What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected সকল কাঁটা ধণ্য করে (হুমায়ুন আহমেদ) (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
324
Messages
6,018
Credits
45,356
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
অন্য রকম উৎসব




ছোটবেলায় আমি একবার মেহমানী উৎসবে গিয়েছিলাম।

আজকালকার পাঠক-পাঠিকারা মেহমানী শব্দটার সঙ্গে পরিচিত কি না জানি না, কাজেই একটু ব্যাখ্যা করে নেই। আগেকার আমলে বিত্তবান লোকদের একটা প্রবণতা ছিল তাদের বিত্তের বিষয় অন্যদের জানানো। মেহমানী উৎসবের শুরুটা বোধহয় সেই বিত্ত প্রদর্শনীতে। এই উৎসবে কোন একটা উপলক্ষ ধরে তিন গ্রাম, পাঁচ গ্রাম কিংবা সাত গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করা হত। সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার।

শৈশবের স্মৃতি থেকে বলি, আমার নানার বাড়ির কাছেই চন্দ্রপুর গ্রাম। সেই গ্রামের বিত্তবান একজন মানুষ তার বাবার মৃত্যুদিনে মেহমানী দেবেন। তিন গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করা হয়েছে। দশটি গরু উৎসব উপলক্ষে প্রাণ দিয়েছে, আরো পাঁচটি অপেক্ষা করছে। প্রয়োজনে এদেরও প্রাণ দিতে হবে।

খাবার আয়েজন খোলা মাঠে। অগুণতি মানুষ। সমুদ্র গর্জনের মত শব্দ উঠছে। স্রোতের মত মানুষ আসছে–খাচ্ছে–চলে যাচ্ছে। রান্নার বিরাম নেই, খাওয়ারও বিরাম নেই। আমার বিশেষ কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে–খোলা মাঠে আটদশটা নৌকা সারি বেঁধে রাখা। নৌকাভর্তি ডাল। ডালের পাত্র হিসেবেও যে নৌকার একটা ব্যবহার আছে, আমার জানা ছিল না।

আমাদের খেতে বসতে বসতে রাত বারোটার মত বেজে গেল। মানুষের তুলনায় আলো কম। চাঁদের আলোয় মাটিতে সানকি নিয়ে মিছিলের একজন হয়ে বসেছি। সানকি উচু করে একজন ভাত দিয়ে গেল। সেই ভাতের উপর একজন এসে ঢেলে দিল এক গাদা গোশত। মুখে দিয়েছি কি দেইনি এর মধ্যে ডাল চলে এল। যিনি মেহমানী দিচ্ছেন (সম্পর্কে তিনি আমার মার আপন খালু) তিনি এক পর্যায়ে হাত জোড় করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং বললেন, তার দাওয়াত রক্ষা করার জন্যে তিনি যে কী পরিমাণ আনন্দিত সেটিও অনেক অলংকার দেয়া ভাষায় জানানো হল এবং তিনি বারবার বলতে লাগলেন, তিনি অতি অভাজন। নাদান। অতি নগণ্য। বলতে বলতে তার চোখে পানি এসে গেল। তিনি কাঁধে ফেলে রাখা চাদরে চোখ মুছতে লাগলেন।

যাঁরা মেহমানী দেন তাঁদের এই সব বলতে হয়। এটাই নিয়ম। তিনি নিয়ম রক্ষা করছেন। আবেগে অশ্রুবর্ষণও নিয়ম রক্ষারই অংশ।

শৈশবের মেহমানীর স্মৃতি আমার মধ্যে বেশ ভালভাবেই ছিল। আমার মেয়েদের কাছে আমি এই গল্প বেশ কবার করেছি। এর প্রতিবারই বলেছে, বাবার কী যে আজগুবি সব গল্প–নৌকাভর্তি ডাল! নৌকার বৈঠা ডাল নাড়ার চামচ।

আমি সুযোগ খুঁজছিলাম আমার মেয়েদের এই দৃশ্য দেখানো যায় কিনা। কোনই সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। মেহমানী দেয়ার রীতি হয়ত দেশ থেকে উঠে গেছে। এই অবস্থায় আমি নিজেই একটা মেহমানী দেব বলে ঠিক করলাম। মাকে বললাম–আমি আমার বাচ্চাদের গ্রামের মেহমানী দেখাতে চাই। আমি আমার গ্রামের সব মানুষকে একবেলা খাওয়াব। এরা সবাই একবেলা খাবে, এবং সারারাত জেগে গান শুনবে। আপনি ব্যবস্থা করুন। মা ব্যবস্থা করলেন। সেই মচ্ছব দেখার জন্যে আমি ঢাকা থেকে বন্ধুবান্ধবের পঞ্চাশজনের এক দল নিয়ে রওনা হলাম।

ঢাকার বন্ধুরা কাণ্ডকারখানা দেখে চমৎকৃত হলেন। কিন্তু আমি যা চেয়েছিলাম, তা কিন্তু হল না। আমার শৈশবস্মৃতির সঙ্গে মিলাতে পারলাম না। নৌকাভর্তি ডাল নেই। ভাতের পাহাড় নেই। মাটির সানকি নেই। অবশ্যি আমাদের আয়েজনও অল্প। আমাদের গ্রাম ছোট। মাত্র সাতশ লোকের বাস। তবে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে চার হাজার মানুষের–হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার না। এলোমেলো ভাবও নেই। তবুও হাজার হাজার মানুষ খাচ্ছে। দেখার মতই উৎসব। কিন্তু এই উৎসব আমার তিন কন্যাকে স্পর্শ করল না। বড় মেয়ে বলল, লোকজন এসে খেয়ে যাচ্ছে–এতে দেখার কি আছে বাবা? মানুষের খাওয়া দেখতে আমার ভাল লাগে না। ছোট মেয়ে বলল, তুমি বলেছিলে নৌকাভর্তি ডাল থাকবে। নৌকা কোথায়?

আমার তিন কন্যা গাছে উঠে বসে রইল। ওদের নাকি গাছে বসে থাকতেই বেশি ভাল লাগছে।

খাওয়া চলল সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যাবেলায় খেতে বসল আশেপাশের গ্রামের ফকিরমিসকিনরা। শহরের ফকির এবং গ্রামের ফকিরদের ভেতর একটা প্রভেদ লক্ষ্য করলাম। শহরের ফকিররা তাদের দৈন্যদশী প্রদর্শনে অসম্ভব আগ্রহী। গ্রামের এরা এই ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতে চায়। আজ তারা সবাই তাদের সবচেয়ে ভাল পোশাকটা পরে এসেছে। ভদ্র, বিনয়ী আমন্ত্রিত অতিথির মত আসন গ্রহণ করছে।

এদের খেতে দেয়া হল। আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হল যাতে আমি মেহমানীর বক্তৃতাটা দেই। আমি যথারীতি উপস্থিত হলাম এবং বললাম,

আমি নিতান্তই অভাজন। আমার নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্যে আপনারা যে কষ্ট করে এসেছেন এতে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।

খাওয়া শুরু হল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। কি আগ্রহ নিয়েই না এরা খাচ্ছে! প্লেট ভর্তি করে মাংস দিয়ে গেল। এরা মুগ্ধ চোখে মাংসের স্তুপের দিকে তাকাচ্ছে। এক মহিলা আনন্দিত গলায় বললেন, আফনেরা কি খাওয়াইতে খাওয়াইতে আমরারে মাইরা ফেলাইবেন? (আপনারা কি খাওয়াতে খাওয়াতে আমাদের মেরে ফেলার মতলব করেছেন?)

এই মহিলার আনন্দিত গলা শুনে হঠাৎ আমার চোখে পানি এসে পড়ল। হঠাৎ মনে হল, আমি আমার শৈশবের স্মৃতি নতুন করে তৈরি করতে পারিনি। না পারলেও আমার শ্রম, আমার অর্থব্যয় সার্থক হয়েছে। অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও এইসব হতভাগ্যদের আনন্দিত চোখ আমি দেখলাম। এ আমার পরম সৌভাগ্য।

চল্লিশ বছর আগে আমার মার খালু এমনই এক মেহমানী উৎসবে হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছিলেন। অতিথিদের খেতে বলার পর তিনি হঠাৎ কঁদতে শুরু করেছিলেন। সেদিন মনে হয়েছিল, তিনি মেকি কান্না কাঁদছেন। চল্লিশ বছর পর চোখের জল ফেলতে ফেলতে বুঝলাম, তার সেদিনের কান্না মেকি ছিল না। আমি তাঁর আত্মার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম।

আমার মনে হল–যদি আমার ক্ষমতা থাকতো, আমি অবশ্যই এদেশের প্রতিটি নিরন্ন মানুষকে খাওয়াতাম। আমি জানি, আমার এই আবেগ সাময়িক–আমি শহরে ফিরে যাব, আমার আর কিছুই মনে থাকবে না। তবুও ক্ষণিকের জন্যে হলেও এক মহান বোধ আমার ভেতর সৃষ্টি হয়েছিল–তার মূল্যই বা কম কি? যে মঙ্গলময় আমার ভেতর এই বোধ তৈরি করেছিলেন–তিনি সেই বোধ সবার ভেতর ছড়িয়ে দিবেন–এই আমার প্রার্থনা।
 
আঙুল



আগুনের পরশমণি ছবি করার সময়কার কথা–একটা দৃশ্য আছে মিলিটারী একজন মুক্তিযোদ্ধার আঙুল কেটে ফেলে। আমি ভাবলাম–এমন একজন কাউকে যদি পাওয়া যেত যার হাতের দুটি আঙুল কাটা পড়েছে তাহলে খুব ভাল হত। সরাসরি তার হান্টা ক্যামেরায় দেখানো যেত।

ফিল্ম লাইনের প্রডাকশানে সাইডে যারা কাজ করেন তারা পারেন না হেন ব্যাপার নেই। আমি আঙুল কাটা পড়েছে এমন একজনকে খুঁজছি শুনে তারা বললেন, স্যার, আপনি নিশ্চিত থাকুন। এক সপ্তাহের ভেতর আপনি লোক পাবেন।

ওদের কথা আমি বিশ্বাস করিনি। দৃশ্যটা অন্যভাবে লেখার পরিকল্পনা করে ফেললাম। তখন সত্যি সত্যি লেদ মেশিনে আঙুল করার কাঁটা পড়েছে এমন একজন তারা উপস্থিত করল। লোকটিকে আমি ব্যবহার করিনি তবে তার কাটা আঙুলগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথার ভেতর একটা গল্প তৈরি হয়ে গেল। গল্পটি দেশের কোন পত্রিকায় ছাপা হয়নি–কোলকাতার একটি শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। পাঠক-পাঠিকাদের জন্যে গল্পটি দিয়ে দিচ্ছি। গল্প কিভাবে তৈরি হয় অনেকে জানতে চান। গল্প তৈরির অনেক প্রক্রিয়ার একটি বলা হল—

দেখি হাত দেখি।

এক হাত মেললেই হয়–মোবারক দুহাত মেলে ধরল। মোবারকের কেমন ভয় ভয় করছে। মনে হচ্ছে ডাক্তারকে হাত দেখাচ্ছে। বামুনদের মত বেঁটে যে ভদ্রলোক হাত দেখছেন–তিনি কোন ডাক্তার না। ফিল্মের ডাইরেক্টার। ফিল্মের নাম শেষ প্রতিশোধ।

মোবারক লক্ষ্য করল উত্তেজনায় তার হাতের আঙুল কাঁপছে। দশটা আঙুল কাপার কথা, তার কাঁপছে সাতটা। কারণ ডান হাতের পাঁচটা আঙুলের মধ্যে তিনটা তার নেই, লেদ মেশিনে কাটা পড়েছে। মেশিনে কাটা বলেই সুন্দর করে কাটা। দেখতে খুব খারাপ লাগে না।

ডাইরেক্টার সাহেব আগ্রহ নিয়ে কাটা আঙুল দেখছেন। তার পছন্দ হচ্ছে কিনা। মোবারক বুঝতে পারছে না। ভদ্রলোকের ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হয় খুঁতখুঁতে স্বভাবের। বেঁটে লোক খুঁতখুঁতে স্বভাবের হয়।

আপনার নাম কি বললেন যেন?

স্যার, আমার নাম মোবারক।

আমরা আসলে চেয়েছিলাম চারটা আঙুল কেটেছে এমন লোক। এক হাতে শুধু একটাই আঙুলের অন্য এক ধরনের বিউটি আছে। যাই হোক, আপনাকে দিয়েও চলবে। অভিনয় করেছেন কখনো?

জ্বি না স্যার।

অভিনয় না করলেই ভাল। যা বলব ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে তাই করবেন। পারবেন না?

জ্বি স্যার পারব।

গুড। খুব সহজ দৃশ্য। এক অত্যাচারী লোক তোমাকে ধরেছে। সে ছড়তা দিয়ে কচ কচ করে তোমার হাতের তিনটা আঙুল কেটে ফেলবে। এক একবার কাটবে আর তুমি আঁ বলে এক চিৎকার দিবে।

মোবারকের কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। ডাইরেক্টার সাহেব একটু আগে তাকে আপনি করে বলছিলেন, এখন তুমি বলছেন। শুরু থেকে তুমি করে বললে অস্বস্তি লাগত না। প্রথম কিছুক্ষণ আপনি বলায় লাগছে। ছড়তা দিয়ে আঙুল কাটার ব্যাপারটাও সে বুঝতে পারছে না। আঙুল তো কাটাই আছে, আবার নতুন করে কাটবে কি?

তোমার বুকে লোম আছে?

মোবারক লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, জ্বি না স্যার।

ডাইরেক্টার সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, পুরুষের বুকে লোম আজকাল উঠেই গেছে। কারণটা বুঝলাম না। যাই হোক, তুমি শার্টটা খুলে ফেল। খালি গায়েই ভাল। লাগবে। খোল, শার্ট খোলা ছিল।

এত লোকের মাঝখানে শার্ট খুলতে মোবারকের লজ্জা লাগছে। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে, যেন পুরুষ মানুষের উদোম হওয়ার দৃশ্য তারা আগে দেখেনি। এদের মধ্যে মেয়েছেলেও আছে। একটা মেয়ে তো একেবারে লাল টুকটুক, গদি দেয়া চেয়ারে। বসে আছে। নায়িকা-টায়িকা হবে। নায়িকা না হলেও নায়িকার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী কিংবা ছোট বোন। মেয়েটা একটু পরপর বিশ্রী ভঙ্গিতে হাই তুলছে। তার মুখটা ছোট তবে হা। করার সময় বিশাল হয়ে যাচ্ছে, জিভ দেখা যাচ্ছে। কালো রঙের একটা জিভ। মোবারকের মনে হল, মেয়েটার জিভটা রঙ করে দেবার দরকার ছিল। লাল টুকটুক চেহারার সঙ্গে কাল জিভ মিশ খাচ্ছে না।

ডাইরেক্টার সাহেব বললেন, তোমার নাম যেন কি বললে?

স্যার মোবারক।

শোন মোবারক, তুমি চুপ করে বসে থাক। তোমার শট কখন নেব বুঝতে পারছি। প্রডাকশনের কেউ আছে? মোবারককে চ-বিসকুট দে।

মোবারক লজ্জিত মুখে বসে আছে। সামান্য কয়টা টাকার জন্যে এই ঝামেলায়। আসাটা ঠিক হয়েছে কি না, বুঝতে পারছে না। মোবারক শুধু যে নিজে লজ্জা পাচ্ছে তা না, তার ধারণা তার ডান হাতটাও লজ্জার মধ্যে পড়েছে। আগে যেখানে আঙুল ছিল। সেই জায়গা চুলকাচ্ছে। আঙুল নেই অথচ চুলকাচ্ছে–যাকে বলে ভৌতিক অবস্থা। এরকম তার মাঝে মাঝে হয়। লজ্জা বা অস্বস্তির মধ্যে পড়লে বেশি হয়। বললে কেউ বিশ্বাস করবে না বলে মোবারক ব্যাপারটা কাউকে বলেনি, শুধু লতিফাকে বলেছে।

লতিফা গম্ভীর গলায় বলেছে, চুলকালে কি করেন? চুলকান?

হুঁ।

আঙুল তো নাই। কই চুলকান?

বাতাসের মধ্যে চুলকাই। এতে আরাম হয়।

লতিফা, মোবারকের ছোট ভাই আবদুল করিমের স্ত্রী। দেড় বছর হল বিয়ে হয়েছে। এখনো ছেলেপুলে হয়নি বলে স্বভাব-চরিত্র নতুন বৌয়ের মত। লাল শাড়ি পরে। মাথায় ঘোমটা দিয়ে ঘুরঘুর করে, দেখতে ভাল লাগে। নতুন বৌ হল বাড়ির শোভা। মোবারকের প্রায়ই মনে হয়, প্রতিটি বাড়িতে একটা করে নতুন বৌ থাকা দরকার। সেজে-গুজে থাকবে, নতুন শাড়ি পরে ঘুরঘুর করবে।

মোবারকের এই মেয়েটাকে বড়ই পছন্দ। মেয়েটার সবই ভাল, শুধু হাসি-রোগ আছে। সব কিছুতেই হাসি। মোবারক হল তার ভাসুর। ভাসুরের সামনে হাসা খুব বড় ধরনের বেয়াদবি। এই মেয়ে সেটা জানে, জেনেও হাসে। তবে এই অপরাধ ক্ষমা করা। যায়। সব ভাল জিনিসে খুঁত থাকে। সোনায় থাকে গিল্টি, চন্দ্রে কলঙ্ক। কি আর করা! এই যে পরীর মত সুন্দর একটা মেয়ে তার কাছেই চেয়ারে বসে আছে, তার জিভটা তো কালো।

খালি গায়ে বসে থেকে মোবারক তার অদৃশ্য আঙুল চুলকায়। এক ঘণ্টার উপর। হল সে বসে আছে। ডাইরেক্টার সাহেব চা দিতে বলেছিলেন, সেই চা তাকে এখনো কেউ দেয়নি। তবে অনেকেই চা-বিসকুট খাচ্ছে। মোবারক খুব ভাল করে চারদিক দেখার চেষ্টা করছে। বাসায় গিয়ে এক ফাঁকে লতিফাকে বলতে হবে। বেচারী ছেলেমানুষ এই সব জিনিসে মজা পাবে। অতি ভাল একটা মেয়ে। ভাসুরের সামনে দুই-একটা ছোটখাট বেয়াদবি করে ফেলে। বয়স কম বলেই করে। সব কিছু ধরলে সংসার চলে না। কিছু ধরতে হয়, কিছু ছাড়তে হয়। তাছাড়া এই জামানায় কয়টা মেয়ে তার ভাসুরকে খাতির করে? সেই ভাসুর কাজের ভাসুর হলেও একটা কথা ছিল। মোবারক হল অকাজের ভাসুর। ছোট ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাচ্ছে-দাচ্ছে-ঘুমাচ্ছে। তাকে খাতির করার কি আছে? এই সব ক্ষেত্রে উল্টোটা হয়। ছোট ভাইকে এবং তার স্ত্রীকে খাতির করে চলতে হয়। সব সময় খেয়াল রাখতে হয় এরা যেন বেজার না হয়। আবদুল করিমের ব্যাপারে মোবারক যে তা করে না, তাও না। করে, নিজের অজান্তেই করে। করার পর মনটা খারাপ হয়ে যায়। নিজের উপর রাগে গা জ্বলে যায়।

গত সোমবারে রহমানিয়া হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে সে সিগারেট টানছিল। হঠাৎ দেখে আবদুল করিম বাজার করে ফিরছে। দেখামাত্র সে হাতের সিগারেট ফেলে দিল। কি কাণ্ড! নিজের ছোট ভাই। তাকে দেখে সে সিগারেট ফেলবে কেন? ভাগ্যিস আবদুল করিম ব্যাপারটা দেখেনি। দেখলে একটা লজ্জার ব্যাপার হত।

দীর্ঘদিন চাকরি-বাকরি না থাকলে মন ছোট হয়ে যায়। তখন মানুষ ছোট ভাইকে দেখে সিগারেট ফেলে দেয়ার মত কাণ্ড-কারখানা করে বসে। তার মন যে ছোট হয়ে গেছে এটা মোবারক জানে। কিছুটা ছোট হয়ে থেমে গেলে হত। থামছে না। যতই দিন যাচ্ছে ততই ছোট হচ্ছে। বিশ্রী ব্যাপার। আবদুল করিমকে দেখলে ইদানিং তার কেমন জানি ভয় ভয় করে। চোখের উপর চোখ পড়লে নিজের অজান্তেই চোখ নামিয়ে নেয়। অবশ্যি আবদুল করিমের কথা বার্তার ধরনও এখন বদলে গেছে। আগে গলার স্বর চিকন ছিল, এখন মোটা হয়ে গেছে। কথা বলার সময় ভুল তালে পা নাচায়। কিছুদিন হল চোখে আবার চশমা পরেছে। মোবারকের ধারণা, এইসব হয়েছে বিয়ের কারণে। বিয়ে করলে পুরুষমানুষ বদলাবেই। তার উপর বউ যদি সুন্দর হয় তাহলে তো কথাই। নেই। নতুন বিয়ে করা পুরুষদের প্রধান কাজই হল বউকে দেখানো যে সে একটা বিরাট কিছু। কাজেই যে পুরুষের গলা চিকন সে অনেক কষ্ট করে মোটা গলায় কথা বলে। আশেপাশের সবার দিকে এমন করে তাকায় যেন তারা কেউ মানুষ না, সে একাই মানুষ। শুধু মানুষ না, জ্ঞানী মানুষ।

সেদিন খাবার টেবিলে বসে আবদুল করিম জ্ঞানীদের মত কথা বলল। প্রথম কিছুক্ষণ পা নাচাল। প্রথমে ডান পা, তারপর বা পা, তারপর দুটাই একসঙ্গে। পা নাচানোর পর গলা খাকারি দিল। গলা পরিষ্কার করে নিল। অপরিষ্কার গলায় তো আর জ্ঞানের কথা বলা যায় না। গলা পরিষ্কার হবার পর বলল, লতু, চশমাটা দেখি। আদর। করে লতিফাকে লতু ডাকা। স্ত্রীকে আদর করে ডাকবে না তো কাকে ডাকবে? লতুফতু যা ইচ্ছা ডাকুক, কিন্তু বড় ভাইয়ের সামনে ডাকবে কেন? আদব-কায়দার একটা ব্যাপার আছে না? তাছাড়া স্ত্রীর সামনে যে ভঙ্গিতে সে কথা বলছে সেটা তো আদবের বড় খেলাফ। চশমা চোখে দিয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে কথা বলা। আরে ব্যাটা, তুই কি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল নাকি? তুই হলি সাবরেজিস্টার অফিসের কেরানী। চশমার ফাঁক দিয়ে তোর কথা বলার দরকার কি? আর গলা মোটা করারও-বা দরকার কি? তোর যেমন গলা তুই তেমন গলায় কথা বলবি। এরকম মোটা গলায় বেশিদিন কথা বললে তো গলায় ক্যানসার-ফ্যানসার হবে। মোবারক অবশ্যি ভাইয়ের সব কথা। মাথা নিচু করে শুনল।

ভাইজান, আর কতদিন এই ভাবে বসে বসে থাকবেন? কিছু একটা করা দরকার না?

মোবারক বলল, হুঁ।

তিনটা আঙুল কাটা গেছে, তার জন্যে তো আপনি অচল হয়ে পড়েননি। হাত নেই এমন মানুষও কাজ করে খাচ্ছে।

মোবারক মনে মনে বলল, ভিক্ষা করে খাচ্ছে। তুই কি তাই চাস? তোর বড় ভাই ভিক্ষা করলে তোর মান থাকবে?

বেঙ্গল টুলস যে আপনাকে দশ হাজার টাকা কমপেনসেশান দিবে বলেছিল, তার কি হল? সেই টাকাটা পেলেও তো একটা ব্যবসা-ট্যবসা শুরু করতে পারতেন। ওরা টাকাটা কবে দিবে কিছু বলেছে?

দিন-তারিখ কিছু বলে নাই।

দিবে তো? নাকি দিবে না?

দিবে।

গা ছেড়ে বসে থাকলে কি আর দিবে? ওদের তাগদা দিতে হবে। রোজ গিয়ে বসে থাকতে হবে। দিনরাত ঘরে বসে থাকায় কোন লাভ নাই। লতু, পান দাও তো।

লতিফা পান আনতে যাচ্ছে এই ফাঁকে মোবারক উঠে পড়ল। পান খাওয়ার সময়। সে সামনে থাকতে চায় না। তখন আবদুল করিম একটা বিশ্রী ব্যাপার করে। সেই বিশ্রী ব্যাপার দেখতে খারাপ লাগে। লতিফা যখন পান এনে দেয় তখন গদগদ ভঙ্গি করে আবদুল করিম হা করে। আবদুল করিমের মুখ ছোট, কিন্তু মুখের কাটা বিরাট বড়। হা। করা মুখ বড় বিশ্রী দেখায়। লতিফাকে সেই হা করা মুখে পান ঢুকিয়ে দিতে হয়। এই ব্যাপারগুলি আগে সে আড়ালে করত। ইদানিং মোবারকের সামনেই করছে। মোবারকের ধারণা, আজকাল তাকে তার ছোট ভাই মানুষ হিসেবেই গণ্য করছে না। কুকুর-বিড়াল ভাবছে। কুকুর-বিড়ালের সামনে মানুষ লজ্জা করে না। আবদুল করিমই বা কেন করবে?

ভাইজান, আপনি টাকাটা উদ্ধার করার চেষ্টা করেন।

আচ্ছা।

টাকাটা পেলে আমিও কিছু দিব। দুটা মিলায়ে একটা দোকান টোকান দেন। আপনার বয়সও তো কম হয় নাই। থিতি হয়ে ঘর সংসার করতে হবে না?

মোবারক মনে মনে বলল, চুপ থাক হারামজাদা। বক্তৃতা দিস না। বসে বসে পান। খাঁ। পা নাচা।

পান চলে এসেছে। আবদুল করিম চোখ বন্ধ করে হা করল। লতিফা মুখে পান ঢুকিয়ে দিল। পান খেতে খেতে বলল, বুঝলেন ভাইজান, আপনার যদি মেট্রিকটাও পাশ থাকত আমাদের অফিসে একটা ব্যবস্থা করে দিতাম। অফিসে এই জুনে লোক নিচ্ছে। আমাদের সাবরেজিস্ট্রার সাহেব বলতে গেলে আমার কথায় উঠেন বসেন। মুন্সিগঞ্জ বাড়ি। অতি অমায়িক।

মোবারক বুঝতে পারে সবই বউকে শোনানোর জন্যে চাল দেয়া কথা। কতবড় লায়েক হয়ে গেছে! মুখের কথায় চাকরি হয়ে যায়! সাবরেজিস্ট্রার তার কথায় উঠে বসে। সাব রেজিস্ট্রারের তো খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই। কেরানীর কথায় উঠবোস করাই একমাত্র কাজ। তুই হলি ড্রিল মাস্টার, তোর কথায় উঠ-বোস করবে? ফাজিলের ফাজিল।

ভাইজান, আপনি বেঙ্গল টুলসকে চাপ দিয়ে ধরবেন। কমপেনসেশান দেবে না মানে? তার বাপ দেবে। তেমন ঝামেলা করলে আমার লোক আছে, মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে। শুধু তক্তা না, প্রয়োজনে তক্তায় বানিশ দিয়ে দেবে। হা হা হা।

এটা হল আবদুল করিমের রসিকতা। বিয়ের পর সে আবার রসিকও হয়েছে। রসিকতা করে নিজেই হা হা হি হি করে হাসে। তার মান রক্ষার জন্যে লতিফাকেও হাসতে হয়। মায়া লাগে মেয়েটার জন্যে। তক্তায় বার্নিশ দিয়ে দেবে এটা কি কোন হাসির কথা? এই কথা শুনে বেকুব ছাড়া কেউ হাসবে? অথচ মেয়েটাকে হাসতে হচ্ছে।

আবদুল করিম আবার হা করল। আরেকটা পান খাবে। এই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখাও শাস্তির মত। মোবারক চলে যেতে ধরেছে, আবদুল করিম বলল, ভাইজান, একটা কাজ করেন। আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট এনে দেন। সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। লতু, টাকা এনে দাও। পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দাও। ফাইভ ফাইভ আনবেন।

মোবারক জানে, সংসারে কঁচা পয়সা আসতে শুরু করেছে। কেরানী ফাইভ ফাইভ সিগারেট খায় না। আবদুল করিম ইদানিং খাচ্ছে একটা ক্যাসেট প্লেয়ারও কেনা হয়েছে। নীল কাপড়ের ঢাকনি দিয়ে সেটা ঢাকা থাকে। অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে সেই ক্যাসেট প্লেয়ার বেজে উঠে। কয়েকদিন আগে রাত তিনটার সময় ক্যাসেট প্লেয়ার। বেজে উঠল–পায়েল বাজে ঝম ঝম ..

ছোট ভাইয়ের জন্যে সিগারেট কিনতে দোকানে যাবার মধ্যে এক ধরনের অপমান আছে। মন ছোট হয়ে যায়। কিন্তু উপায় কি? মোবারক জানে, সিগারেট কেনার মধ্যেই অপমানের শেষ না, আরো খানিকটা বাকি আছে। সিগারেট কেনার পর পঞ্চাশ টাকা থেকে দুটাকা ফেরত আসবে। আবদুল করিম উদাস ভঙ্গিতে বলবে, টাকা ফেরত দিতে। হবে না, রেখে দেন। তাকে দেখে দেখে লতিফাও শিখবে। সকালে বাজার করে আনার পর বলবে, বাড়তি পয়সা ফেরত দিতে হবে না, রেখে দেন।

তার টাকাপয়সার দরকার অবশ্যই আছে। এক-দুই টাকাও কম কিছু না। দুই টাকায় এক প্যাকেট আকিজ বিড়ি পাওয়া যায়। তারপরেও লজ্জা লাগে।

এই যে সে খালি গায়ে বসে আছে এটাও একটা লজ্জারই ব্যাপার। কখন না কখন। ক্যামেরার সামনে নিয়ে যাবে তার জন্য সকাল থেকে খালি গায়ে বসে থাকার দরকার কি? এমন তো না যে তার শার্ট খুলতে এক ঘণ্টা লাগে। বলবে আর সে ফট করে খুলে। ফেলবে। অনেক বেলা হয়েছে। খিদে জানান দিচ্ছে। এক জায়গায় বসে থাকলে খিদে বেশি লাগে। কাজের মধ্যে থাকলে খিদেটা ভুলে থাকা যায়। কাজ আর কোথায়? মোবারকের মনে হচ্ছে সিনেমা লাইনের একমাত্র কাজই হল বসে থাকা। বেশিরভাগ মানুষই বসে আছে। পুতুলের মত লাল টুকটুক মেয়েটাও তার মতই সকাল থেকে চেয়ারে বসা। এরা মনে হয় এক ফাঁকে খেয়ে এসেছে। অনেকের মুখেই পান। পুতুল পুতুল মেয়েটাও পান খাচ্ছে। পান খাওয়ার জন্যে তার জিভটা লাল হবে কি না কে জানে। এক ফাঁকে দেখতে হবে। মেয়েটার নাম এখন মোবারক জানে। নাম হল কুমকুম। মেয়েটার স্বামী তাকে আদর করে কি ডাকবে–কুম? মোবারকের ডান। হাতের কাটা পড়ে যাওয়া আঙুল চুলকাচ্ছে। কোন একজন ডাক্তারের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করলে হয়। পাড়ার সতীশ ডাক্তার আছে, এলএমএফ হলেও ভাল ডাক্তার। এম বি ডাক্তারের চেয়ে ভাল। তাকে বললে সে কি চুলকানির কোন ট্যাবলেট। ফ্যাবলেট দেবে? সতীশ ডাক্তারের সঙ্গে তার আলাপ আছে। রাস্তায় দেখা হলে জিজ্ঞেস করেন–কি মোবারক, খবর কি? তোমার ভাইয়ের এসিডিটি কমেছে? ভাজা-পোড়া কম খেতে বলবে। মোবারক অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলে–জ্বি আচ্ছা। বলব। যদিও সে ভালমতই জানে বলার প্রশ্নই আসে না। সব ছোট ভাইদের উপদেশ দেয়া যায় না। কিছু কিছু ছোট ভাই আছে, যাদের কাছ থেকে শুধু উপদেশ শুনতে। হয়। কিছু কিছু ছোট ভাই আছে যাদের তুমি করে বলতেও অস্বস্তি লাগে। মোবারক তো একবার আপনি বলেই ফেলেছিল। কি লজ্জার ব্যাপার। তবে আবদুল করিম অন্যমনস্ক ছিল বলে বুঝতে পারেনি। হয়েছে কি, আবদুল করিম ইউরিন টেস্ট করাবে। পেচ্ছাব ভর্তি শিশি মোবারকের হাতে দিলে বলল, সাবধানে নিয়ে যান। রাস্তায় যেন না ভাঙে। মোবারক ঘাড় কাত করে বলল, জি আচ্ছা। ছোট ভাইকে আপনি করে। বলা লোকে শুনলে ছিঃ ছিঃ করবে। তবে দিনে দিনে অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে তাতে মনে হয়। খুব শিগগিরই সে আপনি বলা শুরু করবে। কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে। বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে গেলে কেমন হয়? বিছানা-বালিশ নিয়ে হাঁটা দেয়া? কিছু ব্যবস্থা কি আর হবে না? রেল স্টেশনে গিয়ে শুয়ে থাকা যায়। সরকারি জায়গা, কারো কিছু বলার নেই। তবে লোক জানাজানি হবে। তাতে আবদুল করিমেরই অপমান। নিজের ছোট ভাই, তার অপমান হতে দেয়া যায় না। ভাই তেমন খারাপ কিছুও না। তিন বছর ধরে তো তার ঘাড়ে বসেই খাচ্ছে। এখনো তো বাড়ি থেকে বের করে দেয়নি। দুজনের আলাদা সংসারের কত মজা। মোবারকের কারণে তাদের সেই মজা হচ্ছে না। ওদের দিকটাও তো দেখতে হবে।

রাত দশটার পর থেকে ক্ষুধায় মোবারক চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। তার মনে হচ্ছে গত কয়েক বছরে এমন খিদে তার লাগেনি। খিদের চোটে মাথার ভেতরে পর্যন্ত ভো ভো শব্দ হচ্ছে। তার পাশে রাখা সবুজ শাটটায় কেউ লবণ মাখিয়ে দিলে সে সবজি মনে করে খেয়ে ফেলতে পারে এমন অবস্থা। লাল টুকটুক মেয়েটাও চলে গেছে। মোবারকের অংশটা কখন হবে সে বুঝতে পারছে না। ডাইরেক্টার সাহেব একবার কিছুক্ষণের জন্যে তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সে ইচ্ছা করলে তাকে জিজ্ঞেস করতে। পারত। সাহসে কুলায়নি, কারণ তাঁকে দেখাচ্ছিল পাগলের মত। তার নাকি প্রেশারের। সমস্যা আছে। কিছুক্ষণ আগে মাথায় পানি ঢেলেছেন। চুল বেয়ে এখনো ফোটা ফোটা। পানি পড়ছে। চোখ লাল। এরকম অবস্থায় কিছু জিজ্ঞেস করা যায় না।

মোবারকের বাথরুমও পেয়েছে। মনে হচ্ছে পেতলের বড় কলসিতে এক কলসি পানি পেটে জমা হয়েছে। জায়গা ছেড়ে যেতে সাহসে কুলাচ্ছে না। কখন তার ডাক পড়বে কিছু বলা তো যায় না। বারশ টাকা নগদানগদি পাওয়ার কথা। যে তাকে এনে। দিয়েছে সে তাই বলেছে। বারশ টাকা পেলেও দুশ টাকা তাকে কমিশন দিতে হবে।

হাতে থাকবে এক হাজার, সেটাও কম কি? একটা লোক সারাদিন মাটি কেটে পায় ষাট টাকা। আর সে আঁ বলে একটা চিৎকার দিয়ে পাবে বারশ টাকা। বিশ্বাস হতে চায় না। তবে ফিলের সব ব্যাপারই তো অবিশ্বাস্য। হতেও পারে। দেখা যাক। টাকাটা পেলে লতিফাকে একটা শাড়ি কিনে দিতে হবে। বিয়েতে কিছু দেয়নি অথচ সে হল ভাসুর। হাজারখানিক টাকায় সোনার কিছু পেলে তাই দিত। শাড়ি তো আর থাকবে না। সোনাটা থাকবে। নিজের মেয়েদের গল্প করতে পারবে–এটা আমার ভাসুর দিয়েছেন। মেয়েরা এই জাতীয় গল্প করতে খুব পছন্দ করে। কোন গয়না কে দিয়েছে। এটা তাদের একশ বছর পরেও মনে থাকে।

রাত সাড়ে বারটার সময় ডাইরেক্টার সাহেব তার কাছে এসে বললেন, কি যেন নাম তোমার?

স্যার মোবারক।

শোন মোবারক, তোমার অংশটা আজ হচ্ছে না।

কবে হবে স্যার?

বলা যাচ্ছে না। নাও হতে পারে। বিগ স্ক্রিনে আঙুল কাটাকাটি ভাল লাগবে না। যাই হোক, তুমি তোমার ঠিকানা রেখে যাও। প্রয়োজনে খবর দিব। প্রডাকশনের কে আছে এখানে? মোবারককে রিকশা ভাড়া দিয়ে দে।

স্টুডিওর গেট থেকে বেরুতে বেরুতে একটা বেজে গেল। টাউন সার্ভিস বন্ধ। হেঁটে বাসায় ফেরা ছাড়া উপায় নেই। রিকশা ভাড়া পাওয়া যায়নি। যার দেবার কথা সে। গম্ভীর মুখে বলেছে, সব বড় নোট। ভাংতি নাই। আরেক দিন এসে রিকশা ভাড়া নিয়ে। যাবেন।

মোবারকের পকেটে দুটা মাত্র টাকা। হাঁটা ছাড়া উপায় কি? প্রায় চার মাইল পথ। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত তিনটা। এত রাতে ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না। আবদুল। করিমের আবার ঘুমের অনেক নিয়ম-কানুন আছে। একবার ঘুম ভাঙলে আর ঘুম আসে না। রাত তিনটায় বাড়ি ফেরাটা সে কিভাবে নেবে সেটাও একটা কথা। রেল স্টেশনে রাতটা কাটিয়ে ভোরবেলা বাড়ি ফেরাই সবচেয়ে ভাল। কিন্তু খিদেটা অসম্ভব কষ্ট দিচ্ছে। বাসায় ফিরে চারটা ভাত না খেলেই না। লতিফা ঠাণ্ডা কড়কড়া ভাত দেবে না। ভাত তরকারি সব গরম করবে। লেবু থাকলে লেবু কেটে দেবে। একবার সে কাঁচামরিচ চেয়েছিল। ঘরে কঁচামরিচ ছিল না। সে শুকনো মরিচ পুড়িয়ে তেল দিয়ে মেখে দিয়েছে। এটা কোন মেয়ে করে না। লতিফা করে। তার জন্যে শাড়িটা কেনা গেল না। এটা একটা আফসোস।

গেটের সামনে এসে মোবারক অবাক। বারান্দায় বাতি জ্বলছে। আবদুল করিম। বসে আছে বারান্দায়। তার পাশে লতিফা। মোবারককে দেখে আবদুল করিম কিছু বলল না। উঠে ভেতরে চলে গেল। লতিফা বলল, আপনি কোথায় ছিলেন ভাইজান? সে চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। দুশ্চিন্তা করলে তার হাঁপানির টান উঠে। আমি তো আর সেটা জানি না। রাত একটা থেকে হাঁপানির টান উঠেছে। বারান্দায় বসে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। আমি ভয়ে অস্থির।

মোবারক লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল।

লতিফা বলল, ভাত খেয়ে এসেছেন?

না।

হাত-মুখ ধুয়ে আসেন ভাত দেই। কোথায় ছিলেন বলেন তো!

ভাত খাওয়ার সময় লতিফা সামনে থাকে। আজ নেই। না থাকলেই ভাল। আরাম করে খাওয়া যায়। অন্যের সামনে বিশ্রী ভঙ্গিতে দুআঙুলে নলা করে ভাত মুখে তুলতে ভাল লাগে না।

হাত ধোয়ার সময় লতিফা শুকনো মুখে সামনে দাঁড়াল।

ভাইজান, ওর হাঁপানির টানটা তো কমছে না। কেমন কেমন করে যেন শ্বাস নিচ্ছে। আমার তো খুব ভয় লাগছে। আপনি একটু এসে দেখে যান।

আসতেছি। তুমি কোন চিন্তা করবা না। ওর এইটা পুরানা অসুখ। ছোটবেলা কত হয়েছে। একবার হল কি, ইস্কুলের কিছু দুষ্ট ছেলে আমাকে ধরে খুব মার দিল। নাক দিয়ে রক্ত-টক্ত বের হয়ে বিশ্রী অবস্থা। তাই দেখে করিমের হাপানির টান উঠে গেল। এখন-তখন অবস্থা, তাকে নিয়ে গেলাম সদর হাসপাতালে। চিন্তা কর অবস্থা! ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তের বন্ধন তো। এই কারণে এরকম হয়।

আবদুল করিমের অবস্থা আসলেই খারাপ। শোঁ শোঁ শব্দ করে শ্বাস নিচ্ছে। মোবারককে দেখে সে চি চি করে ডাকল–ভাইজান!

মোবারক বলল, কথা বলিস না। চুপ করে শুয়ে থাক। আমি সতীশ ডাক্তারকে নিয়ে আসি।

সে অনেকদিন পর ভাইকে তুই বলল। তুই বলতে গিয়ে তার গলা ব্যথা করতে লাগল।

রাস্তাঘাট ফাঁকা। ফাঁকা রাস্তায় মোবারক এগুচ্ছে। তার কাটা আঙুলের চুলকানিটা এখন নেই। সতীশ ডাক্তারের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করতে হয়। বড়ই রহস্যময় ব্যাপার। জগৎটাই রহস্যময়।

এই অঞ্চলের সবকটা স্ট্রিট লাইট নষ্ট। শেষ রাতের চাঁদের আলোয় চারদিক আবছা আবছা দেখাচ্ছে। কলঙ্ক ভরা চাঁদের আলো এত সুন্দর কেন? এই ধরনের উচ্চ শ্রেণীর দার্শনিক চিন্তা করতে করতে মোবারক লম্বা লম্বা পা ফেলছে। দার্শনিক চিন্তার কারণেই বোধহয় তার চোখ একটু পরপরই জলে ভিজে যাচ্ছে।
 
আমরা কোথায় চলেছি?



ভদ্রলোক একজন সিএ। নিজের ফার্ম আছে। ভাল রোজগার করেন। ছেলেমেয়েরা সব বড় হয়ে গেছে। তার সর্ব কনিষ্ঠা কন্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. পড়ছে। অতি সজ্জন মানুষ। বিনয়ী, ভদ্র এবং খানিকটা লাজুক ধরনের। তিনি তার মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে, তারা দুজন পেছনের সীটে বসেছেন। গল্পগুজব করছেন। গাড়ি বড় রাস্তা ছেড়ে বাইলেনে ঢুকল। ট্রাফিক জ্যাম। ড্রাইভারকে আস্তে আস্তে এগুতে হচ্ছে–হঠাৎ দুর্ঘটনা–একটা ছেলে চেঁচিয়ে উঠল। তার পায়ের পাতার উপর দিয়ে গাড়ি চলে গেছে। ছেলেটি চেঁচাচ্ছে–মেরে। ফেলেছে। আমাকে মেরে ফেলেছে।

ভদ্রলোক ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন। ড্রাইভার বলল, স্যার, এই ছেলে বদমায়েশী করছে। গাড়ি ওর পায়ের উপর দিয়ে যায় নাই।

তুমি থাম।

ড্রাইভার গাড়ি থামাল। দেখতে দেখতে লোক জমে গেল। ছেলেটি দেখা গেল একা নয়। সঙ্গে অনেক বন্ধু বান্ধব আছে। তারা হুংকার দিচ্ছে–ভাঙ, গাড়ির কাচ ভাঙ। হারামজাদাকে টাই ধরে নামা।

তিনি বিব্রত। সঙ্গে তরুণী মেয়ে। ছেলেরা যেসব ভাষা ব্যবহার করছে তা নিজের। কন্যাকে পাশে নিয়ে শোনা যায় না। তিনি বললেন, তোমার পায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চলে গিয়ে থাকলে খুব অন্যায় হয়েছে। তুমি উঠে বস। আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে। যাই।

চুপ থাক শালা। টেকা বের কর, ক্ষতিপূরণ দে। পাঁচ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ।

ভদ্রলোক হতভম্ব হয়ে পড়লেন। তার কন্যা কাঁদতে শুরু করল। এতগুলি মানুষ। চারদিকে। কেউ কিছু দেখছে না। সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তিনি কি করবেন। ভেবে পেলেন না। সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকাও নেই। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, এত টাকা সঙ্গে নেই।

না থাকলে গাড়ি রেখে যা। টাকা দিয়ে গাড়ি ছাড়িয়ে নিবি।

একজন অসহিষ্ণু গলায় বলল, দেরি করছ কেন? একটা ইট এনে গাড়ির কাচ ভাঙা শুরু কর।

ভদ্রলোক মানিব্যাগে যা টাকা ছিল সব দিলেন। হাতের ঘড়ি খুলে দিলেন। মেয়েটি সমানে কাঁদছে। তিনি মেয়ের পিঠে হাত রেখে বললেন–

এই দিন তো দিন নয় আরো দিন আছে
এই দিনেরে নিবে তোমরা সেই দিনেরো কাছে।

গল্পটা আমি মেয়েটির কাছ থেকে শুনি। আমাকে এই গল্প শোনানোর তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে–আমাকে জানানো যে তার বাবা চরম দুঃসময়ে আমার ব্যবহৃত দুটি কবিতার চরণ আবৃত্তি করেছেন।

সমস্যা হচ্ছে, কবিতার চরণ কি সমস্যার সমাধান? আমরা কোথায় চলেছি? মানুষের যাত্রা সব সময় অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। আমরা কি অন্ধকারে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছি? তরুণ ছেলেরা এ কী খেলায় মেতেছে? সমাজে প্রতারক থাকে। কিন্তু তরুণ ছেলেদের এই ভূমিকায় আমরা তো আগে কখনো দেখিনি। এদের চোখে থাকবে স্বপ্ন। এদের মনে থাকবে আশা ও আনন্দ। আজ এদের হৃদয়ে অন্ধকার জমাট বাধতে শুরু করেছে।

কাঠগড়ায় কাদের আগে দাঁড় করাব? ঐ সব ছেলেদের বাবা-মাদের? নাকি শিক্ষকদের? নাকি দেশের কবি-সাহিত্যিকদের?

এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ জন্মায় হৃদয়ে জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে। সেই প্রদীপ যেন সারা জীবন জ্বলতে পারে সে জন্যে বাবা-মারা প্রদীপে তেল ঢেলে দেন। বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরাও এই কাজটি করেন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষকরা এই দায়িত্ব পালন করেন। দেশের কবি-সাহিত্যিকরাও এই কাজটি পরোক্ষভাবে করেন। তাহলে কি ধরে নেব, প্রদীপে তেল ঢালার কাজটি আমরা করতে পারছি না? প্রদীপ যখন পূর্ণ। জ্যোতিতে জ্বলার কথা, তখন তা নিভে যাচ্ছে।

দিনে দুপুরে সবার চোখের সামনে মেয়েদের গলার চেইন ধরে টান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখছি, কিন্তু এগিয়ে আসছি না। একটি প্রতিবাদের বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না। কেন? আমরা কি মানসিকভাবে এইসব অপরাধ জীবনের অংশ হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছি?

হাইওয়েতে এক্সিডেন্ট হয়। আহত মানুষটিকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে তার জীবন রক্ষা হবে। কিন্তু কোন গাড়ি থামে না। এক্সিডেন্ট করে একজন মরতে বসেছে, মরুক। আমাকে দ্রুত পৌঁছতে হবে। এ দেশের একজন অভিনেতার স্ত্রীর এমন দূর্ভাগ্যজনক মৃত্যু হয়েছে বলে খবরের কাগজে পড়লাম। রক্তে ভেসে যাওয়া এই মহিলা তার জীবনের চরম সংকটের মুখেও পাশে। দাঁড়ানো ছেলেমেয়েদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন–তোমরা কেঁদো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিছুই ঠিক হয়নি। একটি গাড়িও থামেনি। মহিলাকে দীর্ঘ পথ নেয়া হয় রিকশায় করে। তিনি মারা যান। যে কটি গাড়ি সেই সময় তাকে ফেলে রেখে চলে গেছে, তার সব আরোহীদের কি হত্যা-অপরাধে বিচার হওয়া উচিত নয়?

শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষের আজ এ কী পরাজয়? আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই মহান বাণী।–Man can be destroyed but not defeated-এর উল্টোই কেন দেখছি? কেন। আমরা বারবার পরাজিত হবার পথ বেছে নিচ্ছি?

একটা গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, আরেকটি গল্প দিয়ে শেষ করি। স্থান। সেকেণ্ড ক্যাপিটেল। সময় সন্ধ্যা। রিকশা করে একটি একটি মেয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ পাশে একটা বেবিটেক্সি এসে থামল। তিন তরুণ বের হয়ে এল। একজনের হাতে ভয়াল ছোরা। তাদের দাবি–গলার চেইন, হাতের চুড়ি খুলে দিতে হবে। মেয়েটি চেইন খুলে দিল, হাতের চুড়ি খুলছে। খোলা যাচ্ছে না। তিন তরুণই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। এই সময় প্রায় সত্তর বছরের একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন–চিৎকার করে বললেন, তোমরা। এইসব কি করছে? খবরদার বললাম। খবরদার।

ছুরি হাতে তরুণটি ক্রুদ্ধ গলায় চেঁচিয়ে উঠল–জানে শ্যাষ কইরা দিমু।

বৃদ্ধ বললেন, দাও, জানে শেষ করে দাও। কিন্তু আমার চোখের সামনে আমি অন্যায় হতে দেব না।

দুর্বল অশক্ত শরীরের এই বৃদ্ধ শক্ত গ্রানাইট পাথরের এক দেয়াল হয়ে মেয়েটির সামনে দাঁড়ালেন। ছেলেগুলির সাধ্য কি সেই দেয়াল ভেদ করে! বৃদ্ধ হুংকার দিলেন, এই মেয়ের চেইন ফেরত দাও। এর কাছে মাফ চাও–ততক্ষণে লোক জমে গেছে। একটি পুলিশের গাড়ি এগিয়ে আসছে। যে বেবীটেক্সি করে এরা এসেছিল সেই বেবীটেক্সিওয়ালা তার গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। আর দেরি করা যাবে না। পালিয়ে যেতে হবে।

তারা মেয়েটির চেইন ফেলে দিয়ে লাফিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল।

ঐ বৃদ্ধকে আমি দেখিনি। আমি তার গল্প শুনেছি। আজকে এই লেখার মাধ্যমে আমি দূর থেকে তার পদস্পর্শ করছি। পবিত্র মানুষের স্পর্শে অন্তর পবিত্র হয়। আমরা সবাই অশুচি হয়ে আছি–কিছু পবিত্র মানুষের বড়ই প্রয়োজন আমাদের।
 
আমার বন্ধুরা




বইমেলার সময় শেষ।

এ সাতটাতেই সময় শেষ হয়, এখন বাজছে নটা।

কোথাও কেউ নেই নামের স্টলে বসে আছি। হলুদ পর্দা ফেলে দেয়া হয়েছে। চা এসেছে, ঝালমুড়ি এসেছে।

চা, ঝালমুড়ি, সিগারেট সমানে খাওয়া হচ্ছে। দিনের ক্লান্তির শেষে জমিয়ে আড্ডা দেয়া। অতি সামান্য রসিকতাতেই আমরা হো হো করে হাসছি। মনে হচ্ছে এই জীবনটা তো খুব খারাপ না।

এমন এক আনন্দময় সময়ে মনে পড়ল জনৈক তরুণ আমাকে একটা স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, বাসায় গিয়ে পড়বেন।

স্লিপে মজার কিছু থাকতে পারে, মজার সেই ব্যাপার নিয়ে সবাই আরো আনন্দ করতে পারেন ভেবে স্টলে বসেই স্লিপটা পড়লাম। মুহূর্তেই সমস্ত আনন্দ বাতাসে মিশে গেল। স্লিপটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেললাম–আমার বন্ধুরা যেন সেই লেখা পড়তে না পারেন। যে আনন্দ-মুহূর্ত আমরা তৈরি করেছি–স্লিপের এই লেখা সেই আনন্দকে বিষাক্ত করে তুলবে।

আড্ডার একজন বললেন, কি লেখা?

আমি বললাম, গালাগালি।

অভিনেতা মোজাম্মেল হোসেন বললেন, চিঠি লিখে গালাগালি কেন? মুখে গালাগালি করলেই হয়। গালাগালি যদি কেউ শুনতেই না পেল, তাহলে কিসের গালাগালি?

সবাই হাসতে শুরু করল। আমিও হাসছি। আড্ডার আনন্দধারা প্রবাহিত হচ্ছে আমি সেই ধারায় নিজেকে যুক্ত করতে পারছি না। স্লিপের সামান্য কয়েক লাইন আমাকে তীব্র যন্ত্রণার মুখোমুখি করে দিল।

না, সেখানে গালাগালি ছিল না। গালাগালিতে আমার কিছু হয় না। আমি এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমার অতি প্রিয়জনরাও আমাকে লিখিতভাবে পত্রিকার ছাপার অক্ষরে এত গালাগালি করেছেন এবং এমন নোংরা ভাষা ব্যবহার করেছেন যে ট্যানারিতে না গিয়েও আমার চামড়া ট্যান হয়ে গিয়েছে। এই চামড়ায় কিছুই লেগে থাকে না। পিছলে যায়। উদাহরণ দিতে পারতাম, ইচ্ছে করছে না। রুচিতে বাধছে।

মানুষের গালাগালি, অপমান এইসব আমি সেধে এনেছি। আমি যদি লেখালেখি না। করতাম, যদি নিজের ছোট্ট সংসারে নিজেকে আটকে রেখে জীবন পার করে দিতে পারতাম তাহলে কেউ আমাকে গালাগালিও করত না, অপমান করার সাহসও পেত না। ধন নয়, মান নয় এতটুকু বাসার ফিলসফি মন্দ নয়।

জীবনের শুরুতে আমার আশা-আকাঙ্ক্ষা এতটুকুই ছিল–তারপর কি যে হল, এক নিশিরাতে আমার ছোট্ট ঘরে জোছনার আলো এসে পড়ল। ইচ্ছে করল জোছনার এই আলোর কথা সবাইকে জানিয়ে দি। কাগজ এবং কলম হাতে তুলে নিলাম। একদল চোখ লাল করে বললেন–কি লিখছে এসব? গেল গেল, সাহিত্য গেল! বই পাড়া ভর্তি হয়ে গেল জঞ্জালে। ঘর মে এত্তা জঞ্জাল। তাঁরা মর্জিনা হয়ে ঝাড়ুর সন্ধানে গেলেন। অতি বিজ্ঞদের একজন, যার জীবনের একমাত্র ব্যর্থতা না কি ব্যর্থতার অভাব, ভুরু কুঁচকে ভাবতে বসলেন এই সাহিত্যের কি নাম দেয়া যায়? নাম খুঁজেও পেলেন–অপন্যাস। তার মহান আবিষ্কার স্বাভাবিক নিয়মে তার কাছেই ফিরে। গেছে। জীবনের গভীর সত্য অনুসন্ধানের ভান যারা করেন তারা কখনোই সহজ সত্য টের পান না। এও এক অমোঘ জাগতিক নিয়ম।

যাই হোক। স্লিপের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। সেখানে লেখা—

হুমায়ূন সাহেব,

আপনাকে সব সময় ঘিরে থাকে একদল মুর্খ প্রকাশক এবং কিছু শিক্ষিত মুর্খ চাটুকার। মোসাহেব ছাড়া আপনি চলাফেরা করতে পারেন না। আপনার সবচে ক্ষতি করছে স্তাবকরা এবং মুর্খ প্রকাশকরা। এদের ত্যাগ করুন। আখেরে ভাল হবে।

অথচ আমার চারপাশে যারা বসে আছেন এঁরা আমার অতি প্রিয়জন। লেখালেখি করতে গিয়ে আমি তো সবই ত্যাগ করেছি। আর কত? আমার পাশে বসে আছেন সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। আমরা স্তাবকতা করে তার কিছু পাবার নেই। আছেন কবি হাসান হাফিজ। তার থাকা উচিত ছিল কবিদের সঙ্গে। কিন্তু তিনি কবিদের ছেড়ে একজন গদ্যকারের সঙ্গে কেন আড্ডা দিতে আসেন, তা তিনিই জানেন। দৈনিক বাংলার জন্যে লেখা দরকার, এই কারণেই কি তার আমার পাশে বসে থাকা? আমার স্তাবকতা করার জন্যে দৈনিক বাংলা তাঁকে বেতন দিচ্ছে না।

আমি আমার নিজের নিঃসঙ্গতা ঘোচাবার জন্যে এঁদের আটকে রাখি। পত্রিকার কাজের দোহাই দিয়ে হাসান হাফিজ উঠতে যান–আমি তার শার্ট খামচে ধরে বলি–অসম্ভব যেতে পারবেন না। থাকতে হবে।

হাসান হাফিজ রুখে গিয়ে বলেন আপনার না হয় চাকরি বাকরির ব্যাপার নেই। অটোগ্রাফ দিতে পারলেই হল। কিন্তু আমি তো চাকরি করি।

অসম্ভব। আপনাকে কিছুতেই যেতে দেয়া হবে না।

হতাশ হয়ে তিনি বসে পড়েন।

শুরু হয় গল্প। সেই গল্পে আর যাই থাকুক হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য থাকে। এরা আমার অতি প্রিয়জন। নিজের অপমান আমি সহ্য করতে পারি, বন্ধুদের অপমান কখনোই না।

প্রকাশকদের কথা বলা হচ্ছে–হ্যাঁ আমাকে দিয়ে তাদের কিছু স্বার্থ সিদ্ধি তো হবেই। কিন্তু একটা ব্যাপার ভুললে চলবে না। এঁরা আমার উপর যতটা নির্ভরশীল–আমি তাদের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। আমার লেখা এদেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে পৌঁছে দিচ্ছেন তারাই। আজকের এই বইমেলার বিশাল আয়েজনের নেপথ্য নায়ক এঁরাই। পাঁচ বছর আগের বইমেলার সর্বাধিক বিক্রিত একটি গ্রন্থের বিক্রয় সংখ্যা ছিল সাত শ। আজ একজন নবীন লেখকের লেখাও মেলার প্রথম দশদিনে এক হাজার কপির বেশি বিক্রি হয়।

মানুষকে গ্রন্থের প্রতি আগ্রহী করার প্রধান ভূমিকা এই প্রকাশকদের। এঁরা ব্যবসায়ী। একজন ব্যবসায়ী লাভ-লোকসান দেখবেন। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে, এরা লাভ-লোকসান বিবেচনা করে চিনি বা পেঁয়াজের ব্যবসায় যাননি। এসেছেন বই-এর ব্যবসায়, যার কোন স্থিরতা নেই। এঁদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে পাশের দেশের শক্তিমান প্রকাশকদের সঙ্গে। যাদের আছে দীর্ঘদিনের প্রকাশনার অভিজ্ঞতা।

আমার বই-এর যারা প্রকাশক তারা সবাই অল্পবয়স্ক। কারো বয়সই আমার। চেয়ে বেশি নয়। প্রতিষ্ঠিত পুরানো প্রকাশকরা আমার প্রতি আগ্রহী হননি। আগ্রহী হয়েছেন তরুণ-প্রকাশকরা–আজ আমাদের প্রকাশনা শিল্পের যে জয়জয়কার তা তাদের উদ্যম এবং কর্মপ্রচেষ্টার সোনালী ফসল।

কলকাতার প্রকাশকরা সেখানে আমার নয়টি বই প্রকাশ করেছেন। মনিলিখো কাগজ নামে চমৎকার কাগজ ব্যবহার করেছেন। তারপরেও সেসব বই এবং এদেশে। প্রকাশিত আমার বইগুলি যখন পাশাপাশি রাখি তখন কোন রকম দ্বিধা ছাড়াই বলতে বাধ্য হই–আমাদের দেশে প্রকাশিত বইগুলির প্রকাশনা মান অনেক অনেক উপরে।

