একাকী বালক
Member
হজরত ওমর রা.-এর শাসনামলে বা অন্যান্য সাহাবী, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনদের বরকতময় যুগে এমন কোনো নজির নেই যে, তারা বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত সকল মুসলমানদের জন্য একই দিনে রোজা বা একই দিনে ঈদের আয়োজন করেছে। তাই সকল ইসলামী রাষ্ট্রে বা কোন একটি ইসলামী রাষ্ট্রে একই সময়ে ঈদ বা রমজান শুরু হওয়া শরয়ীভাবে জরুরি নয়।
কেননা আমাদের ঈদ ও রমজান অন্যান্য জাতির উৎসবের মতো উৎসব নয়, বরং বিশেষ ইবাদতের সময়, যেমন অন্যান্য ইবাদতে সময় বা তারিখ এক হওয়া শরয়ীভাবে জরুরি নয়। বরং আমরা দেখি যে, নামাযের সময় বিভিন্ন দেশে বা একই দেশের বিভিন্ন শহরে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। আমাদের শরীয়তে 'ইবাদতকে' বাহ্যিক নিদর্শনের সাথে যুক্ত করে অনেক সহজে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও, যদি সারা বিশ্বে একই তারিখে ঈদ উদযাপনের প্রয়োজন হতো, তাহলে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাদানী জীবনে, খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে ও সাহাবা-তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন এবং আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীনের যুগে এর কোনে ভিত্তি থাকতো। এবং এর জন্য তখন কেউ আওয়াজও তোলেনি।
যেমনটা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর বর্ণনা দ্বারা সাহাবায়ে কেরামের যুগে তার প্রমাণ পাওয়া যায় যে, শামে (সিরিয়াতে) শুক্রবার রাতে চাঁদ দেখা গেছে এবং মদীনায় সেদিন চাঁদ দেখা যায়নি। সিরিয়াবাসীরা শনিবার রোযা রাখে। অথচ মদিনার লোকেরা রবিবার থেকে রমজান শুরু করে। মদীনায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. হযরত কুরাইবের সাক্ষ্য দ্বারাই রমযান শেষ হওয়ার পূর্বেই সিরিয়ায় শুক্রবার দিন চাঁদ দেখার সংবাদ পেয়ে যান।
তাবেয়ী কুরাইব রহ. বর্ণানা করেন,
"উম্মুল ফযল বিনতে হারেস তার কোনো কাজে আমাকে শামে মু'আবিয়া রাযি. এর কাছে পাঠান। আমি শামে পৌঁছে তার কাজ পুরা করলাম। ইতোমধ্যে শামে রমযানের চাঁদ দেখা গেল। আমি সেখানে চাঁদ দেখেছিলাম শুক্রবার রাতে। তারপর মাসের শেষ দিকে মদীনায় ফিরে এলাম। তখন হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. এর সাথে সাক্ষাত হলে তিনি চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কোন দিন চাঁদ দেখেছিলে? আমি বললাম, শুক্রবার রাতে। তিনি বললেন, তুমি নিজে দেখেছ? আমি বললাম, হ্যাঁ, এবং সকলে দেখেছে। আর মু'আবিয়া রাযি. সহ সকলে রোযা রেখেছে। তখন তিনি বললেন, কিন্তু আমরা মদীনায় শনিবার রাতে চাঁদ দেখেছি। সুতরাং আমরা রোযাকে আমাদের হিসাব অনুযায়ী ত্রিশ দিন পূর্ণ করব অথবা নতুন চাঁদ দেখে রোযা ছাড়ব। আমি বললাম, হযরত মুআবিয়া রাযি. এর চাঁদ দেখা ও রোযা রাখাও কি চাঁদ প্রমাণের জন্য আপনার নিকট যথেষ্ট মনে হয় না? তিনি বললেন- না। আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ এরূপই আদেশ করেছেন। সহীহ মুসলিম ১/৩৪৮ মুসনাদে আহমদ ৫/১০, হাদীস নং ২৭৮৯
এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, মদীনা শরীফ ও শামের মাঝখানে স্থলপথে দূরত্ব হলো ১৯২৮ কিলোমিটার। সুতরাং শাম মদীনা থেকে অনেক দূরবর্তী দেশ। এখন কথা হলো কুরাইব রাহ. একজন ছিকাহ (নির্ভরযোগ্য) তাবে'য়ী। তিনি যখন হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. কে তার নিজের চাঁদ দেখা ও মুআবিয়া রাযি. এর চাঁদ দেখার খবর দিলেন, তখন ইবনে আব্বাস রাযি. তার এ সাক্ষ্য কবুল করলেন না। অথচ তিনি রাসূলুল্লাহ এর এই সহীহ হাদীসও জানতেন, (তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা ছাড়)। কারণ তিনি একথাও জানতেন, রাসূলুল্লাহ্ এর এই হাদীস নিকটবর্তী অঞ্চলগুলোর জন্য প্রযোজ্য। দূরবর্তী অঞ্চলগুলোর জন্য প্রযোজ্য নয়। এই জন্য তিনি বলেছেন-
هكذا أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم
"রাসূলুল্লাহ্ আমাদের এরূপই হুকুম করেছেন।"
যদি সারা বিশ্বে একই দিনে ঈদের নামায এবং একই দিনে রমজানের রোজা শুরু করা শরীয়াহ মোতাবেক কাম্য বিষয় হতো, তাহলে সিরিয়া দেশ থেকে অবিলম্বে আরও শাহাদাত (সাক্ষ্য) চেয়ে এই ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা হত। আর এটা কোনো কঠিন বিষয়ও ছিল না, কিন্তু হযরত ইবনে আব্বাস রা.- তাবেয়ী কুরাইবের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও তাতে কোনো মনোযোগ দেননি।
তাই সারা বিশ্বের সমগ্র মুসলমানদের জন্য একই দিনে
রমজানের রোজা শুরু করা এবং একই তারিখে ঈদ উদযাপন করা এবং এটাকে জরুরি বা পছন্দনীয় মনে করা, এ ধারণা সঠিক নয়।
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. আরো বলেন-
ঐ সকল লোকের উপর আমার আশ্চর্য হয়, যারা রমযান আসার আগেই রোযা রাখতে শুরু করে। আল্লাহর রাসূল সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো বলেছেন, যখন তোমরা চাঁদ দেখবে তখন রোযা রাখবে এবং যখন (দ্বিতীয়) চাঁদ দেখবে তখন রোযা ছাড়বে। চাঁদ যদি আড়ালে থাকে তাহলে ত্রিশ সংখ্যা পূর্ণ করবে। (আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী ৪/২০৭)
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. এ-ও বর্ণনা করেছেন-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
তোমরা একটি বা দুটি রোযার দ্বারা (রমযান) মাসের চেয়ে অগ্রগামী হয়ো না। তবে যদি তোমাদের কারো (অভ্যাসগত নফল) রোযার দিবস হয়, যা সে আগে থেকে রেখে আসছে তাহলে আলাদা কথা। আর তোমরা চাঁদ দেখার আগে রোযা রাখবে না এবং (দ্বিতীয়) চাঁদ দেখা পর্যন্তই রোযা রাখবে। যদি মেঘের কারণে চাঁদ দেখা না যায় তাহলে ত্রিশ সংখ্যা পূর্ণ করবে। (আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী ৪/২০৭)
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর কাছে যদি এ বিষয়ে (দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখা অবশ্যগ্রহণীয় না হওয়ার বিষয়ে) কোনো সুস্পষ্ট বাণী না-ও থেকে থাকে এবং তিনি 'রাসূলের আদেশ' বলে উপরোক্ত হাদীসের প্রতিই ইঙ্গিত করে থাকেন, তবুও তো এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তিনি
صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته
(তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ চাঁদ দেখে রোযা ছাড়।) শীর্ষক হাদীসের এই অর্থই বুঝেছেন যে, এ হাদীসে নিজ এলাকা ও নিকটবর্তী এলাকার চাঁদ দেখা উদ্দেশ্য। দূরবর্তী এলাকার চাঁদ দেখা উদ্দেশ্য নয়।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর এ অনুধাবনের সাথে কোনো মুজতাহিদ ইমামের যদি দ্বিমত থাকে তবে থাকতে পারে, কিন্তু এর দ্বারা দুটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে সামনে আসে :
