What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

শেষের পাতায় শুরু (7 Viewers)

পর্ব তিন – (#2-11)

চন্দ্রিকার আদি বাড়ি কইম্বাটুরে, ওর বাবা কর্মসূত্রে চেন্নাই থাকেন। চন্দ্রিকা দিল্লীতে একটা আইটি কোম্পানিতে চাকরি করে। সিআর পার্কের কাছেই এক ফ্লাটে কয়েকজন বান্ধবী পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকে। তামিল মেয়ে তাই মাছ খেতে খুব ভালোবাসে। রিশুও জানায় যে বাঙ্গালীদেরও মাছ খুব প্রিয় কিন্তু ও মাছ রান্না করতে পারে না। সেটা শুনে খুব হেসেছিল চন্দ্রিকা, বলেছিল ওর জন্য মাছ বানিয়ে খাওয়াবে। সামান্য পরিচয় থেকে কয়েক দিনের মধ্যে এক মিষ্টি ভালোলাগার ভাব এসে যায় চন্দ্রিকা আর রিশুর মধ্যে। মাঝেই মাঝেই ফোনে কথাবার্তা হয়, হসপিটালের কাজের চাপে কোন কোন দিন যদিও বা রিশু ফোন করতে ভুলে যায় কিন্তু চন্দ্রিকা একদম ভোলে না। চন্দ্রিকা মাঝে মাঝেই অফিস থেকে বেড়িয়ে চলে আসত হসপিটালে রিশুর সাথে দেখা করতে।

এমবিবিএস এর পরে রিশুর ইচ্ছে ছিল কোলকাতা ফিরে গিয়ে ওইখানের কোন মেডিকেল কলেজ থেকে এমএস করে। মায়ের শাসনের ফলে ছোট বেলা থেকে পড়াশুনায় রিশুর মাথা খুব ভালো, এইইমস এই পরীক্ষা দিল আর এক বারেই পেয়ে গেল অরথপেডিক নিয়ে এমএস করার। মাম্মা আর পাপা খুব খুশি হয়েছিল, দিয়া একটু মন মরা হয়ে গিয়েছিল কারণ দাদাভাইকে আরো বেশ কয়েক বছর দিল্লীতে থাকতে হবে শুনে।

সেদিন ছিল রবিবার কিন্তু রিশুর ছুটি ছিল না, এমারজেন্সিতে ডিউটি ছিল সেদিন ওর। বাইরে কাঠফাটা রোদ, এমারজেন্সিতে একের পর এক পেসেন্ট এসেই চলেছে। দুপুরের পরে মিটিং রুমে অন্য বন্ধুদের সাথে বসে একটু আড্ডা মারছিল এমন সময়ে একজন এসে ওকে বলে যে এমারজেন্সিতে একটা মেয়ে ওর খোঁজ করছে। কৌতূহল জাগে, এই কাঠ ফাটা রোদ্দুর মাথায় করে দিল্লীর এই গরমে কোন মেয়ে ওর জন্য এমারজেন্সিতে অপেক্ষা করছে। বাইরে বেড়িয়ে এসে চন্দ্রিকাকে দেখে অবাক হয়ে যায় রিশু।

জিজ্ঞেস করে, “এই সময়ে তুমি এখানে?”

মিষ্টি হেসে চন্দ্রিকা উত্তর দেয়, “তুমি ত আর নিজের থেকে মাছ খেতে পার না তাই কাল পমফ্রেট কিনেছিলাম সেটা তোমার জন্য এনেছি।”

রিশু হেসে ফেলে, আসে পাশের বেশ কয়েক জন ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেয়। রিশু চন্দ্রিকাকে বলে, “বিকেলে আসতে পারতে, এই রোদ্দুর মাথায় করে এই গরমে আসার কি দরকার ছিল।”

চন্দ্রিকা গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমানি কণ্ঠে বলে, “দেখা করতে এসেছি বলে তোমার অসুবিধে হচ্ছে যাও আমি চলে যাচ্ছি।”

রিশু ওর হাত ধরে ফেলে, “যা বাবা আমি কখন বললাম যে আমি রাগ করেছি।”

চন্দ্রিকা নাক কুঁচকে হেসে বলে, “আমরা কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব?”

মাথা চুলকে আশেপাশে দেখে রিশু বলে, “এমারজেন্সি ডিউটি, এ ছেড়ে ত যেতে পারব না চন্দ্রিকা। তবে...” বলে ওর হাত ধরে এমারজেন্সি থেকে বেড়িয়ে এসে বলে, “চল ক্যান্টিনে গিয়ে বসি।”

ক্যান্টিনের দিকে যেতে যেতে চন্দ্রিকা জিজ্ঞেস করে, “খুব চাপ দেখছি?”

মাথা দোলায় রিশু, “বিশাল চাপ, নাওয়া খাওয়ার পর্যন্ত সময় থাকে না একদম। একের পর এক পেসেন্ট আসতেই থাকে এখানে। এই দেখ পরশু দিন একজন পা ভেঙ্গে এসেছিল, পাঁচ ঘন্টা টানা অপারেশান করে চোদ্দটা স্ক্রু লাগিয়ে হাড় জোড়া লাগাতে হয়েছে।”

চোখ বড়বড় করে বলে চন্দ্রিকা, “পাঁচ ঘন্টা!”

রিশু মাথা দোলায়, “পাঁচ ঘন্টা, তবে আমি করিনি। আমি এসিস্টেন্ট ছিলাম।”

ডাক্তারদের ক্যান্টিন অন্যদিনের তুলনায় সেদিন অনেক ফাঁকা ছিল, বেশির ভাগ টেবিলেই জোড়ায় জোড়ায় বসে প্রেমিক দম্পতি। চন্দ্রিকা ফিক করে হেসে রিশুকে বলে, “এখানেও প্রেম চলে দেখছি।”

হেসে ফেলে রিশু, “যা বাবা, প্রেমের জন্য কি আর জায়গার দরকার পরে নাকি? দরকার পরে দুই বিটিং হারট, এক সাথে ধুক ধুক করা দুই হৃদয়।”

লাজুক হেসে রিশুর বাম বাজু জড়িয়ে ধরে বলে, “তোমারটা কি বলে তাহলে?”

চন্দ্রিকার কাজল কালো বড় বড় দুই চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “তুমি বল কি বলে।”

ওই ভাবে তাকাতেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় চন্দ্রিকা, নরম ঠোঁট দাতে চেপে চোখ নামিয়ে বলে, “ওই ভাবে একদম আমার দিকে তাকাবে না। চল ওদিকে গিয়ে বসি।”

রিশু মুচকি হেসে কাছে টেনে বলে, “কি এমন দেখালে যে অমন করে দেখতে পারি না।”

রিশুর বুকের ওপরে আলতো চাঁটি মেরে বলে, “ধ্যাত শয়তান। ডাক্তারদের ভালো ভাবেই জানা আছে, কত সুন্দরী নার্স সুন্দরী মেয়ে ডাক্তারদের সাথে কত কিছু কর।”

হেসে ফেলে রিশু, কথাটা একদম আমুলক মিথ্যে নয়, ওর ব্যাচের অনেকের একাধিক সম্পর্ক, সে ছেলেই হোক অথবা মেয়েই হোক, তবে রিশু একটু আলাদা ছিল, বুকে না ধরলে কাউকে সেখানে স্থান দিত না। বিশেষ করে ওর কোনদিন ইচ্ছে ছিল না যে ওর স্ত্রী অথবা প্রেমিকা একি পেশায় নিযুক্ত হোক। তাই কোনদিন কোন নার্স অথবা কোন ডাক্তারের সাথে ওর কোন ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল না, ওদের ব্যাচের মধ্যে পড়াশুনায় বেশ নাম ছিল ওর আর বড্ড ঘরকুনে আর মায়ের নেওটা বলে বদনাম ও ছিল। একটা খালি টেবিল দেখে দুইজনে বসে পরে। আসে আসে পাশের অনেকেই চেনা জানা, তার মধ্যে কয়েকজন ওর ব্যাচমেট। ওদের দেখে কয়েক জন চোখের ইশারা করে, তার উত্তরে রিশুও চোখের ইশারায় জানিয়ে দেয় নিজের প্রেমের কথা।

পাশাপাশি বসে রিশুর বাজুর ওপরে ঝুঁকে পরে চন্দ্রিকা, রিশুর বাম কাঁধের ওপরে মাথা রেখে নিচু গলায় বলে, “তোমার ছুটি কখন হবে?”

রিশু উত্তর দেয়, “দেরি আছে গো।”

বেশ কিছুক্ষন দুইজনেই চুপ করে একে অপরের সানিদ্ধ্য উপভোগ করে। বেশ কিছুক্ষন পরে মাছের কথা খেয়াল পরে চন্দ্রিকার, সঙ্গে সঙ্গে টিফিন খুলে বলে, “ইসসস দেখেছ, তোমার জন্য সব ভুলে যাই। পম ফ্রেট এনেছিলাম।”

টিফিন বক্স খুলতেই মাছের গন্ধ নাকে ভেসে আসে, “বেশ ভালো রান্না করেছ দেখছি। আর কি কি পার?”

মাছের একটু টুকরো ভেঙ্গে রিশুর দিকে উঁচিয়ে বলে, “খেয়ে দেখ তাহলে।”

এইভাবে সবার সামনে চন্দ্রিকার হাত থেকে মাছ খেতে ভীষণ লজ্জা করে রিশুর, “আমি নিজে খেতে পারি।”

মুচকি হাসে চন্দ্রিকা, “আমার হাত থেকে খেতে লজ্জা করছে?”

রিশু হেসে বলে, “মাছের সাথে আমি কিন্তু তাহলে হাত ও খেয়ে নেব।”

দুজনে মিলে গল্প করতে করতে অনেকটা সময় কাটিয়ে দেয়। খাওয়া শেষে রিশু ওকে বলে, “এবারে আমাকে যেতে হবে।”

মুখ শুকনো হয়ে যায় চন্দ্রিকার, খানিক আবদার করে বলে, “আচ্ছা কি আর করা যাবে, আমি এখানে তোমার জন্য তাহলে অপেক্ষা করি আর কি করব।”

হেসে ফেলে রিশু, “পাগল নাকি তুমি, বাড়ি যাও আমার কতক্ষনে ডিউটি শেষ হবে জানি না।”

দুইজনের মধ্যে কারুর ইচ্ছে ছিল না সেদিন একে অপরকে ছেড়ে যায়, কিন্তু চন্দ্রিকা জানে, রিশু একজন ডাক্তার রোগীদের প্রতি ওর দ্বায়িত্ত সব থেকে আগে। ক্যান্টিন ছেড়ে বেড়িয়ে করিডোর ধরে দুইজনে পাশাপাশি হেঁটে চলে গল্প করতে করতে। হটাত পাশের একটা খালি ঘরের মধ্যে রিশু ওকে টেনে নিয়ে যায়। আচমকা খালি ঘরের মধ্যে টেনে আনার কারণ বুঝতে পারে না চন্দ্রিকা, রিশুর দিকে হাজার প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে, কি হল হটাত।

চন্দ্রিকার অপেক্ষাকৃত পাতলা কোমর দুই বলিষ্ঠ হাতে জড়িয়ে ধরে রিশু, বুকের কাছে টেনে ফিসফিস করে বলে, “তোমার কিছু খাওয়ানর ছিল তাই না।”

দুই দেহের মাঝে হাত নিয়ে এসে রিশুর প্রসস্থ বুকের ওপরে হাতের পাতা মেলে ওর দিকে দুষ্টু মিষ্টি হাসি নিয়ে তাকিয়ে বলে, “আচ্ছা এই ছিল তোমার মনে...”

কথাটা আর শেষ করতে পারে না চন্দ্রিকা, রিশুর মাথা নেমে আসে চন্দ্রিকার মুখের ওপরে। চন্দ্রিকার সারা মুখের ওপর অনবরত বয়ে চলে রিশুর উষ্ণ প্রেমের শ্বাস। আসন্ন চুম্বনের অপেক্ষায় নিমিলিত হয়ে যায় চন্দ্রিকার চোখ জোড়া, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ওর। রিশুর ঠোঁট নেমে আসে চন্দ্রিকার ঠোঁটের ওপরে। ঠোঁট জোড়া মিলিত হতেই চন্দ্রিকা রিশুর মাথার চুল দুই হাতে আঁকড়ে ধরে গভির করে নেয় সেই চুম্বন। প্রেমে বিভোর দুই প্রেমিক প্রেমিকা হারিয়ে যায় নিজেদের মধ্যে।

বেশ কিছুক্ষন পরে ঠোঁট ছেড়ে চন্দ্রিকা ওর বুকের ওপরে মাথা রেখে বলে, “একা পেয়ে বেশ বাগিয়ে নিলে তাই না?”

নাকের ওপরে নাক ঠেকিয়ে আদর করে উত্তর দেয় রিশু, “এইভাবে চুরি না করলে আর দিতে নাকি?”

প্রসস্থ ছাতির ওপরে আলতো প্রেমের চাঁটি মেরে বলে চন্দ্রিকা, “এইবারে আর দেরি হচ্ছে না তাই না?”

হেসে ফেলে রিশু, “ডিউটি না থাকলে সারাক্ষন এইভাবে তোমাকে জড়িয়ে ধরে থাকতাম।”

লজ্জায় লাল হয়ে যায় চন্দ্রিকা, “আচ্ছা বাবা সে যখন হবে তখন দেখব কতক্ষন আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকো।”

চন্দ্রিকাকে কিছুতেই ছাড়তে চাইছিল না রিশু, কিন্তু বারেবারে ফোন আসায় ওকে সেদিন চলে যেতে হয়েছিল এমারজেন্সিতে। প্রথম চুম্বনে হারিয়ে যাওয়ার অনাবিল আনন্দে সেদিন আর কাজে মন বসেনি রিশুর। চন্দ্রিকার সাথে রাতের বেলা অনেকক্ষণ কথা বলেছিল, বলেছিল নিজের বাড়ির কথা, দিয়া আর দিপের কথা। রিশু জানিয়েছিল যে এমএস শেষ করার পরে ওর কোলকাতা ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে আছে, চন্দ্রিকা একটু দ্বিধাবোধ করেছিল সেই শুনে।

মাকে সব কিছু বললেও রিশু প্রথমে চন্দ্রিকার কথা লুকিয়ে গিয়েছিল, ওর মনে একটা দ্বিধা ছিল যে চন্দ্রিকা দক্ষিণ ভারতীয় মেয়ে, মা মেনে নেবে কি না সেটা সন্দেহ ছিল। ভেবেছিল এমএস করার পরে মাকে জানাবে সব কথা। কিন্তু মায়ের মন, আম্বালিকার চোখ একদিন রিশুর মনের কথা পড়ে ফেলে। চন্দ্রিকার সাথে দেখা হওয়ার বেশ কয়েক মাস পরের ঘটনা। ওকে অবাক করে দেবে বলে সেবার রিশুকে না জানিয়ে দিপ আর দিয়াকে নিয়ে দিল্লী আসে আম্বালিকা। বাড়ির একটা চাবি ওর কাছে থাকত তাই রিশুর অবর্তমানে বাড়িতে ঢুকতে ওদের কোন অসুবিধে হয়নি। সেদিন লেকচারের পরে চন্দ্রিকার সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। সিনেমা দেখার পরে একটা রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। দরজায় তালা দেখতে না পেয়েই বুঝতে পেরেছিল যে মা এসেছে। দরজায় টকটক করতেই ছোট দিপ দরজা খুলে এক লাফে ওর কোলে উঠে যায়।

দিয়া দৌড়ে এসে দাদাভাইকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, “কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বল।”

এইভাবে না বলে আগে কোনদিন ওর মা দিল্লী আসেনি তাই বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল রিশু। আম্বালিকা মাতৃ স্নেহে বড় ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলে, “একদম রোগা হয়ে গেছিস। কাজের মেয়েটা কি ঠিক করে রান্না করে যায় না নাকি?”

মায়ের শিতল হাতের ছোঁয়ায় হৃদয় কাতর হয়ে ওঠে, কিন্তু ছোট ভাই বোনের সামনে এমন ভাবে আদর খেতে খুব বাধে তাই হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, “ধ্যাত তুমি না প্রত্যেক বার এক কথা বল। সেই ভাবে দেখতে গেলে আমি এতদিনে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেতাম।”

রাতের খাওয়ার সময়ে রিশু বিশেষ কিছু খেতে পারে না কারণ চন্দ্রিকার সাথে রাতের খাওয়া খেয়েই ফিরেছে। পেট খারাপের অজুহাত দেয় কিন্তু ছেলের চেহারা দেখে আম্বালিকার মনে সন্দেহ হয়। রাতের খাওয়ার পরে অন্য সব বারের মতন দিপ আর দিয়া ওর ঘরেই ঘুমিয়ে পরে। দিপ আর দিয়া ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে আম্বালিকা রিশুকে বসার ঘরে ডাকে।

রিশু মনে মনে প্রমাদ গোনে, “কি হয়েছে বল।”

আম্বালিকা রিশুকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করে, “বান্ধবীর নাম কি?”

মায়ের কাছে ধরা পড়তেই রিশু থতমত খেয়ে, কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে হাতের নখ খুটতে খুটতে মায়ের প্রশ্নের উত্তরে বলে, “বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছলাম বললাম ত।”

রিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলে, “নাম কি ওর যার সাথে সিনেমা দেখতে গেছিলি?” ধরা পরে গেছে রিশু। “তোর মুখ দেখে আমি বুঝতে পারি তুই হা করলে হাসবি না হাঁচি দিবি।”

মাকে শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে ধরে রিশু, “না মাম্মা সত্যি শুধু মাত্র ভালো বান্ধবী।”

হেসে ফেলে আম্বালিকা, “কি নাম সেই বান্ধবীর যার জন্য আমার ছেলের কান লজ্জায় লাল হয়েছে?”

রিশু উত্তর দেয়, “চন্দ্রিকা পশুপতি, তামিল মেয়ে, কৈমবাটুরে বাড়ি।”

ধরা পরে গেছে রিশু, আর লুকিয়ে লাভ নেই তাই মায়ের কাছে চন্দ্রিকার পরিচয় দেয়, কোথায় থাকে কোথায় চাকরি করে ইত্যাদি। উত্তরে আম্বালিকা ওকে বলে যে আগে এমএস ঠিক ভাবে পাশ করতে হবে তবে চন্দ্রিকার সাথে দেখা করতে চায়। পরের দিন চন্দ্রিকাকে সাথে নিয়ে আসে মায়ের সাথে দেখা করানোর জন্য। অজানা এক ভয়ে সারা রাস্তা রিশুর হাত শক্ত করে ধরে থাকে আর বারবার প্রশ্ন করে, ওর মা ওদের এই সম্পর্ক মেনে নেবে ত? রিশু অভয় দেয়, ওর মা ভালোবাসা বোঝে শুধু একবার চন্দ্রিকার সাথে দেখা করতে চায়। চন্দ্রিকার সাথে দেখা হওয়ার পরে আম্বালিকার পছন্দ হয় ওকে, বেশ মিষ্টি মেয়ে একদম বাংলা বুঝতে পারে না, কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই মায়ের সাথে বেশ মিশে রান্নাঘরে দুইজনে মিলে মাছ রান্নাতে ব্যাস্ত হয়ে যায়। দিয়া সেই দেখে মুখ টিপে হেসে বলেছিল, এরপর ওদের নারকেল তেল দেওয়া রান্না খেতে হবে।

❤️ "শেষের পাতায় শুরু" ❤️
 
পর্ব তিন – (#3-12)

সেবার কোন এক কারনে তিনদিনের ছুটি পেয়েছিল রিশু। ঘরকুনে ছেলে, সকালেই কোলকাতার ফ্লাইটের টিকিট কেটে নিয়েছিল ছিল তাই বিকেলে হসপিটাল থেকেই সোজা এয়ারপোরটে পৌঁছে গিয়েছিল। এর আগেও বেশ কয়েকবার বাড়িতে না জানিয়ে বাড়ির সবাইকে চমক দেবে বলে এইভাবে গেছে। আর প্রত্যেক বার রাতের ফ্লাইটে বাড়ি পৌঁছাতে দেরি হয়ে যেত, ওর মা ঘুমিয়ে পড়ত আর সেই জন্য খুব বকা খেত। তবে সেই বকুনির মধ্যে কতটা স্নেহ আর ভালোবাসা লুকিয়ে সেটা অনুধাবন করতে পারত রিশু। ছেলে বড় হয়ে গেলেও, রাতের বেলা পৌঁছালেই কান টেনে মৃদু বকুনি দেওয়া চাই, একবার বলতে পারতিস না? কি খাবি এই রাতে? দিপ আর দিয়া নাচানাচি শুরু করে দিত। রাতের বেলাতেই ওর মা প্রেসার কুকারে ডালে চালে বসিয়ে দিত আর সেই সাথে রাগে গজগজ করত যতক্ষণ না সেই ছোট বেলার মতন রিশু মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলবে, মাম্মা প্লিজ। বর্ষাকাল ছিল তখন, ঝমঝম করে বৃষ্টি নামার ফলে ফ্লাইট একটু লেট। বিকেলে ফোনে কথা হয়েছিল মায়ের সাথে, দিপ দিয়ার সাথে কিন্তু ঘুনাক্ষরেও বুঝতে দেয়নি যে ও আসছে। তাই তখন ফোন দেখতে দেখতে মনে মনে হেসে ফেলছিল মাঝে মাঝে।

ঠিক সেই সময়ে চন্দ্রিকার ফোন পেয়ে বেশ ভালো লাগে রিশুর, “অফিস কেমন গেল?” জিজ্ঞেস করে চন্দ্রিকাকে।

চন্দ্রিকা উত্তর দেয়, “গেছে এই আর কি। খুব বৃষ্টি হচ্ছে জানো।”

হাসে রিশু, “হ্যাঁ মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে, দেখো এই একটু খানি হবে আর থেমে যাবে...”

কথাটা টেনে নিয়েই চন্দ্রিকা হেসে বলে, “ব্যাস রাস্তা ঘটা গুলো সব ডুবে যাবে...”

রিশু ইয়ার্কি মেরে বলে, “তুমি নৌকা নিয়ে নেমে পড়বে।”

খিলখিল করে হেসে ফেলে চন্দ্রিকা, “তুমি দাঁড়ে বসবে আমি পাল তুলবো।” একটু থেমে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে, “তুমি বাড়ি কখন ফিরছ?” কেমন যেন একটু আনমনা ওর কন্ঠের স্বর, “এই আসব তোমার ফ্লাটে?”

নিচের ঠোঁট চেপে হেসে ফেলে রিশু, “না গো আমি মানে বাড়ি যাচ্ছি।”

অবাক হয়ে যায় চন্দ্রিকা, “আরে হটাত করে, কি ব্যাপার?”