আমরা যাত্রা শুরু করেছি–এই যাত্রা দীর্ঘ যাত্রা। পথ তৈরি নেই। বন কেটে পথ বানাতে হচ্ছে। বানাচ্ছেন এই সময়ের তরুণ প্রকাশকরা। তাদের মুখ বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চাইলে করা যেতে পারে। কিন্তু এই মুর্খ(!)রাই চেষ্টা করে যাচ্ছেন যেন। দেশ থেকে মুর্খ শব্দটি উঠে যায়।

আমার বন্ধু এঁরাই। মহা আঁতেল বিজ্ঞ পণ্ডিতরা নন। আমার লেখা ছেপে ওঁরা যে অপরাধ করেছেন–বিজ্ঞ পণ্ডিতদের লেখা ছেপে সেই অপরাধ তারা কাটান দেবার চেষ্টাও করছেন। অন্তত এই ধন্যবাদটুকু তো তাদের প্রাপ্য।
 
আমার বাবার জুতা



বিজয় দিবসের কতো সুন্দর স্মৃতি মানুষের আছে। সেসব স্মৃতিকথা অন্যকে শোনাতে ভালো লাগে। প্রেমিকার প্রথম চিঠি পাওয়ার গল্প বলার সময় যেমন রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়, বিজয় দিবসের গল্প বলার সময়ও তাই হয়। আমার বন্ধু দৈনিক বাংলার সালেহ চৌধুরীকে দেখেছি বিজয় দিবসের স্মৃতিকথা বলার সময় তার চোখে পানি এসে পড়ে। যদিও তেমন কিছু উল্লেখ করার মতো স্মৃতি নয়। তিনি তার মুক্তিযোদ্ধা দলবল নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। হঠাৎ শুনলেন দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। যুদ্ধের অবসান হয়েছে, আর গুলি ছুঁড়তে হবে না। তিনি রাইফেল ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদতে শুরু করলেন। এই গল্প বলার সময় কেউ কাঁদতে শুরু করলে তাকে দোষ। দেওয়া যায় না।

আমার দূর সম্পর্কের এক চাচা বিজয় দিবসের স্মৃতি এভাবে বলেন, খবরটা শোনার পর কানের মধ্যে তবদা লেগে গেল। তার কিছুই কান দিয়ে ঢুকে না। আমি দেখছি সবার ঠোট নড়ে, কিন্তু কিছু শুনি না। আজব অবস্থা!

১৬ ডিসেম্বর কাছাকাছি এলেই পত্রিকাওয়ালারা বিজয় দিবসের স্মৃতিকথা ছাপানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা কখনোই ভাবেন না, সেদিনের কথা। যথাযথভাবে বলা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। সেদিন আমরা সবাই ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ঘোরের স্মৃতি হলো এলোমেলো স্মৃতি। ঘোরের কারণে তুচ্ছ জিনিসকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। মস্তিষ্ক খুব যত্ন করে তার মেমোরি সেলে তুচ্ছ জিনিসগুলো রেখে দেয়। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সে অদরকারি মনে করে ফেলে দেয়।

একজন মাতালকে নেশা কেটে যাবার পর যদি জিজ্ঞেস করা হয়, নেশা করার ঐ রাতে তুমি মদ্যপান ছাড়া আর কী করেছিলে? সে পরিষ্কার কিছু বলতে পারবে না। বলতে পারার কোনো কারণ নেই। বিজয় দিবসে আমরা সবাই এক প্রচণ্ড নেশার মধ্যে ছিলাম। কাজেই, হে পত্রিকা সম্পাদক, আপনি কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। জিজ্ঞেস করলেই আমরা উল্টাপাল্টা কথা বলবো। আপনার ধারণা হবে আমরা মিথ্যা কথা। বলছি। কিন্তু আমরা কেউ মিথ্যা বলছি না। দেশের স্বাধীনতা নিয়ে কি আর মিথ্যা গল্প করা যায়?

আজ আমি বিজয় দিবসের স্মৃতির গল্প করবো না। আমি বরং আমার বাবাকে নিয়ে একটি গল্প বলি। এই মহান ও পবিত্র দিনে গল্পটি বলা যেতে পারে।

আমার বাবার এক জোড়াই জুতা ছিল। লাল রঙের চামড়ার জুতা। মাল্টিপারপাস জুতা। সাধারণভাবেও পরতেন, আবার তার পুলিশের ইউনিফর্মের সঙ্গেও পরতেন। জুতা জোড়ার সঙ্গে আমরা খুব পরিচিত, কারণ আমাদের প্রায়ই তার জুতা কালি করতে হতো। কাজটা আমাদের খুব পছন্দের ছিল। জুতার কালির গন্ধটা খুব মজা লাগতো। আবার ব্রাশ ঘষতে ঘষতে জুতা যখন ঝকঝকে হয়ে উঠতো, তখন দেখতে ভালো লাগতো। সবচেয়ে বড় কথা–ঝকঝকে জুতা দেখে বাবা বলতেন, আরে বাপ রে, একেবারে আয়না বানিয়ে ফেলেছে। এই বাক্যটি শুনতেও বড় ভালো লাগতো।

১৯৭১ সালের ৫ মে আমার বাবা তার লাল জুতা পরে বরিশালের গোয়ারেখো গ্রাম। থেকে বের হলেন। সেদিন জুতা জোড়া কালি করে দিলো আমার ছোট বোন। বাবা। যথারীতি বললেন, আরে বাপ রে, একেবারে আয়না বানিয়ে ফেলেছিস। সেই তার জুতা পরে শেষ বের হয়ে যাওয়া।

সন্ধ্যার সময় খবর এলো–বলেশ্বর নদীর তীরে দাঁড় করিয়ে মিলিটারিরা তাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। মানুষকে যে এতো সহজে মেরে ফেলা যায়, তা আমার মা তখনো জানতেন না। তিনি খবরটা বিশ্বাস করলেন না। তিনি আমাদের ডেকে বললেন, তোরা এই লোকগুলোর কথা বিশ্বাস করিস না। তোর বাবা সারা জীবনে কোন পাপ করেনি। এ রকম মৃত্যু হতে পারে না। তোর বাবা অবশ্যই বেঁচে আছে। যেখানেই থাকুন তিনি যেন সুস্থ থাকেন, এই দোয়া করি। আমি জানি তোর বাবার সঙ্গে তোদের আবার দেখা হবে অবশ্যই।

একজনের বিশ্বাস অন্যের মধ্যে সংক্রমিত হয়। আমরা সবাই মার কথা বিশ্বাস করলাম। এর মধ্যে মা এক রাতে স্বপ্নেও দেখলেন, মিলিটারিরা বাবাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে সেখানেই এক জেলে আটকে রেখেছে। বাবা স্বপ্নে মাকে বললেন, দেশ স্বাধীন হলেই এরা আমাকে ছেড়ে দেবে। তখন তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে। এই কদিন একটু কষ্ট করে থাক।

মা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিছুই খেতে পারতেন না। এই স্বপ্নের পর আবার অল্পস্বল্প খেতে শুরু করলেন। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম স্বাধীনতার দিনটির জন্য। আমরাও মার মতোই ধরে নিয়েছিলাম, দেশ স্বাধীন হলেই বাবাকে পাওয়া যাবে। মার প্রতি আমাদের এই অবিচল বিশ্বাসের কারণও আছে। আমার মা কখনোই তার ছেলেমেয়েদের কোনো ভুল আশ্বাস দেননি।

আমরা তখন গ্রামে পালিয়ে আছি। মে মাস প্রায় শেষ হতে চলেছে। ঘোর বর্ষা। দিনের পর দিন একনাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। তখন অদ্ভুত একটা খবর পাওয়া গেলো। এক লোক নাকি বলেশ্বর নদী দিয়ে ভেসে যাওয়া একটা লাশ তুলে কবর দিয়েছে। তার ধারণা, এটা পিরোজপুরের পুলিশ প্রধান ফয়জুর রহমান আহমেদের লাশ। সে লাশটা কবর দিয়েছে, তবে প্রমাণের জন্য লাশের পা থেকে জুতা জোড়া খুলে রেখেছে। এই জুতা জোড়া সে আমাদের হাতে তুলে দিতে চায়। আমার মা বললেন, অসম্ভব! এটা হতেই পারে না। নিশ্চয়ই অন্য কারো জুতা। তবু পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হবার জন্য আমাকে জুতা আনতে শহরে পাঠালেন। আমাকে পাঠানোর কারণ হলো, আমার মার ধারণা, আমি খুব ভাগ্যবান ছেলে। আমি কখনো অমঙ্গলের খবর আনবো না।

মিলিটারিতে তখন পিরোজপুর গিজগিজ করছে। এই অবস্থায় কোনো যুবক ছেলের শহরে ঢোকা মানে জীবন হাতে নিয়ে ঢোকা। তার উপর শুনেছি, মিলিটারিরা। আমাকে এবং আমার ছোট ভাইকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

আমি শহরে গেলাম লুঙ্গি, পাঞ্জাবি এবং টুপি মাথায় দিয়ে, যেন কেউ চিনতে না পারে। ঐ লোককে খুঁজে বের করলাম। আমাকে জুতা জোড়া দেওয়া হলো। হ্যাঁ, আমার বাবারই জুতা। ভুল হবার কোনোই কারণ নেই। জুতা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরলাম। আমার মা জুতা দেখলেন। তিনিও বুঝলেন এটা কার জুতা, তারপরও বিশ্বাস করলেন না। এরকম জুতা তো কতো মানুষেরই থাকতে পারে। তিনি আমাদের বললেন, জুতা দেখে তোরা মন খারাপ করিস না। এটা মোটেই কোনো জোরালো প্রমাণ না। জুতা জোড়া কাগজে মুড়ে এক কোণায় রেখে দেওয়া হলো।

দেশ স্বাধীন হবার পর পর মা ঢাকা থেকে পিরোজপুর গেলেন। নদীর পাড়ে যেখানে বাবাকে কবর দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছে, সেই জায়গা নিজে উপস্থিত থেকে খোঁড়ালেন। কবর থেকে লাশ তোলা হলো। শরীর পচে-গলে গেছে, কিন্তু নাইলনের মোজা অবিকৃত। মা পায়ের মোজা, দাঁত, মাথার চুল দেখে বাবাকে শনাক্ত করলেন। দীর্ঘ ছমাস পর তিনি স্বীকার করলেন, তার স্বামী বেঁচে নেই।

তিনি ঢাকায় ফিরে এলেন। আমাদের যে এতোদিন মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছেন, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেলন। আমার সবচেয়ে ছোট বোনটি অসুস্থ। সে কথা বলতে পারে না, কানেও শোনে না। মা আমার ছোট ভাইকে বললেন তাকে যেন বাবার মৃত্যুর ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলা হয়।

সন্ধ্যাবেলা মা কাগজের মোড়ক থেকে জুতা জোড়া বের করলেন। অনেক সময় নিয়ে পরিষ্কার করলেন। লাল কালি কিনে এনে জুতা কালি করা হলো। আমরা দেখলাম, তার বিছানায় বালিশের পাশে জুতা জোড়া রাখা হয়েছে। সেই রাতে তিনি বাবার জুতা জোড়া জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুতে গেলেন।

আজকের এই মহা আনন্দের দিনে আমি আপনাদের আমার একটি ব্যক্তিগত কষ্টের গল্প বললাম। আমার এই কষ্ট যেন আপনাদের আনন্দকে কোনোভাবেই ছোট না করে। আজকের দিনে কষ্টের কোনো স্থান নেই। আমার বাবা এই দেশকে ভালোবেসেছিলেন। আমিও বাসি। অবশ্যই আমার ছেলেমেয়েরাও বাসবে। আজকের দিনে এই ভালোবাসাই সত্য, আর সব মিথ্যা।

প্রতি বছর বিজয় দিবস আসে, আমি নিজের হাতে বাসায় একটা পতাকা টানাই। পতাকাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে বড় ভালো লাগে। আমার কী সৌভাগ্য, স্বাধীন দেশের পতাকা নিজের হাতে উড়াচ্ছি!

আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব,
ফুরায়ে গেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।
 
এই দিন তো দিন নয়



প্রাথমিক শিক্ষার উপর আমি কয়েকটা টিভি স্পট তৈরি করে দিয়েছি। ইদানীং এগুলি দেখানো হচ্ছে। আপনাদের চোখে পড়েছে কি? ঐ যে একটিতে লম্বা চুলওয়ালা এক বয়াতীকে দেখা যায়, সে এক দল বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে গান গাইতে গাইতে এগুতে থাকে—

এই দিন তো দিন নয় আরো দিন আছে
এই দিনেরে নিবে তোমরা সেই দিনেরো কাছে…

এক পর্যায়ে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মত সে সবাইকে নিয়ে যায় স্কুলের। দিকে। এখন কথা হল, যাদের জন্যে এই জিনিসটা তৈরি করা, তারা কি এটা দেখছে? এর কোন প্রভাব কি পড়ছে? না-কি অর্থ, শ্রম ও মেধাই সবাই মিলে নষ্ট করছি?

স্কুলের সময় চোখ খুলে তাকালে অস্বস্তিকর একটা দৃশ্য দেখা যায়। হাসিখুশি। ছোট ছোট বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে। তাদের ভারী স্কুলব্যাগ যারা টানছে তাদের অনেকের বয়সই স্কুলযাত্রীদের কাছাকাছি। এদের দায়িত্ব আপামণিদের বইয়ের ব্যাগ। স্কুলে পৌঁছে দেয়া।

আমাদের অনেকের বাড়িতেই অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েরা কাজ করে। তাদের কাজ শুরু হয় সূর্য ওঠার আগে, শেষ হয় গভীর রাতে। তাদের কাছে লেখাপড়া অনেক দূরের ব্যাপার। টিভিতে বিজ্ঞাপন প্রচারের আগে লেখাপড়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ওদের শিক্ষিত করার আগে শিক্ষিত করতে হবে তাদের, যারা শিক্ষিত হয়েই আছেন। মোটিভেশনাল ছবি এদের জন্যেই আগে করা দরকার।

আমার সঙ্গে এক ভদ্রলোক খুব তর্ক করলেন–সবাই শিক্ষিত হলে দেশ চলবে? একটা এম, এ. পাস ছেলে হাল চালাবে? শিক্ষিত বেকার দিয়ে হবে কি? এতগুলি বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েই বা হবেটা কি? বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আমাদের কি শেখাচ্ছে? সন্ত্রাস ছাড়া আর কি?

