What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected প্রথম দুপুর (1 Viewer)

Pegasus

Member
Joined
Mar 8, 2018
Threads
103
Messages
171
Credits
28,977
তিথি চুপসে আছে প্রচন্ড ভয়ে। পঁচিশ বৎসর বয়সের একটি মেয়ে প্রচন্ড ভয়ে চুপসে আছে মানে ব্যাপারটা সিরিয়াস। পাঁচ বৎসরের মেয়ে হলে অবশ্য স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হতো। তেলাপোকা দেখে একটি মেয়ে ভয় পাবে, এটাও স্বাভাবিক। আমি অস্বস্তিবোধ করছি ওর ভয়ার্ত চেহারা দেখে। এমন করে ভয় পেতে কখনো দেখিনি তাকে। তাও শুধু একটা ছবি দেখে।
তিথি আমার বৌ। গায়ের রং শ্যামলা। উচ্চতা মিডিয়াম, স্বাস্থ্য ভালোই। আমাদের বিয়ে হয়েছে নয় মাস তেরো দিন।
এখন রাত নয়টা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট।
তিথির বাসা থেকে আনা গল্পের বইগুলোর ভেতরে ডায়েরীটা পেলাম। তিথির ই ডায়েরী। কয়েক পাতা উল্টানোর পর এই ছবিটা পেলাম। একটা ছোট্ট মেয়ের ছবি। বয়স কত হবে। অনুমান করে বলতে পারি, খুব বেশি হলে সাত বৎসর; কিংবা আট বৎসর। বেণী করা চুল, কাঁধের দু'পাশে দু'টো বেণী। ছবিতে হলুদ রঙের একটা জামা গায়ে দিয়ে মেয়ে কাঁধ পর্যন্ত দু'হাত তুলে রেখেছে। দু'হাত ভর্তি মেহেদী দেয়া। মুখে হাসি। কি মিষ্টি সেই হাসি। কি মায়া সেই চেহারায়। এমন একটি মিষ্টি মেয়ের ছবি দেখে তিথি কেন এমন ভয় পাবে?
তিথিকে ছবিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-- তিথি, কে এটা?
তিথি বই পড়ছিলো বিছানায় শুয়ে। একবার অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকালো। তারপরেই চমকে উঠলো। আমি স্পষ্ট দেখলাম, ভয়ে তিথির মুখটা এতটুকুন হয়ে এলো। আমি ছবিটা ডায়েরীতে রেখেই দ্রুত তিথির পাশে বসে বুকে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। তিথি বুকের মধ্যেই কেঁপে কেঁপে উঠলো। আমি বললাম,
-- ওকে। ওকে.. থাক। কিছু বলতে হবেনা। ইটস ওকে তিথি...
তিথি চুপ করে বুকের মধ্যে গুজে রইলো। টু শব্দ ও করলো না আর।
তিথি ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি বালিশ টেনে শুইয়ে দিয়ে অপলক তাকিয়ে রইলাম তিথির বন্ধ চোখের দিকে। ঘুমের মধ্যে ও কেঁপে উঠলো কয়েকবার সে। আমি শক্ত করে জড়িয়ে ধরছিলাম বারবার। বিয়ে হয়েছে নয়মাস তেরোদিন আজ। এই প্রথম বারের মতো তিথিকে বুকে জড়িয়ে ধরে মনে হলো, মেয়েটিকে পাইনি আমি। একগাদা রহস্য নিয়ে শত কোটি আলোকবর্ষ দুরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ মেয়েটি। তিথিকে জানতে হবে আমার, আরো...। তিথি ঘুমের মধ্যে চেহারা বিকৃত করে নাকি সুরে বললো,
-- আমাদের ছোট নদী চলে এঁকে বেঁকে। হি হি...
আমার গায়ের লোম কাটা দিয়ে উঠলো। এ্যাই তিথি বলে ডাক দিতেই উহু শব্দ করে আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তিথি। কিছুক্ষণ পর ঘুমের মধ্যেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমি সারারাত জেগে থাকলাম। এক অদ্ভুত শরীর হিম করা, ভয়ংকর রাত কাটলো আমার..!
......
