What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

ফৎওয়া : গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও বিকাশ (2 Viewers)

এছাড়া ইজতিহাদের দাবী নিয়ে দ্বীনী জ্ঞানে স্বল্পঅভিজ্ঞতাসম্পন্ন, অযোগ্য লোকদের আবির্ভূত হওয়া, কাযীর পদ লাভের আশায় কতিপয় দুনিয়াদার আলেম নামধারীদের মাযহাবপন্থী শাসকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মাযহাবী ভড়ং ধরা, সাধারণ মানুষ কর্তৃক হাদীছ বিষয়ে অজ্ঞ লোকদের কাছে ফৎওয়ার জন্য শরণাপন্ন হওয়া প্রভৃতি কারণে ইজতিহাদভিত্তিক ফৎওয়ার স্থলে ইমামদের তাক্বলীদ ভিত্তিক ফৎওয়া জনসমাজে অধিক বিস্তার লাভ করে। (শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ (বৈরূত : দারু ইহয়াইল উলূম, ৩য় প্রকাশ, ১৯৯৯ইং), ১/৪৪০ পৃঃ।) শাহ ওয়ালীউল্লাহর ভাষায়,أنهماطمأنوابالتقليد،ودبالتقليدفيصدورهمدبيبالنمل وهملايشعرون. ‘তারা তাক্বলীদের মাঝেই প্রশান্তি খুঁজে নিল এবং নিজের অজান্তেই তাক্বলীদের রোগ তাদের অন্তরে পিপীলিকার ন্যায় সন্তর্পণে অনুপ্রবেশ করল’। (তদেব।)
তাক্বলীদ বা অন্ধঅনুসরণের এই যুগে মুক্বাল্লিদ ফৎওয়া প্রদানকারীদের মধ্যে পাঁচটি শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। শ্রেণীগুলি হ’ল-
এক.আল-মুজতাহিদূন ফিল মাযহাব (المجتهدونفيالمذهب) অর্থাৎ যারা স্বীয় মুজতাহিদের ফিক্বহ সংক্রান্ত অনুসৃত মত ও পথের অনুসারী হয়েও বিভিন্ন বিষয়ে নিজের ইমামের সাথে মতদ্বৈততা পোষণ করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজের অনুসৃত মাযহাবের মূলনীতি হ’তে বিচ্যুত হননি। তাদের অন্যতম হ’ল হানাফী মাযহাবের ইমাম হাসান ইবনু যিয়াদ, ইমাম আবূ ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ প্রমুখ। তবে ইমাম যুফার স্বয়ংসম্পূর্ণ মুজতাহিদ ছিলেন। মালিকীদের মধ্য হ’তে ইমাম আব্দুর রহমান ইবনুল কালিম ও শাফিঈদের মধ্য হ’তে ইউসুফ ইবন ইয়াহইয়া আল-বুওয়ায়তী ও ইসমাঈল ইবনু ইয়াহইয়া আল-মালিনী প্রমুখ প্রসিদ্ধ।
(খুলাছাতু তারীখিত তাশরীইল ইসলামী, পৃঃ ৯৫; মুফীদুল মুফতী, পৃঃ ৬২।)
দুই.আল-মুজতাহিদূন ফিল মাসাইল (المجتهدونفيالمسائل ) অর্থাৎ মাসআলা সমূহে ইজতিহাদ কারীগণ। যখন কোন মাযহাবের ইমাম হ’তে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক ও সাধারণ বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট পথ নির্দেশনা পরিলক্ষিত না হ’ত, তখন ‘মুজতাহিদ ফিল-মাসাইল’ স্বীয় ইমামের মৌলিক নীতির অনুসরণে ফৎওয়া প্রদান করতেন। (মজতাহিদীন ফিল মাসাইলের মধ্যে হানাফী মাযহাবের ইমাম আহমাদ ইবনু ওমর আল-খাসসাফ, ইমাম তাহাবী ও আবুল হাসান আল-ফারাযী, মালিকীদের মধ্য হ’তে আবুলওয়ালীদ আল-বাজী আল-লুযামী, কুদরী আবু বাকর ইবনুল আরাবী, ইবনু রুশদ এবং শাফিঈদের মধ্য হ’তে ইমাম আবু ইসহাক আল-ইসফারাইনী, আবূ হামেদ আল-গাযালী (রহঃ) প্রমুখ প্রসিদ্ধ।)
 
তিন.আছহাবুত তাখরীজ (أصحابالتخريج ) অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত বিধি-বিধানের ব্যাখ্যাকারীগণ, যাদের প্রধান কাজ হ’ল নিজেদের অনুসৃত মাযহাবের সংক্ষিপ্ত বিধি-বিধানের ব্যাখ্যা এবং অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য বিষয়কে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা।
চার. আছহাবুত তারজীহ (أصحابالترجيح ) অর্থাৎ মৌলিক বিষয়ে অগ্রাধিকারদানকারী মুজতাহিদগণ। যারা স্বীয় মত ও পথের বিভিন্ন মুজতাহিদ ইমামগণের বিতর্কিত মতসমূহের মধ্য হ’তে কোন একটি বিশেষ মতকে মৌলিক প্রমাণাদির নিরিখে গ্রহণযোগ্য বলে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।
পাঁচ.আছহাবুত তাক্বলীদ আল-মুখাছছাছ (أصحابالتقليدالمخصص) অর্থাৎ খাঁটি তাক্বলীদপন্থী ওলামা। যারা ফৎওয়া প্রদানকালীন স্বীয় ইমামের মত ও পথের বাইরে কখনো যান না। বলা আবশ্যক যে, মাযহাবী তাক্বলীদের জন্য মহামতি ইমামগণ কোন মতেই দায়ী নন। কারণ আমরা স্পষ্ট করেই জেনেছি যে, চার ইমামের কোন ইমামই তাঁর মাযহাব অনুসরণের কথা বলেননি। বরং তাঁরা প্রত্যেকেই পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করতে বলেছেন। ইমাম গায্যালী বলেন, চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর পরবর্তী সময়ে আববাসীয় খলীফাগণ বিশেষ করে হানাফী-শাফেঈ বিতর্কে ইন্ধন যোগাতে থাকেন। ফলে উভয়পক্ষে অনেক ঝগড়া-বিবাদ ও লেখনী পর্যন্ত পরিচালিত হয়। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী বলেন, চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বেকার লোকেরা কোন একজন বিদ্বানের মাযহাবের উপরে নির্দিষ্টভাবে মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। কোন বিষয় সামনে এলে যেকোন বিদ্বানের নিকট হ’তে লোকেরা ফৎওয়া জিজ্ঞেস করে নিতেন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ব্যতীত তারা আর কারুরই অনুসরণ করতেন না। কিন্তু পরবর্তীতে এর ব্যতিক্রম ঘটে গেল। যেমন

(ক) ফিক্বহ বিষয়ে মতবিরোধ
(খ) বিচারকদের অন্যায়বিচার
(গ) সমাজ নেতাদেরমূর্খতা
(ঘ) হাদীছশাস্ত্রে অনভিজ্ঞ
‘মুহাদ্দিছ’ ও ‘ফক্বীহ’ নামধারী লোকদের নিকটে ফৎওয়া তলব ইত্যাদি কারণে হকপন্থী কিছু লোক বাদে অধিকাংশ মানুষ হক্ব-বাতিল যাচাই করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে এবং প্রচলিত যে কোন একটি মাযহাবের তাক্বলীদ করেই ক্ষান্ত হয়।
(ই‘লামুল মুআক্কেঈন, পৃঃ ১৪৫; আহলে হাদীছ আন্দোলন, ৮৮-৮৯ পৃঃ।) অবশেষে মাযহাবী তাক্বলীদের বাড়াবাড়ির পরিণামে হানাফী-শাফেঈ দ্বন্দ্বে ও শী‘আ মন্ত্রীর ষড়যন্ত্রে ৬৫৬ হিজরীতে হালাকু খাঁর আগমনে বাগদাদের আববাসীয় খেলাফত ধ্বংস হয়ে যায়। (আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৮৮-৮৯।)
 
ফলে তাক্বলীদের যুগে মুফতীগণ মূলতঃ মাযহাবকেন্দ্রিক ফৎওয়া প্রদানেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা হাদীছ বর্ণনায় ছহীহ-যঈফ বাছাইয়ের কোন তাকীদ অনুভব করতেন না। কেবলমাত্র পূর্ববর্তী ফক্বীহদের রায় অন্ধের মত মুখস্থ রাখতেন এবং সেই মোতাবেক ফৎওয়া দিতেন। তাদের রায়ের বরখেলাফ করা, এমনকি তার সত্যতা যাচাই করাকেও তারা অপরাধ গণ্য করতেন। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, পৃঃ ১/৪৪২; মুহাম্মাদ জামালুদ্দীন আল-কাসেমী, আল-ফৎওয়া ফিল ইসলাম, তাহক্বীক : মুহাম্মাদ আব্দুল হাকীম ক্বাযী (বৈরূত :দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৮৬ ইং), পৃঃ ৪৩।) অথচ ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, لايجوزالفتوىبالتقليدلأنهليسبعلموالفتوىبغيرعلمحرامولاخلافبينالناسأنالتقليدليسبعلموأنالمقلدلايطلقعليهاسمعالم- ‘তাক্বলীদের মাধ্যমে ফৎওয়া প্রদান জায়েয নয়। কেননা তাক্বলীদ ইলম নয়। আর ইলম ব্যতীত ফৎওয়া প্রদান হারাম। (ই‘লামুল মুআক্কে‘ঈন ১/৪৬।) তাক্বলীদ কোন ইলমই নয় এবং মুক্বাল্লিদকে আলেম বলা হয়না- এ বিষয়ে মানুষের মাঝে কোন মতভেদ নেই’। ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন, إنالتقليدجهلوليسلعلم ‘তাক্বলীদ হ’ল মূর্খতা; ইলম বা জ্ঞান নয়’। (ইরশাদুল ফুহূল, পৃঃ ২৩৬।)
এই বিপরীতমুখী স্রোতের মুখেও আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম তাদের সর্বোচ্চ সাধ্য দিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের চর্চাকে সমাজে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। তারা মাযহাবী শাসক অধ্যুষিত সাম্রাজ্যে কাযীর পদ থেকে নিজেদেরকে সযত্নে দূরে রাখতেন। এজন্য যেসকল হক্বপিয়াসী মানুষ মাযহাবপন্থী সরকারী আলেমদের ফৎওয়া অনুসরণ না করে হাদীছভিত্তিক ফৎওয়া অনুসন্ধান করতে চাইত, তারা আহলেহাদীছ আলেমদের কাছে যেতেন এবং তাদের ফৎওয়া অনুসরণ করতেন। এমনকি অনেক ঐতিহাসিকের মতে, বর্তমান যুগে বেসরকারীভাবে ফৎওয়া প্রদানের যে রীতি সর্বত্র প্রচলিত রয়েছে, তার সূচনা আহলেহাদীছ আলেমদের মাধ্যমেই ঘটেছিল আববাসীয় শাসনামলে তাক্বলীদী আগ্রাসনের যুগে। (http://ar.wikipedia.org/wiki/فتوي )
 
এ যুগে রচিত প্রসিদ্ধ ফিক্বহী গ্রন্থসমূহ :
এ যুগে শাফেঈ মুফতীগণ অনুসরণ করতেন আবু ইসহাক আশ-শীরাযী (মৃঃ৪৭৬ হিঃ)-কে এবং আবু হামেদ আল গায্যালীর (৫০৫হিঃ) লিখিত কিতাবসমূহকে। হাম্বলীগণ অনুসরণ করতেন, ইবনু কুদামার (৬২০ হিঃ) লিখিত কিতাবুল মুক্বনি‘ কিতাবের। আর হানাফীরা অনুসরণ করতেন ইমাম ত্বহাভী (৩২১ হিঃ), ইমাম কারখী (৩৪০ হিঃ), আবু বকর আল-জাছ্ছাছ (৩৭০ হিঃ), আবুল হাসান আল-কুদূরী (তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থটির নাম ‘মুখতাছারুল কুদূরী’।) (৩৪০ হিঃ) আবু বকর আল-মারগেনানী (তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থটির নাম ‘আল-হিদায়াহ’।) (৫৯৩ হিঃ) প্রমুখের লিখিত ‘মুখতাছার’ ফিক্বহী গ্রন্থসমূহের। মালেকী মাযহাবের ইবনে রুশদের (৫৯৫ হিঃ) প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘বিদায়াতুল মুজতাহিদ ও নিহায়াতুল মুক্বতাছিদ’ এ সময়ই রচিত হয়।
অপরদিকে এ যুগে হাদীছের খেদমতে যে সকল ওলামায়ে কেরাম আত্মনিয়োগ করেন তাঁদের মধ্যে ইবনুল আছীর (৬০৬ হিঃ)-জামে‘উল উছূল, হাফেয আল-হায়ছামী (৮০৭ হিঃ)-মাজমাউ‘য যাওয়ায়েদ, খত্বীব তাবরীযী (৮ম শতাব্দী হিঃ)-মিশকাতুল মাছাবীহ। এছাড়া ইবনে হাযম (৪৫৬ হিঃ) রচিত ‘আল-মুহাল্লা’, ইবনে কুদামা রচিত ‘আল-মুগনী’ ও ইমাম নববী (৬৩১ হিঃ) রচিত ‘আল মাজমূ‘ শারহুল মুহায্যব’-এর মত গুরুত্বপূর্ণ ফিক্বহী গ্রন্থসমূহ এসময় রচিত হয়। এই গ্রন্থগুলি অন্যান্য মাযহাবী তাক্বলীদপন্থী ফিক্বহ গ্রন্থগুলোর মত কেবলই মাযহাবকেন্দ্রিক ছিল না বরং দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণের জন্য হাদীছ ভিত্তিক সঠিক ইলমী রীতি অবলম্বনপূর্বক লিখিত হয়েছিল। তাই আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম এসব কিতাবকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।
 
জড়তা ও স্থবিরতার যুগ :