।এদের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। এরা সবকিছুই উল্টো দিক থেকে দেখেন। গোলাপ ফুল এনে দিলে প্রথমে খোঁজেন কাঁটা। তারপর ফুল। ফুল দেখে মুগ্ধ হয়ে কাঁটা অগ্রাহ্য। করার ক্ষমতা আমাদের দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা কেন জানি ছায়াটা আগে দেখতে শুরু করেছি।

আমি এক ডাক্তার সাহেবকে চিনি, যিনি তার সারাজীবনের সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ দিয়ে তার নিজ গ্রামে স্কুল এবং কলেজ করে দিলেন। গ্রামে রটে গেল, ডাক্তার সাহেব ইলেকশন করবেন। এসব তারই প্রস্তুতি। কেউ কেউ বললেন, বহু রোগী মেরে পাপ কামিয়েছে। এখন পাপ কাটানোর চেষ্টা।

মানুষের মুখের এসব কথায় কিছুই আসে যায় না। যা সত্য তা-ই টিকে থাকে। অসত্য স্থায়ী হয় না। সৌভাগ্যক্রমে সত্যকে ভালবাসেন, এমন মানুষের সংখ্যাই এই সমাজে শুধু যে বেশি তাই না, অনেক। এইসব মানুষ সমাজে প্রভাবকের মত কাজ করেন। একজন মন্দ মানুষকে দেখে আমাদের মন্দ হবার ইচ্ছা জাগে না। কিন্তু একজন ভালমানুষকে দেখে ভালমানুষ হতে ইচ্ছা করে।

আমার ছোটবেলায় সিলেটের মীরাবাজারে আমাদের বাসার পাশে একজন। ওভারশীয়ার থাকতেন। তিনি রোজ সন্ধ্যাবেলা তার ছেলে-মেয়েদের পড়াতে বসতেন। কাজের ছেলে ছিল, তাকেও পড়তে বসতে হত। এই ছিল কঠিন নিয়ম। পুরনো। ছেলেটি চলে যাবার পর নতুন কেউ এলে তার জন্যেও এই ব্যবস্থা। এ বাড়িতে কাজ নিলে পড়াশোনা করতে হবে এই ভয়ে কেউ তার বাসায় কাজ নিত না।

ভদ্রলোকের এই সৎগুণটি আমার মাকে প্রভাবিত করে। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখি, আমার মাও বাসায় এই নিয়ম চালু করেছেন। মার বাসায় যেই কাজ করবে। তাকেই পড়তে হবে। মা নিজেই পড়ান। আমার মার বেলায় সবই পণ্ডশ্রম হয়েছে। তিনি কাউকেই পড়ালেখা শেখাতে পারেননি। জানি না এর কারণ কি।

মার ব্যর্থতা পুষিয়ে দিয়েছে আমার মেজো মেয়ে শীলা। তার কাণ্ডকারখানা বেশ। মজার। সে তখন পড়ে ক্লাস ফাইভে। প্রায়ই দেখা যায়, সন্ধ্যাবেলা সে কাজের মেয়েদের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। আমরা খুবই বিরক্ত হই। দরজা বন্ধ করে। সে করে কি? জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না। মাথা নিচু করে থাকে।

আমার স্ত্রীর ধারণা হল, সে নিশ্চয়ই দরজা বন্ধ করে কাজের মেয়েগুলির সঙ্গে। গল্পগুজব করে। এটা ভাল লক্ষণ না। এদের কাছ থেকে সে আজেবাজে গল্প : শুনবে। শীলাকে একদিন প্রচণ্ড বকা দেয়া হল। তারপর রহস্য ভেদ হল। হেলেনা। নামে আমাদের ১২/১৩ বছর বয়েসী একটি কাজের মেয়ে আছে, তার লেখাপড়া। শেখার খুব শখ। সে শীলাকে ধরেছে। শীলা তাকে লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব। নিয়েছে। অনেকদূর না-কি শিখিয়েও ফেলেছে।

আমি পরীক্ষা নিতে গিয়ে চমৎকৃত হলাম। সত্যি সত্যি হেলেনা মেয়েটি পড়তে শিখেছে। বানান করে করে সুন্দর পড়তে পারে। আমি আমার মেয়েকে বললাম, মা, তুমি যে এই কাজটা করছ–গোপনে করছ কেন?

তোমরা যদি বকা দাও, এই জন্যে গোপনে করছি।

আমার এত ভাল লাগল যে বলার নয়।

আমার জীবনে অনেক আনন্দময় ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু এত আনন্দময় ঘটেনি। আমি আমার মেয়েকে পুরস্কার দিলাম।

আমার মেয়েটা জানে না সে কত বড় একটা কাজ করেছে। আমি জানি। পড়তে পারার মত আনন্দ আর কিসে আছে? মনের ভাবকে চিরস্থায়ী করে রাখার ক্ষমতা পরম করুণাময় মানুষকে দিয়েছেন। সে লিখতে পারছে। পশুদের সেই ক্ষমতা দেয়া হয়নি।

তারপরেও দেখি, মানুষ হয়েও একদল পড়তে পারছে না। লিখতে পারছে না। তারা থেকে যাচ্ছে পশুর স্তরে। ওদেরকে টেনে তুলে আনার দায়িত্বও আমরা অস্বীকার। করছি। আমাদের বাংলা ভাষায় খারাপ গালাগালির একটি হচ্ছে মুর্খ। অন্য ভাষায় সে রকম নেই। একজন ইংরেজ অন্য একজনকে gnorant বলে গালি দেয় না। এটা। প্রমাণ করে–জাতিগতভাবে শিক্ষাকে আমরা কত উচুতে স্থান দেই। শিক্ষার প্রতি যে জাতির এত মমতা সেই জাতি কেন সর্বসাধারণকে শিক্ষার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করবে না?

ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এ কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। এই টাকার একটি অংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করলেও কিন্তু ঈপ্সিত ফল পাওয়া যেত। একজন শিক্ষিত মানুষকে। বোঝানো অনেক সহজ।

আমার ভাবতে ভাল লাগে, এমন একদিন আসবে যেদিন আমাদের দেশের সব মানুষ লিখতে জানবে, পড়তে জানবে। এটা তেমন কোন কঠিন ব্যাপারও নয়। যদি আইন করে দেয়া যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা উচ্চশিক্ষা নিতে আসবে তারা অতি অবশ্যই দুজনকে লিখতে এবং পড়তে শিখিয়ে তারপর আসবে।

সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়তে আসার জন্যে এটা হবে অবশ্যপালনীয় শর্ত।

অনেক কঠিন কঠিন কথা বলে ফেললাম–একটা গল্প বলে শেষ করি। আমরা। তখন বগুড়ায় থাকি। মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছি। হাতে প্রচুর অবসর। দিনরাত। গল্পের বই পড়ি। একদিন সতীনাথ ভাদুড়ির অচিন রাগিণী পড়ছি। পড়তে পড়তে চোখে পানি এসে গেল। লজ্জিত হয়ে চোখ মুছছি। তখন দেখি, আমাদের বাসার ঠিকা কি অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। সে বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলে–এমন কি আছে এখানে যা পড়ে একজন কাঁদতে থাকে? বইয়ের ভেতর কোন দুঃখ ভরে দেয়া হয়েছে?

আমি তাকে বোঝাতে পারলাম না। সে বইটা হাতে নিয়ে দেখতে চাইল। আমি বইটা তার হাতে দিলাম। সে নেড়ে চেড়ে দেখল। গন্ধ শুকল। আমার মাকে গিয়ে বলল, দাদা যখন বই পড়তে পড়তে কান্দে তখন যে কি সুন্দর লাগে!

পাঠকের এই সৌন্দর্য আমরা অবশ্যই সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেব। এই দিন তো দিন নয় আরো দিন আছে। এই দিনেরে নেব আমরা সেই দিনেরো কাছে।
 
একদিন চলিয়া যাব



আমার বড় মামা খুব অসুস্থ। মৃত্যুশয্যা পেতেছেন। তিনি শেষবারের মত তার সব প্রিয়জনদের দেখতে চান, এই খবর পেয়ে আমি ছুটে গেলাম নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। মামার সঙ্গে দেখা হল না। আমি পৌঁছলাম বিকেলে, তিনি মারা গেলেন সেইদিন সকালে। মৃত্যুশোকে পাথর হয়ে আছে আমার নানার বাড়ি। গিজ গিজ করছে মানুষ। মেয়েরা সুর করে কাঁদছে। মাদ্রাসার তালেবুল এলেমরা চলে এসেছে–তার কোরান পাঠ শুরু করেছে।

আমি প্রচণ্ড শোকেও চাপা এক উৎসবের ছোঁয়া পেলাম। বড় কোন উৎসবের। আগে যে উত্তেজনা থাকে, যে ব্যস্ততা থাকে–এখানেও তাই। মুরুব্বিরা উঠোনে গোল। হয়ে বসে আছেন। তারা গম্ভীর মুখে তামাক টানছেন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাদের কাছ থেকে আসছে। মরা বাড়িতে তিনদিন কোন আগুন জ্বলবে না। খাবার আসবে বাইরে থেকে। এই খাবারের নাম তোলা খাবার। কোন কোন বাড়ি থেকে এই খাবার আসবে। তার তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। তোলা খাবার সবাই পাঠাতে চায়। কিন্তু সবার খাবার। নেয়া যাবে না। সামাজিক মানমর্যাদার ব্যাপার আছে। এ খান সাহেবের বাড়ি থেকে একবেলা তোলা খাবার পাঠানোর প্রস্তাব এসেছে। এই প্রস্তাবে সবাই বিব্রত। এই প্রস্তাব গ্রহণ করা যাচ্ছে না, আবার তাদের না বলাও যাচ্ছে না। তারা ক্ষমতাশালী। এই ভয়াবহ (!) সমস্যার সমাধান বের করার জন্যে মুরুব্বিরা। নিচু গলায় ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছেন। তামাক পুড়ছে প্রচুর।

মুরুব্বিদের দ্বিতীয়দল (এরা অনেক বয়স্ক। এদের কেউ কেউ অথর্ব পর্যায়ে চলে গেছেন। চলচ্ছক্তি নেই, চোখে দেখেন না–এমন ) অন্য সমস্যা নিয়ে বসেছেন–কে গোসল দেয়াবে? মড়ার গায়ে এক বালতি পানি ঢেলে দিলে তো হবে না। জটিল নিয়ম কানুন আছে। সবাই এইসব নিয়ম জানে না। যে জানে তাঁকে দিয়ে গোসল দেয়ানো যাবে না, কারণ সে শরাব খায়–এরকম গুজব সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে। মুরুব্বিদের একজন বললেন, আচ্ছা ফজলু কি মৃত্যুর আগে কিছু বলেছে–কে তারে। গোসল দিব? বা কবর কোনখানে হবে?

না, বলে নাই।

বলে গেলে কাজকর্মের সুবিধা হয়। বলে যাওয়া উচিত।

এ মৃতের উপর রাগ করা যায় না, তবে মৃতের বোকামির জন্যে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হওয়া। যায়।

ভেতর বাড়ি থেকে মেয়ের চিৎকার করে কাঁদছে। এত উঁচু স্বরে বিলাপ শরিয়তে নিষেধ করা হয়েছে। তাদেরকে গলা নিচু করতে বলা হল। তালেবুল এলেমরা কোরান শরীফ এত মাধা গলায় পড়ছে কেন? গলায় জোর নাই? তাদের মৃদু ধমক দেয়া হল।

আত্মীয়স্বজন সবাই কি খবর পেয়েছে? ভুলক্রমে কাউকে খবর না দেয়া হলে বিরাট জটিলতা হবে। যাদের খবর দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে কারা কারা উপস্থিত হয়েছে? সবাই উপস্থিত না হলে জানাজার সময় ঠিক করা যাবে না।

কবর দিতে দিতে হবে আসরে নামাজের পর পর। দেরি করা যাবে না। কবর দিতে দিতে মাগরেবের নামাজের সময় হয়ে যাবে। মসজিদে মাগরেবের নামাজ আদায়। করে গোরযাত্রীরা ঘরে ফিরবে।

কবরের জায়গা কি ঠিক হয়েছে?

হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে। বাড়ির পেছনে। গোরস্থানে কবর হলে মেয়েছেলেরা যেতে পারে না। মৃত ছেলের মা ছেলের কবর ঘরের পাশে চাচ্ছেন, যাতে তিনি যখন-তখন যেতে পারেন।

মসজিদের লাগোয়া গোরস্থানে কবর হলেই ভাল হত। তবু মার ইচ্ছাই বড়। বাড়ির পেছনে কবর খননের অনুমতি দেয়া হল। তখনই আসল সমস্যা দেখা দিল। যে কবর খুড়বে সে নেই। সে গিয়েছে শম্ভুগঞ্জ, তার মেয়ের বাড়ি। কি সর্বনাশ। শম্ভুগঞ্জ থেকে তাকে ধরে আনার জন্যে তৎক্ষণাৎ লোক ছুটল। মনে হচ্ছে বাদ আছর কবর হবে না। বিলম্ব হবে। উপায় কি? আল্লা আল্লা করে ঐ লোককে পাওয়া গেলে হয়।

আমি ভেবে পেলাম না, মোহনগঞ্জের মত এত বড় একটা জায়গায় কবর খোড়ার কি একজনই মানুষ? আমার অজ্ঞতায় সবাই মজা পেলেন। আমাকে জানানো হল, জালাল উদ্দিন কবর খোড়ার ব্যাপারে অঞ্চল-বিখ্যাত। তার মত সুন্দর করে কেউ কবর খুঁড়তে পারে না। তাকে না পাওয়া গেলে এক কথা। পাওয়ার সম্ভাবনা যখন আছে চেষ্টা করা যাক।

আমি নিচু গলায় বললাম, কবর খোঁড়ার মধ্যে সুন্দর-অসুন্দর কি আছে?

আমার নির্বুদ্ধিতায় আবারো সবাই বিরক্ত হলেন।

মানুষের আসল বাড়ি কবর। সেই বাড়িটা সুন্দর করে বানাতে হবে না? দালানকোঠা সুন্দর করে বানিয়ে ফয়দা কি?