রিশু জানায় ওকে, “মাকে সারপ্রাইজ দেব তাই।” বলেই হেসে ফেলে।

চন্দ্রিকা হয়ত ভেবেছিল যে সেই রাতে রিশুর ফ্লাটে একত্রে কাটাবে। ভীষণ মা ভক্ত ঘরকুনে ছেলে, কথায় কথায় মায়ের রান্না ভালো, মা এই করে দেয়, মা ওই করে বলতে থাকে।

একটু মনক্ষুন্ন হয়ে রিশুকে বলে, “একবার এই ভাবে না গেলে কি এমন হত?”

কথাটা শুনে একটু আহত হয় রিশু তাও চন্দ্রিকাকে বলে, “আরে বাবা, তোমার সাথে ত রোজদিন দেখা হয়ে যায় মায়ের সাথে ত হয় না।” একটু থেমে হেসে বলে, “আমার রান্নার লোক একদম ডাল বানাতে জানে না তাই মাঝে মাঝে মায়ের হাতের ডাল খেতে খুব ইচ্ছে করে।”

আহত হলেও চন্দ্রিকা মুখে হাসি টেনে বলে, “আচ্ছা আমি এরপর তোমার মায়ের মতন ডাল রান্না করা শিখে নেব আর তোমাকে ডাল বানিয়ে খাওয়াব।”

মাথা নাড়ায় রিশু, মায়ের হাতের ডালের মধ্যে যে মিষ্টতা লুকিয়ে সেটা কারুর দ্বারা রান্না করা সম্ভব নয়। ওই ডালের মধ্যে মায়ের ভালোবাসা মায়ের স্নেহ মায়ের বকুনি মায়ের আশা ভরসা মিশে থাকে, অন্য কেউ সেই ডাল কি করে বানাবে?

একটু হেসে উত্তর দেয় রিশু, “আচ্ছা ঠিক আছে।”

চন্দ্রিকা জিজ্ঞেস করে, “ফিরছ কবে?”

রিশু উত্তর দেয়, “তিন দিন পরে।”

চন্দ্রিকা চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে, “তিনদিন পরে? বাপরে, এই তিনদিন ছুটি ছিল ভেবেছিলাম এক সাথে কাটাবো। ধ্যাত তুমি না শুধু বাড়ি আর বাড়ি।”

শেষের কথাটা খুব খারাপ লাগে রিশুর, হ্যাঁ ওর কাছে ওর বাড়ি সব থেকে আগে। মাকে ছেড়ে দিল্লীতে একদম আসতে চায়নি, অনেক ঘ্যানর ঘ্যানর করেছিল কিন্তু ওর পড়াশুনার জন্যেই ওর মা ওকে এই দুরদেশে পাঠিয়েছে। ছোট বেলা থেকে ওকে ক্ষনিকের জন্য চোখের আড়াল হতে দেয়নি ওর মা, রিশু ভালো ভাবেই জানে বুকের ওপরে কত বড় পাথর রেখে ওর মা ওকে এতদুরে ডাক্তারি পড়াতে পাঠিয়েছে। চন্দ্রিকার সাথে কথা বলার ইচ্ছেটাই চলে যায় ওর।

ওকে কাটানর জন্য বলে মুখে হাসি টেনে বলে, “এই শোন, বোর্ডিং কল হচ্ছে। আমি কাল ফোন করব।”

চন্দ্রিকা মুখ ব্যাজার করে উত্তর দেয়, “বাড়ি গেলে তুমি কি আর আমাকে ফোন করবে নাকি? আচ্ছা কাল অপেক্ষা করব দেখি তুমি ফোন কর কি না।”

সারাটা রাস্তা চন্দ্রিকার কথা রোমন্থন করে “ধ্যাত শুধু বাড়ি আর বাড়ি” আর ভাবে, এখন থেকেই ওর বাড়ি যাওয়া নিয়ে মুখ গোমড়া করতে শুরু করে দিয়েছে, এরপরে কি করবে জানা নেই। রিশুর ইচ্ছে এমএস এর পরে কোলকাতা ফিরে যাওয়ার, কিন্তু চন্দ্রিকার সাথে এখন পর্যন্ত সেই বিষয়ে কোন কথাবার্তা হয়নি ওর। শেষের কথা শুনে ওর মনে হল যে কোলকাতা গিয়ে ওদের বাড়ির সাথে হয়ত তেমন ভাবে মিশতে পারবে না চন্দ্রিকা। কোলকাতা পৌঁছে যথারীতি চন্দ্রিকা কে রাতেই ফোন করেছিল রিশু। রাতে অনেকক্ষণ দুজনে মিলে গল্প করেছিল। সেবার ওর মা বেশ কয়েকটা দামী সুতির জামা কিনে দিয়েছিল। রিশু কোনদিন নিজের জামা কাপড় কেনেনি, এমন কি ওর পরনের গেঞ্জি গুলো পর্যন্ত মা কিনে দেয়। প্রত্যেক বার এসে মায়ের কাছে বকুনি খায়, তোর এই গেঞ্জিটা এইভাবে বগল থেকে ছিঁড়ে গেছে একটা কিনতে পারিস নি? অপরাধীর মতন মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে হেসে ফেলত রিশু। রিশু মাঝে মাঝেই বাড়ির গল্প করত চন্দ্রিকার কাছে, রিশুর জামা কাপড় এমন কি গেঞ্জি পর্যন্ত ওর মা কিনে দেয় সেটা শুনে চন্দ্রিকা খুব হেসেছিল। রিশুর একটু খারাপ লেগেছিল বটে কিন্তু হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল সেই কথা। পরে অবশ্য ওর মনে হয়েছিল তখন যদি চন্দ্রিকাকে ঠিক ভাবে বুঝিয়ে উঠতে পারত ওদের বাড়ির সম্পর্ক তাহলে হয়ত রিশুকে সঠিক ভাবে চিনতে পারত চন্দ্রিকা।

কোলকাতা থেকে ফিরে আসার কয়েক মাস পার হয়ে যায়। সেইদিন কথা ছিল হসপিটাল শেষে কাছাকাছি কোন এক রেস্টুরেন্টে রাতের খাওয়া সারবে। ওপিডিতে ডিউটি ছিল তখন, ছুটি হতে হতে সন্ধ্যে গড়িয়ে যায়।

বারেবারে চন্দ্রিকার ফোন আসাতে একটু বিরক্তি প্রকাশ করেই বলে, “বললাম ত আসছি, এত বার করে ফোন করছ কেন?”

চন্দ্রিকা ঘাবড়ে যাওয়ার পাত্রি নয়, হসপিটালের ওপিডি ব্লকেই প্রায় আধা ঘন্টা অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে তাই একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, “আধা ঘন্টা হয়ে গেল আমি দাঁড়িয়ে আছি, একবার বলতে পারতে যে সময় নেই তাহলে আসতাম না।”

কথাটা শুনে রিশু একটু রেগে যায়, চাপা গলায় ফোনে বলে, “দেখো আমি ডাক্তার ডিউটিতে আছি এখন। যতক্ষণ না আমার কাজ শেষ হচ্ছে ততক্ষন আমি আসতে পারব না।”

অন্যপাশ থেকে ঝাঁঝিয়ে ওঠে চন্দ্রিকা, “হ্যাঁ জানা আছে, এখন যদি তোমার মা এসে দাঁড়িয়ে থাকত তাহলে তুমি দৌড়ে আসতে তাই না?”

কথাটা শুনতেই ওর মনে হল কেউ যেন ওর কানে গরম লাভা ঢেলে দিয়েছে। হাত মুঠো করে ক্রোধ সংবরণ করে দাঁতে দাঁত পিষে উত্তর দেয় রিশু, “আমার মা হলে এইভাবে বার বার ফোন করে জ্বালাতন করত না আমাকে। আমার মা জানে আমি কোথায় আছি কি করছি আর কাজ শেষ হলেই যে আসব সেটা আমার মা বোঝেন।”

কথাটা যে ঠিক হয়নি সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না চন্দ্রিকার, তাই ক্ষমা চেয়ে নেয়, “না রিশু সরি আমি তেমন ভাবে বলতে চাইনি কথাটা।”

চোয়াল চেপে রিশু উত্তর দেয়, “দ্বিতীয় বার এই কথা একদম বলবে না যে মায়ের জন্য এটা করতে মায়ের জন্য ওটা করতে।”

সেদিন অবশ্য তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বেড়িয়ে এসেছিল রিশু। সহজে রেগে যাওয়ার পাত্র নয় কিন্তু মায়ের নামে অথবা বাড়ির কারুর নামে কোন দ্বিরুক্তি শুনতে নারাজ। রিশুর শেষ বাক্য শুনে চন্দ্রিকা বুঝতে পারে ওর ওইভাবে কথাটা বলা একদম ঠিক হয়নি। চুপচাপ রিশুর অপেক্ষা করেই দাঁড়িয়েছিল ওপিডিতে। রিশু নিজের কাজ শেষ করে বেড়িয়ে এসে দেখে একটা চেয়ারে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে চন্দ্রিকা। চন্দ্রিকার ওই অবস্থা দেখে রিশু মনে মনে হেসে ফেলেছিল, হয়ত ওই ভাবে চোয়াল চেপে কথাটা বলা ওর ঠিক হয়নি, কিন্তু বাড়ির কাউকে নিয়ে ওই ভাবে কোন তৃতীয় ব্যাক্তি যদি কিছু বলে তাহলে কি আর চুপ করে থাকা যায়। চন্দ্রিকার সামনে দাঁড়িয়ে গলা খ্যাঁকরে নিজের আসার জানান দেয় রিশু। চন্দ্রিকা অপরাধীর মতন এক হাসি দিয়ে ক্ষমা চায় রিশুর কাছে।

বাইকের পেছনে চেপে, চন্দ্রিকা ওকে পেছন থেকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে আদুরে কন্ঠে বলে, “রাগ করেছ আমার ওপরে?” কান ধরে আদুরে কন্ঠে বলে, “এই দেখো কান ধরছি আর বলব না।”

পিঠের ওপরে চন্দ্রিকার নধর কোমল দেহবল্লরীর উষ্ণ চাপে মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে যায় রিশুর, মাথা দুলিয়ে হেসে ফেলে শেষ পর্যন্ত, “তুমি না সত্যি। আচ্ছা বল কোথায় যাবে?”

চন্দ্রিকা ওর বাম কাঁধের ওপরে থুঁতনি রেখে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, “কোথায় নিয়ে চলেছ ডক্টর?”

হেলমেট পড়া ছিল তাই বাঁচোয়া না হলে চন্দ্রিকার উষ্ণ শ্বাসের ফিসফিসানিতে সেদিন নির্ঘাত একটা এক্সিডেন্ট করে বসত রিশু। “তোমায় একদিন কামড়ে খাবো বুঝলে।”

চন্দ্রিকার কোমল চাঁপার কলির মতন আঙ্গুল গুলো মেলে ধরে রিশুর প্রসস্থ বুকের ওপরে, জামা খামচে ধরে পেছন থেকে, নিজেকে ঢেলে উজাড় করে দেয় রিশুর পিঠের ওপরে, “খাও কে বারন করেছে।”

হেসে ফেলে রিশু, চন্দ্রিকা যেভাবে ওকে জড়িয়ে উত্তেজিত করে তুলছে ওর মাথা ঠিক রাখা দায় হয়ে পড়েছে, শরীরের প্রত্যেকটা স্নায়ু যেন উন্মুখ হয়ে ওঠে প্রেয়সীর ত্বকের সাথে মিশিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু ওদের এলাকায় রিশুকে সবাই চেনে, বিশেষ করে নিচের তলার বুড়ো প্রমথেশ বাবু, উদ্ভিন্ন যৌবনা কোন মেয়েকে দেখতে পেলেই হল, ক্ষুধার্ত হায়নার মতন লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে সেই নারীর শ্লীলতা হানি করে শুধু মাত্র চোখ দিয়েই। চন্দ্রিকা যখনি ওর ফ্লাটে যেত তখনি কোন না কোন আছিলায় প্রমথেশ বাবুর ওর বাড়ি আসা চাই, আজকে জ্বর হয়েছে কোন ওষুধ আছে কি তোমার কাছে? ভীষণ পেট খারাপ একটা ট্যাবলেট পেলে বড় ভালো হত, অথবা একটু প্রেসার টা চেক করে দেবে ডাক্তার? এই প্রমথেশ বাবুর জ্বালায় চন্দ্রিকা ওর বাড়িতে আসা কমিয়ে দিয়েছিল, তাই আর সেই ভাবে চন্দ্রিকার সাথে একান্তে বসে কোনদিন প্রেমালাপ করা সম্ভব হয়নি ওর।

সেদিন একটা শপিং মলে গিয়ে দুজনে শুধু ঘুরেই বেড়িয়েছিল, অগত্যা ওই যে “খেতে কে বারন করেছে” সেই খাওয়া আর হয়নি ওদের। তবে রাতের দিকে দুজনে মিলে বেড়িয়ে পড়েছিল একটা হাইওয়ে ধরে। শহর ছাড়িয়ে বেশ অনেক দূরে একটা ধাবায় রাতের খাওয়া সেরেছিল। সেদিন দুজনের একদম ইচ্ছে ছিল না একে অপর কে ছাড়ে। কিন্তু পরের দিন রিশুর হসপিটাল ডিউটি ছিল আর চন্দ্রিকার অফিস, অগত্যা ফিরে আসতে হয় ওদের। সারাটা রাস্তা চুপ করে রিশুর পিঠের ওপরে মাথা রেখে গাল ঠেকিয়ে বসেছিল চন্দ্রিকা, এমন ভাবে পেছন থেকে জাপ্টে ধরেছিল রিশুকে যেন কোন শক্তি ওদের বিচ্ছেদ করতে সক্ষম নয়। চন্দ্রিকা যেখানে পেয়িং গেস্ট থাকত, সেই বাড়ির সামনে পৌঁছে যখন বাইক দাঁড় করায়, তখন চন্দ্রিকার চোখে প্রেমের এই ক্ষনিকের বিচ্ছেদের জন্য একটু জল এসে গিয়েছিল। রিশুর একবার মনে হয়েছিল নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় চন্দ্রিকাকে, সারা রাত ধরে প্রেম আর ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয় হৃদয় জুড়ে থাকা এই মিষ্টি মধুর প্রেমিকাকে। হাত ধরে আঙ্গুলে চুমু খেয়ে বাইক নিয়ে ফিরে এসেছিল রিশু। সেই রাতে দুইজনের মধ্যে কারুর ঘুম হয়নি।

❤️ "শেষের পাতায় শুরু" ❤️
 
পর্ব তিন – (#4-13)

এমবিবিএস পড়ার সময় থেকেই ইন্দ্রজিতের সাথে ওর পরিচয়, এক ব্যাচের বন্ধু। ডাক্তারি পাশ করার পরে ইন্দ্রজিত এক জুনিয়ার ডাক্তার, শালিনীর প্রেমে পাগল। ইন্দ্রজিতের বাড়ি চণ্ডীগড়ে আর শালিনী হরিদ্বারের মেয়ে। শালিনী বেশ মিশুকে মেয়ে অনায়াসে সবার সাথে মিশে যেতে পারত, রিশুকে দাদা হিসাবে সন্মান করত শালিনী। তবে ইন্দ্রজিতের একটা বদ অভ্যেস ছিল, কোন মেয়ে যদি একটু ওর দিকে ঢলে পড়ত তাহলে ইন্দ্রজিত নিজেকে একদম সামলাতে পারত না, কোন না কোন আছিলায় সেই মেয়ের সাথে প্রেমের ঢলানিতে ঢলে যেত। শালিনীর সাথে প্রেম করার সময়েও ওর এই স্বভাব বদলায়নি, এই নিয়ে শালিনীর সাথে অনেকবার ঝগড়া মন কষাকষি হয়েছে, রিশুও ওকে অনেকবার এইসব করতে বারন করেছে, কয়েক মাসের জন্য সব কিছু বন্ধ থাকার পরে আবার সেই পুরানো স্বভাব ফিরে আসে ইন্দ্রজিতের। বারবার বারন করা সত্ত্বেও শালিনীর অবর্তমানে ইন্দ্রজিত বেশ কয়েক জন মেয়ের সাথে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিল, সেটা রিশুর অজানা ছিল না।

সেদিন ওপিডিতে ডিউটি ছিল রিশুর, দুপুরের দিকে হটাত ওর হসপিটালে শালিনী এসে উপস্থিত, বলে যে ওর বাড়ির চাবি চাই। রিশু বুঝে যায় যে নিশ্চয় আবার ইন্দ্রজিতের সাথে রাগারাগি হয়েছে। শালিনীকে বাড়ির চাবি দিয়ে বুঝায় যে হসপিটাল থেকে ফিরে সোজা ইন্দ্রজিতের সাথে দেখা করে একটা ফয়সলা করবে। শালিনী বিশেষ কথা না বাড়িয়ে জল ভরা চোখে ওর হাত থেকে বাড়ির চাবি নিয়ে চলে যায়।

বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যায় রিশুর, দরজায় নক করতেই দরজা খুলে যায়। বসার ঘরে পা রেখে শালিনীর বিধ্বস্ত চেহারা দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। সোফার ওপরে ওর একটা শারট গায়ে অর্ধ শায়িত শালিনীকে দেখেই রিশুর মনে দুশ্চিন্তা জেগে ওঠে। শালিনী ওর দিকে ভগ্ন হৃদয়ে তাকায়, দুই চোখের কোলে জল টলমল করছে, এক হাতে মদের গেলাস অন্য হাতের দুই আঙ্গুলের মাঝে একটা আধা জ্বলা সিগারেট। ঘর ভর্তি সিগারেটের বোটকা গন্ধ যেটা রিশুর একদম সহ্য হয় না। শারটের সামনের দিকে বেশ কয়েকটা বোতাম খোলা, অনায়াসে বুঝে যায় যে ওই শারটের নিচে কিছুই পরে নেই শালিনী। এলোমেলো মাথার চুল, চোখে চুড়ান্ত নেশার ঘোর, ঘাড়ে গালে লাল দাগ মনে হয় দাঁতের, সুগোল মোটা ঊরুর ওপরে নখের আঁচর। মেঝের ওপরে শালিনীর পরনের পোশাক এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, সোফার পাশেই একটা অর্ধেক শেষ হয়ে যাওয়া মদের বোতল। শালিনীর এই অবস্থা দেখে রিশুর চোয়াল কঠিন হয়ে যায়, কিন্তু ওর নিজের ঘরের এই অবস্থার কারণ খুঁজে পায় না।

রিশু ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসতেই রিশুর কলার ধরে কেঁদে ফেলে শালিনী, “ইওর সিস্টার ইজ আর হোড় ডক্টর অম্বরীশ, তোমার বোন একজন বেশ্যা হয়ে গেছে।”

শালিনীর হাত থেকে মদের গেলাস কেড়ে নেয়, সিগারেট নিভিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি করেছ তুমি? তোমার এমন অবস্থা কেন?”

চোয়াল চেপে কাঁপা গলায় উত্তর দেয় শালিনী, “আই ফাকড আ গাই, আমি একজনের সাথে সেক্স করেছি, ভাইয়া।” ভাঙা বুক নিয়ে পাগলের মতন হেসে ওঠে শালিনী, “যদি ইন্দ্রজিত অন্য মেয়ের সাথে শুতে পারে তাহলে আমি কেন পারব না? আমিও তাই অন্য একজনের সাথে সেক্স করেছি।” বলেই ওর বুকের ওপরে মাথা রেখে কেঁদে ফেলে।

রিশু শালিনীর মুখ আঁজলা করে ধরে জিজ্ঞেস করে, “ইন্দ্রজিত কি করেছে?”