৬৫৬হিজরীতে (১২৫৮ খৃঃ) আব্বাসীয় শাসনামলের পতনের পর সমগ্র মুসলিম বিশ্ব জুড়ে নেমে আসে বিপর্যয়ের ঘনঘটা। এ বিপর্যয় ছিল বহুমুখী। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতার যে বিপদ তাদের উপর নেমে এসেছিল, তা ছিল সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক। রাজনৈতিক হতাশা তাদের কর্মজগত ও চিন্তাজগতকে জমাট ও অসাড় করে তুলেছিল। কোন জ্ঞানভিত্তিক প্রাগ্রসর চিন্তা-চেতনা তাদের মাঝে পরিলক্ষিত হ’ত না। বড় জোর পূর্ববর্তী ওলামায়ে কেরামের কিতাবসমূহ অধ্যয়নও তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকেই তারা যথেষ্ট মনে করতেন। এমনকি আব্বাসীয় আমলে তারা কালামশাস্ত্র সহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের আরো যেসকল শাখায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন তাও এ যুগে পরিত্যক্ত প্রায় হয়ে পড়ে। এজন্য এযুগকে ‘জড়তা ও স্থবিরতার যুগ’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। আধুনিক যুগ তথা বিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ৭০০ বছর যাবৎ এ অবস্থাই অব্যাহতভাবে চলে আসছিল। অবশ্য এ অন্ধকার যুগেও সজীব ছিল হানাফী-শাফেঈ বিতর্ক। বিশেষতঃ ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর মাযহাব নিয়ে আলেমগণ বিতর্ক-বাহাছে লিপ্ত হ’তেন এবং এক মাযহাব আরেক মাযহাবের ত্রুটি-বিচ্যুতি অনুসন্ধান করে বই-পত্র রচনায় ব্যস্ত থাকতেন। ফলে চার মাযহাবের বিতর্ক এসময় অনেকটা দুই মাযহাবের বিতর্কে সীমিত হয়ে আসে। (হুজ্জাতুলাহিল বালিগাহ, ১/৪৪০ পৃঃ।) ওছমানীয় তুর্কী খেলাফতের শাসকগণ ছিলেন হানাফী মাযহাবপন্থী। এজন্য বিশেষতঃ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র হানাফী মাযহাবের একাধিপত্য সৃষ্টি হয়। যার প্রভাব অদ্যাবধি বিদ্যমান। জড়তাও স্থবিরতার এই যুগে তৎকালীন বিশ্বে প্রচলিত চারটি মাযহাব একমাত্র অনুসরণযোগ্য মাযহাব হিসাবে পরিগণিত হ’তে থাকে। এমনকি অনেক আলেম প্রচারণা চালাতে থাকেন যে, সকল মুসলমানের উপর চার মাযহাবের একটিকে অনুসরণ করা ফরয। অতঃপর মিসরের বাহরী মামলূক সুলতান রুকনুদ্দীন বায়বারাসের আমলে মিসরীয় রাজধানীতে সর্বপ্রথম চার মাযহাবের লোকদের জন্য পৃথক পৃথক কাযী নিয়োগ করা হয়। যা ৬৬৫ হিজরী থেকে ইসলাম জগতের সর্বত্র চালু হয়ে যায় এবং চার মাযহাব বহির্ভূত কোন উক্তি বা সিদ্ধান্ত কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হ’লেও তা অনুসরণ করা নিষিদ্ধ বলে গণ্য হয়।(আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৮৯।) বুরজী মামলূক সুলতান ফারজ বিন বারকুক-এর আমলে হিজরী ৮০১সনে মুক্বাল্লিদ আলেম ও জনগণকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে মুসলিম ঐক্যের প্রাণকেন্দ্র কা‘বাগৃহের চারপাশে চার মাযহাবের জন্য পৃথক পৃথক চার মুছাল্লা কায়েম করা হয়। আর এই প্রধানতম কারণে তাক্বলীদের কু-প্রভাবে মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি স্থায়ী রূপ ধারণ করে। (আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৮৯।) অবশেষে ১৩৪৩ হিজরীতে বর্তমান সঊদী শাসক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আব্দুল আযীয আলে সঊদ উক্ত চার মুছাল্লা উৎখাত করেন। ফলে মুসলমানগণ বর্তমানে একই ইবরাহীমী মুছল্লায় এক ইমামের পিছনে এক সাথে ছালাত আদায় করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। (আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৮৯।)
 
