What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

শেষের পাতায় শুরু (1 Viewer)

পর্ব পাঁচ – (#4-21)

বেল্ট থেকে সুটকেস তিনটে নামিয়ে যেদিকে ঝিনুক গিয়েছিল সেদিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল এখন আসছে না দেখে খানিক চিন্তিত হয়ে পরে। বিশাল এয়ারপোরট কোথাও আবার হারিয়ে গেল না ত? মনে মনে হেসে ফেলে, এই সবের মধ্যে ওর ফোন নাম্বার নেওয়া হয়নি। নিজের স্ত্রী কিন্তু ফোন নাম্বার জানে না, কেউই যদি এটা শোনে তাহলে ভীষণ হাসাহাসি করবে। ঘড়ি দেখে, পৌনে এগারোটা এখানেই বাজে, এরপর ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরো রাত হয়ে যাবে। পোশাকের নিচে ইনার নিশ্চয় পরেনি ঝিনুক, কোলকাতায় এসবের চল নেই, এয়ারপোরট থেকে বের হলে কনকনে ঠান্ডায় জমে যাবে তাহলে। নিজের সুটকেসে একটা শাল অবশ্য আছে, একটু ভেবে সুটকেস খুলে সেই শাল বার করার সময়ে মনে হল ওর পাশে এসে কেউ দাঁড়িয়েছে। শাল বার করে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে ওর পাশে ঝিনুক।

ওর হাতে শাল ধরিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এত দেরি করলে?”

নরম গলায় উত্তর দেয়, “না মানে এক বান্ধবীর কল এসেছিল তাই কথা বলতে বলতে একটু দেরি হয়ে গেল।”

মাথা দোলায় রিশু, “ওহ আচ্ছা।” ট্রলিতে সুটকেস গুলো নিয়ে বাইরের গেটের দিকে হাঁটা শুরু করে দুজনে।

ঝিনুক একটু পেছনে ছিল, হাতে শাল দেখে ভাবে হটাত শাল কেন বার করতে গেল? এখানে তেমন ঠান্ডা লাগছে না। জিজ্ঞেস করে রিশুকে, “হটাত শাল কেন?”

মুচকি হাসে রিশু, “বাইরে কিন্তু বিশাল ঠান্ডা।”

মাথা দোলায় ঝিনুক, “ওহ আচ্ছা।”

আবার দুইজনে চুপচাপ। টারমিনাল থেকে বেড়িয়ে আসতেই এক দমকা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া কাঁপুনি দিয়ে দেয় ঝিনুকের শারা শরীরে। দাঁতে দাঁত পিষে, বুকের ওপরে হাত শক্ত করে ভাঁজ করে গায়ের ওভারকোটটা শরীরের সাথে বেশি করে জড়িয়ে নেয়। ওকে ওইভাবে কাঁপতে দেখে দাঁড়িয়ে পরে রিশু। হটাত থেমে যেতেই ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকায় ঝিনুক। রিশু ওর হাত থেকে শাল নিয়ে গলায় জড়িয়ে গায়ে জড়িয়ে দেয়। যখন ওর গায়ে শাল জড়িয়ে দিয়েছিল রিশু তখন ঝিনুকের সারা শরীর পাথর হয়ে গেছিল, ঠান্ডায় নয় এক অজানা অনুভুতিতে শরীরের সব রোমকূপ একসাথে উন্মিলিত হয়ে ওঠে। গলায় শাল জড়ানোর সময়ে এক মুহূর্তের জন্য ওর কোমল উষ্ণ গালের ওপরে রিশুর তপ্ত কঠিন আঙ্গুল ছুঁয়ে যায়। গালের ওপর হটাত ওই অচেনা আঙ্গুলের ছোঁয়ায় ভীষণ ভাবেই কেঁপে ওঠে ঝিনুক। আরো কিছুক্ষন এইভাবে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে চেয়েছিল, কেন দাঁড়াতে চেয়েছিল? কারণ ওর অজানা। নির্বিকার চিত্তে রিশু ওর গায়ে শাল জড়িয়ে দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে দেয় ট্যাক্সি স্টান্ডের দিকে। কিঞ্চিত অনুরাগ দেখা দেয় ঝিনুকের বুকে, কৃষ্ণার সাথে কথা বলার পরে মন বেশ হাল্কা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু রিশুকে নির্বিকার ভাবে আবার হাঁটতে দেখে মনে মনে বলে ফেলে, ধ্যাত ছাতার মাথা, কতক্ষন পরে একটু কথা বলতে শুরু করেছিল আবার সেই চুপ।

হাঁটতে হাঁটতে ট্যাক্সির স্টান্ডে গিয়ে ট্যাক্সিতে চাপে ওরা। পেছনের সিটের দুই প্রান্তে দুইজন একাকী বসে, মাঝের ব্যাবধান যেন সহস্র যোজন। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হুহু করে গাড়ি এগিয়ে চলেছে, এত রাতে রাস্তায় সাধারন গাড়ির সংখ্যা কম কিন্তু ট্রাকের ভিড় বেশ। নতুন জায়গা, নতুন রাস্তা, এমন কি আলো গুলো পর্যন্ত নতুন মনে হয় ঝিনুকের। মন দিয়ে গাড়ির বাইরে দেখে আর ভাবে, এবারে এই শহর হয়ে যাবে ওর শহর।

বাড়ি গিয়ে কি করবে ঝিনুক সেটাই চিন্তার প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায় রিশুর কাছে। গতরাতে যেমন ভাবে আহত সাপের মতন ফোঁস করে উঠেছিল তাতেই বুঝে গিয়েছিল রিশু যে পাশে বসা আহত মেয়েটার বুকের ভেতরটা জোড়া লাগতে একটু সময় নেবে। মনে মনেই হাসে রিশু, নাম ঝিনুক যখন তখন একদম খোলের মধ্যেই ঢুকে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই খোল থেকে জোর করে বার করতে গেলে যদি খোল ভেঙ্গে যায় তাহলে মুশকিল, হয়ত ঠিক সময় মতন নিজের খোল থেকে নিজেই বেড়িয়ে আসবে। ঘরের অবস্থা একদম তছনছ, আসার দিন ঘর গুছিয়ে রেখে আসার সময় পায়নি, তখন কি আর জানত রিশু যে ওর সাথে এক সুন্দরী ওর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করবে। সে যাই হোক যদি ওর মা, ভাই বোন এইভাবে থাকতে পারে তাহলে এই পাশে বসা মেয়েটাকেও সেই ভাবেই থাকতে হবে। কিন্তু এত রাতে কি খাবে? এতক্ষনে ওর এলাকার সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে, একমাত্র শহরের মাঝখানের বেশ কয়েকটা রেস্টুরেন্ট হয়ত খোলা থাকবে। কিন্তু ট্যাক্সি ওদের বাড়ির দিকেই ধেয়ে চলেছে।

বড় রাস্তা ছেড়ে বেশ কয়েকটা ছোট রাস্তার এমোড় সেমোড় বেঁকে একটা তিনতলা ফ্লাট বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় ওদের ট্যাক্সি। রাত তখন সাড়ে বারোটা, সামনের পার্কের গাছাপালা গুলো যেন ভুতের মতন দাঁড়িয়ে। শীতকাল সবার বাড়িতে সেই সময়ে আলো বন্ধ, সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ট্যাক্সি থেকে নামতেই হুহু করে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া ঝিনুককে কাঁপিয়ে তোলে। বাপরে কি সাঙ্ঘাতিক ঠান্ডা। ভাড়া মিটিয়ে সুটকেস হাতে করে টানতে টানতে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যায় রিশু।

পকেট থেকে বাড়ির চাবি বের করে ঝিনুকের হাতে ধরিয়ে বলে, “দুইতলার ডান দিকের ফ্লাট, তুমি যাও আমি এই সুটকেস গুলো এক এক করে নিয়ে আসছি।” ঝিনুক নিজের বড় সুটকেসটা টেনে নিয়ে যেতেই রিশু বারন করে বলে, “তুমি ছোটটা নিয়ে ওঠ আমি আসছি।”

মাথা দোলায় ঝিনুক, “আচ্ছা।”

একা একা এইভাবে কারুর বাড়িতে চাবি খুলে ঢুকে পড়তে একটু বিব্রত বোধ করে ঝিনুক। নিজের ছোট সুটকেস হাতে নিয়ে সিঁড়ির কয়েক ধাপ চড়ে পেছন ঘুরে রিশুর দিকে তাকিয়ে থাকে। রিশু একটা বড় সুটকেস হাতে নিয়ে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে ঝিনুক ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। আধো আলো আধারিতে দাঁড়িয়ে এক স্বপ্ন দেশের রাজকুমারী বলে মনে হয় ঝিনুককে, উজ্জ্বল চোখ জোড়া চকচক করছে এক অজানা আশঙ্কা আর ভীতিতে। মাথা নাড়িয়ে রিশু জিজ্ঞেস করে, কি হল চল। মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায় ঝিনুক, হ্যাঁ যাচ্ছি। এক পা এক পা করে চড়ার সময়ে অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতার মাঝে রিনিঝিনি করে বেজে ওঠে ওর পায়ের নুপুর। এতক্ষন চারপাশের কোলাহলে রিশুর কানে এই নুপুরের নিক্কন ঠিক ভাবে পৌঁছায়নি। ফর্সা পায়ের গোড়ালির দিকে তাকিয়ে স্তব্দ হয়ে যায় রিশুর হৃদয়, দুই পায়ে পাতলা রুপোর নুপুর, এই আধুনিক যুগে নুপুরের চল একদম নেই তাই একটু অবাক লাগে ঝিনুকের পায়ে নুপুর দেখে।

দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দেয় রিশু। বসার ঘরের সোফায় একটা জামা আর জ্যাকেট পড়া, মাথা চুলকে সঙ্গে সঙ্গে সেই জামা আর জ্যাকেট সরিয়ে দিয়ে মুখ কাচুমাচু করে হেসে ফেলে।

একটা ঘরের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে ঝিনুককে বলে, “তুমি ওই ঘরে যাও আমি বাকি সুটকেস নিয়ে আসছি।”

দরজা খোলা রেখেই রিশু নেমে যায় সিঁড়ি দিয়ে। রিশু বেড়িয়ে যেতেই ভীষণ ভাবে একা মনে হয় ওর। একেবারে এক নতুন জগতে ঢুকে পড়েছে ঝিনুক। চারপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে জরিপ করে নেয়, আজ থেকে এটাই ওর গন্ডী এখানেই ওকে থাকতে হবে। বসার ঘরটা বেশ ছোট, একটা মাত্র লম্বা সোফা পাতা আর সোফার পেছনে একটা প্লাস্টিকের টেবিল আর দুটো চেয়ার পাতা। এক কোনায় একটা ফ্রিজ, একদিকের দেয়ালে একটা টিভি, পাশে একটা ছোট রান্নাঘর। বসার ঘরের এক পাশে পাশাপাশি দুটো ঘর, মনে হয় ওই দুটো শোয়ার ঘর। একটা ছোট পরিবার থাকার মতন যথেষ্ট। পুরো ফ্লাটটা দেখে মনে হল কোলকাতায় রিশুদের বাড়ির বসার ঘরটা মনে হয় এর চেয়েও বড়। মনে মনে হেসে ফেলে ঝিনুক, টেবিলে একটা গ্লাসে আধা খাওয়া জল মনে হয়। চেয়ারে একটা নোংরা জিন্স ঝুলছে, রান্নাঘরের দিকে উঁকি মেরে দেখে সিঙ্কে বাসন পরে রয়েছে, কাজের লোক আছে না নেই, নাকি এইসব কাজ ওকেই করতে হবে? কিঞ্চিত অস্বস্তি বোধ করে ঝিনুক, ও এখানে কাজের লোক হিসাবে এসেছে নাকি যে রোজ সকালে উঠে রান্না করবে বাসন মাজবে ঘর ঝাড়ু দেবে? বাড়িতে কাজের লোক ছিল বাড়ির কাজের জন্য, মা রান্না করত, কোনদিন রান্না ঘরে পর্যন্ত ঢোকেনি, হ্যাঁ ম্যাগি চা ডিম সেদ্দ এইসব বানাতে জানে কিন্তু এর বেশি ওর দৌড় নয়। এক ধাক্কায় ওর সীমানা এত ছোট হয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারেনি। দরজা বন্ধ করার শব্দ পেতেই সারা শরীর কেঁপে ওঠে ওর। গতরাতে বাড়িতে না হয় সবাই ছিল, সেখানে চেঁচালে হয়ত কেউ ওর ডাক শুনে ওকে বাঁচাতে আসত, কিন্তু এই দূর দেশে এই একাকী এক ফ্লাটের মধ্যে বন্ধ দরজার পেছনে ওর সাথে কি করবে রিশু? রিশুর দিকে তাকিয়ে দেখে, দুটো বড় বড় সুটকেস দুইতলা পর্যন্ত টেনে উঠিয়ে হাপিয়ে গেছে।

রিশু ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে রান্নাঘর থেকে একটা জলের বোতল এনে বেশ কয়েক ঢোক জল খেয়ে ওর দিকে জলের বোতল এগিয়ে দেয়। চারপাশে তাকিয়ে নিজের ঘরের অবস্থা দেখে বেশ বিব্রত বোধ করে। এতদিন বন্ধ থাকার ফলে বেশ নোংরা হয়ে গেছে চারদিক। বারান্দার দিকের একটা জানালা মনে হয় খোলা ছিল বলে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া ঘরের হাওয়া ঠান্ডা করে দিয়েছে।

একটা বড় শোয়ার ঘরের মধ্যে ঝিনুকের বড় সুটকেস রেখে ওকে বলে, “তুমি ফ্রেস হয়ে নাও।”

বুকের মধ্যে হাপর টানছে ঝিনুকের তাও বাধ্য মেয়ের মতন মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে বলে, “হ্যাঁ যাচ্ছি।”

চোখ ঘুরিয়ে রিশুকে দেখে ঝিনুক, শোয়ার ঘরের বিছানাটা বেশ বড় তার পাশের ঘরে একটা ছোট খাট আর একটা চেয়ার। নিজের ছোট সুটকেস নিয়ে বড় শোয়ার ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে ঝিনুক। ঠিক সেই সময়ে ঝিনুকের ফোন বেজে ওঠে। ফোন তুলে দেখে ওর মা ফোন করেছে। মেয়ে ঠিক ভাবে বাড়িতে পৌছাল কি না সেটা সব বাবা মায়ের বড় চিন্তার বিষয়।

ফোন তুলে উত্তর দেয় ঝিনুক, “হ্যাঁ মা, বাড়ি পৌঁছে গেছি ভালো ভাবে।”

ওর মা ওকে বলে, “সাবধানে থাকিস। এবারে বুঝে শুনে সব কিছু মানিয়ে চলিস। বুঝতেই পারছিস...”

কথাটা শেষ করতে দেয় না ঝিনুক, “কি বুঝবো একবার বলবে?”

পিয়ালী তাও মেয়েকে শান্ত হওয়ার জন্য বলে, “দ্যাখ বড় হয়েছিস, বিয়ে হয়ে গেছে কচি খুকি নয় তুই। রিশু তোর থেকে বয়সে অনেক বড় একটু মান সন্মান রেখে চলিস। যে অবস্থায় বিয়ে হয়েছে তাতে তোকে এইসব মানিয়ে নিয়েই চলতে...”

শেষ বাক্য কানে যেতেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঝিনুক, “হ্যাঁ, সব কিছু ত আমাকেই মানিয়ে নিতে হবে। আমি এখানে দোষী আমি খারাপ।”
পিয়ালী মেয়েকে বলে, “তুই দোষী না খারাপ সেটা তোকে বলিনি, একটা নতুন জীবন শুরু করতে গেলে অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে হয়। তোর জেদ...”

চেঁচিয়ে ওঠে ঝিনুক, “হ্যাঁ সারা জীবন আমার জেদ, আমার খামখেয়ালিপনাই এইসব দেখে গেলে তোমরা। কি মানিয়ে নেব? সকাল থেকে প্রায় একশো বার কানের কাছে এক কথা ঘ্যানর ঘ্যানর করে চলেছ, মানিয়ে নিবি মানিয়ে নিবি, ওর সামনে জেদ করবি না, ও যা বলবে শুনবি, ওর সাথে ঝগড়া করবি না। কেউকি ওকে একবার ও বলেছে আমার সাথে মানিয়ে নিতে? কেউ কি ওকে একবারের জন্য বলেছে আমার কি চাই না চাই সেটা বুঝতে? নাহ, যেহেতু সব দোষ আমার সুতরাং সব কিছু চুপচাপ আমাকেই মেনে নিতে...”

