবা ঘুমে তলিয়ে গেলেন। আমি লাইট অফ করে দিয়ে নিজের রুমে চলে এলাম।
রুমে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি,আদিলের ২৩ টা মিসডকল। খানিকটা ভয় পেয়ে সাথে সাথে কল ব্যাক করলাম আমি,
- কই ছিলি অরু? কতবার কল করলাম....
- আরে বাবার রুমে ছিলাম। কেন কি হয়েছে?
- না মানে একটা দরকারে কল করেছিলাম।
- কি দরকার?
- আচ্ছা আমাদের ইকোনোমিক্স ডিপার্টমেন্টের নিজামের কথা মনে আছে তোর? ওর কথা বলার জন্যই....
এরকম করে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাহানায় আদিল আমাকে কল করতো। তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতাম।
আদিলের ফিরে আসায় দিনকে দিন আমি যেন নিজের ভিতরে অন্য এক আমি কে আবিষ্কার করতে শুরু করলাম। নিজের এ বদলে যাওয়া টা খুব ভাল করে উপলব্ধি করতে পারছিলাম। বুঝতে পারছিলাম আমি ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি। আমি চাইলেই আমার আবেগ কে নিজের আয়ত্তে এনে এ উন্মাদনা দমিয়ে রাখতে পারতাম কিন্তু কেন যেন ইচ্ছে করছিলো না নিজেকে আটকাতে। ইচ্ছে করছিলো না এত ন্যায়- অন্যায়,ঠিক-বেঠিক বিচার করতে। তাই নিজেই নিজেকে প্রশ্রয় দিয়ে এ গল্পে আরো কিছু পাতা জুড়ে নিচ্ছিলাম।
- অরু,তুই আমার অফিসে চলে আয়। একটা জরুরী মিটিং এ আটকে গেছি রে।
স্টেশন থেকে বের হয়ে খানিকটা সামনে এগিয়ে উবার কল করে নিলাম। ঢাকার সুখ্যাত ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে বনানী পৌঁছালাম দুপুর ১২ টায়। এই গরমে ৭ ঘণ্টা নাইট জার্নি করে আবার এই এক্সট্রা জার্নি টা শরীরে সায় দিচ্ছিলো না। শরীরের সাথে সাথে মেজাজও খানিকটা বিগড়ে আছে তাই।
অফিসের ক্যান্টিনে মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছি আমি আর মেজো ভাইয়্যা। আমাকে সামনে বসিয়ে রেখে সে এখন পর্যন্ত তিনটা ইমার্জেন্সী কল এটেন্ড করেছে। আর আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে বসে তামাশা দেখছি। ২০ মিনিট পর কথা শেষ করে মোবাইল টা টেবিলের উপর রেখে আমার দিকে মনোযোগ দিলো ভাইয়্যা,
- হ্যাঁ তারপর,কি খবর বল। তার আগে বল কি খাবি?
আমি টেবিলের উপর দু'হাত রেখে সোজাসুজি উত্তর দিলাম,
- কিছু না। যে কাজে এসেছি,সেই কাজ টা কখন হচ্ছে?
- এখান থেকে লাঞ্চ করে বের হতে চাচ্ছিলাম।
- তোর লাঞ্চের দরকার হলে তুই করে নে। কিন্তু আমার হাতে সময় কম।
- এতটা জার্নি করে আসলি,কিছু খাবি না?
- এতটা জার্নি করে এসে যখন ১ ঘণ্টা স্টেশনে বসে থাকতে পেরেছি তখন না খেয়ে সারাটাদিনও কাটিয়ে দিতে পারবো। নেহায়েত তোর সিগনেচার টা লাগবে বলে,নয়তো...। যাই হোক আমার তাড়া আছে,প্লিজ তাড়াতাড়ি কর।
গাড়িতে বসে ভাইয়্যা জিজ্ঞেস করলো,
- কোথায় উঠবি কিছু ঠিক করেছিস?
ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে উত্তর দিলাম,
- চিন্তা করিস না,তোর বাড়িতে উঠছি না,এটা নিশ্চিত থাকতে পারিস।
- তুই এভাবে ঠেস দিয়ে কথা বলছিস কেন অরু? যা হয়েছে তাতে আমার কোনো হাত ছিল না। আমি জাস্ট পরিস্থিতির স্বীকার।
এবার আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ভাইয়্যার দিকে তাকালাম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে,
- পরিস্থিতির স্বীকার নাকি বউয়ের স্বীকার?
ভাইয়্যা কোনো প্রতিউত্তর করলো না।
কোনো সিগন্যালে পড়তে হল না বলে ৪৫ মিনিটের মধ্যেই "আপন ঠিকানা" বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছে গেলাম। বাইরে থেকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে এটা একটা বৃদ্ধাশ্রম। দোতলা হাফ বিল্ডিং। পাশেই কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। ভেতরে ঢুকে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। সামনে খোলা মাঠের মত জায়গাটায় রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে। আরেকটু এগিয়ে গেলে চোখে পড়ছে ছোট ছোট খুপরির মত ১৩/১৪ খানা থাকার ঘর। প্রত্যেকটা ঘরে নাকি তিনজন করে থাকে। তার উপর ঘরের সাথে কোনো লাগোয়া বাথরুম নেই। প্রতি দুই ঘরের জন্য একটা বাথরুম বরাদ্দ,মানে দাঁড়াচ্ছে ছয়জন একটা বাথরুম শেয়ার করে। সব মিলিয়ে পুরো পরিবেশ টা বেশ অস্বাস্থ্যকর। টানা তিন টা মাস আমার বাবা কে এই পরিবেশে থাকতে হয়েছে,এটা ভাবতেই আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। যে মানুষ টা সারাজীবন সৌখিন জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন,তাকে কিনা আজ এভাবে দিন পার করতে হচ্ছে!
ভাইয়্যা ম্যানেজারের সাথে কথা বলছেন,আমি গিয়ে তার পাশে বসলাম। ম্যানেজার ভাইয়্যা কে উদ্দেশ্য করে বলছেন,
- মাত্র তিন মাস হল আপনার বাবা কে এখানে দিয়ে গেলেন। এর মধ্যেই নিয়ে যাচ্ছেন! আসলে এখানে যারা আসেন সাধারণত তাদের ফিরে যাওয়ার খুব একটা সম্ভাবনা থাকে না। তাই আর কি একটু অবাক হচ্ছি। নিন,এই যে এখানটায় সিগনেচার করুন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
- আপনাদের পরিবেশ টা এমন কেন? এখানে থাকলে একজন সুস্থ মানুষও তো অসুস্থ হয়ে যাবে।
ম্যানেজার ভদ্রতাসূচক হাসি দিলেন,
- আমাদের এই আশ্রম টা একদম নতুন বলতে পারেন। সেভাবে কিছু গুছিয়ে নেয়া হয়নি এখনো। তাছাড়া আমরা যেমন সেবা দিতে পারছি,তেমনটাই পারিশ্রমিক রাখছি। এতটুকুও বেশি রাখছি না। আর আপনার ভাই তো সব দেখেশুনেই আপনাদের বাবা কে এখানে রেখে গিয়েছিলেন।
ভাইয়্যার দিকে একবার তাকালাম আমি। আমার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে ভাইয়্যা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। কাগজপত্রে সিগনেচারের কাজ শেষ হয়ে গেলে ম্যানেজার একটা অল্প বয়সী ছেলে কে বললেন বাবা কে নিয়ে আসার জন্য। ছেলেটি চলে যেতে নিলে আমি ম্যানেজারের কাছে অনুমতি চাইলাম,
- আমি কি বাবার কাছে যেতে পারি?
- হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আপনি ওর সাথে যান।
১৫ নম্বর রুমটায় ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধে আমার গা গুলোতে শুরু করলো। রুমের মাঝখানে সারিবদ্ধভাবে পাশাপাশি তিনটা সিংগেল বেড পাতানো, বেডের কাছে একটা ছোট টেবিল। বাবা চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে টেবিলের উপর রাখা ভাতের প্লেট টা তে ভাতগুলো নাড়াচাড়া করছেন। প্লেটের দিকে খেয়াল করে দেখলাম,মোটা চালের ভাত আর একটা ডিম ভুনা। দৃশ্য টা দেখে আমার বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠলো। বাবা মোটা চালের ভাত কখনোই খেতে পারতেন না। আর ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, ডিম ভুনা বাবার পছন্দ না।
আমি "বাবা" বলে একবার ডাক দিতেই বাবা মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। আমি বাবা কে নিয়ে যেতে এসেছি শুনে বাবার চোখ দুটো আনন্দে চিকচিক করে উঠলো।
চলে আসার সময় ভাইয়্যা বলেছিলো,আমাদের ড্রপ করে দিয়ে আসবে। কিন্তু আমার কেন জানি ওর গাড়ি তে উঠতে ইচ্ছে করলো না। উবার ডেকে নিলাম।
আমি অরুনিমা। একটা সরকারি ব্যাংকে জব করছি। শুরুতে আমার পোস্টিং ছিল চিটাগাং এ। তখন আমার তিনভাই তাদের বউ বাচ্চা নিয়ে আমাদের সাথেই থাকতো। দু'বছর আগে একটা এক্সিডেন্টে আমার মা মারা যান। তারপর থেকে শুরু হয় যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবার গঠন। আমরা যে ফ্ল্যাটে থাকতাম সেটা তিন ভাই মিলে বিক্রি করে দিয়ে টাকা টা তিনজন মিলে ভাগ করে নেয়। শুনেছিলাম,সেই টাকা থেকে কিছু অংশ আমার জন্যও তুলে রাখা হয়েছে। অথচ ফ্ল্যাট টা বাবা কিনেছিলেন মায়ের নামে। ছোট ভাইয়্যা তার বউ নিয়ে মালয়েশিয়া স্যাটেল হয়ে যায়। আর মেজো ভাইয়্যা,বড় ভাইয়্যাও আলাদা সংসার শুরু করে। বিপত্তি দেখা দেয় বাবা কে নিয়ে। বাবা কার কাছে থাকবেন,এ নিয়ে টানা দু'সপ্তাহ আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হয়-বাবা ছয় মাস মেজো ভাইয়্যার কাছে থাকবেন আর বাকি ছয়মাস বড় ভাইয়্যার কাছে। বলে রাখা ভালো,আমার দুই ভাই ই একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তে ভালো স্যালারির জব করছে। তো সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাবা মেজো ভাইয়্যার সংসারে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু দু'মাস যেতে না যেতেই বাবা কে নিয়ে মেজো ভাইয়্যার সংসারে অশান্তি শুরু হয়ে গেল। বাবার বিরুদ্ধে মেজো ভাবীর অভিযোগের শেষ নেই। বাবা নাকি বাথরুম ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারেন না। রাতে বাবার কাশির শব্দে মেজো ভাবীর ঘুমের সমস্যা হয়। এমন আরো অনেক অযৌক্তিক অভিযোগ উঠে আসে বাবার নামে। মেজো ভাবীর কাছে এসব শুনে বড় ভাবীও বাবা কে নিতে অসম্মতি জানালেন। নিত্যনতুন অশান্তি সইতে না পেরে মেজো ভাইয়্যা আবারো বড় ভাইয়্যার সাথে আলোচনায় বসলো। আমার দুই ভাই তাদের বউদের খুশি করতে নিরুপায় হয়ে বাবা কে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার সিদ্ধান্ত নিলো। যদিও এই সিদ্ধান্তের পেছনে আমার দুই ভাবীর যথেষ্ট কেরামতি ছিল। কিন্তু তাতে কি! একটা শান্তিচুক্তি তো হল! চিটাগাং এ বসে বসে সব খবরই আমি পাচ্ছিলাম। তাই এই খবর টা পেয়ে আর চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না। দ্রুত ঢাকা ট্রান্সফারের জন্য এপ্লিকেশন জমা দিলাম। ঢাকা আসার একমাস আগে আমার ভার্সিটির ক্লোজ ফ্রেন্ড নাবিলার সাথে যোগাযোগ করে সব কিছু বলার পর বললাম,আমার জন্য একটা বাসা ভাড়া নিয়ে রাখতে আর যদি সম্ভব হয় আমি অফিসে চলে যাওয়ার পর বাবা কে দেখাশুনা করার জন্য ১ টা আয়া ম্যানেজ করে দিতে। আমার কথা অনুযায়ী নাবিলা দুই রুমের একটা বাসা ভাড়া নিয়ে রাখলো শ্যামলী তে। ফার্ণিচারের জন্য কিছু টাকাও পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এখন আমি বাবা কে নিয়ে শ্যামলী তে আমাদের বাপ-বেটির নতুন বাসায় যাচ্ছি।
বাসার ভেতরে ঢুকে আমি রীতিমত অবাক হয়ে গেলাম। কি সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো গুছানো সবকিছু। বিস্ময় চোখে নাবিলার দিকে তাকাতেই নাবিলা মুচকি হাসলো,
- সারপ্রাইজ। বাসা পছন্দ হয়েছে?
- অনেক। তাছাড়া এই অল্প কিছু ফার্ণিচার দিয়েও যে এত সুন্দর করে বাসা সাজানো যায়,তা আজ জানলাম। তোর আজকে অফিস ছিল না?
- ছিল কিন্তু ছুটি নিয়েছি। এত দূর থেকে আসছিস,তাও আবার আংকেল কে সাথে নিয়ে। তাই ছুটি না নিয়ে পারলাম না।
নাবিলা কে জড়িয়ে ধরে আমি কৃতজ্ঞতা জানালাম। নাবিলা আমার পিঠ চাপড়ে বললো,
- হয়েছে হয়েছে। যা,শাওয়ার নিয়ে আয়। আমি খাবার গরম করছি।
- খাবার গরম করছিস মানে? খাবার কিনে আনতে হবে না?
- খাবার যদি কিনেই আনতে হবে,তাহলে আমি সারাদিন থেকে করলাম টা কি?
- তুই না,পারিসও বাবা!
খাওয়াদাওয়া শেষ করে বাবা নিজের রুমে বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন। তারপর আমি আর নাবিলা মিলে আড্ডা দিতে বসে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ নানা বিষয় নিয়ে আড্ডা দেয়ার পর নাবিলা জিজ্ঞেস করলো,
- বাসাটা অনেক ছোট হয়ে গেল না অরু? আংকেল থাকতে পারবেন তো?
- বাবার জন্য একটু ছোট হয়ে গেছে ঠিকই। কিন্তু কি করবো বল,বেশিদিন তো হয় নি চাকরী তে জয়েন করেছি,তেমনভাবে কিছু জমাতেও পারি নি। আর হাতে যা ছিল সেসব তো ফার্ণিচারে লেগে গেল। তবে কয়েকমাসের মধ্যে একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলার চিন্তাভাবনা করছি।
- হুম। কিন্তু তুই কি সারাজীবন এভাবেই থাকবি নাকি? বিয়েশাদী করবি না?
- ধুর,সেই বয়স কি আর আছে নাকি!
নাবিলা এবার সোজা হয়ে বসলো,
- আলবত আছে। তোকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তুই 25+ দিনে দিনে যা সুন্দরী হচ্ছিস! আর তোর বডি ফিটনেসও তো মাশাল্লাহ্।
- অনেক হয়েছে। আর বাতাস দিতে হবে না।
- বাতাস না রে,সত্যি বলছি। ভার্সিটি তে কত ছেলে তোর দিওয়ানা ছিল তা কি ভুলে গেছিস? তোর জন্য আমাদের কেউ পাত্তাই দিতো না। কিন্তু হাতের কাছে এত ভাল ভাল ছেলে পেয়েও,পড়াশোনার জন্য বিয়ে করলি না। হ্যাঁ এটা ঠিক,তুই স্টুডেন্ট হিসেবে যথেষ্ট ভাল ছিলি, একটা ব্রাইট ফিউচার ছিল তোর। তাই বলে ক্যারিয়ারের জন্য সবকিছু বিসর্জন দিয়ে দিলি!
- সবকিছু কই বিসর্জন দিলাম। শুধু তো বিয়ে...
- ওই একই কথা। শোন এখনো সময় আছে,একটা ভাল ছেলে দেখে স্যাটেল হয়ে নে।
- হুম দেখি।
- ইশ্,অনেকটা দেরী হয়ে গেছে রে। আমি আজ উঠি।
- থেকে যা না আজকে।
- না রে। ঝুমু টা আমাকে ছাড়া ঘুমোতে চায় না।
আমি দুষ্ট ইশারা করে জিজ্ঞেস করলাম,
- ঝুমু টা নাকি ঝুমুর বাবা টা,হুম?