জালাল উদ্দিন এসে পৌঁছলেন রাত দশটায়। রোগা পাতলা মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। পানের ব্যবসা করেন। তুচ্ছ ধরনের ব্যবসা। কেউ তাকে পোছে না। কিন্তু কারো মৃত্যু হলে সবাই তার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। জালাল উদ্দিনকে লাগবে। যেখান থেকে পার তাকে ধরে আন।

তিনটা হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে কবর খোড়া শুরু হল। আমি গভীর আগ্রহে কবর খোড়া দেখছি। জালাল উদ্দিন মাটি কুপিয়ে কুপিয়ে তুলছেন। মনে হচ্ছে কাজটায় তিনি আনন্দ পাচ্ছেন। এক সময় মুখ তুলে হাসিমুখে বললেন, ফজলুর ভাগ্য ভাল। মাটি ভাল পাইছি। সচরাচর এমন ভাল মাটি পাওয়া যায় না।

মেয়েদের মধ্যে কে যেন এদিকে এসে পড়ল। তাকে প্রচণ্ড ধমক দেয়া হল। মেয়েদের কবর খোঁড়া দেখতে নেই। এটা পুরুষদের কাজ। কবর খোঁড়া শেষ হল রাত একটায়। জালাল উদ্দিন তার কাজ শেষ করে উঠে পড়লেন। হ্যাজাকের আলো ফেলা হল কবরে। আমি স্বীকার করতে বাধ্য হলাম–এটা সামান্য গর্তবিশেষ নয়। এ এক শিল্পকর্ম। পৃথিবীর অন্যান্য শিল্পকর্মের মত এই শিল্পকর্মের দিকেও মুগ্ধ হয়ে তাকানো যেতে পারে।

ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলল, ফজলুর ভাগ্য আসলেই ভাল। কবরটা যেন। হাসতেছে।

আমি বললাম, আমি একটু কবরে নেমে দেখতে চাই।

কেউ কোন আপত্তি করল না। শুধু বলা হল যেন অজু করে নামা হয়। আমি অজু করে কবরে নেমেছি। আমার চারদিকে মাটির দেয়াল। যারা উপরে আছে তাদের কথা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি না। হঠাৎ আমার মনে হল–আমাকে যেন আলাদা করে ফেলা হয়েছে–এই পৃথিবী, এই অনন্ত নক্ষত্রবীথির সঙ্গে আর আমার কোন যোগ নেই।

জীবনে কোন বড় ধরনের অতিপ্রাকৃত অনুভূতির মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। সেই মধ্যরাত্রের বিচিত্র অভিজ্ঞতাই প্রথম এবং এ পর্যন্ত শেষ। অভিজ্ঞতা।
 
একালের শবে বরাত



আমি যখন ছোট ছিলাম তখনো শবে বরাত উৎসব হতো, এখনো হচ্ছে। তবে উৎসব পালন প্রক্রিয়ায় গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। একালের ছেলেমেয়েদের আমাদের সময়কার উৎসবটির কথা বলতে ইচ্ছে করছে।

আজ আইন করে পটকা ফুটানো নিষেধ করা হচ্ছে। আমাদের সময়ে এই আইনের প্রয়োজন হয়নি। এক সপ্তাহ আগে থেকেই পাড়ায় পাড়ায় পটকার দোকান। ছোটদের প্রিয় ছিল তারাবাতি, কাঠির আগায় পটকা, মার্বেল পটকা। একটু বখাটে ধরনের ছেলেদের জন্যে মরিচ বাতি। কাঁচা মরিচ সাইজের হাউই। দেয়াশলাই-এ আগুন লাগাতে হয়–আগুন লাগানোমাত্র শাঁ করে আকাশে উড়ে যায়।

সে সময় ছেলেমেয়েদের বাবারা পটকা কিনে দিতেন। কিছু তারাবাতি, কিছু লাঠিপটকা, কিছু মার্বেল পটকা। মনে আছে কাঠি-পটকা হাতে আমরা গম্ভীর ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতাম। কিছুক্ষণ পর পর গোণা হত–মোট কটা পটকা আছে। তারাবাতির। প্যাকেট থাকত বুক পকেটে। যখন-তখন পকেট থেকে তারাবাতির প্যাকেট বের করে বাতির সংখ্যা গোণা ছিল অবশ্যকর্তব্যের একটি।

পটকার দোকানে মোমবাতিও বিক্রি হত। শবে বরাতের সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা। হালুয়ার ব্যাপারটা ছিল কিনা মনে পড়ছে না, হয়তো ছিল। তবে। গোশত-রুটির কথা মনে আছে। চালের আটার রুটি এবং প্রচুর ঝাল দিয়ে ব্রাধা গরুর মাংস। ঝোলে কজি পর্যন্ত ডুবিয়ে রুটি খাওয়া শবে বরাতের অবশ্য করণীয় কর্মকাণ্ডের একটি।

রাতের খাওয়ার পরই গোসল। হাড় কনকনে শীতে গোসল সারতে হতো। গরম পানি না, পুকুরে। কারণ গোসল করে পাড়ে উঠার পর গা থেকে গড়িয়ে পড়া পানিতে যত ঘাস ভিজত তত সোয়াব। সোয়াব বাড়ানোর জন্যে ভেজা গায়ে ঘাসের উপর। ছোটাছুটি করার কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে। ১ নামাজ শুরু হলো একটু রাত করে। মেঝেতে পরিষ্কার একটা চাদর বিছানো হতো। আমরা ছোটরা বাবার পেছনে নামাজে দাঁড়াতাম। ছোটদের নামাজ দরকার নেই।–বাবা যেমন করছেন তেমন করলেই সোয়াব। আমাদের কাছে পুরো ব্যাপারটা মজার খেলার মত। সেজদায় গেলে মাথা থেকে টুপি পড়ে যেত। সেই টুপি চট করে মাথায় দেয়া এবং হাত বাড়িয়ে ছোট ভাইয়ের মাথা থেকে টুপি ফেলে দেয়াতেই সময় কাটত।

সারারাত নামাজ পড়তে হবে এই জাতীয় পরিকল্পনা নিয়ে শুরু করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম। যে কোন কারণেই হোক শবে বরাতের রাতে আমাদের খাটে নিয়ে শোয়ানো হতো না। নামাজের চাদরেই আমরা শুয়ে থাকতাম। শুধু চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যেত। আধোঘুম, আধো-জাগরণে অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখতাম–বাবা নামাজ পড়ছেন। মা তার পাশেই রেহেলে কোরান শরীফ রেখে পাঠ করছেন। ইলেকট্রিক বাতি নিভিয়ে ঘরে মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। আগরদানে আগরবাতি পুড়ছে। যেন অলৌকিক এক দৃশ্য। বাবা নামাজের ফাঁকে ফাঁকে উঠে এসে তার পুত্র-কন্যাদের গায়ে দোয়া পড়ে ফুঁ দিতেন। দীর্ঘ ফু–মাথা থেকে পা পর্যন্ত। আবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। শবে বরাত এলেই মনে পড়ে এই মঙ্গলময় ফুঁ দেয়ার জন্যে বাবা বেঁচে নেই। মন বিষণ্ণ হয়।

প্রতি শবে বরাতের রাতেই বাবার স্মৃতি মনে করেই হয়তো গভীর রাতে আমার। বাসাতেও মেঝেতে একটা ঢালাও বিছানা করা হয়। বাবার মত নামাজ পড়ে প্রার্থনা করি। কিন্তু কিছুতেই সেই আগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারি না।

এবারে শবে বরাতে ভেবেছিলাম বাচ্চাদের কিছু তারাবাতি কিনে দেব। কোথাও তারাবাতি পেলাম না। শুনলাম সরকারী নির্দেশে পটকার দোকান নিষিদ্ধ। খোলা বাজারে পাওয়া যাবে না। তবে বন্ধ বাজারে পাওয়া যাবে।

বন্ধ বাজার খোঁজার ইচ্ছা হলো না। তবে যাদের খোঁজার তারা ঠিকই খুঁজে বের। করল। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হল তাণ্ডব। পটকা তো নয়, যেন এটম বোমা ফাটছে। একেকটা পটকা ফুটে ঘর-বাড়ি, দালান-কোঠা কেঁপে উঠে। সেই সঙ্গে চলল মাইক। প্রার্থনা খুবই ব্যক্তিগত বিষয়, নীরব বিষয়। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে সেই ব্যক্তিগত নীরব প্রার্থনা সরব আকার ধারণ করল। যা শুরু হল তার নাম প্রার্থনা নয়, কোরান পাঠ নয়–তার নাম হট্টগোল।

আমি আমার এলিফেন্ট রোডের এ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় বসে আছি, নতুন দিনের শবে বরাত উৎসব পালন দেখছি। এ কি ভয়াবহ উৎসব! হচ্ছেটা কি?

অনেকগুলি খণ্ড দৃশ্য দেখলাম। একটা বর্ণনা করি। রাত এগারটা কিংবা সাড়ে এগারটা। এলিফেন্ট রোড ধরে এক ভদ্রলোক তার কন্যা কিংবা কন্যা-স্থানীয় কাউকে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মাটি খুঁড়ে কোত্থেকে একটা ছেলে এসে রিকশাওয়ালার সামনে বিকট শব্দে একটা বোমা ফাটাল। রিকশাওয়ালা রিকশা থামাল। তখন শুরু হল বৃষ্টির মত বোমা বৃষ্টি। রিকশার চারদিকে ফাটছে। মেয়েটি কাঁদছে। মেয়ের সঙ্গী হাত জোড় করে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে ছেলেগুলির দিকে তাকাচ্ছেন। ছেলেরা ক্ষমা করবে কেন? তারা ক্ষমা করতে আসেনি, তারা এসেছে মজা করতে। কাজেই তারা মজা করেই যেতে লাগল।

আমেরিকায় হেলোইন উৎসব বলে একটা উৎসব হয়। ছোট ছোট বাচ্চা-কাচ্চারা ভূতের মুখোশ পরে বাড়ি বাড়ি যায়। কলিংবেল টিপে বলে–ট্রিট অর ট্রিক (কিছু দাও নয়ত ভয় দেখাব)। ঘরের লোকজন ভয় পাওয়ার ভঙ্গি করে তাড়াতাড়ি মুঠো ভর্তি চকোলেট এনে দেয়। সেই মজার উৎসবের ভয়াবহ বিবর্তন হয়েছে। আজ হেলোইন উৎসবের কথায় আমেরিকাবাসী আঁতকে উঠে। প্রতি স্টেটে স্পেশাল পুলিশ ফোর্স নামানো হয়। কারণ বর্তমানের হেলোইন উৎসবে মজা করার জন্যে বাড়িতে লোককে বাইরে থেকে ঘরে আটকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। উৎসবটা এখন আর মজার ভয় দেখানো পর্যায়ে নেই। এখন ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলার পর্যায়ে। হেলোইন উৎসবের পর পর আমেরিকার খবরের কাগজগুলি উৎসবে হত্যার সংখ্যা প্রকাশ করে। সেই সংখ্যা পড়ে যে কোন মানুষ আঁতকে উঠবেন।

আমেরিকা যে পথে যাবে–আমারও তো সেই পথেই যাব। নয়তো সভ্য বলে নিজেদের পরিচয় দেব কি করে? শবে বরাতের বলি শিরোনামে কাগজ এখন খবর ছাপা শুরু করেছে। ভোরের লাগজ লিখেছে–গ্রেপ্তার ৬০০, আহত ৩৬৫। সবে শুরু।

ভবিষ্যতে কি হবে কে জানে!–ভবিষ্যতের শবে বরাত উৎসবে স্পেশাল পুলিশ বা রায়ট পুলিশ চলবে না–আর্মি নামাতে হবে, ট্যাঙ্ক নামাতে হবে। ধর্মীয় উৎসব কি ভাবে পালন করতে হয় আমরা তা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে ছাড়ব।
 
কচ্ছপের গল্প



ঔপন্যাসিক আসিফ নজরুল সেদিন আমার বাসায় এসেছে। গম্ভীর চেহারার একজন ছেলে। নিজের ওপর তার আস্থা সীমাহীন। কাটা কাটা কথা বলে আশপাশের মানুষদের চমকে দেয়ার সূক্ষ্ম চেষ্টা আছে। মানুষকে চমকে দিয়ে কথাশিল্পী মাত্রই আনন্দ পান। আসিফ তার ব্যতিক্রম হবে এটা মনে করার কোন কারণ নেই। ব্যতিক্রম কিছুটা আছে। তার কথায় অন্যকে আহত করার চেষ্টা আছে।

যাই হোক, তাকে আমি আনন্দিত স্বরে বললাম, কি খবর?

সে আমার আনন্দিত স্বরকে তেমন পাত্তা দিল না। কঠিন গলায় আমার স্ত্রীকে বলল, আচ্ছা ভাবী, হুমায়ূন ভাই কি হিপোক্রেট?

গুলতেকিন হকচকিয়ে গিয়ে বলল, কই না তো! ও যা বিশ্বাস করে তাই তো বলে। ভান তেমন করে না তো!

ভাবী, উনার ওপর একটি বই বের হয়েছে ঘরে বাইরে হুমায়ূন আহমেদ–আপনি কি সেটি পড়েছেন? যদি পড়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই আপনার চোখে পড়েছে–প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন করলেন–বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস সম্পর্কে কিছু লেখা হয়নি–আপনি নিজে কেন লিখছেন না?

হ্যাঁ, চোখে পড়েছে।

তার উত্তরে হুমায়ূন ভাই যা বললেন তার ভেতরে হিপোক্রেসি কি আপনি ধরতে পারেননি?

না তো।

আপনার ধরতে পারার কথা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস সম্পর্কে কোন উপন্যাস লেখা হয়নি এটা হুমায়ূন ভাই স্বীকার করে নিয়েছেন–কিন্তু তিনি জানেন। আমার একটি উপন্যাস এই প্রসঙ্গে আছে–নিষিদ্ধ কয়েকজন। তিনি বইটি পড়েছেন, তিনি আমাকে বলেছেন বইটি তার ভাল লেগেছে। অথচ ইন্টারভ দেয়ার সময় এই ব্যাপারটা তিনি উল্লেখ করেননি। এটা এক ধরনের হিপোক্রেসি নয়?

গুলতেকিন বলল, ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেলে অবশ্যই হিপোক্রেসি।

ব্যাপারটা যে হিপোক্রেসি নয় আমি তা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বললাম—প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় কখনো খুব ভেবেচিন্তে দেয়া হয় না। যা মনে আসে তাই বলা হয়। নিজেকে ডিফেণ্ড করার একটা চেষ্টা থাকে। অন্য কারোর কথা মনে থাকে না। তোমার নিষিদ্ধ কয়েকজনের কথা সেই কারণেই উল্লেখ করা হয়নি। তবে তোমার ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে, আমি আমার একটি বই তোমাকে উৎসর্গ করেছি।

আসিফ আরো কিছু কঠিন কথা বলার জন্যে নিজেকে তৈরি করল–তার চোখ তীক্ষ্ণ হল এবং ভুরু খানিকটা কুঁচকে গেল। আমি তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম–

তুমি লেখালেখি শুরু করেছ মাত্র দুতিন বছর হলো। এর মধ্যেই আমি তোমাকে একটি বই উৎসর্গ করেছি। আর আমার অবস্থাটা দেখ, আমি কুড়ি বছর ধরে লেখালেখি করার পর আমাকে বই উৎসর্গ করলেন কবি শামসুর রাহমান এবং সৈয়দ শামসুল হক। তাঁরা যে আমার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে এই কাজটি করলেন তাও কিন্তু না। আমি তাদের বই উৎসর্গ করেছিলাম, তারা ভদ্রতা করেছেন, উৎসর্গ ফেরত দিয়েছেন। তুমি আমাকে বই উৎসর্গ করবে, তার উত্তরে আমি করব তা কিন্তু হয়নি–আমি তোমার বই উৎসর্গের জন্যে অপেক্ষা করিনি।

আসিফ বলল, আমাকে কিছু কথা বলার সুযোগ দিন।

না, তোমাকে সুযোগ দেয়া হবে না। তুমি আমার কথা শোন। আমি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলাম। দেশে কি লেখালেখি হচ্ছে সেই সম্পর্কে কোন ধরাণা ছিল না। দেশে এসে শুনলাম ইমদাদুল হক মিলন নামে একজন খুব লেখালেখি করছেন। মেলাতে আমি তাঁর বই কিনলাম। একটি বই পরাধীনতা পড়ে আমার এত ভাল। লাগল যে আমি সেই পরাধীনতা নিয়ে দীর্ঘ একটা প্রবন্ধ লিখলাম দৈনিক বাংলায়। তখনো এই লেখকের সঙ্গে আমার কোন পরিচয় হয়নি। কাজেই তুমি বলতে পার না আমার ভেতর কোন হিপোক্রেসি আছে।

দুটি উদাহরণ দিয়েই আপনি আপনার দায়িত্ব শেষ করেছেন। সেটা কি ঠিক হচ্ছে? আপনি কি এই প্রজন্মের লেখকদের সম্পর্কে আপনার দায়িত্ব পালন করেন? নিয়মিত তাদের লেখা পড়েন? তাদের উৎসাহ দেন? তাদের বিকশিত হতে সাহায্য করেন?

মা আমাকে স্বীকার করতে হল, আমি তা করি না। আমি তাকে হাসতে হাসতে বললাম, দায়িত্বে অবহেলার এই ব্যাপারটা আমি শিখেছি আমার অগ্রজদের কাছ থেকে। শওকত ওসমান স্যারের কথাই ধরা যাক। আমার শিক্ষক। ঢাকা কলেজে আমাদের বাংলা পড়াতেন। তার চোখের ওপর আমি লেখালেখি শুরু করেছি। তার সঙ্গে যখন দেখা হয়, তিনি আমার লেখালেখি সম্পর্কে অনেক ভাল কথা বলেন, কিন্তু কথা হচ্ছে, এই কুড়ি বছরে তিনি সাহিত্য-বিষয়ক অনেক কিছুই লিখেছেন কিন্তু। কোথাও হুমায়ূন আহমেদ এই নামটি নেই।

এ প্রসঙ্গক্রমে কবি শামসুর রাহমান সাহেবের কথা বলি। অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদের বাড়িতে আমি, কবি শামসুর রাহমান, দৈনিক বাংলার সালেহ চৌধুরী এবং হুমায়ূন আজাদ আড্ডা দিচ্ছি। আমি এক পর্যায়ে কবিকে বললাম, নির্মলেন্দু গুণকে কবি হিসেবে আপনার কোন স্তরের মনে হয়? কবি শামসুর রাহমান আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন–শুধু আপনাকেই বলছি–বাইরে কোট করবেন না– নির্মলেন্দু গুণকে আমার খুব বড় মাপের কবি বলে মনে হয়। আমি হতভম্ব হয়ে আমার দেশের প্রধান কবির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি যদি কাউকে বড় কবি মনে করেন তাহলে তা প্রকাশ করতে অসুবিধা কি? কেন এটা তাকে ফিসফিস করে বলতে হবে? তিনি হয়ত ভেবেছেন, তাঁর বক্তব্যে অন্য কবিরা তার ওপর ক্ষেপে যাবেন। খুব ভুল ভাবেন নি। চারদিকের আবহাওয়া বিচার করে তাঁর মত কবি মত প্রকাশ করবেন? কবিরা দেশের আত্মা, তারপরেও এত দ্বিধা?

কাকের মাংস কাকে খায় না, লেখকের মাংস লেখক খায়। বেশ মজা করেই খায়। ঈর্ষা নামক ব্যাপারটা বোধহয় সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে যুক্ত। এই ঈর্ষার জন্যেই হয়ত আমরা একজন অন্যজনকে অস্বীকার করি।

হাসন উৎসবে সুনামগঞ্জ গিয়েছিলাম। প্রথম দিন হাসন রাজার গান হল। পরের দিন কবিদের অনুষ্ঠান। যেসব কবি আসবেন নিমন্ত্রণপত্রে তাদের নাম ছাপা হয়েছে। একজন কবি সেই অনুষ্ঠানে এলেন না, কারণ তার নামের আগে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার নাম ছাপা হয়েছে। তিনি কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সিনিয়র, তার নাম আগে যাওয়া উচিত ছিল। হায় রে সিনিয়রিটি! মহাকাল সিনিয়রিটি দেখে না। সে তার কঠিন পাল্লায় সবকিছু মাপে। সেই মাপে ভুল হয় না।

আমরাই শুধু তুচ্ছ জিনিস নিয়ে মাতামাতি করি। কচ্ছপের খোলসের ভেতর নিজেকে নিয়েই শুধু বাস করতে চাই। এই খোলস ছেড়ে আমাদের বেরুবার উপায় নেই, কারণ খোলসবিহীন কচ্ছপ পৃথিবীতে দেখা যায় না।

আমি নিজেও একটা শক্ত খোলসে নিজেকে আটকে ফেলেছি। নতুন প্রজন্মের শক্তিমান লেখকরা খোলসমুক্ত হবেন–এই আমার শুভ কামনা। আমার অগ্রজরা। এবং আমরা যে ভুল করেছি তারা তা করবেন না। বাংলা সাহিত্যকে অনেক দূর এগিয়ে। নেবার দায়িত্ব তাদের। যে মশাল আমরা তাদের হাতে তুলে দিতে পারিনি, সেই মশাল তাঁরা আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ছুটতে শুরু করবেন। শুধু মনে রাখবেন–তাঁদের কচ্ছপ হওয়া চলবে না। কচ্ছপরা ছুটতে পারে না।
 
খেলা



আমার বন্ধু কন্যা লীনা টেলিফোন করেছে। তার গলার স্বর ভারী ও বিষণ্ণ। আমি বললাম, কি হয়েছে রে? সে বলল, চাচা, আজ কি কোন কারণে আপনার মন খারাপ? আমি অবাক হয়ে বললাম, কই, না তো।

ঠিক মত ভেবে তারপর বলুন। হুট করে বলবেন না।

না, আমি ভালই আছি। আমার মন খারাপ করার মত কিছু কি ঘটেছে?

বাংলাদেশ যে মালদ্বীপের সঙ্গে ফুটবল খেলায় ড্র করলো এতে আপনার মন খারাপ হয়নি?

ও আচ্ছা, তা মন খারাপ কিছুটা হয়েছে।

আপনি কি এই মন খারাপের কারণে আপনার মেয়েদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন?

ওদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব কেন? ওরা তো আর ড্র করেনি।

তাহলে বাবা কেন আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে? বাবা কেন শুধু শুধু। আমাকে চড় মারলো?

টেলিফোনের ও প্রান্ত থেকে কান্নার শব্দ আসতে লাগলো। হাউমাউ ধরনের কান্না। এতক্ষণে রহস্য ভেদ হলো। বোঝা যাচ্ছে, মালদ্বীপের সঙ্গে ড্র করার পর আমার বন্ধু রফিকের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বাড়িতে মারধোর শুরু করেছে। রফিকের ক্ষেত্রে এই আচরণ খুবই স্বাভাবিক। ফুটবল আছে তার শয়নে, স্বপনে। চিন্তায় ও নিদ্রায়। লীগের খেলা হচ্ছে আর সে মাঠে নেই, এ হতেই পারে না।

তার পাল্লায় পড়ে একবার লীগ ফাইন্যাল দেখতে গিয়েছি। তার প্রিয় দল তেমন সুবিধা করতে পারছে না। তাকিয়ে দেখি তার চেহারা বিবর্ণ। বিড়বিড় করে কি সব দোয়া পড়ছে। এক সময় সে তার পাঞ্জাবির সব বোতাম খুলে ফেলল। পায়জামার। ফিতার গিট আলগা করে দিল। আমি হতভম্ব। হচ্ছে কি? রফিক বলল, কসাইত লেগে গেছে। এই সব করলে কু কাটা যায়।

সেদিন পায়জামার ফিতা খোলার জন্যেই হোক বা অন্য কোন কারণেই তোক রফিকের দল জিতে গেল। অবাক হয়ে তার আনন্দ প্রকাশের ভঙ্গি দেখলাম। তিন ছেলেমেয়ের বাবা, একটা কলেজে পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়ায়, সেই লোক খালি গা হয়ে তার পাঞ্জাবি একবার আকাশে ছুঁড়ে মারছে আর লুফে নিচ্ছে। মুখে চিহি ধরনের শব্দ করছে, যে শব্দ ঘোড়ার মুখেই মানায়। আমি বলতে বাধ্য হলাম, তুই পাগল হয়ে গেলি নাকি? সামান্য একটা খেলা।

রফিক চোখ লাল করে বলল, উইথড্র ইয়ের ওয়ার্ড। ফুটবল কোন খেলা না, ফুটবল হল লাইফ।

বাঙালী ফুটবলের ব্যাপারে স্পর্শকাতর তা জানি। নব্বুই-এর বিশ্বকাপের পর পর অয়োময় নাটকের শুটিং-এর জন্যে পুরো দলবল নিয়ে ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম। শুটিং চলছে। হঠাৎ শুনি, রাস্তায় বিকট চিৎকার, ভয়াবহ হৈ-চৈ। শ্যুটিং বন্ধ করতে হল। দেখা গেল, মিছিল বের হয়েছে। মিছিলের মানুষ শ্লোগান দিচ্ছে–মানি না। মানি না। বিশ্বকাপের সিদ্ধান্ত মানি না। ব্যাপার হল, আর্জেন্টিনার পরাজয় তারা মানে না। এই জন্যেই মিছিল। কোথায় বিশ্বকাপ আর কোথায় বাংলাদেশের এক মফস্বল শহরের মিছিল। ফুলবল নিয়ে কোন পর্যায়ের স্পর্শকাতরতা থাকলে এ জাতীয় পাগলামি করা যায় তা সহজেই অনুমেয়। সেই স্পর্শকাতরতা যে কোন ধরনের তা রফিককে খুব কাছে থেকে না দেখলে জানা যেত না। কাজেই আমি বন্ধু কন্যার কান্নায় বিস্মিত হলাম না। লীনাকে বললাম তার বাবাকে টেলিফোন দিতে। লীনা কাঁদতে কাঁদতেই তার বাবাকে ডাকতে গেল।

রফিক কি হয়েছে?

কিছু হয়নি। হবে আবার কি?

তুই ভাল তো?

হুঁ।

খুব নাকি হৈ-চৈ করছিস? বাংলাদেশ মালদ্বীপের সঙ্গে ড্র করেছে তো কি হয়েছে?

তোর কাছে এটা খুব সামান্য ব্যাপার মনে হচ্ছে?

দুঃখজনক ব্যাপার তো বটেই। তবে ড্র করায় পরের খেলাগুলি ভাল হবে। বাংলাদেশী প্লেয়াররা লজ্জা পেয়ে জান দিয়ে খেলবে। দেখবি নেপালকে হারিয়ে ভূত বানিয়ে দেবে। এই ডুটা আমাদের জন্যে শাপে বর হয়েছে।

কথাটা মন্দ বলিসনি।

রাগারাগি হৈ চৈ বন্ধ করে স্বাভাবিক হ।

মালদ্বীপের সঙ্গে ড্রয়ের পর মনটা এত খারাপ হয়েছিল, ইচ্ছা করছিল সেলুনে গিয়ে নিজের মাথাটা কামিয়ে ফেলি। কি অপমান!

অপমানের কিছু না। অঘটন ফুটবলে মাঝে মাঝে ঘটে। দেখবি, ফুটবলে সোনা এবার আসবে আমাদের ঘরে।

ইনশাআল্লাহ বল দোস্ত। ইনশাআল্লাহ না বললে শেষে—

আমি ইনশাআল্লাহ বললাম। রফিকের আনন্দের সীমা রইল না। সেও আমার সঙ্গে একশ ভাগ একমত হল, এবারের সোনা আমাদের।

বাংলাদেশ হারলো নেপালের কাছে। আমাদের ফুটবল টীম পুরো জাতিকে বিরাট লজ্জায় ফেলে দিল। আমার নিজেরই এত খারাপ লাগছে, রফিকের না জানি কেমন লাগছে। তার বাসায় টেলিফোন করলাম। সে টেলিফোন ধরলো না। তার স্ত্রী জানালো, রফিক আজ খেলা জেতার জন্যে মানত করে রোজা রেখেছিল। এখন ঘর অন্ধকার করে দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে আছে। কারো সঙ্গে কথা বলছে না।

রাগারাগি করছে না তো?

না। তা করছে না। ভাই, আপনি একবার আসুন। তার সঙ্গে কথা বলে তাকে শান্ত করে যান।

আচ্ছা আমি আসছি।

আমি রফিককে শান্ত করার জন্যে যাচ্ছি। রিকশা নিয়েছি। রিকশাওয়ালা বলল, ঘটনা কি হইছে দেখছেন স্যার? ভালমত কেউ খেলে নাই। পাও বাঁচাইয়া খেলছে।

পা বাঁচিয়ে খেলাটা কি?

সামনে লীগের খেলা। পা জখম হইলে খেলব কি? আর না খেললে লাখ টেকা ক্যামনে পাইব?

পরাজয়ের দুঃখে রিকশাওয়ালা কাতর। শুধু রিকশাওয়ালা নয়, পুরো জাতি আজ বিষণ্ণ। এই বিষণ্ণতা কি আমাদের লাখ টাকা দামী খেলোয়াড়দের স্পর্শ করেছে? আজ তারা কেমন আছেন সোনারগাঁ হোটেলে? তারা কি সত্যি সত্যি জানেন বাতাসভরা ছোট একটা চামড়ার বল নিয়ে ছোটাছুটির এই খেলার সঙ্গেও জাতির আত্মা মিশে যেতে পারে? যদি জানেন, তাহলে কেন এই মৃত্যুসম পরাজয়?

নেদারল্যাণ্ডের এক সাহেব একবার আমাকে বলেছিলো, তোমরা এই খেলাটা খেলতে পার না। তারপরেও এই খেলার প্রতি তোমাদের এত মমতা কেন? কারণটা কি?

আমি সাহেবকে বললাম, বাংলাদেশ মানেই বর্ষা, আর বর্ষা মানেই ফুটবল।

তার মানে?

মানে তুমি বুঝবে না। বাদ দাও।

সাহেবের সঙ্গে বকবক করতে ইচ্ছা করেনি। ইচ্ছা করলে বলা যেত–এই খেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ফেলে আসা শৈশব। ঝুপঝুপ বৃষ্টি পড়ছে, একদল কিশোর বাতাবিলেবু নিয়ে নেমে পড়েছে মাঠে। যে যেদিকে পারছে কিক বসাচ্ছে। উত্তেজনার সীমা নেই। কাদায় গড়াগড়ি, পানিতে গড়াগড়ি। বাতাবিলেবুর। স্টেজ পার হল, চাঁদা তুলে কেনা হল প্রথম চামড়ার ফুটবল। চামড়া নরম করার জন্য সেই ফুটবলে মাখন নিয়ে ঘষাঘষি। কি আনন্দ! কি আনন্দ! গঠন করা হল ফুটবল ক্লাব। সব ইংরেজি নাম–গ্রীন বয়েজ ক্লাব, টাইগার ক্লাব,…

টেলিভিশনে বিশ্বকাপের খেলা যখন দেখি তখন মনে হয় এরা তো আমাদের খেলা খেলছে, আমরা কেন খেলছি না?

বলা হয়, আমাদের শারীরিক যোগ্যতা নেই। আমাদের দম থাকে না।

তার মানে কি? ফুটবল খেলতে হলে দৈত্য হতে হবে? আর আমাদের দম না থাকলে কাদের থাকবে?

বলা হয়, আমাদের খেলোয়াড়রা ফুটবলের আধুনিক কৌশল জানেন না।

কৌশল জানেন না, শিখবেন। আমরা কি বেকুবের জাত যে শিখতেও পারব না?

আমি প্রায়ই স্বপ্নে দেখি, বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলছে। এগারোজন খেলোয়াড় তাদের জার্সির ভেতর বাংলাদেশের হৃদয়কে নিয়ে খেলতে নেমেছেন। ঐ তো বাংলাদেশ ছুটে যাচ্ছে গোলপোস্টের দিকে। কার সাধ্য তাদের রোখে?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top