দরজার দিকে চোখ যেতেই থমকে যায় ঝিনুক, রিশু ওর দিকে নিস্পলক চোখে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে। মায়ের কথা শুনে রিশুর দিকে দেখে একদম সহ্য হয় না ওর, রাগে দুঃখে চরম ঘৃণায় সর্বাঙ্গ রিরি করে জ্বলে ওঠে। দড়াম করে রিশুর মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দেয় ঝিনুক।

রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে হটাত করে এইভাবে ঝিনুককের আচরনে ভীষণ আহত হয় রিশু। চোয়াল কঠিন হয়ে যায় ক্রোধে, কারুর ওপরে এইভাবে চেঁচিয়ে কথা বলা রিশুর একদম পছন্দ নয়। হাত মুঠো করে নিজের আবেগ আয়ত্তে নিয়ে আসে। ছোট বেলা থেকে ওর মা ওকে শিখিয়েছে, রাগ করবে না, রেগে মেগে কোনদিন কোন সমস্যার সমাধান হয় না। বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে সেই সমস্যার আসল কারন খুঁজে তার বিহিত করবে। ডাক্তারি পড়ার সময় থেকেই ওর মা ওকে বলেছিল যে এরপর ডাক্তার হবে, চোখের সামনে প্রচুর রুগী দেখবে, তাদের দুঃখ কষ্ট শুনে যেন ভাবাবেগে বয়ে না যায় তাহলে অপারেশান করার সময়ে হাত কাঁপবে সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরে ঘুমাতে পারবে না। সেই জন্য মায়ের কথা মেনে রোজদিন প্রাণায়াম করে রিশু, ভাবাবেগকে আয়ত্তে রাখার জন্য রোজদিন অন্তত আধ ঘন্টা চোখ বন্ধ করে ধ্যান করে। কিন্তু পাশের ঘরে মেয়েটা যে ওর রোগী নয়, কচি একটা মেয়ে, সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী।

ছোট ঘরের মধ্যে ঢুকে বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ খাটের ওপরে বসে থাকে আর ভাবে একবার মাকে ফোন করবে। ভীষণ কান্না পায় ওর, কিন্তু ওর চোখে জল দেখলে ওর মা থাকতে পারবে না, নিজেকে দোষী ভেবে নেবে আর নিজেকে কষ্ট দেবে, মায়ের সেই কষ্ট দেখতে চায় না রিশু। কি ভাবে ছোটবেলা থেকে ওকে বুকের মাঝে আঁকরে ধরে মানুষ করেছে সেটা ওর অজানা নয়। ওর কাপড় জামা সব কিছুই পাশের ঘরের আলমারিতে। মা ভাই বোন এলে তবেই এই ঘরে শোয়া হয় না হলে এটা ওর পড়ার ঘর। জুতো খুলে বাথরুমে ঢুকে পরিষ্কার হয়ে নেয়। পাশের ঘরের বন্ধ দরজায় কান পাততে একদম ইচ্ছে করে না। যা খুশি করছে করুক, বাকি জীবন না হয় এই বিশাল রঙমঞ্চে মেকি হাসি নিয়ে কাটিয়ে দেবে।
 
পর্ব পাঁচ – (#5-22)

ওই ভাবে রিশুর মুখের সামনে আচমকা দরজা বন্ধ করার পরে প্রচন্ড অনুতাপে ঝিনুকের শরীরের সকল শিরা উপশিরা কুঁকড়ে যায়। নিজের ওপরে ধিক্কার বোধে হাতের ফোন বিছানার ওপরে ছুঁড়ে মারে, চোখ জোড়া জ্বালা করে ওঠে মনে হয় যেন কেউ লঙ্কার গুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়েছে ওর সারা গায়ে। মাথার চুল আঁকড়ে ধরে থম মেরে বিছানার ওপরে বসে পরে ঝিনুক। এই নিস্তব্দ রাতে নিজের পাঁজর ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পায়। একি করল এটা, যতটা সময় রিশু ওর সাথে ছিল, এক বারের জন্যেও রিশু ওর সাথে কোন খারাপ ব্যাবহার করেনি বরং সব কিছু মানিয়ে নিয়ে সুচারু মার্জিত ব্যাবহার করে গেছে ওর সাথে। এক বারের জন্যেও কোন ছুতো খুঁজে অসভ্য ইতরের মতন ওকে ছুঁতেও চায়নি। ভীষণ একা মনে হয় নিজেকে এই সংসারে, সত্যি বড় ভুল করে ফেলেছে। যদি পার্থের আসল পরিচয় আগে থেকে পেয়ে যেত তাহলে অনেক আগেই পার্থকে ছেড়ে দিত, হয়ত নতুন করে অন্য কারুর সাথে প্রেম করত, নিজের মতন একটা জগত গড়তে পারত, কিন্তু এখন সব পথ বন্ধ ওর সামনে। কোন রকম দুরব্যাবহার করলে নিশ্চয় মাতৃ ভক্ত ডাক্তার আম্বালিকা আন্টিকে জানিয়ে দেবে আর সেই সাথে ওর জগত আরো ছোট হয়ে যাবে। ঘরের দেয়াল গুলো যেন ধিরে ধিরে ওর চারপাশ থেকে ওর দিকে এগিয়ে আসছে, ধিরে ধিরে ছাদটা মাথার ওপরে নেমে আসছে ওকে চেপে ধরতে। জুতো খুলে বিছানার ওপরে হাঁটু মুড়ে কুঁকড়ে বসে পরে ঝিনুক। চিন্তা শক্তি ধিরে ধিরে লোপ পেতে শুরু করে। নিজের আসন্ন ভবিতব্যের কথা ভেবে হাঁটুর মাঝে মাথা গুঁজে গুমরে কেঁদে ওঠে শেষ পর্যন্ত, “একটু বিষ পেলে ভালো হত।”

চুপ করে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকার পরে মাকে একটা মেসেজ করে দেয় রিশু যে ঠিক করে বাড়িতে পৌঁছে গেছে। যদিও জানে যে ওর মা জেগে তাও এতরাতে কথা বলার ইচ্ছে ছিল না, কি বলবে। অন্য সময় হলে বাড়িতে ঢোকা মাত্রই মাকে ফোনে জানিয়ে দিত কিন্তু ঝিনুকের এহেন আচরনে প্রচন্ড ভাবেই আহত হয়েছিল। মায়ের প্রিয় বান্ধবীর মেয়ে, মায়ের পছন্দ তাই মায়ের কথা ফেলতে পারেনি না হলে এমন বদরাগী জেদি মেয়েকে কোনদিন বিয়ে করত না। গত রাত থেকে এক বারের জন্যেও ঝিনুকের সাথে কোন বিরূপ আচরন করেনি, তাও কেন এই ভাবে ওর মুখের সামনে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল তার সঠিক উত্তর খুঁজে পায় না। খাটে শুয়ে গায়ে কম্বল টেনে শুয়ে পরে, বড় জোর তিন চার ঘন্টা ঘুমাতে পারবে, সকালে উঠেই দৌড়াতে হবে ট্রমা সেন্টারে। এর মাঝে ওর কলিগ ব্রিজেশের ফোন আসে, ব্রিজেশ জানায় যে সবাই উন্মুখ হয়ে আছে ওর নতুন স্ত্রীকে দেখার জন্য। ক্ষুন্ন মনে হেসে ফেলে রিশু, হায়রে পোড়া কপাল, দুষ্টু গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল ভালো।

চোখ বন্ধ করতে যাবে কি ফোন বেজে ওঠে, ফোনের স্ক্রিনে মায়ের মুখ দেখে হেসে ফেলে রিশু, “মেসেজ করলাম ত, ঘুম নেই নাকি তোমার চোখে?”

অন্য পাশে আম্বালিকা স্নেহ ভরা কন্ঠে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, “তোরা কিছু খেলি? প্লেনে ত কিছুই খেতে দেয়নি।”

মায়ের কাছে মিথ্যে কথা কি করে বলে, “না মানে, ওই আর কি এত রাতে আর খেতে ভালো লাগলো না।”

ওর মা ওকে জিজ্ঞেস করে, “ঝিনুক ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?”

জানা নেই রিশুর তাও উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, খুব টায়ারড ছিল।”

আম্বালিকা একটু থেমে জিজ্ঞেস করে, “পাশের ঘরে, দরজা বন্ধ করে?”

ওর মা সব জানে, মুচকি হেসে উত্তর দেয়, “তুমি কি এখানে সিসি টিভি ক্যামেরা লাগিয়েছ নাকি?”

হেসে ফেলে আম্বালিকা, “লাগাতে হয় নাকি? তোর চোখ আছে ত।” একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ছেলেকে বলে, “মনে আছে, তুই ও যখন প্রথম বার ডাক্তারি পড়তে গেলি তখন কিন্তু প্রথমের বেশ কয়েকদিন...”

হেসে ফেলে রিশু, “হ্যাঁ জানি, ওকে নিয়ে তোমাকে কিছু বলেছি নাকি?”

আম্বালিকা হাসে, জানে ওর পুত্র বেশ বিচক্ষন, “তোকে নিয়ে সেই চিন্তা আমার নেই, তাও...”

রিশু উত্তর দেয়, “ঠিক আছে এবারে ঘুমাও ত।”

আম্বালিকা একটু হেসে বলে, “আচ্ছা কাল সকালে তাহলে কথা হবে, এখন ঘুমো, কাল থেকে তোর আবার মর্নিং ডিউটি তাই না?”

রিশু মাথা দোলায়, “হ্যাঁ, চল গুড নাইট।”

অনেকক্ষণ নাকি অল্পক্ষন জানা নেই ঝিনুকের, কাঁদতে কাঁদতে কখন যে বিছানায় এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই ওর। ঠান্ডায় কেঁপে উঠে বিছানায় বসে চোখ ডলতে ডলতে খেয়াল হয়, সেই যে এই ঘরে ঢুকেছিল তারপর জামা কাপড় পর্যন্ত খোলা হয়নি। এই বাড়িতে আরো একটা মানুষ আছে সে কথা মনে পড়তেই কুন্ঠা বোধ করে। খানিকক্ষন চুপ করে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করে আশেপাশের আওয়াজ, নিস্তব্দ নিঝুম রাতে ওর কানে কোন আওয়াজ পৌঁছায় না। অতি সন্তর্পণে দরজা একটু খুলে বসার ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে দেখতে চেষ্টা করে কেউ আছে কি না। অন্ধকার বসার ঘর দেখে একটু আসস্থ বোধ করে। পা টিপে বাইরে বেড়িয়ে এপাশ ওপাশ তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে রিশু কি করছে। পাশের ঘরে উঁকি মেরে দেখতে পায় যে খাটের ওপরে একটা কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছে রিশু। বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ দরজায় দাঁড়িয়ে রিশুর দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে ছেলেটা এক বারের জন্যেও ওর এই আচরনের জন্য কঠিন ভাষায় কিছুই বলেনি, সকাল থেকে দেখে এসেছে ছেলেটা অদ্ভুত ধরনের শান্ত আর মার্জিত স্বভাবের। নাকের পাটা ফুলে যায়, চোখ ভেসে যায় ওর, কি করবে কিছুই ভেবে পায় না।

বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পরে আবার নিজের ঘরে ঢুকে পরে ঝিনুক। জামা কাপড় বদলে একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার, সেই বিকেল থেকে এক জামা কাপড় পরে রয়েছে। পার্থের সাথে বিয়ে হবে বলে নিজের পছন্দের জামা কাপড় গুছিয়ে নিয়েছিল ওর বড় সুটকেসের মধ্যে, সেটার দিকে এক বারের জন্যেও তাকানো হয়নি, যেমন ছিল সেটা তেমন ভাবেই নিয়ে আসা হয়েছে। সুটকেস খুলে একটা তোয়ালে বের করতে গিয়ে চোখে পরে কিছু লঞ্জারি, পার্থের পছন্দ মতন বেশ কয়েকটা ফিনফিনে জালের রাত্রি পোশাক কিনেছিল, হাই হিল জুতো কিনেছিল, ছোট ছোট স্কারট আর হাতা বিহিন ছোট পারটি ড্রেস কিনেছিল, পেটের চারপাশে পড়ার জন্য একটা পাতলা সোনালি রঙের চেন কিনেছিল। এক রাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে সেই সব পোশাক আর জিনিসপত্রের দিকে দেখে মনে হয় যেন সব জ্বালিয়ে দেয়। ছোট সুটকেসে ওর দৈনন্দিনের ঘরে পড়ার জামা কাপড়, সেখান থেকে কাপ্রি আর টপ নিয়ে শোয়ার ঘর থেকে বেড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে পরে। বাথরুমটা বেশ ছোট, দরজার পেছনে তিন চারটে হুক লাগানো, তাতেই একটা গামছা ঝুলছে, একপাশে একটা বেসিন অন্যপাশে কমোড, দেয়ালে একটা গিজার লাগানো আছে। হুকের মধ্যে নিজের তোয়ালে আর রাতে পড়ার জামা কাপড় ঝুলিয়ে পরনের পোশাক খুলে ফেলে। সালোয়ার কামিজ খুলতেই ভীষণ ঠান্ডায় হুহু করে কেঁপে ওঠে সারা শরীর, কি ভীষণ ঠান্ডা রে বাবা একদম হাড় কাঁপিয়ে দিল ঝিনুকের। বেসিনের কল খুলে হাত পাততেই মনে হল যেন ওর আঙ্গুল কেউ কেটে নিয়ে গেছে। উফফফফ, মরে যাবে এবারে, সঙ্গে সঙ্গে গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে নেয়। এমন সময়ে বাথরুমের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে স্থম্ভিত হয়ে যায় ঝিনুক, গলা শুকিয়ে আসে ওর।

দরজার ওপাশ থেকে ঘুম জড়ান গম্ভির কন্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে, “এত রাতে কি করছ?”

যা বাবা, রাতে কি বাথরুমে যাওয়া বারন নাকি? আমতা আমতা করে উত্তর দেয় ঝিনুক, “না মানে এই একটু ফ্রেস হচ্ছিলাম।”

মেয়েটা একটা কান্ড ঘটাবেই ঠিক করেছে, এত রাতে এই ভাবে জল ঘাঁটলে হাইপোথারমিয়া হবে। রিশু বলে, “গিজার চালিয়ে নাও না হলে এই ঠান্ডা জলে শরীর খারাপ করবে।”

আ মরন আমার, ঠান্ডা জলে ইতিমধ্যে ওর আঙ্গুল কেটে বেড়িয়ে গেছে। উত্তর দেয় ঝিনুক, “গিজারের সুইচ কোনটা দেখতে পাচ্ছি না ত।”

সব কিছু বুঝিয়ে দিত রিশু, কিন্তু ঘরে ঢোকা সাথে সাথে যা খারাপ ব্যাবহার করল তাতে কথা বলার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছিল। রিশু উত্তর দেয়, “ওই গিজারের পেছনে দেখ একটা তার ঝুলছে তার সাথে আছে।”

গিজারের দিকে তাকিয়ে দেখে ঝিনুক, হ্যাঁ গিজারের পেছনে একটা তার ঝুলছে সেই সাথে সুইচ। উত্তর দেয় ঝিনুক, “হ্যাঁ দেখতে পেয়েছি।”

রিশু বলে, “চটি পরে তবেই সুইচ অন করবে ওটা আবার কারেন্ট মারে।”

মরন দশা ওর পায়ে চটি নেই, নিচু গলায় উত্তর দেয় ঝিনুক, “আচ্ছা ঠিক আছে।”

একটু ভেবে রিশু ওকে বলে, “না থাক, তুমি দরজা খোল আমি অন করে দিচ্ছি তোমাকে অন করতে হবে না।”

এমা কি হবে, ঝিনুক যে শুধু মাত্র ব্রা আর প্যান্টি পরে। লজ্জায় কান লাল হয়ে যায় ওর, আমতা আমতা করে উত্তর দেয়, “না আমি অন করে নিতে পারব।”

রিশু বাঁকা হাসি দিয়ে বলে, “কারেন্ট লাগলে আমি জানি না কিন্তু।”

ইয়ার্কির হাসি শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ঝিনুক, এতরাতে মস্কারি করা হচ্ছে ওর সাথে, দাঁতে দাঁত পিষে রাগ সংবরণ করে উত্তর দেয়, “আমি অন করে নেব।”

রিশু বলে, “ঠিক আছে, তবে বেশিক্ষন খালি গায়ে থেকো না হাইপোথারমিয়া হয়ে যাবে।”

কি বলল কথাটা সোজা ভাষায় কি বলতে পারে না নাকি কিছু। না বুঝেই উত্তর দেয় ঝিনুক, “আচ্ছা দেখা যাবে।”

হেসে ফেলে রিশু, “আরে বাবা আমি বললাম যে এত রাতে বেশি জল ঘাঁটলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”

ওহ আচ্ছা, কিন্তু কতক্ষন ছেলেটা দরজার ওপাশে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। বিরক্তি ঝড়ে পরে ঝিনুকের গলায়, “আপনি কি এইভাবে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি?”

ঝিনুকের ওপরে আর রাগ করে থাকতে পারে না শেষ পর্যন্ত হেসে ফেলে রিশু, “এখন ওই আপনি ধরেই বসে আছো।”

অন্যপাশে হেসে ফেলে ঝিনুক, “আচ্ছা বাবা, কিন্তু এইভাবে দাঁড়িয়ে কেন?”

রিশু উত্তর দেয়, “তোমার কিছু হলে আমাকেই ত দেখতে হবে তাই...”

ঝিনুক গিজারের সুইচ অন করতেই যথারীতি কারেন্ট খেয়ে আঁতকে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে রিশু বাথরুমের দরজা ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করে, “কি হল, ঠিক আছো?”

উফফ আঙ্গুল দুটো জ্বলছে, আঙ্গুলের ডগায় ফু দিতে দিতে উত্তর দেয়, “কারেন্ট মারে যে...”

হেসে ফেলে রিশু, “বলেছিলাম কারেন্ট মারবে, নাও এবারে দরজা খোল আমি অন করে দিচ্ছি।”

লজ্জায় লাল হয়ে যায় ঝিনুক, “না মানে...”

ঝিনুকের গলা শুনে রিশুর বুঝতে অসুবিধে হয় না যে এতক্ষনে জামা কাপড় খুলে ফেলেছে, তাই আসস্থ করে ওকে বলে, “হুকে দেখো একটা গামছা ঝুলছে সেটা জড়িয়ে নাও।”

ওরে বাবা ওটা গামছা নাকি, ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঝিনুক, “না বাবা না, ওই নোংরা গামছা আমি গায়ে দেব না।”

হেসে ফেলে রিশু, “তাহলে দাঁড়িয়ে থাকো সারা রাত ওই ভাবে।”

বেগতিক দেখে নিরুপায় হয়ে ঝিনুক বলে, “চোখ বন্ধ করে ঢুকলে তবেই দরজা খুলবো।”

রিশু হাসতে হাসতে উত্তর দেয়, “আচ্ছা বাবা চোখ নাক কান সব বন্ধ করে নেব হয়েছে, নাও এবারে দরজা খোল।”

অতি সন্তর্পণে বাথরুমের দরজা খুলে, দরজার পেছনে নিজেকে আড়াল করে একরাশ বিরক্তি আর একটু ভিতি নিয়ে রিশুর দিকে তাকায়। ঝিনুকের সাথে চোখ মেলাতেই মুচকি হাসে রিশু।

রিশুর ঠোঁটে হাসি দেখে রেগে যায় ঝিনুক, “আমার ঠান্ডা লাগছে, তাড়াতাড়ি করুন... আই মিন কর”

সুইচ অন করে ওর সামনে নিজের চটি খুলে বলে, “এটা পরে নাও। আর মিনিট পনেরো পরে সুইচ বন্ধ করে দেবে।”

নিচের ঠোঁট কামড়ে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে ঝিনুক, যেন বলতে চায় এরপরে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে তুলবে।
 
পর্ব পাঁচ – (#6-23)

কথা বলার সময়ে ঝিনুকের দিকে চোখ যায় রিশুর। ঝিনুক দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকলেও ওর বুঝতে অসুবিধে যে সুন্দরী ললনা শুধু মাত্র তোয়ালে গায়ে জড়িয়ে। হাত, বাজু কাঁধ সব অনাবৃত, চুল এলোমেলো। মেহেন্দির গাড় বাদামি রঙ্গে রাঙ্গান ফর্সা এক হাত কোন রকমে বুকের কাছে জড় হয়ে শক্ত করে তোয়ালে চেপে ধরে। ঝিনুক ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকায় রিশু মাথা নাড়িয়ে একটু হেসে বেড়িয়ে আসে বাথরুম থেকে। ভোরের আলো ফোটার আগেই ওকে দৌড়াতে হবে হসপিটালে, তাই শোয়ার ঘরে ঢুকে পরে নিজের জামা কাপড় নেওয়ার জন্য। ঘরে ঢুকে চোখ পরে বিছানার ওপরে খোলা সুটকেসের দিকে। ওপরে দিকে পাতলা ফিনফিনে লঞ্জারি গুলো দেখে হেসে ফেলে, বেশ দুরন্ত মেয়ে, অনেক কিছুই লুকিয়ে আছে ওই ভয়ার্ত চোখের আড়ালে। তখন পর্যন্ত ঝিনুক বাথরুমে, মনে মনে হেসে ফেলে রিশু, মেয়েটার সর্দি লাগলো বলে আর কি।

আলমারির বেশ কয়েকটা তাক জুড়ে মায়ের কাপড় চোপর, ভাই বোনের পোশাক আশাক ভর্তি, রেসিডেন্টশিপ পাওয়ার পরে কোলকাতা যাওয়া কমে যাওয়াতে ওর মা প্রত্যকে মাসেই ওর কাছে আসেন, কখন ভাই বোনকে সঙ্গে নিয়ে না হলে একাই দুই তিন দিনের জন্য ঘুরে যান। মায়ের ভাই বোনের কাপড়ের দিকে হাত বাড়ায় না রিশু, নিজের জামা কাপড় গুলো একটা তাকের মধ্যে ঠেসে দিয়ে ঝিনুকের জন্য কয়েকটা তাক খালি করে দেয়। এপ্রন আর কাচা জামা প্যান্ট হাতে নিয়ে শোয়ার ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসে। ছোট শোয়ার ঘরের খাটে জামা কাপড় রেখে ঝিনুকের অপেক্ষায় বসার ঘরের সোফায় বসে পরে। এখন পর্যন্ত ঝিনুক ওকে আপনি করেই সম্বোধন করে চলেছে, আধুনিকা মেয়ে তাই ঝিনুকের মুখে আপনি সম্বোধন একদম মানায় না। বুঝতে অসুবিধে হয় না রিশুর যে ঝিনুক হয়ত ওর সাথে সুদুর দিল্লীতে এসেছে কিন্তু মেয়েটার আত্মা কোথাও যেন হারিয়ে গেছে।

বেশ কিছুক্ষন পরে বাথরুমের দরজা খুলে বাইরে উঁকি মারে ঝিনুক, কোথায় গেল? বসার ঘরের সোফার ওপরে বসে থাকতে দেখে মুখ টিপে হাসি লুকিয়ে বেড়িয়ে আসে। এতক্ষন কেন বসে, ওর অপেক্ষায় নাকি? ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে দেখে রিশু, পরনে হাঁটু পর্যন্ত চাপা একটা ঘিয়ে রঙের প্যান্ট আর ওপরে একটা চাপা টপ। পরনের পোশাক বেশ আঁটো যার ফলে ঝিনুকের বাড়ন্ত দেহের আকার অবয়াব স্পষ্ট ভাবেই ফুটে উঠেছে রিশুর চোখের সামনে। ধির পায়ে বাথরুমে থেকে বেড়িয়ে আসার ফলে ফর্সা পায়ের গোড়ালিতে বাঁধা পাতলা নুপুরের নিক্কনে ভরে ওঠে সারা ঘর। ছনছন আওয়াজ বেজে ওঠে রিশুর বুকের ভেতরে। ভীষণ ঠান্ডার ফলে ঝিনুকের স্তনের বোঁটা জোড়া শক্ত হয়ে গেছে, টপের নিচে ব্রা পরে না থাকায় ভীষণ ভাবেই ফুটে উঠেছে স্তনের বোঁটা জোড়া। ভীষণ লজ্জা লাগে ঝিনুকের, তোয়ালেটা বুকের কাছে জড়সড় করে ধরে পিনোন্নত স্তন জোড়া কোন রকমে রিশুর রক্তিম চাহনি বাঁচিয়ে ওর দিকে হাজার প্রশ্ন নিয়ে তাকায়, এত কি দেখছ বল’ত? রিশু মুচকি হাসি দেয় ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে। রিশুর ওই হাসি দেখে ভীষণ লজ্জা পেয়ে ত্রস্ত পায়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে ঝিনুক।

বুক ভরে শ্বাস নেয় রিশু, শোয়ার ঘরের মধ্যে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলে, “এখন ঘুমাতে যাও, যা গুছাবার কাল সকালে গুছিও।” নিজের পোশাক বড় সুটকেসের মধ্যে রেখে বাধ্য মেয়ের মতন মাথা দোলায় ঝিনুক। রিশু ওকে বলে, “আমার ট্রমা সেন্টারে মর্নিং ডিউটি, আমি এই সাড়ে চারটে নাগাদ বেড়িয়ে যাবো।” ছোট উত্তর দেয় ঝিনুক, “আচ্ছা” সেই সাথে জিজ্ঞেস করে কখন ফিরবে? কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বের হল না ওর। রিশু সেই অব্যাক্ত প্রশ্নের উত্তরে বলে, “আমার ফিরতে সেই বিকেল তিনটের মতন হয়ে যাবে। মাম্মা হয়ত সকালেই কাজের মেয়ে রোজিকে ফোন করে দেবে, সে এসে রান্না করে যাবে।” ঝিনুক এক মনে রিশুর দিকে তাকিয়ে সব কথা মন দিয়ে শুনে যায়। রিশু ওকে বলে, “এখন ঘুমিয়ে পড় আর জাগতে হবে না।”

রিশু নিজের ঘরে ঢুকে লেপ মুড়ি দিয়ে চুপচাপ সিলিঙ্গের দিকে একভাবে তাকিয়ে চিন্তায় পরে যায়। অনেক সময়ে ওটিতে থাকলে ওর বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যায়, সেই পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারবে ঝিনুক? মাঝে মাঝে যখন এমারজেন্সি অথবা কোন ডাক্তার ছুটিতে যায় তখন মধ্য রাতেও অনেক সময়ে ডাক পরে। অনেক সময়ে অনেক রোগীকে বাঁচাতে পারে না, কেউ কেউ অপারেশান টেবিলেই মৃত্যু বরন করে, সেসব দিনে খুব চুপচাপ থাকে রিশু। দুঃখে ভাবাবেগে বয়ে যায় না সত্যি কিন্তু ওর মা ওর গলা শুনেই বুঝতে পারে ওর কি হয়েছে। সেসব দিনে ওর মা হসপিটালে থাকাকালীন একদম আর ফোন করে না, সেসব দিনে ওর মা অনেক রাতের দিকে ফোন করে ওকে স্বান্তনা দিতেন। মা ছাড়া ওর এই সব দুঃখ কষ্ট কোন তৃতীয় ব্যাক্তির পক্ষে অনুধাবন করা অসম্ভব।

আগে থেকেই একটা ধারনা ছিল যে ঝিনুক জেদি আর অবাধ্য প্রকৃতির মেয়ে কিন্তু সুটকেসে রাখা পোশাকের বাহার দেখে মনে হল শুধু মাত্র জেদি নয় এই মেয়ে ভীষণ ভাবেই দুরন্ত আর ডানপিটে স্বভাবের। এইসব দুরন্ত আর চঞ্চল স্বভাবের মানুষ সবসময়ে নিজের সুখের কথা আগে চিন্তা করে। ওর মা কোনদিন নিজের চিন্তা করেনি আর সেই শিক্ষাই ওকে দিয়ে এসেছে চির জীবন। মায়ের কথা মনে পড়তেই চোখের কোনা জলে ভরে যায়। মেডিকেল এনট্রান্স পরীক্ষায় যেদিন পাস করেছিল সেই রাতের ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই হুহু করে ওঠে ওর হৃদয়, বহুদিন পরে সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে এক অব্যাক্ত কান্না ঠিকরে বেড়িয়ে আসে গলা থেকে, “মা গো...” সেই রাতে আর ঘুমাতে পারল না রিশু।

রাত তখন সাড়ে তিনটে একটু পরেই রিশু বেড়িয়ে যাবে। ঝিনুকের চোখে ঘুম একদম ছিল না। গলা পর্যন্ত লেপ মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে ভাবে নিজের কথা, এরপর কি হবে, এই চার দেয়ালের মধ্যে গন্ডিবদ্ধ হয়েই কাটাতে হবে বাকি জীবন। হয়ত এরপরে ওর নিত্য কাজ হবে রিশুর জন্য সকালে উঠে টিফিন বানানো, তারপরে ঘরের কাজ কর্ম, তারপরে রান্না বান্না করা, সেই বিকেলে কখন ওর স্বামী আসবে তার অপেক্ষায় থাকা। মায়ের মতন ঘর বন্দি জীবন কাটাতে চায়নি ঝিনুক। রানীগঞ্জে থাকতে মাকে দেখেছে, মা রোজ দিন সকালে উঠে বাবার জন্য চা জল খাবার বানাত, তারপরে ওদের স্কুলের টিফিন বাবার টিফিন বানাত। সেই কাজের পরে যখন বাবা আর ওরা অফিস আর স্কুলের জন্য বেড়িয়ে যেত তারপরে রান্না করতে বসত। হয়ত কোনদিন দুপুরে একটু ঘুমাত না হলে পাশের কোয়াটারের কস্তুরি আন্টির সাথে গল্প করত। এই ছিল ওর মায়ের নিত্য দিনের কাজ। বড় হতে হতে ঝিনুক মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিল, না মায়ের মতন এই গতানুগতিক জীবন যাপন করবে না।

এমবিএ পড়ার সময় থেকেই ইচ্ছে ছিল চাকরি করার, কিন্তু শেষের দিকে পার্থের সাথে মেলামেশা হওয়ার ফলে আশানুরূপ ভালো ফলাফল হল না। ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে চাকরি পায়নি তবে সেজন্য অনুতাপ ছিল না কারণ ততদিনে ওর জীবনে পার্থ এসে গিয়েছিল এবং ঝিনুকের চোখে তখন এক রঙ্গিন ধোঁয়াশা স্বপ্নের আবরন পরে গিয়েছিল। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার ইচ্ছেও ছিল না ওর, কিন্তু মনের কোন এক গহীন কোনে লুকিয়ে ছিল পূর্ণ রূপে শারীরিক সঙ্গমের প্রবল ইচ্ছে। পার্থের হাতের উষ্ণ ছোঁয়া মাঝে মাঝেই ওকে উত্তপ্ত করে তুলতো, কামনার লেলিহান শিখা জ্বলে উঠত তখন, কতবার ব্রা আর প্যান্টি পরে পরেশের ফ্লাটে পাশাপাশি দুইজনে শুয়ে কাটিয়ে গেছে। যৌন সঙ্গমের তীব্র ইচ্ছে থাকলেও কোথায় যেন একটু বাধা পরে যেত ঝিনুক, সেই অনাস্বাদিত শারীরিক সুখের ইচ্ছেটাকে সম্পূর্ণ রূপে উপভোগ করার জন্য কলেজ শেষ করেই পার্থের সাথে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। বুকের পাঁজর ককিয়ে ওঠে সেই কথা ভেবে, কেন মরতে পার্থের সাথে দেখা হয়েছিল।

ভাবতে ভাবতে একটু তন্দ্রাভাব এসেছিল রিশুর, ঠিক সেই সময়ে ফোন বেজে ওঠে ওর। অন্যপাশে ওর কলিগ ব্রিজেশ, ওকে জানায় যে রাতে একটা ট্রাকের সাথে একটা বাসের এক্সিডেন্ট হয়েছে, একের পর এক এ্যাম্বুলেন্স এসে চলেছে, ওকে তাড়াতাড়ি হসপিটাল আসতে হবে। ঘুম আর হল না ওর, ভেবেছিল একটু চোখ বুজে পরে থাকবে কিন্তু কর্তব্য সবার আগে। খাট ছেড়ে উঠতে একদম ইচ্ছে করছিল না, গতরাতেও ঠিক করে ঘুমাতে পারেনি, কাউচে বসে কাটাতে হয়েছিল। বিছানা ছেড়ে উঠে, পাশের ঘরে উঁকি মেরে দেখল যে ঝিনুক ওর ওঠার শব্দ শুনে উঠে পড়েছে। একটা পাতলা কারডিগান গায়ে জড়িয়ে ওর চটি পরে দরজায় দাঁড়িয়ে ঘুম জড়ানো চোখে ওর দিকে তাকিয়ে।

তোয়ালে হাতে করে ঝিনুককে জিজ্ঞেস করে, “এত তাড়াতাড়ি উঠলে কেন?”

ঘুম জড়ানো গলায় ঝিনুক ওকে জিজ্ঞেস করে, “না মানে, এত রাতেই যেতে হবে আপনা...?”

মুখ দিয়ে আপনি আর একটু হলেই বেড়িয়ে যাচ্ছিল, সেটা বুঝতে পেরে একটু হেসে মাথা দোলায় রিশু, “হ্যাঁ, একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে যেতে হবে।”

জামা কাপড় পড়ে তৈরি হয়ে নেয় রিশু। বড় শোয়ার ঘরে ঢুকে আলমারি খুলে কাগজপত্র নিজের ল্যাপটপের ব্যাগের মধ্যে গুছিয়ে নেয়। ঝিনুক চুপচাপ একভাবে রিশুকে শুধু দেখে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করনীয় থাকে না। ও ত এখন ঠিক ভাবে চেনেই না রিশুকে, বোঝেই না ঠিক ভাবে একটা সারজেনের কাঁধে কত বড় দ্বায়িত্ত।

হাতে মোবাইল নিয়ে ঝিনুক কে জিজ্ঞেস করে, “তোমার মোবাইল নাম্বার কি?”

ঝিনুক নিজের নম্বর জানিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কখন ফেরা হবে?”

হেসে ফেলে রিশু, জড়তা কাটেনি ঝিনুকের, এখন সেই ভাববাচ্যে কথা বলে চলেছে, “দেরি হবে, আমি টাইম পেলে ফোন করব।”

বাধ্য মেয়ের মতন মাথা দোলায় ঝিনুক। জুতো পরে হাতে হেলমেট নিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার আগে পেছন ফিরে একবার তাকায়। হটাত করে মনে হল যেন ঝিনুকের মুখ খুব শুকনো হয়ে গেছে, ওর চোখে চোখ রেখে ক্ষনিকের জন্য দাঁড়িয়ে পরে, তারপরে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বেড়িয়ে যায়। পেছনে দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পায় রিশু। গায়ে হলুদের গন্ধ তখন পর্যন্ত কাটেনি কিন্তু কর্তব্য সবার আগে। গত এক বছরে প্রচুর প্রাইভেট হসপিটাল থেকে ডাক এসেছিল ওর কাছে, দুই তিন লাখের মাইনে, মাকে জানিয়েছিল সেসব কথা। ওর মা সব শুনে একটু আহত হয়ে ওকে বলেছিলেন, টাকার জন্য তোকে ডাক্তারি পড়াইনি আমি, তোর নাম হবে যশ হবে মানুষের সেবা করবি সেইজন্য তোকে পড়িয়েছিলাম। সেদিনের পর যখনি কোন প্রাইভেট হসপিটাল থেকে কল আসত, মানা করে দিত রিশু।

ভোরের আলো ফুটতে অনেক দেরি, রয়াল এনফিল্ডে কয়েকবার কিক মেরে স্টারট করে বেড়িয়ে পরে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। পাপা অনেকবার বলেছিল একটা গাড়ি কিনে দিচ্ছি, ছোট গাড়ি। রিশু বলেছিল বাড়িতে দুটো গাড়ি আছে এখানে গাড়ি কিনে লাভ নেই তাই বাইক কেনে। যেতে যেতে ভাবে ঝিনুকের কথা, বর্তমান যুগে কেউই আপনি বলে সম্বোধন করে না, সেখানে এই চঞ্চলমতি মেয়েটা এখন আপনি করেই ওকে ডেকে চলেছে, মেয়েটার ভেতরের জড়তা বুঝতে অসুবিধে হয় না ওর। সেই সাথে এক অজানা আশঙ্কা ভর করে আসে মনের আঙ্গিনায়, এই মেয়ে ভবিষ্যতে কেমন ব্যাবহার করবে সেটা ওর অজানা। ওর বাড়ির সাথে মানিয়ে নিতে পারবে ত? দিপ আর দিয়া ওর দুটো চোখের মণি, ঝিনুক কি কখন সেইভাবে নিজের বোনের সাথে মেলামেশা করেছে? আগামী বছরে কোলকাতা ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে আছে ওর, সেখানে গিয়ে আবার বলবে না ত যে নিজের আলাদা বাড়ি চাই? একসাথে অনেক বাসন থাকলে নড়াচড়া হয় আওয়াজ হয়, রিশু তাই কখন চায়নি যে ওর পরিবারের মাঝে কেউ আসুক। মাকে কেমন ভাবে সন্মান দেবে ঝিনুক, ও যেমন ওর মাকে ভালোবাসে তেমন যদি না করতে পারে তাহলে মরেও শান্তি পাবে না রিশু।

হসপিটালে পা রাখতেই বুঝতে পারে যে অবস্থা খুব খারাপ। এমারজেন্সি ভর্তি হয়ে গেছে, দুই জন স্পটডেড অনেকের অবস্থা অনেক সঙ্গিন। কাজে নেমে পরে রিশু, ওর ওটি টেবিল থেকে কোন লোক হতাশ হয়ে ফিরে যায়নি। মাকে একটা মেসেজ করে জানিয়ে দেয় যে হসপিটালে পৌঁছে গেছে এবং সারাদিন ওটিতে ব্যাস্ত থাকবে। ব্রিজেশ আর সুন্দরের সাথে কথাবার্তা আলোচনা করে ঢুকে পরে ওটি তে, আজকে আর নাওয়া খাওয়া হবে না।

====================== পর্ব পাঁচ সমাপ্ত ======================
 
পর্ব ছয় – (#1-24)

রিশু বেড়িয়ে যাওয়ার পরে দরজা বন্ধ করতেই ভেঙ্গে পরে ঝিনুক, এযে একটা কারাগরে এসে পড়েছে। ছোট ফ্লাট বলে নয়, ওর যেন মনে হচ্ছে ওকে কোন তেপান্তরের মাঠ ছাড়িয়ে দুর কোন এক মহলের এক খাঁচায় বন্দী করে রেখে দেওয়া হয়েছে। পরনে শুধু টপ আর স্লাক্স ছিল তাই ঠান্ডা লাগছিল ওর, বড় ঘরটায় ঢুকে লেপ জড়িয়ে চুপচাপ বিছানায় বসে পরে। বারে বারে ওর মাথায় শুধু ঘোরে কেন ওর সাথেই এমন হল। রানীগঞ্জে থাকাকালীন ও হাসতে জানত খেলতে জানত, বড় হওয়ার পরে চঞ্চলমতী হয়ে ওঠে, সুন্দরী বলে যেহেতু কলেজে বেশ নামডাক ছিল তাই ওর নাকের ডগায় একটা অহম ভাব সর্বদা থাকত। উপরওয়ালা কি এর শাস্তি দিয়েছে ওকে? কি দেখেছিল পার্থের মধ্যে যে ও পার্থের প্রেমে পড়েছিল? ছেলেটা হাসিখুশি ছিল, যখন ইচ্ছে তখন ওর কলেজের সামনে চলে আসত বাইক নিয়ে, কলেজ ফাঁকি দিয়ে বেড়িয়ে পড়ত ওর সাথে ঘুরতে। কোলকাতা চষে বেড়িয়েছে ওর বাইকের পেছনে বসে, এমনকি কয়েকবার কোলকাতার বাইরে পর্যন্ত গেছে ওর সাথে তবে রাতে থাকেনি। ওদের মধ্যে কি ভালোবাসা ছিল নাকি শুধু মাত্র পার্থের উচ্ছন্ন জীবন যাপনের প্রতি একটা টান ছিল।

নতুন জীবন, নতুন ভাবে যুদ্ধ শুরু হবে এবারে। যার সাথে বিয়ে হয়েছে, রিশু, সে কেমন হবে? সে ওর অতীতের অনেক কিছুই জানে আবার অনেক কিছুই ওর অজানা। সম্পূর্ণ অর্থে পার্থের সাথে শারীরিক সম্পর্ক হয়নি যদিও, কামোত্তেজনার প্রবল আকর্ষণে বেশ কয়েকবার শুধু মাত্র ব্রা পান্টি পরিহিত অবস্থায় ওদের শরীর নিয়ে খেলা চলেছে। যদি রিশু জানতে পারে যে পার্থের সাথে শারীরিক সম্পর্ক ছিল ওর তাহলে সত্যি কি ওকে মন থেকে মেনে নেবে? রিশুর অতীতে এক প্রেমিকা ছিল, চন্দ্রিকা, তার সাথে কি রিশুর শারীরিক সম্পর্ক ছিল? হাজার প্রশ্ন মনের আঙ্গিনায় ভর করে আসে ওর। এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল সেটা খেয়াল নেই ওর। ঘুম ভাঙ্গে ফোনের আওয়াজে।

ফোন তুলে দেখে রিশুর মা, আম্বালিকা আন্টি ফোন করেছে। ঝিনুক ঘুম জড়ানো কন্ঠে উত্তর দেয়, “হ্যালো...”

আম্বালিকা জিজ্ঞেস করে, “ঘুমাচ্ছিস, রিশু বেড়িয়ে গেছে?”

ছোট উত্তর দেয় ঝিনুক, “হ্যাঁ।”

আম্বালিকা ওকে জিজ্ঞেস করে, “রাতে ঠিক ভাবে ঘুম হয়েছে?”

মাথা দোলায় ঝিনুক, “হ্যাঁ একটু হয়েছে।”

ঝিনুকের গলার আওয়াজে ব্যাথা অনুধাবন করতে অসুবিধে হয়না আম্বালিকার, “মন খারাপ?”

চোখের কোনা উপচে আসে ঝিনুকের, মাথা দোলায়, “হুম।”

আম্বালিকা স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করে, “যেটা পাসনি তার জন্য মন খারাপ? মনে কর তুই পথ চলতে গিয়ে হটাত করে গোবরে পা দিয়ে দিয়েছিস, তারপর কি আর সেই পা নিয়ে তুই সারাদিন থাকবি? মোটেও নয়, বাড়ি এসে তুই পা ধুয়ে নিবি, তাই না।”

আম্বালিকা আন্টির স্বান্তনা বাক্যে বুকে একটু বল পায় ঝিনুক, মাথা দুলিয়ে বলে, “হ্যাঁ।” পার্থ ওকে কোনদিন ভালোই বাসেনি, শুধু ওর শরীর আর টাকাই দেখে গেছে।

ডান হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে ঝিনুক বলে, “খুব একা লাগছে মামনি।” বলেই ডুকরে কেঁদে ফেলে।

নতুন বোউমার মুখে মামনি ডাক শুনে বুক ভরে আসে আম্বালিকার। চোখ বুজে থাকে কিছুক্ষন, ঝিনুকের বুকের বেদনা বুঝতে পেরে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “কেন একা লাগছে তোর? আমি আছি তোর পাশে, এই দ্যাখ কেমন আমার সাথে কথা বলছিস। মন খারাপ করলেই আমাকে ফোন করিস। দিয়া আর ঝিলিক সাথে গল্প করিস, সব ঠিক হয়ে যাবে।” একটু থেমে আম্বালিকা ওকে বলে, “তুই আমার মিষ্টি মেয়ে তাই না! বুক ভরে শ্বাস নে, আর নিজেকে বল যে এক নতুন ঝিনুক হয়ে তুই দেখাবি।”

মাথা দোলায় ঝিনুক, “হ্যাঁ।”

আম্বালিকা হেসে বলে, “জোরে বল...”

কাঁদতে গিয়েও হেসে ফেলে ঝিনুক, “হ্যাঁ মামনি আমি নতুন ঝিনুক হয়ে দেখাব।”

ঝিনুক কে উৎসাহিত করার জন্য বলে, “এই ত আমার সোনা মেয়ে। তুই জানিস যখন একটা ঝিনুকের মধ্যে এক কণা বালি ঢুকে পরে তখন সেই বালির কি হয়?”

মাথা দোলায় ঝিনুক, ঝিনুকের মধ্যে বালির কনা ঢুকে গেলে কি হয় সেটা ও জানে, কিন্তু আম্বালিকা আন্টি কোন পরিপ্রেক্ষিতে এই উক্তি করছেন সেটা অনুধাবন করতে সক্ষম হয় না।

আম্বালিকা ওকে বলে, “সেই বালির কনার ওপরে ঝিনুক নিজের লালার পরত লাগিয়ে সেটাকে মুক্তো করে তোলে। তোর এই বুকের মধ্যে যে বালি কণা ঢুকেছে সেটার চারপাশে নিজের আত্মবিশ্বাস আর মনের শক্তি দিয়ে গড়তে হবে এক মুক্তো।” মনে মনে মাথা নোয়ায় ঝিনুক, আম্বালিকা আন্টি সত্যিই মহামায়ার অবতার। আম্বালিকা ওকে বলে, “গা ঝাড়া দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পর। আমি কাজের মেয়েটাকে ফোন করে দিয়েছি, এই ন’টা নাগাদ চলে আসবে। আর হ্যাঁ, রিশুর আসতে হয়ত দেরি হবে, একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে অনেক চাপে আছে। তুই চিন্তা করিস না, তোর একা একা ভালো না লাগলে আমাকে ফোন করে নিস। আমি এখন রাখছি, রিশুর পাপা এখন অফিস বের হবে আমার স্কুলের সময় ও হয়ে এসেছে।”

বুক ভরে শ্বাস নেয় ঝিনুক, আম্বালিকা আন্টির মতন এই কয়দিনে ওকে কেউ এমন ভাবে বুঝিয়ে বলেনি। যতবার মায়ের সাথে কথা হয়েছে মা শুধু বলে গেছে রিশুর সাথে মানিয়ে নিতে, রিশুর সাথে মানিয়ে চলতে আর বলেছে অতীতের কথা ভুলে যেতে। অতীত কি আর অত সহজে ভোলা যায়? প্রতারণা ভীষণ ভাবেই বুকের মধ্যে বাজে, কিন্তু এক দুশ্চরিত্র ছেলের জন্য কি ঝিনুক ওর আগামী জীবন কেঁদে কাটাবে নাকি? কিন্তু যার সাথে কাটাবে তাকে বিন্দুমাত্র চেনে না, যদি তার সাথে মতের মিল না হয়, যদি তার পছন্দ ওর অপছন্দ হয় তখন কি করবে?

ঘড়ি দেখল রিশু, দশটা বাজে, পর পর দুটো অপারেশান করার পরে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছে। ওটি থেকে বেড়িয়ে হাতে ফোন নিয়ে দেখে মায়ের একটা মেসেজ, “বাড়িতে ঝিনুক একা আছে, সময় পেলে অন্তত একটা মেসেজ করিস।” এই ছোট একটা বাক্যের মধ্যে কত কিছু লুকিয়ে রয়েছে সেটা মা না লিখলেও ওর বুঝতে অসুবিধে হয় না। মনে মনে হেসে ফেলে রিশু, ওর হৃদয় পাথরের নয় যে একটা খোঁজ নেবে না সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর। ভোরের বেলা যখন বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিল, তখন পেছন ঘুরে ঝিনুকের দিকে তাকানোর মতন মানসিকতা ছিল না ওর। এতক্ষনে কি করছে মেয়েটা? সাধারনত এই ধরনের মেয়েদের স্বভাব ওর অজানা নয়, এরা দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে, সব কিছুই দেরি করেই করে। দশটা বাজে এতক্ষনে নিশ্চয় উঠে পড়েছে, মা হয়ত এতক্ষনে ফোন করে উঠিয়ে দিয়েছে, এতক্ষনে নিশ্চয় রোজি চলে এসেছে কাজের জন্য। ফ্রিজে চারটে ডিম ছাড়া আর কোন কাঁচা সব্জি নেই। যখন কোলকাতা গিয়েছিল তখন কি আর জানত রিশু যে যখন ফিরে আসবে তখন ওর সাথে আরো একজন আসবে? একবার ভাবে ঝিনুক কে একটা ফোন করে দেখে মেয়েটা কি করছে।

ফোন হাতে নিয়েও শেষ পর্যন্ত মাকে ফোন করে, “কি করছ? পাপা অফিস বেড়িয়ে গেছে?”

আম্বালিকা ছেলের ফোন উঠিয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ এই’ত একটু আগেই বেড়িয়ে গেছে। তোর কি অবস্থা?”

বড় একটা নিঃশ্বাস নেয় রিশু, “এই মাত্র দুটো অপারেশান শেষ করলাম। আর বল না, বেশ বড়সড় এক্সিডেন্ট কেস, একটা ট্রাকের সাথে একটা বাসের, বেশির ভাগ লোকজন ঘুমাচ্ছিল, ক্রিটিকাল কেস বেশি।”

রিশুর মুখে প্রায় রোজদিন এক্সিডেন্টের কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে আম্বালিকা, “তা আজকে কিসের কেস ছিল? সবকটা কি ফেমুর টিবিয়ার কম্পাউন্ড ফ্রাকচার ছিল? স্ক্রু দিলি না প্লেট?”

মাথা দোলায় রিশু, ওর মায়ের সব মুখস্থ হয়ে গেছে, “হ্যাঁ ওই আর কি, একজনের পাঁচটা স্ক্রু লাগিয়েছি অন্যটায় প্লেট বসাতে হয়েছে।”

আম্বালিকা কিছুক্ষন চুপ করে ওকে বলে, “একবার ঝিনুক কে একটা ফোন করিস, একা রয়েছে মেয়েটা।”

বাঁকা হাসি দেয় রিশু, “আচ্ছা দেখা যাবে, সময় পেলে করব।”

বড় ছেলের গলা শুনে একটু আহত হয় আম্বালিকা, “এমন করে কেন বলছিস?”

রিশু কিছুক্ষন চুপ করে থাকে, গত রাতে যেভাবে ওর মুখের সামনে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল সেই উদ্ধত আচরনে বেশ আহত হয়ে ছিল রিশু, কিন্তু মাকে সেই আচরনের কথা বলতে গিয়েও কোথায় যেন বাধাপ্রাপ্ত হয়। মাথা নাড়িয়ে নরম গলায় বলে, “না কিছু না।”

ছেলের অনুল্লেখিত শব্দ গুলো ভীষণ ভাবেই কানে বাজে আম্বালিকার, নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আমার ওপরে রেগে আছিস?”

মায়ের ওপরে কোনদিন রাগ করতে পারে নাকি? হ্যাঁ, ছোট বেলায় যখন মা ওকে জোর করে খাওয়াতে বসাত, ভাতের গ্রাস মুখের মধ্যে ঠেসে দিয়ে দাঁত চিবিয়ে বলত, ‘খেতে হবে না শুধু ওই খেলা নিয়েই পরে থাক’ অথবা কান ধরে পড়াতে বসাত ‘কাণ্ডজ্ঞান নেই, সন্ধ্যে হয়ে গেছে এখন টিভি দেখছিস’ তখন মায়ের ওপরে খুব রাগ হত। রাঁচিতে থাকতে কম মার বকুনি খায়নি মায়ের কাছে, রাগ তখন হত।

ম্লান হেসে উত্তর দেয় রিশু, “না গো, আমি তোমার ওপরে কেন রাগতে যাবো।”

ছেলেকে বুঝিয়ে বলে আম্বালিকা, “ওর মনের অবস্থা একবার বুঝতে চেষ্টা কর।”

রিশু উত্তরে বলে, “সব বুঝতে চেষ্টা করব, কিন্তু তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।”

আম্বালিকা জিজ্ঞেস করে, “কি প্রশ্ন?”

রিশু মাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে যে এই মেয়ে এরপর তোমাকে দেখবে? আমার ভাই বোন কে ভালবাসবে? ও ত নিজের...” বলতে গিয়ে থেমে যায় রিশু, বাবা মাকে সেই ভাবে সন্মান দেয় না।

বুক ভরে শ্বাস নেয় আম্বালিকা, বড় ছেলের এই দুশ্চিন্তা একদম আমুলক নয়, তাও ছেলেকে বুঝিয়ে বলে, “একটু সময় দে ওকে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি’ত তোদের সাথে।”

মায়ের এই একটা বাক্যে অনেক শক্তি রয়েছে, যতই জটিল সমস্যার হোক না কেন যখন ওর মা ওকে বলে, “আমি আছি’ত সাথে” তখন ধমনীতে এক নতুন বল খুঁজে পায়।

স্মিত হাসে আম্বালিকা ছেলের মনের অবস্থা অনুধাবন করতে পেরে বলে, “এত কি ভাবছিস? তুই এক পা এগো তাহলে দেখবি ও এক পা এগোবে।” মাথা দোলায় রিশু, তাই করবে, কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে পায়না। “পারলে একটা ফোন করে জিজ্ঞেস কর কিছু খেয়েছে কি না, কি করছে, এইসব।”

হেসে ফেলে রিশু, “এইসব খবর তোমার কাছে অবশ্যই আছে, তুমিই আমাকে বলে দাও।”

আম্বালিকা স্নেহের বকুনি দিয়ে বলে, “আমি বলেছি ফোন করতে, ফোন কর।”

মায়ের ফোন রাখার আগে, মাকে উত্তর দেয়, “আচ্ছা বাবা ফোন করে নেব। এখন রাখছি তাহলে।”

ডাক্তারদের বিশ্রামের জায়গায় ঢুকতেই অনেক সহকর্মী ডাক্তার বন্ধুরা ওকে ছেঁকে ধরে, প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার হয়ে যায় রিশু। “হটাত করে কাউকে না জানিয়েই বিয়ে?” “পুরানো প্রেম নাকি?” “গার্লফ্রেন্ড প্রেগ্ন্যান্ট হয়ে যায়নি ত?” “বিয়ের একদিন পরেই কেন ফিরেছে, রিসেপসান কবে হচ্ছে, পারটি কবে দেবে।” ইত্যাদি। এক এক করে সবার উত্তর দেয় রিশু, মায়ের ছোট বেলার বান্ধবীর বড় মেয়ের সাথে বিয়ে, হটাত করেই ঠিক হয়েছে তাই তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করতে হয়েছে। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর অতীত বাইরের লোকের সামনে উজাগর করতে চায় না। রিশু সবাইকে শান্ত করে বলে, সময় পেলে একদিন সবাইকে একটা বড় রেস্টুরেন্টে খাওয়াবে। ওর বোন গতকাল ওর ফোনে ওদের বিয়ের ছবি গুলো পাঠিয়েছিল, সেই গুলো দেখাল বন্ধুদের। সবার মুখে এক কথা, বাঁদরের গলায় মুক্তের মালা। বিশেষ করে ব্রিজেশ, তোর মতন মুখ চোরা পাব্লিক কে এই মেয়ে কি করে পছন্দ করল। মনে মনে হাসে রিশু, এখন পর্যন্ত কেউই কাউকে সঠিক ভাবে চেনে না, চিনলে হয়ত কেউই কাউকে পছন্দ করত না।

চলবে......
 
পর্ব ছয় – (#2-25)

ফোনে ঝিনুকের নাম্বার, সঙ্ঘমিত্রা নামে লিখে রেখেছিল। বেশ কিছুক্ষন ওদের বিয়ের সময়ের ঝিনুকের একটা হাসি হাসি ছবির দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা মেসেজ করে ঝিনুককে, “হাই, আমার দেরি হবে তুমি খেয়ে নিও।”

সঙ্গে সঙ্গেই ওর মেসেজের উত্তর আসে, খুব ছোট্ট, “ওকে”

এক কাপ কফি নিয়ে মোবাইলে ঝিনুকের বিয়ের আগের একটা ছবির দেখে। ছবিটা ওর বোন ওকে পাঠিয়েছিল ওদের বিয়ের একদিন আগে। এতদিন ঠিক ভাবে সেই ছবি দেখার সময় পায়নি। একটা হাল্কা নীল রঙের জিন্সের ক্যাপ্রি ওপরে হলদে একটা ফুল শারট হাতা গুটিয়ে পরে, চোখে বড় একটা সানগ্লাস, মাথায় একটা বড় টুপি। কমলা লেবুর কোয়ার মতন নরম ফোলা ঠোঁটে লেগে রয়েছে মোহিনী এক হাসি, হাওয়ায় কিছু চুল ওর পানপাতার আকারের মুখ মন্ডলের ওপরে চলে এসে এক অভাবনীয় সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। ছবিটা কোন পাহাড়ি নদীর তীরে তোলা। মনে মনে হেসে ফেলে রিশু, এই মেয়েই গতরাতে ওর মুখের সামনে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, কথা বলার ইচ্ছে ছিল বটে কিন্তু কি বলবে ভেবে পায়নি তাই একটা ছোট মেসেজ করেছে।

দড়াম করেই পিঠের ওপরে চাপড় খায় রিশু, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ওর সহপাঠি ডাক্তার বন্ধু সুদিপ্ত, “বাল আর কত দেখবি, নেশা এখন কাটেনি মনে হচ্ছে?” বলেই গান ধরে, “রাত কা ন্যাশা অভি আঁখ সে গ্যায়া নেহি, তেরা নশিলা বদন বাহো নে ছোড়া নেহি... ”

একটু লজ্জিত হয়ে হেসে ফেলে রিশু, “চল চল, আমার পেশেন্ট কোন ওটিতে?”

সুদিপ্ত উত্তর দেয়, “চারে আছে, হরিশ করে নেবে তুই বাড়ি যা।”

মাথা নাড়ায় রিশু, “না না, আমি এটা করে তবেই যাবো।”

দুইজনে ওটির দিকে চলে যায়, হিপ্পোক্রাটিক শপথটা যতটা পারা যায় ততটা মেনে চলার চেষ্টা করে রিশু। মায়ের কথা বারে বারে স্মরনে আসে, টাকার জন্য তোকে ডাক্তারি পড়াইনি।

কোলকাতায় থাকতে খুব ইচ্ছে করত একা একা ঘরে থাকার, নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করলেই সম্পূর্ণ একা হয়ে যেত ঝিনুক আর সেই একাকীত্ব ভীষণ ভাবে উপোভগ করত। বন্ধুদের সাথে মোবাইলে গল্প জুড়ে দেওয়া, ফেসবুকে ইন্সটাগ্রামে প্রত্যেক দিন নিজের নিত্য নতুন ভঙ্গিমায় ছবি দেওয়া, পার্থের সাথে দুষ্টু গল্প করা ইত্যাদি। মাঝে মাঝেই মায়ের বকুনি শুনতে হত, কি করিস দরজা বন্ধ করে? দিনের বেলায় একদম দরজা বন্ধ করে থাকবি না। সেই থেকে ওর খুব শখ ছিল একা থাকার যেখানে ওর মা ওকে বারন করবে না। সেই স্বপ্ন যে এইভাবে পূরণ হবে সেটা ভাবতে পারেনি ঝিনুক। একটা ফ্লাটে সম্পূর্ণ একা, কারুর সাথে কথা বলার নেই, মোবাইল খুলে কারুর সাথে গল্প করার নেই, ইন্সটাগ্রাম আর ফেসবুক থেকে প্রচুর ছবি সরিয়ে দিয়েছে, নতুন কোন ছবি আর লাগায় নি। কোলকাতায় ওর কাছে সময় থাকত না কিন্তু এখন ওর হাতে অঢেল সময় কিন্তু কি করবে ঝিনুক? এইভাবে বন্দিনী জীবন কাটাতে হবে ওকে, ভাবতেই কেমন যেন মনে হয়। মায়ের সাথে ফোনে কথা বলার পরে একটু ভালো লাগে ওর।

স্নান সেরে বেড়িয়ে হেয়ার ড্রাইয়ারে চুল শুকোতে শুকোতে সেই একাকীত্ব অনেকটাই কেটে যায় ওর। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে সিঁথির দিকে তাকাতেই কেমন যেন মনে হয় ওর, গতদিনের সেই লাল সিঁদুরের দাগটা আর নেই, শ্যাম্পু করার সময়ে সেই দাগ ওর কপাল থেকে মুছে গেছে। মা বারবার করে বলে দিয়েছিল যে স্নানের পরে সিঁথিতে যেন সিঁদুর পরে, সিঁদুরের কৌট খুলে বেশ কিছুক্ষন হাতে নিয়ে দেখে তারপর ডান হাতের কড়ে আঙ্গুলের ডগায় এক ফোঁটা সিঁদুর লাগিয়ে সিঁথিতে টেনে দিয়ে সেটা আবার চুল দিয়ে ঢেকে দেয়। যার নাম করে সিঁদুর পড়া সে কোথায়? বাঁকা এক হাসি মাখিয়ে নেয় ঠোঁটে। গালের দিকে তাকিয়ে দেখে নিজেই একটু লজ্জায় পরে যায়, নখের দাগ গুলো এখন পর্যন্ত মিলিয়ে যায়নি, বোকা মেয়ের মতন নিজেকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ হল। জামা কাপড় পরে আবার সোফায় বসে অপেক্ষা করে ঝিনুক, যদিও ওকে বলেছে খেয়ে নিতে কিন্তু একা খেতে একদম ইচ্ছে করেনা ওর আর দশ মিনিট অপেক্ষা করে দেখা যাক।

ভাত ডাল আর কিসের একটা বাদামি রঙের বিন্সের মতন দেখতে তার তরকারি, রাজমা, এর আগে কোনদিন খায়নি ঝিনুক। কিন্তু কোন সব্জি না থাকায় কাজের মেয়েটা এটাই রান্না করে গেছে। বাড়িতে মাইক্রো ওয়েভ ওভেন নেই যে খাবার গুলো একটু গরম করে নেবে, শেষ পর্যন্ত গ্যাসেই খাবার গরম করতে হয়। ওয়শিং মেশিন নেই, মাইক্রো ওয়েভ নেই, ফ্রিজটা ছোট, ড্রেসিং টেবিল নেই, তবে একা একটা ছেলের ঘরে এইসব থাকতে যাবে কেন? কখন আসবে ঠিক নেই, ডাক্তার মানুষ আম্বালিকা আন্টি ওকে বলেছিলেন যে রিশুর সময়ের কোন ঠিক নেই, অগত্যা একা একাই খেতে বসে যায়। বাড়িতে মাঝে মাঝে যখন একা থাকত তখন একটা ডিমের অমলেট আর ম্যাগি বানিয়ে নিজে নিজে খেয়ে বেশ আনন্দে থাকত, আজ একা একা খেতে বসে মনে পরে যায় বোনের কথা, মায়ের কথা, মাছের পেটি নিয়ে বোনের সাথে ঝগড়া হওয়ার কথা, একটু আলু ভাজা বেশি খাওয়ার জন্য মায়ের কাছে বায়না ধরা।

ওটি থেকে বেড়িয়ে ঘড়ি দেখে রিশু, তিনটে বেজে গেছে। খিধেতে পেটের মধ্যে নাড়ি ভুড়ি তাল গোল পাকিয়ে উঠেছে, অন্যদিন হলে হসপিটালের ক্যান্টিনেই খাওয়া দাওয়া সেরে নিত, কিন্তু বাড়িতে কাজের মেয়ে রান্না করে গেছে হয়ত আর সেই সাথে বাড়িতে একজন হয়ত ওর অপেক্ষায় বসে রয়েছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নিজের জিনিস পত্র গুছিয়ে নিয়ে ক্যান্টিনের দিকে যেতে গিয়েও পারকিঙ্গের দিকে হাঁটা দিল রিশু। মা বলেছিল একটা ফোন করতে সেটা করা হয়ে ওঠেনি। বাইকে কিক মারার আগে একবার ফোন করার কথা ভাবে, কথা একদম হয়নি ঝিনুকের সাথে, কি করছে একবার জানা দরকার, শেষ পর্যন্ত ফোন করে ঝিনুক কে।

একা একা খাওয়ার পরে প্রচন্ড ভাবেই শুন্য হয়ে যায় ওর হৃদয়, কিছুই করার নেই, কারুর সাথে কথা বলার নেই, হাতে কোন কাজ নেই, উড়ে বেড়ান নেই এমনকি প্রান ভরে হাসবে সেই উপায় ও নেই। চুপচাপ বিছানায় বসে থেকে থেকে এক সময়ে ঘুমিয়ে পরে ঝিনুক। ফোন এক নাগারে বেজে চলেছে দেখেই ধরমরিয়ে উঠে পরে। ফোনে রিশুর নম্বর ডক্টর অম্বরীশ সান্যাল নামে লিখে রেখেছিল, সেই নামটা চোখে পড়তেই ঘুমের আবেশ কেটে যায় ওর।

ঘুম জড়ানো কন্ঠে উত্তর দেয় ঝিনুক, “হ্যালো...”

