What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

pinuram রচনাসমগ্র (1 Viewer)

পর্ব সাত (#3)

এই শহর কোলকাতা থেকে অনেক দুর এক মফঃস্বল শহরে বাস করতো তেইশ বর্ষীয় সুভাষ সান্যাল। এক অভিজাত পাড়ার শেষ প্রান্তে এক বস্তি আর তার পাশে রেলের কলোনি। সেই কলোনিতে সুভাষের খুব ছোট তিন কামরার বাড়ি। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে তৃতীয় সন্তান। বাবা রেলের এক সাধারন কর্মচারী। বড়দা বিয়েথা করে আলাদা হয়ে গেছে। দুই বোন, অপর্ণা আর সুজাতা তখন বেশ ছোট। কলেজ শেষ করে কাজের জন্য হন্যে হয়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায়। চায়ের দোকানে আড্ডা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে ওর বন্ধু, অনিলের বাবার ফটোর দোকানে গিয়ে বসে আর ক্যামেরা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে। সেই সুত্রে অনিলের বাবার কাছ থেকে ফটোগ্রাফি করা শিখে ফেলে। খুব বড় লোক না হলে সেই সময়ে বিয়ে পালা পার্বণে ভিডিও করা হতো না তাই স্টিল ফটোগ্রাফির তখন খুব চল ছিল। সবার হাতে তখন ক্যামেরা থাকতো না। অনিলের বাবার সাহায্যে এই বিয়ে পালা পার্বণে গিয়ে গিয়ে ফটো তুলতো। অনিলের বাবার দোকানে ফটো তুলে অন্তত ওর দিনের খাওয়ার খরচ, চা বিড়ির খরচ চলে আসে।

দেখতে হিন্দি ফিল্মের হিরোদের মতন মোটেই ছিল না। পকেটে পয়সা না থাকার ফলে প্রেম করতে পারেনি। তবে লুকিয়ে লুকিয়ে একজনকে খুব দেখতো। স্বপ্নে আঁকা শ্যাম বরন সুন্দরী কন্যে, অনিতাকে। অনিতার বাড়ি সুভাষের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। অনিতার বাবাও সুভাষের বাবার সাথে রেলে চাকরি করতেন। অনিতাকে শুধু মাত্র দুর থেকে দেখে যাওয়া ছাড়া সুভাষের সারা দিনে কোন কাজ ছিল না। মাঝে মাঝে দেখা হলে কথা হতো, ব্যাস সেই পর্যন্ত ওর দৌড়। সুভাষের মেজদা, অতিশ তখন একটা বড় সোনার দোকানের কর্মচারী। বড়দা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পরে মেজদার ওপরেই সংসারের ভার এসে পড়ে। একদিন ওর বুক ভেঙে অনিতাকে বিয়ে করে ফেলল ওর মেজদা। বাবার অমত একদম ছিল না কারন অনিতার বাবা আর সুভাষের বাবা বন্ধু ছিলেন। যে মেয়েটাকে এতদিন মনের এক কোনায় পরীর মতন এঁকে রেখেছিল, নিজের বাড়িতে নিজের বৌদি হয়ে আসাতে সুভাষের বড় কষ্ট হল। তারপর থেকে সুভাষ এক প্রকার বাড়িতে আসা যাওয়া করা ছেড়ে দিল। সারাদিন এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়িয়ে কাটাতো আর অনিলের বাবার দোকানে কাজ করতো। অনেক রাতে বাড়িতে ফিরে কোনোরকমে দুটো ভাত মুখে গুঁজে বারান্দায় একটা তক্তপোষে শুয়ে পড়তো।

উঠতি বয়সের ছেলে, মাঝে মাঝে অনিল আর বন্ধুদের সাথে মদ খেতো। যেদিন অতিশের সাথে অনিতার বিয়ে হয়, তার দুইদিন পরে মদ খেয়ে বেশ্যা পাড়ায় গিয়ে এক সুন্দরী বেশ্যার সাথে রাত কাটিয়ে নিজের কৌমার্য খুইয়ে আসে সুভাষ। সারা রাত মদের নেশায় সেই সুন্দরী মেয়েটাকে অনিতা ভেবেই যৌন সঙ্গম করে গিয়েছিল। কিছু টাকা অবশ্য অনিল দিয়েছিল আর বাকিটা ওর জমানো টাকা ছিল। অন্ধকার হলেই মাঝেই মাঝেই নেশার ঝোঁকে বেশ্যা পাড়ায় কাটিয়ে আসতো সুভাষ।

সেই অভিজাত পাড়ায় এক বিশাল সাদা রঙের বাড়িতে এক কোলিয়ারির ম্যানেজার, বিদ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসবাস। দুই ছেলের পরে একমাত্র কন্যে, অতীব সুন্দরী, ঋতুপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবা মেজাজি মানুষ, এলাকায় বেশ নামডাক। মা, সুনিতা দেবী আর বাবার চোখের মণি, ঋতু। কচি বয়স হলেও অসম্ভব সুন্দরী ছিল ঋতুপর্ণা, বাবা মায়ের আদরে রাজ কুমারী, ঋতু। ভোরের সদ্য ফোটা গোলাপের কুঁড়ির মতন দেখতে। পান পাতার মতন মুখাবয়ব, মাথায় মেঘের মতন ঢালাও চুল। আয়ত কাজল কালো দুই চোখে ছিল পাখীর মতন স্বাধীন হয়ে উড়ে যাওয়ার তীব্র বাসনা। গোলাপি কোমল অধরে যখন হাসি ফুটে উঠতো তখন কোকিলের কুহু ধ্বনি মনে হতো। সব থেকে আকর্ষণীয় ওর নিচের ঠোঁটের নীচে একটা ছোট তিল। বয়সের তুলনায় একটু বাড়ন্ত ছিল ওর দেহের গঠন। বুকের ওপরে উঁচিয়ে থাকা সদ্য গজিয়ে ওঠা তুলতুলে স্তন জোড়া পরনের কামিজ, ফ্রক ফুঁড়ে সামনের দিকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে উদ্যত। পাতলা কোমর অনায়াসে হাতের মুঠোর মধ্যে চলে আসবে। আর তার ঠিক নীচে সদ্য ফুলে ওঠা সুগোল নিতম্ব। মত্ত চলনে রূপসী কন্যে সবার হৃদয়ে দোলা লাগিয়ে চলে যেতো। রূপকথার রাজকন্যে ঋতুপর্ণার রূপের কাছে ম্লান হয়ে যেতো। পড়াশুনায় বিশেষ মাথা না থাকলেও নাচে গানে অতুলনীয় ছিল ঋতুপর্ণা। রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী, পুজোর সময়ে, স্কুলে পাড়ায় যেখানেই নাচের কোন অনুষ্ঠান হতো সেখানেই নাচতো ঋতুপর্ণা। হাঁটার সময়ে যেন ঋতুপর্ণা হাঁটতো না, মনে হতো যেন নেচে বেড়াচ্ছে। ওর রূপের ডালি মেলে নাচ দেখার জন্য পাড়ার সবাই জড়ো হয়ে যেতো সেই মঞ্চে। উচ্ছল উদ্দাম এক পাহাড়ি স্রোতস্বিনী, অধরা অপ্সরা।

সুভাষের চেয়ে প্রায় বছর আটেকের ছোট ঋতুপর্ণা তাই সুভাষের চোখে ঋতুপর্ণা এক দুষ্টু মিষ্টি ছোট মেয়ে ছাড়া আর কিছুই ছিল না। পাড়ার বকাটে ছেলে গুলো বাকি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে ইতর মন্তব্য করলেও কারুর সাহস হতো না জাঁদরেল, বিদ্যুৎ বাবুর একমাত্র কন্যে, ঋতুপর্ণাকে কিছু মন্তব্য করে। তবে যখন ঋতুপর্ণা গাড়ি করে স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হতো তখন রাস্তার মুখে অনেকে জটলা পাকিয়ে বসে থাকতো এই অসামান্য রূপসীর দেখা পাওয়ার জন্য। বাবার গাড়ি হুস করে ওইসব ছেলেদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেততো। ঋতুপর্ণা মজে থাকতো নিজের খেয়ালে, কোনোদিন কোন এক রাজকুমার ওর জীবনে আসবে আর কোন দুর দেশে মেঘের ভেলায় ওকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। স্কুলের দিদিমনি যখন অঙ্ক করাতেন তখন ঋতুপর্ণা অঙ্কের খাতায় আঁকিবুঁকি কাটতো আর জানালার বাইরে তাকিয়ে আম গাছের বকুলের দিকে একমনে তাকিয়ে হারিয়ে যেতো।

সেই সময়ে শীত কালে, পুজোর পরে স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা হতো। সেদিন অঙ্কের পরীক্ষা, আর সেইদিন একটা রাজনৈতিক মিছিলের জন্য রাস্তায় গাড়ির যানজট। এই রাজ্যে ব্যাঙে পেচ্ছাপ করলেও মিছিল ডাকা হয়, যানজট হয়ে সাধারন মানুষের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়।

সুভাষ একটা বিড়ি টানতে টানতে সাইকেল নিয়ে দোকানে যাচ্ছিল। বিশাল জ্যাম দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। সাইকেল নিয়ে এই জ্যাম পার হয়ে দোকানে পৌঁছাতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। তবে খানিকদুরে একজনকে দেখে সুভাষ দাঁড়িয়ে পড়েছিল সেদিন। যদি সেদিন ওইভাবে থমকে দাঁড়িয়ে না পড়তো তাহলে হয়তো বর্তমানের এই গল্প শুরু হতো না। সুভাষ একভাবে বিড়ি টানতে টানতে ঋতুপর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে। গাড়ির দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি মেরে তাকিয়ে আছে ঋতুপর্ণা। আয়ত কাজল কালো চোখ জোড়া জলে ভরে এসেছে।
 
ধবধবে সাদা এম্বাসেডর গাড়ির দরজা খুলে চোখে মুখে প্রবল উৎকণ্ঠার ছায়া নিয়ে সামনের বিশাল জ্যামের দিকে তাকিয়ে প্রায় কেঁদে ফেলে ঋতুপর্ণা। পড়াশুনায় ভালো না হলেও পরীক্ষা দেওয়া ওর চাই না হলে বাবা বকবে। কিন্তু এই বিশাল যানজট পেরিয়ে সময় মতন স্কুলে পৌঁছানো বড় দায়। বাবা সকালেই ওকে অনেকবার করে বলেছিলেন, একটু তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাস আজকে কিন্তু একটা মিছিল বের হবে। কিন্তু সারা সকাল নেচে বেড়িয়েছিল ঋতুপর্ণা। গাড়ি আছেতো কতক্ষণ লাগবে স্কুলে পৌঁছাতে। বড়দা একটু বকা ঝকা করতেই ওর মা এসে বাধা দেয়। আরে বাবা, একটা পরীক্ষা না দিলে কিছু হবে না। বাবা তড়বড়িয়ে ওঠেন, হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার আস্কারা পেয়েই মেয়েটা গোল্লায় গেল। সারাক্ষণ শুধু নাচ আর নাচ। সেই সাথে বড়দাও গলা মেলায়। বাবা, বড়দা ছোড়দা সবাই পড়াশুনায় খুব ভালো। সবাই চায় ঋতুপর্ণা অন্তত ভালো ভাবে পড়াশুনা করুক। কিন্তু অঙ্ক আর বিজ্ঞান যে ওর মাথার অনেকদুর থেকে পালিয়ে চলে যেতো সেটা কে বুঝায়।
সুভাষ বিড়িটা মাটিতে ফেলে সাইকেল নিয়ে ঋতুপর্ণার গাড়ির সামনে এগিয়ে আসে।

সুভাষ স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করে, “কি রে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিস কেন?”