পাঁচ দিন লাগলো তিথি একটু স্বাভাবিক হতে। ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার বললেন, শারীরিক কোনো সমস্যা নেই। অসুখটা মানসিক। আগে কখনো এমন হয়েছে কিনা প্রশ্নের উত্তরে তিথি মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো। তিন বৎসর আগে ও একবার এমন হয়েছিলো। ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত সব কান্ড করতো, সারাদিন ভয়ে ভয়ে থাকতো। কেউ পাশে এলে ভয় পেতো, কথা বললে আঁতকে উঠতো।
তিথি সারাদিন রুমেই থাকে। বই পড়ে, রান্না করে, টিভি দেখে আর ঘরের টুকটাক কাজ...! ডাক্তার পরামর্শ দিলেন, লম্বা ছুটি নিয়ে একটু বেড়িয়ে আসতে কোথাও। একদম সম্ভব না হলে সপ্তাহে একদিন করে হলেও বাইরে বের হয়ে ঘুরে আসতে।
রাতে তিথি কে বললাম,
-- কাল বিকেলে একটা জায়গায় যাবো? আমার প্রিয় একটি জায়গা। যাবে?
তিথি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো,
-- মায়াপুরী পার্ক?
আমি চমকালাম। তারপর কপট রাগ চেহারায় এনে জিজ্ঞেস করলাম,
-- এ্যাই রে.. তুমি চুরি করে আমার ডায়েরী পড়েছো বুঝি...?
তিথি হাসলো।
মায়াপুরী পার্ক। গতকাল রাতে তিথির স্বাভাবিক ঘুম হয়েছে। তিথি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। ভয় পাচ্ছেনা আর। পার্কের একদিকে অসংখ্য প্রজাপতির ঝাঁক। আমরা প্রজাপতি দেখলাম অনেকক্ষণ। পার্কের বাইরে রাস্তার ওপাশে কাঠের বেঞ্চি। রাস্তা সুনসান। এই পার্ক দেখতে কেউ আসেনা..। বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। তিথি বেঞ্চিতে বসে বললো,
-- ছবির গল্পটা বলি?
আমি আঁতকে উঠে নিষেধ করলাম।
-- না না... থাক।
তিথি হাসলো, তারপর বললো,
-- আমাদের স্কুলে প্রিয় একজন শিক্ষক ছিলেন। আমাদের সবার প্রিয়। কি সুন্দর করে কথা বলতেন। সাবজেক্ট টা বোরিং হলেও আমরা শুধু উনার কথা শুনার জন্যেই ঐ ক্লাস মিস করতাম না কখনো। স্যার একদিন বলেছিলেন, 'সিক্রেট শব্দটা হচ্ছে ক্ষতের মতো। রোদে শুকোতে দিতে হয়, মেলে ধরে ঔষুধ লাগাতে দিতে হয়... নইলে পঁচন ধরে।'
তিথি চুল খুলে দিয়েছে। আমি তাকিয়ে আছি। আমার কোনো সিক্রেট নেই। ডায়েরী তে মেলে দিয়েছি সব। তিথি সেটা পড়ে নিয়েছে। ব্যস। তিথির ও কি তেমন কিছু সিক্রেট আছে? যেটা আমার এখনো পড়া হয়নি!
-- আমার বয়স তখন আট বৎসর। সবে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছি। রাতে একা থাকতে পারছি, অনেক রাত হলেও একা বাথরুমে যেতে পারছি। যেহেতু ভাই বোন নেই, আমি খেলাধুলা করতাম ও একা একা। তবে কখনো কখনো বাবা খেলতেন আমার সাথে। আমরা হাঁড়ি পাতিল খেলতাম। আমি হতাম মা, বাবা হতেন আমার ছেলে। আমি ছেলেকে ছোট ছোট হাঁড়ি পাতিল থেকে মিথ্যে মিথ্যে ভাত বেড়ে দিতাম প্লেটে। বাবা মিথ্যে মিথ্যে ভাত খেতেন। তারপর বাবা কে স্কুলে যাওয়ার জন্যে রেডি করিয়ে স্কুলে পাঠাতাম। মা এসে আমাদের খেলার মধ্যে বারবার ঝামেলা বাঁধাতেন। বাবা কে বকা দিতেন, ঘর এলোমেলো করছি দু'জন মিলে বলে বকে দিয়ে যেতেন। বাবা পাত্তা দিতেন না মায়ের রাগ। শনিবার টা ছিলো পুরো সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় আমার। কারণ এই দিন বাবা কোথাও যেতেন না। পুরোদিন বাসায় থাকতেন...।
তিথির মুখ ঝলমল করছে, ঝলমলে স্মৃতি ই বটে। তিথি বললো,
-- বাবার গাড়ির প্রচন্ড শখ ছিলো... কিছুদিন আগে একটা নতুন গাড়ি নিয়েছেন। আমাদের গাড়ি। চকলেট কালার। আমি প্রচন্ড খুশি। বাবা খুব দ্রুত গাড়ি চালানো শিখে ফেললেন। তারপর একদিন মা আর আমায় নিয়ে শহরের অনেক জায়গা ঘুরে আসলেন। আমি অপেক্ষায় আছি স্কুল খোলার। বাবা প্রতিদিন গাড়ি করে স্কুলে দিয়ে আর নিয়ে আসবে। বই উৎসবের দিন বই দেয়া হলো সব ছাত্র ছাত্রীকে। দিনটা ছিলো, জানুয়ারীর ১ তারিখ। স্কুলে বাবার সাথে যাওয়ার কথা ছিলো আমার। কিন্তু বাবার ব্যবসা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কাজে ঢাকা যেতে হয়েছে আগের দিন। আমি মুখ ঘোমড়া করে মায়ের সাথে স্কুলে গেলাম, নতুন বই নিয়ে মুখ ঘোমড়া রেখেই ফিরে এলাম বাসায়। খেলাম না কিছু। আজ বাবা আসুক; মনে মনে ঠিক করে নিয়েছি একদম কথা বলবোনা মানুষটির সাথে। বাবা আসলেন দুপুরের দিকে। গাড়ি থেকে নেমে কারো সাথে কথা বললেন না, গোসলখানায় ঢুকলেন। খেতে বসে প্রথম কথা বললেন, গাড়ি বিক্রি করে ফেলবেন তিনি। আমাদের গাড়ির প্রয়োজন নেই!
......
-- মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন বাবার দিকে। আমিও। বাবা আর কিছু বললেন না। আমি যেচে কথা বলতে চাইলাম, আমার সাথেও বললেন না। পুরো বিকেল ঘুমোলেন। আমার মন খারাপ দেখে মা আমায় বোঝালেন, বাবার মন খারাপ। মন ভালো হলে কথা বলবে। আমি আমার রুমে ঘুমিয়ে পড়লাম। সন্ধ্যের দিকে ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ খুলে দেখি, বাবা শক্ত করে আমায় দু'হাতে জড়িয়ে ধরে রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আমি নড়চড়ে উঠতেই বাবা নিজেকে সামলে নিলেন। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'বাবা, কাঁদছো কেন?' বাবা জোর করে মুখে হাসি টেনে আনলেন, বললেন, 'কই.. কাঁদছিনা তো আমি।' আমি বুঝতে পারলাম না, বাবা আমায় এমন জড়িয়ে ধরে কেন কাঁদলেন আর মিথ্যেই বা কেন বললেন!
তিথির চেহারায় কালো মেঘ, বৃষ্টি হতে পারে। আমি হাত বাড়িয়ে তিথির হাত ধরলাম, তিথি বললো,
-- ঐদিন রাতেই মেয়েটিকে প্রথম দেখি আমি। বাথরুমের কোনায়। রাত এগারোটা সম্ভবত তখন। চোখে ঘুম নিয়ে বাথরুমের সামনে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুলতেই দেখি, বাথরুমের কোনায় কেউ একজন হাঁটুগেড়ে বসে আছে। আমার মতোই একটি মেয়ে। নীল- সাদা স্কুল ড্রেস পড়া। মেয়ের চুল এলোমেলো। দরজা খোলার আওয়াজ শুনেই হাঁটু থেকে মাথা তুলে আমার দিকে চাইলো। আমার পা থর থর করে কাঁপতে লাগলো। মেয়েটির নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, কপালে ও রক্ত লেগে আছে। মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হতাশ স্বরে বললো, 'তোর নতুন বইগুলা থেকে একটা বই দিবি আমায়...?' আমি চিৎকার করলাম। প্রচন্ড জোরে। চিৎকারের শব্দ পাশের বিল্ডিং এ পর্যন্ত পৌঁছেছিলো। চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালাম বাথরুমের সামনেই। জ্ঞান ফিরলে দেখি বিছানায় শুয়ে আছি। রুমে বাবা আর মা। মায়ের চোখে জল। মাথায় হাত দিয়ে রেখেছেন আমার। বাবা অস্থির হয়ে পায়চারী করছেন। আমি ভয়ে ভয়ে আশেপাশে তাকাই। মেয়েটি নেই কোথাও।
তিথি শক্ত করে আমার হাত ধরে রাখে। আমি টের পাই, কি জমাট বাঁধা শক্ত একটা ভয় এখনো কাঁপিয়ে দিচ্ছে শরীর তার। তিথি একটু থেমে বললো,
-- সেইরাত থেকেই শুরু হলো মেয়েটিকে দেখা। বাথরুমে দেখি, বারান্দায় দেখি। ছাদে দেখি, একা খেলতে বসলেই দেখি। দ্বিতীয় বার দেখি বারান্দায়। বাবা বাসায় নেই, মা নামায পড়ছেন। সন্ধ্যে। রুমের বারান্দায় কারো অস্পষ্ট স্বরের গান গাওয়ার আওয়াজ শুনি আমি। গুনগুন করছে কেউ। আমি বারান্দায় উঁকি দিই। মেয়েটি বসে আছে হেলান দিয়ে। সুর করে কবিতা পড়ছে, 'আমাদের ছোট নদী চলে এঁকেবেঁকে...!' পড়তে পড়তেই আমার দিকে তাকিয়ে সেই প্রথমবারের মতো হতাশ গলায় বললো, 'তোর নতুন বইগুলা থেকে একটা দিবি আমায়?' আমি আবারো চিৎকার দিলাম। মা নামায রেখে দৌঁড়ে এলেন, আমার আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান হারাবার একটু আগে শুধু মনে পড়লো মেয়েটি হাসছিলো তখন। একটা বিচ্ছিরি হাসি। রক্ত জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে বসে যাওয়া লালচে দাঁত বের করে হি হি করছিলো..! কল্পনা করেই গায়ের লোম শিউরে উঠে এখনো আমার..
তিথি থামলো। একটা আট-নয় বৎসর বয়েসী বাচ্চার জন্যে একটা বাচ্চা মেয়ের চেহারার ক্ষত, রক্ত ই ভয়ে আঁতকে উঠার জন্যে যথেষ্ট। তিথি বললো,
-- আমি আর কখনো একা থাকিনি এরপর। রাতে বাবা মায়ের সাথে থেকেছি। বাথরুমে যাওয়ার জন্যে হলেও মা থাকতো সবসময় আমার সাথে সাথে। তারপরেও অনেকবার দেখেছি মেয়েটাকে। ছাদের কোনায়। প্রথমে শুধু রাতে দেখলেও কিছুদিন পর দিনের বেলায় ও দেখতে পেলাম। মায়ের সাথে ছাদে উঠেছি, দেখি ছাদের কোনায় বসে আছে মেয়েটি। হাঁটুগেড়ে। মাকে দেখাতে গেলেই দেখি নেই। শূণ্য ছাদ। মেয়েটির সাথে আমি অল্প আধটু কথা বলতে শুরু করি মাস দেড়েক পর। বাবার অবস্থা তখন আমার চেয়েও খারাপ। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, হুজুর, তাবিজ কোনোকিছু বাদ রাখেন নি। আমার হাতে গলায় পাঁচ ছয়টা তাবিজ। কিন্তু তারপরেও আমি মেয়েটিকে দেখি। রাতে হুট করে ঘুম ভাঙ্গার পর শিয়রের কাছে দেখি, পায়ের কাছে দেখি। একটু একটু করে কেন জানিনা অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলাম, একদিন বারান্দায় কথা ও বললাম, জিজ্ঞেস করলাম, 'তুমি কে?' মেয়ে এপাশ ওপাশ তাকিয়ে ভাঙ্গা গলায় বললো, 'চম্পা। আমার নাম চম্পা! হি হি...!' সেই বিচ্ছিরি হাসি। গা কাটা দিলো আমার। বারান্দা থেকে দৌঁড়ে ছুটে এসে মায়ের বুকে ঝাঁপ দিই, মা কে বলি, 'ওর নাম চম্পা! আমার কাছে নতুন বই খুঁজে, বই দিতে বলে ওকে একটা..!'
......
তিথি থামলো। বেঞ্চি থেকে উঠে পড়লো। বললো,
-- ভাল্লাগছেনা। চলো, একটু হাঁটি।
আমরা হাঁটছি। তিথি হাঁটতে হাঁটতে বললো,
-- আমার শরীর শুকিয়ে এতোটুকুন হয়ে গেলো। কিছু খেতে পারিনা। ঘুমোতে পারিনা। চুল পড়তে শুরু করলো। নিজেকে আয়নায় দেখলে ভয় পাই। বাবা ডাক্তার মেডিকেল পারলে তুলে বাসায় এনে বসান। অবস্থা একদম খারাপ হয়ে গেলো একরাতে। শ্বাস নিতে পারছিলাম না। চম্পাকে দেখলাম মাথার কাছেই বসে আছে, আমি চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকি। চম্পা বলে, 'তোর আব্বা একটা বদ লোক।' আমি চিৎকার করে বললাম, 'তুমি যাও আমার সামনে থেকে, আমার বাবা ভালো। তুমি খারাপ। তুমি বদ। তুমি পঁচা!' চম্পা হি হি করে সেই বিচ্ছিরি হাসি হেসে বললো, 'তোর আব্বা গাড়ি চড়ায় না তোকে আর।' আমি রেগে ফেটে পড়ি, 'তুই সর আমার সামনে থেকে, তোকে দেখতে চাইনা আমি আর।' বাবা সেরাতে গাড়ি করেই আমায় হাসপাতালে নিয়ে আসলেন। ঐ গাড়িটা। যেটা বিক্রি করে ফেলবেন বলেছিলেন। কোনো এক অদ্ভুত কারণে বিক্রি করেন নি, আবার এই দুই মাস সেটা ব্যবহার ও করেন নি। পড়ে ছিলো গ্যারাজে। আমায় হাসপাতালে ভর্তি করে বাবা একা গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হন। ঐরাতেই বাবা এ্যাক্সিডেন্ট করেন। গাড়ির খুব বেশি ক্ষতি হয়নি, অথচ বাবার শরীর ছিলো রক্তাক্ত, মাথায় ও প্রচন্ড আঘাত পেয়েছেন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় বাবার। আমার শ্বাস কষ্ট কমে আসে, একরাতেই অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠি। দু'দিনেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাই। এরপর চম্পাকে কখনো আর দেখিনি আমি। বড় হওয়ার পরেও গভীর রাতে চুপিচুপি বারান্দায় উঁকি দিতাম, বাথরুমে উঁকি দিয়ে দেখতাম কেউ হাঁটুগেড়ে বসে আছে কিনা, কান খাড়া করে শুনতাম কোথাও কেউ সুর করে কোনো কবিতা পড়ছে কিনা...!
তিথি হাঁটতে হাঁটতেই আমার দিকে তাকালো। আমি মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ তিথির দিকে তাকাতেই তিথি দাঁড়িয়ে পড়লো, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার দু'হাত শক্ত করে ধরে বললো,
-- তিন বৎসর আগে চম্পাকে আমি একটা পুরনো খবরের কাগজে পাই। 'নতুন বই আর পড়া হলোনা চম্পার' শিরোনামে একটা মেয়ের ছবি পেপারে। হাসৌজ্জ্বল চেহারা। চুলে বেণী করা, দুই কাঁধে দুইটা বেণী। কাঁধ পর্যন্ত দু'হাত তুলে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। দু'হাতে মেহেদী। ছবি দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। তেরো বৎসর পরেও একবারের দেখায় চিনতে পারি আমি। যে চম্পাকে দুইটা মাস ধরে দেখেছি, সে ঐ বৎসর জানুয়ারীর এক তারিখেই মরে গিয়েছিলো। একটা দ্রুত গতির গাড়ি রাস্তার বন্ধ লেনে গিয়ে পিষে দিয়ে যায় মেয়েটিকে। ঘটনাস্থলে মরে যায় সে...!