উলটো হাতে চোখ নাক মুছে সম্পূর্ণ বিবরন দেয় শালিনী, “আমি কয়েক দিনের জন্য বাড়ি গিয়েছিলাম, আমার আজকে ফেরার কথাও ছিল না। গতদিন যখন ইন্দ্রজিতের সাথে কথা হল তখন আমার একটু সন্দেহ হয়েছিল, মনে হল কিছু একটা লুকাচ্ছে। আমিও রাতের বাস ধরে হরিদ্বার থেকে ওকে না বলেই রওনা দিলাম, সকালে এসে দিল্লী পৌঁছে সোজা বাড়ি গেলাম। আমাকে এই সময়ে বাড়ির দরজায় দেখতে পাবে সেটা একদম আশা করেনি। ভীষণ ভাবেই আশ্চর্য হয়ে যায় ইন্দ্রজিত, চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। ওর ইতস্তত ভাব দেখেই বুঝতে পারি কিছু একটা লুকাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে, সঠিক উত্তর দিতে পারল না। শোয়ার ঘরের দিকে যেতেই আমার পথ আটকে দাঁড়িয়ে পরল, আমার মাথায় রক্ত চেপে গেল, বুঝে গেলাম কামুক স্বভাবের সেই পুরানো ইন্দ্রজিত ফিরে এসেছে। ওকে ঠেলে দিয়ে দরজা খুলতেই দেখি আমার বিছানায় এক অর্ধ উলঙ্গ মেয়ে ঘুমিয়ে। আমার সারা শরীর ঘৃণায় রিরি করে জ্বলে উঠল, দিগ্বিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটাকে সপাটে এক চড় কসিয়ে দিলাম। ঘুমন্ত মেয়েটা হটাত করে ওইভাবে চড় খেয়ে ধরমর করে উঠে বসে। ইন্দ্রজিত আমাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে, আমি ইন্দ্রজিতকে যথেচ্ছ গালিগালাজ করে জিনিস পত্র লন্ডভন্ড করে বেড়িয়ে এলাম বাড়ি থেকে। কি করব ভাইয়া, বলতে পার? আমি ত শুধুমাত্র ইন্দ্রজিতকেই মন থেকে ভালোবেসে ছিলাম ভাইয়া।”

কথা গুলো শুনতে শুনতে রিশুর চোয়াল শক্ত হয়ে যায় রাগে। শালিনী তারপরে বলে, “বাড়ি থেকে বেড়িয়ে কোথায় যাবো, কারুর কাছে যেতে ইচ্ছে করল না। তারপরে ভাবলাম, আমার ভাইয়া আছে ওর বাড়িতে যাবো। তাই হসপিটাল গিয়ে তোমার কাছ থেকে চাবি নিয়ে তোমার বাড়ি চলে এলাম। বসে বসে অনেকক্ষণ কাঁদলাম, কিন্তু মন কে কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারলাম না। আমিও ভাবলাম যে আমিও অন্যের সাথে শোব, ওকে দেখাব যে আমিও করতে পারি তখন হয়ত বুঝবে যে প্রেমে এইভাবে ভীষণ ধাক্কা খেলে কেমন লাগে। আমি ইন্টারনেট খুলে গিগোলো খুঁজলাম, খুঁজে পেলাম একটা ছেলেকে। বললাম যে টাকা দেব এসে আমার সাথে উদ্দম সেক্স করতে হবে। তোমরা ছেলেরা সব এক জাত, পায়ের মাঝের কুকুরটাকে সামলে রাখতে পার না। এক কথায় রাজি হয়ে গেল ছেলেটা, ওকে বললাম যে হুইস্কি আর সিগারেট নিয়ে এস। এল সে ছেলেটা, জানি না কে, নামটাও হয়ত ভুয়ো।” দুই চোখে অঝোর ধারায় বন্যা বয়ে চলেছে শালিনীর, রিশুর বুকের ওপর আছড়ে বলে, “আই হ্যাড আ অয়াইল্ড সেক্স, পাগলের মতন সেক্স করেছে আমার সাথে। আমি ছেলেটাকে খুব মেরেছি আর গালাগালি দিয়েছি, চুপ করে সব শুনে গেছে। আমি সেই ভিডিও ইন্দ্রজিত কে পাঠিয়ে দিয়েছি।”

সব কিছু শোনার পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিশু, ইন্দ্রজিতের ওপরে ভীষণ ক্রোধে সারা শরীর জ্বলে ওঠে। এই অচেনা দেশে কেউই কারুর হয় না, সবাই কোন মতলবে বন্ধুত্ত পাতায়, সেখানে ইন্দ্রজিতের সাথে একমাত্র ওর ভালো সম্পর্ক ছিল। সেই সুত্রে শালিনীর সাথে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে যায় রিশুর। যতদিন শালিনীর সাথে ওর প্রেম হয়নি ততদিন রিশু ওকে বারন করত না। কিন্তু শালিনীর সাথে প্রেম করার পরে রিশু বারন করে অন্য মেয়েদের দিকে তাকাতে, অন্য কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখতে। হটাত ছেলেটার কি যে হয়ে গেল, এবারে শেষ বারের মতন একটা বোঝা পরা করতে হবে ওর সাথে।

ইন্দ্রজিতের সাথে এখুনি একবার কথা বলা দরকার, ফোন উঠাতেই শালিনী ওর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলে, “না ভাইয়া আর নয় আর তুমি ওকে ফোন করবে না। ওর সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে।”

রিশু ওকে বুঝানোর শেষ চেষ্টা করে বলে, “তাও একবার ওর সাথে কথা বলতে দাও।”

শালিনীর চোখ জোড়া বুজে আসে, মাথা ধরে টলে পরে রিশুর দিকে, সেই সাথে হড়হড় করে বমি করে দেয়। রাগে দুঃখে এতক্ষন যত মদ খেয়েছিল সব রিশুর গায়ের ওপরে বমি করে দেয়। থরথর করে বার কয়েক সকেঁপে ওঠে শালিনীর দেহ, বমি করে চোখ বুজে নিস্তেজ হয়ে ঢলে পরে রিশুর গায়ের ওপরে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে রিশু, সারা জামায় বমির দুর্গন্ধে রিরি করে ওঠে ওর শরীর। তাও নিস্তেজ হয়ে যাওয়া শালিনীর দেহ পাঁজাকোলা করে তুলে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুয়েই দেয়। বমি করে এতটাই নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল শালিনী যে চোখ খুলে দেখার মতন শক্তি টুকুও ছিল না ওর দেহে। শালিনীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে এসে চোখ মুখ মুছিয়ে দেয়। শালিনী ততক্ষনে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে শালিনীর দিকে তাকিয়ে দেখে, ঊরুর ভেতর দিকের নরম মাংসে, দুই পেলব বাজুতে নখের আঁচর, ঘাড়ে কাঁধে দাঁতের দাগ, মেয়েটাকে সেই ছেলেটা নরখাদক রাক্ষসের মতন সম্ভোগ করেছে। চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসার যোগার হয় ওর।

বাথরুমে ঢুকে জামা কাপড় খুলে স্নান সেরে বেড়িয়ে আসতেই আরো এক আশাতীত চমক ওর জন্যে ওর বসার ঘরে অপেক্ষা করেছিল, চন্দ্রিকা। ঘরে ঢুকে শালিনীর ওই অবস্থা দেখে হয়ত দরজা বন্ধ করতেই ভুলে গিয়েছিল রিশু। চন্দ্রিকার চোখের দিকে তাকিয়ে রিশু বুঝে যায় যে ওর ঘরের এই দুরাবস্থা দেখে ওর মনের মধ্যে হাজার প্রশ্নের ঝড় উঠেছে।

চোয়াল চেপে কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে রিশুকে, “এসবের মানে কি অম্বরীশ?”

রিশু তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে মুচকি হেসে বলে, “কেমন আছো?”

ঝাঁঝিয়ে ওঠে চন্দ্রিকা, “এসবের মানে কি অম্বরীশ?”

চড়া গলার আওয়াজ শুনে দাঁড়িয়ে পরে রিশু, ওর দিকে হাত তুলে থামিয়ে বলে, “কিসের মানে জানতে চাইছ?”

মেঝের ওপরে ছড়ান শালিনীর জামাকাপড় আর মেঝেতে পড়া মদের বোতল দেখিয়ে বলে, “তুমি নাকি ড্রিঙ্ক কর না, তুমি নাকি সিগারেট খাও না? আর এই মেয়েদের পোশাক এইভাবে তোমার মেঝেতে ছড়িয়ে?” শোয়ার ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে দেখে বিছানায় অর্ধ নগ্ন শালিনী রিশুর একটা জামা গায়ে বেহুঁশ হয়ে ঘুমিয়ে। কাঁপা কন্ঠে চাপা চেঁচিয়ে ওঠে রিশুর দিকে, “শেষ পর্যন্ত তুমি আমার সাথে...”

রিশু চোয়াল চেপে দাঁত পিষে উত্তর দেয়, “তুমি যা ভাবছ তার বিন্দুমাত্র কিছুই সত্য নয়। এইসব দেখে তুমি যা ধারনা করছ ……”

ছলছল চোখে চেঁচিয়ে ওঠে চন্দ্রিকা, “আমি যা দেখছি তা সব মিথ্যে? সেই দুপুর থেকে তোমাকে ফোন করে যাচ্ছি, এক বারের জন্যেও আমার ফোন রিসিভ করনি। তুমি ব্যাস্ত জানি তাই ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরলে একটু গল্প করব, কিন্তু তুমি যে এইভাবে এত ব্যাস্ত সেটা ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি। তুমি কি না শেষ পর্যন্ত নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের প্রেমিকার সাথে সেক্স করলে?”

ভীষণ রেগে যায় রিশু, চন্দ্রিকার দিকে আঙ্গুল তুলে গর্জে ওঠে, “চুপ, একদম চুপ, আগে আমার কথা ঠিক করে শোন তারপরে নিজের কথা বলবে।”

চন্দ্রিকা কিছুই শুনতে নারাজ, চেঁচিয়ে ওঠে রিশুর দিকে, “কি ভাবতে বলছ অম্বরীশ, তোমার বিছানায় তোমার জামা পরে শালিনী শুয়ে রয়েছে, দেখেই বোঝা যায় ওর গায়ে শারট ছাড়া আর কিছুই নেই। এইদিকে তুমি শুধু মাত্র একটা তোয়ালে কোমরে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছ। শালিনীর জামা কাপড় থেকে পরনের অন্তর্বাস পর্যন্ত তোমার ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সিগারেট আর মদের গন্ধে ঘরে টেকা দায়। এইসব দেখার পরেও তুমি বলবে যে তুমি কিছু করনি? তুমি নাকি শালিনীকে বোন বলে ডাকো? ও নাকি তোমাকে রাখী পড়িয়েছে, এই তোমাদের ভাই বোনের সম্পর্ক?”

শেষের কথাটা কানে যেতেই মাথায় রক্ত চেপে যায় রিশুর, চোয়াল চেপে চন্দ্রিকার দিকে আঙ্গুল তুলে দরজা দেখিয়ে বলে, “তোমার যখন আমার প্রতি কোন বিশ্বাস নেই, তুমি যখন আমার কথা কিছু শুনতে চাইছ না তখন বেড়িয়ে যাও বাড়ি থেকে। মিস চন্দ্রিকা পশুপতি, আমার মা ছাড়া অন্য কারুর কাছে আমি জবাবদিহি দিতে নারাজ। আমি আজ পর্যন্ত আমার মা ছাড়া অন্য কারুর সামনে মাথা নত করিনি, এমন কি পাপার সামনেও নয়। তবে যাওয়ার আগে একটা কথা জেনে রাখো, ভুল আমি নই ভুল তুমি করছ।”

খোলা দরজা দিয়ে ভাঙা বুক নিয়ে সেদিন বেড়িয়ে যায় চন্দ্রিকা, সেদিনের পরে আর কোনদিন ওদের দেখা হয়নি, সেটাই ছিল ওদের শেষ দেখা। চন্দ্রিকা বেড়িয়ে যাওয়ার পরে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসেছিল রিশু, রাগে দুঃখে সারা শরীর জ্বলে উঠেছিল ওর, ভালোবাসার অপর নাম বিশ্বাস, সেই বিশ্বাস যখন নেই তখন ভালোবাসার ওপর থেকে বিশ্বাসটাই চলে যায়। রিশু এটাও বুঝতে পেরেছিল যে চন্দ্রিকা কোনদিন হয়ত কোলকাতা যেত না, হয়ত ওকে জোর করত দিল্লীতেই থেকে যেতে, ওর বাড়ির সাথে যে মানিয়ে নিতে পারবে না সেটা অবশ্য অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিল রিশু। সেদিন প্রতিজ্ঞা করে রিশু আর কাউকে প্রেম করবে না, কোন তৃতীয় ব্যাক্তিকে নিজের পরিবারের মধ্যে টেনে আনবে না।

❤️ "শেষের পাতায় শুরু" ❤️
 
পর্ব তিন – (#5-14)

প্রত্যেক দিনের মতন সেদিন রাতে যখন মায়ের সাথে কথা হয়েছিল, মা ওর গলার আওয়াজ পেয়েই বুঝে গিয়েছিল কিছু একটা হয়েছে। মাকে সব কথা খুলে জানিয়েছিল রিশু, সাথে এটাও জানিয়ে দিয়েছিল জীবনে কাউকেই আর বিয়ে করবে না, কারণ ও চায়না কোন তৃতীয় ব্যাক্তি এসে ওদের পরিবারের মাঝে কোন ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করুক। আম্বালিকা বার দুয়েক চেষ্টা করেছিল রিশুকে বুঝাতে, কিন্তু রিশু চন্দ্রিকার কাছে জবাবদিহি দিতে নারাজ, ভুল সে করেনি সুতরাং কারুর সামনে ঝুঁকতে নারাজ, এক অহম বোধ সেদিন কাজ করেছিল ওর মধ্যে।

সেই রাতে ইন্দ্রজিত ওর বাড়িতে এসেছিল, রিশুর সাথে খুব ঝগড়া হয়েছিল, রাগের বশে রিশু ইন্দ্রজিতের কলার চেপে ধরে এক ঘুষিতে নাক ফাটিয়ে দিয়েছিল। সেদিনের পরে প্রায় দুই বছর, রিশুর সাথে ইন্দ্রজিতের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, শালিনীর সাথেও ইন্দ্রজিতের সম্পর্ক বিচ্ছন্ন হয়ে যায়। দুই বছর পরে শালিনী আর ইন্দ্রজিতের মধ্যে আবার নতুন করে প্রেমের দানা বাঁধে। ততদিনে ইন্দ্রজিত অনেক শুধরে যায়। ওদের এমএস শেষ হওয়ার পরে ইন্দ্রজিত আর শালিনীর বিয়ে হয়।

মাঝে মাঝেই শালিনী আক্ষেপ করে রিশুকে বলে, “ভাইয়া, আমার জন্য তোমার ভালোবাসা তোমাকে হারাতে হল।”

ম্লান হাসে রিশু, “যে প্রেমে বিশ্বাস নেই সেটা প্রেম নয়, সেটা নিছক একটা রঙ্গিন ধোঁয়া।”

প্লেন এবারে নিচের দিকে নামতে শুরু করে দিয়েছে, সিট বেল্ট বেঁধে নেওয়ার এনাউন্সমেন্ট হতেই জানালার বাইরে দেখে রিশু। ছোট ছোট আলো গুলো একটু একটু করে বড় হতে শুরু করে দিয়েছে। পারস খুলে একটা হাল্কা গোলাপি রঙের কাগজ বের করে দেখে, কি কারনে এই কাগজ রেখে দিয়েছিল সেটা আর মনে নেই তবে মনে হয়েছিল রেখে দেয়। একবছর আগে চন্দ্রিকার লেখা চার পাঁচ লাইনের একটা ছোট চিঠি।

“ডিয়ার ডক্টর অম্বরীশ সান্যাল, আমি জানি না কে ভুল কে ঠিক, তবে তুমি সেদিন যেভাবে আমার বুক ভেঙ্গে দিয়েছিলে তারপরে মানুষের ওপর থেকে ভালোবাসার ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। আমি দিল্লী ছেড়ে ফিরে যাই চেন্নাইয়ে। এক সপ্তাহ পরেই আমার বিয়ে। এই চিঠি এই কারনে লেখা কারণ তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা আর এত বছর পরেও আমি তোমাকে ভুলতে পারিনি। পারলে উত্তর খুঁজো নিজের কাছে, কেন তুমি আমার সাথে এত বড় প্রতারনা করলে। ইতি তোমার চন্দ্রিকা।”

যে ভালোবাসায় বিশ্বাস নেই সেই ভালোবাসার কোন অর্থ নেই। মা ওর জন্য মেয়ে দেখেছে, মায়ের কথা অমান্য করার সাধ্য ওর নেই। শেষ বারের মতন চিঠিটা পড়ে, ছিঁড়ে ফেলে রিশু। চন্দ্রিকা চলে যাওয়ার পরে একাকীত্ব কাটানোর জন্য পড়াশুনা নিয়েই পরে থাকত রিশু, ইতিমধ্যে ওর বেশ কয়েকটা পেপার দেশ বিদেশের বেশ কয়েকটা মেডিকেল জার্নালে ছাপা হয়েছে। মেধাবী ছাত্র আর ভালো সার্জেন হিসাবে অরথপেডিক বিভাগে ওর বেশ নাম হয়েছে।

প্লেন থেকে নেমে মোবাইল খুলে দেখে মায়ের আর বোনের প্রচুর মিসকল। মাকে ফোন করে জানতে পারে যে দিপ আর দিয়া এয়ারপোর্টে ওকে আনতে গেছে। ঘড়ি দেখল রিশু, রাত প্রায় তিনটে বাজে, এত রাতেও ওর ভাই বোনের চোখে ঘুম নেই ভাবতেই হাসি পায়। বুঝতে পেরে যায় যে ওদের আনন্দের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। ব্যাগ নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এসে দেখে ওর জন্য অধীর অপেক্ষায় দিয়া আর দিপ। রিশুকে দেখতে পেয়েই দিপ দৌড়ে দাদাকে জড়িয়ে ধরে, পেছনেই দিয়া তার সাথে অচেনা একটা মেয়ে।

ঝিলিক রিশুকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে, পার্থের সাথে ওর দিদি কয়েক বার দেখা করিয়েছিল, সত্যি বলতে পার্থকে একদম পছন্দ হত না ওর। কেমন যেন গায়ে পড়া ছেলেটা, শুধু ছুতো খুঁজত ওর গায়ে একটু হাত লাগানোর। এমনিতেই দিদি তখন প্রেমে বিভোর ছিল তাই পার্থের কোন দোষ দেখতে পেত না। দিয়ার দাদাকে দেখে মনে হল, ভদ্রলোক সম্পূর্ণ এক ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। বেশ লম্বা চাওড়া, প্রসস্থ কাঁধ, চোখে চশমা, চোখ দুটো ভীষণ বুদ্ধিদীপ্ত, চেহারা দেখলেই বোঝা যায় বেশ শান্ত প্রকৃতির ছেলে। পরনের পোশাক খুব সাধারন হাল্কা হলদে রঙের জামা আর একটা গাড় নীল রঙের জিন্স আর একটা মোটা জ্যাকেট। এ নাকি এইএমেস এর ডাক্তার, ভাবতেই কেমন যেন লাগে ওর। হয়ত যারা সত্যিকারের শিক্ষিত তাদের এই পোশাক আসাকে বিশেষ রুচিবোধ হয়ত থাকে না।

দিপ দাদার বাজু ধরে ঝুলে আবদার করে বলে, “এবারে কিন্তু দিদির মতন আমার একটা ট্যাব চাই।”

রিশু ভাইয়ের কান টেনে আদর করে উত্তর দেয়, “তোর হাত ভাঙা আমি বের করে দেব। আগামি সপ্তাহ থেকে ক্লাস টেস্ট শুরু, আজকে ত পড়াশুনা কিছুই করিস নি মনে হচ্ছে।”

দিপ উত্তরে বলে, “আরে বাবা একটা দিন ত, স্কুলের পরেই ত এই বাড়িতে এসেছি।”

দিয়া দাদাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ফ্লাইটে ঘুম হয়নি মনে হচ্ছে?” বলেই ঠোঁট চেপে হেসে ফেলে। প্রতিবার এই ধরনের প্রশ্ন দাদাভাইকে করে ওর মা।

বোনের কান ধরে টেনে আদর করে বলে, “তোদের জ্বালায় কি আর ঘুম হয়? বিকেলে তোর হোয়াটসাপে ফিসিক্সের প্রাক্টিকালের যে ডায়াগ্রামটা পাঠিয়েছিলাম সেটা কি খাতায় করেছিস?”

দিয়া আদুরে কন্ঠে উত্তর দেয়, “প্লিজ দাদাভাই এখন থেকেই তুমি আমার পড়াশুনা নিয়ে পড়বে?” বলে ঝিলিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, “এটা ঝিলিক, ঝিনুক দিদির বোন আর আমার প্রিয় বান্ধবী।”

আলতো মাথা নুইয়ে ঝিলিক রিশুর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, রিশু হাত মিলিয়ে দিয়ার কানে কানে প্রশ্ন করে, “ব্যাপারটা একটু ঝেড়ে কাশ ত?”

হেসে ফেলে দিয়া, “ওদের বাড়ি চল মাম্মা তোমাকে সব বলবে।” ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন নিয়ে তাকাতেই দিয়া দাদার হাত ধরে টেনে বলে, “চলত আগে, বাড়ি গিয়ে মাম্মার মুখে সব শুনতে পারবে।”

বোনের মাথায় আদর করে চাঁটি মেরে বলে, “বলবি না ত, ঠিক আছে, এইত তোর দাদার প্রতি ভালোবাসা...” বলেই হেসে ফেলে।

দিয়া মুখ ব্যাজার করে মুচকি হেসে উত্তর দেয়, “তুমি না সত্যি ইমোশানাল ব্লাকমেল করতে ওস্তাদ।”

রিশু মুচকি হেসে বলে, “লিভাইসের জিন্স...”

দিয়া চোখ বড়বড় আদর আবদার করে, “প্লিজ দাদাভাই ওটা চাইইইই চাই।”

রিশু হেসে বলে, “আচ্ছা বাবা দেব বলেছি ত, তবে রেজাল্ট দেখে।”

গাড়িতে চেপে রওনা দেয় ওরা, এর মাঝে আরো একবার মায়ের ফোন আসে রিশুর কাছে। সামনের সিটে দিপ, পেছনের সিটে ঝিলিক আর রিশুর মাঝে দিয়া বসে। ঝিলিক পাশে বসে তিন ভাই বোনের এই নিবিড় সম্পর্ক দেখে আর মনে মনে হাসে। দিল্লীর এইএমএসের নাম কারুর অজানা নয়, বিখ্যাত সেই মেডিকেল কলেজ হসপিটালের অরথপেডিক সারজেন ওর বান্ধবীর দাদাভাই, নিশ্চয় ভীষণ ব্যাস্ত মানুষ, কাজের সময়ে হয়ত নাওয়া খাওয়ার সময় থাকে না। তাও ভাইয়ের কবে পরীক্ষা, বোনের প্রাক্টিকালের জন্য কোন ডায়াগ্রামের প্রয়োজন, ভাইয়ের কি চাই বোনের কি চাই সব মনে আছে। সব থেকে আশ্চর্য যেটা লাগে ওর যে ভাইয়ের হাত ভেঙ্গেছে শুনে সেই রাতেই দৌড়ে এসেছে দেশের অপর প্রান্ত থেকে।

বাড়ির দিকে যেতে যেতে, দিয়া মোবাইল খুলে নাম পরিচয় না জানিয়েই ঝিনুকের ছবি দেখিয়ে দাদাকে প্রশ্ন করে, “দাদাভাই একে কেমন দেখতে?”

ছবির দিকে একবার তাকিয়ে দেখে রিশু, বেশ সুন্দরী, ফর্সা গায়ের রঙ, হাসিটা ভীষণ মিষ্টি। বাড়ন্ত দেহের গঠন হলেও চেহারায় সুমধুর কচি কচি ভাব। মুখ দেখে মেয়েটার বয়স আন্দাজ করতে চেষ্টা করে, ওর চেয়ে অনেক ছোট নিশ্চয় বয়সে।

মাথা দোলায় রিশু, ছোট্ট উত্তর দেয়, “মন্দ নয়।”

ভুরু কুঁচকে তাকায় দিয়া, “ব্যাস এইটুকু?”

রিশু হেসে প্রশ্ন করে, “তুই সামনা সামনি দেখেছিস?”

মাথা দোলায় দিয়া, “হ্যাঁ, আসলে কিন্তু এই ছবির চেয়েও ভীষণ সুন্দরী দেখতে।” বলেই ফিক করে হেসে ফেলে।

রিশু মাথা নাড়ায় আর হাসে, “আমাকে বলির পাঁঠা পেয়েছিস তোরা আর কি।”

দিয়া বড় হয়েছে, অনেক কিছু এখন বুঝতে শিখেছে, জানে চন্দ্রিকার কথা তাই দাদার হাত চেপে বলে, “আমি জানি এইভাবে তোমাকে ডেকে নিয়ে আসা একদম উচিত হয়নি কিন্তু আর কোন উপায় ছিল না দাদাভাই।”

হেসে ফেলে রিশু, ওর সেই ছোট বোন আর সেই ছোট নেই, চোখের সামনে দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল। বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সস্নেহে মাথায় চুমু খেয়ে বলে, “ওরে আমার ঠাকুমা রে, তুই যে দেখতে দেখতে এত বড় হয়ে গেলি সেটা টের পেলাম না।”

দিপ সামনের সিট থেকে দিদিকে চেঁচিয়ে বলে, “ও বাবা, তুই একা বড় হয়েছিস নাকি?”

