What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected সকল কাঁটা ধণ্য করে (হুমায়ুন আহমেদ) (2 Viewers)

গ্রীন বয়েজ ফুটবল ক্লাব



ছোটবেলায় আমি একটা ফুটবল দল করি। দলের নাম গ্রীন বয়েজ ফুটবল ক্লাব। সে সময় বাংলা নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না। ক্লাবের নাম ইংরেজিতেই হত। আমাদের। ক্লাবের প্রধান পেট্রন ছিলেন আমার বড় মামা শেখ ফজলুল করিম। তিনি তখন সিলেট এম সি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়তেন। কখনো ফাইনাল পরীক্ষা দিতেন না বলে বছর ছয়েক ধরে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছিলেন। পড়াশোনা ছাড়া পৃথিবীর সমস্ত বিষয়ে তার অসীম উৎসাহ ছিল।

এ কাজেই আমরা একটা ফুটবল ক্লাব করতে চাই শুনে তিনি তার যাবতীয় প্রতিভা এই দিকে নিবদ্ধ করলেন। ক্লাবের নাম ঠিক করলেন। প্লেয়ারদের জার্সির ডিজাইন। করলেন। সবুজ রঙের শার্ট, শাদা কলার, শাদা প্যান্ট এবং শাদা কেডস জুতা। জার্সি বা কেডস জুতা কেনার সামর্থ আমাদের ছিল না। বড় মামা বললেন, একদিন হবে। তখন যেন ডিজাইনের জন্যে বসে থাকতে না হয়। ক্লাবের নিয়মকানুন ঠিক করে সব ফুলস্ক্যাপ কাগজে লিখে ফেলা হল। সদস্যদের জন্যে চার আনা মাসিক চাঁদা নির্ধারিত। হল। ক্লাবের নিয়ম ভঙ্গ করলে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হল।

সবই হল, সমস্যা একটাই। আমাদের কোন বল নেই। চাঁদা যা উঠেছে, তাতে বল হয় না। বড় মামা যে সাহায্য করবেন, সে উপায় নেই। বাড়ি থেকে তাকে টাকা। পাঠানো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমার নানাজান ঘোষণা করেছেন, দুষ্ট গরুর পেছনে। আর অর্থ ব্যয় করবেন না। বড় মামাকে নানান ফন্দি-ফিকির করে নিজের চা-সিগ্রেটের। খরচ যোগাড় করতে হয়।

আমরা ক্লাব করে বিষণ্ণ হয়ে ঘোরাফেরা করি। বল নেই। বল পাওয়া যাবে সে সম্ভাবনাও নেই। এদিকে বর্ষা নেমে গেছে। আমাদের পাশের পাড়ার ছেলেরা রয়েল। বেঙ্গল টাইগার ক্লাব বানিয়ে ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে গেছে। বড় মামা আমাদের সান্ত্বনা। দেন, ক্লাব তৈরি করাটাই আসল, বল কোন ব্যাপার না। তোমরা প্র্যাকটিস কর। ২

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, বল ছাড়া কিভাবে প্র্যাকটিস করব?

মামা বড়ই বিরক্ত হলেন, প্র্যাকটিস করতে বল লাগবে কেন? দৌড়ের প্র্যাকটিস লাগবে, দম রাখার প্র্যাকটিস লাগবে। ল্যাং মারা শিখতে হবে। কাচ্চি মারা শিখতে হবে। দৌড়ের সময় কনুই দিয়ে গুঁতা মেরে বিপক্ষের প্লেয়ার ফেলে দেওয়ার ট্রেনিং নিতে হবে। ফুটবল তো কোন সহজ খেলা না। খুবই জটিল খেলা।

আমরা মামার নেতৃত্বে প্র্যাকটিস শুরু করে দিলাম। ল্যাং মারা শিখলাম, কাচ্চি মারা শিখলাম। কনুই দিয়ে গুতা মারা শিখলাম। তখনকার সময় ফিফার নিয়মকানুন ছিল না। ফুটবলের মাঠে ফাউল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হত। রেফারি এইসব ক্ষেত্রে বলতেন, আরে এটা তো মেয়েছেলের লুডু খেলা না। একটু-আধটু লাগবেই। খেলায় যদি এক দু-একজনের হাত-পা না ভাঙল তবে কিসের খেলা?

মারামারি বিষয়ক পুরোপুরি ট্রেনিং প্রাপ্তির পর কে কোন পজিশনে খেলব তাও মামা ঠিক করে দিলেন। গাট্টাগোট্টা চেহারার জন্যে মজনুকে করা হল ফুল ব্যাক। মামা। তার নাম বদলে দিয়ে নতুন নাম রাখলেন–জুম্মা খা। মামা মজনুকে ডেকে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ভাল মত বল আটকাবি। পেনাল্টি এরিয়ার ধারে কাছে যেন বল না আসতে পারে। ঠিকমত খেলতে পারলে তোর টাইটেল দিয়ে দেব চীনের প্রাচীর। গ্রেট ওয়াল অব চায়না।

তবু আমাদের বিষণ্ণ ভাব কাটে না। অন্য দল আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করে। বল। নেই, ফুটবল ক্লাব। হাসাহাসি করারই কথা। তারচেয়েও দুঃখের ঘটনা ঘটে গেল–শ্রাবণ মাসের গোড়ার দিকে আমাদের জুম্মা খা রয়েল বেঙ্গল ক্লাবে চলে গেল। ওদের ব্যাক হয়ে ধুমসে খেলতে লাগল। অন্যরাও উসখুস করতে লাগল। বড় মামা মিটিং করে মজনুকে চিরজীবনের জন্যে দল থেকে বহিষ্কার করলেন। তাতে মজনুকে তেমন বিচলিত হতে দেখা গেল না। বরং মনে হল খুশিই হল। আমাদের সঙ্গে দেখা হলে দাঁত বের করে হাসে। ( দলের মোরালের যখন এই অবস্থা তখন মোরাল ঠিক করার জন্য বড় মামা ম্যাচ ডিক্লেয়ার করে দিলেন। সিলভার কাপের খেলা। কাপের নাম–শেখ ফজলুল করিম সিলভার কাপ। লীগ পদ্ধতিতে খেলা হবে। যে পার কাপ জিতে নাও। উৎসাহ কিছুটা। ফিরে এল, যদিও তখনো ফুটবলের দেখা নেই।

আমার বাবা তখন দিনাজপুরের জগদলে। তার কাছে ফুটবল কেনার টাকা চেয়ে। ছোটবোনকে দিয়ে একটা চিঠি লেখালাম। কারণ, বাবা তার মেয়েকে অসম্ভব। ভালবাসেন। তিনি মেয়ের আবদার রাখবেন না, তা হতেই পারে না। বাবা সেই চিঠির উত্তরে লিখলেন–মা, মেয়েরা তো ফুটবল খেলে না। তুমি ফুটবল কেন কিনতে চাচ্ছ। তা বুঝলাম না।

এদিকে ম্যাচের দিন ঘনিয়ে এসেছে। শুক্রবার খেলা। প্রথম দিনেই আমাদের খেলা পড়েছে রয়েল বেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে। আমাদের ফুটবল নেই। তাতে তেমন অসুবিধা হবে না, ওদের আছে। সেই ফুটবলে খেললেই হবে। প্রধান সমস্যা বড় মামার ঘোষণা করা। সিলভার কাপেরও খোঁজ নেই। আমরা কিছু জিজ্ঞেস করেলই মামা রেগে যান। বিরক্ত গলায় বলেন, হবে হবে। এত অস্থির হচ্ছিস কেন? যথাসময়ে কাপ চলে আসবে। কাপ। দেখে তোদের চোখ কপালে উঠে যাবে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কাপ চলে এল। সেই কাপ দেখে সত্যি আমাদের চোখ কপালে উঠে গেল। সেই চোখ আর কপাল থেকে নামতে চায় না। বিশাল কাপ। কাপের গায়ে ইংরেজীতে লেখা S. F. Karim Silver Cup 1955.

আমাদের আনন্দ কে দেখে। সন্ধ্যা বেলাতেই কাপ নিয়ে মিছিল। মিছিলের পুরোভাগে আছেন বড় মামা। কি ভয়ংকর উত্তেজনা! কি আনন্দ! রাতে এক ফোটা ঘুম হল না।

এ প্রথম দিনের খেলায় রয়েল বেঙ্গল ক্লাব দুই গোলে হেরে গেল। বড় মামার দিকে তাকিয়ে দেখি, আনন্দে তিনি কাঁদছেন। রুমালে ঘন ঘন চোখ মুছতে মুছতে বলছেন, চোখে আবার কি পড়ল। কি যন্ত্রণা!.

সিলেট শহরে ছোটদের মধ্যে এই কাপ দারুণ হৈ-চৈ ফেলে দিল। ছোটদের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল বড়দের মধ্যে। ফাইনালের দিন রীতিমত উৎসব। অনেক স্কুল ছুটি হয়ে গেল। খেলা দেখতে এলেন ডিসি, এসপি, গণ্যমান্য লোকজন। প্রধান অতিথি হয়ে এলেন এম সি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল সাহেব।

সে বছর মামা আবারো আই. এ. পরীক্ষা দিলেন না। কারণ সিলভার কাপ কেনার জন্যে তিনি তার কলেজের যাবতীয় বই এবং তাঁর অতিপ্রিয় হারকিউলিস সাইকেল বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

কিছুদিন ধরেই রাত জেগে ওয়ার্ল্ড কাপ দেখছি। সোনার তৈরি কাপটি যতবার পর্দায় দেখায় ততবারই আমার বড় মামার কাপটির কথা মনে হয়। আমার এই মামা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তারপরেও টিভি পর্দায় সোনার কাপটি দেখলেই আমার মন বলে–না, পৃথিবী তাকে পুরোপুরি পরাজিত করতে পারেনি। বিশ্বকাপের আয়েজকদের দীর্ঘ তালিকায় অদৃশ্য অক্ষরে তার নাম লিখতে হয়েছে। এই বা কম কি?
 
ছুনু মিয়া



আমার নাম ছুনু মিয়া। গলার স্বরে বিস্মিত হয়ে তাকালাম। চাপা হিসহিসে গলা। সর্পকুলের কথা বলার ক্ষমতা থাকলে হয়ত এভাবেই কথা বলত। তবে আমার পাশে যে দাঁড়িয়ে সে সাপ না, মানুষ। ছোটখাট একজন মানুষ। গায়ে চকচকে শার্ট। সেই শার্ট প্যান্টের ভেতর ইন করা। পায়ে অবশ্যি স্পঞ্জের স্যান্ডেল। লক্ষ্য করলাম, পায়ের বুড়ো আঙুলে নেল পলিশ দেয়া হয়েছে। হাতের কনিষ্ঠ আঙুলেও নেল পলিশ। মাথার চুল তেলে চপচপ করছে। চোখে সানগ্লাস। কিছুক্ষণ আগে পান খেয়েছে, পানের রস গড়িয়ে পড়ছে।

আমার জন্যে এটু খাস দিলে দোয়া রাখবেন স্যার।–এই বলে ছুনু মিয়া আমাকে কদমবুসি করতে এগিয়ে এল। আমার পাশের চেয়ারে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গনি সাহেব বসে আছেন। তিনিও ছুনু মিয়ার মতই ছোটখাট মানুষ। তবে গলায় অসম্ভব জোর। তিনি প্রচণ্ড ধমক লাগালেন, খবর্দার, উনার গায়ে হাত দিবি না। খবর্দার বললাম।

ছুনু মিয়া হেসে ফেলল। মনে হল ধমক খেয়ে সে বড়ই আনন্দ পাচ্ছে। গনি সাহেব। আবারো ধমক দিলেন, দূরে গিয়া দাঁড়া ছুনু।

ছুনু একটু সরে গিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসল। ধমক খেয়ে এত আনন্দিত হতে এর আগে কাউকে দেখিনি। সে পকেটে হাত দিয়ে রুমাল বের করে বেশ কায়দা করে মুখ মুছতে লাগল। ফুল তোলা বাহারী রুমাল। রুমালে আতর ছিল বোধহয়। চারদিক সস্তা। আতরের গন্ধে ভরে গেছে।

গনি সাহেব বললেন, ছুনু, তুই দশ হাত দূরে গিয়া বস। চশমার ফাঁক দিয়া উনারে দেখবার চেষ্টা করবি না। চশমার ফাঁক দিয়া দেখনের চেষ্টা করছস কি তোরে জ্যান্ত কবর দিয়ে ফেলব। উনি অতিথ মানুষ। উনার বিপদ হইলে তোর রক্ষা নাই।

আমি এদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা কিছুই বুঝলাম না। তবে খুব ব্যস্তও হলাম না। আমি জানি, যথাসময়ে আমাকে বলা হবে। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যেই ছুনুকে আনা হয়েছে। এখন তাকে নিয়ে খানিকটা নাটক করা হচ্ছে। গ্রামের। লোকজন নাটক করতে পছন্দ করে।

গনি সাহেব আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, ছুনু মিয়ার চোখ খুবই খারাপ। চোখে নজর লাগে। তার চোখের নজর এই অঞ্চলে বিখ্যাত। এই জন্যেই কালো চশমা। ইউনিয়ন বোর্ডের খরচে চশমা কিনে দেয়া হয়েছে। তবে হারামজাদা বদের হাড্ডি। চশমার ফাঁক দিয়া দেখার চেষ্টা করে। এইটু আগে আপনেরে দেখার চেষ্টা করতেছিল। সময়মত বুঝতে পারছি বইল্যা রক্ষা।

নজর লাগা ব্যাপারটা আমার অজানা নয়। কিন্তু এই সামান্য ব্যাপারটাতে এরা এমন বিশিষ্টতা আরোপ করবে, ইউনিয়ন বোর্ডের পয়সায় নজর লাগা ঠেকানোর জন্যে সানগ্লাস কিনে দেয়া হবে তা ভাবিনি। সানগ্লাস পরিয়ে নজর লাগা ঠেকানো যায় তাও জানা ছিল না।

যার নজর লাগে বলে সবাই মনে করে সে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগবে এটাই স্বাভাবিক। ছুনু মিয়ার মধ্যে সেরকম কিছু দেখা গেল না, বরং তাক তার ক্ষমতায় বেশ আনন্দিত মনে হল। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর রুমালে মুখ মুছছে।

গনি সাহেব বললেন, এই ছুনু, স্থির হইয়া বস। অত কিসের নড়াচড়া?

ছুনু মিয়া আবারো দাত বের করে হাসল। সবাই তার দিকে লক্ষ্য রাখছে এটাই মনে হয় তার আনন্দের মূল কারণ। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ছুনু নামের অর্থ কি?

ছুনু মিয়া হাসি মুখে বলল, নামের অর্থ জানি না। পিতা-মাতা নাম রাখছিল ছানোয়ার, গেরামের লোকে ডাকে ছুনু। বড় নামে ডাকতে গেরামের লোকের কষ্ট হয়। গেরামের লোকের জিহ্বা থাকে মোটা।

আমি ছুনু মিয়ার রসিকতায় অবাক হলাম। তারচেয়েও অবাক হলাম তার গলার স্বরে। আগে যেমন সাপের গলায় কথা বলছিল এখন তা বলছে না। স্বাভাবিক গলা। মনে হয় প্রথম পরিচয়ের সময় সাপের মত গলা সে ইচ্ছা করেই করে। শুরুতেই ভয় দেখানোর চেষ্টা। আমি বললাম, তোমার বয়স কত ছুনু?

ছুন কিছু বলার আগে চেয়ারম্যান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, স্যার, আপনে এরে তুমি কইরা বলতেছেন কেন? তুমি বলনে লাই পাইতেছে। এরে তুই কইরা। বলেন।

ছুনু উদাস গলায় বলল, তুইয়ের নিচে কিছু থাকলে হেইডাও বলতে পারেন। অসুবিধা কিছু নাই। বয়স জিগাইছেন, বয়স ভালই হইছে। অধিক বয়সে বিবাহ করছি বইলা পোলাপান ছোট ছোট। বড় মাইয়া কেলাস সিক্সে পড়ে। আপনাদের দশজনের দোয়ায় সরকারি বৃত্তি পাইছে।

আমি বিস্মিত হয়ে গনি সাহেবের দিকে তাকালাম। গনি সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, কথা সত্য। এই হারামজাদার ছেলেমেয়ে প্রত্যেকটা লেখাপড়ায় ভাল। বড় মেয়েটা তো অত্যধিক ভাল। ময়মনসিং ডিসট্রিক্টে সেকেন্ড হয়েছে।

বলেন কি?

গনি সাহেব উদাস গলায় বললেন, গোবরে পদ্মফুল যে বলে এই জিনিস, আর কিছু না। গোবর তো না, একেবারে গুয়ের মধ্যে পদ্মফুল।

ছুনু বলল, বেয়াদবী না নিলে একটা সিগারেট দেন স্যার। খাইয়া দেখি। বিড়ি টানতে টানতে কইলজার কাম শেষ।

আমি প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করলাম। গনি সাহেব হা হা করে উঠলেন, হাতে দিবেন না স্যার। হাতে দিবেন না। মাটিতে ফিক্যা মারেন, বলে তিনি অপেক্ষা করলেন না। আমার হাত থেকে সিগারেট নিয়ে নিজেই ছুনুর দিকে ছুঁড়ে দিলেন। ছুনু সেই সিগারেট শূন্য থেকে লুফে নিল।

গনি সাহেব বললেন, এই হারামজাদার কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। হারামজাদার চোখ শয়তানের চোখের চেয়েও খারাপ।

আমি বললাম, কি রকম খারাপ?

গনি সাহেব অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ধরেন একটা লকলকা লাউ গাছ, ছুনু যদি সেই গাছ দেখে বলে, আহা কি সুন্দর, তা হইলেই কাম সারা। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গাছের মৃত্যু।

ছুনু আপত্তির গলায় বলল, কিছু না বললেও হয়, বলা লাগে না।

আমি সন্দেহের গলায় বললাম, এটা কি পরীক্ষিত?

আমার সন্দেহে গনি সাহেব আহত হলেন। ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, অবশ্যই পরীক্ষিত। গাছপালা, গরু-ছাগল, মানুষ সবেতেই তার চোখ লাগে।।

ছুনু উদাস গলায় বলল, কলকব্জার মধ্যেও লাগে। গনি চাচা, বজলু ভাইয়ের। সাইকেলের গফটা স্যাররে বলেন। স্যার মজা পাইব।

বজলুর সাইকেলের গল্প শুনলাম। বজলু স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, নতুন সাইকেল কিনেছে। প্রিন্স সাইকেল। অনেকের সঙ্গে ছুনুও সাইকেল দেখতে গেল এবং ফস করে মনের ভুলে বলে বসল, জবর সাইকেল খরিদ করছেন বজলু ভাই। এমুন। সাইকেল লাখে এক।

এই বলাই কাল হল। কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের চাকা বাল্ট। শব্দ। হয়েছিল দুনলা বন্দুকের গুলির মত।

গল্প শুনে বিস্মিত হবার ভঙ্গি করব কি না বুঝতে পারছি না। আমি বিস্মিত হলে গনি সাহেব খুশি হন। তিনি গত তিনদিন ধরে আমাকে নানানভাবে বিস্মিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। গতকাল এক গায়ক নিয়ে এসেছিলেন, যার গলা নাকি অবিকল হেমন্তের মত–কোন উনিশ-বিশ নেই। গায়কের গলা আসলেই ভাল। তবু গণ্ডগ্রামের লুঙ্গি পরা খালি গায়ের গায়কের গলায় তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বিস্তি এল শুনতে ভাল লাগে না। ঝাড়া দুঘণ্টা হেমন্তের গান শুনলাম। গায়কের ধৈর্য যেমন অসীম, মুখস্থ গানের সংখ্যাও অসীম। গান শুনে আমি ক্লান্ত ও বিরক্ত। তারপরেও বিস্মিত, অভিভূত হবার ভঙ্গি করে বলতে হল, অদ্ভুত। এরকম শুনিনি। গনি সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বড়ই আফসোস! কত বড় বড় প্রতিভা পল্লীগ্রামে নষ্ট হইতেছে।

কে জানে ছুনু মিয়াও হয়তো এদের চোখে বিরাট প্রতিভা। পল্লীগ্রামে অনাদরে নষ্ট হচ্ছে। আমাকে দেখিয়ে সেই প্রতিভার খানিক স্বীকৃতিও যদি পাওয়া যায়। গনি সাহেব আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বললেন, ভাই সাহেব, ছনুর চোখ বড়ই ডেঞ্জারাস। ভেরী ভেরী ডেঞ্জারাস।

গ্রামের মানুষদের এই আরেক অভ্যাস, কানে কথা বলা। ছুনুর চোখ ডেঞ্জারাস এই তথ্য আমার কানের ভেতরে দিয়ে দেয়ার দরকার নেই। এটা তেমন গোপন তথ্যও না। এমন না যে ছুনু এই গোপন সংবাদ দিয়ে দেয়ায় আহত হবে। ছুনু এই খবরে খুশি হয়। বলেই আমার ধারণা। সে যে একজন ডেঞ্জারাস ব্যক্তি তা প্রমাণ করার জন্যে ছুনুর নিজের ব্যস্ততাও কম না। গনি সাহেবের চেয়ে বেশি বলেই তো মনে হচ্ছে।

ছুনু বলল, বিয়া বাড়ির গফটা করেন, স্যার মজা পাইব। বড়ই মজার গফ।

মজা পাবার জন্যে আমি তেমন অস্থির ছিলাম না। তারপরেও বিয়ে বাড়ির গল্প শুনতে হল। তিন বছর আগের ঘটনা। এই গ্রামেরই এক মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। বর। আসছে পাল্কিতে। পথে ছুনুর সঙ্গে দেখা। ছুনু পাল্কি দেখে মুগ্ধ হয়ে (মনের ভুলে) বলে ফেলল, মেলা দিন পরে পাল্কি দেখলাম। বড়ই সৌন্দর্য! ছুনুর কথা শেষ হবার আগেই পাল্কি ভেঙে ধান ক্ষেতে পড়ে গেল। সেখানে আবার এক হাঁটু পানি। নতুন বর কাদায় পানিতে মাখামাখি। কনেবাড়ির লোকজন খবর শুনে ছুনুকে ধরে ইচ্ছামত ধোলাই দিয়েছে। নীলগঞ্জ সদর হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল চারদিন।

ছুনু হাসিমুখে বলল, আরেকটু হইলে জানে মাইরা ফেলত স্যার। অল্পের জন্যে জেবন রক্ষা হইছে। সবই আল্লার ইশারা।

আমি বললাম, মার খেয়ে তুমি তো মনে হয় খুশিই হয়েছ।

ছুনু বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, মাইর তো স্যার খাওন লাগবই। অতবড় একটা। ক্ষমতা।

এই ক্ষমতায় কি তুমি খুশি?

লোকজন আমারে সমীহ করে। যখন পথে হাঁটি আঙুল উঁচাইয়া দেখায়–বড় ভাল লাগে! এই যে আফনে আমারে আদর কইরা ফিলটার ছিটে দিলেন, আমি খাইলাম, এই গুলান হইল আমার ক্ষমতার কারণে। ক্ষমতা না থাকলে কে আমারে। পুছতো?

তুমি কি নিশ্চিত তোমার ক্ষমতা আছে?

চুনু মিয়া প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল। আনন্দিত গলায় বলল, নিজের কথা নিজের মুখে বলা ঠিক না, গুনাহ হয়। আল্লাহপাক বেজার হন। দশ জনেরে জিজ্ঞেস করেন, তারা বলব। আর যদি অনুমতি দেন তা হইলে চোউক্ষের একটা খেলা দেখাইয়া দিমু।

চোখের খেলা দেখার জন্যে আমি তেমন আগ্রহ দেখালাম না। এই সব আধিভৌতিক ব্যাপারকে প্রশ্রয় যত কম দেয়া যায় ততই ভাল। পিশাচ ও ডাইনীদের যুগ পেছনে ফেলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। চাদে মানুষ পৌঁছে গেছে, কিছুদিন পর পৌঁছবে মঙ্গল গ্রহে। এই সময় চোখ লাগা নিয়ে মাথা ঘামানো শুধু হাস্যকর না, অপরাধও।

পরদিন দুপুরে ছুনুর সঙ্গে আমার আবার দেখা। গনি সাহেবকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছি। হঠাৎ দেখি, খালের পাড় থেকে ছুনু কচুর লতি সংগ্রহ করছে। ছুনুর গায়ে আগের দিনের পোশাক নেই। ময়লা লুঙ্গি, খালি গা। চোখে সানগ্লাসও নেই। ছুনুর সঙ্গে বার-তের বছরের ফুটফুটে একটা মেয়ে। ছুনুর তুলনায় তার মেয়েটার পোশাক পরিপাটি। ফ্রকটা সুন্দর এবং পরিষ্কার। মাথার চুল বেণী করে বাধা। এই বোধহয় ছুনুর বৃত্তি পাওয়া মেয়ে। আমি বললাম, কে, ছুনু না?

ছুনু জিবে কামড় দিল, যেন হঠাৎ আমাকে দেখে লজ্জা পেয়েছে।

এই কি তোমার বৃত্তি পাওয়া মেয়ে?

ছুনু যেন আরো লজ্জা পেল। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, নাম কি মা?

মেয়ে বিস্মিত এবং খুশি খুখি গলায় বলল, মরিয়ম।

ছুনু বলল, চাচাজানরে কদমবুসি কর মা। মুরুব্বিরে আদব করবা না এইসব আমি সহ্য করব না। মেয়ে এসে সালাম করল। আমি অবাক হয়ে দেখি, ছুনু চোখ মুছছে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ছুনু বলল, আপনের মত একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি আমার মেয়েরে মা ডাকল, মনটার মধ্যে বড় আনন্দ হইতেছে স্যার। বড় আনন্দ। আপনার মত মানুষের দেখা পাওয়া ভাগ্যের কথা।

গনি সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, ঢং করিস না ছুনু। আজ তোর চশমা কই? চশমা ছাড়া ঘুরতাছস, তুই পাইছস কি?

গনি সাহেবের কথায় তার ভাবান্তর হল না। সে চোখ মুছতেই থাকল।

সন্ধ্যাবেলা গনি সাহেবের বাড়িতে ফেরার পথে ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘটল। পা পিছলে ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক থেকে নিচের খালে পড়ে গেলাম। ব্যথা ভালই পেলাম। পা মচকে গেল। দেখতে দেখতে ফুলে ঢোল। গনি সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, এই রকম। ঘটনা যে ঘটব আগেই টের পাইছি। ছুনু যখন বলছে, আপনার মত মানুষের দেখা। পাওয়া ভাগ্যের কথা তখনই বুঝছি, হইছে কাম।

আমি বললাম, গনি সাহেব, আমি নিজের কারণে ব্যথা পেয়েছি। পা পিছলে পড়ে গেছি। বেচারা ছুনুকে এর মধ্যে জড়ানো খুবই হাস্যকর হচ্ছে। [ গনি সাহেব থতমত গলায় বললেন, শুকনা খটখটা রাস্তা, এর মধ্যে আপনের পা। পিছলাইল, বিষয় কি? বিষয় পরিষ্কার। ছুনু হারামজাদা নজর দিছে। তার চউখে ছিল না চশমা। এটা তো সোজা হিসাব। হারামজাদার সাহস কত! চশমা ছাড়া ঘুরে। এর মীমাংসা হওয়া দরকার।

অন্ধ বিশ্বাসের সঙ্গে তর্ক চলে না। কাজেই আর কিছু না বলে আমি গনি সাহেবের কাঁধে ভর দিয়ে ঘরে ফিরলাম। আমার উপর ছুনু নজর দিয়েছে এই খবর কিছুক্ষণের। মধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেল। দলে দলে লোক আমাকে দেখতে আসতে লাগল। যেই আসে, গনি সাহেব তার কাছেই নজর লাগার প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন। আমাকে আমার ফুলে যাওয়া পা দেখাতে হয়। দর্শনার্থীরা আহা, বিদেশী মানুষটারে কি বিপদে ফেলছে বলে সমবেদনার আর্দ্র স্বর বের করে। বিশ্রী অবস্থা!

