পর্ব সাত – সাহচর্যের হাত (#3-47)
বিকেল থেকেই আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। গ্রীষ্ম কাটিয়ে বর্ষা এসে গেছে। ঘন কালো বর্ষার মেঘ গুরগুর চড়চড় আওয়াজ করে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করে দেয়, থেকে থেকে বজ্র বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে কালো আকাশ চিরে খানখান করে দেয়। পরিকল্পনা মাফিক, ঝড় মাথায় নিয়ে নিশুতি রাতের অন্ধকারে দুই খানা নৌকায় জনা দশেক লোক যাত্রা শুরু করে। নৌকায় চড়ার আগে একবার মোবাইল খুলে ইন্দ্রাণীর ছবি দেখে বুকের ওপরে লাগিয়ে নেয়। যদি এই ভয়ঙ্কর কাজে মৃত্যু হয় তাহলে ওর ছবি বুকে নিয়েই মরবে। এক নৌকার হালে রামিজ অন্য নৌকায় শঙ্কর। সবার পরনে গেঞ্জি লুঙ্গি, মাথায় কোমরে গামছা বাঁধা, পাকা মাঝি মোল্লা জেলেদের মতন সাজে সজ্জিত সবাই। নৌকা ছাড়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কাছে পিঠে কোথাও একটা বাজ পড়ে। দানা চমকে ওঠে আর বাকি সবাই হেসে দেয় ওর চমকানি দেখে। যে মানুষ কোনোদিন শহরের বাইরে পা রাখেনি, সেই মানুষ নৌকায় পা রেখে অসীম সমুদ্র পানে ধেয়ে চলেছে। দুর্যোগের গভীর রাতে নদীর কালো কেটে এগোতে এগোতে দানার একটু গা ছমছম করছিল কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে সেই ছমছমে ভাব কেটে যায়। এই কয়দিনে দানা বুঝে গেছে ওর জীবন ভিন্ন খাতে বইতে চলেছে।
সারা রাত ধরে মুষলধার বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভোরের দিকে মোহনার কাছে পৌঁছে যায়। পুবের আকাশে লাল সূর্য জলের নীল রঙ বদলে দেয়। পেছনে তাকালে ঘন সবুজ বন জঙ্গল। রাতের বেলা ঠিক ভাবে ঘুম আসেনি দানার, নৌকার ছাদের ওপরে সারা রাত জেগে বসেছিল। কোন কোন সময়ে ওই ঘন জঙ্গলের ভেতর থেকে বাঘের ডাক শুনতে পেয়েছিল। ডাক শুনে নাসির আর বলাইয়েরা একটুখানি চোখ মেলে তাকিয়ে এপাশ ওপাশ দেখে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওদের মনে হয় এই বাঘের ডাক সহ্য হয়ে গেছে, ওদের কাছে এই হুঙ্কার নতুন কিছু নয়।
দিন বাড়ার সাথে সাথে নৌকা সাগরের নীল জল কাটিয়ে অনন্ত দিগন্ত পানে বয়ে চলে। একটানা নৌকার ইঞ্জিনের আওয়াজে মাঝে মাঝে ঘুম চলে আসে চোখে। দুপুরে রান্না সারা হয় ওই নৌকায়, সামান্য ভাত আর ডাল, কাঁচা সবজি পাতি কিছু আনা হয়েছে। সেই খেয়ে আবার নৌকা চলতে শুরু করে।
যেদিকে তাকায় সেদিক শুধু জল আর জল। বড় বড় নীল রঙের ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনার চুড়া। কাঠের নৌকা একবার ঢেউয়ের তালে ওপরে ওঠে একবার নিচে নামে। মাঝ সমুদ্রে ঝড়ের দেখা দেয়, সমদ্রের বিশাল ঢেউ দেখে মনে হয় কালো জলের পাহাড় গর্জন করে ওদের নৌকা দুটো গ্রাস করে নেবে। কাঠের নৌকা একবার ওই কালো জলের পাহাড় চুড়ায় ওঠে আর পরক্ষনেই অতল সমুদ্র ওকে গিলে নেয়। বিভীষিকা ময় দুর্যোগের রাতে দানার পেটের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসার যোগাড়। দানা কোনোদিন সমুদ্রে যায়নি, ছোট নৌকার উথাল পাথাল দোলের চোটে দানা চোখে অন্ধকার দেখে। কিছু খেলেই বমি করে ফেলে, চোখের সামনে অন্ধকার, বনবন করে মাথা ঘোরে সব সময়ে। দুই দিন দুইরাত এইভাবে ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করে এগিয়ে যায় ওদের নৌকা। বলাই, নাসির ওকে বলে কয়েকবার সমুদ্রে পাড়ি দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু এই দুইদিন যে কিছুতেই কাটতে চায় না। বমি করে শ্রান্ত হয়ে নিচের পাটাতনে বেশির ভাগ সময়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয় দানা। ফাঁকা সময়ে গল্প করা ছাড়া আর টেপ রেকর্ডারে গান শোনা ছাড়া কোন কাজ নেই। গায়ের ঘামে নুনের গন্ধ, চামড়া পুড়ে দুইদিনে আলকাতরার মতন কালো হয়ে গেছে। রোদে নুন জ্বলে ত্বকের ওপরে ফোস্কা পড়িয়ে দিয়েছে, চুলে জট পাকিয়ে গেছে।
দুই দিনের দিন গভীর রাতে দুর দিগন্তে একটা কালো রঙের জাহাজের দেখা পায়। শঙ্কর আর রামিজ সবাইকে সতর্ক করে দেয়। কাজে নামার সময় এসে গেছে। ওইদিকে আকাশে আবার কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। ঘন কালো অন্ধকার আর বিশাল বিশাল ঢেউ চিরে ওদের নৌকা ওই বিশাল জাহাজের বেশ কাছে পৌঁছে যায়। নৌকার আলো বন্ধ করে রামিজ একটা টর্চ হাতে নিয়ে নৌকার ছাদে উঠে অপেক্ষা করে। এক মিনিট যেন এক ঘন্টা, রাত দুটো নাগাদ জাহাজের ডেকের ওপর থেকে একটা টর্চ বেশ কয়েক বার জ্বলে উঠে নিভে যায়। ঠিক সেই ইশারা মতন রামিজ তিন বার টর্চ জ্বালিয়ে নিভিয়ে সঙ্কেত দেয়। আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি আর ঢেউয়ের গর্জনে কিছু কানে শোনা যায় না। তাও মনে হল জলের মধ্যে বেশ কয়েকটা বাক্স পড়ার ঝপাং আওয়াজ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে, বলাই, শক্তি, নাসির, আক্রাম সোহেল দাঁতের মধ্যে একটা টর্চ ধরে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে অতল সাগরের জলে ঝাঁপ দেয়। চোখের সামনে মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখে দানা পিছোতে পারে না, ওযে ইন্দ্রাণীর ভালোবাসার পাপী। দানাও পিছিয়ে থাকে না, ঝাঁপ দিতে যাবে তখন শঙ্কর ওকে একটা টর্চ ধরিয়ে দিয়ে সাবধান করে দেয়। বমি করে দেহের শক্তি অনেকটাই খর্ব, কিন্তু সেইসব উপেক্ষা করে দানা জানিয়ে দেয় জলে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত। শঙ্করকে জানায় যে জীবনে সব কিছুর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চায়। আসলে দানা চেয়েছিল, যদি এই বিভীষিকাময় অতল সমুদ্র ওকে নিজের কোলে চিরদিনের মতন টেনে নেয় তাহলে এই পাপের বোঝা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যাবে। দানা চোখ বুজে একবার ইন্দ্রাণীর হাসি কান্না মেশানো চেহারা বুকে এঁকে নেয়, তারপরে টর্চ দাঁতের মধ্যে চেপে ধরে জলে ঝাঁপ দেয়।
টর্চের আলোয় বিশেষ কিছুই দেখা যায় না। ঘোলা জলে নিচের দিকে নেমে যায় সবাই, চারখানা বাক্সে বেলুনের মতন কিছু বাঁধা। জলের তলায় তলিয়ে যাবার আগেই ওই বাক্সগুলো নিয়ে বাকিদের সাথে নৌকায় উঠে আসে। নৌকায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নৌকা ছেড়ে দেয়। রামিজ একটা বাক্স টেনে উঠাতে যায় আর ঠিক তখনি একটা বড় ঢেউ ওদের নৌকায় আছড়ে পড়ে। বাক্স সমেত রামিজ জলের মধ্যে পড়ে যায়। তড়িৎ বেগে দানা টর্চ দাঁতে চেপে জলে ঝাঁপ দেয়। সাঁতরে সাঁতরে রামিজের গেঞ্জি টেনে ধরে ওইদিকে বাক্স তলিয়ে যাবার উপক্রম। রামিজ খানিক থিতু হয়ে ওকে ওই বাক্স আনতে বলে। দানা আবার জলের তলায় ডুব মারে। কোনোরকমে সাঁতরে বাক্স তলিয়ে যাবার আগেই ধরে ফেলে। ততক্ষণে শঙ্কর আর সোহেল ওর সাহায্যের জন্য এসে যায়। তিনজনে বাক্স নিয়ে আর রামিজকে নিয়ে নৌকায় ওঠে। রামিজ দানাকে জড়িয়ে ধরে ওর জীবন বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ জানায়।
জাহাজের থেকে অনেকদুরে গিয়ে আবার নৌকা থেমে যায়। দানা বাকিদের সাথে ওই বাক্স বোঝাই সোনা নিয়ে আবার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নৌকার নিচে একটা কাঠের পাটাতনের সাথে এক এক করে ওই বাক্সগুলো বেঁধে দেওয়া হয়। তারপরে কাজ শেষ করে জল থেকে উঠে আসে। সবাই বেশ খুশি, কাজ শেষ এইবারে মাছ ধরার পালা শুরু। মাছ ধরে নৌকা ভর্তি করে ফিরতে হবে। পরের চারদিন শুধু মাছ ধরেই কাটিয়ে দেয়। দানা জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে এই মাছ শুধু দেখানোর জন্য, না হলে জলের পুলিসের কাছে কি কৈফিয়ত দেবে। সারডিন, আইলা, লইটা, চিংড়ি এমন অনেক মাছে নৌকা বোঝাই করে শেষে আবার মহানগরের দিকে যাত্রা শুরু হয় ওদের। হিঙ্গলগঞ্জে পৌঁছে রাতের অন্ধকারে সোনা বোঝাই বাক্স নামানো হয়। রাতের অন্ধকারেই সেই সব সোনা চলে যায় বিভিন্ন সেঁকরার দোকানে। গাড়ি করে বস্তা ভর্তি টাকা চলে আসে। দানা শুধু একপাশে দাঁড়িয়ে এইসব কাজ কারবার দেখে। সকালের আগেই বাড়ি থেকে সোনা উধাও হয়ে যায়, খালি বাক্স জলে ফিরে যায়। মহেন্দ্র বাবু সবাইকে কাজের জন্য টাকা দেন, শঙ্কর আর রামিজের বরাদ্দ পঁচাত্তর হাজার, বাকিদের পঞ্চাশ হাজার। দানা নতুন ছেলে তাই ওকে ত্রিশ হাজার দেওয়া হয়, কিন্তু রামিজ জানায় যে দানা বাকিদের ভিন্ন, বুকে বল আছে, মরতে পিছপা হয় না। প্রথম বারেই সমুদ্রে গিয়ে জলে ঝাঁপিয়ে ওর জীবন বাঁচিয়েছে। সেই শুনে মহেন্দ্র বাবু বাকিদের মতন দানাকেও পঞ্চাশ হাজার দেন।
মাঝে মাঝেই শঙ্কর আর রামিজ, দানা আর বাকি ছেলেদের নিয়ে বড় বড় বিল্ডারদের কাছে যায় টাকা আদায়ের জন্য। কাউকে হুমকি দিতে হয় টাকার জন্য কাউকে বন্দুক দেখাতে হয়। ভয় না দেখালে কারুর পকেট থেকে টাকা বের হয় না। পরে দানা জানতে পারে, মহেন্দ্র বাবু এই চোরাই সোনা বিক্রি করার টাকা, প্রোমোটারির ব্যাবসাতেও লাগিয়েছেন। যাদের টাকা দিয়েছিলেন যখন তারা টাকা ফেরত না দেয় তখনি তাদের কাছে বন্দুক নিয়ে যেতে হয়। ওই সোনা আর বিদেশী মাল রফতানি করে যে টাকা আয় করেন বেশির ভাগ হিঙ্গলগঞ্জ এলাকায় বিতরন করে দেন তারপরেও যে টাকা বেঁচে থাকে সেই টাকা এই বিল্ডারদের কাছে খাটান, সেইখান থেকেও যে টাকা আয় হয় সেই টাকা আবার ঘোরাফেরা করে।
দানার কথা বার্তা বাকিদের থেকে আলাদা, অশোধিত ট্যাক্সি চালক হলেও গালি গালাজ কম দেয়, খালি সময়ে মহেন্দ্র বাবুর ঘরে ঢুকে বই পড়ার চেষ্টা করে। বেশ বড় ঘরের তিনদিকে বিশাল বিশাল কাঠের আলমারির তাকে সারি সারি বই সাজানো। ইংরেজি বাংলা হিন্দি উর্দু আরও বেশ কয়েকটা নাম না জানা বিদেশী ভাষার বই। দানা বাংলা আর ইংরেজি পড়তে জানে তাই মাঝে মাঝেই ওই বই গুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে। একদিন ওর এই বই পড়া মহেন্দ্র বাবুর চোখে পড়ে যায় আর সেই থেকে মহেন্দ্র বাবু মাঝে মাঝেই ওকে ভালো ভালো বই পড়তে দেন। কখন কোন মহান সন্ন্যাসীর আত্মকথা, কখন বিদেশী লেখকের কোন বই। ইন্দ্রাণীর দৌলতে পাওয়া ওর শোধিত আচরনের জন্য, এই কয় দিনে দানা, মহেন্দ্র বাবু এবং বাকিদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে।
এইভাবে দুই আড়াই মাস কেটে যায়, এর মাঝে অনেকবার ওদের সমুদ্রে যেতে হয় চোরাই মাল আনার জন্য। কখন বাক্সে সোনা থাকে, কখন দামী পাথর, কখন গাড়ির কলকব্জা, কখন ইলেক্ট্রনিক্স জিনিসপত্র। সমুদ্রযাত্রা দানার পক্ষে বড় অস্বস্তিকর। সমুদ্রে গেলেই ঢেউয়ের নাচনের চোটে ওর পেটের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসার যোগাড় হয়। দশদিন শুধু জল আর জল দেখা, সেই এক চেহারা দেখা, সেই এক গান চল্লিশ বার করে শোনা। মাঝে মাঝে ডকের গুদামে ঢুকে মাল চুরি করা হয়, সেই মাল আবার রাতারাতি বাইরে বিক্রি হয়ে যায়। দুই আড়াই মাসে মহেন্দ্র বাবুর কাছে কাজ করে পকেটে অনেক টাকা এসে যায়, কিন্তু কোথায় খরচ করবে সেটা ভেবে পায় না। ট্যাক্সি চালক দানা, সভ্য সমাজের চোখে হয়ে ওঠে এক অসামাজিক মানুষ, যে রাতের পর রাত চোরাই মাল নিয়ে আসে দেশের মধ্যে, ডকের গুদাম থেকে মাল চুরি করে, রেলের ইয়ার্ড থেকে লোহা চুরি করে।
