‘মডেল নয়, রোল মডেল হতে চাই। আমার মৃত্যুর পরও যেন আমার কর্মক্ষেত্র বেঁচে থাকে’, বলছিলেন আফরোজা পারভীন। রেড বিউটি স্টুডিও অ্যান্ড স্যালনের প্রতিষ্ঠাতা এই রূপবিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের অগ্রসরমাণ নারীগোষ্ঠীর জন্য সত্যিই এক রোল মডেল। তিনি বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রির বোর্ড অব ডিরেক্টর। এ ছাড়া নারীর স্বনির্ভর হয়ে ওঠার পথে সহযোগিতা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান উজ্জ্বলার সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকও তিনি।
শারমিন কচি এবং আফরোজা পারভীন
এমনই আরেকজন রোল মডেল রূপবিশেষজ্ঞ শারমিন কচি। তিনি একজন উদ্যোক্তা এবং মোটিভেশনাল স্পিকার। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ বিউটি কেয়ারের প্রতিষ্ঠাতা এই নারী তরুণ প্রজন্মের জন্য বলছিলেন, ‘মাঝপথে হাল ছেড়ে দিয়ো না, শেষ পর্যন্ত লড়ে যাও। জীবনের পথে বাধা আসতেই পারে, সব বাধা পেরিয়েই একদিন সাফল্যের দুয়ারে পৌঁছে যাবে। নিজের প্রতি এই বিশ্বাসটুকু রেখো।’ নারী উদ্যোগের কান্ডারি এই দুজন এবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন একটু ভিন্নভাবে। রূপবিশেষজ্ঞ হিসেবে কত সময় কত মডেলকেই তো সাজিয়েছেন, হাজারো নারীর অনুপ্রেরণা এই দুই নারী এবারের নারী দিবস সামনে রেখে বিশেষ এক আয়োজনে দাঁড়িয়েছিলেন ক্যামেরার সামনে, আরেক নারী উদ্যোক্তা, ফ্যাশন ডিজাইনার আবেদা মিতুল খানের করা শাড়ি পরে।
ঘুরে দাঁড়ানো নারী
রেড বিউটি স্টুডিও অ্যান্ড স্যালনের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রির বোর্ড অব ডিরেক্টর আফরোজা পারভীন
মহামারি পরিস্থিতিতে পিছিয়ে পড়েছে নানান ব্যবসা খাত। নারীর নানান উদ্যোগও হুমকির মুখে। রূপচর্চার খাতটি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এই করোনাকালে। তবু ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্যে রয়েছেন সেই ঘুরে দাঁড়ানো নারীরাই। আফরোজা পারভীনের ভাষায়, ‘এই এক বছরের ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে হয়তো ৫ বছর লেগে যাবে। তবে আমরা প্রমাণ রেখেছি, আমরা পারি। মনের শক্তি ও সাহস নিয়ে আমরা আবার এগিয়ে যাচ্ছি।’ এ রকম এক পরিস্থিতিতে তাঁদের মতো যোদ্ধাদের কথা মাথায় রেখে এমন আয়োজনে আমন্ত্রণ পাওয়ার বিষয়টা তাঁর কাছে দারুণ। রূপবিশেষজ্ঞ হিসেবে বহুবার নির্দেশনা দিয়েছেন দুজনই, তবে এবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতাটা দুজনের জন্যই বেশ অন্য রকম। এমন আয়োজনে, এমন স্বীকৃতিতে, এমন সম্মাননায় নতুনভাবে কাজে উৎসাহ পান তাঁরা।
শুরু থেকে লড়াই
বাইরের জগতে নিজের কাজের জায়গাটা শারমিন কচির কাছে নিজের সন্তানের মতো। আজকের দিনে এসে সৌন্দর্যচর্চার কাজে নিয়োজিত নারী সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। কিন্তু তিনি যে সময় শুরু করেছিলেন, তখন পরিস্থিতি ছিল ভীষণ বিরূপ। কখনো যুদ্ধ করেছেন সমাজের সঙ্গে, কখনো আবার নিজেরই সঙ্গে লড়েছেন স্বাধীনচেতা এই নারী। নারী দিবসের শাড়ি পরে একজন সফল নারী হিসেবে দাঁড়ালেন গর্বিতভাবে, যেন তাঁর অন্তর থেকে ঘোষণা আসছিল, ‘আমরা আছি’। চমৎকার এক অনুভূতির অনন্যসাধারণ বহিঃপ্রকাশ।
বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ বিউটি কেয়ারের প্রতিষ্ঠাতা শারমিন কচি
শারমিন কচি বলেন, ‘সমাজের কল্যাণে নারীর অবদান কি কেউ অস্বীকার করতে পারে? প্রতিটি দিবসই নারী দিবস হওয়া উচিত। তবু প্রতীক হিসেবে একটি দিনকে বেছে নেওয়া। আর এই দিনটি এলেই যেন অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করে আমার মধ্যে। ঘর থেকে শুরু করে সমাজের সর্বোচ্চ অবস্থান পর্যন্ত নারীরা নিজেদের অনবদ্য কাজের মাধ্যমে এই দেশকে, এই পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবী সুন্দর ও কল্যাণময় হয়ে উঠছে। পুরোনো দিনগুলোতে নিজের আত্মত্যাগ, নিজের কষ্ট—সবকিছু ছাপিয়ে আমিও নিজেকে এই সৃষ্টিশীলতার কারিগরদেরই একজন মনে করি, অন্তরাত্মার শক্তিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করি। এ এক অসাধারণ অনুভূতি।’