ঋতুপর্ণা প্রথমে থতমত খেয়ে যায়। বিশেষ চেনাজানা নেই, বিশেষ পরিচয় নেই তবে চিনতে পারে। পাড়ার শেষ প্রান্তে বাড়ি, বড়দার বিয়েতে ফটো তুলতে এসেছিল। এই পর্যন্ত ওদের পরিচয়।

বাবার বকুনির ভয়ে ঋতুপর্ণা ভুলে যায় ওদের মাঝের পরিচয়। ওকে দেখে প্রায় কেঁদে ফেলে, “আজকে অঙ্ক পরীক্ষা আর দেখো এই জ্যাম। কি করে যাই বলতো?”

সুভাষ সাইকেল দেখিয়ে ওকে বলে, “চল সাইকেলে তোকে ছেড়ে দেই।”

ঋতুপর্ণার চোখ কপালে উঠে যায়, “সাইকেলে? পড়ে যাবো তো।” কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “বাবা আজকে আমার পিঠের চামড়া তুলে দেবে।”

সুভাষ হেসে ফেলে, “কেন রে?”

ঋতুপর্ণা কোনরকমে চোখের কোল মুছে বলে, “বাবা অনেক করে বলেছিলেন যে জ্যাম হবে আমি শুনিনি তাই।”

সুভাষ ওকে বলে, “আচ্ছা, এখন আর কাঁদিস নে। চল চল সাইকেলে উঠে পড়।”

ঋতুপর্ণা কোনোদিন সাইকেলে বসেনি। উভয় সঙ্কটে পড়ে যায়। গাড়ির চালককে বুঝিয়ে বলে যে বাড়িতে যেন এই কথা কারুর কানে না যায়। বাবাকে যেন বলা হয় যে গাড়িতে করেই ঋতুপর্ণা স্কুলে গেছে। না হলে ওর বাবা আর ওর বড়দা ওর পিঠের চামড়া তুলে ঢোল বানিয়ে দেবে। ঋতুপর্ণা কোনোরকমে সাইকেলের সামনের রডে একপাশে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ে। সামনে বসতেই সুভাষের বুকের কাছে ঋতুপর্ণার মাথা এসে লাগে। মেয়েটার শরীর থেকে অসম্ভব এক মিষ্টি মাদক গন্ধ সুভাষকে মাতাল করে তোলে। সাইকেল চালিয়ে গাড়ি মাঝখান থেকে পথ করে ওরা এগিয়ে যায় স্কুলের দিকে। ঋতুপর্ণার দুইপাশে হাত রেখে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরার ফলে। কচি ফুলের কুঁড়িটাকে চেপে ধরতে ইচ্ছে করে। ইসস, নাক কুঁচকায় সুভাষ, ওর মুখ থেকে ভুরভুর করে বিড়ির গন্ধ আসছে। সাইকেল চালানোর সময়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, ওর বুক ঠেকে যায় ঋতুপর্ণার পিঠের সাথে। সাদা সালোয়ার কামিজে ঋতুপর্ণা যেন নিষ্পাপ এক সুন্দরী অপ্সরা, ঠিক যে শিশিরে ভেজা সাদা পদ্ম ফুল।

স্কুলের দিকে যেতে যেতে হটাত নাক কুঁচকে ঋতুপর্ণা ওকে বলে, “ইসস এত বিড়ি খাও যে বিকট গন্ধ বের হচ্ছে।”

লজ্জায় পড়ে যায় সুভাষ, “আচ্ছা বাবা এই মাথা পেছনে করে নিলাম।”

ঋতুপর্ণা খিলখিল করে হেসে বলে, “না থাক, তাহলে আর সাইকেল চালাতে পারবে না।”

সুভাষ সাইকেল চালাতে চালাতে ঋতুপর্ণাকে জিজ্ঞেস করে, “কেমন প্রিপারেশান হয়েছে?”

ঋতুপর্ণা ম্লান হেসে উত্তর দেয়, “ধুস, অঙ্ক একদম মাথায় ঢোকে না।”

সুভাষ ভেবেছিল রূপসী ঋতুপর্ণা পড়াশুনা বেশ ভালো হবে তাই অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “কেন রে, কোথায় অসুবিধে?”

ঋতুপর্ণা হেসে বলে, “আরে বাবা, একটা ট্রেন এতো মিটার লম্বা, এতো গতিতে একদিকে ছুটে চলেছে।” খিলখিল করে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে বলে, “যাক না দৌড়ে আমার বাবার কি। তাও দেখো ওদের, একটা লাইট পোস্ট অতিক্রম করতে কত সময় লাগবে সেটা নিয়ে অঙ্ক। ভারতীয় রেল কখন ঠিক সময়ে স্টেসানে পৌঁছাতে পারল না তার আবার সময় অঙ্ক কষে জানাও।” হাসতে হাসতে সারা শরীর নড়ে ওঠে ঋতুপর্ণার।

সেই মিষ্টি মধুর কচি মেয়েটার হাসি শুনে সুভাষের বুকের রক্ত ছলকে ওঠে। নরম গালে মিষ্টি করে একটা চুমু খেতে বড় ইচ্ছে করে। বড় তরলমতি মিষ্টি হাসি, বড় নিষ্পাপ আপন ভোলা মন। সুভাষের মাথায় কোনোদিন অঙ্ক বিশেষ ঢুকতো না তাই হেসে বলে, “ঠিক বলেছিস, যতসব আজগুবি অঙ্ক। তার চেয়ে ভূগোল ভালো।”

ঋতুপর্ণা হেসে বলে, “আচ্ছা তাই নাকি? বলতো পৃথিবীর সব থেকে বড় মরুভুমি কোনটা?”

মাথা ঝাঁকায় সুভাষ, কবে যেন পড়েছে, কিছুতেই মনে করতে পারে না। সাইকেল চালাতে চালাতে একটু ভেবে বলে, “হবে হয়তো কালাহারি নয় থর। কে জানে বাবা আমি অন্ডাল ছেড়ে কোথাও কোনোদিন যাইনি।”

হেসে ফেলে ঋতুপর্ণা, “তোমার ভূগোল আমার অঙ্কের মতন গোল।”

সুভাষ প্রশ্ন করে, “আচ্ছা তুই বলে দে।”

ঋতুপর্ণা উত্তর দেয়, “সাহারা মরুভুমি, আফ্রিকার উত্তরে। বুঝলে চাঁদু।”
 
ওদের মাঝে যে এর আগে কোনোদিন বিশেষ কোন পরিচয় ছিল না সেটা কেউ বলতে পারবে না। প্রান খোলা মেয়ে ছিল ঋতুপর্ণা, তাই অতি সহজে সুভাষের মতন একজনের সাথে গল্পে মেতে উঠল। গল্পে গল্পে স্কুল চলে আসে। অনেকেই যান জটের জন্য পরীক্ষা দিতে আসতে পারেনি, তাই পরীক্ষা একটু দেরিতে শুরু হয়। কিন্তু সময়ের আগেই সুভাষ ওকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েছে।

সাইকেল থেকে নেমেই স্কুলের সামনে দাঁড়ানো একটা আলুকাবলি ওয়ালাকে দেখিয়ে ঋতুপর্ণা চেঁচিয়ে ওঠে, “এই আলু কাবলি খাবে?”

সুভাষ হেসে মাথা নাড়ায়, “তোর পরীক্ষা দিতে হবে না? যা মন দিয়ে পরীক্ষা দিস।”

ঋতুপর্ণা ঠোঁট উল্টে ভেংচি কেটে বলে, “ধ্যাত তুমি না।” তারপরে নাক কুঁচকে দুষ্টু মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, “টেনে টুনে চল্লিশ আনলেই হবে। বাকিটা মা ঠিক আমাকে বাঁচিয়ে নেবে।”

ঋতুপর্ণা কোমর দুলিয়ে, সারা অঙ্গে মাদকতাময় এক হিল্লোল তুলে মেয়েদের মাঝে হারিয়ে যায়। সবাই সাদা সালোয়ার কামিজ পরা তার মধ্যে সুভাষ ঠিক খুঁজে ঋতুপর্ণার ওপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখে। স্কুলের দরজার ভেতরে ঢোকার মুখে হটাত থমকে দাঁড়িয়ে পরে ঋতুপর্ণা, মুচকি মিষ্টি হেসে হাত নাড়িয়ে ভেতরে চলে যায়। সুভাষ এতটা আশা করেনি এই রূপসীর কাছ থেকে। হটাত কি করে কি হয়ে গেল। সম্মোহিতের মতন সাইকেল নিয়ে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কখন মেয়েটার ছুটি হবে, কখন আবার ওই মিষ্টি চাঁদপানা মুখমণ্ডলের দর্শন হবে।

ঋতুপর্ণা এক প্রকার মুখ গোমড়া করেই ক্লাসে ঢুকে পড়ে। আলু কাবলি খাবার বড্ড ইচ্ছে হচ্ছিল। বাবা মায়ের আদরের মেয়ে, দুই দাদার আদরের বোন কিন্তু জীবনে সেই স্বাধীনতা ছিলো না। যা চাইতো তাই পেয়ে যেতো শুধু স্বাধীনতা ছাড়া। অবশ্য ঋতুপর্ণা তখন সবে মাত্র ক্লাস নাইন, তাই বাইরে বের হলে সব সময়ে মায়ের সাথেই বের হতো। একা একা কোথাও যাওয়া অথবা বাইরের খাবার খাওয়া বাড়ির কারুর একদম পছন্দ নয়। স্কুলের ছুটির পরে সব বান্ধবীরা আলু কাবলি, ফুচকা খায় কিন্তু ওর জন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়ির ড্রাইভার, রঞ্জন কাকু ছুটি হলেও, মামনি চলে এসো, বলে ওকে গাড়িতে করে হুস করে বেরিয়ে যায়। অঙ্ক করতে বসে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁতের মাঝে পেন নিয়ে চিবিয়ে যায়। কালো সাদা অক্ষর গুলো হিব্রু ল্যাটিন হয়ে চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়। হটাত কেমন আনমনা হয়ে যায় ঋতুপর্ণা, তারপরে আর পেন উঠাতে হয়নি। অঙ্ক পরীক্ষা সেইবারে আগের বারের চেয়ে ভালোই হয়।

অনিল ওইদিকে খুঁজতে খুঁজতে স্কুলে চলে আসে। স্কুলের সামনের একটা চায়ের দোকানে সুভাষ বসে বিড়ি টানছিল আর ঋতুপর্ণার অপেক্ষা করছিল। জানে পরীক্ষার পরে আর ঋতুপর্ণা ওর সাইকেলে বসে বাড়ি ফিরবে না কারন দুপুরের আগেই যানজট ছেড়ে যাবে আর ওকে নিতে ওর বাড়ি থেকে গাড়ি চলে আসবে।

অনিল ওকে দেখে পিঠের ওপরে এক চাপড় মেরে জিজ্ঞেস করে, “এই শালা এই মেয়েদের স্কুলের সামনে বসে কি বাল ছিঁড়ছিস।”

সুভাষ থতমত খেয়ে যায়, “না মানে এমনি।”

অনিল চোখ টিপে মুচকি হেসে বলে, “তুই নাকি বিবির মেয়েকে স্কুলে নিয়ে এসেছিস?” বিদ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে এলাকার সবাই “বি.বি” বলে ডাকে।

সুভাষ অবাক হয়ে যায়, “তোকে কে বলল?”

অনিল ওর পাশে বসে হেসে বলে, “তুই হারামি কি ভেবেছিস কেউ দেখেনি? নরেন, বিমল, পটলা সবাই তোকে দেখেছে বিবির মেয়েকে তুই সাইকেলে করে স্কুলে নিয়ে এসেছিস। তাই বলে এইখানে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকবি? ওরে বোকাচোদা ওই মেয়ে ওই রূপের ডালি নিয়ে কি আর তোর কোলে বসবে। ওর জন্য আকাশ থেকে সাদা ঘোড়ায় চেপে রাজকুমার আসবে। চল চল, বিমলের বড়দির ছেলের অন্নপ্রাশন। বাবা ডেকে পাঠিয়েছে, ফটো তুলতে যেতে হবে।”

সুভাষ মুখ কাঁচুমাচু করে অনুনয় করে, “আরে অন্নপ্রাশন সেই বিকেলে এখন প্লিস তুই সামলে নে।”

অনিল চোখ কপালে তুলে বলে, “বোকাচোদা ছেলে, অন্নপ্রাশন কোনোদিন বিকেলে হয়না, দুপুরে হয়। বালের চোদা, এইখানে গাঁড় মারলে পেটে কিছু আসবে না। বাবা অলরেডি বায়না নিয়ে ফেলেছে, যদি তুই না যাস তাহলে বাবা মুখ দেখাতে পারবে না।”

অগত্যা সুভাষ চায়ের ভাঁড় ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনিলের সাথে দোকানে যায়। ক্যামেরা কাঁধে ফেলে অনিলের সাথে বিমলের বড়দির বাড়িতে পৌঁছায়। সারাদিন ফটো তোলে কিন্তু কানে ভেসে আসে ঋতুপর্ণার মিষ্টি কণ্ঠস্বর, “ধুত তুমি না।” মাঝে মাঝেই হারিয়ে যায়। “ধুত” শব্দটা অনেকবার আগেও শুনেছে তবে ঋতুপর্ণার মিষ্টি মধুর কণ্ঠস্বর যেন ওই ছোট শব্দটির ধ্বনির সৌন্দর্য বেশি করে বাড়িয়ে দিয়েছে। ইসস, হাতে হয়তো একটু সময় ছিল। ওর সাথে দাঁড়িয়ে আলু কাবলি খেলে হয়তো আরো একটু বেশি সময়ের জন্য ঋতুপর্ণার পাশে থাকতে পারতো। না না, বড় কচি মেয়ে ওর চেয়ে অনেক ছোট, কত ছোট হবে, হ্যাঁ আট বছরের মতন ছোট। এত কচি একটা মেয়ের প্রেমে পড়বে সেটা সুভাষের পক্ষে আশাতীত। ফটো তুলতে তুলতে অনেক সময় কেটে যায়। সন্ধ্যে নেমে আসে শহরের বুকে। ফটো তোলার পরে ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে সুভাষ বাড়ির পথ ধরে।

ওদের হয়তো আর কোনোদিন সামনাসামনি দেখা হবে না। ঋতুপর্ণা বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়ি ধরে স্কুলে চলে যাবে। সুভাষ সাইকেলে করে দাঁড়িয়ে থাকবে পথের পাশে। সারা রাত ঠিক ভাবে ঘুমাতে পারল না সুভাষ। বৌদি আর পূর্বতন সুপ্ত প্রেয়সী অনিতা ওকে ভাত দিয়ে যায়। চুপচাপ ডাল দিয়ে ভাত মেখে গলাধঃকরন করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বারান্দায় শুয়ে পড়ে। অনেকটা চিরাচরিত বাংলা সিনেমার মতন মনে হচ্ছে। আপন মনেই হেসে ফেলে সুভাষ।

পরেরদিন ঠিক স্কুলের সময়ে সুভাষ স্নান করে সাইকেল নিয়ে রাস্তার মোড়ে ঋতুপর্ণার গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। সেইদিন কোন যান জট নেই, তাও এক অলীক কল্পনা করে অপেক্ষা করে থাকে। যদি একবার এই কচি নিষ্পাপ সুন্দরীর দর্শন পাওয়া যায়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেও সেই অচেনা অথচ খুব চেনা পরিচিত গাড়ির দেখা পাওয়া যায়না। সুভাষের মনে ভয় ঢুকে যায়। বিদ্যুৎ বাবুর কানে কি ওদের এই পরিচয় হওয়ার ঘটনা পৌঁছে গেছে। আর তাই হয়তো ঋতুপর্ণাকে আর স্কুলে আসতে দেয়নি। অবশ্য পরে জানতে পেরেছিল যে সেদিন ঋতুপর্ণার কোন পরীক্ষা ছিল না।
 
পর্ব সাত (#4)

আদির এই সব শুনতে একদম ভালো লাগছিল না। ওর মনে শুধু একটা প্রশ্ন, দশ বছর আগে এমন কি ঘটেছিল যার জন্য পাপা আর মা আলাদা পথ বেছে নিয়েছিল। আদি সুভাষকে জিজ্ঞেস করে, “পাপা, তোমার আর মায়ের বিয়ে হয়েছিল তাই আমি এসেছি। তাই না? তোমার এই গল্প শুনে আমি কি করবো?”

সুভাষ ম্লান হেসে বলে, “দরকার না থাকলে কেন বলতে যাবো বল। একটু তোর পাপার কথাও শোন, না হলে কি করে বুঝবি।”

আদি চেয়ারে বসে বলে, “আচ্ছা বলো আমি শুনছি।”

সুভাষ আবার শুরু করে তার কাহিনী। এইবারে সুভাষ বেশ কয়েক মাস এগিয়ে যায়। এর মাঝে এক বিবাহ অনুষ্ঠানে সুভাষের সাথে ঋতুপর্ণার দেখা হয়েছিল তবে বিশেষ কথাবার্তা হয়নি। সেই অনুষ্ঠানে সুভাষ চুপচাপ ফটো তোলার দিকে মনোনিবেশ করে। একা একা এদিকে ওদিকে ঘুরে ফিরে ফটো তুলতে ব্যাস্ত হয়ে যায় সুভাষ।

বরযাত্রী যাওয়ার আগে সুভাষ বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময়ে ওর পেছনে এসে দাঁড়ায় ঋতুপর্ণা। মিষ্টি চোখে ওর দিকে তাকিয়ে খানিক অভিমান ভরা গলায় বলে, “সেদিন আলু কাবলি খাওয়ালে না কেন?”

সুভাষের কানে যেন কেউ মধু ঢেলে দিয়েছে। সুভাষ ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “তোর পরীক্ষার দেরি হয়ে যেতো তাই।” আসলে সেদিন সুভাষের পকেটে মাত্র পাঁচ টাকা পড়েছিল। দুই টাকার আলু কাবলি কিনলে সারাদিনে ওর আর বিড়ি খাওয়ার পয়সা হতো না।

চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে ঋতুপর্ণা জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা তাই নাকি। এত চিন্তা এই মেয়েটার জন্য?”

সুভাষ কি বলবে ভেবে পায়নি। মুচকি হেসে ওকে উত্তর দেয়, “আরে হ্যাঁ রে বাবা। এখন এইভাবে এইখানে দাঁড়িয়ে না থেকে যা। অন্য কেউ দেখতে পেলে কিছু একটা ভেবে বসবে।”

ঋতুপর্ণার চেহারা হটাত করে বিষণ্ণ হয়ে যায়, “কেন, দেখে ফেললে কি হবে? তোমার কি দাদ হাজা হয়েছে যে তোমার সাথে কথা বলা বারন?”

কি উত্তর দেবে সুভাষ, জানে না। এলাকার ধনী ঘরের মেয়ে একজন সামান্য ফটোগ্রাফারের সাথে নিভৃতে একান্তে কথা বলছে সেটা কারুর নজরে আসলে ভুরু উঁচিয়ে যাবেই। ঠিক তাই হলো। অনিল ওদের দেখে ফেলে।

এগিয়ে আসে ওদের দিকে, “কি রে এইখানে কি করছিস? বর একটু পরেই গাড়িতে উঠবে।”

ঋতুপর্ণা অনিলের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। তারপরে চুপচাপ ওইখান থেকে চলে যায়। ঋতুপর্ণার বিষণ্ণ চেহারা দেখে সুভাষের বুক ভেঙে যায়। কিন্তু অনিলের চলে আসার ফলে ওকে আর বাধা দিতে পারেনা।

ঋতুপর্ণা চলে যেতেই অনিল ওকে সাবধান করে দেয়, “কেন মিছিমিছি মেয়েটাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছিস। তোর পকেটে কানাকড়ি নেই আর ঋতুপর্ণা বিপুল প্রাচুর্যে বড় হয়েছে। যদিও প্রেম করিস তাহলে ওকে খাওয়াবি কি। ভেবে দেখেছিস একবার। মেয়েটা এখন অনেক ছোট, ওকে বিয়ে করতে হলে আগে তোকে দাঁড়াতে হবে ওকে সেই বয়সে যেতে হবে। ততদিনে মতিগতি বদলে যাবে। কাজে মন দে। চল ওইদিকে।”

অনিলের কথার কোন উত্তর দেয় না সুভাষ। চুপচাপ বরের গাড়ির দিকে চলে যায় ফটো তুলতে। তবে ঋতুপর্ণার বিষণ্ণ চেহারা ওর বুকে দাগ কেটে চলে যায়। সেদিনের পরে আর ঋতুপর্ণার সাথে দেখা হয়নি। কিন্তু সুভাষের আর স্বস্তি ছিল না। বিয়ে বউভাতে প্রচুর ফটো তুলেছিল ঠিক, মাঝে মাঝে ঋতুপর্ণার ফটোও তুলেছিল কিন্তু ঋতুপর্ণা আর ওর কাছে আসেনি।

স্কুলের পরীক্ষার পরে শীতের ছুটি পড়ে যায়। একমাস কেটে যায়। ঋতুপর্ণা ছুটিতে দাদা বৌদির সাথে সিমলা কুল্লু মানালি বেড়াতে যায় সেইবারে। সুভাষ মাঝে মাঝেই সাইকেল নিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতো, যদি ঋতুপর্ণা গাড়িতে করে ওর সামনে দিয়ে যায়, যদি একবার ক্ষণিকের জন্য একটু দর্শন পায়। সুভাষ যে সত্যি ঋতুপর্ণার রূপে, ঋতুপর্ণার চোখের ভাষায়, ঋতুপর্ণার মিষ্টি আদুরে কণ্ঠ স্বরের প্রেমে পড়ে গেছে।

শীতের ছুটির পরে স্কুল খুললো। ঋতুপর্ণা ক্লাস টেনে উঠলো। ছুটির পরে প্রথম যেদিন ঋতুপর্ণা গাড়ি করে স্কুল গেল সেদিন সুভাষ সাইকেল নিয়ে মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়েছিল। ঋতুপর্ণা গাড়ির জানালা দিয়ে একবার উঁকি মেরে ওর দিকে তাকিয়েছিল কিন্তু হাত নাড়ায় নি। বড় কষ্ট পেয়েছিল সুভাষ। বুকটা হুহু করে উঠেছিল। সারাদিন দোকানে বসে ভাবে, এই অভিমানী ললনাকে কি করে শান্ত করা যায়। বিকেলের দিকে এক সময়ে আপনমনে সাইকেল নিয়ে মেয়েদের স্কুলে চলে যায়। ছুটির সময়ে গেটের কাছে আলু কাবলি ওয়ালা, ফুচকাওয়ালা ঝালমুড়ি ওয়ালাদের ভিড় জমে ওঠে। সুভাষ দুটো আলু কাবলি কিনে দাঁড়িয়ে থাকে ঋতুপর্ণার অপেক্ষায়। যদিও জানে হয়তো ঋতুপর্ণা স্কুল থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়িতে উঠে বাড়ি চলে যাবে তাও সুভাষ দাঁড়িয়ে থাকে।

স্কুল ছুটি হয় আর সুভাষের বুকের ধুকপুকানি বেড়ে ওঠে। ঋতুপর্ণা বাকি মেয়েদের সাথে গেট থেকে বেরিয়ে গাড়ির দিকে যায়। মাঝে মাঝে আশে পাশের মেয়েদের দিকে তাকায়। ওদের ড্রাইভার রঞ্জন ওর হাত থেকে স্কুলের ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে রেখে ঋতুপর্ণার জন্য অপেক্ষা করে। “চলে এসো মামনি, দিদিমনি অপেক্ষা করছে।”

ঋতুপর্ণা হাত নাড়িয়ে উদাস কণ্ঠে বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে বলে, “এই আসছি কাকু।”

গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময়ে ওর চোখ পরে অদুরে দাঁড়িয়ে থাকা সুভাষের দিকে। সুভাষ দুই হাতে দুটো আলু কাবলির ঠোঙা নিয়ে দাঁড়িয়ে ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে। চোখের মণির সাথে চোখের মণি মিলে যেতেই থমকে যায় ঋতুপর্ণা। ওর বুক হুহু করে ওঠে। মানুষটা সত্যি তাহলে ওর জন্য আলু কাবলি কিনে দাঁড়িয়ে। আলতো মাথা দোলায় ঋতুপর্ণা, কিছু বলতে চেষ্টা করে। ঠিক তখনি রঞ্জন আবার ঋতুপর্ণাকে ডাক দেয়। “মামনি দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোমার নাচের ক্লাসে যেতে হবে না।”

