৯
আমার যখন জ্ঞান ফেরে তখন বিকেল হয়ে গেছে- বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে, ঘন ঘন মেঘ ডাকছে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর দূরে কোথাও যেন বাজ পড়ছে। সারা ঘরে খোলা জানলা দিয়ে আসা হিমেল হাওয়া বইছে।
আমি বোধ করলাম যে কেউ যেন আমাকে যত্ন সহকারে একটা গদি পাতা চৌকিতে শুইয়ে রেখেছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝলাম যে আমি একেবারে উলঙ্গ। উঠে বসার সময় দেখলাম আমার চুলও এলো করা। আমার মাথা ব্যথায় যেন ফেটে যাচ্ছিল, তবে ঘরের বাইরে থেকে আসা একটা মিষ্টি গন্ধ আমার বেশ ভাল লাগছিল। মনে হল যেন ওটা কোন ঔষধির গন্ধ। আমি আসে পাশে দেখতে লাগলাম। আমি যে ঘরে ছিলাম সেটা ছিল বেশ বড়, ঐ ঘরে ছিল একটা বড় আয়না, আলমারি আর যাবতীয় ঘরোয়া অনেক কিছুই ছিল। ইতিমধ্যে আমি হুলা মাসীর স্বর শুনতে পেলাম, “মেজ মা, আঁধারী ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।”
“বেশ ভাল, চল ওকে আগে এই ঔষধি দেওয়া চা টা খাইয়ে দি; আমাদের ওর সাথে অনেক কথা আছে।”, মেজ মা বললেন।
খানিক বাদেই ঘরে ঢুকল দুই নারী, মেজ মা আর আর হুলা মাসী। আমি কয়েক সেকেন্ড ওনাদের দিকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় ভাবে দেখলাম শুধু মেজ মার হাতে একটা মাটির ভাঁড় ছিল। আমি ঘাবড়ে গিয়ে নিজের গা ঢাকার কিছু না পেয়ে, বিছানার চাদরটা টেনে নিজেকে ঢাকতে চেষ্টা করলাম কিন্তু অবাক কাণ্ড, আমার সারা শরীরে যেন একটা আগুন লেগে যাবার মত জ্বালা করে উঠল। আমি ছুঁড়ে চাদরটা ফেলে দিয়ে আর কিছু না ভেবে পেয়ে নিজের দুই হাতের চেটো দিয়েই নিজের মুখ লুকিয়ে ফেললাম।
আমার লজ্জা পাবার বোধ হয় কোন কারণ ছিল না, কেন না হুলা মাসী আর মেজ মা; ওনাদেরও পরনে কিছুই ছিল না আর দুই জনেরই চুল এলো করা ছিল।
মেজ মা আমাকে বললেন, “লজ্জা পাসনি, আঁধারী; এখন তুইও আমাদের মধ্যে একজন। তোকে যে হুলা অনেক বাছাই করে এখানে এনেছে।”, বলে ওরা দুজনে আমার দুই পাশে আমার গা ঘেঁষে বসলেন। মেজ মা আমার মুখটা কাছে নিয়ে এসে আমাকে চুমু খেলেন, দুই গালে আর ঠোঁটে আর তার পরে আমাকে গরম ঔষধি মেশান চায়ের ভাঁড়টা হাতে ধরিয়ে বললেন, “না, না... লজ্জা পাস না.. নে চা টা খা... তোর মাথা ধরা একবারে ঠিক হয়ে যাবে... অনেক কথা আছে তোর সাথে...”, বলে উনি আমার পিছন দিকে একটু সরে গিয়ে, নিজের দুই হাতে দিয়ে আমার এলো খালো চুল ধীরে ধীরে জড়ো করে আমার ঘাড়ের কাছে ঝুঁটির মতো করে ধরলেন, কি যেন আওড়াতে লাগলেন আর আমার সেটা বেশ পরিচিত মনে হল। হ্যাঁ, এটা সেই ‘প্রাচীন গুপ্ত বিদ্যারই’ কোন মন্ত্র-
করপিকোআহাঊ, আহাঊ, আহাঊ
তকু আরিকিওয়াকাহেরিয়া এ আহাউ তকু ওয়াহিনেটাঙ্গা কি আ কউতউ
(ফিস ফিস ফিসফিস)... আঁধারী... (ফিস ফিস ফিস ফিস)
হিয়াহিয়াটিয়াআনা ভাকারিটি ই
উনি যে ফিস ফিস করে কি বললেন আমি শুনতে পারলাম না। তবে আমাই নিজের এই নতুন নাম ‘আঁধারী’ নিশ্চয়ই শুনেছি। মন্ত্রটি উনি আমার নাম করেই বলছেন।
তার পরে আমার মাথার উপরে কয়েকবার ফুঁ দিয়ে উনি আবার অতি আদরের সঙ্গে আমার চুলের মধ্যে দিয়ে আঙুল চালাতে চালাতে আমার পীঠের ওপরে আমার চুল খেলিয়ে দিতে দিতে উনি কি যেন আওড়াতে লাগলেন আর আমার সেটা বেশ পরিচিত মনে হল। হ্যাঁ, এটা সেই ‘প্রাচীন গুপ্ত বিদ্যারই’ কোন মন্ত্র... বোধ হয় মাথা ব্যথা ঠিক করার।
আমি ঔষধি মেশান চা খেতে লাগলাম, কয়েক চুমুকেই যেন আমি একটু চাঙ্গা বোধ করতে লাগলাম আর যেন মাথা ব্যথাও আস্তে আস্তে কমতে লাগল তবে ওনাদের নগ্ন দেহের স্পর্শ আমার যেন কেমন অদ্ভুত লাগছিল, এইবারে আমি ওনাদের জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা কারা? আর আমাকে এই ভাবে উলঙ্গ করে রেখেছেন কেন? আর গায়ে চাদর দিতেই আমার সারা শরীর এমন জ্বালা করে উঠল কেন?”
