What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected সকল কাঁটা ধণ্য করে (হুমায়ুন আহমেদ) (1 Viewer)

বাউলা কে বানাইলরে



তিনি ছিলেন একজন ছোটখাট রাজা, অসম্ভব ক্ষমতাবান এক সামন্ত প্রভু। সামন্ত প্রভুদের অনেক বিচিত্র স্বভাব থাকে, তারও ছিল। গভীর রাতে তিনি রূপবতী। সঙ্গিনীদের নিয়ে বজরায় উঠতেন। বজরা নিয়ে যাওয়া হত মাঝ হাওড়ে। যেন। আশপাশে কেউ না থাকে। যেন তার বিচিত্র নিশিযাপন কেউ বুঝতে না পারে। শুরু হত গান। এক পর্যায়ে তিনি তার সঙ্গিনীদের বলতেন নাচতে। শুরু হত নাচ। প্রবল। তামসিক জীবন। শুধু ভোগ, শুধুই আনন্দ। এই তামসিক জীবন যিনি যাপন করে গেছেন তার নাম হাসন রাজা। ভয়াবহ তৃষ্ণা নিয়ে জীবনকে তিনি পান করেছেন। তারপরেও তৃষ্ণা মেটে না। ভোগে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে গেয়েছেন, বাউলা কে বানাইলরে, হাসন রাজারে?

হাসন রাজার প্রপৌত্র কবি মমিনুল মউজদীন আমাকে সুনামগঞ্জে যাবার আমন্ত্রণ। জানালেন। সুনামগঞ্জের মানুষ হাসন রাজাকে নিয়ে উৎসব করছেন। রাতভর তারা। শোনাবেন হাসন রাজার গান। কবি মমিনুল চাচ্ছেন আমি যেন সেই উৎসবে থাকি। একবার ভাবলাম, যাব না। উৎসব মানেই হৈ-চৈ। তাছাড়া আমাকে সেখানে নিশ্চয়ই বক্তৃতাও দিতে হবে। কি বলব আমি? হাসন রাজার গান শুনেছি–এই পর্যন্তই। আর কিছুই জানি না। বক্তৃতা দেয়ার জন্যে বিদগ্ন বক্তারা তো থাকবেনই। তারা মিসটিক কবি সম্পর্কে অনেক কিছু বলবেন। শুরুটা হবে মিসটিক শব্দের ব্যুৎপত্তি থেকে। গ্রীক কোন শব্দ থেকে এসেছে, এর সাধারণ মানে কি, আবার অসাধারণ মানে কি? দার্শনিক হিসেবে হাসন রাজার শ্রেণীভেদ করা হবে। তার সহজ প্রেমের গানগুলি যে। আসলে আধ্যাত্মিক গান, তা কঠিন সব যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা হবে। ১৯৩১ সনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে The Religion of Man প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ হাসন রাজার গান। বিষয়ে কি বলেছিলেন তা বলা হবে। হংসসম এই সব পণ্ডিত বক্তাদের মাঝে আমি তো দলছুট বক। আমি কি করব?

খোলা মাঠে বসে রাতভর গান শুনতে পাব, খাঁটি গান। টিভি-রেডিও আর্টিস্ট। শহুরে বাউলদের গান না, আসল গান। সেই আকর্ষণ অগ্রাহ্য করা কঠিন। তার উপর আছে হাসন রাজার বাড়ি দেখার লোভনীয় প্রস্তাব। যে বাড়ি নিয়ে তিনি লিখলেন, ঘরবাড়ি ভালা না আমার।

সমস্যা হল শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। সামনে ফেব্রুয়ারির বইমেলা। অনেককে নতুন বই দেব বলে রেখেছি। একটি পাণ্ডুলিপিও শেষ করতে পারিনি। যখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি, তখন আমি সাহায্যের জন্যে যাই দৈনিক বাংলার সালেহ ভাইয়ের কাছে। তিনি নিজেও হাসন মেলায় যাচ্ছেন। আমার সমস্যাটা তিনি ভালই জানেন। সালেহ ভাই অনেক ভেবেচিন্তে বললেন, অসম্ভব, তোমার যাওয়াটা ঠিক হবে না। তুমি লেখালেখি করো।

আপনারা মজা করে গান শুনবেন, আর আমি লেখালেখি করব?

হ্যাঁ। প্রায়েরিটি বলে একটা কথা আছে। তোমার প্রথম প্রায়েরিটি হল লেখালেখি। দ্বিতীয় প্রায়েরিটি খোলা মাঠে গান শোনা। বুঝতে পারছ?

পারছি।

যখন তোমার লেখালেখির চাপ থাকবে না তখন তোমাকে হাসন রাজার বাড়ি দেখিয়ে আনব।



সালেহ ভাই আমাকে ফেলে সুনামগঞ্জ চলে গেলেন। আমার মন খারাপ হল। এবং মন খারাপ ভাব দূর করার জন্যে পরের রাতে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে ট্রেনে চেপে বসলাম। একা না, প্রায় জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছি কবি হাসান হাফিজকে। সফরসঙ্গী হিসেবে কবিরা মোটেই সুবিধার হন না। তারা অকারণে ভাব ধরে ফেলেন। তবে হাসান হাফিজ ব্যতিক্রম। কবি হলেও তার হাবভাব গদ্যকারের মত। ট্রেন ছাড়া মাত্র তিনি পকেট থেকে মার্লবোরো সিগারেট বের করে বললেন, মরমী কবি হাসন। রাজার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যে আমরা এখন থেকে মার্কিন সিগারেট খাব। এবং ক্রমাগত হাসন রাজার গান গাইতে থাকব।

আমরা কেউই গান জানি না। তরুণ গায়ক সেলিম যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে। তাকে ধরে আনা হল। আমি বললাম, এখন থেকে ননস্টপ হাসন রাজার গান চলবে। শুরু কর। সেলিম সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলো,

নিশা লাগিলরে
বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিলরে।
হাসন রাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিলরে…

আমি চমকে উঠলাম। কারণ এই গান নিয়ে আমার কিছু সুখ-স্মৃতি আছে।

কয়েক বছর আগে দেওয়ান গোলাম মোর্তজার স্মৃতি-উৎসবে যোগ দেবার জন্যে হবিগঞ্জ গিয়েছিলাম। থাকি সার্কিট হাউসে। রাত জেগে গল্পগুজব হয় বলে বেলা করে ঘুম ভাঙে। সেদিন কি যে হলো, সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে আমিও জেগে উঠলাম। প্রভাতের সূর্য দেখে আমি অবাক। সূর্যও সম্ভবত আমাকে দেখে অবাক। সকাল এত সুন্দর হয় কে জানতো! আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালার ওপাশে সকাল হওয়া দেখছি। আমার জন্যে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। দরজা খুলে বারান্দায় এসে দেখি এই কাক ডাকা ভোরে মায়াবী চোহারার এক তরুণী আমার ঘরের দরজার সামনে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি বললাম, কি ব্যাপার?

তরুণী ক্ষীণ গলায় জানালো, সে আমার জন্যে কিছু খাবার নিয়ে এসেছে। ঘরে বানানো সন্দেশ। আমাকে সামনে বসিয়ে খাওয়াবে। তারপর একটা গান শোনাবে। সে আমাকে বিরক্ত করবে না। গানটা শুনিয়েই চলে যাবে। বলাই বাহুল্য, আমি অভিভূত হলাম। সকাল বেলায় আমি মিষ্টি খেতে পারি না। তারপরেও তিনটা সন্দেশ খেয়ে। ফেললাম। বললাম, এখন গান শোনাও। সে কিন্নর কণ্ঠে গান ধরলো,

নেশা লাগিলরে

বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিলরে।

হাসন রাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিলরে।

গাইতে গাইতে মেয়েটির চোখে পানি এসে গেল। সে চোখ মুছতে মুছতে বলল, এটা হাসন রাজার একমাত্র প্রেমের গান। আমার খুব প্রিয়। আমি যতবারই গাই, ততবারই কাদি। আপনি যদি আপনার কোন নাটকে গানটা ব্যবহার করেন, আমার খুব ভাল লাগবে।

এর পরপরই আমি অচিন বৃক্ষ নামে একটা টিভি নাটক লিখি। সেখানে হতদরিদ্র প্রাইমারী স্কুলের এক মাস্টার সাহেবের অসুস্থ স্ত্রী এই গানটি করেন। গানটা যখন টিভিতে রেকর্ড করা হচ্ছে, তখন আমি অবাক হয়ে দেখি, আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সেই দিনই মনে মনে ঠিক করি, হাসান রাজার সব গান শুনব। ক্যাসেটের দোকানে দোকানে কদিন খুব ঘুরলাম। অনেকে হাসন রাজার নামও শোনেনি। অল্প কিছু গান পাওয়া যায়–লোকে বলে বলে রে ঘর বাড়ী ভালা না আমার, মাটির। পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়া রে। গাতক কাউকে পেলেই জিজ্ঞেস করি, হাসন রাজার গান জানেন?

বেশির ভাগ সময়ই উত্তর শুনি, না।

একদিন এক বাউল আমাকে চমকে দিয়ে গাইলেন, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে। আমার চমকাবার কারণ হচ্ছে, এই গান আমি আমেরিকায় শুনেছি। বিখ্যাত একটা গান–Close your eyes and try to see.

কবি চোখ বন্ধ করে দেখতে বলছেন। আর হাসন রাজা বলছেন, চোখ বন্ধ করে রূপ দেখতে। কি সুন্দর কথা! কি অপূর্ব বাণী।



গভীর আবেগ ও গভীর ভালবাসায় হাসন রাজার দেশে পা রাখলাম। উৎসব প্রাঙ্গণ। লোকে লোকারণ্য। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এসেছে গান শুনতে। হাসন রাজা তাদের ভালবেসেছিলেন। তারা সেই ভালবাসা ফেরত দিতে চায়।

সভাতে আমাকে বলা হল, হাসন রাজাকে নিয়ে একটা নাটক লিখতে। আমি বললাম, অবশ্যই আমি এই কবির বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে একটা নাটক লিখব।

সভা শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে এসেছি। স্থানীয় এক ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, উনাকে নিয়ে আপনি নাটক লিখবেন? আপনি কি জানেন উনি লম্পট ছিলেন?

আমি বললাম, জানি। হাসন রাজা নিজেই তার গানে লিখে রেখে গেছেন। না জেনে উপায় কি?

হাসন রাজা নিজে বলেছেন তিনি লম্পট?

হ্যাঁ, গানটা হল, সর্বলোকে জানে হাসন রাজায় লম্পটিয়া।

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। আমি বললাম, হাসন রাজার মত আরো কিছু লম্পট থাকলে কত ভাল হত, তাই না ভাই?

রাত দুটোর দিকে বিরাট দলবল নিয়ে আমরা হাসন রাজার কবর দেখতে গেলাম। গান গাইতে গাইতে যাচ্ছি–বাউলা কে বানাইলরে?



কবরের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালাম। কবরের গায়ে লেখা–

লোকে বলে বলে রে ঘর বাড়ি ভালা না আমার
কি ঘর বানাইব আমি শূন্যের মাঝার।

আমি মনে মনে বললাম, হাসন রাজা, আমার গভীর ভালবাসা তোমাকে জানানোর জন্যে আমি তোমার কাছে এসেছি। তুমি আমার ভালবাসা গ্রহণ কর। তোমাকে যিনি বাউলা বানিয়েছেন, আমাকেও তিনি বাউলা বানিয়েছেন। তুমি তোমার প্রাণপুরুষকে খুঁজে পেয়েছিলে। আমি পাইনি। আমি এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছি।*



———-
* হাসন রাজার গান ‘নিশা লাগিল রে’ আমি আমার ছবি আগুনের পরশমনিতে অতি সম্প্রতি ব্যবহার করেছি।
 
ভূতের পা




আমরা তখন কুমিল্লায় থাকি।

বাবা পুলিশের ডিএসপি। আমাদের বাসা ঠাকুরপাড়ায়। এক রাতের কথা। গভীর উৎকণ্ঠায় সবাই জেগে বসে আছি। মা জায়নামাজে তসবি পড়ে যাচ্ছেন। আমরা দোতলার বারান্দায়। গাড়ির শব্দ কানে এলেই চমকে উঠছি। আমাদের এই শংকিত প্রতীক্ষার কারণ আমার বাবা। তিনি পুলিশ ফোর্স নিয়ে গেছেন হোমনায়। সেখানে এর আগের দিন একজন এএসআই এবং দুজন পুলিশ কনস্টেবলকে গ্রামবাসী ধরে নিয়ে। গেছে। এরা আসামী গ্রেফতার করে ফিরছিল। গ্রামবাসী আসামীদের ছিনিয়ে নেয় এবং পুলিশদেরও ধরে নিয়ে যায়। আজকের অভিযান ওদের উদ্ধার করে আনা।

রাত তিনটায় বাবা ফিরলেন।

মা সঙ্গে সঙ্গে দুরাকাত নফল নামাজ পড়লেন। বাবার সঙ্গে আমাদের এক ধরনের দুরত্ব ছিল–আমরা সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি না। মার কাছ থেকে জানলাম, পুলিশদের উদ্ধার করা হয়েছে। তবে ওদের রাইফেল পাওয়া যায়নি। একজন পুলিশের অবস্থা খুবই খারাপ। তাকে কুমিল্লা মিলিটারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। যে কোন মুহূর্তে মারা যেতে পারে।

বাবা রাত সাড়ে তিনটায় রাতের খাবার খেতে বসলেন। খেতে পারলেন না। কিছুক্ষণ ভাত নাড়াচাড়া করে উঠে পড়লেন এবং বিষণ্ণ গলায় বললেন, পুলিশের চাকরি করব না। বাবা তার দীর্ঘ চাকরিজীবনে অসংখ্যবার বলেছেন–পুলিশের চাকরি করব না। তারপরও তাকে এই চাকরি করতে হয়েছে। তার সংসারের দিকে তাকিয়ে করতে হয়েছে।

চাকরির কারণে তাঁকে যেমন অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে, আমাদেরও ভোগ করতে হয়েছে। সবচে বেশী ভোগ করতে হয়েছে আমার মাকে। স্বামীর দুশ্চিন্তায় এই মহিলার কেটেছে দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী।

আমার মার ধর্মকর্মের বড় অংশই নিবেদিত ছিল আমার বাবার মঙ্গলকামনায়। বাবা বাসায় নেই–গভীর রাত্র–মা কোরানশরীফ নিয়ে একমনে পড়ে যাচ্ছেন–ফাবিআয়ে আলাএ রাব্বিকুমা তুকাজজিবান। এ ছিল আমাদের অতি পরিচিত দৃশ্যের একটি।

পুরানো প্রসঙ্গ মনে পড়ল পত্রিকায় নিহত পুলিশ অফিসারের ঘটনা পড়ে। তার নবজাত শিশুপুত্রটির ছবিও দেখলাম। আহা, কী সুন্দর ছেলে! আমার দ্বিতীয় কন্যার জন্মসময়ে তোলা ছবিটিও অবিকল এই রকম। তফাৎ এইটুকু–জন্মের পরপরই আমি আমার কন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পেরেছিলাম। ফরহাদ সাহেবের এই সৌভাগ্য হল না।

মৃত্যুতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কোন মৃত্যুই এখন বোধহয় আমাদের তেমন। স্পর্শ করে না। কিন্তু এই মৃত্যু আমাদের স্পর্শ করেছে। কেন করল? পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী দল। এদের বিপজ্জনক জীবনযাপন করতেই হবে। চাকরির শর্তই তাই। তারপরেও এই মৃত্যু আমাদের এতটা ব্যথিত কেন করল? তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর কথা ভেবে? তার অবোধ শিশুটির কথা ভেবে?

পত্রিকায় খবরটা পড়ে আমার প্রথমেই মনে হল, আহা, এই মানুষটি বোধ হয় এখনো ঈদের বাজার করেননি। স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে ঈদের বাজার করার দিনক্ষণ শুধু করা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী মিলে ঠিক করে রেখেছেন, এবার ঈদে নতুন শিশু যে এখনো পৃথিবীতে আসেনি তার জন্যেও কাপড় কেনা হবে। ছেলে হচ্ছে কি মেয়ে হচ্ছে যেহেতু জানা যাচ্ছে না–সেহেতু দুসেটই কেনা হবে।

যাদের জন্যে এমন এক দুঃখ গাথা তৈরি হল তারা এখন কোথায়? কি করছে তারা? যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা তারা আর কতদিন খেলবে? যারা তাদের দিয়ে এই খেলা খেলছেন-তাঁরা কবে জানবেন–প্রতিটি মানুষকে হিসাব দিতে হয় তার নিজের কড়িতে —ইংরেজিতে আরো সুন্দর করে বলা হয়–Everybody is paid back by his own coin..

এ দেশে সন্ত্রাস কি বন্ধ হবে? যদি হয় তবে কতদিন লাগবে সন্ত্রাস বন্ধ করতে? এক বছর, দুবছর, পাঁচ বছর? একজন পুলিশ অফিসার আমাকে বলেছিলেন, খুব। বেশি সময় লাগলে এক মাস লাগবে। আমরা প্রতিটি সন্ত্রাসীকে চিনি। তারা কোথায় থাকে জানি। কাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ তাও জানি। কিন্তু এদের ধরা যাবে না।

ধরলেও দ্রুত ছেড়ে দিতে হবে। আমি সেই পুলিশ অফিসারকে বলেছিলাম, আপনারা এক কাজ করুন না কেন–আপনাদের কাছে সন্ত্রাসীদের যে তালিকা আছে, সেই তালিকা খবরের কাগজে ছেপে দিন–তারপর আমরা দেখব কারা তাদের আশ্রয় দেন।

ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। সম্ভবত আমি হাস্যকর কিছু বলেছিলাম। পুলিশ ইচ্ছা করলে কি সন্ত্রাস দূর করতে পারে? তাদের কি সেই সদিচ্ছা আছে? আমার কিন্তু মনে হয় না। দীর্ঘদিন আমি শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর ছিলাম। সেই সময়ে প্রায় হল রেইড হত। পুলিশ হল ঘিরে ফেলত। তখন দেখেছি, হলের যেসব ছেলেদের আমি সন্ত্রাসী হিসাবে চিনি, যারা প্রকাশ্যেই বন্দুক হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা বন্ধুর মত পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে ঘুরছে। অমুক ভাই, তমুক ভাই বলে ডাকছে। আমরা যারা হল প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারাও কি সন্ত্রাস নির্মূলে সাহসী ভূমিকা কখনো। রাখতে পেরেছি? আমার মনে হয় না। একটা ঘটনা বলি–একবার শহীদুল্লাহ হলের এক ছাত্র আমাকে গোপনে একটা খবর দিল। কোন একটা ঘরে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়েছে। আমি আমার প্রভোস্টকে তৎক্ষণাৎ ব্যাপারটা জানালাম এবং বললাম ব্যবস্থা নিতে। প্রভোস্ট স্যার আমাকে অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ স্বরে বললেন–হুমায়ূন, তুমি এত অল্পতে উত্তেজিত হও কেন? চুপ থাক তো।

বর্তমান সময়ের একটাই বোধহয় স্লোগান–চুপ করে থাকো। আমরা চুপ করে থাকব। আমরা কথা বলতে পারব না।

কিন্তু আর কতদিন?

একটা কিছু করার সময় কি আসেনি?

বলা হয়ে থাকে, যে একবার বন্দুক হাতে নেয়, সে হাত থেকে বন্দুক নামাতে পারে না। বন্দুক নামালেই তার জীবন সংশয়। এই ব্যাপারটিও না হয় ভেবে দেখা যাক। ভুল পথে যাওয়া যুবশক্তিকে কাজে লাগানোর পথ খোঁজা যাক। সমাজবিদরা ভেবে দেখুন, কি করলে এরা ঠিক হবে। শাস্তির ভয়ে এরা কাবু হবার নয়। জীবন-মৃত্যু খেলা যারা খেলে, তারা এত সহজে ভড়কায় না। এদের জন্যে নতুন করে ভাবতে হবে। সেই ভাবনা সবাই মিলে ভাববেন, এটা আশা করা অন্যায় নিশ্চয়ই নয়।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি–সবার জন্যে স্বাস্থ্য, সবার জন্যে শিক্ষা–… খুব ভাল। কথা, কিন্তু সবচে জরুরী কথা স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা। সেই নিশ্চয়তা সম্পর্কে কঠিন পদক্ষেপ কি আমরা কোনদিন নেব না?

পুলিশ অফিসার ফরহাদ সাহেবের মৃত্যুর পর সংসদে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। জেনে আনন্দিত হলাম। শোক প্রস্তাব নিতে তো এখন ঘেন্না লাগার কথা! শোক প্রস্তাবের বাইরে আমরা কি করছি? আসলেও কিছু করার ইচ্ছা কি আমাদের আছে?

নিহত পুলিশ অফিসারের সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুসন্তানটির মায়াকাড়া মুখ দেখে বেদনায়। অভিভূত হয়েছি। এই ছেলেটি বড় হয়ে যখন প্রশ্ন করবে–কারা মারল আমার বাবাকে? কেন মারল? তখন আমরা কি জবাব দেব?

দেশে এখন জনগণের নির্বাচিত সরকার। এই সরকারের কাছে আমাদের অনেক দাবি, অনেক প্রত্যাশা। কারণ আমরা এই সরকারকে নির্বাচিত করেছি। সরকারের কাছে আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাইছি। জানি, এই কাজ সহজ নয়। সরকারের হাতে আলাদীনের যাদুপ্রদীপ নেই–কিন্তু সৎ ইচ্ছা যাদুপ্রদীপের চেয়েও কার্যকর। সৎ ইচ্ছা নিয়ে এগুতে হবে।

আমরা বিভিন্ন জায়গায় ধূমপানমুক্ত এলাকা ঘোষণা করছি–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্ত্রমুক্ত এলাকা ঘোষণার ব্যাপারটা কি ভাবা যায় না? সমগ্র দেশের সবচে নিরাপদ এলাকা হওয়া উচিত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। আজকাল সন্ধ্যার পর সেই এলাকায় রিকশা যেতে চায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসাবে এই দুঃখ, এই লজ্জা আমি কোথায় রাখি?

আমার কাছে একটি প্রাণের মূল্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দশটি শিক্ষাবর্ষের মূল্যের চেয়েও অনেক বেশি। একটি প্রাণ নষ্ট হবার আশংকা যদি থাকে, তাহলে বন্ধ থাকুক বিশ্ববিদ্যালয়। ধরে নিতে হবে, আমরা উচ্চশিক্ষার জন্য তৈরি হইনি। একদিকে বোমা ফুটবে, গুলি হবে, ছাত্র মরবে, অন্যদিকে আমরা নির্বিকার ভঙ্গিতে ক্লাস করতে থাকব, এ কেমন কথা? আমরা কোথায় চলেছি।

ভূতদের পা থাকে উল্টো দিকে। তারা চলে উল্টো পথে। আমরা ভূত না, আমরা মানুষ। আমরা ভূতের মত উল্টো পায়ে হাঁটতে পারি না। অথচ অনেকদিন ধরেই উল্টোপায়ে হাঁটছি। কেন? কেন? কেন?
 
মৃত্যু



তার পেটে ক্যানসার। দুবার অপারেশন হয়েছে। প্রথমবার দেশে, দ্বিতীয়বার কোলকাতায়। লাভ কিছু হল না। অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগলো। তাকে নিয়ে। যাওয়া হলো ব্যাঙ্ককের আমেরিকান হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসা না-কি ভাল। অনেক সময় এমন হয়েছে, দেশের ডাক্তাররা বলেছেন ক্যানসার—ওখানে গিয়ে দেখা গেছে অন্য কিছু।

তিনিও হয়ত তেমন কিছু আশা করছিলেন। কিন্তু ব্যাঙ্ককের ডাক্তাররা বিনয়ের সঙ্গে বললেন, রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। এখন শুধু যন্ত্রণা কমানোর চেষ্টাই করা যাবে। আর কিছু না।

তিনি হতভম্ব হয়ে ডাক্তারদের কথা শুনলেন। পাশে দাঁড়ানো তার বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে নেত্রকোনার ডায়ালেক্টে বললেন–নাক চেপ্টা ডাক্তার, এইতা কি কয়?

ছেলে বলল, বাবা, তুমি কোন চিন্তা করবে না। আমি তোমাকে আমেরিকায় নিয়ে যাব। যে চিকিৎসা কোথাও নেই–সেই চিকিৎসা আমেরিকায় আছে।

তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, গাধার মত কথা বলিস না। আমেরিকার মানুষ বুঝি ক্যানসারে মরে না? চল দেশে যাই। মরণের জন্য তৈয়ার হই।

ভদ্রলোক মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন।

গল্প-উপন্যাসে এরকম চরিত্র পাওয়া যায়। অমোঘ মৃত্যুর সামনেও দেখা যায় গল্প-উপন্যাসের চরিত্ররা নির্বিকার থাকে। একটা হিন্দী ছবিতে দেখেছিলাম, নায়ক জানতে পেরেছে ক্যানসার হয়েছে। অল্প কিছুদিন বাঁচবে। জানবার পর থেকে তার ধেই ধেই নৃত্য আরো বেড়ে গেল। কথায় কথায় গান। কথায় কথায় হাসি।

বাস্তব কখনোই সেরকম নয়। বাস্তবের অসীম সাহসী মানুষও মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারেন না। মৃত্যুকে সহজভাবে গ্রহণ করা তো অনেক দূরের ব্যাপার —

আমরা বেঁচে থাকতে চাই। শুধুই বেঁচে থাকতে চাই। যখন শেষ সময় উপস্থিত হয় তখনো বলি–দাও দাও। আর একটি মুহূর্ত দাও। দয়া কর।

গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে।
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।

(আট বছর আগে একদিন)।

যে জীবনের জন্যে আমাদের এত মোহ, এত ভালবাসা, সেই জীবনটা যে কী তাই কি আমরা জানি? নিঃশ্বাস নেয়া, খাওয়া এবং ঘুমানো? না কি তার বাইরেও কিছু?

তত্ত্বকথায় না গিয়ে আগের জায়গায় ফিরে যাই। যে ভদ্রলোকের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তার কাছে যাওয়া যাক। ভদ্রলোক শিক্ষকতা করেন। প্রাইভেট কলেজে ইংরেজি সাহিত্য পড়ান। তাঁর সারাজীবনই কষ্টে কষ্টে গেছে। শেষ সময়ে একটু সুখের। মুখ দেখলেন। একজন ছেলে সরকারী কলেজে শিক্ষকতার কাজ পেল। আরেক ছেলে ব্যবসাতে ভাল টাকা পেতে লাগল। একমাত্র মেয়েটি মেডিক্যাল কলেজে ফোর্থ ইয়ারে আছে–। এমন সুখের সময় সব ছেড়ে ছুটে চলে যাবার চিন্তাটাই তো অসহনীয়।

তারচেয়েও বড় কথা, তার যাত্রা এমন এক ভুবনের দিকে যে ভুবন সম্পর্কে কিছুই জানা নেই। সঙ্গী-সাথীও কেউ নেই যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভদ্রলোক মৃত্যুর প্রস্তুতিপর্ব শুরু করলেন অত্যন্ত সহজ। ভঙ্গিতে। এরকম ভঙ্গি যে থাকা সম্ভব তাই আমি জানতাম না।

তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। ধরেই নিয়েছি, মৃত্যুভয়ে ভীত একজন মানুষকে দেখব, যিনি ডুবন্ত মানুষের মত হাতের কাছে যাই দেখছেন তাই ধরার চেষ্টা করছেন। যা ধরতে যাচ্ছেন তাও ফসকে ফসকে যাচ্ছে।

গিয়ে দেখি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। ভদ্রলোক শুয়ে আছেন ঠিকই, কিন্তু মুখ হাসি। হাসি। তার হাতে কি একটা ম্যাগাজিন। তিনি আমাকে দেখে হৈ হৈ করে উঠলেন।

আরে আরে, মিসির আলি চলে এসেছে!

আমি বললাম, কেমন আছেন?

খুবই খারাপ আছি। টাইমলি এসেছে। আর কিছুদিন পরে এলে দেখা হত না। * ডাক্তার বলে দিয়েছে, আর বড়জোর একমাস।

আপনাকে দেখে কিন্তু ভাল লাগছে।

ভাল লাগারই তো কথা। চেহারা তো কোনদিন খারাপ ছিল না। হা হা হা।

আমি রীতিমত হকচকিয়ে গেলাম। কি নিয়ে আলাপ করব তাও বুঝতে পারছি না। মৃত্যুকে শিয়রে নিয়ে যিনি বসে আছেন তার সঙ্গে নিশ্চয়ই নাটক নিয়ে কথা বলা যায় না।

আমি বললাম, এখন চিকিৎসা কি হচ্ছে?

তিনি গলার স্বর নামিয়ে বললেন, সবরকম চিকিৎসা চলছে। আধিভৌতিক চিকিৎসাই বেশি চলছে। বর্তমানে একজন জ্বীন ডাক্তার আমার চিকিৎসা করছেন।

কে চিকিৎসা করছেন?

জ্বীন। জ্বীনদের মধ্যেও ডাক্তার কবিরাজ আছে। তাঁদেরই একজন।

বলেন কি!

যে যেখানে যা পাচ্ছে ধরে নিয়ে আসছে। কবিরাজ, পানিপড়া, মন্ত্র-তন্ত্র সব চলছে। একজন বালক-পীরের সন্ধান পাওয়া গেছে। বয়স নয় বছর। টাঙ্গাইলে থাকে। সে তেলপড়া দিয়েছে। সেই তেলপড়াও পেটে মালিশ করলাম।

কোন লাভ হচ্ছে কি?

লাভ হবে কোত্থেকে? অনেকের ভাল ব্যবসা হচ্ছে। তবে আমি আপত্তি করছি না। যে যা করতে বলছে, করছি। অনেকে আবার বোকার মত জিজ্ঞেস করে–কি খেতে মনে চায়? আমি রাগ করতে গিয়েও রাগ করি না। কি হবে রাগ করে? আমি। খাবারের নাম বলি–যা খুব সহজে পাওয়া যায় না–আবার একেবারে দুষ্প্রাপ্যও নয়। যেমন একজনকে বললাম, চালতার আচার খেতে ইচ্ছা করছে। সে অনেক খুঁজে পেতে এক হরলিক্সের টিন ভর্তি চালতার আচার নিয়ে এল। এবং এই আচার খুঁজে বের করতে তার যে কি কষ্ট হয়েছে সেটা সে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বলল।

ভদ্রলোক কথ বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমি বললাম, আপনি আর। কথা বলবেন না, বিশ্রাম করুন। আমি আবার আসব।

তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বললেন, এসো। এখন কথা বলতে এবং কথা শুনতে ভাল লাগে। আমি ইন্টারেস্টিং কিছু শুনতে চাই। কেউ ইন্টারেস্টিং কিছু বলতে পারে না। সবাই আমার কাছে এখন আসে তাদের সবচে বোরিং গল্পটা নিয়ে।

আমি চলে এলাম। চার-পাঁচ পর দিন তার ছেলে আমাকে এসে বলল, বাবার শরীর খুব খারাপ করেছে। আপনাকে শেষ দেখা দেখতে চায়।

আমি তৎক্ষণাৎ গেলাম। ভদ্রলোকের মুখ এখনো হাসি-হাসি। আমি বললাম–কেমন আছেন?

তিনি উত্তর দিলেন না। সম্ভবত এই প্রশ্নের উত্তর দিতে তার ইচ্ছা করছে না। আগেরবার আমার সঙ্গে আধশোয়া হয়ে গল্প করছিলেন–এবার শুয়েই রইলেন। ছেলেকে বললেন পাশ ফিরিয়ে দিতে। ছেলে পাশ ফিরিয়ে দিল। তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, যাত্রার সব আয়েজন সম্পন্ন করেছি। একটা ইচ্ছা ছিল–আমার স্কুলের সব ছাত্রদের একবেলা দাওয়াত করে খাওয়াব–সে ইচ্ছাও পূর্ণ হচ্ছে। শনিবার দুপুরে এরা খাবে।

বাহ, ভাল তো!

তুমি এসো শনিবারে। তোমাকে দাওয়াত করছি না। দেখার জন্যে আসবে। ঐদিন। শুধু বাচ্চাদের দাওয়াত।

জ্বি, আমি আসব।

তিনি অল্প খানিকক্ষণ কথা বলার পরিশ্রমেই হাঁপাতে লাগলেন। আমি বসে। রইলাম। বিস্তর লোকজন আসছে-যাচ্ছে। অধিকাংশই কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলছে। তিনি সবার সঙ্গেই সহজভাবে একটা-দুইটা করে কথা বললেন। আমাকে নিচু গলায় বললেন, আল্লাহ পাক নিজেই মনে হয় সব মানুষকে মৃত্যুর জন্যে তৈরি করেন। এখন আর মানুষের সঙ্গ আমার ভাল লাগে না, অথচ কয়েকদিন আগেই অন্য ব্যাপার ছিল।

মৃত্যুর জন্যে আপনি তাহলে তৈরি?

হ্যাঁ।

ভয় লাগছে না?

লাগছে। আবার এক ধরনের কৌতূহলও হচ্ছে। এই প্রথমবার আমি এমন একটা। জিনিস জানব যা তোমরা কেউই জান না। মৃত্যু কি সেটা জানা যাবে। ঠিক না?

জ্বি ঠিক।

একটা মজার ব্যাপার কি লক্ষ্য করেছ–জন্ম সময়ের স্মৃতি মানুষ অন্যকে বলতে পারে না, আবার মৃত্যুর কথাও বলতে পারে না। জন্ম-মৃত্যু দুটা স্মৃতিই এমন–যা অন্যকে দেয়া যায় না। দুটোই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত স্মৃতি।

ঠিকই বলেছেন।

অসুস্থ মানুষের সামনে বসে চা খাওয়া যায় না। আমাকে খেতে হল। তিনি চা না খাইয়ে ছাড়বেন না। চলে আসবার সময় হঠাৎ বললেন–তুমি জিজ্ঞেস করছিলে ভয় লাগছে কি-না। হা লাগছে, প্রচণ্ড লাগছে। তবে এক ধরনের ভরসাও পাচ্ছি।

ভরসা পাচ্ছেন কেন?

ভরসা পাচ্ছি, কারণ পবিত্র কোরান শরীফে কয়েকটা অসাধারণ আয়াত আছে। ঐ আয়াতগুলি থেকে ভরসা পাচ্ছি। তুমি তো লেখালেখি কর–কোন এক ফাঁকে এই আয়ত কটা ঢুকিয়ে দিও। এতে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষরা ভরসা পাবে।

আমি বললাম, আয়াত কটি বলুন আমি লিখে নিচ্ছি।

সুরা আল-ওয়াকিয়া, আয়াত ৮৪ ও ৮৫—

একজন মানুষ যখন মারা যায়–
তোমরা তখন তাকে ঘিরে বসে থাক।
কিন্তু তোমরা জান না,
তোমরা ঐ মৃত্যুপথযাত্রীর যতটা কাছে বসে থাক আমি তারচেয়েও অনেক কাছে থাকি।

ভদ্রলোক শান্তস্বরে বললেন–মৃত্যুর সময় পরম করুণাময় যদি আমার পাশে থাকেন, তা হলে আর ভয় কি?
 
লোভ



ভদ্রলোক চেইন স্মোকার।

চেইন স্মোকারের যে অভ্যাস, একটা সিগারেট পুরোপুরি শেষ না করেই অন্য একটা ধরাচ্ছেন। ভদ্রলোককে ঠিক স্বাভাবিক বলে মনে হল না। কেমন অস্থির ভাবভঙ্গি। কিছুক্ষণ পর পর জিব দিয়ে ঠোট ভেজাচ্ছেন। মাথা চুলকাচ্ছেন।

আমার দিকে তাকিয়ে তিনি চাপা গলায় বললেন, আমার একটাই মেয়ে। তার নাম আনান। আপনি কি আনান শব্দটার মানে জানেন?

জ্বি-না।

আনান শব্দের মানে হল মেঘ। আমি ডাকতাম মেঘবতী।

ডাকলাম বলতেন কেন? মেয়েটি কি বেঁচে নেই?

জ্বি না। সেই গল্পটাই বলতে এসেছি। লেখকরা সাইকিয়াট্রিস্টের মত। তাদের কাছে কথা বললে মন হালকা হয়। মেঘবতীর গল্প আপনাকে বলব?

বলুন।

আমি বেশি সময় নেব না। ধরুন দশ মিনিট। দশ মিনিটে গম্প শেষ করে চলে। যাব।

ভদ্রলোক আরেকটা সিগারেট ধরালেন। আমি দুঃখময় গল্প শোনার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিলাম। ছুটির দিনে ভোরবেলায় কষ্টের গল্প শুনতে ভাল লাগে না–ভদ্রলোককে তা বলা যাবে না। তিনি তার মেঘবতীর গল্প বলে মন হালকা করতে এসেছেন।

মেয়েটার লিউকেমিয়া হয়েছিল।

আপনার কি একটাই মেয়ে?

জ্বি একটাই। ওর লিউকেমিয়া হয়েছে শুনে আমার মাথা খারাপের মত হয়ে গেল। যে ডাক্তার বললেন, ইচ্ছা করছিল গলা চেপে ধরে তাকেমেরে ফেলি। আমি বোধহয়। আমার মনের ভাব আপনাকে বুঝাতে পারছি না। আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না।

আপনি বেশ গুছিয়েই কথা বলছেন।

ডাক্তার আমাকে বললেন মেয়েকে বোম্বের ক্যান্সার হাসপাতালে নিয়ে যেতে। হিসেব করে দেখি তিন লাখ টাকার মত লাগে। কোথায় পাব তিন লাখ টাকা? আমি নিম্ন-মধ্যবিত্তের একজন। নিম্ন-মধ্যবিত্তের সহায় বলতে বিয়ের সময় স্ত্রী সঙ্গে করে যা সামান্য গয়না আনেন–তা। কত আয় হবে গয়না বিক্রি করে! তবু রুমালে বেঁধে সব। গয়না একদিন বিক্রি করতে নিয়ে গেলাম। মাত্র তেইশ হাজার টাকা হল। আর টাকা। কোথায় পাই? কার কাছে যাব ধার করতে? পত্রিকায় মেয়ের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে পারি। মৃত্যু পথযাত্রী মেঘবতীর জীবন রক্ষায় সাহায্য করুন। সেই অপমান, সেই লজ্জাও মৃত্যুসম। কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। তখন একটা ব্যাপার হল।

আন্দাজ করুন তো মজার ব্যাপারটা কি?

আন্দাজ করতে পারছি না। আপনিই বলুন।

মেয়ে মারা যাচ্ছে–মেয়ের জন্যে স্ত্রীর গয়না-টয়না সব বিক্রি করেছি এই খবরটা জানাজানি হয়ে গেল। সাহায্য আসতে শুরু করল এমন সব জায়গা থেকে যে কল্পনাও করিনি। মেয়ে যে স্কুলে পড়ত সেই স্কুলের হেডমিসট্রেস একদিন এসে দশ হাজার টাকা দিয়ে গেলেন। স্কুলের মেয়েদের কাছ থেকে চাঁদা তুলেছেন। তার দুদিন। পর মেয়ে যে ক্লাসে পড়ে সেই ক্লাসের একটি মেয়ে তার বাবাকে নিয়ে উপস্থিত। ভদ্রলোককে চিনি না, জানি না। তিনি এক লক্ষ টাকার একটা চেক নিয়ে এসেছেন। আমি আনন্দে কেঁদে ফেললাম। আমার কান্না দেখে মেয়েও কাঁদতে লাগল। নাটকের ক্রন্দন-দৃশ্যের মত রীতিমত ক্রন্দন-দৃশ্য।

একদিন আমার অফিসের কলিগরা এলেন। তারা এক দিনের বেতন নিয়ে এলেন।–আমার আত্মীয়স্বজনরা টাকা নিয়ে আসতে শুরু করলেন। ভয়ংকর কৃপণ বলে। যাকে জানতাম, যার হাত দিয়ে এলুমিনিয়ামের দশ পয়সাও গড়িয়ে পড়ে যায় না–তিনি এলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে। আমার এক প্রতিবেশী, যার অবস্থা আমার। মতই, তিনি পর্যন্ত এসে আমার স্ত্রীর হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গেলেন। আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।

যাঁরা অর্থ সাহায্য করতে পারলেন না তারা এগিয়ে এলেন বুদ্ধি ও পরামর্শ নিয়ে। তাদের বুদ্ধিতেই আমি বিভিন্ন এনজিওর কাছে চিঠি লিখলাম। সাহায্য চেয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এইসব বড় বড় মানুষের কাছে চিঠি। লিখলাম। সেভ দি চিলড্রেন–এ লিখলাম। চিঠি লিখলাম আমাদের দেশের মন্ত্রীদের। কাছে–কেউ বাদ পড়ল না। এমন কি একটা চিঠি পাঠানো হল কোলকাতায় মাদার তেরেসার কাছে।

চিঠির উত্তর আসতে শুরু করল। বেশিরভাগই মেয়ের জন্যে শুভ কামনা এবং আর্থিক সাহায্যের বিধান নেই বলে দুঃখ প্রার্থনা; তবে তাদের মধ্যেও কেউ কেউ চেক পাঠালেন। মোটা অংকের চেক। একটা চেক ছিল পাঁচ হাজার পাউণ্ডের।

একদিন টাকাপয়সা হিসেব করে দেখি চৌদ্দ লাখ সত্তর হাজার টাকা জমা হয়েছে। তখন লোভ নামক ব্যাপারটা আমার মধ্যে দেখা দিল। মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল–আরো কিছু টাকা জোগাড় করা যাক। আরো কিছু। স্ত্রীকে বললাম, এই টাকায় হবে। না–মেয়েকে আমি আমেরিকায় নিয়ে যাব। মিনিমাম কুড়ি লাখ টাকা আমার দরকার। সাহায্য চেয়ে, ছবি দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবার ব্যাপারে আমার যে প্রচণ্ড দ্বিধা ছিল সেটা কেটে গেল। আমি সব পত্রিকায় মেয়ের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিলাম।

টিভির একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে মেয়েকে নিয়ে গেলাম। উপস্থাপক সেই অনুষ্ঠানে মেয়েটির জীবন রক্ষার জন্যে বিত্তবানদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানালেন। সেই অনুষ্ঠানে আমার মেয়ে একটা গান গাইল —

আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে…

আপনি কি অনুষ্ঠানটি দেখেছিলেন?

জ্বি না।

অনেকেই দেখেছেন। অনুষ্ঠানটির কারণে আমার জন্য অর্থ সংগ্রহ সহজ হয়ে গেল। দেশে কোন বড়লোকদের কাছে টাকার জন্যে যখন যাই–কিছুক্ষণ কথা বলার পরই তারা বলেন–ও আচ্ছা, বড় বড় চোখের মেয়েটি যে গান গাইল–আমরা। সবাই রাজা?… আচ্ছা আচ্ছা, ভেরি স্যাড। আপনি বসুন, আপনাকে একটা চেক লিখে দিচ্ছি…

একুশ লক্ষ টাকা জমিয়ে ফেললাম এক মাসের মধ্যে।

একুশ লক্ষ টাকা?

সামান্য কম, তবে একশ লক্ষ ধরতে পারেন। বাংলাদেশ বিমান দিল দুজনের বোম্বে যাবার ফ্রি টিকেট। বোম্বে অবশ্যি যাওয়া হল না মেয়েটা তার আগেই মারা গেল।

ভদ্রলোক সিগারেট ধরালেন। কোন কথা না বলে অনেকক্ষণ সিগারেট টানলেন। ঘড়ি দেখলেন। তারপর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন–আপনার দশ মিনিট সময় নেব বলেছিলাম, পনের মিনিট নিয়ে ফেলেছি। দয়া করে ক্ষমা করবেন। গল্পটা শেষ করেছি। এখন চলে যাব। গল্পের শেষটা বলা হয়নি–শেষটা হচ্ছে–আমার একাউন্টে এখন বাইশ লক্ষ টাকার মত আছে। ইন্টারেস্ট জমা হচ্ছে, টাকা বাড়ছে। মাঝে মাঝে ভাবি–টাকাটা কোন জনহিতকর কাজে ব্যয় করি, কোন সেবা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেই। দিতে পারি না। লোভ আমাকে বাধা দেয়। আবার নিজেও খরচ করতে পারি না। অদ্ভুত একটা অবস্থা। এখন আমার কাজ কি জানেন? কাজ হচ্ছে প্রতি মাসে গিয়ে ব্যাংকে খোঁজ নেয়া–ইন্টারেস্ট কত হয়েছে। তিশ বছর পর কুড়ি লক্ষ টাকা কম্পাউন্ড ইন্টারেস্টে কত হবে জানতে চান? বলব?
 
শিকড়



মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা শহরে খাট, মিটসেফ, চেয়ার-টেবিল এবং লেপ-তোষক বোঝাই করে কিছু ঠেলাগাড়ি চলাচল করে। ঠেলাগাড়ির পেছনে পেছনে একটা রিকশায় বসে থাকেন এইসব মালামালের মালিক। তাঁর কোলে থাকে চাদরে মোড়া বার ইঞ্চি ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভি কিংবা টু-ইন-ওয়ান। তাকে খুবই ক্লান্ত ও উদ্বিগ্ন মনে হয়, কারণ একইসঙ্গে তাকে লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে ঠেলাগাড়ির দিকে এবং তার কোলে। বসানো পরিবারের সবচে মূল্যবান সামগ্রীটির দিকে। তাকে খুব অসহায়ও মনে হয়। অসহায়, কারণ এই মুহূর্তে তার কোন শিকড় নেই। শিকড় গেড়ে কোথাও না বসা। পর্যন্ত তার অসহায় ভাব দূর হবে না।

মানুষের সঙ্গে গাছের অনেক মিল আছে। সবচে বড় মিল হল, গাছের মত মানুষেরও শিকড় আছে। শিকড় উপড়ে ফেললে গাছের মৃত্যু হয়, মানুষেরও এক ধরনের মৃত্যু হয়। মানুষের নিয়তি হচ্ছে তাকে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৃত্যুর ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে হয় চূড়ান্ত মৃত্যুর দিকে।

শিকড় ছড়িয়ে দেবার জন্যে গাছের অনেক কিছু লাগে–নরম মাটি, পানি, আলো, হাওয়া। মানুষের কিছুই লাগে না। কয়েকটা দিন একটা জায়গায় থাকতে পারলেই হল, সে শিকড় গজিয়ে ফেলবে এবং অবধারিতভাবে শিকড় উপড়ানোর তীব্র যাতনায় এক সময় কাতর হবে। দৃশ্যটা কেমন? একটা পরিবারের কথাই মনে করা যাক। ধরা যাক, এরা চার-পাঁচ বছর একটা ভাড়া বাড়িতে থেকেছে। বাড়িওয়ালা, বাড়িওয়ালাদের স্বভাবমত এদের নানাভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে। ঠিকমত পানি দেয়নি। বাড়িভাড়া বাড়িয়েছে দফায় দফায়, শেষ পর্যন্ত নোটিশ দিয়েছে বাড়ি ছাড়ার। এরা বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে। নতুন একটা বাড়ি পেয়েছে, যেটা এই বাড়ির চেয়েও সুন্দর। ভাড়া কম, সামনে খানিকটা খোলা জায়গাও আছে। পরিবারের সবাই এমন ভাব দেখাচ্ছে যে, এই পচা বাড়ি ছেড়ে দিতে পেরে তারা খুবই আনন্দিত। কিন্তু পরিবারের কত্রী মনের কষ্ট পুরোপুরি ঢাকতে পারছেন না। বারবারই তার মনে হচ্ছে, এই বাড়ি ঘিরে কত আনন্দ-বেদনার স্মৃতি।

তাঁর বড় ছেলের জন্ম হলো এই বাড়িতে। এই বাড়িতেই তো সে হাঁটতে শিখল। টুকটুক করে হাঁটতো, একবার সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে কি প্রচণ্ড ব্যথাই না পেল। প্রথম কথা শিখে পাখি দেখে উত্তেজিত গলায় বলেছিল, পা… পা… পা…

তিনি বাধাছাদা করছেন, পুরোনো সব কথা মনে পড়ছে আর চোখ মুছছেন। জিনিসপত্র সরাতে গিয়ে বাবুর ছমাস বয়সের একটি জুতা পেয়ে গেলেন। বাবু বেঁচে নেই, তার সব জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মৃতের কিছু জমা করে রাখতে নেই। কিন্তু তার একপাটি জুতা কিভাবে থেকে গেল? এই জুতায় এখনো বাবুর গায়ের গন্ধ।

তিনি ঘর গোছানো বন্ধ রেখে স্বামীকে নিচু গলায় বললেন, কিছু বেশি ভাড়া দিয়ে থেকে গেলে কেমন হয়? স্বামী খুব রাগ করলেন। কি আছে এই বাড়িতে যে এখানেই থাকতে হবে? এ বাড়ি নরক ছাড়া আর কি? নচ্ছার বাড়িওয়ালা। বাসা ছোট। আলো নেই, বাতাস নেই।

যেদিন বাসা বদল হবে সেদিন ছোট বাচ্চা দুটা কাঁদতে লাগলো। তারা এই বাসা ছেড়ে যাবে না। বাবা হুংকার দিলেন, খবরদার, নাকি কান্না না। এরচে হাজার গুণ ভাল বাসায় তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি।

বাবা জিনিসপত্র ঠেলাগাড়িতে তুলে বাসার চাবি বাড়িওয়ালাকে দিতে গেলেন। চাবি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বাড়িতে তার প্রোথিত শিকড় ছিড়ে গেল। তীব্র কষ্টে তিনি অভিভূত হলেন। তাঁর চোখে পানি এসে গেল। নতুন বাসার জন্যে এডভান্স টাকা দেয়া হয়ে গেছে। তার মত দরিদ্র মানুষের জন্যে অনেকগুলি টাকা। তারপরেও তিনি বাড়িওয়ালাকে বললেন, ভাই সাহেব, ছেলেমেয়েরা এই বাসা ছাড়তে চাচ্ছে না। চারদিকে পরিচিত বন্ধুবান্ধবরা তো… আচ্ছা না হয় পাঁচশ টাকা বেশিই দেব… তাছাড়া ইয়ে, মানে আমার বড় ছেলে এই বাড়িতেই জন্মাল, আমার স্ত্রী মানে। মেয়েমানুষ তো, ইমোশনাল, বুঝতেই পারছেন না… ছেলের স্মৃতি…,

বাড়িওয়ালা রাজি হলেন না। বাবা ভেজা চোখে ছোট্ট টিভিটা কোলে নিয়ে রিকশায় উঠে বসলেন।

অনেকদিন ধরেই আমি এই শহরে আছি। কতবার বাসা বদলালাম। প্রতিবারই এই কাণ্ড। বছরখানিক আগে শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের বাসাটা ছাড়লাম। অনেকদিন সেখানে ছিলাম। কত সুখস্মৃতি! বাসার সামনেটা গাছগাছালিতে ছাওয়া। গাছে বাসা বেঁধেছে টিয়া। একটি দুটি না–হাজার হাজার। বারান্দায় বসে দেখতাম, সন্ধ্যা হলেই ঝাক বেঁধে টিয়া উড়তো। আমার মেয়েরা গাছের নিচে ঘুরঘুর করতো টিয়া পাখির পালকের জন্যে। এরা পাখির পালক জমাতো।

হলের সঙ্গেই কি বিশাল দীঘি! কি পরিষ্কার টলটলে পানি! বাধানো ঘাট। কত জোছনার ফিনকি ফোটা রাতে আমি আমার ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে নেমে গেছি। দীঘিতে। এই দীঘিতেই তো বড় মেয়েকে সঁতার শেখালাম। প্রথম সঁতার শিখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে আমার মেয়ে একা একা মাঝ পুকুরের দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আবার ভয় পেয়ে ফিরে এল। কি সুন্দর দৃশ্য!

হলের সামনের মাঠে আমার তিন কন্যা সাইকেল চালাতে শিখলো, আমি তাদের ইন্সট্রাকটার। সাইকেল নিয়ে প্রথমবারের মত নিজে নিজে কিছু দূর এগিয়ে যাবার আনন্দের কি কোন সীমা আছে? না নেই। এই আনন্দ আকাশ থেকে প্যারাটুপারের প্রথম ঝাঁপ দেয়ার আনন্দের মত। আমার কন্যাদের আনন্দের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এই হল।

হলের বাসার টানা বারান্দায় বসে রাত জেগে কত লেখালেখি করেছি। গুলির শব্দে মাঝে মাঝে লেখায় যেমন বাধা পড়েছে তেমনি অন্যরকম ব্যাপারও ঘটেছে। হঠাৎ শোনা গেল–বাশি বাজছে। কাঁচা হাতের বাজনা না, বড়ই সুন্দর হাত। লেখালেখি বন্ধ করে বাঁশি শুনেছি।

আমার হলের নিশিরাতের সেই বংশীবাদক জানে না আমি কত আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম তার বাশির জন্যে। সে ভাল থাকুক, তার জীবন মঙ্গলময় হোক–এই প্রার্থনা। কত আনন্দ পেয়েছি তার জন্যে!

সেই হল ছেড়ে দেবার সময় হল। বহু দূর প্রোথিত এই শিকড় ছিঁড়তে হবে।

কি কষ্ট! কি কষ্ট!!

ঠিক করলাম, একদিনে হল ছেড়ে যাব না। ধীরে ধীরে যাব। প্রথম দিন হয়তো বইগুলি নেয়া হবে, দ্বিতীয় দিনে শুধু চেয়ার, তৃতীয় দিনে ফুলের টব… এইভাবে এক মাসের পরিকল্পনা। বোঝাও যাবে না। আমরা হল ছাড়ছি। করাও হল তাই। বাচ্চাদের আগে আগে পাঠিয়ে দেয়া হল। আমি এবং আমার স্ত্রী হল ছাড়লাম এক গভীর রাতে।

শেষবারের মত শূন্য ঘরে দাঁড়িয়েছি। ছোট বাচ্চাদের মত ফুঁপিয়ে কাঁদছি, গুলতেকিন বলল, তোমরা যখন এত খারাপ লাগছে তখন হল ছেড়ে দিচ্ছ কেন? থেকে যাও।

থেকে যাও বললেই থেকে যাওয়া যায় না। প্রোথিত শিকড় ছিঁড়তে হয়। হয়ত এই শিকড় ছেঁড়ার মধ্য দিয়েই কেউ একজন আমাদের আসল শিকড় ছেঁড়ার কথা মনে করিয়ে দেন…
 
সমুদ্র বিলাস



প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে আমি ছোট্ট একটা ঘর বানাচ্ছি। পৃথিবী নামক এই গ্রহে নিজের জায়গা বলতে এইটুকু। কেন এই কাজটা করলাম? ব্যাপারটা কি তাৎক্ষণিক? হুট করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসা?

আমরা সব সময় বলি–হুট করে কিছু না ভেবে কাজটা করেছি। ব্যাপারটা মনে হয় সে রকম নয়। মানুষ কখনোই তাৎক্ষণিকভাবে কিছু করে না। তার প্রতিটি তাৎক্ষণিক কাজের পেছনে দীর্ঘ প্রস্তুতি থাকে। এই প্রস্তুতি অবচেতন মনে হয়। সে তার খবর রাখে না।

আজ থেকে কুড়ি বছর আগে আমার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব নড়বড়ে ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হিসাবে সব মিলিয়ে সাতশ-টাকা বেতন। বিরাট সংসার, ছজন ভাইবোন এবং মা। আমার বেতন এবং বাবার সামান্য পেনশন আমাদের সম্বল। এই দুয়ের যোগফল এক হাজার টাকার মত। এই টাকায় এত বড় সংসার টেনে নেয়া সম্ভব নয়। এই অসম্ভব কাজটি করতেন আমার মা কিভাবে করতেন তিনিই জানেন। মাসের শেষের কটি দিন খুব কষ্টে যেত। আমার পকেট শূন্য। মনের আনন্দে আমি যে এক কাপ চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরাব সে উপায় নেই। মাঝে মাঝে এমন হয়েছে, ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষ করে শ্যামলীর বাসায় ফিরেছি হেঁটে হেঁটে। রিকশা নেবার সামর্থ নেই। গাদাগাদি ভিড়ে বাসে ওঠাও সম্ভব নয়।

এই অবস্থায় একটা ঘটনা ঘটল। মাসের পঁচিশ তারিখে হঠাৎ করেই সাপ্তাহিক বিচিত্রা আমাকে নগদ তিনশ টাকা দিয়ে দিল। বিচিত্রা ঈদ সংখ্যায় অচিনপুর নামে একটা উপন্যাস লিখেছিলাম। এই টাকাটা তার সম্মানী। আমার মাথা খারাপ হবার জোগাড়, কি করব এই টাকাটা দিয়ে?

ইউনিভার্সিটি তখন বন্ধ। ক্লাসে যাবার তাড়া নেই। আমি ঠিক করলাম, ঘুরে। বেড়ানো যাক। কোথায় যাব তা ঠিক করা গেল না। টিকিট কেটে চিটাগাং মেইলে উঠে বসলাম। চিটাগাং আগে পৌঁছানো যাক–তারপর দেখা যাবে। সমুদ্র, পর্বত, অরণ্য অনেক কিছুই দেখার আছে। একটা বেছে নিলেই হবে।

সমুদ্র জয়ী হল। সন্ধ্যাবেলা কক্সবাজার পৌঁছলাম। ভাল হোটেল বলতে তখন হোটেল সায়েমান। তার ভাড়া সে সময়ে কম হলেও আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। কক্সবাজারে অনেক সরকারী রেস্ট হাউস আছে। কিন্তু সেসব রেস্ট হাউস সরকারি কর্মকর্তা এবং ভিআইপিদের জন্যে। আমি সরকারি কর্মকর্তা নই, ভিআইপিও নই। সামান্য একজন শিক্ষক।

খুঁজে পেতে সস্তার একটা হোটেল বের করলাম। যার বিছানা নোংরা, বালিশ নোংরা, মেঝে বালিতে কিচকিচ করছে। কমন বাথরুম। অনেকখানি হেঁটে বাথরুমের কাছাকাছি যাবার পর টের পাওয়া যায়–ভেতরে একজন বসে আছে। সেই বাথরুমও বিচিত্র। দরজায় হুড়কো নেই, দড়ি লাগানো আছে। ভেতরে বসে শক্ত করে দড়ি টেনে রাখতে হয়। কারও পায়ের শব্দ পেলে কেশে জানান দিতে হয়–আছি, আমি আছি। রাতে মশারি দেয়া হল না। হোটেলের মালিক বললেন, সাগরের হাওয়ায় মশা থাকে না। মশারি লাগবে না। তার কথায় বিশ্বাস করে ঘুমুতে গেলাম। দেখা গেল, মশা শুধু যে আছে তাই না, প্রবলভাবেই আছে। সমুদ্রের স্বাস্থ্যকর হওয়ার কারণে মশারা। সবাই স্বাস্থ্যবতী। স্বাস্থ্যবতীরা ঝাঁক বেঁধে এসে আমাকে কামড়াতে লাগল। স্বাস্থ্যবতী মশা বলার উদ্দেশ্য–স্ত্রী মশারই মানুষের রক্ত খায়, পুরুষরা না। তসলিমা নাসরিন আবার যেন মনে না করে বসেন যে, আমি মহিলা মশাদের ছোট করার জন্যে এই কথা লিখছি। এটা একটা বৈজ্ঞানিক সত্য।

সারারাত মশার কামড়ে ঘুম হল না। সূর্য উঠার আগেই আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। গেলাম সমুদ্র দেখতে। প্রভাতের সমুদ্র আমার সব দুঃখ, সব কষ্ট ভুলিয়ে দিল। বিপুল জলরাশির উপর আকাশের ছায়া। সমুদ্রের চাপা কান্না। সমুদ্রের পানিতে হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তাকিয়ে আছি দিগন্তের দিকে। সীমাবদ্ধ জগতে দাঁড়িয়ে অসীমের উপলব্ধি। আমার সমস্ত শরীর কাপতে লাগল। আমি স্পষ্ট শুনলাম, সমুদ্র ডেকে ডেকে বলছে–হে মানব সন্তান, আদি প্রাণ শুরু হয়েছিল সমুদ্রে। কাজেই তোমরা আমারই সন্তান। এসো, আমার কাছে এসো। এসো, তোমার গায়ে হাত বুলিয়ে একটু আদর করে দেই।

আমার মনে হল, ইশ, যদি এমন হত, সুন্দর একটা বাংলো বাড়ি আছে আমার, যে বাড়ির বিশাল টানা বারান্দায় চেয়ার-টেবিল পাতা। আমি ক্রমাগত লিখে যাচ্ছি। যখন ক্লান্ত বোধ করছি তখনি তাকাচ্ছি সমুদ্রের দিকে। তাহলে কী ভালই না হত! আচ্ছা, সরকার কি পারেন না, এমন একটি বাংলো লেখক, কবি-শিল্পীদের জন্যে বানিয়ে দিতে? এঁরা তো সমাজের জন্যেই কাজ করেন–সমাজ কি এঁদের জন্যে কিছু করবে না? সৃষ্টিশীল এইসব মানুষ কি সমাজের কাছে এই সামান্য দাবি করতে পারে না?

ভেবেছিলাম সাত দিন সাত রাত্রি সমুদ্রের কাছে থাকবো। টাকা-পয়সা দ্রুত ফুরিয়ে আসায় তৃতীয় দিনের মাথায় ঢাকায় ফিরে এলাম–মাথায় ঘুরতে লাগল কবিসাহিত্যিকদের জন্যে বাংলো। অনেকের সঙ্গে আলাপ করলাম। একজন আমাকে কঠিন ধমক লাগালেন–

তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তোমার চিন্তাধারা বুর্জোয়া। লেখক বাংলোতে বসে লিখবেন মানে? তিনি ঘুরবেন পথে পথে। তিনি থাকবেন বস্তিতে, মাঠে, নৌকায়। রাত্রি যাপন করবেন বেশ্যাবাড়িতে। তিনি সংগ্রহ করবেন অভিজ্ঞতা। সমুদ্রপাড়ের বাংলোতে বসে কফি খেতে খেতে সাহিত্য হয় না। সাহিত্য কঠিন জিনিস। তোমাকে দিয়ে এই জিনিস হবে না।

আমি ক্ষীণ স্বরে বলার চেষ্টা করলাম–লেখকের একটা কাজ হচ্ছে সৌন্দর্য। অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা। তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, সেই সৌন্দর্য জীবনের সৌন্দর্য, সমুদ্রের নয়।

আমি বললাম, প্রকৃতি কি জীবনের অংশ নয়? লেখকরা সব সময় প্রকৃতির কাছেই প্রশ্নের উত্তরের আশায় ফিরে যান।

ওরা কোন লেখক না। ওরা ভোগবাদী মানুষ। তুমি তোমার মাথা থেকে সমুদ্র দূর কর। অরণ্য, পর্বত, আকাশ, জোছনা, বৃষ্টি দূর কর। তাহলেই মহৎ সাহিত্য তৈরি। করতে পারবে।

সমুদ্র, পাহাড়, অরণ্য মাথা থেকে দূর করতে পারলাম না। যতই দিন যাচ্ছে ততই এরা আমার উপর চেপে বসছে। এক ধরনের হাহাকার আমাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। ঝকমকে বর্ষার রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে যে কথাটা প্রথম মনে হয় তা হল।–বর্ষার এই সৌন্দর্য দীর্ঘ দিন থাকবে। শুধু এই সৌন্দর্য দেখার জন্যে আমি বেঁচে থাকব না। হায়, জীবন এত ছোট কেন?

প্রতি বছর সমুদ্র দেখতে যাই। বিরানব্বই সনের শেষ দিকে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে গেলাম। দ্বীপের সৌন্দর্য আবার আমার ভেতর পুরানো হাহাকার জাগিয়ে তুলল। আমি মনে মনে বললাম, এখানে যদি ছোট্ট একটা ঘর বানানো যেত!

প্রকৃতি মানুষের কোন বাসনা অপূর্ণ রাখে না। পরম করুণাময় তৎক্ষণাৎ আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। ঢাকায় বসেই আমার এই দ্বীপে জায়গা কেনা সম্ভব হল। টেকনাফ এবং সেন্টমার্টিনের লোকজন গভীর আগ্রহে সেখানে বাংলো বানিয়ে দিতে এগিয়ে এলেন। বাংলোর নাম ঠিক করলাম সমুদ্র বিলাস।

সমুদ্রের মুখোমুখি ছোট্ট একটি কাঠের বাংলো, যার ছাদ টিনের। সেই টিন নীল রঙ করা যাতে বাংলোটিকে সমুদ্রের অংশ বলে মনে হয়। পেছনে অনেকখানি খালি জায়গা। খাকি জায়গা রাখার কারণ হল–আমার ইচ্ছা এ দেশের লেখকরা এ সমুদ্র বিলাসে কিছুদিন কাটাবেন, জোছনায় সমুদ্র দেখবেন। ফিরে আসার সময় ঐ খালি জায়গায় একটা গাছ পুঁতে আসবেন। পাখি উড়ে চলে যাবে। পাখির পালক পড়ে থাকবে। একদিন আমি থাকব না। কিন্তু আমার সমুদ্র বিলাস থাকবে। আমার ছেলেমেয়েদের জন্যে থাকবে না, থাকবে সৃষ্টিশীল মানুষের জন্যে। তাদের জন্যে এই আমার উপহার।

কুড়ি বছর আগে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, কুড়ি বছর পর তার বাস্তবায়ন হল। এই আনন্দ আমি কোথায় রাখি?

আমারে তুমি অশেষ করেছ,
এমনি লীলা তব
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ
জীবন নব নব।।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top