রিশু ছোট্ট ভাইয়ের মাথায় আলতো চাঁটি মেরে উত্তর দেয়, “না না, তুই ত একেবারে শাল গাছ হয়ে গেছিস।”

=============== পর্ব তিন সমাপ্ত =============

❤️ "শেষের পাতায় শুরু" ❤️
 
পর্ব চার – (#1-15)

রিশু প্লেন থেকে নেমে বাড়ির দিকে রাওনা দিয়েছে খবর পেতেই পীয়ালির বাড়িতে খুশির আমেজ ছড়িয়ে যায়। সোমনাথ আর পীয়ালি কি ভাবে রিশুকে এই রাতে আপ্যায়ন করবে ভেবেই কূল কিনারা পায় না। আম্বালিকার বড় ছেলে সেই সাথে আবার বেশ বড় ডাক্তার, তাল ঠিক রাখতে পারে না পীয়ালি।

আম্বালিকার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে মানে তোর ছেলে কি খেতে ভালোবাসে?”

হেসে ফেলে আম্বালিকা, “তুই এত উত্তেজিত কেন হচ্ছিস? এত রাতে আবার রান্না করতে যাস নে।”

সোমনাথ কি করবে ভেবে পায় না, “না মানে প্রথম বার আসছে তাও আবার এই ভাবে, মানে কি করব ঠিক ভেবে পাচ্ছি না।”

পিয়ালী তাও নাছোড়বান্দা, ফ্রিজে একটু কাঁচা চিকেন ছিল সেটা বের করে বলে, “চিকেন আর লুচি বানিয়ে দেব?”

আম্বালিকা ওদের শান্ত হতে বলে, “কিচ্ছু করতে হবে না। এত রাতে হয়ত কিছু খাবেই না।” বলেই হেসে ফেলে। কিছুক্ষন থেমে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে পীয়ালিকে বলে, “তুই যা একবার ঝিনুকের কাছে, ওর সাথে কথা বল।”

সোমনাথ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “না মেয়েকে কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। আপনার ছেলে শুধু একবার হ্যাঁ বললেই ব্যাস। ঝিনুকের মতামত নিয়ে কোন কাজ নেই, আমি যেখানে বলব সেখানেই ওকে বিয়ে করতেই হবে।”

আম্বালিকা সোমনাথ কে শান্ত করার জন্য বলে, “দেখুন, বিয়ে এমন ভাবে হয় না। দুইজনের অমত থাকলে এই বিয়ে হবে না, অথবা যদিও বা একজন মত দেয় আর অন্যজন বেঁকে বসে তখন জোর করে বিয়ে দিলেও ওদের ভবিষ্যৎ জীবন সুখকর হবে না। তবে হ্যাঁ, আমরা এখন যে পরিস্থিতিতে পড়েছি, তাতে এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমাদের সামনে।” পিয়ালীর দিকে দেখে বলে, “ঝিনুকের সাথে কথা বল, ওকে সবকিছু বুঝিয়ে বল। আমার যা মনে হয় ও বুদ্ধিমতী মেয়ে সব কিছু বিচার বিবেচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। হ্যাঁ ঝিনুক হয়ত একটু জেদি কিন্তু বিপথে যাওয়ার থাকলে এতক্ষনে নিশ্চয় চলেও যেত। আজকাল চারপাশে যা শুনি তাতে ত মাঝে মাঝে আমার দিয়াকে নিয়েই ভয় হয়।”

মাথা দোলায় সোমনাথ, কথাটা সত্যি। পীয়ালির দিকে দেখে বলে, “যাও মেয়ের সাথে কথা বল।”

বুক ভরে শ্বাস নেয় পীয়ালি, আম্বালিকা ওর হাতে হাত রেখে বলে, “আমার ছেলে আসুক আমি কথা বলি তারপরে দুইজনকে সামনা সামনি বসিয়ে সব কিছু খুলে বলা হবে। আমি আমার ছেলেকে যথাসাধ্য বুঝাতে চেষ্টা করব, আমার ছেলে, এই টুকু ভরসা আমি দিতে পারি।”

পিয়ালী ওর হাত ধরে কেঁদে ফেলে, “তুই সত্যি মহামায়া রে, তুই না থাকলে এই যাত্রায় আমাদের কেউই উদ্ধার করতে পারত না।”

বান্ধবীর হাতের ওপরে হাত রেখে প্রবোধ দেয় আম্বালিকা, “সব ঠিক হয়ে যাবে, বিশ্বাস রাখ ভগবানের ওপরে। তিনি যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন।”

ঝিলিক দিয়ার সাথে বেড়িয়ে গেছে এয়ারপোর্ট দিয়ার দাদাকে আনার জন্য। ঘরের ভেতরে বসে বসার ঘরের সব আলাপ আলোচনা ওর কানে গিয়েছিল। দিয়ার দাদাকে আনতে যাওয়ার আগে ঝিলিক ওকে জানিয়ে দিয়েছিল যে আম্বালিকা আন্টির বড় ছেলের সাথে ওর বিয়ের কথা চলছে। ঘরের দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে বিছানার এক কোনায় কুঁকড়ে বসে পরে ঝিনুক। বারং বার নিজেকে প্রশ্ন করে, কেন পার্থ ওর সাথে এমন বিশ্বাস ঘাতকতা করল, মন প্রান দিয়ে ভালবেসেছিল ছেলেটাকে। পার্থের প্রেমে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, বাবা মায়ের অনুযোগ একবারের জন্যেই কান দেয়নি। মানুষ চিনতে এত ভুল করবে সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ঝিনুক, মানুষ যে সব সময়ে এক মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকে সেটা এতদিন শুধু সিনেমায় গল্পেই পড়েছিল। অকাঠ সত্যটা যে এমন ভীষণ ভাবেই ওর সামনে এসে ওকে এক ধাক্কায় এইভাবে নাড়িয়ে দিয়ে চলে যাবে সেটা একদম ভাবতে পারেনি।

যে আসছে সেই বা কেমন হবে জানা নেই, তবে একটাই ভরসা এখানে, আম্বালিকা আন্টি মায়ের ছোটবেলার প্রিয় বান্ধবী আর সেই সাথে দিয়া আর ঝিলিক ও কাকতালীয় ভাবে স্কুলে বন্ধুত্ত হয়ে গেছে। মায়ের কাছেই শোনা যে আম্বালিকা আন্টির বড় ছেলে এমেসের অরথপেডিক সার্জেন। সব ডাক্তার কি ভালো মানুষ হয় নাকি? পড়াশুনা করলেই কি ভালো মানুষ হওয়া যায়? বাবা ভীষণ ভাবেই আহত এবং ক্রুদ্ধ, বিয়ে করার ইচ্ছেটাই চলে গেছে ওর। যদি এখন বিয়েতে মত না দেয় তাহলে কেউই ওর কোন কথা শুনবে না। বাবা জোর করেই ওকে এবারে বিয়ে দেবে। মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস ওর চলে গেছে। আর নয়, এই পৃথিবীতে আর বাঁচতে চায় না...

দরজা ভেজান ছিল, পীয়ালি আলতো ধাক্কায় ঝিনুকের ঘরের দরজা খুলে আলো জ্বালিয়ে জিজ্ঞেস করে, “অন্ধকারে কি করছিস রে?”

গায়ের চাদর বেশি করে গায়ের ওপরে জড়িয়ে ধরে মাথা নাড়ায় ঝিনুক, নরম গলায় উত্তর দেয়, “কিছু না।”

পিয়ালী মেয়ের পাশে বসে ঝিনুকের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে মাতৃ স্নেহে বলে, “দ্যাখ মা, ভুল মানুষের হয়। তাই বলে সেই ভুলটাকে আঁকরে ধরে বসে থেকে লাভ কি বল। তুই ত আমার সোনা মেয়ে রে...”

মাকে জড়িয়ে ধরে ঝিনুক, “না মা, আমি তোমার খারাপ মেয়ে মা। তোমাদের কোন বারন শুনিনি, তোমাদের কোন কথায় কান দেইনি, সেই পাপের ফলে আমার আজকে এই অবস্থা।” বলেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে।

মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে বলে, “না রে, ছোট বেলায় দুষ্টুমি সবাই করে, বাবা মায়ের অবাধ্য হয়, সেটা ঠিক সময়ে বুঝতে পেরে নিজেকে সামলে নেওয়াটাই আসল কথা, তুই কোন পাপ করিসনি।” চোখ মুছিয়ে হাতে গালে হাত বুলিয়ে বলে, “আমার সোনার টুকরো মেয়ে তুই, ইসসস কি ভাবে নিজেকে খামচে একাকার করেছিস।”

কাঁদতে কাঁদতে মাথা ঝাঁকিয়ে মাকে বলে, “মা গো আমি বিয়ে করব না, প্লিজ মা।”

পীয়ালি ওকে আদর করে বুঝিয়ে বলে, “দ্যাখ ঝিনুক, যদি আম্বালিকা এগিয়ে না আসত তাহলে কি হত বলত? আমাদের মান সন্মান সব জলে ধুয়ে মুছে যেত। সবাই এটাই বলত, ওই ত সোমনাথের বড় মেয়ের শেষ পর্যন্ত বিয়েই হল না। পাড়ার লোকের মুখ কি আর চুপ করে থাকত নাকি? তোর বড় পিসি এই পার্থের সাথে বিয়ে হবে বলে কত খোটা দিয়ে কথা শুনিয়েছে সেটা জানিস। ব্যাবসায়ি বাড়ির ছেলে, তার ওপরে ওর বাবা আবার এই প্রমটারিতে বিনিয়োগ করেছে কত কথা সেই নিয়ে, প্রমোটার দের স্বভাব একদম ভালো হয় না।” ঝিনুক চুপ করে মায়ের কথা শুনে যায়, ওর যে করার আর কিছু নেই সেটা বুঝে যায়। পীয়ালি বলে, “অম্বরীশ ভালো ছেলে, এমসের ডাক্তার, অরথপেডিক সার্জেন, আমরা খুঁজলেও হয়ত অমন ছেলে পেতাম না তোর জন্য, সব থেকে বড় কথা আম্বালিকা আমার ছোটবেলার বান্ধবী, আমার প্রিয় বান্ধবী, আমরা একসাথে কলেজে পড়েছি একসাথে মাস্টারস করেছি। এখানে কেউ অচেনা নয় রে।”

কথা শুনে মাথা দোলায় ঝিনুক, সত্যি কথা, যদি বিয়েটা না হত তাহলে আত্মীয় সজ্জন সবাই বলাবলি করত, যে শেষ মুহূর্তে যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল কোন কারনে ছেড়ে দিয়েছে। সঠিক কারণ বের করার কারুর মাথা ব্যাথা নেই সবাই নিজের মনে একটা কারণ বের করে সেই গুজব বদনাম চারদিকে রটিয়ে দিত। হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছে ঝিনুক যে এক শয়তানের রক্ত পার্থের ধমনীতে সেই রক্ত এক সময়ে মাথা চাড়া দিয়ে জাগত, সময় থাকতেই সেটার হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছে ঝিনুক।

চোখের জল মুছে সোজা হয়ে বসে ঝিনুক, মাকে জিজ্ঞেস করে, “ওরা কি এসে গেছে?”

পিয়ালী একবার দরজার দিকে দেখে বলে, “এখন আসেনি হয়ত তবে একটু পরেই চলে আসবে। চোখের জল মোছ, হাতে গালে ক্রিম মাখ, নিজেকে ঠিক কর, ভালো একটা সালোয়ার কামিজ পর। এইভাবে যাবি নাকি ওর সামনে?” একটু থেমে মেয়ের মুখের দিকে দেখ বলে, “তোকে আরো কিছু কথা বলার আছে।” ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। পিয়ালী একটু থেমে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলে, “রিশু কিন্তু আম্বালিকার চোখের মনি। আমার বান্ধবী বলে বলছি তা নয়, তবে আম্বালিকা সাক্ষাৎ মহামায়ার রূপ। তুই আমাকে কথা দে, যে তুই কোনদিন কোন পরিস্থিতিতে আম্বালিকার সাথে কোন দুরব্যাবহার করবি না।”

মাথা নোয়ায় ঝিনুক, মায়ের কথা অবশ্য ঠিক, আম্বালিকা আন্টিকে দেখলেই বোঝা যায়, দেবী দুর্গার মতন রূপ আন্টির, ওই চোখে যেমন আগুন আছে ঠিক তেমনি ভালোবাসা আছে। বুক ভরে শ্বাস নেয় ঝিনুক, এই ওর কপালে লেখা, একেবারে অজানা অচেনা একজনের সাথে বাকি জীবন কাটাতে চলেছে। যার সাথে বিয়ে হবে তাকে কোনদিন দেখেওনি, কথা বলা চেনা জানা হওয়া ত দুরের কথা। এই মানসিক অবস্থায় বিয়ে করতে অনিহা কিন্তু বাবা মায়ের মুখ চেয়েই বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ঝিনুক। মাকে জানিয়ে দেয় যে ওর এই বিয়েতে অমত নেই, কিন্তু মনের গভীরে প্রচুর সংশয়, কেমন হবে ওর এই অচেনা জীবনসঙ্গী।

আলমারি খুলে একটা নতুন সালোয়ার কামিজ বের করে নেয়, তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পরে। আয়নায় নিজের প্রতিফলনের দিকে তাকিয়ে ভীষণ ব্যাথা পায়। কেঁদে কেঁদে চোখ জোড়া লালচে হয়ে গেছে, যার জন্য এত কান্না সেই মানুষটা প্রতারক, তার জন্য আর চোখের জল ফেলে লাভ কি। গালে বাজুতে বুকের ওপরে নখের আঁচর দেখে নিজেই লজ্জায় পরে যায়। চোখ মুখ ভালো ভাবে জল দিয়ে ধুয়ে নেয়, সালোয়ার কামিজ পরে বাথরুম থেক বেড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে পরে প্রসাধনের জন্য। ততক্ষণে মা চলে গেছে ওর কামরা থেকে। গালের আঁচড়ের দাগের ওপরে ক্রিম মাখতে মাখতে নতুন এক জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেয়। জানা নেই এই জীবনে ওর কপালে কি লেখা আছে। নতুন করে কোন স্বপ্ন দেখতে ভয় পায় ওর ছোট্ট হৃদয়। ঠিক সেই সময়ে ঝিলিক এসে পৌঁছাতেই ওর হৃদপিণ্ড এক লাফে গলার কাছে এসে আটকে যায়, এসে গেছে সেই অচেনা মানুষ, যার সাথে বাকি জীবন ওকে কাটাতে হবে।

ঝিলিক দিদির গলা জড়িয়ে ধরে বলে, “তুই আমার সোনা দিদি।”

বুক ভরে শ্বাস নেয় ঝিনুক, ম্লান হেসে জিজ্ঞেস করে, “কেমন দেখলি?”

দিদির গালে গাল ঠেকিয়ে চোখ মেরে মুচকি হেসে বলে, “জিজু দারুন হ্যান্ডসাম রে।”

বাজুতে ক্রিম মাখতে মাখতে ছোট উত্তর দেয়, “আচ্ছা!”

দিদির গলা জড়িয়ে বলে, “দিদি, সত্যি বলছি এই তোকে ছুঁয়ে। ওদের ভাই বোনেদের মধ্যে এক অন্য ধরনের সম্পর্ক যেটা না দেখলে তুই বিশ্বাস করতে পারবি না। দিপের হাত ভেঙ্গেছে শুনেই কিন্তু ওর দাদা এই রাতে এখানে এসেছে।”

যে আসছে সে কি তাহলে নিজেও জানে না যে তার বিয়ে? ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বোনকে প্রশ্ন করে, “মানে?”

ঝিলিক উত্তর দেয়, “দিয়ার সাথে কথা বলে যা বুঝলাম, ওর দাদার নাকি একদম ইচ্ছে নেই বিয়ে করার। কিন্তু এখানে এসে না পৌঁছানো পর্যন্ত আম্বালিকা আন্টির হাত বাঁধা ছিল। প্রথমেই বিয়ের কথা শুনলে ওর দাদা বেঁকে বসত কিছুতেই আসত না। শেষ পর্যন্ত দিপ হাত ভাঙ্গার ভান করে কেঁদে কেটে ওর দাদাকে ফোন করে, শুধু মাত্র ভাইয়ের হাত ভেঙ্গেছে শুনে ওর দাদা এত রাতে প্লেনে করে দিল্লী থেকে কোলকাতা এসেছে।” কথাটা শুনে অবাক হয়ে যায় ঝিনুক, এমন মানুষ হয় এই পৃথিবীতে। ঝিলিক আরো বলে, “তুই জানিস, দিয়ার দাদা এত ব্যাস্ততার মধ্যেও দিয়ার কি হোমওয়ার্ক সেটা মনে রাখে, দিপের কোনদিন কোন পরীক্ষা সেই খবর ওর দাদার কাছে আছে। সত্যি বলছি, দেখে একদম মনে হয় না যে ওর দাদা নাম করা এক মেডিকেল কলেজের অরথপেডিক সার্জেন।”

❤️ "শেষের পাতায় শুরু" ❤️
 
পর্ব চার – (#2-16)

রিশু গাড়ি থেকে নেমে দেখে যে দরজায় ওর মা দাঁড়িয়ে। আম্বালিকা মাতৃ স্নেহে বড় ছেলের গালে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ফ্লাইটে কি একটু ঘুমিয়েছিলিস?”

হেসে ফেলে রিশু, “তোমাদের জ্বালাতনে কি আর ঘুম হয়?”

সেই সাথে বাকি সবাই হেসে ফেলে। পেছনে নীলাদ্রি দাঁড়িয়েছিল, মাথা নুইয়ে আদর সম্ভাষণ জানায় রিশু। এই বাড়ির সবাই অচেনা, পিয়ালীর কথা মনে নেই ওর। বসার ঘরে মায়ের পাশে চুপচাপ বসে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখে। এটা একটা ফ্লাট ওদের বাড়ির মতন বড় নয় তবে বেশ ভালো। কয়েকদিন পরেই বিয়ে তাই ঘর ভর্তি লোকজন। সোমনাথ ওকে দেখে এগিয়ে এসে হাত মেলায়, আম্বালিকা ইশারা করে প্রনাম করতে। রিশু ভুরু কুঁচকে একবার মায়ের দিকে তাকায়, মা আর পাপা আর কয়েকজন শিক্ষক ছাড়া আজ পর্যন্ত অচেনা কারুর পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করেনি।

রিশুর ইতস্তত ভাব দেখে সোমনাথ নিজেই হেসে বলে, “না না এখন মডার্ন যুগ, এখন কি আর কেউ কারুর পায়ে হাত দেয় নাকি।” রিশুর হাতের ওপরে আলতো চাপ দিয়ে বলে, “আসতে কষ্ট হয়নি ত?”

মায়ের চোয়াল একটু কঠিন হয়ে গেছে বুঝতে পেরে রিশু সোমনাথের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে উত্তর দেয়, “না, তেমন কিছু নয়।”

পিয়ালী ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পরে, কি করবে ঠিক ভেবে পায় না। একটা কাঁসার থালায় ফুল প্রদীপ ধুপ ইত্যাদি সাজিয়ে রিশুকে বরন করতে আসতে দেখেই আম্বালিকা একটু বিব্রতবোধ করে।

আম্বালিকা পিয়ালীকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “এসব কি করছিস তুই?”

আমতা আমতা করে পিয়ালী উত্তর দেয়, “না মানে এই প্রথম বার বাড়িতে এলো তাই আর কি।”

আম্বালিকা পিয়ালীর চোখে চোখ নিবদ্ধ করে বলে, “এসবের কোন দরকার নেই।” ওর কন্ঠের স্বর দৃঢ়, “আমি আগেই বলেছি, আগে আমি রিশুর সাথে কথা বলব তারপরে বাকি কথা।”

পিয়ালী বুঝে যায়, এই সেই আম্বালিকা বহু বছর আগে যে রিশুকে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে সেই ভীষণ দুর্ঘটনার রাতে ওর জন্মদিন পালন করেছিল। কেউ সেদিন টলাতে পারেনি ওর সিদ্ধান্ত, ওর কন্ঠে সেই দিনের দৃঢ়তা।

পিয়ালী নিজের ভুল বুঝতে পেরে রিশুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “তোমাকে সেই একদম ছোট বেলায় দেখেছিলাম তোমার দি...” বলতে গিয়েও থেমে যায় আম্বালিকার চোখের দিকে তাকিয়ে, “তোমার মায়ের কোলে।”

রিশু একটু হেসে মাথা নুইয়ে প্রনাম জানায়। আম্বালিকা পিয়ালীকে অনুরোধ করে ওদের একটু একা ছেড়ে দিতে। পিয়ালী ওদের একটা ঘরে বসতে বলে, সেই সাথে জিজ্ঞেস করে রিশুর খাওয়ার জন্য কি কিছু নিয়ে আসবে? রিশু মাথা দোলায়, এখুনি নয়, প্লেনে এক কাপ কফি খেয়েছিল। পিয়ালী বেড়িয়ে যাওয়ার পরে আম্বালিকা ঘরের দরজা বন্ধ করে রিশুর পাসে এসে বসে।

ছেলের মাথায় গালে হাত রেখে আদর করে জিজ্ঞেস করে, “কিছুই ত খাস নি খাবি কিছু?”

রিশু হেসে উত্তর দেয়, “যা বাবা, ডিনার করে ঘুমাতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু তোমাদের জ্বালায় ঘুম আর হল কই।”

হেসে ফেলে আম্বালিকা, “কি করব বল। সব মায়ের ইচ্ছে হয়, চোখ বন্ধ করার আগে...”

মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “এইসব একদম বলবে না।”

ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “আচ্ছা বাবা বলব না। তবে সত্যি কথা বলছি, তোর বয়স বাড়ছে, ইচ্ছে ত হয় বাড়ির বড় ছেলে একটা টুকটুকে বৌমা বাড়িতে আনুক, আমিও একটু নাতি নাত্নির সাথে খেলা করি।”

রিশু মাথা নাড়িয়ে হেসে বলে, “একা আছি ভালই ত আছি। এই যে তুমি আছ, পাপা আছে দিয়া দিপ আছে আর কি চাই।”

আম্বালিকা ছেলের মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বলে, “দিয়া বড় হচ্ছে, এরপর কোথায় পড়াশুনা করতে যাবে সেটা জানি না, তারপর ওর একদিন বিয়ে হয়ে যাবে। একদিন দিপ ও বড় হবে তার একটা পরিবার হবে, তুই তখন বুড় হয়ে যাবি, তোকে কে দেখবে?”

মাকে জড়িয়ে উত্তর দেয়, “কেন তুমি দেখবে?”

হেসে ফেলে আম্বালিকা, “আমি কি আর চিরকাল থাকব নাকি রে পাগল?”

বুক ভরে শ্বাস নেয় রিশু, জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা রবে। এক এক করে সত্যি একদিন সবাই ছেড়ে চলে যাবে, “তোমার কি ইচ্ছে আমি বিয়ে করি?”

ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে হাসে আম্বালিকা, “আগে সব কিছু শুনে তবেই বল।”

হেসে ফেলে রিশু, “মাম্মা, তুমি দেখেছ, তোমার পছন্দ এই যথেষ্ট আমার কাছে।”

চোখে জল চলে আসে আম্বালিকার, “এরপর জীবন তোর, তাই বলছিলাম যে একবার শুনে নে পুরো ঘটনা।”

চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে রিশুর, “এতদিন পরে আমার জীবন আমার নিজের হয়ে গেল?”

আম্বালিকা বুঝতে পারে কথাটা ঠিক হয়নি বলা, “না রে বাবা, আমি ঠিক সেই অর্থে বলিনি।”

চোখের কোনা মুছে হেসে উত্তর দেয় রিশু, “আচ্ছা বাবা বল কি বলতে চাও।”

আম্বালিকা শুরু করে পিয়ালীর বড় মেয়ে সঙ্ঘমিত্রার কথা, কয়েক মাস আগে তেইশে পা দিয়েছে, পড়াশুনায় ভালো, ইংরেজি নিয়ে স্নাতক তারপরে কোলকাতার এক কলেজ থেকেই এমবিএ করেছে এইচআর নিয়ে। কলেজে পড়ার সময়ে একটা ছেলের সাথে প্রেম হয়, পার্থ তার নাম, বাবা মায়ের অমতেই বিয়ে তবে ঝিনুকের প্রচন্ড জেদের জন্য শেষ পর্যন্ত সোমনাথ আর পিয়ালী মেনে নেয় ওদের বিবাহ। এই বিয়ে নিয়েই অনেক ঝামেলা হয়েছে ওদের বাড়িতে, কথায় কথায় আত্মহত্যা করবে এমন বলেছিল। ছেলেটা শেষে পর্যন্ত ঝিনুকের সাথে প্রতারনা করে, শুধু মাত্র টাকার লোভেই আর ঝিনুকের শরীরের লোভেই ছেলেটা এতদিন প্রেমের ছলনা করে গেছে। ওইদিন বিকেলে একটা ফ্লাটে ডেকে নিয়ে গিয়ে ওর সাথে জোর জবরদস্তি করতে যায়। পার্থের আসল চেহারা আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে খুব ভেঙ্গে পড়েছে মেয়েটা। রাত পার হলে আর দুইদিন পরেই বিয়ে, সোমনাথের অফিসের লোকজন আত্মীয় সজ্জন সবাইকে নেমন্তন্ন করা হয়ে গেছে, এখন এই অবস্থায় বিয়ে না হলে মান সন্মান খুইয়ে দেবে পিয়ালী আর সোমনাথ। আম্বালিকা আরো জানায়, যে ঝিনুক একটু বেশি জেদি, চঞ্চল প্রকৃতির তবে যতটা শুনেছে পিয়ালীর কাছে, মেয়েটা একদম উচ্ছন্নে যায়নি। আজকালের যুগে ছেলেরা মেয়েরা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, প্রেমিক প্রেমিকারা বিয়ে থা না করেই একসাথে লিভ-ইন থাকে, যত জেদি হোক না কেন, মেয়েটা সেই পথে যায়নি, বিয়ে করেই পার্থের সাথে যেতে চেয়েছিল। চুপ করে মায়ের সব কথা শুনে যায় রিশু।

সব কিছু শোনার পরে রিশু দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে, “সব বুঝলাম, এরপর তুমি কি বলতে চাও?”

আম্বালিকা হেসে বলে, “আমি এই মেয়েকে বৌমা করতে চাই।”

একটু হেসে ভুরু নাচিয়ে বলে রিশু, “বদরাগী আর জেদি মেয়ে কিন্তু...”

হেসে ফেলে আম্বালিকা, “তাতে কি হয়েছে, তোর মা ও ওই বয়সে কম জেদি ছিল না।”

রাস্তায় আসার সময়ে ওর বোন ওকে সঙ্ঘমিত্রার ছবি দেখিয়েছিল, মানস চক্ষে সেই মুখবয়াব মনে করতে চেষ্টা করে রিশু। ভারী মিষ্টি দেখতে মেয়েটাকে, কাজল টানা চোখ দুটো সত্যি খুব উচ্ছল প্রানবন্ত, বেশ ছটফটে মেয়ে সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। চুলে আবার রঙ করা, হাল ফ্যাশানের সাথে তাল মিলিয়ে গাড় বাদামি রঙ আবার সামনের দিকের এক গোছা চুল লাল রঙের। মনে মনে হেসে ফেলে রিশু, ভবিষ্যতে ধাক্কা আছে অনেক। তবে মায়ের ইচ্ছে মায়ের বিশ্বাস সেই বিশ্বাসকে আঘাত হানার শক্তি ওর নেই।

মাকে জড়িয়ে হেসে ফেলে রিশু, “সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।”

ছেলের মাথার চুলে বিলি কেটে স্নেহ ভরা কন্ঠে বলে, “আমার বিশ্বাস সব ঠিক হয়ে যাবে।”

মাথা নিচু করে একটু ভেবে রিশু বলে, “কিন্তু মাম্মা আমি শুধু জেদের কথা ভাবছি না...”

ভুরু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকিয়ে বুঝে যায় আম্বালিকা তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ঠিক কি কথা বলতে চাইছে, “দ্যাখ বাবা, আগের পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল, সেই ক্ষেত্রে ব্যাবধান আসাটাই স্বাভাবিক সেটাই বর্তমান যুগের নিয়ম। এই ক্ষেত্রে পিয়ালী আমার ছোটবেলার বান্ধবী, অন্তত সেই ভয়টা আমার নেই যে এই মেয়ে আমাদের পরিবারের মাঝে একটা দেয়াল তুলে দাঁড়াবে।”

মাথা দুলিয়ে শেষ পর্যন্ত সায় দেয় রিশু, “তোমার বিশ্বাস যখন তখন আমি আর কিছু বলব না।”

ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে বলে, “আমি আছি ত সাথে, ভয় কি। দ্যাখ বাবা, যে গাছের শিকড় যত গভীরে যায় সেই গাছ তত অটল অবিচল হয়ে সকল প্রকার ঝড় ঝঞ্ঝায় দাঁড়িয়ে থাকে।” শেষ পর্যন্ত মায়ের দিকে তাকিয়ে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায় রিশু। ছেলের মাথায় স্নেহের চুম্বন এঁকে দরজা খুলে পিয়ালীকে জড়িয়ে ধরে বলে, “যা এবারে তোর জামাইকে মিষ্টি খাওয়া।”

খুশির অশ্রু ধারা বয়ে যায় পিয়ালীর দু’চোখ দিয়ে। সোমনাথ জড়িয়ে ধরে নীলাদ্রিকে, “কি যে বলব আপনাদের ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।”

দিয়া আর দিপ দৌড়ে ঢুকে পরে ঘরের মধ্যে। দিয়া দাদার কাছে আবদার করে, “বিয়েতে আমার কিন্তু একটা গাউন চাই আর বউভাতের দিনে লেহেঙ্গা পড়ব।”

দিপের আবদার, “আমি কিন্তু একটা সুট পড়ব।”

ঘরের মধ্যে তাকায় আম্বালিকা, রিশুকে জিজ্ঞেস করে, “কিছু খাবি?”

রিশু মাথা নাড়ায়, সারা রাত ঘুম নেই একটু খিধে পেয়েছে বটে নিজের বাড়ি হলে মাকে বলত গরম ভাত আর মুশুরির ডাল সেদ্ধ আর আলু সেদ্ধ বানাতে। দিল্লীতে রান্নার লোকের হাতের রান্না খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে গেছে, মায়ের মতন ডাল রান্না করতে জানে না কাজের লোক।

মুচকি হেসে উত্তর দেয় রিশু, “তোমার হাতের ডাল সেদ্ধ পাওয়া যাবে কি...”

হেসে ফেলে আম্বালিকা, “আচ্ছা দেখছি...”

দিপ আর দিয়ার সাথে গল্প করতে শুরু করে রিশু। দিয়ার খুব আনন্দ, ওর প্রিয় বান্ধবী ঝিলিকের দিদির সাথে ওর দাদার বিয়ে হবে। কথার ফাঁকে একবার ঘরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে সব কিছু, ঘরটা ছোট, এক পাশে একটা চেয়ার আর পড়ার টেবিল, বই গুলো দেখে বুঝতে পারল এটা ঝিলিকের ঘর। একদিকে একটা বিছানা, এতক্ষন মায়ের সাথে বিছানায় বসেই কথা হচ্ছিল। এর মাঝে সোমনাথ আর নিলাদ্রী ঘরে এসে রিশুর সাথে কুশল বিনিময় করে।

এমন সময়ে আম্বালিকা আর পিয়ালী, ঝিনুক কে নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রিশু, সোমনাথ একটা চেয়ার এগিয়ে দেয় রিশুর দিকে। রিশু চোখ তুলে ঝিনুকের দিকে দেখে মাথা নুইয়ে সম্ভাষণ জানায়। মাথা নিচু করে থাকার ফলে ঝিনুক সেটা দেখতে না পারায়, মা আর আম্বালিকা আন্টির সাথে ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে। রিশুর পাশের দুটো চেয়ারে নিলাদ্রী আর সোমনাথ বসে পরে। রিশুর চুপচাপ মায়ের দিকে তাকায়, আম্বালিকা আলতো মাথা দুলিয়ে ইশারায় জানায় যে পাশের মেয়েটাই সঙ্ঘমিত্রা যার ব্যাপারে এতক্ষন কথা বলছিল। রিশু তাকিয়ে দেখে ঝিনুকের দিকে, পরনে একটা ঘিয়ে রঙের সালোয়ার কামিজ তার ওপরে একটা শাল জড়ান। মাথা নিচু করে থাকলেও বুঝতে অসুবিধে হয় না যে মেয়েটার চোখের পাতা ভিজে, কেঁদে কেঁদে চোখ জোড়া ফুলে গেছে। চুপচাপ বসে নরম চাঁপার কলির মতন আঙ্গুল খুঁটছিল মেয়েটা। নরম ফর্সা গালের ওপরে নখের আঁচর, অনাবৃত হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে, সেখানেও নখের আঁচড়ের দাগ। সাধারন পাঁচটা বাঙালি মেয়েদের চাইতে একটু লম্বা গড়নের, দেহের গঠন বাড়ন্ত, মুখবয়াব বেশ মিষ্টি। ছবিতে যে চোখ দেখেছিল এখন সেটা বুক ভাঙা কান্নার পেছনে হারিয়ে গেছে, যে হাসি খুশি চেহারা দেখেছিল সেটা আর নেই।

হটাত করে ডাক্তারি স্বভাব বশত ঝিনুকের গালের আর হাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে রিশু, “এহ বাবা এই আঁচড় কি করে লেগেছে? বেশ খারাপ অবস্থা দেখছি, আমি একটা অয়েন্টমেন্ট লিখে দেব নিয়ে আসবে, না হলে এই দাগ পরে ঘা হয়ে যেতে পারে।”

হটাত রিশুর মুখে এই কথা শুনে ঝিনুক কি বলবে ভেবে পায় না, এতক্ষন বুকের এক কোনায় একটা অজানা আশঙ্কার কালো মেঘ ছেয়েছিল সেটা একটু কেটে গিয়ে এক ক্ষীণ সূর্যের আলো উঁকি মারে এক কোনায়। সামনের অচেনা মানুষটার কথা শুনে কান্না ভুলে ভেজা চোখেই তাকিয়ে দেখে রিশুর দিকে। বাকিরা হেসে ফেলে রিশুর কথা শুনে। ওকে প্রথম দেখে রিশু যে এই কথা বলবে সেটা একদম আশাতীত, ঝিনুক কাঁদবে না হাসবে ভেবে পায় না। নিচের ঠোঁট চেপে ভাসা ভাসা চোখে তাকিয়ে থাকে রিশুর দিকে। সামনের ছেলেটার দিকে দেখে ঝিনুক, পরনে একটা অতি সাধারন শারট আর একটা জিন্সের প্যান্ট। ভাইয়ের হাত ভেঙ্গেছে শুনেই সেই রাতে যা পেরেছে সেই পরেই নিশ্চয় বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেছে, কথাটা ভাবতেই কেমন যেন লাগে ওর। কতটা নিবিড় বন্ধন না হলে সুদুর দিল্লী থেকে এই ভাবে কেউ এত রাতে আসে না। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, তাও দুটো চোখ ভীষণ উজ্জ্বল। বেশ বলিষ্ঠ দেহের গঠন, চওড়া কাঁধ, চওড়া ছাতি, ওকে দেখে যখন উঠে দাঁড়িয়েছিল তখন বুঝে গিয়েছিল যে ছেলেটা বেশ লম্বা চওড়া। মুখবয়াব হুবহু আম্বালিকা আন্টির মতন, বিশেষ করে উজ্জ্বল চোখ জোড়া।

❤️ "শেষের পাতায় শুরু" ❤️
 
পর্ব চার – (#3-17)

পিয়ালী মেয়ের হাত নিজের হাতে নিয়ে রিশুর দিকে তাকিয়ে বলে, “অম্বরীশ, তোমার মা তোমাকে সব বলেছেন হয়ত।” রিশু মায়ের দিকে দেখে মাথা দুলিয়ে সায় দেয়, হ্যাঁ।

আম্বালিকা আন্টি এতক্ষনে অম্বরীশকে সব বলে দিয়েছে? কি বলেছে, কতটা বলেছে? বুকের ধুকপুকানি বেড়ে ওঠে ঝিনুকের। শরীর কাঠ হয়ে যায় ওর, চেহারা রক্ত শুন্য হয়ে যায়। হাতের মুঠো শক্ত করে, চোখ বুজে দম বন্ধ করে শুধু ভাবে, মা ধরণী দ্বিধা হও আমাকে তোমার কোলে নাও। সামনের ছেলেটা জানে পার্থ ওর সাথে কি করেছে? সামনের ছেলেটা কি জানে যে পার্থের মোবাইলে ওর অর্ধ উলঙ্গ ছবি ছিল, যদিও সেই মোবাইল ভেঙ্গে দিয়েছে ঝিনুক। জানে কি, যে পার্থের সাথে থাকতে থাকতে মদের নেশা আর সিগারেটের নেশা ধরেছে ওর। পার্থের সাথে দেখা হলেই লুকিয়ে একটু মদ খাওয়া, ফাঁক পেলেই লুকিয়ে চুরিয়ে একটু সিগারেটে টান মারা এই সব বদ অভ্যেস আছে ওর। মনে হয় কেউ যেন ওর গলা চেপে ধরেছে, দম বন্ধ হয়ে আসে ওর। সত্যি কি সব কিছু জেনে শুনেও এত বড় এক ডাক্তার ওর সাথে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে? কেন হয়েছে, কি কারণ? ওর বাবা কি আম্বালিকা আন্টিকে টাকার লোভ দেখিয়েছে? ওর বাবা কি বলেছে যে এই ছেলেকে গাড়ি কিনে দেবে অথবা দিল্লীতে বাড়ি কিনে দেবে? টাকা পয়সা সম্পত্তির লোভ অনেকের থাকে। লোকের চোখ দেখে কি আর বোঝা যায় মনের মধ্যে কি চলছে?

আম্বালিকা বাকি সবার দিকে চোখ বুলিয়ে পিয়ালীকে বলে, “সবাই যখন এখানে আছে, তখন আমি রিশুর ব্যাপারে একটা কথা বলতে চাই।” রিশু এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে। আম্বালিকা প্রতি উত্তরে একটু হেসে ছেলেকে বল জুগাতে অনুরোধ করে বলে, “সবাই এখানে আছে, সবার সামনে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত।” একটু থেমে বলতে শুরু করে, “রিশুর একটা অতীত আছে।” পিয়ালী আর সোমনাথ হা করে তাকায় আম্বালিকার দিকে। আম্বালিকা হেসে ফেলে ওদের চেহারার ভাব দেখে, “না না তোরা যেমন ভাবছিস তার কিছুই নয়।” তারপরে বলতে শুরু করে চন্দ্রিকার কথা, কি ভাবে প্রেম হয়েছিল রিশুর সাথে এবং কি ভাবে একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য সেই ভালোবাসা ভেঙ্গে যায়।

সব শেষ করে আম্বালিকা, নীলাদ্রির হাত নিজের হাতের মুঠোতে নিয়ে ঝিনুক আর রিশুর দিকে তাকিয়ে বলে, “যাকে ভালোবাসো তার ওপরে বিশ্বাস রাখবে। আমি হয়ত এক সময়ে এর ওপরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম” বলতে বলতে চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে, “কিন্তু এ আমার ওপর থেকে বিশ্বাস হারায়নি।”

ঝিনুক আড় চোখে একবার রিশুর দিকে তাকিয়ে দেখে, মাথা নিচু করে বসে সামনের মানুষটা, ঠিক ভাবে ঠাহর করা যায় না যে ওর মনের মধ্যে কি চলছে। চশমার পেছনের চোখের ভাষা পড়তে অক্ষম হয় ঝিনুক। আম্বালিকা আন্টি ওর পাশে বসে থাকলেও ঝিনুকের কানে কোন কথাই ঠিক করে পৌঁছায় না, ঝিনুক নিজেকে ততক্ষণে এক অন্ধকার বাক্সের মধ্যে বন্দী করে ফেলেছে। কাঁধের ওপরে মায়ের হাতের আলতো ধাক্কায় নিজেকে ফিরে পায় ঝিনুক।

পিয়ালী জিজ্ঞেস করে মেয়েকে, “কিছু বলার আছে তোর?”

মাথা নাড়ায় ঝিনুক, না, ওর আর কি বলার থাকতে পারে। ওর সব স্বপ্ন ভুঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে অনেক আগেই। এক কাঁচের পুতুল ছাড়া এখন ও আর কিছুই নয়। চুপ করে বাবা মায়ের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া ওর সামনে আর কোন পথ খোলা নেই।

আম্বালিকা রিশুর দিকে দেখে প্রশ্ন করে, “তোর কিছু বলার থাকলে বল। কিছু প্রশ্ন থাকলে করতে পারিস।”

রিশুও মাথা নাড়ায়, না ওর মা যখন ঠিক করেছে এই মেয়ের সাথে বিয়ে দেবে তাহলে ওর কিছুই করার নেই। প্রেম ভালোবাসা সঠিক অর্থে কোনদিন চন্দ্রিকার সাথে ছিল না হয়ত, হয়ত চন্দ্রিকা এমএসের ডাক্তার দেখেই ওর কাছে এসেছিল। মাথা নাড়ায় রিশু, না ওর কোন প্রশ্ন নেই।

দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে সোমনাথ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে সবাইকে বলে, “তাহলে কাজে লেগে পড়া যাক আর কি?”
হেসে ফেলে নীলাদ্রি, “হ্যাঁ হ্যাঁ, হাতে সময় নেই একদম। আমাদের ত কিছুই করা হয়নি, কোন প্রস্তুতি নেই।”

গতকাল সকাল থেকে ঘুম হয়নি রিশুর, গতকাল ট্রমা সেন্টারে অনেক চাপ ছিল, তারপরে এই অবস্থা, সারা রাত সবাই জেগে। আলাপ আলোচনা শেষে আম্বালিকা সবাইকে নিয়ে নিজের বাড়ি ঢাকুরিয়া ফিরে আসে। হাতে মাত্র দুইদিন সময়, কেনা কাটা কিছুই নেই। বাড়ি ফিরে স্নান সেরে নেয় রিশু, স্নানের পরে শরীর একদম ছেড়ে দেয় ওর। বিছানায় আধা শোয়া হয়েই বন্ধুদের ফোন করে জানিয়ে দেয় বিয়ের কথা, সেই সাথে এইচওডিকে জানিয়ে দেয়। তারপরে একটু ঘুমিয়ে নেয় রিশু, শরীরে আর শক্তি বেঁচে নেই ওর। সন্ধ্যের মধ্যে শালিনীকে নিয়ে ইন্দ্রজিৎ উপস্থিত হয়ে যায় ওর বাড়িতে, সেই সাথে বেশ কিছু বন্ধুরাও আসে যুদ্ধ কালীন তৎপরতায় শুরু হয় ওর বিয়ের প্রস্তুতি, কেনা কাটা ইত্যাদি। ছুটি একদম নেই, ঠিক হয় যে বিয়ের একদিন পরেই ফিরে যাবে দিল্লীতে, বউভাত হবে না ওদের।

ঝিলিক আর দিয়ার আনন্দ আর ধরে না, পারলে ক্লাসের সব বন্ধু বান্ধবীকেই নেমন্তন্ন করে ফেলে। দিয়ার সেই সাথে একটাই দুঃখ, ভেবেছিল বিয়ের দিন গাউন পড়বে আর বউভাতে লেহেঙ্গা, কিন্তু বউভাত হবে না শুনে মুষড়ে পরে যায়। দিয়া আর ঝিলিকের জন্য দামি লেহেঙ্গা কেনা হয়। আম্বালিকা আর নিলাদ্রী ফোনেই সব নেমন্তন্ন সেরে ফেলে, বিয়ের কার্ড ছাপিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেমন্তন্ন করার মতন হাতে সময় একদম নেই।

সেদিনের পরে ঝিনুক নিজের খোলসের মধ্যে সম্পূর্ণ ভাবে সেঁধিয়ে যায়। বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা শুরু, নতুন উদ্দমে বিয়ের কাজে সবাই মেতে উঠেছে, কিন্তু ঝিনুক নিজেকে সেই সাথে একদম মেলাতে সক্ষম হয় না। যত সময় পার হয় তত ওর মনে হয় যেন মৃত্যুর হাতছানি ওকে ভীষণ ভাবে কাছে ডাকছে।

বিয়ের দিন সকাল থেকেই তোরজোড় শুরু, বিয়ের জন্য যে ব্যাঙ্কোয়েট হল ভাড়া করা হয়েছে সেটা বাড়ি থেকে একটু দূরে। এই কয়দিনে বন্ধু বান্ধবীদের অনেক ফোন এসেছিল কিন্তু কারুর সাথে কথা বলার মতন মানসিকতা ওর ছিল না। যার সাথে বিয়ে হবে তার ফোন আসেনি এই কয় দিনে, জানে না তার পছন্দ অপছন্দ। কিন্তু বাবা মায়ের মুখেই শুনেছে যে বিয়ের একদিন পরেই সেই অচেনা মানুষটার হাত ধরে পাড়ি দিতে হবে সুদুর দিল্লী। বাবা মাকে ছেড়ে যেতে হবে ভেবেই মন কেঁদে ওঠে ওর, এর আগে এইভাবে কোনদিন ওর মন কেঁদে ওঠেনি।

স্নানের জন্য বাথরুমে ঢুকে নিজেকে একা পেয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলে ঝিনুক। অজানা এক ব্যাথায় সারা শরীর কেঁপে ওঠে বারে বারে। “উড়তে মানা আকাশে তোর, বসতে মানা ডালে, বাসা বাঁধিতে ও মানা কি আছে কপালে বলি ঝড়ে হারাতে ত মানা নাই...” এই কি সেই ঝড় যার সাথে এবারে হারিয়ে যেতে হবে কোন অচিন পুরিতে, সঠিক জানে না ঝিনুক। দুপুরের পরেই বাড়িতে বিউটিসিয়ান পৌঁছে যায় ওকে সাজাতে। সাবেকি আঠপৌরে ধাঁচে লাল বেনারসি পরান হয় ওকে, হাতে গলায় ভারী সোনার গয়না। আগের দিনেই দুই হাতে কুনুই পর্যন্ত মেহেন্দি লাগিয়ে দিয়েছিল বিউটিসিয়ান সেইসাথে আবার দুপায়েও হাঁটু পর্যন্ত মেহেন্দি পড়িয়ে দিয়েছিল। খুব হাসিহাসি হয়েছিল এই মেহেন্দি পড়ান নিয়ে, বিউটিসিয়ান বলেছিল দুইজনের নাম লিখে দেবে কিন্তু ঝিনুক মানা করেছিল। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে, গাড় বাদামি রঙ হয়েছে দুই হাতে। সেদিন একটা মলমের নাম লিখে দিয়েছিল ওই অচেনা ডাক্তার, সেটা এই দুইদিনে লাগিয়ে গালের হাতের বুকের নখের আঁচর কিছুটা মিলিয়ে গেছে। সাজের মাঝে একবার ঝিলিক দিদিকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে যায় যে ওকে ভারী সুন্দরী দেখাচ্ছে। ছলছল চোখে বোন কে দেখে, বোনের চেহারায় খুশির আমেজ আনন্দে যেন মাটিতে আর পা পড়ছে না। সময় পেরিয়ে যায় সেই সাথে হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি বেড়ে ওঠে। গতদুই দিনে কারুর সাথে ঠিক ভাবে কথা বলেনি ঝিনুক। মাটির পুতুলের মতন সাজিয়ে ওকে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে বিয়ে হবে। সন্ধ্যের পরেই লোকজন আসতে শুরু করে দিয়েছে। এর মাঝেই মা ওর কানে কানে এসে সান্ত্বনা দিয়ে গেছে, ঝিলিক ও এসে ওর কাছে প্রবোধ দিয়ে গেছে।

পিঁড়িতে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হল অম্বরীশের সামনে। দুই হাতে ধরা পান পাতা কিছুতেই সরাতে ইচ্ছুক নয় ঝিনুক। শরীরের শেষ শক্তিটুকু বুকের মধ্যে জড় করে বুক ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ঝিনুক, “না আমি এই বিয়ে করব না। আমাকে জোর করে বিয়ে দিলে আমি বিষ খাবো, আমি আত্মহত্যা করব।” ঝিনুকের গলা পর্যন্ত সেই আওয়াজ ঠিকরে উঠে এসেছিল কিন্তু পারেনি আওয়াজ করতে। হাতের পান পাতা সরিয়ে কোন রকমে তাকিয়ে ছিল সামনে দাঁড়ান সেই অচেনা পুরুষের দিকে। কেমন যেন শরীর অবশ হয়ে আসে ওর, কোন কিছু ভাবনা চিন্তা করার শক্তি লোপ পেয়েছে, ওর পাশে দাঁড়িয়ে ওর মা ওকে যেমন ভাবে নির্দেশ দিচ্ছে চাবি দেওয়া কলের পুতুলের মতন করে চলেছে ঝিনুক। বিবাহের যজ্ঞ শুরু, পাশাপাশি বসিয়ে দেওয়া হয় দুজনকে। হাতের ওপরে হাত রেখে বেশ খানিকটা মন্ত্র উচ্চারণ করে গেল ব্রাহ্মন, পাশে যে বসে তার দিকে ক্ষনিকের জন্যেও তাকিয়ে দেখার ইচ্ছে করছিল না ওর।

এই কটা দিন রিশুর কেমন যেন স্বপ্নের মতন মনে হয়েছিল। এত তাড়াতাড়ি সব কিছু ঘটে চলেছে ওর আশেপাশে যে ঠিক ভাবে কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারছিল না। এমন কি যখন ঝিনুককে ওর সামনে এসে দাঁড় করান হয় তখন ওর মনে হয়েছিল এটা একটা দুঃস্বপ্ন, এখুনি হয়ত ওর মা এসে ডাক দেবে আর রিশু ঘুম থেকে উঠে পড়বে। স্বপ্নের ঘোর তখন কাটে রিশুর যখন সামনা সামনি বসিয়ে ওর হাতের ওপরে ঝিনুকের কোমল হাত খানি রাখা হয়। ডাক্তার হিসাবে বহু দেহ স্পর্শ করেছে ডক্টর অম্বরীশ সান্যাল, তবে সামনে বসা মেয়েটার হাত যেমন কোমল তেমন শীতল, যেন ওর সামনে একটা বরফের পুতুল বসে রয়েছে। ওর কঠিন তপ্ত হাতের ছোঁয়াতে ঝিনুকের চাঁপার কলির মতন কোমল আঙ্গুল গুলো বারংবার কেঁপে উঠছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। পদ্ম কুসুমের মতন নরম হাত খানি কুঁকড়ে ছোট হয়ে যায় রিশুর হাতের থাবার মধ্যে। অনুষ্ঠানের পর্ব পেরিয়ে যায়, একে একে মন্ত্র উচ্চারন করে চলে ব্রাহ্মন। এক সময়ে মা এসে ওর পাশে বসে জানিয়ে দিল যে এইবারে পাশে বসা ওই অচেনা মেয়েটার সিঁথিতে ওকে সিঁদুর পরাতে হবে। আড় চোখে তাকিয়ে দেখে পাশে বসা সুন্দরীর দিকে। পাশে বসার পর থেকেই ঘন ঘন রুমাল দিয়ে চোখ মুছে চলেছে, নাকের ডগা লাল, চোখের পাতা ভিজে। একবারের জন্য মনে হয়েছিল অভয় জানিয়ে মেয়েটাকে বলে, “আমি আছি ত সাথে” না সে কথা বলতে পারে না রিশু, ভয় হয় আবার সেই কে ছেড়ে যাবে আর কে থাকবে জানা নেই এই মুহূর্তে। সেই যে একবার দেখা হয়েছিল ওদের বাড়িতে তারপরে এই দুইদিনে দেখাও হয়নি কথাও হয়নি। এই ভাবে অচেনা একজন মেয়েকে নিজের জীবন সঙ্গিনী করতে হবে সেটা রিশু স্বপ্নেও ভাবেনি।

ঘনিয়ে আসে মহেন্দ্রক্ষন, সিঁদুর দানের পর্ব। ভেজা চোখে ঝিনুক শেষ বারের মতন চারপাশে দেখে আর বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। সোমনাথ অদুরে দাঁড়িয়ে ছিল, মেয়ের জল ভরা চোখ দেখে কাছে এসে দাঁড়ায়। রিশু আংটিতে সিঁদুর নিয়ে ঝিনুকের কপাল ছুইয়ে সিঁথির মাঝে টেনে দেয়, ফর্সা কপাল, ফর্সা নাকের অনেকটাই সিঁদুরের লাল রঙ্গে রঞ্জিত হয়ে যায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ঝিনুকের, সেই সাথে চারপাশের তুমুল হর্ষধ্বনি। অচেনা এক মানুষের আংটির সিঁদুরে বদলে গেল সঙ্ঘমিত্রা ঘোষ হয়ে গেল মিসেস সঙ্ঘমিত্রা সান্যাল।

বাবাকে ইশারায় কাছে ডাকে ঝিনুক, বাবার সেই ছোট মেয়ে ঝিনুক আর নেই। সোমনাথ মেয়ের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পিঠের ওপরে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে রে মা?”

যখন ছোট ছিল, যখন খেলতে গিয়ে পরে যেত আর ব্যাথা লাগত কোথাও, তখন ঠিক এই ভাবেই ওর বাবা ওকে কোলে নিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস করত, কি হয়েছে রে মা? অনেকদিন পরে বাবার কন্ঠে সেই আওয়াজ শুনে আর চোখের জল বাঁধ মানাতে পারল না ঝিনুক।

বাবার পা জড়িয়ে ধরে ভেঙ্গে পরে, “বাবা, প্লিজ বাবা শুধু একবার, একটা চান্স দাও বাবা, আমি তোমার ভালো মেয়ে হয়ে দেখাব, প্লিজ বাবা তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই না।”

============= পর্ব চার সমাপ্ত ============

❤️ "শেষের পাতায় শুরু" ❤️
 
পর্ব পাঁচ – (#1-18)

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে যায়। রিশুর ছুটি নেই, পরের দিনেই ওকে ফিরে যেতে হবে দিল্লী তাই সে রাতেই নব বিবাহিত দম্পতিকে নিয়ে আম্বালিকা ফিরে আসে নিজের বাড়িতে। গাড়িতে সারাটা রাস্তা মাথা নিচু করে চুপচাপ রিশুর পাশে বসেছিল ঝিনুক। মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখে পাশে বসা মেয়েটার দিকে যার সাথে এই মাত্র ওর বিয়ে হয়ে গেল। মা যার ছবি ওকে দেখিয়েছিল তার সাথে পাশে বসা মেয়েটার মধ্যে কোন মিল খুঁজে পায় না। কেমন যেন ভাবলেশ হীন চোখের চাহনি ঝিনুকের, যেন কোন সম্মোহনের বশে কাঁচের পুতুলের মতন নড়াচড়া করে চলেছে। গলা খ্যাঁকরে জানান দেয় নিজের উপস্থিতি, ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে তাকায় ঝিনুক রিশুর দিকে। বেদনা কাতর চাহিনি দেখে আর কিছু বলতে পারে না রিশু, বুঝতে পারে ঝিনুকের কষ্ট। গাড়িতে ওরা দুজন ছাড়াও সামনের সিটে দিয়া বসে, ঝিনুকের পাশে ওর বোন ঝিলিক বসে তাই চুপ করেই থাকে রিশু। নব দম্পতিকে বরন করে নতুন জীবনের আশীর্বাদ করে আম্বালিকা আর নিলাদ্রী।

রিশুর ঘরে ঢুকে চারপাশে তাকিয়ে দেখে ঝিনুক। ওদের ফ্লাটের চেয়ে অনেক বড় এই বাড়িটা। মায়ের মুখে শুনেছে যে আম্বালকা আন্টির বাবা নাকি খুব নাম করা একজন ডাক্তার ছিলেন। রিশুর থাকার ঘরটা ওর ঘরের চেয়ে অনেক বড়, এক পাশে ধবধবে সাদা বিছানা, এক পাশের দেয়াল জুড়ে বড় একটা কাঁচের জানালা, সেই জালানার পাশে একটা পড়ার টেবিল, একটা চেয়ার, সেই সাথে বিছানার পাশে একটা কাউচ রাখা। ঘরে ঢোকার আগেই ওর সুটকেস দুটো কোন কাজের লোক এই ঘরে এনে রেখে দিয়েছিল। সারাদিন ঘুম হয়নি ওর তার ওপরে মানসিক অবস্থা ভালো নয়, খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে। যে সুটকেসে ওর সাধারন দৈনন্দিনের জিনিসপত্র ছিল সেটা হাতে নিয়ে বিছানার ওপরে রাখার সময়ে বুঝতে পারে যে দরজায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে যে যার সাথে একটু আগে বিয়ে হয়েছে সেই রিশু দরজার পর্দা সরিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। ধুক করে এক লহমার জন্য ওর হৃদপিণ্ড গলার কাছে এসে আটকে যায়। এত কিছু হয়ে গেল কিন্তু কেউই এক বারের জন্য মুখ খোলেনি। যেন কারুর কিছুই বলার নেই কারুর কাছে।

রিশু বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে ঝিনুকের দিকে। লাল বেনারসি পরিহিত, কপাল জুড়ে এখন লাল সিঁদুর মাখা, গালে নাকের ওপরেও লাল সিঁদুরের ছোপ ছোপ দাগ। কি ভাবছে ঝিনুক? লাজুক স্বভাবের কোনদিন নয় রিশু যে মেয়েদের সাথে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করবে, কিন্তু এই মেয়েটার দিকে তাকাতেই কেমন যেন সব গুলিয়ে আসে ওর মাথার মধ্যে। ঝিনুক একা একাই সুটকেস খুলতে চেষ্টা করাতে এগিয়ে যায় রিশু।

রিশু এগিয়ে এসে বলে, “দাঁড়াও আমি খুলে দিচ্ছি।”

চুপচাপ সুটকেসের পাশ থেকে সরে দাঁড়ায় ঝিনুক। এটা ওর সাথে দ্বিতীয় বার কথা বলেছে।

সুটকেস খুলে দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে রিশু, “যে অয়েন্মেন্টটা বলেছিলাম সেটা লাগিয়েছিলে?”

মাথা দোলায় ঝিনুক, হ্যাঁ, এনেছিল এবং সেটা নিয়ম মতন লাগিয়েছিল আঁচড়ের দাগের ওপরে। ছেলেটার গলার আওয়াজ বেশ রাশভারী, ভীষণ ভাবেই কাছে ডাকে, দূরে সরে থাকতে চাইলেও যেন দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

রিশু ওকে বাথরুম দেখিয়ে দিয়ে বলে, “যাও, আগে ফ্রেশ হয়ে নাও।”

সুটকেস থেকে রাতে পড়ার একটা নতুন কেনা মাক্সি আর তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পরে ঝিনুক। বাথরুমটা বেশ বড়, এক পাশে একটা বড় বাথটাব। গিজার চালিয়ে গরম জল করে এক এক করে নিজের সাজ খুলে ফেলে, সাবান দিয়ে মুখ হাত ধুয়ে নেয়। কপালের সিঁদুর ধুতে গিয়ে হটাত করেই কেমন যেন বাঁধা পরে যায় ওর মন, না এটা এমন থাকুক, হয়ত এটাই নিয়তি। আয়নায় নিজের গালের দিকে দেখে, এতক্ষন সাজের পেছনে লুকিয়ে ছিল দাগ গুলো, মেকআপ ধুয়ে যেতেই সেই অস্পষ্ট দাগ বেড়িয়ে পরে। গালের দাগ এখন একটু আছে তবে হাতের আঁচড়ের দাগ তেমন আর নেই। মাক্সিটা পরে গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে পরনের ভারী বেনারসি আর বাকি কাপড় হাতে বেড়িয়ে আসে বাথরুম থেকে। বেড়িয়ে এসে দেখে রিশু হাতে নিজের জামা কাপড় নিয়ে বাথরুম খালি হওয়ার অপেক্ষায়।

রিশু নিজের আলমারি খুলে একটা ঢিলে প্যান্ট আর একটা টি শারট বের করে নেয় পড়ার জন্য। বাথরুমের ভেতর প্রথমে কোন আওয়াজ না পেয়ে একটু ভাবনায় পরে যায়। ঝিনুক সকাল থেকে কিছুই খায়নি, খেয়েছে সেই রাতে বিয়ে শেষ হওয়ার পরে তাও আবার খুব অল্প। প্রেসার লো হয়ে মাথা ঘুরে পরে গেল না ত বাথরুমের মধ্যে? দেরি দেখে দরজায় একবার টোকা দেওয়ার কথা ভাবে, তারপরে ভাবে না, এটা ঠিক হবে না, মেয়েদের সাধারণত দেরি হয়। তারপরে যখন জলের আওয়াজ পায় তখন ধড়ে প্রান ফিরে পায়, না ঠিক আছে ঝিনুক। এক ধাক্কায় এতবড় একটা দায়িত্ব ওর ওপরে এসে পড়েছে, সেই সাথে ভীতি ওর বুকের মাঝে ছায়া ফেলে, মানিয়ে নিতে পারবে ত? এরপর একে নিয়ে দিল্লী ফিরে যেতে হবে, জানা হয়নি ঝিনুকের পছন্দ অপছন্দ, আসলে চেনেই না যার সাথে হটাত করে বিয়ে হয়ে গেল। বাথরুম থেকে ঝিনুক বেড়িয়ে আসতেই ওর চোখ আটকা পরে যায় ঝিনুকের মুখের দিকে। এতক্ষন মেকি সাজের নিচে লুকিয়ে থাকা মেয়েটার আসল সৌন্দর্য বেড়িয়ে এসেছে। পানপাতার মতন মুখ বয়াব, টানাটানা ভাসা ভাসা দুই চোখ, ওর দিকে তাকিয়ে যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। গালের দিকে চোখ যায় ওর, এখন আঁচড়ের দাগ মিলিয়ে যায়নি। কপাল নাক জুড়ে তখন সিঁদুরে মাখামাখি দেখে মনে মনে হেসে ফেলে রিশু। রিশুর দিকে আড় চোখে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায় ঝিনুক।

রিশু ঢুকে পরে বাথরুমের মধ্যে। ধুতি পাঞ্জাবী খুলে, হাত মুখ ধুয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখে ঝিনুক আলো নিভিয়ে ওর বিছানার ওপরে এক কোনায় চুপচাপ হাঁটু মুড়ে মাথা নিচু করে কুঁকড়ে বসে। রিশু ঘরের ডিম লাইট জ্বালিয়ে দেয়, হাল্কা নীল আলোয় ভরে ওঠে ঘর। দরজা বন্ধ করে দেয় রিশু, দরজা বন্ধের আওয়াজে কেঁপে ওঠে ঝিনুক, ভাসা ভাসা চোখে ওর দিকে দেখে। কি করতে চলেছে এবারে, এবারে কি ঝাঁপিয়ে পড়বে নাকি ওর ওপরে? হাল্কা নীলাভ আলোয় রিশু পরিস্কার দেখতে পায় যে ঠান্ডার জন্য হোক কি কোন অজানা আশঙ্কায় ঝিনুকের কমনীয় শরীরে কাঁপন ধরেছে। বিছানার দিকে এগিয়ে যায় রিশু। ওকে এইভাবে এগিয়ে আসতে দেখে ঝিনুক আরও কুঁকড়ে যায়। ঝিনুকের এই ভাবে কুঁকড়ে যাওয়ায় রিশু খুব ব্যাথা পায়, এইভাবে কাউকে ব্যাথা দিতে কোনদিন চায়নি।

ঝিনুকের দিকে দেখে নরম গলায় বলে, “ঝিনুক যে অবস্থায় আমাদের...”

কথাটা শেষ করতে দেয় না ঝিনুক, ভগ্ন হৃদয়ে চাপা কন্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে, “আমাদের বিয়ে হয়েছে বলে আপনি আমাকে কিনে নেন নি।”

সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর মুখে “আপনি” সম্বোধন শুনে হেসে ফেলে রিশু, “এখন আপনি ধরেই বসে আছো?” ঝিনুক চোয়াল চেপে ওর দিকে রক্ত চক্ষু হেনে তাকিয়ে তখন। রিশু নরম গলায় বলে, “আমি জানি তোমার মনের অবস্থা।”

ঝিনুক ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “না, আপনি কিছুই জানেন না। আমার দিকে এক পাও এগোবেন না।”

হাত তুলে শান্ত ঝিনুককে শান্ত করিয়ে বলে, “প্লিজ এত ফরমালিটি কর না, আপনি নয় তুমি করেই বল। আমরা সত্য যুগে বসবাস করছি না।” ঝিনুক হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না। নরম গলায় ঝিনুকের রাগ প্রশমিত করার জন্য বলে, “এত রাতে এইভাবে চেঁচাতে নেই। বাইরে মা পাপা আমার ভাই বোন তোমার বোন সবাই আছে।” ঝিনুক নিজের ভুল বুঝতে পেরে চুপ করে যায়। মাথা নাড়ায় রিশু, “না সত্যিই আমি কিছুই জানি না।”

কথা বাড়ায় না ঝিনুক, লেপটা গায়ের ওপরে টেনে নিয়ে এক কোনায় কুঁকড়ে শুয়ে পরে। বিছানার পাশের কাউচে চুপচাপ বসে পরে রিশু, ওর দিকে পেছন করে ঝিনুক শুয়ে। হাল্কা নীলাভ আলোয় পরিষ্কার বুঝতে পারে যে শায়িত ঝিনুকের দেহ থেকে থেকে ফুলে ফুলে উঠছে, চাপা কান্নার আওয়াজ ওর কানে ভেসে আসে।

আলমারি খুলে একটা মোটা শাল গায়ে জড়িয়ে চুপ করে সারা রাত কাউচে বসে কাটিয়ে দেয় রিশু। চোখের দৃষ্টি সাদা বিছানায় শায়িত ক্রন্দনরত ললনার দিকে নিবদ্ধ। এক দুশ্চিন্তায় ডুবে যায় ওর মন, যে মেয়ে বাবা মাকে অমান্য করতে পারে সে অনায়াসে ওর বাড়ির লোককে অমান্য করবে। মায়ের ছোট বেলার বান্ধবী তার বড় মেয়ে তাও মনের কোনায় এক বড় কিন্তু জাগে ওর। এর আগেও একজনের ওপরে বিশ্বাস করেছিল, কিন্তু সেই তৃতীয় ব্যাক্তি মায়ের মাতৃস্নেহ সঠিক অর্থে অনুধাবন করতে পারেনি। ঝিনুক বদরাগী জেদি মেয়ে একদম ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। বাবা মায়ের কথা অমান্য করে কেউ যদি বারেবারে আত্মহত্যার ভয় দেখায় সেই মেয়েকে জীবন সঙ্গিনী করা ভীষণ বিপদ। নিজেকেই প্রশ্ন করে রিশু, মা কি শুধু মাত্র বান্ধবীর মুখের দিকে চেয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে? একবারের জন্য মনে হয়েছিল যে বলে, মা মেয়েটা খুব বদরাগী আর জেদি, মনে হয় একে ওদের মাঝে এনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু মায়ের চোখে তখন মহামায়ার রূপ, কি করে একটা ভেসে যাওয়া মেয়েকে বাঁচাবে সেটাই চিন্তা ঘোরাফেরা করছিল ওর মায়ের মাথায়। সহজ সরল রেখায় ওদের জীবন ধারা অগ্রসর হবে না সেটা সেই রাতেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিল রিশু।

কয়েক বছর আগের কথা মনে পরে যায়, বেশ কয়েকবার চন্দ্রিকার সাথে বাড়ি নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছিল, কয়েকবার বুঝাতে চেষ্টা করেছিল ওর সাথে ওর বাড়ির সম্পর্ক। কিন্তু যা ভেঙ্গে গেছে সেটা শেষ পর্যন্ত জোড়া লাগাতে কোনদিন চেষ্টা করেনি রিশু, খানিকটা অহম ভাব জেগে উঠেছিল শেষের দিকে, যার জন্য কোনদিন চন্দ্রিকাকে ক্ষমা করতে পারেনি রিশু। কিন্তু এখানে ঝিনুকের ওপরে সেই রাগ সেই ক্ষোভ দেখাতে পারবে না রিশু, নিজের অহম ভাবটাকে ঢেকে রাখতে হবে শুধু মা আর দিয়ার মুখ চেয়ে। মা হয়ত কোনদিন চাইবে না ওর প্রিয় বান্ধবীর সাথে আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক অথবা এই দরজার বাইরে ওই ওর বোন আর বান্ধবী যে ভাবে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে সেটাকেও ভেঙ্গে দিতে ওর মন চায় না। লেপের মুড়ি দেওয়া ঝিনুকের ঢেউ খেলানো দেহ পল্লবের দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা তখন চাপা কান্নায় কেঁপে চলেছে।

ভোরের দিকে তন্দ্রা ভাব এসে গেছিল রিশুর, দরজায় আলত ঠকঠকের আওয়াজ পেয়েই সেই তন্দ্রা ভাব কেটে যায়। জানালায় দিয়ে নতুন ভোরের আলো ওর সাদা বিছানার ওপরে এসে পড়েছে। চোখ ডলে, চশমা পরে দেখে গলা পর্যন্ত লেপ জড়িয়ে বিছানায় বসে ওর দিকে তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে তাকিয়ে ঝিনুক। ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন করে ঝিনুককে, কি হয়েছে? ঝিনুক মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, কিছু না। সারা রাত কাঁদার ফলে ওর চোখ জোড়া ফুলে উঠেছে, কিন্তু স্বান্তনার সঠিক ভাষা খুঁজে পায় না। কাকে দেবে স্বান্তনা, নিজেকে না বিছানায় বসা মেয়েটাকে।

দরজা খুলতে যাওয়ার আগে, ঝিনুকের দিকে গায়ের শাল এগিয়ে দিয়ে বলে, “এটা গায়ে দাও না হলে ঠান্ডা লেগে যাবে। এখন উঠে পর, ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে নাও।”

কথা বাড়ায় না ঝিনুক। সারা রাত জেগেছিল, লেপের তলায় অন্য পাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়েও ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানে বিছানার পাশের কাউচে বসে সারা রাত ওর দিকেই তাকিয়েছিল রিশু। ওর হাত থেকে শাল নিয়ে, সুটকেস খুলে ব্রাস বের করে বাথরুমে ঢুকে পরে ঝিনুক। রিশু আড়ামোড়া ভেঙ্গে, ঘুম থেকে ওঠার ভান দেখিয়ে দরজা খুলে দেখে দিয়া আর ঝিলিক একটা ট্রে তে চা নিয়ে দাঁড়িয়ে।

দিয়া দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে, “কি দাদা ভাই, ঘুম হয়েছে?”

ঝিলিকের ঠোঁটে দুষ্টুমি ভরা হাসি, বান্ধবীকে ঠেলে ইয়ারকি মেরে বলে, “ধ্যাত তুই না, ঘুম কি আর হয়। দুইজনে সারা রাত প্রেমালাপ করেছে।”

ওদের কথা শুনে হেসে ফেলে রিশু, “তোরা দুটো না বড্ড শয়তান হয়ে গেছিস।”

ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে দুইজনে। ঝিলিক জিজ্ঞেস করে, “দিদি কোথায়?”

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বাথরুম দেখিয়ে দিয়ে উত্তর দেয় রিশু, “বাথরুমে।”

ঝিনুক বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এসে দেখে দিয়া আর ঝিলিক ওদের ঘরে উপস্থিত। রিশু ঘাড় ঘুরিয়ে নতুন ভোরের সদ্য ফোটা ফুলের দিকে তাকিয়ে দেখে। কপালের সিঁদুর ধুয়ে ফেলেছে বইকি কিন্তু এখন যেন মাথার চুলে একটু লেগে রয়েছে। শাল জড়িয়ে মুখে হাসি টেনে দিয়া আর ঝিলিকের দিকে তাকায় ঝিনুক। ভেতরে খানিক ইতস্তত ভাব, বুদ্ধিমতী ঝিনুক সেই ভাব আড়াল করে রিশুর দিকে তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে চোখের ইশারায় বাথরুমে ঢুকে যেতে বলে। এই টানাটানা চোখের হুকুম অমান্য করা ওর সাধ্যের বাইরে। তোয়ালে নেওয়ার সময়ে দুইজনের আঙ্গুল ক্ষনিকের জন্য একে অপরের সাথে ছুঁয়ে যায়। জোর করে রিশুর হাতের মধ্যে তোয়ালে গুঁজে দিয়ে মিষ্টি হেসে দিয়া আর ঝিলিককে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। রাতের ওই ঝড়ের পরে ভোরের বেলায় ঝিনুকের ঠোঁটের হাসি দেখে বিভোর হয়ে যায় রিশু, দরজা দিয়ে বেড়িয়ে না যাওয়া পর্যন্ত নিস্পলক ওর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।।

❤️ "শেষের পাতায় শুরু" ❤️
 
পর্ব পাঁচ – (#2-19)

সকালের খাওয়া দাওয়ার পর থেকেই তোড়জোড় শুরু, সন্ধ্যের ফ্লাইটে ফিরে যেতে হবে দিল্লী। ঝিনুকের বাবা মা কিছু পরে উপস্থিত হয়ে যায় আম্বালিকার বাড়িতে। জিনিস পত্র গুছাতেই সময় চলে যায় ওদের। বড় বড় তিনটে সুটকেস ভর্তি জিনিস পত্র, একটা রিশুর দুটো ঝিনুকের। বারবার আম্বালিকা ঝিনুককে জানিয়ে দেয় যে দিল্লীতে প্রচন্ড ঠান্ডা, যেন একটু সাবধানে থাকে। গত রাতের যে আড়ষ্ট ভাব ছিল সেটা মায়ের দেখা পেয়ে অনেকটাই কেটে যায় ঝিনুকের। যদিও ঠিক ভাবে এই সম্পর্ক মানতে নারাজ তাও সবার মুখের দিকে চেয়ে ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে থাকে। সারাদিনে হ্যাঁ, না, মাথা দোলান ছাড়া বিশেষ কোন কথা হয়না রিশুর সাথে। লাজুক নতুন বউয়ের মতন ভাব দেখিয়ে এড়িয়ে গেছে রিশুকে। বিকেলের দিকেই সবাই রওনা হয় এয়ারপোরটের জন্য। সন্ধ্যের পরে ফ্লাইট, দিল্লী পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে যাবে, বাড়ি পৌঁছাতে আরো অনেক রাত হবে। আম্বালিকা বারেবারে ওদের বলে ছিল যে এয়ারপোরটে যেন কিছু খেয়ে নেয়। বাধ্য ছেলে মেয়ের মতন মাথা দুলিয়ে সায় দেয় রিশু আর ঝিনুক। জল ভরা চোখে সবাইকে বিদায় জানিয়ে এয়ারপোরটের কাঁচের দরজা দিয়ে ঢুকে পরে দুইজনে। আম্বালিকা আর পিয়ালী, দুই মা, ওদের দিকে জল ভরা চোখ নিয়ে বিদায় জানায়।

রিশু সারা দিনে ঠিক ভাবে চোখ ভরে দেখার অবকাশ পায়নি ঝিনুকের দিকে। সর্বদা ওকে ঘিরে কেউ না কেউ ছিল, বিয়ের পরের দিনেই এই ভাবে ফিরে যেতে হবে বলে সবার খুব মন খারাপ, কিন্তু কিছু করার নেই, রিশু ডাক্তার কর্তব্য দায়িত্ব সবার আগে। এয়ারপোরটে ঢুকে লাগেজ চেক করানোর সময়ে তাকিয়ে থাকে ঝিনুকের দিকে। যদিও ঝিনুকের পছন্দ অপছন্দ ওর জানা নেই তাও বেশ কয়েকটা দোকান ঘুরে একটা দামি তুঁতে রঙের সালোয়ার কামিজ কিনেছিল, সেই সাথে গাড় নীল রঙের কলার দেওয়া লম্বা ওভারকোট। ঝিনুকের পরনে ওর দেওয়া সেই সালোয়ার কামিজ দেখে বেশ ভালো লাগে। দুই কাজল টানা চোখের দিকে তাকায় রিশু, যেন ওকেই জিজ্ঞেস করছে, এত কি হা করে দেখছ? ঠোঁটে গাড় লাল রঙের লিপস্টিক, মাথার চুল একপাশে করে আঁচড়ান, গাড় বাদামি রঙের চুল মাথার পেছনে বেশ সুন্দর করে বাঁধা, সাজতে জানে মেয়েটা তাহলে। বাঁকা পাতলা ভুরুর মাঝে ছোট্ট লাল রঙের টিপ আর সিঁথিতে সিঁদুরের দাগ। ওভারকোটটার বেল্ট কোমরে বাঁধা থাকার ফলে কোমর বেশ পাতলা দেখায়, দুই হাতে সোনার গয়না আর সদ্য বিবাহিতার নিদর্শন স্বরূপ সোনায় বাধানো শাঁখা পলা, লম্বা নখে লাল রঙের নেল পলিশ।

রিশুকে ওইভাবে তাকিয়ে থাকাতে দেখে ভীষণ বিব্রত বোধ করে ঝিনুক। বুকের ওপরে হাত ভাঁজ করে অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকে। অত কি ফ্যালফ্যাল করে দেখছে ছেলেটা, এর আগে কি মেয়ে দেখেনি নাকি। এতক্ষনে ঠিক ভাবে কথাও হয়নি, কথা বলার মতন মানসিকতা ছিল না একদম। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়েই গেল আর এই মানুষটার সাথে কেমন নির্বিকার ভাবে চলেও যাচ্ছে দিল্লীতে। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হয় ঝিনুকের, তোর নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছে বলতে কি কিছু নেই নাকি যে চলে যাচ্ছিস? আপন মনে হটাত করেই মাথা নাড়ায়, না চলে যাওয়া ছাড়া ওর কাছে আর কোন উপায় নেই।

সিকিউরিটি চেকের আগে ওর হাতে বোরডিং পাস ধরাবার সময়ে আঙ্গুলের সাথে আঙ্গুলের ছোঁয়া লাগে। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের লাইন বেশ লম্বা, ঝিনুকের তাড়াতাড়ি চেকিং হয়ে যায়। বেড়িয়ে এসে কোথাও রিশুকে দেখতে না পেয়ে ব্যাকুল হয়ে যায় ওর হৃদয়, নিজের অজান্তেই শুন্য হয়ে যায় মনের কানা গলি, গেল কোথায়? এই ত দাঁড়িয়েছিল লাইনে। এদিকে ওদিকে তাকিয়েও খুঁজে পায় না। হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নাকি? এমন সময়ে কাশির আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে। খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, কোথায় গেছিলেন, এতক্ষন লাগে নাকি? না বলতে পারেনি ঝিনুক কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকেছিল তখন। রিশু ইশারায় জানায় যে ফ্লাইটের আরো বেশ কিছু দেরি আছে। ঝিনুক ফোন করে মাকে জানিয়ে দেয় যে ওদের সিকিউরিটি চেক হয়ে গেছে, দিল্লীতে পৌঁছে জানিয়ে দেবে। একটা চেয়ার খালি দেখে ঝিনুক কে বসতে অনুরোধ করে রিশু।

অন্ধকার নেমে এসেছে বেশ আগেই, বড় কাঁচের জানালা পাশে দাঁড়িয়ে রিশু, কাঁধে ওর ল্যাপটপের ব্যাগ। চেয়ারে বসে ফোন দেখতে দেখতে আড় চোখে রিশুর দিকে তাকিয়ে দেখে। পরনে একটা জিন্স আর শারট, দেখে মনেই হয় না যে আগের দিন ওদের বিয়ে হয়েছে। ছেলেটাকে খুব সাধারন দেখতে কিন্তু কেমন যেন একটা আকর্ষণ আছে ওর বুদ্ধিদীপ্ত চোখে আর গুরু গম্ভির আওয়াজে। এই কয়দিনে ঠিক ভাবে নিজের ফোন দেখতে পারেনি ঝিনুক, প্রচুর কল আর প্রচুর মেসেজ। বন্ধু বান্ধবীরা যারা এসেছিল তাদের সবার প্রশ্ন, হটাত কি করে দিল্লীর এত বড় এক ডাক্তারের সাথে ওর বিয়ে হয়ে গেল। বসে বসে ফেসবুক আর ইন্সটাগ্রাম খুলে পার্থের সাথে যেকটা ছবি দেওয়া ছিল, সব সরিয়ে দেয়। ফেসবুকে, মোবাইলে প্রচুর মেসেজ কিন্তু কারুর মেসেজের উত্তর দেওয়ার মতন মানসিকতা ছিল না ওর।

কাঁচের জানালার অন্যপাশে ঘন অন্ধকার, সারি দিয়ে প্লেন দাঁড়িয়ে। কাঁচের জানালায় ঠিক পেছনে বসে থাকা ঝিনুকের প্রতিফলনের দিকে চোখ যায়, মাথা নিচু করে বসে এক মনে ফোন দেখে চলেছে। আশে পাশে প্রচুর মানুষের ভিড়, যারা একা নয় তারা সবাই তাদের সাথের লোকের সাথে গল্প করছে। এপাশে ওপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কয়েকজন দম্পতি চোখে পরে, সবাই কেমন একে অপরকে জড়িয়ে ধড়ে আলাপে মশগুল। ওর সাথে ওর নতুন বিবাহিতা স্ত্রী তাও রিশু বড় একা। ইন্দ্রজিত আর শালিনীকে বলেছিল সাথে আসতে, কিন্তু বিয়ের পরে নিলেশের সাথে ওদের বাড়ি চলে গেল তাই একা একাই ফিরতে হচ্ছে ওদের। ইন্দ্রজিত থাকলে অন্তত ওর সাথে গল্প করতে পারত আর শালিনীকে পেয়ে ঝিনুকের একাকিত্ত্ব ভাব দূর হত। অনেকক্ষণ না খেয়ে রয়েছে হয়ত ওর খিধে পেয়েছে, রিশুর অভ্যেস আছে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা, না খেয়ে থাকা। কোন কোন দিন টানা পাঁচ ছয় ঘন্টা অপারেশান থিয়েটারে কাটিয়ে যখন বের হয় তখন আর খাওয়ার ইচ্ছে থাকে না। তাও একবার ঝিনুক কে জিজ্ঞেস করা উচিত কিছু খাবে কি না।

দুপুরের পরে কিছুই খায়নি, জল পিপাসাও পেয়েছে, কিছু বলতেও পারছে না ঝিনুক। গত রাতে যেভাবে গলা চড়িয়ে কথা বলেছে তারপর থেকে রিশু ওর সাথে ঠিক ভাবে কথা বলেনি। অতি আবশ্যক না হলে একদম কথাই বলেনি বরং ওকে এড়িয়েই চলে গেছে। ঝিনুক মাথা নিচু করে ফোন দেখলেও ষষ্ট ইন্দ্রিয় সজাগ ছিল ওর। পাশে ছায়া দেখতে পেয়ে মাথা উঁচু করতেই রিশুর সাথে চোখাচুখি হয়ে যায়।

ভুরু কুঁচকে ঝিনুক ওর দিকে তাকায়, কি হয়েছে? না মুখে বলেনি ইশারায় কথা হয় ওদের।

রিশু জিজ্ঞেস করে, “কিছু খাবে কি?”

নিজের ল্যাপটপের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় ঝিনুক, রিশুর চোখের দিকে তাকাতে গিয়েও চোখ নামিয়ে বলে, “একটু জল পেলে ভালো হত।”

ছোট্ট উত্তর দেয় রিশু, “আচ্ছা।”

সামনের একটা দোকান থেকে জলের বোতল কিনে ওর হাতে ধরিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আর কিছু চাই? ইঙ্কামিং ফ্লাইট এখন আসেনি তাই ফ্লাইট একটু লেট আছে।”

খিধে পেয়েছিল খুব, কিন্তু কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারছে না। জল খেয়ে এপাশ অপাশ তাকিয়ে দেখে, বেশ কয়েকটা ফুড স্টল রয়েছে। ঝিনুকের চোখ খাবারের স্টলের দিকে যেতেই মনে মনে হেসে ফেলে রিশু, “পিজ্জা বারগার না দোসা?”

এমনি বন্ধুদের সাথে হলে পিজ্জা না হয় বার্গার এইসব খেত কিন্তু রিশুকে কি বলবে? নিচু গলায় বলে, তুমি যা খেতে চাও। কিন্তু গলা থেকে স্বর বের হয়না ওর, শুধু ঠোঁট কাঁপাটাই রিশুর চোখে পরে। শুনতে না পেয়ে ঝিনুকের দিকে একটু ঝুঁকে পরে রিশু, নাকে ভেসে আসে মাদকতাময় সুঘ্রাণ, বুক ভরে শ্বাস নিয়ে সেই ঘ্রানে নিজের স্নায়ুকে তরতাজা করে নেয় রিশু। আবার জিজ্ঞেস করে, “কি খাবে বল?”

কানে কালা নাকি ছেলেটা, নাকি রিশু ইচ্ছে করেই ওর দিকে অমন ভাবে ঝুঁকে? কিঞ্চিত রেগে যায় ঝিনুক, ভুরু কুঁচকে বলে, “না, খিধে নেই আমার।”

মুচকি হাসে রিশু, “লো কস্ট ফ্লাইট, খেতে দেবে না কিন্তু।”

হাসি পেয়ে গেছিল ঝিনুকের তাও ওর সামনে হাসতে খুব বাধো বাধো ঠেকছিল তাই গোমাড়া মুখ করে উত্তর দেয়, “দোসা হলেই চলবে।”

দুটো মসালা দোসা নিয়ে সামনা সামনি চেয়ারে বসে খেতে শুরু করে দুইজনে। দিল্লী পৌঁছাতে কত রাত হবে জানা নেই, এয়ারপোরট থেকে ওর বাড়ি কতদুর সেটাও জানে না, শুধু জানে সিআর পার্ক এলাকায়। দিল্লীতে বেড়াতে এসেছে ঝিনুক কিন্তু সেটা অনেক ছোট বেলায়। গত রাতে পাশে আসেনি, সেটা ঠিক, কিন্তু দিল্লীতে কি করবে? কটা ঘর ওর বাড়িতে, আলাদা শোয়ার ঘর আছে? মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন জেগে ওঠে ওর। যদি রিশু বিছানায় শোয় তাহলে ও মাটিতে শোবে। যদিও ওদের ধর্ম সম্মত বিয়ে হয়েছে কিন্তু তাও এই ভাবে কোন অচেনা অজানা মানুষের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে নারাজ। দেখে ত মনে হয় না যে রিশু ওর প্রতি এতটা নিষ্ঠুর হবে। এখন এই প্রশ্নের উত্তর জানা হয়নি, কেন ওকে বিয়ে করেছে। বেশ শিক্ষিত এত বড় ডাক্তার, ইচ্ছে করলে ওর চেয়েও অনেক ভালো মেয়েকে বিয়ে করতে পারত। প্রেমে ধাক্কা খেয়েছে বলে আর বিয়েই করল না? মায়ের মুখে শুনেছে, অম্বরীশ প্রচন্ড মাতৃ ভক্ত ছেলে, ভয় সেখানেই কথায় কথায় হয়ত এরপর মাকে টেনে আনবে। এই সব মাতৃ ভক্ত অতি ভালো ছেলেদের দেখলেই গা পিত্তি জ্বলে যায়, কেমন যেন ভিজে বেড়াল মনে হয় ওদের। এতক্ষন সামনে বসে থাকলেও ভুলেও চোখ তুলে তাকায়নি ওর দিকে, পাছে চোখাচুখি হয়ে যায় আর ওর মনের ভেতরের হাজার প্রশ্ন পড়ে ফেলে রিশু। তবে রিশুকে দেখে ভিজে বেড়াল বলে একদম মনে হয় না, বরঞ্চ মনে হয় যেন পশুর রাজা সিংহ, শান্ত বুদ্ধিদীপ্ত, মার্জিত শিক্ষিত সেটা ওর চলনে বলনে চেহারায় ফুটে ওঠে। গতরাতে ও যেমন ভাবে রিশুর ওপরে চেঁচিয়ে ছিল অন্য কোন ছেলে হলে সেই মুহূর্তে বাড়ির সবাইকে ডেকে একটা বিহিত করে দিত, হয়ত ওকে টেনে এক থাপ্পড় মেরে চুপ করিয়ে দিত। সেই সব কিছুই করেনি, উলটে ওকে বুঝিয়ে চুপ করাতে চেষ্টা করেছে।

চুপ করে খেতে খেতে মাঝে মাঝে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে দেখে। এত নিচু মাথা করে কি কেউ খায় নাকি? এরপর মনে হয় থালার মধ্যে ঢুকে পড়বে। ঝিনুকের খাওয়া দেখে ভীষণ হাসি পায় রিশুর, ছোট এক টুকরো নিয়ে কত ভেবে তারপরে মুখের মধ্যে গ্রাস তুলছে। এত কি ভাবছে? কোথায় হারিয়ে গেছে মেয়েটা? মায়ের মুখে অথবা পিয়ালী আন্টির মুখ থেকে যা শুনেছে তার কিছুই মিলছে না। শুনেছে এই মেয়ে নাকি প্রচন্ড কথা বলে, ভীষণ উচ্ছল আর প্রানবন্ত, কোথায় সেই সব? একটা প্রেমে ধাক্কা খেয়েছে বলে এত মুষড়ে পড়েছে? একদম সঠিক সময়ে সেই ধূর্তের সত্য উন্মোচন হয়েছে বলেই বেঁচে গেছে না হলে সারা জীবন সেই ধূর্তের সাথে কাটাতে হত। তাই বলে এই ভাবে মুষড়ে পড়বে নাকি? চন্দ্রিকা চলে যাওয়ার পরে মুষড়ে যদিও পরেনি তবে কারুর সাথে আর নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে পারেনি। মনে মনে হেসে ফেলে রিশু, রাতে যেভাবে আহত সাপের মতন ওর দিকে ফোঁস করে উঠেছিল তাতেই বোঝা গেছে যে এই মেয়ে ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না।

ভাবনা চিন্তনের ধারা কেটে যায় রিশুর গলা শুনে, “এত কি ভাবছ?”