এক. صوموا لرؤيته শীর্ষক হাদীসের এ ব্যাখ্যাই নির্ধারিত নয় যে, 'যেখানেই চাঁদ দেখা যাক তোমরা রোযা শুরু কর, দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখাও তোমাদের জন্য অবশ্যগ্রহণীয়।' কারণ আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. একজন ফকীহ সাহাবী এবং তিনি নিজে ঐ হাদীস আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছেন, কিন্তু তিনি এর ঐ অর্থ বোঝেননি।
দুই. আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর মাযহাব এই ছিল যে, দূরবর্তী এলাকার চাঁদ দেখা অবশ্যগ্রহণীয় নয়; নিজ এলাকার চাঁদ দেখাই আমলযোগ্য।
সাহাবা-যুগে আমরা সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর এই মাযহাব পেলাম যে, তিনি দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখা ধর্তব্য মনে করেননি। আর এ বিষয়ে অন্য কোনো সাহাবী তাঁর সাথে দ্বিমত করেছেন এমন তথ্য আমাদের জানামতে হাদীসের কিতাবসমূহে বর্ণিত হয়নি।
তাছাড়াও, ইসলামিক ইবাদত, যেমন রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদি চন্দ্র মাসের সাথে সম্পর্কিত এবং বিশেষ করে রমজানের শুরু করাটাই তো চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ তা'য়ালা ইরশাদ করেন,
فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ
'তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে ...। সুতরাং যে এই মাস পাবে সে যেন রোজা রাখে...।' সূরা বাকারাহ, ১৮৩-১৮৫
আর এর জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি সহজ ও সাধারণ উপায় বলে দিয়েছেন যে, ''তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো এবং চাঁদ দেখেই ইফতার করো (রোজা ছেড়ে দাও)।'' [সহিহ বুখারি ] যাতে একজন সাধারণ মুসলমানের পক্ষেও ফরজ ইবাদত আদায় করা সহজ হয়।
তাবেয়ী-যুগের আমল
ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ. মুয়াত্তা মালিকের ভাষ্যগ্রন্থ ''আততামহীদ'' কিতাবে এ বিষয়ে ইমামগণের মাযহাব বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথম মত এই উল্লেখ করেছেন যে, অন্য এলাকার চাঁদ দেখা অবশ্যগ্রহণীয় নয়। তিনি লেখেন, এটাই ইবনে আব্বাস রাযি. (সাহাবী) (৬৮ হি.), ইকরিমা (১০৭ হি.), কাসিম বিন মুহাম্মাদ (১০৭ হি.) ও সালিম বিন আবদুল্লাহ (১০৬ হি.) (এই তিনজন তাবেয়ী)-এর মাযহাব। এবং ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহও (২৩৮ হি.) এ কথাই বলেছেন। এরপর ইবনে আবদুল বার দ্বিতীয় মাযহাব বর্ণনার পর স্পষ্ট ভাষায় লেখেন, ''আমি প্রথম মতই গ্রহণ করি। কারণ এর সমর্থনে একটি মারফূ হাদীস আছে, যা সনদের বিচারে দলীলযোগ্য। আর তা এক বড় সাহাবীর মাযহাব। সাহাবীদের মধ্যে কেউ এ বিষয়ে তার বিরোধিতা করেননি। পাশাপাশি এটি ফকীহ-তাবেয়ীগণের একটি জামাতেরও সিদ্ধান্ত। আত-তামহীদ ১৪/৩৫৬-৩৫৮
'আততামহীদ' ছাড়া মুয়াত্তার দ্বিতীয় শরহ (ভাষ্যগ্রন্থ) 'আলইসতিযকারে'ও তিনি ঐ তাবেয়ীগণের মাযহাব উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ''এটিই ইকরিমা, কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ ও সালিম ইবনে আবদুল্লাহর বক্তব্য। ইবনুল মুবারক ও ইসহাক ইবনে রাহূয়াহসহ একটি জামাতের মাযহাবও এটিই।'' আলইসতিযকার ১০/২৯
এই তিন তাবেয়ীর মাযহাব সম্পর্কে একথা আরো অনেক আগে বলেছেন ইবনুল মুনযির রাহ. (৩১৮ হি.) ''ইশরাফ'' গ্রন্থে (৩/১১২) এবং খাত্তাবী (৩৮৮ হি.) ও বাগাভী (৫১৬ হি.) সহ অন্যান্য গ্রন্থকারগণ। [দ্র. মাআলিমুস সুনান ২/৮৪, শরহুস সুন্নাহ ৪/১৪৫, আরো দেখা যেতে পারে : আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা ৬/২৮০ আছার : ৯৬৫৮]
আমাদের জানা মতে তাবেয়ী-যুগের এই তিন বিশিষ্ট মনীষীর বিপরীতে অন্য কোনো তাবেয়ীর ফতোয়া বিদ্যমান নেই। শুধু হাসান বসরী (১১০ হি.) রাহ. থেকে এমন একটি রেওয়ায়েত পাওয়া যায়, যা এই মাযহাবের বিপরীত ধারণা করা হতে পারে।
মাযহাবের ফকীহগণের ফতোয়া
ইমাম তিরমিযী রাহ. (২৭৯ হি.) তার 'জামি' গ্রন্থে কিতাবুস সিয়াম (সিয়াম-অধ্যায়)-এর নবম বাব (পরিচ্ছেদের) শিরোনাম দিয়েছেন-
باب ما جاء لكل أهل بلد رؤيتهم
(প্রত্যেক শহরবাসীর জন্য নিজ নিজ চাঁদ দেখা অনুসরণীয় সংক্রান্ত হাদীস) এই শিরোনামের অধীনে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর ঐ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, যা 'সাহাবা-যুগ' শীর্ষক আলোচনায় উল্লেখিত হয়েছে। এই হাদীস বর্ণনার পর ইমাম তিরমিযী রাহ. লেখেন-
حديث ابن عباس حديث حسن صحيح غريب. والعمل على هذا الحديث عند أهل العلم، أن لكل أهل بلد رؤيتهم.
ইবনে আব্বাস রা.-এর উপরোক্ত হাদীস 'সহীহ'। (ইমাম তিরমিযীর বিশেষ পরিভাষায় ''হাসানুন সহীহুন গরীবুন'') এবং আহলে ইলমের (ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণের) আমলও এটাই যে, প্রত্যেক শহরবাসীর জন্য নিজেদের দেখাই গ্রহণযোগ্য। (জামে তিরমিযী ২/২৩২, হাদীস : ৭০২-এর অধীনে)।
ইমাম তিরমিযী রাহ. বিধান সংক্রান্ত হাদীসের অধীনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে হাদীসের ইমাম ও মুজতাহিদ ফকীহগণের মাযহাব বর্ণনা করে থাকেন। সাহাবা, তাবেয়ীনের মাযহাবের সাথে চার ইমাম, সুফিয়ান ছাওরী ও ইসহাক ইবনে রাহূয়াহ রাহ.-এর মাযহাব বিশেষভাবে বর্ণনা করেন। অথচ আলোচ্য বিষয়ে তিনি কোনো ইখতিলাফই বর্ণনা করেননি। সাধারণভাবে 'আহলে ইলমে'র মাযহাব বর্ণনা করেছেন যে, 'প্রত্যেকে নিজ অঞ্চলের চাঁদ দেখা অনুসারে আমল করবে।' (অর্থাৎ দূর-দূরান্তের শহর-নগরের চাঁদ দেখা অবশ্যগ্রহণীয় নয়) বোঝা গেল, ইমাম তিরমিযী রাহ.-এর দৃষ্টিতে অধিকাংশ ফকীহ ও মুহাদ্দিসের মাসলাক সেটাই, যা তিনি উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত এ কারণেই এ বিষয়ে কোনো ইখতিলাফ বর্ণনার প্রয়োজন বোধ করেননি।
হানাফী ইমামগণের মন্তব্য
হানাফী মাযহাবের ইমামদের গ্রহণযোগ্য মতও এটাই ছিলো যে, দূরবর্তী অঞ্চলের এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য অপরিহার্য নয়। তবে এক অঞ্চল যদি অন্য অঞ্চলের এত কাছাকাছি হয় যে, উভয়ের উদয়স্থল (مطلع) এক, তাহলে এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অপর অঞ্চলের জন্য অপরিহার্য হবে।
এ ব্যাপারে হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত কয়েকজন ইমামের বক্তব্য নিম্নে পেশ করা হলো।
১. ইমাম আবুল হুসাইন আল কুদূরী রাহ. বলেন-
যদি দুই দেশের মাঝে দূরত্ব এতটুকু থাকে যে, উভয়ের
উদয়স্থল (مطلع) অভিন্ন, তাহলে এক অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য অপর অঞ্চলের চাঁদের হুকুম অপরিহার্যভাবে প্রযোজ্য হবে। পক্ষান্তরে যদি উভয় দেশের মাঝের দূরত্ব এত বেশি হয় যে, উভয়ের উদয়স্থল ভিন্ন, তাহলে এক অঞ্চলের চাঁদের হুকুম অপর অঞ্চলের জন্য অপরিহার্য নয়। ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া ৩/৩৬৫