আমি চমকে উঠলাম, তিথি টের পেলো। শক্ত করে আমার দু'হাত ধরে রেখে বললো,
-- ছবিটা দেখার পর বহুদিন পুরনো সেই ভয়ের স্মৃতি ফিরে এলো আবার। ঘুমের মধ্যে চিৎকার, অকারণে ভয়ে আঁতকে উঠা, কারো সাথে কথা না বলা, একটা ছোট্ট শব্দেও ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া! পাঁচ ছয় দিন লাগলো স্বাভাবিক হতে। পেপার থেকে ছবিটা কেটে ডায়েরীতে রাখলাম। নিউজে কিছু তথ্য ছিলো, খোঁজ খবর নিয়ে চম্পার বাসার ঠিকানা পেলাম। পরিবার সম্পর্কে জানলাম। অভাব অনটনের সংসার ওদের। বাবা রিকশা চালায়। মা বাড়ি বাড়ি কাজ করতো আগে। চম্পারা ভাই বোন চার জন। ছোট তিন জন পড়ছে, বড় ভাইটা রাস্তার পাশে একটা টং দোকান দিয়েছে। আমি বাবার গাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে সবগুলো টাকা এই পরিবার কে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম...!
তিথি কে থামালাম, কিছু জিজ্ঞেস করার আছে ওকে। তিথি থামলো, আমি বললাম,
-- চম্পা তোমাকেই কেন দেখা দিয়েছিলো?
তিথির চোখে জল এলো। অনেকক্ষণ ধরে মেঘ করেছিলো চেহারায়, অতঃপর বৃষ্টি এলো। আমার বুকে মাথা গুজে দিয়ে বললো,
-- আমি জানিনা। হয়তো জানি। চম্পাকে রাস্তায় পিষে দেয়া গাড়িটার ড্রাইভিং সিটে বাবা ছিলো। গাড়িটা আমাদের ছিলো হয়তো। বাবার অনুতপ্ত চেহারা দেখেছি আমি। একটা মানুষের সবচেয়ে অসহ্য কষ্টকর অনুভুতি হচ্ছে, 'তখনই তার কাছে অনুতপ্ত হওয়া যখন ক্ষমা করার জন্যে সে থাকেই না।' আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বাবা ঐ সন্ধ্যেয় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন। তখন বুঝতে চেয়েও বুঝিনি। এখন বুঝতে চাইনি.. অথচ বুঝেছি।
তিথি বুকে গুজে থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা। কিছু একটা বলা দরকার, তিথি বললো,
-- আমি আমার অনুতপ্ত বাবা কে ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু রাস্তায় একটি ছোট্ট শিশুর নতুন বইয়ের গন্ধ নেওয়ার ছোট্ট স্বপ্ন পিষে দিয়ে যাওয়া ড্রাইভার কে সবাই ক্ষমা করেনা..! না ঐ এক তারিখ, না ঐ দুপুর, না ঐ রাস্তা, না ঐ শিশুর পরিবার। কিন্তু আমি জানি, আমার বাবা খারাপ মানুষ নয় নীল..। বিশ্বাস করো...
মায়াপুরী পার্কের আশেপাশে সন্ধ্যে নেমে এসেছে। তিথি বুকে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি। সন্ধ্যেবেলায় কাঁদতে নেই। অথচ তিথি কাঁদছে।
আচ্ছা, ঐ রাস্তা ও কি এমন করে কাঁদে..? বৎসরের ঐ প্রথম দুপুর, ঐ প্রথম তারিখ..?
রাত বাড়ছে। 'জানুয়ারির এক তারিখ।' কেউ কেউ এই দিনে নতুন করে শুরু করেছিলো... আর কারো ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্ন, ছোট্ট শরীরটা থেঁতলে গিয়ে মিশে গিয়েছিলো রাস্তায়। দুপুর দেখেই চলে যেতে হয়েছে, সন্ধ্যে দেখা হয়নি তার.. পড়া হয়নি গুনগুন করে ছড়া- কবিতা.. গন্ধ নেওয়া হয়নি নতুন বইগুলোর।

মেয়েটির হাসৌজ্জ্বল চেহারার মিষ্টি ছবিটা চোখে ভেসে উঠছে। কান্না পাচ্ছে আমার; বৎসরের প্রথম দিন আর কখনো ভালো থাকতে পারবোনা আমি...!
 

Users who are viewing this thread

Back
Top