শঙ্কর আর রামিজ ছাড়া বাকিদের কারুর বিয়ে থা হয়নি। এতদিন মহেন্দ্র বাবুর বাড়িতে থেকে মহিলা বলতে মহিমা বৌদি আর আবিদা ভাবীর দর্শন পেয়েছিল, তবে ওই দুই নারীকে দানা সর্বদা মাতৃময়ী রূপেই দেখে এসেছে। মহেন্দ্র বাবুর বাড়ির চৌহিদ্দি থেকে বিশেষ বের হতো না, আর বের হলে হিঙ্গল গঞ্জ এলাকায় তেমন সুন্দরীর দেখা পাওয়া যেতো না। এই এলাকায় যে বেশ্যা বৃত্তি হয় না সেটা নয়। হিঙ্গলগঞ্জ মাঝি মোল্লাদের এলাকা, এলাকার অন্যদিকে বেশ বড়সড় বেশ্যালয় আছে যেখানে ওই নাসির, বলাই, শক্তি আক্রাম ওরা যায়। প্রায় রাতেই বাকি ছেলেরা মদ খেয়ে বেশ্যা বাড়িতে রাত কাটিয়ে ফুর্তি করে আসে। ওকে সবাই লিঙ্গহীন পুরুষ বলে খেপায় কিন্তু দানা চুপ করে মিচকি হেসে ওদের কথা শুনে যায়। মনে মনে হাসে, এই কাজে নামার আগে দানা এত নারীর সাথে সহবাস করেছে যে নারী অঙ্গের যৌনসুখ ওর কাছে ম্লান হয়ে গেছে। যার সাথে ভালোবাসা নেই তার সাথে সহবাস করে কি হবে।
একদিন দানা শঙ্করকে জানায় যে এই কাজ ওর বিশেষ ভালো লাগছে না, বিশেষ করে ওই সমুদ্রে যাওয়া। সমুদ্রে গেলেই ওর শরীর খারাপ হয়ে যায়, মাথা ঘোরে, বমি পায় কিছু খেতে পারে না। শঙ্কর হেসে বলে, এটাই ওদের প্রধান কাজ, সমুদ্র থেকে মাল নিয়ে আসা। তবে এই বিষয়ে মহেন্দ্র বাবুর সাথে কথা বলবে। মহেন্দ্র বাবু ওকে একদিন ডেকে জানিয়ে দেন যদি দানা চায় তাহলে অন্য কাজ করতে পারে আর তাতে মহেন্দ্র বাবু সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু দানা গাড়ি চালানো ছাড়া আর অন্য কিছু কাজ জানে না, তাই অগত্যা মহেন্দ্র বাবুর কাছেই ওকে থেকে যেতে হয়।
ফারহান সপ্তাহে অন্তত একবার করে আসে হিঙ্গল গঞ্জে আর এলেই ওর সাথে দেখা করে। ওর বাড়ি এই এলাকাতেই কিন্তু কোনোদিন ওর বাড়ি যাওয়া হয়নি। সেদিন দানা ঠিক করে নেয়, ফারহানকে সব জানাবে।
একদিন ফারহান ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি রে দানা কেমন চলছে সব।”
দানা মিচকি হেসে জানায়, “এই এক রকম ভাই। তবে শালা ওই সমুদ্রে যাওয়া বড় বিপজ্জনক কাজ। আর তার চেয়েও বড় ব্যাপার শালা ওই নৌকার দোলের চোটে আমার নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসার যোগাড় হয়। শরীর খারাপ হয়ে যায় রে ভাই।”
ফারহান মিচকি হেসে ওকে বলে, “হ্যাঁ শালা, আমিও এই লাইনে এক বছর কাজ করেছিলাম। কিন্তু ওই সমুদ্রে যাওয়া আমারো ঠিক সইল না তাই কাজ ছেড়ে দিলাম। কাজ ছেড়ে দিলেও আজ পর্যন্ত বড়দার সাথে খাতির আছে।”
দানা ওকে মিনতি করে, “অন্য কিছু কাজ দ্যাখ না ভাই। আর কয়েক বার যদি আমাকে সমুদ্রে যেতে হয় তাহলে আমি মারা যাবো রে।”
ফারহান মাথা চুলকে বলে, “দ্যাখ ভাই এখুনি হাতে ভালো কোন কাজ নেই। সেই আবার ট্যাক্সি চালাবি তার চেয়ে ভালো, কোন বড়লোকের গাড়ি চালানো। টাকাও আছে খাটনি বিশেষ নেই, এই অফিসে নিয়ে যাওয়া আর নিয়ে আসা। বাপ্পা নস্করের অনেক চেনাজানা, দেখি তাঁকে বলে যদি কারুর গাড়ি চালানোর কাজ পাওয়া যায়।”
দানা ওর হাত ধরে বলে, “হ্যাঁ ভাই তাই দ্যাখ। এই সমুদ্রে গিয়ে আর হুমকি মেরে বেশি দিন এইখানে থাকতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না।”
বিকেল থেকেই আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। গ্রীষ্ম কাটিয়ে বর্ষা এসে গেছে। ঘন কালো বর্ষার মেঘ গুরগুর চড়চড় আওয়াজ করে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করে দেয়, থেকে থেকে বজ্র বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে কালো আকাশ চিরে খানখান করে দেয়। পরিকল্পনা মাফিক, ঝড় মাথায় নিয়ে নিশুতি রাতের অন্ধকারে দুই খানা নৌকায় জনা দশেক লোক যাত্রা শুরু করে। নৌকায় চড়ার আগে একবার মোবাইল খুলে ইন্দ্রাণীর ছবি দেখে বুকের ওপরে লাগিয়ে নেয়। যদি এই ভয়ঙ্কর কাজে মৃত্যু হয় তাহলে ওর ছবি বুকে নিয়েই মরবে। এক নৌকার হালে রামিজ অন্য নৌকায় শঙ্কর। সবার পরনে গেঞ্জি লুঙ্গি, মাথায় কোমরে গামছা বাঁধা, পাকা মাঝি মোল্লা জেলেদের মতন সাজে সজ্জিত সবাই। নৌকা ছাড়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কাছে পিঠে কোথাও একটা বাজ পড়ে। দানা চমকে ওঠে আর বাকি সবাই হেসে দেয় ওর চমকানি দেখে। যে মানুষ কোনোদিন শহরের বাইরে পা রাখেনি, সেই মানুষ নৌকায় পা রেখে অসীম সমুদ্র পানে ধেয়ে চলেছে। দুর্যোগের গভীর রাতে নদীর কালো কেটে এগোতে এগোতে দানার একটু গা ছমছম করছিল কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে সেই ছমছমে ভাব কেটে যায়। এই কয়দিনে দানা বুঝে গেছে ওর জীবন ভিন্ন খাতে বইতে চলেছে।
সারা রাত ধরে মুষলধার বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভোরের দিকে মোহনার কাছে পৌঁছে যায়। পুবের আকাশে লাল সূর্য জলের নীল রঙ বদলে দেয়। পেছনে তাকালে ঘন সবুজ বন জঙ্গল। রাতের বেলা ঠিক ভাবে ঘুম আসেনি দানার, নৌকার ছাদের ওপরে সারা রাত জেগে বসেছিল। কোন কোন সময়ে ওই ঘন জঙ্গলের ভেতর থেকে বাঘের ডাক শুনতে পেয়েছিল। ডাক শুনে নাসির আর বলাইয়েরা একটুখানি চোখ মেলে তাকিয়ে এপাশ ওপাশ দেখে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওদের মনে হয় এই বাঘের ডাক সহ্য হয়ে গেছে, ওদের কাছে এই হুঙ্কার নতুন কিছু নয়।
দিন বাড়ার সাথে সাথে নৌকা সাগরের নীল জল কাটিয়ে অনন্ত দিগন্ত পানে বয়ে চলে। একটানা নৌকার ইঞ্জিনের আওয়াজে মাঝে মাঝে ঘুম চলে আসে চোখে। দুপুরে রান্না সারা হয় ওই নৌকায়, সামান্য ভাত আর ডাল, কাঁচা সবজি পাতি কিছু আনা হয়েছে। সেই খেয়ে আবার নৌকা চলতে শুরু করে।
যেদিকে তাকায় সেদিক শুধু জল আর জল। বড় বড় নীল রঙের ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনার চুড়া। কাঠের নৌকা একবার ঢেউয়ের তালে ওপরে ওঠে একবার নিচে নামে। মাঝ সমুদ্রে ঝড়ের দেখা দেয়, সমদ্রের বিশাল ঢেউ দেখে মনে হয় কালো জলের পাহাড় গর্জন করে ওদের নৌকা দুটো গ্রাস করে নেবে। কাঠের নৌকা একবার ওই কালো জলের পাহাড় চুড়ায় ওঠে আর পরক্ষনেই অতল সমুদ্র ওকে গিলে নেয়। বিভীষিকা ময় দুর্যোগের রাতে দানার পেটের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসার যোগাড়। দানা কোনোদিন সমুদ্রে যায়নি, ছোট নৌকার উথাল পাথাল দোলের চোটে দানা চোখে অন্ধকার দেখে। কিছু খেলেই বমি করে ফেলে, চোখের সামনে অন্ধকার, বনবন করে মাথা ঘোরে সব সময়ে। দুই দিন দুইরাত এইভাবে ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করে এগিয়ে যায় ওদের নৌকা। বলাই, নাসির ওকে বলে কয়েকবার সমুদ্রে পাড়ি দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু এই দুইদিন যে কিছুতেই কাটতে চায় না। বমি করে শ্রান্ত হয়ে নিচের পাটাতনে বেশির ভাগ সময়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয় দানা। ফাঁকা সময়ে গল্প করা ছাড়া আর টেপ রেকর্ডারে গান শোনা ছাড়া কোন কাজ নেই। গায়ের ঘামে নুনের গন্ধ, চামড়া পুড়ে দুইদিনে আলকাতরার মতন কালো হয়ে গেছে। রোদে নুন জ্বলে ত্বকের ওপরে ফোস্কা পড়িয়ে দিয়েছে, চুলে জট পাকিয়ে গেছে।
দুই দিনের দিন গভীর রাতে দুর দিগন্তে একটা কালো রঙের জাহাজের দেখা পায়। শঙ্কর আর রামিজ সবাইকে সতর্ক করে দেয়। কাজে নামার সময় এসে গেছে। ওইদিকে আকাশে আবার কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। ঘন কালো অন্ধকার আর বিশাল বিশাল ঢেউ চিরে ওদের নৌকা ওই বিশাল জাহাজের বেশ কাছে পৌঁছে যায়। নৌকার আলো বন্ধ করে রামিজ একটা টর্চ হাতে নিয়ে নৌকার ছাদে উঠে অপেক্ষা করে। এক মিনিট যেন এক ঘন্টা, রাত দুটো নাগাদ জাহাজের ডেকের ওপর থেকে একটা টর্চ বেশ কয়েক বার জ্বলে উঠে নিভে যায়। ঠিক সেই ইশারা মতন রামিজ তিন বার টর্চ জ্বালিয়ে নিভিয়ে সঙ্কেত দেয়। আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি আর ঢেউয়ের গর্জনে কিছু কানে শোনা যায় না। তাও মনে হল জলের মধ্যে বেশ কয়েকটা বাক্স পড়ার ঝপাং আওয়াজ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে, বলাই, শক্তি, নাসির, আক্রাম সোহেল দাঁতের মধ্যে একটা টর্চ ধরে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে অতল সাগরের জলে ঝাঁপ দেয়। চোখের সামনে মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখে দানা পিছোতে পারে না, ওযে ইন্দ্রাণীর ভালোবাসার পাপী। দানাও পিছিয়ে থাকে না, ঝাঁপ দিতে যাবে তখন শঙ্কর ওকে একটা টর্চ ধরিয়ে দিয়ে সাবধান করে দেয়। বমি করে দেহের শক্তি অনেকটাই খর্ব, কিন্তু সেইসব উপেক্ষা করে দানা জানিয়ে দেয় জলে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত। শঙ্করকে জানায় যে জীবনে সব কিছুর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চায়। আসলে দানা চেয়েছিল, যদি এই বিভীষিকাময় অতল সমুদ্র ওকে নিজের কোলে চিরদিনের মতন টেনে নেয় তাহলে এই পাপের বোঝা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যাবে। দানা চোখ বুজে একবার ইন্দ্রাণীর হাসি কান্না মেশানো চেহারা বুকে এঁকে নেয়, তারপরে টর্চ দাঁতের মধ্যে চেপে ধরে জলে ঝাঁপ দেয়।
টর্চের আলোয় বিশেষ কিছুই দেখা যায় না। ঘোলা জলে নিচের দিকে নেমে যায় সবাই, চারখানা বাক্সে বেলুনের মতন কিছু বাঁধা। জলের তলায় তলিয়ে যাবার আগেই ওই বাক্সগুলো নিয়ে বাকিদের সাথে নৌকায় উঠে আসে। নৌকায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নৌকা ছেড়ে দেয়। রামিজ একটা বাক্স টেনে উঠাতে যায় আর ঠিক তখনি একটা বড় ঢেউ ওদের নৌকায় আছড়ে পড়ে। বাক্স সমেত রামিজ জলের মধ্যে পড়ে যায়। তড়িৎ বেগে দানা টর্চ দাঁতে চেপে জলে ঝাঁপ দেয়। সাঁতরে সাঁতরে রামিজের গেঞ্জি টেনে ধরে ওইদিকে বাক্স তলিয়ে যাবার উপক্রম। রামিজ খানিক থিতু হয়ে ওকে ওই বাক্স আনতে বলে। দানা আবার জলের তলায় ডুব মারে। কোনোরকমে সাঁতরে বাক্স তলিয়ে যাবার আগেই ধরে ফেলে। ততক্ষণে শঙ্কর আর সোহেল ওর সাহায্যের জন্য এসে যায়। তিনজনে বাক্স নিয়ে আর রামিজকে নিয়ে নৌকায় ওঠে। রামিজ দানাকে জড়িয়ে ধরে ওর জীবন বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ জানায়।
জাহাজের থেকে অনেকদুরে গিয়ে আবার নৌকা থেমে যায়। দানা বাকিদের সাথে ওই বাক্স বোঝাই সোনা নিয়ে আবার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নৌকার নিচে একটা কাঠের পাটাতনের সাথে এক এক করে ওই বাক্সগুলো বেঁধে দেওয়া হয়। তারপরে কাজ শেষ করে জল থেকে উঠে আসে। সবাই বেশ খুশি, কাজ শেষ এইবারে মাছ ধরার পালা শুরু। মাছ ধরে নৌকা ভর্তি করে ফিরতে হবে। পরের চারদিন শুধু মাছ ধরেই কাটিয়ে দেয়। দানা জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে এই মাছ শুধু দেখানোর জন্য, না হলে জলের পুলিসের কাছে কি কৈফিয়ত দেবে। সারডিন, আইলা, লইটা, চিংড়ি এমন অনেক মাছে নৌকা বোঝাই করে শেষে আবার মহানগরের দিকে যাত্রা শুরু হয় ওদের। হিঙ্গলগঞ্জে পৌঁছে রাতের অন্ধকারে সোনা বোঝাই বাক্স নামানো হয়। রাতের অন্ধকারেই সেই সব সোনা চলে যায় বিভিন্ন সেঁকরার দোকানে। গাড়ি করে বস্তা ভর্তি টাকা চলে আসে। দানা শুধু একপাশে দাঁড়িয়ে এইসব কাজ কারবার দেখে। সকালের আগেই বাড়ি থেকে সোনা উধাও হয়ে যায়, খালি বাক্স জলে ফিরে যায়। মহেন্দ্র বাবু সবাইকে কাজের জন্য টাকা দেন, শঙ্কর আর রামিজের বরাদ্দ পঁচাত্তর হাজার, বাকিদের পঞ্চাশ হাজার। দানা নতুন ছেলে তাই ওকে ত্রিশ হাজার দেওয়া হয়, কিন্তু রামিজ জানায় যে দানা বাকিদের ভিন্ন, বুকে বল আছে, মরতে পিছপা হয় না। প্রথম বারেই সমুদ্রে গিয়ে জলে ঝাঁপিয়ে ওর জীবন বাঁচিয়েছে। সেই শুনে মহেন্দ্র বাবু বাকিদের মতন দানাকেও পঞ্চাশ হাজার দেন।
মাঝে মাঝেই শঙ্কর আর রামিজ, দানা আর বাকি ছেলেদের নিয়ে বড় বড় বিল্ডারদের কাছে যায় টাকা আদায়ের জন্য। কাউকে হুমকি দিতে হয় টাকার জন্য কাউকে বন্দুক দেখাতে হয়। ভয় না দেখালে কারুর পকেট থেকে টাকা বের হয় না। পরে দানা জানতে পারে, মহেন্দ্র বাবু এই চোরাই সোনা বিক্রি করার টাকা, প্রোমোটারির ব্যাবসাতেও লাগিয়েছেন। যাদের টাকা দিয়েছিলেন যখন তারা টাকা ফেরত না দেয় তখনি তাদের কাছে বন্দুক নিয়ে যেতে হয়। ওই সোনা আর বিদেশী মাল রফতানি করে যে টাকা আয় করেন বেশির ভাগ হিঙ্গলগঞ্জ এলাকায় বিতরন করে দেন তারপরেও যে টাকা বেঁচে থাকে সেই টাকা এই বিল্ডারদের কাছে খাটান, সেইখান থেকেও যে টাকা আয় হয় সেই টাকা আবার ঘোরাফেরা করে।
দানার কথা বার্তা বাকিদের থেকে আলাদা, অশোধিত ট্যাক্সি চালক হলেও গালি গালাজ কম দেয়, খালি সময়ে মহেন্দ্র বাবুর ঘরে ঢুকে বই পড়ার চেষ্টা করে। বেশ বড় ঘরের তিনদিকে বিশাল বিশাল কাঠের আলমারির তাকে সারি সারি বই সাজানো। ইংরেজি বাংলা হিন্দি উর্দু আরও বেশ কয়েকটা নাম না জানা বিদেশী ভাষার বই। দানা বাংলা আর ইংরেজি পড়তে জানে তাই মাঝে মাঝেই ওই বই গুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে। একদিন ওর এই বই পড়া মহেন্দ্র বাবুর চোখে পড়ে যায় আর সেই থেকে মহেন্দ্র বাবু মাঝে মাঝেই ওকে ভালো ভালো বই পড়তে দেন। কখন কোন মহান সন্ন্যাসীর আত্মকথা, কখন বিদেশী লেখকের কোন বই। ইন্দ্রাণীর দৌলতে পাওয়া ওর শোধিত আচরনের জন্য, এই কয় দিনে দানা, মহেন্দ্র বাবু এবং বাকিদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে।
এইভাবে দুই আড়াই মাস কেটে যায়, এর মাঝে অনেকবার ওদের সমুদ্রে যেতে হয় চোরাই মাল আনার জন্য। কখন বাক্সে সোনা থাকে, কখন দামী পাথর, কখন গাড়ির কলকব্জা, কখন ইলেক্ট্রনিক্স জিনিসপত্র। সমুদ্রযাত্রা দানার পক্ষে বড় অস্বস্তিকর। সমুদ্রে গেলেই ঢেউয়ের নাচনের চোটে ওর পেটের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসার যোগাড় হয়। দশদিন শুধু জল আর জল দেখা, সেই এক চেহারা দেখা, সেই এক গান চল্লিশ বার করে শোনা। মাঝে মাঝে ডকের গুদামে ঢুকে মাল চুরি করা হয়, সেই মাল আবার রাতারাতি বাইরে বিক্রি হয়ে যায়। দুই আড়াই মাসে মহেন্দ্র বাবুর কাছে কাজ করে পকেটে অনেক টাকা এসে যায়, কিন্তু কোথায় খরচ করবে সেটা ভেবে পায় না। ট্যাক্সি চালক দানা, সভ্য সমাজের চোখে হয়ে ওঠে এক অসামাজিক মানুষ, যে রাতের পর রাত চোরাই মাল নিয়ে আসে দেশের মধ্যে, ডকের গুদাম থেকে মাল চুরি করে, রেলের ইয়ার্ড থেকে লোহা চুরি করে।