২. ফকীহ আব্দুর রশীদ আল ওয়ালওয়ালিযী রাহ. বলেন-
'কোন অঞ্চলের অধিবাসীরা যদি রমযানের চাঁদ দেখে ত্রিশ রোযা রাখে, আর আরেক অঞ্চলের অধিবাসীরা রমযানের চাঁদ দেখে উনত্রিশ রোযা রাখে, এরপর যারা উনত্রিশ রোযা রেখেছে তারা ত্রিশ রোযা পালন কারীদের সম্পর্কে জানতে পারে, তাহলে তাদের উপর একটি রোযা কাযা করা ওয়াজিব। কেননা যারা ত্রিশ রোযা রেখেছে তারা রমযানের চাঁদ এক দিন আগে দেখেছে। এই বিধান তখন প্রযোজ্য, যখন উভয় অঞ্চলের মাঝে দূরত্ব এতটুকু হয় যে, উভয়ের উদয়াচল এক ও অভিন্ন। পক্ষান্তরে যদি উভয়ের উদয়াচল ভিন্ন ভিন্ন হয়, তাহলে এক অঞ্চলের চাঁদের হুকুম অপর অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য অপরিহার্য নয়।' ফাতাওয়ায়ে ওয়ালওয়ালিযিয়্যাহ ১/২৩৬
৩. ইমাম আলাউদ্দীন কাসানী রাহ. বলেন-
এই বিধান (এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য অপরিহার্য হবে) তখনই যখন উভয় অঞ্চল এমন কাছাকাছি হবে যে, উভয়ের উদয়াচল এক ও অভিন্ন। পক্ষান্তরে এক অঞ্চল অপর অঞ্চল থেকে যদি দূরে হয়, তাহলে এক অঞ্চলের চাঁদের বিধান অপর অঞ্চলের জন্য অপরিহার্য নয়। কেননা অনেক দূরত্ব হলে এক অঞ্চলের উদয়াচল অপর অঞ্চল থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই প্রত্যেক অঞ্চলের ক্ষেত্রে সে অঞ্চলের উদয়াচল বিবেচনা করা হবে (অর্থাৎ সে অঞ্চলে চাঁদ দেখা গেলে রোযা বা ঈদের বিধান সাব্যস্ত হবে, অন্যথায় নয় ) । বাদায়েউস সানায়ে ২/২২৪-২২৫,
৪. জহিরুদ্দীন আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ আল
বুখারী রাহ. এর বক্তব্য-
'যহীরিয়্যাহর লেখক জহিরুদ্দীন আল বুখারী রাহ. বলেন, উযাজান্দীকে জিজ্ঞেস করা হলো, কেউ তার ঋণদাতাকে বললো, ঈদের দিন তোমার ঋণ আদায় না করলে এই হবে (কোনো কসম করলো)। এখন এমন হলো যে, ঈদের দিন হলো; কিন্তু সে যে শহরের অধিবাসী সেখানকার কাযী স্পষ্ট কোনো দলীলের ভিত্তিতে সে দিন ঈদ না করার সিদ্ধান্ত দিলো এবং ঈদের নামায পড়লো না। পক্ষান্তরে অন্য কোনো শহরের কাযী সে দিন ঈদের দিন ধার্য করলো। (তাহলে কোন দিন ঈদের দিন গণ্য হবে এবং এ লোকের কসমের কী হবে?) উযাজান্দী রাহ. উত্তরে বললেন, দুই শহরের উদয়স্থল যদি অভিন্ন হয়, তাহলে এক শহরের কাযীর ঘোষণা অন্য শহরের জন্যও অবশ্য অনুসরণীয় হবে। রমযান শুরুর ঘোষণার ক্ষেত্রেও এ মাসআলা। আল বাহরুর রায়েক ৪/৬১৫
৫. ইমাম ফখরুদ্দীন যাইলা'য়ী রাহ. বলেন-
সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ মত হলো, চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা শরী'আতে গ্রহণযোগ্য হবে। কেননা প্রত্যেক সম্প্রদায় কোনো হুকুম পালনে ঐ সময় আদিষ্ট হবে যখন ঐ হুকুমের 'সবব' বা কারণ তাদের মধ্যে পাওয়া যাবে (অর্থাৎ অন্যের মাঝে পাওয়া গেলে সে হুকুম তাদের জন্য অপরিহার্য নয়)। সূর্যের কিরণ
থেকে চাঁদের পৃথক হওয়ার ক্ষেত্রে অঞ্চল ভেদে ব্যবধান হয়। যেমনিভাবে নামাযের ওয়াক্তসমূহ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে হয়। সুতরাং মাশরিকে (পূর্বাঞ্চলে) যখন সূর্য ঢলে পড়ে, তখন মাগরিবে (পশ্চিমাঞ্চলে) সূর্য ঢলে পড়া অপরিহার্য হয়ে যায় না। এমনিভাবে সূর্য উদয় ও সূর্য অস্তের সময়টাও এমনই। বরং সূর্য যখন এক ডিগ্রি নড়ে, তখন হয়তো কোথাও ফজরের ওয়াক্ত, ঠিক ঐ সময়ে অন্য জায়গায় সূর্য উদয়ের ওয়াক্ত, কোথাও সূর্যাস্তের সময়। আবার কোথাও অর্ধরাত্রি। তাবঈনুল হাকায়েক ২/১৬৫
অনেকেই এ কথা বলে থাকেন যে, 'ইখতেলাফে মাতালে এর ই'তেবার (বিবেচনা) হানাফী মাযহাবে শুধুমাত্র আলাউদ্দীন কাসানী রাহ. ও ফখরুদ্দীন যাইলা'য়ী রাহ.-ই করেছেন। আর পরবর্তী কেউ কেউ তাঁদের অনুসরণে এ কথা বলেছেন।
আমাদের পূর্বের আলোচনায় তাদের এ কথার দুর্বলতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ কাসানী রাহ. ও যাইলা'য়ী রাহ. এর আগেও অনেক ইমাম ও ফকীহ এ কথা বলে গেছেন। তাঁদের মাত্র কয়েকজনের উদ্ধৃতি আমরা পেশ করেছি। এছাড়া এটাই যে ছিলো সাহাবা, তাবেঈন ও পরবর্তীদের আমল, তাও আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি।
উপমহাদেশের হানাফী আলেমদের মন্তব্য
এবার আমরা এ ব্যাপারে উপমহাদেশের হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত কয়েকজন ফকীহর বক্তব্য পেশ করবো।
১. শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী রাহ. (১১৭৬ হি.) বলেন, 'যদি কোনো শহর থেকে চাঁদ দেখা যায় আর অন্য শহরে অনুসন্ধান করেও চাঁদ দেখা না যায়, আর দুই শহর কাছাকাছি হয়, তাহলে এক শহরের চাঁদ দেখা অপর শহরের জন্য প্রযোজ্য হবে। আর যদি এক শহর অপর শহর থেকে দূরে হয়, তাহলে এক শহরের চাঁদ দেখা অপর শহরের জন্য প্রযোজ্য হবে না। এই মাসআলা সাব্যস্ত হয় হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. এর হাদীস দ্বারা। তাছাড়া ঈদুল ফিতর, হজ্ব ইত্যাদি যে সকল মাসআলা হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ আছে সেগুলোর উপর কিয়াসের দাবিও এটাই।' আল মুসাফফা শরহুল মুআত্তা ১/২৩৭
২. আনোয়ার শাহ্ কাশ্মীরী রাহ. (১৩৫২ হি.) বলেন-
'এক্ষেত্রে ইমাম যায়লায়ী রাহ. এর মত মেনে নেয়া ব্যতীত কোনো উপায় নেই। অন্যথায় কোনো কোনো অঞ্চলে ঈদ কখনো রমযানের ২৭/২৮ বা ৩১/৩২ তারিখে হয়ে যাবে, যখন দুই দেশের দূরত্ব হবে অনেক বেশি। যেমন হিন্দুস্তান ও ইস্তাম্বুল। কারণ কখনো ইস্তাম্বুলে দুই দিন আগেই চাঁদ দেখা যাবে। অতঃপর হিন্দুস্তানে যখন ইস্তাম্বুলে চাঁদ দেখার দুই দিন পরে চাঁদ দেখা যাবে, এরপর তাদের চাঁদ দেখার খবর আমাদের কাছে পৌঁছবে, এখন যদি তাদের দেশের চাঁদ আমাদের উপর অপরিহার্য করে দেয়া হয়, তাহলে আমাদের ঈদ আগে করতে হবে। আমি যায়লায়ী রাহ. এর মতকেই অকাট্যভাবে গ্রহণ করেছি । মা'আরিফুল সুনান। ৫/৩৩৭
৩.মুফতী শফী রাহ. (১৩৯৬ হি.) এর বক্তব্য-
তিনি চাঁদ দেখা সংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র কিতাব রচনা করেছেন। তাতে তিনি আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ. ও শাব্বীর আহমাদ উসমানী রাহ. এর মত আলোচনার পর বলেন, যদি কয়েকটি দেশের মধ্যে দূরত্ব এত বেশি হয় যে, এক দেশের তারিখ আরেক দেশের থেকে ভিন্ন হয়, তখন ইখতেলাফে মাতালে এর ই'তেবার করাই আবশ্যক। আর এটাই হানাফী মাযহাবের মূল ধারার সাথে সামঞ্জস্যশীল। আমার উস্তাদের অনুসরণে এটাই আমার মত। জাওয়াহিরুল ফিকহ: ৩/৪৮৩
৪. সাইয়েদ মুহাম্মদ ইউসুফ বানূরী রাহ. (১৩৯৭হি.) এর মত-
তিনি জামে তিরমিযীর ব্যাখ্যাগ্রস্থ মা'আরিফুস সুনানে এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। এবং ইখতেলাফে মাতালে এর বিবেচনা করার মতটিকে সুদৃঢ়ভাবে সাব্যস্ত করেছেন। মাআরিফুস সুনান ৫/৩৩-৩৪০ ৩৫১ ৩৫.