গম্ভির গলায় জিজ্ঞেস করে রিশু, “কি হল, ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?”

ছোট্ট ঝিনুক উত্তর দেয়, “ওই একটু চোখ লেগে গেছিল।”

রিশু জিজ্ঞেস করে, “খেয়েছ?”

মাথা দোলায় ঝিনুক, “হ্যাঁ।”

বাইক স্টারট করে রিশু বলে, “আমি বেড়িয়ে গেছি এই আসছি।”

যাক শেষ পর্যন্ত বাড়িতে আসছে। অপেক্ষা করতে করতে ঝিনুক একবার ভেবেছিল হয়ত ওকে এখানে একা রেখেই চলে গেছে রিশু। তোয়ালে দিয়ে চোখ মুখ মুছে ঠিক করে নেয়, চুল একটু আঁচড়ে নেয়, চোখের কোলে কি এখন কালি নাকি? গত রাতে সেই ভাবে ঘুম হয়নি ওর। বাড়িতে কোনদিন মাক্সির মতন জামা কাপড় পড়ত না ঝিনুক, সর্বদা আধুনিক পোশাক আশাক পরে থাকত, টপ, গেঞ্জি, ক্যাপ্রি হাফ প্যান্ট ইত্যাদি। স্নান সেরে তেমন একটা পোশাক পড়েছিল, একটা ঢিলে প্লাজো আর একটা গোল গলার ঢিলে টপ, ঠান্ডার জন্য টপের ওপরে একটা কারডিগান চাপিয়ে নিয়েছিল। তাড়াহুড়োতে নিজের জিনিস পত্র ঠিক ভাবে গুছানো হয়নি, যা হাতের সামনে পেড়েছিল তাই ছোট সুটকেসে গুছিয়ে নিয়ে চলে এসেছে, সেই জন্য চপ্পল আনা হয়নি, তাই রিশুর চপ্পল পড়ে নেয় পায়ে। যা বাবা কত বড় পা, ধ্যাত কেমন ঢলঢল করছে। বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পরে বাড়ির সামনে বাইকের আওয়াজ পেতেই কান খাড়া হয়ে যায় ঝিনুকের, ত্রস্ত পায়ে বারান্দায় গিয়ে একবার তাকিয়ে দেখে, ওর ডাক্তার এলো কি না।

বাড়ির সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে চোখ চলে যায় নিজের ফ্লাটের বারান্দায়, সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী ওর জন্য দাঁড়িয়ে সেখানে। হেলমেট নিয়ে বাড়িতে ঢোকার মুখে নিচের এক তলার বুড়ো প্রমথেশ বাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।

এক গাল দেঁতো হাসি হেসে রিশু কে প্রশ্ন করেন প্রমথেশ বাবু, “রাতে আসা হল নাকি?”

মাথা দোলায় রিশু, এই ভদ্রলোককে একদম সহ্য হয় না ওর, সব কিছুতেই কেমন যেন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসে। এক বার মায়ের সাথে প্রায় ঝগড়া লেগে গিয়েছিল, আপনার অত কিসের দরকার আমার বাড়িতে কে এসেছে না এসেছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর। এর জন্যেই শেষের দিকে রিশু নিজেই চন্দ্রিকাকে ওর ফ্লাটে নিয়ে আসা কমিয়ে দিয়েছিল।

ভুরু নাচিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করে প্রমথেশ বাবু, “কে এসেছে?”

রিশু হেসে ফেলে, “আমার মিসেস।”

চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করে প্রমথেশ বাবু, “যাঃ বাবা জানতেও পারলুম নে, একেবারে চট মাঙ্গনি পট বিয়া করে ফেলেছ দেখছি?”

বাঁকা হাসি হাসে রিশু, “না তা ঠিক নয়, আগে থেকেই দেখা সাক্ষাৎ ছিল তাই হয়ে গেল তাড়াতাড়ি।”

কথাটা ঠিক পছন্দ হল না প্রমথেশ বাবুর, “এই’ত গেলে চারদিন আগে, এরমধ্যেই বিয়ে বোউভাত সব মিটে গেল?”

প্রশ্নের জেরবারে বেশিক্ষন দাঁড়ানোর ইচ্ছে ছিল না রিশুর, কিন্তু যেভাবে ছেঁকে ধরেছে অগত্যা একটা উত্তর দিতেই হয়, মা থাকলে এতক্ষনে ঝ্যাঁটা পেটা করে বিদায় দিয়ে দিত। “হ্যাঁ অসুবিধে কোথায়, বিয়ের দিন গেলাম তার একদিন পরে বউভাত হল, এদিকে হসপিটাল আছে তাই তার পরের দিন চলে এলাম।”

বুড়ো প্রমথেশ মেনে নিতে পারল না রিশুর যুক্তি তাই মাথা ঝাঁকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ওকে, কিন্তু রিশু ততক্ষনে সেই প্রশ্নের জাল থেকে নিজেকে টেনে বার করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যায়। ফ্লাটের দরজা খুলে ওর জন্যে দাঁড়িয়ে ছিল ঝিনুক, ওকে দেখে ভদ্রতার এক হাসি দেয়, প্রত্যুত্তরে ঝিনুক একটু হেসে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় ব্যাগ আর এপ্রন নেওয়ার জন্য।

রিশু মাথা নাড়িয়ে ওকে বলে, “হসপিটাল থেকে এসেছি, এগুলো হাতে নিও না।” বাধ্য মেয়ের মতন মাথা দোলায় ঝিনুক। রিশু ওকে জিজ্ঞেস করে, “সব ঠিক আছে ত?”

বাধ্য মেয়ের মতন মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ।”

সেই ভোর চারটে থেকে এক প্রকার ঘরের মধ্যে বন্দি, এক সময়ে এই একাকীত্ব ভীষণ ভাবেই আকাঙ্ক্ষিত ছিল ওর, সেই একাকীত্ব যে এইভাবে প্রকট হয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়াবে সেটা আশাতীত।

সদর দরজা বন্ধ করে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে রিশুকে, “কিছু খাওয়া হয়েছে?”

ততক্ষনে নিজের শোয়ার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে রিশু, সারাদিন তিনটে অপারেশান করে ভীষণ ক্লান্ত। শরীর ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম, ঘাড়ে ব্যাথা, আর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না একদম। ঝিনুকের প্রশ্ন কানে ভেসে আসতেই ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে উত্তর দেয়, “না খাওয়া হয়নি, এই স্নান সেরে আমি খেয়ে নেব।” একটু থেমে ওকে বলে, “তোমার কাজ থাকলে তুমি করতে পার আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।”

কথাটা শুনে কান্না পেয়ে যায় ঝিনুকের, এতটাই কি অস্পৃশ্য যে ওর সামনে দাঁড়াতে নেই? কলেজে ওর দেখা পাওয়ার জন্য ছেলেরা যেখানে মুখিয়ে থাকত সেখানে এই ডাক্তার ওকে চোখের সামনে থেকে সরে যেতে বলছে? কেন তাহলে এই দূরদেশে বিয়ে করে এনেছে? জলভরা চোখে রিশুর দিকে চোখ তুলে তাকায় ঝিনুক, কিন্তু যেহেতু রিশু ওর দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়েছিল তাই ঝিনুকের সেই আশ্রুভরা বেদনা কাতর দৃশ্য চোখে পড়েনা। ঝিনুক কিছুক্ষন ওর শোয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকার পরে চুপচাপ নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে। আম্বালিকা আন্টি ওকে বলেছিল পেয়িং গেস্টের মতন থাকতে, কিন্তু এইভাবে কি কেউ এড়িয়ে চলে নাকি?
 
পর্ব ছয় – (#3-26)

অভ্যেস বশত জামা কাপড় খুলে খালি গায়ে কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে পরে রিশু। গ্রীষ্ম বর্ষা শীত, হসপিটাল থেকে ফেরার পরে সে রাত হোক কি দিন, স্নান করে তবেই বাকি কাজ করে। সারাদিন রোগীদের নিয়ে কাটায়, কত অপারেশান থাকে তাই বাড়ি ফিরে স্নান না সারলে ভীষণ অস্বস্তি বোধ হয় ওর। স্নান করতে করতে ভাবে, মা ওকে বলেছিল এক পা যদি ও এগোয় তাহলে ঝিনুক ও এক পা ওর দিকে বাড়িয়ে দেবে। ঝিনুকের কি পছন্দ কি অপছন্দ কিছুই জানা নেই, সেই এক পা কি ভাবে বাড়াবে সেটা ভেবে পায় না। ভাবতে ভাবতে মনে মনে হেসে ফেলে রিশু, ভীষণ দুষ্টু মেয়েটা, গত রাতে অজান্তেই ঝিনুকের বড় সুটকেসের দিকে ওর নজর চলে গিয়েছিল, বেশ কিছু ফিনফিনে লঞ্জারি দেখে হাসি পেয়ে গেছিল ওর, মেয়েটা বেশ কামুকী আর বিলাসী স্বভাবের। প্যান্টি গুলো অনেক ছোট ছোট আর স্বচ্ছ পড়া না পড়া এক ব্যাপার। জামা কাপড়ের মধ্যে এক বাক্স উঁকি মারছিল কিছু একটা রাখা ছিল যেটা ঠিক ভাবে চোখে পরেনি তবে এইটুকু বুঝে গিয়েছিল যে যন্ত্রটা সাধারন ব্যাবহারের জন্য নয়। কলেজের শুরুর দিকে ল্যাপটপে বসে যে নগ্ন মেয়েদের ছবি দেখেনি সেটা নয়, উঠতি বয়সের সাথে সাথে যেটা সব ছেলেদের মধ্যে আসে সেটা রিশুর মধ্যেও ছিল। ওই রকম লাস্যময়ী কামুকী পোশাকে মেয়েদের ছবি বহুবার দেখেছে তবে চাক্ষুস কাউকে এইভাবে দেখার সুযোগ হয়নি। হ্যাঁ একবার চন্দ্রিকা ওর বাড়িতে এসেছিল, তখন স্নান সেরে শুধু মাত্র একটা তোয়ালে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পোশাক বদলের সময়ে চন্দ্রিকাকে নগ্ন অবস্থায় দেখেছিল। যেহেতু সে ডাক্তার তাই প্রচুর নারী দেহ দেখেছে কিন্তু সেইভাবে কোন নারীর দিকে চোখ তুলে তাকায়নি কোনদিন। বসার ঘরের সোফায় বসে আড় চোখে চন্দ্রিকার তীব্র যৌন আবেদনে মাখামাখি দেহবল্লরীর সুধা আকন্ঠ পান করে মত্ত হয়ে গিয়েছিল সেদিন। মানস চক্ষে সদ্য বিবাহিতা তন্বী তরুণী ঝিনুকের সেই লাস্যময়ী ফিনফিনে লঞ্জারিতে আঁকতে চেষ্টা করে রিশু।

স্নান সেরে কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে অন্য একটা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেড়িয়ে আসে বাথরুম থেকে। বসার ঘর ফাঁকা দেখে একটু আশ্চর্য হয়ে যায়, আবার কি ঘুমিয়ে পরল নাকি ঝিনুক? শোয়ার ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে দেখে যে একটা শাল গায় দিয়ে মেয়েটা বিছানায় চুপচাপ কুঁকড়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। হটাত কি হল আবার? গলা খ্যাঁকরে নিজের অস্ত্বিতের জানান দিতেই অশ্রু প্লাবিত নয়ন মেলে দরজার দিকে তাকায় ঝিনুক।

নরম গলায় রিশু ঝিনুককে জিজ্ঞেস করে, “এই কি হয়েছে?”

মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে ঝিনুক, মরন দশা আমার কেন মরতে বিয়ে করেছিল যখন আমার চোখের জলের ভাষা বুঝতে পারো না? সারাদিন একলা ছিলাম এক বারের জন্য খোঁজ নিয়েছ, বাড়িতে একটা কুকুর থাকলেও মানুষ যখন বাড়ি ফেরে তখন অন্তত সেই কুকুরটার সাথে একটু খেলা করে, তুমি ত আমাকে অস্পৃশ্যের মতন পাশ কাটিয়ে চলে গেলে।

বুকের ভেতরে এত কিছু এক নিঃশ্বাসে আওড়ে গেল ঝিনুক, মুখ থেকে শুধু একটা কথা বের হল, “না এমনি ভালো লাগছে না তাই।”

দরজার ভেতরে এক পা বাড়িয়ে বিছানার কাছে এসে বলে, “এই ভাবে একা একা এখানে বসে থাকলে কি ভালো লাগবে? ওই ঘরে বসে টিভি দেখতে পারো ত।”

সারাদিন টিভি গিলে কি হবে? বাধ্য মেয়ের মতন চোখ মুছে বিছানায় উঠে বসে বলে, “আচ্ছা।”

মাথা মুছতে মুছতে রিশু ওকে বলে, “ওয়াইফাই আছে, বাড়িতে ভিডিও কল কর তাহলে খারাপ লাগবে না।”

বিছানায় ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ঝিনুক, এইভাবে ওর সামনে খালি গায়ে শুধু একটা তোয়ালে জড়িয়ে দাঁড়াতে লজ্জা করছে না রিশুর? ভেতর ভেতর খুব হাসি পাচ্ছিল সেই সাথে লজ্জাও, বলিষ্ঠ চেহারার মানুষটার দিকে তাকাতে লজ্জা পায় তাই ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে নিচু কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “খাবার গরম করে দেব?”

আলমারি খুলে একটা নিজের জামা কাপড় বের করে উত্তর দেয়, “না থাক আমি করে নেব।” জামা পড়তে পড়তে ওকে বলে, “বিকেলে বাজারে যাবো, কিছু আনার থাকলে বল।”

মাথা দোলায় ঝিনুক, অনেক কিছু কেনার আছে ওর, জিজ্ঞেস করে রিশুকে, “এখানে এটিএম কোথায় আছে?”