সুভাষের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে চোয়াল চেপে আক্ষেপ করে মাথা নাড়ায় ঋতুপর্ণা। যেন বলতে চাইলো, “আমি নিরুপায় সুভাষদা।” মন চাইছিল এক দৌড়ে সুভাষের কাছে চলে যেতে। ওর হাত ধরে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে। কিন্তু পায়ে যে সোনার বেড়ি বাঁধা।
 
গাড়িতে উঠে নিস্পলক নয়নে সুভাষের দিকে তাকিয়ে থাকে ঋতুপর্ণা। সুভাষ স্থানুর মতন দুই হাতে দুটো ঠোঙা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। ওর দুই পা কে যেন পেরেক দিয়ে মাটির সাথে গেঁথে দিয়েছে। রাগে দুঃখে সেই দুটো ঠোঙা মাটিতে ফেলে পায়ের তলায় মুচড়ে দিল সুভাষ। গাড়ির মধ্যে বসে থাকা ঋতুপর্ণা, দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললো। চাইলেও যে ওর কাছে যেতে পারবে না। দুইজনের মাঝের সামাজিক বৈষম্যের অলঙ্ঘনীয় এক প্রাচীর দাঁড়িয়ে।

গাড়িটা হুস করে ওর পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে চলে গেল। ঋতুপর্ণা দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল। সেটা আর সুভাষের নজরে গেল না। সুভাষ শুধু মাত্র দেখল যে, ঋতুপর্ণা ওর আলু কাবলি উপেক্ষা করে গাড়িতে উঠে চলে গেছে। সুভাষ আর পেছনে ফিরে তাকাল না। সেদিন রাতে অনিলের সাথে মদে চুর হয়ে পিঙ্কির কোঠাতে গিয়ে পিঙ্কিকে আস্টেপিস্টে যৌন সঙ্গমে মেতে উঠেছিল। বারেবারে ঋতুপর্ণাকে গালি দিয়েছিল সেদিন রাতে। অনিল বুঝেছিল ওর মনের দুঃখটা। শেষ রাতে পিঙ্কি শ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পরে অনিল আর সুভাষ ওর কোঠা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল অন্ধকার রাস্তায়।

অনিল ওর কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, “আমাদের দেখে যাওয়া ছাড়া আর কাজ নেই বুঝলি। ওই মেয়ে তোর জন্য জন্মায়নি। ওই মেয়ে তোর বুক চিরে বেরিয়ে যাবে।”

সারা রাত চোখের পাতা এক করেনি ঋতুপর্ণা। একা ঘরে খিল দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছিল সেই রাতে। লোহার শিক ভেঙে ঘন নীল আকাশে পাখীর মতন বিচরন করা হয়তো ওর কপালে নেই। এই ক্লাস টেনে উঠবে, তারপরে বাবা মায়ের চাপাচাপির ফলে হয়তো বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে হবে। বাবা আর বড়দা দুইজনে ইঞ্জিনিয়ার, ছোড়দা ডাক্তারি পড়ছে। কিন্তু ওর মাথায় অঙ্ক বিজ্ঞান একদম ঢোকেনা। নাচ শিখতে চায়, শান্তিনিকেতনে যেতে চায়। ঋতুপর্ণা পাখী হতে চায়, মেঘের ভেলায় ডানা মেলে উড়ে যেতে চায় দুর দেশে। পাহাড়ি ঝরনায় স্নান করতে চায়, কোকিলের কুহু ধ্বনির সাথে গলা মিলিয়ে গান গাইতে চায়। কিন্তু বাবাকে বড়দাকে কে বুঝাবে।

সুভাষ রোজ রাতে মদ খায়। এখন পর্যন্ত কেউ কারুর হাত পর্যন্ত ধরেনি কিন্তু দুইপাশে প্রেমের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। এই আগুনে ভস্মীভূত হওয়া ছাড়া ওদের কাছে আর কোন পথ খোলা নেই। সুভাষ নিজের ভবিতব্যকে মেনে নেয়। মদের নেশায় ঋতুপর্ণাকে ভুলে থাকতে প্রবল চেষ্টা চালায়।

সেদিন দুপুরের দিকে দোকানে একা একা বসে ছিল সুভাষ। দুপুরে কেউ ফটো তুলতে আসেনা। এমন সময়ে একটা আদিবাসী ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে ওর দোকানে বলে, “সুভাষদা, সুভাষদা তোমারে একজন ডাকতিছে।”

সুভাষ ওকে জিজ্ঞেস করে, “কে ডাকছে, কোথায় ডাকছে?”

ছেলেটা দূরে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ের দিকে হাত দেখিয়ে বলে, “ওই মেয়িডা তোমায় ডাকতিছে।”

দুর থেকে মেয়েটাকে দেখে সুভাষ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। স্কুলের সাদা সালোয়ার কামিজ, গায়ে একটা ভারী নীল রঙের সোয়েটার, সম্পূর্ণ চেহারা ওড়নায় ঢাকা। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। সাদা ওড়নায় ঢাকা সুগোল স্তনের আকার, হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা পড়ে যাওয়া কোমর আর সুগোল নিতম্ব, যেন আদিম বালির ঘড়ি দাঁড়িয়ে। সুভাষ মেয়েটার দেহের গড়ন আর কাজল কালো চোখ দেখে বুঝতে পারল কে ওইখানে দাঁড়িয়ে। সুভাষ সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে ঋতুপর্ণার কাছে যায়।

ঋতুপর্ণাকে গাছের আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে বলে, “তুই পাগল হয়েছিস নাকি? স্কুল পালিয়ে কেন এসেছিস?”

ঋতুপর্ণা মুখের ওপর থেকে ওড়না সরিয়ে ছলছল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “প্লিস সুভাষদা তুমি আমাকে নিয়ে পালিয়ে চলো।”

সুভাষ আকাশ থেকে পড়ে, “কি বলছিস জানিস?”

ঋতুপর্ণা ওর হাত ধরে কাতর কণ্ঠে বলে, “হ্যাঁ জানি। আর এটাও জানি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

সুভাষের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। ঋতুপর্ণার বাজু শক্ত করে ধরে বলে, “তুই পাগল হয়ে গেছিস। তুই বাড়ি যা।”

ঋতুপর্ণা ধরা গলায় বলে, “তুমি সত্যি করে বলতো যে তুমি আমাকে ভালোবাসো না?”

সুভাষের বুক ভেঙে যায়। সেদিন তাহলে কে ওর আলু কাবলি উপেক্ষা করে চলে গিয়েছিল গাড়িতে করে। তাহলে কি ওর চোখের ভুল। অন্যদিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “না আমি তোকে একদম ভালোবাসি না। তুই বাড়ি যা।”

ঋতুপর্ণা ওর গালে হাত দিয়ে নিজের দিকে করে বলে, “আমার চোখে চোখ রেখে বলো কেন তুমি সেদিন স্কুলের সামনে ঠোঙা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলে।”

সুভাষ কি উত্তর দেবে। ও যে ঋতুপর্ণাকে ভালোবেসে ফেলেছে কিন্তু এই ভালোবাসার পরিণতি শুধুমাত্র কান্না ছাড়া আর কিছু নয়। সুভাষ বুক ভরে শ্বাস নিয়ে মিথ্যে বলে ঋতুপর্ণার কাছে, “অনিলের জন্য দুটো ঠোঙা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।”

চিবিয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঋতুপর্ণা, “এত বড় মিথ্যে। আমি দেখেছি তুমি ওই ঠোঙা দুটো মাটিতে ফেলে দিয়েছিলে।”

সুভাষের চোখ জোড়া জলে ভরে যায়। মাথা ঝাঁকিয়ে ঋতুপর্ণাকে বলে, “কি বলবো বল। তুই যা শুনতে চাস সেটা আমি তোকে দিতে পারি না।”

ঋতুপর্ণা মাথা ঝাঁকিয়ে ওর কলার ধরে টেনে বলে, “কেন বলতে পারো না, কে বাধা দিয়েছে তোমাকে।”
 
ঋতুপর্ণার গালে হাত দিয়ে মাথায় মাথা ঠেকিয়ে ধরা গলায় বলে, “বাড়ি যা ঋতু। দয়া করে বাড়ি ফিরে যা, লক্ষ্মীটি।”

“লক্ষ্মীটি” বলতেই ঋতুপর্ণার দেহ বয়ে এক শিহরণ খেলে যায়। দুইহাতে আঁকড়ে ধরে সুভাষকে। বুকের ওপরে মুখ গুঁজে ধরা গলায় বলে, “একটি বার বলো তুমি আমাকে ভালোবাসো ব্যাস আমি চলে যাবো।”

রেশমি চুলে ঠোঁট চেপে সুভাষ শেষ পর্যন্ত মনের কথাটা ব্যাক্ত করে দেয়, “হ্যাঁ তোকে ভালোবেসে ফেলেছি।”

ওর লোমশ বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলে ঋতুপর্ণা। “ব্যাস এইটুকু শুনতে চেয়েছিলাম।”

সুভাষ ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “প্লিস এইবারে বাড়ি যা। বিবি দেখে ফেললে অথবা তোর দাদার কানে কথা উঠলে আমাদের লাশ দামোদরের জলে ভাসবে।”

কিছুতেই ওর বুক থেকে ছাড়ানো যায় না ঋতুপর্ণাকে, “মরতে হলে একসাথে মরবো। চলো না কোথাও পালিয়ে যাই।”

কি করে সুভাষ। ইচ্ছে করে ঋতুপর্ণাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে কিন্তু কোথায় যাবে। কোনোদিন অন্ডাল ছেড়ে বাইরে পা দেয়নি। অন্য শহরের কোথাও কাউকে চেনে না। পকেটে টাকা পয়সা নেই। ঋতুপর্ণার বয়স এখন অনেক কম। ধরা পড়ে গেলে পুলিস ওকে ধরে নিয়ে যাবে। ক্ষণিকের মধ্যে শত চিন্তা ভর করে আসে ওর মাথার মধ্যে। কিন্তু এইভাবে গাছের আড়ালে ওদের জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকতে কেউ যদি দেখে ফেলে তাহলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবি।

সুভাষ ঋতুপর্ণাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “আচ্ছা এখন তুই স্কুলে ফিরে যা। তুই আমাকে কয়েকটা মাস সময় দে। আমি দেখছি কি করতে পারি।”

শেষ পর্যন্ত চোখে জল ঠোঁটে হাসি নিয়ে বুকের ওপর থেকে মুখ তুলে তাকায় ঋতুপর্ণা। “সত্যি বলছো?”

ঋতুপর্ণার কপালে ছোট চুমু খেয়ে আদর করে বলে, “তোর মতন পাগলীকে নিয়ে পালাতে হবে যখন তখন না হয় একবার দামোদরের জল দেখেই যাবো।”

ঋতুপর্ণা লাফিয়ে উঠে টুক করে সুভাষের দাড়ি ভর্তি গালে চুমু খেয়ে, লাজুক হেসে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। সুভাষ হতভম্বের মতন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওর গালে ছোট একটা চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করে, “স্কুল থেকে পালালি কি করে?”

