নেত্রকোনার কাঞ্চনপুর থেকে শিশু মহুয়াকে চুরি করেছিল হুমরা বাইদ্যা। প্রেমিক নদের চাঁদকে বাঁচাতে শেষ মুহূর্তে বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছিল যুবতী মহুয়া। প্রায় পৌনে চার শ বছর আগে দ্বিজ কানাইয়ের মহুয়া পালার মূল গল্প এই নারীকে কেন্দ্র করে বেদে জনগোষ্ঠীর জীবন। জন্মগতভাবে না হলেও মহুয়া ছিল বেদেকন্যা। আরেক বেদেকন্যা উঠে এসেছিল এ প্রজন্মের মানুষের কাছে বিপুল আয়োজনে, বেদের মেয়ে জোছনা। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাগিন কন্যার কাহিনীতে হিজল বিলের ‘বিষ বেদে’ সম্প্রদায়ের নারী অথবা আল মাহমুদের জলবেশ্যায় উঠে আসা এই চরিত্ররাই প্রান্তিক এক জনগোষ্ঠীর নারী চরিত্রের প্রতীক।
সাহিত্যের সঙ্গে যে বাস্তবের বিস্তর ব্যবধান, তার প্রমাণ পান্থপথের মোড়ের সিগন্যাল, বেইলি রোড বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে হঠাৎ দেখা বেদে নারীদের বাস্তবতা। ১০ হাত শাড়ির আড়াই প্যাঁচের ঢঙে জড়ানো শরীরে থাকে অসংখ্য পুঁতির মালা। পায়ে মল বা নূপুর। দুই হাত ভর্তি চুড়ির সঙ্গে নাকে–কানে দৃশ্যমান গয়না। এসব আমাদের চোখ টেনে রাখে। কিন্তু তাঁদের হাতে থাকা ছোট কাঠের বাক্সটি দেখামাত্রই চোখ বন্ধ করে রাখতে ইচ্ছা করে। ওর ভেতরে সাপ না থাকলেও আমাদের জন্য থাকে ভয়। অদেখা যেকোনো কিছুতেই এ ভয় মানুষের মজ্জাগত। সেটাই কাজে লাগিয়ে উপার্জন করেন তাঁরা।
বেদে জনগোষ্ঠীর নারীরাই বেশি কর্মঠ
সত্যি বলতে কি, এদিকে তাঁদের ঠেলে দিয়েছি আমরাই। বেদেসমাজ যা জানত, যা তাঁদের আয়ের পথ, তা হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। বেদে জনগোষ্ঠীতে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি কর্মঠ। সেই ভোরবেলা গাওয়াল করতে বের হয়। ফিরে বিকেলে। পায়ে-পায়ে বাড়ি খায় পেটিকোটের ফুল দেওয়া কুঁচি। কিন্তু এই নারীদের স্বাস্থ্য ও সচেতনতা বেদনাহত হওয়ার মতো উপেক্ষিত।
অধিকাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৪ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। ফরিদপুরের মুন্সিবাজারে পথের পাশে একজনের ফেলে রাখা জমিতে আছে ১৮ ঘরের বেদেপল্লি। হলুদ শাড়ি পরে মাঠের মধ্যে বসেছিলেন সন্তানসম্ভবা শাবনূর। জানতে চেয়েছিলাম ঝড় এলে কোথায় থাকবেন। হাতে থাকা গাছের এক শুকনা ডাল উঁচু করে এমন ভঙ্গিমায় দেখালেন, যেন প্রাসাদের সুরক্ষিত নিরাপত্তা। অথচ ওটা বাঁশের দুটি টানা দিয়ে টাঙানো একটা কালো প্লাস্টিকের ছাউনি। মাটির ওপর একটা ছেঁড়া পাটি পেতে ঘুমানোর ব্যবস্থা। মাত্র ২১ বছর বয়সী শাবনূরের তিনটি সন্তান আছে এরই মধ্যে। চতুর্থ সন্তান জন্মের সময় এমন অপুষ্টিতে ভুগছেন যে নিজেরই টিকে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে এখন।
বেদে সম্প্রদায়ের নারীরা সন্তান জন্মের জন্য সাধারণত সদর হাসপাতালেও যান না। তাঁদের অভিযোগ, নার্স বা চিকিৎসকদের অবহেলা নিয়ে। নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেই আছেন কয়েকজন ধাই। তাঁদের একজন যেমন সদরপুরের তাসলিমা বেগম। তিনি বলছিলেন, ‘ওপরে আল্লাহ আর নিচে আমি। আমার হাতে যতক্ষণ রোগী আছে, জান থাকা পর্যন্ত আমি ছাড়ব না।’ তাসলিমা বেগমের হাতে জন্ম নিয়েছে কয়েক শ শিশু। তিনি এ বিদ্যা শিখেছেন তাঁর শাশুড়ি আর দাদিশাশুড়ির কাজ দেখে দেখে।
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. শরিফুননেছা বলছিলেন, ‘নরমাল ডেলিভারির সময় যে নিয়মকানুনগুলো মানতে হয়, বেদে জনগোষ্ঠীর নারীদের সেটুকু প্রশিক্ষণও নেই। যেহেতু এ মানুষদের জন্য আমরা সমাজের সব ধরনের সেবা পাওয়ার সুযোগ অবারিত রাখিনি, তাই মাঝেমধ্যে মেডিকেল ক্যাম্প করে হলেও মৌলিক কিছু বিষয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। কিশোরীদের মাসিকের সময়ের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়েও কোনো সাধারণ ধারণা নেই। এই অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা শুধু নারীর নিজের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, তা–ই নয়। একই সঙ্গে তাঁর সন্তানের সুস্থতাও নিয়ে আশঙ্কা থাকে।’
এদিকে মুন্সিগঞ্জের গোয়ালীমান্দা হচ্ছে এ অঞ্চলের বেদে সম্প্রদায়ের আদি নিবাস। এখানে এখন বসবাস করেন কয়েক হাজার মানুষ। যাঁরা নৌকা ছেড়ে স্থলভাগে বাস করছেন বহুদিন হলো। অনেকের জীবিকায় এসেছে পরিবর্তন। নারীরা শিঙা ফুঁকা বা বিষ-ব্যথা নামানোর পেশা বাদ দিয়েছেন। মেয়েশিশুরা যাচ্ছে স্কুল, মাদ্রাসায়। তবে স্বাস্থ্য নিয়ে অসচেতনতা একই রকম। পোশাকে ও সাজে তারা অনিন্দ্য অথচ সেদিন দুপুরে হঠাৎ উপস্থিত হয়ে দেখা গেল সতর্কতার কোনো বালাই নেই। করোনা নামের অতিমারিতে যে গোটা বিশ্বের এমন পরিস্থিতি, সে খবর এতটুকু বিচলিত করেনি তাঁদের। চার নারী মিলে যেখানে বসে রান্না করছেন, সেখানে কিছুক্ষণ আগেই মারা হয়েছে কোনো প্রাণী। উঠানের এখানে-সেখানে রক্ত জমাট বাঁধা। মাছি ঘুরছে ভন ভন করে। এই পরিবেশের মধ্যে বসে শিশুর থালায় ভাত মেখে দিচ্ছেন দুজন। করোনার কথা বলতেই হেসে উড়িয়ে দিলেন। তাঁদের কোমরে রুপার বিছা আর হাতের বাজু বন্ধনী চমকাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সুন্দর মুখে, শরীরের ত্বকে নানা রকম ছত্রাকের বাসা। প্রান্তিক এ জনগোষ্ঠীর প্রতি নানা কারণে আমাদের আকর্ষণ আছে, কিন্তু তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সচেতন হওয়ার দায়িত্বটা উপেক্ষা করা চলে না। সরকারি হাসপাতালে গেলে যেন চিকিৎসার মৌলিক অধিকারটুকু পায়, সে জন্য নির্দেশ দিতে হবে। বছরে অন্তত দুবার করে মেডিকেল ক্যাম্প করার প্রয়োজন এই বেদেপল্লিগুলোতে।
একটি জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত রয়ে গেলে সারা দেশের সুরক্ষা সম্ভব নয় কখনোই।
* লেখক: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম, ঢাকা