বারমুডা পড়তে পড়তে ওকে বলে, “এই পাশেই একটা মারকেট আছে সেখানে আছে।”

জামা কাপড় পরে রান্নাঘরে ঢুকে পরে রিশু। ভাত ডাল রাজমা রান্না করে রেখে গিয়েছিল কাজের মেয়ে। গ্যাস জ্বালিয়ে খাবার গরম করার সময়ে ভাবে, বিকেলে বাজারে গিয়ে কিছু কাঁচা সব্জি নিয়ে আসা দরকার না হলে আগামিকাল কি খাবে। বাড়িতে ও ছাড়াও আরো একজন আছে, সেকি আর এই রাজমা খেতে পারবে? ফ্রিজে ফল নেই, দুধ নেই, ঝিনুক নিশ্চয় ওর মতন গ্রিন টি খায় না ওর জন্য অন্তত চাপাতা আনতে হবে। ওর বাড়ির কেউই দুধ দেওয়া চা খায় না শুধু মাত্র বোন ছাড়া তাই বোনের জন্যেই ওর বাড়িতে চা এনে রাখা হয়। খাবার নিয়ে বসার ঘরে এসে দেখে ঝিনুক চুপচাপ সোফায় বসে টিভি চালিয়ে কিছু একটা সিনেমা দেখছে, দেখছে বললে ভুল হবে চলন্ত টিভির দিকে তাকিয়ে রয়েছে একভাবে। ঝিনুকের শুন্য চোখের ভাষা দেখে রিশুর খুব খারাপ লাগে, মানুষ হয়ত যা চায় সর্বদা তাই পায়না আর মানুষ যা পায় বাকিটা জানে না ঠিক রিশু।

চুপচাপ খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে ঢূকে পরে রিশু। খাটের ওপরে আধা শোয়া হয়ে একটা বই খুলে পড়তে শুরু করে দেয়, ফাইব্রাস ডাইস্প্লাসিয়া নিয়ে একটা নতুন পেপার লিখবে তাই নিয়ে পড়াশুনা করতে হবে।

হাঁটু মুড়ে সোফার ওপরে বসে টিভির দিকে তাকিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল ঝিনুক। মাঝে মাঝে ওর ভীষণ ভয় লাগে, পার্থ নিশ্চয় ওর বিয়ের সময়ে কাউকে পাঠিয়েছিল খোঁজ নেওয়ার জন্য। যদিও ফোন ভেঙ্গে দিয়েছে কিন্তু ছেলেটার ওপরে একদম বিশ্বাস নেই, হয়ত এতক্ষনে অন্যদের কাছেও ওর অর্ধনগ্ন ছবি পৌঁছে গেছে, হয়ত ইন্টারনেটে ছড়িয়ে গেছে এতদিনে ওর বাথরুমে তোলা অর্ধনগ্ন ছবি। ভীষণ কান্না পায় ঝিনুকের, ওর জীবনের স্বপ্ন গুলো এইভাবে চৌচির হয়ে ভেঙ্গে যাবে কোনদিন ভাবেনি।

যখন পার্থের সাথে প্রেম হয়নি তখন থেকেই ওর স্বপ্ন ছিল যার সাথে জীবন কাটাবে সে যেন ওকে খুব ভালোবাসে, একটু দাম্ভিক প্রকৃতির ছিল বলে সবসময়ে নিজের রূপচর্চা নিয়েই পরে থাকত। চেয়েছিল যখন ওর ভালোবাসার মানুষ কাজ সেরে ঘরে ফিরবে তখন ও সেজেগুজে তৈরি থাকবে তাকে আহ্বান করার জন্য। দুই হাত মেলে উজাড় করে দেবে নিজেকে সেই দয়িতের বাহুডোরে। যে মানুষটা ওই ঘরের মধ্যে শুয়ে আছে এতক্ষনে তার চরিত্র সম্বন্ধে এক ধারনা পরিষ্কার হয়ে যায় ঝিনুকের কাছে। মানুষটা খুব কম কথা বলে, মেধাবী রুচিবোধ সম্পন্ন নম্র ব্যাক্তি, নিজের কাজ নিজেই করতে ভালোবাসে, বাড়ির প্রতি টান একটু বেশি সেটা ওর মা অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছে। মনে হয় না আধুনিক পোশাক আসাকে বিশেষ রুচি আছে ওর।

একটু পরে কাজের মেয়ে এসে যাওয়াতে ঘরের মধ্যে এতক্ষন যে একটা বদ্ধ ভাব ছিল সেটা একটু কেটে যায়। রাতের খাওয়ার ব্যাপারে ঝিনুকে জিজ্ঞেস করাতে ঝিনুক জানিয়ে দেয় যে যা খুশি খেতে প্রস্তুত, ওর স্বাধীনতা অনেক আগেই খর্ব হয়ে গেছে সেখানে রান্নার ব্যাপারে নিজের মতামত জানিয়ে কি হবে। “রাতে রাজমা চলবে?” শুনে মুখ শুকনো হয়ে যায় ঝিনুকের, দুপুরে রাজমা খেতে যে ঝিনুকের একদম পছন্দ হয়নি সেটা বুঝতে পারে রিশু। রিশু কাজের মেয়েকে রাতের রান্না করতে বারন করে দেয়, বলে যে রাতে ওরা বাইরের কিছু একটা খেয়ে নেবে।

কাজের মেয়ে চলে যাওয়ার পরে, রিশু ঝিনুক কে বলে, “মারকেট যাবো, তুমি কি যাবে?”

এই বদ্ধ ঘরের মধ্যে দম আটকে আসছিল ওর, একটু বাইরের বাতাসে শ্বাস নিতে পারলে যেন বেঁচে যায়, খুব ইচ্ছে করে একবার বাইরে বের হই তারপর হাত ছেড়ে পালিয়ে যাবো। মাথা দোলায় ঝিনুক, “হ্যাঁ একটু বের হলে ভালো হত।”

চুপচাপ নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে আলমারি খুলে বাড়ি থেকে আনা পোশাকের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে। ভীষণ মুশকিলে পরে গেল ঝিনুক, সালোয়ার কামিজ খুব কম পরে ঝিনুক তাই এখানে যা পোশাক আনা হয়েছে তাতে বিশেষ কোন ভালো সালোয়ার কামিজ নেই। আলমারি ভর্তি শুধু মাত্র জিন্স, শারট, টপ, হাফ প্যান্ট, প্লাজো ইত্যাদি। এইসব পোশাক পরে যদি রিশুর সাথে বের হয় তাহলে ভীষণ বেমানান লাগবে।

জামা কাপড় পড়ে তৈরি হয়ে ঝিনুকের ঘরের মধ্যে উঁকি মারতেই দেখে যে ঝিনুক আলমারি খুলে ঠায় দাঁড়িয়ে আবার হারিয়ে গেছে। এবারে রিশু আর হাসি থামাতে পারে না, “তুমি মাঝে মাঝে কোথায় হারিয়ে যাও বল’ত?”

ভীষণ রাগ হয় ঝিনুকের, মনে হয় যেন ঠাস করে এক থাপ্পর মারে রিশুকে, আমি কোথায় হারিয়ে যাই না যাই সেটা তোমার দেখে কি দরকার, তোমার মুখে ত রা কাটে না একদম আবার এখানে ইনিয়ে বিনিয়ে কি জিজ্ঞেস করতে এসেছ? তাক থেকে একটা সালোয়ার কামিজ হাতে নিয়ে ঠোঁটে একটু হাসি টেনে বলে, “এটা খুঁজছিলাম।”

মাথা দোলায় রিশু, উঁকি মেরে আলমারির ভেতরে তাকিয়ে দেখে যে তাক ভর্তি জিন্স, শর্টস, টপ প্লাজো এইসব আধুনিক পোশাকে ভর্তি। খুব বলতে ইচ্ছে করছিল তখন, না না জিন্স টপস এইসব পড়তে পারো, তোমাকে সালোয়ার কামিজে নয় আধুনিক পোশাকে বেশি সুন্দরী দেখায়। মাথা দোলায়, “আচ্ছা, একটু তাড়াতাড়ি কর প্লিজ।”

হাসতে গিয়েও বাধা পায় ঝিনুক, মাথা দুলিয়ে বলে, “আচ্ছা তৈরি হয়ে নিচ্ছি।”

অগত্যা রিশু বসার ঘরের সোফায় বসে টিভি খুলে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন গতি নেই। শপিং করার কথা শুনলে ওর বোন যে সাজতে কত সময় নেয় সেটা ওর অজানা নয় তাই ভালো ভাবেই জানে মেয়েদের কত সময় লাগবে সাজতে। অনেকক্ষণ পরে নুপুরের নিক্কন কানে যেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে সেই নুপুরের অধিকারিণীর দিকে তাকিয়ে দেখে। এবারে আর একপাশে করে চুল আঁচড়ায়নি ঝিনুক, মাঝখানে সিঁথি করে মাথার পেছনে একটা খোঁপা করে বাঁধা চুল, বাঙালি বৌদের মতন সিঁথির মাঝে জ্বলজ্বল করছে এক চিলতে সিঁদুর। কচি কলাপাতা রঙের আঁটো কামিজটা ঝিনুকের নধর দেহবল্লরীর সাথে ভিজে পাতার মতন লেপটে রয়েছে, গালের দাগ গুলো অনেক আবছা হয়ে এসেছে, চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ভুলে যায়, ভাসা ভাসা কাজল কালো চোখ জোড়ায় একটু বেদনা একটু হারিয়ে যাওয়ার অব্যাক্ত রচনায় রচিত। ভীষণ সুন্দরী মেয়েটা কিন্তু তাও খোলা মরে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না রিশু।

কামিজের ওপরে একটা ছোট কারডিগান দেখে রিশু মাথা দুলিয়ে হেসে ফেলে, “এতে কিছু হবে না। তোমার আর কোন জ্যাকেট নেই?”

মাথা দোলায় ঝিনুক, “এছাড়া একটা জিন্সের জ্যাকেট আছে আর ওই নীল রঙের ওভারকোট আছে।”

চিন্তায় পরে যায় রিশু, দিল্লীর এই শীতে এই জ্যাকেটে কিছুই হবে না, খরচা বাড়বে এবারে, যদিও চিন্তা খরচা নিয়ে নয়, “ওই ওভারকোটটাই এখন পর, আসছে রবিবার তোমার জন্য শপিং করতে যাবো। আর হ্যাঁ, একটা শাল গলায় জড়িয়ে নিও বাইরে কিন্তু হাওয়া চলছে।”

বাধ্য মেয়ের মতন আবার ঘরে ঢুকে আলমারি খুলে একটা শাল গলায় জড়িয়ে নেয়, রিশুর আদেশের সামনে ওর গলার আওয়াজ বের হয় না, বাড়িতে থাকলে এতক্ষনে বাড়ি মাথায় করে তুলত, ধ্যাত এর ওপরে আবার কেউ শাল নেয় নাকি? কিন্তু সামনে যে দাঁড়িয়ে তার সামনে জোর গলায় কথা বলতে খুব বাধে ওর।

বাইকে চড়ে রিশু আর ওর মাঝে হাজার যোজনের ব্যাবধান রেখে বসে পরে। কাঁধের ওপরে কোমল চাঁপার কলি আঙ্গুলের পরশে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকায় ঝিনুকের দিকে, “ঠিক করে বসেছ?”

হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি এর আগেও বাইকে বসেছি, অত আদিখ্যেতা না দেখিয়ে চালাও, ছোট উত্তর দেয় ঝিনুক, “হ্যাঁ।”

বাইকটা শুরু হতেই পেছনের দিকে একটু ঝুঁকে পরে ঝিনুক, কোলের কাছে পার্সটা শক্ত করে ধরে নেয় সেই সাথে রিশুর বলিষ্ট কাঁধের ওপরে আলতো করে হাত রেখে নিজের ভার সামলে নেয়। কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় কান গাল অবশ হয়ে যায় ঝিনুকের। অনেক ছোট বেলায় একবার মানালী গিয়েছিল বাবা মায়ের সাথে ঘুরতে সেখানে বরফ নিয়ে খেলার সময়ে বুঝেছিল ঠান্ডা কাকে বলে। বাড়ি থেকে বাজার বেশি দূরে নয়, মিনিট দশেকের মধ্যেই বাজারে পৌঁছে যায়। এইটুকু পথ অনায়াসে হেঁটেই আসতে পারত কিন্তু এইভাবে খালি রাস্তা ধরে ঝিনুকের পাশাপাশি হাঁটতে একটু বিব্রত বোধ করছিল রিশুর তাই বাইক নিয়ে আসা।

বাইরে বেড়িয়ে ঝিনুকের মনে হয় যেন স্বর্গ হাতে পেয়েছে। এতক্ষন ওই ঘরের মধ্যে বন্দিনী জীবন যাপন করছিল, যেন এক রাক্ষস ওকে বন্দী করে রেখে গিয়েছিল। বাজারে নেমে চারপাশে দেখে ঝিনুক, এই বাজারে প্রচুর বাঙালি ভর্তি, দেখে মনেই হয় না যে এটা কোলকাতা নয়। মাছের বাজারের দিকে পা বাড়াতেই নাক কুঁচকে ঝিনুক জানিয়ে দেয় যে ওর মাছ পছন্দ হয়, মাছ রান্না করতে জানে না। সে কথা শুনে হেসে ফেলে রিশু।
 
পর্ব ছয় – (#4-27)

বাজারের পাশের দিকে একটা রেস্টুরেন্ট ছিল, রাতের রান্না করতে বারণ করে দিয়েছিল বটে কিন্তু রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার মতন মানসিক অবস্থা ওদের কারুর ছিল না।

রিশু ঝিনুককে জিজ্ঞেস করে, “রাতে কি খাবে? কাজের লোক ত কিছু রান্না করে যায়নি।”

বাইরে বেড়িয়ে ঝিনুকের মন একটু হাল্কা হয়, তাই একটু হেসে বলে, “দেখা যাবে খানে।”

এতক্ষন পরে সুন্দরীর ঠোঁটে হাসি দেখে রিশুর বেশ ভালো লাগে, “পাশে একটা বিরিয়ানি টেক এওয়ে আছে, প্যাক করে নিয়ে যাই?”

কোলকাতায় আজকাল যেখানে সেখানে বিরিয়ানির দোকান, কোন ছুতো পেলেই সবাই এই বিরিয়ানি সেই বিরিয়ানির দোকানে ঢুকে পারটি দেয়, ঝিনুকের বিরিয়ানি খাওয়ার একদম ইচ্ছে ছিল না। নাক কুঁচকে আপত্তি জানিয়ে বলে, “বিরিয়ানি নয় এখানের খাবার কিছু পাওয়া যায় না, মানে নর্থ ইন্ডিয়ান ফুড?”

রিশু ঝিনুককে জিজ্ঞেস করে, “আফগানি চিকেন তন্দুরি আর বাটার নান খেয়েছ?”

ঝিনুক উত্তর দেয়, “না খাইনি, কেমন খেতে?”

রিশু একটু হেসে উত্তর দেয়, “মন্দ নয়, আমার তো ভালো লাগে।” এতক্ষন ঘর বন্দী থাকার পরে বাইরে বেড়িয়ে দুজনের বেশ ভালো লাগে। রিশু ঝিনুকের গালের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “অয়েন্টমেন্টটা ঠিক ভাবে লাগাচ্ছো ত?”

বাপরে কত যেন ওর ওপরে নজর, অফিস ফেরত একবার দেখল না ঠিক ভাবে। মাথা দোলায় ঝিনুক, “হ্যাঁ।”

খুব জানতে ইচ্ছে করে রিশুর কেন বোকার মতন নিজেকে কষ্ট দিয়েছিল ঝিনুক, কৌতূহলী মন টাকে বেঁধে রেখে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, লাগিও এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।”

কাঁচা সবজি, ডিম, চা, ঝিনুকের জন্য চপ্পল ইত্যাদি কেনাকাটা করতে করতে বেশ রাত হয়ে যায় ওদের। বাড়ি ফিরে যথারীতি আফগানি চিকেন আর বাটার নানের অর্ডার দেওয়া হয়। খেতে বেশ ভালোই লাগে ঝিনুকের এই ধরনের খাবার আগে কোনদিন খায়নি, কোলকাতায় তন্দুরি চিকেন অনেকবার খেয়েছে কিন্তু এখানের এই আফগানী তন্দুরি খায়নি এর আগে। খাওয়া শেষে আবার সেই আগের মতন যে যার ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে, তবে এইবারে গতরাতের মতন মুখের সামনে দরজা বন্ধ করেনি ঝিনুক। রাতের দিকে ভিডিও কল করে ঝিনুক বোনের সাথে গল্প করেছিল অনেকক্ষণ।

বদ্ধ পরিবেশ বেশ হাল্কা হলেও দুইজনের মধ্যে কথাবার্তা বিশেষ হত না। দিনের মধ্যে কয়েকটা মেসেজ, “খেয়েছ?” উত্তর আসত, “হ্যাঁ, তোমার খাওয়া হয়েছে?” উত্তর আসত, “এই যাবো ক্যান্টিনে” হয়ত কখন রিশু সময় পেলে ফোন করত, “খেয়ে নিও।” উত্তর আসত “আচ্ছা”। “কি করছ, কটা ওটি ছিল আজকে?” অথবা “সকালে কি খেলে? কাজের লোক কি রান্না করে গেল?” এই ধরনের দীর্ঘ প্রশ্ন উত্তর দুইজনেই এড়িয়ে যেত। রাতে খাওয়ার সময়েও দুইজনে সামনা সামনি বসে খাওয়া সেরে ফেলে। চুপচাপ খেয়ে দেয়ে যে যার নিজের ঘরে ঢুকে পড়ত, ঝিনুক নিজের ল্যাপটপ খুলে কখন বন্ধুদের সাথে গল্প করত অন্য দিকে রিশু নিজের পড়াশুনা আর পেপার নিয়েই ব্যাস্ত থাকত। তবে রোজ দিন এই ঠান্ডায় ভোর চারটেতে উঠে পড়ত ঝিনুক, রিশু হসপিটাল বেড়িয়ে যাবে তখন কি আর ঘুমিয়ে থাকা যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে ঝিনুকের খুব ইচ্ছে করত বলতে, সাবধানে যেও, কিন্তু সে কথা বলতে পারত না। শুধু চেয়ে থাকত বারান্দা দিয়ে যতক্ষণ না রিশুর বাইক রাস্তার বাঁকে হারিয়ে যায়। বাইকে কিক মেরে একবার ওর বারান্দায় দেখা চাই, আবছা অন্ধকার হলেও দেখতে পেত ঝিনুকের চোখ দুটো, চোখা চুখি হলেই একটু হাত উঠিয়ে দিত ঝিনুক, ভদ্রতার খাতিরে একটু মাথা নোয়াত রিশু।

দেখতে দেখতে রবিবার চলে এলো, ঝিনুকের ভোর বেলা ওঠার তাড়া নেই, রিশুর হসপিটালে দৌড়ানো নেই। তবে রোজকার অভ্যেসের জেরেই রিশুর ঘুম আগেই ভেঙ্গে যায়। দাঁত ব্রাশ করতে উঠে দেখে ঝিনুকের রুমের দরজা তখন বন্ধ, মনে মনে হেসে ফেলে রিশু, না থাক আজকে আর জাগিয়ে কাজ নেই। রোজদিন ওর জন্য সাত সকালে উঠে পরে, তারপরে ঠিক ভাবে ঘুমায় কি ঘুম হয় না জানা নেই। গত রাতেই খাওয়ার সময়ে কথা হয়েছিল যে পরেরদিন শপিং এ যাবে, সেই জন্য এটিএম থেকে টাকা তুলেছিল। টাকা কেন তুলছো, আমাকে বল তোমার কি চাই? না সেটা মুখে আনতে গিয়েও আনতে পারেনি রিশু। হয়ত এখন ওদের মাঝে সহস্র যোজনের দুরত্ব তাও রিশু ভেবে রেখেছিল যে ঝিনুক যা কিনতে চায় তাই কিনে দেবে।

রান্না ঘরে ঢুকে নিজের জন্য এক কাপ চা বানায়, দুধ ছাড়া, আদা তুলসি পাতা দেওয়া শুধু মাত্র পাতা দিয়ে চা তৈরি করে খায়। বসার ঘরের সোফায় বসে ভাবে গত কয়েকদিনের কথা, এমনিতে দুটো ওটি করতেই অনেক সময় চলে যেত, যদি দেখত যে তৃতীয় ওটি বেশি সময় নেবে তখন অন্য কাউকে বলে দিত করতে। একটা না হোক তবে দেড়টা কি দুটোর মধ্যে বাড়ি ফিরে আসত রিশু। যদিও ওদের কথাবার্তা খুব সীমিত তবুও ওই যে পাশের ঘর থেকে নুপুরের নিক্কন শোনা যায়, সেটাই অনেক। ওর সাথে কথা না বললেও যখন ওর বাড়ির সাথে কথা বলত অথবা নিজের বোনের সাথে কথা বলত তখন গলা শুনে মনে হত যে ওদের মাঝের দুরত্ব একদম নেই। শুধু মাত্র রিশুর মা ছাড়া বাকি কারুর চোখে পরেনি ওদের আসল ব্যাবধান। ফোন রাখার পরেই বাড়িতে সেই আগের মতন নিস্তব্ধতা নেমে আসত। মায়ের সাথে রাতে কথা বলার সময়ে রোজদিন জিজ্ঞেস করত, “কেমন আছিস বাবা?” ছোট তিনটে শব্দের মধ্যে প্রচুর না বলা প্রশ্ন লুকিয়ে। হেসে ফেলত রিশু, “তোমার কথা মতন হাঁটছি, দেখা যাক কবে পৌঁছানো যায়।”

দরজার ওপাশে খুট খাট আওয়াজ পেয়েই ঘুম ভেঙ্গে যায় ঝিনুকের, উঠে পরল নাকি ডাক্তার? ধুর ব্যাঙ এর জ্বালায় একটু শান্তিতে ঘুমানো যায় না। স্নান করার পরে তোয়ালে দিয়ে গা মোছার সময়ে নুপুরের মধ্যে মাঝে মাঝে তোয়ালে আটকে গিয়ে ভীষণ অসুবিধে হত, কোনদিন পরেনি অভ্যাস নেই, ধ্যাত খুলেই ফেলা যাক। কিন্তু যখন রিশু ওই নুপুরের রিনিঝিনি আওয়াজ শুনে ওর দিকে তাকিয়ে থাকত তখন এক মিষ্টি অনুভুতিতে ওর হৃদয় কোন অজানা কারনে কাতর হয়ে উঠত। অনুভুতি গুলো যদিও ওর অজানা নয় তবুও ওর মনে হত এ এক নতুন অনুভুতি ওর হৃদয়ে দোলা লাগিয়েছে, আর সেই জন্য পা থেকে নুপুর খোলেনি। আড়ামোড়া ভেঙ্গে দরজা খুলে দেখে যে সোফায় বসে একা একা চা খাচ্ছে। একটু রাগ হয় ওর, একটু অপেক্ষা করলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত নাকি? চোখা চুখি হতেই মিষ্টি হাসি দেয় ঝিনুক। একটা সোয়েটার পরে বাথরুমে ঢুকে পরে ঝিনুক। রিশুও ঢুকে পরে রান্না ঘরে, নব বিবাহিতা স্ত্রীর জন্য চা বানাতে।

বাথরুম থেকে বের হতেই রিশু ওকে ডাকে, “এই নাও চা।”

চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে মুখ বেঁকায় ঝিনুক, “এই চা আমি খাই না, শুধু গরম জল।”

রিশু একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে, “তাহলে কি খাও?”

রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে ঘাড় বেঁকিয়ে বলে, জানে না যখন তখন অত আদিখ্যেতা দেখিয়ে বানাতে কেন গেছিল? “আমি বানিয়ে নেব।”

নিজের চা বানিয়ে সোফায় একটু তফাত হয়ে বসে রিশুকে জিজ্ঞেস করে, এই সাদা চা খেয়ে কি পাও? দুধ নেই, চিনি নেই, ওয়াক থু। মুক প্রশ্নটা মুক থেকেই যায়, তার জায়গায় অন্য প্রশ্ন বের হয়, “সান্ডউইচ বানাবো?”

মাথা দোলায় রিশু, “হ্যাঁ আপত্তি নেই।”

চা খেতে খেতে রিশু ঝিনুককে বলে, “লাঞ্চের পরে বেড়িয়ে যাবো, বেশি রাত হয়ে গেলে আবার তোমার ঠান্ডা লাগতে পারে।”

আহা রে, মেয়েদের বেড়াতে বের হলে ঠান্ডা লাগে না বুঝলে ডাক্তার, মাথা দোলায় ঝিনুক, “ঠিক আছে।”

চা শেষ করে রিশু ওকে বলে, “কাল থেকে আমার জেনারেল ডিউটি, তিনদিন ওপিডি আর দুই দিন ওটি।”

বিশেষ বুঝল না এই কথা তাও মাথা নাড়িয়ে দিলো ঝিনুক, “আচ্ছা।”

চা খাওয়া শেষে নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা সিরিঞ্জ আর কয়েকটা ছোট বোতল হাতে নিয়ে বেড়িয়ে আসে রিশু। সিরিঞ্জ দেখে হাজার প্রশ্ন নিয়ে ওর দিকে তাকায় ঝিনুক, কি করতে চলেছে? ঝিনুকের হাতে একটা ছোট প্লাস্টিকের বোতল ধরিয়ে দিয়ে বলে, “কাল সকালে ইউরিন দিও একটা টেস্ট করাব।” আর সিরিঞ্জ দেখিয়ে বলে, “তোমার একটা ব্লাড টেস্ট করাবো।”

খানিকটা আশ্চর্য হয় ঝিনুক, সেই সাথে একটু বিরক্তি ভাব ফুটে ওঠে চেহারায়, তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছ যে আমি পার্থের সাথে সহবাস করে কোন রোগ বাধিয়েছি কি না? “কেন আমার কি হয়েছে?”

একটু হাসে রিশু, “না তোমার কিছু হয়নি, তবে মেয়েদের অনেক রকমের গ্যানোকজিকাল প্রবলেম হয়, ইউরিন ইনফেক্সান, থাইরয়েড বা কোন হরমোনাল প্রবলেম থাকলে আগে থেকে ধরা পরলে ওষুধে সেগুলো কন্ট্রোলে রাখা যায়।”

মুখ ব্যাজার করে উত্তর দেয় ঝিনুক, “না আমার কিছু হয়নি, আমি রক্ত দেব না।”

হেসে ফেলে রিশু, “আমি লিটার লিটার রক্ত নেব নাকি?” হাতের দুটো ছোট বোতল দেখিয়ে বলে, “এই ব্যাস এইটুকু।”

প্রচন্ড ইঞ্জেকশানের ভীষণ ভয় ঝিনুকের, জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “উরি বাবাআআ নাআআআ...” বলেই সোফা ছেড়ে উঠে পরে।

হসপিটালে প্রচুর লোককে দেখেছে এমন করতে। চোখ নাক মুখ বন্ধ করে থাকে যখন ইঞ্জেকশান দেওয়া হয় দেখে মনে হয় যেন ওদের বুকে কেউ ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে। যেভাবে সারা অঙ্গে ঢেউ তুলে এক ঝটকায় সোফা ছেড়ে উঠে পরল তাতে হাসি পেয়ে যায় রিশুর। ছন্দময় তালে মত্ত চলনে চোখের বাণে ওর বুকে আঘাত হেনে চলে গেল। হাতে সিরিঞ্জ নিয়ে সোফায় বসে মিটিমিটি ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে হাসে, পাগলি মেয়ে, ফুচকা খেতে দেব, ম্যাবেলিনের লিপস্টিক পাবে, ম্যাকএর বেস কিনে দেব।

মরন দশা, ওই ভাবে দাঁত বের করে হাসার কি হয়েছে? আবার ডাকছে দেখো। যাবো না যাও, শপিং গেল মাথায় উঠে। মুখ কাচুমাচু করে কাতর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “রক্ত না নিলেই নয়?”

ঝিনুকের কাচুমাচু মুখ দেখে হাসি থামাতে পারে না রিশু, বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনী মাঝে এক ইঞ্চি ব্যাবধান দেখিয়ে বলে, “এই এত্তটুকু নেব, একদম লাগবে না। একটা টিএসএইচ আর এলএফটি করাব।”

শান্ত পায়ে হরিণীর মতন দুলকি চালে রিশুর সামনে এসে মুখ ব্যাজার করে আদুরে কন্ঠে বলে, “লাগবে না’ত, সত্যি বলছ?”

ফর্সা হাত, হাতের পাতায় এখন মেহেন্দির রঙ একটু লেগে আছে। রোজদিন বিকেলে যখন ওর সাথে বাজারে বের হয় তখন শরীরে কোন পারফিউম লাগায়, কিন্তু সেদিন সকালে একদম কাছ থেকে ওর গায়ের গন্ধে মাতাল হয়ে যায় রিশু, ভোরের ফোটা শিউলি ফুল, ইচ্ছে করছিল হাত দুটো টেনে পাশে বসায়। বিয়ের পাঁচদিন কেটে গেছে কিন্তু সেই যে বিয়ের দিনে ওর হাতের ওপরে হাত রেখেছিল ঝিনুক তারপর আর সেই পদ্ম কুড়ির মতন কোমল হাত দুটো আর নিজের হাতে নেওয়া হয়নি। দুই কব্জি ভরা সোনার চুড়ি, সোনা দিয়ে শাঁখা পলা বাঁধানো, মাঝে মাঝেই ছনছন করে বেজে ওঠে। এই মিষ্টি মেয়টা কি ভাবে অসৎ সংসর্গে পড়েছিল ভেবে পায় না।

সোফায় বসতে অনুরোধ করে বলে, “না রে বাবা একদম লাগবে না।”

চুপচাপ সোফার ওপরে রিশুর পাশে বসে পরে ঝিনুক। সোয়েটারের হাতা গুটিয়ে ডান হাত এগিয়ে দেয় রিশুর দিকে। একটা রাবারের বেল্ট দিয়ে কুনুইয়ের ওপরে বাঁধতেই কোকিয়ে ওঠে ঝিনুক, ছটফট করতে করতে বলে, “লাগছে ত।”

রিশু ওকে বলে, “হাত মুঠো করো।”

ইঞ্জেক্সানের দিকে তাকিয়ে কাঁদুনে চেহারা করে হাত মুঠো করে মিউ মিউ করে ওঠে, “উম্মম্মম লাগছে হাতে...”

মেয়েটা এত ডানপিটে এত চঞ্চল তাও এই ইঞ্জেক্সানের ভয়? হাসি পেয়ে যায় রিশুর। ওর ডান হাত শক্ত করে ধরে, স্পিরিটে একটু তুলো ভিজিয়ে হাতের ওপরে আলতো করে ডলে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা কি কি শপিং করবে কিছু ভেবেছ? কি রঙের জ্যাকেট কিনবে?”

আদিখ্যেতা দেখ, আবার জিজ্ঞেস করছে কি শপিং করবে। “জানি না যাও, আমি যাবো না তোমার সাথে শপিং করতে।” মাথা ঝাঁকিয়ে বলে ঝিনুক।

ফর্সা হাতের মাঝখানে শিরা খুঁজতে ব্যাস্ত রিশু। ঝিনুকের বাজুর মোলায়ম ফর্সা ত্বকের ওপরে দুটো আঙ্গুল দিয়ে একটু জোরেই বার কতক বাড়ি মারতেই লাল হয়ে যায় সেই স্থান। যে ভাবে মেয়েটা ছটফট করছে, নিডেল না বেঁকে যায়। এবারে একটা ধমক না দিলে কাজে দেবে না।

বাম হাতে ঝিনুকের ডান হাত শক্ত করে ধরে একটু ধমক দিয়েই বলে, “একদম ছটফট করবে না, নিডেল বেঁকে যাবে।”

যেই শুনেছে যে নিডেল বেঁকে যাবে, সেই ঝিনুকের কান্না শুরু। রিশুর হাত ছাড়িয়ে এক লাফে সোফা থেকে উঠে পরে, “তুমি ডাক্তার না হাতির মাথা, আমি রক্ত দেব না যাও।”

ঝিনুক নিজের হাতে বাঁধা রাবারের বেল্ট খুলে ছুঁড়ে মারে রিশুর দিকে। হাতে সিরিঞ্জ নিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই, ঝিনুকের কান্ডকারখানা দেখে হেসে ফেলে রিশু। ইচ্ছে করছিল মেয়েটাকে এক ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়, অত ভয় পাওয়ার কি আছে? কিন্তু ওই মিষ্টি অনুরাগে রক্তিম ঝিনুকের লালচে গালের দিকে তাকিয়ে সেই ধমকের কথা ভুলে যায়। একটু পরেই ল্যাবের লোক আসবে রক্ত নিয়ে যেতে, তাকে আগে থেকেই আসতে বলেছিল। নিরুপায় রিশু আরো একবার চেষ্টা করে, মাথা দুলিয়ে ইশারায় ঝিনুককে ডাকে। ঝিনুক ততক্ষনে শোয়ার ঘরের দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে, পাছে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় সেই ভয়ে। বসার ঘর যেন এক রণক্ষেত্র, এদিকে হাতে সিরিঞ্জ নিয়ে রিশু অন্যপাশে শোয়ার ঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ঝিনুক।

শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেয় রিশু, “কাল সকালে হসপিটাল যাওয়ার আগে কিন্তু আমি ব্লাড নিয়ে যাবো।”

দরজার আড়াল থেকে একটু বিরক্তি মেশানো একটু হাসি মাখানো উত্তর আসে, “ধুস, কাল আমি দরজাই খুলবো না।”
 

Users who are viewing this thread

Back
Top