ঋতুপর্ণা হেসে বলে, “ওই কাজের মাসীটাকে দশ টাকা দিয়ে পালিয়ে এসেছি। এইবারে দশ টাকা দাও না হলে স্কুলে ঢুকতে পারবো না।”

হেসে ফেলে সুভাষ। পকেট থেকে দশ টাকা বের করে ওর হাতে দিয়ে বলে, “সাবধানে যাস।”

খিলখিল করে হেসে ঋতুপর্ণা জবাব দেয়, “এই বারে সাবধান আর অসাবধান বলে কিছু নেই। যার কাছ থেকে যেটা শুনতে ইচ্ছে ছিল সেটা শুনে ফেলেছি। এইবারে দামোদরে ভাসতে রাজি আছি।”

ঋতুপর্ণার পা যেন আর মাটিতে পড়ছে না। নেচে ওঠে ওর সারা শরীর। ওড়নায় সারা মুখ ঢেকে একটা রিক্সা চেপে উঠে চলে যায়। রিক্সাটা যতক্ষণ না মোড়ের আড়ালে হারিয়ে যায় ততক্ষণ ঋতুপর্ণা আর সুভাষ পরস্পরকে একভাবে দেখে যায়।

সুভাষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গালে হাত বুলায়। মেয়েটা সত্যি মস্ত পাগল, তার সাথে ওকেও পাগল করে ছেড়ে দেবে। কিন্তু এর একটা বিহিত করতেই হবে। বাবা শুনলে ওকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে। পাঁচ খানা ভাই বোন তাই কারুর ওপরেই বিশেষ খেয়াল নেই ওদের বাবা মায়ের। ঋতুপর্ণাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কোথায় পালাবে, কি খাওয়াবে। কিছু একটা করতেই হবে।

গুটিগুটি পায়ে দোকানে এসে বসে। এই দোকানে কাজ করে আজকাল দুই হাজার টাকা পায় তাতে পাঁচশো টাকা বাড়িতে দিতে হয়। হাজার টাকা ওর মাসের খরচে লাগে। এই কয় মাসে চার হাজার টাকা জমিয়েছে কিন্তু তাতে কতদিন চলবে। এই অন্ডালে থেকে ফটো তুলে জীবন কাটানো অসম্ভব। বিদ্যুৎ বাবুকে এলাকার সবাই চেনে। ওর মেয়েকে নিয়ে পালানো অর্থাৎ সাক্ষাৎ বাঘের মুখ থেকে মাংস ছিনিয়ে নেওয়ার মতন। বুক ঠুকে বেরিয়ে পড়ে সুভাষ। ঋতুপর্ণার চোখে সত্যিকারের ভালোবাসার আগুন দেখেছে, এই আগুনে পতঙ্গের মতন ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত।

সারা রাত ঘুমাতে পারে না সুভাষ। এক এক করে অঙ্ক কষে, কি ভাবে ঋতুপর্ণাকে নিয়ে পালানো যায়। কিছুতেই কিছু ভেবে উঠতে পারে না। পরেরদিন ভোরের বেলায় নিজের জামা কাপড় একটা ব্যাগে গুছিয়ে জমানো টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিরুদ্দেশের পানে। বের হওয়ার সময়ে মাকে বলে যায় কাজের জন্য বাইরে যাচ্ছে ফিরতে হয়তো কয়েকদিন সময় লাগবে। ওর বাড়িতে এই সবের বিশেষ বালাই ছিল না তাই বেরিয়ে যেতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। সাতদিন কোলকাতা ঘুরে বেড়িয়ে অনেক জায়গায় গিয়ে অনেকের কাছে গিয়েও সুভাষ কোন কাজ পেল না। অগত্যা সুভাষ বিফল মনোরথে সাতদিন পরে অন্ডাল ফিরে আসে।

স্টেসান থেকে বাড়ি আর যায় না। সোজা দোকানে চলে যায়। দোকানে পৌঁছাতেই অনিলের বাবা ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। মিথ্যে বানিয়ে গল্প বলে সুভাষ, ওর কোন বন্ধুর কাকা মারা গিয়েছে তাই দুর্গাপুরে গিয়েছিল। অনিলের সেই কথা বিশ্বাস হয় না। সুভাষ আর অনিলের বন্ধুত্ব অনেকদিনের।

রাতের বেলা অনিল ওকে চেপে ধরে, “সত্যি করে বলতো কোথায় পালিয়ে ছিলিস?”

ঋতুপর্ণার কথা লুকিয়ে সুভাষ ওকে বলে, “একটা কাজ চাই রে তাই কোলকাতা গিয়েছিলাম। কিন্তু শালা কেউ কাজ দিতে চায় না। ওইখানে শালা টাকা ওড়ে মাইরি। কিন্তু শালা ঠিক রাস্তা না জানলে সেই টাকা কেউ ধরতে পারে না।”

অনিল ওর পিঠ থাবড়ে জিজ্ঞেস করে, “হটাত তোর টাকার দরকার হল কিসে? এরপরে এই ফটোর দোকান তুই আর আমি মিলেই চালাবো।”

সুভাষ দৃঢ় কণ্ঠে বলে, “না রে আমার অন্ডালে থাকলে হবে না। আমাকে অনেক বড় হতে হবে।”

সুভাষের কণ্ঠ স্বর শুনে অনিল বুঝতে পারে শুধু মাত্র টাকা অর্জনের জন্য সুভাষ কোলকাতা যায়নি এর পেছনে আর কিছু মতলব লুকিয়ে আছে যেটা সুভাষ ওকে খোলসা করে বলতে চাইছে না।

এই সাত দিনে রোজ দিন ঋতুপর্ণা, গাড়ি করে স্কুলে যাওয়ার পথে সারাটা রাস্তা জালানার বাইরে তাকিয়ে থাকতো। ওর দুই বড় বড় উৎসুক নয়ন শুধু মাত্র সুভাষকে খুঁজে বেড়াতো। সাতদিন হয়ে গেল কিন্তু ওর দেখা নেই দেখে খুব মুষড়ে পড়ে। সত্যি ভালোবাসা বড় বেদনাময়। এটা জানে যে এই মিলন হয়তো শুধুই পরী কথার মতন অলীক স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে। সিনেমার পর্দায় দেখা যায় একজন বড়োলোকের মেয়েকে নিয়ে এক গরীব ছেলে পালিয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তব দুনিয়ায় কি সেটা কখন সম্ভব। অন্তত এই মফঃস্বল শহরে সেটা কখনই সম্ভব নয়। এই শহরে ওর বাবাকে ওর দাদাকে ওর কাকাকে ওদের পরিবারকে সবাই চেনে। যদি সুভাষের সাথে পালাতেও যায় তাহলে ধরা পড়ে যাবে আর তাতে হয়তো ওদের মৃত্যু হতেও পারে। সুভাষ কি তাহলে এই শহর ছেড়ে ওকে ছেড়ে পালিয়ে গেল।

কিন্তু সুভাষ ওইদিকে বসে ছিল না। ওর মাথার ভেতরে শুধু একটা মাত্র চিন্তা, কি করে ওর ভালবাসাকে এই শহর থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়া যায়। ঋতুপর্ণার সাথে দেখা করা অসম্ভব ব্যাপার। অবশ্য তার আগে ওকে একটা কাজ খুঁজতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। কয়েকদিন পরে সুভাষ একটা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে। কোলকাতার একজন নাককরা ফটোগ্রাফার একজন এসিস্টেন্টের খোঁজ করছে। সঙ্গে সঙ্গে সেইদিনেই সুভাষ কোলকাতা চলে যায়।

আদি মাথা দোলায়, “পাপা, এরপরে তুমি আর মা পালিয়েছিলে তাই তো।”

সুভাষ ম্লান হেসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলে, “হ্যাঁ। তারপরে আমি কোলকাতায় সেই ফটোগ্রাফার বন্ধু, অতিন্দ্রর কাছে এসিস্টেন্টের কাজ পাই। তারপরে একদিন আমি তোর মাকে নিয়ে কোলকাতা পালিয়ে চলে আসি।” কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকে সুভাষ। তারপরে জল ভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে কঠোর কণ্ঠে বলে, “এত তাড়াহুড়ো করছিস কেন? যদি বলি আই সি ইউতে যে শুয়ে আছে সে তোর জন্মদাত্রী মা নয়।”

আদির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আদি চাপা গলায় আঁতকে ওঠে, “পাপা... একি বলছো তুমি।”

সুভাষ চোয়াল চেপে আলতো মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, সত্যি বলছি।”

আদি চোখে অন্ধকার দেখে। চোখ বুজে দুই হাতে মুখ ঢেকে চুপচাপ পাথরের মূর্তির মতন বসে পড়ে।
 
পর্ব সাত (#5)

অনেকক্ষণ পরে আদি সুভাষের দিকে চোয়াল চেপে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমি কে তাহলে? তোমার কোন...”

সুভাষ মাথা নেড়ে গম্ভির কণ্ঠে উত্তর দেয়, “না। তোর মাকে তখন খুব ভালবাসতাম...” একটু থেমে নিচু গলায় বলে, “এখন বাসি তবে আমরা সবাই অনেক বদলে গেছি।”

অতিন্দ্রের কাছে কাজ করার সময়ে সুভাষ ওর কাজের জায়গার পাশে একটা ছোট ঘরে বাসা বেঁধেছিল। একটাই ঘর, একটা তক্তপোষ, কিন্তু সেইসব ভাবার সময় ওর কাছে ছিল না। ওর মন পড়ে ছিল দুর অন্ডালে ওর প্রেয়সী ঋতুপর্ণার কাছে। তবে সুভাষ প্রতি শনি রবিবার অন্ডাল যেতো, কোনোদিন দুর থেকেই ঋতুপর্ণাকে দেখে মন ভরিয়ে নিতো কখন দেখা পর্যন্ত হতো না। অন্যপাশে ঋতুপর্ণা এক প্রকার নিদ্রাহীন হয়েই দিন কাটাচ্ছিল। মাঝে মাঝে শুধু মাত্র চোখের দেখা ছাড়া ওদের মাঝে কোন কথাবার্তার অবকাশ ছিল না।

সুভাষ একদিন ওর পালানোর পরিকল্পনা অনিলকে জানায়। অনিল উদ্বেগ প্রকাশ করে ওকে সাবধান করে দেয়। বিদ্যুৎ বাবুর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কারন ঋতুপর্ণাকে একা বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া হতো না। সুভাষ ভাবে ওকে সোজা স্কুল থেকে নিয়ে পালাতে হবে তাছাড়া ওর কাছে আর কোন রাস্তা নেই। যেমন ভাবা তেমন কাজ। একদিন সুভাষ ঋতুপর্ণার স্কুলের বাইরে অপেক্ষা করেছিল। ঋতুপর্ণা স্কুল থেকে বের হতেই সুভাষ ওদের গাড়ির চাকার নীচে কয়েকটা পেরেক রেখে দেয়। গাড়ি চলা মাত্রই চাকার মধ্যে পেরেক ঢুকে হাওয়া বেড়িয়ে যায়। ড্রাইভার যখন গাড়ির চাকা ঠিক করতে ব্যাস্ত ততক্ষণে সুভাষ ঋতুপর্ণার হাতের মধ্যে একটা চিঠি গুঁজে দেয়। চিঠিতে লেখা ছিল যে পরেরদিন সুভাষ আর ঋতুপর্ণা স্কুল থেকেই পালাবে। সারা রাত সুভাষ ঘুমাতে পারেনি। অন্যদিকে আসন্ন টানটান উত্তেজনায় ঋতুপর্ণা দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। পরেরদিন ওর স্বাধীনতা দিবস, বাবা মায়ের তৈরি সোনার খাঁচা ছেড়ে মুক্ত বিহঙ্গের মতন এই নীল আকাশের নীচে উড়ে যেতে পারবে। সকাল সকাল স্কুলের ব্যাগের মধ্যে বেশ কিছু জামা কাপড়, নিজের জমানো কিছু টাকা আর পরনের কিছু গয়না নিয়ে ঋতুপর্ণা প্রতিদিনের মতন স্কুলে বেরিয়ে পড়ে। সুভাষ আর অনিল একটা গাড়ি নিয়ে ওদের স্কুলের অদুরে অপেক্ষা করেছিল। ঋতুপর্ণাকে দেখে সুভাষ ইশারায় জিজ্ঞেস করে সব তৈরি কি না। উত্তরে ঋতুপর্ণা লাফিয়ে উঠে মুচকি হেসে ইশারায় জানিয়ে দেয় স্কুলে ঢুকে কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। যথারীতি, গাড়ি বাড়ি ফিরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ঋতুপর্ণা স্কুল থেকে পালায়। সুভাষ নিজের পরিচয় লুকানোর জন্য নকল গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে মুসলমান সেজে যায় আর ঋতুপর্ণাকে একটা বোরখা দিয়ে দেয়। অনিলের গাড়িতে ওরা সোজা রেল স্টেসান চলে আসে। সেইখান থেকে ট্রেন ধরে সোজা কোলকাতা। আসার সময়ে অনিলের হাত ধরে সুভাষ ধন্যবাদ জানায়। অনিল ওদের জানিয়ে দেয়, যে এই খবর বিদ্যুৎ বাবুর কানে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যাবে। ততক্ষণে ওরা কোলকাতা পৌঁছে যাবে।

