পর্ব পাঁচ – (#4-21)
বেল্ট থেকে সুটকেস তিনটে নামিয়ে যেদিকে ঝিনুক গিয়েছিল সেদিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল এখন আসছে না দেখে খানিক চিন্তিত হয়ে পরে। বিশাল এয়ারপোরট কোথাও আবার হারিয়ে গেল না ত? মনে মনে হেসে ফেলে, এই সবের মধ্যে ওর ফোন নাম্বার নেওয়া হয়নি। নিজের স্ত্রী কিন্তু ফোন নাম্বার জানে না, কেউই যদি এটা শোনে তাহলে ভীষণ হাসাহাসি করবে। ঘড়ি দেখে, পৌনে এগারোটা এখানেই বাজে, এরপর ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরো রাত হয়ে যাবে। পোশাকের নিচে ইনার নিশ্চয় পরেনি ঝিনুক, কোলকাতায় এসবের চল নেই, এয়ারপোরট থেকে বের হলে কনকনে ঠান্ডায় জমে যাবে তাহলে। নিজের সুটকেসে একটা শাল অবশ্য আছে, একটু ভেবে সুটকেস খুলে সেই শাল বার করার সময়ে মনে হল ওর পাশে এসে কেউ দাঁড়িয়েছে। শাল বার করে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে ওর পাশে ঝিনুক।
ওর হাতে শাল ধরিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এত দেরি করলে?”
নরম গলায় উত্তর দেয়, “না মানে এক বান্ধবীর কল এসেছিল তাই কথা বলতে বলতে একটু দেরি হয়ে গেল।”
মাথা দোলায় রিশু, “ওহ আচ্ছা।” ট্রলিতে সুটকেস গুলো নিয়ে বাইরের গেটের দিকে হাঁটা শুরু করে দুজনে।
ঝিনুক একটু পেছনে ছিল, হাতে শাল দেখে ভাবে হটাত শাল কেন বার করতে গেল? এখানে তেমন ঠান্ডা লাগছে না। জিজ্ঞেস করে রিশুকে, “হটাত শাল কেন?”
মুচকি হাসে রিশু, “বাইরে কিন্তু বিশাল ঠান্ডা।”
মাথা দোলায় ঝিনুক, “ওহ আচ্ছা।”
আবার দুইজনে চুপচাপ। টারমিনাল থেকে বেড়িয়ে আসতেই এক দমকা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া কাঁপুনি দিয়ে দেয় ঝিনুকের শারা শরীরে। দাঁতে দাঁত পিষে, বুকের ওপরে হাত শক্ত করে ভাঁজ করে গায়ের ওভারকোটটা শরীরের সাথে বেশি করে জড়িয়ে নেয়। ওকে ওইভাবে কাঁপতে দেখে দাঁড়িয়ে পরে রিশু। হটাত থেমে যেতেই ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকায় ঝিনুক। রিশু ওর হাত থেকে শাল নিয়ে গলায় জড়িয়ে গায়ে জড়িয়ে দেয়। যখন ওর গায়ে শাল জড়িয়ে দিয়েছিল রিশু তখন ঝিনুকের সারা শরীর পাথর হয়ে গেছিল, ঠান্ডায় নয় এক অজানা অনুভুতিতে শরীরের সব রোমকূপ একসাথে উন্মিলিত হয়ে ওঠে। গলায় শাল জড়ানোর সময়ে এক মুহূর্তের জন্য ওর কোমল উষ্ণ গালের ওপরে রিশুর তপ্ত কঠিন আঙ্গুল ছুঁয়ে যায়। গালের ওপর হটাত ওই অচেনা আঙ্গুলের ছোঁয়ায় ভীষণ ভাবেই কেঁপে ওঠে ঝিনুক। আরো কিছুক্ষন এইভাবে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে চেয়েছিল, কেন দাঁড়াতে চেয়েছিল? কারণ ওর অজানা। নির্বিকার চিত্তে রিশু ওর গায়ে শাল জড়িয়ে দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে দেয় ট্যাক্সি স্টান্ডের দিকে। কিঞ্চিত অনুরাগ দেখা দেয় ঝিনুকের বুকে, কৃষ্ণার সাথে কথা বলার পরে মন বেশ হাল্কা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু রিশুকে নির্বিকার ভাবে আবার হাঁটতে দেখে মনে মনে বলে ফেলে, ধ্যাত ছাতার মাথা, কতক্ষন পরে একটু কথা বলতে শুরু করেছিল আবার সেই চুপ।
হাঁটতে হাঁটতে ট্যাক্সির স্টান্ডে গিয়ে ট্যাক্সিতে চাপে ওরা। পেছনের সিটের দুই প্রান্তে দুইজন একাকী বসে, মাঝের ব্যাবধান যেন সহস্র যোজন। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হুহু করে গাড়ি এগিয়ে চলেছে, এত রাতে রাস্তায় সাধারন গাড়ির সংখ্যা কম কিন্তু ট্রাকের ভিড় বেশ। নতুন জায়গা, নতুন রাস্তা, এমন কি আলো গুলো পর্যন্ত নতুন মনে হয় ঝিনুকের। মন দিয়ে গাড়ির বাইরে দেখে আর ভাবে, এবারে এই শহর হয়ে যাবে ওর শহর।
বাড়ি গিয়ে কি করবে ঝিনুক সেটাই চিন্তার প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায় রিশুর কাছে। গতরাতে যেমন ভাবে আহত সাপের মতন ফোঁস করে উঠেছিল তাতেই বুঝে গিয়েছিল রিশু যে পাশে বসা আহত মেয়েটার বুকের ভেতরটা জোড়া লাগতে একটু সময় নেবে। মনে মনেই হাসে রিশু, নাম ঝিনুক যখন তখন একদম খোলের মধ্যেই ঢুকে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই খোল থেকে জোর করে বার করতে গেলে যদি খোল ভেঙ্গে যায় তাহলে মুশকিল, হয়ত ঠিক সময় মতন নিজের খোল থেকে নিজেই বেড়িয়ে আসবে। ঘরের অবস্থা একদম তছনছ, আসার দিন ঘর গুছিয়ে রেখে আসার সময় পায়নি, তখন কি আর জানত রিশু যে ওর সাথে এক সুন্দরী ওর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করবে। সে যাই হোক যদি ওর মা, ভাই বোন এইভাবে থাকতে পারে তাহলে এই পাশে বসা মেয়েটাকেও সেই ভাবেই থাকতে হবে। কিন্তু এত রাতে কি খাবে? এতক্ষনে ওর এলাকার সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে, একমাত্র শহরের মাঝখানের বেশ কয়েকটা রেস্টুরেন্ট হয়ত খোলা থাকবে। কিন্তু ট্যাক্সি ওদের বাড়ির দিকেই ধেয়ে চলেছে।
বড় রাস্তা ছেড়ে বেশ কয়েকটা ছোট রাস্তার এমোড় সেমোড় বেঁকে একটা তিনতলা ফ্লাট বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় ওদের ট্যাক্সি। রাত তখন সাড়ে বারোটা, সামনের পার্কের গাছাপালা গুলো যেন ভুতের মতন দাঁড়িয়ে। শীতকাল সবার বাড়িতে সেই সময়ে আলো বন্ধ, সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ট্যাক্সি থেকে নামতেই হুহু করে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া ঝিনুককে কাঁপিয়ে তোলে। বাপরে কি সাঙ্ঘাতিক ঠান্ডা। ভাড়া মিটিয়ে সুটকেস হাতে করে টানতে টানতে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যায় রিশু।
পকেট থেকে বাড়ির চাবি বের করে ঝিনুকের হাতে ধরিয়ে বলে, “দুইতলার ডান দিকের ফ্লাট, তুমি যাও আমি এই সুটকেস গুলো এক এক করে নিয়ে আসছি।” ঝিনুক নিজের বড় সুটকেসটা টেনে নিয়ে যেতেই রিশু বারন করে বলে, “তুমি ছোটটা নিয়ে ওঠ আমি আসছি।”
মাথা দোলায় ঝিনুক, “আচ্ছা।”
একা একা এইভাবে কারুর বাড়িতে চাবি খুলে ঢুকে পড়তে একটু বিব্রত বোধ করে ঝিনুক। নিজের ছোট সুটকেস হাতে নিয়ে সিঁড়ির কয়েক ধাপ চড়ে পেছন ঘুরে রিশুর দিকে তাকিয়ে থাকে। রিশু একটা বড় সুটকেস হাতে নিয়ে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে ঝিনুক ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। আধো আলো আধারিতে দাঁড়িয়ে এক স্বপ্ন দেশের রাজকুমারী বলে মনে হয় ঝিনুককে, উজ্জ্বল চোখ জোড়া চকচক করছে এক অজানা আশঙ্কা আর ভীতিতে। মাথা নাড়িয়ে রিশু জিজ্ঞেস করে, কি হল চল। মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায় ঝিনুক, হ্যাঁ যাচ্ছি। এক পা এক পা করে চড়ার সময়ে অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতার মাঝে রিনিঝিনি করে বেজে ওঠে ওর পায়ের নুপুর। এতক্ষন চারপাশের কোলাহলে রিশুর কানে এই নুপুরের নিক্কন ঠিক ভাবে পৌঁছায়নি। ফর্সা পায়ের গোড়ালির দিকে তাকিয়ে স্তব্দ হয়ে যায় রিশুর হৃদয়, দুই পায়ে পাতলা রুপোর নুপুর, এই আধুনিক যুগে নুপুরের চল একদম নেই তাই একটু অবাক লাগে ঝিনুকের পায়ে নুপুর দেখে।
দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দেয় রিশু। বসার ঘরের সোফায় একটা জামা আর জ্যাকেট পড়া, মাথা চুলকে সঙ্গে সঙ্গে সেই জামা আর জ্যাকেট সরিয়ে দিয়ে মুখ কাচুমাচু করে হেসে ফেলে।
একটা ঘরের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে ঝিনুককে বলে, “তুমি ওই ঘরে যাও আমি বাকি সুটকেস নিয়ে আসছি।”
দরজা খোলা রেখেই রিশু নেমে যায় সিঁড়ি দিয়ে। রিশু বেড়িয়ে যেতেই ভীষণ ভাবে একা মনে হয় ওর। একেবারে এক নতুন জগতে ঢুকে পড়েছে ঝিনুক। চারপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে জরিপ করে নেয়, আজ থেকে এটাই ওর গন্ডী এখানেই ওকে থাকতে হবে। বসার ঘরটা বেশ ছোট, একটা মাত্র লম্বা সোফা পাতা আর সোফার পেছনে একটা প্লাস্টিকের টেবিল আর দুটো চেয়ার পাতা। এক কোনায় একটা ফ্রিজ, একদিকের দেয়ালে একটা টিভি, পাশে একটা ছোট রান্নাঘর। বসার ঘরের এক পাশে পাশাপাশি দুটো ঘর, মনে হয় ওই দুটো শোয়ার ঘর। একটা ছোট পরিবার থাকার মতন যথেষ্ট। পুরো ফ্লাটটা দেখে মনে হল কোলকাতায় রিশুদের বাড়ির বসার ঘরটা মনে হয় এর চেয়েও বড়। মনে মনে হেসে ফেলে ঝিনুক, টেবিলে একটা গ্লাসে আধা খাওয়া জল মনে হয়। চেয়ারে একটা নোংরা জিন্স ঝুলছে, রান্নাঘরের দিকে উঁকি মেরে দেখে সিঙ্কে বাসন পরে রয়েছে, কাজের লোক আছে না নেই, নাকি এইসব কাজ ওকেই করতে হবে? কিঞ্চিত অস্বস্তি বোধ করে ঝিনুক, ও এখানে কাজের লোক হিসাবে এসেছে নাকি যে রোজ সকালে উঠে রান্না করবে বাসন মাজবে ঘর ঝাড়ু দেবে? বাড়িতে কাজের লোক ছিল বাড়ির কাজের জন্য, মা রান্না করত, কোনদিন রান্না ঘরে পর্যন্ত ঢোকেনি, হ্যাঁ ম্যাগি চা ডিম সেদ্দ এইসব বানাতে জানে কিন্তু এর বেশি ওর দৌড় নয়। এক ধাক্কায় ওর সীমানা এত ছোট হয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারেনি। দরজা বন্ধ করার শব্দ পেতেই সারা শরীর কেঁপে ওঠে ওর। গতরাতে বাড়িতে না হয় সবাই ছিল, সেখানে চেঁচালে হয়ত কেউ ওর ডাক শুনে ওকে বাঁচাতে আসত, কিন্তু এই দূর দেশে এই একাকী এক ফ্লাটের মধ্যে বন্ধ দরজার পেছনে ওর সাথে কি করবে রিশু? রিশুর দিকে তাকিয়ে দেখে, দুটো বড় বড় সুটকেস দুইতলা পর্যন্ত টেনে উঠিয়ে হাপিয়ে গেছে।
রিশু ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে রান্নাঘর থেকে একটা জলের বোতল এনে বেশ কয়েক ঢোক জল খেয়ে ওর দিকে জলের বোতল এগিয়ে দেয়। চারপাশে তাকিয়ে নিজের ঘরের অবস্থা দেখে বেশ বিব্রত বোধ করে। এতদিন বন্ধ থাকার ফলে বেশ নোংরা হয়ে গেছে চারদিক। বারান্দার দিকের একটা জানালা মনে হয় খোলা ছিল বলে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া ঘরের হাওয়া ঠান্ডা করে দিয়েছে।
একটা বড় শোয়ার ঘরের মধ্যে ঝিনুকের বড় সুটকেস রেখে ওকে বলে, “তুমি ফ্রেস হয়ে নাও।”
বুকের মধ্যে হাপর টানছে ঝিনুকের তাও বাধ্য মেয়ের মতন মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে বলে, “হ্যাঁ যাচ্ছি।”
চোখ ঘুরিয়ে রিশুকে দেখে ঝিনুক, শোয়ার ঘরের বিছানাটা বেশ বড় তার পাশের ঘরে একটা ছোট খাট আর একটা চেয়ার। নিজের ছোট সুটকেস নিয়ে বড় শোয়ার ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে ঝিনুক। ঠিক সেই সময়ে ঝিনুকের ফোন বেজে ওঠে। ফোন তুলে দেখে ওর মা ফোন করেছে। মেয়ে ঠিক ভাবে বাড়িতে পৌছাল কি না সেটা সব বাবা মায়ের বড় চিন্তার বিষয়।
ফোন তুলে উত্তর দেয় ঝিনুক, “হ্যাঁ মা, বাড়ি পৌঁছে গেছি ভালো ভাবে।”
ওর মা ওকে বলে, “সাবধানে থাকিস। এবারে বুঝে শুনে সব কিছু মানিয়ে চলিস। বুঝতেই পারছিস...”
কথাটা শেষ করতে দেয় না ঝিনুক, “কি বুঝবো একবার বলবে?”
পিয়ালী তাও মেয়েকে শান্ত হওয়ার জন্য বলে, “দ্যাখ বড় হয়েছিস, বিয়ে হয়ে গেছে কচি খুকি নয় তুই। রিশু তোর থেকে বয়সে অনেক বড় একটু মান সন্মান রেখে চলিস। যে অবস্থায় বিয়ে হয়েছে তাতে তোকে এইসব মানিয়ে নিয়েই চলতে...”
শেষ বাক্য কানে যেতেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঝিনুক, “হ্যাঁ, সব কিছু ত আমাকেই মানিয়ে নিতে হবে। আমি এখানে দোষী আমি খারাপ।”
পিয়ালী মেয়েকে বলে, “তুই দোষী না খারাপ সেটা তোকে বলিনি, একটা নতুন জীবন শুরু করতে গেলে অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে হয়। তোর জেদ...”
চেঁচিয়ে ওঠে ঝিনুক, “হ্যাঁ সারা জীবন আমার জেদ, আমার খামখেয়ালিপনাই এইসব দেখে গেলে তোমরা। কি মানিয়ে নেব? সকাল থেকে প্রায় একশো বার কানের কাছে এক কথা ঘ্যানর ঘ্যানর করে চলেছ, মানিয়ে নিবি মানিয়ে নিবি, ওর সামনে জেদ করবি না, ও যা বলবে শুনবি, ওর সাথে ঝগড়া করবি না। কেউকি ওকে একবার ও বলেছে আমার সাথে মানিয়ে নিতে? কেউ কি ওকে একবারের জন্য বলেছে আমার কি চাই না চাই সেটা বুঝতে? নাহ, যেহেতু সব দোষ আমার সুতরাং সব কিছু চুপচাপ আমাকেই মেনে নিতে...”
দরজার দিকে চোখ যেতেই থমকে যায় ঝিনুক, রিশু ওর দিকে নিস্পলক চোখে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে। মায়ের কথা শুনে রিশুর দিকে দেখে একদম সহ্য হয় না ওর, রাগে দুঃখে চরম ঘৃণায় সর্বাঙ্গ রিরি করে জ্বলে ওঠে। দড়াম করে রিশুর মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দেয় ঝিনুক।
রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে হটাত করে এইভাবে ঝিনুককের আচরনে ভীষণ আহত হয় রিশু। চোয়াল কঠিন হয়ে যায় ক্রোধে, কারুর ওপরে এইভাবে চেঁচিয়ে কথা বলা রিশুর একদম পছন্দ নয়। হাত মুঠো করে নিজের আবেগ আয়ত্তে নিয়ে আসে। ছোট বেলা থেকে ওর মা ওকে শিখিয়েছে, রাগ করবে না, রেগে মেগে কোনদিন কোন সমস্যার সমাধান হয় না। বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে সেই সমস্যার আসল কারন খুঁজে তার বিহিত করবে। ডাক্তারি পড়ার সময় থেকেই ওর মা ওকে বলেছিল যে এরপর ডাক্তার হবে, চোখের সামনে প্রচুর রুগী দেখবে, তাদের দুঃখ কষ্ট শুনে যেন ভাবাবেগে বয়ে না যায় তাহলে অপারেশান করার সময়ে হাত কাঁপবে সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরে ঘুমাতে পারবে না। সেই জন্য মায়ের কথা মেনে রোজদিন প্রাণায়াম করে রিশু, ভাবাবেগকে আয়ত্তে রাখার জন্য রোজদিন অন্তত আধ ঘন্টা চোখ বন্ধ করে ধ্যান করে। কিন্তু পাশের ঘরে মেয়েটা যে ওর রোগী নয়, কচি একটা মেয়ে, সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী।
ছোট ঘরের মধ্যে ঢুকে বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ খাটের ওপরে বসে থাকে আর ভাবে একবার মাকে ফোন করবে। ভীষণ কান্না পায় ওর, কিন্তু ওর চোখে জল দেখলে ওর মা থাকতে পারবে না, নিজেকে দোষী ভেবে নেবে আর নিজেকে কষ্ট দেবে, মায়ের সেই কষ্ট দেখতে চায় না রিশু। কি ভাবে ছোটবেলা থেকে ওকে বুকের মাঝে আঁকরে ধরে মানুষ করেছে সেটা ওর অজানা নয়। ওর কাপড় জামা সব কিছুই পাশের ঘরের আলমারিতে। মা ভাই বোন এলে তবেই এই ঘরে শোয়া হয় না হলে এটা ওর পড়ার ঘর। জুতো খুলে বাথরুমে ঢুকে পরিষ্কার হয়ে নেয়। পাশের ঘরের বন্ধ দরজায় কান পাততে একদম ইচ্ছে করে না। যা খুশি করছে করুক, বাকি জীবন না হয় এই বিশাল রঙমঞ্চে মেকি হাসি নিয়ে কাটিয়ে দেবে।
বেল্ট থেকে সুটকেস তিনটে নামিয়ে যেদিকে ঝিনুক গিয়েছিল সেদিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল এখন আসছে না দেখে খানিক চিন্তিত হয়ে পরে। বিশাল এয়ারপোরট কোথাও আবার হারিয়ে গেল না ত? মনে মনে হেসে ফেলে, এই সবের মধ্যে ওর ফোন নাম্বার নেওয়া হয়নি। নিজের স্ত্রী কিন্তু ফোন নাম্বার জানে না, কেউই যদি এটা শোনে তাহলে ভীষণ হাসাহাসি করবে। ঘড়ি দেখে, পৌনে এগারোটা এখানেই বাজে, এরপর ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরো রাত হয়ে যাবে। পোশাকের নিচে ইনার নিশ্চয় পরেনি ঝিনুক, কোলকাতায় এসবের চল নেই, এয়ারপোরট থেকে বের হলে কনকনে ঠান্ডায় জমে যাবে তাহলে। নিজের সুটকেসে একটা শাল অবশ্য আছে, একটু ভেবে সুটকেস খুলে সেই শাল বার করার সময়ে মনে হল ওর পাশে এসে কেউ দাঁড়িয়েছে। শাল বার করে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে ওর পাশে ঝিনুক।
ওর হাতে শাল ধরিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এত দেরি করলে?”
নরম গলায় উত্তর দেয়, “না মানে এক বান্ধবীর কল এসেছিল তাই কথা বলতে বলতে একটু দেরি হয়ে গেল।”
মাথা দোলায় রিশু, “ওহ আচ্ছা।” ট্রলিতে সুটকেস গুলো নিয়ে বাইরের গেটের দিকে হাঁটা শুরু করে দুজনে।
ঝিনুক একটু পেছনে ছিল, হাতে শাল দেখে ভাবে হটাত শাল কেন বার করতে গেল? এখানে তেমন ঠান্ডা লাগছে না। জিজ্ঞেস করে রিশুকে, “হটাত শাল কেন?”
মুচকি হাসে রিশু, “বাইরে কিন্তু বিশাল ঠান্ডা।”
মাথা দোলায় ঝিনুক, “ওহ আচ্ছা।”
আবার দুইজনে চুপচাপ। টারমিনাল থেকে বেড়িয়ে আসতেই এক দমকা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া কাঁপুনি দিয়ে দেয় ঝিনুকের শারা শরীরে। দাঁতে দাঁত পিষে, বুকের ওপরে হাত শক্ত করে ভাঁজ করে গায়ের ওভারকোটটা শরীরের সাথে বেশি করে জড়িয়ে নেয়। ওকে ওইভাবে কাঁপতে দেখে দাঁড়িয়ে পরে রিশু। হটাত থেমে যেতেই ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকায় ঝিনুক। রিশু ওর হাত থেকে শাল নিয়ে গলায় জড়িয়ে গায়ে জড়িয়ে দেয়। যখন ওর গায়ে শাল জড়িয়ে দিয়েছিল রিশু তখন ঝিনুকের সারা শরীর পাথর হয়ে গেছিল, ঠান্ডায় নয় এক অজানা অনুভুতিতে শরীরের সব রোমকূপ একসাথে উন্মিলিত হয়ে ওঠে। গলায় শাল জড়ানোর সময়ে এক মুহূর্তের জন্য ওর কোমল উষ্ণ গালের ওপরে রিশুর তপ্ত কঠিন আঙ্গুল ছুঁয়ে যায়। গালের ওপর হটাত ওই অচেনা আঙ্গুলের ছোঁয়ায় ভীষণ ভাবেই কেঁপে ওঠে ঝিনুক। আরো কিছুক্ষন এইভাবে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে চেয়েছিল, কেন দাঁড়াতে চেয়েছিল? কারণ ওর অজানা। নির্বিকার চিত্তে রিশু ওর গায়ে শাল জড়িয়ে দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে দেয় ট্যাক্সি স্টান্ডের দিকে। কিঞ্চিত অনুরাগ দেখা দেয় ঝিনুকের বুকে, কৃষ্ণার সাথে কথা বলার পরে মন বেশ হাল্কা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু রিশুকে নির্বিকার ভাবে আবার হাঁটতে দেখে মনে মনে বলে ফেলে, ধ্যাত ছাতার মাথা, কতক্ষন পরে একটু কথা বলতে শুরু করেছিল আবার সেই চুপ।
হাঁটতে হাঁটতে ট্যাক্সির স্টান্ডে গিয়ে ট্যাক্সিতে চাপে ওরা। পেছনের সিটের দুই প্রান্তে দুইজন একাকী বসে, মাঝের ব্যাবধান যেন সহস্র যোজন। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হুহু করে গাড়ি এগিয়ে চলেছে, এত রাতে রাস্তায় সাধারন গাড়ির সংখ্যা কম কিন্তু ট্রাকের ভিড় বেশ। নতুন জায়গা, নতুন রাস্তা, এমন কি আলো গুলো পর্যন্ত নতুন মনে হয় ঝিনুকের। মন দিয়ে গাড়ির বাইরে দেখে আর ভাবে, এবারে এই শহর হয়ে যাবে ওর শহর।
বাড়ি গিয়ে কি করবে ঝিনুক সেটাই চিন্তার প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায় রিশুর কাছে। গতরাতে যেমন ভাবে আহত সাপের মতন ফোঁস করে উঠেছিল তাতেই বুঝে গিয়েছিল রিশু যে পাশে বসা আহত মেয়েটার বুকের ভেতরটা জোড়া লাগতে একটু সময় নেবে। মনে মনেই হাসে রিশু, নাম ঝিনুক যখন তখন একদম খোলের মধ্যেই ঢুকে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই খোল থেকে জোর করে বার করতে গেলে যদি খোল ভেঙ্গে যায় তাহলে মুশকিল, হয়ত ঠিক সময় মতন নিজের খোল থেকে নিজেই বেড়িয়ে