মেজ মা বললেন, “আমরা ধুমিয়া গ্রামের ডাইনি, আমরা বেশির ভাগ সময় ল্যাংটো হয়েই থাকি, যাতে আমরা প্রকৃতি আর তার উর্যা ভালোভাবে অর্জিত করতে পারি। কিছু দিন আগেই আমাদের বড় মা মারা গেছেন। আমাদের আর একটা নারীর দরকার ছিল। আমাদের বড় মা অনেক দিন ধরেই ভুগছিলেন আর হুলা তোর কথা খুব বলত আর আজ তুই আমাদের বাড়িতে আছিস। তোকে এবারে আমাদের সঙ্গে যোগদান দিতে হবে আর যত দিন আছিস, আমাদের বাড়িতে তুই ল্যাংটো হয়েই থাকবি।”
“কিন্তু...”, আমি অবাক হলাম!
“হ্যাঁ, ঝিল্লী তুইও আমাদের মত একটা ডাইনি হবি, আমরা তোকে সেই শিক্ষা দেব।”, বলে মেজ মা আমার মাথায় থেকে পীঠ বেয়ে নেমে আসা চুলে হাত বোলাতে লাগলেন, “তোর সেই গুণ আছে... নিজের গোলাপ গাছ বাড়িয়েছিস... নিজের চুল বাড়িয়েছিস... সবাই সব কিছু পারে না, তবে তুই পেরেছিস... তোর সেই গুণ আছে। এটাকে ব্যর্থ যেতে দিস না... তবে তোর রীতি পালনে একটা খুঁত রয়ে যাচ্ছে... তার জন্যে তোকে একটু অসুবিধেও বোধ করতে হচ্ছে।”
আমার মনে পড়ে গেল যে আমাদের কাজের লোক লিলি বৌদির সঙ্গে কথা কাটাকাটি, অফিসে ঝামেলা আর নিলম্বন; আমি বাকি চায়ে চুমুক দিতে দিতে অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম, যে উনি এইসব জানেন কি করে?
মেজ মা বলতে থাকলেন, “এটা তো তুই জানিস যে আমাদের প্রাচীন গুপ্ত বিদ্যার বইতে লেখা তুক আর রীতি পালন করে, তার একটা করে প্রতিপালক থাকেন- বইটার প্রথমেই লেখা ছিল যে উহলোকের যে বিদ্যমান অশরীরী, তাহাকে সব অসারত্ব, পূর্বধারণা, অহং ত্যাগ করে একেবারে হীন, নির্বস্ত্র এবং নম্র হয়ে আহ্বান করতে হবে এবং তিনি হবেন আহ্বানকারীর ‘প্রতিপালক’। এই অশরীরী অস্তিত্ব ঠিক সময় মত নিজেকে আহ্বানকারীর সামনে ব্যক্ত করবেন কিন্তু তুই বোধ হয় এটা জানিস না যে প্রত্যেক তুক আর মন্ত্র সফল হবার পরে আহ্বানকারী- ডাইনী- যেমন তুই, তাকে নিজের প্রতিপ্রতিপালককে একটা ধন্যবাদ জানাতে হয়। বইটাতে অনেক মন্ত্র আছে আর তার শেষের দিকে লেখা আছে প্রতিপালককে কি করে ধন্যবাদ জানাতে হয়।”
আমি হাঁ করে সব শুনছিলাম।
মেজ মা বলছিলেন, “তোর দুইটা তুক সফল হয়েছে কিন্তু তুই নিজের উহলোকের অশরীরী প্রতিপালক ‘আঁধার’ কে নিজে একবারও ধন্যবাদ জানাস নি তাই তোর জীবনে অনেক মারাত্মক আর ক্ষতিকারক তরঙ্গ জমা হয়ে গিয়েছিল আর তোকে এত ঝগড়া আর অশান্তি ভোগ করতে হচ্ছিল।”, বলে মেজ মা উঠে গিয়ে একটা কাগজ নিয়ে এসে আমাকে দেখালেন। এটা সেই কাগজটা যেটা নাকি গাছতলায় আঁকা আসনের উপরে রাখা ছিল, আমি বাড়িতে ঢোকার সময়ই লক্ষ করেছিলাম। হ্যাঁ, তাতে একটা নগ্ন নারীর রেখাচিত্র আঁকা ছিল আমার এখন মনে হল যেন এই রেখাচিত্রটা আমাকে উদ্দেশ্য করেই আঁকা হয়েছে আর তার সঙ্গে হুলা মাসী আর মেজ মা নিশ্চয় দরকারি গুণ তুক করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই!