১৯৪৮ সালের সংবিধানে বার্মার অনেক সম্প্রদায় ও তাদের অধিকার গুরুত্ব লাভ করেনি। যার ফলে পরবর্তী ১০ বছর তুমুল গৃহযুদ্ধ বার্মার রাজনৈতিক জীবন সংঘাতময় করে রাখে, অর্থনীতিতেও ধ্বস নামে। এমন অবস্থায় দেশে আইন ও শৃঙ্খলা পুনর্বহালের জন্য ১৯৫৮ সালে জেনারেল নে উইন এক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে ইউ ন্যুকে অপসারণ করেন। সমগ্র দেশের ভার নিয়ে নে উইন সার্থকভাবে সকল সম্প্রদায়কে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুগামী হতে বাধ্য করেন। তার সরকারের অধীনেই ১৯৬০ সালে ইউ ন্যু পুনঃনির্বাচিত হন। কিন্তু মাত্র দু’বছর পরেই নে উইন এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে বার্মার সামরিক একনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন। নে উইন পূর্বের সংবিধান বাতিল করে স্বৈরাচারী সামরিক শাসন চালু করেন। কমিউনিস্ট ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর বিদ্রোহের সশস্ত্র দমনের উপর পূর্ণ মনোযোগ দেয়া হয়। বার্মীজদের সামাজিকীকরণের নামে বাইরের দুনিয়া থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করা হলো। কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বিদেশীবিদ্বেষী ও নির্দয় নে উইন পরবর্তী তিন দশকে একটি উন্নয়নশীল দেশকে পরিবেশ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি সবদিক দিয়ে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সশস্ত্র বিদ্রোহ রোজকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৮৮ সালের জুলাইয়ে হঠাৎ নে উইন ঘোষণা দেন যে তিনি ক্ষমতা ছাড়ছেন। এতদিনের সামরিক শোষণ, নিয়মতান্ত্রিক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অর্থনৈতিক অবনতি হতে মুক্তির আশা দেখে রেঙ্গুনের রাস্তায় জনতার ঢল নামে। কিন্তু ৮ জুলাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেনাবাহিনী রাস্তায় জমা নারী পুরুষ ও শিশুদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। চারদিন ধরে চলা এ হত্যাযজ্ঞে প্রায় ১০ হাজার মানুষ নিহত হয়। হাজারে হাজারে ছাত্র ও গণতন্ত্রকামী মানুষ সীমান্তবর্তী এলাকায় পালিয়ে যায়।
ঠিক এই অশান্ত অবস্থাতেই বার্মার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা অং সানের কন্যা বিদেশে অবস্থানরত অং সান সু কি অসুস্থ মাকে দেখতে দেশে আসেন। সময়ের প্রয়োজনে তিনিও রাজনীতিতে পা রাখেন। এ সময় আন্তর্জাতিক চাপ এড়াতে সামরিক সরকার এক বহুদলীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। সমমনাদের নিয়ে গঠিত সু কির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (NLD) দেশব্যাপি জনপ্রিয়তা লাভ করে। সু কির জনপ্রিয়তার ফলাফল টের পেয়ে তাকে গৃহবন্দী করা হয়। ১৯৯০ সালের ২৭ মে প্রতিশ্রুত নির্বাচনে সু কির দল ৮২% ভোট পেয়ে জয়ী হয়, কিন্তু সামরিক সরকার সে ফলাফল গোপন রেখে ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানায়।
২০০২ সালে সু কিকে মুক্তি দেয়া হলেও ক্ষমতা সামরিক সরকারের হাতেই থাকে। টানা একনায়কতন্ত্রের ফলে গৃহযুদ্ধ, মানবেতর জীবন, সংঘাত, রক্তপাত, অর্থনৈতিক দুর্বলাবস্থা সব মিলিয়ে জাতিসংঘের সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর তালিকায় প্রথম দিকে আছে বার্মা। সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের ১৫ বছরই সু কির বিভিন্ন সময়ে গৃহবন্দী অবস্থায় কাটে। ২০০৯ সালে আসিয়ান সামিটে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সু কির মুক্তির উপর বিশেষ জোর দেন। আমেরিকা ও ব্রিটেন উভয়ই বার্মায় সাধারণ নির্বাচনের উপর জোর দিতে থাকে। ২০১০ সালে সু কি মুক্তি পান। ২০১২ সালে সাধারণ নির্বাচনে সু কি ও তার দল NLD বিজয়ী হয়ে শপথ গ্রহণ করেন। ২০১২ সালের ৯ মে সু কি প্রথম আইন প্রণেতা হিসেবে পার্লামেন্টে উপস্থিত হন। ছয় দশকের রক্তপাত ও সশস্ত্র সংঘাত ও একনায়কতন্ত্রের পর বার্মা বা মিয়ানমার গণতন্ত্রের মুখ দেখে। কিন্তু সমস্যা কি আদৌ ফুরোলো?
বার্মায় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জাতির মানুষদের উপর অত্যাচার নিপীড়ণ চলছে সে গোড়া থেকেই। এর পেছনে মূল কারণ তাদের বহিরাগত ভাবা। অনেক আগে মূলত বাংলাদেশ থেকে উঠে যাওয়া মানুষদেরই একটি গোষ্ঠী এই রোহিঙ্গারা। সেনাবাহিনী ও সংখ্যাগুরু বার্মীজদের গণহারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও এর কারণে রোহিঙ্গারা আজ নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত। আশ্চর্যের বিষয় বার্মার গণতন্ত্রের মানসকন্যা সু কি রোহিঙ্গা ইস্যুতে একদম চুপ। ২০১২-তে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের বার্মার অধিবাসী মনে করা যায় কি না সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন।
বর্তমান পরিস্থিতি সকলেরই জানা। ভারত, আমেরিকা ও ইসরায়েলের প্রত্যক্ষ সমর্থনে আরও তুমুল আগ্রহে রোহিঙ্গা নিধন চলছে। তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া যথেষ্ট সমবেদনা দেখালেও তেমন কার্যকরী ভূমিকা কেউই নিচ্ছে না। আর সীমান্তবর্তী দেশ হওয়ায় লাখে লাখে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সয়লাব হয়ে গেছে বাংলাদেশ। যেভাবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের মাটি আঁকড়ে ধরছে আর যেভাবে মিয়ানমার সরকার তাদের ফিরে যাবার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে এই দ্রুত জনবর্ধনশীল দেশের কী অবস্থা হবে তা ভাবা যাচ্ছে না।
এদিকে একদল অসহিঞ্চু ও অজ্ঞ বাঙালির দাবি বৌদ্ধদের দেশ থেকে তাড়িয়ে রোহিঙ্গাদের জায়গা করে দেওয়া। তাদের সাথে ওপারের রোহিঙ্গা বিতাড়নকারী সংখ্যাগুরু বার্মীজদের কী তফাৎ তা বোঝা দায়। সীমান্তবর্তী বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে হঠাৎ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যাতে ছড়িয়ে না পড়ে তার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্কতা জারি রয়েছে। পৃথিবীর রাজনীতিতে সুদীর্ঘদিন আড়ালে থাকা মিয়ানমার এভাবেই আজ বাংলাদেশের জন্য এক মূর্তিমান উৎপাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। পার্শ্ববর্তী এই দেশকে নিয়ন্ত্রণ করাই এখন বাংলাদেশের জন্য সময়ের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
(সংগৃহিত এবং সংযোজিত।)