আসবে। ঘরের অবস্থা একদম তছনছ, আসার দিন ঘর গুছিয়ে রেখে আসার সময় পায়নি, তখন কি আর জানত রিশু যে ওর সাথে এক সুন্দরী ওর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করবে। সে যাই হোক যদি ওর মা, ভাই বোন এইভাবে থাকতে পারে তাহলে এই পাশে বসা মেয়েটাকেও সেই ভাবেই থাকতে হবে। কিন্তু এত রাতে কি খাবে? এতক্ষনে ওর এলাকার সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে, একমাত্র শহরের মাঝখানের বেশ কয়েকটা রেস্টুরেন্ট হয়ত খোলা থাকবে। কিন্তু ট্যাক্সি ওদের বাড়ির দিকেই ধেয়ে চলেছে।
বড় রাস্তা ছেড়ে বেশ কয়েকটা ছোট রাস্তার এমোড় সেমোড় বেঁকে একটা তিনতলা ফ্লাট বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় ওদের ট্যাক্সি। রাত তখন সাড়ে বারোটা, সামনের পার্কের গাছাপালা গুলো যেন ভুতের মতন দাঁড়িয়ে। শীতকাল সবার বাড়িতে সেই সময়ে আলো বন্ধ, সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ট্যাক্সি থেকে নামতেই হুহু করে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া ঝিনুককে কাঁপিয়ে তোলে। বাপরে কি সাঙ্ঘাতিক ঠান্ডা। ভাড়া মিটিয়ে সুটকেস হাতে করে টানতে টানতে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যায় রিশু।
পকেট থেকে বাড়ির চাবি বের করে ঝিনুকের হাতে ধরিয়ে বলে, “দুইতলার ডান দিকের ফ্লাট, তুমি যাও আমি এই সুটকেস গুলো এক এক করে নিয়ে আসছি।” ঝিনুক নিজের বড় সুটকেসটা টেনে নিয়ে যেতেই রিশু বারন করে বলে, “তুমি ছোটটা নিয়ে ওঠ আমি আসছি।”
মাথা দোলায় ঝিনুক, “আচ্ছা।”
একা একা এইভাবে কারুর বাড়িতে চাবি খুলে ঢুকে পড়তে একটু বিব্রত বোধ করে ঝিনুক। নিজের ছোট সুটকেস হাতে নিয়ে সিঁড়ির কয়েক ধাপ চড়ে পেছন ঘুরে রিশুর দিকে তাকিয়ে থাকে। রিশু একটা বড় সুটকেস হাতে নিয়ে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে ঝিনুক ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। আধো আলো আধারিতে দাঁড়িয়ে এক স্বপ্ন দেশের রাজকুমারী বলে মনে হয় ঝিনুককে, উজ্জ্বল চোখ জোড়া চকচক করছে এক অজানা আশঙ্কা আর ভীতিতে। মাথা নাড়িয়ে রিশু জিজ্ঞেস করে, কি হল চল। মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায় ঝিনুক, হ্যাঁ যাচ্ছি। এক পা এক পা করে চড়ার সময়ে অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতার মাঝে রিনিঝিনি করে বেজে ওঠে ওর পায়ের নুপুর। এতক্ষন চারপাশের কোলাহলে রিশুর কানে এই নুপুরের নিক্কন ঠিক ভাবে পৌঁছায়নি। ফর্সা পায়ের গোড়ালির দিকে তাকিয়ে স্তব্দ হয়ে যায় রিশুর হৃদয়, দুই পায়ে পাতলা রুপোর নুপুর, এই আধুনিক যুগে নুপুরের চল একদম নেই তাই একটু অবাক লাগে ঝিনুকের পায়ে নুপুর দেখে।
দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দেয় রিশু। বসার ঘরের সোফায় একটা জামা আর জ্যাকেট পড়া, মাথা চুলকে সঙ্গে সঙ্গে সেই জামা আর জ্যাকেট সরিয়ে দিয়ে মুখ কাচুমাচু করে হেসে ফেলে।
একটা ঘরের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে ঝিনুককে বলে, “তুমি ওই ঘরে যাও আমি বাকি সুটকেস নিয়ে আসছি।”
দরজা খোলা রেখেই রিশু নেমে যায় সিঁড়ি দিয়ে। রিশু বেড়িয়ে যেতেই ভীষণ ভাবে একা মনে হয় ওর। একেবারে এক নতুন জগতে ঢুকে পড়েছে ঝিনুক। চারপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে জরিপ করে নেয়, আজ থেকে এটাই ওর গন্ডী এখানেই ওকে থাকতে হবে। বসার ঘরটা বেশ ছোট, একটা মাত্র লম্বা সোফা পাতা আর সোফার পেছনে একটা প্লাস্টিকের টেবিল আর দুটো চেয়ার পাতা। এক কোনায় একটা ফ্রিজ, একদিকের দেয়ালে একটা টিভি, পাশে একটা ছোট রান্নাঘর। বসার ঘরের এক পাশে পাশাপাশি দুটো ঘর, মনে হয় ওই দুটো শোয়ার ঘর। একটা ছোট পরিবার থাকার মতন যথেষ্ট। পুরো ফ্লাটটা দেখে মনে হল কোলকাতায় রিশুদের বাড়ির বসার ঘরটা মনে হয় এর চেয়েও বড়। মনে মনে হেসে ফেলে ঝিনুক, টেবিলে একটা গ্লাসে আধা খাওয়া জল মনে হয়। চেয়ারে একটা নোংরা জিন্স ঝুলছে, রান্নাঘরের দিকে উঁকি মেরে দেখে সিঙ্কে বাসন পরে রয়েছে, কাজের লোক আছে না নেই, নাকি এইসব কাজ ওকেই করতে হবে? কিঞ্চিত অস্বস্তি বোধ করে ঝিনুক, ও এখানে কাজের লোক হিসাবে এসেছে নাকি যে রোজ সকালে উঠে রান্না করবে বাসন মাজবে ঘর ঝাড়ু দেবে? বাড়িতে কাজের লোক ছিল বাড়ির কাজের জন্য, মা রান্না করত, কোনদিন রান্না ঘরে পর্যন্ত ঢোকেনি, হ্যাঁ ম্যাগি চা ডিম সেদ্দ এইসব বানাতে জানে কিন্তু এর বেশি ওর দৌড় নয়। এক ধাক্কায় ওর সীমানা এত ছোট হয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারেনি। দরজা বন্ধ করার শব্দ পেতেই সারা শরীর কেঁপে ওঠে ওর। গতরাতে বাড়িতে না হয় সবাই ছিল, সেখানে চেঁচালে হয়ত কেউ ওর ডাক শুনে ওকে বাঁচাতে আসত, কিন্তু এই দূর দেশে এই একাকী এক ফ্লাটের মধ্যে বন্ধ দরজার পেছনে ওর সাথে কি করবে রিশু? রিশুর দিকে তাকিয়ে দেখে, দুটো বড় বড় সুটকেস দুইতলা পর্যন্ত টেনে উঠিয়ে হাপিয়ে গেছে।
রিশু ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে রান্নাঘর থেকে একটা জলের বোতল এনে বেশ কয়েক ঢোক জল খেয়ে ওর দিকে জলের বোতল এগিয়ে দেয়। চারপাশে তাকিয়ে নিজের ঘরের অবস্থা দেখে বেশ বিব্রত বোধ করে। এতদিন বন্ধ থাকার ফলে বেশ নোংরা হয়ে গেছে চারদিক। বারান্দার দিকের একটা জানালা মনে হয় খোলা ছিল বলে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া ঘরের হাওয়া ঠান্ডা করে দিয়েছে।
একটা বড় শোয়ার ঘরের মধ্যে ঝিনুকের বড় সুটকেস রেখে ওকে বলে, “তুমি ফ্রেস হয়ে নাও।”
বুকের মধ্যে হাপর টানছে ঝিনুকের তাও বাধ্য মেয়ের মতন মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে বলে, “হ্যাঁ যাচ্ছি।”
চোখ ঘুরিয়ে রিশুকে দেখে ঝিনুক, শোয়ার ঘরের বিছানাটা বেশ বড় তার পাশের ঘরে একটা ছোট খাট আর একটা চেয়ার। নিজের ছোট সুটকেস নিয়ে বড় শোয়ার ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে ঝিনুক। ঠিক সেই সময়ে ঝিনুকের ফোন বেজে ওঠে। ফোন তুলে দেখে ওর মা ফোন করেছে। মেয়ে ঠিক ভাবে বাড়িতে পৌছাল কি না সেটা সব বাবা মায়ের বড় চিন্তার বিষয়।
ফোন তুলে উত্তর দেয় ঝিনুক, “হ্যাঁ মা, বাড়ি পৌঁছে গেছি ভালো ভাবে।”
ওর মা ওকে বলে, “সাবধানে থাকিস। এবারে বুঝে শুনে সব কিছু মানিয়ে চলিস। বুঝতেই পারছিস...”
কথাটা শেষ করতে দেয় না ঝিনুক, “কি বুঝবো একবার বলবে?”
পিয়ালী তাও মেয়েকে শান্ত হওয়ার জন্য বলে, “দ্যাখ বড় হয়েছিস, বিয়ে হয়ে গেছে কচি খুকি নয় তুই। রিশু তোর থেকে বয়সে অনেক বড় একটু মান সন্মান রেখে চলিস। যে অবস্থায় বিয়ে হয়েছে তাতে তোকে এইসব মানিয়ে নিয়েই চলতে...”
শেষ বাক্য কানে যেতেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঝিনুক, “হ্যাঁ, সব কিছু ত আমাকেই মানিয়ে নিতে হবে। আমি এখানে দোষী আমি খারাপ।”
পিয়ালী মেয়েকে বলে, “তুই দোষী না খারাপ সেটা তোকে বলিনি, একটা নতুন জীবন শুরু করতে গেলে অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে হয়। তোর জেদ...”
চেঁচিয়ে ওঠে ঝিনুক, “হ্যাঁ সারা জীবন আমার জেদ, আমার খামখেয়ালিপনাই এইসব দেখে গেলে তোমরা। কি মানিয়ে নেব? সকাল থেকে প্রায় একশো বার কানের কাছে এক কথা ঘ্যানর ঘ্যানর করে চলেছ, মানিয়ে নিবি মানিয়ে নিবি, ওর সামনে জেদ করবি না, ও যা বলবে শুনবি, ওর সাথে ঝগড়া করবি না। কেউকি ওকে একবার ও বলেছে আমার সাথে মানিয়ে নিতে? কেউ কি ওকে একবারের জন্য বলেছে আমার কি চাই না চাই সেটা বুঝতে? নাহ, যেহেতু সব দোষ আমার সুতরাং সব কিছু চুপচাপ আমাকেই মেনে নিতে...”
দরজার দিকে চোখ যেতেই থমকে যায় ঝিনুক, রিশু ওর দিকে নিস্পলক চোখে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে। মায়ের কথা শুনে রিশুর দিকে দেখে একদম সহ্য হয় না ওর, রাগে দুঃখে চরম ঘৃণায় সর্বাঙ্গ রিরি করে জ্বলে ওঠে। দড়াম করে রিশুর মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দেয় ঝিনুক।
রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে হটাত করে এইভাবে ঝিনুককের আচরনে ভীষণ আহত হয় রিশু। চোয়াল কঠিন হয়ে যায় ক্রোধে, কারুর ওপরে এইভাবে চেঁচিয়ে কথা বলা রিশুর একদম পছন্দ নয়। হাত মুঠো করে নিজের আবেগ আয়ত্তে নিয়ে আসে। ছোট বেলা থেকে ওর মা ওকে শিখিয়েছে, রাগ করবে না, রেগে মেগে কোনদিন কোন সমস্যার সমাধান হয় না। বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে সেই সমস্যার আসল কারন খুঁজে তার বিহিত করবে। ডাক্তারি পড়ার সময় থেকেই ওর মা ওকে বলেছিল যে এরপর ডাক্তার হবে, চোখের সামনে প্রচুর রুগী দেখবে, তাদের দুঃখ কষ্ট শুনে যেন ভাবাবেগে বয়ে না যায় তাহলে অপারেশান করার সময়ে হাত কাঁপবে সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরে ঘুমাতে পারবে না। সেই জন্য মায়ের কথা মেনে রোজদিন প্রাণায়াম করে রিশু, ভাবাবেগকে আয়ত্তে রাখার জন্য রোজদিন অন্তত আধ ঘন্টা চোখ বন্ধ করে ধ্যান করে। কিন্তু পাশের ঘরে মেয়েটা যে ওর রোগী নয়, কচি একটা মেয়ে, সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী।
ছোট ঘরের মধ্যে ঢুকে বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ খাটের ওপরে বসে থাকে আর ভাবে একবার মাকে ফোন করবে। ভীষণ কান্না পায় ওর, কিন্তু ওর চোখে জল দেখলে ওর মা থাকতে পারবে না, নিজেকে দোষী ভেবে নেবে আর নিজেকে কষ্ট দেবে, মায়ের সেই কষ্ট দেখতে চায় না রিশু। কি ভাবে ছোটবেলা থেকে ওকে বুকের মাঝে আঁকরে ধরে মানুষ করেছে সেটা ওর অজানা নয়। ওর কাপড় জামা সব কিছুই পাশের ঘরের আলমারিতে। মা ভাই বোন এলে তবেই এই ঘরে শোয়া হয় না হলে এটা ওর পড়ার ঘর। জুতো খুলে বাথরুমে ঢুকে পরিষ্কার হয়ে নেয়। পাশের ঘরের বন্ধ দরজায় কান পাততে একদম ইচ্ছে করে না। যা খুশি করছে করুক, বাকি জীবন না হয় এই বিশাল রঙমঞ্চে মেকি হাসি নিয়ে কাটিয়ে দেবে।