এ যুগে রচিত প্রসিদ্ধ ফিক্বহী ও ফৎওয়া গ্রন্থসমূহ :
এযুগের যে সকল মাযহাবী কিতাব প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল সেগুলির মধ্যে আলাউদ্দীন আল-হাছকাফী হানাফীর (১০৮৮ হিঃ) ‘আদ-দুররুল মুখতার’, আমীন ইবনু আবেদীনের (১২৫২হিঃ) লিখিত ‘রাদ্দুল মুহতার হাশিয়াতু ইবনে আবেদীন’, হাম্বলী মাযহাবের শারফুদ্দীন আবু নাজা (৯৬০ হিঃ)-এর ‘যাদুল মুসতাক্বনি’ ও মানছূর বিন ইউনুস আল-ভূতীর মুখতাছার, শাফেঈ মাযহাবের ‘মুখতাছার আবুশশুজা’, আশ-শারবীনীর ‘আল-ইকনা‘, আশ-শাবরাভীর মুখতাছার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ যুগে হাদীছের খেদমতে যেসকল ওলামায়ে কেরাম আত্মনিয়োগ করেন, তাঁদের মধ্যে ‘আল-মাতালিব আল-আলিয়াহ’ ও ‘বুলূগুল মারামে’র লেখক ইবনু হাজার আসক্বালানী (৮৫২ হিঃ), জাম‘উল জাওয়ামে‘, আল-জামে‘ আছ-ছাগীর ও যিয়াদাতুহু এর লেখক জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (৯১১ হিঃ) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। সাথে সাথে পূর্ববর্তী ফিক্বহ গ্রন্থসমূহের ছহীহ-যঈফ হাদীছ সমূহও যাচাই-বাছাই করেন কতিপয় মুহাদ্দিছ। যেমন জামালুদ্দীন আয-যায়লাঈ (৭৬২ হিঃ) হানাফী মাযহাবের ‘হিদায়াহ্’ গ্রন্থটির তাখরীজ করে রচনা করেন ‘নাছবুর রায়াহ’, ইবনু হাজার আসক্বালানী শাফেঈ মাযহাবের ‘শারহুল ওয়াজীয’ গ্রন্থের তাখরীজ করে রচনা করেন ‘তালখীছুল হাবীর’। (তারীখুল ফিক্বহিল ইসলামী, পৃঃ ১৪২; ড. ইউসুফ আল-কারযাভী, আল-ফৎওয়া বায়নাল ইনযিবাত্ব ওয়াত তাসাইয়ুব (কায়রো : দারুছ ছাহওয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৮৮ইং), ১৫ পৃঃ।) এই যুগেই ইমাম ইবনু তায়মিয়া (৭২৮ হিঃ)-এর ফৎওয়াসমূহ সর্বপ্রথম গ্রন্থাবদ্ধ করে ফৎওয়ার উপর একটি পূর্ণাঙ্গ সংকলন ৩৭ খন্ডে প্রকাশিত হয়, যা ‘মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়া’ নামে খ্যাত। এছাড়া ইমাম সুয়ূতীর কিতাবুল হাভী লিল ফৎওয়া, যাকারিয়া আনছারী আশ-শাফেঈর (৯২৬ হিঃ) ফৎওয়া সংকলন এবং ইবনু হাজার হায়ছামীর (৯৭৪ হিঃ) ফৎওয়া সংকলন এই সময়েই সংকলিত হয়। (তারীখুল ফিক্বহিল ইসলামী, ১৪২ পৃঃ।)
 
জড়তা ও স্থবিরতার যুগের দুর্ভাগ্যজনক ফলাফল :
মুসলিম সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক জড়তা ও স্থবিরতার এই যুগে ইসলামী শরী‘আত বিভিন্ন গোষ্ঠী ও দলের মাঝে ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে গিয়েছিল। রাসূল (ছাঃ) প্রচারিত যে ইসলাম স্বচ্ছতা ও সরলতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে মানবসমাজকে চিরমুক্তির পথ বাতলে দিয়েছিল, সে ইসলাম এ যুগে দলাদলির গ্যাড়াকলে আটকা পড়েছিল। মাযহাবী দলাদলির পরিণামে মুসলিম সমাজ শত শত বছর ধরে যেসকল কুপ্রভাব ও ফলাফল বয়ে বেড়াচ্ছিল তা ড. ওমর সোলায়মান আল-আশকার উল্লেখ করেছেন- (১) ইজতিহাদ পরিত্যাগ (২) যারা ইজতিহাদের প্রয়াস নিয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে মাযহাবী আলেমদের যুদ্ধ ঘোষণা (৩) তর্ক-বিতর্ক, বাহাছ-মুনাযারার বিস্তৃতি (৪) শত্রুতা, বিভক্তি ও পারস্পরিক ঘৃণার প্রসার (৫) জ্ঞানী ও মর্যাদাবান ব্যক্তিদের অবমর্যাদা (৬) তাক্বলীদ ও গোঁড়ামিজনিত কারণে সৃষ্ট ফিতনা-ফ্যাসাদের সর্বব্যাপকতা (৭) মাযহাবী সংকীর্ণতাবাদ ও আত্মকেন্দ্রিকতা এবং (৮) মূর্খতা বৃদ্ধি ও জ্ঞানের স্বল্পতা সৃষ্টি ইত্যাদি।
তিনি মুক্বাল্লিদদের দুরবস্থা বর্ণনা করে বলেন যে, মাসআলাগত মতবিরোধ যে ছাহাবায়ে কেরাম বা পরবর্তী ওলামায়ে কেরামের মধ্যে ছিল না তা নয়; তবে তাদের এই মতদ্বৈততা ছিল কেবল প্রাকৃতিক স্বভাবজাত বোধগম্যতার কম-বেশীর কারণে। সে বিরোধিতা কখনো স্বেচ্ছাকৃত হ’তনা। কিন্তু মুক্বাল্লিদদের অবস্থা ছিল ভিন্ন। তাদের সামনে যদি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দলীল পেশ করা হ’ত তবুও তারা স্বীয় মাযহাবের রায় যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখত। আল্লাহর কিতাবকে পশ্চাতে নিক্ষেপ করতে তাদের মোটেও বুক কাঁপত না। ছাহাবায়ে কেরাম ও আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের মাঝে যে মতবিরোধ ছিল তাতে পারস্পরিক ঘৃণা-বিদ্বেষের কোন ব্যাপার ছিল না। তারা একে অপরকে দাওয়াত করতেন, এক সাথেই ছালাত আদায় করতেন, একসাথেই উঠাবসা করতেন। কিন্তু মুক্বাল্লিদরা পরস্পরের প্রতি এতই ঘৃণা এবং বিদ্বেষ পোষণ করত যে, ভিন্ন মাযহাবের ইমামের পিছনে ছালাত আদায় করাকে পর্যন্ত তারা অপরাধ মনে করত। এমনকি ভিন্ন মাযহাবভুক্ত পরিবারে বিবাহ-শাদীকেও তারা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ফৎওয়া দিয়েছিল। (ড. ওমর সোলায়মান আল-আশকার, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭২।)
এযুগে কিছু বিখ্যাত যুগ সংস্কারক ওলামায়ে কেরামের জন্ম হয়, যাঁদের অমূল্য খেদমত ইসলামের ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। কোন মাযহাব বা মতবাদ নয়; বরং হক্ব সন্ধানই ছিল তাদের একমাত্র ব্রত। আর এজন্য তাদেরকে সমাজ কর্তৃক বহু নির্যাতনের শিকার হ’তে হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আল-ইয বিন আব্দুস সালাম (৬৬০ হিঃ), শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (৭২৮ হিঃ), ইবনুল ক্বাইয়িম (৭৫১ হিঃ), ইবনু কাছীর (৭৭৪ হিঃ), মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (১২০৬হিঃ), মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আছ- ছান‘আনী (১১৮২ হিঃ), আল্লামা শাওক্বানী (১২৫০ হিঃ) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
 
ভারতীয় উপমহাদেশে ফৎওয়ার উৎপত্তি :
ইসলামের কেন্দ্রভূমি মক্কা মুকার্‌রামাহ হতে সুদূর প্রান্তে অবস্থান করলেও মধ্যযুগ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশ ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পাদপীঠে পরিণত হয়। মুসলিম বিশ্বে দ্বীনী জ্ঞানর্চ্চার বিকাশে অত্র অঞ্চলের আলেমগণ যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তা অনস্বীকার্য। ৭১১ হিজরীতে তরুণ মুসলিম সেনাপতি মুহাম্মাদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে উপমহাদেশে মুসলমানদের রাজনৈতিক বিজয় সূচিত হয়। অতঃপর ১২০৬ সালে গযনীর সুলতান মুহাম্মাদ ঘোরীর উত্তর-পূর্ব ভারত বিজয় এবং দিল্লীতে রাজধানী স্থাপনের মাধ্যমে উপমহাদেশে মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে আরব ও মধ্য এশিয়া থেকে আগত মুবাল্লিগদের মাধ্যমে এ দেশে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বিকাশ হতে থাকে। ধীরে ধীরে ভারত উপমহাদেশের আনাচে কানাচে সর্বত্রই এই দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে যায়। একইভাবে দ্বীন শিক্ষাদানের জন্য সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে দারসগাহ ও খানকাহ স্থাপিত হতে লাগল। বিশেষত এ সময় দিল্লী, দেওবন্দ, করাচী ও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, সোনারগাঁ প্রভৃতি অঞ্চলের দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। এসকল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উপমহাদেশে ফিকহ ও ফৎওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা শুরু হয়। এক্ষণে আমরা উপমহাদেশের যেসকল ওলামায়েকেরাম ফিকহ ও ফৎওয়া চর্চায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন এবং তাদের ফৎওয়াসমূহ নিয়ে যেসকল সংকলনগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পেশ করব।
 
উপমহাদেশে ফৎওয়ার বিকাশ :
উপমহাদেশে ফিকহ ও ফৎওয়া চর্চার ইতিহাস পর্যালোচনায় যে বিষয়টি প্রথমেই জ্ঞাতব্য তা হল, মুহাম্মাদ ঘোরীর সামরিক বিজয়ের পর যে মুসলিম শাসকগণ ভারত শাসন করেছিলেন তারা ছিলেন নওমুসলিম তুর্কী এবং হানাফী মাযহাবভুক্ত। ফলে অত্র অঞ্চলের সুন্নী আলেমগণ ছিলেন মূলতঃ হানাফী। (যারা কেবল হানাফীই ছিলেন না, বরং তাদের ধর্মাচরণে তুর্কী, ইরানী, আফগান, মোগল এমনকি হিন্দুয়ানী বহু আক্বীদা-আমলের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। ফলে ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের আক্বীদা ও আমলের সাথে এতদঞ্চলের আলেম-ওলামা ও সাধারণ মানুষের আক্বীদা-আমলে বিস্তর পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়। দ্রঃ আহলেহাদীছ আন্দোলন, ২২৯-২৩০ পৃঃ।) এ কারণে উপমহাদেশে ফৎওয়ার চর্চা এবং উৎপত্তি ও বিকাশ বলা যায় একচেটিয়াভাবে হানাফী মাযহাবের উপরই ভিত্তিশীল ছিল। যদিও মুলতান, দিল্লী, বিহার, কাশ্মীর, বাংলাদেশের সোনারগাঁও প্রভৃতি অঞ্চলে হাদীছ ভিত্তিক ফিকহ ও ফৎওয়া চর্চার শক্তিশালী কেন্দ্র ছিল। কিন্তু শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় হানাফী মাযহাব ভিত্তিক ফৎওয়াই মানুষের মাঝে সার্বজনীন প্রাধান্য বিস্তার করে।
মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনে ফৎওয়ার চর্চা অনেক পূর্বেই শুরু হলেও লিখিত আকারে ফৎওয়া সংকলনের কাজ শুরু হয় অষ্টম হিজরী শতাব্দীতে। ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম যে ফৎওয়া সংকলনের সন্ধান পাওয়া যায় তার নাম ‘ফাতাওয়া তাতারখানিয়া’। উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ এই ফাতাওয়া গ্রন্থটি বাংলাদেশের সোনারগাঁওয়ের শাসক খান-ই-আযম বাহরাম খাঁ ওরফে তাতার খানের নির্দেশে ১৩৩১ খৃষ্টাব্দে (৭৭৭ হিঃ) খ্যাতনামা আলেম ইবনুল আলা আল-আন্দারিতী আল-হানাফী সংকলন করেন।
(৯৫৬ হিজরীতে এই গ্রন্থটি ১ খন্ডে সংক্ষেপণ করেন ইবরাহীম হালাবী। গ্রন্থটি ‘যাদুল মুসাফির’ নামেও পরিচিত। ) এরপর ‘ফাতাওয়া হাম্মাদিয়া’র মত কিছু ফৎওয়া সংকলন প্রকাশ পেলেও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ যে ফৎওয়া সংকলনটি প্রকাশিত হয় তার নাম ‘ফাতাওয়া আলমগীরী’, যা ‘ফাতাওয়া হিন্দিয়া’ নামেও খ্যাত। মোঘল সম্রাট শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র আওরঙ্গজেবের সুদীর্ঘ অর্ধশত বছরের (১৬৫৮-১৭০৭খৃঃ) শাসনামলে এটি রচিত হয়, যা এখনও পর্যন্ত উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ফৎওয়া সংকলন। ‘দরবেশ সম্রাট’ খ্যাত আওরঙ্গজেবের ঐকান্তিক আগ্রহের প্রেক্ষিতে এবং মোল্লা নিযামের সুযোগ্য তত্ত্বাবধানে ফৎওয়ার এই বৃহৎ অাঁকর গ্রন্থটি রচনা সম্ভব হয়েছিল। অদ্যাবধি উপমহাদেশসহ মধ্যপ্রাচ্যেও হানাফী আলেমদের নিকট এটি একটি বহুল সমাদৃত গ্রন্থ। নিম্নে এই সংকলনটি সহ উপমহাদেশের অপরাপর ফৎওয়া গ্রন্থগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি প্রদান করা হল।
 
ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী :
ফাতাওয়া আলমগীরী রচিত হয়েছিল হানাফী ফিকহের ভিত্তিতে। একে হানাফী মাযহাবের তৎকালীন সময় পর্যন্ত প্রকাশিত ও পরিচিত গ্রন্থসমূহের সারনির্যাসই বলা চলে। স্বয়ং সম্রাট আলমগীরের বিশেষ আগ্রহ ছিল যাতে সকল মুসলমান ঐ সমুদয় মাসআলার উপর আমল করতে পারে, যা হানাফী মাযহাবের আলেমগণ অবশ্য পালনীয় মনে করে থাকেন। কিন্তু সমস্যা ছিল যে, ওলামা ও ফুকাহাদের মতভেদ হানাফী মাযহাবের গ্রন্থসমূহে এমনভাবে মিশ্রিত হয়ে গিয়েছিল যে, একজন লোক যতক্ষণ পর্যন্ত ফিকহ শাস্ত্রে পরিপূর্ণ পারদর্শিতা লাভ করতে না পারে এবং অনেকগুলি সুর্ববৃহৎ গ্রন্থ সংগ্রহ করতে সমর্থ না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন মাসআলা সম্পর্কে পূর্ণ অবগতি লাভ করা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। সম্রাট আলমগীর তাঁর প্রবল আগ্রহের প্রেক্ষিতেই উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল হ’তে ফিকহ শাস্ত্রে পারদর্শী আলেমগণকে একত্র করলেন। তাঁর নির্দেশ মোতাবেক তাঁরা বিভিন্ন পুস্তকাদির সাহায্যে এমন একটি পূর্ণতর গ্রন্থ প্রণয়ন করেন যাতে বিস্তারিতভাবে সমস্ত মাসআলা সন্নিবেশিত হয়।
আওরঙ্গজেব গ্রন্থখানি প্রণয়ন করতে প্রায় ৫০০ ফকীহকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। যাদের মধ্যে ৩০০ জন উপমহাদেশের এবং ১০০ জন ইরাক ও ১০০ জন হেজায থেকে আগমন করেছিলেন। এটি প্রণয়নে মোট আট বছর সময় লেগেছিল এবং তৎকালীন সময়ে দুই লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল। শাহী গ্রন্থাগারের ১৩০-এর অধিক কিতাবাদি হ’তে সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছিল। ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী সংকলনের কাজ চার ভাগে বিভক্ত করে প্রসিদ্ধ ও যোগ্য চারজন আলিমের উপর অর্পণ করা হয়। যাদের একেকজনের সাহায্যের জন্য দশ দশজন আলিম নিযুক্ত করা হয়। অবশ্য সামগ্রিকভাবে পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল শায়খ নিযামুদ্দীন বুরহানপুরীর উপর।
আরবী ভাষায় লিখিত ৬খন্ডে সমাপ্ত এই ফৎওয়া গ্রন্থটির উর্দূ, ফার্সীসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তৎকালীন উপমহাদেশের সর্বত্রই বিচারালয় সমূহে এই গ্রন্থটি অনুসৃত হত।
(ইসলামী বিশ্বকোষ ১৪/৫৫৮-৫৬৪; লেখকমন্ডলী, ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৪), পৃঃ ৮১।)
 

Users who are viewing this thread

Back
Top