অন্যান্য মাযহাবের ইমামদের মন্তব্য
মালেকি মাযহাবের প্রখ্যাত ইমাম আবু উমার ইবনে আবদিল বার মালেকী রাহ. (৪৬৩ হি.) ''আল ইসতিযকার'' গ্রন্থে ইমাম মালেক রাহ.-এর মিসরী শাগরিদ ও মাদানী শাগরিদগণের বর্ণনা ও অন্যান্য ফকীহগণের মাযহাব বর্ণনার পর লেখেন, 'অর্থাৎ তাঁরা সবাই এ বিষয়ে একমত যে, যে সকল শহর পরস্পর অনেক বেশি দূরে অবস্থিত যেমন আন্দালুস থেকে খোরাসান, সেখানে এক জায়গার চাঁদ দেখা অন্য জায়গায় প্রযোজ্য হবে না। (আলইসতিযকার শরহুল মুয়াত্তা ১০/৩০)
ইবনে জুযাই আলকালবী (৬৯৩-৭৪১ হি.)
ইমাম আবুল কাসেম মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ ইবনে জুযাই আলকালবী আলমালেকী ৭৪১ হিজরীতে যার শাহাদত, তিনি তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব ''আলকাওয়ানীনুল ফিকহিয়্যাহ''য় লেখেন, 'এখানে ইবনে জুযাই মালেকী রাহ. পরিষ্কার বলেছেন যে, অনেক দূরের শহর-নগরে যেমন আন্দালুস ও হিজায, এক শহরের চাঁদ দেখা অন্য শহরের জন্য অবশ্যঅনুসরণীয় (লাযিম) না হওয়া ইজমায়ী বা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত।' (আলকাওয়ানীনুল ফিকহিয়্যাহ, পৃষ্ঠা : ৮৯, আলকিসমুল আওয়াল, কিতাবুস সিয়াম)
কুয়েত ফতোয়া বোর্ডের ফতোয়া
অর্থাৎ কুয়েতবাসী ও কুয়েতে অবস্থানকারী প্রবাসীদের
কুয়েত হেলাল কমিটির ফয়সালা অনুসরণ করা অপরিহার্য। কারণ রাষ্ট্রের পক্ষ হতে এ কমিটিই এ ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের (চাঁদের সিদ্ধান্ত দেওয়ার) জন্য নির্ধারিত। তাই শনিবারের রোযা তাদের কাযা করতে হবে না। তাদের জন্য পয়লা রমযান ছিল রবিবার অর্থাৎ ১২ জুন, ১৯৮৩ ঈ.। (মাজমূআতুল ফাতাওয়াশ শরইয়্যাহ ১/২৩৩-২৩৪)
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আল উছাইমীন রাহ.
এর ফতোয়া (২৭.০৯.১৩৪৭-১৫.১০.১৪২১ হিজরী)
শায়খের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, রোযা ও ঈদে যেন গোটা উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এজন্য কিছু লোক মনে করেন, শুধু মক্কা মুকাররমার 'মাতলা' উদয়স্থলকেই বুনিয়াদ বানানো হোক। এ বিষয়ে আপনার সিদ্ধান্ত কী?
তিনি যে জবাব দিয়েছেন তার সারকথা এই যে, যখন এটা স্বীকৃত যে, উদয়স্থল আলাদা হয়ে থাকে তাহলে দলীলের দাবি প্রত্যেক এলাকার হুকুম আলাদা হওয়া, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ
অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যে (রমযান) মাস পাবে সে যেন তার রোযা রাখে। (সূরা বাকারা ২ : ১৮৫)
তো এখন যদি মক্কায় চাঁদ উদিত হওয়ার কারণে মক্কাবাসীরা এ মাসে উপনীত হল আর অন্যরা তাদের অঞ্চলে চাঁদ না উঠায় উপনীত হল না তাহলে আয়াতের হুকুম তাদের জন্য কীভাবে প্রযোজ্য হবে? হাদীসে আছে, 'তোমরা চাঁদ দেখলে রোযা রাখবে, চাঁদ দেখলে রোযা শেষ করবে।' (সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৯০৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৬৭)
তো মক্কাবাসীদের চাঁদ দেখার কারণে পাকিস্তান ও তারও পূর্বের লোকদের কীভাবে রোযা রাখতে বাধ্য করব? অথচ আমরা জানি যে, তাদের দিগন্তে চাঁদ ওঠেনি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো রোযাকে চাঁদ দেখার সাথেই যুক্ত করেছেন।
আরো আলোচনার পর শায়খ পুনরায় বলেন, দলীলের দাবি এটাই যে, প্রত্যেক জায়গার জন্য আলাদা বিধান হবে। (মক্কার 'মাতলা' (উদয়স্থল)-কে সব অঞ্চলের জন্য বুনিয়াদ বানানো ঠিক নয়) তাঁর আরবী ইবারতের শেষ অনুচ্ছেদ এই-
(ফাতাওয়া আরকানিল ইসলাম, শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আলউছাইমীন পৃষ্ঠা : ৪৫১, মাসআলা : ৩৯৩)
& রাবেতাতুল আলামিল ইসলামীর অধীনে নতুন-পুরাতন মাসাইলের তাহকীকে নিয়োজিত মজলিস, যার নাম 'আলমাজমাউল ফিকহিল ইসলামী মক্কা মুকাররমা' এবং সংক্ষেপে যাকে 'মাজমাউ মক্কা' বলা হয়, এর চতুর্থ দাওরায় (ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ ঈ.) 'চাঁদের ঐক্য' বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, যার মূল অংশ আলকাউসারের শাওয়াল ১৪৩৪ হি. সংখ্যায় উদ্ধৃত হয়েছে সেই সিদ্ধান্তেই 'ইখতিলাফুল মাতালি' উদয়স্থলের বিভিন্নতার প্রসঙ্গটিও আলোচনায় এসেছে এবং ঐ সিদ্ধান্তে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, মাজমা উদয়স্থলের বিভিন্নতার প্রসঙ্গটির উপর 'দিরাসাহ' (গবেষণা) করেছে এবং উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য হওয়ার মাসলাকটিই তাঁরা গ্রহণ করেছেন। তাদের বক্তব্য, এতে মুকাল্লাফদের জন্য সহজতাও আছে। আর কিয়াসের দাবিও তা-ই। আর এর পক্ষে শরয়ী দলীলও রয়েছে।
لقد درس المجمع الفقهي الإسلامي مسألة اختلاف المطالع، ...، ففي مسألة الأهلة ذهب إلى إثباتها بالرؤية البصرية ...، كما ذهب إلى اعتبار اختلاف المطالع، لما في ذلك من التخفيف على المكلفين، مع كونه هو الذي يقتضيه النظر الصحيح، فما يدعيه القائلون من وجوب الاتحاد في يومي الصوم والإفطار مخالف لما جاء شرعا وعقلا ...
وكثير من كتب أهل المذاهب الأربعة طافحة بذكر اعتبار اختلاف المطالع، للأدلة القائمة من الشريعة بذلك، وتطالعك الكتب الفقهية بما يشفي العليل ...
(কারারাতুল মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী, মক্কা মুকাররমা, পৃষ্ঠা : ৮৭-৮৮)
শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ
তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম পরিষ্কার বলেছেন-
"প্রশ্ন হল, কোনো ব্যক্তি কি এখানে (পাকিস্তান) সৌদি আরবের ফায়সালা অনুযায়ী আমল করতে পারবে? এর উত্তর, এখানে থেকে সৌদি আরবের ফায়সালা অনুযায়ী আমল করা জায়েয হবে না। কেননা সৌদি আরবের ফায়সালার এখানে কর্তৃত্ব নেই।
(ইনআমুল বারী, বুখারী শরীফের দরস সংকলন, মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী, খ- : ৫,/৪৯৭, মাকতাবাতুল হেরা, করাচী)।
কাজেই রোজা ও ঈদের ভিত্তি হচ্ছে চাঁদ দেখার উপর।
অর্থাৎ চাঁদ দেখা গেলে রমজান শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হবে, আর চাঁদ দেখা না গেলে রমজান শুরু হবে না। ঈদের ক্ষেত্রেও একই বিধান। আকাশ মেঘলা থাকায় চাঁদ দেখা না গেলেও, এবং জ্যোতির্বিদ্যার নিয়ম অনুযায়ী মেঘের আড়ালে তার অস্তিত্ব নিশ্চিত হলেও, বাহ্যিক চাঁদ দেখার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
তবে যদি কোনো এলাকায় কোনো কাযী বা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কমিটি সমগ্র জেলা বা প্রদেশ অথবা সমগ্র দেশের জন্য নির্ধারিত হয় এবং তারা শরয়ী শাহাদাত প্রাপ্তির পর চাঁদ দেখার ঘোষণা দেন, তাহলে তাদের সিদ্ধান্ত নির্ভরযোগ্য ও নিশ্চিত সুত্রে যখন উক্ত প্রদেশ বা দেশের বাসিন্দাদের কাছে পৌছবে তখন তাদের জন্যও আমল করা ওয়াজিব হবে।
যেহেতু কেন্দ্রীয় চাঁদ দেখা কমিটি শরয়ী কাযীর মর্যাদা রাখে, তাই তিনি শাহাদাত প্রাপ্তির পর চাঁদ দেখার ঘোষণা দিলে সেই অঞ্চলের যাদের কাছে এ ঘোষণা নির্ভরযোগ্য সূত্রে পৌঁছে, তাদের জন্য রোজা রাখা বা ঈদ পালন করা আবশ্যক।
তবে সর্বস্বীকৃত যে, প্রত্যেক কাযী ও শাসকের ফায়সালা তার এখতিয়ারের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আল্লাহ তা'য়ালা বুঝার তাওফিক দান করুক, আমিন।
মুফতি Khairul Islam 20/04/2023
নজরে সানী : মুফতি Affan Bin Sharfuddin হাফি.
কালেক্টড
কেননা আমাদের ঈদ ও রমজান অন্যান্য জাতির উৎসবের মতো উৎসব নয়, বরং বিশেষ ইবাদতের সময়, যেমন অন্যান্য ইবাদতে সময় বা তারিখ এক হওয়া শরয়ীভাবে জরুরি নয়। বরং আমরা দেখি যে, নামাযের সময় বিভিন্ন দেশে বা একই দেশের বিভিন্ন শহরে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। আমাদের শরীয়তে 'ইবাদতকে' বাহ্যিক নিদর্শনের সাথে যুক্ত করে অনেক সহজে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও, যদি সারা বিশ্বে একই তারিখে ঈদ উদযাপনের প্রয়োজন হতো, তাহলে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাদানী জীবনে, খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে ও সাহাবা-তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন এবং আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীনের যুগে এর কোনে ভিত্তি থাকতো। এবং এর জন্য তখন কেউ আওয়াজও তোলেনি।
যেমনটা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর বর্ণনা দ্বারা সাহাবায়ে কেরামের যুগে তার প্রমাণ পাওয়া যায় যে, শামে (সিরিয়াতে) শুক্রবার রাতে চাঁদ দেখা গেছে এবং মদীনায় সেদিন চাঁদ দেখা যায়নি। সিরিয়াবাসীরা শনিবার রোযা রাখে। অথচ মদিনার লোকেরা রবিবার থেকে রমজান শুরু করে। মদীনায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. হযরত কুরাইবের সাক্ষ্য দ্বারাই রমযান শেষ হওয়ার পূর্বেই সিরিয়ায় শুক্রবার দিন চাঁদ দেখার সংবাদ পেয়ে যান।
তাবেয়ী কুরাইব রহ. বর্ণানা করেন,
"উম্মুল ফযল বিনতে হারেস তার কোনো কাজে আমাকে শামে মু'আবিয়া রাযি. এর কাছে পাঠান। আমি শামে পৌঁছে তার কাজ পুরা করলাম। ইতোমধ্যে শামে রমযানের চাঁদ দেখা গেল। আমি সেখানে চাঁদ দেখেছিলাম শুক্রবার রাতে। তারপর মাসের শেষ দিকে মদীনায় ফিরে এলাম। তখন হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. এর সাথে সাক্ষাত হলে তিনি চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কোন দিন চাঁদ দেখেছিলে? আমি বললাম, শুক্রবার রাতে। তিনি বললেন, তুমি নিজে দেখেছ? আমি বললাম, হ্যাঁ, এবং সকলে দেখেছে। আর মু'আবিয়া রাযি. সহ সকলে রোযা রেখেছে। তখন তিনি বললেন, কিন্তু আমরা মদীনায় শনিবার রাতে চাঁদ দেখেছি। সুতরাং আমরা রোযাকে আমাদের হিসাব অনুযায়ী ত্রিশ দিন পূর্ণ করব অথবা নতুন চাঁদ দেখে রোযা ছাড়ব। আমি বললাম, হযরত মুআবিয়া রাযি. এর চাঁদ দেখা ও রোযা রাখাও কি চাঁদ প্রমাণের জন্য আপনার নিকট যথেষ্ট মনে হয় না? তিনি বললেন- না। আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ এরূপই আদেশ করেছেন। সহীহ মুসলিম ১/৩৪৮ মুসনাদে আহমদ ৫/১০, হাদীস নং ২৭৮৯
এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, মদীনা শরীফ ও শামের মাঝখানে স্থলপথে দূরত্ব হলো ১৯২৮ কিলোমিটার। সুতরাং শাম মদীনা থেকে অনেক দূরবর্তী দেশ। এখন কথা হলো কুরাইব রাহ. একজন ছিকাহ (নির্ভরযোগ্য) তাবে'য়ী। তিনি যখন হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. কে তার নিজের চাঁদ দেখা ও মুআবিয়া রাযি. এর চাঁদ দেখার খবর দিলেন, তখন ইবনে আব্বাস রাযি. তার এ সাক্ষ্য কবুল করলেন না। অথচ তিনি রাসূলুল্লাহ এর এই সহীহ হাদীসও জানতেন, (তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা ছাড়)। কারণ তিনি একথাও জানতেন, রাসূলুল্লাহ্ এর এই হাদীস নিকটবর্তী অঞ্চলগুলোর জন্য প্রযোজ্য। দূরবর্তী অঞ্চলগুলোর জন্য প্রযোজ্য নয়। এই জন্য তিনি বলেছেন-
هكذا أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم
"রাসূলুল্লাহ্ আমাদের এরূপই হুকুম করেছেন।"
যদি সারা বিশ্বে একই দিনে ঈদের নামায এবং একই দিনে রমজানের রোজা শুরু করা শরীয়াহ মোতাবেক কাম্য বিষয় হতো, তাহলে সিরিয়া দেশ থেকে অবিলম্বে আরও শাহাদাত (সাক্ষ্য) চেয়ে এই ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা হত। আর এটা কোনো কঠিন বিষয়ও ছিল না, কিন্তু হযরত ইবনে আব্বাস রা.- তাবেয়ী কুরাইবের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও তাতে কোনো মনোযোগ দেননি।
তাই সারা বিশ্বের সমগ্র মুসলমানদের জন্য একই দিনে
রমজানের রোজা শুরু করা এবং একই তারিখে ঈদ উদযাপন করা এবং এটাকে জরুরি বা পছন্দনীয় মনে করা, এ ধারণা সঠিক নয়।
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. আরো বলেন-
ঐ সকল লোকের উপর আমার আশ্চর্য হয়, যারা রমযান আসার আগেই রোযা রাখতে শুরু করে। আল্লাহর রাসূল সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো বলেছেন, যখন তোমরা চাঁদ দেখবে তখন রোযা রাখবে এবং যখন (দ্বিতীয়) চাঁদ দেখবে তখন রোযা ছাড়বে। চাঁদ যদি আড়ালে থাকে তাহলে ত্রিশ সংখ্যা পূর্ণ করবে। (আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী ৪/২০৭)
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. এ-ও বর্ণনা করেছেন-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
তোমরা একটি বা দুটি রোযার দ্বারা (রমযান) মাসের চেয়ে অগ্রগামী হয়ো না। তবে যদি তোমাদের কারো (অভ্যাসগত নফল) রোযার দিবস হয়, যা সে আগে থেকে রেখে আসছে তাহলে আলাদা কথা। আর তোমরা চাঁদ দেখার আগে রোযা রাখবে না এবং (দ্বিতীয়) চাঁদ দেখা পর্যন্তই রোযা রাখবে। যদি মেঘের কারণে চাঁদ দেখা না যায় তাহলে ত্রিশ সংখ্যা পূর্ণ করবে। (আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী ৪/২০৭)
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর কাছে যদি এ বিষয়ে (দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখা অবশ্যগ্রহণীয় না হওয়ার বিষয়ে) কোনো সুস্পষ্ট বাণী না-ও থেকে থাকে এবং তিনি 'রাসূলের আদেশ' বলে উপরোক্ত হাদীসের প্রতিই ইঙ্গিত করে থাকেন, তবুও তো এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তিনি
صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته
(তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ চাঁদ দেখে রোযা ছাড়।) শীর্ষক হাদীসের এই অর্থই বুঝেছেন যে, এ হাদীসে নিজ এলাকা ও নিকটবর্তী এলাকার চাঁদ দেখা উদ্দেশ্য। দূরবর্তী এলাকার চাঁদ দেখা উদ্দেশ্য নয়।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর এ অনুধাবনের সাথে কোনো মুজতাহিদ ইমামের যদি দ্বিমত থাকে তবে থাকতে পারে, কিন্তু এর দ্বারা দুটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে সামনে আসে :
এক. صوموا لرؤيته শীর্ষক হাদীসের এ ব্যাখ্যাই নির্ধারিত নয় যে, 'যেখানেই চাঁদ দেখা যাক তোমরা রোযা শুরু কর, দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখাও তোমাদের জন্য অবশ্যগ্রহণীয়।' কারণ আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. একজন ফকীহ সাহাবী এবং তিনি নিজে ঐ হাদীস আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছেন, কিন্তু তিনি এর ঐ অর্থ বোঝেননি।
দুই. আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর মাযহাব এই ছিল যে, দূরবর্তী এলাকার চাঁদ দেখা অবশ্যগ্রহণীয় নয়; নিজ এলাকার চাঁদ দেখাই আমলযোগ্য।
সাহাবা-যুগে আমরা সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর এই মাযহাব পেলাম যে, তিনি দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখা ধর্তব্য মনে করেননি। আর এ বিষয়ে অন্য কোনো সাহাবী তাঁর সাথে দ্বিমত করেছেন এমন তথ্য আমাদের জানামতে হাদীসের কিতাবসমূহে বর্ণিত হয়নি।
তাছাড়াও, ইসলামিক ইবাদত, যেমন রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদি চন্দ্র মাসের সাথে সম্পর্কিত এবং বিশেষ করে রমজানের শুরু করাটাই তো চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ তা'য়ালা ইরশাদ করেন,
فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ
'তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে ...। সুতরাং যে এই মাস পাবে সে যেন রোজা রাখে...।' সূরা বাকারাহ, ১৮৩-১৮৫
আর এর জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি সহজ ও সাধারণ উপায় বলে দিয়েছেন যে, ''তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো এবং চাঁদ দেখেই ইফতার করো (রোজা ছেড়ে দাও)।'' [সহিহ বুখারি ] যাতে একজন সাধারণ মুসলমানের পক্ষেও ফরজ ইবাদত আদায় করা সহজ হয়।
তাবেয়ী-যুগের আমল
ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ. মুয়াত্তা মালিকের ভাষ্যগ্রন্থ ''আততামহীদ'' কিতাবে এ বিষয়ে ইমামগণের মাযহাব বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথম মত এই উল্লেখ করেছেন যে, অন্য এলাকার চাঁদ দেখা অবশ্যগ্রহণীয় নয়। তিনি লেখেন, এটাই ইবনে আব্বাস রাযি. (সাহাবী) (৬৮ হি.), ইকরিমা (১০৭ হি.), কাসিম বিন মুহাম্মাদ (১০৭ হি.) ও সালিম বিন আবদুল্লাহ (১০৬ হি.) (এই তিনজন তাবেয়ী)-এর মাযহাব। এবং ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহও (২৩৮ হি.) এ কথাই বলেছেন। এরপর ইবনে আবদুল বার দ্বিতীয় মাযহাব বর্ণনার পর স্পষ্ট ভাষায় লেখেন, ''আমি প্রথম মতই গ্রহণ করি। কারণ এর সমর্থনে একটি মারফূ হাদীস আছে, যা সনদের বিচারে দলীলযোগ্য। আর তা এক বড় সাহাবীর মাযহাব। সাহাবীদের মধ্যে কেউ এ বিষয়ে তার বিরোধিতা করেননি। পাশাপাশি এটি ফকীহ-তাবেয়ীগণের একটি জামাতেরও সিদ্ধান্ত। আত-তামহীদ ১৪/৩৫৬-৩৫৮
'আততামহীদ' ছাড়া মুয়াত্তার দ্বিতীয় শরহ (ভাষ্যগ্রন্থ) 'আলইসতিযকারে'ও তিনি ঐ তাবেয়ীগণের মাযহাব উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ''এটিই ইকরিমা, কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ ও সালিম ইবনে আবদুল্লাহর বক্তব্য। ইবনুল মুবারক ও ইসহাক ইবনে রাহূয়াহসহ একটি জামাতের মাযহাবও এটিই।'' আলইসতিযকার ১০/২৯
এই তিন তাবেয়ীর মাযহাব সম্পর্কে একথা আরো অনেক আগে বলেছেন ইবনুল মুনযির রাহ. (৩১৮ হি.) ''ইশরাফ'' গ্রন্থে (৩/১১২) এবং খাত্তাবী (৩৮৮ হি.) ও বাগাভী (৫১৬ হি.) সহ অন্যান্য গ্রন্থকারগণ। [দ্র. মাআলিমুস সুনান ২/৮৪, শরহুস সুন্নাহ ৪/১৪৫, আরো দেখা যেতে পারে : আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা ৬/২৮০ আছার : ৯৬৫৮]
আমাদের জানা মতে তাবেয়ী-যুগের এই তিন বিশিষ্ট মনীষীর বিপরীতে অন্য কোনো তাবেয়ীর ফতোয়া বিদ্যমান নেই। শুধু হাসান বসরী (১১০ হি.) রাহ. থেকে এমন একটি রেওয়ায়েত পাওয়া যায়, যা এই মাযহাবের বিপরীত ধারণা করা হতে পারে।
মাযহাবের ফকীহগণের ফতোয়া
ইমাম তিরমিযী রাহ. (২৭৯ হি.) তার 'জামি' গ্রন্থে কিতাবুস সিয়াম (সিয়াম-অধ্যায়)-এর নবম বাব (পরিচ্ছেদের) শিরোনাম দিয়েছেন-
باب ما جاء لكل أهل بلد رؤيتهم
(প্রত্যেক শহরবাসীর জন্য নিজ নিজ চাঁদ দেখা অনুসরণীয় সংক্রান্ত হাদীস) এই শিরোনামের অধীনে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর ঐ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, যা 'সাহাবা-যুগ' শীর্ষক আলোচনায় উল্লেখিত হয়েছে। এই হাদীস বর্ণনার পর ইমাম তিরমিযী রাহ. লেখেন-
حديث ابن عباس حديث حسن صحيح غريب. والعمل على هذا الحديث عند أهل العلم، أن لكل أهل بلد رؤيتهم.
ইবনে আব্বাস রা.-এর উপরোক্ত হাদীস 'সহীহ'। (ইমাম তিরমিযীর বিশেষ পরিভাষায় ''হাসানুন সহীহুন গরীবুন'') এবং আহলে ইলমের (ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণের) আমলও এটাই যে, প্রত্যেক শহরবাসীর জন্য নিজেদের দেখাই গ্রহণযোগ্য। (জামে তিরমিযী ২/২৩২, হাদীস : ৭০২-এর অধীনে)।
ইমাম তিরমিযী রাহ. বিধান সংক্রান্ত হাদীসের অধীনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে হাদীসের ইমাম ও মুজতাহিদ ফকীহগণের মাযহাব বর্ণনা করে থাকেন। সাহাবা, তাবেয়ীনের মাযহাবের সাথে চার ইমাম, সুফিয়ান ছাওরী ও ইসহাক ইবনে রাহূয়াহ রাহ.-এর মাযহাব বিশেষভাবে বর্ণনা করেন। অথচ আলোচ্য বিষয়ে তিনি কোনো ইখতিলাফই বর্ণনা করেননি। সাধারণভাবে 'আহলে ইলমে'র মাযহাব বর্ণনা করেছেন যে, 'প্রত্যেকে নিজ অঞ্চলের চাঁদ দেখা অনুসারে আমল করবে।' (অর্থাৎ দূর-দূরান্তের শহর-নগরের চাঁদ দেখা অবশ্যগ্রহণীয় নয়) বোঝা গেল, ইমাম তিরমিযী রাহ.-এর দৃষ্টিতে অধিকাংশ ফকীহ ও মুহাদ্দিসের মাসলাক সেটাই, যা তিনি উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত এ কারণেই এ বিষয়ে কোনো ইখতিলাফ বর্ণনার প্রয়োজন বোধ করেননি।
হানাফী ইমামগণের মন্তব্য
হানাফী মাযহাবের ইমামদের গ্রহণযোগ্য মতও এটাই ছিলো যে, দূরবর্তী অঞ্চলের এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য অপরিহার্য নয়। তবে এক অঞ্চল যদি অন্য অঞ্চলের এত কাছাকাছি হয় যে, উভয়ের উদয়স্থল (مطلع) এক, তাহলে এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অপর অঞ্চলের জন্য অপরিহার্য হবে।
এ ব্যাপারে হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত কয়েকজন ইমামের বক্তব্য নিম্নে পেশ করা হলো।
১. ইমাম আবুল হুসাইন আল কুদূরী রাহ. বলেন-
যদি দুই দেশের মাঝে দূরত্ব এতটুকু থাকে যে, উভয়ের
উদয়স্থল (مطلع) অভিন্ন, তাহলে এক অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য অপর অঞ্চলের চাঁদের হুকুম অপরিহার্যভাবে প্রযোজ্য হবে। পক্ষান্তরে যদি উভয় দেশের মাঝের দূরত্ব এত বেশি হয় যে, উভয়ের উদয়স্থল ভিন্ন, তাহলে এক অঞ্চলের চাঁদের হুকুম অপর অঞ্চলের জন্য অপরিহার্য নয়। ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া ৩/৩৬৫
২. ফকীহ আব্দুর রশীদ আল ওয়ালওয়ালিযী রাহ. বলেন-
'কোন অঞ্চলের অধিবাসীরা যদি রমযানের চাঁদ দেখে ত্রিশ রোযা রাখে, আর আরেক অঞ্চলের অধিবাসীরা রমযানের চাঁদ দেখে উনত্রিশ রোযা রাখে, এরপর যারা উনত্রিশ রোযা রেখেছে তারা ত্রিশ রোযা পালন কারীদের সম্পর্কে জানতে পারে, তাহলে তাদের উপর একটি রোযা কাযা করা ওয়াজিব। কেননা যারা ত্রিশ রোযা রেখেছে তারা রমযানের চাঁদ এক দিন আগে দেখেছে। এই বিধান তখন প্রযোজ্য, যখন উভয় অঞ্চলের মাঝে দূরত্ব এতটুকু হয় যে, উভয়ের উদয়াচল এক ও অভিন্ন। পক্ষান্তরে যদি উভয়ের উদয়াচল ভিন্ন ভিন্ন হয়, তাহলে এক অঞ্চলের চাঁদের হুকুম অপর অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য অপরিহার্য নয়।' ফাতাওয়ায়ে ওয়ালওয়ালিযিয়্যাহ ১/২৩৬
৩. ইমাম আলাউদ্দীন কাসানী রাহ. বলেন-
এই বিধান (এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য অপরিহার্য হবে) তখনই যখন উভয় অঞ্চল এমন কাছাকাছি হবে যে, উভয়ের উদয়াচল এক ও অভিন্ন। পক্ষান্তরে এক অঞ্চল অপর অঞ্চল থেকে যদি দূরে হয়, তাহলে এক অঞ্চলের চাঁদের বিধান অপর অঞ্চলের জন্য অপরিহার্য নয়। কেননা অনেক দূরত্ব হলে এক অঞ্চলের উদয়াচল অপর অঞ্চল থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই প্রত্যেক অঞ্চলের ক্ষেত্রে সে অঞ্চলের উদয়াচল বিবেচনা করা হবে (অর্থাৎ সে অঞ্চলে চাঁদ দেখা গেলে রোযা বা ঈদের বিধান সাব্যস্ত হবে, অন্যথায় নয় ) । বাদায়েউস সানায়ে ২/২২৪-২২৫,
৪. জহিরুদ্দীন আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ আল
বুখারী রাহ. এর বক্তব্য-
'যহীরিয়্যাহর লেখক জহিরুদ্দীন আল বুখারী রাহ. বলেন, উযাজান্দীকে জিজ্ঞেস করা হলো, কেউ তার ঋণদাতাকে বললো, ঈদের দিন তোমার ঋণ আদায় না করলে এই হবে (কোনো কসম করলো)। এখন এমন হলো যে, ঈদের দিন হলো; কিন্তু সে যে শহরের অধিবাসী সেখানকার কাযী স্পষ্ট কোনো দলীলের ভিত্তিতে সে দিন ঈদ না করার সিদ্ধান্ত দিলো এবং ঈদের নামায পড়লো না। পক্ষান্তরে অন্য কোনো শহরের কাযী সে দিন ঈদের দিন ধার্য করলো। (তাহলে কোন দিন ঈদের দিন গণ্য হবে এবং এ লোকের কসমের কী হবে?) উযাজান্দী রাহ. উত্তরে বললেন, দুই শহরের উদয়স্থল যদি অভিন্ন হয়, তাহলে এক শহরের কাযীর ঘোষণা অন্য শহরের জন্যও অবশ্য অনুসরণীয় হবে। রমযান শুরুর ঘোষণার ক্ষেত্রেও এ মাসআলা। আল বাহরুর রায়েক ৪/৬১৫
৫. ইমাম ফখরুদ্দীন যাইলা'য়ী রাহ. বলেন-
সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ মত হলো, চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা শরী'আতে গ্রহণযোগ্য হবে। কেননা প্রত্যেক সম্প্রদায় কোনো হুকুম পালনে ঐ সময় আদিষ্ট হবে যখন ঐ হুকুমের 'সবব' বা কারণ তাদের মধ্যে পাওয়া যাবে (অর্থাৎ অন্যের মাঝে পাওয়া গেলে সে হুকুম তাদের জন্য অপরিহার্য নয়)। সূর্যের কিরণ
থেকে চাঁদের পৃথক হওয়ার ক্ষেত্রে অঞ্চল ভেদে ব্যবধান হয়। যেমনিভাবে নামাযের ওয়াক্তসমূহ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে হয়। সুতরাং মাশরিকে (পূর্বাঞ্চলে) যখন সূর্য ঢলে পড়ে, তখন মাগরিবে (পশ্চিমাঞ্চলে) সূর্য ঢলে পড়া অপরিহার্য হয়ে যায় না। এমনিভাবে সূর্য উদয় ও সূর্য অস্তের সময়টাও এমনই। বরং সূর্য যখন এক ডিগ্রি নড়ে, তখন হয়তো কোথাও ফজরের ওয়াক্ত, ঠিক ঐ সময়ে অন্য জায়গায় সূর্য উদয়ের ওয়াক্ত, কোথাও সূর্যাস্তের সময়। আবার কোথাও অর্ধরাত্রি। তাবঈনুল হাকায়েক ২/১৬৫
অনেকেই এ কথা বলে থাকেন যে, 'ইখতেলাফে মাতালে এর ই'তেবার (বিবেচনা) হানাফী মাযহাবে শুধুমাত্র আলাউদ্দীন কাসানী রাহ. ও ফখরুদ্দীন যাইলা'য়ী রাহ.-ই করেছেন। আর পরবর্তী কেউ কেউ তাঁদের অনুসরণে এ কথা বলেছেন।
আমাদের পূর্বের আলোচনায় তাদের এ কথার দুর্বলতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ কাসানী রাহ. ও যাইলা'য়ী রাহ. এর আগেও অনেক ইমাম ও ফকীহ এ কথা বলে গেছেন। তাঁদের মাত্র কয়েকজনের উদ্ধৃতি আমরা পেশ করেছি। এছাড়া এটাই যে ছিলো সাহাবা, তাবেঈন ও পরবর্তীদের আমল, তাও আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি।
উপমহাদেশের হানাফী আলেমদের মন্তব্য
এবার আমরা এ ব্যাপারে উপমহাদেশের হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত কয়েকজন ফকীহর বক্তব্য পেশ করবো।
১. শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী রাহ. (১১৭৬ হি.) বলেন, 'যদি কোনো শহর থেকে চাঁদ দেখা যায় আর অন্য শহরে অনুসন্ধান করেও চাঁদ দেখা না যায়, আর দুই শহর কাছাকাছি হয়, তাহলে এক শহরের চাঁদ দেখা অপর শহরের জন্য প্রযোজ্য হবে। আর যদি এক শহর অপর শহর থেকে দূরে হয়, তাহলে এক শহরের চাঁদ দেখা অপর শহরের জন্য প্রযোজ্য হবে না। এই মাসআলা সাব্যস্ত হয় হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. এর হাদীস দ্বারা। তাছাড়া ঈদুল ফিতর, হজ্ব ইত্যাদি যে সকল মাসআলা হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ আছে সেগুলোর উপর কিয়াসের দাবিও এটাই।' আল মুসাফফা শরহুল মুআত্তা ১/২৩৭
২. আনোয়ার শাহ্ কাশ্মীরী রাহ. (১৩৫২ হি.) বলেন-
'এক্ষেত্রে ইমাম যায়লায়ী রাহ. এর মত মেনে নেয়া ব্যতীত কোনো উপায় নেই। অন্যথায় কোনো কোনো অঞ্চলে ঈদ কখনো রমযানের ২৭/২৮ বা ৩১/৩২ তারিখে হয়ে যাবে, যখন দুই দেশের দূরত্ব হবে অনেক বেশি। যেমন হিন্দুস্তান ও ইস্তাম্বুল। কারণ কখনো ইস্তাম্বুলে দুই দিন আগেই চাঁদ দেখা যাবে। অতঃপর হিন্দুস্তানে যখন ইস্তাম্বুলে চাঁদ দেখার দুই দিন পরে চাঁদ দেখা যাবে, এরপর তাদের চাঁদ দেখার খবর আমাদের কাছে পৌঁছবে, এখন যদি তাদের দেশের চাঁদ আমাদের উপর অপরিহার্য করে দেয়া হয়, তাহলে আমাদের ঈদ আগে করতে হবে। আমি যায়লায়ী রাহ. এর মতকেই অকাট্যভাবে গ্রহণ করেছি । মা'আরিফুল সুনান। ৫/৩৩৭
৩.মুফতী শফী রাহ. (১৩৯৬ হি.) এর বক্তব্য-
তিনি চাঁদ দেখা সংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র কিতাব রচনা করেছেন। তাতে তিনি আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ. ও শাব্বীর আহমাদ উসমানী রাহ. এর মত আলোচনার পর বলেন, যদি কয়েকটি দেশের মধ্যে দূরত্ব এত বেশি হয় যে, এক দেশের তারিখ আরেক দেশের থেকে ভিন্ন হয়, তখন ইখতেলাফে মাতালে এর ই'তেবার করাই আবশ্যক। আর এটাই হানাফী মাযহাবের মূল ধারার সাথে সামঞ্জস্যশীল। আমার উস্তাদের অনুসরণে এটাই আমার মত। জাওয়াহিরুল ফিকহ: ৩/৪৮৩
৪. সাইয়েদ মুহাম্মদ ইউসুফ বানূরী রাহ. (১৩৯৭হি.) এর মত-
তিনি জামে তিরমিযীর ব্যাখ্যাগ্রস্থ মা'আরিফুস সুনানে এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। এবং ইখতেলাফে মাতালে এর বিবেচনা করার মতটিকে সুদৃঢ়ভাবে সাব্যস্ত করেছেন। মাআরিফুস সুনান ৫/৩৩-৩৪০ ৩৫১ ৩৫.
অন্যান্য মাযহাবের ইমামদের মন্তব্য
মালেকি মাযহাবের প্রখ্যাত ইমাম আবু উমার ইবনে আবদিল বার মালেকী রাহ. (৪৬৩ হি.) ''আল ইসতিযকার'' গ্রন্থে ইমাম মালেক রাহ.-এর মিসরী শাগরিদ ও মাদানী শাগরিদগণের বর্ণনা ও অন্যান্য ফকীহগণের মাযহাব বর্ণনার পর লেখেন, 'অর্থাৎ তাঁরা সবাই এ বিষয়ে একমত যে, যে সকল শহর পরস্পর অনেক বেশি দূরে অবস্থিত যেমন আন্দালুস থেকে খোরাসান, সেখানে এক জায়গার চাঁদ দেখা অন্য জায়গায় প্রযোজ্য হবে না। (আলইসতিযকার শরহুল মুয়াত্তা ১০/৩০)
ইবনে জুযাই আলকালবী (৬৯৩-৭৪১ হি.)
ইমাম আবুল কাসেম মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ ইবনে জুযাই আলকালবী আলমালেকী ৭৪১ হিজরীতে যার শাহাদত, তিনি তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব ''আলকাওয়ানীনুল ফিকহিয়্যাহ''য় লেখেন, 'এখানে ইবনে জুযাই মালেকী রাহ. পরিষ্কার বলেছেন যে, অনেক দূরের শহর-নগরে যেমন আন্দালুস ও হিজায, এক শহরের চাঁদ দেখা অন্য শহরের জন্য অবশ্যঅনুসরণীয় (লাযিম) না হওয়া ইজমায়ী বা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত।' (আলকাওয়ানীনুল ফিকহিয়্যাহ, পৃষ্ঠা : ৮৯, আলকিসমুল আওয়াল, কিতাবুস সিয়াম)
কুয়েত ফতোয়া বোর্ডের ফতোয়া
অর্থাৎ কুয়েতবাসী ও কুয়েতে অবস্থানকারী প্রবাসীদের
কুয়েত হেলাল কমিটির ফয়সালা অনুসরণ করা অপরিহার্য। কারণ রাষ্ট্রের পক্ষ হতে এ কমিটিই এ ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের (চাঁদের সিদ্ধান্ত দেওয়ার) জন্য নির্ধারিত। তাই শনিবারের রোযা তাদের কাযা করতে হবে না। তাদের জন্য পয়লা রমযান ছিল রবিবার অর্থাৎ ১২ জুন, ১৯৮৩ ঈ.। (মাজমূআতুল ফাতাওয়াশ শরইয়্যাহ ১/২৩৩-২৩৪)
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আল উছাইমীন রাহ.
এর ফতোয়া (২৭.০৯.১৩৪৭-১৫.১০.১৪২১ হিজরী)
শায়খের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, রোযা ও ঈদে যেন গোটা উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এজন্য কিছু লোক মনে করেন, শুধু মক্কা মুকাররমার 'মাতলা' উদয়স্থলকেই বুনিয়াদ বানানো হোক। এ বিষয়ে আপনার সিদ্ধান্ত কী?
তিনি যে জবাব দিয়েছেন তার সারকথা এই যে, যখন এটা স্বীকৃত যে, উদয়স্থল আলাদা হয়ে থাকে তাহলে দলীলের দাবি প্রত্যেক এলাকার হুকুম আলাদা হওয়া, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ
অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যে (রমযান) মাস পাবে সে যেন তার রোযা রাখে। (সূরা বাকারা ২ : ১৮৫)
তো এখন যদি মক্কায় চাঁদ উদিত হওয়ার কারণে মক্কাবাসীরা এ মাসে উপনীত হল আর অন্যরা তাদের অঞ্চলে চাঁদ না উঠায় উপনীত হল না তাহলে আয়াতের হুকুম তাদের জন্য কীভাবে প্রযোজ্য হবে? হাদীসে আছে, 'তোমরা চাঁদ দেখলে রোযা রাখবে, চাঁদ দেখলে রোযা শেষ করবে।' (সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৯০৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৬৭)
তো মক্কাবাসীদের চাঁদ দেখার কারণে পাকিস্তান ও তারও পূর্বের লোকদের কীভাবে রোযা রাখতে বাধ্য করব? অথচ আমরা জানি যে, তাদের দিগন্তে চাঁদ ওঠেনি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো রোযাকে চাঁদ দেখার সাথেই যুক্ত করেছেন।
আরো আলোচনার পর শায়খ পুনরায় বলেন, দলীলের দাবি এটাই যে, প্রত্যেক জায়গার জন্য আলাদা বিধান হবে। (মক্কার 'মাতলা' (উদয়স্থল)-কে সব অঞ্চলের জন্য বুনিয়াদ বানানো ঠিক নয়) তাঁর আরবী ইবারতের শেষ অনুচ্ছেদ এই-
(ফাতাওয়া আরকানিল ইসলাম, শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আলউছাইমীন পৃষ্ঠা : ৪৫১, মাসআলা : ৩৯৩)
& রাবেতাতুল আলামিল ইসলামীর অধীনে নতুন-পুরাতন মাসাইলের তাহকীকে নিয়োজিত মজলিস, যার নাম 'আলমাজমাউল ফিকহিল ইসলামী মক্কা মুকাররমা' এবং সংক্ষেপে যাকে 'মাজমাউ মক্কা' বলা হয়, এর চতুর্থ দাওরায় (ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ ঈ.) 'চাঁদের ঐক্য' বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, যার মূল অংশ আলকাউসারের শাওয়াল ১৪৩৪ হি. সংখ্যায় উদ্ধৃত হয়েছে সেই সিদ্ধান্তেই 'ইখতিলাফুল মাতালি' উদয়স্থলের বিভিন্নতার প্রসঙ্গটিও আলোচনায় এসেছে এবং ঐ সিদ্ধান্তে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, মাজমা উদয়স্থলের বিভিন্নতার প্রসঙ্গটির উপর 'দিরাসাহ' (গবেষণা) করেছে এবং উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য হওয়ার মাসলাকটিই তাঁরা গ্রহণ করেছেন। তাদের বক্তব্য, এতে মুকাল্লাফদের জন্য সহজতাও আছে। আর কিয়াসের দাবিও তা-ই। আর এর পক্ষে শরয়ী দলীলও রয়েছে।
لقد درس المجمع الفقهي الإسلامي مسألة اختلاف المطالع، ...، ففي مسألة الأهلة ذهب إلى إثباتها بالرؤية البصرية ...، كما ذهب إلى اعتبار اختلاف المطالع، لما في ذلك من التخفيف على المكلفين، مع كونه هو الذي يقتضيه النظر الصحيح، فما يدعيه القائلون من وجوب الاتحاد في يومي الصوم والإفطار مخالف لما جاء شرعا وعقلا ...
وكثير من كتب أهل المذاهب الأربعة طافحة بذكر اعتبار اختلاف المطالع، للأدلة القائمة من الشريعة بذلك، وتطالعك الكتب الفقهية بما يشفي العليل ...
(কারারাতুল মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী, মক্কা মুকাররমা, পৃষ্ঠা : ৮৭-৮৮)
শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ
তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম পরিষ্কার বলেছেন-
"প্রশ্ন হল, কোনো ব্যক্তি কি এখানে (পাকিস্তান) সৌদি আরবের ফায়সালা অনুযায়ী আমল করতে পারবে? এর উত্তর, এখানে থেকে সৌদি আরবের ফায়সালা অনুযায়ী আমল করা জায়েয হবে না। কেননা সৌদি আরবের ফায়সালার এখানে কর্তৃত্ব নেই।
(ইনআমুল বারী, বুখারী শরীফের দরস সংকলন, মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী, খ- : ৫,/৪৯৭, মাকতাবাতুল হেরা, করাচী)।
কাজেই রোজা ও ঈদের ভিত্তি হচ্ছে চাঁদ দেখার উপর।
অর্থাৎ চাঁদ দেখা গেলে রমজান শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হবে, আর চাঁদ দেখা না গেলে রমজান শুরু হবে না। ঈদের ক্ষেত্রেও একই বিধান। আকাশ মেঘলা থাকায় চাঁদ দেখা না গেলেও, এবং জ্যোতির্বিদ্যার নিয়ম অনুযায়ী মেঘের আড়ালে তার অস্তিত্ব নিশ্চিত হলেও, বাহ্যিক চাঁদ দেখার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
তবে যদি কোনো এলাকায় কোনো কাযী বা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কমিটি সমগ্র জেলা বা প্রদেশ অথবা সমগ্র দেশের জন্য নির্ধারিত হয় এবং তারা শরয়ী শাহাদাত প্রাপ্তির পর চাঁদ দেখার ঘোষণা দেন, তাহলে তাদের সিদ্ধান্ত নির্ভরযোগ্য ও নিশ্চিত সুত্রে যখন উক্ত প্রদেশ বা দেশের বাসিন্দাদের কাছে পৌছবে তখন তাদের জন্যও আমল করা ওয়াজিব হবে।
যেহেতু কেন্দ্রীয় চাঁদ দেখা কমিটি শরয়ী কাযীর মর্যাদা রাখে, তাই তিনি শাহাদাত প্রাপ্তির পর চাঁদ দেখার ঘোষণা দিলে সেই অঞ্চলের যাদের কাছে এ ঘোষণা নির্ভরযোগ্য সূত্রে পৌঁছে, তাদের জন্য রোজা রাখা বা ঈদ পালন করা আবশ্যক।
তবে সর্বস্বীকৃত যে, প্রত্যেক কাযী ও শাসকের ফায়সালা তার এখতিয়ারের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আল্লাহ তা'য়ালা বুঝার তাওফিক দান করুক, আমিন।
মুফতি Khairul Islam 20/04/2023
নজরে সানী : মুফতি Affan Bin Sharfuddin হাফি.
কালেক্টড