সত্যি ধরা পরে গেছে, কান লাল হয়ে যায় ঝিনুকের। মাথা নাড়ায়, না কিছু না এমনি। ওর দিকে তাকাতে ভীষণ বিব্রত বোধ করে। দোসা খাওয়া শেষ, অর্ধেক খেয়েই ওর পেট ভরে গেছে।

রিশু ওর থালার দিকে দেখে বলে, “এই টুকু, ব্যাস, আর খাবে না?”

মাথা দোলায় ঝিনুক, না ব্যাস হয়ে গেছে।

খাওয়া শেষে উঠে পরে দুইজনে। হাঁটতে হাঁটতে গেটের দিকে চলে যায়, হাঁটার সময়ে পাশাপাশি না হেঁটে একটু তফাতে পেছনে পেছনে হেঁটে চলে ঝিনুক। ফোন করে বাড়িতে জানিয়ে দেয় যে ফ্লাইট লেট, ওদের দিল্লী পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে যাবে। যথারীতি, ওর মায়ের সাথে রিশুও কথা বলে। তারপরে যখন রিশু নিজের বাড়িতে ফোন করে তখন ঝিনুক ও বেশ ভালো ভাবেই কথা বলে। শুধু মাত্র যখন দুজনা অন্যজনের সাথে কথা বলে না তখন মনে হয় যেন দুইদিকে দুই তুষের আগুন জ্বলছে ধিকিধিকি করে।

বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পরে প্লেনের বোর্ডিং কল হয়। জানালার পাশে ঝিনুকের সিট তার পাশে রিশু। কিছু পরে লম্বা রানওয়ে ধরে অন্ধকার চিড়ে ভীষণ জোরে দৌড়াতে শুরু করে প্লেন, ঝিনুকের বুক কেঁপে ওঠে, গত দশ বছর এই শহরে কাটিয়েছে। প্লেনটা মাটি ছাড়তেই চোখের কোনা ভিজে যায় ওর, রুমাল বার করে রিশুর অলক্ষেই চোখের কোনা মুছে বাইরের দিকে তাকায়। আলো গুলো ধিরে ধিরে এক এক করে ছোট হয়ে আসছে, আর কি ফিরে আসা হবে এই মাটিতে? চোখ বন্ধ করে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে হাতের মুঠো শক্ত করে নেয়, বুকের পাঁজর কেঁদে ওঠে, মা গো...
 
পর্ব পাঁচ – (#3-20)

রিশু ঘাড় ঘুরিয়ে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে দেখে, কাঁচের জানালায় মাথা রেখে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। এয়ারহস্টেসকে ডেকে একটা বালিশ চেয়ে আলতো করে ওর মাথা তুলে তার নিচে গুঁজে দেয়। গায়ের ওভারকোটটা গলার কাছে ঠিক করে দেয়। নজর যায় ওর বন্ধ চোখের কোনায়, একটা সরু শুকনো জলের দাগ করুন হয়ে বয়ে নাকের ডগা পর্যন্ত চলে গেছে। এত কষ্ট পাবে জানলে সত্যি বিয়ে করত না ঝিনুককে, কিন্তু সেদিন সবার সামনে তাহলে হ্যাঁ কেন বলেছিল, বলতে পারত যে একটু সময় চাই ভেবে দেখার জন্য, রিশু কিছু একটা বলে তাহলে কাটিয়ে দিতে পারত। অন্তত ওর একবার উচিত ছিল বিয়ের আগে একবার ফোন করার, সেটাও করেনি, বাধো বাধো ঠেকেছিল, মনে হয়েছিল আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাওয়া। বুকের বামদিকের পাঁজর ককিয়ে ওঠে এক অজানা ব্যাথায়। এই দুষ্টু মিষ্টি মেয়েটার বুকের ঘা কি সত্যি শুকিয়ে দিতে পারবে রিশুর কোন ওষুধ? শারীরিক ব্যাথা বেদনা, কাটা ছেঁড়া নিয়েই ওর নিত্য দিনের কাজ, শত শত রোগী আসে ওর কাছে তাদের অঙ্গ কেটে সেলাই করে সারাতে চেষ্টা করে রোজদিন। কিন্তু এই মেয়েটার বুকের ক্ষতর ওষুধ ওর জানা নেই।

পুরো ফ্লাইটেই ঝিনুক ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিল। এর আগেও বহুবার বেড়াতে গিয়ে প্লেনে উঠেছে তবে সেইবারের প্লেনে চাপা অন্যবারের চাইতে অনেক আলাদা। অন্যবার বোনের সাথে ঝগড়া হত কে জানালার পাশে বসবে, এবারে অনায়াসে জানালার সিট পেয়ে যায়। প্লেন নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। রিশু ঘুমন্ত ঝিনুকের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে, সিটের ওপরের আলো কোমল গালের মোলায়ম ত্বকের ওপরে পিছলে যায়। ঝিনুকের দিকে একটু ঝুঁকতেই ওর মিষ্টি এক ঘ্রানে ওর শিরা উপশিরা টানটান হয়ে যায়। ইচ্ছে করে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে গালের ওপরে জলের দাগ মুছে দেয়, কিন্তু কাজটা কি ঠিক হবে? গত রাতে একবার হাত ছুঁতে চেষ্টা করেছিল, আহত সাপের মতন যেভাবে ফোঁস করছিল তাতে আর দ্বিতীয় বার ইচ্ছে হয়নি। ডান হাত মুঠো করে মুখের সামনে নিয়ে গিয়ে ওর কানের কাছে অল্প কাশে।

ঘুম জড়ান চোখ মেলে তাকায় ঝিনুক, “কি হল?”

রিশু উত্তর দেয়, “এই ত ব্যাস ল্যান্ড করবে।”

ঝিনুক রুমাল দিয়ে চোখ মুছে জিজ্ঞেস করে, “আর কত দেরি লাগবে?”

রিশু বলে, “লাগেজ নিয়ে এখানে থেকে বের হতে ধর আরো এক ঘন্টা তারপরে ট্যাক্সিতে আরো এক ঘন্টা।” ঘড়ি দেখে বলে, “এখন সাড়ে ন’টা বাজে ত বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওই সাড়ে একগারটা বারোটার মতন বেজে যাবে।”

ওরে বাবা, এত দেরি। ঝিনুক ছোট উত্তর দেয়, “আচ্ছা।”

রিশু জিজ্ঞেস করে, “কোন ভারী জ্যাকেট এনেছ?”

ভুরু কুঁচকে তাকায় ঝিনুক, “কোন জ্যাকেট?”

মাথা নাড়ায় রিশু, “আর কোন জ্যাকেট আনোনি?”

মাথা নাড়ায় ঝিনুক, “হ্যাঁ এই এমনি বাড়িতে পড়ার অথবা এই বাইরে যাওয়ার কয়েকটা আছে।”

হেসে ফেলে রিশু, “ওই কোলকাতা মার্কা জ্যাকেটে কিন্তু এই রাতে কোন কাজে দেবে না। বাইরে কিন্ত এখন চার কি পাঁচ চলছে।”

ভয় দেখাচ্ছে নাকি ওকে? এত ঠান্ডা নাকি এখানে? আম্বালিকা আন্টি আর দিয়া বলেছিল এখানে খুব ঠান্ডা কিন্তু জ্যাকেট কেনার কথা ওকে কেউ বলেনি, আর সেই মানসিকতা ছিল না শপিং করার। প্লেন থেকে নামতে নামতে বেশ দেরি হয়ে যায়, বারবার ঘড়ি দেখে রিশু। প্লেন থেকে নেমে দুই বাড়িতেই জানিয়ে দেওয়া হয় যে ঠিক ভাবেই ওরা দিল্লী পৌঁছে গেছে, এবারে লাগেজ নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেবে। বাড়ির সাথে কথা বলার সময়ে বুদ্ধিমতী ঝিনুক আমূল পালটে যায়, যেন বেশ ভালো আছে। ওর কন্ঠস্বর শুনে কারুর বোঝার উপায় নেই ওর মনের ব্যাথা। মনে মনে হেসে ফেলে রিশু, বেশ চালাক মেয়ে, তাই’ত কলেজে কাউকে পাশে ঘেঁষতে দেয়নি। কিন্তু কি করে যে একটা অপদার্থের কবলে পড়ে গিয়েছিল কে জানে? মানুষ চিনতে সবার ভুল হয়, ওর ও হয়েছিল, চন্দ্রিকার হয়ত কোনদিন ওর ওপরে তেমন বিশ্বাস জন্মায়নি তাই ওর আসল ঘটনা না জেনেই ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

ঝিলিকের সাথে কথা বলার পরে একটু ভালো লাগে ঝিনুকের। দেখতে দেখতে বোন কত বড় হয়ে গেছে, পার্থের সাথে সম্পর্ক চলাকালিন দুই বোনের সম্পর্কের মধ্যে একটা চিড় দেখা দিয়েছিল। এক ধাক্কায় হারিয়ে যাওয়া বুকের কাছে সম্পর্ক গুলো আবার ফিরে পেয়েছে, পেয়েছে ওর ছোট বেলার খেলার সাথি ঝিলিককে, ফিরে পেয়েছে মাকে, ফিরে পেয়েছে বাবাকে। এয়ারপোরটে সবার সাথে বাবাও ছাড়তে এসেছিলেন, সবার পেছনে দাঁড়িয়ে সবার অলক্ষে চোখের কোনা মুছে নিয়েছিলেন সেই দৃশ্য ওর চোখে ধরা পরে গিয়েছিল। একটু ফ্রেশ হয়ে নিলে ভালো লাগত, ওদিকে রিশু যে হনহনিয়ে হেঁটে চলেছে। ওর সাথে তাল মিলিয়ে হাটা খুব মুশকিল, কি লম্বা লম্বা পা ফেলে রে বাবা ছেলেটা।

পেছন থেকে একটু জোরে ডাক দেয় রিশুকে, “হ্যালো, এই যে...” ঝিনুকের ডাক রিশুর কানে পৌঁছায় না কারণ ফোনে কারুর সাথে কথা বলতে ব্যাস্ত। একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে রিশুর পাশে গিয়ে একটু জোরেই ডাক দেয়, “হ্যালো... আমি একটু ওয়াশ রুম যাবো।”

কান থেকে ফোন সরিয়ে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে এক পাশে ওয়াসরুম দেখিয়ে ঝিনুককে বলে রিশু, “ওদিকে আছে, আমি লাগেজ বেল্টের কাছে থাকব।”

মাথা দোলায় ঝিনুক। ওয়াশ রুমের দিকে এগোতে এগোতে একটা অজানা নাম্বার থেকে ফোন আসাতে বেশ অবাক হয়ে যায় ঝিনুক, সেই সাথে একটু ভয় পেয়ে যায়। ঝিনুক জানত যে ওর বিয়েতে পার্থ নিজের গুপ্তচর লাগাবে, জানতে চাইবে কার সাথে বিয়ে হয়েছে কোথায় বিয়ে হয়েছে। সেদিন রাতে পার্থের ফোন ভেঙ্গে দিয়েছিল, এই নাম্বার পার্থের নয়ত? ওর ছবি পার্থের মোবাইলে ছিল, সেই ছবি অন্য কাউকে দেখিয়েছে কি? যদি দেখিয়ে থাকে তাহলে অনেকের কাছেই ওর অর্ধ নগ্ন ছবি ছড়িয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এমন বহু প্রশ্ন মনের দোরগোড়ায় ভিড় করে আসে।

শেষ পর্যন্ত দোনামনা করে ফোন উঠায় ঝিনুক, “হ্যালো কে?”

অন্য পাশে এক রমণী বেশ উচ্ছল আওয়াজে প্রশ্ন করে, “কে বলত?”

তাহলে পার্থ করেনি ফোন, ভেবেই ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে ঝিনুকের, কিন্তু অন্যপাশের মেয়েটার গলা একদম চিনতে পারছে না তাই জিজ্ঞেস করে, “ঠিক বুঝতে পারছি না।”

খিলখিল করে হেসে ফেলে অন্যপাশের মেয়েটা, “রিতিকা... মনে আছে কি?”

এত রাতে আচমকা রিতিকার ফোন আসাতে অবাক হয়ে যায় ঝিনুক, “কি ব্যাপার?”

হেসে ফেলে রিতিকা, “বিয়ে করলি আর একবার ও বললি না?”

মাথা নাড়িয়ে হেসে ফেলে ঝিনুক, “সব কিছু ঝড়ের মতন হয়ে গেছে রে কাউকেই ঠিক করে নেমন্তন্ন করতে পারিনি।”

গলা নামিয়ে রিতিকা বলে, “কৃষ্ণা আজ সকালে ফোন করেছিল ওর মুখ থেকে তোর কথা শুনলাম।”

এমবিএ ব্যাচের সহপাঠিনী, রিতিকা পান্ডে, জামশেদপুরের মেয়ে, এমবিএ পড়ার সময়ে বিশেষ কথাবার্তা হত না ওদের মধ্যে কারণ দুই জনের মধ্যে একটা রেশারেশি ছিল কে বেশি সুন্দরী। যদি ঝিনুক কোনদিন হাই হিল পরে কলেজ যেত তাহলে পরেরদিন থাই হাই বুটস পরে রিতিকা কলেজে আসত। যদি কেউ লেকমে লিপস্টিকের একটা সেড কিনত পরের দিন অন্যজনে ম্যাবেলিনের অন্য শেড কিনত। কলেজে একটা বয় ফ্রেন্ড ছিল রিতিকার, হরিশ সিনহা নামের বিহারি ছেলে। কলেজ ছাড়ার পরে কোনদিন ফোনে কথা হয়নি ওর সাথে। কৃষ্ণা ওর বান্ধবী, বিয়েতেও এসেছিল, এমবিএ করার পরে কোলকাতায় চাকরি পেয়ে যায় কৃষ্ণা। কৃষ্ণার সাথে রিতিকার কথাবার্তা চলে সেটা ও জানত। কৃষ্ণা কি এমন বলেছে যে হটাত করে এত রাতে রিতিকার ওকে ফোন করতে গেল? কৃষ্ণার ওপরে ভীষণ রাগ হচ্ছিল ঝিনুকের, মেয়েটার পেটে কোন কথা থাকে না। যার সাথে এতদিন কোন সুহৃদ সম্পর্ক ছিল না তাকে কেন ওর হাঁড়ির কথা জানাতে গেল?

রিতিকা ওকে বলে, “আমিও দিল্লীতে জানিস।” বলেই হেসে ফেলে খিলখিল করে।

ওহ তাই ফোন করেছে, একটু হেসে অবাক ভাব দেখিয়ে ঝিনুক বলে, “ওহ আচ্ছা তাই নাকি?” কথা বলার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে ছিল না ওর।

রিতিকা ওকে জিজ্ঞেস করে, “শুনলাম তোর হাবি (বর) নাকি এমেসের অরথপেডিক সার্জেন?”

ছোট উত্তর দেয় ঝিনুক, “হ্যাঁ।”

রিতিকা জিজ্ঞেস করে, “দিল্লীতে কোথায় আছিস?”

সঠিক ঠিকানা জানে না ঝিনুক, তাও বলে, “সি আর পার্কে।”

রিতিকা অবাক হয়ে উত্তর দেয়, “আরি ব্বাস, আমার অফিসের একদম কাছে রে। ঠিকানা দে কাল দেখা করব। তোর ডাক্তার কখন ফেরে হসপিটাল থেকে?”

এই খবরটাও সঠিক জানা নেই ঝিনুকের তাও আন্দাজ করে উত্তর দেয়, “সন্ধ্যের দিকে ফিরে আসেবে।”

ফিক করে হেসে ফেলে রিতিকা, “এবারে কিন্তু জমিয়ে ঠান্ডা পড়েছে, তবে তোর অসুবিধে হবে না। পুরো গরম থাকবি কি বল।”

কথাটা শুনে একটু লজ্জিত হয়ে কান লাল হয়ে যায় ঝিনুকের। লাজুক হেসে উত্তর দেয়, “জানি না রে এই ত ল্যান্ড করলাম, বাড়ি গিয়ে বোঝা যাবে।”

রিতিকা বলে, “ওহ আচ্ছা, ঠিক আছে তাহলে কাল ফোন করব তোকে।”

ঝিনুক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, “হুম ঠিক আছে।”

রিতিকার ফোন রাখার পরেই কৃষ্ণাকে ফোন করে ঝিনুক, মেয়েটা কি বলতে না কি বলেছে সেটা একবার জানা দরকার। এইভাবে বলে বেরালে বড্ড মুশকিলে পরে যাবে। কৃষ্ণা ফোন উঠাতেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঝিনুক, “তুই কি বলেছিস রিতিকাকে?”

অন্যদিকে এত রাতে ফোন পেয়ে ঘাবড়ে যায় কৃষ্ণা, আমতা আমতা করে উত্তর দেয়, “কই কিছু না ত? কেন কিছু হয়েছে নাকি?”

দাঁতে দাঁত পিষে উত্তর দেয় ঝিনুক, “এই একটু আগেই ফোন করেছিল। সত্যি করে বল কি বলেছিস?”

কৃষ্ণা হেসে উত্তর দেয়, “তুই একটুতেই এক্সসাইটেড হয়ে যাস, বড্ড হাইপার মেয়ে। ওকে শুধু এইটুকু বলা হয়েছে যে তোর বয়ফ্রেন্ড মানে পার্থ যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তার সাথে শেষ মুহূর্তে তুমুল ঝামেলা হয় যার জন্য তোর বিয়ে ভেঙ্গে যায়।”

মাথা নাড়ায় ঝিনুক, অবশ্য নিজে সবাইকে এই গল্প বলেছিল তাই এর চেয়ে বেশি কারুর কাছে কোন খবর থাকার কথাও নয়। তাও জিজ্ঞেস করে, “আর কি বলেছিস?”

হেসে ফেলে কৃষ্ণা, “আর কি বলব, বললাম যে দিল্লীর এক বড় হসপিটালের অরথপেডিক সারজেনের সাথে তোর সেই দিনেই বিয়ে হয়েছে। সেই শুনে রিতিকার আর কি বলব, হারটফেল করার মতন অবস্থা।” হিহি করে হেসে ফেলে কৃষ্ণা। তারপরে জিজ্ঞেস করে, “তোরা ঠিক ভাবে পৌছালি?”

মাথা দোলায় ঝিনুক, “হ্যাঁ রে এই একটু আগেই ফ্লাইট থেকে নেমেছি।”

গলা নামিয়ে ওকে প্রবোধ দিয়ে বলে কৃষ্ণা, “একটা সত্যি কথা বলব? জানিস যা হয় ভালোর জন্য হয়। যা হয়েছে ভুলে যা, গুলি মার ওই বোকাচোদাকে, সব কিছু ঝেড়ে ফেলে নতুন শুরু কর। অম্বরীশের ফ্যামিলিকে যেমন দেখলাম ওর বোন আর তোর বোন ত হরিহর আত্মা, কাকিমা ও দেখি তোর শ্বাশুরির সাথে বেশ মিশে গেছে।”

হেসে ফেলে ঝিনুক, “আরে আম্বালিকা আন্টি, মানে ওর মা আর আমার মা ছোট বেলার বান্ধবী, আবার সেই সাথে ঝিলিক আর দিয়া বেস্ট ফ্রেন্ড।”

হেসে ফেলে কৃষ্ণা, “তাহলে এত মুখ গোমড়া কেন তোর? কোন অচেনা বাড়িতে অথবা পরিবারে ত বিয়ে হয়নি। এত মনে হচ্ছে তুই এবাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে গেছিস।”

হেসে ফেলে ঝিনুক, কথাটা মিথ্যে বলেনি কৃষ্ণা। আম্বালিকা আন্টি আর মায়ের মধ্যে এক অটুট বন্ধন যেটা প্রথম দিনে যখন বিয়ের নেমন্তন্ন করতে গিয়েছিল তখন ওর চোখে পড়েছিল। সত্যি দেখতে গেলে পরিচয়ের বাইরের কাউকে বিয়ে করেনি ঝিনুক, হ্যাঁ এতদিন হয়ত দূরে থাকার জন্য সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল কিন্তু দুই বাড়ির মা আর দুই বাড়ির বোনের মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক সেটা সত্যি। যদি সত্যি বিয়ে হয়ে যেত পার্থের সাথে আর তারপরে ওর এই দুশ্চরিত্র ধরা পড়ত তখন ওর করার কিছুই থাকত না, তার সাথে বাবা মায়ের বদনাম নিজের বদনাম হত।

কৃষ্ণার সাথে কথা বলার পরে বেশ হাল্কা লাগে ঝিনুকের, “এই আসছি রে এরপর ক্যাব ধরব। আচ্ছা চল আবার পরে কথা হবে।”

এতক্ষন পরে একজন বান্ধবীর সাথে অনেকটা কথা বলার পরে মন একটু হাল্কা লাগে ঝিনুকের। ফোন রাখার পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঠিক করে নেয়। টিসু এনেছিল সেটা দিয়ে চোখ গাল মুছে নিয়ে লাল রঙের লিপস্টিক বের করে আরো একবার ঠোঁটের ওপরে বুলিয়ে নেয়। ব্যাগের ভেতরে লিপস্টিক রাখার সময়ে টাকার পার্স খুলে দেখে কত টাকা আছে। পার্স খুলতেই লম্বা সাদা রঙের সিগারেটের প্যাকেটের দিকে নজর পড়তেই ধুক করে ওঠে ওর বুক। গত রাত থেকে এখন পর্যন্ত রিশুকে কোন সিগারেট খেতে দেখেনি, মদ বা অন্য কিছুর নেশা করে কি না জানা নেই। বাড়িতে থাকলে লুকিয়ে চুরিয়ে দিনে একটা কি দুটো সিগারেট জ্বালিয়েই ফেলত কিন্তু সেটা এখন আর হবে না, পার্থ অথবা বন্ধু বান্ধবীদের সাথে বসলে একটু আধটু ড্রিঙ্কস সেটাও প্রায় মাসে কয়েকবার হয়ে যেত। সিগারেট প্যাকেট দেখে ভীষণ বিব্রত বোধ করে ঝিনুক। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দুমড়ে মুচড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে হাসে, এই পর্যন্ত তোর সাথে আমার ছিল সঙ্গ। দুই কব্জির দিকে তাকায়, দুই হাতে সোনার পাতে বাঁধানো শাঁখা পলা, সেই সাথে সোনার পাতে জড়ান লোহা বাঁধানো, বাঙালি এয়োস্ত্রীর চিহ্ন। আয়নার প্রতিফলনে কপালের দিকে চোখ যায় ওর, গাড় লাল রঙের হাইলাইটিং করা চুলের নিচে লুকিয়ে একটা পাতলা লাল রঙের সিঁদুরের দাগ। হয়ত নতুন এক সূর্য দেখা দেবে আগামি কাল, নাকি কালো মেঘ উঠবে আকাশে?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top