দোতলা ভবনটি পূর্ব-পশ্চিম লম্বা। পূর্ব দিক দিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ির গোড়ায় সুড়ঙ্গের চৌকোণ মুখ। প্রবেশমুখ ইট দিয়ে বন্ধ এখন। তবে বছর কয়েক আগেও খোলা ছিল। ২৯ বছরের ওয়ারেসুল হক যেমন দেখেছেন তাঁর ছোটবেলায়। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় কৌতূহলবশে বাড়ির পাশের সেই সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকেও ছিলেন। চামচিকা আর অন্ধকারের কারণে ১০-১২ হাতের বেশি সামনে এগোতে পারেননি।
ভবনের ছাদ কড়ি-বর্গার। কার্নিশে কাঠের চমৎকার নকশা এখনো অটুট। বাঁকানো সিঁড়িগুলো বেশ সুন্দর। একতলার ছাদের কড়ি-বর্গা অবিকল রয়েছে। প্রতি তলায় ছোট-বড় তিনটি করে ঘর রয়েছে। একটি হলরুমের মতো বড়। অন্য দুটি ছোট। প্রায় ৩০০ বছর আগের চৌকাঠগুলো এখনো ভালো আছে। শুধু ওপরতলার ছাদ ও জানালার পাল্লাগুলো নষ্ট হয়েছে।
প্রবেশমুখ ইট দিয়ে বন্ধ এখন
ভবনের চেয়েও আমার আগ্রহ ছিল সেই সুড়ঙ্গ। এই সুড়ঙ্গ দেখতেই রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার জামিরা গ্রামে গিয়েছিলাম গত ১৩ আগস্ট। জনতা ব্যাংকের একটি শাখার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ওয়ারেসুলের সঙ্গে সেখানেই পরিচয়। যে সুড়ঙ্গের কিছুটা ভেতরে ঢুকেছিলেন ওয়ারেসুল, সেটি অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ডাচ ব্যবসায়ীদের তৈরি। দ্বিতল ভবনটি ব্রিটিশ আমলে পুঠিয়ার চার আনার রাজার কাছারিবাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখন একটি মাদ্রাসা তাদের ছাত্রীনিবাস বানিয়েছে। শিশুরা ভয় পায় বলে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ সুড়ঙ্গের মুখটি ইট দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকের ধারণা, ডাকাতদের কবল থেকে অর্থসম্পদ বাঁচাতেই এই সুড়ঙ্গ বানানো হয়েছিল।
কেউ কি সুড়ঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে জামিরা গ্রামের অনেকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, নওশাদ আলী নামের এক ব্যক্তি এই সুড়ঙ্গের সবচেয়ে দূরে গিয়েছিলেন। চার-পাঁচ বছর আগে তিনি মারা গেছেন।
হেরিটেজ রাজশাহীর প্রতিষ্ঠাতা ও গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, রেশম ও কার্পাস তুলার ব্যবসার জন্য ডাচ ব্যবসায়ীরা ১৭২৫ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে কোনো এক সময় রাজশাহীর বড়কুঠি ভবন নির্মাণ করেছিলেন। জামিরার ভবনটিও এই সমসাময়িক। বড়কুঠি ও জামিরা ভবনের গঠনশৈলী একই।
সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষের বাসভবন হিসেবে যে ভবনটি ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটিও ডাচদের তৈরি। পরে ভবনগুলো ব্রিটিশদের সঙ্গে বিনিময় করা হয়েছিল। বড়কুঠি দুই বছর আগে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে চলে গেছে।
মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, জামিরা গ্রামের পাশ দিয়ে পদ্মার শাখা নারদ নদ প্রবাহিত হতো। পলাশীর প্রান্তরে পরাজিত সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যরা নারদ নদ হয়ে এই জামিরা গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
ব্রিটিশ আমলেই পুঠিয়ার চার আনার রাজা এই ভবন কাছারিবাড়ি হিসেবে ব্যবহার করতেন। পাকিস্তান আমলে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার আগপর্যন্ত এটি তা-ই ছিল। শেষ পর্যন্ত এই কাছারিবাড়ির নায়েব হিসেবে কর্মরত ছিলেন পুঠিয়ার লস্করপুর ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আ ন ম মনিরুল ইসলামের বাবা নাসির উদ্দিন মোল্লা। মনিরুল ইসলামের বাবা ১৯৭৯ সালের ২৩ নভেম্বর মারা যান। তিনি বাবার কাছ থেকে এই কাছারিবাড়ির অনেক গল্প শুনেছেন। মনিরুল বলেন, ‘তখন বাবা জামিরা গ্রামের আহাদ আলী সরকারের বাড়িতে জায়গির থাকতেন। ১৫ দিন পরপর পুঠিয়ার রাজবাড়িতে এসে ট্রেজারিতে চালান জমা দিয়ে আবার চলে যেতেন।’
সুড়ঙ্গের এই ভবন জামিরা ফাইজি আম দারুল উলুম মাদ্রাসার সম্পত্তি। এটি একটি কওমি মাদ্রাসা। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ইশতিয়াক ইয়াহিয়া বললেন, মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৫২ সালের কিছু আগে-পরে। প্রাচীন ভবনটি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে তাঁরা ৯৯ বছরের জন্য বন্দোবস্ত নিয়েছেন।
সুড়ঙ্গটা কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত, এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। কেউ বলেন নারদ নদ পর্যন্ত গেছে। আসলে কেউ শেষ পর্যন্ত ভেতরে ঢুকে দেখেননি। ভেতরে যাওয়াই যায় না, তাই জানাও যায় না এই সুড়ঙ্গের শেষ কত দূরে।
[FA]pen[/FA] লেখক: আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী