দ্বাদশ পর্ব
স্কুল পালিয়ে চলে যেতো সুচরিতা। শান্তনুরও কলেজ কামাই। সপ্তাহে দু’তিনদিন তো রুটিন হয়ে গিয়েছিলো। নিয়মিত আনপ্রটেক্টেড সেক্সের ফলে যা হবার তাই হলো। মাস দু’একের মধ্যেই মাসিকধর্ম বন্ধ হয়ে গেলো তার। অথৈ জলে পড়লো শান্তনু-সুচরিতা। তখনকার দিনে আ্যবর্সন আজকালকার মতো এতোটা জলভাত ছিলো না। দু’চারটে তৃতীয় শ্রেণীর নার্সিং হোমে গোপনে করা হলেও, ঝুঁকি ছিলো অনেক বেশী। তাছাড়া এটা তো তাদের প্রেমের ফল। কেন তাকে নষ্ট করবে? শান্তনু-সুচরিতা মিলিতভাবে ডিসিশন নিলো, বিয়েই করে নেবে তারা। কিন্তু একে বেকার, তায় জাতে নিচু। সুচির বাড়ীতে কিছুতেই আ্যকসেপ্ট করবে না শান্তনুকে। অবশেষে তারা ঠিক করলো, পালিয়ে বিয়ে করবে। লাল্টুবাবুই একটা বাড়ী ভাড়া ঠিক করে দিলেন। বাবার ক্যাশবাক্স থেকে কিছু টাকা আর মায়ের গয়না নিয়ে পালিয়ে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে চলে গেলো সুচরিতা, সঙ্গে শান্তনু। শান্তনু-সুচরিতার দু’চারজন বন্ধু, কলিবৌদি, এরকম গুটিকতক লোকের সামনে বিয়ে হয়ে গেলো তাদের। সুচরিতার বাবা-কাকা বিরাট ঝামেলা শুরু করে দিলেন। থানায় এফআইআর, হুমকি ইত্যাদি। লাল্টুবাবু পাশে দাড়ালেন। তার এলাকায় তিনিই পুলিশ, তিনিই ব্যারিস্টার, তিনিই জজ। তাছাড়া ছেলে মেয়ে দুজনাই প্রাপ্তবয়স্ক। আইন তাদের পক্ষে। কিছুই করতে পারলেন না সুচির বাড়ীর লোক; তবে তারা এই বিয়ে মেনেও নিলেন না। তার বাবা বললেন, “আজ থেকে মনে করবো আমার ওই মেয়ে মারা গেছে।
প্রেম হলো, বিয়ে হলো, সংসার পাতা হলো। কিন্তু সংসারের গাড়ীটা চালাতে গেলে টাকারুপী তেল দরকার। যে টাকাপয়সা সুচি বাড়ী থেকে নিয়ে এসেছিলো, তাই দিয়ে দার্জিলিঙে হানিমুন করা হলো। টাইগার হিলে গাল ঘষাঘষি, এক লেপের তলায় সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে দুজনার দুজনকে জড়িয়ে শোওয়া, গিজারের কবোষ্ণ জলে উলঙ্গ হয়ে দুজনে স্নান করা, ম্যালে এক শাল দুজনে জড়িয়ে হাতে হাত ধরে ঘোরা, নাথমুলের এতিহ্যপূর্ণ টি শপে এক পেয়ালায় দুজনে ঠোঁট লাগিয়ে দার্জিলিঙ টি খাওয়া, সব হলো তারপর ফিরে আসা কলকাতার প্যাঁচপেঁচে গরমে। সোনাদানা যেটুকু নিয়ে এসেছিলো সুচি, তার প্রায় সবটা বেচে চললো আরও কিছুদিন। তারপর অভাবের সংসারে প্রেম আস্তে আস্তে জানালা দিয়ে পালাতে শুরু করলো। পড়াশুনো মাঝপথেই ছেড়ে দিয়ে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে লাগলো শান্তনু। সুচরিতার সঙ্গে কেসটার পর এলাকার বেশীরভাগ টিউশনিই চলে গিয়েছিলো তার। সুচিকে নিয়মিত ডাক্তার দেখানো, ওষুধ জোগাড় করা তো দুরে থাক, দুবেলা দুমুঠো ভাত জোটানোই মুশকিল হয়ে পড়েছিলো। অভাবী মায়ের পেটে তিলতিল করে বেড়ে উঠছিলো ঝুম।
