এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনা অতিমারিতে বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। এ অদৃশ্য শত্রুর হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন তিন কোটির বেশি মানুষ। ইতিমধ্যেই অন্তত কয়েক হাজারবার নিজের রূপ বদলেছে এ ভাইরাস। তাই এর গতিবিধি, বৈশিষ্ট্য ধরা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। টিকা চলে আসার পরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি ভালোভাবে মেনে চলাই এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায়। এ স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে রয়েছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ২০ মিনিট পরপর ২০ সেকেন্ড সময় নিয়ে সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়া, এটি সম্ভব না হলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা এবং বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরা।
বাজারে আছে নানা ধরনের মাস্ক; প্রয়োজনীয় সঠিকটা বেছে নেয়া
এসব স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে মাস্ক পরাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোভিড–১৯ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম প্রধান উপায় হলো শ্বাসনালি থেকে বেরিয়ে আসা ক্ষুদ্র জলকণা (ড্রপলেট) যা মানুষের কথা বলা, হাঁচি, কাশির সময় বের হয়ে আসে। এই ড্রপলেট যাতে বাইরে এসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে জন্য মাস্ক পরতেই হবে। এ ছাড়া বাইরে বের হলে যেখানে সামাজিক দূরত্ব মানা কঠিন, সেখানে সুরক্ষা দেবে মাস্ক। করোনাভাইরাস নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। এর ভেতর দেখা গেছে, মাস্ক পরে এ ভাইরাসের সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিরোধ সম্ভব।
২০২০ সালে যখন প্রথমবারের মতো বিশ্বজুড়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন সবাই নিজেদের সুরক্ষায় সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার শুরু করে। ফলে বিশ্বব্যাপী মেডিকেল মাস্কের সংকট দেখা দেয়। পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সাধারণ কাপড়ের মাস্ক পরার পরামর্শ দেয়। তবে সেটা হতে হবে তিন স্তরের। আর কেউবা কারও পরিবারের কোনো সদস্য কোভিড–১৯-এর সংক্রমণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন (৬০ বছরের বেশি বয়সী বা অন্য কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যায় আক্রান্ত) কিংবা কেউ করোনায় আক্রান্ত কারও পরিচর্যায় নিয়োজিত থাকেন, কেবল সে ক্ষেত্রে মেডিকেল মাস্ক পরার কথা বলা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নন–মেডিকেল বা কাপড়ের মাস্কের জন্য একটি গাইডলাইন নির্ধারণ করে দেয়। সেখানে বলা হয়, তিন স্তরের কাপড়ের মাস্কের ভেতরের স্তরটি হবে সুতি কাপড়ের মতো শোষণকারী উপকরণ দিয়ে। মাঝের স্তরে থাকবে পলিপ্রোপাইলিনের মতো বোনা নয়, এমন উপকরণ; আর বাইরের স্তরটি তৈরি হবে পলিয়েস্টার বা পলিয়েস্টার মিশ্রণের মতো শোষণকারী নয়, এমন উপকরণ দিয়ে।
এরপর থেকে গত এক বছরে মাস্কের জনপ্রিয়তা বেড়েছে অনেক। যাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে, তাঁরা ঘরেই এ গাইডলাইন অনুসরণ করে মাস্ক বানিয়ে নিয়েছেন। অনেক নামীদামি ফ্যাশন ব্র্যান্ডও নানা ডিজাইনের মাস্ক বাজারে এনেছে। মাস্ক এখন এটি শুধু জীবনরক্ষার উপাদান নয়, একটি ফ্যাশন অনুষঙ্গও বটে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মাস্ক নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবাতে বাধ্য করছে। তবে কেবল মাস্ক পরলেই হবে না, বরং দেখতে হবে, সেটা কতটা মানসম্পন্ন এবং সুরক্ষা দিতে সক্ষম। এ ছাড়া এ মাস্ক পরে ঠিকমতো শ্বাস নেওয়া এবং ছাড়া যায় কি না, সেটাও বিবেচ্য বিষয়।
এ বছরের শুরুতে করোনাভাইরাসের নতুন কিছু ভেরিয়েন্ট অতিমারি পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তোলে। মিউটেশনের ফলে সৃষ্ট নতুন স্ট্রেইনগুলো আগের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং অত্যন্ত সংক্রামক। এ জন্য বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সবাইকে সংক্রমণ থেকে বাঁচতে মেডিকেল গ্রেড মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়েছেন। বেশ কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে, মেডিকেল গ্রেড মাস্ক যথাযথভাবে পরলে ৯৯ শতাংশ বায়ুবাহিত কণা ও জীবাণু কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
বাজারে অনেক ব্র্যান্ডের মেডিকেল গ্রেড মাস্ক কিনতে পাওয়া যায়। ভালো মানের মেডিকেল গ্রেড মাস্ক তিন স্তরের হয়ে থাকে। আর এর মাঝের স্তরটা হয় মেল্টব্লোন ফেব্রিকের যার ঘনত্ব প্রতি বর্গমিটারে ৭৫ গ্রাম। এসব মাস্ক ৯৯ শতাংশ ব্যাকটেরিয়া ফিল্টারেশন ও ৯৫ শতাংশ বায়ুবাহিত কণা ফিল্টারেশন দক্ষতাসম্পন্ন হয়ে থাকে। আর আইএসও সার্টিয়ায়েড হলে তো কথাই নেই। তা ছাড়া চলমান করোনা পরিস্থিতিতে নিজের ও পরিবারের সুরক্ষায় আমাদের সবার উচিত ভালো মানের মেডিকেল গ্রেড মাস্ক পরা যেটা এসজিএস পরীক্ষিত ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ) অনুমোদিত।
শুধু মাস্ক পরলেই হবে না। এটি পরতে হবে সঠিক নিয়মে। নয়তো কোনো কাজেই আসবে না। আমাদের এখানে দেখা যায়, অনেকেই নাকের নিচে মাস্ক পরে থাকেন। এটা করা যাবে না। ঢিলেঢালা মাস্ক পরা যাবে না। মাস্ক পরতে হবে এমনভাবে যাতে সেটি মুখের ত্বকের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। এতে নাক–মুখ ভালো করে ঢাকা থাকবে। আর মাস্ক ঘেমে গেলে বা কোনোভাবে ভিজে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বদলে ফেলতে হবে।