What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

ফৎওয়া : গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও বিকাশ (3 Viewers)

arn43

Co-Admin
Staff member
Co-Admin
Joined
Mar 2, 2018
Threads
1,620
Messages
122,486
Credits
312,732
DVD
Whiskey
SanDisk Sansa
SanDisk Sansa
Computer
Glasses sunglasses
ফৎওয়া : গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও বিকাশ

ভূমিকা :
আল্লাহ মানবজাতিকে কেবল তাঁরই ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন’ (যারিয়াত ৫৬)। মানব সৃষ্টির এই মৌলিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এবং মানবজাতির পার্থিব জীবন পরিচালনার জন্য আল্লাহ রাববুল আলামীন যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন, যাদের মাধ্যমে তিনি মানব সমাজের জন্য প্রেরণ করেছেন আসমানী কিতাব তথা স্বীয় বিধি-বিধান। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত দায়-দায়িত্ব পালন করতে হ’লে মানুষকে অবশ্যই এ সকল আসমানী নির্দেশ সম্পর্কে অবগত হ’তে হয়। নবী-রাসূলগণ তাঁদের জীবদ্দশায় নিজেরাই দ্বীনের খুঁটিনাটি সকল বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন এবং মানব সমাজে তা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাঁদের অবর্তমানে এ দায়িত্ব পালন করেন উম্মতের সেসকল বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ যারা দ্বীন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখেন। আলোচ্য প্রবন্ধে ফৎওয়ার গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা ও বিকাশ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে।
 
ফৎওয়ার শাব্দিক বিশ্লেষণ :
فَتوى ‘ফৎওয়া’ বাفُتوى ‘ফুৎওয়া’ আরবী শব্দ এবং এটি একবচন; বহুবচনেفَتَاوَى ‘ফাতাওয়া’ বাفَتَاوِى ‘ফাতাবী’, যার অর্থ ‘ফক্বীহ কর্তৃক অভিমত’। কোন কোন অভিধানবিদের মতে ইহা الفَةْوةশব্দ হ’তে গৃহীত হয়েছে, যার অর্থ করা হয় অনুগ্রহ, বদান্যতা, দানশীলতা, মনুষ্যত্ব ও শক্তি প্রদর্শন। (ইসলামী বিশ্বকোষ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯৩ ইং), পৃঃ ৫৩৪।) মূলতঃفَتْوىশব্দটিفَتْىমূল ধাতু থেকে নির্গত। একই মূলধাতু থেকে নির্গতفتوى (ফাৎওয়া)-কেفُتْيَا (ফুৎইয়া) অর্থাৎفاঅক্ষরকে পেশ দিয়ে পড়া যায়। আরবী ভাষায় ফৎওয়া শব্দটি ফুৎইয়া হিসাবেই বেশী ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইবনু মানযূর ‘লিসানুল আরব’ অভিধানে উল্লেখ করেছেন,الفَتْوىوالفُتْيَاإسمانيوضعانمنموضعالإفتاءإلاأنلفظةالفُتيَاأكثراستعمالاًفىكلامالعربمنلفظةالفتوى. ‘ফৎওয়া(فَتْوى)এবং ফুৎইয়া(فُتْيا)দু’টি বিশেষ্যকে ইফতা(إفتاء)শব্দের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। তবে আরবী ভাষায় ফৎওয়া(فَتْوى)শব্দের তুলনায় ফুৎইয়া(فُتْيا)শব্দটিই বেশী ব্যবহৃত হয়ে থাকে। (ইবন মানযূর, লিযানুল আরব, ৫ম খন্ড (বৈরুত : দারু এহইয়াইত তুরাছিল আরাবী), পৃঃ ২০।) আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া গ্রন্থে বলা হয়েছে, الفتوىإسممصدربمعنىالإفتاءويقال : أفتيتهفتوىوفتياإذاأجبتهعنمسألته،والفتياتبيينالمشكلمنالاحكام. ‘ইফতা অর্থে ফৎওয়া শব্দটি ক্রিয়ামূল। যেমন কারো কোন প্রশ্নের উত্তর দিলে বলা হয়, أفتيتهفتوىوفتيا ‘আমি তাকে ফৎওয়া প্রদান করেছি’। জটিল বিধি-বিধান বর্ণনা করাকে ফুৎয়া বলা হয়।
 
মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উছমানী বলেন, الفتوىوالفتياكلاهماإسمانيستعملانكأصلمصدرمنقولهم : أفتىيفتىإفتاء: معناهفىاللغة: الإجابةعنسؤالماكانمتعلقابالأحكامالشرعيةأوبغيرها، ‘ফৎওয়া ও ফুৎয়া শব্দ দু’টিই ক্রিয়ামূল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন বলা হয়, أفتىيفتىإفئاءএর শাব্দিক অর্থ হ’ল, শারঈ বিধি-বিধান বা অন্য বিষয়ে প্রশ্নের জবাব প্রদান করা’। (মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উছমানী, উছূলুল ইফতা (ঢাকা : মাকতাবাতু শায়খুল ইসলাম, ২০০৭), পৃঃ৯। ) প্রসিদ্ধ ৯টি হাদীছগ্রন্থে ফুৎইয়া(فُتْيا)শব্দটি মোটামুটি ৩০ বার উল্লেখিত হয়েছে। যেমন- ছহীহ মুসলিমে ৪ বার, মুসনাদে আহমাদে ১২ বার, সুনানু আবী দাঊদে ৩ বার, সুনানু নাসাঈতে ২ বার, সুনানু ইবনে মাজাহতে ২ বার ও সুনানুদ দারেমীতে ৭ বার এসেছে। উল্লেখিত গ্রন্থ সমূহেفَتْوى (ফৎওয়া) শব্দের উল্লেখ নেই। তবে অর্থ ও উদ্দেশ্যের দিক থেকেفَتْوى (ফৎওয়া) এবংفُتيا (ফুৎইয়া) শব্দ দু’টি এক ও অভিন্ন এবং উভয়ের ব্যবহার শুদ্ধ। (অধ্যাপক ড.মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ, ফাতওয়া : সংজ্ঞা, গুরুত্ব ও ফাতওয়া দানের যোগ্যতা (ঢাকা :বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ২০১০), পৃঃ ৬-৭।)
 
ফৎওয়ার পারিভাষিক অর্থ :
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে, ফৎওয়া বলতে বুঝায়, কারো জিজ্ঞাসার জবাবে দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে শরী‘আতের বিধান সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করা। (ফতওয়া :গুরুত্ব ও প্রয়োজন, সম্পাদনা, আব্দুল মান্নান তালিব, (ঢাকা :ইসলামিক ল রিসার্চ সেন্টার এন্ড লিগ্যাল এইড বাংলাদেশ, ২০০১), পৃঃ ৩৪।)
১. মুফতী তাকী ওছমানী ফৎওয়ার সংজ্ঞায় বলেন, ‘দ্বীন ইসলাম সম্পর্কিত কোন প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার উত্তর দেয়া’। (মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উছমানী, উছূলুল ইফতা, পৃঃ ৯। )
২. ড. আব্দুছ ছবুর মারযূক বলেন,هيبيانالحكمالشرعيفىمسألةمنالمسائل،مؤيَّداًبالدليلمنالقرآنالكريم،أوالسنةالنبوية،أوالاجتهاد. ‘কোন মাসআলায় শরী‘আতের হুকুম কি তা বর্ণনা করা, যা পবিত্র কুরআন, সুন্নাহ অথবা ইজতিহাদের আলোকে সমাধা করা হয়।
(রাশেদ আল-বিদাহ, আল ফাৎওয়া বি গায়রি ইলম (রিয়ায : ১৪২৮ হি, পৃ: ২৫)
৩. ইমাম রাগিব এর মতে ফৎওয়া হ’ল, والفُتْياوالفَتْوىالجوابعمايُشكِلُمنالأحكام،ويقال: استفتيتهفأفتانىبكذا. ‘জটিল বিষয়ের সুষ্ঠু সমাধান দেওয়ার নামই ফৎওয়া বা ফুৎয়া। যেমন- বলা হয় আমি তার কাছে ফৎওয়া জানতে চেয়েছি এবং তিনি আমাকে এরূপ ফৎওয়া দিয়েছেন’।
(রাগিব ইস্পাহানী, আল-মুফরাদাতু ফী গারীবিল কুরআন (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, ১৪২০ হিঃ/১৯৯৯খৃঃ), পৃঃ ৩৭৫।)
৪. মুফতী আমীমুল ইহসানবলেন, الفتوى : هوالحكمالشرعىيعنىماأفتىبهالعالموهىاسمماأفتىالعالمبهإذابيّنالحكم. ‘ফৎওয়া হচ্ছে শারঈ হুকুম, অর্থাৎ একজন আলিম যার দ্বারা জবাব দেন। কোন আলিম শরী‘আতের কোন হুকুম বর্ণনা করলে সে হুকুমকে ফৎওয়া বলাহয়। (মুফতী সাইয়েদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান, কাওয়ায়েদুল ফিক্বহ (দেওবন্দ : আশরাফিয়া বুক ডিপো, ১৯৯১), পৃ: ৪০৭।)
৫. আল-মাউসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া গ্রন্থে বলা হয়েছে, الفتوىفيالاصطلاح : تبيينالحكمالشرعيعندليللمنسألعنهوهذايشملالسؤالفيالوقائعوغيرها- ‘কোন ব্যক্তির জিজ্ঞাসার জবাবে দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে শরী‘আতের বিধান সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করাকে ফৎওয়া বলা হয়। সে প্রশ্ন সমসাময়িক সমস্যা বা অন্য যে কোন প্রসঙ্গে হতে পারে’। একজন মুফতী এবং একজন বিচারকের মধ্যে পার্থক্য হ’ল- মুফতী কেবল শরী‘আতের বিধান জানিয়ে দেন; তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব তার নয়, আর বিচারক ফৎওয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত হুকুমের প্রয়োগ সুনিশ্চিত করেন। আদালতের রায় হচ্ছে প্রয়োগযোগ্য ও বাধ্যতামূলক, অপরদিকে ফৎওয়া হচ্ছে উপদেশমূলক। বিচারক ও মুফতী উভয়ই শরী‘আতের ব্যাখ্যা প্রদান করেন, কিন্তু বিচারকের কাজের লক্ষ্য থাকে সাক্ষ্য-প্রমাণাদির পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে কি-না তা দেখা, আর মুফতীর লক্ষ্য থাকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর মূলসূত্র অনুসন্ধান করা। একজন মুজতাহিদের সাথে মুফতীর পার্থক্য হল- মুজতাহিদ গবেষণার মাধ্যমে শারঈ হুকুম সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেন এবং মুফতী প্রশ্নকারীর প্রশ্নের প্রেক্ষিতে জবাব জানিয়ে দেন।
(আল-ফাৎওয়া বি গায়রি ইলম, পৃঃ ২৫-২৬।)
 
ফৎওয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :
শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের যে বিধান নিয়ে আগমন করেছেন তা পূর্বের অন্যান্য সমস্ত নবী ও রাসূল অপেক্ষা তুলনাহীনভাবে সামগ্রিক ও সর্বব্যাপী। এর কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা যায় : (ক) নবী ও রাসূল হিসাবে তিনি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর আগমনের মাধ্যমেই অহী আগমনের ধারা পরিসমাপ্ত হয়েছে। (খ) পূর্বের সমস্ত নবী-রাসূলের উম্মতের চাইতে এককভাবে তাঁর উম্মতই অনেক বেশী সংখ্যক। (গ) শেষ নবী হিসাবে তাঁর বিধানই ক্বিয়ামত পর্যন্ত চূড়ান্ত। (ঘ) তাঁর আনীত বিধান দ্বারা পূর্বের সমস্ত বিধান রহিত ও বাতিল হয়ে গেছে। অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছই ক্বিয়ামতপর্যন্ত মানুষের জীবন পরিচালনার চূড়ান্ত সংবিধান। এখান থেকেই মানব জীবনে ফৎওয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। সাধারণভাবে ফৎওয়া বলতে বুঝায়- ‘আইন ও ধর্ম থেকে উদ্ভূত কোন বিষয়ের উপর উত্থাপিত প্রশ্নের স্বব্যাখ্যাত জবাব’। অর্থাৎ দ্বীন ইসলামের শারঈ বিষয়ে যেকোন প্রশ্নের দলীল ভিত্তিক জওয়াবই ফৎওয়া। একটু লক্ষ্য করলেই বুঝা যায় মানবজীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ফৎওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবে প্রযোজ্য। কেননা ফৎওয়ার বিষয়বস্ত্তই হ’ল-মানুষের প্রাত্যহিক দ্বীনী অনুশাসন, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও আইন-আদালতকে পরামর্শ প্রদান এবং ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা দান। তাই ফৎওয়া ছাড়া ইসলামী জীবনব্যবস্থা কল্পনাও করা যায় না। আধুনিক কালে সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলো ব্যাপকতা লাভের প্রেক্ষিতে বিষয়টি যে সমধিক গুরুত্ব নিয়ে বিকাশ লাভ করেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) মুফতীকে ‘আল্লাহর পক্ষে স্বাক্ষরকারী’ অভিহিত করে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন’-এর নামকরণ করেছেন। এই গ্রন্থের ভূমিকায় ফৎওয়ার গুরুত্ব বর্ণনায় তিনি উল্লেখ করেছেন-وإذاكانمنصبالتوقيععنالملوكبالمحلالذىلاينكرفضلهولايجهلقدرهوهومناعلىمراتبالسنياتفكيفبمنصبالتوقيععنربالأرضوالسماوات.সাধারণত: একজন রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে কৃত স্বাক্ষরকে অত্যন্ত গুরুত্ব ও মর্যাদা দেয়া হয়। সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে তাকে রাখা হয়। তাহলে আকাশ-যমীনের রাজাধিরাজের পক্ষ থেকে স্বাক্ষরের মর্যাদা কেমন হ’তে পারে!!’ (ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন (বৈরূত : দারুল জীল, ১৯৭৩ ইং), ১/১০ পৃঃ। )
 
ফৎওয়ার ঐতিহাসিক তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে লক্ষ্য করা যায় যে, ফৎওয়া প্রদান তথা দ্বীনের বিধান বর্ণনার কাজ প্রথমত: মহান আল্লাহই করেছেন। অতঃপর তাঁর প্রেরিত অহীকে মানব সমাজে ছড়িয়ে দিয়েছেন নবী-রাসূলগণ এবং সবশেষে আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ); যার মাধ্যমে পরিসমাপ্ত ও পূর্ণাঙ্গ হয়েছে অহী অবতরণের সুদীর্ঘ ধারা। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর তাঁর উম্মত তথা ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ), তাবেঈ ও তাবা তাবেঈগণ এ দায়িত্ব নিরবচ্ছিন্নভাবে পালন করেছেন। অতঃপর দ্বীনী বিষয়ে গবেষণাকারী মুজতাহিদগণের মাধ্যমে অদ্যাবধি এ সিলসিলা চালু রয়েছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত তা চালু থাকবে ইনশাআল্লাহ। ফৎওয়ার অসামান্য গুরুত্ব ও মর্যাদার সাথে সাথে ফৎওয়া প্রদানে ঝুঁকিও রয়েছে সীমাহীন। কেননা ফৎওয়া প্রদানকারী ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর পক্ষ হ’তে দ্বীন সংক্রান্ত বিষয়টি বর্ণনা করে থাকেন। হালাল-হারাম ব্যক্ত করে থাকেন। অসতর্কতাবশত যদি তার পক্ষ থেকে কোন ভুল সিদ্ধান্ত আসে তবে তাতে দ্বীনের বিধান ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়। সে কারণে ছাহাবায়ে কেরাম ও তৎপরবর্তী ইসলামী শরী‘আত বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ সহজে ফৎওয়া প্রদানের কাজে জড়িত হ’তে চাইতেন না। আবার ইলম গোপন করার আশংকা ও জবাবদিহিতার ভয়ে ফৎওয়া প্রদান হ’তে দূরেও থাকতে পারতেন না। (ইবনু সা‘দ, আত-ত্বাবাকাতুল কুবরা (বৈরূত : দারু ছাদের, ১ম প্রকাশ : ১৯৬৮ ইং), ৬/১১০ পৃঃ। ) সুতরাং ইলম ও যোগ্যতা ছাড়া ফৎওয়া প্রদান কোনক্রমেই বৈধ নয়। দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, আজ ইলমহীন অজ্ঞ-অযোগ্য ব্যক্তিদের ফৎওয়ার কারণেই দ্বীনের বিধানগত বিষয় নিয়ে মুসলিম সমাজে এত মতানৈক্য, দ্বন্দ্ব ও কলহ-বিবাদ। মাযহাব, তরীকা ও রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিভক্তির কারণে মুফতীদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর পক্ষে ফৎওয়া প্রদানও দ্বীনের মাঝে চরম বিভক্তি সৃষ্টিতে কম ভূমিকা রাখেনি। তাই অনিবার্য কারণেই একদল যোগ্যতাসম্পন্ন মুসলিমকে ইখলাছের সাথে এ কাজে নিয়োজিত থাকা আবশ্যক। নতুবা ইসলামী শরী‘আতের ভিত্তি শিথিল হয়ে পড়বে এবং সমাজে দ্বীনে ইসলামের বিশুদ্ধ রূপ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তৈরী হবে প্রতিবন্ধকতার পাহাড়। মোদ্দাকথা, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানাবিধ সমস্যা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে সমাধান করে ইসলামের অবিমিশ্র রূপ জনসম্মুখে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ফৎওয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
 
ফৎওয়ার মৌলিক উৎস :
প্রতিটি বিষয়েরই উৎপত্তিস্থল বা উৎস থাকে। ইসলামী শরী‘আতের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে ফৎওয়া বা জিজ্ঞাসার জওয়াব, যাকে অনুসরণ করে একজন মুসলিম তাঁর সার্বিক জীবন পরিচালনা করে থাকে। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এর উৎস অবশ্যই পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ বা হাদীছ; এতদ্ভিন্ন অন্য কিছুই নয়। (ফাতওয়া :সংজ্ঞা, গুরুত্ব, পৃঃ ১১। ) কেননা এ দু’টিই হ’ল অভ্রান্ত সত্যের উৎস আল্লাহ প্রদত্ত অহী, যার অনুসরণ করাকে আল্লাহ রাববুল আলামীন অপরিহার্য করেছেন। এ দু’টি উৎসের ভিত্তিতে জীবন সমস্যার সমাধান করার জন্যই ফৎওয়ার উৎপত্তি। অবশ্য রায়পন্থী ওলামাগণ ফৎওয়ার উৎস হিসাবে পবিত্র কুরআন ও হাদীছের সাথে ‘ইজমা’ ও ‘ক্বিয়াস’ নামক দু’টি নীতিও যুক্ত করেছেন। তবে ইসলামের মূল দুই উৎসের সাথে একই কাতারে ইজমা ও ক্বিয়াসকে নিয়ে আসা কখনই সমীচীন নয়। আর পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে কোন বিধান সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ না পাওয়া গেলে সে ব্যাপারে কুরআন, সুন্নাহর সাদৃশ্যপূর্ণ বিষয়গুলোর আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়, তাকে বলা হয় ইজতিহাদ। অর্থাৎ যুগ-জিজ্ঞাসার জওয়াব খুঁজে বের করার জন্য (যা সরাসরি কুরআন ও হাদীছে সরাসরি পাওয়া যায় না) পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে সামনে রেখে গবেষণার মাধ্যমে সঠিক জওয়াব খুঁজে বের করাকেই ইজতিহাদ বলা হয়। যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত সকল যোগ্য ও অভিজ্ঞ আলেমগণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। (মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলে হাদীছ আন্দোলন কি ও কেন? (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯৬), পৃঃ ২০। )
 
ফৎওয়ার উৎপত্তি ও বিকাশ :
মানব জীবন সমস্যার সমাধানে পবিত্র কুরআনেই সর্বপ্রথম দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। কুরআনের বিভিন্ন সূরা ও আয়াতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ফৎওয়া প্রদানের দৃষ্টান্ত রয়েছে অনেক। পবিত্র কুরআনে সরাসরি ফৎওয়া শব্দটি ৯টি আয়াতে মোট ১১ বার এসেছে। (মুহাম্মাদ ফুওয়াদ আব্দুল বাকী, আল-মু‘জামুল মুফাহরাস লি-আলফাযিল কুরআনিল কারীম (কায়রো : দারুল হাদীছ, ১৪১৭/১৯৯৬), পৃঃ ৬২৩। )এভাবে পবিত্র কুরআনের মাধ্যমেই ফৎওয়ার উৎপত্তি সূচিত হয়েছে। অতঃপর ফৎওয়ার বিকাশ সাধন হ’তে থাকে দ্বীন ইসলামের প্রচার-প্রসার ও পরিব্যাপ্তি লাভের সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে। এক্ষণে ফৎওয়ার উৎপত্তি ও বিকাশধারাকে স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে মোটামুটি পাঁচটি যুগে ভাগ করা যায়। যথা :
(ক) রাসূল (ছাঃ)-এর যুগ
(খ) ছাহাবায়ে কেরামের যুগ
(গ) তাবেঈ ও তাবা-তাবেঈদের যুগ
(ঘ) আববাসীয় যুগ (ইমামগণের যুগ)
(ঙ) আধুনিক যুগ।
নিম্নে প্রতিটি যুগ সংক্ষেপে আলোচিত হ’ল।
রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে ফৎওয়া :
ইতিমধ্যেই আলোচিত হয়েছে যে, আল্লাহ রাববুল আলামীন সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে ফৎওয়া প্রদান করেছেন।
(মুহাম্মাদ আলী আস-সাইস, তারীখুল ফিক্বহ আল-ইসলামী (বৈরূত : দারুল ফিকর, প্রথম প্রকাশ, ১৯৯৯), পৃঃ ৩৩-৩৪; আবু ছাইদ মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ, ফিকহ শাস্ত্রের ক্রমবিকাশ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯৭), পৃঃ২৪। ) আর রাসূল (ছাঃ) তা প্রচার করেছেন। যেমন ফৎওয়া প্রসঙ্গে আল্লাহর নিজস্ব ভাষা হ’ল-يَسْتَفْتُوْنَكَقُلِاللهُيُفْتِيْكُمْفِيالْكَلاَلَةِ. ‘তারা আপনার কাছে ফৎওয়া জানতে চায়, অতএব আপনি বলে দিন, আল্লাহ তোমাদেরকে ‘কালালাহ’ (পিতৃহীন ও নিঃসন্তান)-এর মীরাছ সংক্রান্ত ফৎওয়া দিচ্ছেন’ (নিসা ১৭৬)। তিনি আরো বলেন, يَسْتَفْتُوْنَكَفِيالنِّسَاءِقُلِاللهُيُفْتِيْكُمْفِيْهِنَّ ‘তারা আপনার কাছে নারীদের (বিবাহ) সম্পর্কে জানতে চায়। আপনি বলে দিন, আল্লাহ তোমাদেরকে তাদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট বলে দিচ্ছেন’ (নিসা ১২৭)
 
পবিত্র কুরআনের সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ ভাষাতেও ফৎওয়া প্রদান করেছেন, যাকে আমরা হাদীছ বলে থাকি। রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী তথা হাদীছ মূলত: অহী। যার অর্থ ও ভাব আল্লাহর; কেবল ভাষা রাসূল (ছাঃ)-এর। ইসলামী বিধি-বিধানের কোন একটি কথাও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের পক্ষ থেকে বলেননি, যা কিছু বলেছেন তার সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে অহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়েই বলেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَايَنْطِقُعَنِالْهَوَى،ِإنْهُوَإِلَّاوَحْيٌيُّوحَى. ‘তিনি মনগড়া কথা বলেন না। যা বলেন, তা তাঁর কাছে অবতীর্ণ (অহী) প্রত্যাদেশ ছাড়া আর কিছুই নয়’ (নাজম ৩-৪)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কুরআনের কোন আয়াতের ফৎওয়া সুস্পষ্ট না হয়ে থাকলে তার ব্যাখ্যা নিজেই করেছেন এবং পবিত্র কুরআনে উল্লেখ নেই এমন বিষয়েও তিনি ফৎওয়া দিয়েছেন এবং ছাহাবায়ে কেরাম তা সংরক্ষণ করেছেন। যা পরবর্তীতে হাদীছ হিসাবে সংরক্ষিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় তৎকালীন ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রস্থলে তিনি ব্যতীত আর অন্য কেউ ফৎওয়ার কাজে লিপ্ত ছিলেন না।
(ইবনুল কাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ইন, ১ম খন্ড, পৃঃ ৭ ও ৮। ) তবে তিনি কিছু সংখ্যক যোগ্য, অভিজ্ঞ ও দূরদর্শী ছাহাবীকে ফৎওয়া প্রদান ও বিচারকার্য পরিচালনা করার অনুমতি দিয়ে দূরবর্তী বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেন। যেমন১০ম হিজরীতে মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ)-কে বিচারক হিসাবে ইয়ামানে প্রেরণ করেন। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ; মিশকাত হা/১৭৭২। )
 
ছাহাবায়ে কিরামের যুগে ফৎওয়া :
রাসূল (ছাঃ)-এর অবর্তমানে তাঁরই একনিষ্ঠ ছাহাবীগণ ইসলামী শরী‘আতের ধারক-বাহক, সংরক্ষক ও প্রচারক হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যার জন্য রাসূল (ছাঃ) তাঁদেরকে বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করে তোলেন। খোলাফায়ে রাশিদুনও এভাবে প্রশিক্ষণ দিতেন। যেমন ওমর (রাঃ)-এর খেলাফত কালে একদা তিনি শুরাইহ (রাঃ)-কে বললেন,اقض بما في كتاب الله، فإن لم يكن في كتاب الله فبسنة رسول اللهصلى اللهعليه وسلم، فإن لم يكن في سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم فاقضبما قضى به الصالحون-
‘যা আছে আল্লাহর কিতাবে তা দিয়ে মীমাংসা করবে। আর যদি আল্লাহর কিতাবে সে বিষয়টি না থাকে, তাহ’লে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত দ্বারা মীমাংসা করবে। আর যদি সে বিষয়টি রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতেও না পাও তাহ’লে তোমার পূর্বসূরী সৎকর্মশীল মুহাক্কিক্ব আলেমদের মতামত অনুযায়ী মীমাংসা করবে’। (ইবনুল কাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন আন রাবিবল আলামীন, ১ম খন্ড, (বৈরুত :দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ২য় সংস্করণ, ১৯৯৩ র্খঃ/১৪১৪হিঃ), পৃঃ ১০। ) রাসূল (ছাঃ)-এর পর ফৎওয়া প্রদানের দায়িত্বভার তাঁরই ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞও যোগ্য ছাহাবীদের উপর অর্পিত হয়। আছহাবে কিরামের মধ্যে যাঁরা ফৎওয়া প্রদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁদের সংখ্যা নারী-পুরুষ মিলে ১৩০ জনের কিছু বেশী ছিল। তাঁদের মধ্যে আবার কয়েকটি স্তর রয়েছে। সবচেয়ে বেশী ফৎওয়া প্রদানকারী ছাহাবার সংখ্যা সাত জন। তাঁরা হ’লেন- ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ), আলী ইবনু আবী ত্বালিব (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ), উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ), যায়েদ বিন ছাবেত (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) ও আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ)। তাঁদের সকলেই এত বেশী ফৎওয়া প্রদান করেছেন যে, তা একত্রিত করলে বিরাট বিরাট পান্ডুলিপি হয়ে যাবে। (মুফতী তাকী ওছমানী, উছূলুল ইফতা, পৃঃ ২৪। ) আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ)-এর ফৎওয়া পরবর্তীতে (আববাসীয় যুগে) একত্রিত করলে তা বিশটি গ্রন্থে পরিণত হয়। (মুফতী তাকী ওছমানী, উছূলুল ইফতা, পৃঃ ২৫। )
 

Users who are viewing this thread

Back
Top