- যাহ,তোর মুখে না কিচ্ছু আটকায় না।
নাবিলা কে বিদায় দিয়ে আমি বাবার কাছে গেলাম। বাবা বই পড়তে পড়তে চেয়ারে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছেন। সাবধানী ভঙ্গী তে চোখ থেকে চশমা টা খুলে নিলাম। তখন আমার নজরে পড়লো,বাবার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। এই ক'মাসে অনেকখানি বুড়িয়ে গেছেন।
আমার বাবা-মা দুজনই ব্যাংকে জব করতেন। তাই আল্লাহ্র রহমতে আমাদের সংসারে ভাল সচ্ছলতা ছিল। সবাই বলে,মেয়েরা নাকি মায়ের চেয়ে বাবাদের টান বেশি টানে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ঘটেছে পুরো উল্টো ঘটনা। আমি মা'র সাথে ফ্রি ছিলাম বেশি। বাবাকে ছোটবেলা থেকে খুব একটা কাছে পাই নি বাবার ব্যস্ততার কারণে। তাছাড়া বাবার গম্ভীরতার জন্য বেশ ভয় পেতাম তাঁকে। বাবা বাসায় ফেরার আগেই ঘুমিয়ে পড়তাম যেন বাবার মুখোমুখি হতে না হয়। তবে আমার মত আমার অন্য তিন ভাই আবার বাবাকে এতটা ভয় পেতো না। তাদের সব আবদার বাবা অবলীলায় পূরণ করতেন। আর আমি তো ভয়ের ছোটে বাবার কাছে কোনো আবদার ই করতে পারতাম না। তাই ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে আমার একটা অদৃশ্য দূরত্ব থেকে গেছে,যা এখনো ঘুচে নি। অথচ আদরের বেলায় বাবা আমাকে অন্য তিন ভাইদের তুলনায় যে বেশি আদর করতেন,এটা আমি বেশ বুঝতে পারতাম। বাবার সাথে খেতে বসলে মাছের মাথা টা সবসময় আমার প্লেটে তুলে দিতেন বাবা। ঈদের সময় বড় একটা বাজেট বরাদ্দ থাকতো আমার জন্যে। আমার মধ্যেও বাবার প্রতি এক ধরনের আলাদা টান কাজ করতো সবসময়। বাবা অফিসিয়াল কাজে কখনো ঢাকার বাইরে গেলে আমার খুব মন খারাপ হত,কিন্তু কাউকে বুঝতে দিতাম না। বড় ভাইয়্যা রেজাল্ট খুব একটা ভাল করতো না বলে বাবা খুব কষ্ট পেতেন,এ কষ্টটাও যেন আমার কলিজায় গিয়ে বিঁধতো তখন। মোট কথা আমার আর বাবার ভালোবাসা টা সবসময় ই লুকোচুরি স্বভাবের ছিল।
পরদিন বিকেলবেলা নাবিলা কল করে বললো,
- অরু,তুই আয়ার কথা বলেছিলি না?পেয়েছি একজন কে। আংকেলের দেখাশুনার জন্য একদম পারফেক্ট।
- ঠিক আছে। তুই তাহলে উনাকে কাল আমার কাছে পাঠিয়ে দিস। কথা বলে সব ঠিকঠাক করে ফেলবো। ভালোই হল,এর মধ্যে ম্যানেজ হয়ে গেছে। খুব টেনশনে ছিলাম জানিস,কাল ই তো আমার ছুটি শেষ হয়ে যাবে।
- হুম আচ্ছা। কিন্তু একটা কথা আছে অরু।
- কি,বল?
- বলছি যে, মেয়েটা এডুকেটেড,ভদ্র ফ্যামিলির। ঠেকায় পড়ে এই কাজ টা করতে রাজি হয়েছে। ওকে দিয়ে অন্য কোনো কাজ করানো টা ঠিক হবে না।
- তুই চিন্তা করিস না। আমি এমনিতেও ওকে দিয়ে অন্য কোনো কাজ করাতাম না। আমি যতক্ষণ অফিসে থাকবো,ততক্ষণ ও শুধু বাবার খেয়াল রাখবে। যাই হোক,ওর নাম টা কি?
- রজনী।
এর কিছুদিন পর একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে আমার কাছে। আমি তখন অফিসে ছিলাম। কল রিসিভ করলাম আমি,
- হ্যালো, কে বলছেন?
- বলছি কেউ একজন। কেমন আছেন আপনি?
কণ্ঠ টা বেশ চেনা চেনা লাগলেও ঠিক ধরতে পারছিলাম না। তাই আবারো জিজ্ঞেস করলাম,
- কে বলছেন প্লিজ?
ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসলো,
- তোর ভয়েস টা এখনো সেই আগের মতোই সেক্সি আছে রে অরু।
আমি যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য হার্টবিট মিস করলাম,
- আদিল? এতদিন পর? আমার নাম্বার পেলি কোথায়?