সুভাষ আর ঋতুপর্ণা বাড়ি থেকে পালিয়ে সোজা কোলকাতা চলে আসে। ওদের একমাত্র ভয় যদি ঋতুপর্ণার বাবা ওদের ধরতে পারে তাহলে সুভাষের জেল হয়ে যাবে কারন তখন ঋতুপর্ণা আইন সম্মত ভাবে বিয়ের বয়স হয়নি। সুভাষ আর ঋতুপর্ণা কালিঘাট মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে নেয়। তারপরে শুরু হয় ওদের জীবন যুদ্ধ। একমাত্র অনিল জানতো কোলকাতায় সুভাষ কোথায় থাকে। তবে ওদের নিরাপত্তার খাতিরে অনিল কোনোদিন কাউকে ওদের ঠিকানা দেয়নি। ঋতুপর্ণার বাবা, বিদ্যুৎ বাবু হন্যে হয়ে মেয়ের খোঁজ করেছিলেন। পুলিস লোক লাগিয়েছিলেন সবার পেছনে কিন্তু কেউই ঋতুপর্ণা আর সুভাষের খোঁজ দিতে পারেনি। রাগে দুঃখে বিদ্যুৎ বাবু মেয়েকে ত্যাজ্য করে দিয়েছিলেন। এই খবর ওরা অনিলের কাছ থেকে পরে পেয়েছিল। ঋতুপর্ণার দুঃখ হয়েছিল বটে, ভেবেছিল ওর বাবা হয়তো ভবিষ্যতে ওদের ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু বিদ্যুৎ বাবু নাকি মেয়ের শেষ কৃত্য করেছিলেন।

দুই বছরে সুভাষ, অতিন্দ্রের কাছে কাজ করে। প্রথম প্রথম ঋতুপর্ণার বাড়িতে একা থাকতে খুব কষ্ট হতো। কথা বলার কেউ ছিল না, বাড়ি থেকে বের হতে পারতো না পাছে কারুর নজরে চলে আসে আর ওর বাবার কানে কথা পৌঁছে যায়। ধনী বাড়ির রাজকন্যে ঋতুপর্ণা, সুভাষের ছোট বাড়িটাকে নিজের খেলা ঘরের মতন করে সাজিয়ে তুলেছিল। দুই বছর পরে একদিন সুভাষ নিজেই একটা ফটো শুট করে। সেই খুশিতে ওরা সেই রাতে মিলিত হয় আর ঋতুপর্ণা সন্তানসম্ভবা হয়ে যায়। নিজেদের সেই সময়ে খাওয়া পরার ঠিক ছিল না তাই প্রথমে ওর এই সন্তানকে এই পৃথিবীতে আনতে চায়নি। কিন্তু যে বাড়িতে ভাড়া থাকতো সেই বাড়ির কর্তৃ ঋতুপর্ণাকে বুঝিয়ে বলেছিল যে প্রথম সন্তান ভালোবাসার উদাহরন তাকে কখন নষ্ট করতে নেই। তাই সুভাষ আর ঋতুপর্ণা ঠিক করে যে ওদের যত কষ্ট হোক এই সন্তানকে ওরা পৃথিবীতে আনবে।

বাড়িতে তখন কাজের লোক ছিল না, ঋতুপর্ণাকে দেখার কেউ ছিল না। সুভাষ যত সম্ভব ঋতুপর্ণাকে খুশি রাখার চেষ্টা করতো কিন্তু কাজের চাপে সুভাষ সব সময়ে ঋতুপর্ণার কাছে থাকতে পারতো না। ঘরের কাজ ঋতুপর্ণা একাই করতো। যে মেয়ে কোনোদিন এক গেলাস জল গড়িয়ে খায়নি বিয়ের পরে সেই মেয়ে রান্না করা থেকে, ঘর গোছানো থেকে সব করতে শুরু করে দিয়েছিল। গৃহ কর্তৃ মানা করা সত্ত্বেও ঋতুপর্ণা কাজ করতো।

একদিন বিকেলে ঋতুপর্ণার তলপেটে খুব ব্যাথা ওঠে। তখন সুভাষ বাড়িতে ছিল না। ঋতুপর্ণা একা একাই ডাক্তার দেখাতে যায়। ইউ এস জি করার পরে ধরা পড়ে যে ওর গর্ভাশয় বাকি পাঁচজন মহিলার চেয়ে একটু দুর্বল। ওইদিকে তখন ঋতুপর্ণা গর্ভধারণের ছয় মাস হয়ে গেছে। রাতে সুভাষ বাড়িতে এলে ঋতুপর্ণা সব ঘটনা খুলে বলে। এই পাঁচ ছয় মাসে সুভাষ একা একা ফটো শুট করে বেশ টাকা কামিয়ে ফেলে। কিন্তু টাকা বেশি খরচ হয়ে যাবে ভেবে ঋতুপর্ণা আর কাজের লোক রাখেনি।

সামনে পুজো, ঋতুপর্ণা বেশ খুশি। ঠিক পুজোর পরেই ঋতুপর্ণার ঘর আলো করে সন্তান আসবে। সুভাষ রোজদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে কিন্তু কাজের চাপে মাঝে মাঝেই ওর দেরি হয়ে যায়। সুভাষ ওর দেখা শুনার ব্যাপারে কোন কার্পণ্য করেনি। বারেবারে ওকে বলতো একটা কাজের লোক রাখার জন্য কিন্তু জেদি ঋতুপর্ণা টাকা খরচের ভয়ে কিছুতেই কাজের লোক রাখেনি।

বর্ষা শেষ, তাও আকাশে মাঝে মাঝেই কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। এমনি একদিনে সুভাষ তখন ফটো শুটে বেশ ব্যাস্ত। একসময়ে ওর স্টুডিওর একজন এসে ওকে খবর দেয় যে এক মহিলা ওর সাথে দেখা করতে এসেছে। সুভাষ স্টুডিওর নীচে গিয়ে অনিতাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি যে অনিতা ওর খোঁজ করে এই কোলকাতা চলে আসবে। অনিতার চেহারায় সেই জৌলুস নেই, চোখের কোনে কালিমা, পোশাকের ঠিক নেই। পেটের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে অনিতাও অন্তঃসত্বা।

সুভাষ অনিতাকে জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার। তুমি এইখানে?”

অনিতা কি বলবে বুঝে পায় না। দুইহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে অনিতা, “আমি পাপী, বড় পাপ করেছি।”

সুভাষ কিছু না বুঝে ওকে জিজ্ঞেস করে, “মানে? মেজদা কোথায়?”

অনিতা কান্না থামিয়ে বলে, “তোমার মেজদার কথা আর বোলো না। মুরোদ নেই এক পয়সার কি করা যাবে।”

সুভাষ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে এই বাচ্চা কার?”

অনিতা উত্তর দেয়, “তোমার বন্ধু অনিলের।” মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে সুভাষ।

শেষ পর্যন্ত অনিল অনিতার সাথে জড়িয়ে পড়েছে। অনিতা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ কাহিনী খুলে জানায়। সুভাষের মেজদা অনিতাকে যৌন সুখ দিতে পারতো না সেই সুযোগে অনিল আর অনিতার মাঝে এক অবৈধ যৌন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অনিল শুধু চেয়েছিল অনিতার দেহ ভোগ করতে। যখন অনিল জানতে পারল যে অনিতা অন্তঃসত্বা তখন অনিল ওকে ছেড়ে পালিয়ে চলে যায়। বহুদিন ধরেই অনিতা ওর স্বামীর সাথে যৌন সংসর্গ করেনি তাই সুভাষের মেজদা বুঝে যায় যে এই সন্তান ওর নয়। অনিতাকে দুশ্চরিত্রা বলে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। অনিতা নিজের বাড়িতে যেতে পারেনি কারন ওর বাবা মা এই খবর জানতে পেরে মেয়েকে নষ্টা বলে ধরে নেয়। এক বান্ধবীর বাড়িতে এত দিন ছিল অনিতা কিন্তু সেই বান্ধবীর বাড়িতেও কিছুদিন আগে সুভাষের মেজদা চড়াও হয়ে ওকে গালিগালাজ করে। অগত্যা অনিতা আর কিছু বুঝতে না পেরে কোলকাতা চলে আসে সুভাষের কাছে। সুভাষ জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারে অনিল অনেক আগে একবার অনিতাকে সুভাষের ঠিকানা জানিয়েছিল। নিরুপায় অনিতা সেই ঠিকানা খুঁজে অনিতা সুভাষের দ্বারস্থ হয়।

অনিতা সুভাষের হাত ধরে কাতর মিনতি করে, “দয়া করে আমাকে একটু সাহায্য করো। আমার সন্তান প্রসবের সময় আসন্ন। আমার কাছে টাকা পয়সা কিছুই নেই। বাচ্চা হয়ে গেলেই আমি চলে যাবো।”

ঋতুপর্ণা অনিতার সম্বন্ধে কিছুই জানতো না, কি বলে ওকে বাড়ি নিয়ে যাবে সেই চিন্তা ভাবনা করে। যখন অনিতার কাছে শুনল যে অনিতার সন্তান প্রসবের সময় আসন্ন তখন সুভাষ ঠিক করে যে ওকে একটা হসপিটালে ভর্তি করাই ভালো। সাত পাঁচ ভেবে সুভাষ অনিতাকে একটা হসপিটালে ভর্তি করে দেয়। ওর হাতে হসপিটাল খরচের কিছু টাকা দিয়ে আর বাড়তি কিছু টাকা দিয়ে আসে। সেদিন রাতে সুভাষের বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যায়। ঋতুপর্ণা খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে সুভাষের দেরি দেখে। সারাদিন একা একা কাটিয়ে ওর মাঝে মাঝে মনে হয় যে এই স্বাধীনতার চেয়ে ওর সোনার খাঁচা বেশি ভালো ছিল কিন্তু এই কথা কোনোদিন ঋতুপর্ণা সুভাষকে জানতে দেয়নি। এর কয়েকদিন পরে অনিতা একটা ফুটফুটে পুত্র সন্তান প্রসব করে। বাচ্চাটা নর্মাল ডেলিভারি হয়।
 
অনিতা বাচ্চাটাকে কোলে করে সুভাষকে বলে, “তুমি আমার জন্য অনেক করলে। আমি কি করে তোমার এই ঋণ শোধ করব জানি না।”

সুভাষ ওকে জিজ্ঞেস করে, “এর পরে তুমি কোথায় যাবে? কি করবে?”

অনিতা সুভাষকে বলে, “আমি যে বান্ধবীর বাড়িতে ছিলাম তার একজন জানাশোনা লোক মুম্বাইয়ে থাকে। আমাকে একটা কাজ পাইয়ে দেবে বলেছে। আমি ওইখানে চলে যাবো।”

সুভাষ কি বলবে ভেবে পায় না। এক সময়ে দুর থেকেই অনিতার রূপ দেখে প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। সেই অতীতের কথা মনে পড়তেই সুভাষের মনে কিঞ্চিত ঘৃণা ভাব জেগে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ওর সব থেকে ভালো বন্ধু ওর সাথে প্রতারনা করল। শুধু মাত্র অনিতার কথা ভেবেই ওকে সাহায্য করেছিল নচেত কোনোদিন অনিতাকে সাহায্য করতো না। দুইদিন পরে স্টুডিও থেকে হসপিটালে গিয়ে সুভাষ জানতে পারে যে অনিতা বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিয়েই চলে গেছে। সুভাষ এই খবর পেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। এক এক করে সবাই ওর সাথে প্রতারনা করে চলেছে। একটা ছোট বাচ্চা নিয়ে সুভাষ কোথায় যাবে কি করবে কিছুই ভেবে পায় না। শেষ পর্যন্ত সুভাষ হসপিটালের মেট্রনকে অনুরোধ করে কয়েকদিনের জন্য বাচ্চাটাকে কাছে রাখতে এবং সুভাষ ওই বাচ্চার একটা ব্যাবস্থা করবে। কিন্তু কি ব্যাবস্থা করবে সেটা তখন সুভাষ জানে না। অনিতার সন্তানকে এইভাবে অনাথালয়ে দিয়ে দিতে সুভাষের মন কিছুতেই মানছিল না কিন্তু ওই দিকে ঋতুপর্ণাকে এই সব বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি।

সেই রাতে ঋতুপর্ণার পেটে ভীষণ ব্যাথা শুরু হয়। সেই রাতেই ঋতুপর্ণাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তারেরা জানায় যে বারন করা সত্বেও ঋতুপর্ণা নিজের শরীরের প্রতি নজর দেয়নি। বাড়ির কাজ করে গেছে যার ফলে ওর ভ্রুন গর্ভাশয়ের অনেক নিচের দিকে নেমে এসেছে। সারা রাত ঋতুপর্ণা ব্যাথায় কঁকিয়ে ওঠে, শরীর বেঁকে যায়। ভোর রাতের দিকে ঋতুপর্ণা অজ্ঞান হয়ে যায়। ডাক্তারেরা তৎক্ষণাৎ অপারেশান করে কিন্তু ঋতুপর্ণার বাচ্চাকে বাঁচানো সম্ভব হয়না। সুভাষ খুব ভালবাসতো ঋতুপর্ণাকে, আর ঋতুপর্ণা বেশ খুশি ছিল এই মা হওয়া নিয়ে। বাচ্চা মারা যাওয়াতে সুভাষ একটু দুঃখ পেয়েছিল বটে তবে ওর ভয় ছিল যদি ঋতুপর্ণা এই খবর জানতে পারে তাহলে খুব ভেঙে পড়বে। এই দুই বছরে ঋতুপর্ণাকে খুশি রাখার সব প্রচেষ্টা করেছে বটে কিন্তু মন থেকে জানতো যে ঋতুপর্ণাকে সেই স্বাধীনতার সুখের ছোঁয়া দিতে পারেনি। ঋতুপর্ণা এই সন্তানের মধ্যেই দিয়েই সেই স্বাধীনতার সুখ স্বাধীনতার আনন্দ খুঁজে পেতে চেয়েছিল। সুভাষের মাথায় তখন একটা বুদ্ধি খেলে যায়। অনিতার সন্তানকে হাস্পাতাল থেকে ঋতুপর্ণার বাচ্চার স্থানে রেখে দেয়। সেই কচি শিশুকে কোলে করে ঋতুপর্ণা কেঁদে ফেলে।

সুভাষ ওর কপালে চুমু খেয়ে হেসে বলে, “এইবারে তুমি মা হয়ে গেলে।”

ঋতুপর্ণা ছোট্ট শিশুটিকে কোলে করে ওর কপালে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি খুশি?”

সুভাষ স্মিত হেসে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ খুব খুশি। তুমি আমার কাছে আছো এর চেয়ে বেশি আর কি।”

ঋতুপর্ণা শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমাদের জীবনে এক সূর্যের মতন আলো নিয়ে এসেছে। এর নাম কি রাখা যায় বলতো?”

সুভাষ হেসে বলে, “তোমার ছেলে তুমি বলো।”

কচি শিশুটির গালে চুমু খেয়ে ঋতুপর্ণা ওর নামকরণ করে, “আমার দুষ্টু আদি। আদিত্য সান্যাল।”

আদি নির্বাক হয়ে সুভাষের কাছে নিজের জন্ম বৃতান্ত শুনে স্তব্দ হয়ে যায়। সব কিছু শোনার পরে আদি সুভাষকে জিজ্ঞেস করে, “তার মানে মা জানে না যে আমি...”

সুভাষ মাথা নাড়ায়, “না, তোর মা জানে না। কোনোদিন জানতে দেইনি যে তুই ওর সন্তান নস।”

আদি কি বলবে কিছুই ভেবে পায়না। আই সি ইউর সাদা বিছানায় নির্জীবের মতন শায়িত ঋতুপর্ণাকে নিস্পলক চোখে দেখে। ওর চোখের কোল ভরে আসে। সুভাষের দিকে তাকিয়ে নিজের গলা শুকিয়ে যায়।

গলার কাছে দলা পাকানো কান্নাটাকে কোন রকমের আটকে বলে, “আর তাই তুমি আমাকে এত ভালবাসতে।”

সুভাষ মাথা দোলায়, “তুই কি কোন অর্থে আমার ছেলে নস? আমি কি তোকে ঋতুর কোলে তুলে দিয়ে কোন ভুল করেছি? কোনোদিন কি তুই বলতে পারিস যে তোকে ভালোবাসি নি?”

কেঁদে ফেলে আদি, “না পাপা। শুধু জন্ম দিলেই বাবা মায়ের অধিকার জন্মায় না। পশুরাও সন্তানের জন্ম দেয়। এইখানেই পশুদের চেয়ে মানুষ আলাদা। তারা ভালবাসতে জানে, বড় করতে জানে, মায়া মমতা দিয়ে মানুষ করে তোলে। মায়ের বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়েছি, মায়ের আঁচলের তলায় ঘুমিয়েছি। সেই মাকে কি করে ফেলে দেবো পাপা। কে আমাকে জন্ম দিয়েছে সেটা না হয় নাই জানাতে। কিন্তু এর পরে আমি যে মাকে আর দূরে করে রাখতে পারবো না। তুমি আর মা আর সত্যিকারের বাবা মা। পাপা। কিন্তু পাপা...”

সুভাষ মাথা নত করে বলে, “হ্যাঁ আমি জানি এর পরে তুই জিজ্ঞেস করবি যে আমি যখন তোর মাকে এতই ভালবাসতাম তাহলে ছেড়ে কেন গেলাম।”

আদি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে, “দেখো পাপা, সেই বিষয় আমি আর জানতে চাই না। তবে মা তোমাকে দেখে খুব বিচলিত হয়ে পড়েছে। আমার সব থেকে বড় কষ্ট যে মা আমাকে চিনতে পর্যন্ত পারছে না আবার তোমাকে দেখতে পারছে না। কি করবো, পাপা? আমার যে আর কেউ নেই, পাপা।”

সুভাষ ওর কাঁধে হাত দিয়ে বলে, “এই ভাবে বলিস না যে তোর কেউ নেই। আমি সর্বদা তোর পেছনে আছি।”

আদি চোখের জল মুছে বলে, “কিন্তু পাপা। আই সি ইউতে শুয়ে যে মা, সেই মা কিন্তু আগের মতন নেই। চোখ খোলার পরে মায়ের মানসিক অবস্থা কোনদিকে যাবে সেটা সঠিক জানা নেই। পাপা, আমার মনে হয় এইবারে তোমাকে আমাদের জীবন থেকে চিরদিনের মতন চলে যাওয়া উচিত। আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হবে কিন্তু...”
 
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সুভাষ। কালো মেঘ কাটিয়ে সকালের সূর্য পূর্ব দিক থেকে উদিয়মান। আদি আর সুভাষ পাশাপাশি হেঁটে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসে। সুভাষ একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ছেলের দিকে এগিয়ে দেয় আর নিজে একটা সিগারেট জ্বালায়। বাবার সামনে সিগারেট ধরাবে সেটা আদির পক্ষে আশাতীত। এতদিন যে সন্মানে দেখে এসেছিল সেই সন্মান কখনো এক ধাক্কায় ভেঙে দিতে পারে না। নিজের বাবা না হোক কিন্তু ভালোবাসায় কোনোদিন সুভাষ কার্পণ্য করেনি।

সুভাষ মুচকি হেসে ছেলেকে বলে, “ছেলের কাঁধ যখন বাবার কাঁধ ছেড়ে উপরে উঠে যায় তখন ছেলে বাবার বন্ধু হয়।”

আদি তাও সিগারেট না নিয়ে সুভাষকে বলে, “সেটা আলাদা কথা পাপা কিন্তু আমি তোমার সামনে সিগারেট খেতে পারবো না।”

সুভাষ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বলে, “আমি তোর মা আর ছেলের জীবনে কোনোদিন আসবো না, কথা দিলাম। চিরদিনের মতন চলে যাবো। আমি জানি এই কথা না বললেও তুই করবি। তাও বলছি, তুই তোর মাকে দেখিস। আমি ঋতুকে অনেক কিছু দিতে পারিনি হয়তো তুই ওর সেই অপূর্ণ চাহিদাগুলো পূরণ করতে সক্ষম হবি। আমি চেয়েছিলাম তুই আমার মতন ফটোগ্রাফার হ। কিন্তু ঋতুর জেদের বশে যেমন তুই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ঢুকেছিস ঠিক তেমনি ওর কথা রাখিস।”

আদি মাথা দোলায়, “তুমি আর মা, আমার সব। তবে সত্যি বলছি, যত বড় হয়েছি আর যখন বুঝতে পেরেছিলাম যে বাবা মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে তখন তোমার প্রতি আমার একটু ঘৃণা বোধ জেগেছিল। কিন্তু আজ সেটা সত্যি সব ধুয়ে মুছে গেছে। আমি কথা দিলাম, মাকে আমি দেখব। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি মাকে আগলে রাখব। কিন্তু পাপা, মা যে আমাকে চিনতে পর্যন্ত পারছে না। আমি কি করব?”

সুভাষ আদির কাঁধে হাত দিয়ে বলে, “উপর ওয়ালা যখন একটা রাস্তা বন্ধ করে দেয় তখন অন্য একটা রাস্তা খুলে দেয়। আমার মনে হয় এখন ওকে সম্পূর্ণ সুস্থ রাখা সব থেকে বড় জরুরি। ঋতুর স্মৃতি দশ বছর পিছিয়ে গেছে। ওর হৃদয়ের গভীরে আমার বিস্বাসঘাতকতা এখনো তরতাজা। ওর মন থেকে আমাকে মুছে ফেলতে চেষ্টা কর। তুই তোর মায়ের সাথে ছেলে হিসাবে নয় এক বন্ধুর মতন করে মেলা মেশা শুরু কর। আমার মনে হয় যদি ও আমাকে ভুলে যেতে পারে তাহলে ধীরে ধীরে ওর স্মৃতি শক্তি হয়তো ফিরে আসবে। এটা আমার ধারনা তবে একবার কোন মনোবিদ বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে নিস।” আদি চুপচাপ ওর বাবার কথা মন দিয়ে শোনে। সুভাষ ওকে বলে, “আমি মুম্বাই ফিরে তোর একাউন্টে পাঁচ লাখ টাকা পাঠিয়ে দেব। আমার মনে হয় ঋতুকে এখুনি স্কুলে জয়েন না করতে দেওয়াটা ভালো। তার ওপরে তোর পড়ার খরচ, গাড়ির লোন ইত্যাদি আছে। আশা করি ততদিনে তুই একটা চাকরি পেয়ে যাবি।”

আদি বাবার হাত ধরে কৃতজ্ঞতা জানায়, “পাপা, তুমি সত্যি আমার পাপা।”

ম্লান হাসে সুভাষ, “জানিনা রে সত্যি জানিনা। একবার ভেবেছিলাম দশ বছরে তোর মায়ের মনে পরিবর্তন আসবে। তোর কলেজের কনভোকেশানে আমি আসব। তোর মায়ের সাথে দেখা হবে। কত কিছু ভেবেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আমরা আজ এই হসপিটালে দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক সেই দশ বছর আগের মতন হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।” খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সুভাষ। পুব আকাশে নতুন সূর্য ঝলমল করছে। আদির সাথে শেষবারের মতন হাত মিলিয়ে বলে, “আমি আসি রে আদি।” গলাটা ধরে আসে সুভাষের।

আদির গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে, “পাপা...” ছলছল চোখে বাবার হাত চেপে ধরে। এই হয়তো শেষ বারের মতন বাবার দেখা পাবে।

এরপরে মাকে নিয়েই ওর জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হবে। জানে না ওর মা কখন ওকে নিজের ছেলে বলে চিনতে পারবে কি না। দুই চোখ ভরে আসে জলে। যার কোলে মাথা রেখে শান্তির ঘুম ঘুমাতো, যার হাতের ছোঁয়ায় ওর সকাল হতো, যার গায়ের গন্ধ ওকে পাগল করে দিতো সেই মমতাময়ী নারী আজ ওকে ভুলে গেছে। আশে পাশে কেউ নেই। সেই ঝলমলে ভোরের আলোয় আদি চারদিকে অন্ধকার দেখে। বাবা বেরিয়ে যেতেই দুর দিগন্ত রেখায় এক ক্ষীণ আশার আলো জ্বলে ওঠে। বাবা বলে গেছে মায়ের সাথে একজন বন্ধুর মতন ব্যাবহার করতে। কতটা সক্ষম হবে আদি ওর মাকে ফিরিয়ে আনতে? আর যদি কোনোদিন ওর মা ওকে চিনতে না পারে তাহলে কি হবে?