শঙ্কর আর রামিজ ছাড়া বাকিদের কারুর বিয়ে থা হয়নি। এতদিন মহেন্দ্র বাবুর বাড়িতে থেকে মহিলা বলতে মহিমা বৌদি আর আবিদা ভাবীর দর্শন পেয়েছিল, তবে ওই দুই নারীকে দানা সর্বদা মাতৃময়ী রূপেই দেখে এসেছে। মহেন্দ্র বাবুর বাড়ির চৌহিদ্দি থেকে বিশেষ বের হতো না, আর বের হলে হিঙ্গল গঞ্জ এলাকায় তেমন সুন্দরীর দেখা পাওয়া যেতো না। এই এলাকায় যে বেশ্যা বৃত্তি হয় না সেটা নয়। হিঙ্গলগঞ্জ মাঝি মোল্লাদের এলাকা, এলাকার অন্যদিকে বেশ বড়সড় বেশ্যালয় আছে যেখানে ওই নাসির, বলাই, শক্তি আক্রাম ওরা যায়। প্রায় রাতেই বাকি ছেলেরা মদ খেয়ে বেশ্যা বাড়িতে রাত কাটিয়ে ফুর্তি করে আসে। ওকে সবাই লিঙ্গহীন পুরুষ বলে খেপায় কিন্তু দানা চুপ করে মিচকি হেসে ওদের কথা শুনে যায়। মনে মনে হাসে, এই কাজে নামার আগে দানা এত নারীর সাথে সহবাস করেছে যে নারী অঙ্গের যৌনসুখ ওর কাছে ম্লান হয়ে গেছে। যার সাথে ভালোবাসা নেই তার সাথে সহবাস করে কি হবে।
একদিন দানা শঙ্করকে জানায় যে এই কাজ ওর বিশেষ ভালো লাগছে না, বিশেষ করে ওই সমুদ্রে যাওয়া। সমুদ্রে গেলেই ওর শরীর খারাপ হয়ে যায়, মাথা ঘোরে, বমি পায় কিছু খেতে পারে না। শঙ্কর হেসে বলে, এটাই ওদের প্রধান কাজ, সমুদ্র থেকে মাল নিয়ে আসা। তবে এই বিষয়ে মহেন্দ্র বাবুর সাথে কথা বলবে। মহেন্দ্র বাবু ওকে একদিন ডেকে জানিয়ে দেন যদি দানা চায় তাহলে অন্য কাজ করতে পারে আর তাতে মহেন্দ্র বাবু সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু দানা গাড়ি চালানো ছাড়া আর অন্য কিছু কাজ জানে না, তাই অগত্যা মহেন্দ্র বাবুর কাছেই ওকে থেকে যেতে হয়।
ফারহান সপ্তাহে অন্তত একবার করে আসে হিঙ্গল গঞ্জে আর এলেই ওর সাথে দেখা করে। ওর বাড়ি এই এলাকাতেই কিন্তু কোনোদিন ওর বাড়ি যাওয়া হয়নি। সেদিন দানা ঠিক করে নেয়, ফারহানকে সব জানাবে।
একদিন ফারহান ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি রে দানা কেমন চলছে সব।”
দানা মিচকি হেসে জানায়, “এই এক রকম ভাই। তবে শালা ওই সমুদ্রে যাওয়া বড় বিপজ্জনক কাজ। আর তার চেয়েও বড় ব্যাপার শালা ওই নৌকার দোলের চোটে আমার নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসার যোগাড় হয়। শরীর খারাপ হয়ে যায় রে ভাই।”
ফারহান মিচকি হেসে ওকে বলে, “হ্যাঁ শালা, আমিও এই লাইনে এক বছর কাজ করেছিলাম। কিন্তু ওই সমুদ্রে যাওয়া আমারো ঠিক সইল না তাই কাজ ছেড়ে দিলাম। কাজ ছেড়ে দিলেও আজ পর্যন্ত বড়দার সাথে খাতির আছে।”
দানা ওকে মিনতি করে, “অন্য কিছু কাজ দ্যাখ না ভাই। আর কয়েক বার যদি আমাকে সমুদ্রে যেতে হয় তাহলে আমি মারা যাবো রে।”
ফারহান মাথা চুলকে বলে, “দ্যাখ ভাই এখুনি হাতে ভালো কোন কাজ নেই। সেই আবার ট্যাক্সি চালাবি তার চেয়ে ভালো, কোন বড়লোকের গাড়ি চালানো। টাকাও আছে খাটনি বিশেষ নেই, এই অফিসে নিয়ে যাওয়া আর নিয়ে আসা। বাপ্পা নস্করের অনেক চেনাজানা, দেখি তাঁকে বলে যদি কারুর গাড়ি চালানোর কাজ পাওয়া যায়।”
দানা ওর হাত ধরে বলে, “হ্যাঁ ভাই তাই দ্যাখ। এই সমুদ্রে গিয়ে আর হুমকি মেরে বেশি দিন এইখানে থাকতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না।”