আয়োজনের দিন শারীরিকভাবে খানিকটা অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছেন ক্যামেরার সামনে, ভালো লাগাটা যেন অনুভব করছিলেন অন্তর থেকে। এই দিনটাতে তাঁর সুবিধা-অসুবিধা, তাঁর প্রয়োজন প্রভৃতি নিয়ে অন্যদের চিন্তাটাও তাঁর জন্য বেশ অন্য রকম ভালো লাগার একটা বিষয় ছিল। লড়াই করে প্রতিষ্ঠা পাওয়া, একটা প্রতিষ্ঠান চালিয়ে নেওয়া, এসব নিঃসন্দেহে বড় অর্জন। তবে এসবের বাইরেও মানুষের কাছ থেকে এত মায়া, এত ভালোবাসা পেয়েছেন, শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছে এটাকেই জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য বলে মনে হয়। দেশের নানান স্থানের নারীর কাজের প্রচার এবং স্বীকৃতি প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। কারণ, পত্রিকার পাতায় কিংবা ডিজিটাল মাধ্যমে অন্যদের এগিয়ে যাওয়ার সংবাদ অনুপ্রাণিত করে অন্য নারীদের, এমনকি তাঁকেও।
নকশাকারের গল্পটা
এই দুই অগ্রগণ্য নারীর শাড়ি তৈরি হয়েছে যাঁর নকশায়, তাঁর কথা শুনে আসা যাক। ছাত্রজীবন থেকে ঘরে বসেই কাপড়ের টুকটাক কাজ করতেন তিনি। ২০০২ সালের পয়লা বৈশাখ সামনে রেখে ১০০ শাড়িতে হ্যান্ডপেইন্টের কাজ করলেন। ঘরের মেঝেতে বিছিয়ে যত্ন নিয়ে রং করা সেই শাড়িগুলো বিক্রি হয়ে গেল। একটিও রইল না। নিজে পয়লা বৈশাখে পরবেন ভেবে যে শাড়িটা রেখে দিয়েছিলেন, সেটি পর্যন্ত বিক্রি হয়ে গেল। এ ঘটনায় পেলেন দারুণ উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা। মনে হলো, তিনি সত্যিই কিছু একটা করতে পারবেন নিজের উদ্যোগে।
আবেদা মিতুল খানের নকশা করা শাড়িতে মডেল হয়েছেন শারমিন কচি ও আফরোজা পারভীন
এরপর সংসার-সন্তান সামলে হলেন একজন সফল উদ্যোক্তা। গড়ে উঠল ‘সীবনী বাই আবেদা মিতুল খান’। সেই যিনি ঘরের মেঝেতে কাপড় বিছিয়ে রং করতেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানে এখন কাজ করেন কর্মীরা। চারপাশের প্রকৃতি থেকেই তুলে আনেন ফিউশনধর্মী নকশা। উঠতি বয়সীদের জন্য নানান কাজ করেন তিনি। শাড়ি, আনস্টিচ থ্রি-পিস আর ছেলেদের জন্য পাঞ্জাবি তৈরি হয় তাঁর নকশায়। করোনাকালের গৃহবন্দী সময়ে চারদিকে যখন মন্দা, তখন তাঁর কর্মীদের সাহস জুগিয়েছেন তিনি নিজেই, আর পরে সময়োপযোগী কাজ শুরু করেছেন নতুনভাবে। মিতুলের নিজের অনুপ্রেরণা তাঁর মা, শৈশবে তিনি যাঁকে দেখেছেন বৈচিত্র্যময় নকশায় পোশাক তৈরি করতে। আরেক অনুপ্রেরণা তাঁর স্বামী, দারুণ সমর্থন পেয়েছেন যাঁর কাছ থেকে।
আয়োজনের শাড়ি
শাড়ির নকশাকার আবেদা মিতুল খানের মূল ভাবনা ছিল নারী দিবস
নারী দিবসের আয়োজনের শাড়িগুলো কেমন ছিল? জানালেন শাড়ির নকশাকার আবেদা মিতুল খান। মূল ভাবনা ছিল নারী দিবস। পার্পল আর গোলাপি রঙের রেশমি শাড়ি দুটিতে ছিল এমব্রয়ডারি করা ফুলেল মোটিফের নকশা। ফুলেল মোটিফ নারীর জন্য দারুণ মানানসই। আরও ছিল গোলাপি আর হালকা পেস্ট রঙের দুটি শাড়ি, যাতে ছন্দময় ভাষায় লেখা ছিল,
ভাবনারা আটকে রয়
বাস্তবতার দেয়ালে
জলে লিখি ডাকনাম
খেয়ালে বেখেয়ালে...
নারী জীবনের পাওয়া না-পাওয়ার চিত্র যেন কবি রিপন ইমরানের ভাষায় উঠে এসেছে শাড়ি দুটিতে। করোনাকালের এই মন্দায় দেশীয় তাঁতশিল্পীদের অনুপ্রেরণা দিতে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িতে স্ক্রিন প্রিন্টের মাধ্যমে এই কাব্যময় কাজ ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। আর ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে উঠে আসা, উদ্যমী, সফল দুই নারীকে বেছে নিয়েছেন এই আয়োজনের জন্য।