********** পর্ব সাত সমাপ্ত **********
 
পর্ব আট (#1)

সুভাষ বেরিয়ে যাওয়ার পরে অনেকক্ষণ পর্যন্ত আদি চুপচাপ চেয়ারে বসে থাকে। অনেক প্রশ্নের উত্তর ওর আর জানা হল না, কোনোদিন জানতে পারবে কি না সেটা সন্দেহ আছে। যে ওকে আসলে জন্ম দিয়েছিল সে কেন ওকে ছেড়ে চলে গেল? তবে ওকে ছেড়ে চলে যাওয়াতে আদির সুবিধা হয়েছে। ভালোবাসা, মায়া মমতা, ওকে বড় করা কোন কিছুতেই সুভাষ আর ঋতুপর্ণা কোনদিনের জন্য কার্পণ্য করেনি। ঋতুপর্ণা এখন পর্যন্ত জানে না যে আদি ওর নিজের ছেলে নয় তাই চোখ খুলেই স্নেহরত মায়ের মতন আদিকে খুঁজেছিল কিন্তু ওর মা যে ওকে চিনতে পারছে না। আদির ফাঁকা বুক আবার টনটন করে ওঠে।

দুপুরের পরে ঋতুপর্ণার জ্ঞান ফেরে। জ্ঞান ফিরতেই ঋতুপর্ণার সেই এক চাহিদা, নিজের ছেলেকে দেখতে চায়। আদি প্রথমে মায়ের সামনে যেতে সাহস পায়নি। পাছে ওকে দেখে ভুল ভেবে বসে। ওর পাশে কেউ নেই, হটাত করে বড় একা নিঃসঙ্গ বলে মনে হয় নিজেকে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, ডাক্তার তৃষা আদিকে বলেন, “তোমার মায়ের পোস্ট ট্রমাটিক রেট্রোগ্রেড এম্নেশিয়া হয়েছে।” আদি হাঁ করে ডক্টরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ডক্টর তৃষা বলেন, “তোমার মায়ের মনের মধ্যে, সময় থমকে গেছে দশ বছর আগে। তোমার মা, তোমাকে দশ বছর আগের হিসাবে খুঁজছে। তোমার চেহারা এই দশ বছরে অনেক বদলে গেছে। তুমি এখন ক্লাস সিক্সে পড়া সেই ছোট আদি নেই। তোমার মায়ের মাথায় তোমার যে ছবি আঁকা তার সাথে কিছুতেই বর্তমানের আদিকে মেলাতে পারছে না। এমত মানসিক অবস্থায় তোমার মায়ের সাথে খুব সাবধানে কথাবার্তা বলতে হবে। দশ বছর আগে সঠিক কি হয়েছিল যার জন্য তোমার বাবা মায়ের মধ্যে ডিভোর্স হয়েছিল, সেটা সম্বন্ধে কি তুমি কিছু জানো?” আদি মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় সেই ব্যাপারে কিছুই জানে না। ডক্টর তৃষা জানায়, “সেটা জানলে হয়ত একটু ভালো হত।” কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার বাবার সাথে কি একবার কথা বলা যাবে?” আদি, ডক্টরকে সুভাষের ফোন নাম্বার দেয়। তৃষা জানিয়ে দেয়, সুভাষের সাথে কথাবার্তা বলে তারপরে জানাবে।

আদি তৃষাকে প্রশ্ন করে, “মা যদি আমাকে চিনতে নাই পারল, তাহলে বাড়ি নিয়ে কি করে যাবো?”

তৃষা একটু ভেবে উত্তর দেন, “নিজের বাড়ি তোমার মা চিনতে পারবেন, কিন্তু সেই বাড়িতে তুমি থাকলে তোমার মায়ের মনে সন্দেহ জাগবে। সেটা কি করে কাটানো যায় সেটাই বড় চিন্তার বিষয়।”

আদিও চিন্তায় পড়ে যায়। এক বাড়িতে এক ছাদের নিচে মায়ের সাথে অচেনা মানুষের মতন কি করে কাটানো সম্ভব। একটা উপায় বের করতেই হবে, না মা ওর সাথে থাকতে চাইবে না। কড় গুনতে গুনতে, এদিক ওদিকে তাকিয়ে সাত পাঁচ চিন্তা ভাবনা করতে করতে আদি, তৃষার চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে। পায়ে পায়ে, চুপচাপ আই সি ইউর সামনে এসে দাঁড়ায়। কাঁচের দরজার পেছনে, সাদা বিছানায়, সাদা চাদরে ঢাকা নিস্তব্ধ, নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকা ঋতুপর্ণার দিকে একভাবে চেয়ে থাকে। কাঁচের দরজায় নিজের প্রতিফলন দেখে ভড়কে যায়। নাওয়া খাওয়া এক প্রকার চুলোয় গেছে, উদ্ভ্রান্ত পাগলের মতন দেখাচ্ছে আদিকে।

তিস্তার ফোন এলো, “ঋতুপর্ণাদি এখন কেমন আছেন?”

উত্তর দেওয়ার তেমন মানসিকতা ছিলনা তাও ভদ্রতার খাতিরে উত্তর দিতে হয়, “একই রকম।” ভাবে একবার, তিস্তাকে কি সবিস্তারে জানাবে। ওকে জানানো কি ঠিক হবে? হয়ত একটু সাহায্য করতে পারে তিস্তা। প্রেম ভালোবাসা হয়ত ওদের মধ্যে নেই ঠিক, কিন্তু আন্তরিকতা আছে। আদি উত্তর দেয়, “মায়ের রেট্রোগ্রেড এম্নেসিয়া হয়েছে।”

তিস্তা, “মানে?”

আদি, “অর্থাৎ, মা আমাকে চিনতে পারছে না। দশ বছর আগের আমাকে খুঁজছে, আমাকে দেখে মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে আমি বড় হয়ে গেছি।”

তিস্তা সব কিছু শুনে বার কয়েক হুম হ্যাঁ, করার পরে বলে, “ঋতুপর্ণাদি কবে ছুটি পাচ্ছে?”

আদি উত্তর দেয়, “দিন পাঁচ সাত লাগতে পারে।”

তিস্তা খানিক্ষন ভেবে বলে, “আমি তোমার বাড়িতে এসে থাকব, ঋতুপর্ণাদির দেখা শোনা করব, চিন্তা কোরো না।”

এটা কি তিস্তার কোন মতলব আদির কাছাকাছি আসার না এর পেছনে অন্য কোন মতলব আছে? কিন্তু প্রেমিক কৌশিককে ছেড়ে ওর কাছে আসতে কেন যাবে তিস্তা? খানিক ভেবে আদি উত্তর দেয়, “ডোন্ট ওরি, আমি ম্যানেজ করে নিতে পারবো। তোমার অত চিন্তা করতে হবে না। আর এই যে তুমি বললে আমাকে হেল্প করবে তার জন্য মেনি মেনি থাঙ্কস।”

তিস্তা মৃদু হেসে উত্তর দেয়, “অত ফরমাল হতে হবে না আদি। তুমি অনেক মেচিওর আর ম্যানেজ করে নেবে সেটা জানি, তাও বলে রাখলাম। এই সময়ে ঋতুপর্ণাদির পাশে একটা মেয়ে থাকলে, মানে আশা করি তুমি বুঝতে পারছ। অনেক সময়ে হয়ত তোমার সাহায্য নিতে চাইবে না, তখন তুমি কি করবে?”

আদি অনেক কিছুই এখন চিন্তা ভাবনা করে দেখেনি। মাকে নিয়ে কি করে বাড়িতে ফিরবে। মায়ের সামনে নিজের কি পরিচয় দেবে। তবে বাবা যখন অর্থনৈতিক সাহায্যের ভরসা দিয়েছে তখন সর্বদার জন্য একটা নার্স রাখবে। তাই তিস্তার জবাবে বলে, “নার্স রেখে নেব।”

তিনদিন একভাবে কেটে যায়। এর মাঝে অবশ্য সোসাইটি থেকে কমল জেঠু আর জেঠিমা ওর জন্য খাবার দাবার পাঠিয়ে দিয়েছিল। তিস্তা আর কৌশিক এসেছিল এর মাঝে দেখা করতে। ওর কলেজের বন্ধুরা, মায়ের স্কুলের কলিগরা সবাই এক এক করে দেখা করতে এসেছিল। দশ বছর আগে বীথিকা দেবী তখন ইতিহাসের টিচার ছিলেন, তাই ঋতুপর্ণা শুধুমাত্র তাকেই চিনতে পারল।

ঋতুপর্ণাকে আই সি ইউ থেকে রুমে নিয়ে যাওয়া হল। মাথার ব্যান্ডেজ খুলে দেওয়া হয়েছে, তবে বেশ কয়েক জায়গায় স্টিকিং প্লাস্টার লাগানো। আদি পাশে ছিল, চোখের আড়াল হয়নি কিন্তু মায়ের চোখের সামনে যেতে পারেনি, পাছে ওকে দেখে আবার কিছু গোলযোগ বেড়ে যায়। দিন যায় আর ঋতুপর্ণা যত সুস্থ হয়ে ওঠে, আদির বুকের ধুকপুকানি, আশঙ্কা আরো বেশি বেড়ে ওঠে। মাকে নিয়ে কি করে বাড়ি যাবে। এদিকে ডাক্তার বলে দিয়েছে একদিন পরে মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে।

মনরোগি বিশেষজ্ঞ ডক্টর তৃষার সাথে শলা পরামর্শ করে আদি, কি ভাবে মাকে বুঝানো যায়। তৃষা ওকে বুঝিয়ে বলে যে আগে ওর মাকে বুঝতে দিতে হবে যে তিনি অনেক কিছু ভুলে গেছেন। আদিকে মায়ের কাছাকাছি থাকতে হবে, বুঝতে দিতে হবে যে আদি ঋতুপর্ণার কাছের মানুষ, ওকে ভালবাসে। কারন স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পরে ওর মায়ের একমাত্র সম্বল ওর ছেলে আদি। আদি মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয়, মায়ের জন্য সব কিছু করতে প্রস্তুত।

রাতের বেলা হস্পিটালের ওয়েটিং রুমে একটা চেয়ারে বসে একটু ঝিমুনি ভাব এসে গিয়েছিল আদির। এমন সময়ে নার্স এসে ওকে ডেকে তুলে বলে ওর মা নাকি ওকে ডাকছে। আদি ভালো ভাবে জানে, মা যাকে খুঁজছে সেই মানুষ ও নয়। তাও ধির পায়ে নার্সের পেছন পেছন রুমে এসে ঢোকে আদি। তিন বেডের, সেমি প্রাইভেট রুম, পর্দা দিয়ে ঘেরা।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top