কলিবৌদিই লাল্টুদাকে বলে পাড়ার গভর্নমেন্ট স্পন্সর্ড লাইব্রেরিতে একটা ক্যাজুয়াল চাকরি যোগাড় করে দিলেন। শানু-সুচির সংসার জোড়াতালি দিয়ে চলতে শুরু করলো। শানুর চাকরিটা ছিলো অফিস বয়ের, লাইব্রেরি খোলা বন্ধ করা, ঝাড়পোঁছ করা ইত্যাদি ছিলো তার কাজ। কিন্তু লাইব্রেরিয়ান সনাতন কয়াল ছিলেন পার্টির বড়ো নেতা, সেই সূত্রেই চাকরিটা বাগিয়েছিলেন। বেশীর ভাগ দিনই পার্টির মিটিং-মিছিল নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ফলে লাইব্রেরিটা প্র্যাকটিকালি শান্তনুই চালাতো। এতে তার একটা সুবিধা ছিলো এই যে যে সে দেশ-বিদেশের অনেক সাহিত্য পড়ার সূযোগ পেয়ে গেলো এবং নিজেও কিছু লেখালেখি করার সময় পেয়ে গেলো। লেখার অভ্যসটা শানুর মধ্যে ছিলোই। এবার উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে সেটা বিকশিত হলো। এভাবেই কিছুদিনের মধ্যেই কিছু ছোট গল্প এবং একটা গোটা উপন্যাস লিখে ফেললো সে। তারপর বুক ঠুকে হাজির হয়ে গেলো বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সর্বাধিক প্রচারিত স্বদেশ পত্রিকার সম্পাদক সমুদ্র বোসের কাছে।
সমুদ্র বোস দু’চারদিন ঘুরিয়ে যেদিন শান্তনু লেখা অবশেষে পড়ার সময় পেলেন, সেদিন বুঝতে পারলেন, ছেলেটির লেখার হাত খুব পাকা না হলেও, গল্প বলার অনেক রসদ তার মধ্যে আছে। বয়স কম হলেও জীবনটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছে এবং সংসারের ধাক্কা অনেক খেয়ে বুকের ক্ষতগুলো একদম তাজা রয়েছে, যেগুলি তখনকার দিনের বিখ্যাত লেখকদের মধ্যে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। যেটুকু ছিলো সেটুকু প্রথম দু’চারটে গল্প-উপন্যাসেই শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন তারা এসি ফ্ল্যটে থাকেন, এসি গাড়ী, ট্রেনের এসি কম্পার্টমেন্টে, প্লেনে চড়েন। দোকান-বাজারে যান না, ট্রামে-বাসে চড়েন না, সাধারন মানুষের সাথে মেশেন না। ফলে জীবনের প্রতি বাঁকে যে গল্পগুলো লুকিয়ে আছে, সেগুলির সন্ধানই তাদের নেই। নবীন প্রজন্মকে তারা কাছ থেকে দেখেনই নি; তাদের ভাষা জানেন না, তাদের মনের কথা জানেন না, এককথায় তাদের চেনেনই না। ফলে তাদের লেখাগুলো হয়ে যাচ্ছে তাদের পুরনো লেখাগুলোর চর্বিতচর্বন, ভীষণ নীরস এবং অনাকর্ষণীয়। মোদ্দা কথা পাবলিক আর খাচ্ছে না।
তুখোড় সম্পাদক সমুদ্র বোস চিন্তা করলেন ছেলেটিকে কাজে লাগানো যাক। তার পরম সুহৃদ, তখনকার দিনের সর্বাধিক পপুলার লেখক অনিল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফোনে আলোচনা করে, তার কাছেই পাঠালেন শান্তনুকে।