রাতে খাবার সময় গনি সাহেব আমাকে জানালেন যে, ছুনুকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে পলাতক। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ছুনু পলাতক কেন?

তার নজর লাগছে সেই খবর পাইয়া ভাগছে। ভাইগ্যা যাইব কই? ছুনুর কপালে দুঃখু আছে। বেজায় দুঃখ।

আমি হতভম্ব গলায় বললাম, মারধোর করা হবে নাকি?

দেখেন না কি হয়। আইজ তার বাপের নাম বিস্মরণ হবে।

আমি আপনার কাছে হাত জোড় করে বলছি ছুনুকে কিছুই বলবেন না। আমি পুরো ব্যাপারটায় খুবই লজ্জিত। আমার লজ্জা আর বাড়াবেন না।

গনি সাহেব উত্তর দিলেন না। গম্ভীর হয়ে রইলেন।

গ্রামের মানুষ একটা তুচ্ছ ব্যাপারকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে তার প্রমাণ পেলাম শেষ রাতে। ঘুমিয়ে ছিলাম। গনি সাহেব আমাকে ঘুম থেকে তুলে বললেন, ছুনু ধরা পড়েছে। আসেন দেখে যান। হারামজাদা কত বড় বদ! নিজের ঘরের চালের উপরে উঠে বসেছিল। তয় তার জন্মের শিক্ষা হয়ে গেছে।

আমি ঘর থেকে বের হয়ে দেখি, উঠোনের মাঝখামে ছুনু পড়ে আছে। আমাকে আসতে দেখে কে একজন পঁাচ ব্যাটারির একটা টর্চ ছুনুর উপর ধরল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ছুনুর গায়ে কোন কাপড় নেই, সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় সে পড়ে আছে। সারা শরীর রক্তে মাখামাখি। সে মাঝে মাঝে শাঁ শাঁ জাতীয় শব্দ করছে। আবার সেই শব্দ থেমে যাচ্ছে। কি ভয়াবহ অবস্থা!

উঠোনের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ছুনুর মেয়েটা। সে তার বাবাকে দেখছে না, দেখছে আমাকে। তার চোখে ঘৃণা নেই, রাগ নেই, তার চোখ গভীর অভিমানে আর্দ্র।

আমি ছুনুর কাছে গিয়ে বললাম, ছুনু, আমার লজ্জা আর অনুতাপের কোন শেষ নেই। আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

ছুনু অনেক কষ্টে চোখ মেলল। আমি তার চোখে মুখে একটা আনন্দের আভা দেখলাম। সে ফিস ফিস করে বলল, গরীব হইয়া জন্মাইছি। মাইর তো কপালে আছেই। স্যাররে যে ক্ষমতাটা দেখাইতে পারছি এইটাই মনে শান্তি। আপনে জ্ঞানী মানুষ। আপনে যেটা বুঝবেন, অন্য দশজনে সেইটা বুঝব না। তাছাড়া আইজের ঘটনায় নাম আরো ফাটব। এইটাও তো স্যার কম কথা না। মন্দ হউক ভাল হউক, একটা ক্ষমতা পাইছি। দশজনে যদি নাই জানলো, হেই ক্ষমতা দিয়া লাভ কি? আমারে একটা সার্টিফিকেট যদি লেইখ্যা দেন বড় ভাল হয়। ঘরে টানাইয়া রাখি।

কি সার্টিফিকেট?

নজরের বিষয়ে একটা সার্টিফিকেট।

আচ্ছা যাও, দেব সাটিফিকেট।

ছুনুর হেঁচকির মত উঠছে। দূরে দাঁড়িয়ে তার মেয়েটা কাঁদছে। কি অদ্ভুত পরিস্থিতি! কে একজন বলল, ছুনুর তওবাটা পড়ায়ে ফেলা দরকার, অবস্থা ভাল ঠেকতেছে না।

ছুনুকে বিছানায় এনে শোয়ানোর ব্যবস্থা করে ডাক্তার আনতে লোক পাঠালাম। ছুনু চোখের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকল। আমি মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ফিস ফিস করে বলল, মইরা যাব কিনা বুঝতাছি না। শ্বাসকষ্ট হইতাছে। একটা গোপন কথা আফনেরে বইল্যা যাই স্যার। না বললে অফরাধি হইয়া থাকব। আমার আসলে কোন ক্ষমতা নাই। দুষ্ট লোকে গেরাম ভর্তি। ক্ষমতা থাকলে নজর দিয়া এবারে শেষ কইরা দিতাম। যেমন ধরেন, আমরার চেয়ারম্যান গনি সাহেব। কত চেষ্টা করছি তারে নজর লাগাইতে। লাগে না।

আমি তাকিয়ে আছি। কি বলব বুঝতে পারছি না।

ছুনু শ্বাস টানতে টানতে ফিসফিস করে বলল, সার্টিফিকেটটা কিন্তু স্যার দিবেন। বাঁইচ্যা থাকলে কামে লাগব।
 
ছেলেটা



আমি এলিফেন্ট রোডের যে এ্যাপার্টমেন্ট হাউসে থাকি তার নিয়ম কানুন খুব কড়া। যে-কেউ ইচ্ছা করলেই ঢুকতে পারে না। গেটেই তাকে আটকানো হয়। রিসিপশনিস্ট (মহিলা নয়, পুরুষ) কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করেন–কোথায় যাবেন? কার কাছে যাবেন? কোত্থেকে এসেছেন? এখানেই শেষ না। যার কাছে যাওয়া হবে তাকে ইন্টারকমে ধরা হয়। তাকে বলা হয়–অমুক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। পাঠাব? যদি পাঠানোর অনুমতি পাওয়া যায় তবেই দর্শনার্থী ঢুকতে পারেন।

ব্যবস্থা ভাল। উটকো লোকের ঝামেলা থাকে না।

আমি আবার এই ভাল ব্যবস্থার উপর এককাঠি। আমার দিক থেকে রিসিপশনিস্টকে নির্দেশ দেয়া আছে সকাল দশটার আগে কাউকেই যেত আসতে না দেয়া হয়। আমি রাত জেগে লেখালেখি করি,পড়াশোনা করি। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়। হাত-মুখ ধুতে ধুতে দশটা বেজে যায়। বাসি মুখে কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা। করে না।

রিসিপশনিস্ট আমার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। একদিন তার ব্যতিক্রম হল। ভোর ছটায় ইন্টারকম বেজে উঠল। একজন ছেলে এসেছে। খুব কাঁদছে। একটা। জরুরী চিঠি সে নিয়ে এসেছে। নিজেই আমার হাতে দেবে। এক্ষুণি দিতে হবে।

আমি তাকে উপরে পাঠাতে বললাম। চেহারা দেখে মনে হল কলেজে পড়ে। ভদ্র চেহারা। মাথা নিচু করে আছে। হাতে রুমাল। মাঝে মাঝে রুমালে চোখ মুছছে। আমি বললাম, কি ব্যাপার? সে একটা কাগজ বের করে দিল। একটা চিঠি। আমাকে সম্ভাষণ করে লেখা। চিঠির ভাষা হুবহু মনে নেই মোটামুটিভাবে এরকম–

হুমায়ূন সাহেব,

আপনার মেয়ে শীলা আমার ছাত্রী। আমি খুব বিপদে পড়ে আমার ছেলেকে আপনার কাছে পাঠালাম। আমার স্বামী গতকাল রাত তিনটায় মারা গেছেন। আমার হাত একেবারে খালি। মৃতদেহের সৎকারের জন্যে এই মুহূর্তে কিছু টাকা দরকার। আপনি কি ঋণ হিসেবে আমার ছেলের হাতে দুহাজার। টাকা পাঠাবেন? ছাত্রীর বাবার কাছে টাকার জন্যে হাত পাততে হল—এই লজ্জা আমার রাখার জায়গা নেই। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক। ইতি আমি আমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম–মা,… এই নামে তোমার কোন টিচার আছেন?

শীলা বলল, হ্যাঁ, উনি আমাদের ক্লাস টিচার। খুব ভাল টিচার। আমি আর সময় নষ্ট করলাম না। ছেলেটির হাতে দুহাজার টাকা দিলাম। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে কিছু কথা বললাম। যদিও জানি, প্রবল শোকের সময়ে সান্ত্বনার কথা খুব হাস্যকর শোনায়। ছেলেটি চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল। আমার খানিকটা মন খারাপ হল এই ভেবে যে, মৃত্যুর প্রবল শোকের যন্ত্রণা ছাপিয়ে অর্থকষ্টের যন্ত্রণা এই সমাজে বড় হয়ে উঠছে।

হাত-মুখ ধুয়ে নাশতার টেবিলে বসেই মনে হল–একটা ভুল হয়েছে। ছেলেটি মিথ্যা কথা বলে টাকা নিয়েছে। চিঠির বক্তব্য অনুসারে ছেলেটির বাবা মারা গেছেন রাত তিনটায়—তার মাত্র তিন ঘণ্টা পরে সে টাকার সন্ধানে বের হয়েছে। এটা তো হতে পারে না। মৃত্যুর প্রাথমিক ধাক্কা সহ্য করতেও অনেক সময় লাগবে। টাকার কথা মনে হবে প্রাথমিক ধাক্কা কেটে যাবার পর।

আমার মন বেশ খারাপ হল। দুহাজার টাকা এমন কোন অর্থ না যার জন্যে মন এতটা খারাপ হবে। মন খারাপ হল ছেলেটির প্রতারণার কৌশলে। বাবার মৃত্যুর কথা বলে সে কাঁদছিল। ভান না, সত্যি সত্যি কাঁদছিল–চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছিল। আমরা নানাভাবে মানুষকে প্রতারিত করি–বাবা-মার মিথ্যা মৃত্যুর কথা বলে মানুষকে প্রতারিত করি না। তাছাড়া প্রতারকের চোখে কখনো অশ্রু টলমল করে না।

তাহলে কি ছেলেটি সত্যি কথাই বলেছে? ব্যাপারটা নিয়ে খোঁজ-খবর করতেও আমার লজ্জা লাগল। যদি ব্যাপারটা সত্যি হয় তাহলে ভদ্রমহিলা কি মনে করবেন? তিনি কি ভাববেন না সামান্য দুহাজার টাকা দিয়ে সে খোঁজ-খরব শুরু করেছে?

মনের ভেতর একটা কাটা খচখচ করতে লাগল। সেদিন সন্ধ্যায় শীলাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা, আজ কি তোমাদের ক্লাস টিচার… এসেছিলেন?

সে বলল, হুঁ।

ক্লাস নিয়েছেন?

হুঁ। ক্লাস নেবেন না কেন?

হাসি-খুশি ছিলেন?

শিক্ষকরা কখনো হাসিখুশি থাকে না। শিক্ষকরা গম্ভীর থাকে।

আমার মনটা গ্লানিতে ভর্তি হয়ে গেল। একটা নষ্ট ছেলে আমাকে বোকা বানিয়ে চলে গেছে! সে ব্যবহার করেছে একজন শিক্ষিকার নাম। সেই শিক্ষিকাকেও ব্যাপারটা জানানো দরকার।

কাজেই আমি তাকে জানালাম। তিনি অসম্ভব ব্যথিত হলেন এবং বললেন–যে ছেলে আপনার কাছে গিয়েছিল সে বাইরের কেউ না। সে আমারই ছেলে।

সে কি?

সে ড্রাগ ধরেছে। ড্রাগের টাকার জন্যে নানান কৌশল বের করে। আমার ছাত্রীদের কাছে যায়…

ভদ্রমহিলার চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে গেল। তিনি চোখ মুছে বললেন, আমি আপনার টাকা দিয়ে দিচ্ছি।

আমি বললাম, টাকা দিতে হবে না। আপনি ছেলেটির চিকিৎসা করান।

তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন–অনেক চিকিৎসা করিয়েছি। কিছুদিন ভাল থাকে তারপর আবার শুরু করে। আজ এই ড্রাগ আমার ছেলেকে ধরেছে–আস্তে আস্তে সবাইকে ধরবে। কি ভয়ংকর সময়ের দিকে যে দেশটা যাচ্ছে কেউ বুঝতে পারছে না! কেউ না! আপনি লেখক মানুষ, আপনিও বুঝছেন না। বুঝলে ড্রাগ বিষয়ে কিছু লিখতেন।

ভদ্রমহিলা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
 
জাপানী কৈমাছ



বৎসরের শুরুতে পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধনবান ব্যক্তিদের একটা তালিকা প্রস্তুত হয়। সংবাদ সংস্থাগুলি সেই তালিকার খবর দিকে দিকে পাঠিয়ে দেয়। খবরের কাগজগুলি আগ্রহ করে সেই খবর ছাপায়। আমরা মুগ্ধবিস্ময় নিয়ে সেই খবর পড়ি। অন্যদের পড়ে শোনাই। পৃথিবীর সেরা ধনীদের খবর জানতে আমাদের ভাল লাগে। আমাদের ঈর্ষাবোধ হয় না। বাড়ির কাছে মোটামুটি ধনীদের আমার ঈর্ষা করি, সেরা ধনীদের করি না। পৃথিবীর প্রথম দশজন বিত্তশালীর তালিকা প্রস্তুত হলেও সবচে দরিদ্র দশজনের তালিকা আমরা প্রস্তুত করি না। প্রথমত কাজটা অসম্ভব। একজন ধনীর উপরে। আরেকজন ধনী হতে পারে, কিন্তু নিঃস্বের নিচে নিঃস্ব নেই, এবং এদের সংখ্যা এক কোটির কাছাকাছি। এক কোটি মানুষের তালিকা তৈরির প্রয়োজন কি?

মজার ব্যাপার হচ্ছে, সত্যি সত্যি যদি নিঃস্বদের তালিকা তৈরি হত তাহলে দেখা যেত পৃথিবীর বেশিরভাগ ধর্মপ্রচারকদের নাম সেই তালিকায় আছে। এই খবরে জগতের নিঃস্বরা কোন মানসিক শান্তি লাভ করেন না। মহাপুরুষরা তাদের সঙ্গে থাকলেই কি আর না থাকলেই কি? তারা তো খেতে পারছে না। পূর্ণিমার চাঁদ তাদের কাছে ঝলসানো রুটি, যে রুটি আখের গুড় দিয়ে খেতে পারলে পেট শান্ত হত।

হঠাৎ করে ধনী-নিঃস্ব নিয়ে লিখতে বসলাম কেন সেই ব্যাপারটা বলে নেই। এ দেশের জনৈক ধনবান ব্যক্তির বাসায় যাবার দুর্লভ (!) সৌভাগ্য আমার সম্প্রতি হয়েছিল। বাড়িতে ঢুকে ঝিম মেরে গেলাম। যা দেখছি তাতেই চোখ স্থির হয়ে যাচ্ছে। ভদ্রলোক মিউজিয়ামের কিউরেটরের ভঙ্গিতে তার বাড়ির প্রতিটি দুর্লভ সামগ্রীর বাংলাদেশী টাকায় মূল্য এবং ডলারের মূল্য বলে যাচ্ছেন। জিনিসটি কোন জায়গা থেকে কেনা হল সেই ইতিহাস বলছেন। তিনি বলে আরাম পাচ্ছেন, আমিও শুনে স্তম্ভিত হচ্ছি। তিনি এক পর্যায়ে বললেন, আসুন আসুন, আমার মাছের একোরিয়াম দেখুন। মজা পাবেন।

মজা পাবার উদ্দেশ্যে মাছের একোরিয়ামের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। একোরিয়াম বলা ঠিক হবে না। চৌবাচ্চা জাতীয় জিনিস। চারপাশে চেয়ার বসানো। চেয়ারে বসে মাছের খেলা দেখতে হয়। ভেবেছিলাম, পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য জাতীয় মাছ দেখব, মৎস্যকন্যা টাইপ কিছু। তেমন দেখলাম না। দেখলাম বিশাল কৈ মাছ। শ্বেতী রোগ হলে গা যেমন শাদা হয়ে যায় তেমন শাদা, মাঝে মাঝে সোনালী ছোপ। এরচে সুন্দর মাছ মধ্যবিত্তদের একোরিয়ামে সবসময়ই দেখা যায়।

ভদ্রলোক আগ্রহের সাঙ্গে বললনে, কেমন দেখলেন?

আমি শুকনো গলায় বললাম, ভাল। ইন্টারেস্টিং কৈ মাছ।

শুধু ইন্টারেস্টিং কৈ মাছ বলে শেষ করবেন না। এগুলি জাপানী কৈ, চারশ বছর বাঁচে।

আমি এই খবরেও তেমন অভিভূত হলাম না। চারশ বছর বেঁচে থেকে এরা আমাদের তেমন কোন উপকার করছে না। কচ্ছপও চারশ বছর বাঁচে। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার জন্যে এদের একোরিয়ামে রাখতে হলে কচ্ছপও রাখতে হয়।

মাছগুলির দাম কত আন্দাজ করুন তো?

আন্দাজ করতে পারছি না। বুঝতে পারছি আকাশ-পাতাল কিছু হবে।

তবু আন্দাজ করুন।

আমি আমার কল্পনাকে যতদূর সম্ভব প্রশ্রয় দিয়ে বললাম, প্রতিটি মাছ কুড়ি হাজার টাকা।

আমার অজ্ঞতায় ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে বললেন, গিনেস বুক অব ওয়ার্লড রেকর্ডে এই মাছ সম্পর্কে একটা তথ্য আছে। তথ্যটা হচ্ছে–পৃথিবীর সবচে বেশি দামে বিক্রি হওয়া মাছ হল জাপানী কৈ মাছ। এরকম একটা মাছ বিক্রি হয়েছিল দু মিলিয়ন ইউএস ডলারে। অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় কুড়ি লক্ষ টাকা।

আমি পুরোপুরি হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, কে কিনেছে? আপনি?

না, আমি কিনিনি। আমার কাছে সবচে দামী যেটা আছে সেটা ৪০ হাজার ইউএস ডলার।

কোন মাছটা বলুন তো, আমি একটু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি।

হাত দিয়ে ছোঁয়া যাবে না। মানুষের স্পর্শ এরা পছন্দ করে না।

এমন দামী মাছ মানুষের মত মূল্যহীন প্রাণীর স্পর্শ পছন্দ করার কোন কারণ নেই। আমি ভদ্রলোককে এই অমূল্য প্রাণী দেখতে পাবার সৌভাগ্যের জন্যে ধন্যবাদ দিলাম। তিনি বললেন, আসল জিনিস তো এখনো দেখেননি।

আসল জিনিস কি?

আমার কুকুর। রাত বারোটার পর ছাড়া হয়। আসুন দেখবেন।

আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, ইউএস ডলারে আপনার কুকুরের দাম কত?

ঠাট্টা করছেন নাকি ভাই?

জ্বি না, ঠাট্টা করছি না। সত্যি জানতে চাচ্ছি।

দামটা তো কোন ব্যাপার না। জিনিসটা কেমন সেটা হল কথা। আসুন আমার সঙ্গে।

একদিনে বেশি হয়ে যাচ্ছে, আরেক দিন এসে দেখে যাব।

কুকুর না দেখেই আমি চলে এলাম।

এইসব বিপুল বিত্তের অধিকারীদের সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই। এরা তাদের বিপুল বিত্তের অংশবিশেষ খরচ করবে, আমরা দেখে মুগ্ধ হব এই তো স্বাভাবিক। তবুও কোথায় যেন একটা ছোট্ট কাঁটা বিঁধে থাকে–। কি যেন খচ খচ করে। একজনের একলক্ষ টাকা দামের পোষা মাছ থাকবে, আরেকজনের ঘরে অবোধ শিশু খেলনার জন্যে, ভাতের জন্যে কাঁদবে?

শুনেছি এই পৃথিবীতে যত খাদ্যশস্য হয় তা দিয়ে পৃথিবীর সব মানুষ শুধু যে আরাম করে খাওয়া-দাওয়া করতে পারে তাই না, অনেক উদ্বৃত্তও থাকে। তবুও কেন এই গ্রহের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ রাতের বেলা অভুক্ত অবস্থায় ঘুমুতে যায়? আমি নিজে ক্ষুধার কষ্টের স্বরূপ জানি না, কিন্তু তীব্র অভাবে দিশেহারা মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে।

কুড়ি বছর আগের কথা। আমি তখন বাবর রোডে থাকি। আমাদের বাসার সামনে ছোট্ট দুকামরার একটা টিনের ঘর। স্বামী-স্ত্রী এবং ছোট ছোট দুটি বাচ্চার সংসার। একদিন শুনলাম, ভদ্রলোকের চাকরি চলে গেছে। কিছুদিন পর দেখা গেল, তারা তাদের সিলিং ফ্যান বিক্রি করে দিচ্ছে। তারপর খাট-পালং। একদিন মেয়েটি রুমালে বেঁধে তার বিয়ের চুড়ি আমাদের কাছে রেখে কিছু টাকা ধার করতে এল। সে কাঁদো কাঁদো গলায় আমার মাকে বলল, হারটা আমার মার স্মৃতিচিহ্ন। এই জন্যে বিক্রি করতে পারছি না। আপনি হারটা রেখে আমাকে পঁচিশ টাকা দিন। যখন আমাদের টাকা হবে তখন টাকা দিয়ে হার ফেরত নেব। আমার মা অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। মেয়েটিকে সান্ত্বনা দিয়ে। বললেন, হার রাখতে হবে না। তুমি টাকা নিয়ে যাও আর মনে সাহস রাখো। খুব যখন অসুবিধেয় পড়বে আমার কাছে আসবে।

আমাদের নিজেদের অবস্থাও তখন শোচনীয়। দিনে আনি দিনে খাই অবস্থা। মেয়েটি প্রায়ই আসে। শেষের দিকে আর টাকা চাইতে আসতো না। ছোট্ট একটা বাটি নিয়ে রাত করে আসতো। মাটির দিকে তাকিয়ে বলতো, খালাম্মা, বাটিটাতে একটু ভাত আর ডাল দিন আমার মেয়ে দুটির জন্যে।

এক সকালবেলা বাড়িওয়ালা তাদের বের করে দিল। আমি সকালবেলা বারান্দায় দাঁত মাজতে এসে দেখি, স্বামী-স্ত্রী তাদের পুরোনো বাসার গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জিনিসপত্র চারদিকে ছড়ানো। বাচ্চা দুটি খুব কাঁদছে।

পৃথিবী নামক এই গ্রহের সবচে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ। কি প্রচণ্ড তার ক্ষমতা! একদিন সে জয় করবে অনন্ত নক্ষত্রবীথি, কিন্তু আজ তার একি পরাজয়!
 
তিনি



রাত নটার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায় চকচক করছে। ব্যাপারটা ঠিক। বুঝলাম না। বিখ্যাত মানুষরা যে আমাকে একেবারেই টেলিফোন করেন না তাতো না। মেয়ে এত উত্তেজিত কেন?

বাবা তুমি কিন্তু আবার বলতে বলবে না যে তুমি বাসায় নেই। তোমার বিশ্রী। অভ্যাস আছে বাসায় থেকেও বল বাসায় নেই।

আমি বললাম, টেলিফোন কে করেছে মা?

আমার মেয়ে ফিসফিস করে বলল, জাহানারা ইমাম।

এই নাম ফিসফিস করে বলছ কেন? ফিসফিস করার কি হল?

বাবা উনি যখন বললেন, তার নাম জাহানারা ইমাম তখন আমি এতই নার্ভাস হয়ে গেছি যে, তাকে স্নামালিকুম বলতে ভুলে গেছি।

বিরাট ভুল হয়েছে। যাই হোক দেখা যাক কি করা যায়।

আমি টেলিফোন ধরলাম এবং বললাম, আমার মেয়ে আপনাকে সালাম দিতে ভুলে গেছে এই জন্যে সে খুব লজ্জিত। আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। সে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।

ওপাশ থেকে তার হাসির শব্দ শুনলাম। হাসতে হাসতেই বললেন, আমি কিন্তু আপনাকে টেলিফোন করেছি কিছু কঠিন কথা বলার জন্যে।

বলুন।

আপনি রাগ করুন বা না করুন কথাগুলো আমাকে বলতেই হবে।

আমি শংকিত হয়ে আপনার কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছি।

আপনি স্বাধীনতাবিরোধীদের পত্রিকায় লেখেন কেন? আপনার মত আরো অনেকেই এই কাজটি করে। কিন্তু আপনি কেন করবেন?

তিনি কথা বলছেন নিচু গলায়, কিন্তু বলার ভঙ্গিতে কোন অস্পষ্টতা নেই। কোন আড়ষ্টতা নেই।

আমি হকচকিয়ে গেলাম। আক্রমণ এইদিক থেকে আসবে ভাবিনি। তবে পত্রিকায়। লেখা দেয়ার ব্যাপারে আমার কিছু যুক্তি আছে। খুব যে দুর্বল যুক্তি তাও না। যুক্তিগুলো তাকে শোনালাম। মনে হল এতে তিনি আরো রেগে গেলেন। কঠিন গলায় বললেন, আপনার মিসির আলী বিষয়ক রচনা আমি কিছু কিছু পড়েছি, আপনি যুক্তি ভাল। দেবেন তা জানি। কিন্তু আমি আপনার কাছ থেকে যুক্তি শুনতে চাচ্ছি না। আপনাকে কথা দিতে হবে ওদের পত্রিকায় লিখে ওদের হাত শক্তিশালী করবেন না। আপনি একজন শহীদ পিতার পুত্র। তুই রাজাকার শ্লোগান আপনার কলম থেকে বের হয়েছে। বলুন আর লিখবেন না।

আমি সহজে প্রভাবিত হই না। সে রাতে হলাম। বলতে বাধ্য হলাম, আপনাকে কথা দিচ্ছি আর লিখব না। এখন বলুন আপনার রাগ কি কমেছে? তিনি হেসে ফেললেন। বাচ্চা মেয়েদের একধরনের হাসি আছে–কুটকুট হাসি, বড়দের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে যে হাসিটা তারা হাসে সেই হাসি।

আমি বললাম, আমি সবসময় লক্ষ্য করেছি আপনি আমাকে আপনি আপনি করে বলেন। নিজেকে খুব দূরের মানুষ মনে হয়। দয়া করে আমাকে তুমি করে বলবেন। তিনি বললেন, আচ্ছা বলব। এখন থেকে বলব।

তিনি কিন্তু আমাকে তুমি কখনই বলেননি। যতবারই মনে করিয়ে দিয়েছি। ততবারই বলেছেন, হ্যাঁ এখন থেকে বলব। কিন্তু বলার সময় বলেছেন আপনি। হয়তো আমাকে তিনি কখনোই কাছের মানুষ মনে করেননি।

তার অনেক কাছের মানুষ ছিল আমার মা। আমার ছোট ভাই জাফর ইকবাল। জাফর ইকবালের উল্লেখ তার লেখাতে পাই। ব্যক্তিগত আলাপেও জাফর ইকবালের প্রসঙ্গে তাকে উচ্ছ্বসিত হতে দেখি। শুধু আমার ব্যাপারেই এক ধরনের শীতলতা। হয়তো তার ধারণা হয়েছিল, যে মহান আন্দোলনের নেতৃত্ব তিনি দিচ্ছেন আমি সেই আন্দোলন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছি। যে ১০১ জনকে নিয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আদি যাত্রা, আমি সেই ১০১ জনের একজন। অথচ পরে আমার আর কোন খোঁজ নেই। কাজেই আমার ভূমিকায় অস্পষ্টতাতো আছেই। তিনি আমার প্রতি শীতল ভাব পোষণ করতেই পারেন। সেটাই স্বাভাবিক।

আরেক দিনের কথা, তিনি টেলিফোন করেছেন। গলার স্বর অস্পষ্ট। কথা কেমন জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, আপনার শরীর কি খারাপ করেছে?

তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন, শরীর আছে শরীরের মতই। আপনাকে একটা ব্যাপারে টেলিফোন করেছি।

বলুন কি ব্যাপার।

এই যে একটা আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি এতে অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আমাকে চলতে হচ্ছে মানুষের চাদায়। আপনি প্রতিমাসে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা দেবেন।

অবশ্যই দেব।

আমি একজনকে পাঠাচ্ছি। এ মাসের চাঁদা দিয়ে দিন।

জি আচ্ছা, কত করে দেব?

আপনি আপনার সামর্থ্য মত দেবেন। মাসে দুহাজার করে দিতে পারবেন?

পারব।

একজন এসে চাঁদা নিয়ে গেল। পরের দুমাস কেউ চাঁদা নিতে এলো না। আমার একটু মন খারাপ হল। মনে হল হয়ত সিদ্ধান্ত হয়েছে আমার কাছ থেকে চাঁদা নেয়া। হবে না। তৃতীয় মাসে তিনি টেলিফোন করে বললেন, কি ব্যাপার, আপনি আপনার চাদার টাকা দিচ্ছেন না কেন?

আমি বিনীতভাবে বললাম, কেউ তো নিতে আসেনি।

আমার এত লোকজন কোথায় যে পাঠাব! আপনি নিজে এসে দিয়ে যেতে পারেন।? আপনিতো এলিফেন্ট রোডেই থাকেন। দুমিনিটের পথ।

আমি আসছি। ভাল কথা আপনার সঙ্গে রাগারাগি করার মত একটা ঘটনা। ঘটেছে। আমি এসেই কিন্তু রাগারাগি করব।

তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।

এসে নেই তারপর বুঝবেন।

না এখনই বলুন।

আমার বড় মেয়ে নোভার ছিল মাথা ভর্তি চুল। আপনি হচ্ছেন তার আদর্শ। আপনার মাথার ছোট ছোট চুল তার খুব পছন্দ। সে আপনার মত হবার প্রথম ধাপ। হিসেবে তার মাথার সব চুল কেটে ফেলেছে।

সত্যি?

বাসায় আসুন। বাসায় এসে দেখে যান।

একেবারে কিশোরী গলায় তিনি অনেকক্ষণ হাসলেন। তারপর বললেন, আপনার মেয়েকে বলবেন লম্বা চুল আমার খুব প্রিয়। আমি যখন ওর বয়েসী ছিলাম তখন আমার হাঁটু পর্যন্ত লম্বা চুল ছিল। ছবি আছে। আমি আপনার মেয়েকে ছবি দেখাব। চুল কেটে ছোট করতে হয়েছে ক্যান্সারের জন্যে। কেমোথেরাপির কারণে চুল পড়ে যাচ্ছিল। কি আর করব?

তিনি একবার আমার বাসায় আসার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমার মেয়েদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করবেন। তাঁর গল্প করতে ইচ্ছা করছে। গাড়ি পাঠিয়ে তাকে আনালাম। বাসায় আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। গ্রহ যেমন সূর্যকে ঘিরে রাখে আমার মেয়েরাও তাকে সেই ভাবে ঘিরে গোল হয়ে বসে পড়ল। তিনি তাদের বললেন তার। শৈশবের কথা। আমি আসরে যোগ দিতে চেয়েছিলাম। তিনি বললেন, আপনি আসবেন না। এই আসরে আপনার প্রবেশাধিকার নেই।

অন্যান্য ফ্ল্যাটে খবর চলে গেছে। ছেলেমেয়েরা আসছে। তারাও গল্প শুনতে চায়।

আমার স্ত্রী ব্যস্ত হয়ে পড়ল, অতি সম্মানিত এই মানুষটিকে সে কি খাওয়াবে? তিনি তো কিছুই খেতে পারেন না।

তিনি আমার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন, শুধু মুখে যাবেন না। কিছু খাবেন। পাকা পেঁপে থাকলে ভাল হয়।

ঘরে পাকা পেঁপে নেই। আমি ছুটলাম পাকা পেঁপের সন্ধানে। লিফট থেকে নামতেই এক ভদ্রলোক চোখ বড় বড় করে বললেন, জানেন, আমাদের এই ফ্ল্যাটের কোন এক বাড়িতে জাহানারা ইমাম এসেছেন।

আনন্দে আমার মন দ্রবীভূত হল। এই মহীয়সী নারী কত অল্প সময়ে মানুষের হৃদয় দখল করে নিয়েছেন।

তাঁর মৃত্যু সংবাদ আমাকে দেন আসাদুজ্জামান নূর।

বাসায় তখন ক্যাসেট প্লেয়ার বাজছে। আমার মেয়েরা জন ডেনভারের গান শুনছে রকি মাউন্টেন হাই, কলারাডো। সঙ্গে সঙ্গে গান বন্ধ হয়ে গেল। মেয়েরা তাদের নিজেদের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আমার মা আমার কাছে জানতে চাইলেন, আন্দোলন এখন কে এগিয়ে নিয়ে যাবে? আমি তাকে বললাম, দ্বিতীয় জাহানারা ইমাম আমাদের নেই। জাহানারা ইমাম দুটা তিনটা করে জন্মায় না। একটাই জন্মায়। তবে কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেই। অপেক্ষা করুন।

মা জায়নামাজে বসলেন।

আর আমি একা একা বসে রইলাম বারান্দায়। এক ধরনের শূন্যতা বোধ আমার ভেতর জমা হতে থাকল। কেবলি মনে হতে লাগল একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। কি পরিমাণ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা এই মানুষটির প্রতি আমার ছিল তা তাকে জানানো হয়নি। আমার একটাই সান্ত্বনা মৃত্যুর ওপাশের জগৎ থেকে আজ তিনি নিশ্চয়ই আমার বিপুল শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অনুভব করতে পারছেন। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি সবসময়ই তার পাশে ছিলাম। যে কদিন বেঁচে থাকব তাই থাকব। বঙ্গজননীর পাশে তার। সন্তানরা থাকবে না তা কি কখনো হয়?

বাংলার পবিত্র মাটিতে তাঁর পায়ের চিহ্ন আর পড়বে না। স্বাধীনতাবিরোধীদের এই সংবাদে উল্লসিত হবার কিছু নেই। বাংলার হৃদয়ে তিনি জেলে দিয়েছেন অনির্বাণ শিখা। ঝড় ঝাপ্টা যত প্রচণ্ডই হোক না কেন সেই শিখা জ্বলতে থাকবে। কি সৌভাগ্য। আমাদের তিনি জন্মেছিলেন এই দেশে।
 
ধন্য! জন্মেছি এই দেশে



আমার বড় মেয়ে পড়ে হলিক্রস কলেজে। একেকটা কলেজের মেয়েরা একেক ধরনের হয়। হলিক্রস কলেজের মেয়েদের ভেতর ইংরেজি ভাবটা খুব প্রবল। কাজেই আমার বড় মেয়ে যখন আমাকে এসে বলল, তার ইচ্ছা বাসায় একটা স্লাম্বার পার্টি দেয়, তখন আমি তেমন বিস্মিত হলাম না। শুধু ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম, স্লাম্বার পার্টি ব্যাপারটা কি? জানা গেল, স্লাম্বার পার্টি হচ্ছে কিছু বান্ধবী একত্র হয়ে হৈ-চৈ করবে এবং রাতে এক বিছানায় ঘুমুবে। আমি অতিরিক্ত রকমের উৎসাহ দেখিয়ে বললাম, স্লাম্বার পাটি খুব প্রয়েজনীয় একটা ব্যাপার। নিশ্চয়ই এতে শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। তুমি এই পার্টি করতে চাচ্ছ শুনে ভাল লাগল। তা এই পার্টিটা কবে হচ্ছে?

আমার কন্যা বেণী দুলিয়ে বলল, পার্টি হবে নিউ ইয়ার্স ইভে। সারারাত আমরা ঘুমুব না।

নিউ ইয়ার্স ইভ বললে আমরা ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ বুঝে থাকি। এখন এপ্রিল মাস, এক বছর আগে দিনক্ষণ ঠিক হচ্ছে কেন বুঝতে পারলাম না। জানা গেল, এই নিউ ইয়ার্স ডে হল বাংলা নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ। আমার কন্যা তার বান্ধবীদের নিয়ে। বাংলা নববর্ষ বরণ করবে। পায়ে আলতা পরবে, চুলে গুজবে সাদা রং-এর ফুল। কন্যার এক বান্ধবী সম্প্রতি চুল কেটে পাংকু হয়েছে। বাংলা নববর্ষের উৎসবে তো আর। পাংকু সেজে যাওয়া যায় না, কাজেই সে সিঙ্গাপুর থেকে নকল চুল আনিয়েছে। সেই চুল হাঁটু পর্যন্ত নেমে যায়। খাঁটি বঙ্গললনা হবার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। আমার পবিত্র দায়িত্ব হল, এদের সবাইকে সূর্য ওঠার আগে রমনা বটমূলে নিয়ে যেতে হবে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা হল। সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে ওঠা আমার কাছে এক ধরনের ক্রাইম বলে মনে হয়। ঠিক সময়ে ওঠা সূর্যের জন্য খুব জরুরী, আমার জন্যে নয়। তার চেয়েও বড় কথা, পহেলা বৈশাখের যে নাগরিক উৎসব ঢাকায় চালু হয়েছে তা আমাকে আগের মত আর আকর্ষণ করে না।

উৎসব শব্দটা মাথায় এলেই যে ছবি আমার চোখে ভাসে সে ছবি হৈচৈ-এর ছবি। ভেঁপু বাজানোর ছবি, নাগরদোলার ছবি। ঢাকা শহরের নাগরিক রমনা বটমূলকেন্দ্রিক পহেলা বৈশাখের উৎসব মোটেই সেরকম না। বলা যেতে পারে সিরিয়াস টাইপের উৎসব, যার নিয়মকানুন বেশ কড়া। রিচুয়েলের দিক থেকে বিচার করলে এই উৎসব খানিকটা ধর্ম উৎসবের মত। সূর্য ওঠার আগেই উপস্থিত হতে হয়। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা গান ধরেন–এসো হৈ বৈশাখ। উদ্বোধনী এই গানের পর একের পর এক রবীন্দ্র সংগীত চলতে থাকে। অন্য কোন গান নয়। শ্রোতাদের গম্ভীর ভাব করে গান শুনতে হয়। কারো ভেতর সামান্যতম তারল্য ভাব দেখা গেলে আশেপাশের সবাই কঠিন চোখে তাকায়। যে দৃষ্টির অর্থ–এই অসংস্কৃত গাধা কোত্থেকে এসেছে? প্রচণ্ড ভিড়ে ঠেলাঠেলি করতে করতে রবীন্দ্র সংগীত শুনতে ভাল লাগে না।

গানপর্ব শেষ হবার পরের অংশটা অবশ্যি বেশ মজার। নগরবাসী আধুনিক বঙ্গসন্তানরা তখন খাঁটি দেশীয় খাবারের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। উৎসব উপলক্ষে গজিয়ে ওঠা খাবারের দোকানের সামনে ভিড় করেন। শানকিতে পান্তাভাত, পোড়া মরিচ দেয়া হয়। নাকের জলে চোখের জলে এক হয়ে সেই প্রচণ্ড ঝাল পান্তাভাত খেতে খেতে এক একজন ঘোর লাগা গলায় বলেন, আহা রে, কি অপূর্ব খাবার। ধন্য জন্মেছি এই দেশে!

আমার লেখা থেকে মনে হতে পারে, আমি বোধহয় বটমূলের নববর্ষ আবাহনী উৎসবকে তুচ্ছ করার চেষ্টা করছি। একটা সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে সস্তা রসিকতা করার চেষ্টা করছি। তা কিন্তু নয়। এই উৎসব এখন আমাদের প্রধান জাতীয় উৎসবের একটি। একে তুচ্ছ করার কোন উপায় নেই। কেন, তা একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি।

এই বাংলায় পহেলা বৈশাখ কখনোই আনন্দময় উৎসবের কোন দিন ছিল না। জমিদাররা এই দিনে পুণ্যাহ করতেন। সেই পুণ্যাহ জমিদারের খাজনা আদায়ের উৎসব। প্রজাদের জন্য সুখকর কিছু না। ব্যবসায়ীরা করতেন হালখাতা। সেখানেও সাধারণদের ভূমিকা হল বকেয়া টাকাপয়সা দেয়া। নতুন বৎসর তাদের কাছে আনন্দ নিয়ে আসে না। আসে আশংকা নিয়ে–না জানি কেমন যাবে সামনের দিন! তাছাড়া কিছুদিন আগেই হয়ে গেছে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। আর কেন? বৈশাখ মাস উৎসবের জন্য আদর্শ নয়। আছে কালবোশেখী, শিলাবৃষ্টি। এই মাসে কৃষকদের কাজের চাপও প্রচণ্ড। নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই, উৎসব তো অনেক পরের ব্যাপার।

এদেশে বাংলা নববর্ষ পালনের ধারণাটা পশ্চিম থেকে পাওয়া। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকরা নওরোজ করতেন। তবে তার প্রভাবে এদেশে বাংলা নববর্ষ পালন শুরু হয়নি। রাজা-বাদশাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এদেশের মানুষ কিছু করে না। বর্ষপালন প্রক্রিয়া। শুরু করলেন আধুনিক কিছু মানুষ, তাও বিচ্ছিন্নভাবে ঘরোয়া ভঙ্গিতে। পঞ্চাশ দশকের দিকে কবি বেগম সুফিয়া কামালের তারাবাগের বাসভবনে পহেলা বৈশাখ পালিত হত। কবি জাহানারা আরজুর বাসভবন কবিতাঙ্গনে বাংলা নববর্ষ বেশ ঘটা করে করা হত।