- তাও ভালো যে চিনতে পেরেছিস। নাবিলার কাছে শুনলাম তোর ঢাকায় ট্রান্সফার হয়েছে,তাই আর এই সুযোগ টা মিস করলাম না।
- ও,তাহলে কথা চালাচালির কাজ টা নাবিলাই করছে।
- উঁহু, না। চালাচালি এখনো হয় নি। আপাতত শুধু সেল নাম্বার টা নিতে পেরেছি।
সেদিন আদিলের সাথে প্রায় ২৫ মিনিটের মত কথা হল আমার। কথা আরো চলতো যদি না আমি অফিসে থাকতাম। আদিল আমার ক্লাসমেট। একসময় ওর আর আমার এক গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ভার্সিটির সব ছেলেরা যেখানে আমার সাথে প্রেম করতে চাইতো,সেখানে একমাত্র আদিল ই ছিল যে কিনা প্রেম ভালবাসা বাদ দিয়ে আমার সাথে শুধু বন্ধুত্ব করতে এসেছিলো। প্রথমে ভেবেছিলাম এটা প্রি-প্রপোজের একটা স্টেপ মাত্র। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। আদিল কখনোই আমার সাথে কোনো চান্স নেয়ার চেষ্টা করে নি। ওর সাথে নির্দ্বিধায় আমি মনের সব কথা শেয়ার করতে পারতাম। খুব ভালো বন্ধু ছিলাম আমরা। ভার্সিটি তে ও ই ছিল আমার একমাত্র ছেলেফ্রেন্ড। আদিল দেখতে আহামরি কিছু ছিল না কিন্তু ওর খুব সুন্দর একটা মন ছিল। তাছাড়া ওর পারসোনালিটি বরাবরই আমাকে মুগ্ধ করতো। এভাবে চলতে চলতে এক সময় আমিই ওর প্রেমে পড়ে গেলাম,কিন্তু প্রকাশ করলাম না। আর আদিলও বুঝতে পারলো না। ভেবেছিলাম,গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে গেলে ওকে আমি আমার মনের কথা জানাবো। ও নিশ্চয়ই আমাকে ফিরিয়ে দিবে না। কিন্তু বিধি বাম। হঠাৎ করে আদিল আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তারপর একদিন শুনি ও আমেরিকা চলে গেছে। ওখানে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করবে। বড্ড অভিমান হয়েছিল আমার। সেই অভিমান পুষে রেখে ওর সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করি নি।
দু'দিন পর আদিল আমাকে ওর সাথে দেখা করতে বলে। আমিও পুরনো সবকিছু ভুলে রাজি হয়ে যাই। অফিস টাইমের পর আমরা একটা কফিশপে বসলাম। মুখোমুখি বসে আছি আমি আর আদিল,
- আচ্ছা অরু,তোর বয়স কি বাড়ছে নাকি কমছে রে?
ভ্রু কুঁচকে ফেললাম আমি,
- কেন?
- তুই আগের থেকেও বেশি সুন্দরী হয়ে গেছিস।
- সে তো তুইও আগের থেকে অনেক হ্যান্ডসাম হয়ে গেছিস,কই তার বেলায় কি আমি কিছু বলেছি?
তারপর দুজনই হেসে উঠলাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আদিল আমতা আমতা করতে করতে বললো,
- অরু,তোকে এখনো আমার স্যরি বলা হয় নি। আসলে তখন আমাকে হুট করে এ সিদ্ধান্ত টা নিতে হয়েছিল যে তোকে জানানোর মত সময় পাই নি। আমি সত্যি....
- আদিল প্লিজ। পুরনো কথা তুলতে ইচ্ছে করছে না। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন আর এসব বলে কি হবে! সময় টা তো ফিরে আসবে না। বাদ দে। আমার এখন উঠতে হবে।
- কফি টা শেষ করে নে।
- না রে। এমনিতেই লেট হয়ে গেছে। বেশি দেরী হয়ে গেলে বাবা টেনশন করবেন। আমাকে আবার নীলক্ষেত যেতে হবে। বাবার জন্য কিছু বই কিনবো।
- ও। তাহলে আমি তোর সাথে নীলক্ষেত পর্যন্ত যাই? অনেকদিন টিএসসির মাল্টা চা খাওয়া হয় না।
আমি মুচকি হেসে সম্মতি জানালাম।
বাসায় এসে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রাতের রান্না টা করতে যাব এমন সময় রজনী এসে বললো,
- ম্যাডাম,আপনাকে এখন রান্নাঘরে যেতে হবে না। আপনার দেরী হচ্ছে দেখে আমি রান্না করে রেখেছি।
- তুমি রান্না করতে গেলে কেন? আর তোমাকে না বলেছি আমাকে ম্যাডাম না ডাকতে।
রজনী লজ্জা পেয়ে উত্তর দিলো,
- এখন অভ্যাস হয়ে গেছে ম্যাডাম। রান্না করতে আমার কোনো কষ্ট হয় নি। সবকিছু তো রেডি ই ছিল। তাছাড়া আংকেল তো টাইমলি খাওয়াদাওয়া করতে পছন্দ করেন।
রজনীর কাছে এগিয়ে গিয়ে আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম,
- তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ থাকলো না। তুমি যেভাবে বাবার যত্ন নাও,খেয়াল রাখো! এভাবে ক'জন তার দায়িত্ব টা পালন করে বলো! তুমি কিন্তু রাতে খেয়ে যাবে।
- না ম্যাডাম। তা সম্ভব হবে না। আমাকে ছাড়া আমার ছোট ভাই টা খেতে চায় না।
- ওহ্,তাহলে আর কি।
রাতে খাওয়ার সময় বাবা বললেন,
- তোমাকে আজ খুব রিফ্রেশ লাগছে।
আমি হাসিমুখে উত্তর দিলাম,
- আসলে আজ আমার এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে। অনেকদিন পর ওর সাথে আড্ডা হল তো তাই।
- হুম। মাঝে মাঝে এভাবে বন্ধুদের সাথে সময় কাটালেও তো পারো। তোমাদের বয়সে থাকতে আমরা কতকিছু করেছি জানো....
এভাবে গল্প করতে করতে বাবার খাওয়া শেষ হল ঠিকই কিন্তু গল্প শেষ হল না। সেদিন বাবা আর বই পড়লেন না। আমার সাথে গল্প করে করে সময় কাটিয়ে দিলেন। এমনিতে বাবা খুব কম কথার মানুষ। তাই হঠাৎ বাবাকে এত কথা বলতে দেখে আমার নিজেরও খুব ভাল লাগছিলো। তাছাড়া বাবা যে এত সুন্দর করে গুছিয়ে গল্প জমাতে পারেন,তা আগে জানা ছিল না। গল্প করতে করতেই বাবাকে ঔষুধ খাওয়ালাম,ব্রাশ করালাম। তারপর ঘাড়ে পিঠে গলায় ঘামাচির পাউডার দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতেই বাবা ঘুমে তলিয়ে গেলেন। আমি লাইট অফ করে দিয়ে নিজের রুমে চলে এলাম।
রুমে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি,আদিলের ২৩ টা মিসডকল। খানিকটা ভয় পেয়ে সাথে সাথে কল ব্যাক করলাম আমি,
- কই ছিলি অরু? কতবার কল করলাম....
- আরে বাবার রুমে ছিলাম। কেন কি হয়েছে?
- না মানে একটা দরকারে কল করেছিলাম।
- কি দরকার?
- আচ্ছা আমাদের ইকোনোমিক্স ডিপার্টমেন্টের নিজামের কথা মনে আছে তোর? ওর কথা বলার জন্যই....
এরকম করে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাহানায় আদিল আমাকে কল করতো। তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতাম।
আদিলের ফিরে আসায় দিনকে দিন আমি যেন নিজের ভিতরে অন্য এক আমি কে আবিষ্কার করতে শুরু করলাম। নিজের এ বদলে যাওয়া টা খুব ভাল করে উপলব্ধি করতে পারছিলাম। বুঝতে পারছিলাম আমি ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি। আমি চাইলেই আমার আবেগ কে নিজের আয়ত্তে এনে এ উন্মাদনা দমিয়ে রাখতে পারতাম কিন্তু কেন যেন ইচ্ছে করছিলো না নিজেকে আটকাতে। ইচ্ছে করছিলো না এত ন্যায়- অন্যায়,ঠিক-বেঠিক বিচার করতে। তাই নিজেই নিজেকে প্রশ্রয় দিয়ে এ গল্পে আরো কিছু পাতা জুড়ে নিচ্ছিলাম।