কালবৈশাখী ঝড়
|| অধ্যায় - অভ্যর্থনা (পর্বঃ ১) ||
[ পটভূমিঃ বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল 'মোল্লাকান্দি' ইউনিয়নের 'পরীর দীঘির পাড়' নামের একটি গ্রামকে কেন্দ্র করে ঘটনা। এই গ্রামের প্রায় সকলেই শ্রমজীবী মানুষ। গ্রামের একমাত্র কর্মসংস্থানের উৎস, স্থানীয় বড় এক 'ইট-ভাটা (brick-field)'।
এই ইটভাটার দিনব্যাপী বিভিন্ন ধরনের দৈহিক শ্রম-নির্ভর কাজে গ্রামের সব বয়সের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। আশেপাশের এলাকা থেকে মাটি কেটে সেটা ইটভাটার চুল্লীতে পুড়িয়ে ইট বানিয়ে ঢাকা শহরে পৌঁছে দেয়া, শহরের ক্রমবর্ধমান নগরায়নের কাঁচামাল সরবরাহ করাই এধরনের ইটভাটা স্থাপনের ব্যবসায়িক লক্ষ্য। ]
বৈশাখ মাসের প্রখর খরতাপের একদিন বিকেল। সূর্য তখনো পশ্চিমাকাশে গনগনে বিকিরণে উত্তপ্ত করে রেখেছে গ্রামীণ প্রকৃতি।
প্রচন্ড রোদে মাঠ-ঘাট-প্রান্তর খাঁ খাঁ করছে। যেদিকে তাকানো যায়, শুধু শুকনো মাটি, পাথরের চেয়েও শক্ত। আর অসংখ্য ফাটল। মাটি উত্তাপ সহ্য করতে পেরে ফেটে যায়। দাঁড়কাকগুলো তৃষ্ণায় সারাক্ষণ কা-কা করে উড়ে বেড়ায় এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে, গ্রামীণ বাড়িঘরের আনাচে কানাচে।
গ্রীষ্মের প্রচন্ত গরমে নদী-নালাগুলোতে পানি কমে যায়। মানুষজন গরুছাগল ইচ্ছেমতো পায়ে হেঁটে এপার-ওপার চলে যায়। পুকুরগুলোর পানিও অনেক কমে আসে। এমন অসহ্য গরমে ঘরে থাকে না কেও। গাছের নিচে চাটাই বিছিয়ে শুয়ে বসে দিন কাটায়। বাতাসে একটি পাতাও নড়ে না। সূর্য ডুবলেও উত্তাপ কমে না, মাটিতে সারাদিনের খরতাপ জমানো ভাঁপ বেরোয়। তাতে আরো বেশি উঞ্চতায় ডুবিয়ে রাখে গ্রামাঞ্চল।
এমনই এক বৈশাখের বিকেলে পরীর দীঘির পাড় গ্রামে ট্রাক চালিয়ে এক মধ্যবয়সী পুরুষের আগমন। পেশায় ট্রাক-ড্রাইভার ৪০ বছর বয়সের এই তাগড়া জোয়ান মরদের নাম মন্তু মিঞা। ইটভাটায় কাজ করা এই গ্রামের এক শ্রমজীবী পরিবারের সন্তান। বহু বছর বাদে নিজের জন্মস্থান, পারিবারিক গ্রামে ফিরেছে সে।
বছর পনেরো আগে ঢাকায় থাকা এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করে এই গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় গিয়েছিল মন্তু৷ নিজের ২৫ বছর বয়সের তরুণ জীবনে সেই যে গ্রাম ছেড়ে গেছে, এরপর থেকে আজ অবধি গত ১৫ বছরে আর গ্রামে ফেরা হয়নি ছেলের। ঢাকার মিরপুর এলাকার শ্বশুড়বাড়িতে বউকে নিয়ে থাকা ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ট্রাক চালিয়ে মালামাল পরিবহনের কাজ করা, এভাবেই দিন কেটেছে তার।
অবশেষে আজ এতগুলো বছর বাদে মাঝবয়সী যুবকের গ্রামে ফেরার কারণ - গত দু'দিন আগে গ্রামে থাকা তার বাবার মৃত্যুর খবর। এই প্রত্যন্ত গ্রামে কেবল তার বাবা মা বাস করে। চার সন্তানের মাঝে মন্তু মিঞা সবার বড়, তার চেয়ে ছোট তিন বোনের সবাই বিয়ে-থা করে ঢাকার আশেপাশের বিভিন্ন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে ওখানেই স্বামী-সন্তান নিয়ে থিতু হয়েছে।
ছোট বোনদের কারো পক্ষে স্বামী সংসার গার্মেন্টসের চাকরি ছুটি নিয়ে বাবার শেষকৃত্য করতে গ্রামে আসা সম্ভব হয়নি। অগত্যা একমাত্র ছেলে হিসেবে মৃত বাবার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও বিধবা একাকী মায়ের খোঁজ খবর নিতে বড়ছেলের গ্রামে আসা। তার অশিক্ষিত শ্রমিক মা মোবাইল ব্যবহার করতে পারে না। এখানকার এক প্রতিবেশী শ্রমিকের কাছ থেকে ফোনে বাবার মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছে মন্তু। ছেলে-মেয়েদের ছাড়া পৈত্রিক ভিটায় পুরো একলা তার ৫৪ বছরের বিধবা মা। প্রতিবেশী শ্রমিক আরো জানায়, নিঃসঙ্গতা ও স্বামী হারানোর শোকে সারাদিন নাকি কান্নাকাটি করছে তার মা, মন্তু এসে যেন তার মাকে সঙ্গ দিয়ে মন ভালো করে।
পরীর দীঘির পাড় গ্রামের ভেতরের এক কুঁড়েঘরে বাবা মায়ের ভিটা। ইটভাটা পেড়িয়ে মাইল দু'য়েক দূরের সেই গ্রামে ঢোকার মুখে একটা বড় দিঘি আছে, যেটার নাম 'পরীর দীঘি'। এই দিঘির নামেই গ্রামের নামকরণ। দিঘির চারপাশে উঁচু জায়গায় সারি সারি একতলা কুঁড়েঘরে ইটভাটার শ্রমিক পরিবারগুলোর বসবাস। জায়গার তুলনায় গ্রামে লোকসংখ্যা বেশি বলে একটি ঘরে একটি পুরো শ্রমিক পরিবার থাকে, চাইলেও কারো পক্ষে বেশি ঘর নেবার উপায় নেই। নিম্ন-আয়ের অশিক্ষিত শ্রমজীবী এসব পরিবার উপরে টিনের চালা ও চারপাশে মাটি দিয়ে বানানো অপ্রশস্থ ছোট এক-রুমের এসব কুঁড়েঘরে গাদাগাদি করে থাকে। এক ঘরের সাথে আরেক ঘর প্রায় লাগানো। ৮/১০টা ঘরে থাকা অনেকগুলো পরিবারের জন্য একটি কমন রান্নাঘর, একটি টিনের পাকা বাথরুম ও একটি টিউবওয়েল৷ কাপড় ধোয়া, গোসল, থালাবাসন মাজা সবই দিঘির পানিতে করতে হয়।
তবে, এতগুলো বছর বাদে জন্মস্থানে ফিরে নিজের পৈতৃক বাড়ি ঠিক ঠাহর করতে পারছিল না ছেলে মন্তু। ইটভাটা দিঘি সব পাড় হয়ে এবার কোনদিকে গেলে নিজের বাবা-মার ঘরটা পাবে কোনমতেই মনে পড়ছে না তার। তাই ট্রাক থামিয়ে গ্রামের মেঠোপথে নামে সে। ঘড়িতে তখন প্রায় পাঁচটা বাজতে চললো। স্থানীয় বড় ইটভাটায় দিনের কাজ শেষে ইটভাটার শ্রমিকরা সব দল বেঁধে গ্রামে ফিরছে। এমনই এক প্রৌঢ় শ্রমিককে পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে তাকে থামিয়ে মন্তু জিজ্ঞেস করে, "ওই মিঞাভাই, কও দেহি, এইহানে আম্বিয়া বেগমের বাড়ি কোনডা? কোনদিক দিয়া যামু?"।
মাঝবয়েসী অচেনা যু্বকের প্রশ্ন শুনে প্রৌঢ় শ্রমিক তাকে বাড়ির হদিস দিতে থাকে। এরপর মন্তুর নাম পরিচয়, সে কোথা থেকে এসেছে, কেন এসেছে কৌতুহল নিয়ে এসব জিজ্ঞেস করতে থাকে। শ্রমিক বৃদ্ধের এসব কৌতুহলী প্রশ্নের উত্তর ব্যস্ত ছেলে মন্তুর কথা হঠাৎ থেমে যায়। মেঠোপথ দিয়ে গ্রামের দিকে এগোনো মহিলা শ্রমিকদের একটি দল পথের উপর দাঁড়ানো মন্তুর বিশাল ট্রাকের ওপাশ দিয়ে হেঁটে মন্তু ও প্রৌঢ় শ্রমিকের পাশ দিয়ে চলে যায়।
নারী শ্রমিকের এই দলের একজন মহিলা শ্রমিককে চোখের কোনা দিয়ে দেখেই হঠাৎ কথা থামায় মন্তু। ভালোমতো মহিলাটির দিকে নজর ফেলে মনের গভীরে চমকে উঠে সে। নীরবে তন্ময় হয়ে দেখতে থাকে শ্রমিক মহিলাটিকে।
নারী শ্রমিকদের হেঁটে চলা ভীড়ের মধ্যে এই মহিলাই সবচেয়ে লম্বা চওড়া। মন্তু নিজেও বিশাল উচ্চতার পেটানো দেহের মরদ, এই মহিলা লম্বায় তার কাছাকাছি হবে। বাঙালি গ্রামীণ সমাজে এতটা লম্বা মহিলা দেখা খুবই দুষ্কর। ঢাকা শহরেও কালেভদ্রে এত লম্বা গড়নের নারীর দেখা মেলে। পরিপক্ব যৌবনা মহিলাটি বৈশাখের এই কাঠফাটা গরমে ইটভাটার কাজ সেরে বাড়ি ফিরছে, প্রচন্ড রকম ঘেমে ভিজে থাকা পুরো শরীর। গায়ে জড়ানো নামমাত্র কাপড়চোপড় সারাদিনের খাটাখাটুনির ঘামের স্রোতধারায় ভিজে চুপচুপে হয়ে দেহের সাথে সাপ্টে লেগে রয়েছে।