ভাষা আন্দোলনের পর পর আমাদের চিন্তা-ভাবনায় কিছু পরিবর্তন দেখা দিল। প্রয়োজন হয়ে পড়ল স্বকীয়তা অনুসন্ধানের। আমরা বাঙালীরা আলাদা, এটা যেমন নিজেদের জানার দরকার হয়ে পড়ল, অন্যদেরও জানানোর প্রয়েজনীয়তা দেখা দিল। রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার পায়তারাও তখন চলছে, এটা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না। প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবেও প্রয়োজন হল রবীন্দ্র সংগীতের। ১৯৬৭ সনে প্রথম এগিয়ে এল ছায়ানট, রমনা বটমূলে রবীন্দ্র সংগীত দিয়ে আবাহন করা হবে বাংলার নতুন। বছরকে। এই আবাহন বিদ্রোহ ছাড়া আর কিছুই নয়। যোগ দিলে হাজারো মানুষ। যে নাগরিক উৎসবের পেছনের ইতিহাস এত গৌরবের তাকে ছোট করে দেখা নিজেকেই ছোট করে দেখা।

যতই দিন যাচ্ছে এই উৎসবের ব্যাপকতা ততই বাড়ছে। স্বাধীনতার পর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা দিলেন। উৎসবপালনে এগিয়ে এল অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত উৎসব। বাংলা একাডেমীতে লোক উৎসব, শিশু একাডেমীর মেলা, বিসিকের মেলা, পুরানো ঢাকার ধূপখোলা মাঠে তিনদিন ধরে বৈশাখী মেলা। দুতিন বছর হল এই দিনে আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েরা বর্ণাঢ্য র‍্যালী বের করা শুরু করেছেন। সে এক দেখার মত দৃশ্য। বিচিত্র। সব মুখোশ, রংচংয়ে পোশাক, বাদ্য-বাজনা–সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার। মিছিল যখন বের হয় তখন ইচ্ছা করে মজাদার একটা মুখোশ পরে আমিও ওদের মত নাচানাচি করি। নানান কারণে তা করা হয় না। মুখ শুকনো করে বলতে হয়, আচ্ছা, এরা শুরু করেছে কি?

গত বছর নববর্ষের আগের দিনটিতে আমি ছিলাম কোলকাতায়। বাংলাদেশ মিশনের আয়েজিত-গ্রন্থমেলার অতিথি। ভাবলাম, এসেছি যখন কোলকাতার পহেলা বৈশাখের উৎসবটা দেখেই যাই, তাছাড়া, তখন ১৪০০ সাল পূর্তি উপলক্ষে অনেক কিছু হচ্ছে। বাংলাদেশ মিশনের সঙ্গে কথা বলে আরো দুদিন থাকার ব্যবস্থা হল। তারপরেই মনে হল, আরে কি করছি? বাংলা নতুন বছরে আমি রমনা বটমূলের আশেপাশে থাকব না, তা কি করে হয়? সূর্য ওঠার আগে অবশ্যই উঠতে হবে। গান শুনতে হবে, মাটির শানকিতে করে পান্তাভাত খেতে হবে পোড়া মরিচ মাখিয়ে। একদিনের বাঙালী বলে অনেকেই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে, করুক। আমি আগুন ঝাল পান্তা খেতে খেতে, বৈশাখের কড়া রোদে পুড়তে পুড়তে বলব, ধন্য! জন্মেছি এই দেশে।
 
পোট্রেট



অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের বাসায় আমি মাঝে মাঝে যাই। তাঁর স্ত্রী খুব ভাল বেগুনভাজা রান্না করেন। বেগুনভাজার লোভে যাই বললে ভুল বলা হবে। খাদ্য হিসেবে বেগুন আমার তেমন প্রিয় নয়। তবে এই দম্পতির সঙ্গ প্রিয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনই নিতান্ত ভালমানুষ। আমার যে-কোন রসিকতায় এঁরা হো হো করে হাসেন। তাদের বাড়িটা ছোটখাটো একটা মিউজিয়ামের মত। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা ধরনের শিল্পকর্ম। দেয়ালে ঝুলছে অপূর্ব সব পেইনটিং। কিছু কিছু অতি বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা। ছবিগুলোও আমার বাড়তি আকর্ষণ। পেইন্টিং পুরোনো হয় না। একই ছবি বারবার দেখা যায়। আমি মাঝে মাঝে ছবি দেখার লোভেও যাই।

সেদিন তাদের বাসায় গিয়ে দেখি, দেয়ালে দাড়িওয়ালা এক বুড়োর পোট্রেট। সেই বুড়োর একটা চোখ বন্ধ, একটা চোখ খোলা। মনে হয়, বুড়ো চোখ টিপ মারছে। পোট্রেটের মানুষটিকে পরিচিত লাগছে। এর ছবি যেন আগেও কোথায় দেখেছি।

আমি নূরকে বললাম, ভাই এটা কার ছবি?

নূর এক বিখ্যাত শিল্পীর নাম করে বললেন, উনার আঁকা পোট্রেট। উনি পোট্রেট করেন না। এই প্রথম করলেন। ভাগ্যক্রমে পেয়ে গেছি। সুন্দর না?

বিখ্যাত কারো আঁকা ছবি দেখলে বলতে হয়, খুব সুন্দর। না বললে বেকুব প্রমাণিত হবার ভয় থাকে। কাজেই আমি নূরের উত্তর এড়িয়ে জানতে চাইলাম, পোট্রেটটা কার?

নূর অবাক হয়ে বললেন, কি আশ্চর্য! রবীন্দ্রনাথের ছবি। চিনতে পারছেন না কেন?

আমি হতভম্ব হয়ে রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে আছি। এই প্রথম রবীন্দ্রনাথের এমন এক ছবি দেখছি যেখানে তিনি চোখ টিপ মারছেন। আমি বললাম, নূর, আমি কি ভুল দেখছি? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, পোট্রেটের রবীন্দ্রনাথ চোখ টিপ মারছেন। ব্যাপারটা কি তাই, না আমার মনের ভুল?

আপনি ঠিকই ধরেছেন।

বিখ্যাত একজন শিল্পী ছবিটি এঁকেছেন। নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তে এঁকেছেন। চোখ টেপার ভেতর দিয়ে হয়তো তিনি মহা কোন ব্যাপার ধরে ফেলেছেন, যা আমি আমার। স্বল্প বুদ্ধির কারণে ধরতে পারছি না। আমার সীমিত শিল্পবোধ আমাকে বলছে, এটি নিতান্তই অরুচিকর একটা ছবি। এই রসিকতা রবীন্দ্রনাথের প্রাপ্য নয়। মহারথী। শিল্পীর রসিকতা হলেও নয়।

স্বয়ং পিকাসো যদি রবীন্দ্রনাথের চোখ টিপ-মারা ছবি আঁকেন তারপরেও আমি বলব, অসুন্দর একটি ছবি। ছবিতে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়েছে। নূরের বাসা থেকে আমি মন খারাপ করে ফিরলাম। একবার ভাবলাম, আমার মন খারাপের ব্যাপারটা তাকে বলি। তাকে বলি যে, রবীন্দ্রনাথের সবচে সুন্দর জিনিস হল তার স্বপ্নময় চোখ। একজন বড় শিল্পীর চেষ্টা থাকবে সেই চোখের স্বপ্নকে ক্যানভাসে ধরা। তারপরই মনে হল, কি হবে বলে? নূর এই ছবি রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্যে ঘরে ঝুলিয়ে রাখেননি। ছবিটি রেখেছেন একজন বড় শিল্পীর শিল্পকর্মের নিদর্শন হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ চোখ টিপি দিক কিংবা জিহ্বা বের করে থাকুক কিছু যায় আসে না।

আমি ঠিক করলাম, আর কোনদিনই নূরের বাসায় যাবো না। তার বাসায় গেলেই ছবিটির দিকে চোখ যাবে, মনটা হবে খারাপ। কি দরকার?

এই পৃথিবীতে অল্প কিছু মানুষ আছেন যাঁরা অন্ধকার রজনীতে আলো জ্বেলে সবাইকে পথ দেখান। মানুষ যখন হতাশাগ্রস্ত হয়, তাঁরা বলেন, সম্মুখে শান্তি পারাবার, যখন সে পরাজয়ের মুখোমুখি হয় তখব তারা কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপি চুপি বলেন, Man can be destroyed but not defeated, এঁদের প্রতি সামান্যতম অশ্রদ্ধাও আমাকে পীড়া দেয়।

সমস্যা হল, আমরা কোন এক বিচিত্র কারণে সম্মানিত মানুষের সম্মানহানি করে এক ধরনের আনন্দ পাই। এক রবীন্দ্র গবেষক আমাকে ফিসফিস করে বলেছিলেন, আমার কাছে সিরিয়াস মেটেরিয়েল আছে। প্রকাশ হলে কবিগুরু ফ্লাট হয়ে মাটিতে পড়ে যাবেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন তাদের এক কর্মচারীর মেয়েকে। চিন্তা করে দেখুন, জমিদারের ছেলে বিয়ে করেছেন তাদের এক কর্মচারীর মেয়েকে। সেই মেয়ের না আছে রূপ, না আছে গুণ। তাহলে কেন এই বিয়ে? আমি প্রমাণ করে দিতে পারি যে, তিনি বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার উপায় ছিল না। কেলেংকেরিয়াস ব্যাপার।

গবেষকের আনন্দোজ্জল চোখ দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেবেছি, হায় রে! আমরা। এমন কেন? চন্দ্র দেখলেই আমরা কেন কলঙ্ক দেখার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ি? কি আছে কলঙ্কে?

মজার ব্যাপার হল, এই আমরাই আবার বাড়াবাড়ি ধরনের ভক্তি দেখাতেও ভালবাসি। সেই ভক্তিও অশ্রদ্ধার মতই। উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করি। ২২শে শ্রাবণ উপলক্ষে বাংলা একাডেমীতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে অপূর্ব সব গান শুনছি। গভীর আবেগে চোখ ভিজে উঠেছে। এমন সময় এব ভদ্রলোক আমার কাছে এগিয়ে এলেন। (তার নাম বললে আপনারা তাঁকে চিনে ফেলতে পারেন, কাজেই নাম বলছি না) তিনি আমাকে দেখে গম্ভীর গলায় বললেন, হুমায়ূন, আপনি কি জানেন রবীন্দ্রনাথ হলেন আমার ঈশ্বর। আমি তাঁর আরাধনা করি।

আমি ভদ্রলোকের কথায় চমৎকৃত হলাম। তিনি আবেগকম্পিত গলায় বললেন, আমার যাবতীয় প্রার্থনা তার কাছে। ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি গেলাম হকচকিয়ে। সহজ গলায় বললাম, ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ বেঁচে নেই। তিনি বেঁচে থাকলে খুব বিরক্ত হতেন।

তিনি অবাক হয়ে বললেন, আপনার এই কথার মানে কি?

আমি বললাম, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান একজন মানুষ। মানুষের বোকামিতে তিনি সবসময়ই বিরক্ত হতেন।

আপনি কি আমাকে বোকা বলার চেষ্টা করছেন?

আমি হাসতে হাসতে বললাম, ইয়েস স্যার।

তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, রবীন্দ্রনাথের রচনা আপনি পড়েননি। আর পড়লেও তার মর্ম বোঝার ক্ষমতা আপনার নেই। থাকলে আপনিও তার আরাধনা করতেন।

ভদ্রলোকের রাগ আর বাড়াবার সাহস আমার হল না। একটা কথা মুখে প্রায় এসে গিয়েছিল, প্রায় বলতে যাচ্ছিলাম–রবীন্দ্রনাথের রচনার সঙ্গে যাদের পরিচয় সবচেয়ে কম, শুধু তারাই তাঁকে ঈশ্বরের পর্যায়ে নিয়ে যায়। এতে তাকে বড় করা হয় না, ছোট করা হয়।

আমি কিছু বললাম না। মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।

আমাদের পরম সৌভাগ্য, এত বড় মাপের একজন মানুষকে আমরা নিজেদের মধ্যে পেয়েছি। যিনি তাঁর প্রতিভার যাদুস্পর্শে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে একাই ১০০ বছর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। জীবনের গভীরতম বোধকে আমাদের উপলব্ধির কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন অবলীলায়। সেই তাকে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হিসেবে কাছে না টেনে ঈশ্বর হিসেবে দূরে সরিয়ে দেয়াটা হাস্যকর ব্যাপার নয় কি? হাস্যকর ব্যাপারগুলি

আমরা এত আগ্রহ নিয়ে কেন করি?

আমি একবার মজা করে লিখেছিলাম, মানুষ হচ্ছে এমন এক বুদ্ধিমান প্রাণী যে বেশিরভাগ কাজই করে বোকার মত। আজকাল প্রায়ই মনে হয়, এটাই বোধহয় সত্যি। বোকার মত কাজ করার জন্যেই হয়তো বুদ্ধিমান এক প্রাণী সৃষ্টির প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।



————-

** পত্রিকায় দেয়ার আগে নূরকে আমি রচনটা পড়ে শোনালাম। শুরুতে তার মুখ খুব হাসি হাসি

থাকলেও, শেষটায় গম্ভীর হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, নন্দনতত্ত্ব ব্যাখ্যায় হুমায়ূন আহমেদের বক্তব্য গ্রহণ করতে হবে, তা কে বলল?
 
প্রিয় পশু



আপনার রাশি কি?

আপনার প্রিয় রঙ কি?

আপনার প্রিয় ফুল কি?

এ জাতীয় প্রশ্নের জবাব আমাকে প্রায়ই দিতে হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেনি–আপনার প্রিয় পশু কি? সম্ভবত প্রশ্নকর্তাদের মনে। কখনো আসেনি যে পশুরাও প্রিয় হতে পারে। গালি দেয়ার জন্যে পশু ব্যবহার করা হয়—পশু প্রিয় হবে কিভাবে! মানুষ ভয়ংকর কোন কাণ্ড করলে আমরা বলি—ব্যাটা নরপশু।

তারপরও সবারই বোধহয় প্রিয় পশু আছে। টিপু সুলতানের ছিল বাঘ, নিউটনের ছিল বিড়াল, যে বিড়াল জ্বলন্ত ল্যাম্প ফেলে পুড়িয়ে ফেলেছিল প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা নামের বিখ্যাত গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি। আমাদের দেশের বিখ্যাত এক ব্যক্তির প্রিয় পশু বানর। মাসে অন্তত একবার তিনি চিড়িয়াখানায় যান এবং হা করে বানরের খাচার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন। কে জানে মনে মনে হয়তো ভাবেন–বানর থেকে মানুষে বিবর্তন হওয়ার প্রয়োজনটা কি ছিল! বানর হয়ে গাছে গাছে জীবনটা পার করে দিতে পারলে জীবনটা কত সুখময় হত!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক শিক্ষকের ছিল। ছাগলপ্রীতি। তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারেই ছাগল পুষতেন। একটা-দুটা না–গোটা সাতেক। রাতে ঘুমুতেন ছাগলের সঙ্গে। অবিশ্বাস্য এই ঘটনা শুনে আমি তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। তিনি বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন–এগুলি ছাগল না, পাঠা। আমার একটা অসুখ আছে। পাঠার গায়ের গন্ধে সেই অসুখ সারে বলে আমি রাতে তাদের সঙ্গে। ঘুমাই।

আমি হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আমি কি করি না করি তা আমার ব্যাপার। ব্যক্তি-স্বাধীনতা আমার সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধানের… ধারার উপধারায়…।

আমি বললাম, তা তো বটেই। আপনি অবশ্যই পাঁঠাদের সঙ্গে ঘুমুতে পারেন।

প্রিয় পাঠক, আমি এই গল্প রসিকতার জন্যে ফাঁদিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় খোঁজ নিলেই ঘটনার সত্যতা জানতে পারবেন।

পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে যাই–এমন কোন পশু কি আছে যা গোটা মানব সম্প্রদায়ের প্রিয়? বা বড় একটি মানবগোষ্ঠীর প্রিয়? আমার ধারণা আছে–সেই পশুর নাম হাতি, যাকে দেখামাত্র একসঙ্গে বিস্ময়, ভয় এবং করুণায় মন কেমন কেমন করে ওঠে। বিস্ময় এবং ভয়ের কারণ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। করুণ কেন হয়। বলি। করুণা হয়–বিশাল একটা প্রাণী মানুষের মত ক্ষুদ্র প্রাণীর হাতের পুতুল হয়ে ঘুরছে, এই কারণে। একটা পিপড়া ছাগলের গলায় দড়ি বেঁধে তাকে টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছে–এই দৃশ্যে যে করুণ রস আছে, হাতি এবং মানুষের ব্যাপারে তেমন করুণ রস আছে।

আমাদের বাংলাদেশের মানুষের কাছে হাতি খুবই পরিচিত প্রাণী। এইত সেদিন ঢাকা শহরে এক বিয়েতে দেখলাম হাতিতে চেপে বর যাচ্ছে। বেচারার উচিত এক হাতে। রুমাল নিয়ে রুমালে মুখ চেপে ধরে রাখা। সে তা করছে না। ভয়ে অস্থির হয়ে দুহাত দিয়ে জাপটে সামনের মানুষটির কোমর ধরে আছে।

ছোটবেলায় খুব কাছ থেকে হাতি দেখার সৌভাগ্য হল নানার বাড়িতে। আমার এক দূর-সম্পকের নানা চেয়ারম্যান ইলেকশনে দাঁড়িয়েছেন। তার মার্কা হল হাতি। তিনি নির্বাচনী প্রচারণার জন্যে এক হাতি নিয়ে এলেন। হাতির পিঠে চড়ে তিনি প্রচার-অভিযানে বের হন–গ্রামের অর্ধেক মানুষ সেই হাতির পেছনে পেছনে যায়। আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে ভোট দিবেন কিসে? হাতী মার্কা বাক্সে। শুধুমাত্র হাতির কল্যাণে আমার সেই দূর-সম্পর্কের নানা ইলেকশনে পাশ করে ফেলেন। সেই ইলেকশনের হাতিতে আমি অনেকবার চড়েছি। হাতির পিঠে চড়া সম্পর্কে যা যা জেনেছি তা হচ্ছে–

হাতির পিঠে চড়া এবং নৌকায় চড় এক রকম। দুটোতেই দুলুনি আছে। একই রকম দুলুনি।

নাক ভর্তি সর্দি না থাকলে হাতির পিঠে চড়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হাতির গায়ে একশ হর্স পাওয়ারের বিকট গন্ধ।

হাতির গায়ের লোম সাধারণ লোমের মতো না–সুইয়ের মত শক্ত। লোমের পেছনে ফুটো থাকলে অনায়াসে গ্রামের মেয়েরা হাতির লোম দিয়ে কথা সেলাই করতে পারত।

শৈশবে বেশ কিছুদিন হাতির কাছাকাছি থাকার কারণে আমার ধারণা হয়েছিল–হাতি সম্পর্কে আমি একজন নলেজেবল ব্যক্তি। এই বিরাট পশু সম্পর্কে যা জানার সবই জেনে ফেলেছি। আরো যে অনেক কিছু জানার বাকি তা টের পেলাম এই সেদিন। ঘটনাটা বলি–ঈদের আনন্দমেলা অনুষ্ঠান। আমার উপর দায়িত্ব একটা ছোট্ট তিন-চার মিনিটের হাসির অংশ তৈরি করা। আমি হাতি দিয়ে একটা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করলাম। হাতির পিঠে চড়ে অয়োময়ের ছোট মীর্জা এবং তার লাঠিয়াল হানিফ এসেছে গাউছিয়ায় ঈদের বাজার করতে।

দুটা হাতি আনানো হল। প্রথমটায় ছোট মীর্জার লোকজন। দ্বিতীয়টায় লাঠিয়ালসহ ছোট মীর্জা। প্রচণ্ড রোদের ভেতর শুটিং চলছে। হঠাৎ ছোট মীর্জা আসাদুজ্জামান নূর এবং লাঠিয়াল মোজাম্মেল হোসেনের বিকট চিৎকার—ভিজিয়ে ফেলেছে। ভিজিয়ে ফেলেছে।

ব্যাপার বিচিত্র। হাতি কিছুক্ষণ পর পর তার শুড় মুখে ঢুকিয়ে এক ধরনের জলীয় পদার্থ টেনে এনে তার সারা গায়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে। হাতির মাহুত বলল, গরমের সময় হাতি এইটা করে। পেটের ভেতর থেকে পানি এনে শরীর ভিজিয়ে দেয়।

শ্যুটিং এগুচ্ছে। মহাপরাক্রমশালী ছোট মীর্জা এবং তার ভয়ংকর লাঠিয়াল কিছুক্ষণ পর পর চেঁচাচ্ছে–সর্বনাশ! আবার ভিজিয়ে দিয়েছে। পেটের ভিতর থেকে হাতি কি টেনে এনে আমাদের ভিজাচ্ছে–আল্লাহ জানেন!

হাতিকে আমরা খুব বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে জানি। অথচ মূখের উপমা দেবার সময় বলি–হস্তীমুর্খ। ব্যাপারটা মজার না? হস্তীমুর্খ কেন বলা হয় আমি বের করেছি। আপনাদের ব্যাখ্যা করে বলি।

কিছুদিন আগে আমার একজন প্রকাশক সময় প্রকাশন-এর ফরিদ আহমেদ আমাকে বলল, হুমায়ূন ভাই! শ্রীমঙ্গলে দুটা ছোট ছোট হাতির বাচ্চা আছে। হাতির ব্যাপারে আপনার তো খুব আগ্রহ, দেখতে যাবেন?

আমি বললাম, অবশ্যই যাব।

স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে চললাম হস্তী-শাবকের সন্ধানে। পাহাড় থেকে কাঠ কেটে নামানোর জন্যে সেখানে প্রচুর হাতি ব্যবহার করা হয়। হাতি বেচা-কেনাও হয়। একটি পরিণত বয়সের হাতির দাম পাঁচ লাখ টাকা। অল্পবয়সী হাতি তিন লাখ টাকায় পাওয়া যায়। কাঠ-টানা হাতিগুলি অমানুষিক পরিশ্রম করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাঠ টানে। কোন বিশ্রাম নেই। এক দিনের পরিশ্রম বাবদ হাতির মালিক পান দুহাজার টাকা। দিনের পর দিন এই কাঠ টানা চলতে থাকে। প্রচণ্ড শক্তিধর এই প্রাণী ইচ্ছা। করলেই মাহুতকে গা ঝাড়া দিয়ে ফেলে বনে ফিরে যেতে পারে–তা সে করে না। মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করে–সে যদি মুর্খ না হয়–মুর্খ কে?

হাতির বাচ্চা দেখার জন্যে এক ভোরবেলা শ্রীমঙ্গল থেকে মাইক্রোবাসে করে রওনা হলাম। বাচ্চারা কমলা কিনে নিল হাতির বাচ্চাকে খাওয়াবে। সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরা নেয়া হল। হাতির বাচ্চার গলা জড়িয়ে ধরে ছবি তোলা হবে। আমার বাচ্চাদের উৎসাহের সীমা নেই।

হাতির বাচ্চা দেখে প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। ছোটখাট একটা হাতি। সামনের দুটা পা এবং পেছনের দুপা শিকল দিয়ে বেঁধে টানা দিয়ে রাখা হয়েছে। তার নড়াচড়ার শক্তি নেই। তার ঊড় নানান জায়গায় কাটা। রক্ত পড়ছে। চোখ ভেজা। সে নিঃশব্দে কঁদছে। জানা গেল, বাচ্চাকে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে সে বন থেকে কাঠ টেনে আনতে পারে এই ট্রেনিং। আমি বললাম, এর বয়স কত?

মাহুত বলল, তিন বছর।

একে আপনারা মারছেন?

না মারলে শিখবে কিভাবে?

এভাবে টানা দিয়ে কতক্ষণ রাখা হয়?

মাঝে মাঝে দুদিন-তিনদিনও রাখা হয়। খাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। হাতির ট্রেনিং বড়ই কঠিন।

তিন বছর বয়েসী হাতির বাচ্চা হুংকারের মত করল। মাহুত সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে তার গুঁড়ে লাঠি দিয়ে প্রচণ্ড বাড়ি বসাল। আমরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ছবি হল না, ভিডিও ক্যামেরায় ভিডিও করা হল না। মানুষ হয়ে জন্মেছি, এই লজ্জা ও এই অপমান সহ্য করে মাথা নিচু করে ফিরে চলে এলাম। মনে মনে বললাম, জগতের। সমস্ত পশু, তোমরা আমাদের মানুষ হয়ে জন্মানোর এই অপরাধ ক্ষমা করে দাও।
 
প্রিয় হক ভাই



হক ভাইকে প্রথম দেখি বাংলা একাডেমীতে। তখন তার মাথায় চুল ছিল, হাতে ছিল জ্বলন্ত সিগারেট। তিনি খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে কাকে যেন কী বলছেন। আমি পেছনের দিকে রয়েছি, কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি না। ইন্টারেস্টিং কিছু হবে–এই ভেবে কাছে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে শুনি, হক ভাই বইয়ের ভাষায় কঠিন কঠিন শব্দে জটিল সব বাক্য তৈরী করে রাগ ঝাড়ছেন। আমার মনে হলো, মানুষটা তো বেশ। রাগের সময়ও কথা ঠিক রাখছেন।

তাঁর সঙ্গে পরিচয়ও ভাসা ভাসা পরিচয়। সমস্যাটা আমার–আমি চট করে সহজ হতে পারি না। আরে হক ভাই, এতোদিন কোথায় ছিলেন? বলে গায়ের উপর পড়ে যাওয়া আমার স্বভাবে নেই। সমস্যা কিছুটা হক ভাইয়েরও কথাবার্তা বলার সময় তিনি দূরত্ব তৈরি করে এমন ভাষা ব্যবহার করেন।

যাই হোক, প্রথম পরিচয়েই আমি তাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আমি তার রচনার ভক্ত পাঠক। আমার এই কথায় তিনি তেমন উল্লসিত হননি। শুকনো গলায় বললেন, ও আচ্ছা।

এতে আমি খানিকটা আহত হলাম। আমার মনে হলো, তিনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি। কাজেই তার প্রচুর লেখা যে আমার পড়া সেই প্রমাণ দেবার চেষ্টা করলাম। এতেও তার তেমন উৎসাহ দেখলাম না। নিজের রচনা সম্পর্কে আলোচনা শুনতে সবাই উৎসাহী হয়, এ মানুষটা হচ্ছেন না কেন? না কি তিনি শুধু আমার প্রতিই এ ধরনের আচরণ করলেন? এই রহস্য এখনো ভেদ হয়নি।

আমি আমার অনেক লেখায় অনেক ইন্টারভ্যুতে বলেছি–সৈয়দ হক আমার প্রিয় লেখক। এ দেশের প্রধান ঔপন্যাসিক আমার মতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নন–সৈয়দ শামসুল হক। নানান কারণে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সমালোচকদের সুনজর পেয়েছেন–হক ভাইয়ের ভাগ্যে তা তেমন জোটেনি, বরং অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ টাইপদের কাছ থেকে পর্ণোগ্রাফিক লেখক আখ্যা পেয়েছেন। এই অসম্মান তার প্রাপ্য ছিল না।

একজন বড়ো লেখকমাত্রই তার লক্ষ্য ঠিক করে নেন। তারপর সেই লক্ষ্যের দিকে খুব সাবধানে এগুতে থাকেন। অনেকটা বিড়ালের নিঃশব্দ যাত্রার মতো। পাঠক বুঝতেও পারেন না লেখক তাঁকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। যখন বুঝতে পারেন তখন আর ফিরে আসার উপায় থাকে না। হক ভাই এই কাজটি অসম্ভব সুন্দর ভঙ্গিতে করেন। একজন বড়ো লেখক চারপাশের জগৎ অগ্রাহ্য করে নিজের কল্পনার জগতে বাস করেন না। বড়ো লেখকের এসকেপিস্ট হওয়ার পথ নেই। হক ভাই এসকেপিস্টদের একজন না, তিনি কখনোই বাস্তবতাকে অস্বীকার করেননি। তার নিজের আনন্দের জন্য তিনি লেখেন না–পাঠকের আনন্দও তাঁর রচনার প্রধান বিষয় নয়…। তার রচনা পাঠ করে মনে হয়, তিনি বিশ্বাস করেন তাকে একটি দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে। এই দায়িত্ব প্রিয় হোক অপ্রিয় হোক তাকে পালন করতেই হবে।

একজন বড়ো লেখককে মানুষ হিসেবেও বড়ো হতে হয়। হক ভাই মানুষ হিসেবে বড়ো কিনা আমি জানি না, তেমন ঘনিষ্ঠভাবে তার সঙ্গে মেশার সুযোগ আমার হয়নি, তারপরেও দুটি ক্ষুদ্র ঘটনার উল্লেখ করছি–

কবি শামসুর রাহমান সাহেব তখন খুব অসুস্থ। বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ফুসফুসে পানি জমে গেছে। জীবন সঙ্কটাপন্ন। আমি দৈনিক বাংলার সালেহ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে তাকে দেখতে গিয়েছি। কবিকে দেখে মনটা খুব খারাপ হয়েছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, তখন এলেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি কবির কাছে দাঁড়ালেন। তার একটি হাত টেনে নিয়ে নিজের বুকের উপর রাখলেন এবং বললেন, আমি সবার সামনে এই প্রার্থনা করছি–আমার আয়ুর বিনিময়ে হলেও আপনি যেন বেঁচে থাকেন।

বলেই তিনি আর দাঁড়ালেন না, ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। আমি দেখলাম, সৈয়দ হক কাঁদছেন। আজ শুনতে পাই দুজনের সম্পর্কের খুব অবনতি হয়েছে। একে অন্যের নাম পর্যন্ত শুনতে পারেন না। তারপরেও আমি নিশ্চিত জানি, আবারো যদি কবি অসুস্থ হন–সৈয়দ হক ছুটে যাবেন এবং কবির রোগমুক্তি প্রার্থনা করবেন।

এবার দ্বিতীয় ঘটনাটা বলি–আমি তখন শহীদুল্লাহ হলে থাকি। হঠাৎ খুব শরীর খারাপ হলো। নিঃশ্বাস নিতে পারি না। ভয়াবহ শারীরিক কষ্ট। হক ভাই কার কাছ থেকে আমার অসুখের খবর শুনলেন। শোনামাত্র ছুটে এলেন আমার বাসায়। বিছানায় আমার পাশে বসে কঠিন গলায় বললেন–হুমায়ূন, তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে এবং অনেক দিন বেঁচে থাকতে হবে। তোমার হাতে ছয়টি আঙুল। এই ছটি আঙুলের একটি হলো কলম। ছআঙুলি মানুষের অসুস্থ হওয়া চলে না।

হক ভাইয়ের সুন্দর করে বলা এই বাক্য দুটি আমার অনেক সঞ্চয়ের একটি। মাঝে মাঝে সমালোচকদের কঠিন আক্রমণে যখন দিশেহারা হয়ে যাই তখন নিজের ডান হাত চোখের সামনে মেলে ধরে বলি–আমার হাতে ছটি আঙুল। ছ-আঙুলি মানুষদের দিশেহারা হলে চলে না।

ভোরের কাগজ হক ভাইয়ের ওপর একটি বিশেষ সংখ্যা বের করছে শুনে খুব। ভালো লাগছে এই কারণে যে, আমি তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানোর একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম।

হক ভাই, আপনি ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন–আপনার প্রতি এই আমার শুভ কামনা। আপনি অতি ভাগ্যবান। জীবন তার মঙ্গলময় হাতে আপনাকে স্পর্শ করেছে–এই বিরল সৌভাগ্য কজনের হয়?
 
ফুটবল ও আমরা



চার বছর আগে কথা। অয়োময় ধারাবাহিক নাটকের চিত্রায়ন হচ্ছে ময়মনসিংহের রাজবাড়িতে। ক্যামেরা নিয়ে সবাই বসে আছি। শিল্পীরা তৈরি। পরিচালক নওয়াজিশ আলী খান এ্যাকশান বললেই অভিনয় পর্ব শুরু হবে। এমন সময় ঝামেলা শুরু হল। মিছিলের প্রচণ্ড শ্লোগানে চারদিক কাঁপতে লাগল। আমাদের দেশটা মিটিং-মিছিলের দেশ। শ্লোগান কোন নতুন ব্যাপার না। কিন্তু সেদিনের মিছিলের শ্লোগান অতি বিচিত্র। সাধু ভাষায় বলা যেতে পারে অশ্রুতপূর্ব। শ্লোগান হচ্ছিল–ওয়ার্ল্ড কাপ সিদ্ধান্ত! মানি না। মানি না। আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন! করতে হবে, করতে হবে।

নওয়াজিশ আলী খান বিস্মিত হয়ে বললেন, ব্যাপার কি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি তাকে বললাম–লোকজন আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন না হওয়ায় ক্ষেপে গেছে। এই জন্যেই মিছিল, শ্লোগান, আন্দোলন।

তিনি অবাক হয়ে বললেন, আন্দোলন করে লাভ কি? আমি বললাম, আমরা। ময়মনসিংহের লোক, আমরা লাভ-লোকসান বিচার করে আন্দোলন করি না। আমাদের ফেবারিট টিম আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনা হেরে যাবে আর আন্দোলন করব না, তা হয় না।

নাটকের ইউনিটের সবাই কৌতূহলী হয়ে মিছিল দেখতে গেল। বিশাল জঙ্গী মিছিল। গলায় রুমাল বাধা এক যুবক আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করছে–আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন না বানালে —

বাকি সবাই ধুয়া ধরছে,–জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।

নওয়াজিশ আলী খান বিনীত ভঙ্গিতে জানালেন যে, তিনি এই জীবনে অনেক পাগল দেখেছেন। ময়মনসিংহের লোকের মত পাগল দেখেননি।

কি এই ঘটনা আমি জাতিগতভাবে বাঙালীর ফুটবল প্রীতির নমুনা হিসাবে উপস্থিত করলাম। সাম্প্রতিক আরেকটি নমুনা দিচ্ছি। ডামফা কাপ ফাইনাল কিছুদিন আগে হয়ে। গেল। আবাহনীর হয়ে খেলছেন ইরাকী খেলোয়াড় নজর আলী। তিনি গোল করলেন। টিভিতে এই দৃশ্য দেখে এক দর্শক নজর আলী বলে বিকট চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালেন। দ্বিতীয় দিনও তার জ্ঞান ফেরেনি। এই খবর পত্রিকার মারফতে আমি জানি। ও আচ্ছা, আরেকটি ঘটনা মনে পড়েছে। গত ওয়ার্ল্ড কাপের সময় আমার এক দূর সম্পর্কের ফুপুকে বিশেষ বিশেষ খেলার দিনে রোজা রাখতে হয়েছে। ভদ্রমহিলার বয়স ষাটের কাছাকাছি। ফুটবল খেলা নিয়ে তার কোন রকম মাথাব্যথা নেই। থাকার কথাও নয়। তারপরেও তাকে রোজা রাখতে হয়েছে। কারণ তার ছেলের ফেবারিট টিমের খেলা। ছেলে নিজে রোজা রাখতে পারে না, কষ্ট হয়। মাকে দিয়ে রাখাচ্ছে।

আমাদের জাতীয় খেলা কাবাডি নয়–ফুটবল। মজার ব্যাপার হল এই ফুটবল আমরা কিন্তু খেলতে পারি না। গত সাফ গেমসে আমাদের ফুটবলাররা শরীর ফিট রাখার জন্যে এক মণ মধু খেয়ে কি খেলা খেলেছিলেন, তা আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। আমাদের খেলোয়াড়রা বিদেশে খেলতে গিয়ে দশ-বারোটা করে গোল হাসিমুখে খান। আমরা দল বেঁধে এয়ারপোর্টে তাদের আনতে যাই। তারা সেখানে গম্ভীরমুখে। সাংবাদিক সম্মেলন করেন। গলাটলা কাঁপিয়ে ভাষণ দেন।

আমাদের টিম অত্যন্ত ভাল খেলেছে। পাসের আদান-প্রদান এবং দলীয় সমঝোতা ছিল অসাধারণ পর্যায়ের। আমরা প্রতিপক্ষকে বেশিরভাগ সময়ই কোণঠাসা করে রেখেছিলাম। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তারা ছিল প্রবল চাপের মুখে। আমরা যে পরাজিত হয়েছি তা নিতান্তই ব্যাড লাক। আমরা আসলে ভাল খেলে পরাজিত। তবে। এই পরাজয় বৃথা যায়নি। পরাজয় থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করেছি। সে শিক্ষা ভবিষ্যতে বিদেশের মাটিতে জয়লাভ করতে আমাদের সাহায্য করবে।

পরাজয়ের শিক্ষা মনে হয় তেমন কাজে আসে না। কাজে এলে অসংখ্য পরাজয় থেকে এরইমধ্যে আমরা অনেক কিছু শিখে ফেলতাম। কিছু শিখতে পারিনি। পারব এমন লক্ষণও দেখছি না।

তারপরেও আমরা ফুটবল ভালবাসি। বাঙালী বাবারা তাদের পুত্রদের প্রথম যে খেলনা কিনে দেন তার নাম ফুটবল। কেন?

আজ পত্রিকায় দেখলাম–পলিটেকনিকের ছেলেরা ওয়ার্ল্ড কাপের সময়। পরীক্ষা পড়েছে এই রাগে তাদের কলেজের চেয়ার-টেবিল, দরজা-জানালা সব ভেঙে একাকার করেছে। ভালবাসা নামক এই অবসেসানের কারণ কি?

মনস্তত্ত্ববিদরা কারণ হয়ত জানেন। আমার নিজের ধারণা আমরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ঘণ্টাখানিকের জন্যে উত্তেজিত হতে ভালবাসি। উপদেশ এবং গালি দিতে পারলে আমাদের খুব আনন্দ হয়। খেলার মাঠে যত ইচ্ছা উপদেশ এবং দেয়া যায়। নমুনা—

কানা তুই দেখস কি? পাস দে। তোর বাপের বল, পায়ের চিপায় রেখে দিয়েছিস?

(শব্দটা পায়ের চিপা নয়, অন্য এক স্থান। শালীনতার কারণে পায়র চিপা বললাম। বুদ্ধিমান পাঠক বুঝে নিন)।

ল্যাং মার। ল্যাং মার। আরে কুত্তার বাচ্চা, ল্যাং মেরে ফেলে দে না।

ভ্যাবদা মেরে বসে আছিস ক্যান রে চান্দি ছোলা? শট দে। শট দেয়া ভুলে গেছিস?

(এই খেলোয়াড়ের মাথায় চুল কম বলেই আদর করে চান্দি ছোলা বলা হচ্ছে)।

ঐ শুওরের বাচ্চার চোখ তুলে ফেল।

চামড়া ছিলে লবণ মাখিয়ে দে।

টান মেরে–ছিঁড়ে ফেল।

(কি ছিঁড়তে বলা হয়েছে পাঠক বুঝে নিন)।

খেলা শেষ হবার পরপর রেফারিকে ধোলাই দেয়ার একটা ব্যাপার চলে আসে। নূতন কোন ব্যাপার না। আবহমানকাল থেকেই চলে আসছে। বাঙালী রেফারিরা এতে কিছু মনেও করে না। ধোলাই খাওয়াটাকে তারা কপালের লিখন হিসাবে মেনে নিয়েছে। অবশ্যি রেফারিকে ধোলাই দেয়ার এই প্রবণতা শুধুমাত্র বাঙালী জাতির বৈশিষ্ট্য নয়, এটা সর্বজনীন। পাঞ্চ পত্রিকায় একটা কার্টুন দেখেছিলাম। কার্টুনে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে একটা বেড সাজানো হচ্ছে। জিজ্ঞেস করা হয় ব্যাপার কি? হাসপাতালের এটেনডেন্ট বলল, আজ ফুটবল খেলা আছে না? এই বেড় রেফারির জন্যে।

যাই হোক, চার বছর পর আবার আসছে ওয়ার্ল্ড কাপ। এই সময়ের সবচে বড় ঘটনা এবং আশ্চর্যজনক ঘটনা।

বাতাস ভর্তি চামড়ার একটি গোলকের দিকে সারা পৃথিবীর মানুষ তীব্র উত্তেজনা নিয়ে তাকিয়ে থাকবে–এর চেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার আর কি হতে পারে? আমরা বাঙালীরা খেলা দেখতে দেখতে কিছু সময়ের জন্যে হলেও আমাদের শৈশবে ফিরে যাব। তার মূল্যও বা কম কি? ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। আমরা ভিজে ন্যাতা ন্যাতা। বৃষ্টিভেজা। মাঠে জাম্বুরা নিয়ে আমরা দৌড়াচ্ছি। পায়ের নিচে পানি ছপ ছপ করছে। কে যেন। গড়িয়ে পড়ল কাদায়। পড়ুক। দেখার সময় নেই। বল নিয়ে দৌড়াতে হবে। ঐ তো দেখা। যায় গোল পোস্ট।*



———-

* ফুটবল নিয়ে এই সংকলনে আরেকটি লেখা আছে। লেখাটার শিরোনাম খেলা। দুটি লেখার মূল বিষয় একই। একটা লেখা রাখলেই চলত, তবু দুটাই রেখে দিলাম।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top